পকেটমার

 ধড়মড় করে উঠে বসল সানু। চোখ কচলাতে কচলাতে তাকালও সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে।

ওহ, কনেস্টবল।  ওর লাথি খেয়ে ঘুম টা ছুটে গেছে।  মনে মনে কনেস্টবল কে গালাগালি দিলো ওর বাপ মা তুলে। এই ব্যাটার কি এসে যায় এই স্টেশনের চত্বরে ও ঘুমালে। ঐ শালা কি জানে সানুর বাসা ঘর বলে কিছু নাই। এই মেঝেই তার বাসা। এই গায়ের কম্বল টাই তার সম্বল।

-এই ওঠ এখান থেকে। বলে লাঠি টা দিয়ে একটা খোঁচা দিলো সানু কে।  

-যাওয়ার তো কোথাও জাগা নেই। ভাই।

-ভাই, ভাই বলবি না। আমি ফিরে এসে যদি দেখি এখানে তবে তোর হাড্ডি ভেঙে দেবো। বলে কনেস্টবল অন্য দিকে গেলো।

সানু কম্বল টা গায়ে পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো পাশের পানির কল টার দিকে। মুখ হাত টা ধুয়ে নিলো। ট্রেন টা আসবে আর একটু পরে। পনের মিনিট থামবে। এই সময়ের মধ্যে কয়েকটা কামরায় যেয়ে হাত পাতলে কেউ কিছু দেবে। একটা রুটির পয়সা উঠলে আজকের সকাল টা চলে যাবে।

কালু টা আজ ওর সাথে শুতে আসেনি। কোথায় গেছে কে জানে।

ট্রেনটা এসে দাঁড়ালো। সানু দৌড়িয়ে যেয়ে একটা কামরায় উঠে পড়ল। হাত পাতলো। কেউ দিলো কেউ বলল, কাজ করতে পারিস না? এই বয়সে ভিক্ষাবৃত্তি আরম্ভ করেছিস।

আর একজন সাথে যোগ দিলো, বলল, এটাই তো সহজ পন্থা।

এইসব কথা সানুকে শুনতে হয় প্রতিদিন। পেটের জ্বালা কি তাতো ওরা জানে না। কাজ করতে চেয়ে ছিল। পায়নি। কেউ দেয়নি। ভাবে ও বোধ হয় চোর। সব চুরি করে নিয়ে পালাবে।

ট্রেন টা চলে গেলো। এবার সে আস্তে আস্তে রওয়ানা দিলো বাসস্টেন্ডের দিকে। ওর বয়সী আরও দুজন আছে। কালু আর ফকা। দিন শেষে সন্ধ্যা নামলে ওরা এসে বসে ট্রেন স্টেশনের বেঞ্চে। নয়টার সময় শেষ ট্রেন টা চলে গেলে ওরা শুয়ে পরে।  কোনদিন বেঞ্চে কোনদিন মাটিতে।

এমনি একদিনে সানু,কালু আর ফকা শোয়ার ব্যবস্থা করছিল। সামনে এসে দাঁড়ালো একজন। কোট পড়া। ওরা ভাবল পুলিশের কোন লোক হবে। কম্বল টা হাতে নিয়ে সানু দৌড় দিতে যাবে, লোক টা ওর হাতটা চেপে ধরলও।

-আমাকে ছেড়ে দিন আমি আর এখানে শোবো না।

-বয়স কত?

-চোদ্দ।

-কাজ করতে চাস?

সানু ভ্যাবাচেকা খেয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

-কি? চাস কাজ করতে? ধমক  দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো লোকটা।

-চাই তো। মিনমিন করে বললও সানু।

-তবে চল আমার সাথে। বলে লোকটা ওর হাতটা ছেড়ে দিলো।

ওরা লোকটার পিছন পিছন মন্ত্রমুগ্ধের মত চলতে থাকলো। লোকটা একবারও পিছন ফিরে তাকালও না।

এসে দাঁড়ালো একটা জীপের কাছে।

-ওঠ। বলে লোকটা উঠে বসলো সামনে। ওরা পিছনে বসলো।

বুকটা দুরুদুরু করছে। একজন আর একজনের দিকে তাকালও। কাজ পাবে এই আশাতেই তারা দৌড় দিয়ে পালায়নি।

গাড়ীটা এসে দাঁড়ালো একটা টিনের ঘরের কাছে। দেখে মনে হোল গুদাম ঘর। লোকটা নেমে এলো। ওরা তিনজন নেমে লোক টাকে অনুসরণ করে এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। দুটো টোকা দিতেই একটা লোক এসে দরজাটা খুলে দাঁড়ালো।

কোট পড়া লোকটা ঢুকল না। শুধু বলল, শম্ভু, এদের কে শিখিয়ে পড়িয়ে নিবি। আমি সাতদিন পরে  আসব।

লোকটার কথার মধ্যে কি যেন একটা আছে যাকে অবহেলা করা যায় না।

-জি বস। বলে লোক টা ওদের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করলো ভিতরে ঢুকতে।

ভয়ে ভয়ে ওরা এলো ভিতরে। সানু যা ভেবেছিল তাই। এটা একটা গুদাম ঘর। মেঝেতে লম্বা করে মোটা কম্বল পাতা। পাঁচ ছয় টা ওরই বয়সের ছেলে বসে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছিল।

লোক টা এবার তাকালও সানুদের দিকে। পাশে রাখা একটা লাঠি উঠিয়ে নিলো হাতে।  

বলল, আমার নাম শম্ভু। এখানকার সর্দার। আমি যা যা বলব তাই করবি। তা নাহলে হাত কেটে ফেলব।

ঐ কোনায় তোদের জায়গা। কাল থেকে ট্রেনিং শুরু হবে।

কি ট্রেনিং,কিসের ট্রেনিং কিছুই বুঝতে পারলো না।

কালু জিজ্ঞাসা করতে মুখটা শুধু খুলেছিল, সানুর চিমটি খেয়ে চুপ করে গেলো।

আস্তে আস্তে ওরা যেয়ে শুয়ে পড়লো ঘরের কোনটাতে।

শম্ভু আলোটা নিভিয়ে দিলো। অন্ধকারে ছেয়ে গেলো ঘরটা।

দরজা খোলার শব্দ পেলো ওরা। শম্ভু বেড়িয়ে গেলো। ঝুম করে একটা আওয়াজ হোল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। বাহিরে তালাটা ঝুলতে থাকলো।

অনেকদিন পর ওরা ঘুমিয়ে ছিল। উপরে ছিল ছাদ, পাশে ছিল দেওয়াল। পাশের ছেলেটার ধাক্কাতে ঘুমটা ভেঙে গেলো।

-এই ওঠ, এখনি সর্দার আসবে। ঘুমাতে দেখলে হাতের বেত টা দিয়ে পাছার ছাল ছিরে ফেলবে।

-নামটা কি তোর ? চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞাসা করলো সানু।

-চন্দন। এক মুখ হাসি দিয়ে বলল সে।

-সকালে খাওয়া দেবে? বেশ অস্থির ভাবে জানতে চাইল কালু।

-দেবে, সর্দার নিয়ে আসবে। পোলাও করমা খাবি? বলে হাসতে থাকলো চন্দন।

-কি কাজ করতে হবে? সানু জানতে চাইল।

-চন্দন হাসতে হাসতে বলল, কাটিং।

-কাটিং?

-হ্যাঁ। মানে—

কথা শেষ হোল না। দরজা খোলার শব্দ পেলো ওরা।

সর্দার ঢুকল। হাতে ব্যাগ। 

সবাই উঠে দাড়িয়ে লাইন দিল। চন্দন পা দিয়ে ঠেলা দিলো সানু কে।

ওরা তিনজন তাড়াতাড়ি করে দাড়িয়ে পড়লো সবার পিছনে। বুঝতে পারলো না কি হতে চলেছে।

সর্দার ব্যাগ টা রাখল টেবিলের উপর। বের করলো রুটি আর হালুয়া।  

একে একে সবাই নিলো দুটো করে রুটি আর হালুয়া। যেয়ে বসলো যার যার জাগায়।

-বুলু, চন্দন, মতি, তোরা যাবি বান্দর নগর বাস টার্মিনালে। মহি, স্বপন, ঝীলু, তোরা যাবি রেল ষ্টেশনে। ঠিক ছয়টায় দেখা করবি আমার সাথে।

 এই তিন ছোড়া এদিকে আয়। বলে ডাক দিলো ওদের কে।

সর্দারের হাতে একটা বেত। বাড়ি দিলো টেবিলে।

সানু, কালু আর ফকা এসে দাঁড়ালো সর্দারের সামনে। হাত পা কাঁপছে। বেশ ভালই তো ছিল, এ কিসের মধ্যে এসে পড়লো। এখনো জানে না কি করতে হবে।

সানু ভাবছিল, খাওয়া টা ভালই ছিল। রুটি, হালুয়া। কতদিন  এই রকম পেট ভরে খায়নি।

চন্দন আর ওরা সবাই বেড়িয়ে গেলো।

-কি করতে হবে জানিস? বলে বেত টা দিয়ে আবারও টেবিলে একটা বাড়ি মাড়ল।

-না, জানি না। গলার স্বর টা নামিয়ে বললও ফকা।

-কাটিং করতে হবে, মানে পকেট মারতে হবে। বুঝলি কিছু? বলে চেয়ার  থেকে উঠে এসে দাঁড়ালো সানুর সামনে। আজকের থেকে তোদের ট্রেনিং শুরু। তিন দিন ট্রেনিং দেবো। তারপর রাস্তায় নেমে যাবি।

মনে রাখিস, আমি কিন্তু সব সময় তোদের চোখে চোখে রাখবো। কোন রকম চালাকি করার চেস্টা করেছো কি বাছাধন, কল্লাটা ফুঁস। বুঝেছিস?

সানু তাকালও কালুর দিকে। মনে হোল ও গামছে। কেমন যেন ফ্যাকাসে মুখ।

সানু গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলল, সব বুঝেছি স্যার।

-স্যার? রাখ তোর স্যার, সর্দার বলে ডাকবি, মনে থাকবে?

-থাকবে সর্দার।

বুকে হঠাৎ করে যেন বল এলো সানুর।

-এদিকে আয়। দাড়া আমার সামনে। এই মানিব্যাগ টা আমি কালুর পকেটে রাখছি। কালু বাসে উঠতে যাচ্ছে, আর আমি এই ভাবে—

বলে দেখালও মানিব্যাগ টা  কি ভাবে কালুর পকেট থেকে চলে এলো সর্দারের হাতে।

ট্রেনিং শুরু হয়ে গেলো।

রাতে চন্দন এসে শুয়ে পড়লো। কোন কথা বলল না। যার মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে তার মুখ টা অন্ধকারাচ্ছন্ন।

-কি হয়েছে তোর? সানু ওর পাশে এসে বসলো।

চন্দন তাকালও সানুর দিকে, চোখ টা ছলছল, বলল, জানিস, আজ যে মেয়েটার ব্যাগ থেকে টাকাটা নিয়ে নিলাম সেই টাকা ওর মা ওষুধের টাকা।

-তুই জানলি কি ভাবে?

-মেয়ে টা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল। আমি একটু দুরে দাড়িয়ে শুনছিলাম। একটা বুড়ো লোক এসে কয়েকটা টাকা ওর হাতে দিয়ে বলল, যাও মা, দেখো এটা দিয়ে ঔষধ কিনতে পারো কিনা।

-শুয়ে পড়। বলে ও নিজের চোখ টা মুছে কম্বল টা টেনে নিলো গায়ের উপর।

ট্রেনিং শেষ।

ঠিক সাত দিনের দিন বস এলো। সন্ধ্যায়।

সর্দার একটা ব্যাগ বসের হাতে ধরিয়ে দিলো। কোন কথা নয়। শুধু চোখাচোখি। বস বের হয়ে গেলো।

কাজে লেগে গেলো সানু, কালু, ফকা। একেক দিন একেক স্থানে। দিন শেষে যা রোজগার হয় তা নিয়ে ওরা সবাই এসে মিলিত হয় এক মিষ্টির দোকানের পিছনের ঘরে। সেখানে বসে থাকে সর্দার। ওর হাতে উঠিয়ে দেয় সারাদিনের রোজগার।

মাস শেষে ওরা কিছু পায়। তাতেই ওরা খুশি। ওই টাকা দিয়ে ওরা আনন্দ করে। মাঝে মাঝে সিনেমা দেখে।

কয়েক মাস কেটে গেছে। সানু হাতের সাফাই ভালো রপ্ত করে ফেলেছে। ট্রেনে, বাসে যেখানে ভিড় সেখানে সে ওঠে। একদিন বাসে এক ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক উঠতে যেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, পিছনে ছিল সানু। হাতদিয়ে ঠেকালও তাকে। ভদ্রলোক পিছন ফিরে ধন্যবাদ জানালো সানুকে। ইতিমধ্যে সে নিয়ে নিয়েছে মানিব্যাগ টা।

বেশ মোটাসোটা মানিব্যাগ। দাঁড়ালো না সেখানে সানু। দ্রুত পায়ে চলে এলো। বসলো এসে এক চা র দোকানে।

খুললও মানিব্যাগ টা। অনেক গুলো টাকা। এত সুন্দর মানিব্যাগ সে দেখেনি আগে। কয়েকটা ভাঁজ ব্যাগটাতে।

একটা ভাঁজ খুলতেই দেখতে পেলো একটা ছোট্ট মেয়ের ছবি।

বের করলো সে। ধরল চোখের সামনে। তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।

ছবি টা মনে করিয়ে দিলো ওর ছোট্ট বোন টির কথা। আপন না। সৎবোন। নাম ছিল টিঙ্কু।

মা মারা যাবার পর বাবা বিয়ে করে ছিল। সৎমা প্রথম থেকেই কেনও জানি ওকে দেখতে পারতো না। শুধু নালিশ দিতো বাবার কাছে। বাবা কোনদিন গায়ে হাত তোলেনি। শুধু বলতো, মার কথা শুনে চলিস।

সৎমা প্রায় ওকে মারত। বলত, দুর হয়ে যা এখান থেকে।

টিঙ্কু এসে জড়িয়ে ধরত। বলত, না, ভাইয়া কোথাও যাবে না।

ওকে কাঁধে করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো। যেয়ে বসতো আম গাছটার নিচে। অঝোরে কাঁদত। শুধু বলত, মা কেন তুমি আমাকে রেখে চলে গেলে। টিঙ্কু ওর ছোট ছোট হাতটা দিয়ে চোখ দুটো মুছিয়ে দিতো।

একদিন ওর বাবা আসতেই মা নালিশ দিলো, সে তার কানের দুল পাচ্ছে না। টেবিলের উপর ছিল। ওর বদ্ধ ধারনা সানু নিয়েছে। সে নাকি ওকে এখানে ঘুরঘুর করতে দেখেছে।

বাবার সেদিন কোন কারনে মেজাজ ভালো ছিল না। হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো সামনে।

জিজ্ঞাসা করলো, নিয়েছিস দুল টা।

-না নেই নি।

-তবে কোথায় গেলো এখান থেকে।

– আমি জানি না।

এই প্রথম বাবা ওর গায়ে হাত তুলেছিল। সেই রাতেই সানু বেড়িয়ে গিয়েছিল বাসা থেকে। শুধু কিছু বলে আসতে পারেনি ছোট্ট বোন টাকে।

অনেকদিন পড়ে মনে পড়ল বাবা কে, টিঙ্কু কে।

মানিব্যাগটা আর ফটো টা রাখল এক পকেটে। টাকা গুলো অন্য পকেটে।

মাঝে মাঝে ভাবে একাজ ছেড়ে দেবে। কিছু টাকা জমেছে। অন্য কোথাও চলে যেয়ে কোন দোকানে কাজ নেবে। কিন্তু সে জানে সর্দারের চোখ চারিদিকে। তাছাড়া বসের লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিকে। পালাবার পথ নেই।

পালাতে চেয়েছিল ঝীলু, পারেনি।  

সেদিন দিনশেষে ঝীলু ফিরে আসেনি ছোট্ট ঘরে। গাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল অন্য কোথাও। শেষ ট্রেনে চলে যাবে ভেবেছিল। উঠেও  ছিল। ট্রেনটা ছেড়ে দিতেই ভেবেছিল, যাক এবার পগার পাড়।

না, পরের ষ্টেশনে দুইটা ষণ্ডা মার্কা লোক উঠলো। এসে বসলো ঝীলুর পাশে। জামাটা উঠিয়ে দেখালও চকচকে ছুরি টা। নামতে বলল।

দুইদিন পরে ফেলে রেখে গেলো ওকে গুদাম ঘরে। সারা শরীরে চাবুকের দাগ। সবাই মিলে শুইয়ে দিলো।

রাতে ঘুমের মাঝে চিৎকার করত। আস্তে আস্তে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। একদিন সকাল বেলা ওরা সবাই বেড়িয়ে পড়লো কাজে। ফিরে এসে ঝীলু কে দেখল না। সর্দার কে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ওকে নিয়ে গেছে হাসপাতালে।

সেই শেষ, ঝীলু আর ফেরেনি।

ঝীলুর মুখ টা সানু ভুলতে পারে না। কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, সানু পারবি ঐ বদমাশ বস টাকে মারতে। আমি আমার সেই গ্রামটাতে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। ওরা আমাকে যেতে দিলো না। আমি আবার নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলাম। ঐ বদমাশ টা আমাকে বাঁচতে দিলো না।

সেই শেষ কথা। ঝীলু আর কথা বলেনি।

সেদিন রোজগার খুব একটা ভালো হয়নি সানুর। সর্দারকে  কৈফিয়ত দিতে হবে। মনটা খারাপ ছিল। বাস থেকে নেমে এক ফলের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। ভাবল একটা কলা খাবে। এমন সময় এক বয়স্ক লোক হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়ালো। বেশভূষায় গরিবিয়ানার ছাপ।

-ভাই দুটো কলা আর কয়েক টা খেজুর দেন। বলে মাজায় বাঁধা একটা পুঁটলি বের করলো।

সানু তাকিয়ে দেখল অনেক গুলো টাকার থেকে বিশ টাকা বের করে দোকানি কে দিয়ে আবারও হন্তদন্ত হয়ে হাটতে থাকলো।

সানুর কলা কিনা হোল না। লোকটাকে অনুসরণ করে ভিড়ের মধ্যে এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। একটু ধাক্কা দিতেই লোকটা পড়ে যাওয়ার আগেই সানু ওকে জড়িয়ে ধরলও।

-সাবধানে হাঁটবেন। চোট লেগেছে?

-না, ঠিক আছি, বাবা। বলে আবারও দ্রুত চলতে থাকলো।

কাজ হয়ে গেছে। সানুর হাতে সেই পুঁটলি টা। খুলে দেখল অনেক অনেক টাকা। উপরওয়ালা কে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে এসে বসলো চা র দোকানে। চা র সাথে আজ সে ডালপুরি খাবে ঠিক করলো। বেশ তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছিল, এমন সময় দৌড়িয়ে এলো চন্দন, হাপাচ্ছে।

-কি হয়েছে? চা খাবি? জিজ্ঞাসা করতেই চন্দন বলল, চল হাসপাতালে, ফকাকে অনেক মেরেছে লোকেরা। হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। চল,চল তাড়াতাড়ি।

খাওয়া টা শেষ করতে পারলো না।

হাসপাতালের গেটের কাছে আসতেই দেখল এক বুড়ো কাঁদছে আর হাত পেতে লোকের কাছে টাকা চাইছে। ওকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেয়ে থমকে দাঁড়ালো সানু।

সেই ফলের দোকানে দেখা বয়স্ক লোকটা।

সানু দাঁড়াল।

-এই চল তাড়াতাড়ি। চন্দন হাত ধরে টান দিল।

-তুই যা আমি আসছি। বলে একটু কাছে এলো লোকটার।

শুনতে পেলো কাঁদতে কাঁদতে বলছে, আমার ছেলের অপারেশন হবে। তাই বাড়িঘর জমিজমা বন্ধক রেখে টাকা এনেছিলাম। হারিয়ে গেছে সেই টাকা। আমার ছেলের আর অপারেশন হবে না। ওকে আমি বাচাতে পারলাম না। বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো।

সানু কয়েক সেকন্ড তাকিয়ে রইল বুড়োর মুখের দিকে। এগিয়ে এলো বুড়োর কাছে।

পকেটে হাত দিলো। বের করলো সব টাকা গুলো। বুড়োর হাতে দিয়ে বলল, তোমার ছেলের অপারেশন হবে।

বলে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো। বুড়ো কত ডাকল ওকে। সানু ফিরে তাকালও না।

শুধু মনে মনে ঠিক করল, আর নয়। এই পেশা এখানেই শেষ।

সন্ধ্যায় সবাই এসে বসলো সেই ছোট্ট ঘরে। গুনে গুনে টাকা দিলো সর্দার কে। শুধু সানু ছাড়া।

সর্দার তাকালও সানুর দিকে।

সানু বলল, আজ থেকে আমি আর তোমাদের সাথে নেই। আমি চললাম।

বলে সে বেড়িয়ে এলো রাস্তায়।

সেইদিন থেকে সানুকে আর দেখা যায়নি ঐ শহরে।

Continue Reading

এ্যালবাম

ওর সাথে দেখা হয়েছিল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে। আমি ঢুকছিলাম আর সে বের হচ্ছিল। ধাক্কাটা অত জোড়ে লাগেনি। দোষ টা আমি বলব তার। কারন সে তাড়াহুড়া করে বের হচ্ছিল। আমি সরি বলতেই সে না তাকিয়ে, ওহো, ফটো শুট হচ্ছে, আমি বোধহয় বাদ পড়ে গেলাম। বলে দ্রুত দরজা পেড়িয়ে বাহিরে চলে গেলো।

কিসের ফটো শুট? আসার সময় কোন ফিল্মের শুটিং হচ্ছে এমন তো দেখলাম না।

ঘরে না ঢুকে বেড়িয়ে এলাম। বাহিরের লনে ফুলের গাছ। সেই খানে হলুদ শাড়ী, মাথায় হলুদ ফুল গুজে ছবি  তুলছে মেয়েরা । এটাকেই সে বলে ছিল ফটো শুট।

-কিরে, তুই কতক্ষণ এসেছিস। বলে সামনে এসে দাঁড়াল আমার প্রিয় রুমাদি।

-এই তো এলাম, তা দেরী হলে তো এই শুটিং দেখা হতো না।

-যা না, তুই ওদের সাথে ছবি তোল। দাড়া আমি শিউলি কে ডাকছি। তোকে ওদের সাথে নিয়ে ছবি তুলতে।

-তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। আমি চললাম ভিতরে, খিদে পেয়েছে। বলে ভিতরে চলে এলাম।

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত এগারটা বেজে গেলো। উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় রুমাদি এসে বলল, শোন কাল দুপুরে আমার বাসায় খাবি।

-তথাস্তু। বলে আমি বেড়িয়ে এলাম।

পরদিন রুমাদির বাসায় যেতে একটু দেরী হয়ে গেলো। ঘরে ঢুকতেই দেখি সেই ধাক্কা দেওয়া মেয়ে টা কথার খই ছড়াচ্ছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মত্ত হয়ে গেলো কথার মাঝে। চেনা পরিচিত দুই একজন আছে আমার। তারা আমার কুশল জানতে চাইলো। আমি কথা বলতে বলতে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম।

ছোট একটা প্লেটে দুটো কাবাব উঠাতে যাবো রুমাদি এসে দাঁড়ালো আমার পাশে।

-এই শিউলি, এদিকে আয়। বলে ডাক দিল।

-কি হয়েছে এত চিল্লাচ্ছ কেন? বলে ধাক্কা দেওয়া মেয়ে টা এসে দাঁড়ালো পাশে।

-চিল্লাচ্ছি কারন আমার এই ছোট ভাই এর সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। ওর নাম শমিত। তুই না বলিস,

নিউইয়র্কের কোন কিছুই আজ পর্যন্ত দেখা হয়নি। এই শমিতই তোকে নিয়ে যাবে। তোর যেমন

ফটো তোলার বাতিক, ওর বাতিক হচ্ছে ফটো উঠানোর।

এই যে মশাই, এর নাম শিউলি। থাকে টেনেশিতে। এবার তোমরা কথা বলও। বলে রুমাদি চলে গেলো রান্না

ঘরের দিকে।

-তা আপনি আমাকে কবে নিয়ে যাবেন নিউইয়র্ক শহর টা দেখাতে?

-তা আপনার যেদিন সুবিধা। চলুন কাল সকালে বেড়িয়ে পড়ি। বলে ওর উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

-কালই?  দুই এক দিন পরে গেলে হয়না। বলে সে আমার দিকে এমন ভাবে চাইল যে মনে হোল আমাকে রাগাতে

চাইছে।

আমার মেজাজ টা একটু তিরিক্ষি হয়ে গেলো, বললাম, গরজ টা আপনার আমার নয়। যেদিন যেতে চান, রুমাদির

কাছে আমার নাম্বার আছে, কল করবেন। যদি সেদিন ব্যস্ত না থাকি তবে নিয়ে যাবো।

এই কথা বলে আমি রান্না ঘরে  রুমাদির কাছে যেয়ে বসলাম। সেও এলো আমার পিছন পিছন।  

গলার স্বর মোলায়েম করে বলল, আপনি রাগ করছেন। আমি ঠাট্টা করছিলাম। আপনি যেদিন বলবেন সেদিনই

যাবো।

রুমাদি থাকিয়ে দেখল আমাদের দুজন কে। তারপর হেসে বলল, কিরে পরিচয় হতে না হতেই ঝগড়া আরম্ভ হয়ে

গেছে।

-তোমার ছোট ভাই এর সহন শক্তি একটু কম। একটু ঠাট্টা করে কিছু বললাম তো রেগে বাঘ। বলে হাসতে থাকল।

–কাল সকাল দশ টায় রেডি থাকবেন। বলে গরম গরম ভাজা ডালপুরি একটা উঠিয়ে নিলাম পাত্র থেকে।

আড্ডা টা জমে উঠেছিল। মুক্তার ভাই জমিয়ে রেখেছিল। বাসাটা মুক্তারভাই আর রুমাদির।

 আমার সাথে তাদের পরিচয় অনেক অনেক আগের। ছোট বেলায় একই পাড়ায় থাকতাম। আমার বয়স তখন দশ।

আমাদের বাসার পিছনের বাসায় রুমাদিরা থাকতো। রুমাদির বাবা পুলিশে চাকরি করে। আমার আসা যাওয়া ছিল ঐ

বাসাতে। ওখানে গেলেই রুমাদি আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলতো, একটা কাজ করে দিবি, এই চিঠি টা মুক্তার   

ভাইকে দিয়ে আসতে পারবি?

-কোথায় পাবো তাকে?

-রাস্তার শেষ মাথায় যে গাছটা আছে, ওর নিচে দাড়িয়ে আছে। যাবি লক্ষীটি।

কেন জানি রুমাদির কথা আমি ফেলতে পারতাম না।  

অনেক দিন ধরে এই চিঠি আদান প্রদান আমি করেছি। আমি ওদের দুজনের মাঝে সেতুর মত।

একদিন স্কুল শেষে ঐ বাড়ীতে যেয়ে থমকে গেলাম। থমথমে ভাব। রুমাদিকে কোথাও দেখলাম না।

সাহানা আমাকে ডেকে নিয়ে এলো এক কোণে। ও আর আমি একই ক্লাসে পড়ি।

বলল, আপা বাড়ীতে নেই। মুক্তার ভাই এর সাথে কোথায় যেন চলে গেছে।

কেন? এসব আমার মাথায় তখনো ঢোকেনি।

পরে শুনেছি রুমাদির বাবা রাজি ছিলনা মুক্তার ভাই এর হাতে রুমাদিকে তুলে দিতে।  

তারপর আমি বড় হলাম। সেই শহর ছেড়ে আরও বড় শহরে এলাম। একদিন সেই বড় শহর ছেড়ে

সাত সমুদ্র তেরো নদী পেড়িয়ে এলাম এই দেশে।

রুমাদির সাথে এদেশে দেখা হওয়া টাও বলা যেতে পারে এক আশ্চর্য ঘটনা।

শিল্পাঙ্গনের অনুষ্ঠান। আমি বাহিরে আড্ডা দিচ্ছিলাম।

শুনতে পেলাম অনুষ্ঠানের পরিচালক বলছে,

-আপনারা সবাই বসুন, যারা বাহিরে দাড়িয়ে আছেন তাদের কে অনুরোধ করব যার যার আসন নিয়ে বসতে।

আমাদের অনুষ্ঠান আরম্ভ হচ্ছে।

 আমি ভিতরে ঢুকতে যাবো, নাম ধরে মেয়েলি গলায় কে যেন

ডাকল।

পিছন ফিরে তাকালাম, তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।

-চিনতে পারছিস? আমি তোকে এক দেখায় চিনতে পেরেছি।

-রুমাদি? তুমি?

– হ্যাঁ, আমি। তুই একটুও পাল্টাসনি, শুধু গোঁফ টা ছাড়া।   

রুমাদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোকে আমি ভুলিনি ভাই।

ঠিক দশটায় আমি হাজির রুমাদির বাসাতে। সেখানেই তার থাকার কথা। রুমাদি  বোধহয় আমার সময় জ্ঞানটা ওকে বলে রেখেছিল। তাই আমি যেতেই সে নেমে এলো উপর থেকে। জিনসের প্যান্টের উপর হলুদ রং এর কামিজ।

মানিয়েছে। পড়তে যাচ্ছিল ফ্যান্সি জুতো।

বললাম, ওটা চলবে না। হাটতে হবে অনেক। সিনিকার হলে ভালো হয়।  

– সিনিকারে ছবি ভালো আসবে না।  খ্যাত খ্যাত লাগবে।

-এ বাংলা শেখালো কে? ভেবে ছিলাম আপনি বুঝি——-

কথা শেষ না হতেই দুচোখ বড় করে আমার চোখের দিকে চেয়ে বলল, কেন ভাষা শুধু আপনিই জানেন আমরা জানি না?

আরও কথার পিঠে কথা হয়তো চলতো, রুমাদি এসে থামাল।

-তোরা শুধু ঝগড়াই করবি?

-এতো ঝগড়া নয় রুমাদি একে অপরকে জানা। বলে শিউলির দিকে তাকিয়ে বললাম, চলেন, দেরী হয়ে যাচ্ছে।

সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। তাপের উষ্ণতা কম।

বাহিরের লনে অনেক গোলাপের গাছ। কয়েকটা মৌমাছি গুনগুণ করে ডেকে বেড়াচ্ছে গোলাপের পাশে।

-আমি এই গোলাপ ফুল নিয়ে ছবি তুলবো। বলে দুটো গাছের মাঝে বসল সে।

রুমাদি তো বলেই ছিল তার বাতিকের কথা। অতএব একটা নয় বেশ কয়েকটা ছবি তুলতে হোল। বিভিন্ন ভঙ্গিতে।

গাড়ী তে উঠে আমাদের আজকের পরিকল্পনা টা বললাম। উল্লসিত হয়ে সে আমার ডান হাত টা চেপে ধরল।

আমি ছাড়িয়ে নেই নি এই ভেবে যে ও ওর আনন্দটা প্রকাশ করছে। বাঁধা দিলে আনন্দ টা মাটি হয়ে যাবে।

-ও সরি।

-সরি হওয়ার কিছু নেই, আমরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক। বলে পকেটে রাখা ট্রাইডেন্ট গাম টা এগিয়ে দিলাম।

আসার আগে রুমাদি পাশে ডেকে বলেছিল, আজ হবে তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা। ফিরে এসে সব বলবে আমাকে

কোন কিছু সেন্সর করে নয়।  

-কেন সেন্সর করার মত কিছু হবে বলে তোমার মনে হয়।

-কি জানি দুজনেই ব্যাচেলার কিনা। বলে দুটো পানির বোতল আমার ব্যাগপেকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

সাবওয়েতে সে চড়েনি আগে। কাজেই এটা তার কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা।

টিকিট কাটতে যাবো, সে তার পার্স থেকে টাকা বের করে আমাকে দিতে চাইল।

বললাম, আজ আপনি আমার গেস্ট। কাজেই সব ব্যয় আজ আমার।

সে না করলো না। শুধু বলল, এই আপনি আপনি বলা টা বড় কানে লাগছে। তুমি বলে যদি সম্বোধন করি তবে

কি রাগ করবেন। তাছাড়া আপনি আমার থেকে এমন কিছু বয়সে বড় বলে মনে হচ্ছে না। কত? পাঁচ ছয় বছরের

বড় হবেন হয়তো। তাই না?

আমি উত্তর দেবার আগেই আমার হাত টা ধরে টেনে নিয়ে এলো প্লাটফর্মের ধারে।

-ঐ দেখো ট্রেনটা আসছে, এখান থেকে আমার একটা ছবি নাও ট্রেন টা কে নিয়ে।

-অত ধারে যেও না পড়ে যাবে। আমার বুকটা ধক করে উঠল।

-তাড়াতাড়ি নাও।

নিয়েছিলাম, রেগে বলেছিলাম, এই রকম ছেলেমানুষি করবে না।

-এই দেখো, তোমার এই তুমি ডাকটা আমার খুব ভালো লাগছে।

ট্রেন টা এসে দাঁড়ালো। ভিড় কম। দুজনে পাশাপাশি বসলাম।

-একটা সেলফী উঠাও আমার আর তোমার। বলে ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে আলতো ভাবে ঠোঁটে ছুঁইয়ে নিলো।

আপত্তি করতেই, বলে উঠলো, ওহ, তোমার গার্লফ্রেন্ড দেখলে একচোট নেবে তোমাকে, তাই?

-এখনো কপালে জোটে নি। কাজেই ঐ ভয় নেই।

প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। নামব বলিং গ্রীন ষ্টেশনে। সেখান থেকে দেখবো স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। দুর থেকে দেখব, তাই ভেবেছিলাম। তা আর হয়নি। ফেরী করে যেতে হোল স্ট্যাচু অফ লিবার্টি কাছে। আমার ক্যামেরায় ছবি তুলল সে বিভিন্ন ভঙ্গিতে। কখনও  বসে, কখনও দাড়িয়ে, কখন হাওয়ায় চুল উড়িয়ে।

 বসলাম গাছের তলায়। বারগার খেয়ে কাটিয়ে দিলাম দুপুর টা।

সেখানেই কি শেষ? ফ্রীডম টাওয়ার থেকে টাইম স্কয়ার।  টাইম স্কয়ারের চত্বরে যখন দুজনে দুটো কফি নিয়ে বসলাম তখন সূর্য ঢলে পড়েছে। নিয়ন সাইনের আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক।

দুজনেই ক্লান্ত।

-আমার হাতটা ধরে বলল, জানো, কতবার এসেছি নিউইয়র্কে কেউ আমাকে নিয়ে আসেনি, তুমিই নিয়ে এলে। তোমার সাথে দেখা না হলে এটাও দেখা হতো না।

কথা বলতে বলতে জিজ্ঞাসা করলাম, রুমাদির সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে।  

-সে এক ইতিহাস। শুনতে চাও?

-তোমার আপত্তি না থাকলে।

-শোন, আমরা তখন থাকি মিশিগানে। বাবা ডাক্তার, মা নার্স। বুঝতেই পারছ কম্বিনেশন টা। মা র কাছে শুনেছি

ওদের ছিল প্রেমের বিয়ে। যে মহল্লায় আমরা থাকতাম, সেখানে কটা বাঙালির মাঝে আঙ্কেল আর অ্যান্টিও ছিল।

কিভাবে যেন মা র সাথে অ্যান্টির খুব ভাব হয়ে গেলো। আমার তখন বয়স ছয়। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি

মা শুয়ে আছে। চোখ দুটো লাল। কাছে আসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।

আমার ছোট্ট মাথায় কিছুই ঢুকল না।

-কি হয়েছে, শরীর খারাপ? বলে আমি মার আঁচল দিয়ে মার চোখ টা মুছিয়ে দিলাম।

সেই রাতে বাবাকে বাড়ীতে দেখলাম না। ভাবলাম, কাজের চাপে হসপিটালে রয়ে গেছে। পরদিনও বাবা এলো না।

এলো অ্যান্টি। আমাকে নিয়ে এলো খাবার ঘরে। যত্ন করে খাইয়ে দিলো।

বেশ কিছুদিন পরে বাবা এলো। শরীরের চারিদিকে নল লাগানো। উপরে একটা পানির থলে। আমি কিছুই বুজতে পারলাম না। একদিন  অ্যান্টি আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে এলো সকাল সকাল। বাসায় এসে দেখলাম অনেক লোক ড্রয়াইং রুমে বসা। মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর বাবা চলে গেছে। আর ফিরবে না। দেখলাম বাবা শুয়ে আছে, চোখ দুটো বন্ধ। এরপর অ্যান্টি প্রতিদিন আসতো। আমার দেখাশুনা অ্যান্টিই করতো।  আমার কপালে যে আরও দুর্ভোগ আছে তা কে জানতো। মাস ছয়েকের মাথায় মা ও চলে গেলো গাড়ী এক্সিডেন্টে।

তারপর অ্যান্টি নিয়ে এসেছিল ওদের বাসায়। আঙ্কেল আর অ্যান্টি মিলেই আমাকে মানুষ করেছে। আমি আজ ওদের মেয়ে।

মিশিগান থেকে ওরা চলে এলো নিউইয়র্কে আর আমি চাকরি নিয়ে চলে গেলাম টেনেশিতে। বলে থামল।

আমি ওর দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা দেখতে পেলাম।

চলো উঠি।

ট্রেনে বসে ও বলল আমি তোমার ঘাড়ে মাথা রাখতে পাড়ি? বড় ক্লান্ত লাগছে।

আমি না করিনি।

দুদিন পরে, বিয়ের ডামাডোল। সবাই সাঁজতে ব্যস্ত। শিউলি পড়লো শাড়ী। গাড় মেরুনের উপর সোনালী কাজ। চওড়া পাড়।

সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে।

বিরাট হলঘর। একই টেবিলে আমি রুমাদি, মুক্তার ভাই আর শিউলির সাথে অন্যান্যরা। বর, কণে এসে গেছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছে। শিউলি উঠে এলো, চলো আমার কয়েকটা ছবি উঠিয়ে দেবে।

অগত্যা আমাকে উঠতে হোল।

শিউলি মিশে গেলো ওদের সাথে। আমি ছবি তুললাম, কথা বললাম অন্যদের সাথে।  

ঘাড়ে হাত পড়লো, ফিরে তাকিয়ে দেখি শ্রাবণী।

-আমার ছবি উঠাবে না? বলে হাসল।

-কবে ফিরলে লন্ডন থেকে।

-গত পরশু। জানতাম তোমার সাথে দেখা হবে এখানে। কেমন আছো?

-এজ ইউজুয়াল।

-আমার কথা মনে পড়ে তোমার?

-পড়ে, তবে আগের মত অত বেশি নয়।

-সেটাই স্বাভাবিক। পেয়েছ কি কাউকে?

-খুঁজিনি।

-তুমি?

-পেয়েছি, ওদেশী।

-কংগ্রাট।

এক সময় আমি আর শ্রাবণী ঘুরেছি এক সাথে। ও সুন্দরী, স্মার্ট  তবুও কোথায় যেন একটা কিন্তু রয়ে যায়। সেও বুঝেছিল। তাইতো একদিন বলেছিল, আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব টাই বড় হোক, গাঁটছড়া নাই বা বাধলাম, কি  বলও?

তুমি এখানে? আমি তোমাকে খুজে বেড়াচ্ছি। বলে শিউলি তাকালও শ্রাবণীর দিকে।

-পরিচয় করিয়ে দেই। শ্রাবণী, আমার বান্ধবী, থাকে লন্ডনে।

আমি কিছু বলার আগেই সে শ্রাবণীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি শিউলি, থাকি টেনেশিতে।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো ব্যস্ত। ঠিক আছে, বলে চলে গেলো।

শ্রাবণী কাঁধে হাত দিয়ে বলল, যাও, আমি আছি কিছুদিন।

অনুষ্ঠানের প্রধান পরিচালক ঘোষণা করছে যার যার জাগায় গিয়ে বসতে। এখনি অনুষ্ঠান শুরু হবে।

আমি শিউলি কে খুজলাম যেখানে ভিড় সেখানে, পেলাম না। ফিরে এলাম আমার টেবিলে, দেখি সেখানে সে বসে।

মুচকি হেসে বলল, তোমার বান্ধবী দেখতে মিষ্টি।

আমি হাসলাম।

সব অনুষ্ঠান শেষ। এবার শিউলির ফেরার পালা। কেন জানি বুকের মাঝে ফাকা ফাকা লাগছে। আমাকেই নিয়ে  যেতে হবে এয়ারপোর্টে।

সুটকেস দুটো গাড়ীতে উঠিয়ে নিলাম। ও এসে বসলো।

আমি আমার পাশে রাখা এ্যালবাম টা ওর হাতে দিয়ে বললাম, তোমার আমার স্মৃতি রইল এই এ্যালবামের মাঝে।

আমার দিকে তাকালও সে। বলল, কবে আসবে আমাকে দেখতে।

দিন যায়, ক্ষণ যায়। ফোনে কথা হয়। সময় বয়ে যায়।

 একদিন আর ফোন বাজলো না। আমি ফোন করলাম সে ধরলও না।

রুমাদি কে জিজ্ঞাসা করলাম। সে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেয়ে অন্য কথা বলতে আরম্ভ করলো। চোখে জল।

ঠিক করলাম টেনেশিতে যাবো।

পৌছালাম সন্ধ্যায়। দরজায় টোকা দিতে দরজা খুলে যে মেয়ে টা দাঁড়াল তার কথা আমি শুনেছি ওর কাছে। ওর রুমমেট।

দরজা থেকে সরে দাঁড়াল সে।

আমি ভিতরে গেলাম। ও নিয়ে গেলো শিউলির ঘরে। পরিপাটি করে বিছানা সাজানো। মাথার কাছে এ্যালবামটা।

-কোথায় সে? কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম।

-আছে সে, তবে যেখানে আছে সেখানে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো না। ও তোমার সইবে না। তুমি তাকে চিনতে পারবে না। সেও তোমাকে চিনতে পারবে না। সে কিছুই বলে যেতে পারলো না। বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

-বলও, কি হয়েছিল? আমি জানতে চাইলাম।

-স্ট্রোক।

অনেক কথার পর সে আমাকে নিয়ে গেলো সেই নার্সিং হোমে।

আমি দেখলাম। ওর শরীরের চারিদিকে নল লাগানো।

এ- কোন শিউলি।

আমি পাশে বসলাম। হাত টা হাতে নিলাম। সে জানতেও পারলো না আমি এসেছিলাম।

Continue Reading

কত দেখা কত স্মৃতি

  হঠাৎ করে চোখে পড়ল গেট ১ এর একটা বিজ্ঞাপন। অস্ট্রেলিয়া , নিউজিল্যান্ড। ১৪ দিনের সফর। দাম টা কম মনে হোল। তিন বন্ধু কে ফোন করলাম। তিনজন রাজি। দুই মাস পরে যাত্রা। কোথা দিয়ে কেটে গেলো দুটি মাস। আমরা রওয়ানা হলাম।  নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস। সেখান থেকে সিডনি। সব মিলিয়ে উনিশ ঘণ্টার পথ। প্লেনে পরিচয় হোল দুই জনের সাথে। ওরাও একই প্যাকেজ নিয়েছে। প্লেনে বাধ্যতা মূলক ম্যাস্ক পড়ার নিয়ম আজ আর নেই। যাক বাচা গেলো। এই ভেবে সীট বেল্ট টা বেঁধে বসলাম। প্লেনে কোনদিনই আমি ঘুমতে পারিনা। অথচ সেইদিন ঘুম এসে গেলো। ছেলে মেয়েরা বলে দিয়েছে উঠে হাটা চলাফেরা করতে। করিনি যে তা নয়। তবে অতটা নয়।

অকল্যান্ড থেকে প্লেন চেঞ্জ করে সিডনিতে যখন এসে পৌছালাম তখন সকাল সাড়ে দশ টা। হাতে ফ্ল্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আমাদের ট্যুর গাইড। পরিচয় হোল। নাম ডানা। আমাদের গ্রুপে সব মিলিয়ে ১৬ জন। সবাই আমরা আমেরিকার থেকে এসেছি। বিরাট বাসের ভিতর আমরা ১৬ জন। বাহিরে ঝলমলে রৌদ। তাপমাত্রা ৬৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট। নিয়ে এলো হোটেলে। Rydges World Square. লোকেশন টা এমন এক জায়গায় যেখান থেকে বিখ্যাত অপেরা হাউস খুব বেশি দুরে নয়। দুরে নয় হাইড পার্ক।

লম্বা একটা ঘুম দিলাম রুমে এসে। রাতে দেখা হোল ডিনারে সবার সাথে। নাম আদান প্রদান হোল।

রাতের ঘুম টা খুব একটা ভালো হোল না। নাই বা হোল। এসেছি আনন্দ ফুর্তি করতে। ঘুম নিয়ে গবেষনা করলে তো চলবে না। সকাল সাতটার সময় নিচে নেমে এলাম। নয়টায় গাড়ী আসবে। ডাইনিং রুমে এলাম।

 বিভিন্ন রকমের নাস্তা সাজানো। চার জনের একটা টেবিল নিয়ে আমরা চারজন বসলাম।

আব্বাস আর নাফীসা সুপ্রভাত জানালো টেবিলের কাছে এসে। ওরা এসেছে শিকাগোর থেকে। পাশের টেবিলে বসা সেন্ডী আর বারবারা।

এগ হোয়াইটের অমলেট অর্ডার দিয়ে কফির সরঞ্জামের দিকে এগিয়ে গেলাম। সকালের কফির স্বাদই আলাদা। ওটা নাহলে আমার দিনই অচল। বড় একটা প্লেটে সাজিয়ে নিলাম চিকেন সসেজ, পটেট ফ্রাই, ডেনিশ আর টোস্ট। কিছুক্ষণ পরেই ওয়েটার এসে দিয়ে গেলো অমলেট টা।

খাওয়ার মাঝেই কাঁধের উপর একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। ঘাড় ফিরে তাকাতেই ডানা বলল, ঘুম হয়েছে কি?

-না তেমন আর হোল কই। বলে হাসলাম।

-নয় টায় আমরা বেড়িয়ে পড়বো। পানি গাড়ীতে আছে। বলে সে অন্য টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।

সিডনি তে আসবে আর অপেরা হাউস দেখবে না তা হলে তো এখানে আসাই বৃথা। দেখলাম। দেখলাম হারবার ব্রিজ।

সেলফী উঠানোর চেস্টা করছিলাম অপেরা হাউস আর ব্রিজ টাকে নিয়ে,

-আমাকে দাও তোমাদের সবার ছবি উঠিয়ে দেই। সোনালী চুল গুলো ঘাড়ের পাশে সরিয়ে দিয়ে বলল, বারবারা।

-অবশ্যই।

বেশ কয়েকটা ছবি সে উঠিয়ে দিল।

বললাম তোমরা এসো আমাদের সাথে সেলফী করি।

সেন্ডী আর বারবারা থাকে রোড আইলেন্ডে। 

বললাম অনেক বার গিয়েছি ওখানে। নিউ পোর্টের পানির পাশ দিয়ে হেঁটেছি।

-আমরা থাকি প্রভীডেন্সে। বলল বারবারা।

-তুমি আর সেন্ডী দুজনে মিললে কি ভাবে? একটা বেঞ্চে বসে জিজ্ঞাসা করলাম ওকে। 

-একই স্কুলে কাজ করতাম আমরা দুজনে। অনেক অনেক অনেক বছর ধরে। দুজনেই হারালাম দুজনের সঙ্গিকে। তাও তো দশ বছর হয়ে গেলো। রিটায়ার করে এখন আমরা দুজনে একসাথে ঘুরে বেড়াই।

মনে হোল অনেক দিন পর সে পেয়েছে কাউকে  তার মনের খবর উজাড় করে দিতে।

-জানো সেই দিন টা ভুলতে পারিনা। বলে সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।

আমিও ওকে সময় দিলাম। ওর মনের কথা এক অপরিচিত মানুষ কে বলতে চায়। হাল্কা হতে চায়।

দুরে সিডনি হারবারের শেষ প্রান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল সে, আস্তে আস্তে আমার দিকে তাকালও।

-আমার ছেলের সাথে কথা বলছিলাম ফোনে। দরজায় টোকার শব্দে উঠে গেলাম।  দরজা খুলতেই দেখি দুই জন পুলিশ দাঁড়ানো। ভয় পেয়ে গেলাম। পুলিশ কেনও আমার দরজায়।

-তোমার স্বামীর নাম জন সেলবি। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলো আমাকে।

-হ্যাঁ, বলতেই বলল, আমাদের সাথে তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। তোমার স্বামী গাড়ী এক্সিডেন্ট করেছে।

আমি এলাম হাসপাতালে। ওকে নিয়ে গেছে অপারেটিং রুমে।

বসে রইলাম সারা রাত।

ওকে ওরা ফিরিয়ে আনতে পারলনা।

আমার চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি বের হোল না। ও আমাকে বিদায় জানাতে পারলো না। আমি একা হয়ে গেলাম।

আমি ওর চোখে পানির রেখা দেখতে পেলাম।

-কি রে তোরা যাবিনা? সেন্ডী জোড়ে ডাক দিলো। ওদিকে ডানা অপেক্ষা করছে। বলে সেন্ডী আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।

সবাই বাসে উঠে গেছে। শুধু আমরা তিন জন বাকি।

বাস পার্লামেন্ট হাউজ, সেন্ট মেরী ক্যাথিড্রাল, কুইন ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং ঘুরে বাঁক নিলো ডানে।

অবশেষে  দি রক্স। ঐতিহাসিক এলাকা। প্রতিষ্ঠিত করেছিল আরথার ফিলিপস  তার convicts দের দিয়ে। আমাদের কেউ কেউ লোকাল শপ গুলো ঘুরে ঘুরে দেখল। দামদর করে পিছিয়ে এলো।

বাস দাড়িয়ে ছিল দুরে। হাটতে হাটতে আমরা এলাম বাসের কাছে।

সন্ধ্যায় ডিনার ক্রুজ। সিডনি হারবারে। জাহাজের নাম ক্যাপ্টেন কুক ক্রুজ। টেবিল রিজার্ভ ছিল আমাদের জন্য। ডিনার মেনুতে ছিল Barramundi fish filet, chicken cutlet, সালাদ। সব শেষে ভেনেলা চকলেট কেক।

দেড় ঘণ্টার ক্রুজ। জাহাজ টা চলছিল অপেরা হাউজের পাশ দিয়ে, বড় বড় নায়ক নায়িকা দের বাসার কোল ঘেঁষে। সময় পেড়িয়ে গেলো। আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।

পরের দিন যাবো Blue Mountain দেখতে। ডানা বলে দিয়েছিল সকাল সাড়ে আটটায় যেন আমরা লবিতে থাকি।

সকালে নামতে একটু দেরী হয়ে গেলো। এসে দেখি সবাই নাস্তার রুমে এসে গেছে। রউফ কে বললাম, আজ বোধহয় অমলেট খাওয়া হোল না।

-আমি ওটা না খেয়ে যাবো না। বলে সে দাড়িয়ে রইল অর্ডার দেওয়ার জন্য।

না, খুব একটা দেরী হয়নি। প্রধান বাবুর্চি তাড়াতাড়ি বানিয়ে দিলো।

নাস্তা শেষে বাহিরে এসে দেখি আকাশ মুখ গোমড়া করে আছে।

লিলি পাশে এসে বলল, ক্রস ইওর ফিঙ্গার। যেন আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। নচেৎ যাওয়াই বৃথা।

লিলি আর ক্যাথলিন এসেছে সানডিয়াগো থেকে।

বাস ছেড়ে দিলো ঠিক সাড়ে আটটায়।

যাবো Katoomba তে।

যাওয়ার পথে থামলাম Featherdale Wild Park এ। আছে কোয়ালাস, ক্যাঙ্গারু, পেঙ্গুইন, বিভিন্ন রং এর কাকাতোয়। ছোট্ট প্যাকেটে খাবার কিনে নিলাম ক্যাঙ্গারুকে খাওয়াবো বলে। ডানা বলে দিয়েছে বেশি সময় এখানে কাটানো যাবে না। কেননা যদি আকাশ মেঘে ঢেকে যায় তাহলে Blue Mountain এ যাওয়া টাই বৃথা।

আমরা সবাই এলাম গাড়ীতে, কিন্তু বিল আর ভীকী কোথায়? ওরা তো এসে পৌঁছায়নি। ফোন এখানে কাজ করে না। ডানা বাহিরে পায়চারি করছে। ১৫ মিনিট কেটে গেলো। ডেভিড বলল, আমি যেয়ে দেখি ওরা কোথায়।

ডানা রাজি হোল না।

কিছুক্ষণ পরে দুরে দেখা গেলো ওরা আসছে। হাসছে। বলল, কাকাতোয়া গুলো দেখেছ, কি সুন্দর। ওখানেই দেরী হয়ে গেলো। সরি।

দুরের আকাশ কালো। মাঝে মধ্যে বৃষ্টির ছিটে ফোঁটা পড়ছে গাড়ীর জানালায়। এখনো এক ঘণ্টার পথ। দুরে পাহাড় দেখা যায়। চলতে চলতে দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপর আলোর রেখা। আমরা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ডানা বলল, এ পাহাড় সে পাহাড় নয়।

এসে পৌছালাম রৌদের ঝর্না নিয়ে। দুরের থেকে দেখলাম,  মনে হোল নীল ব্ল্যাঙ্কেট পাতা আছে তাই এর নাম দিয়েছে Blue Moumtain.

দুরের  পাহাড় নীলাভ রঙ দিয়ে কে যেন এঁকেছে। আকাশ নীল রঙে ছেয়ে আছে। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য। 

Echo Point থেকে দেখা Jamison Valley, The Three sisters এর অত্যাশ্চর্য দৃশ্য। 

দেখার কি শেষ আছে? ক্লান্ত হয়ে আমরা চারজন এসে বসলাম বেঞ্চে। হাটতে হাটতে এলো সফিয়া।

-কি ব্যাপার বসে কেন? পাহাড়ের নিচে নামোনি?

-নামতে তো পারবো, উঠতে পারবো তো? এই আশঙ্কায় আর যাওয়া হোল না। বলে বললাম, বসো।

ও এসে বসলো পাশে।

-ইব্রাহীম ভাই কোথায়? জিজ্ঞাসা করতেই বলল, সে নিচে গেছে, আমার হাঁটুতে ব্যাথা। তাই আর সাহস করলাম না।

-ভালো করেছো।

কিছুক্ষণ চুপ চুপ আমারা সবাই।

সফিয়া কি যেন ভাবছে মনে হোল। তাকালও আমার দিকে। বলল, জানো আমার ছেলে অনী এখানে আমাদেরকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। চেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া দেখবে।  

-এবার তোমাদের সাথে আসতে পারেনি, পরে তোমাদেরকে নিয়ে আবার আসবে।

– না। সে আর হবার নয়। বলে তাকালও সামনে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ানো কবুতর গুলোর দিকে।

আমিও হতচ্ছাড়া, বলে বসলাম, তা হবার নয় কেন?

-সে চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে? বলে সজল নয়নে তাকালও আমার দিকে।

আমি আর কিছু তাকে জিজ্ঞাসা করিনি।

সেই বলেছিল, আমার ছেলে ছিল সোনার টুকরা। এখানেই জন্ম। সে ছিল valedictorian তার ক্লাসে। ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিল। কার্ডিয়াক সার্জেন হয়ে যখন বের হোল, কত বড় বড় হসপিটাল থেকে ওর অফার এসেছিল। ও নেয়নি। পাছে আমাদের ছেড়ে বেশিদূর যেতে হয়। তাই মিশিগানের এক হসপিটালে চাকরি নিলো। ওখানেই পরিচয় হয়েছিল নাদিয়ার সাথে। সেও ডাক্তার। আমাদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছিল।

ওর বাবা বলেছিল, এবার বিয়ে করে ফেল। আমাদেরও তো বয়স হয়েছে। 

বাঁধা আসেনি। ধুমধাম করে বিয়ে হোল।

দুই বছর পরে টুকটুকে একটা ছেলে এলো।

আমরা দাদা দাদি মিলে পালতাম। ওরা যেতো কাজে।

একদিন একটা অপারেশন শেষ করে বাসায় এসে সোজা শুতে চলে গেলো। আমি এলাম ওর ঘরে।

বললাম, বাবা, খাবি না? 

বলল, মাথা টা ভীষণ ধরেছে।

পীড়াপীড়ি করলাম না। ভাবলাম, খাটনি গেছে, তাই।

বৌমা এলো ঘণ্টা দেড়েক পরে। বললাম অনী তো শুয়ে পড়েছে মা, বলল মাথা ধরেছে।

-ওর ইদানিং প্রতিদিনই মাথা ধরছে। গত পরশু দিন তো বমিও করেছিল।

বললাম, তোমরা ডাক্তার, কেনও একটা মাথার MRI করছ না।

-আমি ওকে বলেছি, শুধু আজ না কাল করছে। কালই আমি এপয়েন্টমেন্ট নেবো। 

-MRI করেছিল? কেন যে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম। নিজেকে নিজে গালাগালি করলাম।

-হ্যাঁ করেছিল।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওর বুক চিরে।

তাকাল নীল পাহাড়ের দিকে। আমিও চুপ করে রইলাম।

সফিয়া ফিরে এলো তার জগতে।

-টিউমার। ছোট নয়, বেশ বড়। আর মাথার এমন জাগায় যে অপারেশনও করা যাবে না।

সে ডাক্তার সে নিজেই জানে বেশিদিন তার হাতে সময় নেই। শুধু যাওয়ার আগে আমাকে আর ওর বাবা কে বলেছিল, তোমরা তোমাদের নাতি টাকে দেখো। আর আমিও বলেছি, তোমরাও বলও, নাদিয়া যেন আবার বিয়ে করে। ওর জীবনটা যেন নস্ট না হয়ে যায়।

আমি কেন জানি কেউ কাদলে কিছু বলতে পারিনা। আজও পারলাম না। সফিয়া কাঁদলও। এই জায়গায় তারা আসতে চেয়েছিল। অদৃষ্টের পরিহাস, এক সাথে আসা হোল না।

আস্তে আস্তে সবাই এলো বাসের কাছে। সফিয়া উঠে দাঁড়ালো। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, এসো।

ইব্রাহীম ভাই এসে ওর হাতটা ধরল, বলল, যাওনি ভালো করেছ, ভীষণ খাড়া রাস্তা।

সকালে রওয়ানা দিলাম Qantas Airways এ করে মেলবোর্নের পথে। এক ঘণ্টা পয়ত্রিশ মিনিটের ফ্লাইট। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নামলাম মেলবোর্নে। ঠাণ্ডা আর বাতাস। এমন তর হবে আশা করিনি। হোটেল চারটার আগে পাওয়া যাবে না। তাই ডানা ঘুরে ঘুরে দেখালও শহর টা। Melbourne Cricket Ground (MCG).

স্কুলে থাকা কালিন, রেডিও তে শুনতাম মেলবোর্নে খেলা হচ্ছে। পাকিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়া। হানীফ মোহাম্মদ ব্যাট করছে। আমরা গুলুর মতো আটকিয়ে থাকতাম রেডিও ঘিরে। আজ এতকাল পরে দেখতে পেলাম সেই জায়গা। সেই ক্রিকেট পিচ। মনে আনন্দ ধরে না।

অস্ট্রেলিয়ায় শেষ দিন। এক সাথে বসে আজ ডিনার করব সবাই। বিদায় দেবো ডানা কে। এতদিন সে ছিল আমাদের সাথে। আমাদের দেখাশোনার ভার ছিল তার উপর। আমরা সবাই কৃতজ্ঞ।

খাওয়ার টেবিলে সবাই ধরল ওর নিজের কথা বলতে।

কথার শুরু তে বললও, এই ট্যুর যখন বন্ধ থাকে, তখন আমি একটি কলেজে মাস্টারি করি। বন্ধু বান্ধবী দের সাথে বারে যাই। ড্রিংক করি। তেমনি এক বারে দেখা হয়েছিল অ্যান্থনির সাথে। ও বারটেন্ডার। সেদিন খাওয়ার মাত্রা টা একটু বেশি হয়েছিল। ও আমাকে গাড়ী চালিয়ে যেতে দেইনি। সে নিজে পৌছে দিয়েছিল আমার বাসায়।

তারপর প্রতিদিন যেতাম ওই বারে। বসতাম, ও গল্প করতো। বৌ এর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে পাঁচ বছর হোল।

প্রতি রাতে আমি বসে থাকতাম। ওর ডিউটি শেষ হলে আমরা একসাথে হাটতে হাটতে এসে বসতাম কোন বেঞ্চে। ওর কেয়ারিং টা আমাকে আরও ওর  কাছে নিয়ে এলো।

এক রাতে আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে ও দাড়িয়ে রইল।

বললাম, কি ব্যাপার বাসায় যাবে না।

-যাবো, বলে সে আমার ঘরের দরজার সামনে হাঁটু গেরে বসে, একটা ছোট্ট বাক্স থেকে আংটি বের করে বলল, উইল ইউ মেরি মি?

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বলেছিলাম, ইয়েস, আই উইল মেরি ইউ।

আমাদের একমাত্র মেয়ে আমেরিকার ডুক ইউনিভারসিটি থেকে গ্রাজুয়েট করে ফিরে এসেছে।

এত সুখের মাঝে উপরওয়ালা একটু যদি কল কাঠি না নাড়ে তবে সুখ টা কি তা তুমি বুঝবে কি করে।

তাই তো দুটো ব্রেস্ট ফেলে দিতে হোল। ক্যান্সারের বিষ ওখানে ঘোরাফেরা করছিলো।

 বেশ আছি। ছয় মাস পরপর শুধু চেক করতে হয়।

এই আমার কাহিনী।

আমারও তাই মনে হোল শুধু সুখই যদি থাকে জীবন ভর, তবে দুঃখ কি তা বুঝবে কি ভাবে।

এয়ারপোর্টে ডানা কে বিদায় দিয়ে আমরা প্লেনে উঠলাম। যাবো নিউজিল্যান্ড। 

Tasman sea পাড়ি দিয়ে Christ Church এ প্লেন পালটিয়ে আমরা এসে পৌছালাম Dunedin।

Karen দাড়িয়েছিল আমাদের কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। নিউজিল্যান্ডে সে আমাদের গাইড।

Dunedin এ একদিন কাটিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম Queenstown এর দিকে। সকাল তখন নয়টা।

পথে লাঞ্চ করবো Clyde শহরে। Olivers Restaurant এ। চোখটা লেগে এসেছিল। শোয়েব ভাইয়ের ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে গেলো।

-কি হয়েছে?

-দুই চোখ খুলে দেখো চারিদিকে। কি অপূর্ব।

সত্যিই রাস্তার দুই দিকের সৌন্দর্য মুগ্ধ করল আমাকে। আঁকা বাঁকা রাস্তা। কখন অনেক নিচে নেমে গেছে। কখন অনেক উপরে উঠছে। দুরে সবুজ পাহাড়। তার মাঝে হলুদ ফুল। আল্লাহর সৃষ্টি। চোখ ভরে দেখো।

পাঁচ ঘণ্টা পার করে Queenstown এ ঢুকলাম। চোখ জুড়ানো দৃশ্য। পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ লুকোচুরি খেলছে পাহাড়ের সাথে। ছোট্ট নদী বয়ে চলেছে নিচে। আমরা এলাম হোটেল মিলিনিয়ামে।

মনে হচ্ছিল, অনেক দিন বাহিরে। ঘরটা আমার হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নাতি বলছে আর কতদিন থাকবে দাদা। নাতনী ডাকছে, নানা ফিরে এসো।

আসব, Milford Sound টা দেখে নেই। যেখানে ঝরছে উচু পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্না। সাদা কালো মেঘ গুলো আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। পাথরের উপর শুয়ে আছে তিনটি বাচ্চা Sea Lion। আমাদের বোটটা কাঁপছে ঢেউ এর তালে তালে।

বাচ্চা পেঙ্গুঈন দুটো ঝুপ করে ঝাপ দিলো পানিতে।

আমাদের বোঁট এসে ভিড়ল ঘাটে।

এবার ফেরার পালা। অকল্যান্ড হয়ে ফিরব আমরা যার যার গন্তব্য স্থানে। Pullman Auckland Hotel এ  ফেয়ারওয়েল ডিনার খেয়ে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নিলাম। চৌদ টা দিন আমরা কাটিয়েছি একসাথে। শুনেছি অনেকের জীবন কাহিনী। দেখেছি চোখের জল।

শুনেছি বিল তার ছেলেকে দেখে না দশ বছর হোল। দশ বছর হোল সে আসেনি বাবা কে দেখতে। কারন সে দেখতে চায় না তার সৎমা কে।

সব স্মৃতি গেঁথে নিলাম আমার হৃদয়ে।

প্লেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম নিচের আকাশ টাকে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল আমার প্রিয় মুখ গুলো।

বলছে যেন, আমার জন্য কি এনেছ দাদা, আমার জন্য কি এনেছ নানা।

Continue Reading

প্রতিভা

  একদিন কাজ থেকে ফিরে এসে গিন্নিকে বললাম, জানো আজ থেকে আমি গল্প লিখতে শুরু করব। আমি সাহিত্যিক হবো। আমার মধ্যে প্রতিভা আছে মনে হচ্ছে। প্রথমে গিন্নি গুরুত্ব দিলো না আমার কথায়। আর একবার বলতেই উননের আঁচ টা একটু কমিয়ে দিয়ে তাকালও আমার দিকে।

-কি বললে, কি হবে?

– সাহিত্যিক।

-রসিকতা না করে গোসল করে এসো। রান্না শেষ। বলে খুন্তি টা দিয়ে কড়াই এর মধ্যে যা ছিল সেটা নাড়াচাড়া করতে থাকলো। 

বুঝলাম উলো বনে মুক্ত ছড়িয়ে লাভ নেই। আমার সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হবে।

পরের দিন খাতা পত্র কিনে ফেললাম। যথারীতি রাতের খাওয়া শেষে টেবিল চেয়ারে বসলাম। কলম টা কয়েকবার মাথায় ঠোকাঠুকি করে, চোখ বুজে, ভাবতে থাকলাম কোথা থেকে আরম্ভ করবো।

এক ঘণ্টা কেটে গেলো, একটা বাক্যও লেখা হলো না। 

এর মধ্যে গিন্নি তাগীদা দিয়ে গেছে বিছানায় যেতে। ভাবলাম আজ হবে না, মাথায় প্লট আসছে না। বড় বড় সাহিত্যিকরা কি একদিনেই বড় সাহিত্যিক হয়েছিল। মন কে সান্ত্বনা দিয়ে বিছানায় চলে এলাম। গিন্নি তখন গভীর ঘুমে।

পরের দিন কাজে লাঞ্চের সময় দুই তিনজন কলিগ মিলে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো আমি সাহিত্যিক হবো।

কাঞ্চন কেবল স্যান্ডউইচ টাতে কামড় বসিয়ে ছিল। ওটা বেড়িয়ে এসে থালাতে পড়ে গেলো।

ওরা তিন জন তাকালও আমার দিকে। যেন অবিশ্বাস্য কোন কথা আমি বলে ফেলেছি।

-কেন? লেখা আমার মাথা দিয়ে আসবে না বলে তোদের মনে হয়।

-না না তা নয়। বলে সুমন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বলল, শোন লিখতে হলে পড়তে হবে, পড়তে হবে বিভিন্ন লেখকের বই। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়। তার বাহিরেও।

কথাটা মনে ধরলও।

পরের দিন কাজ থেকে ফেরার পথে গেলাম সাগরের বই এর দোকানে। কিনা ফেললাম গোটা দুই তিন বই। বাসায় ফিরতে একটু দেরী হয়েছিল সেদিন।

বাসাতে ঢুকতেই আমার মেয়ে শমিতা হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো বারান্দায়। চুপিচুপি বলল, মা র মেজাজ টং হয়ে রয়েছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?

-ভুলুর মা এসেছিল, তার সাথে কথা বলার পরই— কথা শেষ না করেই দৌড়ে চলে গেলো তার ঘরে। 

আমার মেয়ে শমিতা মাত্র দশ বছর হলে কি হবে সেই আমাকে আগলিয়ে রাখে। 

ঘরে ঢুকে দেখলাম গিন্নির চেহারা টা আষাঢ় মাসের মেঘের মত হয়ে আছে। আমার হাতে তখনো রয়েছে তিনটা বই। বই গুলো টেবিলের উপর রাখতেই গিন্নির রাগ এসে পড়লো আমার উপর।

-এইগুলো কি?

-বই।

-হঠাৎ বই পড়ার শখ হোল কেন?

-বই না পড়লে জ্ঞান হবে না আর জ্ঞান না  হলে লেখা আসবে না।

-রাখো তোমার লেখা। সবার চাকরিতে উন্নতি হচ্ছে আর তোমার কি হচ্ছে? সেই একি জাগায় তো পড়ে আছো আজ এত বছর।

বুঝলাম এসবই ওই ভুলুর মার ব্যাপার।

কথার উত্তর না দিয়ে ঢুকে পড়লাম বাথরুমে। এই একটা জায়গা যেখানে পুরোপুরি তুমি স্বাধীন। কলটা ছেড়ে দাও, মনের সুখে গান করো।

একটু সময় নিয়ে বের হলাম বাথরুম থেকে। সময় যত পাড় হবে রাগ টা তত পড়ে যাবে। এই পদ্ধতিতে আমি বিশ্বাসী।

তাই হোল। এক সাথে রাতের খাওয়া টা শেষ করলাম। মেয়েটা এসে আমার পাশে বসলো। ওর ঘন চুলের ভিতর হাত বুলাতে বুলাতে আমি একটা বই হাতে তুলে নিলাম।

বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেলো। বইগুলো পড়ে শেষ করেছি। কিন্তু মাথা দিয়ে লেখা বের হোল না। মেয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে, বাবা কিছু এলো।

বললাম, না মা, এলো না।

 অগত্যা, ইস্তফা দিলাম।

বেশ কিছুদিন চুপচাপ কেটে গেলো। একদিন আড্ডার আসরে কলীম বলল, এই মহি তুই তো বেশ ভালো বক্তৃতা দিতে পারিস, রাজনীতিতে নেমে যা না।

ওর কথাটা কানে বাজতে থাকলো।

রাজনীতি নিয়ে কোনদিন আমি মাথা ঘামাই নি। স্কুল জীবনে একটু আধটু করেছি। সেই শেষ।

কে যে কোন দলে আছে খোঁজ রাখি না।

একদিন আমি আর কবীর বসে চা খাচ্ছিলাম এক রেস্টুরেন্টে।

এমন সময় একজন এলো, সাথে অনেক চেলা চামুন্ডা। পিছনের দিকে বেশ কয়েক টা চেয়ার টেবিল নিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা উনার সেবা তেই মগ্ন হয়ে গেলো। দুই একজন কে ডেকেও কাছে আনা গেলো না।

কবীর বললও, চিনিস ওকে?

বললাম, না।

-অমুক দলের উঠতি নেতা।

সেই নেতার হঠাৎ করে চোখ পড়লো আমার দিকে। উঠে এলো আমার টেবিলে।

তাকালও আমার দিকে। চোখাচোখি হোল। চিনতে পাড়লাম না।

-মহি না? বলে আমার কাধে একটা থাপ্পড় দিলো।

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।

-শালা, রজত, সেই স্কুলের সাথী।

এইবার মনে পড়ল। সেই হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা। আমার পাশে বসতো। অংক, বাংলা, ইংরাজি কিছুই বুঝতে পারতো না। আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলত, এটা তো কিছুই বুঝলাম না। ওর জন্য কত বার আমি মাস্টারের কাছে বকা খেয়েছি। প্রথম বার এস,এস,সি পরীক্ষায় সে পাশ করতে পারেনি। সেই শেষ দেখা আমার সাথে।

-কিরে হা হয়ে গেলি।

-তা  হা হওয়ার মতোই তো ব্যাপার। আমার বন্ধু বলছিল,তুই উঠতি নেতা।

-ওসব কথা থাক, কাল বন্ধের দিন, অবশ্য আমার সবদিনই সমান।  বিকেল পাঁচটায় আমার বাসায় আয়। অনেক কথা আছে।

বলে একজনের কাছ থেকে কাগজ কলম নিয়ে ফসফস করে ওর ঠিকানা টা লিখে আমার হাতে গুজে দিলো।

বাসায় এসে গিন্নিকে বলতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ভুলে গিয়েছিল মেয়ে পাশে দাড়িয়ে।

জিজ্ঞাসা করলাম তোমার এত উৎফুল্ল হওয়ার কারন?

-উনাকে চেননা তুমি, উনি উঠতি নেতা। তোমার বাল্যবন্ধু। তোমাকে উনার বাসায় যেতে বলেছে। এত বিরাট ব্যাপার।

-ও নেতা তাতে আমার কি যায় আসে। বলে আমি জুতো মোজা খুলতে লাগলাম।

-তোমার দাড়া কিচ্ছু হবে না। উনাকে বলে প্রমোশন টা করিয়ে নিতে পারো কিনা দেখো।

রাতে ঘুম এলো না। যাবো কি যাবো না এই দ্বন্দ্বের মধ্যদিয়ে রাতটা কেটে গেলো। গিন্নির পিড়াপিড়ি আর নিজের ও জানতে ইচ্ছা করছিল এই এস,এস,সি ফেল করা ছেলে টা আজ এইখানে উঠলো কি ভাবে।

বিশাল বাড়ি। মোজাইকের তৈরী মেঝে। দামী সোফা। দালানে আর্ট ঝুলছে। ও আর্টের কি মর্ম বোঝে আমি বুঝতে পাড়লাম না। যাহোক সে নিজে এসে আমাকে দরজার থেকে নিয়ে গেলো।

চা , সমুচা, নুডুলস এসে গেলো।

চা র পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললাম, কবে থেকে রাজনীতি শুরু করেছিলি।

– এস,এস,সি টা পরে অবশ্য পাশ করেছিলাম। কলেজে এসে ছাত্র রাজনীতি আরম্ভ করলাম। তারপর ধীরে ধীরে  এই পর্যন্ত এসেছি। তোদের দোয়ায় দুটো গারমেন্টস ইন্ডাস্ট্রি দিয়েছি। চার পাঁচ টা বাড়ি আছে অমুক জায়গায়।

শোন তুই ও রাজনীতি তে ঢুকে পড়। আমি সাহায্য করবো। তোর তো মাথা আছে, অবশ্য এই পথে মাথা থাকার কোন দরকার নেই।

-কেন? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

-শুধু কথা বেচে খাবি। দেখবি টিপস আসছে।

-টিপস মানে? আমি দুই চোখ বড়বড় করে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম।

-আহ, তুই একটা বোকা। কাউকে সাহায্য করলি,টেন্ডার টা পাইয়ে দিলি।  তার পরিবর্তে সে খুশি হয়ে টিপস দিলো। বুঝলি কিছু?

-হা, বুঝলাম, কিন্তু আমি তো জনগনের সেবা করতে চাই।

-গুলি মার তোর জনগনের সেবা। আগে নিজের সেবা কর। দেখছিস না চারিদিক। নিজের আঁখের গুছাতে ব্যাস্ত সবাই।

-না, তাহলে আমার দাড়া এ হবে না।

-তাহলে তোকে সারা জীবন ওই ঘানিই চালাতে হবে। বলে সিগারেটের প্যাকেট টা বের করলো।

গিন্নি বলে দিয়েছিল ওকে বলে আমার প্রমোশন টা করে নিতে। আর তা নাহলে ওর ডানহাত হয়ে আপাতত কাজ করতে। তাহলে ভবিষ্যতে আমি একটা কেউকেটা হতে পারবো।

কিন্তু আমি পাড়লাম না। ওকে আমার প্রমোশনের কথা বলে আমার উচু মাথাটা নিচু করতে পাড়লাম না।

আমি চলে এলাম।

রিক্সার টুংটুং শব্দ শুনে দরজা খুলে দাড়ালো আমার মেয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা তোমার কিছু হয়েছে?  তুমি মনমরা কেন? বলে আমার হাত টা চেপে ধরলও।

-আমি কিছুই হতে পাড়লাম না, মা। না সাহিত্যিক, না রাজনীতিবিদ। আমার প্রতিভা নেই। বলতে বলতে গলায় কান্নার স্বর টা আমি শুনতে পেলাম।

–তোমার যা আছে তা অনেকরই নেই বাবা। বলে সে আমাকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো।

তারপর আমার খুব কাছে এসে বলল, মনে পড়ে বাবা, তুমি আমাকে মাঝ রাতে উঠে কোলে করে দুধ খাওয়াতে। শুনেছি মা র কাছে।

 আমার পেম্পার পালটিয়ে দিতে।

আমি হাটতে শিখলে তুমি আমার ছোট হাতটা ধরে বাহিরে হাটতে নিয়ে যেতে। রাস্তায় কাউকে দেখলে বলতে,

দেখো দেখো আমার মা হাটতে শিখেছে।

তারপর আস্তে আস্তে আমি যখন আর একটু বড় হলাম, একদিন আমার প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল। তুমি সারা রাত আমার পাশে বসে আমার কপালে ঠাণ্ডা পানির পট্টি দিয়েছিলে।

আমার দশ বছর বয়সেও এখনো তুমি মাঝে মাঝে আমার চুল আঁচড়িয়ে দাও। পাশে বসিয়ে বল, দেখি মা তোর মুখটা, এত মেয়ে দেখি এমন সুন্দর মুখ তো দেখি না।

তুমি কি, তা তুমি জানো না বাবা। তুমি হচ্ছ আমার কাছে পৃথিবীর সব চেয়ে সেরা বাবা।

বলে সে আমার কোলে মাথাটা রেখে বলল, তুমি কাঁদছ বাবা।

বললাম, না মা, চোখে কি যেন পড়েছে, বলে মেয়েটার মাথা টা চেপে ধরলাম বুকে।

আমার বুকটা শান্তিতে ভোরে গেলো।

,

Continue Reading

আমি অভিনেতা নই

  আমি নাট্যদলে ঢুকেছি। কি রকম অদ্ভুত শোনাচ্ছে না কথাটা। আমার নিজের কাছেও তাই মনে হয়েছিল। আমি ঢুকতে চাইনি। জোড় করেই আমার নামটা লিখিয়ে দিয়েছিল ওদের নাট্যদলে।

ওর নাম নবীন। মাঝে মাঝে দেখেছি ওকে এখানে ওখানে। পরিচয় টা এমন জায়গায় হোল যেখানে সবার চোখে জল। আমার চোখ টা তাড়াতাড়ি ভেজেনা। অনেকে মনে করে আমি নিষ্ঠুর। এই পরিবেশে কারোর চোখে জল আসবেনা তাই কী হয়? আমি চেস্টা করি কিন্তু আসেনা।

তাই দুরে দাড়িয়ে ছিলাম। বুকটার মধ্যে ব্যাথা করছিল। একটা অস্থিরতা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। ওখান থেকেই তাকিয়েছিলাম কাঠের তৈরী বাক্সটার দিকে। ওখানে শুয়ে আছে আমার বন্ধু।

ওকে ঘিরে আছে আমার অন্যান্য বন্ধুরা। আছে আত্মীয় স্বজন। ওরা কাঁদছে।

আমার বন্ধুর ছিল অনেক বন্ধু। ও সবার সাথে মিশে যেতে পারতো। ছেলে বলো মেয়ে বলো প্রথম পরিচয়ে ও অনর্গল কথা বলে যেতে পারতো। মনে হতো ওরা ওর অনেক দিনের পরিচিত। আমি ওর পাশে থাকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ওর কথা শুনতাম। ওদের মধ্যে কেউ যদি আমার সাথে কথা বলতে চাইত তবে আমি দুই কথার পড়ে আর কথা খুজে পেতান না। 

সেই পরিবেশে কখন যে নবীন এসে আমার পাশে দাড়িয়েছে আমি জানিনা।

-উনি আপনার কেউ হন। প্রশ্নটা ও করেছিল আমাকে।

-আমার বন্ধু, খুব কাছের। বলে আবারও তাকিয়ে রইলাম ঐ ভিড়ের দিকে।

বলেছি আমি কথার পিঠে কথা বলতে পারিনা। তাই আমি চুপ করে রইলাম।

-উনি আমার চাচার বন্ধু। আমাদের এক নাট্যদল আছে ওখানে উনি আসতেন। সেই সুবাদে আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল। অমায়িক ছিলেন। চাচার বন্ধু অথচ আমি উনাকে ভাই বলে ডাকতাম। বন্ধুসুলভ কথা বার্তা বলতেন। আমাকে স্নেহ করতেন। এই বলে ও থামল।

আমি কোন উত্তর দিচ্ছি না বলে আবার ও বলল, কাছে ধারে থাকেন বুঝি।

বললাম, হ্যাঁ, দশ মিনিটের পথ।

-আপনি শম্পাকে চেনেন?

এবার আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। যেহেতু শম্পা নামটার সাথে আমি পরিচিত।

-হ্যাঁ, কেনও বলুন তো?

-আমি আপনাকে দেখেছি ওর সাথে কথা বলতে। ও আমাদের নাট্যদলের সহকর্মী। আসুন না সামনের রবিবারে আমার বাসায়। নাটকের মহড়া আছে। শম্পাও আসবে। ওকে বলব আপনাকে নিয়ে আসতে। এই দেখুন, আপনার নামটাই জানা হলনা।

নাম আদান প্রদান করলাম। আমি যে একটু বিরক্ত হয়নি তা নয়। এই পরিবেশে ও আমাকে নাটকের কথা বলছে। তবে ভালো লাগলো এই ভেবে ও আমার সামনে আহা উহা করেনি। বরং পরিবেশ টাকে হাল্কা করার চেষ্টা করছে।

বললাম শম্পাকে আমি চিনি, পরিচয় আছে এইটুকু।

-ওতেই হবে।

কাঠের বাক্সটা ফিউনারালের গাড়ীতে উঠিয়ে দিলো সবাই মিলে। যাত্রা হবে সেইখানে যেখানে খোঁড়া আছে ছয় ফুটের একটা গর্ত।

বললাম, এবার আমি যাবো। ওদের সাথে যেতে হবে।

-আপনার সাথে দেখা হবে আগামী রবিবার। বলল সে।

আমি কোন উত্তর দিলাম না। আস্তে আস্তে গাড়ীর কাছে এলাম।

ঘুম টা ভাঙ্গল টেলিফোনের শব্দে। আমার ঘুম আসে শেষ রাতে। বন্ধুরা বলে আমি নাকি নিশাচর। রাতের ঘুমটা তাই পুষিয়ে নিতে চাই সকালের ঘুমে। বিরক্ত হলাম। নাম্বার টা পরিচিত মনে হোল না। তাও কেন জানি ঘুমের ঘোরে হ্যালো বলে ফেললাম।

-তুমি ঘুমাচ্ছ? সরি। শম্পা বলছি।

মনে পড়লো সেইদিনের কথা। কথা গুলোকে আমি গুরুত্ব দেই নি সেদিন। কিন্তু ও যে সত্যি শম্পা কে বলবে তা কস্মিনকালেও মনে হয়নি।

-শোন তোমাকে ঠিক বারটায় আমি পিক করব। ঠিকানা টা বলও।

চোখ কচলাতে কচলাতে বললাম, ও আমার পোষাবে না। নবীন কে বলও আমি দুঃখিত।

-ও শোনবে না। ও তোমার মধ্যে কী পেয়েছে আমি জানি না। আমি ঠিক বারটায় আসবো। রেডি হয়ে থেকো। বলে লাইনটা কেটে দিলো।

বিরক্তের শেষ নেই। ঐ ছেলেটার উপর ভীষণ রাগ হোল। আমি আবার এই রাগ গুলো সচরাচর মুখের উপর বলে দিতে পারিনা। এটাও আমার একটা দুর্বল দিক। তবে মনে হোল, যাই না, দেখি ওরা কী করে। রবিবার টা ঘরে বসে না কাটিয়ে ওখানে না হয় কিছুক্ষণ সময় কাটালাম।

শম্পা এলো ঠিক ঘড়ির কাঁটা ধরে। এই প্রথম আমি ওর সাথে এক গাড়ীতে উঠলাম। ওর সাথে আমার পরিচয় অনেকদিনের। তবে সেই বন্ধু বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা নয়। ওই যে আগেই বলেছি, আমি স্বল্পভাষী। তাই সবার সাথে বন্ধুত্ত করা আমার হয়ে উঠেনা।

গাড়ীর দরজা খুলে ঢুকতেই খুব মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এলো। পারফিউমের গন্ধ।

বলতে ইচ্ছে হোল, খুব সুন্দর গন্ধ তোমার এই পারফিউমের। নাম টা কী বলো তো। না, বলা হোল না। উচ্ছ্বসিত হয়ে কিছু বলতে আমি পারিনি কখন।

-কী করো সারাদিন? জিজ্ঞাসা করল শম্পা।

-বই পড়ি, টিভি দেখি। বললাম।

-কিছু চিন্তা করেছ? এই ভাবে বাকি জীবন টা কাটাবে?

-মন্দ কী?

আমরা এসে গেলাম নবীনের বাসার সামনে। বড় বাসা। সামনে সুন্দর করে ছাঁটা লন। চারিদিকে বিভিন্ন রং এর ফুল ফুটে আছে। হৈ চৈ শুনতে পেলাম বাসার ভিতর। ঢুকতেই নবীন এগিয়ে এলো।

-আমি যে কী খুশি হয়েছি কী বলব। আসুন। বলে পরিচয় করিয়ে দিলো ওদের নাট্যগোষ্ঠীর কর্মীদের সাথে।

আসমা, সায়মা, মীতুল, চন্দন, করিম,রোকন।

একটু দুরে বসেছিলেন, বয়স্ক এক ভদ্রলোক। গুরু গম্ভীর। নবীন আমাকে নিয়ে এলো উনার সামনে।

-আমাদের নাটকের পরিচালক, জব্বার ভাই।

বুঝলাম এখানে সবাই ভাই আর ভাবী। অথবা নাম ধরে ডাকা। বয়স এখানে উহ্য।

-অভিনয় করেছেন কখন? জব্বার ভাই জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে।

-না, ওটা আমার সাধ্যের বাহিরে। নবীন জোড় করল, তাই আসা।

-কার কোনটা সাধ্যের বাহিরে তা কি সে জানে? আপনার মধ্যে যে প্রতিভা বিরাজ করছে তা হয়ত আপনি জানেন   না।

শুনতে বেশ ভালোই লাগছিলো আমার ভিতরের প্রতিভার কথা শুনে। কে না চায় নিজের গুনের কথা অন্যের মুখে শুনতে।

ওদের নাটকের মহড়া আরম্ভ হোল।

আমি টেবিল থেকে সমুচা আর কফি নিয়ে ঘরের কোণে একটা চেয়ার টেনে বসলাম।

শেক্সপীয়ারের ওথেলো নাটক।

শুরুতেই দেখা গেলো Brabantio র ভূমিকায় যে অভিনয় করবে সে তখনো পৌঁছায়নি। পরিচালক গজগজ করতে লাগলেন।

-কতদিন বলেছি সময় মতো না আসতে পাড়লে ছেড়ে দাও।

তারপর উনি আমার দিকে তাকালেন।

-আপনি কি Brabantio র ভূমিকা টার প্রক্সি দিতে পারবেন?

-আমি?

অবাক বিশ্বয়ে তাকালাম উনার দিকে।

বলে কি? বাংলা নয়, ইংলিশ। তারপর শেক্সপীয়ারের লেখা। পাগল হোল নাকি ভদ্রলোক।

-হ্যাঁ, আপনি।

-ও আমার দাড়া হবেনা।

-কেন? ইংলিশ বলতে, পড়তে পারেন না? বেশ কটমট করে আমার দিকে চেয়ে উনি বললেন।

প্রথম দেখা আর চেনাতে এইভাবে কেউ বলতে পারে আমি ভাবিনি। তবে আমি মনে মনে ভাবলাম পরিচালক হতে হলে এমনি হওয়া উচিৎ।

আমাকে পড়তে হয়েছিল সেদিন। অভিনয় করে নয়।

মহড়া শেষে নবীন আমাকে নিয়ে এলো সবার মাঝে। বলল, উনি আজ থেকে আমাদের নাট্যগোষ্ঠীর একজন।

বেশ কিছু সময় পাড় হয়ে গেছে। আমি ভুলতে বসেছিলাম, নবীন, জব্বার ওদের নাম গুলো। এমনি এক সময়ে নবীনের ফোন এলো।

-অনেকদিন পরে, তাই না শমিত ভাই।

-হ্যাঁ, তা কি মনে করে। আমি জানতে চাইলাম।

-নতুন নাটক নামাবো সামনের নাট্যমেলায়। আপনার একটা রোল আছে সেখানে। আমি জানি আপনি না, না করবেন কিন্তু আমি শুনতে রাজি নই।

-না, লোক হাসাতে পারবো না। আর সেই সাথে তোমাদের নাটকটার ভরাডুবি করতে চাই না।

ও শুনল না। আমাকে যেতে হোল মহড়ার দিন। সেই পরিচালক। জব্বার ভাই।

নাটকের নাম সকাল সন্ধ্যা। প্রেমের কাহিনী। তবে মাঝ পথে শোকাবহ ঘটনা আছে। নায়িকার ভাই মারা যাবে ক্যান্সারে।

আর ঐ ভাইয়ের অভিনয়টা করতে হবে আমাকে।

বললাম, ঐ স্টেজে উঠা আর গলায় ফাঁস দেওয়া আমার কাছে সমান। কাজেই ও হবে না।

নবীন কে বললাম। ও শুনল না। না শুনল পরিচালক জব্বার ভাই।

আমি মুখস্ত করলাম। কিন্তু মহড়ার দিন সব তালগোল পাকিয়ে যেতো। আগের সংলাপ পিছে, পিছের সংলাপ আগে চলে আসতো।

একদিন জব্বার ভাই আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। আমার সংলাপ শেষ হওয়ার আগেই আমাকে থামিয়ে দিলেন।

দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ইমোশান আনুন। আপনি মৃত্যুপথযাত্রী। আপনার অভিনয় দেখে মনে হচ্ছে আপনি ফুটবল খেলা দেখতে যাচ্ছেন।

-আমি তো বলেছিলাম, আমার দাড়া হবে না। বেশ তেজেই বললাম।

-আলবৎ হবে। আমি আপনাকে দিয়েই এই রোল করাবো।

পরিচালক ঐ দিনের মত মহড়া বন্ধ করে দিলো। আমি আমার জ্যাকেট টা নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। মেজাজ তিরিক্ষি। হনহন করে গাড়ীর কাছে আসার আগেই পিছনে আমার নাম ধরে কে যেন ডাক দিলো।

মনীষা। এই গোষ্ঠীর সাথে অনেকদিন ধরে আছে।

-রাগ করে চলে যাচ্ছেন? জব্বার ভাই ঐ রকমই। কত বকা আমি যে খেয়েছি তার কাছে।

-তাই  বলে—–

কথা শেষ না হতেই মনীষা বলল, আপনি কোনদিকে যাবেন।

বললাম আমার ঠিকানা।

-আমার বাসাও ঐদিকে, গাড়ী আনতে পারিনি আজ, নামিয়ে দিতে পারবেন? অবশ্য—

-উঠুন।

চলার পথে কথা হচ্ছিল, খুবই সাধারন, মামুলি কথা। তবুও মনে হোল ওর হৃদয়ে কাঁটা দাগ আছে।

দীর্ঘ নিশ্বাস। মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যাওয়া।

 বাসার সামনে গাড়ীটা দাড় করালাম। ছোট্ট কেপ হউজ। আমি নেমে দরজাটা খুলে দেওয়ার আগেই মনীষা নিজেই নেমে পড়লো।

-ভিতরে আসুন, বিকেলের চা টা না হয় এক সাথে বসে খাবো।

বলার ভিতর একটা আন্তরিকটা ছিল, যেটাকে উপেক্ষা করা গেলো না।  

ছিমছাম করে সাজানো বৈঠকখানা। দুটো সোফা। পাশে একটা চেয়ার। সামনে টিভি।

-চা, না কফি?

-কফি। বলে পাশে রাখা সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বই টা হাতে নিলাম।

মনীষা ভিতরে চলে গেলো। আমি বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ঘরের চারিদিক টা দেখছিলাম।

মনীষা কফি নিয়ে এলো। সাথে ভাজা পোড়া।

গল্প করতে করতে বিকেল টা পেড়িয়ে গেলো। মনীষাই কথা বলল বেশি, আমি শ্রোতা। ভুলে গিয়েছিলাম দুপুরের ঘটনা টা।

-এবার উঠি। বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম।

-আবার কবে আসবেন? না, মানে কথা বলার একটা লোক পেলাম, তাই বলছি। আমরা কি ফোন নাম্বার আদান প্রদান করতে পারি? বলে সে আমার দিকে তাকাল।

-অবশ্যই, বলে আমি আমার ফোন নাম্বার টা দিলাম। সেও দিলো তারটা।

মনীষা গাড়ী পর্যন্ত এলো আমার সাথে।

এরপর অনেক বার মনীষার সাথে হেঁটেছি। বসেছি নদীর পাড়ে। লোকে কানাঘুষা করেছে। কান দেইনি। বলেছে সে তার জীবন কাহিনী।

প্রেমের বিয়ে। টেকেনি।

বাচ্চা না হওয়াতে শুধু খোটা দিতো মোহিত। খুত ধরত সব কিছুতে। তাই একদিন ইতি টেনে চলে গেলো ছোট্ট একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করে। সেখানে ছিল কয়েক বছর। তারপর এই বাসা।

আমরা দুজন আটকিয়ে গেলাম বন্ধুত্তের বন্ধনে।

মহড়া চলছিল। আমার অভিনয়ের উন্নতি হয়নি। তবু জব্বার ভাই হাল ছাড়েনি। হঠাৎ ই একদিন মহড়াতে বাঁধা পড়ল। নায়িকার কবিড ধরা পড়েছে। আপাতত মহড়া চোদ্দ দিনের জন্য বন্ধ।

বাসাতে বসা। মাঝে মধ্যে মনীষার সাথে কথা হয়।

কদিন ধরে শরীরটা দুর্বল লাগছিল। ঘুসঘুসে জ্বর। পাত্তা দেইনি।

 মনীষাকে বলেছিলাম। সে বলল, ডাক্তার দেখালে ভালো হতো না?

অনিচ্ছা সত্বেওগেলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করতে দিলো।

দুদিন পরে ডাক্তারের অফিস থেকে কল এলো।

ভূমিকা না করে বলল, মিস্টার শমিত আপনাকে একটা অনকোলজিস্টের কাছে যাওয়া দরকার। আমি রেফার করছি। ব্লাড রিপোর্ট খুব একটা ভালো আসেনি।

ধক করে উঠল বুকটা। সেই রাজরোগ। তিলে তিলে শেষ করে জীবন টাকে।

দেখালাম।

বলল, ব্লাড ক্যান্সার।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কতদিন হাতে সময় আছে।

-দুই থেকে চার বছর। নির্লিপ্ত ভাবে বলল ডাক্তার।

 ডাক্তার কে বলেছিলাম, কিমও এখন দিতে পারবো না। কটা দিন সময় দিতে হবে। নাটক আছে আমার।

-ডাক্তার অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে।

নাটক মঞ্চস্থ হতে চলেছে।

 আজ সেই দিন। অডিটোরিয়ামে তিল ধরেনের জায়গা নেই।

আস্তে আস্তে পর্দা উঠল।  

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব শেষ হোল। লোকের করতালি আমি শুনতে পাচ্ছি।

তৃতীয় পর্ব।

আমি বিছানায় শুয়ে। মৃত্যুপথযাত্রী। পাশে বসে আছে আমার মেয়ে কণিকা। বলছে, তুমি আমাদেরকে ছেড়ে যাবেনা বাবা।

একি লীলাখেলা। আমি সত্যিই তো ওই পথেরই যাত্রী। কে জানতো আমাকেই এই চরিত্রটা করতে হবে। অদৃষ্টের কি পরিহাস।

কি সংলাপ আমি বললাম আমি জানিনা। মনে হতে থাকলো আমার হাতে বেশি সময় নেই। আমাকে যেতে হবে।

  কান্নায় ভেঙে পড়লাম। দর্শক ভাবল আমি দারুন অভিনয় করছি।

শুধু কানে এলো করতালি।

আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম, এ অভিনয় নয়। আমি অভিনয় জানিনা। আমি অভিনেতা নই।

আমি অভিনেতা নই।

আস্তে আস্তে পর্দা টা নেমে এলো।

Continue Reading

পুতুল

  ঢক ঢক করে পানি খেলো প্রিয়া। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। কি একটা দুঃস্বপ্ন ওর ঘুম টা ভেঙে দিলো। মনে করার চেস্টা করল পুরো স্বপ্ন টা। না, শুধু মনে পড়লো কে যেন ওর গলাটা টিপে ধরেছিল। পাশে তাকিয়ে দেখল তন্নয় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

প্রিয়ার রাগ হোল। মনে হোল এক ধাক্কা দিয়ে ওকে উঠিয়ে দেয়।

মাঝে মাঝে এমন হয় প্রিয়ার। ও যখন ঘুমাতে পারেনা তখন কাউকে ঘুমাতে দেখলে ওর রাগ হয়। এটা এক রকম হিংসেমি কিনা ও বলতে পারেনা।

প্রিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে এলো বসার ঘরে। পিছনের বাড়ীর লনের আলোটার কিছু আলোক রশ্মি এসে পড়েছে ওর ঘরে। ও এসে দাঁড়ালো জানালার কাছে। জানালা দিয়ে সামনের রাস্তা টা দেখা যাচ্ছে। টিউবের আলো পড়েছে কালো পীচ ঢালা রাস্তাটার উপর। ঝলমল করছে। মাঝে মাঝে সাদা দাগ। এমন ভাবে কোনদিন সে দেখেনি রাস্তা টাকে। মনে হোল এ রাস্তাটা তার চেনা নয়। অথচ প্রতিদিন সকালে সে হাটে এই রাস্তা দিয়ে। দেখা হয় পরিচিত লোকজনের সাথে।

হাই, হ্যালো বলে।

প্রায় পাঁচ বছর হোল বিয়ে হয়েছে প্রিয়ার। তারও আগে তিন বছর ও আর তন্নয় এক সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে। পাঁচটা বছরে ওর কোলে কেউ এলো না। ডাক্তার দেখিয়েছে। কোন ফল হয়নি।

মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। তন্নয় তাকে উৎফুল্ল করার চেষ্টা করে।

অনেকে বলে, মানত করে এসো ঐ দরগায়, সুতো বেঁধে এসো। 

ঐ সবে বিশ্বাস নেই ওদের দুজনের।

বিছানায় আর ফিরে গেলো না প্রিয়া। সামনে পড়ে থাকা অর্ধেক পড়া বইটা হাতে তুলে নিলো।

সকালে তন্নয় অফিসে গেলে প্রিয়া তার জিমের সুট টা পড়ে হাটতে বেড়িয়ে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পথে দেখা তন্নী আর সুভ্রার সাথে। বন্ধু বলা যায়না। হাটার সাথী।

আজও হাটতে হাটতে আর মেয়েলি গল্প করতে করতে চলার পথে ফোনটা বেজে উঠল।

তন্নয়ের ফোন।

অফিসে যেতে না যেতেই কেনও ফোন করল, ভেবে মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা নাড়া দিয়ে উঠল।

-হ্যালো। কি ব্যাপার, সব ঠিক তো?

-হ্যাঁ, শোন এবার ঈদের ছুটিতে আমরা রাঙামাটিতে বেড়াতে যাবো। সাগরের কথা মনে আছে? ও কল করেছিল। আসতে বলল। কি বলও?

-উত্তরটা কি এখনি দিতে হবে, নাকি তুমি বাসায় এলে দিলে হবে না? বলে হাসল প্রিয়া । ও চেনে তন্নয় কে। কোন কিছুতেই ওর তর সয় না।

-ঠিক আছে, বলে ফোন টা রেখে দিল তন্নয়।

অনেকদিন বাহিরে যাওয়া  হয়নি। প্রিয়াও চাচ্ছিল কোন একদিকে গেলে মন্দ হতো না। কাজেই মনে মনে একটা ছক কেটে নিলো তন্নয় এলে কি বলবে। সাগর তার পরিচিত। বিশেষ করে তার বৌ পান্না ছিল অনেক কাছের। থাকতো ওরা তাদের বাসার থেকে খুব একটা দুরে নয়। তারপর সাগর যখন চাকরি নিয়ে রাঙামাটি চলে গেলো তখন আস্তে আস্তে দূরত্বটাও বেড়ে গেলো। 

অনেকদিন ওদের সাথে যোগাযোগ নেই প্রিয়ার। চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল তো হবেই। সেই সাথে ব্যাস্ততা।

গুনগুণ করে একটা গানের কলি আওড়াতে আওড়াতে বাসার গেটে এসে দাঁড়ালো প্রিয়া।

তাকালও বামে। অনামিকা তার তিন বছরের মেয়ে টার সাথে খেলছে বাসার সামনের লনে।

 অনামিকা তাকালও।

-হাটতে বের হয়েছিলে বুঝি? বলে মেয়ে সুপর্ণাকে কোলে নিয়ে এসে দাড়াল গেটের কাছে।

প্রিয়া হাত বাড়াতেই সুপর্ণা চলে এলো ওর কোলে।

এই বাড়ীতেই প্রিয়ার যাওয়া আসা বেশি। প্রিয়ার মত অনামিকাও বাসাতে থাকে মেয়ের পিছনেই সারাটা দিন কেটে যায়।

-কোন কাজ আছে? অনামিকা জিজ্ঞাসা করতেই প্রিয়া বলল, না আমার আর কাজ কোথায় বলে সুপর্ণার গালে চুম দিয়ে চেপে ধরলও ওকে।

-তাহলে এসো, চা খাই আর গল্প করি।

প্রিয়ার বাসায় ঢোকা হোল না। সুপর্ণা কে ওর মা নিতে চাইল, ও গেলো না। প্রিয়ার গলাটা জড়িয়ে ধরে মাথাটা নামিয়ে দিল ওর কাঁধে।

-দেখলে কেমন বেইমান মেয়ে টা। বলে হাসতে হাসতে অনামিকা গেটটা খুলে দিলো।

অনামিকার স্বামী মহীউদ্দিন,  ইউনিভার্সিটির ইংলিশের প্রফেসর। দিল দরিয়া মানুষ। সব সময় মুখে হাসি লেগেই আছে।

ছুটির দিনে কোন প্রোগ্রাম না থাকলে অনামিকাদের বাসাতেই আড্ডা বসে। আরও  দুই তিনটা বন্ধু তাদের বৌ দের নিয়ে  এসে যোগ দায়। তাস খেলা চলে।  বৌ রা হাতে হাতে কয়েকটা ডিশ তৈরী করে ফেলে। কোন কোন দিন আড্ডা দিতে দিতে মাঝ রাত হয়ে যায়।

-এবার ঈদের প্রোগ্রাম ঠিক করেছ? চা র পানিটা বসাতে বসাতে জিজ্ঞাসা করলো অনামিকা।

-তন্নয়ের এক বন্ধু থাকে রাঙামাটিতে। যেতে বলছে। ওখানে যেতে পারি। 

-আমারও রাঙামাটিতে যাওয়া হয়নি। বলে অনামিকা ফ্রীজ খুলে মিষ্টির পাত্র টা এনে রাখল টেবিলে। তারপর প্রিয়ার কোলে বসে থাকা সুপর্ণা কে বলল, এসো, তোমার দুধ খাওয়ার সময় হয়েছে বলে হাত পাতলো।

সুপর্ণা মুখ টা ফিরিয়া নিলো।

-আমাকে দাও ভাবী, আমি খাইয়ে দেই। বলে আবারও চুমো দিলো ওর গালে। তোমরাও চলো না আমাদের সাথে। খুব মজা হবে।

-দেখি তোমার ভাই কে বলে।

কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে প্রিয়া এলো তার বাসায়।

ওর মনে হোল ওর সারা শরীরে সুপর্ণার শরীরের মিষ্টি ঘন্ধ। ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল গুলো  ওর মুখে চোখ ছুঁয়ে যাচ্ছে।  ওকি কোন দিন মাতৃত্বের স্বাদ পাবে না? ওর কোল জুড়ে কি কেউ আসবে না।

একটা দীর্ঘও নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সব কিছু থেকেও যেন অনেক কিছু নেই তার।

চেয়ার টা টেনে এনে বসল। মনে পড়লো অনেকদিন আগে অনামিকা বলেছিল, ভাবী কিছু মনে করো না, একটা কথা বলি।

-বলও।

– আমি বলি কি একটা বাচ্চা এডোপট করো। আমার কথায় কিছু মনে করোনা, তবে চিন্তা করতে দোষ কি?

কেন জানি ঐ কথা গুলো আজ খুব মনে পড়ছে প্রিয়ার।

সব ঠিকঠাক। অনামিকারাও যাবে ওদের সাথে। তন্নয় সাগরকে জানিয়েছিল, ওরা আসছে তবে আরও লোক আছে। সাগর আর পান্না দুজনেই খুশি। অনেকদিন পরে দেখা হবে। নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়া যাবে পুরনো হারানো দিন গুলো।

ঈদের আগের দিন ওরা এসে পৌছালো বিকেলে রাঙামাটিতে। 

সাগর-পান্নাদের বাসাটা রাস্তা থেকে একটু উচুতে। দোতালা। সামনে ফুলের বাগান।

দরজা খুলেই পান্না জড়িয়ে ধরলও প্রিয়া কে। কতকাল পরে দেখা তোমার সাথে। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো। সাগরই বলে উঠলো, ওদেরকে  আগে ঘরে ঢুকতে  দাও।

তন্নয় পরিচয় করিয়ে দিলো মহীউদ্দীন আর অনামিকার সাথে। পান্নার ছেলে সুপর্ণার বয়সী। তাকিয়ে ছিল সুপর্ণার দিকে। ছোটরা ছোটদের কথা বুঝতে পারে। ওরা জানে ওদের ভাষা। অনামিকা নামিয়ে দিলো সুপর্ণা কে। ওরা দুটো কুটিকুটি পা ফেলে চারিদিকে ঘুরতে থাকলো।

সাগর ওর কাজের থেকে একটা মাইক্রোবাস জোগাড় করেছে। ঈদের পরের দিন ওরা বেড়িয়ে পড়লো সাজেক ভ্যালি, কাপ্তাই লেক দেখতে। সাথে রান্না করে নিয়েছিল হরেক রকমের খাবার। পথে থেমে ছিল একটা সুন্দর লেকের পাশে। ওখানেই চাদর পেতে সবাই বসলো লাঞ্চ খেতে।

কথা বলতে বলতে সাগর বলল, কাল বাসায় আমার এক বন্ধু কে বলেছি ডিনার করতে। আমরা এক ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। নাম অচীন্ত।  আমাদের থেকে কয়েক বছরের ছোট। বিয়ে করেছে এক সাঁওতালি মেয়েকে। প্রেম করে। নিজেদের দুটো ছেলে মেয়ে আর আছে চার মাসের একটা মেয়ে। বলে থামতেই, প্রিয়া বলল, সাগর ভাই আপনি কিন্তু বলেছেন, নিজেদের দুটো ছেলে মেয়ে, তার মানে চার মাসের মেয়ে টা ওদের নয়।

-ঠিক বলেছ। ওটা ওদের নয়, ওর বাসায় কাজ করতো তার মেয়ে। ঘটনা টা খুলেই বলি, মেয়েটা  প্রেগনেন্ট হওয়ার পাঁচ মাস পরে হঠাৎ একদিন গাড়ী এক্সিডেন্টে ওর স্বামী মারা যায়। অচীন্তের বৌ ওকে ওদের বাসাতেই রেখে দেয়। কিন্তু অদৃষ্টের কি পরিহাস, বাচ্চা হতে যেয়ে মা মারা যায়।

সেই থেকে বাচ্চা টা ওদের কাছেই আছে।

প্রিয়া চোখের জল ঠেকাতে না পেরে তাকালও পাশের দিকে। সাগরের চোখ এড়ায়নি।

-তুমি কাঁদছ? সাগর জানতে চাইলো।

-ধরে রাখতে পারলাম কই, সাগরদা।

সন্ধ্যায় এক থালা চাঁদ উঠল আকাশে। তারই নরম আলোটা ছড়িয়ে পড়ল বাড়ীটার সামনের লনে। ওরা চেয়ার নিয়ে এসে বসলো সাদা টেবিলের চারিপাশে। পান্না এক সময় গান করতো। সবার অনুরধে,  “ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি—– “ গান টা ধরল সে।

প্রিয়া চোখ বন্ধ করে শুনছিল গানটা। তার মনে সেই না পাওয়ার এক আকাঙ্খা তীব্র থেকে তীব্রতর হোল।

রাত গভীর হোল। সবাই একে একে উঠলো। শুধু বসে রইল প্রিয়া। তন্নয় কে বসতে বলল।

আসে পাশে কেউ নেই। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মাঝে মাঝে রাত জাগা পাখি গাছের ডাল ঝাঁকিয়ে উড়ে যাচ্ছে।

তন্নয় এসে বসল প্রিয়ার পাশে।

-কিছু বলবে।

-আচ্ছা, ওই পাঁচ মাসের বাচ্চা টাকে আমরা এডোপট করতে পারিনা? ওদের তো আরও দুটো বাচ্চা আছে। বলতে বলতে কান্না ভরা কণ্ঠে তন্নয়ের কাঁধে মাথাটা নামিয়ে দিলো।

সাঁজ সাঁজ রব। মহিলারা ব্যাস্ত রান্না ঘরে। মনে হচ্ছে বিরাট পার্টি। অথচ সবে গুনে আঁট জন। ছেলেরা বসেছে তাস খেলতে।

তন্নয় উচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদের মেনুতে আজ কী কী আছে? যে রকম আঁটসাঁট বেঁধে নেমেছ তোমরা।

-টিপ্পনী কাটছ? তাহলে মাছের ভর্তা তুমি পাবেনা। হাসতে হাসতে প্রিয়া এসে তন্নয়ের গালে একটা টোকা দিয়ে গেলো।

অতিথি এসে পৌছাল ঠিক সাতটায়। অচীন্ত, তার বৌ, দুটো বাচ্চা আর স্ট্রলারে শুয়ে আছে ছোট্ট মেয়েটা। অচীন্তের  বৌ এর গায়ের রং একটু কালোর দিকে। সুন্দর করে পড়া কালো পাড়ের শাড়ী। প্রসাধন রুচি সম্মত। কেবল মাত্র চেহারা ছাড়া কেউ বলবে না সে সাঁওতালি।

প্রিয়া স্ট্রলারের কাছে এসে শুয়ে থাকা পুতুলটার গালটা টিপে দিলো। তন্নয়ের চোখ এড়ায়নি। 

দুজনে চোখাচোখি হোল।

মুরগীর রোস্ট, বীফ ভুনা, ভাজা চিংড়ি মাছ, পোলাও সাথে সাদা ভাত। ভর্তা আর শুটকি দিয়ে খাওয়ার জন্য। অচীন্তের বৌ ঠোটের কোণে হাসি দিয়ে বলল, ভাবী, এত সব করলেন কখন।

কথায় আঞ্চলিক টান আছে। ওর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়েছিল প্রিয়া। কেমন যেন মায়াময় চাহনী।

খাওয়া শেষে আড্ডা, অচীন্তরা যখন চলে গেলো তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই। সবাই মিলে টেবিলটা পরিষ্কার করে এসে বসলো বারান্দায়। আকাশে নক্ষত্রের সারি।

মহীউদ্দীন বলল, বারান্দার আলো টা নিভিয়ে দেই। উপভোগ করি চাঁদের আলো। রোম্যান্টিক পরিবেশ টা।

বাহ, কবিতা লেখার অভ্যাস আছে নাকি? পান্না চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলল।

তন্নয় সামনে রাখা কোকের বোতলটা থেকে এক ছিপ গলায় ঢেলে দিয়ে বলল, তোমাদের কাছে একটা কথা বলতে চাই। শুনতে চাই তোমাদের অভিমত।

সবাই একটু নড়ে চড়ে বসল।

অনামিকা গায়ের ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বলল, খুব সিরিয়াস কথা মনে হচ্ছে।

-হ্যাঁ, তাই। বলে তন্নয় তাকালও প্রিয়ার দিকে।

-তাড়াতাড়ি বলে ফেলো, দোস্ত। সাগরের তড় সইছে না।

কাশি দিয়ে গলা টা পরিষ্কার করে তন্নয় বলল, তোমরা সবাই জানো, অনেক চেষ্টা করেছি আমরা, কিন্তু এলো নাতো আমাদের মাঝে আর একজন। তাই ঐ ছোট্ট তুলতুলে টাকে এডোপট করতে চাই। যদি অচীন্ত আর ওর বৌ রাজি থাকে।

কথা টা এক নিশ্বাসে বলে তন্নয় তাকালও সবার দিকে।

উৎফুল্ল হয়ে পান্না বলল, এতো বিরাট খুশীর খবর। তবে—

-জানি ওরা হয়তো রাজি হবেনা। প্রিয়ার গলার স্বরে কান্নার আভাস।

সাগর বলল, কালই আমি খোঁজ নেবো।

পরের দিন ওরা সবাই মিলে গিয়েছিল অচীন্তের বাসায়। কথাটা সাগরই পেড়েছিল। অচীন্ত শুনে বলেছিল, বলে দেখেন  আমার বৌ কে। এই পাঁচটা মাস বুকে চেপে ধরে রেখেছে।  রাত জেগে ওকে দুধ খাইয়েছে। অসুখ হলে অস্থির হয়ে উঠেছে। মানুষ করছে নিজের ছেলে মেয়েদের মত করে। কেউ বুঝতে পারবে না যে ও আমাদের মেয়ে না।

অনামিকা বলল আপনি রাজি তো?

ওকে দুঃখ দিয়ে আমি কিছু করতে পারবো না। বলে তাকালও প্রিয়ার দিকে।

অচীন্তের বৌ নাস্তা নিয়ে এলো। প্রিয়াই ওকে ডেকে বসাল নিজের পাশে।

কী ভাবে কথাটা বলবে সেটা সে চিন্তা করল। তারপর কোন ভূমিকা না করেই বলল, ভাবী তোমার ঐ পুতুল মেয়ে টাকে আমি কী আমার মেয়ে করতে পারি?

অচীন্তের বৌ কথা টা ঠিক বুঝতে পারলো না। অচীন্তই বুঝিয়ে দিলো। প্রিয়া আর তন্নয় ওকে এডোপট করতে চায়। তোমার অনুমতি থাকলে।

অচীন্তের বৌ কোন কথা না বলে সামনে পড়ে থাকা খালি প্লেট টা নিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো।

নীস্তবততা ঘিরে রইল টেবিল জুড়ে। কারোর মুখে কোন কথা নাই তন্নয় তাকালও অচীন্তের দিকে।

-অত্যন্ত দুঃখিত তোমার বৌ কে কষ্ট দেওয়ার জন্য। জানতাম, এ হবার নয়। ক্ষমা কর। তন্নয় কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।

প্রিয়া আর পান্না এলো রান্না ঘরে। শুনতে পেলো অচীন্তের বৌ এর কান্না।

প্রিয়া ওর কাঁধে হাত রাখল।

-মাফ করে দিও ভাই। তোমাকে দুঃখ আমি দিতে চাই নি। কেনও জানি মাতৃত্বের স্বাদ জেগে উঠেছিল ঐ পুতুল টাকে দেখে । নিজেকে বেঁধে রাখতে পারিনি। প্রিয়ার গলা পর্যন্ত কান্না।

অচীন্তের বৌ ফিরে তাকালও প্রিয়ার দিকে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ও আমার চোখের মনি। ওর মা আমাকে একদিন বলেছিল, আপা আমার যদি কিছু হয় , নতুন যে আসবে তুমি তাকে দেখো। ওকি জানতে পেরেছিল যে ও চলে যাবে?

প্রিয়া কান্না চেপে রেখে বলল, চল, আমাদের সাথে বসে গল্প করবে।

এবার ফেরার পালা। তন্নয় আর মহীউদ্দীন সুটকেস গুলো এনে বাহিরে রাখল। প্রিয়া, অনামিকা, পান্না এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। আকাশে মেঘের আনাগোনা। মাঝে মাঝে কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে বারান্দায়।

সাগর গাড়ী স্টার্ট দিয়ে নেমে এলো।

-চলো সবাই। বৃষ্টি আসতে পারে। গাড়ীতে বসে গল্প শেষ করো। বলে সাগর শেষ সুটকেস টা টেনে নিয়ে এলো।

ওরা বারন্দা থেকে দেখতে পেলো একটা কালো টয়োটা এসে দাঁড়ালো মাইক্রোবাস টার পাশে। নেমে এলো অচীন্ত আর তার বৌ। কোলে সেই তুলতুলে পুতুলটা।

এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। অচীন্তের বৌ এসে প্রিয়ার হাত টা ধরে বলল, চলে যাচ্ছ, কিন্তু  আবার তো আসতে হবে তোমাকে ভাই, তোমার এই মেয়েকে নিয়ে যেতে। ওর নামের শেষে তোমাদের নাম বসিয়ে।

এই বলে পুতুল টাকে প্রিয়ার কোলে তুলে দিলো।

প্রিয়া ওকে বুকে চেপে ধরল। দুই ফোঁটা জল গাল বেয়ে এসে পড়লো পুতুলের কপালে।

Continue Reading

ছায়া-কায়া

 শীতের সকাল। ঘুম থেকে উঠে কফি টা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম বাহিরের দিকে। গুঁড়িগুঁড়ি বরফ পড়ছে। বাহিরে যাবার ইচ্ছে নেই আজ। ভালো লাগতো এই বরফ পড়া দেখতে প্রথম জীবনে। আজ আর লাগেনা। সাইদ আসবে বলেছে বিকালে আড্ডা দিতে। ওর বৌ গেছে দেশে।

ভাবলাম, বহুকাল ধরে জমানো কাগজপত্র গুলো ফেলতে হবে। ফেলতে যেয়ে হাতে পড়লো অনেক আগের একটা পুরানো ছবি। আমার আর শমসেরের। স্কুলে পড়া কালীন ওঠানো ছবি। ঐ ছিল আমার সব চেয়ে কাছের বন্ধু।

নাটোর। বাবার বদলি চাকরি। পোস্টিং হয়েছিল নাটোরে। তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র আমি। প্রথম দিন শমসেরের পাশেই বসেছিলাম। সেই থেকে বন্ধুত্ব শুরু। ওর বাবার ছিল কাঠের ব্যাবসা, ছিল কয়েকটা বাস। বিশাল জমি নিয়ে ওদের বাসা। তার পাশেই ছিল আমাদের বাসা টা।

সে আজকের কথা নয়।  কত স্মৃতি ভরা সেই দিনগুলো।

যে কাজ করবো বলে হাত দিয়েছিলাম, তা আর হোল না। ছবি টা নিয়ে ড্রয়াইং রুমে এসে বসলাম। শমসেরের সাথে শেষ কথা হয়েছিল আজ থেকে দুই বছর আগে। চোখের সামনে ভেসে উঠল ওদের বাসার পিছনের সেই আম বাগান কাঁঠাল বাগান গুলো।

ওর ফোন নাম্বার টা বের করলাম।

-হ্যালো

-কিরে চিনতে পারছিস।

-না পারার কী কোন কারন আছে বন্ধু। তা কী মনে করে?

-ভাবছি ঘুরতে আসবো তোর ওখানে। সময় হবে তোর।

-আলবৎ, কবে আসবি? আমার চেহারা তোর মনে আছে তো?

– ফাজলামি ছাড়। আর শোন, ঢাকা থেকে ট্রেনে আসবো। ষ্টেশনে থাকবি।

দেরী করিনি আমি। অনেকদিন বাহিরে যাওয়া হয়নি। মনটাও ছুটে গিয়েছিল। টিকেট কেটে উঠে পড়লাম প্লেনে সাতদিন পর। তারপর ট্রেন ধরে এসে পোঁছালাম নাটোরে। তখন সন্ধ্যা।

নামলাম। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো শমশের। জড়িয়ে ধরলও। সাথে দুজন। আমার ল্যাগেজ টা ওরা নিয়ে নিলো।

-বেশ মুটিয়েছিস দেখছি। হাসতে হাসতে বললাম।

– তোর তো কোন পরিবর্তন নেই শুধু পাঁকা চুল আর এই মোছ টা ছাড়া। বলতে বলতে আমার হাতটা ধরে রাখল।

বাহিরে দাঁড়ানো ছিল ট্যাক্সি।  ভাড়া করে এনে ছিল। চারিদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছি। মনে হোল অনেক পাল্টে গেছে এই শহর টা। না পালটানোর কথা নয়। যখন এখানে ছিলাম বয়স ছিল দশ আর বিশের মাঝে। আজ সত্তর পেড়িয়ে গেছে।

শমসেরদের বাসার খুব একটা পরিবর্তন নেই। শমসেরের বৌ দরজা খুলে দিলো। এই প্রথম দেখলাম। বাচ্চারা বড় হয়ে চলে গেছে দুরে। বাড়ীতে শুধু ওরা দুজন।

-আসুন, আপনার কথা অনেক শুনেছি ওর কাছে। বলে দরজাটা খুলে ধরল।

অনেক রাত কাটিয়েছি ছোট বেলায় এই বাড়ীতে। খালাম্মার হাতের মুড়িঘণ্টের স্বাদ আজও মুখে লেগে রয়েছে।

-তুই হাত মুখ ধুয়ে নে। খাবারের ব্যবস্থা করতে বলি। বলে পাশে দাড়ানো লোক টাকে বলল আমার সুটকেস টা ঘরে নিয়ে রাখতে।

আমি গোসল সেরে এসে দাড়ালাম বাড়ীর বারান্দায়। দুটো চেয়ার পাতা। চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দাতে। মনে হোল আজ পূর্ণিমা।

শমসের এলো দুই গ্লাস ভর্তি আমের সরবত নিয়ে।

-ধর, বৌ বলল খাবার আগে এটা খেলে নাকি খিদে বাড়ে। বলে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

গ্লাসটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানকার সবাই কে কেমন আছে।

-তুই কী অন্যদের কথা জানতে চাইছিস না অনুর কথা। বলছি।

বলা হোল না। শমসেরের বৌ ডাক দিলো ডিনার খেতে।

খাওয়া শেষে শমসের বলল, তুই আজ বিশ্রাম নে, আমাকে একটু যেতে হবে বাহিরে। একটা বাসে কী যেন গণ্ডগোল হয়েছে। 

সকালে সব কথা হবে। দেখাবো তোদের বাসাটা আর অনুদের টাও।

কখন যে দুচোখ বুজে গিয়েছিল মনে নেই। চুড়ির টুংটাং আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো। পুরো ভাঙেনি। আধো ঘুমে তাকালাম। মনে হোল কে যেন দাড়িয়ে আছে দরজার কাছে। শাড়ী পড়া। মনে করার চেস্টা করলাম দরজার ছিটকিনি দিয়ে ছিলাম কিনা।

মাথার চিন্তার জট ছাড়ানোর আগেই সে এসে দাঁড়ালো আমার বিছানার পাশে। আমি তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।

-চিনতে পারছ?

সে কথা বলছে। আমি তাকিয়ে দেখলাম, মনে হোল এত সেই অনু। যার সাথে আমি খেলতাম।

-অনু তুই? এত রাতে।

-এসো আমার সাথে। বলে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত ওকে অনুসরণ করলাম। আমি কী স্বপ্ন দেখছি? এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম।

ও বলল, কী দাড়িয়ে আছো কেনও, এসো।

এলাম বারান্দায়, সিঁড়ি বেয়ে উঠানে। জ্যোৎস্নার আলোতে আলোকময় চারিদিক। অনু এসে আমার হাতটা ধরে বলল, তাহলে আমাকে চিনতে পেরেছ অনীকদা। চলো হেটে আসি।

-তুই কোথা থেকে এসেছিস। এত রাতে?

ও কোন উত্তর দিলো না।

হাটতে হাটতে আমরা এলাম আম বাগানে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। আধো আলো আধো অন্ধকার।

ও দাঁড়ালো। তাকালও আমার দিকে।

-মনে পড়ে কী, তুমি আমি কত হেঁটেছি এই বাগানের ভিতর দিয়ে। এই আম গাছটার নিচে বসে আম খেয়েছি। তুমি ঢিল দিয়ে আম পারতে। আমি বাসার থেকে লবণ আর ঝাল নিয়ে আসতাম। আম কেটে কেটে আমি মাঝে মাঝে তোমার মুখে দিতাম। মনে পড়ে কী?

-হ্যাঁ, পড়ছে।  

আমি যেন ফিরে যাচ্ছি অনেক অনেক পিছনে।

-ছোটবেলা থেকে আমি তোমার সাথে ঘুরতাম। তুমি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলে চরক মেলায়। হঠাৎ তুমি আমাকে ফেলে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলে। আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। মনে হয়েছিল আমি আর ফিরে যেতে পারবনা। তুমি ফিরে এসে বললে, এই পাগলি কাঁদছিস কেন? বলে তোমার হাত দিয়ে আমার চোখ দুটো মুছিয়ে দিয়েছিলে। মনে কী পড়ে তোমার অনীকদা?

ও তাকালও আমার দিকে।

-চলো তোমাকে নিয়ে যাবো সেই শান বাঁধানো পুকুর পাড়ে। যেখানে আমরা শুয়ে শুয়ে আকাশে  উড়া পাখি দেখতাম। তুমি বলতে, জানিস আমি একদিন ওদের মত উড়ে চলে যাবো অনেক দুরে।

সেই তো চলে গেলে অনেক দুরে আর ফিরে এলে না। আজ কেনই বা এলে অনীক দা।

-জানিনা, হঠাৎ মনে হোল, চলে এলাম। তোর পড়নে এই লাল শাড়ী কেনও। এত বিয়ের শাড়ী। তোর বয়স একটুও বাড়েনি অনু।

-বলব সব। আচ্ছা অনীক দা মনে পড়ে তুমি একদিন উঠানে বসে কী যেন করছিলে আমি এসে তোমার পাশে দাঁড়ালাম। ভর সন্ধ্যা। খালাম্মা বলেছিল, কিরে অনু এই সন্ধ্যায়? আমি বলেছিলাম,  অনীকদার সাথে একটা কথা আছে। খালাম্মা আর কিছু না বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গিয়েছিল।

-না মনে করতে পারছিনা।

– তা পারবে কেন। এসেছিলাম বলতে, মা বাড়ন করেছে তোমার সাথে ঘুরতে। আমার নাকি বয়স হচ্ছে। আমি ওড়না ধরেছি। এখন ছেলেদের সাথে নাকি মেলামেশা করতে নাই।

তুমি আমার গায়ে একটা চিমটি কেটে বলেছিলে, ওরে বাবা, তুই বড় হয়েছিস। আমিতো এখনো হ্যাফপেন্ট পড়ে ঘুরে বেড়াই। বলে এক হাসি দিয়ে সব কথা উড়িয়ে দিলে।

আচ্ছা অনীকদা, আজ এতদিন পড়ে আমাকে দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে বলও তো?

-মনে হচ্ছে, তোকে এই বেশে আমি কখন দেখিনি।

-বলেছি তো সে কথা পড়ে বলব। ওই যে দেখছ ওটা কী বলতো?

-ওমা, ওটা তো সেই বট গাছ। শান বাঁধানো চারিদিক। যার চত্বর তুই আর আমি বসে বসে গল্প করতাম। মনে পড়ে একদিন এক জট ধারী সাধু এসে বসে ছিল আমাদের পাশে। তুই ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলি। সাধু কটমট করে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। উঠে যাবার সময় বলেছিল, এই ছুঁড়ী এই দুপুর বেলা চুল ছেড়ে এই বট তলায় থাকিস নে। অমঙ্গল হবে।  

-তা সেই অমঙ্গলই তো হোল অনীকদা। চলো ঐ বটগাছ টার নিচে আবার আমরা বসি।

-কী অমঙ্গল?

-বলব, সেটা বলতেই তো আজ আমার আসা। তুমি ছিলে স্কুলের শেষ ক্লাসের ছাত্র। তখন তুমি হ্যাফপেন্ট ছেড়ে পাজামা ধরেছ। মা র কথা শুনিনি আমি। তোমার ঘরে এসে বসে থাকতাম। তুমি মাঝে মাঝে তোমার বিদ্যা আমার উপর ঝারতে। বলতে, জানিস আমি একদিন অনেক দূরদেশে চলে যাবো। আমি বলতাম, আমাকে নেবে তোমার সাথে অনীকদা। তুমি বলতে তোর মা বাবা যদি রাজি থাকে তাহলে তোকে নিয়ে যাবো আমার সাথে। তখন কী কোন কিছু ভেবে বলতে না এমনিই বলতে অনীক দা।

-কী জানি। মনে করতে পারছিনা, কী ভেবে বলতাম।

-জানো অনীকদা, যেদিন তুমি এসে আমাকে বলেছিলে, খালুর বদলির অর্ডার এসেছে। সামনের মাসে তোমরা চলে যাবে। সেদিন আমি পাগলের মত চারিদিক ছুটে বেড়িয়ে ছিলাম।

এই বট তলায় এসে বসে ছিলাম চুল ছেড়ে।

যাবার দিন তুমি এসে বলেছিলে, অনু আমি যাচ্ছি। আবার আসবো। তুমি কথা রাখো নি। তুমি আর আসোনি। যাবার দিন তোমার মুখমণ্ডলে পিছনে কিছু ফেলে রেখে যাচ্ছ সে চিহ্ন আমি দেখিনি। 

-আমি ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম আমাকে নিয়ে। আমার ভবিষৎ নিয়ে।

-বলেছিলাম সব কথা বলব, তবে শোন, ওমা, ওই দেখো টর্চের আলো। কারা যেন এদিকে আসছে। আমাকে চলে যেতে হবে। আমি চললাম, আর বলা হোল না আমার কথা।

– অনু যাসনে।

 আমি ওকে ধরতে চাইলাম। পাড়লাম না। ও দ্রুত মিলিয়ে গেলো। টর্চের আলো টা এসে পড়লো মুখে।

শমসেরের গলার আওয়াজ।

-তুই এখানে কী ভাবে এলি।

আমার মনে হোল আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।

-অনু, হ্যাঁ অনু আমার ঘরে এসেছিল। সেই তো নিয়ে এলো আমাকে এইখানে। ওর পড়নে ছিল লাল শাড়ী, বিয়ের শাড়ী।

-কী বলছিস আবোল তাবোল।

-হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এসেছিল, বিয়ের শাড়ী পড়ে। আমি কী ঘুমের মাঝে হাটতে হাটতে চলে এসেছি এইখানে? না, ওতো আমার হাত ধরে নিয়ে এলো। তারপর তোর টর্চের আলো দেখে চলে গেলো। তোর সামনে আসতে চাইল না।  

 -কারন সে নেই।

বলে টর্চের আলো গাছের একটা বড় ডালের উপর ফেললো শমসের। বলল, ওই যে দেখছিস ডাল টা, ওটাতেই অনুর  দেহটা ঝুলছিল। 

আমার সারা শরীর হীম হয়ে এলো।

-অনু কী যেন বলতে চেয়েছিল। বলতে পারেনি, তুই চলে এলি।

শোন, অনুর বিয়ে হয়েছিল এক ব্যাবসায়ীর সাথে। পাঁটের ব্যাবসা করে। দুশ্চরিত্র, মদখোর।

অনুকে মারত। একদিন বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। অনু ফিরে এলো ওর মা,বাবার কাছে।

এখানেও ওর শান্তি হোল না। একদিন সেই বদমাইশ এসে ওকে নিয়ে যেতে চাইল।

সে বলল আজ যাবো না, কাল সকালে যাবো।

সেই সকাল আর আসেনি। সেই রাতেই বিয়ের শাড়ীটা পড়ে এসেছিল এই বটগাছের নিচে।

অনেকে বলে পূর্ণিমা রাতে এই গাছের নিচে নাকি লাল শাড়ী পড়া মেয়েকে হাটতে দেখেছে। কাঁদতে দেখেছে। তাই এদিকটাতে সন্ধ্যার পর কেউ আর আসে না। আজ তো পূর্ণিমা।

চল, ঘরে চল। সকাল হতে  এখনো অনেক দেরী। 

বললাম একটু বস।

Continue Reading

জীবন কাহিনী

                                       জীবন কাহিনী   

  গুলীর আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো স্বপনের। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত তিন টা। এরকম শব্দ অহরহ শুনতে পায় সে।  জানালার পর্দা টা সরিয়ে তাকালও নিচের দিকে। কিছু দেখতে পেলো না। মা পাশের ঘর থেকে ডাক দিলো।

-জানালার কাছে দাঁড়াসনে বাবা। গুলি এসে লাগতে পারে। শুয়ে পড়।

স্বপন রান্না ঘরে এসে এক গ্লাস পানি নিয়ে ফিরে এলো বিছানার কাছে। তাঁর বিছানা বসার ঘরে। এক রুমের বাসাতে মা কে নিয়ে থাকে সে। এই জায়গা টা খুব একটা ভালো না সে জানে। কিন্তু ওরা আর যাবেই বা কোথায়?

কম ইনকাম লোকদের জন্য বানানো বাসা গুলো  সিটি তৈরী করেছে  স্বপনদের মতো লোকদের জন্য। একটা বিল্ডিং নয়, পনের তালা করে পাঁচটা এই রকম বিল্ডিং। একে বলা হয় প্রোজেক্ট।  গ্রাফিটিতে আঁকা সব দালান গুলো। বিল্ডিং এর আশে পাশে আবর্জনায় ভর্তি। মাঝে মধ্যে আলো থাকে না হলওয়ে তে। ভাঙা বাল্বের টুকরো গুলো ছড়িয়ে থাকে এদিকে সেদিকে।

প্রতিদিন পুলিশের গাড়ী আসে। কাউকে ধরে নিয়ে যায়। কাউকে পাশে নিয়ে জিজ্ঞাসা বাদ করে। এ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শোনা যায় রাতে দিনে।  

বাবার মৃত্যু হয়েছে আজ প্রায় তিন বছর হলো। কলেজে ঢুকেছিল সে। পড়া আর হয়নি। সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।

চাচা বলে ডাকে, ইমান আলি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এক পেট্রোল পাম্পের মালিকের সাথে। আফগানী মালিক। কাজ দিয়েছিল। ভোর পাঁচটা থেকে বিকেল চার টা পর্যন্ত। স্বপন ভেবেছিল, ভালোই হোল, রাতে কোন একটা কলেজে ঢুকে পড়া টা শেষ করবে। সেই মতোই সে আবার সিটি কলেজে ঢুকেছিল। কাজ শেষে চলে যায় কলেজে। ফিরতে ফিরতে রাত  বারোটা বেজে যায়। মা না ঘুমিয়ে বসে থাকে।

স্বপন চাদরটা গায়ে টেনে শুয়ে পড়লো। উঠতে হবে আর কিছুক্ষণ পরে। কাজে যেতে হবে। আজ ফিরতে দেরীও হবে। একটা পরীক্ষা আছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, মার ডাকে ঘুম ভাঙল।

-এই খোকা, ওঠ। কাজে যাবি না?

ধড়মড় করে উঠে বসলো স্বপন। তাকালও পাশে রাখা ঘড়িটার দিকে। নাহ, খুব একটা দেরী হয়নি। কাজের জায়গা, হাটা পথ।

-তুই তৈরী হয়ে নে, আমি তোর নাস্তার ব্যবস্থা করছি। বলে মা রান্নাঘরের দিকে গেল।

রান্নাঘর, যে ঘরে দুইজনের বেশি তিনজন দাঁড়ানো যায়না।

কোন কোনদিন খেতে বসে সে মা কে বলে, মা, তোমার খুব অসুবিধা হয়, না মা, এইখানে থাকতে।

-না বাবা, তোর বাবা অনেক কষ্টে এই ফ্ল্যাট টা পেয়েছিল। না পেলে আজ আমাদের পথে পথে থাকতে হতো। মনে নেই, শেষ যেখানে ছিলাম, বাড়ীওয়ালা একদিন এসে বলল, একমাসের মধ্যে এই বাসা ছেড়ে দিতে হবে। তখন যদি সালাম ভাইএর সাথে দেখা না হতো, আজ কোথায় থাকতাম কে জানে। তুই লেখাপড়া শেষ কর, ভালো চাকরি কর, তখন আমরা ভালো বাসা নেবো।

জমিজমা ছিল, মুদির দোকান ছিল চান মিয়াঁর। সচ্ছল সংসার।

সন্ধ্যার পর, দোকানের বাহিরে পাতা বেঞ্চে বসে আড্ডা চলতো। কেউ পান চায়, কেউ বা চায় চা। অনেকের হাতে থাকে না পয়সা। তাই বলে চান মিয়াঁ তাকে চা খাওয়া থেকে বঞ্চিত করে না। খাতার পাতায় লিখে রাখে।

একদিন এই আড্ডার মাঝে রহিম মিয়াঁ বলেছিল, শুনে এলাম আমেরিকা যাওয়ার জন্য নাকি দরখাস্ত চাচ্ছে। লটারি হবে।

চান মিয়াঁ প্রথমে গা করে নি। এক রাতে বাসায় আসতেই আয়েশা বলেছিল, ঝুমুরের মা বলছিল, ঝুমুরের বাবা নাকি কি সব কাগজ পত্র পাঠিয়েছে, আমেরিকা যাবে বলে। তুমিও পাঠাও না কাগজ পত্র।

প্রতি রাতেই একি বিষয় নিয়ে ঘ্যানর-ঘ্যানর করে আয়েশা।

অবশেষে বলতে গেলে বিরক্ত হয়েই চান মিয়াঁ কাগজ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল। ক্রমশ ভুলেও গিয়েছিল ব্যাপার টা।

হঠাৎ একদিন ডাকহরকরা এসে একটা বড় খাম দিয়ে গেলো চান মিয়াঁ কে।

এপাশ ওপাশ উল্টাল। আস্তে আস্তে খুললো চিঠিটা। কিছুই বুঝতে পারলো না প্রথমে। জমির আলি বসে ছিল বেঞ্চে।

-দেখি আমাকে দাও। বলে চিঠি টা হাতে নিয়ে দেখল। পড়লো।

চান মিয়াঁ তুমি তো ডিভি লটারি পেয়েছ। আমেরিকা যাওয়ার। উচ্ছ্বাসিত ভাবে বলে উঠলো জমির আলি।

সে যে মনে প্রানে চেয়েছিল, তা নয়। শুধু আয়েশার ঘ্যানঘ্যানির জন্যই করতে হয়েছিল।

আনন্দ আয়েশার, আনন্দ স্বপনের।

চান মিয়াঁ হিসাব করতে বসল। কিছু জমি বিক্রি করে দিতে হোল। দোকান টা খালাতো ভাই মজনুর হাতে দিয়ে, বাড়ীটা ওরই তত্ত্বাবধানে দিয়ে একদিন পাড়ি দিলো চান মিয়াঁ আমেরিকার উদ্দেশে।  

আসার আগে জমির আলিই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল ওরই এক দুঃসম্পর্কে আত্মীয় আবিরের সাথে, থাকে নিউ ইয়র্কে। 

বলেও ছিল, কয়েকটা দিনের জন্য তোমার কাছে রেখো।

সেই আবিরই জোগাড় করে দিয়েছিল কাজ টা সেভেন-ইলেভেনে। রাতের শিফটে কাজ করতো। ফাঁকি কাকে বলে তা জানতো না চান মিয়াঁ। মালিকের নজরে পড়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। রাতের শিফটের ম্যানেজার করে দিয়েছিল।

নতুন একটা বাসা ভাড়া নিয়ে যাবার সময় আবিরকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তোমার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না আবির।

সেই বাসাতে ছিল বেশ কিছু বছর। স্বপনের স্কুলের কাছেই ছিল ডানকিন-ডোনাটের দোকান। ওখানেই স্কুল শেষে কয়েক ঘণ্টা কাজ করতো সে। হাত খরচ টা চলে যেতো। বাপের কাছে চাইতে হতো না। হঠাৎ একদিন বাড়ীওয়ালা বলেছিল এই বাড়ী বিক্রি করে দিচ্ছে। তাদের কে উঠে যেতে হবে। মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছিল চান মিয়াঁর। কোথায় পাবে আর একটা বাসা। তখন সালাম ভাই এই বাসার সন্ধান দিয়েছিল।

প্রথম প্রথম আয়েশার ভালো লাগেনি জায়গাটা। চারিদিকে তাকালে ভিতরে একটা ভয় ভয় ভাব আসে। সে কথা বলেছিল স্বামীকে।

চান মিয়াঁ রেগে বলেছিল, মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছ, সেই শোকর করো, আশপাশে তাকিওনা। এতো কম ভাড়ায় আর কোথায় পাবে বাসা।

কাজের দূরত্ব টা একটু বেশি, যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যেতো। স্বপনেরও কাজটা চলে গেলো। নতুন স্কুলে নতুন করে মিলে মিশে চলতে চাইল। কিছু কিছু ছেলেরা ওকে বিরক্ত করতো। মাঝে মাঝে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতো।

একদিন স্কুল শেষে ফেরার পথে হ্যালো,হ্যালো বলে কে যেন ডাকছে বলে মনে হোল স্বপনের। পিছন ফিরে তাকালও।

উচু, স্বাস্থ্যবান এক ছেলে। হাতে বই। কোনদিন দেখেছে বলে মনে পরে না।

এগিয়ে এসে বলল তাঁর নাম, টম। হাতের পেশী গুলো দেখলেই মনে হয় ব্যায়াম করে। স্বপনের বুকটা দুড়দুড় করছিল। এখনি একটা চড় থাপ্পড় মারবে।

না, সে তা করলো না। নাম জিজ্ঞাসা করল। স্বপন তাঁর নাম বলতেই বলল থাকো কোথায়? স্বপন বলল তাঁর ঠিকানা।

-ও, আমিও ওখানেই থাকি।তোমার দুই ক্লাস উপরে পড়ি।  আমার বিল্ডিং তোমার দুটো বিল্ডিং পরে। কাল স্কুলে যাওয়ার সময় আমার সাথে যাবে।

টম তাঁর কথা রেখেছিল। স্বপনকে সাথে নিয়ে স্কুলে গিয়েছিল। যারা ওকে উত্যক্ত করতো, তারা তাকিয়ে দেখল। আর কোন দিন ওরা ওকে বিরক্ত করেনি।

 

ইদানিং আয়েশা খেয়াল করে চান মিয়াঁ মাঝে মাঝে উদাসীন হয়ে বসে থাকে। কি যেন ভাবে।

আয়েশা জিজ্ঞাসা করেছিল, এত কি ভাবো?

উত্তরে চান মিয়াঁ বলেছিল, জানো স্বপনের মা, এদেশ কে আমি আপন করে নিতে পারলাম না। আমার সেই ছোট্ট দোকান তাকে আমি খুব মিস করি। সেই সন্ধ্যার আড্ডা এখানে কোথায় পাবে। শুধু কামড়ে পরে আছি ছেলেটার জন্য। ওর ভবিষ্যৎ এর দিকে চেয়ে। একদিন বড় হবে সে। এখানকার মত লেখাপড়া তো দেশে পাবে না। বড় ডিগ্রী নিয়ে বের হবে। বড় চাকরি করবে। তখন ওই তোমাকে দেখবে।

-কেন? আপনি কোথায় যাবেন? বালাই ষাট, আপনি থাকবেন আমাদের সাথে। যতদিন আমি আছি। বলে আয়েশা রান্নাঘরের দিকে গেলো চা আনতে।

 

এখনো মাঝ রাতে স্বপনের মা র ঘুম ভেঙে যায়। মনে পরে সেই রাতের কথা। ঝনঝন করা ফোনের শব্দ। লাফ দিয়ে উঠে ফোন টা ধরেছিল স্বপন।

-ইজ ইট চান মিয়াঁজ রেসিডেন্স? এক মেয়ের গলা।

-ইয়েস?

-আই এম কলিং ফ্রম হসপিটাল? চান মিয়াঁ হ্যাজ এ স্ট্রোক। কাম কুইক। হাসপাতালের নাম টা দিলো মেয়েটা।

আয়েশা প্রথমে কিছুই বুজতে পারানি। স্বপন বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লে সে।

-এখন তো কান্নাকাটি করলে চলবে না মা। চলো তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে হবে।

আয়েশার চোখে এখনো ভাসে চান মিয়াঁর অসাড় দেহটা। চোখ মেলে চেয়ে আছে তাঁর দিকে, কথা বলতে পারছে না। কি যেন বলতে চাইছে সে।

তারপর আর বেশিদিন ছিলনা চান মিয়াঁ। সব কিছুর বন্ধন কাটিয়ে চলে গেল। রেখে গেলো দুটো অসহায় মানুষ কে।

 

কলেজ থেকে ফিরতে সেদিন বেশ দেরীই হয়েছিল স্বপনের। দুই একটা বন্ধু জুটেছে। তাদের সাথে বসে চা সিগারেট টানতে টানতে বেশ কিছুটা সময় চলে গিয়েছিল। বিল্ডিং এর কাছে এসে দেখল চার পাঁচ টা ছেলে সিঁড়িতে বসে কি যেন করছে। দুজনের হাতে ছোট কাগজে মোড়া পুঁটলি। স্বপনের বুঝতে বাকি রইল না ওই পুটলির মধ্যে কি? ও ওদের সাথে চোখে চোখ না করে দরজাটা খুলতে যেয়ে দেখল দরজা খোলা। হল ঘরের বারান্দা টা অন্ধকার। দুটো ছেলে কোনায় দাড়িয়ে কি যেন করছে। এলিভেটরের বোতাম টা টিপ দিলো। বারো তালা থেকে আস্তে আস্তে নেমে আসছে। স্বপনের মনে হোল আজ ইচ্ছে করে এলিভেটর টা দেরী করছে।  স্বপনের বুকটা ধুকধুক করছে।

অন্ধকারে দাঁড়ানো ছেলে টা ডাক দিল স্বপন কে।

স্বপন ডাক টা উপেক্ষা করতে চাইলো।

ছেলে টা পাশে এসে দাঁড়ালো। তাকালও স্বপনের দিকে।

-ইউ ইগনোরিং মি? রাইট?  চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল ছেলে টার।

এলিভেটর পাঁচ তালায় এসে দাড়িয়ে আছে।

-আই ডিডনট হেয়ার ইউ। শুকনো গলায় বলল স্বপন।  

-ডু ইউ হ্যাভ মানি? একটা দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগলো স্বপনের।  মনে মনে সে আয়াতুল কুরসি পড়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু বার বার ভুল হয়ে যাচ্ছে।

-অনলি টু ডলার। বলে বের করতে যাবে তখনি পোঁ পোঁ করে পুলিশের গাড়ীর আওয়াজ শুনতে পেলো।

ছেলেটা দৌড় দিয়ে দরজাটা টান দিয়ে খুলে মিলিয়ে গেলো রাস্তায় । আর ঠিক সেই সময় এলিভেটর টা এসে দাঁড়ালো নিচ তালায়।

মা জেগে ছিল।

-আজ আর খাবো না মা, বলে বিছানায় শুয়ে পড়লো স্বপন। বুকের ধুকধুকানি তখনো যায় নি।    

সকালে কাজে যাওয়ার পথে দেখতে পেলো পাশের বিল্ডিং এর নিচে জটলা। তিনটা পুলিশের গাড়ী। কিছুটা জায়গা হলুদ ফিতে দিয়ে ঘেরা। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো গতরাতে একজনের মরা দেহ পড়েছিল ওইখানে। কপালে গুলির চিহ্ন।

স্বপনের মনে পড়লো গত রাতের কথা। এই মৃতদেহ তারও হতে পারতো। গা টা কাঁটা দিয়ে উঠল।

সরে এলো সেখান থেকে।

এখনো দুই সেমিস্টার বাকি। তারপর গ্রাজুয়েসন। ভালো একটা চাকরি পেয়ে মা কে নিয়ে এই বিল্ডিং ছেড়ে চলে যাবে। আর নয়। দিন দিন চারিদিকের পরিবেশ টা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সব সময় একটা আতংক স্বপনের মনে।

একদিন কাজের ফাকে বসে পড়াশুনা করছিল। একটা মার্সেডিজ এসে দাঁড়ালো পাম্পের কাছে। গাড়ী থেকে নেমে লোক টা এসে দাঁড়ালো স্বপনের কাছে। পঞ্চাশ ডলারের একটা নোট বের করে স্বপনের হাতে দিতে যেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল স্বপনের মুখের দিকে।

-আর উ সপান?

-ইয়েস। বাট হাও উ নো মাই নেম?  অবাক হয়ে ডলার টা ক্যাশ বাক্সে রাখতে রাখতে বলল।

-উওর ড্যাড ইউজ টু ওয়ার্ক ইন মাই স্টোর। সাচ এ নাইস গাই। হি শোড মি ইওর পিকচার। আই এম রিচার্ড।

স্বপন কোনদিন দেখেনি রিচার্ড কে। নাম শুনেছিল বাবার কাছ থেকে। শুনেছিল এত ভালো লোক বলে আর হয় না। বাবা খুব প্রশংসা করতো রিচার্ডের।

পকেট থেকে বিজনেস কার্ড বের করে দিয়ে বলেছিল  কোন প্রয়োজন হলে তাকে কল করতে।

দরকার পড়েছিল স্বপনের। যেদিন রাতে বাড়ী ফিরে ঘরে ঢুকে মা কে দেখতে না পেয়ে। ছোট্ট এক চিলতে ঘরে মা আর কোথায় লুকিয়ে থাকবে। চিৎকার করে কয়েক বার ডাকল মা কে। সারা শরীর হীম শীতল হয়ে এলো। দরজার বাহিরে এসে ডাকল।

পাশের এপার্টমেন্টের দরজা খুলে এক বয়স্ক মহিলা বেড়িয়ে এলো। তার পিছনে মা দাড়িয়ে।

স্বপন স্তম্ভিত।

মা বেড়িয়ে এসে স্বপনকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।

-কি হয়েছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞাসা করল।

-ওরা এসেছিল।

-কারা?

-তিনটা ছেলে। দড়াম দড়াম করে দরজায় বাড়ি মারছিল। কি কি যেন বলছিল, আমি কিছুই বুজতে পারিনি। ওরা চলে গেলে আমি পাশের দরজায় যেয়ে ধাক্কা দিতেই মহিলা দরজা খুলে আমাকে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলো। আমি আর এখানে থাকবো না বাবা। তুই একটা কিছু কর। বলে স্বপনকে জড়িয়ে ধরলও।

স্বপন কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। তবে নিশ্চিত এখানে আর নয়।

মনে পড়ল রিচার্ডের কথা। পরদিন কল করলো।

সব শুনে রিচার্ড বলেছিল তার একটা বাসা আছে। সেই বাসার বেজমেন্ট টা খালি পরে আছে। গুছিয়ে নিতে হবে। যৎ সামান্য কিছু দিলেই হবে। আরও বলেছিল, তোমার বাবা আমার পুরো বিজনেস টা দেখে রেখেছিল আর আমি তোমাদের জন্য এই টুকু করতে পারবো না?  

তারপর মাকে আর জেগে থাকতে হয়নি। মা  নিশ্চিন্তে মনে ঘুমায়। স্বপন মাঝ রাতে ফিরে ঢাকা দেওয়া খাবার গরম করে নেয়। তারপর সেও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ে।

 

 

 

 

 

 

 

 

Continue Reading

ওল্ড ইজ নট গোল্ড

  মিসেস পিটারশন আমার প্রতিবেশী। সকাল, সন্ধ্যায় ঘরের সামনের ছোট্ট বারান্ধায় চেয়ার নিয়ে বসে থাকে।

আসতে যেতে আমি হ্যালো বলি। মাঝে মধ্যে পাশের চেয়ার টা টেনে নিয়ে বসে গল্প করি।

এমনি এক সকালে কথায় কথায়, ওল্ড ইজ গোল্ড কথাটা বলতেই মিসেস পিটারশন ক্ষেপে উঠল।

তেতে মেতে বলল, ওল্ড ইজ গোল্ড কথাটা কে বলেছিল ?  একবার তাকে দেখতে ইচ্ছে করে। ভালই তো ছিলাম। যেই ষাট পাড় হলাম অমনি রাজ্যের অসুখ এসে হানা দিলো। এখন গিটে গিটে ব্যাথা, সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয়টা ঔষধ খেতে হয়।

৬৫ বছর আমার ছেলেমেয়েরা ধুমধাম করে পালন করলো। বললও, আবার তুমি রিটায়ার করো।

করলাম। এখন প্রতিটি ঔষধে কো পেমেন্ট দিতে হয়। এই তোমার ওল্ড ইজ গোল্ড। গজরাতে গজরাতে মিসেস পিটারশন ভিতরে চলে গেলো।

আমিও রওয়ানা দিলাম।

কয়েকজন মিলে আড্ডা দেওয়ার কথা।

ইদানীং আড্ডার সুর পাল্টিয়েছে। আগের মতো হৈ হৈ নেই। বয়স সবার মিসেস পিটারশনের মত। কাজেই আড্ডা যদিও আরম্ভ হোল হাস্য রসিকতা নিয়ে, কিন্তু একটু জমে উঠতেই  একজন বলে উঠল তার প্রেশার আজ তুঙ্গে উঠেছে। অমনি আর একজন সুর ধরল তার আজ দুদিন ধরে হার্টবীট টা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। আলোচনা সীমাবদ্ধ হোল শারীরিক আর মানসিক অবস্থার মঝে।

বললাম, এইসব আলোচনা থাক।

রফিক বলে উঠল, তা আর কি নিয়ে আলোচনা করবো বলও। স্টক মার্কেট? ওটা একদিন নর্থে গেলে দুইদিন যায় সাউথে। বুক ধড়ফড় করে। ৪০১কে। ওটাই তো সম্বল। বৌ সেদিন রাগ করেছিল। বলল, সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে টাকা মানি মার্কেটে রেখে দাও। তাহলেই তো কোন চিন্তা নেই। শোন কথা। বুক ধড়ফড় করলেও ওটাই একমাত্র একশাইটমেন্ট দেয়। কি বলিস?

হাঁ, অন্য সব একশাইটমেন্ট তো লাঠে উঠেছে। হাসতে হাসতে  বললও শমিত।

আসলেই, বার্ধক্য খুব সুখের নয়। নানা রকম সমস্যা। শুধু তাই নয়, অন্যদেরকে ও বাতিব্যাস্ত করে তোলা।  

মানুষ মানতে রাজি নয় যে সে বার্ধক্যে পৌছে গেছে।

এইতো কিছুদিন আগেও তো সে জোড়ে হাটতে পারতো, আজ কেনও তার হাঁটুতে ব্যাথা। সময় যে পেড়িয়ে গেছে তা সে জানতে পারেনি। ব্যস্ত ছিল ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া নিয়ে। বাড়ী ঘর নতুন করে সাজান নিয়ে। ধাপে ধাপে উন্নতির পথে  এগোন নিয়ে। বলা যায়  এ এক কম্পিটিশন।  শরীরে রোগ দেখা দেয়নি। শুধু কাশি সর্দি।

খেয়ে নেও দুটো পিল, চলো এগিয়ে।

সেই চলতে চলতে একদিন আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখল কয়েকটা পাকা চুল। চোখের নিচে পানির থলি।

হাটতে যেয়ে মনে হোলও একটু বিশ্রাম নিলে ভালো হতো। 

সাড়া জীবন ব্যায়ামের ধার ধারেনি। কলকব্জা গুলোতে মরিচা পড়ে গেছে।

ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি অনেকদিন হোল।

যদি বা গেলো, ডাক্তার ক্ষেপে উঠলো।

এতদিন কোথায় ছিলেন? কি ব্যাপার, খাওয়া দাওয়াতে কোন কন্ট্রোল নেই আপনার?  

কলেস্ট্রল তো চুঙ্গে উঠেছে। ব্লাড প্রেসার তো আকাশ ছুঁই ছুঁই।  ব্লাড সুগার আর নাইবা বললাম।

রোজ চার থেকে পাঁচটা ঔষধ খাওয়া আরম্ভ হোলও।

বাসায় এসে গেলো প্রেসার মাপার যন্ত্র, এসে গেলো সুগার মাপার যন্ত্র।

কি রে কিছু ভাবছিস? আনোয়ার ডাকে হুঁশ এলো শমিতের।

কি আর ভাববো, বড় বোন বাথরুমে যেতে যেয়ে পড়ে গেছে। মাথা তে চোট লেগেছে। 

তারপর?

সিটি স্ক্যান করেছে। খুব একটা ভালো না। মাথায় রক্ত জমেছে। কথা জড়িয়ে আসছে।

আমাদের সবাই কে সাবধানে চলতে হবে। বললও গিয়াস।

তা আর বলতে। এইতো সেদিন হাটতে যেয়ে বাম দিকটাতে একটু চাপ অনুভব করলাম। পাত্তা দিলাম না।

বৌ এর চাপে পড়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। বলে বাবুল একটু দম নিলো।

কি বলেছে ডাক্তার, জিজ্ঞাসা করলো সানু।

এঞ্জীওগ্রাম করতে হবে। দেখবে কোন ব্লক আছে কিনা।

আমাদের সবাই কে এখন স্ট্রেস টা কমাতে হবে। স্ট্রেস কুড কিল ইয়ু। বললও সানু বিজ্ঞের মত।

স্ট্রেস কমাতে চাইলেই কমাতে পারবো ?  মেয়েটার এখনো বিয়ে হয়নি। বয়স তো কম হোল না। বলে উদাস ভাবে তাকালও আকাশের দিকে বাবুল।

শোন, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। বাবা যখন রিটায়ার করল পঞ্চান্ন বছর বয়সে, ভেবে ছিলাম অনেক বয়স হয়েছে বাবার। আমাদের কিন্তু অনেক আগেই তা পেড়িয়ে গেছে। কাজ কমিয়ে দে। চল, জিমে যাওয়া আরম্ভ করি। বডি টাকে ফিট রাখতে হবে।

আমার কথা শেষ না হতেই রফিক বলে উঠল, কাজ কমিয়ে দেবো? এখনো মর্টগেজ রয়েছে। রিটায়ার করবো ভেবেছিলাম। হিসাব করে দেখলাম পোষাবে না।

যতটুকু গিলতে পারবে তার চেয়ে বেশি গলার ভিতর দিয়ে বসে আছো। তখন ভাবোনি। আসলে আমরা কেউই ভাবিনি একদিন বার্ধক্য আসবে। বিজ্ঞের মত বলল আমিন।

কিছুদিন আগে একজন আমার মেসেঞ্জারে কিভাবে চির তরুন ও নিরোগ থাকা যায় তার পদ্ধতি লিখে পাঠিয়েছি।

অবশ্য এটা একটা বিশ্বখ্যাত চিকিৎসকের পরামর্শ। বললাম।

কি বলেছে সে? উদগ্রীব হয়ে শুনতে চাইল সানু।

সকালে ঘুম থেকে উঠে গরম পানি খাওয়া। দুধ ছাড়া চা। সারা দিনে আট থেকে বারো গেলাস পানি খেতে হবে।

ধূমপান নিষিদ্ধ। রেড মিট অর্থাৎ গরু,খাসি, ভেড়ার মাংস খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে।

হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না, ওসব আমার দাড়া হবে না। মাঝ পথে থামিয়ে দিলো আমিন। কবে, কখন কোথায়  মরবো তাতো লেখাই আছে। এসব তথ্য শুনে লাভ নেই।

আল্লাহ না করে যদি তোর স্ট্রোক হয়। একটা দিক অবশ হয়ে যায়। তোকে দেখবে কে? তুই তো বোঝা হয়ে থাকবি অন্যের। বলে সানু তাকাল আমিনের দিকে।  

শোন আলোচনা এখানেই শেষ কর। যেতে হবে নাতিকে দেখতে। তবে আমার একটা প্রস্তাব।

কি? সবাই উদগ্রীব হয়ে শুনতে চাইল।

প্রতি সপ্তাহে রবিবার সকালে আমরা  মিলিত হবো নাস্তা খেতে। একঘণ্টা দুইঘন্টা কাটাবো গল্প করে। অসুখের কথা নয়। শুধু মন মাতানো কথা। রাজি?

রাজি? আমি আর একটা জিনিস যোগ করতে চাই। বলল আমিন।

কি?

প্রতি মাসে একবার আমরা মুভি দেখতে যাবো। রাতের শো তে। গৃহিণী দের কে বাসায় রেখে?

হাসতে হাসতে সবাই বললও রাজি।

আলবৎ রাজি।

Continue Reading

ওরা তিনজন

   তিন বন্ধু। একই শহরে জন্মেছিল, সেই শহরে বড় হয়েছিল। স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিয়ে ওরা তিন জন চলে গিয়েছিল তিন  দিকে। বছর খানেক যোগাযোগ ছিল। তারপর  বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। নিয়মই তাই। যে যেখানে থাকে সেই পরিবেশ টাকেই আঁকড়ে ধরে। 

বিংশ শতাব্দী পেড়িয়ে এক বিংশ শতাব্দী চলছে। এর মাঝে ওদের আর দেখা হয়নি, কথা হয়নি। তখন না ছিল সেল ফোন না ছিল ফেসবুক। ওরা ভুলেই গিয়েছিল একে অপরকে।

বিংশ শতাব্দীর  শেষে এলো সেল ফোন, এলো ফেসবুক।  সেই ফেসবুকের পাতায় হঠাৎ একদিন তৌফিক দেখতে পেলো সুশান্তর চেহারা টা।

পিউপিল উ নো পেজে।

 আগের সেই মাথা ভর্তি চুল আর নেই। চেহারাটায় কিছুটা সাদৃশ্য আছে।

প্রোফাইল খুজে দেখল, হাইস্কুলের নাম। মিলে গেলো।

 যোগাযোগ হতে দেরী হলনা। ফোন নাম্বার আদান প্রদান হওয়ার সাথে সাথে কল এলো। তারপর জমিয়ে গল্প। আহসান কে খুজে পেতে খুব একটা দেরী হোল না।

ওরা তিনজন ঠিক করলো দুই সপ্তাহর ছুটি নিয়ে আসবে সেই শহরে যে খানে ওরা বড় হয়েছিল।

 দিন, তারিখ ঠিক হোল।

গুগুল করে জেনে নিয়েছিল নদীর পাড়ের সেই বাংলো টা আজও আছে কিনা। ভাড়া দেওয়ার রীতি নেই, তবুও দুই সপ্তাহর জন্য দিতে অসুবিধা হবে না, বলেছিল মহীউদ্দীন সরকার। সেই বাংলো টা দেখাশোনা করে। একটু বেশি পয়সা খরচ করতে হবে, এই আর কি।

সুশান্ত এসে পৌছাল প্রথমে। কিছু বাদে এলো আহসান আর তৌফিক। চেহারার খুব একটা পরিবর্তন নেই কারো। শুধু বয়সের রেখা  গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মুখমণ্ডলে। চুলে পাঁক এসেছে। আহসানের চোখে চশমা। হ্যাংলা, পাতলা সেই তিনজন আর হ্যাংলা, পাতলা নেই।

জোড়ে হাসি দিয়ে এঁকে অপর কে জড়িয়ে ধরলও।

-কোনদিন আমরা তিনজন আবার একসাথে হবো ভাবিনিরে। বলে তৌফিক তাকাল নদী টির দিকে। এই নদীর পাড় দিয়ে কত হেঁটেছে ওরা। সেই স্মৃতি আজও ভাসে মনের কোণে।

– ছোটবেলায় এই বাংলোর কাছে আসতে ভয় হতো। দুরে থেকে দেখতাম। মাঝে মাঝে সুট কোট পড়া লোকেরা থাকতো, আবার চলে যেতো। মনে পড়ে? বলে সুশান্ত তাকালও সামনের গাছটার নিচে বসে থাকা ছোট ছেলেটার দিকে।

-তা আর পড়েনা, চল বেড়িয়ে পড়ি। হাটতে হাটতে আমি যেতে চাই সেই পুকুর পাড়ের রাস্তাটার কাছে। সেই বাড়ী টা আছে কিনা দেখতে চাই। বলে আহসান উঠে দাঁড়ালো।

-তুই তো যাবিই সেখানে। সেই বাসন্তীর খোজে। তোর স্যান্ডেল টা ছিড়ে গিয়েছিল ছাদের উপর দাড়িয়ে থাকা হলুদ রঙের জামা পড়া মেয়েটার দিকে তাকাতে যেয়ে হোঁচট খেয়ে। বলে হো হো করে হেসে উঠল তৌফিক।

-একটা চিঠি ও তো দিয়েছিলি। আর সেই চিঠি পড়লো যেয়ে ওর বড় ভাইয়ের হাতে। তারপর যেন কি হয়েছিল? বলে মুচকি হাসল সুশান্ত।

-শালা, অনেকদিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে ছিলাম। না জানি হেডমাস্টারের কাছে বলে দেয়। চল, বসে থাকতে ভালো লাগছে না।

ওরা বেড়িয়ে পড়লো। তৌফিক একটা পাথর কুঁচি উঠিয়ে ছুড়ে মারলও নদীতে। কচুরিপানায় ভর্তি নদীটা। পাথর টা কোথায় যেয়ে পড়লো দেখতে পেলনা সে।

বিকেলের সূর্যের তাপ টা সহ্য করা যায়। আকাশ কালো মেঘ শূন্য। ওদের চোখে ডিযাইনার রোদচশমা। কিছু কিছু লোক ওদের দিকে তাকাচ্ছে। ওরা যে এই শহরের নয়, বুঝতে ওদের দেরী হয়নি।

-এই রাস্তার কোনায় তো ভুবন চাচার কাপড়ের দোকান ছিল? উৎকণ্ঠ ভরে বলল আহসান। এই দোকান থেকেই তো বাবা ঈদের দিনে পাজামার কাপড় কিনত। এখন তো চেনাই যাচ্ছেনা রাস্তা টা কে। বলে চারিদিকে তাকালও সুশান্ত।

-এই তৌফিক দেখ, এই খানে একটা গলি ছিলনা? গলি টা দিয়ে গেলেই বা পাশে কাঞ্চন দের বাসা ছিল। সেই গলি তো আর নেই দেখছি। আহসান গলায় বিষণ্ণতাঁর ছাপ। যেন এই পরিবর্তন সে দেখতে চায়না। 

ওরা হাটতে হাটতে এসে দাঁড়ালো সেই পুকুর পাড়ে। কোথায় সেই পুকুর। পুকুর ভরাট করে দালান উঠেছে। সেই এবড়ো থেবড়ো ভাঙ্গা রাস্তা টা আর নেই। বাসন্তীদের সেই বাড়ীটাও নেই। ওখানে নতুন বাড়ী উঠেছে।

আহসান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওই দিকে। কোন কথা বললও না। মনে হোল ও ভেবেছিল বাসন্তী হয়তো আবারও এসে দাঁড়াবে সেই ছাঁদে।

পাশ দিয়ে এক ভদ্রলোক কে হেটে যেতে দেখে আহসান এগিয়ে গেলো।

-আচ্ছা ভাই, এইখানে একটা বাড়ী ছিল সোমনাথ মজুমদারের। বলতে পারেন ওরা কোথায়?

লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আহসানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কতদিন আগেকার কথা বলছেন?

-এই ধরুন ষাটের দশকের।

-ঐ সময় তো আমার জন্মই হয়নি। আমার বাবা হয়তো জানলে জানতে পারবে।

নিরাশ হয়ে আহসান ফিরে এলো ওদের কাছে।

-চুল পাকলেই ভেবেছিস সে বয়স্ক? চল, ওর বাবা কে খুজে বের করি। তোর বাসন্তী ফুরুৎ করে উড়ে গেছে। বলে হাসতে থাকলো সুশান্ত।

এক বিংশ শতাব্দীতে এসেও ওরা ফিরে গিয়েছিল বিংশ শতাব্দীতে। মানুষ তাঁর অতীত ভুলতে পারেনা। মনে হয় আবার যদি ফিরে যেতে পারতাম সেই অতীতে।

ওরা এসেছে সেই অতীতকে খুজতে। এঁকেই বলে নস্টালজিয়া। বর্তমান তো আছেই। ভবিষৎ এঁর কথা ভেবে লাভ কি? ওটাতো দেখা যায়না।

এতদিন পরে ফিরে এসে রাস্তা গুলো চেনা মনে হচ্ছে না। পরিচিত একটা লোকের ও দেখা পেলো না। যে বাসাতে তৌফিক বড় হয়েছিল সেটা বিবর্ণ প্রায়।

যেই রেস্তোরায় ওরা মাঝে মাঝে খেলা শেষে এসে বসতো সেটার নামটা একই আছে, শুধু ভিতর টা পালটিয়েছে।

তিনটে চেয়ার টেনে নিয়ে ওরা বসলো। এক অল্প বয়স্ক ছেলে এলো অর্ডার নিতে।

অর্ডার দিয়ে সুশান্ত বলল, তোমাদের ম্যানেজার কে একটু আসতে বলবে।

ম্যানেজার  হাসি মুখে এসে দাড়াতেই সুশান্ত কয়েকটা নাম বলল, জিজ্ঞাসা করলো চিনতে পারে কিনা।

ম্যানেজার এবার ওদের দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, উনাদের মধ্যে শুধু একজনই আছেন, তবে তিনি বাসা থেকে বের হন না।

ওরা নিজেরা নিজেদের দিকে তাকালও।

আহসান বলল, চল বাংলোই ফিরে যাই।

ওরা যা খুজতে এসেছিল টা নেই, চলেগেছে অনেক পিছনে, বিস্মৃতির আড়ালে।

সন্ধ্যা হয়ে এলো। ঝি ঝি পোকা ডাকছে। সামনের নদীটা অন্ধকারের ভিতর ডুবে চাচ্ছে। ওপারে কে যেন চিৎকার করে কাউকে ডাকছে।

 ওরা এসে বসলো বারান্দায়।

আবু নামের একটা ছেলে কে মহীউদ্দীন বলেছিল ওদের খাবারের ব্যবস্থা এবং দেখাশুনা  করতে।

সে  এসে মশা মারার কয়েল টা জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো। জিজ্ঞাসা করলো কখন ওরা ডিনার করবে।

কয়েক মিনিট ওরা চুপচাপ বসে রইল। নীস্তব্দতা টাকে ওরা উপভোগ করতে চাইলো। হৈ চৈ হীন সন্ধ্যা।

 কারো মুখে কথা নেই।

তৌফিক বলল, আচ্ছা, এইযে এতকাল পরে আমাদের দেখা হোল, মধ্যে একটা বিরাট সময় আমরা কে কি করেছি, সুখ দুঃখের কথা জানতে ইচ্ছে করছে।  তোর কি মত আহসান। বলে তৌফিক তাকালও ওর দিকে।

-দ্যটস এ গুড পয়েন্ট।   তৌফিক তোকে দিয়েই শুরু হোক। সুশান্ত প্রস্তাব টা দিলো।

কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে তৌফিক  বলতে আরম্ভ করলঃ

এই শহর ছেড়ে চলে গেলাম। কলেজ জীবন টা পাড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সেখানে পরিচয় হয়েছিল চয়নিকার সাথে।

সুশান্ত ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তা সেই যে মেয়ে টি যে তোর স্কুল জীবনে তোর জানালার কাছে এসে মাঝে মাঝে  উকি দিতো। তাকে ভুলে গেলি?

হ্যাঁ, আসলেই ভুলে গেছি। সময় গুলো যেন দ্রুত চলে গেলো। বলে তৌফিক আবার আরম্ভ করলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে এসে একটা অফার পেলাম আমেরিকা আসার। হাতছাড়া করতে রাজি নই। তাই চয়নিকাকে বললাম,চল বিয়ে করি। এক সাথে চলে যাবো ওখানে।

সে বলেছিল, আমার তো আরও এক বছর বাকি।

-তাঁর মানে বিয়ে হয়নি ওর সাথে? সুশান্ত বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল।

-আগে শোন, বড় ব্যগরা বাধাতে পারিস।

বিয়ে হোল, আমি চলে গেলাম। ও এলো এক বছর পরে।

-এতো নিতান্ত এক গেয়েমী গল্প। আবারও সুশান্তর কথায় থামতে হোল তৌফিক কে।

– আর একবার যদি তুই কোন কথা বলেছিস তাহলে আমি বলা বন্ধ করে দেবো।

-কান মললাম।

পাঁচটা বছর অনেক ঘুরলাম দুজনে মিলে। সুখ শুধু সুখ।

এক রাতে চয়নিকা বলল, এবার আমাদের পাখা গুটিয়ে বসার পালা। ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত বড় ধরতে ইচ্ছে করছে।

সেই মাসেই সে প্রেগন্যান্ট হোল। ডাক্তার বললও মেয়ে হবে। কত জল্পনা কল্পনা। ও বলল, নাম রাখব চন্দ্রিমা।

ঠিক সময় মতো চন্দ্রিমা এলো আমাদের মাঝে।

কথা শেষ করে তৌফিক চুপ করল।

-তারপর? জিজ্ঞাসা করল আহসান।

-তারপর, তারপর সব ওলটপালট হয়ে গেলো। চন্দ্রিমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথে একটা বড় গাড়ী এসে ধাক্কা দিল চয়নিকা যে পাশে বসেছিল সেই দিকে।

জ্ঞান ফিরে এলো। ডাক্তার এসে পাশে দাঁড়ালো। বিষণ্ণ মুখ।

বলল, তোমার স্ত্রী কে বাচাতে পারলাম না। বাচ্চা টা ভালো আছে।

চয়নিকা চলে গেলো। রেখে গেলো চন্দ্রিমাকে আমার কাছে। নিয়তির কি পরিহাস। 

কেউ কোন কথা বলছে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৌফিক।

চোখের কোণ টা মুছে বলতে শুরু করলো আবার।

চন্দ্রিমা আর আমি। অফিস থেকে ছুটি নিলাম। দুঃখ বেদনা কে পাশে রেখে চন্দ্রিমার মুখটার দিকে তাকালাম।

চয়নিকার মুখ টা যেন বসান চন্দ্রিমার মুখের উপর।

মনে মনে বললাম এইতো আমার চয়নিকা। ওর মাঝে ভুলবো আমার দুঃখ।

ওকে তিলে তিলে বড় করেছি। কষ্ট যে হয়নি তা নয়। ওর মুখটা, হাঁটি হাঁটি পা পা করে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরা আমাকে দিয়ে ছিল শক্তি, বেচে থাকার প্রেরনা।

 আমিই ওর মা, আমিই ওর বাবা। তাই সে ডাকে পাপামা বলে।

ওর মাঝেই আমি ভুলেছি আমার দুঃখ, পেয়েছি সুখ।

আমার কাহিনী এখানেই শেষ। আবার সুশান্তর পালা।

সুশান্ত গলা ঝেড়ে নিয়ে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো।

তোরা তো জানিস পড়াশোনায় আমি কোন সময়েই খুব ভালো ছিলাম না। তবুও কলেজ টা শেষ করার পরে এক আদম ব্যাপারীর সাথে যোগাযোগ হোল। তাঁরই মাধ্যমে আমি একদিন এসে পৌছালাম জার্মানিতে। বার্লিনে থাকা অবস্থায় ছোট খাটো কাজ করতাম। ভালোই চলে যেতো।

একদিন বারে বসে ড্রিঙ্ক করছি সেইখানে পরিচয় হোল পিটার সামসের সাথে। এক কারখানায় কাজ করে।

একদিন যেতে বললও ওর বাসায়।

গেলাম।

চার পাঁচ জন বন্ধু ঘরে। ঘরে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম এই ধোঁয়া সিগারেটের ধোঁয়া নয়। প্রায় জোর করেই পিটার আমার হাতে দিলো একটা।

সেই প্রথম। সেখানে যদি সেদিন না যেতাম তা হলে আমার জীবনীটা একটু অন্য রকম করে লেখা হতো।

কয়েক মিনিটের জন্য থামল সুশান্ত।

গ্লাসের পানিটা শেষ করে আরম্ভ করল।

আস্তে আস্তে ওদের দলে ঢুকে গেলাম। নেশা খোরের সাথে থাকলে নেশা না করে কি থাকা যায়। আমাকে পেয়ে বসলো। টাকা ফুরিয়ে যেতে লাগলো মাস পাড় হবার আগেই। বাড়ী ভাড়া বাকি পড়লো।

একদিন বাড়ীওয়ালা বের করে দিলো।

পিটারের ওখানে গেলাম। দুইদিন থাকার পর সে বলল, চল আজ এক জাগায় যাবো।

জিজ্ঞাসা করিনি কোথায় যাচ্ছি।

এসে দাঁড়ালাম এক ব্যাঙ্কের সামনে। ভাবলাম পিটার হয়তো টাকা উঠাবে।

সে বলল এই মুখোশ টা পড়ে নে, ব্যাঙ্ক ডাকাতি করব।

বললাম, না আমি পারবো না।

সে জোড় গলায় বলল, তাহলে তুই আমার রুমে থাকতে পারবি না। রাস্তায় থাকবি।

টাকা আমার দরকার। নেশা মেটাতে হবে।

নিয়তি লিখে রেখে ছিল জেলের ভাত খেতে হবে, তাই ধরা পড়লাম ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে যেয়ে।

সাত বছরের জন্য জেল হোল। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল ইব্রাহীমের সাথে। কনভারটেড মুসলমান। আগে নাম ছিল আলেক্স।  খুনের দায়ে পঁচিশ বছরের কারাদণ্ড তাঁর। আবদুল্লাহ নামে এক কয়েদি ওকে একদিন বলেছিল, যাবে সেখানে যেখানে আমরা নামাজ পড়ি। ও বসে থাকতো। একদিন আবদুল্লাহ কোরআনের ইংরাজি অনুবাদ বইটা দিয়ে বলেছিল, পড়ে দেখো। পড়ে সে কি পেয়েছিল সেই জানে, এসে বলেছিল আমি তোমাদের ধর্মে দীক্ষিত হতে চাই।

পরে সে ইমামতি করত।

সেই আমাকে কোরআন পড়া শেখাল। আমিও কনভার্ট হলাম।

-তাহলে তোর নাম টা? জিজ্ঞাসা করলো তৌফিক।

সুশান্তর সাথে ইসলাম যোগ করে নিয়েছি।

বেশ, তারপর।

আমি আস্তে আস্তে পালটিয়ে যেতে লাগলাম। আমার সামনের কালো পর্দা সরে গেলো। নতুন আলোর সন্ধান পেলাম।

 সাতটা বছর কাটিয়ে যেদিন বেড়িয়ে আসবো, ইব্রাহীম একটা চিঠি দিয়ে বলল, এই ঠিকানায় যোগাযোগ করে চিঠি টা দেবে, আমি সব বলে রেখেছি।  

মসজিদের পাশেই বাড়ীটা। মসজিদের ইমাম নাজাম। ওই বাসাতেই আমার থাকার জায়গা হোল। এখনো ওখানেই থাকি।

ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুটা জানার চেষ্টা করছি। আর মসজিদের দেখাশুনা করি।

 সবই নাজাম সাহেবের জন্য।

সুশান্ত ইসলাম আজ ভিন্ন মানুষ।  যা পেয়েছি তাতেই আমি সুখী।

এবার আহসানের কথা।

আবু কে ডাক দিয়ে চা দিয়ে যেতে বলল তৌফিক।

চা টা দিয়ে গলা ভিজিয়ে আহসান আরম্ভ করলো তাঁর কথা।

দেশে বড় এক ব্যাঙ্কের ম্যনেজার ছিলাম। দৈব যোগে আমার কলিগ অমিতের বাসায় দাওয়াত খেতে যেয়ে

দেখা হয়েছিল সেলীনার সাথে। অমিতের চাচা তো বোন। থাকে লন্ডনে। বেড়াতে এসেছে।

-জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেলীনাকে, কতদিন থাকবেন?

উত্তরে বলেছিল তিন মাস।

একদিন লাঞ্চ ব্রেকে অমিত প্রশ্ন করলো, বিয়ে করবি?

-হোয়াট? বুঝে উঠতে একটু দেরী হোল। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, কাকে?

-সেলীনা কে?

আবারও এক ধাক্কা।

-হ্যাঁ, ঠিক বলছি। সেলীনা রাজি, এখন তুই রাজি থাকলেই হয়।

ওকে যে আমার ভালো লাগানি তা নয়। বললাম, বাবা মার সাথে আলাপ করে জানাবো।

বাবা মা অরাজি হবে না জানি।

তাই শুভস্য শীঘ্রম।

আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। সেলীনাকে ফিরে যেতে হবে।

-তারমানে তৌফিকের মত প্রেম করে নয়? সুশান্ত জানতে চাইলো।

না, তবে দুই একবার বসেছি রেস্তোরায়।

তারপর? জিজ্ঞাসা করল সুশান্ত।

ও চলে গেলো।

তাঁর মাস ছয়েক পরে আমিও পাড়ি জমালাম। পিছনে রেখে গেলাম বাবা মা কে। ওটাই ছিল মনকষ্ট। জানিস তো আমিই একমাত্র সন্তান।

বলে ছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের কে নিয়ে যাবো।

দুই বছর পেড়িয়ে গেলো সংসার টা গুছিয়ে নিতে।

এক রাতে খবর এলো বাবা হার্টফেল করে মারা গেছে।

সাথে সাথে দেশে ফিরে এলাম। মা একা। চোখের জল শুধু ঝরছে। বাবা,মা ছিল এক বৃন্তে দুটি ফুল।

সেলীনা বলল, তুমি কিছুদিন থেকে মা কে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর।

তাই করলাম।

নিয়ে এলাম সাথে করে।

অনেক অনেক বছর কেটে গেলো। বাচ্চা কাচ্চা নেই আমাদের।

মা  আস্তে আস্তে ভুলে যেতে থাকলো সব কিছু। ডাক্তার বলল উনার Alzheimer disease. বাহিরে যেন কখন একা না যায়। রাতের খাওয়ার শেষে সেলীনা মা র চুল বেঁধে বিছানায় শুইয়ে দিতে গেলে মা বলে, বৌমা রাতে তোঁ আমাকে খেতে ডাকলে না তোমরা। চোখে জল আসে।  সব সেলীনাই করে, গোছল দেওয়া থেকে আরম্ভ করে খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত।

 কাজ ছেড়ে দিয়ে মা র সেবাই সে মগ্ন।

আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি। পরের মেয়ে নয় এ যেন তাঁরই মেয়ে। মন টা ভরে যায়।

 এর চেয়ে সুখ আর কি বল।

এই বলে আহসান থামল।

সবাই চুপ।

তৌফিক মৌনতা ভেঙে বলল, সুখ টা হচ্ছে একটা রিলেটিভ টার্ম। এই তো দেখনা আমরা সবাই সুখী তিন ভাবে।

আবু এসে বলল, স্যার, খাবার টেবিলে দিয়েছি।

Continue Reading