বেডরুম

   হাটতে যাই প্রতিদিন। কাছেই একটা মল আছে, সেখানে। যারা হাটতে আসে তাদের জন্য দরজা খোলে একঘণ্টা আগে। অনেকদিন ধরে হাঁটছি। তাই সবার মুখই আমার চেনা। এমন কি যে মেয়েটা পরিষ্কার করে মেঝে, মোছে ডাস্টবিন, সে কয়টায়ে আসে জানিনা তবে ঠিক কয়টায় ফিরে যায় তা আমার নখও দর্পণে। এমন কি কবে তার ছুটি সেটাও আমি বুঝে নিয়েছি। রোববারে তার সাথে দেখি সুদর্শন চেহারার একটা ছেলে। পাশে পাশে হাটে। মেয়েটার পরিষ্কার করার গাড়ী টা ছেলে টা ঠেলে নিয়ে যায়।  দুজনে কথা বলে। মাঝে মধ্যে একে অপরের হাত ধরে। স্বামী বলে মনে হয় না। স্বামী হলে কাজের সময় হাত ধরতও না। আমি পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে চলে যাই। ওদের কথা বুঝতে পারিনা। ওরা কথা বলে ইসপেনিসয়ে।

আর ঐ যে চারজন ভারতীয় মহিলা, দক্ষিণ ভারতীয় হবে, তারা আসে দশটার দিকে। তাদের মধ্যে চিকন যে মহিলা টি সে আসে প্রথমে। আস্তে আস্তে অন্যরা এসে যোগ দেয়। ওরা দ্রুত হাটতে পারে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়। আমি চোখ নামিয়ে পানির বতলে মুখ দেই। বেশ কিছুদিন হোল ওদের সবাই কে এক সাথে দেখিনা। শুধু আসে চিকন মেয়ে টা। ফোনে কথা বলে। মাঝে মধ্যে ভাবি জিজ্ঞাসা করবো নাকি, তোমার বান্ধবীরা কোথায়? হয়তো গিয়েছে ছুটিতে, অথবা চলে গেছে এই এলাকা ছেড়ে।

আর ঐ যে ছেলে টা, মাথা ভরা টাঁক, ঢেকে রেখেছে বেজবল ক্যাপ দিয়ে। তার হাতে থাকে ডানকিনের কফি। ছেলে টা কেনও জানি ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। তাকে আমি যখন প্রথম দেখে ছিলাম সে অনেক দ্রুত হাটতে পাড়ত। আজ আর দ্রুত হাটে না সে। পুরো হাটা পথ শেষ করে না। মাঝ পথ থেকে ফিরে আসে। মাঝে মধ্যে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি ওর –। না ওই চিন্তা মাথা থেকে দুর করে দেওয়ার চেষ্টা করি।

প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য আমি বাহিরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে আমি আর তাকে দেখি না। একদিন দুইদিন গেলো সে এলো না। ভাবলাম আমার মতো সেও হয়তো বাহিরে গেছে। না, একমাস হয়ে গেলো তাকে আর দেখিনা। আমার চোখের সামনে ভাসে তার ক্যাপ টা। ভাসে তার চেহারা টা।

নতুন নতুন অনেকে এসে যোগ দিয়েছে। পুরনো দের মধ্যে একটা জোড়া, মাঝ বয়সী। ভদ্রলোক লম্বায় প্রায় ছয় ফুট হবে, মহিলাটা ওর মাজা সমান। হাটার গতি মেয়েটার বেশি। প্রায় ভদ্রলোক পিছিয়ে পরে। মেয়েটা থামে ওকে সংগে নেয়।

একদিন হাটতে যেয়ে দেখা আমার পরিচিত এক মহিলার সাথে।

-আপনি? প্রায় আসেন বুঝি?

আমি বললাম, তা প্রায় প্রতিদিনই আসার চেষ্টা করি। বাসা থাকে তো বেশি দুরে নয়। তাছাড়া সময়টা ও কেটে যায়।

মহিলার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল বাংলাদেশ নাইটে। বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় উনি পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। তন্নী ডাক দিলো। এক গাল হেসে এসে বসলেন আমাদের আড্ডার মাঝে। সবাইকেই চেনে মনে হোল শুধু আমাকে ছাড়া। তন্নী পরিচয় করিয়ে দিলো।

-মনটু ভাই, আমাদের ভাবী তনুকা।

 বলে আমার নামটা ও তনুকাকে বলল। আমি সালাম দিলাম। তনুকাও সালাম দিয়ে পাশে বসলো। ঝাল মুড়ি,পিঁয়াজু আরও কি কি যেন নিয়ে এসেছিল তন্নী আর ওর বান্ধবী রা। মাঝে মধ্যে আমরা দুজন কথা আদান প্রদান করছিলাম। উনার কথার মধ্যে যশোর দিককার কথার টান আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার জন্মস্থান কি যশোরে?

-কি ভাবে বুঝলেন?

-কথার টানে। আমিও ওই দিককার কিনা?

তন্নী বাঁধা দিয়ে বলল, নাও এবার তোমরা ছোট বেলার কথা বলতে থাকো। তবে একটু আস্তে। আমরা গান শুনতে এসেছি। তনুকা ভাবী, তুমি আমার এই ভাইটা কে বাসায় দাওয়াত দেও সেখানে তোমরা অনেক আলোচনা করতে পারবে ছোটবেলার।

-ঠিক আছে বলে আমি সেদিন চুপ করে গিয়েছিলাম।  

উনার সাথে আর আমার দেখা হয়নি। তন্নী বলেছিল, উনার স্বামী মারা গিয়েছিলেন হার্ট অ্যাটাকে।

বেশ কয়েক মাস পরে আবার দেখা। সনু নীগামের কনসার্ট দেখতে এসেছি। দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাজপোড়া খাচ্ছিলাম বন্ধুদের সাথে। পিঠে হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখি তনুকা।

কোন ভূমিকা না করেই বলল, আপনাকে আমি মলে আর দেখিনা। ওদিকে আর যান না বুঝি?

-যাই, তবে সময়ের কোন ঠিক নেই। আপনি ঠিক কয়টায় আসেন?

-ঠিক দশটায়। এলে দেখা হবে।

আমার বন্ধুরা আমার পাশ থেকে একটু দুরে সরে গেছে। কি নিয়ে যেন হাসা হাসি করছে।

-অবশ্যই।

তনুকা চলে গেলো। আমিও ফিরে এলাম আমার বন্ধুদের কাছে।

এরপর দেখা হয়েছে মলে। আমরা দুজনে হাটি। প্রায় প্রতিদিনই। একদিন হাটা শেষে বলল, চলুন আজ আমার বাসায়। যদি আপনার কোন অসুবিধা না থাকে।

অসুবিধা যেটুকু ছিল তা তুচ্ছ মনে হোল।

লেভীটটাউনে একটা এপার্টমেন্ট থাকে। পরিপাটি করে সাজানো।

দেয়ালে এক ভদ্রলোকের ছবি। একটাই ছবি লিভিং রুমে। মনে হোল বাচ্চা কাচ্চা নেই। থাকলে ছবি থাকতো।

তনুকা চলে গেলো বেডরুমে। কিছুক্ষণ পরে পোশাক পালটিয়ে, হাতমুখ ধুয়ে এসে বসলো সোফার উপর। ওর পোশাক টা আমাকে একটু অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যে ফেললো।

  আমি বসেছিলাম ঠিক ওর সামনে। ও মাঝে মাঝে চারিদিকে কি যেন দেখছিল।

 মনে মনে ভাবছিলাম, কেনও এলাম, এমন কোন সম্পর্ক তো ওর সাথে আমার নেই যে এক কথায় ওর বাসাতে চলে আসবো। অনেক অজুহাত দিতে পারতাম। কিন্তু কেন দেইনি? এমনই হয়তো হয়, যখন ঠিকমত মাথা কাজ করে না।

বুঝলাম দেরী হয়ে গেছে। ও উঠে যেয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে এলো। সাথে গুর দিয়ে বানানো বিস্কুট। আমাকে সে জিজ্ঞাসাও করে নি আমি আমার কফিতে চিনি বা দুধ খাই কিনা। 

সে নিজেই বলল, চিনি এবং দুধ ঠিক মত হয়েছে তো?

আমি বললাম, পারফেক্ট। ঠিক যে পারফেক্ট হয়েছিল তা নয়। কিন্তু বলতে পারলাম না।

ঐযে বলেছিলাম না, মাথা টা ঠিক কাজ করছে না।

আমরা আমাদের পারিবারিক কোন কথায় গেলাম না। সেও কিছু বলল না, আমিও তাগীদা অনুভব করলাম না।

সে বলল, খেলাধুলা গান বাজনা আমার খুব প্রিয়। T20 খেলা দেখতে গিয়েছিলেন?

বললাম, হ্যাঁ, ইস্টার্ন সাইডে ছিলাম।

আমিও তো ইস্টার্ন সাইডে ছিলাম। আপনার টিকেট নাম্বার কত ছিল।

বললাম।

কি বলেন আমি তো দুই রো পিছনেই ছিলাম।  আপনি দেখেন নি? খুব উত্তেজিত হয়ে  সে জিজ্ঞাসা করলো।

-না, আমার দৃষ্টি ছিল সামনের দিকে। পিছনে তাকানোর দরকার পড়েনি।

-আপনি তো খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। বলে হাসল তনুকা।

আমি খুব গর্ব অনুভব করলাম।

ঘণ্টা খানেকের উপর হয়ে গিয়েছিল আমরা কথা বলছি। এবার উঠবো।

তনুকা বলল, আপনাকে আমার অন্য রুম গুলো দেখানো হয়নি।

বললাম আর একদিন দেখবো।  বিদায় নিয়ে এক পা সিঁড়িতে রাখতেই সে বলল, যাবেন নাকি শ্রেয়া ঘোষালের কনসার্ট দেখতে।

দাড়িয়ে পড়লাম সিঁড়িতে।

-কবে, কোথায়।

-আগামী মাসে, নিউজার্সি তে।

-না, ওর কনসার্ট আমি আগে দেখেছি। একটু কঠোর হওয়ার চেষ্টা করলাম।

-আমি আপনাকে ওর লিংক টা পাঠিয়ে দেবো। এখনও তো সময় আছে। মত পাল্টাতে তো পারে, আমার দুই একটা বন্ধুও যাবে।

গান শুনতে গিয়েছিলাম। মাঝে মধ্যে ও আমার হাতটা চেপে ধরে বলছিল, জানেন এই গান টা  আমার খুব প্রিয়। আমি হাত টা ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। ওর ভেজা ভেজা হাত টা আমার কাঁপা কাঁপা হাতে আটকে গেছে। আমরা কিন্তু এখনো আপনি থেকে তুমিতে আসিনি।

আর তাছাড়া আমার মনের মধ্যেও এমন কিছু ঘটছেনা যাতে করে সম্পর্ক টা তুমিতে আনতে পারি। ওর সান্নিধ্য আমার ভালো লাগছে। এই পর্যন্তই, এর বাহিরে কিছু নয়।

বলতে ভুলে গেছি এর মধ্যে আমাদের মাঝে ফোন নাম্বার আদান প্রদান হয়ে গেছে। প্রায় ফোনে কথা হয়। ফোন টা বেশির ভাগ সময় ওর দিক থেকেই আসে। মাঝে মধ্যে ভাবি ধরবনা কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।

একদিন রাত নয়টায় তন্নীর ফোন এলো।

হ্যালো, বলতেই বলল, কারো সাথে ফোনে ছিলেন বুঝি।

-বাহ বাহ বা, তুমি জ্যোতিষী হলে কবে থেকে।

-না থাকতেও পারেন। বলে হাসল, তবে হাসি টার মাঝে একটু প্রশ্ন বোধক চিহ্ন।

-সময় ব্যায় না করে বলে ফেলো এত রাতে কি মনে করে।

-আগামী শনিবার আমার বাসায় পার্টি, আপনি আমন্ত্রিত।

অনেকে এসেছে, সেই সাথে তনুকাও।

আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। অনেক কাছে আসে বলল, এসেই আপনার খোঁজ করছিলাম। তন্নী কে জিজ্ঞাসা করতেই ও বলল, আসবেন, তবে দেরী হতে পারে।

কয়েক জোড়া চোখ যে আমাদের উপর দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে তা বুঝতে পারলাম। আমারও একটু

অস্বস্তি লাগছিল। সেই মুহূর্তে ওর ডাক পড়লো গান গাওয়ার জন্য।

ওর যে এই গুনটা আছে জানা ছিলনা।

আমি পিছনের সারিতে দাড়িয়ে ছিলাম। তন্নী এসে দাঁড়ালো আমার পাশে।

-কেমন গাইছে?

-ভালো।

-শুধু ভালো।

-কেনও ওর সাথে আর কোন শব্দ জোড়া লাগানোর দরকার আছে কি? আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম।

-সাবধান!

-মানে?

ও কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেলো অন্যদের সাথে কথা বলতে। হাজার হলেও ওর বাসায় পার্টি। ওকে তো সব দিকেই দেখতে হবে।

সেই রাতে আমার ঘুমের বিঘ্ন ঘটে ছিল।

একদিন সকালে হাটতে হাটতে তনুকা বলল, আপনার কাছে ২০০ ডলার হবে। জরুরি দরকার। আমার একাউন্টে একটু অসুবিধা হচ্ছে।

বললাম, কাছে তো নেই, ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দিতে পারব।

দিয়েছিলাম, সেও আমাকে দুদিন পরে ফেরত দিয়েছিল।

এরপর একদিন চেয়ে বসলো সাত হাজার ডলার। বলল, আমার লজ্জা করছে টাকা টা চাইতে। কিন্তু না হলেই নয়। যদি পারেন দিতে আমার খুব উপকার হয়।

একটু খটকা লাগলো, বললাম এই মুহূর্তে তো পারবো না, তবে দুই চার দিন পরে দিতে পারবো।

ও কোন কথা বললও না।

আমরা হাঁটছিলাম, হাটা থামিয়ে বলল, আসি। এই বলে হনহন করে চলে গেলো মল থেকে বের হবার দরজার দিকে।

আমি কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম ওর পথের দিকে। একটু আশ্চর্য হলাম ওর ব্যাবহারে।

বাসায় ফিরে এসে কল দিলাম। ভয়েস মেলে চলে গেলো।

আর দেখা পাইনি তনুকার। ওর বাসায় গিয়েছিলেম, কেউ দরজা খোলেনি।

তন্নী কে কল দিয়ে জানতে চাইলাম তনুকার কথা।

বলল, সে জানে না, শুধু জানতে চাইলো আমি ওর বেডরুমে গেছি কিনা।

অবাক হয়ে বললাম, না যাইনি। কেন? ওকথা কেনও?

-বেডরুমে ক্যামেরা আছে শুনেছি। বেচে গেছেন।

আমি আবারও ফিরে এসেছি আমার হাটার সঙ্গীদের কাছে।  মাঝের কয়টা মাস ছিল আনন্দময়।

শুরুটা ছিল সুন্দর, শেষটাও হতে পাড়তও কিন্তু হোল না।

শুধু মনে পরে তন্নীর কথা, বেচে গেছেন।

Continue Reading

মা

   পলাশের গাড়ী টা সোজা কবরস্থানের গেট পেড়িয়ে  মায়ের কবরের কাছে এসে দাঁড়ালো।  বিশাল মাঠের মাঝে ও একা। আজ কেউ বুঝি আসেনি তাদের প্রিয়জনের কবরের পাশে কিছুক্ষণের জন্য দাড়িয়ে থাকতে। কলেমা পড়তে। হয়তো এসেছিল। চলে গেছে। এই মুহূর্তে সে একা।

 সন্ধ্যা হতে অনেক দেরী। আকাশ টা কালো মেঘে ছেয়ে আছে। অনেক গাংচিল বসে আছে মাঠের মাঝে। মাঠ টা সাদা হয়ে গেছে ওদের গায়ের সাদা রঙে। পলাশ এত গাংচিল একসাথে কখন দেখেনি। হঠাৎ একদল উড়ে গেলো আকাশে। পলাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। মনে মনে ভাবছিল এরাই কি পাহারা দেয় যারা এখানে শুয়ে আছে তাদের কে? এই দৃশ্য তো দেখেনি আগে।

অসংখ্য গাংচিল কোথা  থেকে এলো। পলাশ উড়িয়ে দিতে চাইলো ওদের কে। ওরা উড়ল না। পলাশ যত ওদের কাছে গেলো ওরা আস্তে আস্তে সড়ে গেলো। কেউ কেউ ওর পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু উড়ল না। ওরা উড়ে যখন ওদের মন চায়। পলাশ একটাকে ধরতে চাইল।

চিঁ চিঁ শব্দ করে সে একপাশে সড়ে গেলো।

পলাশ এসে দাঁড়ালো ওর মায়ের কবরের পাশে। গাংচিল গুলো একটু নোংরা করে দিয়েছে কবরের উপর বাঁধানো ফলক টাকে। ও রাগ করলনা। রাতে তো সে এসে পাহারা দেয় না ওর মা কে। পাহারা দেয় ওরা। ওরাই তো পাহারাদার।

ফলক টার উপর লেখা আছে মার জন্ম,মৃত্যু তারিখ। মাত্র একষট্টি বছর বয়সে মা চলে গিয়েছিল। বাবা চলে গিয়েছিল আরও আগে। তার কবর এখানে নয়।

মা পলাশ কে ডাকতো পলু বলে। কেন যে ওর কোন ভাই বোন এলো না সে কথা কোনদিন জিজ্ঞাসা করেনি। বরং মনে হয়েছে, যাক ভালোই হয়েছে কাউকে কোন কিছুর ভাগ দিতে হবে না। আজ সে কথা মনে হয় না। বড় মিস করে ওর বোন ভাই নাই বলে।

পায়ে সুড়সুড়ি লাগতেই তাকিয়ে দেখে একটা গাংচিল ওর পায়ে মুখ গসছে। ধরতে যেতেই দুরে সরে যেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। সে আগন্তুক। ওরা ওকে চিনতে পারছে না, তাই কাছে এসেও দুরে চলে যাচ্ছে। পলাশ ফিরে তাকালও ফলকের দিকে।

মার মুখ টা ভেসে উঠলো। কি কষ্ট করেই না মা ওকে মানুষ করেছিল। বাবা চলে গিয়েছিল ওর বয়স যখন আট।

এই দেশে এসেছিল অনেক আগে। বাবা ছিল প্রকৌশলী। এই দেশে এসে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নেওয়া হয়নি। তবে বড় একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিল। নিজের যোগ্যতায় ধীরে ধীরে উপরে স্থান করে নিয়েছিল।

বাবার কথা কিছু কিছু মনে পরে পলাশের। কাজ থেকে এসে ওকে নিয়ে বাহিরে হাটতে যেতো। হাত ধরে কি যত্নেই না রাস্তা টা পাড় করতো।

মা করতো বাসার কাজ। বাবা ফিরে এলে মা চা বানিয়ে সাথে বিস্কুট নিয়ে পাশে এসে বসতো। কত কথাই না বলতো ওরা। পলাশ কিছুই বুঝত না।

তারপর হঠাৎ কি হয়েছিল পলাশ জানে না। শুধু মনে পরে এ্যাম্বুলেন্স এসে বাবা কে নিয়ে গেলো।

সেই শেষ যাওয়া।

মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। ওর সামনে কোনদিন চোখের জল ফেলেনি। বুঝতে দেয়নি বাবা চলে গেছে। শক্ত হাতে হাল ধরে ছিল। ঐ কোম্পানিতেই বাবার খ্যাতির জন্য মা কে ওরা নিয়েছিল ছোট্ট একটা পদে। বেতন কতই  বা হবে, খুব যে বেশি তা নয়। অথচ সেই অল্প মাইনে দিয়েই মা কি সুন্দর ভাবে সংসার টা চালাত।

কোনদিনই পলাশ কে বুঝতে দেয়নি কোন অভাব এই সংসারে আছে। শুধু বলতো বাবা পড়াশুনাটা ঠিক মতো করিস, তোকে আমি যেন মানুষের মত মানুষ করে দিয়ে যেতে পারি।

হ্যাঁ, মা তাকে তাই করে দিয়ে গেছে। আজ সে অনেকের মাঝে একজন।

মা বলেছিল ডাক্তারি পড়বি? পলাশ বলেছিল, মা, ডাক্তারি পড়া আমার দাড়া হবেনা। আমি বিজনেস নিয়ে পড়তে চাই। মা, না করেনি। ভালো একটা  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়ে চাকরি নিয়েছিল বড় একটা ফার্মে।  
মা কে আর চাকরি করতে দেয়নি। বলেছিল, অনেক করেছ এবার শান্ত হয়ে বসো। 
মা ওর মুখের দিকে চেয়ে বলেছিল, আমি একা একা কতক্ষণ বসে থাকবো এই ঘরের মধ্যে। কাউকে নিয়ে আয়। 
মুচকি হেসে পলাশ বলেছিল, আনবো। তোমার পছন্দ হবে কিনা জানি না।
-তোর পছন্দই আমার পছন্দ। মা বলেছিল পলাশ কে।
 
তসলিমা কে যেদিন সন্ধ্যায় নিয়ে এসেছিল, মা তখন কোরআন শরিফ পড়ছিল। 
-পলু এলি?
-হ্যাঁ, মা, তুমি বাহিরে এসো। দেখো কাকে নিয়া এসেছি।
মা তার স্বভাবজাত হাসি টা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
-মা, তসলিমা, বলে পরিচয় করিয়ে দিতেই মা তসলিমার হাত ধরে বলল, এসো মা, বসো।
 
মা তসলিমাকে বলেছিল, শোন, আজ এখানেই রাতের খাবার টা খাবে। কোন অসুবিধা হবে?
পলাশ শুনেই বলেছিল, না মা, আজ পারবে না। আমাদের একটা রেস্টুরেন্টে রিজার্ভেশন আছে। আর একদিন খাবে। বলে পলাশ তসলিমার দিকে তাকাল।
-ঠিক আছে, আর একদিন না হয় অনেক কিছু রান্না করবো, তখন কিন্তু না করবি না। বলে মা তসলিমার হাত টা ওর হাতের মধ্যে নিয়ে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে।
-না, অ্যান্টি, আজই খাবো। বলে তসলিমা পলাশের দিকে তাকিয়ে বলল, রেস্টুরেন্টের রিজার্ভেশন টা বাতিল করে দাও,
-কি বলছ? বলে পলাশ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তসলিমার দিকে।
-ঠিকই বলছি, আজকের এইদিন টা আর একবার আসবে না। হোটেলটা ওখানেই থাকবে, অন্য একদিন আমরা যেতে পারবো।
পলাশ বিড়বিড় করে বলল, মেয়েদের মন বোঝা দায়।
সেই রাতে মা আর তসলিমা অনেক কথা বলেছিল। পলাশের কাছে মনে হয়েছিল ওরা যেন একে অপরের অনেক দিনের চেনা। পলাশ ছিল নীরব দর্শক।
 
গাংচিল গুলো আবারও চিঁ চিঁ করতে করতে উড়ে গেলো। শুধু রয়ে গেলো ওর পায়ের কাছে ঘুরে বেড়ানো পাখিটা। ও বারবার তকাচ্ছে ওর দিকে। মনে হয় কি যেন বলতে চায়।
ঝিরঝির করে বাতাস বইছে।
পলাশের মনে হোল এখানে যারা শুয়ে আছে রৌদ্রের তাপে যেন ওরা কষ্ট না পায় সেইজন্যই কি এই বাতাস। আকাশের আলো নিভে এলে গেট টা বন্ধ করে দেবে। সূর্য এখনো ঢলে পড়েনি পশ্চিম দিগন্তে।
পলাশ বসে পকেট থেকে কাগজের ন্যাপকিন টা বের করে ফলক টা মুছে দিলো।
মনে হোল মা যেন বলছে, বাবা পলু, তান্নী মা কে দেখে রাখিস। আমার সোনা টাকে বড় করে দিয়ে যেতে পারলাম না।
দুই ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো ফলকের উপর। পলাশ হাত টা ফলকের উপর রেখে বলল, মা, তুমি তো ওকে ছয় মাস কোলে পিঠে করে নিয়ে বেড়িয়েছিলে, কিন্তু তুমি তো ওর দাদি, দাদি ডাক শুনে যেতে পারলে না। 
আবারও গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা জল।
পলাশ উঠে দাঁড়ালো, সন্ধ্যা হয় হয়। 
পাখিটা ও উড়াল দিয়ে চলে গেলো।
পলাশ বলল, মা ওরা গেট বন্ধ করে দেবে। আমি আজ আসি। তুমি ভালো থেকো। 
 
 
 
 
 
Continue Reading

অপরিচিতা ২য় পর্ব

                           

   কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল অনন্ত। মাথাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লোক টার গলার স্বর টা চিনতে চেষ্টা করল। যদি চেনা জানা হবে তবে ফোনটা কেটে দিলো কেনও? হাজার চিন্তা মাথায়। আস্তে আস্তে উঠে যেয়ে দাড়ালো মেডিসিন কেবিনেটর সামনে। ব্যথার ঔষধের বোতল টা খুলে দুটো ট্যাবলেট মুখে দিয়ে  দিলো। যদিও ব্যথাটা অতটা তীব্র নয়। সেইক্ষণে ফোনটা বেজে উঠলো।

যাক এতদিনে তৃপ্তির মনে পড়লো ফোন করার কথা। মনে মনে একটা ছক কেটে নিলো কি কি সে জিজ্ঞাসা করবে। এও ভেবে নিলো সঠিক উত্তর সে পাবে না। তাড়াতাড়ি ড্রয়াইং রুমে যেতে যেয়ে হোচট খেয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে। ততক্ষণে ফোনের রিং টা বন্ধ হয়ে গেছে। সময় নিয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাড়ালো অনন্ত। ধীর পায়ে এসে ফোনটা হাতে নিলো। মিস কলটা দেখল কোথা থেকে এসেছে।  না, তৃপ্তির কল নয়। সুপর্ণা কল করেছিল।

অনেকদিন সুপর্ণার সাথে যোগাযোগ নেই। সে আজই বা কেন কল করতে গেলো ? দুশ্চিন্তা টা আরও পাকিয়ে উঠল অনন্তের মাথায়। সাহস পেলো না সুপর্ণা কে কল করতে। টিভি টা চালিয়ে দিলো। টিভির পর্দায় চোখ কিন্তু মন টা তার অনেক দুরে।

কখন যে সোফাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে পড়ে না। এ ঐ পেইন কিলারে কারসাজি। চোখ টা যখন খুললও রাত তখন তিন টা।

সন্ধ্যা হয় হয়। বাসার সামনে গাড়ীর শব্দ শুনল অনন্ত। ইচ্ছে করেই উঠলো না সোফা থেকে। দরজা  খোলা এবং বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলো। ঘাড় ফিরে তাকালও। চোখাচোখি হোল তৃপ্তির সাথে। তৃপ্তি কোনো কথা না বলে সুটকেস টা নিয়ে ওর ঘরের দিকে চলে গেলো।

সাওয়ার শেষে তৃপ্তি এসে বসলো সোফার এক কর্নারে। চাদা থাই রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিলো। তারপর তাকালও অনন্তের দিকে। অনন্তও তাকালও তৃপ্তির দিকে।

-তোমাকে কয়েক বার কল করেছিলাম। গম্ভীর ভাবে বলল অনন্ত।

-জানি, মিস কল দেখেছি। বলল তৃপ্তি।

-তোমার ফোন অন্য কেউ ধরেছিল।

-তাও জানি। নিষ্প্রভ ভাবে বলল তৃপ্তি ফোনটার দিকে তাকিয়ে।

-এক্সপ্লেন করবে? উত্তেজিত না হয়ে জিজ্ঞাসা করলো অনন্ত।

-এক্সপ্লেন করার কিছু নেই।

-কেন? আমার জানতে ইচ্ছে করে না? এবার গলার স্বর টা একটু উপরে ছিল অনন্তের।

-তুমি যে ভাবে ইচ্ছা সে ভাবেই ভাবতে পারো, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

-আমি ভাবতে চাই না জানতে চাই। তুমি কি চাও আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ হয়ে যাক?

-সে কথা তো আমি বলিনি। সে তো তুমি বলছ। বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো তৃপ্তি।

উবার খাবার টা রেখে গেছে দরজার কাছে।

সে রাতে দুজন এক টেবিলে খেতে বসল না। খাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে অনন্ত তৃপ্তি কে দেখতে পেলো না। ফোন করতে ইচ্ছে করলো না।

ফোন করলও তার বোন সায়লা কে। শুধু বলল আমি আসছি আজ রাতের ফ্লাইটে।

একটা চিরকুট রেখে গেলো টেবিলের উপর, লেখা, সায়লার ওখানে যাচ্ছি। অস্থির মন টাকে বাগে আনতে। কবে ফিরবো জানিনা।

সুটকেসে ভরে নিলো ঔষধ গুলো, লাঠি টা নিলো সাথে। যেটা তার নিত্ত সঙ্গী।

অনেক দিন পরে এলো যেখানে গোল্ডেন ব্রিজ, সেই শহরে।

সায়লা আর মাহমুদ দাড়িয়ে ছিল বাহিরে। দুরের থেকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে মাহমুদ অনন্তের হাত থেকে সুটকেস টা নিয়ে নিলো। বলল, হেটে যেতে পারবে অনন্ত।

অনন্ত আর মাহমুদ একই সাথে পড়ত। সেই সুবাদে পরিচয় হয়েছিল সায়লার সাথে।

-পারব, তবে একটু সময় লাগবে যেতে।

-কোন সমস্যা নেই। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়। বলে সায়লা আর একটা হাত ধরল।
-না, ধরতে হবে না।

মাহমুদ চোখের ইশারায় সায়লাকে না করলো ধরতে।

-অনেকদিন পরে এলে ভাইয়া। সামনে থ্যাংকসঘিভিং। খুব মজা হবে।

-তোর সেই টটন ভাই আছে এখনো? সেই বার থ্যাংকসঘিভিং করেছিলাম। খুব মজা হয়েছিল।

-হ্যাঁ, এবারও সেখানেই হবে। ওরা তো জানে না তুমি আসছ। হঠাৎ করে এলে—

কথা শেষ হবার আগেই মাহমুদ বাঁধা দিয়ে বলল, এবার আমরা লেক টাহো তে যাবো অনন্ত। গতবার যাওয়া হয়নি।

-অবশ্যই। বলে অনন্ত একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো।

সায়লা বুঝতে পাড়লও মাহমুদ কেন তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কথা বলেছে। ওরা এখনো জানে না কেন হঠাৎ করে অনন্ত এলো, আর সাথে তৃপ্তি কে না নিয়ে।

মাহমুদের দুই একটা কথার উত্তর দিয়েছে অনন্ত, বেশির ভাগ সময় জানালা দিয়ে চলমান গাড়ী গুলো দেখছিল। চোখ ছিল বাহিরে, মন ছিল অনেক দুরে।

গাড়ীটা বাসার সামনে থামতেই দৌড়িয়ে এলো মেহা। কেবল তেরো তে পা দিয়েছে।

-মামা অনেকদিন পরে তোমাকে দেখলাম। জানো তোমার ঘরটা আমি সাজিয়ে রেখেছি নীল লাল বাতি দিয়ে। আর জানো মা আজকে তোমার জন্য ইলিশ মাছ রান্না করেছে। তুমি কতদিন থাকবে মামা। আমার গানের প্রোগ্রাম না দেখে কিন্তু যাবেনা।

এতগুলো কথা একসাথে বলে গেলো মেহা।

অনন্ত ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, না রে পাগলি তোর গান না শুনে আমি যাবো না। চল, তোর নীল লাল বাতি দেখি।

সন্ধ্যায় তৃপ্তি ফিরে এসে দেখল ঘর অন্ধকার। এমন তো হয়নি কখন। পারতপক্ষে অনন্ত বাহিরে যায় না। যদিও বা কোন বন্ধু এসে নিয়ে গেলে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে।

আলো টা জ্বালালো তৃপ্তি। কোথাও কোন শব্দ নেই। চোখ পড়লো টেবিলের উপর রাখা কাগজ টার দিকে।

হাতে উঠিয়ে নিলো।

পড়া শেষে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে এসে সোফাতে বসলো।

নিস্তব্ধ চারিদিক। এমন নিস্তব্ধতা আগে কখন উপলব্ধি করেনি।

এই প্রথম সে বাসাতে একা।

ভাবতে চাইলো গতরাতের ঘটনা গুলো। কেন সে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পারলও না অনন্ত কে। কেন বলতে পাড়লও না মোহিতের সাথে ওর সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্তের। এর বাহিরে কিছু নয়।

কেন বলতে পারলও না বাসায় এলেই ওর মনে পরে সেই বাচ্চার কান্নাটা। যে কিনা ভূমিষ্ঠ হবার আগেই চলে গিয়েছিল পৃথিবী ছেড়ে।

কত বার না করেছিল অনন্ত কে সেই রাতে বন্ধুদের সাথে বাহিরে না যেতে। ও যদি বাসাতে থাকতো তাহলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ওকে নিয়ে গেলে হয়ত বাচ্চা টাকে বাঁচানো যেতো।

পা পিছলে বাথরুমে কতক্ষণ পড়েছিল সে নিজেও জানে না। জেগে উঠে দেখে সে মেঝে তে পড়ে আছে।

অনন্ত কে কল করেছিল। হাসপাতালে গিয়েছিল।

ডাক্তার বলেছিল অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। আমরা আর কিছু করতে পারবো না।

সেই থেকে তৃপ্তি অনন্ত কে দায়ী করে।

অনন্ত কতবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তৃপ্তি কোন কথাই শুনতে চাইনি। আস্তে আস্তে দুজনের মাঝে দূরত্ব তৈরী  হয়েছে।

টটন ভাইয়ের বাসায় গানের আয়োজন। অনন্ত প্রথমে যেতে চাইনি। মেহার টানাটানি তে যেতেই হোল। টটন ভাই হাস্যমুখে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো অনন্তের দিকে।

-অনেকদিন পরে এলেন।

-হ্যাঁ, হঠাৎ ই চলে এলাম। গান বাজনার আয়োজন আছে নিশ্চয়? বলে অনন্ত তাকালও চারিদিকে।

-এইতো, গান, আড্ডা তারপর খাওয়া দাওয়া।

কথার মাঝে মেহা এসে অনন্তের হাতটা টান দিয়ে বলল, মামা এসো তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবো আমার গানের মাস্টারের সাথে। বলে টেনে নিয়ে এলো এক ভদ্রমহিলার সামনে।

-শেফালি অ্যান্টি, আমার মামা।

শেফালি তাকালও অনন্তের দিকে, বলল, আপনার কথা শুনেছি সায়লার কাছে। আর এত শুনেছি যে মনে হয় আপনি অনেক দিনের চেনা।

অনন্ত হাসল, আর আপনার নাম আমি শুনেছি এই মিষ্টি মেয়ে টার কাছে।

কথা শেষ না হতেই টটন ভাই ডাক দিলো শেফালি কে।

গান শুরু হবে। অনন্ত পিছনের দিকে একটা চেয়ার টেনে বসলো।

বেশ কটা গানের পর শেফালি গাইতে শুরু করলো রবীন্দ্র সঙ্গীত। “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে—-

অনন্তর মনটা শুনতে শুনতে চলে গেলো অনেক পিছনে। তৃপ্তির প্রিয় গান। বাড়ীর বারান্দায় আলো নিভিয়ে দিয়ে তৃপ্তি ওর কোলে মাথা রেখে গাইত এই গানটা।

-কিছু ভাবছেন? চমকে তাকাল অনন্ত।

সামনে দাঁড়ানো শিউলি।

– চলুন, ঐ যে ঢালু জাগাটা ওখান থেকে দেখতে পাবেন সামনের পাহাড় টা। অপূর্ব দৃশ্য। আমি টটন ভাই এর বাসায় এলে ঐখানে বসে থাকি। বলে শিউলি লাঠি টা এগিয়ে দিলো।

-গান শেষ?

-আপাতত।

অনন্তের ভালোই লাগছিলো শিউলির সান্নিধ্য।

অতি কাছের মানুষ যখন দুরে চলে যায়, কথা বলার মানুষটা যখন আর কথা বলে না, তখন শিউলির আপ্যায়ন অনন্তের ভালো লাগে।

ওরা এসে বসল টটন ভাইয়ের বাসার মাঠের শেষ প্রান্তের বেঞ্চে। দুরে লালচে আভার আকাশটা ঢলে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে। সন্ধ্যা হয় হয়।

শিউলি বলল তার স্বামী, ছেলের কথা। বলল,তার স্বামী গেছে অফিসের কাজে বাহিরে। আরও অনেক কথা।

অনন্ত শুনল বেশি, বলল কম।

ডাক পড়লো, ডিনারের। উঠতে যেয়ে লাঠিটা ফসকে গিয়েছিল হাত থেকে। পড়তে যেয়ে আবার উঠে দাঁড়ালো।

-সাহায্য লাগবে। শিউলি জিজ্ঞাসা করল।

-না, আমি ঠিক আছি। বলে অনন্ত হাটতে আরম্ভ করলো।

সেই রাতের পর থেকে তৃপ্তি যায়নি দোকানে। মমতা কে বলেছে অর্ডার গুলো ঠিক মতো পাঠিয়ে দিতে। মোহিত কল করেছিল কয়েক বার। ফোনটা ধরেনি।

আবারও ফোনটা বেজে উঠল। মোহিত। এবার ধরলও সে।

শুধু বলল, একটি বার এসো আমার বাসায়।

মোহিত এলে ওর হাতে অনন্তের লেখা চিরকুট টা এগিয়ে দিলো।

লেখা টা পড়ে মোহিত বলল, দোষ টা তোমার। দুটো জীবন এইভাবে নষ্ট করে দিও না। ভুলে যাও অতীত।

ডাকো তাকে। বলো, আমরা দুজনেই ভুল করেছি। এসো, আমরা আবার নতুন করে গড়ে তুলি আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংসার টা। ওর মনের মধ্যে যে ভুল তোমার আমার সম্পর্ক টা নিয়ে, সেটা ভেঙে দাও। 

আমি থাকবো তোমার পাশে সব সময় বন্ধু হয়ে। উঠাও ফোনটা কল কর। মোহিত একসাথে এতগুলো কথা বলে যেয়ে দাঁড়ালো জানালার কাছে।

ফোনটা বেজে উঠল। অনন্ত তাকালও ফোনটার দিকে। তৃপ্তির ফোন। ধরতে যেয়ে হাত টা সরিয়ে নিলো।

আবারও বেজে উঠল। এবার ফোনটা ধরলও অনন্ত। কিছুক্ষন কেউ কোন কথা বলল না।

নীরবতা ভেঙে তৃপ্তি বলল, কবে আসবে, আমি অপেক্ষায় আছি।

কান্নার শব্দ। তারপর আবারও চুপ দুজনে।

-আগামীকাল। সাথে লাঠি টা আনবো না।

-কেন?

– তুমি হবে আমার লাঠি।

হাসতে যেয়ে আবার কেঁদে ফেললো তৃপ্তি।

Continue Reading

অপরিচিতা

  সকাল নয়টা। সূর্যের আলো টা জানালা দিয়ে এসে অনন্তর চোখের উপর পড়ছিল। কতবার তৃপ্তি কে বলেছে  একটা কালো পর্দা দিয়ে ডেকে দিতে। আজও তার সময় হয়নি। বিছানা থেকে উঠতে যেয়ে বাম পা টা ব্যাথায়  টনটন করে উঠলো। কোন রকমে  পা টা টানতে টানতে রান্না ঘরে এসে দাঁড়ালো অনন্ত। তৃপ্তি বেড়িয়ে গেছে। প্রথমে যাবে জিমে। তারপর বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেবে। ফিরতে ফিরতে এগারটার উপর হয়ে যাবে।

অনন্তর নিজের নাস্তাটা নিজেই করে নিতে হবে। ব্যাথা টার তীব্রতার জন্য বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে পারে না। কফির পটটা আনতে যেয়ে হাতের লাঠি টা পড়ে গেলো মেঝেতে। অনন্ত জানে নিচু হয়ে সে উঠাতে পারবে না। একবার চোখ বুলিয়ে নিলো চারিদিকে। কোথাও রীচার গ্রাবার টা দেখতে পেলোনা। পাশে থাকা স্টুল টা টেনে নিয়ে এলো। ওটাতে বসে ডান হাতটা নামিয়ে দিলো নিচে। প্রথম বার ছুঁতে পাড়লও না। আর একবার চেষ্টা করতেই তীব্র ব্যাথায় সারা মুখ নীল হয়ে এলো।

যাক উঠাতে পাড়লও সে। কিছুক্ষন বসে রইল।   ব্যাথা টা একটু কমে আসতেই উঠে দাঁড়ালো। কফি টা বসিয়ে দিয়ে এলো ফ্রিজের কাছে। পাউরুটি আর জেলি টা নিয়ে রাখল টেবিলে। তৃপ্তি বাসায় না থাকলে সকালের নাস্তা টা সে এই ভাবেই সেরে নেয়।

কফিটা তে চুমুক দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ওর আর তৃপ্তির ছবি টা। বিয়ের আগে তোলা।

অনন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো তৃপ্তির ঠিক ঠোটের নিচের তিল টাকে। ঐ তিল টাই ওকে আকর্ষণ করেছিল। আজ থেকে অনেক বছর আগে তোলা এই ছবি।

তৃপ্তির সাথে দেখা হয়েছিল এক রেস্টুরেন্টে।

 অনন্ত, স্বপন আর সন্ধ্যা কর্নারের একটা টেবিলে কফি নিয়ে বসেছিল।

হঠাৎ দেখতে পেলো তার পরিচিত একজন কে, সুপর্ণা। সাথে তিন বান্ধবী।

সুপর্ণার সাথে চোখাচোখি হতেই সুপর্ণা এগিয়ে এলো।

-কেমন আছো অনন্ত। তোমার তো ইদানীং পাত্তা পাওয়া যায় না। থাকো কোথায়? বলে সুপর্ণা অনন্তর উত্তরের অপেক্ষা না করে পরিচয় করিয়ে দিলো ওর বান্ধবীদের সাথে। তৃপ্তি, তাসনিম, মমতা।

-তোমাদের কোন আপত্তি না থাকলে বসো আমাদের সাথে। একসাথে আড্ডা দেই। সুপর্ণা কে  কথাটা বলে অনন্ত তাকাল তৃপ্তির দিকে।

সেইক্ষণে সে দেখতে পেলো ঐ তিল টা।

চোখ টা আটকিয়ে গেলো।

-কি, হ্যাঁ করে কি দেখছ। কপট হাসির ভান করে জিজ্ঞাসা করলো সুপর্ণা।

একটু লজ্জা পেলো অনন্ত। পরক্ষনে  নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, না, দেখছি তোমার সুন্দরী বান্ধবীদের।

-হু, তা কোনটাকে পছন্দ?

-আহ, তুমি সেই আগের মতই রয়ে গেছো। বসো, কি খাবে বলও।

-দেখি মেনুতে কি আছে। ঘাড় যখন তোমার ভাঙ্গব তখন ভালভাবেই ভাঙ্গি।

-কুছ পরোয়া নেই। বলে চেয়ার টা একটু পিছনে ঠেলে দিলো।  

ওরা বসলো একসাথে।

দুই একবার চোখাচোখি হোল তৃপ্তির সাথে।

আড্ডা টা বেশ ভালই জমেছিল

বের হয়ে যাওয়ার আগে অনন্ত সুপর্ণা কে একটু পাশে ডেকে নিয়ে যেয়ে বলল, এই ঐ যে মেয়েটা ঠোটের নিচে তিল, নাম টা যেন কি?

-তৃপ্তি

-লাইন আছে ওর না থাকলে লাইন টা আমার সাথে লাগিয়ে দাও

-হু, মনে ধরেছে তাহলে

-ধরেছে তো

– ঠিক আছে, কাল সন্ধ্যা সাত টায় এইখানেই আবার এসো সুপর্ণা অনন্তের হাতে একটা চিমটি দিয়ে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেলো।

তৃপ্তি এসেছিল

 সুপর্ণা ওদের দুজনকে রেখে কোথায় যে চলে গেলো এলো দুই ঘণ্টা পড়ে

এই দুই ঘণ্টায় ওরা অনেক কথা বলল, দুজনের মধ্যের লজ্জার আবরণ টা কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো

তারপর ওরা আবারও মিলল একসাথে হাত ধরাধরি করে হাঁটল ঠোঁটে ঠোঁট রাখল

তারপর একদিন ওরা হয়ে গেলো মিস্টার আর মিসেস

দরজা খোলার শব্দ হোল তৃপ্তি ঢুকল

অনন্ত ছবিটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকালও দরজার দিকে।

-নাস্তা করেছো? গায়ের কাপড়টা খুলতে খুলতে জিজ্ঞাসা করল তৃপ্তি।

-করেছি তবে অনেক কষ্টে। বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।

-সরি, আমাকে এখুনি দোকানে যেতে হবে। কতগুলো কাপড় ডেলিভারি দেবে। আমি না থাকলেই নয়। তুমি উবার ইটে দুপরের খাবার অর্ডার দিয়ে দাও। একটু বেশি করে দিও তাহলে রাতেও খেতে পারবে। আমার আসতে দেরি হতে পারে। আমি বাহিরে খেয়ে আসবো। এই বলে তৃপ্তি সাওয়ার নিতে চলে গেলো।  

অনন্ত আস্তে আস্তে এসে বসলো বাহিরের বারান্দায়। কুয়াশায় তখনো ঘাস ভেজা। দুটো শালিক কিচিরমিচির করছে ওর বারান্দার কোনায়। অনন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল  শালিক দুটো কে। আর ভাবছিল,

কোথায় গেলো সেইদিন গুলো। যখন তৃপ্তি বসে থাকতো  অনন্তের জন্য ভাতের থালা আগলে। কাজ থেকে আসতেই দরজা খুলে প্রথমে একটা চুমো দিয়ে বলতো, তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো, আমার অনেক খিদে পেয়েছে।

অনন্ত ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলতো, কতদিন বলেছি, তুমি খেয়ে নিও, তারপর আমি খেতে বসলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করো।

-আহারে, এসব বুঝি শরৎচন্দ্রের বই তে পড়েছ।

-হ্যাঁ, কিন্তু আমার শরৎচন্দ্র হারিয়ে গেছে।

-না হারায় নি, মডার্ন হয়েছে। আমি এয়ারকন্ডিশন চালিয়ে দিয়েছি। বলে হেসে উঠত। আর ঠিক সেইক্ষণে অনন্ত আলতো করে চুমো দিতো ঐ তিল টার উপর।

সেইসব দিনগুলো  একদিন কর্পূরের মতো উবে গেলো।

তৃপ্তির অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল একটা বুটিকের দোকান দেবে। অনন্ত কে বলেছিল। অনন্ত না করেনি।

-কিন্তু টাকা কোথায় পাবো?

-শোন, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। যদি চাও তবে হোম ইকিউটি নিয়ে আরম্ভ করো। বলেছিল অনন্ত।

-ভয় হয়। যদি ব্যবসাটা দাড় করাতে না পারি। তাহলে টাকা শোধ দেবো কি ভাবে। তৃপ্তি ভয়ে ভয়ে বলেছিল।

অনন্ত আশ্বাস দিয়েছিল। বলেছিল, চেষ্টা করতে দোষ কি?  তোমার উপর আমার অগাধ বিশ্বাস। তুমি পারবে।

পেরেছিল সে। আস্তে আস্তে ছোট্ট দোকান টাকে অনেক বড় করেছিল।

শুধু হারিয়ে গিয়েছিল সেই  বৌ টা।

দেরি করে ফিরতে আরম্ভ করলো তৃপ্তি। জিজ্ঞাসা করলে বলে দোকানে কাজ ছিল অনেক। অনন্ত বসে থাকে ওর জন্য এক সাথে ডিনার করবে বলে। তৃপ্তি খেয়ে আসে বাহিরের থেকে।

বললে বলে, তুমি এখন থেকে খেয়ে নিও। আমার জন্য বসে থেকো না।

এর মাঝে একদিন  এক অঘটন ঘটলো। গাড়ীর এক্সিডেন্টে অনন্ত বাম পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলো। সেই সাথে মাজায়।  ডাক্তারেরা অনেক চেষ্টা করল পা টাকে আবার আগের অবস্থাতে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পাড়লও না।

চাকরি থেকে আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাসাতে বসে থাকতে হোল।

প্রথম দিকে তৃপ্তিই ওকে দেখাশোনা করতো। ক্রমেই কয়েকটা মাস পাড় হতেই অনন্ত বুঝতে পাড়লও তৃপ্তি আস্তে আস্তে দুরে সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক থাকে। ডাকলে সাড়া দেয়না।

এক রাতে বারান্দা বসে তৃপ্তি বলল, এবার একটা লোক রাখো, আমি আর পেরে উঠছি না। ঘরে বাহিরে আমার পক্ষে সামলানো দায় হয়ে উঠেছে।

কথাটা একটু ঝাঁঝালো স্বরে বলেছিল তৃপ্তি।  

কিছুক্ষন চুপ করেছিল অনন্ত।

কোথায়, সে তো নিজের কাজ যতটা পারে নিজেই করে। কাপড় জামা এখনো নিজেই পড়ে, তবে একটু কষ্ট হয়। টয়লেটে নিজেই যেতে পারে। শুধু যখন ব্যথাটা প্রচণ্ড আকার ধারন করে তখন বিছানা থেকে নামতে গেলে নামতে পারেনা।

অনন্ত তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, একটা লোক রাখতে তো অনেক টাকার দরকার।

তৃপ্তি কোন কথা না বলে উঠে ঘরের দিকে চলে গেলো।

বাড়ীতে অশান্তি দেখা দিলো।

তৃপ্তি একদিন বলল, সে আর রান্না করতে পারবে না। তার সময় নেই। খোঁজ নিতে বলল, কাউকে পাওয়া যায় কিনা যার কাছে অর্ডার দাওয়া যাবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেলো তসলিমা কে।

ইয়ং মেয়ে। ছোট একটা বাচ্চা আছে তার।

রান্না ভালো করে। অনন্ত বলেছিল, তোমাকে কিন্তু বাসায় দিয়ে যেতে হবে।

-কোন অসুবিধা নেই ভাইয়া।

মাঝে মাঝে খাবার দিতে এসে তসলিমা বসে।  গল্প করে অনন্তর সাথে। অনন্ত ওকে বিভিন্ন লেখকের বই পড়ে শোনায়।

বলেছিল, ওর বড় ভাই এর কথা। একদিন কাজ থেকে এসে বলল, মা শরীর টা ভালো লাগছে না। আজ আর খাবো না। একটু শুয়ে থাকি। সেই শোয়াই তার শেষ শোয়া। বলে অনেক কেঁদে ছিল।

আরও বলেছিল, তুমি ঠিক আমার বড় ভাই এর মতো। সে ও আমাকে বই পড়ে শোনা তো। সে আমার বিয়ে দেখে যেতে পাড়লও না। আমার সংসার দেখল না।

আচ্ছা ভাইয়া, ভাবী কে দেখি নাতো। অনেক ব্যস্ত বুঝি।

-অনেক।

-তোমার এই পা আর ভালো হবে না?

-না, অসুবিধা কি। এই লাঠি টা তো আছে। বলে হাল্কা করতে চায় পরিবেশ টাকে অনন্ত।

সেদিন তৃপ্তি একটু তাড়াতাড়িই বাসায় এলো। যেটা অনেক অনেক দিন ধরে হয়নি।

-আজ একসাথে আমরা ডিনার করবো। বলে ফ্রীজ টা খুলে দেখল তৃপ্তি।

এরকম প্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেনি অনেকদিন। অনন্ত তৃপ্তির দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। আনন্দে সে আত্মহারা।

আবার বুঝি ফিরে এলো সেই হারিয়ে যাওয়া দিন গুলো।

মনে মনে অনেক কিছু ভাবল অনন্ত। ঐ তিল টাতে আবার আজকে সে চুমো দেবে। খাওয়ার আগে না খাওয়ার পরে।

তৃপ্তি কাছে আসতেই অনন্ত উঠে দাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতেই সে অনন্ত কে আস্তে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে  বলল, কি ঢং আরম্ভ করলে।

অনন্ত অপ্রত্যাশিত এই ধাক্কা টা সামলিয়ে নিয়ে বলল, এসো না ওই ঢং টাই আমরা আবার করি। আচ্ছা তোমার মনে পরে না আমাদের সেই প্রেমের কথা। তুমিই না হয় আমার লাঠি হয়ে দাড়াও আমার পাশে। চল আমরা বেড়িয়ে আসি কাছে কোন এক জায়গা থেকে।

তৃপ্তি তাকালও অনন্তের দিকে। কোন উত্তর না দিয়ে ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, আমি দিন পাচেকের জন্য বাহিরে যাচ্ছি। নিজের চোখে দেখে কাপড়ের অর্ডার গুলো দিতে চাই। তোমার একা থাকতে কোন অসুবিধা হবে?

-অসুবিধা হলেই বা তুমি কি করবে বলও। তবে কোথায় যাচ্ছ? একটু রেগেই বলল অনন্ত।

-স্টেটসের বাহিরে। 

-কবে যাবে?

-আগামীকাল দুপুরে আমার ফ্লাইট। হঠাৎ করেই যেতে হচ্ছে।  দরকার পড়লে আমার হোয়াটস আপে কল দিও।

-কোন হোটেলে থাকবে?

-হিলটনে।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। শুধু চামচের টুংটাং শব্দ।

অনন্ত নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, আচ্ছা তৃপ্তি আমি কি সত্যিই তোমার কাছে একটা বোঝা হয়ে উঠেছি।

-দেখো এই ধরনের প্রসঙ্গ আমি শুনতে চাই না। বলে উঠে দাঁড়ালো তৃপ্তি।

-তৃপ্তি, শোন, আমি এখনও পুরপুরি অথর্ব হয়ে যাইনি। এখনো লাঠি ভর দিয়ে অনেক দুর যেতে পারবো। আমি শুধু  চাই তুমি আমার পাশে এসে দাড়াও। ঐ বুটিক শপ একদিন আমিই তোমাকে করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলাম। আজ সেই বুটিক শপই আমার কাল হয়ে দাঁড়ালো।

-ও। তোমার হিংসে হচ্ছে? বলে তৃপ্তি তাকালও অনন্তের দিকে।

– হিংসে কেনও হতে যাবে। বরং আমার গর্ব হচ্ছে। তুমি ছোট্ট একটা দোকান কে কত বড় করে তুলেছ। মনে নেই সেদিন আমি বলেছিলাম, তুমি পারবে।

তুমি পেরেছ। তুমি পেরেছ।  আমি হারিয়েছি।

-তোমার সাথে তর্ক করার ইচ্ছে আমার  নেই, আমি ঘুমতে গেলাম। বলে তৃপ্তি চলে গেলো তার রুমে।

অনন্ত আরও কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে টিভি টা চালিয়ে দিলো।

দুইদিন পার হয়ে গেছে। তৃপ্তি ফোন করে নি। অনন্ত অস্থির হয়ে লাঠি ভর দিয়ে একবার এঘর, ওঘর করে বেড়াতে লাগলো। কত বার কল করলো ওর হোয়াটস আপে। তৃপ্তি ফোন ধরলও না।

তৃতীয় দিন রাত দশটায় ফোন করল, বেশ কিছুক্ষণ বাজার পর ফোন টা ধরল।

হ্যাঁলো বলল, এ স্বর কোন মেয়ের নয় ছেলের।

অনন্ত কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, তৃপ্তি কোথায়।

লাইন টা কেটে দিল, যে ধরে ছিল ফোনটা।  

অনন্ত চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

Continue Reading

শৈবালের জীবন কাহিনী

   শৈবাল আর আমি একই স্কুলে পড়তাম। ও ছিল লেখাপড়ায় তুখোড়। আমি ছিলাম ব্যাক বেঞ্চার। শুধু পড়াশুনায় নয়, খেলাধুলায়ও সে একেবারে চৌকস না হলেও মন্দ নয়। আমরা যেমন মাঠের বাহিরে দাড়িয়ে খেলা দেখতাম, ও থাকত মাঠের ভিতরে। এমন কি ১০০ মিটার স্প্রিন্টে দ্বিতীয় স্থান ওর ছিল অবধারিত। কিন্তু ঘোরাঘুরি করত সে আমাদের সাথে। আমি, মতলেব, দীলিপ আর সে। স্কুলের শেষ বর্ষের শেষ পরীক্ষাতে সে ফার্স্ট ডিভিশন সাথে চার টাতে লেটার নিয়ে চলে গেলো রাজধানীর দিকে নাম করা কলেজে ভর্তি হবে বলে।

আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। তারপর অনেক বছর পরে হঠাৎ করে একদিন দেখা হোল কার্জন হলের চত্তরে। আমি হেটে যাচ্ছিলাম বন্ধুদের সাথে, পাশ দিয়ে এক তরুন তরুনী হেটে গেলো।

হঠাৎ শুনতে পেলাম আমার নাম ধরে কে যেন ডাকছে পিছন থেকে। ফিরে চাইলাম। ও এগিয়ে এলো সাথে তরুনীটি ও।

-চিনতে পারছিস না? বলে হাত দিয়ে মৃদু ভাবে ঠেলা দিলো।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চিনতে পারলাম।

-এই শালা তুই। বলে জড়িয়ে ধরলাম। তরুনী চেয়ে রইল আমাদের দিকে।

আমার বন্ধুরা হাটতে হাটতে বেশ দুরে চলে গেছে। জানি কোথায় যেয়ে তারা বসবে।

এই মুহূর্তে শৈবালের সাথে দেখা হয়েছে সেটাই বড় হলো আমার কাছে।

-পরিচয় করিয়ে দেই, কঙ্কনা, আমার বান্ধবী। পলিটিকাল সাইন্সে প্রথম বর্ষের ছাত্রী।

কঙ্কনা ওর হাত টি এগিয়ে দিলো।

-আর তুই? জিজ্ঞাসা করলাম ওকে।

-কেমিস্ট্রি তে। বলে উৎফুল্লের সাথে বলল, চল ক্যান্টিনে যেয়ে বসি।

বললাম, অনেকদিন পর দেখা, খুবই ভালো লাগছে, তবে এই মুহূর্তে তোদের মাঝে আমি বসবো না। তোদের সময় টুকু তোদের থাক। এই চত্তরে আবার তোর সাথে আমার দেখা হবে, কারন ঐ শেষ বিল্ডিঙের উপর তালায় আমার ক্লাস।

-ও তুই বাইওকেমিস্ট্রিতে আছিস।

-হ্যাঁ, তাহলে চলি আজ। কাল বারোটা চল্লিশে ক্যান্টিনে আয় দেখা হবে। বলে আমি পিছন ফিরলাম।

দেখা হয়েছিল।

তারপর আবারও আমরা হারিয়ে গেলাম। লেখাপড়া শেষে যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম।

হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে আবার যখন পেলাম, তখন নদীর জল অনেক দুরে গড়িয়ে গেছে। সেই উচ্ছল শৈবাল আর নেই। দেখা হয়েছিল বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে। দুর থেকে আমি দেখছিলাম তাকে। দ্বিধা ছিল মনে। তবুও এগিয়ে গেলাম। ও তাকালও আমার দিকে। 

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে দাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল।

-কতদিন এদেশে?  জিজ্ঞাসা করলাম।

-১৯৭৪ থেকে।

-মাই গড, আমি এসেছি বছর দশেক হোল।  তোর গিন্নি কোথায় তার সাথে মোলাকাত করে নেই।

-সে নেই।

-মানে? হতভম্বের মতো তাকালাম ওর দিকে।

-চলে গেছে উপরে, তা পাঁচ বছর হয়ে গেলো। তুই আছিস কোথায় বল, একদিন দেখা করব। অনেক কথা বলার আছে।

আমি ওকে আমার ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে আস্তে আস্তে এলাম আমার টেবিলে।

ও এসেছিল। অনেকক্ষণ বসেছিল। বলেছিল ওদের প্রেমের কথা। আমি শুনতে শুনতে চোখ টা কতবার যে মুছে ছিলাম আজ তা মনে নেই। 

আজ ওর জীবনী লিখতে যেয়ে অনেকবার আমাকে উঠে যেতে হয়েছে ঝাপসা চোখে জানালার কাছে।

  •  

কঙ্কনার সাথে শৈবালের দেখা হয়েছিল শৈবালের বোনের বাসায়। চোখে কাজল,কপালে টিপ, পরনে সাদা শাড়ী কালো পাড়, দুটো বেনি করা চুল।  ছিপছিপে গড়ন। 

তোমার নাম?

কঙ্কনা।

কি যেন সেদিন শৈবাল দেখেছিল কঙ্কনার মাঝে তাইতো প্রায় সে আসতো মোহাম্মদপুরে ওর বোনের বাসায়।

দুজনে বসে গল্প করতো।

গল্পে গল্পে শৈবাল জানতে পেরেছিল কঙ্কনা শৈবালের দুলাভাইয়ের  খালাতো বোন। সবে ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। আপাতত থাকে এখানে। 

শৈবাল জিজ্ঞাসা করেছিল কঙ্কনা কে , এবার কি পড়বে ?

-ভাবছি পলিটিকাল সাইন্সে অনার্স নিয়ে পড়ব। কিন্তু এত বড়  বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথায় গিয়ে কি করতে হবে কিছুই তো জানিনা। আপনি কি ব্যাস্ত, না হলে আমাকে যদি একটু সাহায্য করেন। কোন সংকোচ না করে জিজ্ঞাসা করেছিল শৈবাল কে।

-কোন সমস্যা নেই, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। বলেছিল শৈবাল।

এই পর্যন্ত বলে শৈবাল একটু থেমেছিল। আমিই জিজ্ঞাসা করলাম, কিরে থামলি কেন?

-তারপর কি জানিস, উপরওয়ালা কলকাঠি নাড়িয়ে সব ঠিক করে দিল। বোন আর মহিম ভাইকে বেশ কিছুদিনের জন্য চলে যেতে হোল মহিম ভাই এর দেশের বাড়ীতে। আর কঙ্কনার কোন থাকার জায়গা না থাকাতে তাকে

আমার বোন আমাদের বাসাতে রেখে গেলো। আর সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ্ডগোল হওয়াতে সব ছাত্রদের কে হল ছেড়ে দিতে হোল। আমি বাসায় এলাম।

এর পরের ঘটনা, ওরা দুজনে ঘরে বসে লুডু খেলে, হেসে গড়িয়ে পরে। পায়ে পায়ে টোকা লাগে। তাস খেলতে যেয়ে একের হাত অন্যের হাত স্পর্শ করে। তাকায় দুজনে একে অন্যের দিকে।

কবে কখন যে কঙ্কনা শৈবালকে তুমি বলতে শুরু করেছে সে নিজেও জানে না।

শৈবাল কঙ্কনার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলেছিল, ঠকবেনা তুমি কথা দিলাম।

কঙ্কনা ঠকেনি।

কঙ্কনা ভর্তি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। শৈবাল প্রতিদিন আসে  ছাত্রী হলের গেটের কাছে। কঙ্কনা বেড়িয়ে এলে

ওরা এসে বসে দুই গাছের ছায়ায়, বসে খোলা আকাশের নিচে। সন্ধ্যা হয়ে আসে, কথা ফুরাতে চায়না।

কঙ্কনা বলে, জীবনে এই প্রথম কারোর হাতে আমি হাত রেখেছি, এই হাত রাখাই যেন আমার শেষ হাত রাখা হয়।  তোমার হাতেই যেন আমি মরতে পারি।

শৈবাল চেষ্টা করছিল বিদেশে যাওয়ার। সুযোগ টা এলো নিউইয়র্কের একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু খরচের পরিমান দেখে সাহস করতে পারছিল না। কঙ্কনাই বলেছিল, যাও একটা কিছু ব্যবস্থা হবে। এই সুযোগ হয়ত আর আসবে না।

রওয়ানা দেওয়ার আগের দিন ওরা বসেছিল ইগলু ক্যাফেতে। অনেক কথার পর শৈবাল বলেছিল, একটা বছর অপেক্ষা করো সোনা, আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।

বাহিরে বৃষ্টি, কঙ্কনার চোখে জল।

নিউইয়র্কে এসে শৈবাল উঠল এক বন্ধুর বাসায়। কিছুদিন পরে বুঝতে পারলো একটা কাজ নিতে হবে। টাকা পয়সা দরকার। স্কলারশিপ পাওয়ার পর ও, লাগবে আরও টাকা, আছে দৈনন্দিন জীবনের খরচ। কাজ নিলো একটা রেস্টুরেন্টে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পরে সন্ধ্যায় যায় সেখানে। বাসায় আসতে আসতে বেজে যায় রাত বারো টা। পড়াশোনা করে সাবওয়েতে ট্রেনের কামরায় ।

সময় টা দ্রুত পেড়িয়ে গেলো। বছর ঘুরে এলো। কথা দিয়েছিল সে, এক বছর পরে সে ফিরবে। বিয়ে করবে।

শৈবাল তার এক ভাবীকে নিয়ে গিয়েছিল কেনাকাটা করতে। বিয়ের বাজার বলে কথা।  

ভাবী জিজ্ঞাসা করেছিল, কি কি কিনতে হবে জানো?

-আমি কি করে জানবো, সেইজন্যই তো তোমাকে নিয়ে এলাম।

-মাপ জানো?

-কিসের মাপ? আকাশ থেকে পড়েছিল শৈবাল।

-এই যে ৩২,৩৩, বি সি। ঠিক আছে, গড়ন কি রকম।

শৈবাল একটা মেয়ে কে দেখিয়ে বলেছিল, ওর মতো তবে লম্বায় একটু শর্ট।

-ঠিক আছে। বলে ভাবী, চলে গেলো।

ফিরে এলো কিছুক্ষণ পরে। শৈবাল এবার বুঝতে পারলো  ভাবী কি জানতে চাইছিল।

কেনাকাটা শেষ, নিয়েছে কসমেটিক, কিনেছে গোলাপি সুটকেস।

২৬ শে অক্টোবর বিয়ে। শৈবাল ভাবছিল কঙ্কনার কথা, ভাবছিল ভবিষৎ এর কথা।

বিয়ে শেষে দুই মাস পরে শৈবাল ফিরে এলো নিউইয়র্কে। টাকা জমাতে হবে। বাসা নিতে হবে। মাথার ভিতর শত চিন্তা। রেস্টুরেন্টের ওয়েটারের কাজটা শুরু করলো। আরও দুটো বছর লাগবে পিএইচডি টা শেষ করতে।

দেখতে দেখতে কেটে গেলো ছয় টা মাস। কঙ্কনা আসবে। বাসা পাওয়া দুরহ ব্যাপার। বিধাতা মুখ তুলে চেয়েছিল। এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারই বিল্ডিং এক কামরার একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিলো।

ঘর সাজাল বিল্ডিং এর বেজমেন্টে পড়ে থাকা সোফা, খোঁজ দিয়েছিল বিল্ডিং এর সুপার, তাই দিয়ে। পাঁচশ ডলার দিয়ে কিনে আনল বেডরুম সেট, সাথে ডাইং টেবিল।  রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে এলো কফির খালি জার। সাজিয়ে রাখল তার ভিতরে বিভিন্ন ধরনের মসলা দিয়ে।

শৈবাল ছুটি নিয়েছিল কয়েক দিনের জন্য। যেদিন কঙ্কনা এসেছিল পরের দিনই নিয়ে গিয়েছিল সারকেললাইনে।  ওর পরনে ছিল বড় বড় ছাপের শিফনের শাড়ী। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। অপূর্ব লাগছিল কঙ্কনা কে শৈবালের চোখে। কঙ্কনা তার শাড়ী সামলাতে সামলাতে বলেছিল, ঐ বুঝি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, ঐ যে দুরে বুঝি টুইন টাওয়ার। আনন্দে উচ্ছল ওরা।  

কঙ্কনা তখনো শাড়ী ছেড়ে প্যান্ট ধরেনি। দুজনে বসে থাকত রেডিও সিটি মিউজিক হলের সামনে। চোখ ভরে দেখত  রকফেলার সেন্টারে স্ট্যাচু টা।  কঙ্কনা শৈবালের কাঁধে মাথা রেখে বলত, এ দেখার তো শেষ নেই এখন আমি তোমাকে দেখব।

শৈবাল ওর ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরত কঙ্কনার লালচে রং এর ভিজে ঠোঁট। হারিয়ে যেতো দুজন ভালোবাসার গভীর বন্ধনে।

কয়েক মাস পার হয়ে গেলে কঙ্কনা কাজ নিয়েছিল এক কলমের কারখানায়। ভোর সাতটায় বেড়িয়ে যায়। আসে বিকেল পাঁচটায়। শৈবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শেষে যায় তার দ্বিতীয় কাজে, রেস্টুরেন্টে। ফিরতে ফিরতে বাজে রাত একটা। কঙ্কনা তখন ঘুমিয়ে। তাই ওদের দেখা হতো মাঝ পথে এক ষ্টেশনে। কিছুক্ষণ সময় কাটাত দুজনে। তারপর কঙ্কনা চলে যেতো বাসার দিকে, আর শৈবাল চলে যেতো তার দ্বিতীয় কাজে। কোন অভিযোগ ছিলনা কঙ্কনার। কোনদিন ওর মুখে হাসি ছাড়া কিছু দেখেনি শৈবাল।

সময় বয়ে গেলো। শৈবাল তার পিএইচডি শেষ করার পরে কাজ পেলো এক বড় কোম্পানিতে। সছলতা এলো জীবনে। কোল জুড়ে এলো এক ফুটফুটে ছেলে। আরও আট বছর পরে এলো এক মেয়ে।

তারপর জীবনের অনেক টা পথ পেড়িয়েছে ওরা চারজন মিলে। দেখেছে পৃথিবীর বিভিন্ন শহর। একে একে ছেলে মেয়ে বড় হোল। নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হোল দুজনে।

ওরা নিজেরা নিজের মত করে বেছে নিলো ওদের প্রিয়জন কে।  ওরা সংসার পাতলো ওদের মত করে।

মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হয়। ছেলে মেয়েরা মানুষের মত মানুষ হয়েছে। ঘরে এসেছে বৌমা, এসেছে জামাই। এবার ওদের ছুটি। ওরা শুধু আনন্দ ফুর্তি করে ঘুরে বেড়াবে সারা পৃথিবী।

এত সুখ এত আনন্দ ওদের ভাগ্যে সইল না।

কঙ্কনা একদিন বলল, আমার মাজায় ভীষণ ব্যাথা।  আমি আর পারছি না।

শৈবাল নিয়ে এলো কঙ্কনা কে হাসপাতালে। বিভিন্ন টেস্ট, সিটি স্ক্যান, এমআরআই করা হোল।

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ছেলেমেয়েরা মায়ের পাশে। শৈবাল হলঘরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। কাঁধে হাতের পরশে শৈবাল ফিরে তাকাল। পালমোনোলজিস্ট​। ফিরে তাকাতেই বলল, একটা কথা বলব, আপনার স্ত্রীর ফুসফুসে একটা স্পট দেখা যাচ্ছে, মনে হয় ক্যান্সারাস। অবশ্য বায়োপসি করার পরে বলতে পারবো।

শৈবালের মনে হোল, চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো, এ সত্যি নয়। 

বায়োপসি রেজাল্ট ভালো এলো না। ফুসফুসে ক্যান্সার। ধরা পড়েছে অনেক পরে।

শৈবাল কঙ্কনার বিছানার পাশে এসে বসলো, চুমো দিয়ে বলল, ভয় করোনা সোনা। এখন অনেক নতুন নতুন ওষুধ বেড়িয়েছে। তুমি ভালো হয়ে যাবে।

কঙ্কনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমাকে নিয়ে বেহেশত আমি এই পৃথিবীতেই বানিয়ে ছিলাম, আমার কোন আফসোস নেই। আর কি জানো, আল্লাহ যখন আমাকে এত সুখ দিয়েছিল তখন তো আমি বলিনি কেনও দিলে, আজ যখন সে আমাকে নিতে চলেছে তখন কেনও বলব হোয়াই মি?

কেমথেরাপি দেওয়া শুরু হোল। আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকলো। কিন্তু বেশি দিনের জন্য নয়। মাত্র আড়াইটা বছর। কেমথেরাপি আর কাজ করলো না। শৈবাল ছুটে গেলো আরও বড় হাসপাতালে। যেখানে ওরা এই বিষয়ে রিসার্চ করে। ক্লিনিকাল ট্রয়াল  অনেক ঔষধ আছে। সে সব ঔষধের পরীক্ষা নিরীক্ষা তখনো শেষ হয়নি। ডাক্তার বলল, ঐ ঔষধ দিয়ে দেখা যেতে পারে। কাজ হলেও হতে পারে।

দেওয়া হোল, কাজ হোল না। কঙ্কনা তখন কষ্টের শেষ সীমানায় পৌছে গেছে। শৈবাল উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়ে গেলো অঙ্কলজীস্টের কাছে। জিজ্ঞাসা করল, মিরাকেল কি ঘটেনা? হয়ত আবার সে আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যেতে পারে?

অঙ্কলজীস্ট কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, আমার ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা তে আজ পর্যন্ত কোন মিরাকেল ঘটেনি। তুমি মন শক্ত করো। ওকে যেতে দাও।

শৈবাল দুই হাতে মুখ ডেকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসেছিলো।

ততক্ষনে নার্স কঙ্কনার শরীরে লাগানো যন্ত্রপাতি গুলো খুলেতে শুরু করেছে।

সব শেষ, আস্তে আস্তে কঙ্কনার সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এলো। ও চলে গেলো সেই না ফেরার দেশে।

কান্নার রোল উঠলো ক্যান্সার সেন্টারের ২২২ নম্বর কক্ষে। কাঁদছে ছেলে সুশান্ত, কাঁদছে মেয়ে সুস্মিতা। কাঁদছে শৈবাল।

দীর্ঘ চল্লিশটা বছর হাতে হাত ধরে যার সাথে পথ চলেছিল, সব বাঁধা বিপত্তি পাড় করেছিল, সে আজ তাকে একলা রেখে চলে গেলো।

যাওয়ার আগে একদিন কঙ্কনা বলেছিল, তোমাকে একলা রেখে আমি চলে যেয়েও শান্তি পাবনা। তুমি তো রান্না করতে জাননা। খাবে কোথায়, থাকবে কি ভাবে?

হায়রে, চলে যাওয়ার আগেও তার চিন্তা শুধু শৈবাল কে নিয়ে।

ছেলে মেয়েরা যার যার বাসায় ফিরে গেছে।

শৈবাল আজ একলা। চল্লিশ টা বছরের বিবাহিত জীবনের একটা দিনও খুজে পেলো না যেখানে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু ছিল।

বিশাল বাড়ীটায় আজ নেই কোন কোলাহল, নেই কোন টুংটাং শব্দ। আছে শুধু তার হাতের ছোঁয়া।   

 নিস্তব্ধ শূন্য বাড়ীতে সে আজ একা।

স্মৃতির ভাড়ে আজ সে ক্লান্ত। জানে না এর শেষ কোথায়।

Continue Reading

শেষ দেখা

 শান্তিপুর গ্রামে। গ্রাম বলতে যা বুঝায়। একটা পাকা রাস্তা, যা চলে গেছে চুঁচড়ার দিকে। সেই রাস্তার  দুই পাশে আছে ছোট ছোট দোকান। কোনটা মুদির দোকান, কোনটা বা চুল কাঁটার। স্কুল আছে, অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত। আর আছে একটা খাবারের দোকান। সকালে বিষ্ণু তার দোকানের সামনে পরটা ভাজে। লোকেরা অলস ভাবে এসে বসে। চা খায়, সাথে পরটা। গল্প চলে।

বেশির ভাগ লোকেরই আছে জমি। সেই জমিতে ওরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের তরকারি করে। বাজারে বিক্রি করে। কিছু বকাটে ছেলে যে নাই তা নয়। তবুও বলতে গেলে শান্তি পূর্ণ গ্রাম।

ইকবালের বাবার আছে মুদিখানা। মাঝে মাঝে ইকবাল  এসে বসে ঐ মুদিখানায়। তার বিদ্যা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত।

তার ঝোঁক রান্না বান্নায়। মা র কাছে বসে দেখে মা র রান্না। মা কে বলে, পিয়াজ একটু বেশি দাও মা।

মা হেসে বলে, দেখো, আর এক রাধুনী এসেছে। যা তাড়াতাড়ি দোকানের দিকে যা, বাবা বকা দেবে।

অগত্যা তাকে উঠতে হয়।

বিষ্ণু  ইকবালের বাবার বয়সী। বাবা যখন দোকানে থাকে ও তখন বিষ্ণুর দোকানে যেয়ে মিষ্টি বানানো শেখে। পরটা ভাজে। বিষ্ণু ওকে খুব আদর করে। নিজের ছেলে মেয়ে নেই, তাই বোধ হয় ওর উপর টানটা একটু বেশি।

এক সকালে ইকবালের বাবা জহরত আলি দোকান খুলতে এসে দেখে দোকানের বেঞ্চে শুয়ে আছে একটা ছেলে।

কাছে এসে দেখল সে। মনে হোল আট নয় বছর বয়স। হাতটা বুকের কাছে নিয়ে সকালের ঠাণ্ডা থেকে একটু বাঁচতে চাইছে মনে হোল।

গায়ে হাত রাখতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো ছেলে টা। জহরত আলি আগে কখন ওকে দেখেছে বলে মনে পড়ে না।

-কি নাম তোমার? এখানে কি ভাবে এলে?

ছেলে টা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর কেঁদে ফেললো। জহরত আলি বুঝে পেলো না কি করবে।

-তোমার বাসা কোথায়? কে আছে তোমার সাথে? কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ছেলে টা দুই হাত দিয়ে চোখ মুছল।

তারপর উঠে দাড়িয়ে হাটতে আরম্ভ করলো।

 জহরত আলি প্রথমে কি করবে বুঝতে পারলো না। পরক্ষনে মনে হোল এত ছোট ছেলে কে এইভাবে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। হেটে যেয়ে ছেলেটার হাতটা ধরতেই ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে জহরত আলি কে জড়িয়ে ধরলও।

আস্তে আস্তে নিয়ে এলো ওর দোকানে।

বলল, এখানে বসো। বলে দোকানের ঝাপ টা উঠালো। 

বিষ্ণু এতক্ষণে চলে আসার কথা। আজ কেনও যে দেরি করছে বুঝতে পারলো না। ও এলে দুজনে মিলে একটা কিছু ঠিক করতে পারত, কি করা যায় ছেলে টাকে নিয়ে।

ছেলেটার মুখটার দিকে তাকালও, ছেলেটা চেয়ে আছে ওর দিকে। মনে হোল কি যেন বলতে চাইছে।

দুরে দেখতে পেলো বিষ্ণু হেটে আসছে।

কাছে এসেই জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

-ছেলেটা শুয়ে ছিল এই বেঞ্চে। কোন কিছুই তো বলছে না।

-দাড়াও, আমি দোকান টা খুলে ওর জন্য একটা পরোটা বানিয়ে দেই। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছে। একটু স্বাভাবিক হয়ে নিক, তাহলে হয়তো সব বলবে।

বিষ্ণু তড়িৎকর্মা লোক, কিছুক্ষনের মধ্যে পরটা আর ডিম বানিয়ে নিয়ে এলো।

-খাও বাবা, কোন ভয় নেই। বলে ওর সামনে প্লেট টা এগিয়ে দিলো।

ছেলে টা প্রথমে তাকালও ওদের মুখের দিকে। তারপর খেতে শুরু করলো। ওদের কাছে মনে হোল অনেক দিন সে যেন কিছু খায়নি।

বিষ্ণু আস্তে আস্তে নিচু গলায় জহরত আলি কে বলল, বড় মায়া ভরা চেহারা।

-আর একটা পরটা দেবো, বাবা।

-না, বলে তাকাল বিষ্ণুর দিকে।

-তোমার নাম কি সোনা।  বলে বিষ্ণু একটা চমচম ওর হাতে দিলো।

ছেলে টা বড়বড় চোখ করে তাকালও চমচম টার দিকে। যেন এই প্রথম দেখল। পুরোটা মুখের মধ্যে দিতে যেয়ে একটু থামল, তারপর অর্ধেক টা মুখে পুরে দিলো।

বিষ্ণু আবারও জিজ্ঞাসা করলো, তোমার নাম কি?

-রজত। বলে বাদ বাকি মিষ্টিটা অল্প অল্প করে কামড় দিয়ে খেতে থাকলো।

-তা বাবা রজত এখানে এলে কি ভাবে? বিষ্ণু ওর পাশে বসে মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

-বাবা, রাতে নামিয়ে দিয়ে গেছে। পরে আসবে। বলে পানির গ্লাসটা থেকে ঢকঢক করে পানি খেলো।

-তোমার বাড়ী কোথায়? কাছেই ? জায়গার নাম কি?

রজত তাকাল ওদের দুজনের দিকে। মাথা নাড়াল। জানে না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, শিমুলপুর।

শিমুলপুর? এ নাম তো ওরা কেউ শোনে নি। 

দু এক জন লোক আসতে শুরু করেছে। সব পরিচিত মুখ। প্রতিদিন সকালে ওরা আসে। বসে রৌদ তাপায়। চা খায়। সবাই শুনল ঘটনা টা। এক একজন এক এক পরামর্শ দিতে থাকলো। কেউ বলল, পুলিশের কাছে দিয়ে দিতে। কেউ বলল, এতিমখানায় পাঠিয়ে দিতে।

-পুলিশের কাছে দিলে ওরা কি করবে কোন ঠিক আছে। আর এতিমখানা? জানোই তো এতিমখানার অবস্থা।

তার চেয়ে বরং, বলে একটু থামল বিষ্ণু। দাড়াও আমার বৌ এর কাছ থেকে শুনে আসি। বলে হনহন করে রওয়ানা দিলো বাড়ীর দিকে।

রজত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল লোকগুলোর দিকে। এক সময় বেঞ্চ থেকে উঠে এসে জহরত আলির জামাটা আঁকড়ে ধরে লেপটে রইল ওর গায়ের সাথে।

দেখা গেলো বিষ্ণু আর ইকবাল কে। ওরা খুব দ্রুত হেটে আসছে। কাছে এসেই ইকবাল রজতের হাতটা ধরলও। পথে আসতে আসতে বিষ্ণু সবকিছু বলেছে ইকবালকে। ইকবাল রজতের হাত ধরে দোকানে ভিতর নিয়ে এলো।

বিষ্ণু তাড়াহুড়া করে আসাতে একটু নিশ্বাস নেওয়ার জন্য বসলো বেঞ্চে। তারপর বলল, বৌ রাজি আছে। আপাতত ছেলেটা আমার বাসায় থাকবে। পরে কেউ যদি খোঁজ নিতে আসে তখন আমরা সবাই সত্যতা যাচাই করে রজত কে পাঠিয়ে দেবো। তোমরা সবাই কি বলও।

কেউ কেউ বলল রাজি, বাকীরা চুপ করে রইল।

রজত খেলছে ইকবালের সাথে। দাঁড়িপাল্লা নিয়ে।

হঠাৎ ইকবাল বলল, বাবা, রজত কে আমাদের বাসা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো?

-যাও, আর বিষ্ণু কাকার বাসাতেও নিয়ে যাও। বলে দোকানের ভিতরে এসে বসলো।

রজতের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। ইকবালের পাশে পাশে  হেলে দুলে চলেছে সে । মাঝে মাঝে দৌড়িয়ে যেয়ে রাস্তার পাশে মুরগী টাকে ধাওয়া দিচ্ছে। মনের ভিতরের ক্রন্দন ভাবটা কমে এসেছে। তবুও মাঝে মাঝে বাবার মুখ টা মনে পড়ছে। বাবা আসবে বলেছিল। মার মুখ টা মনে পরে আবছা আবছা। পরে যে মা টা এসেছিল, সে কেনও ওকে বকা দিতো? ও তো শুধু আর একটু দুধ চেয়েছিল খাবে বলে।

-মা দেখো কাকে নিয়ে এসেছি। বলে জোড়ে ডাক দিলো ইকবাল।

-কে এই ছেলে টা? মা বলতে বলতে এগিয়ে এলো।

রজত দেখতে পেলো একটা কবুতর বকবকুম বকবকুম করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে দৌড়িয়ে গেলো ওটাকে ধরবে বলে।

ইকবাল মা র কাছে এসে বলল আজকের ঘটনা।

-তা সারাদিন কিছু খেয়েছে ছেলেটা? যা মুড়ি আর পাটালি আছে, নিয়ে এসে ওকে দে। আহা রে কোন হতচ্ছাড়া এই কাজ করল। ওই বেটা কি মানুষ? বলে রজতের হাতটা ধরে নিয়ে এসে বসালো রান্না ঘরের মেঝেতে।

আর সেইক্ষণে রজত জোড়ে কেঁদে উঠল। জড়িয়ে ধরলও ইকবালের মা কে।

কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকল, আমার বাবা কোথায়, আমার বাবা কোথায়।

-আসবে সোনা, তোমার বাবা আসবে। বলে সান্ত্বনা দিতে থাকলো ইকবালের মা। ওর ও চোখ টা পানিতে ভরে এলো।

-আয় রজত আমরা মুড়ি খাই। বলে ইকবাল ওকে নিয়ে বসল মাদুরের উপর। রজত তখনো ফোফাচ্ছে।

ইকবালের মা শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিলো।

রজত বসলো ইকবালের পাশে।

পাঁচ টা দিন কেটে গেছে। রজতের বাবা ফিরে আসেনি। রজতের ঠাঁই হয়েছে বিষ্ণুর বাসায়। কেউ কেউ আড়ালে কথা উঠিয়েছিল, মুসলমানের ছেলে, থাকবে কিনা অন্য ধর্মের বাসায়।

ধপে টেকে নি। জহরত  আলি মুখের উপর বলেছিল, তাহলে তোমরা তোমাদের বাসায় নিয়ে রাখো, যতদিন না ওর বাসার অথবা ওর বাবার খোঁজ পাওয়া যায়।

বিষ্ণুর বৌ ইন্দু। কোলে তুলে নিলো রজত কে। নতুন জামা কাপড় কিনে নিয়ে এলো। মনের সেই অতৃপ্ত বাসনা আজ পূর্ণ করেছে ভগবান।  রজত কে নিজে হাতে খাইয়ে দেয়। স্কুলে যাওয়ার আগে পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়ে দেয়। বিষ্ণু দেখে তার ইন্দুর মলিন চেহারা কোথায় যেন বিলীন হয়ে গেছে। যে ইন্দু চুপচাপ করে বসে থাকতো তার আজ বসার সময় কোথায়।

শুধু তাই নয় বিষ্ণুর জায়গা হয়েছে অন্য ঘরে। রজত কে পাশে নিয়ে ইন্দু থাকে তার ঘরে । বিষ্ণু একটু আপত্তি তুলেছিল, ইন্দু বলেছিল, না, এখন ও রজত বড় হয়নি। রাতে ঘুমে ভয়ের স্বপ্ন দেখলে ভয় পাবে।

বিষ্ণু হেসেছিল। তারও যে মনটা ভরে উঠেনি তা নয়। অনেকটা বছর পেরিয়েছে ওরা ছিল সন্তানহীন । আজ যখন উপরওয়ালা মুখ তুলে চাইলো তখন তার কাছে অন্য সবকিছুই তো তুচ্ছ।

দিন থেকে সপ্তাহ, সপ্তাহ থেকে মাস পেরিয়েছে। কেউ আসেনি রজতের খোজে। রজতও মিশে গেছে ওদের সাথে। ইন্দু কে মা বলে ডাকে। বিষ্ণুকে বলে বাবা।

স্কুলের বন্ধুরা আসে, খেলা করে। মাঝে মাঝে ইকবাল নিয়ে যায় বাজারে। নিয়ে যায় খালের পাড়ে। বড়শি দিয়ে মাছ ধরেতে যায়, মাছ ওঠে না। নাই বা উঠলো। গুলতি দিয়ে পাখি মেরে বেড়ায়। পাখির গায়ে লাগে না। চিঁ চিঁ করতে করতে ওরা উড়ে যায়।

এইভাবে ছয়টা মাস কেটে গেলো। একদিন দুপুরে চুঁচড়া যাওয়ার বাস টা শান্তিপুর বাস স্ট্যান্ডে থামতেই  নামল একজন মাঝ বয়সী লোক। পাঞ্জাবী পায়জামার উপর চাদর গায়ে। চারিদিকে তাকাচ্ছিল। আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালো জহরত আলির দোকানের সামনে। উসখুস করছিল। জহরত আলি কয়েক বার তাকালও ওর দিকে। আগে কোনদিন দেখেনি এই তল্লাটে।

-কিছু লাগবে?

জহরত আলির কথা শুনেই লোকটা একটু এগিয়ে এলো। কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আমতা আমতা করে বলল, প্রায় ছয় মাস আগে, মানে, আমার সাথে একটা ছোট ছেলে ছিলো, ও প্রস্রাব করবে বলে নামতেই বাস টা ছেড়ে দিয়েছিল। তাড়াহুড়া করে আমি নামতে পারিনি।

 জহরত আলির দুই চোয়াল কঠিন হয়ে এলো। তাকালও আগন্তুকের দিকে।  

-তা রোখকে বলে বাস টাকে তো থামাতে পারতেন। ছয়মাস পরে এসেছেন খোঁজ নিতে। আপনাকে তো —

কথা শেষ করতে পারেনি জহরত আলি, তার আগেই কাঁদতে কাঁদতে লোকটা জহরত আলির হাতটা চেপে ধরল।

-ওকে কি দেখেছেন আপনি? জানেন কি কোথায় পাবো ওকে?

জহরত আলি হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।

বিষ্ণু দেখছিল ওদের দুজন কে। এগিয়ে এলো সে।

-কি ব্যাপার? জহরত দা কি হয়েছে? বিষ্ণু কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলো।

-উনি বলছেন, ছয় মাস আগে একটা ছেলে—

বিষ্ণু তারস্বরে বলে উঠল, না না আমরা এখানে কোন ছেলে কে দেখিনি। আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন খোঁজ নিতে। যান এখান থেকে।

ঠিক সেই সময় দেখা গেলো দুরে রজত আর তার বন্ধু জমির হাটতে হাটতে আসছে এইদিকে। স্কুল ছুটির পরে ওরা প্রতিদিন আসে বিষ্ণুর দোকানে। মিষ্টি খায়। তারপর ইকবাল এলে ওর সাথে খালের পাড়ে যেয়ে খেলা করে। আজও তার ব্যতিক্রম ছিলনা।

কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো রজত। তাকালও আগন্তুকের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পিছন ফিরে দৌড় দিলো। দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইন্দুর কোলে।

-না না আমি যাবো না মা। আমি যাবো না মা। বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো।

ইন্দু কিছুই বুঝতে পারলো না।

-কি হয়েছে সোনা? কোথায় যাবে না?

-যাবো না বাবার সাথে। বলে কাঁদতে থাকলো।

-বাবা বকেছে বুঝি? আজ বাসায় এলে আমি বকা দিয়ে দেবো। বলে তাকাল উঠানের দিকে।

দেখল জহরত আলি আর বিষ্ণুর পাশে এক অপরিচিত লোক।

বুকটা হিম হয়ে গেলো ইন্দুর। বুঝতে বাকি রইল না কোন বাবার কাছে রজত যেতে চাচ্ছে না।

আঁকড়ে ধরে রইল রজত কে।

দুজনেই কাঁদছে।

রজত শুধু জোড়ে জোড়ে মাথা নাড়াচ্ছে আর বলছে, আমি যাবো না আমি যাবো না।

ইন্দুর মুখটা নেমে এলো রজতের কপালে। চুম দিতে দিতে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোকে কেউ নিতে পারবে না আমার কাছ থেকে। কেউ নিতে পারবে না।

আগন্তুক কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।  তারপর চোখ টা মুছে পিছন ফিরে হাটতে আরম্ভ করলো।

Continue Reading

আকস্মিক দেখা

 হাল্কা পাতলা ছেলে মহিম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। যে কিনা মুখ গুজে পড়ে থাকতো বইয়ের পাতায়। ক্লাসে এসে বসতো সামনের সারির পরের সারিতে।  সেই মহিম একদিন প্রেম করে বসবে তাহমিনার সাথে কেউ কি তা ভেবেছিল।

তাহমিনার সাথে প্রেম করতে চেয়েছিল সহিদ, নজিব, মিন্টু। তবে ওদের মধ্যে একটা কন্ডিশন ছিল। যে তাহমিনা কে পাবে সে অন্যদের কে সাতদিন ধরে সকালের নাস্তা খাওয়াবে। তথাস্তু বলে ওরা একটা কাগজে সই করেছিল। কাগজ টা আমাকে দিয়ে বলেছিল, এই তুই একটু আলাপ করিয়ে দেনা ওকে আমাদের সাথে।

আমার সাথে তাহমিনার কথা হয়। সে হেসে কথা বলে আমার সাথে, আমিও বলি। যেহেতু আমার মধ্যে ওর প্রতি কোন দুর্বলতা নেই কাজেই সহজ ভাবেই আমরা কথা বলি।

ওদের কে আমি বলেছিলাম, প্রেম তো অংক কষে প্লাস মাইনাস করে হয় না। সাহস করে এগিয়ে যা। বুক দুড়দুড় যদি করে তবে আর ও পথে পা বাড়াস না।

ওদের ভাগ্যে শিকে ছিড়ল না। শিকে ছিড়ল মহিমের ভাগ্যে। মহিমের জিত হোল।   

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কেউ বা উচ্চশিক্ষার্থে কেউ বা চাকরির সন্ধানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে যোগাযোগে ভাটা পড়ল। হারিয়ে গেলো সহিদ, নজিব, মিন্টু।

তারপর বহু বছর পেড়িয়ে গেছে। আমি চলে এলাম অনেক দুরে। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়ে সময় টা কেটে যাচ্ছিল।  এমনি একদিন নাট্যমেলায় দেখা মহিমের সাথে। চিনতে অসুবিধা হয়নি। সেও আমাকে চিনতে পেরেছিল। হাল্কা পাতলা সেই মহিম আর হাল্কা পাতলা নেই। মোটা ফ্রেমের চশমা হারিয়ে গেছে ডিজাইনার চশমার মাঝে। পাশে যে দাড়িয়ে ছিল তাকে তাহমিনার মুখমণ্ডলের সাথে মিলাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মিললও না।

-কিরে চিনতে পারছিস না? বলে হাত টা এগিয়ে দিলো।

-পেরেছি, তবে—

কথা টা আমাকে সে শেষ করতে না দিয়ে বলল, পরিচয় করিয়ে দেই। অনামিকা। আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক।

কুশল আদান প্রদানের পর আমরা একে অপরের ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম। সেই মুহূর্তে আমার ডাক পড়লো স্টেজ থেকে।

বললাম, এবার যেতে হবে। তুই চলে যাসনে।

-তুই কি নাটক করিস নাকি? একটু আশ্চর্য হোল সে।

বললাম, এই আর কি, সময় কাটান। ফিরে এসে যেন দেখা পাই তোর। বলে চলে গেলাম।

সব কিছু শেষ হতে একটু সময় নিলো। ফিরে এসে দেখলাম সে সেখানে নেই। খুজলাম হলের চারিদিকে।

কোথাও পেলাম না তাকে। একটা প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরে বাড়াচ্ছিল। যে প্রশ্ন টা করতে পারিনি অনামিকার সামনে।

ও বলেছে ওরা কলিগ। এই পর্যন্ত।

তাহলে—

আমার অংক মিললও না। দুয়ে দুয়ে চার হোল না।

কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ায় আর ফোন করা হয়ে উঠেনি।

ওর কাছ থেকেই কল এলো।

সেদিন ছিল শুক্রবার। কাজের শেষে দুই চারজন মিলে এসে বসেছিলাম রেস্তরাঁয়। এখানে আমরা প্রায় প্রতি শুক্রবারে আড্ডা দেই।

-হ্যালো বলতেই সে বলল, অত্যন্ত দুঃখিত। সেদিন শেষ পর্যন্ত না থাকা তে। অনামিকার একটা জরুরি কল এসেছিল। তাই চলে যেতে হয়েছিল। তা আমরা কি কোথাও একদিন বসতে পারি?

-অবশ্যই। তা কবে কোথায় তুই বল। বলে আমি কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে রইলাম।

-রবিবার সন্ধ্যা ছয়টায় ডিটমাস আর থারটিসেভেন স্ট্রীটের কর্নারে একটা সিফুড রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে।

বললাম, ঠিক আছে। দেখা হবে।

দেখা হয়েছিল সেদিন মহিমের সাথে। কোথা থেকে সে শুরু করবে ঠিক করতে পারছিল না।

আমিই জানতে চাইলাম তাহমিনার কথা।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোর নিশ্চয় মনে আছে, আমাদের শেষ পরীক্ষার পরে আমরা সবাই মিলে বসেছিলাম তাজ রেস্টুরেন্টে।

বললাম, সে কথা কি ভোলা যায়।

সেদিন হৈ হুল্লার মাঝে তাহমিনা আমাকে বলেছিল, বাবা মা খুব চাপ দিচ্ছে বিয়ে করতে। বলেছিল, ওর মার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তাই কখন কি হয়, দেরি করতে চায় না।

ওকে বলেছিলাম, তাহলে আমি তোমার বাবা মা কে বলি, যদিও আমার এই মুহূর্তে কোন চাল চুলো নেই। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট থেকে বলেছে রেজাল্ট বের হবার পরে আমাকে লেকচারার করে নেবে।

আমি জানতে চাইলাম কি হয়েছিল  তারপর।

সে বলল, দেখা করলাম, ওর মা বলল, আগে লেকচারার হও তারপর দেখা যাবে।

তুই তো জানিস লেকচারার পদ টা আমি পাইনি।

বললাম, জানি তোকে দেওয়া হয়নি। কারন তুই প্রথম হতে পারিস নি। হয়েছিলি দ্বিতীয়।

-হ্যাঁ। কয়েকদিন পরে গিয়েছিলাম ওদের বাড়ীতে। ওর মার তখন অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে। নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। ও এসে বলেছিল, তুমি এখন যাও। পরে কথা হবে।

তারপর অনেক দিন সে আর যোগাযোগ করেনি। আমি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলাম।

বেশ কিছুদিন পরে গেলাম ওদের বাসায়। থমথমে ভাব। তাহমিনা এলো। দেখে মনে হোল অনেকদিন ঘুমায়নি। শুধু বলল, মা আর নেই।

বলতে চাইলাম, আমাকে একটু জানালে পারতে? না, আমার বিবেকে বাধল। এই মুহূর্তে কোন প্রশ্ন নয় শুধু শোনা।

সে বলল, আমরা যা ভেবেছিলাম তা এখন হবার নয়। বাবার দেখাশুনার ভার আমার। অন্য কোনকিছু আমি এই মুহূর্তে চিন্তা করতে পারছি না।

ঘণ্টা খানেক বসেছিলাম ওদের বৈঠকখানায়। ওর বাবার সাথে দেখা হয়নি। ও এক সময় এসে বলল, খেয়ে যেও।

বললাম, না, আজ আসি।  এই বলে বেড়িয়ে এসেছিলাম।

তারপর বেশ কয়েক মাস চলে গেছে পিছনে। মাঝে মধ্যে গিয়েছি ওদের বাসায়। কোন সময় ওর দেখা পেয়েছি কোন সময় পাইনি।

এর মাঝে একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম আমেরিকা যাওয়ার। দেখা করলাম ওর সাথে। ও বলল, যাও, ফিরে এলে বাধবো সংসার।

আমি কালামারী খেতে খেতে শুনছিলাম ওর কথা। ও থামতেই জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর?

-সেই শেষ দেখা।

-মানে? আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।

তুই তো জানিস সেই সত্তর দশকে আমেরিকা আর বাংলাদেশের সাথে ফোনে যোগাযোগের ব্যবস্থা আজকের মতো ছিল না। তাছাড়া ওদের বাসায় ফোন ছিল না। শুধু চিঠির উপর নির্ভরশীল।

সেই চিঠিও একদিন বন্ধ হয়ে গেলো। আমি উতলা হয়ে উঠলাম। দেশে যেতে চাইলেই যাওয়া সহজ নয়। তাছাড়া আমার থিসিস জমা দিতে হবে। দেড়ি হয়ে গেলো যেতে। যখন গেলাম ওর খোঁজ আর পেলাম না।

আবার ও আমি অবাক হলাম। খোঁজ পেলিনা মানে?

ওদের বাসায় যেয়ে কড়া নাড়তেই যে এসে দরজা খুলে দিলো তাকে আমি চিনিনা। জিজ্ঞাসা করলাম, এই বাসায় যারা থাকতো তারা কোথায়।

সে বলল, সে জানে না।

ভিতর থেকে এক ভদ্রলোক বেড়িয়ে এলেন। বলল, এই বাড়ীর লোকেরা চলে গেছে। আমরা ভাড়া নিয়েছি এই বাড়ী।

কোথায় গিয়েছে? জিজ্ঞাসা করতেই বলেছিল

জানিনা, বলে গেছে ভাড়াটা আমার এক আত্মীয় মাসে মাসে এসে নিয়ে যাবে।

এরপর আর তাকে খুজে পাইনি। দেশেও আর ফিরে যাইনি। বলে সে আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে তাকিয়ে রইল প্লেটের দিকে।

বুঝলাম, নিজেকে কান্না থেকে সংবরণ করার চেষ্টা করছে।

আমি সেই মুহূর্তে আবহাওয়া টাকে হাল্কা করার চেষ্টায় বললাম, তা সেই অনামিকা টা কে?

মহিম তাকাল বলল, নিতান্তই বান্ধবী। এবার জিজ্ঞাসা করবি বিয়ে করেছি কিনা। না করিনি।

দুজন দুজন কে বিদায় দিয়ে যখন রাস্তায় নামলাম তখন বৃষ্টি পড়ছে। ও চলে গেলো ওর গাড়ীর কাছে।

আমি বসলাম আমার গাড়ীতে। নিজের মনে মনেই বলতে থাকলাম কেন দুটো জীবন এক না হয়ে দুদিকে চলে গেলো। তাহমিনা, সেই বা কোথায়?

এখানেই নাটকের যবনিকা হওয়া উচিৎ ছিল । কিন্তু হোল না। আমরা ভাবি এক আর উপরওয়ালা ভাবেন অন্য ভাবে।

মহিমের সাথে আমার যোগাযোগ রয়ে গেলো। আমরা প্রায় মিলিত হই। কখন বা ব্রেকফাস্টে কখনও বা লাঞ্চে।

ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ এ চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। চুল সাদা হয়েছে। মাজাতে ব্যাথা। রাতে গাড়ী চালাতে গেলে রাস্তার দাগ গুলো দেখতে পাইনা স্পষ্ট ভাবে।

মেয়েকে ব্যাথার কথা বললে সে হাসতে হাসতে বলে, আব্বু তুমি মাঝে মাঝে ভুলে যাও তোমার বয়স হয়েছে।

মহিমের অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। পড়ে যেয়ে মাজায় চোট পেয়েছিল ভীষণ। থেরাপি তে কাজ হয়নি। ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে। বাসায় দেখার লোক নেই। অগত্যা তাকে যেতে হয়েছে নার্সিং হোমে। আমি সপ্তাহে একদিন যাই। বসে গল্প করি।

সেদিনও নিয়ম মাফিক বিকেলের দিকে উপস্থিত হলাম। ওকে দেখলাম না ওর রুমে। নার্স কে জিজ্ঞাসা করতেই বলল সে লনে বসে আছে।

গেলাম, একজন মহিলার সাথে বসে গল্প করছে। ও আমাকে দেখল। চোখে হাসির ছোঁয়া। আমি এগিয়ে এলাম।

দাঁড়ালাম ওদের পাশে। তাকালাম মহিলার দিকে। চেয়ে রইলাম অবাক দৃষ্টি তে।

তাহমিনা? মুখ দিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বেড়িয়ে এলো।

-তাহলে চিনতে পেরেছ? বলে হাসতে লাগলো।

আমি কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

-বস। বলছি সব। বলে হাসতে থাকলো মহিম।

অনেকদিন ওকে এই ভাবে প্রান খুলে হাসতে দেখিনি।

সে বলতে আরম্ভ করলো, গত পরশুদিন রাতে গিয়েছি ডাইনিং রুমে। খেতে খেতে তাকালাম দুটো টেবিল পরে কর্নারের টেবিল টার দিকে। দেখলাম মহিলা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চশমাটা খুলে মুছে নিলাম। না, ভুল দেখিনি। তাহমিনা। সেও তাকিয়ে আছে অবিশ্বাসের মত।

আমি লাঠি টা হাতে নিলাম। আস্তে আস্তে এলাম ওর টেবিলে।

জিজ্ঞাসা করলাম তুমি এখানে কবে এলে।

সে বলল, গত পরশু।

আমি জানতে চাইলাম কেউ আছে সাথে।

সে বলল, না। তোমার?

আমি বললাম, না  কেউ নেই।

জিজ্ঞাসা করিনি এতদিন কোথায় ছিলে। সে সব অতীত। অতীত নিয়ে ঘাটা ঘাটি করতে চাই না।

ঠিক করেছিস। আমি বললাম।

তাহমিনার চোখের হাসিটা আমি ভুলতে পারছিলাম না। সারা মুখ টা ঘিরে একটা আলোর জ্যোতি ফুটে উঠছে।

আমি বললাম, আজ থেকে আমার আর আসার দরকার নেই।

-বাজে কথা থাক। কাল একটু সকাল সকাল আসিস কথা আছে।

সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বেড়িয়ে পড়লাম। ওদের দুজনের মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকলো।

যুগ যুগ আগে ওরা যা চেয়েছিল আজ তা সম্পন্ন হতে চলেছে।  বিনোদনের হল টা সাজানো হয়েছে বিভিন্ন ফুল দিয়ে। দুটো চেয়ার পাশাপাশি। মহিমের এক হাতে হাটার লাঠি অন্য হাত দিয়ে শক্ত করে ধরেছে তাহমিনার হাত। পরনে লাল পাঞ্জাবি। তাহমিনা পড়েছে সাদার উপর ছোট ছোট লালের ফোঁটা আর লাল পাড়ের শাড়ী। অপূর্ব লাগছিল ওকে।

ওরা এসে বসলো চেয়ারে। মাথায় টুপি পরে মওলানা সাহেব এসে দাঁড়ালো পাশে।

আমি হলাম সাক্ষী।

Continue Reading

আবার হোল দেখা

 সতী কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যাবে আর একবার ভিন দেশে। সেই যে গিয়েছিলাম ছয় বছর আগে। আর তো গেলে না।

 ও চুপ করে ছিল। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল।

বলল, যেতে চাই আর একবার।

চোখে চোখ রেখে বলল, জানো, অনেক দ্বিধা। অনেক ভয় ভয় মন নিয়ে সেদিন তোমার সাথে গিয়েছিলাম। তার জন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। নিজে ইচ্ছে করে তোমার থেকে একটা দূরত্ব তৈরী করে নিয়েছিলাম।  তুমি বুঝতে পেরেছিলে। সরে গিয়েছিলে আমার থেকে। প্রতিদিন যেখানে কথা হতো সন্ধ্যা ছয়টার পরে, কাজ থেকে বাড়ী ফেরার পথে সেটা এসে দাঁড়ালো সপ্তাহে একদিন। আজও সেটাই বজায় রয়েছে। 

সত্যি বলতে কি আজ আর কান দেই না ও সব কেচ্ছা তে। যাব, কবে যাবে ?

বললাম, দুই মাস পরে। তৈরী থেকো।

অনেকদিনের ইচ্ছে আমার Croatia দেশ টা দেখার। সময় পেয়েছি কিন্তু সাথে কাউকে পাইনি। তাই আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। আজ সতী রাজি হওয়াতে Gate1 Travel এর সদ্য আসা বই টা খুলে বসলাম। দেখলাম, ভালো একটা Deal আছে। Croatia, Slovenia, Serbia, Montenegro নিয়ে বারো দিনের সফর। সতী কে বলতেই সে বলল, মন্দ কি।

তাহলে প্রস্তুত হয়ে নাও, একমাস পরেই যাত্রা করবো।

বছর কেটে যায় চোখের পলকে আর এক মাস তো চোখ বুজতেই চলে এলো।

আমি এলাম কেনেডি এয়ারপোর্টে। ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে আধাঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো। ফোন করলেও ফোন ধরছে না। সোজা ভয়েসমেলে চলে যায়। একটু চিন্তা হোল, তাহলে কি সে যাবে না? না, এমন সে করবে না। ভাবতে ভাবতেই ওর উজ্জ্বল হাসিতে ভরা মুখটা দেখতে পেলাম।

-কি ব্যাপার-

কথা শেষ করার আগেই বলল, আর বলো না, পাসপোর্ট টা ভুলে রেখেই তো রওয়ানা দিয়ে দিয়েছিলাম। একটু আসতেই মনে হোল পাসপোর্ট তো নিয়ে আসিনি। ওটা তো বিছানার উপর পরে আছে। ভাগ্য ভালো বেশি দুর যাইনি। যাক বাদ দাও, চলো লাইনে দাড়াই।

এতগুলো কথা সে একসাথে বলে আমার দিকে তাকাল।

বকা দেবো ভাবে ছিলাম। তা আর হলনা।
সিকিউরিটি শেষ করে আমরা এলাম এয়ার ফ্রান্সের লাউঞ্জে। বিকেল চারটায় আমাদের ফ্লাইট।

কফি আর সাথে একটা পেস্ট্রি নিয়ে এসে বসলাম জানালার পাশে। সতী নিলো চা আর একটা স্যান্ডউইচ।

ওর পড়নে ছিল কালোর উপর সাদা বর্ডার দেওয়া সালোয়ার কামিজ। খুব সুন্দর লাগছিল দেখতে।

সময় হোল গেটের কাছে যাওয়ার। এসে দাড়ালাম। ওর সীট টা জানালার পাশে। তাই দেখে বলল, এখনো মনে রেখেছ?

-ভুলতে পারলাম কই?

প্লেন ছাড়ল। প্রথম স্টপ জুরিখ।

সাত ঘণ্টা আকাশে উড়ে অবশেষে জুরিখ এয়ারপোর্টে  এসে পৌছালাম এখানকার সময় ভোর ছয়টায়। ছোট্ট এয়ারপোর্ট। বাহিরে ঝিরঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। দুরের পাহাড় সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন।

ছয় ঘণ্টা পরে আমাদের ফ্লাইট। যাবো Belgrade, Serbia তে।

সতী কে বললাম, ঐ যে বেঞ্চ টা খালি আছে, একটু শুয়ে চোখটা বন্ধ করবে কি?

ও বলল, না, তার চেয়ে চলো এক কাপ চা খাই কোথাও বসে।

একটা দোকানই খোলা ছিল। সেখানে চা নেই, আছে কফি।

চলবে? জিজ্ঞাসা করলাম।

-অগত্যা কি করা যাবে, বলে চেয়ারে বসে মাথাটা এলিয়ে দিলো দেয়ালে।

Serbia র রাজধানী Belgrade. এসে পৌছালাম দুপুর দুটোই। বাহিরে দাড়িয়ে ছিল Gate1এর লোক। গাড়ীতে করে নিয়ে এলো হোটেলে। নাম Moskva.

Ivona দাঁড়িয়েছিল হোটেলের লাউঞ্জে। পরিচয় হোল। বয়স তিরিশের কোঠায় মনে হোল। মুখে হাসি  লেগেই আছে। আজ থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ও আমাদের গাইড। একে একে পরিচিত হোল সে সবার সাথে। ওর কাছে সবার রুমের চাবি। সবাইকে দিতে দিতে সে এসে দাঁড়ালো আমার আর সতীর কাছে।

তাকালও আমাদের দিকে। বলল, তোমাদের দুজনের আলাদা আলাদা রুম?

বলে সে একটু লজ্জিত হোল মনে হোল।

বললাম, হ্যা, এসেছি একসাথে, থাকি আলাদা, বলে হাসলাম।

সেও আমার সাথে হাসিতে যোগ দিলো।

সতী বলল, মনে আছে কি,  এই প্রবলেম আমাদের গতবারেও হয়েছিল।

আজ রেস্ট। আগামীকাল সকালে দেখবো শহর টাকে। বলে Ivona বিদায় নিলো।

আমার আর সতীর রুম পাশাপাশি। বললাম, রাতে তো খেতে হবে, আজ ওরা ডিনার দেবে না। তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। সন্ধ্যার আগেই বের হবো।

ও ওর দরজা বন্ধ করলো। আমি ঢুকলাম আমার ঘরে।

কখন যে চোখটা বন্ধ করেছি মনে নেই। দরজায় টোকার শব্দে চোখ মেলে চাইলাম। জানালার বাহিরে সূর্যের আলো টা ম্লান মনে হোল।

সতী দাড়িয়ে।

-কি বের হবে না? তুমি ঘুমিয়ে ছিলে? আহা, কেন আমি তোমাকে ঘুম থেকে উঠালাম?

-এসো, দুই মিনিট লাগবে আমার তৈরী হতে।  বলে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।

অচেনা শহরে হাটতে ভালোই লাগছিল। সন্ধ্যা হয় হয়।

সতী বলল, গতবার Langkawi তে আমাদের হোটেল ছিল সমুদ্রের  পাশে। আমরা পানির পাশ দিয়ে হেঁটেছিলাম।

সন্ধ্যায় বসে ছিলাম সমুদ্রের পাড়ে। মনে পড়ে? এবার শহরের মাঝে। চারিদিকে আলোর ঝলকানি।

-তোমার সব মনে আছে দেখছি? বলে বললাম, চলো ঐ যে একটা রেস্টুরেন্ট ওখানে খেয়ে নেই।

হোটেলে যখন ফিরে এলাম তখন রাত নয় টা। সতী ওর ঘরের চাবি বের করলো। বললাম, সকাল সাত টায় নিচে নামব নাস্তা করতে।

-ঠিক আছে। বলে সে দরজা বন্ধ করে দিলো।

সকালে আমরা সবাই কে নিয়ে Ivona বের হোল শহর টা দেখাতে। সুন্দর সকাল। তাপমাত্রা ৬৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট। মিলিটারি মিউজিয়াম, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ভিক্টর মনুমেন্ট ফিরে এলাম বাসের কাছে।

যাবো জসেফ টিটোর কবর দেখতে

এই দেশের নাম ছিল যুগোস্লাভিয়া। তারই প্রেসিডেন্ট ছিল টিটো।

এখন ভেঙে হয়েছে Croatia, Montenegro, Serbia, Slovenia, Bosnia and Herzegovina, and Macedonia।

দেখা শেষে ফিরে এলাম হোটেলে।

সতী বলল, এতসব কিছুই জানতাম না।

রাতে ডিনারে পরিচয় হোল ডায়ানা আর জুলিয়ার সাথে। ওরা এসেছে মেরিল্যান্ড থেকে।

Belgrade শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থান Zegrab. Croatia র রাজধানী। বাসে আমাদের সিটের সামনে বসেছিল ডায়ানা আর জুলিয়া। সব মিলিয়ে আমরা ৪২ জন। তার মধ্যে এই দুজনের সাথে আমাদের বন্ধুত্ত হোল বেশি। সতী কত কথাই না বলতে থাকলো জুলিয়ার সাথে।

শুধু কানে এলো ও বলছে, না আর কিছু নই, শুধু বন্ধু।

Belgrade থেকে Zegrab ছয় ঘণ্টার পথ। এসে পৌছালাম সন্ধ্যায়। হোটেল সেরাটনের লবিতে আমি আর সতী বসে রইলাম ডিনার শেষে। ও বসেছিল দুরে এসে বসলো কাছে, পাশে নয়। বলল, এই চলা আর কদিন পরে শেষ হয়ে যাবে। আমরা আবার যে যার মত ব্যাস্ত হয়ে পড়বো নিজেদের কে নিয়ে। তাই না?

বললাম, এটাই তো নিয়ম। তবে সেলফোন টা আছে।

ও হেসে উঠল।

Ivona বলেছে সকাল নয়টায় লবিতে থাকতে। আটটায় আমরা এলাম নাস্তা করতে। সবাই এসে গেছে। ডায়ানা ডাক দিলো, ওদের টেবিলে দুটো চেয়ার খালি আছে। হরেক রকম খাবার। ক্রুসেন্ট, টোস্ট আর ডিম সানি সাইড আপ নিয়ে এসে বসলাম। সতী নিলো অমলেট আর টোস্ট। সাথে ডেনিশ।

কথায় কথায় জুলিয়া বলল, ওর বিয়ে হয়েছিল উনিশ বছরে। সেই বিয়ে টেকেনি। তবে একটা মেয়ে হয়েছিল। সেই মেয়েকে বড় করেছে একা। এত বছর একলাই ছিল, দশ বছর আগে ডেভিডের সাথে পরিচয় হয় এক পার্টিতে। আজ ওরা সুখে আছে।

Ivona এসে সবার সাথে দেখা করে গেলো। আমরা এসে দাঁড়ালাম লবিতে। আজকের গাইড Valentina.

নিয়ে এলো Jelacic Square এ। দেখলাম Gric Tunnel, Archaeiligical Museum, Zagreb Cathedral, Museum of Broken Relationship.

গেলাম আমরা কয়জন মিলে টিটোর জন্ম ভূমি Kumrobec এ। যেখানে সে বড় হয়েছিল। দেড় ঘণ্টার পথ। চারিদিকে সবুজ পাহাড়। আঁকাবাঁকা রাস্তা। এলাম, দেখলাম। ডিনার করলাম পাহাড়ের উপর এক রেস্তোরায়।

পাহাড়ের ঢালুতে আমরা দুজন পা ছড়িয়ে বসলাম। দুরের পাহাড়ের উপরে মেঘ।

সতী বলল, আবার কবে দেখব এই সৌন্দর্য।

আল্লাহ যেন আবার আসতে দেয় তোমার সাথে। চল, সবাই চলে যাচ্ছে। বলে সে উঠল।

Zagreb থেকে Slovenia, যাবো ওর রাজধানী Ljubljana. উচ্চারণ লুবলিয়ানা। রাস্তা খালি। তিন ঘণ্টার মধ্যে পৌছে গেলাম ছোট্ট শহরে। অনেক টুরিস্টের আনাগোনা। মাথার উপর রৌদ। আমাদের আজকের গাইডের নাম সেমিনা। দেখলাম, Preseren Square, Triple Bridge, Ljubljana Castle, Dragon Bridge, Tivoli Park,

Ljubljana Cathedral, Central Market.

দেখা শেষে রওয়ানা দিলাম Bled এর পথে। ওখানে রাত কাটাবো।

রাস্তার দুপাশে ঘন সবুজ গাছ। দুরে আল্পস পাহাড় । পাহাড়ের উপর জমে আছে বরফ। ৪টায় এসে পৌঁছালাম Bled, Slovenia তে। আমাদের হোটেল টা ছোট একটা পাহাড়ের উপরে। নিচে দেখা যায় লেক। তার চারিপাশে রেস্টুরেন্ট ।সন্ধ্যা হয়ে এলো। Ivona আমাদের কে নিয়েএলো লেকের পাশের রেস্টুরেন্টে ডিনার খাওয়াতে।

দুরে পাহাড়ের চুড়ায় Bled Castle. কি অপুর্ব দৃশ্য।

সকালে গাড়ী নিয়ে এলো সেই পাহাড়ের চুড়ায়। Bled Castle দেখতে। ধীরে ধীরে পা ফেলে উঠে এলাম Castle এর চুড়ায়।  নিচে নীল পানি , দুরে পাহাড়।

সতীকে বললাম, এদিকে মুখ ফিরে দাড়াও। নিচের নীল পানির সাথে তোমার নীল সালোয়ার কামিজ এক হয়ে গেছে। এর ছবি না নিলেই নয়।

ও বলল, ফিরে যেতে মন চাইছে না।  

-তবু ফিরে যেতে হবে। জানো তো কাল যাবো Plitvice Lake দেখতে, Croatia তে।

এসো, দুই মিনিট লাগবে আমার তৈরী হতে।  বলে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।

অচেনা শহরে হাটতে ভালোই লাগছিল। সন্ধ্যা হয় হয়।

সতী বলল, গতবার Langkawi তে আমাদের হোটেল ছিল সমুদ্রের  পাশে। আমরা পানির পাশ দিয়ে হেঁটেছিলাম।

সন্ধ্যায় বসে ছিলাম সমুদ্রের পাড়ে। মনে পড়ে? এবার শহরের মাঝে। চারিদিকে আলোর ঝলকানি।

-তোমার সব মনে আছে দেখছি? বলে বললাম, চলো ঐ যে একটা রেস্টুরেন্ট ওখানে খেয়ে নেই।

হোটেলে যখন ফিরে এলাম তখন রাত নয় টা। সতী ওর ঘরের চাবি বের করলো। বললাম, সকাল সাত টায় নিচে নামব নাস্তা করতে।

-ঠিক আছে। বলে সে দরজা বন্ধ করে দিলো।

সকালে আমরা সবাই কে নিয়ে Ivona বের হোল শহর টা দেখাতে। সুন্দর সকাল। তাপমাত্রা ৬৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট। মিলিটারি মিউজিয়াম, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ভিক্টর মনুমেন্ট ফিরে এলাম বাসের কাছে।

যাবো জসেফ টিটোর কবর দেখতে

এই দেশের নাম ছিল যুগোস্লাভিয়া। তারই প্রেসিডেন্ট ছিল টিটো।

এখন ভেঙে হয়েছে Croatia, Montenegro, Serbia, Slovenia, Bosnia and Herzegovina, and Macedonia।

দেখা শেষে ফিরে এলাম হোটেলে।

সতী বলল, এতসব কিছুই জানতাম না।

রাতে ডিনারে পরিচয় হোল ডায়ানা আর জুলিয়ার সাথে। ওরা এসেছে মেরিল্যান্ড থেকে।

Belgrade শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থান Zegrab. Croatia র রাজধানী। বাসে আমাদের সিটের সামনে বসেছিল ডায়ানা আর জুলিয়া। সব মিলিয়ে আমরা ৪২ জন। তার মধ্যে এই দুজনের সাথে আমাদের বন্ধুত্ত হোল বেশি। সতী কত কথাই না বলতে থাকলো জুলিয়ার সাথে।

শুধু কানে এলো ও বলছে, না আর কিছু নই, শুধু বন্ধু।

Belgrade থেকে Zegrab ছয় ঘণ্টার পথ। এসে পৌছালাম সন্ধ্যায়। হোটেল সেরাটনের লবিতে আমি আর সতী বসে রইলাম ডিনার শেষে। ও বসেছিল দুরে এসে বসলো কাছে, পাশে নয়। বলল, এই চলা আর কদিন পরে শেষ হয়ে যাবে। আমরা আবার যে যার মত ব্যাস্ত হয়ে পড়বো নিজেদের কে নিয়ে। তাই না?

বললাম, এটাই তো নিয়ম। তবে সেলফোন টা আছে।

ও হেসে উঠল।

Ivona বলেছে সকাল নয়টায় লবিতে থাকতে। আটটায় আমরা এলাম নাস্তা করতে। সবাই এসে গেছে। ডায়ানা ডাক দিলো, ওদের টেবিলে দুটো চেয়ার খালি আছে। হরেক রকম খাবার। ক্রুসেন্ট, টোস্ট আর ডিম সানি সাইড আপ নিয়ে এসে বসলাম। সতী নিলো অমলেট আর টোস্ট। সাথে ডেনিশ।

কথায় কথায় জুলিয়া বলল, ওর বিয়ে হয়েছিল উনিশ বছরে। সেই বিয়ে টেকেনি। তবে একটা মেয়ে হয়েছিল। সেই মেয়েকে বড় করেছে একা। এত বছর একলাই ছিল, দশ বছর আগে ডেভিডের সাথে পরিচয় হয় এক পার্টিতে। আজ ওরা সুখে আছে।

Ivona এসে সবার সাথে দেখা করে গেলো। আমরা এসে দাঁড়ালাম লবিতে। আজকের গাইড Valentina.

নিয়ে এলো Jelacic Square এ। দেখলাম Gric Tunnel, Archaeiligical Museum, Zagreb Cathedral, Museum of Broken Relationship.

গেলাম আমরা কয়জন মিলে টিটোর জন্ম ভূমি Kumrobec এ। যেখানে সে বড় হয়েছিল। দেড় ঘণ্টার পথ। চারিদিকে সবুজ পাহাড়। আঁকাবাঁকা রাস্তা। এলাম, দেখলাম। ডিনার করলাম পাহাড়ের উপর এক রেস্তোরায়।

পাহাড়ের ঢালুতে আমরা দুজন পা ছড়িয়ে বসলাম। দুরের পাহাড়ের উপরে মেঘ।

সতী বলল, আবার কবে দেখব এই সৌন্দর্য।

আল্লাহ যেন আবার আসতে দেয় তোমার সাথে। চল, সবাই চলে যাচ্ছে। বলে সে উঠল।

Zagreb থেকে Slovenia, যাবো ওর রাজধানী Ljubljana. উচ্চারণ লুবলিয়ানা। রাস্তা খালি। তিন ঘণ্টার মধ্যে পৌছে গেলাম ছোট্ট শহরে। অনেক টুরিস্টের আনাগোনা। মাথার উপর রৌদ। আমাদের আজকের গাইডের নাম সেমিনা। দেখলাম, Preseren Square, Triple Bridge, Ljubljana Castle, Dragon Bridge, Tivoli Park,

Ljubljana Cathedral, Central Market.

দেখা শেষে রওয়ানা দিলাম Bled এর পথে। ওখানে রাত কাটাবো।

রাস্তার দুপাশে ঘন সবুজ গাছ। দুরে আল্পস পাহাড় । পাহাড়ের উপর জমে আছে বরফ। ৪টায় এসে পৌঁছালাম Bled, Slovenia তে। আমাদের হোটেল টা ছোট একটা পাহাড়ের উপরে। নিচে দেখা যায় লেক। তার চারিপাশে রেস্টুরেন্ট ।সন্ধ্যা হয়ে এলো। Ivona আমাদের কে নিয়েএলো লেকের পাশের রেস্টুরেন্টে ডিনার খাওয়াতে।

দুরে পাহাড়ের চুড়ায় Bled Castle. কি অপুর্ব দৃশ্য।

সকালে গাড়ী নিয়ে এলো সেই পাহাড়ের চুড়ায়। Bled Castle দেখতে। ধীরে ধীরে পা ফেলে উঠে এলাম Castle এর চুড়ায়।  নিচে নীল পানি , দুরে পাহাড়।

সতীকে বললাম, এদিকে মুখ ফিরে দাড়াও। নিচের নীল পানির সাথে তোমার নীল সালোয়ার কামিজ এক হয়ে গেছে। এর ছবি না নিলেই নয়।

ও বলল, ফিরে যেতে মন চাইছে না।  

-তবু ফিরে যেতে হবে। জানো তো কাল যাবো Plitvice Lake দেখতে, Croatia তে।

Slovenia কে বিদায় দিয়ে আমরা সকাল নয়টায় নাস্তা শেষে রওনা দিলাম Plitvice Lake National Park দেখতে।

 চার ঘন্টার পথ। আবহাওয়া আজ আমাদের অনুকুলে নয়। ঝিরিঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তাপমাত্রা ৬৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট । এতদিন ঝলমলে রৌদের মাঝে দিনগুলো কাটিয়েছি। আজ না হয় আকাশ টা গোমড়ামুখ হয়ে থাকল, তা থাক, তাতে আমরা হতাশ হয়নি। The Plitvice Lakes Croatia এর সবচেয়ে পুরানো এবং বৃহত্তম ন্যাশনাল পার্ক। অসম্ভব সুন্দর॥ ১৬ টা লেক এসে যোগ হয়েছে জলপ্রপাতের সাথে। স্বচ্ছ লেকের পানি। নিচে লাইমস্টোন। পুরো পার্ক টা ঘুরে দেখতে এক ঘন্টা লেগে গেলো।

রাতে ফিরে এলাম হোটেলে। কাল যাবো Splitএ।

সতী বলল, জানো বাসার কথা বড় মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে অনেক অনেক দিন আমরা বাহিরে।

বললাম, আর মাত্র তিনটা দিন তারপরে তুমি দেখতে পাবে তোমার ছেলে মেয়েদের।

চার ঘন্টা লেগে গেলো Split এ আসতে।

আবহাওয়া গতকালের ঠিক বিপরীত । সুর্যের আলো আজ আর মেঘে ঢেকে নেই। তাপমাত্রা ৮৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপরে চলে গেছে।

গরমে সতীর মুখ লাল হয়ে গেছে। বললাম দাড়াও তোমার জন্য একটা ক্যাপ কিনে আনি।

ও বসে রইল বেঞ্চে। দৌড়ে যেয়ে নিয়ে এলাম।

ও বলল, তোমার এই ছোট ছোট কাজ গুলো মনে থাকবে সারা জীবন।

Split দ্বিতীয় বৃহতম শহর Croatia র। Adriatic Sea এর পাশে। Diocletian’s Palace না দেখলেই নয়। Roman Emperor Diocletian এখানে এসে তার শেষ জীবন কাটিয়ে ছিল । এই বাড়ি তে Game of Throne এর Throne Room (also where dragons are kept) shooting হয়েছিল। দেখা শেষে বসলাম ছাতার নিচে দুপুরের খাবার খেতে।

সতী অর্ডার দিলো ফিস কাটলেট, আমি নিলাম বারগার।

বাস এলো ৪:৩০ টায়। এলাম হোটেলে।

কাল ভোরে বেরিয়ে পড়বো Dubrovnik এর পথে।

Dubrovnik, Croatia এর আর একটি টুরিস্টের শহর। সকাল সকাল আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম । এসে পৌঁছালাম তিন ঘন্টা পর। পুরাতন শহর। চারিদিক Stone Walls . Adriatic Sea এর পাশে। পুরো টা দেখতে ঘন্টা লেগে গেলো।

Montenegro. এটাই হবে আমাদের ভ্রমনের শেষ শহর দেখা।

Ivona বলেছিল সকাল সকাল রওয়ানা দিতে হবে। যেহেতু Montenegro, EU এর ভিতরে নয় তাই বর্ডারে অনেক সময় লেগে যাবে। আমরা সবাই সকাল সাতটায় এসে দাঁড়ালাম লবিতে।

মনে পড়লো প্রথম দিনের কথা।

শুরু করেছিলাম New York থেকে শেষ হলো Montenegro র Kotor টাউনে। চারটা দেশ ঘুরে দেখলাম। এক একটা দেশের সৌন্দর্য এক এক রকম। আমি মুগ্ধ হলাম Montenegro তে এসে। ছোট্ট শহরটাকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে উঁচু পাহাড় । মাঝে Bay of Kotor. নদীর মাঝে অতি ছোট একটা মানুষের তৈরি Island. কথিত আছে ঠিক ঐ জায়গায় একটা জাহাজ টুকরো হয়ে গিয়েছিল। জেলেরা ঐখানে এসে দেখতে পায় Virgin Mary র ছবি ভাসছে। ওরা ঠিক করে এখানেই তৈরি করতে হবে চার্চ ।

বছরের পর বছর ধরে জাহাজ তৈরি করে সেই গুলো কে ডুবিয়ে দিয়ে, বড় বড় পাথর ফেলে ভিত তৈরি করেছিল। সময় লেগেছিল ২০ বছরের উপর। চার্চের নাম Church of Our Lady of the Rocks . ভিতরে আছে সেই Original ছবিটা।

আধো আলো আধো ছায়া মাথায় করে এসে পৌছেছিলাম Montenegro তে। সব দেখা শেষ হতেই আকাশ ভেঙে নামল ঢল সেই সাথে ঝড়ো হাওয়া। দৌড়ে যেয়ে এক কাপ কফি নিয়ে বসলাম ছাতার নিচে। পানির ভারে ভেঙে গেলো ছাতা। সতীর লম্বা কোর্তা টা ভিজে গেলো।

দৌড়ে যেয়ে আমরা দুইজন ঠাঁই নিলাম কফি শপের ভিতরে।

সতীকে বললাম, দাড়াও ওদের কাছে দেখি কাপড়ের ন্যাপকীন আছে কিনা।

সতী বলল, কেন?

-তাহলে তোমার চুল টা মুছতে পারবে।

ও তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

 আস্তে আস্তে বৃষ্টি থেমে এলো।  আমরা এলাম গাড়ীর কাছে।

বিদায় Montenegro. মনে থাকবে তোমার সৌন্দর্য।

রাতে এলাম ফেয়ারওয়েল ডিনার Konova Dubrava তে। Ivona  শেষদিনে ফেয়ারওয়েল স্পীচ দিতে যেয়ে গলাটা কান্নায় বুজে এলো। 

আমরা বিদায় নিলাম সবাই সবার কাছ থেকে।

জুলিয়া, ডায়ানা জড়িয়ে ধরল আমাদের কে।

বলল, কীপ ইন টাচ।

হোটেলে ফিরে এসে আমরা দুজন লবিতে বসে থাকলাম অনেক রাত পর্যন্ত।

সতী বলল, বারোটা দিন তোমার সাথে সুন্দর ভাবে কেটে গেলো। আবার কবে আসবো বলতে পারো কি?

-না, জানি না। তবে আসিব নিশ্চয় কোন না কোন দিন।

সতী হাসতে হাসতে বলল, তুমি কি তোমার রবি ঠাকুরের কবিতা বলছ।

-না, আমার নিজের। চলো, রাত হোল। কাল সকালে ফ্লাইট।

Continue Reading

সন্ধ্যা তাঁরা

                          

রাত বারোটা। কেবল চোখ টা বুজে এসেছিল। টুং করে শব্দ হোল ফোন টা তে। ম্যাসেজ এসেছে। ঘুমানোর আগে আমি ওটাকে সাইলেন্টে দিয়ে রাখি। আজ ভুলে গিয়েছিলাম। তারই খেসারত দিতে হোল। সামন্তী পাঠিয়েছে ম্যাসেজ টা। লিখেছে , তুমি ঘুমাও নি আমি জানি। তাই সরি বলছি না। এখনি আমাকে কল করো, জরুরী কথা আছে।

ও মনে করে আমার উপর তার অধিকারের সীমা নেই। যখন তখন কোন খবর না দিয়েই চলে আসবে। বাসায় আমি আছি কি না আছি তার তোয়াক্কা করে না। আমার যে একটা পার্সোনাল লাইফ আছে সেটা সে মানতে রাজি না। হয়তো আমিই সেই বেড়া টা উঠিয়ে দিয়েছিলাম।

পরিচয় হয়েছিল আমার বান্ধবী সামীনার বাসায়। আমরা ছিলাম একই ডিপার্টমেন্টে একই ক্লাসে।

 বন্ধু বান্ধবীর আমার অভাব নেই। অথচ আমি আজও চিরকুমার রয়ে গেলাম। লেখা পড়া আর অনেক ডিগ্রী গলার মধ্যে ঝুলাতে যেয়ে দেখলাম সময় পেড়িয়ে গেছে। না, সে কথা বললে ভুল হবে, দেখা হয়েছিল একজনের সাথে, অপর্ণা।

সে কথা থাক, এখন বলব সামন্তীর কথা।

কি আর করা। ফোন করতেই, সে বলল আমি জানি তুমি ঘুমাও নি। শোন, এক মাস পরে সামির গ্রাজুএশন। তোমাকেই সব ব্যাবস্থা করতে হবে।

-এই কথা বলার জন্য তুই আমাকে এত রাতে কল করেছিস ?  একটু রাগান্বিত স্বরে বললাম।

-হ্যা, কাল সকালে হয়তো মনে থাকবে না। তাই। তুমি রাগ করেছো? তুমি ছাড়া আর কে করে দেবে, বলও।

ও জানে আমি ওর উপর রাগ করলেও ওটা ক্ষণস্থায়ী।

-ঠিক আছে, কাল সন্ধ্যায় আসিস আমার বাসায়। কি কি করতে হবে সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে। এখন আমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করি। বলে আমি পাশ ফিরে শুলাম।

ওর সাথে পরিচয় হওয়া টাও একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সামীনার বাসায় দাওয়াতে এসেছিল কয়েকজন বন্ধু বান্ধবী। সামীনার হাতে ফুলের তোরা টা দিতেই চোখে চোখ পড়লো বসে থাকা বাচ্চা মেয়েটার দিকে। ওকে এড়িয়ে অন্যদের সাথে হাত মেলাতে যাবো তখনি সে বলে উঠলো, আমাকে আপনার চোখে পড়লো না?

ফিরে তাকালাম। মনে হোল বাচাল।

-না, তোমার সাথে পরিচয় নেই কিনা, তাই—

কথা শেষ না হতেই বলল, আমার নাম সামন্তী। আর ঐ যে ছেলে টা দেখছেন ও আমার ছেলে।

বুঝলাম ও আমাকে বুঝিয়ে দিল ও বাচ্চা মেয়ে নয়।

-ও তাই। তুমি কিন্তু লুকিয়ে রেখেছ তোমার বয়সটা তোমার আচলের ভিতর। বলে ভাবলাম, প্রথম পরিচয়ে এই কথা বলাটা ঠিক হোল কিনা।

সামীনা এসে দাড়াল, বলল, তোদের পরিচয় হয়েছে? ও সতীর ছোট বোন।

-আমিই পরিচয় করে নিলাম, সামীনা আপা। উনি তো আমাকে পেড়িয়ে চলে যাচ্ছিল ছোট মেয়ে ভেবে।

-তুই পারিসও বটে। বলে সামীনা চলে গেলো অন্য ঘরে। 

এ ঘরের সবাই আমার চেনা। ওর বোনের সাথেও আমার পরিচয় আছে, তবে ঘনিষ্ঠতা নেই।

ওর পাশেই বসলাম আমি।

-এসো, তোমার সাথে আলাপ-পরিচয় করি। বলে হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আমার নাম তৌফিক। 

আলাপে আলাপে জানলাম সে থাকে আমার থেকে পনেরো মাইল দুরে। স্বামী মারা গেছে বছর দুয়েক হোল।

ছেলের বয়স আট। বয়স তার ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। থাকে একা। বোন থাকে বেশ দুরে। ঘণ্টা খানেকের পথ।

বললাম, পরিচয় হোল। এই আমার ফোন নাম্বার। আমি তোমার কাছাকাছিই থাকি। দরকার পড়লে কল দিতে ভুলো না।

কল একদিন এসেছিল, অনেক রাতে। ফোন টা ধরতেই কান্না কান্না স্বরে বলল, তৌফিক দা একটু আসবে আমার বাসায়, মুন্না যেন কেমন করছে।

ঠিকানা নিয়ে ওর বাসায় পৌছালাম, রাত তখন দুটো। মুন্না কে দেখে মনে হোল এখনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। নিয়ে এলাম কাছাকাছি একটা হাসপাতালে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ওরা নিয়ে গেলো ভিতরে।

ওকে বললাম, কেঁদো না। ভিতরে যখন নিয়ে গেছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

ভোর সাতটায় মুন্না কে ছেড়ে দিল। ডাক্তার বলে দিল, ওর হাঁপানি রোগ আছে। ওটাই অ্যাটাক করেছিল। চিন্তার কোন কারন নেই। 

মুন্নার যে হাঁপানি রোগ আছে সেটাই সে জানতো না।

সেই ঘটনার পরে অনেক অনেক বার ও এসেছে আমার বাসায়। আমরা আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে তুই এ চলে গেছি।

আজ ও জানে ওর একটা বড় ভাই আছে কিছু দুরে। বিপদে আপদে সেই সম্বল। অধিকার টাও তার অনেক বেশি।

অনুষ্ঠান টা সম্পন্ন হয়েছিল খুব সুন্দর ভাবে। ওর বাসার ব্যাক ইয়ার্ডে।

স্পীচ দিতে যেয়ে কেঁদেছিল সে। কাঁদা টাই স্বাভাবিক।

সবাই যখন চলে গেলো, রইলাম শুধু সে আর আমি।

ও এসে বসলো আমার পাশে। বলল, তুমি এক হাতেই তো সব করলে।

বললাম, না, তুই তো পাশে ছিলি।

ও ওর মাথা টা আমার কাঁধে এলিয়ে দিলো। 

ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম, অনেকদিন ধরে বলছি, তোর বয়স আর কতই বা হোল এবার কারোর সাথে ঘর বাধার কথা চিন্তা কর।

ও বলল, জানো তৌফিক দা, তোমার জেনারেশন আর আমার জেনারেশনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।

তোমরা ভালবাসতে মন প্রান দিয়ে, আর এখনের ভালবাসা উড়ো উড়ো।

তুমি মনে করছ আমি চেষ্টা করি নি। অন লাইনে কয়েকজনের সাথে কথাও হয়েছে। দেখাও করেছি। কিন্তু কেউ কমিটমেন্ট করতে রাজে নয়। একজন তো বলেছিল, বিয়ে কেন,  চলো, আমরা বন্ধু হয়ে ঘুরে বেড়াই। সেটাই ভালো নয় কি? বোঝো?

একজন তো বেশ কয়েক দিন ঘোরার পরে  আর আমার টেক্সটের উত্তরই দিলো না। He ghosted me.

বুঝলাম, কেটে পড়েছে।

এসব ছেলেদের প্রবলেম টা কি বলও তো?

আমি বললাম, তা আমি কি করে বলব। আমি তো  তোদের যুগের মানুষ নই।

তারপর হাসতে হাসতে বলল, তুমিও শাদি ডট কমে তোমার নাম টা এন্ট্রি করো। নয়ত অন লাইনে ডেটিং কর। দেখবে পাকা চুলের কাউকে পেয়ে যাবে। আর কতকাল একলা থাকবে?

ও সব নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। বলে ওর মাথায় একটা চাট্টি মারলাম।

অতি কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল তার।

কলেজে উঠেছে মাত্র। কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ওকে দেখেছিল ডাক্তার আসিফ আহমেদ। সবাই উনাকে চাচা বলে ডাকে। এসেছিল অনেক আগে এই দেশে। ফিরে আর যাওয়া হয়নি। এখানকার ডাক্তারির লাইসেন্স টা নিয়ে একটা হাসপাতালে চাকরি শুরু করেছিল। ধাপে ধাপে অঙ্কলজী ডিপার্টমেন্টের হেড হয়েছিল। দেখা হয়েছিল এক জার্মান মহিলার সাথে ঐ হাসপাতালে। তাকে নিয়েই ঘর বেধেছিল।

সামন্তী কে দেখে প্রস্তাব দিয়েছিল ওর মা র কাছে।

-আপনার মেয়ে টাকে কি আমি আমার পুত্রবধূ করে নিতে পারি?  বলে হাসতে হাসতে বলেছিল, এলাম বিয়ে খেতে আর এখানেই কিনা নতুন সম্বন্ধ করতে চলেছি।

 সামন্তীর মা বলেছিল,আপনার প্রস্তাব টা আলাপ করে দেখব অন্যদের সাথে।

সামন্তীই ছোট, অন্য পাঁচ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সামন্তীর বাবা মারা গেছে আজ প্রায় ছয় বছর হোল। মেয়ে আর জামাইদের উপর সে নির্ভরশীল।

তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছোট টাকে পাড় করে দিতে পাড়লে উনিও শান্তি পান।

বড় জামাই রাজি ছিল না। তবে বলেছিল, আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই করেন।

ধুমধাম করে একদিন বিয়ে হয়ে গেলো সামন্তীর আবিদের সাথে। কোন কিছু বুঝতে না বুঝতেই পেটে এলো  সামি। ওর জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় আবিদ মারা গেলো গাড়ী দুর্ঘটনায়।

বলতে গেলে সামি কে ওর দাদা আসিফ আহমেদই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে যতদিন বেচে ছিলেন। শাশুড়ি চলে গিয়েছিল তারও আগে।

ও একটা কপাল পোড়া মেয়ে।

আজ দশটা বছর ও জড়িয়ে আছে আমার জীবনে। সেই যে প্রথম দেখা হয়েছিল সেই থেকে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রইল আমার সাথে। কাজের শেষে প্রতিদিন আসে আমার বাসায়। কোনদিন বা রাতে খায় আমার সাথে, কোনদিন বা না খেয়ে চলে যায় সানির সাথে খাবে বলে।

সানির কথা ভাবতে ভাবতে আমি চলে যাই অনেক পিছনে। আমার ছোট বেলায়।

সবেদার মার চেহারাটা ভেসে ওঠে। থাকতো একটা কুঁড়ে ঘরে। মাঝে মাঝে আসতো মা র কাছে। সাথে আসতো সবেদা। আমরা দুজনে এক্কা দক্কা খেলতাম। আস্তে আস্তে সময় চলে গেলো পিছনে। ওর বিয়ে হয়ে গেলো। আমি তখন স্কুলের শেষ ক্লাসে। মা মানা করেছিল, বলেছিল এই অল্প বয়সে বিয়ে দিসনে। সবেদার মা বলেছিল, কি করব আপা, ওর বাবা নেই, আমারও বয়স হচ্ছে, হাজার হলেও মেয়ে তো।

বছর পাঁচেক পরে সাদা শাড়ী পরে ছোট্ট একটা মেয়েকে হাতে ধরে ফিরে এসেছিল ওর মার ভিটা তে। ওর মা তখন চলে গেছে। আমার মা র কাছে বাচ্চা টাকে রেখে যেতো অন্যের বাসায় কাজ করতে। কারো হাত সে আর ধরে নি। বাচ্চা টাকে মানুষ করবে এই ব্রতই সে নিয়েছিল। সে আজ অনেক আগের কথা।

জানি না আজ সে কোথায়। মনে হয় কোথায় যেন মিল আছে সামন্তীর সাথে।

আমি ভাবি, সানি চলে যাবে কলেজে। হয়তো দুরে। একলা হয়ে যাবে ও। শ্বশুরমশায় চলে গেছে। একলা ঘরে থাকবে একা।

বলেছিলাম চলে আয় আমার বাসায়। আমরা ভাই বোন মিলে কাটিয়ে দেবো বাদ বাকি জীবন টা। যতদিন না তুই খুজে পাশ কাউকে।

ও বলেছিল, তারপর ঐ যে তোমার আড়ালে আবডালে কথা বলার মানুষ গুলো, তাদের মুখ বন্ধ করবে কি ভাবে?

তুমি না হয় ঐ পথে পা বাড়াবে না কিন্তু আমাকে তো আজ হোক কাল হোক কাউকে পেতে হবে। সেকি আসবে? না ভুরু কুচকাবে?

বলেছিলাম, যার মনটা সন্দেহে ভরা তাকে তোর জীবনে জড়াবি কেনও?

তোমার মত সবাই নয় মিস্টার পণ্ডিত। বলে চা বানাতে চলে গিয়েছিল।

এক সন্ধ্যায় আমি বসেছিলাম আমার বাসার উঠানে। ছোট্ট এক চিতলে উঠান। দুটো ইজি চেয়ার পাতা। প্রতি সন্ধ্যায় আমি এখানে বসি। আজও তার  ব্যতিক্রম নেই। আকাশে আজ চাঁদ উঠেনি। শুধু ঝলমলে তারার সারি।

পিছনের দরজা খুলে এলো সে আমার উঠানে।

বললাম, এই ভর সন্ধ্যায়, কি মনে করে?

কেন, তোমার এখানে আসতে কল করে আসতে হবে নাকি?

-না তা নয়। বোস।

-এই সন্ধ্যার অন্ধকারে কি করছ?

-তাঁরা গুনছি।

-একটা কথা বলবে তৌফিক দা। যদিও কোনদিন আমি তোমাকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি, আজ আর না জিজ্ঞাসা করে পারছিনা। বিয়ে শাদি করলে না কেন?

-মনের মত কাউকে পেলাম না বলে।

-এবার কাউকে খুজে নাও। আমি তো সারা জীবন তোমার কাছে থাকবো না। একদিন না একদিন তো আমি কাউকে খুজে পাবো। সেদিন হয়ত তোমার কাছ থেকে অনেক দুরে চলে যাবো। তুমি থাকবে একলা। এটা আমি সহ্য করতে পারবো না।

-পাগলি, চোখ টা মোছ। আমি একা কে বলল তোকে? ঐ যে দেখছিস আকাশের কোণে জ্বলজ্বল করছে তাঁরা টা। ওটা আছে আমার সাথে।

-মানে?

-ঐ তো অপর্ণা।

Continue Reading

স্বপ্নভঙ্গ

   অনেক অনেক দিন পরে  রুমার সাথে দেখা হোল গৌরীর এক আত্মীয়র বাসায়। তখন আমার পড়ন্ত যৌবন। সে ও পিছিয়ে নেই। বয়স বেড়েই চলেছে বেহায়ার মত। রুমার সেই দেমাগি চেহারা টা আজ আর নেই। যেটা আমি দেখে ছিলাম ওর যৌবন কালে। তার সেই মসৃন সাদা চামড়ার উপর কে যেন লেপটে দিয়েছে একরাশ কালো কালি।

সে অহংকার করতো তার চেহারা নিয়ে। আজ তা বিলুপ্ত। দামী সালোয়ার কামিজ পড়ে বের হতো সে।

আজ পড়নের শাড়ীটা নিতান্তই আটপৌরে। তার সেই অহমিকা আজ আর আমি দেখতে পেলাম না তার চেহারায়।

সে নিজেই এগিয়ে এলো। চোখ তুলে তাকালও আমার দিকে। চোখের নিচটা কালচে হয়ে গেছে।

-চিনতে পারছেন? বলে আরও কাছে এগিয়ে এলো সে।

-অসুবিধা হয়নি তোমাকে চিনতে। কিছুটা পাল্টিয়েছ।

-অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি, চঞ্চল দা। যাক সে সব কথা। গৌরী কোথায়?

-ভিতরে।

গৌরী আর সে পড়তো একই স্কুলে, একই শ্রেণীতে।  গৌরীর বাসায় যাতায়েত ছিল আমার। গৌরীই বলেছিল আমাকে, জানো ও ভীষণ দাম্ভীক। সুন্দরী তো,  একটু গান জানে তাই ধরাকে সরা জ্ঞান করে। কি বলেছিল সেদিন জানো?

আমি গৌরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কি বলেছিল?

বলেছিল সে অনেক বড়লোকের ছেলে কে বিয়ে করবে। গাড়ী চালিয়ে যখন সে যাবে তখন পথের ধুলা এসে পড়বে আমাদের গায়ে।

-তা স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? বলেছিলাম।

গৌরী ভ্রু কুচকিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল।

এখানে বলে রাখি, গৌরী আর আমার মাঝে প্রেম, ভালবাসা বলে কিছু হয়নি তখনো। পাশের বাড়ী, তাই যাওয়া আসা ছিল। কাহিনী আজ আমাকে নিয়ে নয়, রুমাকে নিয়ে।

বাবা মার এক আদুরে মেয়ে। ভাই ছিল ওর ছোট। বাবার টাকা পয়সার অভাব ছিল না। মেয়ে যা চেয়েছে তাই কিনে দিয়েছে। তার বদ্ধমূল ধারনা, সে দেখতে সুন্দরী। আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকতো অনেক সময় নিয়ে। ( অবশ্য শোনা কথা)

বাবাকে বলেছিল সে গান শিখবে। বাবা গানের মাস্টার রেখেছিল। তবে বেশিদিন টেকেনি। দুই একটা গান গাইতে শিখেই সে ভেবেছিল আর দরকার নেই। এবার স্টেজে গাইবে।

সেই দিনটিও এলো।

 আমাদের ছোট্ট শহরটি সাংস্কৃতিক দিক দিয়েছিল অনেক উন্নত মানের। রাজনীতি নিয়ে মারামারি কাটাকাটি নেই।

ছিল সাংস্কৃতিক সংঘ । শিল্পী সংঘ। গান নাচ শেখানো হতো।

সেই সংঘের এক অনুষ্ঠানে গান গাইল সে। লোকে হাততালি দিয়েছিল। ওতেই ওর মাথাটা আরও বিগড়ে গেলো।

সে নিজেকে উচু দরের শিল্পী মনে করতে আরম্ভ করলো।

স্বপন দা তাকে বলেছিল, তোমার এখনো গান শেখা হয়নি। অনেক কিছু শেখার আছে।

 হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রতিদিন কাজের পরে রেওয়াজ করতে হবে। সে শোনেনি সে কথা। প্রতি অনুষ্ঠানে একই গান গাইত। আস্তে আস্তে মাস যেয়ে বছর পাড় হোল। আমি তখন ঐ শহর ছেড়ে চলে এসেছি রাজধানী তে।

হঠাৎ একদিন দেখা নিউ মার্কেটে।

-এই যে চঞ্চল  দা, এদিকে তাকান।

একটু জোর গলায় ডেকেছিল সে।

তাকালাম।

– রুমা। কবে থেকে এই শহরে? বলতেই পরিচয় করিয়ে দিলো পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের সাথে।

-দুই বছর হয়ে গেলো। আপনার তো জানার কথা। গৌরীর সাথে তো আমার প্রায় দেখা হয়।

-হয়তো ভুলে গেছে। তা তোমার গান বাজনা কেমন চলছে।

-ছেড়ে দিয়েছি। বড় বাজে দর্শক। হাততালি না দিয়ে শিটি মারে। ওসবের মধ্যে আমি আর নেই। রিয়াজ আর আমি অন্য কিছু চিন্তা করছি।

-অন্যকিছু মানে? অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে।

-আর একদিন বলব, আজ চলি। বলে রিক্সায় ওরা দুজন উঠে বসলো।

ভদ্রলোক কে দেখে বয়স্ক মনে হোল।

এরপর সব শুনেছিলাম গৌরীর কাছ থেকে।

রিয়াজ এসেছিল ওর ভাগ্নী কে হোস্টেলে নামাতে। সেখানেই দেখা ওর সাথে। 

সেদিন বাহিরে এসে কোন রিক্সা দেখতে পেলো না রুমা।

রিয়াজ এগিয়ে এসে বলেছিল, রিক্সা খুজছেন, এই সময়ে পাবেন না। কোন দিকে যাবেন?

-উনিশ নম্বর রোডে।

-আসুন আমি নামিয়ে দেবো। আমি ওদিকেই যাবো। যদি আপনার কোন আপত্তি না থেকে এক সাথে রিক্সায় উঠতে।  আমার পরিচয় দেই, আমি রওশোন আরার মামা।

সেদিন সে আপত্তি করে নি।

ওদের বয়সের ব্যবধান ছিল বিশ বছরের। রিয়াজ বলেছিল, সে এক বিরাট কোম্পানির ম্যানেজার।  বাবা মা থাকে বগুরায়। সে থাকে গুলশানে।

কোনদিনই সে তার গুলশানের ফ্লাটে নিয়ে যায় নি।

স্যুইট টকার রিয়াজ কে সে চিনতে ভুল করেছিল। জানতে চায়নি অন্যকিছু। 

বাবা মা কে জানিয়েছিল সে বিয়ে করতে চলেছে রিয়াজ কে।

ওরা সব শুনে বলেছিল, এ ভুল করিস নে মা। তোর চেয়ে বিশ বছরের বড়। ও যা বলেছে সব বিশ্বাস করলি তুই? খোঁজ নিয়েছিলি?

জবাবে বলেছিল, জানতে চাই না। ও আমাকে ভালবাসে। ও বলেছে, বিয়ের পর ও আমাকে নিয়ে আরও বড় একটা ফ্ল্যাটে উঠে যাবে। ওর  টাকা পয়সার তো কমতি নেই।

মা বাবা ওকে ঠেকাতে পারেনি।

ও বিয়ে করেছিল। রিয়াজ গুলশানের ঐ ফ্লাটে ওকে উঠায় নি। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিল টিকাটুলি তে। দুই পাশে বেড়া, উপরে টিনের ছাদ।

কতবার রুমা বলেছিল, তোমার ঐ গুলশানের ফ্লাট কি হোল?

উত্তরে রিয়াজ বলেছিল, আমার বস কিছুদিন থাকবে ওখানে। চটাতে তো পারিনা। হাজার হলেও বস।

রুমা কিছু বলে নি।

মাঝে মাঝে রিয়াজ বাসায় ফেরে না। জিজ্ঞাসা করলে সঠিক উত্তর দেয় না। কোথায় যেন একটা গড়মিল আছে মনে হয় রুমার কাছে।  একদিন অনেক রাতে রিয়াজ  বাসায় আসতেই রুমা বলেছিল সে অন্তঃসত্বা। রিয়াজ ভালো মন্দ কিছুই বলে নি। সেদিন রুমা অনেক কেঁদেছিল।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রুমা। শরীর টা আজ বড় ম্যাজম্যাজ করছে। দুইবার বমি হয়েছে। রিয়াজ বেরিয়ে গেছে সেই সাত সকালে।

দরজা খুলে দেখল এক ভদ্রমহিলা দাঁড়ানো।

-কাকে চাই। জানতে চাইল রুমা।

-এটা কি রিয়াজের বাসা?

-হ্যা, ও বাসায় নেই। ওকে কিছু বলতে হবে?

-ওকে বলবেন ওর বৌ এসেছিল।

-মানে? রুমার মাথাটা টলে উঠল।

-মানে, আমি ওর বিয়ে করা বৌ। নাম শিউলি।  গত দুইদিন আগেও তো সে আমাকে কিছু বলে নি। দুজনে মিলে সিনেমা দেখলাম। আজ যদি সবীরের মা না বলতো তবে তো কোনদিনও জানতাম না সে আমার সতীন নিয়ে ঘর করছে।

দরজা খোলা রেখেই রুমা এসে বসলো একটা চেয়ারে। শিউলি ভিতরে এলো। চেয়ার টেনে বসলো পাশে।

-কতদিন হয়েছে ঐ বদমাইশ টা তোমাকে বিয়ে করেছে।

-দেড় বছর।

-দেড় বছর? আমাকে বলে কিনা সে অফিসের কাজে বাহিরে যায়। গজরাতে থাকলো শিউলি।

-কোথায় থাকেন। জানতে চাইলো রুমা।

-মোহাম্মদপুর।

-গুলশানের ফ্লাটে থাকেন না?

-গুলশানের ফ্লাট? তুমি কি স্বপ্ন দেখছ? ও বলেছে ওর ওখানে ফ্লাট আছে? হারামজাদা। ওর আমি গলা কেটে ফেলব।

রুমা কোন কথা বলতে পারেনি। আবারও বমির ভাব এলো। দৌড়ে চলে গেলো বাথরুমে। সেখান থেকে সে বের হয়নি যতক্ষণ না শিউলি চলে না যায়।

নাওয়া নেই খাওয়া নেই। বসে ছিল চেয়ার টা তে। চারিপাশে সব অন্ধকার হয়ে আসছে।

পাশের বাড়ীর মনিরার মা এসেছিল। ওকে বলেছিল সব কথা।

মনিরার মা  সেদিন রান্না করে দিয়েছিল। চুল বেঁধে দিয়েছিল।

সন্ধ্যায় রিয়াজ এলো।

-অন্ধকার কেনও। লোডশেডিং নাকি? বলে বাহিরে রাখা গামছা নিতে যাবে তখনি রুমা বলল,

-শিউলি এসেছিল। 

চমকে উঠলো রিয়াজ। তাকালও যে দিক থেকে কথা টা এসেছিল সেই দিকে।

দেখতে পেলো আবছা অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে রুমা। সুইচ টা অন করতেই রুমার  অগ্নিঝরা চেহারা টা দেখতে পেলো রিয়াজ।

-আমার জীবন টা কেন তুমি শেষ করলে। আমি তো তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম। এই তার প্রতিদান, অসভ্য, নির্লজ্জ, ইতর। বেরিয়ে যাও এখান থেকে। থরথর করে কাঁপছে রুমা।

মনে পড়লো বাবা,মা নিষেধ করেছিল। সবার কথা উপেক্ষা করে সে বেরিয়ে পড়েছিল এই লোকটার সাথে।  অনেক বড় বাড়ীতে থাকবে। গাড়ী চালাবে। চাকর বাকর থাকবে। এই না চেয়ে ছিল সে।

তাই তো কলেজের ডিগ্রী তার নেওয়া হয়নি।

আজ সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে দরজা টা বন্ধ করে দিলো।

এরপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। চলে এসেছিল সেই ছোট্ট শহরে। বিচ্ছেদ নিয়ে ছিল রিয়াজের থেকে। বাবা, মা যতদিন বেচে ছিল ওরাই দেখা শোনা করেছে। ছেলে টা বড় না হতেই বাবা মা কে হারালও সে। জমি জমা কিছু পেয়েছিল বাপের কাছ থেকে। সংসার চালাতে যেয়ে সেগুলোও বিক্রি করে দিলো।

আজ তার টানা পড়নের সংসার।

-এই শুনছো।

আমি তাকালাম গৌরীর দিকে।

-এদিকে এসো। কথা আছে।

আমি এগিয়ে এলাম।

ও কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, তোমার কাছে কি কিছু টাকা হবে?

-হবে।

-তাহলে দাও।

আমি সব টাকা ওর হাতে উঠিয়ে দিলাম।

ও ভিতরে চলে গেলো।

  1.  
Continue Reading
1 2 3 7