যে কথা বলা হয়নি

শ্যামলী চলে গেলো।

 রটা ফাকা।

ও আমার কাজিনের মেয়ে। থাকে কানসাসে। কলেজ বন্ধ। এসেছিল বেড়াতে। ভালই লাগছিলো ওর সঙ্গ। কোলাহল হীন   বাসাতে একটু প্রান সঞ্চার হয়েছিল। ওর ভালবাসা আমার সমস্ত দুঃখ , কষ্ট, অসুস্ততা নিরাময়ে সর্বোত্তম টনিকের মত কাজ করত।

 মেয়েটা আমার বুকের মাঝে একটা আঁচড় দিয়ে গেলো।

 বেশ তো ছিলাম।

ছেলে মেয়েরা আসতো, দিনে দিনে চলে যেতো। এতো দিন ধরে তো কেউ থাকে নি আমার ঘরে।

 পান থেকে চুন খসতে দেয়নি। চশমা, ঘড়ি ঘুচিয়ে রাখতো। মাঝে মাঝে বলতো, শমিত কাকা ইদানীং  তুমি সব কিছু ভুলে যাচ্ছ। আমার কি ভয় হয় জানো?

কি?

না থাক। আমি ও কথা ভাবতে চাই না। শুধু উপরের ছিটকিনি টা লাগাবে না।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেনও রে?

বলেছিল, শুধু যা বললাম তাই শোন। আর তোমার কথা বলার একটা সাথি দরকার। ছেলে বন্ধু নয় মেয়ে বন্ধু। সতী খালা কে বলও মাঝে মাঝে এখানে চলে আসতে।

হাসতে হাসতে বলেছিলাম, শোন আমাদের সমাজ এখনও কুসংস্কার আর নীচমনা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। যদি দুই পা এগিয়ে কোন ভদ্র মহিলার সাথে কথা বলেছি অমনি সবার চক্ষু আমার দিকে। মনে হয় আমি যেন অস্পৃশ্য।

তোকে একটা ঘটনা বলি, আমার কয়জন বন্ধু আর বান্ধবী একদিন বেড়াতে গিয়েছিলাম।  সবাই দুজন করে  শুধু আমিই একা। হঠাৎ ই এক বান্ধবী কে বললাম, এসো তোমার সাথে সেলফী উঠাই।

উঠালাম। 

বললাম, ফেসবুকে দেবো।

সে হৈ হৈ করে উঠলো। বলল, না না দিও না। তোমার সাথে ছবি দেখলে লোকে অন্য কিছু ভাববে।

বললাম কেন আগে তো উঠিয়েছো?

তখন তুমি দোকলা ছিলে, এখন একলা।

বুজতে পারছিস। কাজেই অনেক ভেবে চিনতে চলতে হয়।

কত কথাই না ওর সাথে বসে বসে বলতাম।

যাওয়ার সময় চোখ টা মুছে বলেছিল, আমাকে মাঝে মাঝে কল করবে তো।

বলেছিলাম, করবো, যা সামনের থেকে, আর মায়া বাড়াস নে।

মনের মধ্যে মাকড়সার জালের মতো  অনেক অনেক আগের ঘটনা গুলো ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। যা কিনা বলা হয়নি কাউকে।

মনে পরে ইয়াসমিনের কথা।  কলেজ জীবনে পরিচয় হয়েছিল।

অনেক অনেক বছর পর লস এঞ্জেলেস থেকে ফেরার পথে কিছুদিন ছিল আমার বাসায়।

 একটু অস্বস্তি বোধ যে হয়নি তা নয়। তবে তা ক্ষণিকের জন্য।

বয়স বলে কথা।

চুলে পাঁক ধরেছে দুজনের।

এখন সব কিছু শুষ্ক মরুভূমির মতো। তাতে দুব্বা গজাবে না। কাজেই ভয় এর কোন কারন নেই।

অনেক রাত পর্যন্ত দুজনে গল্প করেছিলাম। মনে হয়েছিল বয়সের সাথে সাথে  ও অনেক পাল্টেছে।

জীবনের উচু নিচু পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে আজ এখানে আসে পৌছেছে সেও ,আমিও।  

ফেলে আসা অবুঝ দিনের ঘটনা গুলো কোথায় যেন ভেসে গিয়েছে।

সামনে নেই ভবিষ্যৎ পিছনে হাসি কান্নায় ভরা। ওরও আমারও।

সেই সব কথা বলতে বলতে সতীর কল এসেছিল মনে আছে। কোন কারন নয়, শুধু জানতে চাওয়া।

হাসি এসেছিল, মেয়েলি মন।

কথা শেষে ইয়াসমিন চলে গিয়েছিল ঘরে। আমি উপরের তাক থেকে লোটা কম্বল পেড়ে ড্রয়াইং রুমে শোবার  আয়োজন করেছিলাম।  ঢং  করে পাশের ঘড়িটা জানালো রাত দুটো।

গরম নিশ্বাস আমার কপাল ছুয়ে গেলো। একটা ভেজা আঙ্গুল আমার ঠোট ছুঁইয়ে আস্তে আস্তে গ্রীবাপেরিয়ে বুকের কাছে এসে থেমে রইল কিছুক্ষণ। সারা শরীরে নেমে এলো আফিং এর মাদকতা। আমি আঙ্গুল টা ধরতে চাইলাম, পারলাম না। চোখ খুলতে গেলাম কে যেন দুই হাত দিয়ে বন্ধ করে দিল। আঙ্গুল টা আরও নিচে নেমে এলো। নাভীর কাছে। আমি না না বলে চিৎকার করে উঠলাম। ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো। এতো স্বপ্ন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

ইয়াসমিন দরজা খুলে বেড়িয়ে এসেছিলো। বলেছিল, কি হোল।

বলেছিলাম, দুঃস্বপ্ন। তুমি শুয়ে পড়।

নিউইয়র্ক শহর ঘুরেঘুরে ওকে দেখিয়ে ছিলাম। যাওয়ার দিন বলে গিয়েছিল, দেশে এলে আমার বাসায় উঠবে।

কফি খেতে হবে। রক্তে ক্যাফিনের অভাব। বাহিরের আকাশ টাও মেঘলা হয়ে এলো। দুই একবার বিদ্যুৎ চমকিয়ে গেছে। আজ আবহাওয়ার পূর্বাভাসে মেঘের ঘনঘটার কথা ছিল না।  বলেছিল আকাশে থাকবে নীল মেঘের ছড়াছড়ি।  কিন্তু কোথায়, হঠাৎ করে কোথা থেকে জড়ো হয়েছে এক গুচ্ছ কালো মেঘ। মাঝে মাঝে গর্জন করে তার উপস্থিতি জানিয়ে  দিচ্ছে।  আমি বাহিরে বসে কফিতে চুমক দিয়ে স্মৃতি মন্থন করবো ভেবেছিলাম।  হোল না।

ভিতরে এসে বসলাম। ফোন টা বাজছে। শুভঙ্করের ফোন। না, আজ কারোর ফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না।

তার চেয়ে শোন আমার কথা।

আমার খামখেয়ালি, অন্যমনস্কতা, অথবা উপেক্ষা করা, যাই বলা হোক না কেনও, দোষ টা আমার। আমি ছয় মাসের মধ্যে তার কোন খোঁজ নেইনি। সে তার ফোন নাম্বার টা রেখে গিয়ে ছিল, বলেছিল, মিন্টু ভাই, এই রইল আমার নাম্বার, পারলে কল করেন।

মনে পরে সাধনার কথা। স্বামী থেকে বিতাড়িত, কেন্সারে সর্ব শরীর জর্জরিত। কি ভাবে ভুলে গিয়েছিলাম তাকে। এমনি হয়।

সবাই নিজের বাস্ততায় মগ্ন। আমি বা তার ব্যতিক্রম হবো কেনও। খুজতে থাকলাম সেই কাগজ টা। যেখানে সে লিখে দিয়েছিল নাম্বার টা। কোথাও পেলাম না। অস্থির হয়ে এ ঘর ও ঘর করলাম অনেক বার। সতী কে কল করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে জানে কিনা।

বলে ছিল , সে কিভাবে জানবে।

তাই তো তার তো জানার কথা নয়। দুদিন পেড়িয়ে গেলো। হঠাৎ মনে পড়ল পুরানো মানিব্যাগ টার কথা। ওটার ভিতরে রেখেছিলাম। ওটা যে কেনও এতদিন ফেলে দেইনি তা উপরওয়ালাই জানেন।

চিরকুট টা পাইয়েছিলাম, কলও করেছিলাম। বলেছিলাম সাধনার সাথে দেখা করতে চাই, আসতে পারি কি?

ওপার থেকে বলেছিল, একটু দেরী হয়ে গেলো। গত মাসে সে চলে গেছে নাম না জানা দেশে।

আমার নামটা জানার পরে বলেছিল, আপনার নামে একটা খাম সে রেখে গেছে। বলে গেছে কোনদিন যদি আপনি আসেন তবে আপনাকে দিতে।

সেদিন বসে ছিলাম অন্ধকার ঘরের মাঝে। বাহিরে আজকের মতো অঝোরে ঝরছিল।  এ যেন আমার কান্না। আমি কাঁদতে পারিনি বলেই হয়তো বাহিরে তার প্রতিফলন হয়েছিল।

পৌঁছেছিলাম কমেকে। ওর বোনের বাসায়। দরজা খূলে দাঁড়াল যে সে অবিকল দেখতে সাধনার মতো। ভিতরে এসে বসতেই মেয়েটা একটা তোয়ালে এনে দিয়েছিল, সাথে একটা খাম। বলেছিল, মা বাসায় যেয়ে পড়তে  বলেছে।

 বড় বড় করে খামের উপর লেখা , মিন্টু ভাই।

চিঠি তে লেখা ছিল,

 মিন্টু ভাই,

 আপনার ফোনের আশায় থাকতে থাকতে আজ মনে হচ্ছে আর হয়তো দেখা হবে না। সময় আমার ফুরিয়ে এসেছে। কেন যে সেদিন আপনার নাম্বার টা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম  তা জানিনা। এই চিঠি যদি আপনার হাতে পৌছায় তবে একটা অনুরোধ আমার মেয়ে টা কে রেখে গেলাম ওর খালার কাছে, আপনি শুধু মাঝে মধ্যে ওর খোঁজ নিয়েন। দাবি করবো না শুধু অনুরোধ। কেন জানি সব সময় আমার মনে হতো আপনি আমার বড় ভাই। যাওয়ার আগে আপনার দেখা পেলাম না। দুর থেকে আশীর্বাদ করেন যেন উপরে যেয়ে দুঃখের ভাঁড় আবারো বহন করতে না হয়।

ইতি

সাধনা

পড়া শেষে চুপ করে বসেছিলাম। ভাবলাম পাথরের গা বেয়ে পানি ঝরতে তো আমি দেখেছি । তবে আমার চোখ দিয়ে সেদিন পানি ঝরল না।

কেন?

হয়তো নিজেকে দোষী মনে হয়েছিল। তাই। 

সুবর্ণ কে নিয়ে এসেছিলাম কিছুদিনের জন্য। ছিল আমার বাসায়। মাঝে মাঝে চলে আসে সে। মামা ভাগ্নী মিলে সময় আমাদের ভালই কেটে যায়।

দরজায় খট খট শব্দ। দরজা খুলতেই দেখি শুভঙ্কর। ভিজে একশেষ। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সোজা বাথরুম যেয়ে তোয়ালে টা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল, ফোন উঠাস নি কেন?

ইচ্ছা করে নি।

ওসব ভোগলামী ছাড়। তোর বৌদি তোকে যেতে বলেছে।

অগত্যা উঠতে হোল।

Continue Reading

অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি

 -জহীর, জহীর বলে ডাক দিলো অনির্বাণ।

-জি, মামা। জহীর আসে দাঁড়ালো অনির্বাণের পাশে। কিছু লাগবে মামা? বলে অনির্বাণের পায়ের কাছে পরে থাকা চাদরটা উঠিয়ে পা টা ঢেকে দিলো।

-টেবিলের উপর থেকে ব্যাথার ঔষধ টা এনে দে। চা য়ের কাপ টা চেয়ারের পাশে ছোট্ট টেবিল টা তে রাখতে রাখতে বলল অনির্বাণ।

-তুমি তো কয়েক ঘণ্টা খানেক আগেই খেয়েছ দুটো ট্যাবলেট। ডাক্তার না করে দিয়েছে ঐ ঔষধ বেশি খেতে।

-বেশি বকিস না, যা বলছি তাই কর। ডাক্তার কি জানে? ব্যাথা তার না আমার। বলে একটা ধমক দিলো অনির্বাণ। 

আমার হয়েছে যত জ্বালা, বলে জহীর বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো চায়ের কাপ টা নিয়ে।

বাহিরে শীত নয়, শীতের একটা আমেজ আছে।

 প্রতিদিন সন্ধ্যায় জহীর বাহিরের বারান্দায় অনির্বাণকে এনে বসিয়ে দেয় এই চেয়ার টাতে। 

কাজ শেষে জহীর এসে বসে মেঝেতে অনির্বাণের পাশে। সাথে বাঁশি টা। সুর তোলে। বিষাদের।

সুন্দর বাজায় সে। কোথায় শিখেছিল জানতে চায়নি অনির্বাণ।

একদিন জহীর বলেছিল এবার একটা সিনেমার গান বাজাই, মামা।

-না, চটুল গান আমার ভাললাগে না।

আর কোনদিন এই গানের কথা বলেনি জহীর।

 আজ আর জহীর এসে পাশে বসলো না। বারান্দার এক কোণে বসে রইল। বার বার তাকাচ্ছিল অনির্বাণের দিকে।

জহীরের মনে পরে , প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল অনির্বাণের সাথে।

ছোট্ট শহর গোপালগঞ্জ। সেই শহরে নতুন কলেজ খুলেছে। সেই কলেজের  ইংলিশের টিচার অনির্বাণ। অনির্বাণ আর তিন বন্ধু প্রতিদিন কলেজ শেষে এসে বসতো মতীনের চা র দোকানে। সেই দোকানে মাঝে মধ্যে চেয়ার টেবিল পরিষ্কার করতো জহীর। বয়স তখন তাঁর দশ পেরিয়েছে।

সেদিন টেবিলটা পরিষ্কার করছিলো সে। কি ভেবে তাকালও ওদের দিকে। চোখে চোখ হোল অনির্বাণের সাথে।

-নাম কি তোর? জিজ্ঞাসা করেছিল অনির্বাণ।

-জহীর।

-থাকিস কোথায়।

-রাস্তায়।

অনির্বাণের কাছে মনে হয়েছিল ছেলেটা বকাটে।

-মা, বাবা আছে? জিজ্ঞাসা করেছিল অনির্বাণ

-মারা গেছে।

-কি ভাবে?

– কি একটা রোগ হয়েছিল, জানিনা সবকিছু।

-আমার বাসায় থাকবি?

কিছুক্ষণ সে চেয়ে ছিল অনির্বাণের দিকে, কোন কথা বলে নি।

-ঠিক আছে,যা কাজ কর।

জহীর চলে যেতেই সাবীর বলেছিল, আর উ সিরিয়াস?

-কেনও না? উত্তরে অনির্বাণ চোখ তুলে বলেছিল।

-না মানে, চেনা জানা নেই। কি রকম ছেলে তা তো তুই জানিস না। থাকিস একলা।

-তাতে কি হয়েছে? জন্মানর সময় কি লেখা থাকে সে ভালো না খারাপ। ভাল খারাপ তো হয় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। ওকে যদি চান্সই না দেই তা হলে বুঝবো কি ভাবে সে খারাপ না ভালো?

-তোর সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তুই যা ভালো বুঝিস তাই কর। বলে সাবীর চা র কাপ টা টেনে নিলো কাছে।

পরেরদিন কলেজ শেষে জহীরকে নিয়ে এসেছিল বাসায়।

জহীরের মনে পরে, তার হাতে ছিল একটা ময়লা জামা আর চটের একটা ছালা, যেটা ফুটপাতে বিছায়ে শুত।

অনির্বাণ একবার তাকিয়েছিল ওগুলোর দিকে, কিছু বলে নি।

জহীর আজও ভুলেনি সেই মধুর ডাক টা।

-পারুলের মা, দরজা খোলো, দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।

পারুলের মা দরজা খুলে তাকালও জহীরের দিকে।

-এটা কে?

-ভিতরে যেয়ে বলছি।

পারুলের মা প্রতিদিন সকালে আসে। রান্না করে, ঘরদোর গুলো পরিষ্কার করে রাখে।

-ওর নাম জহীর। আজ থেকে এখানে থাকবে, তোমাকে সাহায্য করবে। ঐ পাশের ঘর টা ঠিক করে দিও ওর জন্য।

আর শোন তোমার ছেলে কামাল কে বলও আমার সাথে যেন দেখা করে।

জহীর জামার শেষ প্রান্তটা দিয়ে চোখ টা মুছলও। নিজের অজান্তেই চোখে পানি এলো।

সেই নতুন জামা,নতুন প্যান্টের কথা মনে পড়ল।

কামালের সাথে গিয়ে কিনেছিল। কবে নতুন জামা গায়ে দিয়েছে মনে করতে পারেনা। একটা জামা ছিল, সেটাকে কখন কখন কোন পুকুরের পাশে বসে পানিতে ভিজিয়ে শুকাতে দিয়েছে।

আজ সেই কথা মনে করে চোখে পানি না এসে পারে।

-জহীর জহীর ডাক দিল অনির্বাণ।

হাতড়ে বেড়ানো অতীতের স্মৃতি পাশে রেখে বাস্তবে ফিরে এলো সে।

-মামা, বলও।

-আমাকে ভিতরে নিয়ে চল, কেন জানি ঠাণ্ডা লাগছে। বলে উঠে দাঁড়ালো অনির্বাণ।

জহীর নিয়ে এলো ভিতরে, বসিয়ে দিলো ইজিচেয়ারে।

-এক কাপ চা বানিয়ে আনতো। খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

-চা খেলে তো তোমার ঘুম হবে না।

-তা নাহলে না হোক।

জহীর কথা বাড়ায় নি। শুধু ওর হাত টা অনির্বাণের কপালে ঠেকিয়ে দেখল জ্বর আছে কিনা।

চা এর পানিটা বসিয়ে দিয়ে আবারও ফিরে গেলো অতীতে।

সেদিন বিকালে, পারুলের মা বাসায় চলে গেছে।

দরজায় ঠকঠক শব্দ।

জহীর খুলল দরজা টা। এক ভদ্রমহিলা।

-কাকে চাই।

-অনির্বাণ আছে?

-আছে, আসুন, বলে বসার ঘরে নিয়ে এলো। চেয়ার টা দেখিয়ে বলল, এখানে বসুন।

অনির্বাণের সাথে চলতে চলতে সে আদব কায়দা বেশ রপ্ত করেছে।

দরজার কাছে যেতে যেতে ফিরে তাকাল মহিলার দিকে। কোন দিন এই বাসায় কোন মহিলা আসেনি ওর মামার খোজে।

-মামা, বলে দরজায় টোকা দিল।

-কি হয়েছে, দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলো অনির্বাণ।

-তোমার কাছে এক মহিলা এসেছে দেখা করতে।

-মহিলা? যেন আকাশ থেকে পড়লো অনির্বাণ।

বসার ঘরে ঢুকল অনির্বাণ।

অবাক হয়ে শুধু বলল, তৃষ্ণা তুমি?

-কেনও আসতে নেই।

জহীর রান্না ঘর থেকে শুনতে পেলো ওদের কথা ওদের হাসির শব্দ। আনন্দের হাসি।

কিছুক্ষণ পরে জহীরের ডাক পড়লো।

-দুই কাপ চা র ব্যবস্থা কর। আর কিছু আছে?

-আছে মামা, কালকের আনা মিষ্টি আর টোস্ট। জহীরের মনে হোল ও একটা বিরাট কিছু করতে চলেছে।

-এই সেই জহীর। মহিলা জহীরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো অনির্বাণ কে।

-হাঁ, ওর হাতের চা খেলে তুমি অন্য কোথাও চা খেতে চাইবে না। বলে হাসল অনির্বাণ।

এর পরে আরও কয়েকবার তৃষ্ণা এসেছে এই বাসায়। একদিন জহীর বলেছিল, তোমাকে কে কি আমি মামি বলে ডাকব?

-না, অনির্বাণ বাঁধা দিয়েছিল।

-কেন দোষ কি বলতে, ও আমাকে মামি বলেই ডাকবে।

অনির্বাণ আর কিছু বলেনি।

-কিরে তোর চা হোল? অনির্বাণের ডাক শুনতে পেলো জহীর।

আজ যেন কি হয়েছে জহীরের। বার বার ফিরে যাচ্ছে সে অতীতে।

তৃষ্ণা ছিল অনির্বাণের কলিগ। সে এসে কলেজে জয়েন করেছিল বেশ কয়েক বছর পর। অনির্বাণদের তিনবন্ধুর জোটের মধ্যে সেও এসে যোগ দিয়েছিল। ওরা হোল চার জন। আড্ডা দিতো। তৃষ্ণার অবর্তমানে তিনজন বাজি ধরত কে প্রথম প্রেম করবে তৃষ্ণার সাথে।

সেদিনের ঘটনা।

মতীনের দোকানে অনির্বাণ একা। তখনো কেউ এসে পৌঁছায়নি। প্রথমে এলো তৃষ্ণা। বসলো অনির্বাণের মুখোমুখি।

কোন ভূমিকা না করেই বলল, আচ্ছা অনির্বাণ, প্রেম করেছ কোনদিন?

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, না করিনি। কেন বলতো।

-করবে? চাঁছাছোলা জিজ্ঞাসা।

-তোমার হাতে আছে নাকি কেউ?

-আছে।

-কে? হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলো অনির্বাণ।

-আমি। চোখেচোখ রেখে বলল তৃষ্ণা।

অবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল সে তৃষ্ণার দিকে।

একটু সময় নিয়ে বলল, ইয়ার্কি মারছ।

-না সত্যি বলছি। বাকিটা তোমার উপর। বলে মাথা নিচু করে রইল।

জহীরের মনে পরে, সে নতুন জামা, নতুন প্যান্ট পড়েছিল বিয়ের দিন। কি ধুমধাম করেই না হয়েছিল বিয়েটা।

নদীর পাড়ের হলঘর টা ভাড়া করেছিল অনির্বাণ। সাজানো হয়েছিল ফুল দিয়ে। অনেক লোক এসেছিল।

তৃষ্ণা যখন এলো এই ছোট্ট বাসা টায়, জহীরের আনন্দ ধরে না। ওরা ছুটি নিয়েছিল। বাসাতেই ছিল।

জহীর ওর মামি কে আসতে দেয়নি রান্না ঘরে। পারুলের মা আর ও নিজে সব রান্না করেছে।

টেবিলে খাবার এনে ওদেরকে ডাক দিয়েছে।

ওরা হাসতে হাসতে বেড়িয়ে এসেছে আলুথালু বেশে।

কয়েকটা বছর ছিল আনন্দ মুখর।

একদিন ডিনারে বসে অনির্বাণ বলল, আমার চোখে সব কিছু ঝাপসা লাগছে।

বলে চোখ দুটো কচলালও।

ঝাপসা গেলনা।

-কি বলছও? জিজ্ঞাসা করেছিল তৃষ্ণা। হয়তো ছানি পড়েছে। কাল ডাক্তার সাকীলের কাছে যাও। বলে ওর পাতে ভাত বেড়ে দিলো।

ডাক্তার সাকীল দেখে বলেছিল, একটা ভালো চোখের ডাক্তার দেখানো দরকার। তুমি ঢাকা তে যাও। ডাক্তার মুর্তজা কে দেখাও। আমি চিনি ওনাকে। একটা চিঠি দিয়ে দিচ্ছি। দেরী করোনা।

পরের দিন রওয়ানা দিয়েছিল ঢাকার দিকে।

ডক্টর মুর্তজা দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল অনির্বাণকে, কোনদিন চোখে ব্যাথা পেয়েছিলে?

-হাঁ, বল এসে লেগেছিল চোখে, হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল সপ্তাহ খানেক।

– ফলো আপ টা ঠিক মত করা হয়নি। ইট ইজ টু লেট। বলে একটা ওষুধ লেখে দিয়েছিল।

কাজ হয়নি।

 আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে গেলো অনির্বাণের। কলেজের চাকরি টা ছেড়ে দিতে হোল।

সাবীর আর লতীফ আসতো ওর বাসায়। কি নিয়ে কথা বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারতো না। জহীর ঘরের কোণে বসে  কাঁদত।

ক্রমে ক্রমে জহীর দেখল ওর মামি আর আগের মত মামা কে সময় দেয় না। বেশির ভাগ সময় থাকে ফোনে।

 হাঁ হাঁ করে হাসে। বাসার কাজে মন নেই।

একদিন জহীর শুনল  মামা মামির মধ্যে কি নিয়ে যেন ঝগড়া হচ্ছে। শুধু একটা কথা কানে এলো।

মামি বলছে, আর আমি পেরে উঠছি না, কলেজের কাজ তাঁর উপর বাসায় এসে তোমার সেবা শুশ্রূষা।

মামার গলা শুনতে পায়নি জহীর।

এইভাবে চলেছিল বছর খানেক। তারপর আর চলল না। মামি বিদায় চেয়েছিল মামার কাছ থেকে। মামা সই করে দিয়েছিল কোর্টের কাগজে। 

যাওয়ার সময় মামি কে বলেছিল, তুমি সুখী হও।

চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়লো। কেন জানি আজ আর ঠেকাতে পারলো না। 

ওর মামা ডাকল।

-আসছি মামা, বলে চোখ টা মুছলও।

এক গ্লাস দুধ গরম করে হাতে নিলো।

-কেনও ডাকছিলে। এই নাও দুধ টা খেয়ে নাও।

Continue Reading

নিঃসঙ্গতা

  দুই রুম নিয়ে মহিদের বাস। ছোট্ট এক চাতলা রান্না ঘর। ওটাকেই গুছিয়ে নিয়েছে। একপাশে রেখেছে কফির মেশিন। ষ্টোভের পাশে রেখেছে পুরানো একটা টোস্টার-ওভেন। ঘরটার এককোনে দেয়ালে লাগানো স্থায়ী খাওয়ার টেবিল। এরই মাঝে আছে ডিশওয়াসার। বলতে গেলে বেশ ছিমছাম।

রান্না ঘর থেকে বের হলেই এল শেপের বসার ঘরের সাথে ফর্মাল ডাইনিং টেবিল।  দুটো সোফা, সামনে একটা টেলিভিশন।

এই হচ্ছে মহিদের জগত। ভাড়া নিয়েছে  এক পরিচিতার কাছ থেকে।

এমন ছিলনা আগে। ছিল বড় বাড়ী। অনেকে আসতো। হই হুল্ল করত। আজ আর কেউ আসেনা। মাঝে মধ্যে কল করে।

আজ, সকাল থেকেই আকাশ গোমড়া করে আছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। বৃষ্টি আসবে। বাহিরে হাটতে যাওয়া হোল না মহিদের। ভাবল তামান্নাকে কল করলে মন্দ হয় না। আগে অনেক কথা হতো। তামান্না কল করতো।

ইদানিং আর করে না। একটা বিষণ্ণতা মহিদ কে পেয়ে বসেছে আজ। কারো সাথে কথা বলে হাল্কা হতে চায়।

তামান্না ধরলও ফোনটা। জিজ্ঞাসা করল, কেন সে ফোন করেছে।

মহিদ বলল, এমনি, কেমন আছো, ব্যাস্ত কিনা।

মহিদের মনে হোল, তামান্নার কথার তাল কেটে যাচ্ছে। অন্যমনস্ক।

তামান্নাই দুই একটা কথার পরে বলল, আমার একটা কল এসেছে, তোমাকে দুই মিনিট পরে করছি।

মহিদ জানে সে আর করবে না। এই কথা আগেও বলেছে তামান্না। কল আর করে নি।

মহিদ ভেবে ছিল কথা বলে কিছুটা সময় কাটাবে। বড় একলা লাগছে আজ মহিদের।

অথচ কোন এক সময় গেছে, ওরা কথা বলেছে ঘণ্টা ধরে। সেইদিন গুলো অনেক পিছিয়ে গেছে।

বন্ধুত্ত ছিল।

ইদানিং মহিদের মনে হয়, ওটা ভাটার দিকে। কি কারন মহিদ জানে না। জানার ইচ্ছে নেই তার।

কথা হলনা।

জীবনে কখনও কখনও এমন সময় আসে যখন না চাইলেও একা থাকতে হয়। মহিদেরও হয়েছে তাই। ও তো একা থাকতে চায়নি কোনদিন। অনেকে বলে এ নাকি উপরওয়ালার একটা পরীক্ষা।

এই একাকীত্ব কাটানোর জন্যই সে চায় কারো সাথে কথা বলতে। কারো বাসার পার্টিতে যেয়ে আড্ডা দিতে।  

এইতো গতকাল সুরাইয়ার বাসায় ছিল পার্টি। আগে মহিদ দাওয়াত পেতো। ইদানিং ডাকে না।

ও যেতে চায় শুধু সময় কাটাতে। আড্ডা দিতে।

বাহিরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নেমেছে।  

মহিদ এসে দাঁড়াল জানালার কাছে।

মাঝে মাঝে  কয়েকটা পাখি ওর জানালার কার্নিশে এসে বসে। বাসা বাঁধতে চায় ওর জানালার উপরে ছাদের কোনে।

আজ আসেনি।

 ঘণ্টা দুই পরে সন্ধ্যা হবে। দিন বড় ছোট। শীতকাল। সময় কাটতে চায়না মহিদের।

এলো রেফ্রিজারেটরের কাছে। ডিপ ফ্রিজে ছোট ছোট পাত্রে রাখা মাংস,মাছ, ডাল আর তরকারি আছে।

এসবই এসেছে অরুনার কাছ থেকে। ও ক্যাটারিং করে।

মহিদ এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল একজনের জন্য উনি রান্না করেন কিনা। পরিমাণ যেহেতু খুবই কম।

রাজি হয়েছিল অরুনা। সেই থেকে ওর তৈরি খাবার থাকে মহিদের ফ্রীজে।

মাছ, ডাল আর তরকারি টা বের করলো মহিদ।

অথচ একসময় ওর টেবিলে থাকতো হরেক রকমের আইটেম। পাঁচ পদের নিচে কোনদিন সে দেখেনি টেবিলে।

কে যেন বলেছিল, তোর কোটা পুরন হয়ে গেছে। তাই তো তোর আজ এই দশা।

মহিদ আবারও এসে দাঁড়ালো জানালাটার কাছে। অন্ধকার হয়ে গেছে।  জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপারের বাড়ীটার বারান্দার আলো টা। মহিদ তাকিয়ে ছিল আলোটার দিকে। তার  মনে হোল সে যেন নির্জন দ্বীপের একজন। চারদিকে ব্যস্ততা, গুঞ্জন, কোলাহল, আলাপ, কলকাকলি অথচ নিজে যেন এক অপার শূন্যতায়-মনের মাঝে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার অন্ধকারে যেন ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে।  

মহিদের মনে হয় আশে পাশে কেউ নেই তার, নেই কথা বলার কেউ।

আছে, আছে তার ছেলে, আছে তার মেয়ে। ওরা বলে এসো বাবা, থাকবে আমাদের সাথে।

কিন্তু ওতে মন ভরে না তার।

কি যেন নেই।

আস্তে আস্তে ক্রমেই যেন সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মহিদের শুধু মনে হয় একটা কথা বলার লোক যদি থাকতো , ফোনটা উঠালেই তাকে পাওয়া যেতো। বলতে পারতো সে মনের কথা, বন্ধু ভেবে আশ্বাস দিতো।

না, নেই।

ইদানীং মহিদের মনে পরে ফেলে আসা ছোট বেলার স্মৃতি গুলো। মাঠ, আম বাগান। বেনী পাগলি।

 সেই আঁখের বাগান থেকে আঁখ কেটে পুকুর পাড়ে বসে খাওয়া।

গুলতি দিয়ে পাখি মারা।

কোথায় মুবা, কোথায় অণু, ধরাধামে আছে কি নেই জানে না মহিদ। চেষ্টা করেছিল ফেসবুকের মাধ্যমে। না, খোঁজ পাইনি।  

ঘড়িটা দেখল মহিদ। রাত সাতটা। এই সময় সে ডিনার করে। একটা প্লেটের মধ্যে সব গুলো খাবার ঢেলে মিশিয়ে নিলো।

মাইক্রোওয়েভে গরম করলো। সব গুলো মিলে একটা জগাখিচুড়ি তৈরী হোল। প্রথমে ভেবেছিল ফেলে দেবে। এক গ্লাস দুধ খেয়ে রাত টা কাটিয়ে দেবে। কি ভেবে প্লেট টা টেনে নিলো ।

খাওয়া শেষে টিভি টা বন্ধ করে দিলো মহিদ। গায়ে গরম কোটটা চাপিয়ে দরজাটা খুলে দাঁড়ালো। ছিটে ছিটে বৃষ্টি পড়ছে এখন। বেড়িয়ে পড়লো রাস্তায়। দুই রাস্তা পাড় হলে একটা ক্যাফে আছে। ওখানে বসে কফি খাবে। মন টা হাল্কা হবে।

অনেক লোকজন থাকে সেখানে। কথা নাই বা হোল। একলা তো নয়।

এক কাপ কফি নিয়ে বসল জানালাটার কাছে।

দুটো এ্যাম্বুলেন্স শব্দ করে চলে গেলো। এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনলে ওর মনে একটা ভীতির সঞ্চার হয়। মনে হয় যে আছে ঐ এ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে এ যেন তার শেষ ডাক।

জানালার থেকে চোখ টা সরিয়ে তাকালও বা দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল একটু দুরের টেবিল টার দিকে। চেনা মনে হোল মহিলা কে। মনে করতে চাইলো কোথায় যেন দেখেছে সে। চোখ টা ফিরিয়ে নিলো কফির পেয়ালার দিকে।

মনটা কে এফোঁড়ওফোঁড় করল। মিললও না। অথচ মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছে তাকে।

ভাবল যেয়ে জিজ্ঞাসা করবে। সেকি কোথাও তাকে দেখেছে কিনা।

মনটা বাড়ন করছে, যাসনে মহিদ।

শুনলোনা সে। কফিটা হাতে করে এগিয়ে  এলো টেবিল টার কাছে।

মহিলা তাকালও মহিদের দিকে। চোখে চোখ হল।

-কোথায় যেন দেখেছি আপনাকে। খুব ধীর স্থির গলায় বলল মহিদ।

মৃদু হাসল সে।

-কোথাও দেখা না হলেও এখানে তো দেখা হোল। বলে চোখের ইশারায় বসতে বলল মহিদ কে।

-বিরক্ত করলাম কি? কফিটা টেবিলে রেখে বলল মহিদ।

-না, বরং ভালো লাগছে কিছুক্ষণ কথা বলার একটা সাথী পেলাম। বলে চশমা টা খুলে গলার স্কার্ফ টা দিয়ে মুছল।

-না, মানে আমি আপনাকে—

কথা শেষ হোল না মহিদের।

-থাক সে কথা, কোথায় আগে দেখেছেন নাই বা মনে করতে পারলেন। এখন আমরা কথা বলি, সময় টা কাটাই। অতীত ঘেঁটে কি লাভ। বর্তমানই কি আসল না? বলে হাসল।

-হাঁ, অস্থির মন টা একটু শান্ত হোল আপনার সাথে কথা বলে। কি বলব? কোথা থেকে আরম্ভ করবো বলেন তোঁ?

-যা মনে আসে তাই বলুন। আমিও যা মনে আসে তাই বলব। তারপর কথা যখন ফুরিয়ে যাবে, আমরা উঠে পড়বো।

আপনি চলে যাবেন আপনার দিকে, আমি চলে যাবো আমার দিকে।

-আর দেখা হবে না? মহিদ কণ্ঠস্বর কাঁপা।

-না, আর দেখা হবে না। নির্লিপ্ত ভাবে বলল সে।

অনেক ঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো। ওরা হাসল, হাসতে হাসতে চোখে পানি এলো।

দোকান বন্ধের সময় হোল।

ওরা এসে দাঁড়াল রাস্তায়।

দুজনে বিদায় নিলো দুজনের কাছ থেকে।

রাস্তা পাড় হতে হতে মহিদ বার বার মনে করতে চাইল, কোথায় যেন দেখেছি ওকে। কোথায়, কোথায়, কোথায়।

Continue Reading

মনের মানুষ

         তৌফিক হাটতে বেড়িয়েছিল। প্রতিদিনই বের হয়। দুই থেকে তিন মাইল হাটা তার অভ্যাস। শরীর টাকে ঠিক রাখা। অনেকে বলে বয়সটা তার নাকি চেহারায় ফুটে ওঠেনা।

তৌফিকের বয়স শুনে অনেকে হাঁ হাঁ করে উঠে।

– মাশাআল্লাহ! বলে।

তৌফিক বলে, উপরে দেখে কি সব কিছু বোঝা যায়। ভিতরে তো উইপোকা খেয়ে ঝরঝরে করে ফেলেছে। শুধু একটা ধাক্কা। তখন লোকে বলবে, আহ, চলে গেলো, তবে শরীর টা মজবুদ ছিল। এই কথা বলেই হাঁ হাঁ করে হেসে উঠে।

অন্যান্যরা যোগ দেয় ওর হাসির সাথে।

তা সেইদিন কি হোল, এক পাক দিয়ে দুই পাকের মাথায় হার্টবিট টা বাড়তে আরম্ভ করলো। তৌফিকের মনে হোল ওর বুকে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ধপ ধপ শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে। একটা গাছে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল।

না, হার্টবিট টা থামছে না। বাসাটা বেশি দুরে নয়।  সে ভাবল, আস্তে আস্তে হেটে বাসাতে যেতে হবে। রাস্তায় কিছু হলে সর্বনাশ।

ধীরে ধীরে পা ফেলে সে বাসাতে এলো। শুয়ে পড়লো সোফা তে। এরকম তো আগে কখনো হয়নি। এই মুহূর্তে কি করনীয় সেটা সে ভাবতে লাগলো। ভাবল, কারডিওলজিস্টকে কল দিয়ে দেখা যাক। ও ভাবেনি তাকে দুই ঘণ্টার মধ্যে আসতে বলবে। সে ভাবল স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক কিছু হয়নি। হলে সে এতক্ষণে ধরাশায়ী হয়ে পড়তো।

ডাক্তার চেক করলো তৌফিক কে। একোকারডিওগ্রাম থেকে আরম্ভ করে সব রকম টেস্ট করে বলল, সাবধানে থাকতে। আবারও হতে পারে। এঁকে বলে আরটারীয়াল ফাইব্রিলেশন। এর কোন সমাধান নেই।

একটা ঔষধ লেখে দিলো, সবসময় সাথে রাখতে। 

সেই রাতটা তৌফিকের ভালো কাটেনি। অজানা একটা ভয় তাকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকলো।

মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলো, একদিন না একদিন তো যেতেই হবে।

পরদিন বন্ধু ফারহান কে কল করলো।

সবকিছু শুনে সে বলল, এইবার একটা বিয়ে করে ফেল। কিছু হলে তোকে দেখাশুনা করতে পারবে। নার্সিং হোমে গেলে কি হবে তা তো জানিস। তোকে একটা ভিডিও পাঠাচ্ছি ওটা দেখলে বুঝতে পারবি তোর বাজার দর এখন অনেকের চেয়ে বেশি।

-বাজে কথা রাখ? যারা আসবে বা আসতে চায়, তারা এই শেষ প্রান্তে পৌছে যাওয়া লোকের সেবা শুশ্রূষা করতে আসবে না। তবে কেউ বান্ধবী হতে রাজি হলে আমাকে জানাস। কথা বলে সময় কাটানো যাবে।

-ওই গুড়ে বালি। ফরহান হাসতে হাসতে বললও কথাটা।

-তোর সাথে পরে কথা হবে একটা জরুরী কল এসেছে, ধরতে হবে। বলে অন্য কলটা ধরলও তৌফিক।

পরমারা ফোন। 

সকালেই তো কথা হয়েছিল। আবার কল করলো কেনও?

-কি ব্যাপার, কোন সমস্যা। তৌফিক উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞাসা করলো।

-আমি হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে। তাড়াতাড়ি এসো। কথাটা বলে পরমা তৌফিকের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন টা রেখে দিলো।

তৌফিক কোন রকমে প্যান্ট সার্ট পড়ে বেড়িয়ে পড়লো।

তৌফিকের সাথে পরমার দেখা হয়েছিল বন্ধু রসুলের বাসায়।

 কোন এক বৃষ্টি ঝরা দিনে রসুলের বাসাতে আড্ডা দিতে বসেছিল ওরা পাঁচ জন। সাথে যার যার বৌ। একমাত্র তৌফিকই একা। যে কারনেই হোক ঐ পথে তার যাওয়া হয়নি। কেন যায়নি সে রহস্য বের করতে বন্ধুরা অনেক চেস্টা করেছে, সফল হয়নি।

নীলুফারের হাতের মুড়ি ভাজা সকলের কাছেই প্রিয়। বৃষ্টির দিনে মুড়ি ভাজা, সেই সাথে পাকোড়া আর কফি আড্ডাটাকে আরও জমিয়ে তুলল।

রাতে না খেয়ে যেতে দিলো না নীলুফার। রান্নায় সে পারদর্শী। ওটা তার হবি বলা যেতে পারে।

খেতে বসে তৌফিক দেখল হরেক রকমের আয়োজন। মুড়ি ঘন্ট, ইলিশ ভাজা, ছিমের ভর্তা সেই সাথে জলপাই এর আচার।

এইসব খাওয়া তৌফিকের ভাগ্যে জোটে না সহজে।

-এই জলপাই এর আচার কোথায় পেয়েছ, ভাবী? পাতের পাশে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল সাকিল।

-দেশ থেকে মা পাঠিয়েছে। তুমি কি কিছুটা নিয়ে যাবে। জিজ্ঞাসা করতেই সাকিল বলল, না, না লাগবে না।

-ও তোমাদের কে তো বলাই হয়নি, আমার এক নতুন বান্ধবী হয়েছে। গতমাসে ও মুভ করে এখানে এসেছে। একটা বাচ্চা আছে। আজ আসতে বলেছি। 

খাওয়া শেষে বন্ধুরা সব লিভিং রুমে যেয়ে বসলো। 

মহিলারা রান্না ঘরে।

পান খাওয়ার নেশা নীলুফারের। ওর সাথে যোগ দিয়েছে শিউলি। ফারহানের বৌ। দুজনেরই ঠোট লাল। পানের গুনে।

কিছুক্ষণ পরে দরজায় ঘন্টা বাজলো।

-ঐ পরমা এলো মনে হয়। বলে নীলুফার এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।

-এসো। নীলুফার নিয়ে এলো পরমা কে।

সাকিলের বৌ শম্পা নিজেই এগিয়ে যেয়ে পরিচয় করে নিলো।

হো, হো করে হাসির শব্দ আসছিলো রান্না ঘর থেকে।

তৌফিক উঠে দাঁড়ালো, বলল, যাই দেখে আসি এত হাসি কিসের। আর সেই সুবাদে নতুন আগন্তুক কে দেখে আসি।

-একমাত্র তোর পক্ষেই সম্ভব। বলে সাকিল টিপ্পনী কাটল।

রান্না ঘরের আইল্যান্ডে গোল করে সব বৌরা বসা।

-তোমাদের হাসির শব্দে টিকতে না পেরে এলাম দেখতে। আর— কথা শেষ হলনা তৌফিকের।

চোখে চোখ পড়ল পরমার সাথে।

মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেলো, তুমি?

-চেনও নাকি? দুচোখে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো নীলুফার।

উত্তর দিতে একটু দেরী হয়েছিল তার।

-কি ব্যাপার তৌফিক ভাই উত্তর দিচ্ছেন না যে। নীলুফার আবারও জিজ্ঞাসা করল।

– হাঁ, চিনি, তবে এভাবে দেখা হবে ভাবিনি কখন।

পরমারও বিস্ময়ের সীমা নেই। শুধু তাকিয়ে রইল তৌফিকের দিকে।

– তৌফিক ভাই, খুলে বলুন। রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।   নীলুফার হাতে তালি দিতে দিতে বলল।

তৌফিক উত্তর না দিয়ে তাকালও নয় দশ বছরের ছেলেটার দিকে। কোঁকড়ানো চুল। শ্যামলা।

-পরিতোষ, আঙ্কেল কে নমস্কার করো। বলল, পরমা। তাকালও আবারও তৌফিকের দিকে।

পরিতোষ কাছে এগিয়ে এসে নমস্কার করেই সাকিলের ছেলের হাত ধরে চলে গেলো অন্য ঘরে।

-কি ব্যাপার, পরমা তুমিই বলও, বলল নীলুফার।

-সে অনেক অনেক ঘটনা ভাবী। এই গল্প এক রাতে শেষ হবার নয়। বলে পরমা আবারও তাকালও তৌফিকের দিকে।

সত্যি এক রাতে এই গল্প শেষ হওয়ার নয়।

ফিরে যাই সেই সময়ে। যখন তৌফিক স্কুলে পড়ে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে ছিল পরিমল। ওর বাসাতেই যাতায়াত ছিল বেশি। মুসলমানের ছেলে বলে যে ওদের বাসাতে পাত পড়েনি তা নয়। পরিমলের মা কে মাসীমা বলে ডাকত। ওরই বোন পরমা। ফোর ফাইবে পড়ে। তৌফিক আর পরিমল পড়তো ক্লাস এইটে।

ঈদের দিনে পরিমল আসতো তৌফিকের বাসায় ,পূজাতে তৌফিক যেতো পরিমলের বাসায়।

দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা বছর পাড় হয়ে গেলো।

তৌফিক স্কুল শেষে কলেজে অনার্সে ঢুকেছে। সাইন্সের ছাত্র সে। লেখা পড়ায় বেশ ভালোই ছিল।

একদিন পরিমলই বলল ওকে, তোর কি সময় হবে আমার এই মাথা মোটা বোন টাকে কোচিং করা।

-মানে? বুঝতে একটু দেরী হোল তৌফিকের।

-মানে হচ্ছে পরমার ফিজিক্স আর অংকে যে মাথা তাতে সে পাশ করতে পারবে বলে মনে হয় না। এই মাথা নিয়ে কেনও যে সাইন্স পড়তে গেলো। বেশ রাগান্বিত মনে হোল পরিমল কে।

-ঠিক আছে। সন্ধ্যায় যাবো। 

চার দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল অন্যান্য বন্ধুদের সাথে তৌফিক। সন্ধ্যা হয় হয়। হঠাৎ মনে হোল ওকে যেতে হবে পরিমলের বাসায়।

উঠে পড়লো।

পরিমলদের বাসা চৌরাস্তার মোড় থেকে একটু দুরে। হাটা পথ। রাস্তায় কিছু পরপর বিজলী বাতির আলো। তারই আলোয় হাটতে হাটতে এসে পৌছাল পরিমলের বাসায়।

দরজায় টোকা দিতেই মাসীমা এসে দরজা খুলে দিলো।

-পরিমল বলেছে তুমি আসবে, ওর আসতে দেরী হবে, গেছে ওর বাবার দোকানে। কিছু জিনিষ কেনাকাটার আছে। এই বলে সে ডাক দিল পরমা কে।

যে এলো তাকে দেখে মনে হোল যেন নুতন দেখছে তাকে। ফুলফুল কামিজের সাথে ম্যাচ করে সালওয়ার, ওড়না টা গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।

ওর যে ওড়না পড়ার বয়স হয়ে গিয়েছে সেটা তৌফিকের মনেই আসেনি।

-বসও। শুনলাম অংকে আর ফিজিক্স এ নাকি জাহাজ।

-আগে তো তুই বলে বলতে, আজ তুমি করে বলছ যে।

-তোমাকে দেখে, এত বড় হয়ে গেছো বুঝতে পারিনি। যাক, কথা না বলে বই গুলো বের করো। বলেছিল তৌফিক।

মাসিমা সেই রাতে না খেয়ে যেতে দেয়নি।

এরপর প্রতিদিনই কি এক অদৃশ্য সুতার টানে চলে এসেছে তৌফিক। অংক আর ফিজিক্স বোঝাতে বোঝাতে অনেক কিছুই

তারা বুঝে ফেলেছে।

মাঝে মাঝে হাতের থেকে পেন টা নিতে যেয়ে হাতটা ধরে ফেলেছে। এক ঘণ্টার জাগায় তিন ঘণ্টা কেটে গেছে।

 এ সেই বাল্যকালের প্রেম।  

স্কুল শেষ করে পরমা এলো কলেজে। সেই কলেজে শিক্ষক হয়ে যোগ দিল তৌফিক। আড়ালে আবডালে দেখা হয় দুজনের।

পরমা বলে এখানে নয়, বাসায় এসো।

পরিমলের সাথে অনেকদিন দেখা হয়না। ও ব্যস্ত বাবার দোকান নিয়ে। কলেজ শেষ করে সে আর অন্য কোথাও কাজ নেইনি। ওর বাবার বয়স হয়েছে।

অন্যদিনের মত সেদিনও  তৌফিক এসেছিল। দরজায় টোকা দিতে পরিমলই খুলে দিল দরজাটা।

-তোর তো ইদানীং দেখাই পাওয়া যায় না। বলল তৌফিক।

-ব্যস্ত দোকান নিয়ে। পরমা বলছিল তুই আসবি। চল কোথাও যেয়ে চা খাই।

তৌফিকের মনে হোল পরিমল কিছু বলতে চায়।

ওরা এসে বসলো বাসার কাছে এক চা এর দোকানে।

দুজনেই চুপচাপ।

-কিছু বলবি, মৌনতা ভাঙ্গল তৌফিক।

-বলছিলাম কি, ভেবেছিস কি কোন পথে এগোচ্ছিস তোরা। তেলে জলে কি মিশ খাবে। এই কথা বলে পরিমল তাকালও তৌফিকের দিকে।

-আমার দিক থেকে তো কোন আপত্তি নেই। তুই তো আমাকে চিনিস। জাত বেজাত নিয়ে আমি ভাবিনা।

-তুই না মানতে পারিস, তোর বাবা,মা কি বলবে তা তুই জানিস না। আর তাছাড়া আমার বাবা মা কি বলবে তাও পরমা জানে না। সেকি পারবে সব তুচ্ছ করে বেড়িয়ে যেতে? চিন্তা করে দেখ। পরমাকেও বুঝতে দে, সে পারবে কিনা এত বড় একটা রিক্স নিতে।  

কথা শেষে চুপ পড়ে রইল দুজন।

পরিমলই বলল, চল।

দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল পরমা। পরিমল আর তৌফিক ভিতরে এলো হাসতে হাসতে। কাউকে বুঝতে দিলোনা ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছে।

-তোরা দুজন কথা বল, আমি বাহিরে যাচ্ছি, আসতে দেরী হবে। বলে বেড়িয়ে গেলো পরিমল।

সেদিন অনেক কথা বলেছিল ওরা দুজনে। সংকল্প করেছিল যত বাঁধা-বিপত্তি আসুক না কেনও ওরা অটল থাকবে ওদের জীবন গড়া নিয়ে।

উপরওয়ালার কল কাঠি কি কেউ বুজতে পারে, না জানতে পারে।  

অনেক দিন আগে থেকেই সবাই বুঝতে পারছিল দেশে একটা বড় সড় পরিবর্তন হতে চলেছে। এই পরিবর্তন যে এত ভয়াবহ আকার ধারণ করবে কেউ বুঝতে পারানি।

রাতের অন্ধকারে আর্মি নামলো রাস্তায়। রাজধানীর রাস্তায় যত্রতত্র গুলি বর্ষণ হতে থাকলো। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হোল দোকানপাট।

মৃত্যুর খবর আসতে থাকলো। স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো । শোনা গেলো পাকসেনারা যে কোনদিন এসে পড়তে পারে এই শহরে।

তৌফিক এলো পরিমলদের বাসায়। মাসিমা বলল, বাবা আমাদের বোধহয় চলে যেতে হবে এই শহর ছেড়ে।

-কোথায় যাবেন? উৎকণ্ঠিত স্বরে জানতে চাইলো তৌফিক। দরজার কোনে দাঁড়ান পরমা। মুখটা ফ্যাঁকাসে।

-কলকাতায়। আমার এক পিসতুতো বোন থাকে ঐখানে। দোকান আর বাড়ী টা বশীর দেখবে। অনেকদিন ধরে সে কাজ করে এই দোকানে। বিশ্বস্ত।

পরিমল হন্তদন্ত হয়ে এলো বাহিরের থেকে। চেহারায় ভীতির চিহ্ন।

-মা, দুই একদিনের মধ্যে ওরা এসে পড়বে। দেরী করা বোধহয় উচিৎ হবে না।

বলে তৌফিকের হাত ধরে বলল, আয় ভিতরে আয় কথা আছে।

আসলে কোন কথা নয়, পরমার সামনে ওকে দিয়ে বলল, আমি চান টা সেরে আসি।

-এই দেখাই কি শেষ দেখা। জিজ্ঞাসা করেছিল তৌফিক। সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছিলনা কি করবে।

-আমি আবার ফিরে আসব এইখানে। এই শহরে। তুমি যেওনা কোথাও। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল পরমা।  

তৌফিক থাকেনি এই শহরে। যোগ দিয়েছিল মুক্তি বাহিনী তে। ওর বাবা মা চলে এসেছিল রাজধানীতে।

নয় মাস পরে তৌফিক ফিরে এসেছিল এই শহরে। দেশ তখন মুক্ত।

এসে দাঁড়িয়েছিল পরিমলদের বাসার সামনে। দরজায় টোকা দিতে এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করেছিল কি চায় সে।

পরিমলের বাবা মোহনলালের কথা জিজ্ঞাসা করতেই মহিলা বলেছিল, ওরা উনার কাছ থেকে কিনে নিয়েছে এই বাড়ী আর দোকান।  জানেনা ওরা এখন কোথায় থাকে।

তৌফিক খুজে বের করেছিল বশীর কে। কলকাতার ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।

সেও জানে না।  

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তৌফিকে চলে এসেছিল বিদেশে। আস্তানা গেরে ছিল এইখানে। বন্ধু বান্ধব জুটেছিল।

রাতের অন্ধকারে একটা কাঁটা ঘা সব সময় জ্বলত ওর বুকে। জানতে দেই নি কাউকে।

সেই রাতে নীলুফারের বাসা থেকে আস্তে আস্তে সবাই উঠে পড়লো।

 পরমাও চলে গেলো। শুধু রইল তৌফিক। নীলুফারের কাছ থেকে পরমার ঠিকানা নিয়ে এলো সে ওর বাসার সামনে।

দরজায় নক করলো।

দরজা খুলল পরমা, অবাক হলনা। শুধু বলল, জানি তুমি আসবে। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
-তুমি বস। আমি আসছি। বলে পাশে রুমে গেলো।

সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো বৈঠকখানা। পরমা আর পরিতোষের ছবি দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। অন্য কারো ছবি সে দেখতে পেলো না। পরমা এলো শাড়ীটা পাল্টিয়ে। হাল্কা হলুদ রঙের। এই রং টা তৌফিকের প্রিয়। পরমা তা জানতো।

তৌফিক তাকালও ওর দিকে। কয়েকটা সাদা চুল দেখতে পেলো ওর কানের কাছে।

বয়স হয়েছে। ওর চেয়ে তিন চার বছরেরই না ছোট।

-তোমাদের দুজনের ছবি দেখলাম।

-অন্য কারো ছবি দেখার আশা করেছিলে? একটু ব্যাঙ্গ করে বলল পরমা।

 -সেটাই তো স্বাভাবিক।

-না, আর কারো ছবি নেই।

-ডিভোর্স? নাকি—একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল তৌফিক।

-কোনটাই নয়। চোখে চোখ রেখে বলল পরমা।

-হেঁয়ালি বাদ দিয়ে সোজা ভাবে বলবে কি? অস্থির হয়ে উঠল তৌফিক।

-সে অনেক কথা, রাত শেষ হয়ে যাবে। এখন তুমি বাসায় যাও, রাত অনেক হয়েছে। খুব ধীর স্থির ভাবে বলল  পরমা।

– না, না শুনে আমি যাবো না। একগুঁয়েমিতে পেয়ে বসলো তৌফিককে।

-তবে শোন। আমি, বাবা আর দাদা লুকিয়ে এসেছিলাম ওই শহরে। ভেবেছিলাম তোমার দেখা পাবো। কিন্তু পাই নি। দাদা খবর নিয়ে এলো তুমি মুক্তি বাহিনী তে যোগ দিয়েছ। তোমার বাবা মা এই শহর ছেড়ে চলে গেছে।

বাবা এসেছিলো দোকান আর বাড়ীটা বিক্রি করতে। বশীর চাচা অনেক কম দাম বলাতে বাবা অন্যের কাছে বিক্রি করলো।

কলকাতায় ফিরে এসে প্রতিদিন তোমার নামে মানত দিয়েছি মন্দিরে, যেন তুমি ফিরে আসো। বশীর চাচার কাছে কলকাতার ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাম। তুমি তো আর ফিরে যাও নি সেই শহরে।

-কি ভাবে জানলে? একটু রেগেই বলল তৌফিক। বশীর চাচাই তো বলল তোমাদের ঠিকানা সে জানেনা।

ফুফিয়ে কেঁদে উঠল পরমা। বলল, বশীর চাচা কেনও এমন করলো। তা নাহলে তো তুমি ঠিকই আসতে কলকাতায়।

সামনে রাখা ন্য্যাপকীন দিয়ে নাক টা পরিষ্কার করলো পরমা।

তাকাল ঘড়িটার দিকে। রাত তিন টা।

-বাসায় যাবে না? গলার স্বর টা ভারী।

– যাবো, সব শুনে। কবে ছাদনা তলায় বসে ছিলে? একটু রুঢ় ভাবে বলল তৌফিক।

শান্ত ভাবে পরমা বলল, ছাদনা তলায় বসার সৌভাগ্য আর হোল কোথায় বলও। যার সাথে বসব ভেবেছিলাম সেতো আর এলোনা।

-তাহলে? পরিতোষ?

-আমার পিসতুত বোনের ছেলে। ওর বাবা,মা গাড়ী এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ায় আমি ওকে দত্তক নিয়েছি। হোল তো। এবার বাসায় যাও। তোমার দেখা যখন পেলাম আজ আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো।

তৌফিক উঠে দাঁড়াল।

পরমা কাছে এসে বলল, সাবধানে যেও, তোমার তো চুলে পাঁক ধরেছে দেখছি।

 

আধা ঘণ্টার উপর লেগে গেলো হাসপাতালে আসতে। সারাটা পথ দুশ্চিন্তাতে কেটেছে। কেন পরমা হাসপাতালে, কার কি হয়েছে কিছু না বলেই ফোন টা রেখে দিয়েছিল।

ইমারজেন্সি রুমে মুখ ডেকে বসে আছে পরমা। তৌফিক আসতেই কাঁদতে কাঁদতে বলল, পরিতোষ-

আবারও কাঁদতে থাকলো।

-কি হয়েছে পরিতোষের? জিজ্ঞাসা করল তৌফিক।

-অভারডোজ।

-হোয়াট ডু উ মিন অভারডোজ? আতঙ্কিত স্বরে জানতে চাইল তৌফিক।

-ড্রাগ অভারডোজ। বেশ কিছুদিন থেকে ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন আমি দেখছিলাম কিন্তু বুজতে পারিনি যে ও এই পথে চলেছে। আমি কি করব তৌফিক? এই বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল।

তৌফিক কি বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না।

ডাক্তার আসতেই ওরা যেয়ে দাঁড়ালো ডাক্তারের পাশে।

-পেসেন্ট কে আই সি উ তে নিয়ে গেছে। বলল ডাক্তার। তোমরা বাসায় যাও। টাইম টু টাইম খবর দেওয়া হবে। এই বলে ডাক্তার চলে গেলো।  

পাঁচ দিন পর পরিতোষ বাসায় এলো। চোখের কোনে কালি। চুল আলুথালু। কারোর সাথে কথা বলে না। ঘরের মধ্যে বসে থাকে একা।

ডাক্তার বলে দিয়েছে চোখে চোখে রাখতে। রীহ্যাবে পাঠাতে বলেছে।

একমাস রীহ্যাবে থেকে ফিরে আলো পরিতোষ। আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠছে মনে হোল। পরমাকে জড়িয়ে ধরে একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, মা, আমি বাঁচতে চাই।

তৌফিক একদিন বলেছিল, চল, আমরা তিনজন দুরে কোথাও বেড়িয়ে আসি। বাহিরে গেলে ওর ভালো লাগবে। এক জায়গায় থাকতে থাকতে ওর এক ঘেয়েমী এসে গেছে। আর তাছাড়া তোমারও একটু বাহিরে যাওয়ার দরকার।

ভেবো না যেখানেই যাই দুটো রুম নেবো।

ওরা গিয়েছিল কোস্টা রিকা। ছোট একটা আলাদা বাসা ভাড়া করেছিল। পরিতোষ আনন্দে আত্মহারা। এই প্রথম সে বাহিরে

এলো। পরিতোষ কে নিয়ে তৌফিক গিয়েছিল যীপলাইনে।

-আমি পারবো তো আঙ্কেল? ভয়ে ভয়ে বলেছিল মাথায় শক্ত হ্যাট টা পড়ার সময়।

-কোন ভয় নেই। আমি তো আছি। তৌফিক ওকে সাহস দিয়েছিল।

পরমা ভয় পায়। ও যায়নি। বলেছিল, তোমরা এলে আমরা হাটতে হাটতে ঐ পাহারটার কাছে যাব। আর ঐ যে আগ্নেয়গিরি ওটার কাছে যাওয়া যাবে না? জিজ্ঞাসা করেছিল তৌফিক কে।

-যাবো রাতে, জ্বলন্ত লাভা দেখতে পাবে। বলেছিল সে।

যিপলাইন থেকে ফিরে এসে পরিতোষ পরমাকে গল্প করেছিল, বলেছিল, খুব এক্সাইটমেন্ট মা। তুমি মিস করলে।

পরমা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল।

তৌফিকের মনে হয়েছিল ওর এখানে আসাটা সার্থক।

পরিতোষ ঘুমিয়ে পড়লে ওরা দুজন এসে বসলো বারান্দায়। ছোট ছোট অনেকগুলো বাসা ছড়ান ছিটানো। লাল সুরকি দিয়ে তৈরী পায়ে চলা পথ মিশে গেছে এক বাসা থেকে আরেক বাসাতে। দুই পাশে ছোট ছোট ঝাও গাছ। টিমটিম বাতি জ্বলছে গাছ গুলোর ভিতর। এ যেন মায়াপুরী। আলো আঁধারের মাঝে কোথায় যেন একটা ঝি ঝি পোকা ডাকছে। বাতাসে গাছের পাতা গুলো একে পরের উপর ঢলে পড়ছে। ঝিরঝির শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিক।

ওদের কারো মুখে কোন কথা নেই।

তৌফিক হাতটা বাড়িয়ে ছিল পরমার হাত টা ধরবে বলে। কি ভেবে গুটিয়ে নিলো।

পরমা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এই ভালো, কি বলও?

 

 

 

Continue Reading

পাহাড়ের চুড়ায় বাংলোটা

     -কি সাঁজা শেষ হোল? রবীন ডাক দিলো রুবীনা কে।

-এই তো, হোল বলে। দুটো মিনিট সময় দাও। বলে রুবীনা কপালের টিপটা খুলে ফেলল। ওটা যেন মানাচ্ছে না শাড়ীর রংএর সঙ্গে।

-বেশি সাজগোজ করো না। নতুন বস আবার ব্যাচালার কিনা। পরে না খুইয়ে আসি তোমাকে। বলে হাসতে থাকলো রবীন।

-ফাজলামি করো না। কোন টিপই আমার পছন্দ হচ্ছে না। একটু হেলপ করবে। দেখতও কোন টিপ টা যায় শাড়ীর রং এর সাথে।

রবীন বৈঠকখানায় বসে  একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ও আমার দাড়া হবেনা।

তা যে হবে না সেটা রুবীনা ভালকরেই জানে। রুবীনার সাঁজার ব্যাপারে রবীন সব সময় উদাসীন। আজ পর্যন্ত কোনদিন মুখ ফুটে বলে নি, তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে।

অথচ সুমিতার স্বামী সুমিতার কাপড় পর্যন্ত ইস্ত্রী করে দেয়। কোন শাড়ী টা পড়বে সেটাও দেখিয়ে দেয়। সব সময় যে সুমিতা সেটাই পড়ে তা নয়। তবুও– । হঠাৎ এইসব চিন্তা রুবীনার মাথায় খেলে গেলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দপ করে উঠলো রাগে।

একবার ভাবল যাবে না সে পার্টিতে। দরকার হয় রবীন একাই যাক।

পড়ে ভাবল থাক, সিন ক্রীয়েট করে লাভ নেই। রবীন কেন সে রাগ করছে সেটাও বুঝতে পারবে না।

আজকের অনুষ্ঠান টা চা বাগানের নতুন CEO আবির আহমেদের আগমন উপলক্ষে। রবীন এই চা বাগানের ম্যানেজার।

এই অনুষ্ঠান টা সুন্দর ভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব তার উপর। তাই একটু আগে আগে যাওয়ার চিন্তা করছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যনেজার কামাল কল করেছিল দু বার। বলেছিল CEO সাহেব পথে, কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে।

-আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। বলে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে থাকল।

– কি? হোল তোমার? ওদিকে তো CEO সাহেব এসে পড়লো বলে।

রুবীনা ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। ইন্ডীয়া থেকে আনা সত্যপালের শাড়ি তার গায়ে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল। রবীন কিন্তু অতটা  নজর দিলোনা। নজর দিলো না তার কপালে ছোট্ট লাল টিপ টা।

গাড়ী এসে ঢুকল কনভেনশন হলের গাড়ী বারান্দায়। লোকজন প্রায় সবাই এসে গেছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যনেজার কামাল এগিয়ে এসে বলল, উনি পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বেন। আপনি একবার স্টেজ টা ভালো করে দেখে  নেন।

-উনাকে ফুলের তোরা কে দেবে ঠিক করেছেন? বলে তাকালও প্লান্ট ম্যানেজার শুভ ইসলামের দিকে।

-হ্যাঁ, আমাদের ফুড ডিপার্টমেন্টের বশীর উদ্দিনের মেয়ে মিলি, পাঁচ বছর বয়স, ওকে বলেছি। চটপটে মেয়ে।

-ঠিক আছে। বলে প্লান্ট ম্যানেজার শুভ ইসলামের সাথে করমর্দন করে, দুজনে কোথা বলতে বলতে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো।

রুবীনা এসে বসলো প্রথম সারিতে অনন্যাও ম্যানেজারের  বৌ দের সাথে। রুবীনার বান্ধবী শিমুল, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যনেজারের কামালের বৌ। ওর সাথেই রুবীনার বন্ধুত্ত বেশি।

রুবীনার রুপের প্রশংসা এই মহলের সবারই জানা। তা নিয়ে রুবীনার কোন গর্ব নেই। বরং কেউ কোন পার্টিতে এই বিষয় উঠালে সে লজ্জিত হওয়ার সাথে সাথে কথার মোড় অন্যদিকে নেয়ে যাওয়ার চেস্টা করে।

CEO আবির আহমেদের গাড়ী এসে দাঁড়ালো গাড়ী বারান্দায়। রবীন, শুভ ও অন্যান্য রা এগিয়ে গেলো।  

গাড়ী থেকে নেমে এলো আবির আহমেদ।

রবীন একে একে পরিচয় করিয়ে দিলো বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কর্তাদের সাথে।  

মেয়েদের সারি থেকে দেখা যাচ্ছিলো না আবির আহমেদ কে। উচ্চতায় খুব একটা উচু নয়। আর রবীন দাঁড়িয়েছে ঠিক ওর সামনে। রবীনের উচ্চতা অনেক বেশি হওয়াতে আবির আহমেদ ওর আবডালে রয়ে গেলো।

শিমুল রুবীনার হাতে চিমটি কেটে বলল, ভাই, বলও না তোমার কর্তা কে একটু সরে দাড়াতে। আমরা একটু দেখি। শুনেছি খুব হ্যান্ডসাম নাকি দেখতে?

-তা হ্যান্ডসাম হলেই বা তোমার কি এসে গেলো। তোমার তোঁ ওই প্যাঁচা নিয়েই থাকতে হবে। আর দুধের স্বাদ ঘলে মেটাতে হবে। বলে রুবীনা একটু জোড়ে হেসে উঠলো।  

হাসির শব্দ আবিরের কানে পৌছাতেই সে রবীনের ডানদিকে সরে এসে তাকালও যেখান থেকে হাসি টা এলো সেই দিকে।

চোখে চোখ হোল রুবীনার সাথে। মুহূর্তের মধ্যে রুবীনার মনে হোল তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। আবিরও আর তাকালও না ওই দিকে।

কামাল রবীনের কানে কানে বলল, উনাকে কি লেডিস দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন?

এই প্রস্তাব টা কামালের নিজের মাথা থেকে আসেনি, এসেছে শিমুলের কাছ থেকে।

বাসা থেকে বের হবার  আগে শিমুল বলেছিল, যদি পারো তোমাদের ওই বস কে পরিচয় করিয়ে দিও আমার সাথে।

-কেন? আমি তো আছি।

-তুমি তো ঘরের, সে তো বাহিরের। হিংসে হচ্ছে বুঝি। মিটি মিটি করে হেসে বলেছিল।

-না হিংসে হবার নয়। জানি মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।

এরকম কথা বার্তা ওদের মধ্যে হয়। দুজন দুজনকে জানে,চেনে। ওরা জানে ওদের বন্ধনে ফাটল ধরবে না।

একটু ইতস্তত করে রবীন বলল, আসুন স্যার আমাদের অর্ধাঙ্গিনীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এই বনজঙ্গলে কর্মসম্পাদনের জন্য ওরাই তো আমাদের অন্তরের শক্তি। বলতে পারেন ঐশ বা দৈব শক্তি।

-বাহ, লেখালেখি করেন নাকি? বলে হাসলও আবির আহমেদ।

-না, ওসব আমার দাড়া হয় না। বলে রবীন এঁকে এঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকল।

-এই, আমার হাতের তালু ঘামছে। কি করবো বলতো। বলে শিমুল রুবীনাকে ঠেলা দিলো। 

রুবীনা কিছু বললও না।

রুবীনার সাথে পরিচয় হোল আবিরের। আবির একটু হেসে মাথাটা দোলালও। রুবীনা মাথাটা একবার উঠিয়ে আবার মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

লেকচার শেষ। খাওয়া পর্ব শুরু। শহর থেকে নাম করা বাবুর্চি এনে রান্না করা হয়েছে বিভিন্ন ধরণের খাবার। খাবারের মান উন্নত। প্রশংসা শোনা যাচ্ছে চারিদিকে।

কিন্তু রুবীনার মুখে রুচি নাই। একটু খেয়ে পুরো প্লাট টা সরিয়ে দিলো সামনের থেকে। পাশে বসা শিমুলকে বললও,

মাথা টা ভীষণ ধরেছে, বমিবমি লাগছে। রবীন কে বলতে, সে বাসায় চলে গেছে। রবীন যেন চিন্তা না করে।

-কি বলছো? এর পরে তো গানের অনুষ্ঠান আছে। নাম করা শিল্পী এসেছে। অনেক কাকুতি মিনতি করল সে রুবীনা কে থাকার জন্য।

না সে থাকলো না। বাহিরে এসে দাঁড়ালো রুবীনা। ভাবল ড্রাইভার মাসুম বোধহয় খেতে বসেছে। ওকে এই মুহূর্তে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে কিনা, বুঝতে পারছে না সে।

– ম্যাডাম, কিছু খুজছেন? দারোয়ান হাবীব জিজ্ঞাসা করলো।

-বাসায় যাবো, ড্রাইভার কে খুজছিলাম।

-আমি দেখছি, ম্যাডাম । বলে হাবীব চলে গেলো।

বাহিরে ঝিরঝির বাতাস বইছে। ঠাণ্ডা নয়। কিন্তু রুবীনার কেনও জানি ঠাণ্ডা লাগছে। সারা শরীর মনে হচ্ছে হীম হয়ে আসছে।

– ম্যাডাম, বাসায় যাবেন? শরীর ভালো তো? মাসুম ডাকতেই সে তাকালও ওর দিকে।

-তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো মাসুম। আমাকে দিয়েই তুমি চলে এসো।

-না ম্যাডাম । চলেন।

খাওয়ার সাথে সাথে চা বাগানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলো আবির। আর মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছিল। কি যেন খুঁজছিল সে।

বাসায় এসে ঘরের জানালা গুলো খুলে দিলো রুবীনা। এক কাপ কফি এনে বাহিরের চেয়ারে বসলো। তাকিয়ে ছিল সুন্দর করে ছাঁটা লনের দিকে। দুরে উচু পাহাড় টা আজ আর দেখতে ভালো লাগলো না।

যেদিন রবীন এসে বলেছিল ওদের বড় সাহেব আসবে, নাম তার আবির আহমেদ, সেদিন ঘুণাক্ষরেতো মনে আসেনি এই সেই আবির যার সাথে চার চার টা বছর হাতে হাত ধরে ঘুরেছিল। কত স্বপ্ন এঁকেছিল।

আবির পড়তো সয়েল সাইন্সে। রুবীনা ছিল বোটানিতে। দেখা হয়েছিল সাইন্স ক্যফেটেরীয়াতে।

কফি আর কেক অর্ডার দিয়ে পকেটে হাত দিয়ে আবির দেখে মানিব্যাগ পকেটে নেই। অগত্যা অর্ডারটা ফিরিয়ে নিতে বলল।

পিছনে দাড়িয়ে ছিল রুবীনা। আবির পাশ ফিরে চলে যাবার উপক্রম করতেই রুবীনা বলেছিল, কিছু যদি মনে না করেন আমার কাছে কিছু বাড়তি টাকা আছে। ওটা কাজে লাগানো যেতে পারে। পরে দিয়ে দেবেন।

সেই শুরু।

দুজনে পাশ করে বেড়িয়ে গেলো। আবির চাকরির সন্ধানে রেজুমি পাঠালও বহু জাগায়। কাজ হোল না। বেকার সে। রুবীনার কাছ থেকে তাগাদা আসতে আরম্ভ করলো বিয়ে করার।

বাস্তবের করাঘাতে আবির বুঝতে পারলো না কি করবে। বিয়ে করে বৌ কে খাওয়া বে কি?

ঠাণ্ডা মাথায় বলেছিল রুবীনা কে, কিছুদিন অপেক্ষা করো। একটা না একটা কাজ জুটে যাবে। 

রুবীনা সে কথা শুনতে রাজি নয়।  

একদিন ওরা বসে ছিল পাবলিক লাইব্রেরীর মাঠে। কথায় কথায় রুবীনা বলল, তোমার দাড়া কিচ্ছু হবে না। তোমার সাথে আমার গাঁটছড়া বাধার চেস্টা না করাই উচিৎ ছিল।

আবির কোন কিছু বলার আগেই রুবীনা হন হন করে একটা রিক্সা ডেকে চলে গেলো।

আবির ভাবল কটা দিন যাক, রাগটা পরে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সাত দিন, দশদিন, চোদ্দ দিন পেড়িয়ে গেলো। রুবীনা এলো না।

আবির গেলো ওদের বাড়ীতে। দারজায় কড়া নাড়ল।

এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দাঁড়ালো।

জিজ্ঞাসা করলো আবির রুবীনার কথা।

মহিলা বললেন, সে তো এখানে নেই। ক্যানাডায় গেছে।

আবির কি করবে বুঝতে পারলনা। একটু পরে জিজ্ঞাসা করলো, ঐখানকার ফোন নাম্বার টা পাওয়া যাবে কিনা।

উত্তরে মহিলা বলেছিল, সে জানে না।

সেই শেষ দেখা আবির আর রুবীনার।

গাড়ীর শব্দ শুনে রুবীনা উঠে এলো। রবীন দরজা খুলেই দ্রুত এলো রুবীনার কাছে। হাত টা কপালে দিয়ে দেখতে চাইলো জ্বর আছে কি না।

-কি হয়েছিল? উৎকন্ঠা স্বরে জিজ্ঞাসা করলো।

-কিছু না। মাথা টা ঘুরছিল। তাই চলে এলাম। বলে দরজার দিকে তাকাল রুবীনা।

বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। রুবীনা রবীন কে  জিজ্ঞাসা করবে করবে করেও করতে পারছিলনা, আবিরের কথা। কোথায় সে। চলে গেছে না কি এখনও এখানে। রবীন তো এই ব্যাপারে কিছুই বলে নি তাকে।

শিমুল কে জিজ্ঞাসা করা মানে তো সারা বিশ্বকে জানানো।

হঠাৎ করে মনে হোল একজন জানবে, সে হোল মাসুম। ড্রাইভার।

মাসুম প্রতিদিন রবীন কে কাজে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসে। যদি ম্যাডামের কোন দরকার পরে। সে বাসার সামনে বসে সিগারেট টানছিল। বাবুর্চি শওকত এসে খবর দিলো ম্যাডাম ডাকছে।

-আমাকে ডাকছেন ম্যাডাম? জিজ্ঞাসা করতেই রুবীনা বললও সে একটু বের হবে। শহরে যাবে কিছু কেনাকাটা করতে।

শহর বেশি দুর নয়, মাইল দশেক পথ। আগে মাটির রাস্তা ছিল। এখন পাকা রাস্তা। দুদিকে সবুজ বড় বড় গাছ। ছায়ায় ঘেরা  রাস্তা। মাঝে মাঝে রুবীনা আর শিমুল হাটতে বের হয়। কিছুদূর গেলেই একটা নদী। নদী না বলে খাল বলা যেতে পারে। মাঝে মাঝে সেইখানে ওরা দুজন এসে বসে একটা ভিটের উপর। শিমুলই একমাত্র এই নির্জনে ওর কাছের মানুষ।

রবীন ব্যাস্থ থাকে ওর কাজ নিয়ে। ও যেন কাছে থেকেও অনেক দুরে মনে হয় রুবীনার কাছে।

রুবীনা থাকে একলা ঘরে। এই একাকীত্ব ওকে বিষণ্ণতার মাঝে ঠেলে দেয়।

বাসায় কাজের লোক আছে, আছে রান্না করার লোক, তাকে বলতে গেলে কিছুই করতে হয়না। এই কিছু করতে হয়না বলেই সময় কাটতে চায়না। মাঝে মধ্যে ভাবে আজ যদি একটা বাচ্চা থাক তো। তাকে ঘিরেই তো তার দিন টা কেটে যেতো।

-ম্যাডাম, কোন স্টরে থামবো। মাসুমের ডাকে রুবীনা ফিরে এলো বাস্তবে।

-কিছু শাঁক সবজি কিনবো। আর একটা ফুলের দোকানে দাঁড়াবে।

-ঠিক আছে ম্যাডাম। বলে মাসুম নিয়ে এলো কাচা বাজারে। শাঁক সবজি, ফলমুল সবই আছে।

কেনাকাটা শেষে ফেরার পথে রুবীনা জিজ্ঞাসা করলো, মাসুম, তোমার CEO সাহেব আছেন কোথায়?

-স্যার তো চলে গেছেন। সেদিন রাতেই চলে গেছেন।

রুবীনা আর কিছু বলল না।

ওর মাথায় হিজিবিজি চিন্তা এসে ঘুরপাক খেতে লাগল।

কেন? সে আসতে পারতো না? একটা অজুহাত দিয়ে তো আসতে পারতো রবীনের সাথে। শুনেছে তো আমি অসুস্থ। চলে এসেছি পার্টি থেকে। নাকি চিনতে পারেনি আমাকে?

দেখে তো বেশ ভালই আছে মনে হোল। ব্যাচেলার! বৌ এর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, নাকি অন্য কিছু।

 ছি! কি সব ভাবছে ও? কেন আসবে ? সে নিজেই তো সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে এসেছিল। তাহলে এত বছর পরেও কি ওর অবচেতন মনে আবির রয়ে গেলো।

-ম্যাডাম, বাসায় এসে গেছি। বলে মাসুম গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ করলো।

আজ রবীন একটু আগেই চলে এসেছে কাজ থেকে। দুমদাম করে পা ফেলে বেডরুমে যেয়ে সটান শুয়ে পড়ল। রুবীনা ভেবেছিল রবীন বাসায় এলে  বলবে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাহিরে কোথাও  ঘুরতে যাবে। দুরে নয়তো কাছে কোথাও।

এইতো কয়দিন আগে প্ল্যান্ট ম্যানেজার শুভ আর তার বৌ দুই মেয়ে নিয়ে দার্জিলিং থেকে ঘুরে এলো। আর রুবীনা যত বার বলেছে রবীন ততবার একটা না একটা অজুহাত দেখিয়ে এসেছে।

কিন্তু রবীনের দুমদাম পা ফেলা দেখে সে কথা আর বলা হোল না।

-কি ব্যাপার, শরীর খারাপ লাগছে? বলে ওর কাছে এলো রুবীনা।

-না, যত রাজ্যের ঝামেলা এসে হাজির হচ্ছে। বলে উঠে বসলো রবীন।

-কি ঝামেলা? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো সে।

-CEO সাহেব আবার আসছেন। এবার একদিনের জন্য নয়। বেশ কিছুদিনের জন্য।

-তাতে তোমার কি? তুমি তোমার মত কাজ করবে। তা কারণ টা কি?  কেন আসছে? থাকবে কতদিন?

ওর যেন ভালোই লাগছে কথাটা শুনে।

কেন? সে নিজেও জানেনা। হয়তো রবীনের কাছ থেকে যা পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিল তা না পাওয়ার বেদনা এই অপ্রত্যাশিত খবরটা তার মনে সাড়া দিলো।

আবারও একই  প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলো রুবীনা।

রবীন গায়ের জামাটা খুলতে খুলতে বলল, নতুন এক টা চা বাগান কেনার কথা চলছে। সেই বাবদে এখানে আসা। জানিনা কতদিন থাকবে।

হঠাৎ রুবীনা জিজ্ঞাসা করল রবীন কে, আচ্ছা, তুমি জানো কি, কেন তোমার বস বিয়ে করেনি। নাকি ডিভোর্স?

-তা আমি জানবো কি করে? তোমাদের এই মেয়েলি স্বভাব না–। বলে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

আবির এসেছে বেশ কিছুদিন হোল। রবীন বলে নি, বলেছে শিমুল। তাছাড়া আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। যে মেয়েরা চা বাগান থেকে চা পাতা তোলে তাদের বাথরুম ছিল দুরে আর মাটির তৈরী। সেটাকে কাছে আনার আর ইটের তৈরী বাথরুমের ব্যবস্থা করার জন্য বলেছে।

-বাহ, ভালোই তো করছে। তা আমার কর্তা তো কিছু বললও না এই ব্যাপারে। রুবীনার কথা শুনে শিমুল হেসে বলল, আমাদের কর্তারা তেতিয়ে আছে। বলছে, দুদিন এসে এদের কে মাথায় উঠিয়ে দিচ্ছে, উনি চলে গেলে ঠ্যালা সামলাতে হবে ওদের।

-কি জানি, বলে ফোনটা রেখে দিয়েছিল রুবীনা।

সেদিন ছিল পূর্ণিমা। আর ছিল রুবীনার জন্মদিন। আশা করেছিল রবীন একগোছা ফুল নিয়ে আসবে। না খালি হাতেই সে ঢুকল বাসাতে। রুবীনা তাকে মনে করিয়ে দিলো না। বরং বলল, চলো আজ হাটতে বের হবো। জ্যোৎস্না রাতে।

-তুমি তো জানো আমার রোমান্টিকতা আসে না। তবুও চলো। বলল রবীন।

-আজ তোমাকে একটা কথা বলব। তোমাকে বলিনি আগে।

-বলও। বলে নিতান্তই নির্লিপ্ত ভাবে হাটতে থাকলো।

-শোন, আমার জীবনে প্রেম এসেছিল। একজন কে আমি ভালোবেসেছিলাম। অথচ সেই প্রেম আমি নিজে হাতে বিসর্জন দিয়েছিলাম শুধু আমার জীবনের নিরাপত্তার জন্য। ওকে অস্থির করে তুলেছিলাম বিয়ে করার জন্য। যদিও সে তখনো পায়ে  দাড়ায় নি। শুধু কিছুটা সময় চেয়েছিল। বলেছিল, আজ যেটা চাইছ, কাল সেটা বিষাক্ত হয়ে উঠবে।

আমি ওকে মেরুদণ্ডহীন মনে করে ছেড়ে চলে এসেছিলাম। এসে তোমাকে দেখলাম বোনের বাসায়। তুমি ইস্টাবিলস্ট। বড় চাকরি কর। আমার জীবন সেট। বলে থামল রুবীনা।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। শুধু বাতাসের শব্দ চারিদিকে।  

-কিছু বলবে। চোখ তুলে রুবীনা চাইলো রবীনের দিকে।

রবীন বলল, তুমি ভালবাসতে জাননা। তুমি জাননা ভালবাসা কি জিনিষ। তুমি সেলফীস। শুধু নিজের টা বোঝো।

আরও কিছু বলতে চাইছিল রবীন, কিন্তু বলা হোল না। দুরে পাহাড়ের উপরে বাংলোটা দেখতে পেলো। আলো জ্বলছে।

বলল, চলো সারপ্রাইজ দিয়ে আসি।

দুজনে উঠে এলো উপরে। কলিং বেল টিপতে যেয়ে দেখল দরজাটা একটু খোলা। ধাক্কা দিলো। খুলে গেলো।

ভিতরে এলো ওরা। কেউ নেই ঘরে। সামনে একটা টেবিল। উপর একটা মোমবাতি জ্বলছে। পাশে হাতে আঁকা বড় ক্যানভাস পেপারের উপর লেখা হ্যাপি বার্থডে।

কোথা থেকে যেন একটা গান ভেসে আসছেঃ

 “ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে—“

Continue Reading

পরী

       শমশের আলী ছিল ছেলেদের হাই স্কুলের হেডমাস্টার। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সেই আমলে বিএ পাশ করে এই মফস্বল শহরে এসে আস্তানা গেরে ছিল।

তার পিছনে অবশ্য ইতিহাস আছে। লেখা পড়ায় ভালো শমশের আলী ছিল উচ্চাভিলাষী। কলেজের প্রফেসরদের নজরেও পড়েছিল। মাস্টার্স শেষ করে দেশের বাহিরে যাওয়ার পরিকল্পনা যে ছিল না তা নয়। তবে মন চেয়ে ছিল একদিন এই কলেজের প্রফেসর হবে। কিন্তু বিঁধি বাম।

মাস্টার্সে আর ঢোকা হলনা। খবর এলো বাবা হঠাৎ করে মারা গেছে। তল্পিতল্পা ঘুচিয়ে রওয়ানা দিলো দেশের দিকে।

বাড়ীর বড় ছেলে সে। হাল তো তাকেই ধরতে হবে।

বাড়ীতে আছে মা, আর ছোট বোন।

মাধবপুর গ্রাম। আছে ধান ক্ষেত, আছে বিল। চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ।  ছিমছাম একটা গ্রাম। শমশের আলীর বাবার ছিল কয়েক বিঘা ধানিজমি, ছিল বড় একটা পুকুর।  জীবন ছিল সচ্ছল।

শমশের আলী যখন বাসায় এসে পৌছাল তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ছেলেকে দেখে মা আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। বোনটা এসে জড়িয়ে ধরলও ভাইকে। রহমান চাচা এসে শমশের আলীর মাথায় হাত রাখল।  

-হাত মুখ ধুয়ে নাও, আমি তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। বলে আয়েশা চাচী উঠে গেলো রান্না ঘরের দিকে।

-আমি বাবার কবর দেখতে যাবো চাচী। বলে শমশের আলী বারান্দা থেকে নিচে নেমে এলো।

বাসার কাছেই কবরস্থান। রহমান চাচার হাতে হ্যারিকেন। চারিদিকে অন্ধকার। শুধু হারিকেনের আলোতে পায়ে হাটা পথ ধরে ওরা এলো কবরস্থানে। এতক্ষণ কাঁদেনি শমশের আলী। বাবার কবরের ভিটিতে হাত রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে।

বাবাই ছিল তার সব চেয়ে কাছের মানুষ।

মনে পরে, বাবা তার শেষ চিঠিতে লেখেছিল, তুই অনেক বড় হবি শমশের।  আমি সবসময় তোর জন্য দোয়া করি।

-চলো বাবা, রাত হোল। পিঠে হাত রাখল রহমান চাচা।

রহমান চাচা শমশেরের বাবার চাচাতো ভাই। বয়সে শমশেরের বাবার চেয়ে অনেক ছোট। শমশেরের বাবার এইকুলে আর কেউ নাই। এই চাচাতো ভাইয়ের সাথেই তার উঠা বসা ছিল। দুজনে মিলেই নিজেদের জমিজমা দেখা শুনা করতো।

বেশ কটা দিন গ্রামের চারিদিকে ঘুরে বেড়িয়ে আর মা কে সংগ দিয়ে কাটিয়ে দিল শমশের আলী। ভাবল, বাহিরে কোথাও যেয়ে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তাই না বোনটা ক্লাস এইটে। আর কদিন পরে স্কুল শেষ করে কলেজে যাবে। ওর ও একটা ভালো স্কুলে যাওয়ার দরকার।

মা কে বলেছিল। প্রথমে মা রাজি হয়নি। পরে বলেছিল, তুই যা ভাল মনে করিস তাই কর।

একদিন চাচা কে বলেছিল তার পরিকল্পনার কথা। শুনতেই চাচা বলেছিল মহেশখালীর হাই স্কুলের কথা।

-তুই কালই চলে যা, ওইখানে যেয়ে খোঁজ নে। শুনেছি ওদের হেডমাস্টার চলে গেছে নতুন চাকরি নিয়ে। তোর তো বিএ ডিগ্রী আছে। তাও আবার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে, তোকে ওরা নিয়ে নেবে।

চাচার কথা শুনে পরের দিনই রওয়ানা দিয়েছিল শমশের আলী।

দেখা করেছিল স্কুলের কমিটির লোকদের সাথে।

চাকরিটা হয়ে গেলো।

চাচার উপর জমিজমার ভার দিয়ে শমশের আলী মহেশখালীতে এসে বাসা বাধল।

আসার সময় চাচা বলেছিল, খুব তো একটা দুরে নয়, মাঝে মধ্যে এসে দেখে যাস। চিন্তা করিস না। তোদের সব কিছু আমি দেখে রাখবো। বড় ভাই ছিল আমার বট গাছ। সে আমাকে আগলিয়ে রেখেছে সব সময়। সে কি আমি  ভুলতে পারি।

কথা শেষে অনেক কেঁদে ছিল চাচা।

আস্তে আস্তে অনেক গুলো বছর পেড়িয়ে গেলো। এই ছোট্ট শহর টিকে শমশের আলী ভালোবেসে ফেলল। রাস্তায় চলতে গেলে লোকে এসে সালাম দেয়।

-হেড মাস্টার মশায় কেমন আছেন? বলে কুশল সংবাদ নেয়।

ভালো লাগে শমশের আলীর।

একদিন ভাড়া বাড়ি ছেড়ে আম, কাঁটাল বাগানে ভরা নিজের বাড়ীতে উঠে ছিল শমশের।  ছোট বোনটারও একদিন বিয়ে হয়ে  গেলো।

বাসাতে শুধু মা, আর সে।

মা বলে, শমশের এবার একটা বৌ নিয়ে আয়, বাবা। আমি আজ আছি কাল নেই। তোকে বৌ এর হাতে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত মনে ডাক আসলে যেনও যেতে পারি।

সেই দিনও এলো। স্কুলের এক শিক্ষকের বোন কে নিয়ে এলো বৌ করে। মা খুব পছন্দ করলো বৌমা কে।

বৌমার হাতে সংসার টা উঠিয়ে দিয়ে  সেও পাড়ি দিলো ওপারে।

বৌ নিয়ে মাধবপুরে এসেছিল শমশের। মা র আগেই চাচা চলে গেছে। চাচাতো ভাইরা সব দেখাশুনা করে।

জসীম বলেছিল, চল ভাবী তোমাকে তোমাদের জমি গুলো দেখাই।

আমেনা দেখে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, এত অনেক জমি জসীম ভাই।

-অনেক তো বটেই। আর এই পুকুর টাও তোমাদের। এখানে বিভিন্ন মাছের পোনা ছাড়ি প্রতি মাসে। 

যাবার সময় জসীম বলেছিল, ভাবী, এখান থেকে ধান, তরিতরকারি, মাছ পাঠাবো তোমার ওখানে। তুমি ধান আর চাল রাখার গুদামের ব্যবস্থা কর।

মাঝে মাঝে জসীম নিজে নিয়ে আসতো। অথবা অন্য কারো দিয়ে পাঠিয়ে দিতো।

শমশের আলীর সংসার বড় হোল। ঘরে এলো দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলে মেয়েদের নিয়ে সন্ধ্যায় মাদুর পেতে বারান্দায় বসতো শমশের আলী। আমেনা বেগম  রান্না ঘরের কাজ সেরে ডাক দিতো খাবার জন্য। শমশের আলী ভালো ভালো মাংসের টুকরা, মাছের পেটী উঠিয়ে দিতো ছেলে মেয়েদের পাতে।  

-তুমি সারাদিন কাজ করে আসো, ওই গুলো না খেয়ে ওদের পাতে উঠিয়ে দিচ্ছ? বলে গজ গজ করতো আমেনা।

শমশের আলী শুধু হাসত।

বাবার নেওটা ছিল ছেলে মেয়েরা। বাবা বাসায় এলেই নালিশ দিতো বাবার কাছে। কতবার মা ওদেরকে বকা দিয়েছে, কতবার মা পড়ার সময় হ্যারিকেন নিয়ে গেছে।

স্কুলের হেড মাস্টারির সাথা সাথে কিছু ব্যবসা আরম্ভ করেছিল শমশের আলী। কাঠ কাঁটার কল বসিয়েছিল বাসার সামনের জমিতে। সেই সময় পাঁটের ব্যবসা রমরম। শমশের আলী এক বন্ধুর সাথে পাঁটের ব্যবসা আরম্ভ করল। কাট আর পাঁটের ব্যবসা মন্দ চলছিল না।

দুই মেয়ের বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে দিয়েছিল শমশের আলী। মেয়ে দুটো চলে যাওয়াতে বাসা টা বড় নীরব হয়ে গেল।

একদিন শমশের আলীই আমেনা কে বলল, তোমার ছেলের এবার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? লেখা পড়া যা করেছে তাতে বাহিরে যেয়ে চাকরি না খুজে এই ব্যবসা গুলো দেখাশুনা করুক। বাসাতেও একটা বৌ আসুক। তোমারও ভালো লাগবে। কথা বলার একটা সঙ্গী পাবে। কি বলও?

-আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করেন। জামসেদ কে বলে দেখেন, রাজি আছে কিনা।

– তুমি আজ রাতেই ওকে ডেকে এনে কথা টা পাড়। নবহাটির সবুর মিয়াঁর বড় মেয়ে টার কথা সেদিন আজমল বলছিল। আজমল কে তো চেনও? আমার স্কুলের অংকের মাস্টার। বলেছিল দেখতে শুনতে ভালো। কথা গুলো বলে শমশের আলী উঠানে নেমে এলো। যাবে মসজিদে। নামাজ পড়ার সাথে সাথে লোকজনের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়। ভালো লাগে।

সেই রাতেই আমেনা জামসেদ কে বলেছিল কথা টা। জামসেদ অরাজী হয়নি।  

দিনকাল দেখে পরী কে ঘরে নিয়ে এলো বৌ করে।  পরী ঠিক পরীর মতই দেখতে। গায়ের রং দুধে আলতা মেশানো। গ্রামের মেয়ে। লেখা পড়া ততটা করে নি। কিন্তু আদব, আচরণ দেখে শমশের আলী আর আমিনা দুজনেই খুব খুশি।

ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সোজা চলে যায় রান্না ঘরে। শ্বশুর বাবা আর শাশুড়ি মার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে।

পরী নিজের হাতে ভার নিলো সব কিছুর। কাউকে বলে দিতে হোল না কি করতে হবে।

 আগে বাসার কাজের মেয়ে টা এসে রান্না ঘর খুলত। নাস্তার ব্যবস্থা করতে করতে নয়টা বেজে যেতো। আমিনা ঘুম থেকে উঠত একটু দেরী করে। কাজের মেয়ে টাকে বলে দিতো আজ কি কি রান্না করবে।

এখন শমশের আলী গরম ভাত খেয়ে স্কুলে যায়। জুতো জোড়া ঠিক জাগায় পায়। আগে খুজতে হতো।

শেফালীর মা, পাশের বাসার, প্রায় প্রতিদিন বিকেলে আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমেনা বেগম বসে ছিল বারান্দায়। পাশে রাখা বেতের টুল টা এগিয়ে দিল। শেফালীর মার হাতে পানের ডিব্বা। টুলে বসে দুটো পান বানাল শেফালীর মা।

একটা পান আমেনা বেগমের দিকে এগিয়ে দিল।  

পরী রান্না ঘরে রাতের খাবার কি কি করবে তার ব্যবস্থা করছিল। কাজের মেয়ে, রহীমা, ওকে সাহায্য করছিল।

রান্না ঘর থেকে উকি মেরে দেখল পরী। উঠে এলো ওদের কাছে।

-খালা চা দেবো? বলে তাকালও শেফালীর মার দিকে।

-না, মা, পান খাচ্ছি, চা খাবো না। বলে হাসল শেফালীর মা।

পরী চলে যেতেই বলল, তুমি ভাগ্যবান, ভালো একটা বৌ পেয়েছ।

-সবই আল্লার ইচ্ছা। বাসাটা একটু খালিখালি লাগে, একটা নাতি, নাতনী আসে গেলে হৈ চৈ করতাম ওটাকে নিয়ে।

শেফালীর মা কি যেন বলতে যাচ্ছিল, সদর দরজা খোলার শব্দে তাকালও সেদিকে। শমশের আলী কে দেখে বলল, আজ আসি বইন। কাল আসব। বলে উঠে পড়লো।

হাত, মুখ ধুয়ে শমশের আলী এসে বসলো বারান্দায় পাতা চেয়ার টাতে। মুখ গম্ভীর।

শ্বশুর কে দেখে রান্না ঘর থেকে উঠে এলো পরী। হাতে এক জোড়া স্যান্ডেল।

-এই স্যান্ডেল টা পড়েন বাবা, ওটা ছেড়া। চা বানিয়েছি, সাথে মুড়ি দিচ্ছি। বলে। পরে থাকা স্যান্ডেল টা উঠিয়ে নিলো।

-ঠিক আছে মা। বলে টেবিল থেকে কাগছ কলম  হাতে নিলো শমশের আলী। কি যেন হিসাব করল।

আমেনা বেগম পাশে এসে দাড়াতেই, শমশের আলী বলল, জামসেদের মা, পাঁটের দাম টা পড়ে গেছে। অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেলো।

-ও নিয়ে ভাববেন না। আল্লা সহায়।

-ভাবতে চাই না, কিন্তু মাথায় চলে আসে। অনেক টাকা লোন রয়েছে। শমশের আলী আবারও কাগছের মধ্যে কি কি যেন লিখল। টাকা পয়সা নিয়ে আমেনা বেগম কোন সময়ই মাথা ঘামায় নি। বরং শমশের আলীই বলত জামসেদের মা, কোথায় কি আছে তোমাকে বুঝিয়ে দেই।

আমেনা বেগম বলেছিল, আপনার ছেলে কে বলেন, সেই বুঝে নেবে।

-ও বড়ই ছেলে মানুষ, বুঝে টুঝে চালাতে পারবে বলে মনে হয় না।  

কথা বলার মাঝে পরী চা আর মুড়ি রেখে গেলো টেবিলের উপর।

পরী চলে গেলে শমশের আলী তাকাল আমেনা বেগমের দিকে। বলল, ভবিষ্যৎ তে ওই বৌ ই তোমাকে দেখাশুনা করবে। মেয়েরা তো সবই বাহিরে চলে গেলো।

গম্ভীর প্রকৃতির শমশের আলী আরও গম্ভীর হয়ে গেলো। কথা বার্তা বলা কমিয়ে দিলো। মাঝে মাঝে উঠানে পায়চারি করে আর কি যেন ভাবে। আমেনা বেগম জিজ্ঞাসা করেছিল একদিন, শারীরিক কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। শমশের আলী নেতি সুচক উত্তর দিয়েছিল।

আমগাছে মুকুল এসেছে। প্রতি বছর এই সময় টাতে আমেনা বেগম যায় তার বাপের বাড়ি। শমশের আলী তা জানে।

একদিন গাড়ীর ব্যবস্থা করে দিয়ে বলেছিল, চিন্তা করো না বৌমা আছে, সে  সব দেখেশুনে রাখবে।

দুইদিন না যেতেই খবর এলো শমশের আলী হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল আমেনা বেগমের।

বাসায় এসে দেখে অনেক এসেছে। এসেছে স্কুলের মাস্টার, ছাত্ররা। এসেছে আত্মীয় স্বজন। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে  গেছে আমেনা বেগমের। পরী আর জামসেদ এসে পাশে দাঁড়ালো।

কিছুদিন পাড় হয়ে গেছে। পরী ধরেছে হাল। শাশুড়ির সেবা, স্বামীর ভালোমন্দ দেখা, সেই সাথে উননের কাজ, সব এক হাতে করতে থাকল। গ্রাম থেকে নিয়ে এলো এক মেয়ে, নাম আয়েশা। ওকে সাহায্য করার জন্য। স্বামীকে বাসায় রেখে গেলো শ্বশুরের ভিটায়।

কোথায় কোন জমি আছে, কোন জমিতে কি চাষ হয় সব কিছুর একটা হিসেব নিয়ে এলো। চাচার ছেলে বাদল, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল সবকিছু।

 আমেনা বেগম কে সমস্যার কথা ভাবতে হয়নি । মনে পড়েছিল স্বামী বলেছিল, এই বৌমাই একদিন তোমার দেখাশুনা করবে। তাই হোল।  

দুই মেয়ে এসে কিছুদিন থেকে চলে গেলো নিজ নিজ সংসারে।

দিন পেড়িয়ে মাস, মাস পেড়িয়ে বছর। পরীর কোলে এলো এক ছেলে। দাদির সাথে খেলা করে। পরী ব্যস্থ থাকে ঘরের কাজ নিয়ে।

হঠাৎ একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে যেয়ে, আমেনা বেগম পড়ে গেলো মাটিতে। পরী ছিল  পিছনের বাগানে। শাকসবজি তুলছিল। আয়েশা দৌড়ে এসে খবর দিলো।

আমেনা বেগম তখনও মাটিতে পড়ে। উঠার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পাড়ল না। পরী আয়েশা কে পাঠালও জামসেদ কে খবর দেওয়ার জন্য।

জামসেদ এসে মা কে উঠিয়ে চেয়ারে বসাতেই আমেনা বেগম চিৎকার করে উঠল। বিছানায় শোয়ায়ে দিয়ে জামসেদ গেলো ডাক্তার আনতে।

পরী গরম তেল এনে মালিশ করতে থাকলো, যদি ব্যাথা কমে।

-আমার কি হবে ,মা, আমি হাটতে পারবো তো। বলে কাঁদতে থাকলো আমেনা বেগম।

-এখনি ডাক্তার আসবে। সব ঠিক হয়ে যাবে, মা। চিন্তা করবেন না। পরী সান্ত্বনা দেয়।

ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল, একটা এক্সরে করা দরকার। হাসপাতালে নিয়ে যান। ওখানে ওরা সব ব্যবস্থা করবে।

গাড়ী ডাকা হোল। আমেনা বেগম কে হাসপাতালে ভর্তি করা হোল।

এক্সরের রিপোর্ট এলো। মাজার হাড্ডি ভেঙে গেছে। অপারেশন করতে হবে। যেতে হবে শহরে। অথবা রাজধানীতে।

আমেনা বেগম অপারেশন করতে রাজি হোল না। ফিরে এলো বাসাতে। সময় বয়ে গেলো। আস্তে আস্তে ব্যথা কমে এলো।

কিন্তু আমেনা বেগম আর বিছানা থেকে উঠতে পাড়ল না।

পরী একটা মেয়ে কে নিয়ে এলো গ্রাম থেকে। শাশুড়ি কে দেখাশুনা করার জন্য।

পরী হাতের কাজ শেষ করে শাশুড়ির পাশে এসে বসে, বই পড়ে শুনায়। কে কেমন আছে তার খবরাখবর দেয়।

প্রতিদিন শাশুড়ির বিছানা পত্র পরিষ্কার করে।

একদিন শাশুড়ির চোখে জল দেখে পরী জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কাঁদছেন কেন মা? আমি কি আপনের সেবা করতে পারছি না? কোন ভুল ত্রুটি হচ্ছে?

-মা, খোদাতালা তোমাকে না এনে দিলে আমি কবেই চলে যেতাম। বলে কাঁদতে থাকলো আমেনা বেগম।

পরী শাশুড়ির চোখটা মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, আপনার মতো মা পাওয়া ভাগ্যির কথা। আমাকে দোয়া করবেন সারা জীবন যেন আপনার সেবা করে যেতে পারি।  

আজ অনেক অনেক বছর হয়ে গেলো। আমেনা বেগম বিছানায় পড়ে আছে।

পরীর বয়স বেড়েছে। কিন্তু কাজের অন্ত নেই।

ঘরের কাজ, স্বামীকে দেখা, সেই সাথে শাশুড়ির প্রতি রাতের নোংরা কাপড় বদলিয়ে নতুন কাপড় পড়িয়ে দেওয়া। সবই হাসি মুখে করে যাচ্ছে সে।

যেন এই ভাবেই করে যেতে পারে এই মোনাজাত করে সে ঘরের এলো নিভিয়ে দেয়, ভোরের আলোর সন্ধানে। 

 

Continue Reading

অশান্ত মন

 ঘরের তাপমাত্রা টা দেখল সাকিল। সত্তরের কোঠায়। সাকিলের কাছে মনে হচ্ছিল পঞ্চাশের নিচে। সোয়াটারের উপর একটা চাদর চাপিয়ে নিলো। জ্বর আসছে বলে মনে হোল না। তবুও থার্মোমিটার টা বের করল। বাহিরের  রৌদ্রে তাপ আছে বলে মনে হোল না সাকিলের কাছে।

একটা ঘুঘু পাখি অলস ভাবে বসে আছে গাছের ডালে। মাঝে মাঝে ঠোঁট দিয়ে গা টা চুলকাচ্ছে।

সাকিল জানালার কাছ থেকে সড়ে এলো। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাল। দরকার ছিল না সময় দেখার। কোথাও যাওয়ার নেই। কাউকে কল করারও নেই।

না, একজন এখনও আছে। তামান্না। অথচ ওকেই সে অবহেলা করত সবচেয়ে বেশি।

সেই দিন গুলো। শরীরের রক্তে তখন প্রবল উন্মাদনা। সাকিলের বন্ধুর চেয়ে বান্ধবীর সংখ্যাই বেশি। ওর কথার মধ্যে ছিল মাদকতা। সাকিল কথা বলতে ভালোবাসতো। ভালোবাসতো শুনতে। কথার মাঝে কথা বলতো না। শুধু মাথা নেড়ে নেড়ে ওদের কথা শুনত। সাকিল শিখা, সন্ধ্যা, সাকী, মতীন, পরে এসে যোগ দিয়েছিল তামান্না। কথা কম বলত সে। কাজেই  সাকিলের সাথে অত বেশি বন্ধুত্ব হয়ে উঠেনি।

কফি শপে বসে  আলোচনা হচ্ছিল বিভিন্ন বিষয়ের উপর। হঠাৎ মতীন বলে উঠল, আচ্ছা তোদের কি মত, একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ত কি গড়ে উঠতে পারে সেক্স ছাড়া।  

হঠাৎ এই ধরেনের প্রশ্নে, একটু ইতস্ত করল সবাই।

সাকিল চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ত হতে পারে উইদাউট সেক্স।

হাত তুলে ভোট নিয়ে দেখা গেলো, সেক্সের দিকে পাল্লা ভারী।

-হেরে গেলে বন্ধু, হাসতে হাসতে বলল মহি।  

-তাহলে এই যে এখানে বসে আছে শিখা, সন্ধ্যা, তামান্না এরা আমাদের বন্ধু নয়? বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল সাকিল।

-বন্ধু, তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয় । তোমার আর সন্ধ্যার বন্ধুত্ব যদি বন্ধুত্ব ছেড়ে অন্য দিকে মোড় নেয় সেখানে আজ না হয় কাল সেক্স আসবে। মতীন বেশ জোড় গলায় বলল।

সাকিল মানতে রাজী না।

হঠাৎ সাকিলের মাথায় ভুত চেপেছিল কিনা কে জানে, হয়ত প্রমান করতে চেয়েছিল ওরা ভুল।  

তামান্নার দিকে তাকিয়ে বলল, যাবে তুমি আমার সাথে ব্যাংককে?

আমি? আমতা আমতা করে বলল সে। আচমকা এই প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।

-আমি যাবো, বলে শিখা চেয়ার টা টেনে এনে সাকিলের পাশে বসল। আমি তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই না? কবে যেতে চাও? সাকিলের চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল।

সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। কি ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সবার চোখ সাকিল আর শিখার দিকে।

-তা তুমি কিসে বিশ্বাসী? সেক্স না নো সেক্স। সাকিলের প্রশ্ন।

-পরিস্থিতির উপর। সব নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। তুমি এই মুহূর্তে আমার বন্ধু, প্রেমিক নও।

– তোমার মতে প্রেমিক প্রেমিকা হলে, ওটা হতে পারে। সাকিল জিজ্ঞাসা করলো।

-ঐ যে বললাম, সব নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। তুমি প্রমান করবে বন্ধুত্ত টাই বড়, অন্য কিছু নয়। এখন বলও কবে  যাবে?

-আগামী সপ্তাহের প্রথমে। বলল সাকিল।

যেই কথা, সেই কাজ।

ওরা এলো ব্যাংককে।

যেদিন ব্যাংকক এয়ারপোর্টে এসে পৌছাল, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বাহিরে এসে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এলো এম্বেসেডর হোটেলে। আগের থেকে বুক করা ছিল। দুটো রুম। পাশাপাশি। দুই রুমের সাথে সংযোগ মধ্যের দরজাটা।

-ওটা খোলাই থাক। কি বলও? মৃদু হেসে শিখা বলল।

ওরা একে অপরকে চেনে আজ অনেক অনেক বছর হয়ে গেল। পড়াশুনা শেষে দুজনেই চাকরিরত। ভালো একটা ফার্মে কাজ করে শিখা। আর সাকিল ইউনিভারসিটিতে অধ্যাপক হিসাবে জয়েন করেছিল। বন্ধুরা প্রতি সপ্তাহে বন্ধের দিন মিলিত হয়। আড্ডা হয়, কথা কাটাকাটি চলে।

গোসল টা সেরে মাঝের খোলা দরজার কাছে এসে ডাক দিল শিখা। মাথার চুলটা জড়িয়ে নিয়েছে সাদা তোয়ালে দিয়ে।

-আসবো? ভদ্রোচিত অবস্থায় আছো তো? হাসতে হাসতে বলল,

-এসো।

বিছানার উপরে বসে পড়ল শিখা।

-মাত্র তো তিনদিনের জন্য আসা। প্রোগ্রাম টা কি বল? বালিশ টা মাথার কাছে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো শিখা।

-প্রথম দিন দেখব গ্র্যান্ড প্যালেস, যাবো চায়না টাউনে। দেখব Reclining Buddha Statue  খাবো The Sixth এ।

-তুমি তো ভালোই স্টাডি করে এসেছ। বলে বালিশটা টেনে বুকের কাছে নিয়ে এলো শিখা।

তিনটা দিন কোথা দিয়ে কেটে গেলো ওরা নিজেরাও বুঝতে পারলো না।

সব রকম কথাই হোল। সন্ধ্যায় সমুদ্র সৈকতে হাত ধরাধরি করে হাঁটল দুজনে। রাতে জ্যোৎস্নার আলোতে মাখা সুইমিং পুলের পাশে বসে গল্প করলো। কেউ নেই। শুধু ওরা দুজন।

শিখা জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা সাকিল, তোমার মন টাকে কি তুমি বোঝো, না বুঝতে চাওনা।

– সাকিল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ভয় হয়।

শিখা বলেছিল এই তিনটা দিন আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন।  গেঁথে রইল মনের মাঝে। হয়তো আবার আসব এখানে, হয়তো বা অন্য কারো সাথে, সেই দুইয়ের আসা যাওয়ার মাঝে থাকবে অনেক ব্যবধান।

সাকিল কোন কথা বললও না, শুধু শুনল।

শিখা বলল, তুমি অতি ভদ্র, মাঝের দরজাটা খোলাই রয়ে গেলো।

জানালার কাছ থেকে সরে এলো সাকিল। ঠাণ্ডা টা শরীরের ভিতরে সুঁই ফোটাচ্ছে। কফির মেশিন টা চালিয়ে দিলো।

মনে পড়ল, সেই দিনটার কথা।

সন্ধ্যায় আড্ডা দেবে বলে সবাই এসে বসেছিল রেস্তোরায়। এসেছে সবাই, আসেনি শিখা। শিখার দেরী দেখে সাকিলই জিজ্ঞাসা করলো, কি রে একটা কল দে শিখা কে, কোথায় গেলো সে।  

শিখা এলো। একলা নয়। সাথে আর একজনকে নিয়ে। সবাই তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। সাকিলের মুখের রেখার কোন পরিবর্তন এলো না।

শিখা পরিচয় করিয়ে দিলো, আনন্দ, আমার বন্ধু বা তার চেয়ে একটু বেশি। বলে তাকালও সাকিলের দিকে।

সেই “একটু বেশি” কথা টা সাকিল শুনতে পেলো কি না বোঝা গেলো না। চেয়ার থেকে উঠে আনন্দ কে বলল, বস এখানে, আমি আর একটা চেয়ার নিয়ে আসছি। বলে উঠে গেলো।

কোথায় যেনও একটা তাল কেটে যাচ্ছে বলে মনে হোল মতীনের। অন্যদিনের মত জমছে না। আনন্দই কি এর কারণ? মতীন ভাবছিল আনন্দের ঐ জায়গাটা মতীনের হতে পারতো। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা বের করে উঠে দাঁড়ালো।

-তোরা বস, আমি একটু টান দিয়ে আসি। বলে বাহিরে যেয়ে দাঁড়াল।

ওর মনে পড়ল সেই ফেলে আসা বৃষ্টির রাত টা। আড্ডা সেরে বাহিরে এসে দেখে মাত্র দুটো রিক্সা  দাঁড়ানো।  মতীন আর শিখা থাকে একি দিকে। সাকিলই প্রস্তাবটা দিলো।

-এই মতীন, তুই আর শিখা একটা রিক্সা নিয়ে চলে যা। যাওয়ার পথে শিখাকে নামিয়ে দিবি। বলে রিক্সা কে ডাক দিলো।

মুখচোরা মতীন সাহস করে সেদিন বলতে পারেনি কিছু।

-আপনার কথা শুনেছি শিখার কাছে। আনন্দ কনভারসেশন করার চেষ্টা করল।

-ওসব ভদ্র ভাষায় কথা বলা রাখো, হয় তুমি অথবা তুই দিয়ে কথা বলও। বলে হেসে উঠল।

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আনন্দ বলল, প্রথম প্রথম কিনা।

আড্ডা ভাঙ্গল। আনন্দ গেলো বাথরুমে।

সাকিল এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। শিখা এসে ওর কাঁধে হাত রাখল।

সাকিল তাকালও না ওর দিকে।

-তোমাকেই আমি চেয়ে ছিলাম। বলে সামনে এসে দাঁড়ালো শিখা।

– আমি নিজেও জানি না আমি কি চাই। যদি কিছু ভেবেও থাকো ঐ পদ্মায় তা ভাসিয়ে দিও। হৈ হৈ করে তো অনেক গুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। এবার সবারই সময় এসেছে পাখা গুটিয়ে বসার। তুমি বসতে চলেছ, আস্তে আস্তে সবাই বসবে। আমিই হয়ত থেকে যাবো একা।  ঐ যে বললাম আমি নিজেও জানি না আমি কি চাই।

সাকিল জানে তামান্না এখনি কল করবে। তাঁর কুশল সংবাদ নেবে। তারপর তাঁর কি কি করা উচিৎ আর উচিৎ না তাঁর উপর একটা লেকচার দেবে। এই তামান্নার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যখন আস্তে আস্তে সবাই চলে গেছে দুরে।

কফি হাউসের সেই আড্ডা আর নেই। অনেকেই আজ সংসারী।

শেষ পর্যন্ত শিখার আংটি বদল হয়েছিল মতীনের সাথে। আনন্দের সাথে নয়।

মনে পড়লো ওরা সবাই এসেছিল শিখার এপার্টমেন্টে। জাস্ট গেট টুঁগেদার।

আসেনি তামান্না। অসুস্থ। সুসংবাদের সাথে দুঃসংবাদও আছে। প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার না করে দিয়েছে হাটা চলাফেরা করতে। মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে।

শিখার বাসার ব্যাল্কনীতে দাড়িয়ে দুরে নিভছে জ্বলছে বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল সাকিল।

কাঁধে হাত পড়তেই ফিরে তাকালও। পাশে দাড়িয়ে মতীন।

-কিছু বলবি ? জিজ্ঞাসা করলো সাকিল।

-শিখা তোকে খুঁজছে। আর শোন, যদি কিছু মনে না করিস একটা কথা জিজ্ঞাসা করব।

–ভণিতা না করে জিজ্ঞাসা কর।

-মনে আছে, অনেক দিন আগে তোরা দুজন ব্যাংককে গিয়েছিলি—

কথাটা শেষ করতে দেইনি সাকিল। বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিল, নিজের বৌ কে চিনতে পারলেনা, বন্ধু।

মতীন আর কথা বাড়ায়নি।

কয়েকদিন পরে খবর এসেছিল, তামান্না বাচ্চা টাকে ধরে রাখতে পারেনি। এটা নিয়ে পর পর দুবার হলও।

আরও খারাপ খবর আসার বাকি ছিল। খবর টা এনেছিল মহি। তামান্নার সাথে ওর স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ও কেনও পারছে না বাচ্চা ধরে রাখতে এই ওর অপরাধ।

-ছোটলোক? ঘৃণিত কণ্ঠে বলেছিল সন্ধ্যা।

এক পড়ন্ত বিকেলে, তামান্নার বাসার বেলটা বাজাল সাকিল।

-তুমি কি মনে করে? আশ্চর্য হয়ে তামান্না তাকালও সাকিলের দিকে।

-কিছু মনে করে নয়। একলা বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। তাই বেড়িয়ে পড়েছিলাম, কিছু না ভাবেই তোমার বাসায় এসে হাজির হলাম। যদি মনে করো সময় ভালো না তবেঁ এখনি বিদায় নিচ্ছি।

-তোমার এই মন ভুলানো কথা বলার ঢং এখনো রয়ে গেলো সাকিল। এসো ভিতরে। ব লে দরজাটা খুলে এক পাশে দাঁড়ালো।

সেই থেকে দুজনে খোঁজ নেয় দুজনের। মাঝে মাঝে তামান্না এসে রান্না করে দেয়।

দুজনে বসে টিভি দেখে। রাতে তামান্না ফিরে যায়। শুধু বলে যায় কোন খাবার টা কখন খাবে।

-কি বললে? ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছ। বাহিরে রীতিমত গরম। আমি এখনি আসছি।

-না না তোমাকে –, কথা শেষ হতে পারেনি। তামান্না ফোনটা রেখে দিয়েছিল।

যখন সে এলো তখন সাকিলের গায়ের তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রী ফারেনহাইট। বমি করলো কয়েক বার।

তামান্না নিয়ে এলো ওকে হাসপাতালে। 

অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হোল। ফুসফুসে পানি জমেছে। ভাইরাল ইনফেকশন।

দুইদিন পরে বাসায় এলো সাকিল। তামান্নাই নিয়ে এলো।

দুর্বল। পা চলছে না।

লিফট টা বন্ধ। দোতালায় উঠতে হবে।

তামান্নার কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে এলো। হাঁপিয়ে উঠলো সাকিল। নিশ্বাস টা বন্ধ হয়ে আসছে মনে হোল। দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তামান্না ওকে জড়িয়ে ধরে রাখল।

-পড়ে যেওনা যেন। বলে ওর একটা হাত দিয়ে সাকিলের মাজাটা শক্ত করে ধরল।

ঘরে এসে শুইয়ে দিলো লিভিং রুমে পাতা বিছানাতে।

-তুমি শুয়ে থাক আমি তোমার ঔষধ গুলো সাজিয়ে রাখি। বলে ব্যাগ থেকে ঔষধ গুলো বের করলো।

-এদিকে একটু আসবে? ডাক দিল সাকিল তামান্না কে।

তামান্না এলো কাছে।

-তুমি কি রাতে চলে যাবে? এ যেনও শিশুর কণ্ঠ।

-না, আমি আছি।

সাকিলের চোখের কোণ বেয়ে ঝরা পানিটা মুছিয়ে দিলো তামান্না ওর হাত দিয়ে।  

Continue Reading

গলির সেই বাড়ীটা

    গলি টা তে পা দিতেই কাঞ্চনের গা টা ছমছম করে উঠলো। আলো অন্ধকারে ঘেরা রাস্তা। দুই দিকে ছোট ছোট পান বিড়ির দোকান। একটা খাওয়ার দোকানে পরাটা লুচি ভাজছে একটা ছেলে। ষণ্ডা মার্কা দুটো লোক দাড়িয়ে কি যেনও বলা বলি করছে। কাঞ্চনের দিকে তাকাল, ফিসফিস করে কি যেন বললও ওরা। বেশ কিছু লোক একটা বাড়ীর দরজা দিয়ে আসছে যাচ্ছে। যে বেড়িয়ে আসছে সে চারিদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে। যে ঢুকছে সেও তাই করছে।

কাঞ্চন বুঝতে পেরেছে এই সেই বাড়ি।

দুই বার ঢোঁক গিললও, বুকের ভিতর খালি খালি লাগছে। পাশের দোকানের হাড় জিরজিরে লোকটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

কাঞ্চন ডান হাতটা দিয়ে মুখ টা মুছে নিলো। পকেটে হাত দিয়ে দেখল মানিব্যাগ টা ঠিকমত আছে কিনা। টিভি তে দেখা সেই লোকটার কথা মনে করলো। সেও যখন প্রথমবার নিশিদ্ধ পল্লীতে এসেছিল,তারও বুক কেঁপেছিল। কাঞ্চন সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করল।

ইদানীং ইনটারনেটের মাধ্যমে অনেক ওয়েবসাইটে যাওয়া যায় যেখানে আছে এডাল্ট মুভি। কাঞ্চন দেখেছে সেই মুভি। শরীরের ভিতর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। গুগুল করে জেনেছে কোথায় গেলে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে।

তারপর বুক ফুলিয়ে বন্ধুদের কাছে বলতে পারবে ওর অভিজ্ঞতার কথা। বলবে লোমহর্ষক কাহিনী।

-এই ছোড়া এখানে দাড়িয়ে কি করছিস? বেটে, গলায় পুঁতির মালা, চোখ লাল, কপালে কাঁটা দাগ চেহারার লোকটা জামার কলার টা ধরে ধমকের সুরে বলল।

আমতা আমতা করে কাঞ্চন বুঝাতে চেষ্টা করল সে ভিতরে যাবে।

হাঁ হাঁ করে হেসে উঠল লোকটা।  

-ভিতরে যাবি? আয়, বলে হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ভিতরে নিয়ে এলো।

-ও মামি, বলে চিৎকার করে ডাক দিল লোকটা, দেখো কাকে নিয়ে এসেছি। বলে আবারও প্রান খুলে হাসতে লাগলো।

আলো আঁধারের মাঝে দেখা দিলো বয়স্ক এক মহিলা।

-এত চিৎকার করছিস কেন গরুর মত, বলেই কাঞ্চন কে দেখে বলে উঠল, ওমা এ ছোড়া এখানে কি করে?

-বুঝতেই পারছ, স্বাদ নিতে এসেছে। কোন ঘরে দেবে বলও, ডাক দাও।

কাঞ্চন ঘামতে শুরু করেছে। ভাবল দৌড়িয়ে বের হয়ে যাবে কিনা। পা যেন অবশ হয়ে গেছে। দৌড়ানোর শক্তি নেই।  

-পকেটে মাল আছে তোঁ? ভসভস করে মুখ দিয়ে পচা গন্ধ বের করে জিজ্ঞাসা করল ঐ কর্কশ চেহারার লোক টা।

কাঞ্চন পকেট থেকে টাকা গুলো বের করতেই মামি বলে ডাকা মহিলা ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো।

-যা, চম্পা কে ডাক দিয়ে বল, ওর সোয়ামি এসেছে। বলে সে ঘরে ঢুকে গেলো।

কাঞ্চন ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, চার পাঁচ টা মেয়ে, উগ্র সাঁজে সাঁজা, খিলখিল করে হাসছে। তার মধ্যে থেকে একটা মেয়ে বেড়িয়ে এলো।

-এই আমার নাগর নাকি আজ রাতের। বলে হেলতে দুলতে এসে কাঞ্চনের হাতটা চেপে ধরলও।

ওমা, এত ঠাণ্ডা বরফ। চলো, তোমাকে আমি গরম করব।

-না,না আমি চলে যেতে চাই। কাঞ্চন কান্না কান্না স্বরে বলল।

-তাতো হবে না বাছা, আমার রাত টা আমি মিছে যেতে দেবো না। এসেছ এখানে মৌজ মারতে, চলে যাবো বললেই কি যাওয়া যাবে। বলে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো দরজার সামনে। ধাক্কা দিয়ে খুলল দরজাটা।

-এসো, আমাকে বেশি বিরক্ত করো না।

ভিতরে টেনে এনে ময়লা একটা বিছানাতে বসিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

কাঞ্চনের মনে হোল, আজ এখানেই সে শেষ। কেউ জানতে পারবে না ও কোথায়, ওর লাশ টা হয়তো কোন রাস্তার ধারে ফেলে রেখে দেবে।

-এই ছোড়া, ঝটপট কাপড় খুলে ফেলো। বলে সে তার নিজের শাড়ীটা এক টানে খুলে ফেলল।

কাঞ্চন তাকিয়ে রইল চম্পার দিকে।

চম্পা এগিয়ে এলো।  

কাঞ্চন থরথর করে কাঁপছে।

চম্পা আরও কাছে এলো। কাঞ্চনের মুখ টা ওর হাতের মধ্যে নিলো। তাকালও ওর চোখে দিকে।

-বয়স কত? কঠিন স্বরে জানতে চাইল।

-পনের। ভয়ে ভয়ে বলল কাঞ্চন।

-বড় লোকের বকাটে ছেলে? বলে প্যান্টের উপর দিয়ে জোড়ে চাপ দিলো ওর পুরুষাঙ্গে।

রক্তাত চোখে বলল, এই ছোট ইঁদুর টা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি। বলে ঘরের কোনে পড়ে থাকা শাড়ীটা এক পেচে পড়ে নিলো।

তাকাল কাঞ্চনের চোখের দিকে। দেখল ওর ভয়ার্ত চেহারা টা। পাশে পড়ে থাকা চেয়ার টা টেনে এনে বসলো ওর সামনে।

তারও বয়স ছিল পনের। বাবা নাম দিয়েছিল সখিনা। বাস করতো ছোট্ট একটা গ্রামে, নাম সুন্দরপুর। গ্রাম বলা চলে না, বলতে হবে ছোট শহর। এখানে অনেকের ছিল পাকা ইটের বাড়ি।  ছিল স্কুল। ওদের বাড়ীটা ছিল মাটির। বাবা ছিল ফেরিওয়ালা। দোরে দোরে বিক্রি করে বেড়াতো বিভিন্ন জিনিষ। সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে ফিরত। মা গামছা টা এগিয়ে দিতো। অভাব ঢোকেনি এই বাড়ীতে।

পাশের বাড়ীর মেয়ে সুফিয়া ছিল ওর বান্ধবী। একই বয়সের। ওদের বাসায় বসে আড্ডা দিতো।

মাঝে মাঝে সুফিয়ার ভাই তোবারক ঐ ঘরের ভিতর এসে কিছু খোজার ভান করে খুজে বেড়াতো না জানা জিনিষ টা।

ওরা দুই বান্ধবী মিটমিট করে হাসত।

ঐ সুন্দর সংসার একদিন ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো। সখিনার বাবা কাঠফাটা রৌদে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো রাস্তায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো তার জিনিষপত্র। আর উঠল না। কে যেনও সখিনার মা কে খবর দিলো। পড়ে থাকা সখিনার বাবা কে ধরে সে অনেক কাঁদলও। সখিনার চোখের পানি শুখিয়ে গেছে। ও কাঁদেনি। ও পাথরের মত দাড়িয়ে ছিল।

অভাব এসে টোকা দিল দরজায়। নুন আনতে পান্তা ফুরাল। অনেকে অনেক পরামর্শ দিলো। অবশেষে আবার বিয়ে করল সখিনার মা।

সম্বন্ধ টা এনেছিল পাশের বাড়ীর জমীরের মা। তার দুঃসম্পর্কের ভাই। বছর তিনেক হোল বৌ এর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সেই ভাই এসেছিল জমীরের মার বাসায়। দেখেছিল সখিনার মা কে, দেখেছিল সখিনা কে।

সেই বলেছিল জমীরের মা কে।

-কি বলও বোন, বিয়ে বসবে ও?

জমীরের মা বলেছিল, জিজ্ঞাসা করে দেখি।

অভাব যখন আসে তখন সব দিক শুধু অন্ধকার মনে হয়।

মন না চাইলেও বিয়ে বসতে হয়েছিল সখিনার মা কে। প্রথম থেকেই পছন্দ হয়নি লোক টাকে সখিনার। গুন্ডা মার্কা চেহারা।  কেমন যেনও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে।

অস্বস্তি লাগে সখিনার।

ভেবেছিল, মা যদি সুখে থাকে ওর কি আসে যায়। লোক টা বের হয়ে যায় সকালে ফেরে রাতে। কি করে জানতে ইচ্ছে করে নি সখিনার। লোকটার নাকি টাকা পয়সা আছে শুনেছে।

দুটো ঘর। একটা ঘর ছোট। একসাথে লাগানো না। মাঝে এক ফালি জায়গা। সেখানে কাঠ আর কিছু ইট জড়ো করা।  রান্না ঘরটা উঠোন পেড়িয়ে। ছোট ঘরটাতে থাকে সখিনা।

সেই রাতে দরজার সিটকানি টা দিতে যেয়ে সখিনা দেখল, ওটা ভাঙ্গা। কি করবে ভেবে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। মাঝ রাতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। মনে হোল  ওর বুকের উপর কি যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। চিৎকার করতে যাওয়ার আগেই একটা হাত ওর মুখটা চেপে ধরল। তাকিয়ে দেখল ঐ লোকটা। অন্য হাতে ছুরি।

-একটা আওয়াজ করলে শেষ করে দেবো। তোকে আর তোর মাকে।

তারপর সখিনা আর কিছু জানেনা। শুধু জানে সেই রাতে ঐ পিশাচটা ওর সতীত্ব হরণ করেছিল। ঘরের এককোণে বসে কেঁদে ছিল অনেকক্ষণ।

সকালে পিশাচ টাকে কোথাও দেখতে পেলনা। মা  কে বলতে যেয়ে মনে হলও মা ওর কথা শুনতে চাচ্ছে না। সারা টা দিন না খেয়ে কাঁটালো।

তারপর এক সন্ধ্যায় কয়েকটা কাপড় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল দৌলতপুর শহরের দিকে।

 মা কে বলেছিল, মা এখানে আমার থাকা হোল না। ঐ পিশাচ টাকে পাড়লে তুমি জবাই করো। মা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমাকে তুই মাফ করে দিস।

 দৌলতপুরে ওর এক খালা থাকে। অনেকদিন আগে বাবার  সাথে গিয়েছিল সেখানে। অনেক কে জিজ্ঞাসা করে বাড়ীটা খুজে পেলো। প্রথমে খালা চিনতে পারেনি , পরিচয় দিতেই মুখটা গম্ভীর করে বলল, এসো।

-তা কতদিন থাকবে, বাছা।  বলে তাকালও ওর দিকে।

সখিনা বুঝতে পারলো এখানকার পাঠ খুব বেশি দিনের নয়।

আমতা আমতা করে বলেছিল, কোথাও একটা চাকরি পাই কিনা খুজে দেখবো। তারপর—

কথা শেষ হওয়ার আগেই খালা বেশ কর্কশ স্বরে বলেছিল, মাস খানেকের মধ্যে যদি কিছু পাও তোঁ ভাল, তার বেশি তোমাকে আমি রাখতে পারবো না বলে দিলাম।

সখিনা বুঝতে পাড়ল তার পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। বার বার একটা কথাই মনে হচ্ছে, আত্মহত্যা। আত্মহত্যা করা ছাড়া তার আর কোন পথ নেই।

প্রতিদিন সকালে উঠে বেড়িয়ে পড়ে। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে থাকে প্রতিটা দোকানে, প্রতিটা কল কারখানায়। চাকরি আছে কি?

কেউ আশ্বাস দেয়, কেউ সরাসরি না করে দেয়।

এমনি একদিন হাঁটছিল সে। পিছন থেকে একজন দ্রুত পায়ে এসে ওর কাঁধে আস্তে করে হাত রাখল।

চমকিয়ে পিছন ফিরে তাকাল। চিনতে পারলো না লোক টাকে।

কিছু বলতে যাওয়ার আগেই, খুব নরম স্বরে বলল, দুঃখিত। মাফ করে দেবেন। আপনাকে আমি গতকাল বশীরের দোকানে দেখেছিলাম। চাকরি খুজতে এসেছিলেন। আমার নাম খোকন, থাকি মাঠ পাড়ায়। যদি কিছু মনে না করেন তবে বলি,

এখান থেকে পঁচিশ মাইল দুরে জেলা শহর। ওখানে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

সখিনা যেনও পায়ের নিচে মাটি দেখতে পেলো। ভাবল, পৃথিবীর সবাই খারাপ নয়। এখনো কিছু লোক আছে যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

-কি কাজ? উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো সখিনা।

-আমার এক মামি থাকে ওখানে, তাকে দেখাশুনা করতে হবে। প্রতিদানে অনেক টাকা দেবে। বলে হাসল সে।

এ যেনও হাতে চাঁদ পাওয়া। রাজি হয়ে গেলো সখিনা।

-কবে যেতে হবে?

-কালই রওয়ানা দেবো। বিকালে। ঐ বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াবেন।

যেই কথা সেই কাজ। পরদিন রওয়ানা হয়ে গেলো দুজনে। পথের খাওয়া দাওয়ার পয়সা খোকন দিলো। অনেক গল্প করলো দুজনে।

পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। রিক্সা নিয়ে এলো এক গলির মাঝে। সখিনা তাকালও চারিদিক। কিছু কিছু লোক হাঁটছে। পানের পিক ফেলছে। সখিনার ভয় ভয় করছে।

রিক্সা দাঁড়ালো। ওরা নেমে এলো। খোকন মিটিয়ে দিলো ভাড়া।

দরজা খোলা।

-ও মামি, বলে ডাক দিলো খোকন।

দুই তিনটা মেয়ে একটু দুরে দাড়িয়ে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। বেশভূষা যেন কি রকম, মনে হোল সখিনার।

মামি এলো। ঠোঁট পানের রসে রাঙানো।

-কিরে পেচু, নিয়ে এসেছিস।

-হাঁ বলে ফিক করে হাসল।

সখিনা বুঝতে পেরেছে কোথায় তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। ঘৃনায় ঐ লোকটার মুখে থুথু মারতে ইচ্ছা করল।

মামি হাত ধরে টান দিলো।

-এসো এই ঘরে।

নতুন জীবন শুরু হোল সখিনার।  

সখিনা হোল চম্পা।

দশ টা বছর পাড় হয়ে গেছে চম্পার জীবন থেকে। কত লোক এলো, ভোগ করল।

মাঝে মাঝে ভাবে, মা কি বেচে আছে। ফিরে যাওয়ার পথ নাই। তরী ডুবে গেছে।

ফিরে এলো বাস্তবে। কাঞ্চনের দিকে তাকাল। হাতটা ধরে নিয়ে এলো ঘরের বাহিরে। ডাক দিলো মামি কে।

মামি বেড়িয়ে আসতেই বলল, ওর টাকা টা ফিরিয়ে দাও।

-মানে?  ফিরিয়ে দাও, বললেই ফিরিয়ে দেবো। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল মামি।

-আবারও বলছি মামি, টাকাটা ফিরিয়ে দাও। ওর গলার স্বরে কি যেন ছিল। মামি আর ঘাটালও না। টাকাটা দিলো চম্পার হাতে।

কাঞ্চন মাথা নিচু করে তার ছায়া টা দেখছে। নিজের ছায়া টাকে সে চিনতে পারছে না। মনে হচ্ছে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ছি ছি করছে। ওর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।

ওর একটা হাত চম্পা ওর হাতের মধ্যে নিলো। অন্য হাত দিয়ে টাকা গুলো ওর পকেটে ঢুকিয়ে দিলো।

আস্তে আস্তে দরজার কাছে নিয়ে এসে হাত টা ছেড়ে দিলো চম্পা।

কাঞ্চন মাথা নিচু করে বেড়িয়ে গেলো।

Continue Reading

মেঘ ভাঙ্গা রোদ

  সাত গঞ্জের বাস স্ট্যান্ড থেকে বাঁয়ে মোড় নিলে  যে রাস্তা সেই রাস্তার  পাশে ছোট্ট একটা দোকান।  পান থেকে আরম্ভ করে সব কিছুই পাওয়া যায় এই দোকানে। শুধু চাল আর ডাল ছাড়া। ছোট ছোট কাচের বয়ামে কোনটার মধ্যে বিস্কিট কোনটার মধ্যে লেবেঞ্চুস। পাশে  বাঁশের ছাউনী দেওয়া জাগাটায় চা র সরঞ্জাম। দুটো তিনটা  বেঞ্চ  পাতা দোকানের সামনে। এক জন উঠলেই আর একজন এসে বসে পড়ছে।

মধুর দোকানের চা খায়নি এমন লোক এই তল্লাটে নেই। সকাল সন্ধ্যে আড্ডা বসে এই দোকানের সামনে।

চা র অর্ডার আসে একের পর এক। কেউ নগত টাকা দেয় কেউ বা বাকি রাখে। মধু চেনে সবাই কে। শুধু খাতায় নাম টা লিখে রাখে। কেউ দুই চার দিন পর আসে দিয়ে যায়। কেউ বা ভুলে যায়। ইচ্ছা করে কিনা বলা মুশকিল।

মধুকে কেউ কোন দিন রাগ করতে দেখেনি।

এই তো সেদিন, বদনের মা বদনকে দিয়ে পাঠিয়েছিল বতল টা। তেল ফুরিয়ে গেছে। রান্না বন্ধ। বদন এসে বলেছিল, মধু চাচা মা তেল দিতে বলেছে, টাকা এখন নেই পরে দেবে।

মধু বতল টা ভরে দিয়ে দিতেই মহীন মধুর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কিরে মধু এই করলে ব্যাবসা চলবে? এই টাকা কি কোনদিন পাবি?

-কি যে বলিস, সবার দোয়াতেই তো আমার দোকান এখনও টীকে আছে। দুই পয়সা না হয় চলেই গেলো, আর একজনের পেট টা তো ভরল।

বিয়ে শাদী করেনি মধু। বয়স চল্লিশের কাছে। বাসাতে আছে শুধু মা। কত বার বলেছে, বাবা এবার বিয়ে কর। আমি আর কদিন। নাতি পুঁতি দেখতে ইচ্ছে করে।

মধু মাতে নি। হাসতে হাসতে গামছা টা নিয়ে বেড়িয়ে গেছে পুকুর পাড়ের দিকে।

কতদিন এই সান বাঁধানো পুকুর পাড়ে বসে ফিরে গেছে অতীতের সেই দিনগুলোতে।

রজত, জগদীস, শম্ভু, নারায়ন। ছোট বেলার বন্ধু এরা।

 আর ধোপা পাড়ার সেই মেয়ে টা, যার মুখ দিয়ে শুধু কথার ফুলঝুরি ঝরত।

অনু।

স্কুল শেষে বাঁশের ঝারের মাঝ দিয়ে যে পায়ে চলার পথ, পাড় হয়ে গেছে ধোপা পাড়ার উপর দিয়ে, সেই পথ দিয়ে ওরা পাচজন এসে দাঁড়াত রাখাল পাড়ায়।

ওখানে হাঁ ডু ডু খেলছে বড়রা।

মনে  পরে, ডু ডু করতে করতে নওশের ভাই এগিয়ে চলেছে, ছুঁতে যাবে একজন কে অমনি বাদল ভাই জাপটে ধরল নওশের ভাইএঁর পা।

দম ছাড়েনি নওশের ভাই। টানতে টানতে এগিয়ে চলেছে নিজের কোর্টে। চারিদিক থেকে সবাই চিৎকার করছে। শম্ভু পাড়লে দৌড়িয়ে যায় নওশের ভাই কে সাহায্য করতে।

না পাড়লও না। দম ফুরিয়ে গেলো।

সে কি উত্তেজনা।

 কতবার নারায়ন বলেছে মহি ভাইকে ওকে খেলায় নিতে। মাথায় একটা আস্তে করে চাপড় মেরে বলেছে, তোর এই ছোট পা টা ভেঙ্গে যাবে। আর একটু বড় হ।

সেই দশ বছর বয়স টা পিছনে চলে গেলো।

সন্ধ্যা হয়ে এলো। কাঞ্চনপুরে যাওয়ার বাস টা এসে দাঁড়ালো। দুই চারজন লোক নামলো। বাসটা ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কন্ডাক্টর, রোককে, বলে থাপ্পড় মারল বাসের দরজায়।

বাসটা থেমে গেলো।

এক মহিলা নেমে এলো। হাতে সুটকেস। সবাই তাকাল ঐ দিকে।

সূর্য ডুবেছে, লাল আভা টা এখনও ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। সেই আলোতে মহিলার মুখ টা দেখতে পেলো মধু।

-বিদিশা তুমি?

-মধু দা। কেমন আছো?

বেঞ্চে বসে থাকা লোকেরা এ ওর মুখের দিকে চাইছে।

-অনেক দিন পরে এলে।

-তা পাঁচ বছর তো হয়ে গেলো।

-দাড়াও এই ভর সন্ধ্যায় চিনে যেতে পারবে না তোমার ভাই এর বাসায়।

এই বলে মধু ডাক দিলো পাশে সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে থাকা ছেলে টাকে।

-এই পলটুঁ, ওকে রিক্সা দিয়ে তোর নারায়ন কাকার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আয়।

আর শোন ভিতরে না ঢোকা পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকবি।

-তুমি একদম পাল্টাও নি মধু দা। বলে রিক্সায় উঠল সে।

আড্ডা টা আবার জমে উঠল। দুই একজন এসে যোগ দেয়, দুই একজন চলে যায়। মধু মাতে না ওদের সাথে। শুধু শোনে। চা র পেয়ালা হাতে হাতে।

মতলব মিয়াঁর ভাণ্ডারে আছে সব রকমের খবর। কাঠের আড়ত আছে মতলব মিয়াঁর। পয়সা আছে। ইটের দোতালা বাড়ি। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়ীতে শুধু সে আর তাঁর গিন্নি। প্রতি সন্ধ্যায় হাতে একটা ছড়ী নিয়ে মধুর দোকানে এসে হাজির হয়। মধু জানে চা র সাথে আর কি কি খাবে মতলব মিয়াঁ। জমির কে ডেকে বলে দেয়।

 জমির ছেলে টা ভালো। কর্মঠ। ছোট্ট এই শহরে সবাই সবাই কে চেনে। জমিরের মা একদিন বলেছিল মধুকে,

বাবা, আমার ছেলে টাকে তোমার এখানে যে কোন কাজে লাগিয়ে দেও। তা না হলে ও বেপথে চলে যাবে। দেখছ তো চারিদিকে, ওর বন্ধুরা নেশায় মত্ত।

 মধু কথা রেখেছিল। কাজ শিখে উঠতেই মাসের শেষে কিছু টাকা হাতে দেয়। জমির মার সাথে ভাগ করে ঐ টাকা।

চা আর খাবারের প্লেট টা জমির এগিয়ে দিলো মতলব মিয়াঁ কে। হাতের ছরী টা পাশে রেখে  চা তে চুমুক দিয়ে খবর দিলো, চেয়ারম্যান সাহেব নাকি আগামী ইলেকশনে দাঁড়াবে না।  

-কেন কেন? উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো শমশের।

-গম্ভীর ভাবে, চারিদিকে চেয়ে, আস্তে আস্তে বলল, টাকা তো কম খায়নি, আর কত। এবার হজ করতে যাওয়ার পালা।

কথা চলতে থাকে।

কাঞ্চনপুরে যাওয়ার শেষ বাসটা এসে দাড়ায় রাত আটটা পনের তে। এর পর রাস্তা খালি হতে থাকে। মধুও দোকানের ঝাপ নামায়।

  হাটতে হাটতে বাসার সামনে এসে দাঁড়াল মধু। জানে মা বসে আছে খাবার সামনে নিয়ে। অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

আজ খেতে মন চাইছে না মধুর। তবুও বসলো মার সাথে।

আজ যে ২৪ শে এপ্রিল। এই রাতে সে  যায় ঐ দুরের শ্মশানে। পনের বছর কোন ব্যতীক্রম হয়নি। অনুর দেওয়া বাঁশিটা নিয়ে এসে বসে নিম গাছ টার নিচে। রাতের অন্ধকারে করুন সুরে বাজে বাঁশিটা।

অনু, ধোপা পাড়ার মেয়ে। কত বার ঐ ধোপা পাড়া দিয়ে পাড় হয়েছে ওরা পাঁচ বন্ধু। মধু বাজাতো বাঁশি।

মাঝে মাঝে ফ্রক পড়া মেয়েটা এসে দাঁড়াত সামনে। রজত ধমক দিতো।

সেই মেয়ে ফ্রক ছেড়ে একদিন শাড়ী ধরল। চুলে দুই বেনী করল।

একদিন একা একা হেটে আসা পথের সামনে এসে দাঁড়াল সে। 

-বাজাও না বাঁশি টা। বলেছিল সুর্মা দিয়ে আঁকা চোখ টা উঠিয়ে।

মধু তাকিয়ে ছিল। আগে দেখেছে, চোখে লাগেনি, আজ চোখ সড়াতে পাড়লও না।

কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল আজ তা মনে নেই।

শুধু বলেছিল, বাসাতে এসো, শোনাব।

এসেছিল সে। বসেছিল মধুর ঘরে। মধু শুনিয়েছিল অনেক গুলো গান।

তারপর কেটে গেলো দিন, কেটে গেলো মাস, কেউ বুঝতে পারলো না, অনু আর মধু এক হয়ে গেছে।

অনু বলেছিল, মধু দা, তোমার কি মনে হয় আমরা কোনদিন এক হতে পারবো।

-কেন হবো না? বলেছিল মধু।

-তা তুমি ভালো করেই জানো। মুখটা ঘুরিয়ে কান্না ভরা গলায় বলেছিল অনু।

– আমার মা,বাবা ওসব কিছুর ধাঁর ধারে না। উচ্চ কণ্ঠে বলেছিল মধু।

তার প্রমান মধু দিতে পারেনি। তার আগেই সব শেষ হয়ে গেলো।

কে জানতো ঐ বিষাক্ত গোক্ষুর সাপ টা বাসা বেধেছিল অনুর ঘরের মাটির নিচে।

দাউ দাউ করে চিতায় আগুন জ্বলল। কাঁদলও অনুর মা, কাঁদলও বাবা।

মধু বাঁশি টা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে ছিল পাঁথরের মূর্তির মত।

রজত চলে গেছে বিদেশে। জগদীশ মারা গেছে আজ বছর দুই হোল। শম্ভু চলে গেছে কোলকাতায়। থাকার মধ্যে আছে শুধু নারায়ন। সেও ব্যাস্ত তার ব্যবসা নিয়ে।

কিছুদিন আগে নারায়ন এসেছিল দোকানে। অনেক দিন পর। চা খেতে খেতে বলেছিল, আয় একদিন আমার বাসায়। আড্ডা দেওয়া যাবে। বিদিশাও তোর কথা বলছিল।

দুপুরে লোকের ভিড় কম। কি ভেবে জমির কে বলে সে বেড়িয়ে পড়লো। নারায়নের বাসার দরজায় টুক টুক করে শব্দ করলো। দরজা খুলে দাঁড়ালো বিদিশা।

-নারায়ন নেই?

-না, দাদা তোঁ বারোবাজার গেছে। তা দাড়িয়ে রইলে কেন, ভিতরে এসো। বিদিশার কণ্ঠে আন্তরিকতার সুর।

-দাদা বলছিলও অনেকদিন তুমি এই পথে পা মাড়াও নি।

হাসলও মধু।

পুরানো দিনের কথা তুলে বিদিশা বলল, মনে পরে মধু দা, তুমি আমাকে অংক শেখাতে আসতে।

-হাসতে হাসতে মধু বলল, মনে না থেকে পারে। তোমার মাথায় তো কিছুই ঢুকতো না।

-তা সে কত আগেকার কথা। কাকা মারা যাওয়াতে তুমি তো আর লেখাপড়া করলে না। কাকার দোকান নিয়ে বসলে। শুনেছি তোমাদের বন্ধুদের মধ্যে তোমার মাথা ছিল সবচেয়ে ভালো।

-সংসারের হাল তো একজন কে ধরতে হবে। ভালই তো আছি। মধু বিদিশার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।

এসো একদিন বাসাতে, কাকীমা কে দেখতে।

-আসব।

কথা শেষে মধু উঠে দাঁড়ালো।

-আবারও আসবে তো মধু দা। বিদিশা খোলা দরাজার পাশে দাড়িয়ে বলেছিল।

মধুর কানে শেষ কথাটা ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকলো।

এক রাতে মধু বাসায় ফিরতেই  মা বলল, বাবা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবি।

-কেন? কি হয়েছে? অস্থির হয়ে উঠল মধু।

-বুকে বড় চাপ লাগছে। বলে হাপাতে লাগল।

তাড়াতাড়ি রিক্সা ডেকে নিয়ে এলো হাসপাতালে।

ডাক্তার চেনা। অনেক পরীক্ষা করে এসে বলল, মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

ওষুধ দিয়ে দিলো। সাবধানে থাকতে বলল।

খবর শুনে সকালেই নারায়ন আর বিদিশা এসে হাজির। বিদিশা রয়ে গেলো সারাদিন মধুর মা কে দেখা শুনা করার জন্য।

-তুমি যাও মধু দা। আমি তোঁ আছি। বলে মধুর মার গায়ে চাদর টা টেনে দিলো।

বিদিশার বিয়ে হয়েছিলো। টেকে নি। চলে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়।

নারায়ন বলেছে ও আর ফিরে যাবে না। এখানেই একটা চাকরি নেবে। কোন স্কুলে।

প্রতিদিন বিদিশা আসে। মধু বেড়িয়ে যায়, রাতে মধু এলে ও ফিরে যায়। মধু নামিয়ে দিয়ে আসে।

মাঝে মাঝে বিদিশা বলে,  এবার তোমার বিয়ে করার দরকার মধু দা। মা কে দেখার জন্য। তোমাকে দেখার জন্য।

মা বলে, মেয়ে টা বড় ভালো । কি যত্নই না আমাকে করছে।

এক রিক্সায় দুজনে বসে যেতে গেলে গায়ে গায়ে ঘষাঘষি তো লাগবেই।

লাগছে। কেউ কিছু বলছে না।

এক রাতে বিদিশা রিক্সা থেকে নামতেই মধু বলল, মা তো এখন একটু ভালো, তোমার আর না আসলেও চলবে।

বিদিশা চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি তো বাসায় থাকো না, আমি জানি উনি কতটুকু ভালো, আর তাছাড়া উনি শুধু তোমার মা না , আমার ও মা। বলে দ্রুত পায়ে চলে গেলো ভিতরে।

পরদিন সকালে মধু বসে রইল, সময় বয়ে যাচ্ছে বিদিশার দেখা নাই।

-কিরে ও আজ আসবে না? মা উৎকণ্ঠ জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল। তা হলে আমার কি হবে।

-আমি তো আছি। আজ আমি যাবনা দোকানে।

-না তুই ওকে নিয়ে আয়। বলতে বলতে মার চোখে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

ঠিক আছে বলে ঘুরে দাড়াতেই দেখল বিদিশা দাড়িয়ে আছে দরজার কাছে।

-মা, তুমি যেওনা আমাকে ছেড়ে, তুমি চলে গেলে আমি বাঁচবো না। বলে কেঁদে উঠলো মা।

– না, আমি কোথাও যাবো না, এই বাসা আমার বাসা। বলে মধুর মার চোখের পানি নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিলো বিদিশা।

মধু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।

Continue Reading

সমস্যা

     সকাল বেলা কম্পিউটারটা খুলে ব্যাংকিং এর কিছু কাজ করতে যেয়ে দেখি আমার একাউন্ট থেকে কে বা কারা টাকা সরিয়ে নিয়েছে। টাকার পরিমাণ অনেক না হলেও আমার জন্য অনেক বেশি।

 আমি ছাই পোষা মানুষ। আমার একাউন্টে হাত দেওয়া কেন?

দৌড়ে গেলাম ব্যাংকে।  

আমার সমস্যা শুনে ম্যানেজার মহাশয় খুব একটা বিচলিত হলেন না। হয়ত এই ধরনের পরিস্থিতি তাদের কে প্রায় পোহাতে হয়। কিন্তু আমার জন্য এটা একটা বিরাট বিষয়।

সব দেখে বলল, আমরা এর ব্যবস্থা নেবো, তবে সময় সাপেক্ষ। এই মুহুর্তে এই একাউন্ট বন্ধ করে নতুন একাউন্ট খুলুন।

নতুন একাউন্ট খুলে এলাম।

এই খানেই তো সমস্যার সমাধান নয়। যে যে পাওনাদাররা আমার এই একাউন্ট থেকে প্রতি মাসে টাকা উঠিয়ে নেয় তাদের কে নতুন একাউন্টের কথা জানাতে হবে। জানাতে হবে সরাসরি আমার কাজের থেকে যে টাকা জমা হয়, তাদেরকে।

ভোগান্তির শেষ নেই।  

এই তো সে দিন। নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। সামনের থেকে তৃতীয় সাড়িতে বসা এক রুপসী মহিলা বার বার ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে চাইছে। দুই দুই বার চোখাচোখি হোল। মহিলা একটু হাসলেন।

 কেন? জানিনা।

অস্বস্তি লাগছিলো। চিনিনা জানি না কেন আমার দিকে তাকানো।

নাটক শেষে বাহিরে আসতেই মহিলা এসে আমার সামনে দাঁড়াল।

চিনতে পারছেন?

বললাম, না, চিনতে তো পারছি না।

আমার নাম — , আমার বড় বোনের সাথে আপনার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। ওর নাম —-।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এই নাম আমি কস্মিনকালে ও শুনিনি।

বললাম, আপনি বোধ হয় অন্য কারো সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন।

না তা কেনও হবে? ওই যে ওই পাড়াটা। নাম হচ্ছে— ।  

ওই পাড়ার কাছে দিয়েও কোনদিন গেছি বলে মনে পড়ছে না।  

-তাহলে কি আমি ভুল করলাম। বলে একটু সময় নিয়ে আবার বললেন, আমার বোনটা আজ থাকলে সে হয়তো বলতে পারতো।

-উনি আসেন নি? জিজ্ঞাসা করলাম।

-না সে বেচে নেই।

-অত্যন্ত দুঃখিত। তাহলে তো সমস্যার সমাধান হোল না। বলে চারিদিকে তাকালাম। 

-না তা হোল না। তবে কথা আমরা চালিয়ে যেতে পারি এক কাপ চা খেতে খেতে। আমার দিকে তাকিয়ে ঠোটের কোনে হাসি এনে বললেন।  

-বললাম, এক জায়গায় যেতে হবে। তাড়া আছে। চলি।

কোন রকমে পালিয়ে বাচলাম।

এইতো, দুইদিন আগে এক বন্ধু ফোন করে বলল, মস্কো যাবি?

একটু সময় নিলো ওর কথা টা বুঝতে।

ভোর বেলা। তখনো আমার চা র পেয়ালা শেষ হয়নি।

-কি রে চুপ করে রইলি যে।

-না, তোর কথা টা ঠিক বুঝতে পারলাম না। বলে চা র পেয়ালায় শেষ চুমুক টা দিলাম।

-মস্কো, মস্কো যাবি?

-তোর সকাল টা কি চা দিয়ে না অন্য কোন তরল পদার্থ দিয়ে শুরু হয়েছে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম।

-না, সত্যি বলছি, ভাল একটা ডিল আছে। গেট ১ ট্রাভেল থেকে দিয়েছে।

রাজি হলাম।

ছেলে কে বলতেই সে হৈ হৈ করে উঠল।

মস্কো, মাথা খারাপ। ওই খানে গেলেই তোমার পিছনে চর লেগে যাবে। আর ফিরে আসতে হবে না। অন্য কোন দেশে যাও –আমার আপত্তি নাই।

-চর? কেন, আমার পিছনে চর লাগবে কেন? আমি কি এখান কার কেউকেটা কিছু। অবাক হলাম ওর কথা শুনে।

না, যাওয়া হলনা।

যত সব জুট ঝামেলা।

মা মরা ছেলেটার কথা ভেবে ওদিকে আর পা বাড়ালাম না।

সমস্যার সীমা নেই।

এইতো গতকাল। গাড়ীটা নিয়ে বেড় হয়েছি। যাবো এক বন্ধুর বাসায়। থাকে তিরিশ মাইল দুরে। বাহিরে বৃষ্টি।

ইচ্ছা ছিলনা যাওয়ার। কিন্তু বন্ধু আমার নাছোড় বান্ধা। আরও কয়েক জন আসবে। 

বলেছিল, প্রণতি আসবে।

প্রণতি ,ঐ নামটা আমাকে টেনে নিয়ে গেলো। এক সময় ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল।   

আমার দশ বছরের পুরানো গাড়ীটার সিডি কম্পারটমেন্টে রবীন্দ্র সংগীতের একটা সিডি চালিয়ে দিলাম। গানের সাথে গুনগুণ করে গাইছি।

হঠাৎ দেখি পিছনে ফ্লাশিং লাইট।

ওহ, নো। পুলিশের গাড়ী। আমাকে সাইড করতে বলছে।

অগত্যা পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম।

বৃষ্টি মাথায় পুলিশটা এসে দাঁড়াল আমার গাড়ীর জানালার কাছে।

জানালা খুলে জিজ্ঞাসা করলাম আমি কি অন্যায় করেছি।

গাড়ী যে খুব একটা জোড়ে চালিয়েছি তাও নয়।

তাহলে?

বাহিরে বৃষ্টি, অয়াইপার চলছে, কিন্তু আমার গাড়ীর বাতি জ্বলছে না। এই আমার অপরাধ। বলল, পুলিশটা।  

মনে পড়ল আইন করেছে অয়াইপার চললে বাতি জ্বলতে হবে। আমার পুরান গাড়ীতে অটোম্যাটিক এসব হয় না।

মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম অপরাধ হয়ে গেছে।

শুনল না। টিকিট টা ধরিয়ে দিলো।

মাটি হয়ে গেলো প্রণতির সাথে দেখার আগ্রহ।  রবীন্দ্র সংগীত বন্ধ করে দিলাম।

মেজাজ খিঁচিয়ে গেলো।

মেজাজ আরও খিঁচিয়ে গেলো প্রণতি কে দেখে।

 হাল্কা লিকলিকে বাহু, মোটা গ্লাসের চশমা চোখে, পড়নের শাড়ী টা যেমন তেমন করে পরা। সিঁথিতে সিঁদুর নেই।

আমার দেখা সেই প্রণতি কোথায়?

 যার বুক সমুদ্রের ঢেউ এর মতো উঠা নামা করত, আজ তা নদীর মতোই শান্ত। যার চোখের দৃষ্টি অর্জুনের ছোড়া তীরের মতো তীক্ষ্ণ। বুকে এসে আঘাত হানত। আজ তা হারিয়ে গেছে মোটা চশমার অন্তরালে।

দুহ ছাই! বলে চৌকাঠের দিকে পা বাড়াতেই ডাক শুনলাম।

পিছন ফিরে দেখি শাহিন।

চলে যাচ্ছিস?

হাঁ।

কারন?

কোন কিছুই মনের মতো হচ্ছে না।

-নদীর জল অনেক গড়িয়ে গেছে বন্ধু। এখন মনের মতো চাইলে তো মনের মতো হবে না।  বলে হাসল শাহিন।

-হেঁয়ালি রাখ, কি বলবি, বল।

-হাকিমের কথা মনে আছে?

-আছে।

-যোগাযোগ আছে?

-না।

-সে সব সমস্যার সমাধান করতে চলেছে। বলে শাহিন আমার দিকে তাকিয়ে রইল রিঅ্যাকশন দেখার জন্য।

-আবারও হেঁয়ালি?  গলাটা ঝেড়ে বললাম ওকে। আমার পাকস্থলীতে কে যেনও সুড়সুড়ি দিচ্ছে মনে হোল।

-পেনক্রীয়াটিক ক্যান্সার। শেষের পথে। চিকিৎসা করাবে না বলেছে। নরম সুরে বলল শাহিন।

-কি বলছিস?  সুড়সুড়ি টা এখন পাকস্থলী থেকে হৃদপিন্ডে এসে পৌছেছে।

-সে বলেছে, চিকিৎসা করিয়ে কি লাভ? একমাসের পরিবর্তে না হয় দুই মাস বাজবো।  দুমাস বাচতে যেয়ে ঐ বিষাক্ত ঔষধের যে প্রতিক্রিয়া তা আমার সইবে না। শাহিনের গলার স্বরে কান্নার আভাস।

-যাবি দেখতে?

শাহিনের দিকে চেয়ে নিজের সমস্যা আর সমস্যা বলে মনে হোল না।   

বললাম, যাবো।

Continue Reading