বন্ধন

 আমাকে নমস্কার করে সে বলল, আসি! তোমার এই মেয়েকে ভুলনা। সাবধানে থেকো। যদি কোন দিন আসো আমাদের দেশে, দেখা করতে ভুলো না।  এই বলে চোখ মুছতে মুছতে ধীরে ধীরে পা ফেলে গাড়ীতে যেয়ে উঠলো।

 চরন আর আঁধিরা জড়িয়ে ধরল আমাকে, বলল,  ঠিক আসবে তো, নানা ভাই?

চোখ টা মুছে ওদেরকে জড়িয়ে ধরলাম। পকেট থেকে ওদের সাথে তোলা একটা ছবি বের করে চরণের হাতে দিয়ে  বললাম, এটা হারিয়ে ও না। এটা দেখলে মনে পড়বে এই নানা ভাইয়ের কথা। চন্দ্রেশ কাছে এসে বলল,অনেক স্মৃতি রইল তোমার সাথে, ভুলব না কোনদিন। দেখলাম, ওর চোখ টা ছলছল করছে।

গাড়ীটা চলতে আরম্ভ করল। আমি সজল নয়নে হাত নাড়িয়ে ওদের কে বিদায় দিলাম।

মন্ত্র পাঠ করে শুরু হতো ওদের সকাল। আমার নিচের তালার বাসিন্দা । প্রথমে যে দিন এসে উঠেছিলাম এই বাসাতে, জিনিষ পত্র ঘুচানো নিয়ে ব্যাস্ত, মধ্যের দরজায় টোকা পড়লো। ঐ দরজা দিয়ে আমার তালায় আসা যায়। বলা যায় দুই তালার সংযোগ পথ।

-আসতে পারি? বলে আস্তে আস্তে সে এসে দাঁড়াল আমার সিঁড়ির কাছে।

লম্বায় ছয় ফুট হবে, নাম বলল চন্দ্রেশ।

-এসো। তোমার কথা শুনেছি বাড়ীর মালিকের কাছে। আমি টিভি রাখার জায়গা টা আমার ছেলেকে দেখিয়ে দিতে দিতে বললাম। 

-ইন্টারনেটের জন্য অর্ডার করবে শুনলাম।

-হ্যাঁ, কেন? জিজ্ঞাসা করলাম নিচে পড়ে থাকা একটা ফটো উঠাতে উঠাতে।

-দরকার কি পয়সা খরচ করার। আমার ইন্টারনেট আছে ওটার থেকে আমি তোমাকে লাইন দিয়ে দেবো। বলে টিভি রাখার জায়গাটা দেখল।

-নাহ, এখানে কোন লাইন নেই দেখছি। তোমার  বেডরুম টা দেখতে পারি। বলে সে আমার শোবার ঘরে এলো। এইতো, এখানে লাইন আছে, রাওটার টা এখানে বসিয়ে দেবো।

-কিন্তু, বলে ওর দিকে তাকালাম। একটু অস্বস্তি লাগছিলো আমার।

ও আমার কিন্তুর কোন পাত্তা না দিয়ে পুরানো রাওটার টা ঘরের মাঝে বেড়িয়ে আসা তাঁরটার সাথে যোগ করে দিয়ে নিচে চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পড়ে ফিরে এসে আমার কম্পিউটার টা নিয়ে বসলো।

দেখি ওয়াইফাই এসে গেছে।

-কোন কিছু লাগলে আমাকে অথবা অর্চনাকে ডাক দিও। বলে সে নিচে চলে গেলো।

বিছানা টা গোছাতে গোছাতে আমার মেয়ে বলল, তোমার আর ভাবনা কি আব্বু, নিচেই তো তোমার ছেলে মেয়েরা রয়েছে।

ওর কথাটা সেদিন চারিদিকে হয়ত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল, তা নাহলে আমি ওদের সাথে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়লাম কেনও।

দিন যেয়ে মাস এলো, আমি প্রতিদিন সকালে শুনি টুংটুং ঘণ্টার শব্দ। শুনি মন্ত্র পাঠ। শুনি চরন আর আঁধিরা গাইছে সাঁ রে গাঁ মা। মাঝে মধ্যে চন্দ্রেশ আসে আমার খোঁজ নিতে।

চন্দ্রেশের বাড়ি চেন্নাই। বাবার ব্যাবসা আছে। দুই ভাই এক বোন। চন্দ্রেশ বড়। এখানে এসেছে চার বছেরের কন্ট্রাক্টে। কয়েকটা হাসপাতালের কম্পিউটার গুলো দেখাশুনা করে।  মুখে হাসি লেগে আছে।

আমি যেমন বকলম কম্পিউটারে, আমার সুবিধা হয়েছে। একটু অসুবিধা হলেই ওকে টেক্সট পাঠাই অথবা কল করি।

একদিন বলেছিলাম, অনেক তো করছ আমার জন্য, ঋণ তো বেড়েই চলেছে।

হেসে বলেছিল, এখানে তো আমার কেউ নেই, প্রতিদিন কাজে যাই, মাঝে মধ্যে আসতে দেরী হয়। ওরা থাকে একলা। ভয় হয়। তুমি উপরে আছো, নিচে তোমার মেয়ে আছে, ওদের দিকে খেয়াল রেখো।

অজান্তে জড়িয়ে গেলাম ওদের সাথে।

একদিন নিচের দরজায় ঠুক ঠুক শব্দ। ভাবলাম শুনতে ভুল করেছি। আবারও শব্দ। No God but God বই টা পড়ছিলাম। উঠে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে একটু নেমে আসতে দেখতে পেলাম অর্চনা দরজাটা খুলে দাড়িয়ে আছে। হাতে বড় কাঁসার থালা।

-আসব উপরে? জিজ্ঞাসা করল আমাকে।

– অবশ্যই।

থালাটা টেবিলের উপর রেখে বলল, এইমাত্র বানিয়েছি।

দেখলাম থালাতে কয়েকটা দোসা, পাশে সাম্বার। মঝে রাখা বাটীটা দেখিয়ে বললাম, এটা কি?

-ক্ষীর। নারিকেল দেওয়া। গরম থাকতে থাকতে খেয়ে নেও। বলে চলে যেতে যেয়ে ফিরে এলো।

বলল, জানো, তোমাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে হয়।

বললাম,  তাই, একদিন শুনব তোমার বাবা মার কথা।

সেই একদিন এলো বেশ কিছু দিন পরে।

সকালে নাস্তা শেষে কফি নিয়ে বসেছি। নিচে বাচ্চাদের হাসি কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি, মাঝে মাঝে ওদের মার বকুনি। রান্নার গন্ধ উপরে আসছে।

বাহিরে বাতাস। তবুও দুটো জানালা খুলে দিলাম। ক্রস ভেন্টীলেসন হলে তরকারীর গন্ধটা আটকিয়ে থাকবেনা ঘরের মাঝে।  

কফিটা হাতে নিয়ে বেডরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ওখানে সব জামা কাপড় গুলো সাজানো।

নিচে হৈ হুল্লা বন্ধ হয়ে গেছে। ওই হৈ হুল্লা টা যেন আমার মনের একটা খোরাক। ওটা বন্ধ হয়ে গেলে চারিদিক নীরব হয়ে যায়। ভাললাগে না। অর্চনার উচ্চ গলায় শাসন, আবার কখন কখন হাসির ফোয়ারা নয়ত তিনজন একসাথে গায় গান।

 এই সবই যেনও আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে।

 আমি এক ঘেয়ে CNN র নিউজ পালটিয়ে বাংলা চেনেল দিলাম।  

-আসতে পারি?

শুনে বুঝলাম অর্চনার গলা।

-এসো।

একহাতে কয়েকটা পুরি, অন্য হাতে ছোলার ডাল।

-নাস্তা করেছ?

-সে তো কখন শেষ। বলে ওর দিকে তাকালাম।

-ঠাণ্ডা হলে খেতে ভালো লাগবে না, বলে টেবিলের উপর রাখা ডিসপোজেবল প্লেটে করে পুরি আর ডাল নিয়ে এলো।

-কি দরকার—

বলেছি না, তোমাকে দেখলে আমার বাবার কথা মনে হয়। বলে একটা চেয়ার টেনে এনে পাশে বসল।

-বাবা, মা আছে? জিজ্ঞাসা করলাম।

-মা আছে, বাবা নেই। বলে অন্য দিকে মুখটা ঘুরিয়ে রাখল কিছুক্ষণ।

বুঝলাম চোখের পানিকে সামাল দিচ্ছে।      

জানো, আমিই বাবা,মার একমাত্র সন্তান। বাবা ছিল আমার বন্ধুর মত। মা র কাছে অনেক বকুনি শুনেছি, দুই একটা চড় ছাপ্পড় যে খায়নি তা নয়।

মুখ ভাঁড় দেখলে বাবা ডাক দিয়ে বলতো, অরচু মা মনি, মা বুঝি বকেছে? চল বাজার থেকে ঘুরে আসি।  

পড়াশুনায় ওতটা ভালো ছিলাম না। বাবার কথাবার্তা শুনে মনে হতো আমি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল।

মা বলত, এই মেয়ে কে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে বিদায় না করলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।

বাবা হাসত। মা কে বলতো, তুমি যাই বলো , আমি শেষ বয়সে আমার মায়ের কাছে যেয়ে থাকবো।  

 অনেকে বলে, মেয়েরা নাকি বাবার বেশি প্রিয় হয়, আর বাবারাও নাকি মেয়েদের কাছ থেকেই বেশি আদর পায়। কথাটায় যুক্তি হয়তো নেই, কিন্তু খুব একটা ভুলও বোধহয় নেই। এমন মেয়ে খুব কমই আছে, বাবার জন্য যার মনে বিশেষ দুর্বলতা নেই। বাবা যেন তার এক ছোট্ট ছেলে। যাকে সে ভালোবাসে, আবার শাসনও করে। যত্ন নেয়, আবার বকুনিও দেয়। আর বাবারা? মেয়ের জন্য জান-জীবন। মেয়ের সুখই যেন বাবার সুখ।

কোথা থেকে যে বাবার জন্য এত মায়া, এত ভালোবাসা, এত টান তৈরি হয়েছিল বুঝতে পারি না। শুধু বুঝি বাবা আমার পরম প্রিয় বন্ধু। আমার অনুপ্রেরণা। আমার আত্মবিশ্বাস।

বাবা মানে মাথার ওপর শীতল কোমল ছায়া। বাবা মানে ডালপালা মেলা এক বিশাল বটবৃক্ষ।

এই বলে সে একটু থামল। মনে হোল কি যেন বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না।

আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

চারিদিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা গলায় বলল,  

 জানো, সেই বাবা একদিন কাজ থেকে ফেরার পথে আর ফিরে এলো না। বাসের ধাক্কায় গুড়িয়ে গেলো তার সব স্বপ্ন।

আমি শুনছিলাম ওর কথা।

-কত বছর তখন তুমি? জিজ্ঞাসা করলাম।  

-তেরো বছর।

কয়েক মিনিট কেটে গেলো আমরা দুজনেই চুপচাপ।

হঠাৎ বলল, জানো, এই বাসায় আমি থাকতে চাইনি। চলে যেতে চেয়েছিলাম।

চন্দ্রেশ বলেছিল, বাড়ীটা রাস্তার উপরে নয়, ভিতরে। কত বড় ড্রাইভ ওয়ে। চরন, আঁধিরা নিশ্চিন্তে খেলা করতে পারবে। তুমিও চিন্তা মুক্ত খাকবে। আমিতো বাইরে বাইরে থাকি।

আমি থেকে গেলাম। এটাই ছিল ভগবানের ইচ্ছা।

তুমি এলে। চন্দ্রেশের সাথে প্রথম যেদিন তোমার তালায় এসেছিলাম, তোমাকে দেখেই আমার বাবার কথা মনে হোল। মনে হলও  বাবার সেই কথা গুলো,” আমি শেষ বয়সে আমার মায়ের কাছে যেয়ে থাকবো”।

তোমার মাঝে আমি বাবা কে খুজে পেলাম।

বলে সে  কেঁদে উঠল।

ন্যপকীন টা এগিয়ে দিলাম। মাথায় হাত দিয়ে বললাম, তুমি তো আমার মেয়েই।

পর কখনো আপন হয় না। কথাটা আমার ডিকশনারির থেকে উঠিয়ে দিলাম।

 আমার পায়ের আওয়াজ না পেলে সে উপরে আসতো। দেখত আমি ঠিক আছি কিনা। ভালো মন্দ কিছু বানালেই নিয়ে আসতো।  

সময় বয়ে গেলো। চন্দ্রেশের চার বছরের কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে এলো। এবার ওদের ফিরে যাবার পালা।

ওরা এসেছিল আমার কাছে। বসেছিল অনেকক্ষণ। কথা বলার চেয়ে চোখের পানিই ঝরল বেশি। চরন আর আঁধিরা বসল এসে আমার পাশে।

আঁধিরা ওর হাতে আঁকা একটা ছবি আমার হাতে দিয়ে বলল, তুমি একা থাকতে পারবে তো, নানা ভাই।  

সেই মুহূর্তে আমার চোখের পানি বাঁধ মানল না।

গাড়ীটা আস্তে আস্তে ড্রাইভওয়ে পেড়িয়ে রাস্তায় পড়ল। আমি এগিয়ে গেলাম রাস্তার দিকে। গাড়ীটা বাঁক নিলো।  

ওরা চলে গেলো।

Continue Reading

‘নিবিছে দেউটি’

 চলে গেছে কত প্রিয়জন

শমিতের আজ বারবার মনে হচ্ছে মাইকেল মধুসুদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের সেই লাইন- ‘এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি’
“ জম্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে” মাইকেল মধুসুদন দত্তের এ লাইনটির মতোই জীবন।

উনিশ শো পঞ্চাশ থেকে দুই হাজার বিশ সাল। সত্বর টা বছর। পিছনে চলে গেলো।

শমিত তার লিভিং রুমে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল বাহিরের দিকে।

 চব্বিশ বছর বয়সে এসে ছিল এই দেশে।

 সময় টা বড় দ্রুত চলে গেলো। চোখের পলকে।

সেই মুহূর্তে বাহিরে হলুদ হয়ে যাওয়া গাছের পাতা গুলো দুলছিল বাতাসে। যে কোনো মুহূর্তে ঝরে পড়বে।

 দুরের আকাশটা  লাল।

 সূর্য ডুবছে।

হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা গুলোর দিকে তাকিয়ে শমিত ভাবছিল এই পাতার মত সেও ঝরে পড়বে একদিন।

অনেকেই তো ঝরে পড়েছে। কোথায় আজ তামান্না ভাবী, কোথায় আজ শান্তি ভাবী, নেই কাছে লুতফুল, নেই আজ হাকিম।

প্রিয় বন্ধু মইন গিয়েছিল দেশে, ফেরে নি সেখান থেকে।

নিজের প্রিয় সঙ্গীটিই তো ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো।

ছিল ব্যাচেলার। ধীরে ধীরে সবাই নিয়ে এলো সঙ্গিনী। বাসা নিলো কাছাকাছি। দেখা হতো প্রতি সপ্তাহে।

ধুমধাম করে হতো বিবাহ বার্ষিকী।

শমিতের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে এসেছিল অনেকে। বন্ধু বান্ধব ছাড়া এসেছিল বড় ভাইয়েরা। রানু ভাবী অনেক কিছু  করে দিয়েছিল।

এক টুকরো জায়গায় কারো বসতে অসুবিধা হয়নি।

তামান্না ভাবী শমিতের বৌ কে বলেছিল, রোস্ট টা আমি বানিয়ে দেবো।  

না করেনি, সামন্তী।

রানু ভাবী করেছিল খাসীর বিরয়ানী। 

কি আনন্দ না হয়েছিল ওই দিন। সেই সময় বেশির ভাগ বন্ধুরাই ছিল ব্যাচেলার।

হাতে হাতে সবাই গুছিয়ে দিয়েছিল সব কিছু।

এঁকে এঁকে এলো সবার অর্ধাঙ্গিনী। আজ এবাড়ি, কাল ও বাড়ি তে আড্ডা লেগেই থাক তো। সবাই মিলে চলে যেতো দুরে।

বিবাহ বার্ষিকীর পালা শেষ করে এলো সবার কোল জুড়ে ছোট্ট শিশু।

আরম্ভ হোল জন্মদিন করা।

বাচ্চারা আনন্দে ছুটাছুটি করতো। মহা আনন্দ তাদের।

সেই ছোট ছোট শিশু গুলো এঁকে এঁকে বড় হয়ে গেলো। সবাই ব্যাস্ত ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে। ওদের কে মানুষ করে দিয়ে যেতে হবে।

দুই এক বন্ধু বাড়ি কিনে দুরে চলে গেলো। তাই বলে যে আসা যাওয়া বন্ধ হোল তা নয়। বরং আরও মজা হোল। রাত টা কাটাতও সবাই ওই বাড়ীতে। বন্ধুরা মিলে তাস খেলাতো। অল্প পয়সা দিয়ে।

ভাবীরা কি নিয়ে গল্প করতো কে জানে।

শমিত জিজ্ঞাসা করেছিল সামন্তী কে। তোমরা কি নিয়ে গল্প কর।

হেসে বলেছিল, তোমাকে বলব কেনও? ওসব মেয়েলি কথা।  

কোথায় গেলো সেই দিনগুলো।

শমিতের মনে পড়লো সেই দিনটার কথা। কাজ থেকে এলো। সামন্তী টেবিলে খাবার দিলো।   

শমিতের মনে হোল সামন্তী অন্যদিনের মতো আজ যেনও কথা কম বলছে।

ভাত টা মুখে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল

-কি ব্যাপার? তোমার শরীর ভালো তো?

-আমি ভালো। তুমি কি কিছু শুনেছ?

-কি শুনব? বলে আর একবার হাতটা মুখের কাছে নিতে যেয়ে নামিয়ে রাখল। কোথায় যেনও একটা অশুভ সংকেত।

-পলি ভাবী কল করেছিল। বলে থামল সামন্তী।

-কি বলেছে? একটু তাড়াতাড়ি বলও। ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠল শমিত।

-পলি ভাবীর ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে।

-কি বলছ? উনি তো প্রেগন্যান্ট? বলে পানির গ্লাসটা হাতে নিলো শমিত।

-হ্যাঁ, চেক আপ করতে যেয়ে ধরা পড়েছে।

-তাহলে কি হবে? তরুন তো কিছু বললও না আমাকে। গতকালই তো ওর সাথে কথা হয়েছিল। বলে থামল শমিত।

-ভাবীই কল করে বললও। বলল, এই মুহূর্তে ওরা কিছু করবে না। বাচ্চা হওয়ার পরে যা করার করবে। জানো, ভাবী খুব ভেঙ্গে পড়েছে। তুমি একবার তরুন ভাই কে কল করো।

শমিত কল করেছিল। কি বলে সান্ত্বনা দেবে ? তবুও বলেছিল অনেক ভালো ভালো কথা। শমিত জানে এসব কথা শুধু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। তরুন কে বলেছিল যেকোন দরকারে আমাকে কল করিস।

তরুন কান্না ভিজানো গলায় বলেছিল, ঠিক আছে।

শমিত উঠে জানালাটা বন্ধ করে দিলো। ঝাপটা বাতাস ঘরটা ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। ঘরের আলো টা জ্বালিয়ে দিলো।

আস্তে আস্তে এলো ছোট্ট ঘরটাতে। যেখানে রয়েছে শমিতের সব এ্যালবাম গুলো।

 ফটো উঠানো ছিল শমিতের হবি। সব বন্ধু, ভাবীরা তা জানতো।

কোথাও গেলে তার উপরেই ভার পড়তো ছবি উঠানোর।

একটা এ্যালবাম টেনে বের করলো। এসে বসলো সোফাতে। এক একটা ছবি যেনও জীবন্ত মনে হলে। চল্লিশ বছর আগে তোলা। আছে পিকনিকের ছবি। আছে বাচ্চা দের জন্মদিনের।

এই তো এই ছবিটা, ওয়াশিংটন ডিসিতে বেড়াতে গিয়েছিল। তরুন তখন ওখানে থাকে। ওদের বাসাতে উঠেছিল।

বিকেলে এসে বসেছিল ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালের নিচে। পলি ভাবী বসে আছে সামন্তীর পাশে।

মনের জোড় ছিল পলি ভাবীর। প্রত্যেক টা পার্টিতে আসতো তা সে যতো অসুস্থই থাক না কেনও। পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে শেষ এসেছিল থ্যাংকস গিভিং পার্টিতে।

পলি ভাবী চলে যাওয়ার কয়েক দিন পরে এলো আরও এক মহা দুঃসংবাদ। শমিত ছিল কাজে। ব্যাস্তই ছিল সেদিন। সানার কলটা প্রথমে ধরবে না ঠিক করেছিল। কি মনে করে ধরলও।

ধরেই বলল, আমি একটু ব্যাস্ত আছি, তরে পরে কল করছি।

-শোন, এক সেকেন্ড। লুতফুল গাড়ী এক্সিডেন্টে মারা গেছে।

-কি বলছিস? ফোনটা আর রাখা হোল না শমিতের। গতকাল রাতে সে আমাকে কল করেছিল। বলল, শমিত। তোকে আমি দুই মিনিট পরে কল করছি। বলে হাতের কাজ গুলো তাড়াতাড়ি সাড়ার চেষ্টা করল শমিত।  

কাজ শেষে সেদিন আর বাসাতে যাওয়া হয়নি শমিতের। সামন্তীকে বলেছিল লুতফুলের বাসাতে আসতে।

শমিত এসে দেখল অনেক বন্ধুরা এসে গেছে। সামন্তী আর অন্যান্য ভাবীরা এক পাশে বসা। সবাই কাঁদছে। কাঁদছে অনীকা ভাবী। কে তাকে সান্ত্বনা দেবে। কি সান্ত্বনাই বা দেবে তাকে। বাচ্চা গুলো বসে আছে মাথা নিচু করে। বড় মেয়েটা শমিতের মেয়ের সমান। ওরা গলায় গলায় বন্ধু। ছোট বেলার থেকে একসাথে বড় হয়েছে।

চলে গেলো।  অকালেই এই ধরাধাম ত্যাগ করল সে।

প্রিয় শান্তি আপাও যে চলে যাবে তা কি সামন্তী ভাবতে পেরেছিল? ইউনিভারসিটিতে থাকা কালিন একই হলে থাকতো। সেই সুবাদে আপা বলে ডাকতো। শমিতের বন্ধুর সাথে বিয়ে হয়েছিল। এখানে এসেও একই বিল্ডিংএ ছিল অনেক দিন। কাজে যেতো একসাথে। মাঝে মাঝে এটা ওটা রান্না করে দিয়ে যেতো। ঘন্টার ওর ঘণ্টা ওদের ঘরে নচেৎ শমিতেদের ঘরে আড্ডা চলতো।

সেও একদিন এসে সামন্তীকে বলল, আমার বোধহয় সময় হলো যাওয়ার। রাজরোগ ধরা পড়েছে।

সেদিন কি কান্নাই না কেঁদেছিল সামন্তী। অনেক যুদ্ধ করেছিল সামন্তীর শান্তি আপা সেই রাজরোগের সাথে। কিন্তু পারলো  না। অবশেষে পরাজয় মেনে নিতে হোল।

শমিতের এ্যালবামের পাতায় পাতায় অনেক ছবি।

বহুকাল আগের। যার যার বৌ এর পিছনে সে সে দাঁড়ানো।  

শমিত দেখল তাকিয়ে।  এর মাঝে অনেকেই আজ আর নেই। চলে গেছে কোন না কোন ভাবে।

 সে নিজে ও আজ একা।

দেখা হয় মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সাথে। অনেকে বাসা কিনে চলে গেছে দুরে।  আগের মত আর যাওয়া আসা নেই।

সবার ছেলে মেয়েরা বিয়ে শাদী করে যার যার মত আছে। কেউ কাছে কেউ বা দুরে। এটাই তো নিয়ম।

একদিন শমিত বলেছিল মুস্তাক কে, দুরে গেলি কেনও? আজ যদি কাছে থাক তিস তাহলে এই অবসর প্রাপ্ত জীবন টাতে কিছুটা নতুন রসের সঞ্চার করা যেতো।

মুস্তাক হেসে বলেছিল, তোর সাথে আমি একমত। তখন বুঝিনি। আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি।

শমিত উঠে গেলো ঔষধের ডিব্বা টা আনার জন্য। একটা নয় কয়েকটা ঔষধ খেতে হয়। শরীর টা এখন ও টিকে রয়েছে এই ডিব্বার উপরে। বন্ধুদের সাথে কথা হলে ঐ একই কথা, কে কোন ঔষধ খাচ্ছে। কার প্রেসার কততে।

A1C বেড়েছে না কমেছে। মিষ্টি খাওয়া কি ডাক্তার নিষেধ করেছে না করেনি। আরও কত কি?

উঠে দাঁড়ালো শমিত। খুজে বের করলো টিভির রিমোট টা।  

অন করলো।

টিভির পর্দায় ভেসে উঠলো কিংবদন্তি ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনার ছবি।

 মারা গেছে। 

Continue Reading

টুনি পাগলি

“এই টুনি তুই মেয়ে পেলি কনে”, চিৎকার করে বলতাম আর ওর পিছনে পিছনে হাঁটতাম।

আমার মতো তিন চার জন, বয়স ছয়, সাত। টুনি ওর মেয়েটাকে কোলে করে ফিরে চাইত আমাদের দিকে। চোখে আগুনের হল্কা। মাঝে মাঝে বলত,

-যা, তোদের মা কে যেয়ে জিজ্ঞাসা কর। 

কেন বলতাম, এর মানেই বা কি কিছুই বুঝতাম না। সবাই বলতো, আমরাও বলতাম।

বয়স টা যখন চোদ্দর কোঠায় পৌছাল তখন কথার মানে টা বুঝতে পারলাম, আমরা তখন আর ওর পিছনে যাই না। সেই জায়গায় এসেছে অন্য আরেক দল।

দেখতে দেখতে অনেক গুলো বছর পেড়িয়ে গেলো। আসা যাওয়ার পথে টুনি কে দেখি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমি লজ্জায় মুখ নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। ভাবি ওকি আমার সেই ছয় সাত বছরের চেহারা টা মনে রেখেছে?

 ছোট্ট শহর, সবাই তো সবাই কে চেনে। লজ্জাটা আমার সেই জন্য।  মেয়েটা এখন আর কোলে নেই, হাত ধরে হাটে।  

তারপর আমি এই শহর ছেড়ে চলে গেছি।

বহু দূরে।

অনেক দিন পর ফিরে এলাম দেশে। এলাম আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শহরে। উঠলাম আমার এক বন্ধুর বাসায়। পিছনে ফেলে আসা দিন গুলো মনের পর্দাতে ভেসে উঠল। আলাপে আলাপে প্রসঙ্গ এলো টুনি পাগলির কথা।

-কোথায় সে? জিজ্ঞাসা করলাম।

-চলে গেছে এই ধরাধাম থেকে। বলল আমার বন্ধুটি।  

-ওর সেই মেয়েটা?

-আছে, এই তো দুই মাইল দূরে, থাকে সাকোর পাড় গ্রামে । বলল বন্ধু টি।

-যাওয়া যায় সেখানে? হঠাৎ প্রশ্ন করলাম আমি।

-যাওয়া যায়। তবে ওর বাসা আমি চিনি না। খোঁজ নিয়ে বের করতে হবে।

-ওঠ চল, আমি এখনি যাবো। বলে তাকালাম ওর দিকে।  

 কেনও জানি টুনির চেহারা টা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। রাগান্বিত নয়। অসম্মানে কুচকিয়ে যাওয়া চেহারা। যার জন্য দায়ি আমরা।

 ছোট বেলার অনেক স্মৃতি ভোলা যায়না। ফিরে ফিরে আসে। হয়ত আমার অবচেতন মনে ফেলে আসা টুনির চেহারা টা দাগ কেটে ছিল। ওর প্রসঙ্গ উঠতেই আমার মনে হোল ওর উপর যে অন্যায় আমরা করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত করতে যাবো আজ তার মেয়ের কাছে, বলব, আমি দুঃখিত।     

রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম আমরা দুজন। সাকোর পাড় গ্রামের ভিতরে রিক্সা যেতে পারলো না।

 পায়ে চলা পথ। নেমে পড়লাম।

 বন্ধুটি অনেক খোঁজ নিয়ে বের করলো বাসাটা। উঠানে দাড়িয়ে জোরে বলল, কেউ আছে বাসাতে?

 ওর গলার স্বর সব সময় উচুতে খেলা করে।

বেড়িয়ে এলো পাতলা গড়নের একটি মেয়ে। বয়স বোঝা যায় না। এক পেচে পড়া শাড়ী।

কাকে চাই? জিজ্ঞাসা তার।

তুমি কি টুনির মেয়ে? বন্ধুটির প্রশ্ন

-হাঁ। বলে অবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে।

এবার আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, তোমার মাকে আমি চিনতাম। ছোট বেলায় খুবই খারাপ ব্যবহার করেছি তার সাথে। তাকে তো পেলাম না। বলতে পারো ক্ষমা চাইতেই এসেছিলাম। 

সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

অবশেষে বলল, শুধু আপনি নয়, আমার মা কে অনেকেই খুব খারাপ কথা বলেছে রাস্তা ঘাটে। কোন কিছু না জেনে। আমি তখন ছোট বুঝতে পারিনি কি বলছে ওরা, আপনারা। 

কেন? বলতে পারেন, কেনও এতো খারাপ কথা বলতেন?

ওর প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। শুধু এই টুকুই মনে হোল , ওর মার কাছে আমি অপরাধী রয়ে গেলাম সাড়া জীবনের জন্য।

বললাম, তোমার মা থাকলে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম, তা যখন হলনা পারলে তুমি ক্ষমা কর।

সে ঘরের ভিতর চলে গেলো, ফিরে এলো একটা মাদুর নিয়ে। পেতে দিয়ে বলল, বসেন, সব বলব আজ আপনাদের কে।

মা আমাকে সব বলে গেছে। সব ঘটনা। কেন মা কে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যেতে হয়ে ছিল।

শোনেন।

বলো। বলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

নানা  ছিল গাদনপুরের চেয়ারম্যান। প্রতিপত্তি ছিল। লোকে যেমন সামনে সম্মান করতো, পিছনে তেমনি ভেংচি কাটত। শত্রুর তার অভাব ছিলনা। গদী রাখতে হলে অনেক ভাল মন্দ লোক কে পুষতে হয়। নানাও পুষেছিল অনেক কে। ওই গদী টিকিয়ে রাখতে যেয়ে সে মা কে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক মদখোরের কাছে বিয়ে দেয়। নানী বাধা দিয়ে ছিল। কিন্তু পারেনি। মা ছিল নানার একমাত্র মেয়ে। এই গদীর লোভ বড় ভয়ঙ্কর। 

আমি ঐ মদখোরের মেয়ে।

কোন এক সময়ে নানার সাথে আমার বাপের টাকা পয়সা নিয়ে মনোমালিন্য হয়। নানা তার লোকজন দিয়ে চেম্বার থেকে বের করে দিয়েছিল ঐ মদখোর কে। 

এই বলে থামল সে।

আমি পিছন ফিরে চাইতেই দেখলাম লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়া একজন দাড়িয়ে।

টুনির মেয়ে বলল, আমার স্বামী। এখানকার পাঠশালাতে মাস্টারি করে।

এগিয়ে আসতেই আমার উঠে দাঁড়ালাম।

আমার নাম কছম আলী, এখানে কি ব্যাপারে?

কিছু বলার আগেই টুনির মেয়ে বিস্তারিত সব বলল।

কছম আলী শুধু একটা কথাই বলল, অনেক কাঁদিয়ে ছিলেন আমার শাশুড়িকে। বলে ঘরের ভিতর চলে গেলো।

আমরা বসলাম। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই।

আমিই  মৌনতা ভাঙলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর?

 সেই সময় আমার মা অন্তঃসত্ত্বা। একদিন বাবা নানার উপর প্রতিশোধ নিতে যেয়ে  মা কে বের করে দিলো বাসা থেকে মিথ্যা দোষারোপ দিয়ে। অস্বীকার করলো আমার অস্তিত্ব। বলল সে আমার পিতা নয়।

বলেছিল, আমার মা কুলাঙ্গার।

মা এসে উঠল নানার বাসায়। কিন্তু সেখানে সে থাকতে পারলনা। আমার বাবা,  মার নামে মিথ্যে সব ঘটনা রটনা করতে থাকল। বিষিয়ে উঠল বাসার পরিবেশ।

এক রাতে মা এক কাপড়ে বেড়িয়ে পড়ল।  চলে এলো বহু দূরে। আশ্রয় নিলো  এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায়।

সেখানেই আমার জন্ম। বাবার কোন সন্ধান না থাকাতে লোকে মার নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে থাকল। সেই অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে, ভিক্ষা করে মা আমাকে তিলেতিলে মানুষ করেছিল। 

আমার মা নষ্টা নয়। আমার কাছে আমার মা দেবী, আপনাদের মার মতই সেও একজন মা। সারা জীবন শুধু অপবাদই পেয়ে গেল।

এই বলে একটু থামতেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি বেড়িয়ে এলো। আমি আমার হাতের রুমাল টা এগিয়ে দিলাম।  

আমার বন্ধু উঠে উঠানের এককোণে যেয়ে দাড়িয়ে রইল।

জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নানা খোঁজ নেই নি?

-না, জানিনা সে বেচে আছে কিনা। তিক্ততা মেশানো গলার স্বর। 

বললাম, আমি আবারও ক্ষমা চাইছি। ছোট বেলার ঐ খেলা বড় নিষ্ঠুর খেলা ছিল। আজ তা বুজতে পারছি।

বলে তাকালাম ওর দিকে।  সে চেয়ে রইল দূরে, দুর আকাশের কোনে।

আমার চোখের কোণটা যে ভেজেনি তা নয়।

উঠে দাঁড়ালাম।

সে শাড়ীর আচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভিতর চলে গেলো।

Continue Reading

আজ সেই দিন

       শফিক কেক টা এনে রাখল টেবিলের উপর। সুন্দর করে লেখা কেকের উপর ——।  

রাত বারোটার পরে কাটবে।

ঘরটা অন্ধকার করে দিল শফিক। ছোট্ট একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখল।

 কনা চোখ ধাঁধাঁ নো আলো পছন্দ করে না।

অন্ধকার ঘরে বসে শফিক কনার গায়ের গন্ধটা অনুভব করতে চাইল। ঐ গন্ধে মাদকতা ছিল। বলেছিল কনা কে।

-পারফিউম টার নাম কি? আলতো করে কনার থুতনিতে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করেছিল শফিক ।

– পারফিউম তো আমি ব্যাবহার করি না কখনো।

-তাহলে এই গন্ধ কিসের?

-আমি কি করে বলব বলও। বলে মিটমিট করে হেসেছিল কনা।

শফিক চোখটা বন্ধ করলো। অনেক পুরানো স্মৃতি মনে এলো।

সাদা শাড়ী, কালো পাড়ে ওকে মানায়। বলেছিল শফিক।

তখনো ওরা আংটি বদল করে নি।

আংটি বদলের দিন ওকে যে কি সুন্দরই না লাগছিল, সেইক্ষণে বলতে পারেনি। 

দুপাশে মেয়েদের দল। আর কনা বসে আছে মাথা নিচু করে।

আচ্ছা, শফিকের মনে হোলও, আজকাল তো বর কনে আর ওভাবে মাথা নিচু করে বসে থাকে না।

সময় পালটিয়ে গেছে।

কত কত বছর চলে গেছে পিছনে।

ও এলো, জীবনটা পূর্ণতায় ভরে গেলো।

দৈনন্দিন জীবনে কত না ঠোকাঠুকি লাগে। ভাংচুর হয়।

তাতো হলনা।

প্রতিটা দিনকে কিভাবে আনন্দময় করে তুলতে হয় তা জানা ছিল কনার।

নতুন দিনকে নতুন করে সাঁজা তো সে।

শফিকের মনে হোল ওকে নিয়ে ছাইভস্ম কিছু লিখেছিল সে।

এক রাতে রান্না ঘর ঘুচিয়ে যখন এলো, ওকে জড়িয়ে ধরে শফিক বলেছিল,

-তোমাকে একটা লেখা পড়ে শুনাবো।

-কার লেখা? 

-আমার।

-তোমার? বিয়ের আগে প্রেমপত্র লেখার পর আর কিছু লিখেছ বলে তো আমার মনে পড়ে না।

– লিখেছি তোমার রান্না করার সময় তোমার মুখটা দেখে।

-বাহ, আমাকে ছাড়, তা না হলে পড়ে শুনাবে কি ভাবে?

-তবে শোন। বলও হাসবে না?

-না, হাসবো না। কথা দিলাম।

“ছাত্রীহলের গেট দিয়ে যখন সে বেরিয়ে আসতো,   

পরনে সাদা শাড়ি কালো পাড়

বলতাম, তুমি এলে পাশের অন্যরা এতো ম্লান হয়ে যায় কেন?

সে বলত, এতো তোমার চোখে আমাকে দেখো তাই।

বলতাম, বিধাতা বুঝি একজনকেই বানিয়েছে এই ধরাধামে

এতো সুন্দর করে?

সে বলতো এতো তোমার চোখে আমাকে দেখো

বলতাম চশমাটা খুলবে কি?

বলত কেন ?

তোমার কাজলে আঁকা চোখটা দেখবো।

এতো সুন্দর করে কাজল দিয়ে আঁকো কি ভাবে?

বলত, এতো তোমার চোখে আমাকে দেখা।

বলতাম, তোমার হাসিতে মুক্ত ঝড়ে জানো কি তা তুমি ?

বলত, তাতো জানিনা, এ ঝরা শুধু তুমিই দেখো,

এতো তোমার চোখে আমাকে দেখা।

এই নিটোল হাতে টুং টাং চুড়ির শব্দ আর কারো কানে বাজে কি?

তুমি বলতে, বাজে, তুমি শুনতে পাওনা।

তুমিতো দেখো আমার হাতটা তোমার চোখে।

যখন তুমি বেণী বেঁধে আস্তে পায়ে আসতে,

আর আমি চোখ ভরে তাকিয়ে থাকতাম,

সে দুটো বেণী আবার বাঁধবে কি?

বলত না, ওটা থাক তোমার মনের ভেতর গাঁথা,

যে চোখ দিয়ে সেদিন তুমি আমাকে দেখেছিলে।

তুমি জানো, টিপ পরলে তোমাকে কত সুন্দর দেখায়?

বলত, তাই কি? এতো তোমার চোখে আমাকে দেখা।

আচ্ছা বলো তো তোমার নাকফুলটা এতো জ্বলজ্বল করে কেন ?

বলত, তাতো জানিনা?

আমি বলতাম ওটা নাকফুলের বাহাদুরি নয়, সৌন্দয ঐ সুন্দর নাকটার

যেখানে ওটা শোভা পাচ্ছে।

বলতাম চলো হেঁটে আসি,

বলত, কেন?

দেখবো তোমার পায়ে চলার পথে কাঠবিড়ালিটা থমকে দাড়ায় কিনা?

বলত, কি আবোল তাবোল বকো।

বলতাম তুমি যখন রান্না করো আগুনের তাপে লাল হয়ে আসা তোমার

মুখটা কি অপূর্ব লাগে তা কি তুমি জানো?”

এই পর্যন্ত লিখেছি। বলেছিল শফিক ।  

-বাহ, অপূর্ব। শেষে এই কথা টি যোগ কর,

তোমার হাতেই যেনও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।

ঢং করে বড় ঘড়িটাতে শব্দ হোলও।

রাত বারটা।

শফিক চোখ মেলে চাইল।  

মোমবাতিটা পুড়ে পুড়ে শেষের পথে।

সে এসে দাঁড়াল কেক টার কাছে।

আজ ছাব্বিশে অক্টোবর।

পঁয়তাল্লিশ বছর আগে এই দিনে ওরা আংটি বদল করেছিল।

ঝাপসা চোখে শফিক তাকাল চারিধারে।

মোমবাতি নিভে গেলো, রইল শুধু অন্ধকার।  

Continue Reading

দায়ী কে?

  -না, ছুয়োনা আমাকে। লালা ডগডগে চোখে ধমকের সুরে বলল আসমা।

আবু দুই পা এগিয়ে যেয়ে আবার পিছিয়ে এলো। এমন যে আগে বলেনি তা নয়। প্রায় প্রতিদিনই অফিসে যাওয়ার আগে এমন হয়। ঔষধ গুলো খাওয়াতে গেলে ছুড়ে ফেলে দেয়।

-ঐ ছাই ভস্ম কেনও আনো আমার সামনে? বলেছি না আমি খাবনা। বলে দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।

আবুর কোন কথা শুনতে চায় না আসমা। আবুকে কেনও জানি সহ্য করতে পারে না।

অনু কে ডাক দিলো আবু।

আঠারো উনিশ বছরের মেয়ে। মামা মামী বলে ডাকে আবু আর আসমা কে। বন্ধু আনিসের বাসাতে কাজ করতো। বিয়ে হওয়ার পরে চলে গিয়েছিল স্বামীর সাথে। বিয়েটা টেকে নি। বৌ পেটানও স্বামী। ওকে ছেড়ে চলে এসেছিল আবার আনিসের বাসাতে। বলেছিল, মামা জাগা হবে তোমার এখানে? দরকার ছিলনা আনিসের। তবুও বলেছিল, থাক কয়দিন, এর মধ্যে একটা ব্যবস্থা হবে তোর।  আর ঠিক সেই মুহূর্তে আবুর কল এসেছিল।

তাও তো একবছর হয়ে গেলো অনু দেখা শোনা করে। ঘরের কাজ পুরো টাই তার হাতে। সকালে নাস্তা দেওয়া থেকে আরম্ভ করে রাতের খাওয়া পর্যন্ত। আবু আসমা বেড়িয়ে যেতো কাজে। ফিরে এলে চা বিস্কিট এগিয়ে দিতো।

আসমার সাথে এক নিবির বন্ধন সৃস্টি হোলও। ওর কথা শোনে আসমা।

-মামী এসো, তোমার চুলটা আঁচড়িয়ে দেই। বলে আবুকে ইশারা করে চলে যেতে বলল।

আবু এসে দাঁড়ালো ব্যালকনি তে। ধোয়াটে চারিদিক। তার ভেতর দিয়ে সূর্যের এলো এসে পড়েছে সামনের টবে রাখা ফুল গাছ গুলোর উপর।

আজ রোববার।

 নিচের রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যা কম। তবুও প্যে পু শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুরে এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। রাস্তায় লাইট পোস্টের তারের উপর বসা অনেক গুলো কাক হঠাৎ করে কা কা করে উড়ে গেলো। ওরা খুজে বেড়াচ্ছে আবর্জনা।

আসমার পছন্দে কেনা এই ফ্লাট।

বিয়ের পরে ভাড়া বাড়ীতে ছিল বেশ কয়েক বছর। প্রতিদিন কিছু না কিছু সমস্যা লেগেই ছিল। বাড়িওয়ালাকে বললে একই উত্তর। অসুবিধা হলে অন্য বাসা দেখতে পারেন। আবুর মনে হয় আসমা ওর ঘরের লক্ষ্মী।

ও জীবনে আসার পর তড়তড় করে একটার পর একটা উন্নতি। এই ফ্লাটটা, তাও তো ওরই জন্য। তা না হলে সেদিন বসুন্ধরা মলে তার যাওয়ার কথা নয়।

আসমা বলেছিল, চলো মলে যাই, একটু কেনাকাটা আছে।

-না, আজ থাক। বলেছিল আবু।

-প্লীজ, চলো না। গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করেছিল আসমা।

অগত্যা রাজি হোলও , একটা বেবী ট্যাক্সি ডেকে এসে নামলো বসুন্ধরা মলে।

আর ঠিক সেই দিনে, সেই ক্ষণে দেখা হয়েছিল আকমলের সাথে।

 কাঁধের উপর হাত পড়তেই চমকে পিছনে তাকিয়ে ছিল আবু,

-কি রে চিনতে পারছিস?

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, বলল, আকমল না?

-চিনতে পেরেছিস তাহলে। আকমল কথা শেষ করে তাকাল আসমার দিকে।

-ওহ পরিচয় করিয়ে দেই। আমার অর্ধাঙ্গিনী। আসমা।

-সালাম, ভাবী, এই হতচ্ছাড়ার সাথে একই কলেজে পড়াশুনা করেছি। কলেজ শেষে ও চলে গেলো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আর আমি চলে এলাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে । বলে হেসে উঠল আকমল।

-তা আছিস কোথায়? কি করছিস? জিজ্ঞাসা করলো আবু।

-এই তো বাড়ি ঘর বানাই, আর বিক্রি করি। হাসতে হাসতে বললও আকমল।

-তার মানে রিয়েলস্টেটের ব্যাপসা।

-বলতে পারিস। তা তুই আছিস কোথায়?

-কাজ না বাসার কথা বলছিস। প্রশ্ন ছিল আবুর।

-দুটোই।

-চাকরি করি একটা ফার্মে। আর থাকি শান্তিনগরে।

-শোন, এই আমার বিজনেস কার্ড। সময় করে কল দিস। গল্প করা যাবে।

আকমল চলে গেলো দরজা পেড়িয়ে। ওরাও এসে ঢুকল এক শাড়ীর দোকানে।

-কেমন আছেন আকমল ভাই? অনেক দিন পরে আসলেন। আসফু জিজ্ঞাসা করলো। দোকানের কর্মচারী।  ওর কাছ থেকেই বিয়ের সব শাড়ীগুলো কিনেছিল। তাও তো আজ অনেক বছর আগের কথা। মাঝে মধ্যে আকমল আর আসমা আসে, আসফুই ওদের কে দেখাশোনা করে।

বাসায় ফিরে এসে আসমা বলেছিল, তোমার ঐ বন্ধুকে বলও না একটা এপার্টমেন্টের কথা।

-ভাড়া নেবে নাকি কিনবে? উৎসুক নয়নে আসমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল আবু।

-দেখাই যাক না। জিজ্ঞাসা করতে তো কোন ক্ষতি নেই।

তিন চার দিন পর আবু কল দিয়েছিল আকমল কে। গুলশানের এক নম্বরে ওর বাসা।

বলেছিল, চলে আয়। ডিনার করব এক সাথে।

সাত তালায় ওর ফ্লাট। ফ্লাট নয়, স্যুইট। সুন্দর করে সাজানো। আকমলের রুচি আছে। ঘরের চারিদিকে চোখ দিলেই বোঝা যায়। লিভিং রুমের এক পাশে বেশ বড় অ্যাকোয়ারিয়াম। লাল নীল মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

-বল কি খাবি এই মুহূর্তে। ঠাণ্ডা না গরম।

-হার্ড কোর ড্রিংকসের কথা বলছিস? আবু জানতে চাইল।

– তা যেটা তুই চাস। চা, কফি, লাল পানি। হাসতে হাসতে আকমল তাকালও আসমার দিকে।

-কফি চলবে। উত্তরে বলল আবু।

-ভাবী আপনার জন্য-?

– কফিতে আপত্তি নেই। একটু চুপ করে আসমা বললও, এই বাসাতে আপনি একলা থাকেন?

-বাহ, অসাধারন, সরাসরি বৌ আছে কিনা জিজ্ঞাসা না করে কি সুন্দর জানতে চাইলেন। না, নেই। আমি একেলা।

ছিল এক সময় কিন্তু কপালে টিকলো না। কলীম বলে একজন আছে আমার ড্রাইভার সেই বাজার ঘাট করে দিয়ে যায় আর পেয়ারার মা, রান্না করে।

আসমা আর কথা বাড়াল না। শুধু উসখুস করতে লাগল কখন আবু কথা টা পারবে।

খাওয়ার টেবিলে আবু জিজ্ঞাসা করলো, কোন ফ্লাট আছে কিনা ভাড়া বা কেনার জন্য।

-আছে, তবেঁ একটা সমস্যা আছে।

-কি? অতি দ্রুত জানতে চাইল আসমা।

-এক ভদ্রলোক বায়না দিয়েছে, তারপর তার আর কোন পাত্তা নেই। এক সপ্তাহ পরে ওর বায়নার মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। যদি সে না কেনে তা হলে তোকে দিতে পারবো। অবশ্য যদি তোদের পছন্দ হয়। ফ্লাটটা এই বিল্ডিংএর পাঁচ তালায়।

যদি চাস তবে খাওয়ার পরে দেখাতে পারব বলে পেয়ারার মা কে ডাক দিল।

-কি রকম দাম হতে পারে আকমল ভাই। আসমা জিজ্ঞাসা করল।

-তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আগে দেখেন।

পছন্দ হয়ে ছিল আসমার। আকমল বন্ধুর বন্ধুত্ত রক্ষা করেছিল। আবু আসমা কিনতে পেরেছিল ফ্লাট টা।

-মামা তাড়াতাড়ি আসেন। ভয়ার্ত স্বরে ডাক দিল অনু।

-কি হয়েছে?

-মামী যেনও কেমন করছে।

আসমা জানালার শিক ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে। চোখ মুখে ঘৃনা আর বিদ্বেষের ছাপ। চিৎকার করছে আর বলছে, ওরা আসবে, ওরা আবার আসবে।

-না কেউ আসবে না, আমি তো আছি তোমার কাছে। আসমা কে জড়িয়ে ধরতে চাইল আবু।

ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল ওর হাত।

-তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। বলে ঘরের কোণে যেয়ে বসে রইল।

আবু তাড়াতাড়ি ডাক্তার কে কল দিলো। ওরই বন্ধু।

পরিমল এলো সন্ধ্যায়। তখন আসমা ঘুমাচ্ছে। প্রথম থেকেই আসমা পরিমলের চিকিৎসাধীন আছে। ঘুমিয়ে আছে তবু যেনও চেহারাতে ভয়ের ছাপ।

ওরা দুজন এসে বসল ব্যালকনি তে।।

-কি মনে হয় তোর? জিজ্ঞাসা করল আবু।

-ওর মনের ভিতরের জট টা না ছুটানো পর্যন্ত কিছু হবে বলে মনে হয় না। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আরও হিংস্রতা বাড়ছে। বাসাতে না রেখে অন্য কোথাও দিতে চাস। পরিমল জানতে চাইল।

-তার মানে তুই বলতে চাস পাগলা গারদে।

-ও ভাবে বলছিস কেন? তুই একা সামলাতে পারবি? তোকে তো কাজেও যেতে হয়।

-তা হয়, তবুও আমার সামনে ওকে রাখতে চাই। চোখের সামনে, দুরে নয়।  

বলে দুরে তাকিয়ে থাকল আবু।

-কি ভাবছিস? পরিমল জানতে চাইল।

– মনে পরে কি, তোর বিয়েতেই আসমা কে প্রথম দেখেছিলাম।

-পরে বৈকি। তুই আমার পাশে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলি, আমার বৌ এর পাশে ঐ মেয়ে টা কে?

পরে আমার বৌ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওর বান্ধবীর সাথে,

– হু, তারপর ছয়মাস যেতে না যেতেই ওকে ঘরে উঠিয়ে এনেছিলাম। তারপর প্রতিটি মুহূর্ত এক সাথে কাটিয়েছি। আস্তে আস্তে পনেরো টা বছর পাড় করে দিয়েছি। ঘরে আর কেউ এলো না বলে মন খারাপ করিনি। তুই কি মনে করিস ওটা একটা কারন?

-না সেটা কারন নয়। কারন যে কোন টা তা তুই ও জানিস আমি ও জানি। বলে থামলো পরিমল।

দুজনেই চুপ।

পরিমল নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলও। বলল, ঘুমের ঔষধ টা বাড়ীয়ে দিচ্ছি। সময় করে আনিয়ে রাখিস।

ওকে বিদায় দিয়ে আবু আবারও এসে বসল ব্যালকনিতে।
 তাকালও রাস্তার দিকে, নিঃসঙ্গ একটা লোক একাকী পথে হেঁটে চলেছে। আবুর মনে হোলও ও  ঐ  লোকটির মত, নিঃসঙ্গ।

না, সে নিঃসঙ্গ ছিল না। সপ্তাহে দুই তিন দিন বাহিরে যেতো ডিনার করতে। আবু নিজেই গাড়ী চালাত। আসমার ডান হাতের আঙ্গুল গুলো আবুর চুলে বিলি কাটত।

 ডিনার শেষে এসে বসত নির্জন কোথাও, মনে হতো তাঁরা নতুন করে প্রেম করছে।

তারপর সেই রাত টা। গাড়ীর আলোতে দেখতে পেলো সামনে দাঁড়ানো—–

না,না,না চিৎকার করে উঠল আবু।

-কি হয়েছে মামা। দৌড়ে এলো অনু।  

– না কিছু না, তুই যা। কপালটা ঘেমে গেছে।

চোখ সরিয়ে নিলো রাস্তা থেকে।

-মামা, খাবার দিয়েছি টেবিলে, আসেন। বলল অনু।

অনু থাকে আসমার ঘরে। আবু পাশের রুমে। দরজাটা খুলে রাখে। যাতে কোন শব্দ হলে শুনতে পায়। ঘুম আসে না চোখে।

যদিও বা আসে দেখে হিংস্র দানবদের স্বপ্ন। ওরা তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। কেউ ওদেরকে বাঁধা দেয় না। বাঁধা দেবার কেউ নেই। ওরা তা জানে। আর জানে বলেই ওদের এই তান্ডপ নৃত্য।  

বেশ কিছুদিন ধরে আসমা কে একটু শান্ত দেখাচ্ছে। আগের মত ঔষধ গুলো ছুড়ে ফেলছে না। অনু যা বলে তাই শুনছে। আবু কে দেখলে চিৎকার করছে না। একি ভালো হয়ে যাওয়ার পূর্ব লক্ষন।

অফিসে যাওয়ার আগে পরিমল কে কল দিল আবু।

-মনে হচ্ছে ঔষধ গুলো কাজ দিচ্ছে।

-মানে? জিজ্ঞাসা করলো পরিমল।

– আসমা এখন অনেক শান্ত । দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললও আবু।

-হু, চুপ করে রইল পরিমল, মনে হোলও কিছু ভাবছে সে।

-কিরে চিকিৎসা সার্থক শুনেও আনন্দ পাচ্ছিস না? 

-না, মানে, ঠিক আছে আমি দুই একদিনের মাঝে আসব দেখতে। ওর ঔষধ পত্র গুলো কোথায় থাকে?

-কেন?

– জানতে চাইছি।

-অনুর কাছে, কেন? জিজ্ঞাসা করল আবু।

– না এমনি।

কথা শেষে আবু বেড়িয়ে গেলো।

অনু দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

দুদিন পর। আবু বের হয়ে যাওয়ার আগে আসমা ডাক দিলো পিছন থেকে।

সচরাচর এমন হয়না।

আবু ঘাড় ফিরিয়ে তাকালও আসমার দিকে।

-কিছু বলবে?

-তোমার কি আসতে দেরী হবে আজ।

-না, কেনও, কিছু লাগবে। জিজ্ঞাসা করলো আবু। একটু অবাক হোলও, চেহারায় সেই ভাব আসতে দিলো না।

-না, এমনি। বলে ওর ঘরের দরজাটা ভিজিয়ে দিলো।

তখন বাজে দুপুর একটা। আবু ব্যাস্ত কাজ নিয়ে।

অনুর কল।

-মামা, আপনি তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন। কান্না কান্না স্বরে অনু বলল।

-কেন? কি হয়েছে? উৎকণ্ঠা আবুর কণ্ঠে।

-আমি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছি কিন্তু মামি দরজা খুলছে না। তাড়াতাড়ি আসেন, কাঁদতে কাঁদতে বলল অনু।

আবু বেড়িয়ে এলো অফিস থেকে। কি ভাবে গাড়ী চালিয়েছিল সে নিজেও জানে না।

অনু দরজার সামনে বসে কাঁদছে।

আবু পকেট থেকে চাবি টা বের করলো।

হাত কাঁপছে।

দরজাটা খুলল।

আসমার নিষ্প্রাণ দেহটা ঝুলছে ফ্যানের সাথে।

লোকজন এলো, এলো আকমল, এলো পরিমল । ওরা আবুকে নিয়ে বসাল ব্যালকনি তে।

আবু তাকাল ওদের দিকে। রক্তশূন্য মুখমণ্ডল।

শুধু একটা প্রশ্ন জানতে চাইল সে,

– যারা ওকে সেই রাতে টেনে হেঁচড়ে গাড়ী থেকে নামিয়ে নিয়েছিল, তাঁরা আজও কেনও হেসে খেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বল, কেন? কেন?   

Continue Reading

ভয়ার্ত চিৎকার ২

     থর থর করে কাঁপছে শম্ভু। কি সে জিনিস যা কিনা রাখতে হবে দরজার সামনে। শম্ভু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। একবার ভাবল পুলিশের কাছে যাবে কিনা। না, তাতে আরও জড়িয়ে যাবে। পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা।

তাহলে?

গাড়ীটা স্টার্ট দিলো। হাত কাঁপছে। হৃদপিণ্ডের কাঁপনি বেড়েই চলেছে। ভাবল ঐ নাম্বারে কল করে বলবে, সে কিছুই জানেনা। কি তারা চাইছে।

তারাই বা কারা। কাঁপা হাতে ফোনটা উঠালো। না, বলছে এই নাম্বার ঠিক নাম্বার নয়।

মনে পড়লো লম্বা ঐ লোকটার কথা। সে কি ঐ দলের লোক?  ওর চেহারাটা দেখে গেলো লাইটার নেওয়ার ভান করে?

অনেক ভয়ার্ত ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরছে।

কি চাইছে তাঁরা? ওরা কি দেখেছে ছেলেটা ওর বাসায় ঢুকেছিল। তা নাহলে ওকেই বা টার্গেট করবে কেনও?

গাড়ীটা পার্ক করল শম্ভু। এবারও বেশ কয়েকটা বাড়ি পরে। স্ট্রীট লাইটের আলো। খুব উজ্জ্বল তাও নয়। এতদিন সে এসব নিয়ে চিন্তা করেনি। আজ মনে হোল আলোর চেয়ে অন্ধকার টাই বেশি। চারিদিকে তাকিয়ে দ্রুত হাটতে থাকলো।

ঘেউ ঘেউ করে পাশের বাসা থেকে একটা বিরাট কুকুর দৌড়ে এলো।

গেটে পা দিয়ে আঁচড়াতে থাকলো।

শম্ভুর মনে হোলও কুকুর টা এখনি লাফ দিয়ে ওর ঘাড়ে কামড় দেবে। কোন দিকে না তাকিয়ে দৌড় দিল শম্ভু।

হাপাতে হাপাতে এসে পৌছাল ওর বাসার দরজায়।

দরজা খুলতে যেয়ে মনে হোলও কে যেন দাড়িয়ে ওর পিছনে।

পিছন ফিরে তাকাতে পারছে না সে, আজ তার শেষ দিন, শম্পাকে কিছুই বলে যেতে পারবে না। লোকটা বোধহয় পিস্তল টা বের করেছে। এইবার গুলিটা বিঁধবে, বেড়িয়ে যাবে হৃদপিণ্ড কে ঝাঁজরা করে।

না, এখনো গুলিটা বেঁধে নি। একটু সাহস সঞ্চয় করে পিছনে তাকাল শম্ভু।

আলো আধার থেকে বেড়িয়ে এলো লোকটা। সুট পরা।

এই রাতে কে এই লোকটা? শম্ভু চিন্তা করে পেলো না। লোকটার চোখে মুখে হিংস্রতা নেই।

এগিয়ে এলো, হাত বাড়ীয়ে দিয়ে বললও, আমি ডেভিড ফক্স, ডিটেকটিভ। কিছু প্রশ্ন আছে।

ডিটেকটিভ শুনে শম্ভু মনে মনে ভাবল, ওকে শান্ত থাকতে হবে। ডিটেকটিভরা চোখ মুখ দেখেই বুঝে ফেলতে পারে ওর মনের কথা। মনে মনে ঠিক করল বলা যাবে না ছেলে টা এসেছিল ওর বাসাতে।

– এইখানে একটা খুন হয়েছে জানেন নিশ্চয়? 

-হ্যাঁ, জানি। বলল শম্ভু।যত টুকু শান্ত থেকে বলা যায়।

-কোন গুলীর শব্দ বা গাড়ীর আওয়াজ শুনেছেন কি?

– না, ঘুমিয়ে ছিলাম।

– ও! ঠিক আছে, এই আমার কার্ড। কোন কিছু মনে পড়লে ফোন করতে ভুলবেন না। বলে কার্ড টা এগিয়ে দিল।

-সিওর। বলে কার্ড টা হাতে নিয়ে পকেটে রেখে দিল শম্ভু।

গুড নাইট বলে মিস্টার ফক্স যেতে যেয়ে আবার পিছন ফিরে তাকালও। কিছু বলতে যেয়ে, না বলে এগিয়ে গেলো গেটের দিকে।

দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো একটা কাগজ। কেউ দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে ফেলেছে।

কোন কিছু লেখা নাই। শুধু একটা পাখির ছবি। মড়া। বেলী আপ। 

সকালে হয়ে এলো। ঘুম আসেনি। উঠে পড়ল শম্ভু। কফিটা বানাতে দিয়ে, সাওয়ার নিতে গেলো। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ওরা বলেছে বাসার সামনে জিনিস টা রাখতে। জিনিসই নাই, কি রাখবে সে। 

শম্ভু কাজ করে একটা অ্যাডভারটাইজমেনট কোম্পানিতে। আজ একটা বড় ক্লায়েন্টর সাথে অ্যাপএন্টমেন্ট আছে।

এই অস্থির মন নিয়ে কতটুকু কি করতে পারবে বুঝতে পারছে না। অথচ এই কাজ টা যে করে হোক ধরতেই হবে।

ম্যানেজার তার উপর অনেক আশা করে আছে।

কফিটা নিয়ে জানালার কাছে বসল। বাহিরে তাকালও। আগন্তুক কাউকে দেখতে পেলো না।

সকাল নয় টা।

দরজাটা বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। গেটটা খুলে রাস্তায় নামলো। হেটে এলো গাড়ীটার কাছে। গাড়ীতে ঢুকে স্টার্ট দিতে যেয়ে চিৎকার করে উঠল। গাড়ীর কাঁচে উপর দুটো মরা পাখি।

মাথাটা ঝিমঝিম করছে। অফিসে ঢুকতেই ম্যানেজার অ্যান্ডারসন ঢেকে পাঠালও শম্ভুকে।

-Everything alright? You look like a — anyway. Hope you are going to get this son of a bitch. We need his advertisement.

-I will get it.

যদিও অনেক সাহস নিয়ে বলল, কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য কিছু।

মরা পাখি, লম্বা লোক, কালো গাড়ী।

SoonHo কোম্পানি ওকে আশ্বাস দিয়েছে। অ্যাডভারটাইজমেনটা দেবে মনে হয়। এই কাজ টা নিতে পারলে ওর একটা প্রোমোশন হওয়ার সম্ভবনা আছে। এই ভাবনাতে মাঝে মাঝে মন টা উৎফুল্ল হচ্ছে আবার মনে পড়ছে ঐ লোকটার কথা। আজ একটু আগেই বেড়িয়ে পড়ল অফিস থেকে। সোজা বাসা।

বাসার কাছেই আজ গাড়ীর পারকীং টা পেয়েছে শম্ভু।

 গেটটা খুলে সিঁড়িতে পা দিয়ে মনে হোলও দরজাটা ঠিক মতো লাগানো না। একটু খোলা। মনে করার চেষ্টা করলো সে অফিসে যাওয়ার আগে বন্ধও করে ছিল কি না।

ভয়ে ভয়ে ধাক্কা দিলো। খুলে গেলো দরজাটা।

ঢুকতে যাওয়ার আগে চিন্তা করল, কেউ ভিতরে আছে কিনা। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলো। ভয়ে সারা শরীর হীম হয়ে যাচ্ছে। সাহস সঞ্চয় করে এক পা ভিতরে দিলো শম্ভু। লিভিং রুমের চেয়ার পত্র চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। একটা চেয়ারের হাতল ভাঙ্গা। যেনও ঝড় বয়ে গেছে।

পা দিয়ে সরিয়ে আস্তে আস্তে শোয়ার ঘরে এলো সে। বিছানা টা ছুরি দিয়ে কেটে তছনছ করে গেছে।

শম্ভু বুঝতে পারলো না কি তাঁরা চায়। কি খুজছে।

একটা চেয়ার উঠিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।

এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নাম্বার।

হ্যালো, বলতেই ভারী গলায় একজন বলল, খেলা করার জায়গা পাচ্ছনা। তোমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তোমাকে তিন  ঘণ্টা সময় দিলাম। জিনিস টা কেন্ট আর লকাস্ট রোডের কর্নারে যে বাক্সটা আছে তার পাশে কালো ব্যাগের মধ্যে করে রেখে দেবে। নচেৎ তুমি শেষ। বিশ মিনিট পড়ে আমি আবার কল করবো।

লাইন কেটে গেলো।

শম্ভু কি করবে বুঝতে পারছে না। পেটের ভিতর কামড় দিচ্ছে। মনে হচ্ছে বমি করতে পারলে ভালো হতো। তিন ঘণ্টা মানে বিকেল ছয় টা।

মনে পড়লো ডিটেকটিভ ফক্সের কথা। ওকে না বললেই নয়। ও জড়িয়ে গেছে এক ভীষণ ফাদে।

কল করলো শম্ভু।

হ্যালো, মিস্টার ফক্সের গলা।

-আমি শম্ভু ঐ খুনের ব্যাপারে। কথা শেষ হওয়ার আগেই মিস্টার ফক্স বলল, আমি এখনি আসছি।

দশ মিনিটের মধ্যে মিস্টার ফক্স এলো। ঘরে ঢুকেই তাকালও চারিদিকে।

-তাহলে সেদিন তুমি আমাকে সব কথা বলোনি। কথা টা বলে এগিয়ে যেয়ে ফ্লোর থেকে পড়ে থাকা পেন্সিল টা উঠিয়ে নিলো।

শম্ভু বললও সেই রাতের কথা। বলল, এর বেশি সে কিছুঁই জানিনা। ছেলে টা এসেছিল, আবার দৌড়ে চলে গিয়েছিল, বলল, মরা পাখির কথা, বলল সেদিনের গাড়ী ফলো করার কথা।

তারপর আজকের এই ফোন কল।

-বিশ মিনিট পড়ে কল করবে বলেছে? জিজ্ঞাসা করল মিস্টার ফক্স

-হ্যাঁ

-ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি। এখনো হাতে দুই ঘণ্টা সময় আছে।

দেখতে দেখতে কয়েকটা পুলিশের গাড়ী ওর বাসার সামনে এসে হাজির।

ঠিক বিশ মিনিট। ফোনটা বেজে উঠলো। মিস্টার ফক্স ইশারা করে বলল স্পীকারে দিতে।

-হ্যালো, কাঁপা কাঁপা স্বর শম্ভুর।  

-পুলিশের সাহায্য নিলে দেখছ ছবিটা,এক একটা অঙ্গ কেটে পাঠাবো তোমার কাছে।

শম্ভু দেখল ম্যসেজে পাঠানো ছবি টা।

এতো শম্পার ছবি।

আঁতকে উঠলো শম্ভু।

মিস্টার ফক্স কাগজে লিখে ধরলও শম্ভুর সামনে। লেখা আছে ঠিক সময় মত আমি ওই টা রেখে আসবো।

আর কেউ থাকবে না।

-ঠিক পাঁচ টা তিরিশ মিনিট। ব্যাগ টা রেখে সোজা হেটে যাবে। পিছনে তাকাবে না। আমার লোক চারিদিকে। বলে ফোন টা কেটে দিলো।

শম্ভু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, শম্পার কি হবে? আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।

-শম্পা কে কল কর।

শম্পা ফোন ধরছে না। ভয়েস মেল।

মাথায় হাত দিয়ে পায়চারি করতে থাকল শম্ভু।

আবারও কল করলো শম্ভু। আবারও ভয়েস মেল।

কোথায় কাজ করে সে? জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার ফক্স।

-এম এম জি ব্যাঙ্কে। ফীথ অ্যাভিনিউ এন্ড ২১ স্ট্রীট।

মিস্টার ফক্স কোথায় যেনও কল করলো।

-কালো ব্যাগ আছে? জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার ফক্স

-আছে বলে নিয়ে এলো শম্ভু

মিস্টার ফক্স বলল এটা নিয়ে ঠিক ৫;৩০ মিনিটে ওই জায়গায় রাখবে। বাদ বাকি কাজ আমার।

এই সময় ফোন বেজে উঠলো মিস্টার ফক্সের।

-কি বললে সে বেড়িয়ে গেছে এক ঘণ্টা আগে? একজনের সাথে? মিস্টার ফক্স ফোনটা রেখে শম্ভুর দিকে তাকাল। শম্ভুর মুখ ফ্যাঁকাসে।

পাঁচ টা তিরিশ।

শম্ভু গাড়ী থেকে নেমে এলো। এগিয়ে গেলো। দেখল বড় একটা বাক্স পড়ে আছে। রাস্তার উল্টো দিকে একটা ভাঙ্গা বাড়ি।

নির্জন রাস্তা । পাশে একটা পার্ক মনে হোলও। গাছ পালায় ঢাকা।  পারফেক্ট গেটওয়ে। মিস্টার ফক্স কি আরেঞ্জমেন্ট করেছে শম্ভু জানেনা। জানে এই ব্যাগে কিছু নাই, শুধু একটা ছেড়া কাপড়।

শম্পার খবর জানে না। সেকি ওদের হাতে? মাথায় এক বোঝা চিন্তা। এরপর কি হবে সে নিজেও জানেনা।

ব্যাগ টা রাখল।

পিছনে তাকানো নিষেধ। এক পা এগোতেই মনে হোলও কে যেন একটা জিনিষ ওর পিঠে ঠেকালও।

-সামনে এগিয়ে চলো। কে যেন বলল ওর কানের কাছে।

শম্ভুর মনে হোলও আজ এইখানেই শেষ। মিস্টার ফক্স কোথায়?

ঠিক সেই মুহূর্তে পার্কের ভিতর থেকে তিন জন বেড়িয়ে এলো। বুকে বুলেট প্রুফ ভেস্ট। দুজনের হাতে পিস্তল একজনের হাতে রাইফেল।

-স্টপ। ড্রপ দা গান। চিৎকার করে বলল একজন।

লোকটা শম্ভুর গলা আঁকড়িয়ে কুইক ঘুরে দাঁড়ালো। শম্ভুকে সামনে রেখে।

হাতের পিস্তল শম্ভুর মাথায় ধরা। ব্যাগ টা কাঁধে।

আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে সে।

পুলিশ তিনজন এগিয়ে আসছে। মাঝ খানে শম্ভু।

লোকটা শম্ভু কে টেনে নিয়ে এলো পার্কের পাশে। বন জঙ্গলে ভরা।

হঠাৎ শম্ভুকে ধাক্কা দিয়ে সামনে ফেলে লোকটা দৌড়ে ঢুকে গেলো জঙ্গলের ভিতরে।

আর সেই মুহূর্তে গর্জে উঠলো পিস্তল আর রাইফেল গুলো।

জঙ্গলের ভিতর থেকে এক আর্তনাদ ভেসে এলো।

শম্ভু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকলো।

মিস্টার ফক্স শম্ভুর কাঁধে হাত রাখল।

শম্ভু তাকালও, মিস্টার ফক্সের পাশে শম্পা।

এই ঘটনার দশ পনেরো দিন পরে, প্রীসীলা এসেছে শম্ভুর ঘর পরিষ্কার করতে।

শম্ভু বসে বসে খেলা দেখছিল।

-মিস্টার! প্রীসীলা ডাক দিলো।

-হোয়াট? শম্ভু টিভির থেকে চোখ না সরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

প্রীসীলা একটা ছোট্ট পার্স শম্ভুর হাতে দিয়ে বলল, এইটা তোমার লন্ড্রির ব্যাগের মধ্যে পেলাম। বলে সে অন্য কাজে লেগে গেলো।

শম্ভু তাকালও পার্সটার দিকে। আগে কখন দেখিনি।

জীপার টা আস্তে আস্তে খুললও।

ভিতরে  জ্বলজ্বল করছে কতোগুলো হীরার টুকরা।

Continue Reading

ভয়ার্ত চিৎকার

  শম্ভু অনেক রাতে কাজ সেরে শুতে এসেছিল। ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে দেখল, দুটো দশ।

চোখ টা কেবল লেগেছে। ধুম ধুম দরজায় কে যেন বাড়ি মারছে। লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। কয়েক সেকেন্ড লাগলো ব্যাপার টা বুঝে উঠতে।

আবারও শব্দ।

দরজাটা খুলতেই ওকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল ছেলেটা। থরথর করে কাঁপছে। বয়স সতের আঠারোর উপর হবে না।

-প্লীজ আমাকে বাচান। দরজা খুলবেন না। ওরা আমাকে পেলে মেরে ফেলবে। ভয়ে ওর মুখটা সাদা হয় গেছে।

-তা কি হয়েছে, কে তুমি? জিজ্ঞাসা করল শম্ভু।

এমন সময় আবারও দরজায় কে যেন বাড়ি মারল।

ছেলেটা দৌড়িয়ে ঢুকে গেলো শম্ভুর বেডরুমে।

কিছুক্ষণ কোন শব্দ নেই। পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো শম্ভু। আওয়াজ টা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো।

শম্ভুও যে ভয় পায়নি তা নয়।

এত রাতে উটকো ঝামেলা, তারপর কি না কি ব্যাপার, শম্ভু কে ভাবিয়ে তুললো।

ছেলে টা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ভয়ে কাঁপছে।

-কি হয়েছে?

-ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।

-দাড়াও, পুলিশ কে কল করি।

-না, না বলে দৌড়ে গেলো দরজার কাছে।

দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখল।

তারপর দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।

সবকিছু কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটে গেলো।

শম্ভু সমস্ত ব্যাপার টা ভাবতে চেষ্টা করল। আস্তে আস্তে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো।

দরজাটা বন্ধ করে ফিরে এলো রান্না ঘরে। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি ঢক ঢক করে খেয়ে বিছানায় এলো।

রাস্তায় হৈ হুল্লার শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। 

-যত সব নিকুচি করি, বলে একটা গাল দিয়ে উঠে এলো বিছানা থেকে। আজ তার বন্ধের দিন। প্রতিদিন ভোর ছয়টায় উঠতে হয়। আজ সেই তাড়া ছিলনা। কাজ না থাকলে সে সকাল দশ টার আগে উঠে না। ঘুম ভেঙ্গে গেলেও পরে থাকে বিছানায়। তারপর আস্তে আস্তে উঠে এসে কফির মেশিন টা চালু করে দেয়।

মুখ টা না ধুয়ে কফিটা নিয়ে জানালার কাছে বসে।

আজ আর তা হোলও না।

এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনতে পেলো।

দরজাটা খুলে বাহিরে এসে দাঁড়ালো।

পাশের বাড়ীর মহিলা টাও দাঁড়ানো।

-কি হয়েছে? জিজ্ঞাসা করলো শম্ভু।

-খুন হয়েছে, শুনলাম। বলল মহিলা টা

-খুন? ধপ করে উঠল বুকটা।

রাতের কাপড় পরেই এগিয়ে গেলো রাস্তার দিকে। দেখতে পেলো দুই ব্লক দুরে অনেক লোকের জটলা।

দুটো এম্বুলেন্স, আর গোটা চারেক পুলিশের গাড়ী। বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে হলুদ ফিতে দিয়ে ঘেরাও করা।

শম্ভু এসে দাঁড়াল। লোকটা তখনো পরে আছে রাস্তায়। দুই জন কোট পড়া লোক পরে থাকা মানুষ টার পাশে বসে কি যেন করছে।

মুখ টা দেখা যাচ্ছে না। সার্ট টা দেখতে পেলো শম্ভু। আঁতকে উঠল। সেই লাল জামা তার উপর কালো ছোপ ছোপ।

ও? একটা শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে।

তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এলো ভিড় থেকে।

কপাল টা ঘামে ভিজে গেলো। বুকের ভিতর দুরদুর করছে। এতো সেই।

কোন কিছু চিন্তা করতে পারছে না শম্ভু। দ্রুত পায়ে হেটে এলো। বাথরুমে যেয়ে সাওয়ারের কল টা ছেড়ে দিলো।

সারাটা দিন অস্থির ভাবে কাঁটাল। প্রথমে ভাবল শম্পা কে কল করে সব ঘটনা টা বলবে। পরে মনস্থির করল না কাউকে জানাবে না। তবুও শম্পা কে কল করল, কিছুক্ষণ কারো সাথে বসে কথা বলা দরকার। অস্থির মন টাকে বাগে আনতে হবে।

-ব্যাস্ত?

– না। বলল শম্পা।

-তাহলে তৈরী হয়ে নাও। আধা ঘণ্টার মধ্যে আসছি। বাহিরে ডিনার করব।

শম্পা না করলো না।

সন্ধ্যা হয় হয়। গতকাল রাতে বাসার সামনে জায়গা না থাকাতে একটু দুরে পার্ক করতে হয়েছে। শম্ভু তাকালও দুই দিকে।

দেখল যেখানে লোকটা পড়েছিল সেই দিকে রাস্তা হলুদ টেপ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। ক্রাইম সিন।

ভাগ্যভালো ওর গাড়ীটা উল্টো দিকে।
চলার শুরুতেই রাস্তার ওপাশ থেকে কে যেন একজন ডাক দিল।

-শুনছেন?

উত্তর দেওয়ার আগেই দৌড়ে রাস্তা পাড় হয়ে এলো। মাথায় বেজবল ক্যাপ।

রাস্তায় আর কেউ নেই।

সামনে এসে দাঁড়ালো। শম্ভুর গলা শুকিয়ে গেছে। লোকটা লম্বায় সাড়ে ছয় ফুটের কম নয়।  কনুই এর নিচ থেকে কব্জি পর্যন্ত সাপের ট্যাটু।

-লাইটার আছে? বলে পকেট থেকে সিগারেট বের করল।

– না, আমি সিগারেট খাই না। বলল শম্ভু শুকন গলায়।

-ও! বলে দৌড়ে যে ভাবে এসেছিল ঠিক সেই ভাবেই চলে গেলো।

লোকটার মুখটা শম্ভু ভালভাবে দেখতে পেলো না ক্যাপের জন্য।

গাড়ীটা পার্ক করতেই শম্পা নেমে এলো। 

-কোথায় খাবে, জিজ্ঞাসা করল শম্ভু

-এজ উজুয়াল।

আছে ওদের জানাশুনা এক রেস্তোরা। যেখানে ওরা প্রায় যায়, সবাই চেনে। পরিবেশ টা হোমলি।

-তোমার যেন কি হয়েছে মনে হচ্ছে?

-কবে থেকে আবার জ্যোতিষী হলে। মৃদু হেসে বলল শম্ভু।

-আমার কাছে লুকোতে চেওনা। আমি তোমাকে অনেকদিন থেকেই চিনি।

শম্ভুও  কেনও জানি না বলতে পারলে স্বস্তি পাচ্ছিল না।

বলল সব।

-ওকে কি কেউ দেখেছে তোমার বাসায় ঢুকতে। জিজ্ঞাসা করল শম্পা।

– তা তো জানিনা। তবে আমার দরজায় কয়েক বার কে যেনও নক করেছিল। আমি খুলি নি। ওই ছেলে টাই মানা করেছিল।

– হয়ত সবার বাসাতেই নক করেছে? আশ্বাস দিলো শম্পা।

-তাই যেন হয়।

খাওয়া শেষে বের হয়ে এলো দুজনে। শম্পাকে নামিয়ে দিলো। মনের মাঝের ভয় টা কোন ক্রমেই গেলো না। যদিও শম্পা অনেক রকম আশ্বাসের বানী শুনিয়ে ছিল।

ঝন ঝন করে ফোন টা বেজে উঠল। প্রতিদিন একি ভাবে বাজে, আজ যেন মনে হোলও অনেক জোড়ে বাজচ্ছে।

তাকালও ফোন টার দিকে । চেনা নম্বর নয়। তবুও হ্যালো বলল শম্ভু।

ওপাশ থেকে শুধু নিশ্বাসের শব্দ। কেটে দিল কলটা।

আবারও বেজে উঠল।

ভয়ে শম্ভুর হাতটা কেঁপে উঠল। গাড়ীটা লেনের বাহিরে চলে এসেছিল। জোড়ে হর্ন দিয়ে একটা গাড়ী বের হয়ে গেলো পাশ দিয়ে।

শম্ভু তাকাল রেয়ার ভিউ মিররের দিকে। মনে হোলও পিছনের গাড়ীটা ওকে ফলো করছে। শম্ভু বায়ে টার্ন নিলো। যদিও এদিকে তার বাসা নয়। পিছনের গাড়ী টাও একই দিকে টার্ন নিলো।

ফোন টা বেজে উঠল আবার। না এবার শম্পা কল করেছে।

-কোথায় তুমি।

-জানিনা, পিছনে একটা গাড়ী আমাকে ফলো করছে। 

– কি বলছ?

কথা বলতে বলতেই পিছনের গাড়ীটা পাশ কেটে সামনে এসে ব্রেক করেই এক সেকেন্ডের মধ্যে শা করে চলে গেলো।

শম্ভু আত্ম চিৎকার করে ব্রেক করল। ফোনটা ছিটকে পরে গেলো নিচে।

গাড়ীটা রাস্তার পাশে এনে রাখল শম্ভু। ফোনটা খুজে বের করলো।

টুং করে শব্দ হোলও। ম্যাসেজ এসেছে।

“যদি ভালো চাও তবেঁ মাল টা দরজার সামনে রেখে দিও। নচেৎ —-“

(চলবে)

Continue Reading

নিয়তি

  সাদা চাদর দিয়ে ডেকে দাওয়া হয়েছে। ডাক্তার হারুন বাহিরে এসে দাঁড়ালো। সেখানে দাঁড়ানো সাধন, রফিক আর পার্থ। তিনজন তাকাল ডাক্তার হারুনের দিকে।

একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে নিচে। এই মুহূর্তে শব্দ টা অসহ্য লাগছে ওদের।

ভর দুপুর।

 রৌদের তাপ টাও বেড়েছে।

 ঘামছে ওরা।

মুখটা রুমাল দিয়ে মুছে পার্থের কাঁধে হাত রেখে বলল ডাক্তার হারুন , ডেথ সার্টিফিকেট টা আমার চেম্বার থেকে নিয়ে যেয়েন। আর যা যা করার সব ব্যবস্থা করুন। 

 সেই মুহূর্তে ওরা উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠল।

-আপনাদের মধ্যে রফিক কে?

 ওরা তাকাল মহিলার দিকে।

-আমি, বলল রফিক।

-আমিই আপনাকে খবর দিয়েছিলাম। পাশের ফ্লাটটা থাকি। চাচা বলে ডাকতাম। এই চিঠি টা আপনাকে দিতে বলেছিল।

হাত বাড়িয়ে চিঠি টা নিলো রফিক।  

খামের উপর টা সাদা।

খুলতে যেয়েও খুলল না। পকেটে রেখে দিলো।

-সাহেব, আমি উনার রান্না করে দিতাম। ওদের পাশে এসে বলল এক জরাজীর্ণ কাপড় পড়া মহিলা। এই মসের টাকাটা উনি দিয়ে যান নি।

-কত? জিজ্ঞাসা করল সাধন।

টাকাটা দিতে গেলো রফিক। বাঁধা দিল পার্থ।

টাকাটা হাতে নিয়ে মহিলা এসে দাঁড়ালো বিছানার পাশে। বিড়বিড় করে কি যেন পড়ল। তারপর চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো।

আত্মা টা চলে গেলে তখন নাম ধরে কেউ ডাকে না। ওটা হয়ে যায় লাশ। সেই লাশ টা বিছানায় পড়ে আছে। কেউ নেই পাশে। ওরা তিনজন বাহিরে দাঁড়ানো।

কবর দিতে হবে। ওরা ব্যস্থ হয়ে উঠল।

সব কাজ সেরে ওরা ফিরে এলো ঐ ফ্লাটে। সন্ধ্যা হয় হয়।

পাশের ফ্লাটের মহিলাকে বলল রফিক, ওর ঘরে তালা দিয়ে গেলাম। আমাদের কে আজই ফিরে যেতে হবে।  

 আমি ফিরব সাতদিন পরে। 

-ঘুমাতে এসো। রফিকের পাশে দাড়িয়ে বলল আলেয়া।

-তুমি যাও আমি আসছি। বলে ড্রয়ার থেকে চিঠি টা বের করলো রফিক।

কাঁপা হাতের লেখা।

কোন সম্বোধন নেই।

   এই চিঠি যখন তোর হাতে পৌছাবে তখন আমি অনেক অনেক দুরে চলে গেছি।

 তুই, আমি, সাধন, পার্থ।

 এক সাথে বড় হয়েছি। তুই ছিলি আমার সব চেয়ে নিকট তম বন্ধু। তাই এই চিঠি টা তোকেই দিয়ে গেলাম। পড়া শেষে ছিড়ে ফেলে দিস।

ভাবতে অবাক লাগে আজ  কি ভাবে কি ভাবে  তোদের সাথে আমার বন্ধুত্ত হয়ে গেলো।

বাস ড্রাইভারের ছেলে আমি, আর তোরা–। স্কুল শেষে তোরা কলেজে চলে গেলি আর আমি পড়া শেষে বাপের চাকরি টা হাতে নিলাম।

বাবার হাঁপানি রোগ ছিল। ক্রমেই ওটা খারাপের দিকে চলল। বাবা বলে ছিল, তুই কলেজে যা বাবা।

না আমি পারিনি। একমাত্র ছেলে আমি। সংসারের হাল ধরতে হবে।

বেশ তো ভালোই চলছিল। কাজের শেষে আমি এসে বসে থাকতাম কলেজের সামনে। মা র হাতের তৈরী গজা দিতাম তোদের কে । হাটতে হাটতে যেতাম দুর ব্রিজের কাছে। মনে কি পড়ে ?

তোরা কলেজ শেষ করে চলে গেলি দুরে। উচ্চ শিক্ষারতে। আমি রয়ে গেলাম।

চলে যাওয়ার আগের দিন আমরা চারজন বসেছিলাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। শেষ কথা কি বলেছিলি মনে আছে?

-আবার দেখা হবে দোস্ত।

-বলেছিলাম, সেদিন চিনতে পারবি তো এই বাস ড্রাইভার কে?

চিঠি আসতো তোর কাছ থেকে। কার সাথে যেন ইয়েটিয়ে করছিস। হাসতাম আমি।

আস্তে আস্তে চিঠি আসা কমে এলো। আমিও ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। মালিক আগের রুট পালটিয়ে অন্য রুটে আমাকে দিলো।

সে অনেক দূরপাল্লার রুট। মাঝে মাঝে বাসাতে ফিরতাম দুদিন পরে।

মা মাথার পাশে বসে বাতাস করতো। বলত, তোর বাবার শরীর টা ভাল যাচ্ছে না।  বুঝতাম মা কাঁদছে।

পাশের ঘর থেকে বাবার কাশির শব্দ শুনতাম।

এই ভাবেই দিনগুলো কাটছিল। হঠাৎ একদিন কি হোলও জানিস।

সেদিন শেষ ট্রিপ আমার। বাসে মাত্র কয়েকজন লোক। এঁকে এঁকে সবাই মেনে গেলো যার যার স্থানে। রইল দুইজন। মনে হোলও স্বামী স্ত্রী। কথায় কথায় লোক টা বকছে মেয়েটা কে। মাঝে মাঝে থাপ্পড় দিচ্ছে গালে। মেজাজ টা টং হয়ে গেলো।

কিন্তু কিছু করার নেই।

ওরা নামলো আমার বাসের শেষ স্টপে।

নেমে যাওয়ার সময় কেনও জানি রাগ সামলাতে পারলাম না। শুধু বললাম, লজ্জা করে না মেয়েদের উপর হাত তুলতে?

লোক টা ঘুরে আমাকে চড় মারতে চাইলো।

পারলো না। তার আগে ওর হাত টা ধরে এক লাথি দিয়ে বাস থেকে নিচে ফেলে দিলাম। লোকজন জড় হয়ে গেলো।

ও বলল, আমি নাকি ওর জেনানার হাত ধরতে চেয়েছিলাম, তাই সে চড় মারতে চেয়ে ছিল। মেয়ে টা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিল। আর কাঁদছিল।

আমাকে থানায় নিয়ে গেলো। একরাত কাটানোর পরে ছেড়ে দিলো।

বাসায় ফিরে এসে দেখলাম বাবার কাশি বেড়ে গেছে। নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। দৌড়ে গেলাম ডাক্তার আনতে।

তুই তো জমির ডাক্তার কে চিনতিস।

সে এলো। ততক্ষণে সব শেষ।

বাবা চলে গেলো।

মনে হোলও আমার মাথার উপরের ছাউনী কে যেন সরিয়ে দিলো। এতদিন বাবার ছায়াতেই ছিলাম। যদিও বাবা কিছুই করছে না। তবুও সে যেন একটা বিরাট খুঁটি। ওটা ধরেই আমরা ঘুরছিলাম।

ঐদিন নিজেকে বড় অসহায় মনে হোলও।

আজ বলতে বাঁধা নেই, সেদিন তোর কথা অনেক মনে হয়েছিল। সান্ত্বনা পাবার জন্য।

দিন তো বসে থাকে না। তার নিজের নিয়মে সে চলবে। শোক কাটিয়ে আমিও বাসের স্টিয়ারিং হুইলে হাত দিলাম। 

মাস  পেড়িয়ে বছর এলো। মা প্রায় তাগীদা দেয়, বলে এবার বিয়ে কর। আমার তো বয়স হোলও। তোকে কারো হাতে দিয়ে গেলে আমি শান্তি পাবো।

ওসব কথায় কান দেইনি।

চলছিল ভালোই।

একদিন এক স্টপ থেকে উঠল এক মহিলা। দেখে মনে হোলও কোথায় যেন দেখেছি।

-তুমি কি ঘুমাতে আসবে? অনেক রাত হোলও। আলেয়া ধমকের সুরে জানালো রফিক কে।

-একটু পরে আসছি। বলে রফিক চিঠি টা পড়তে শুরু করলো।

মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে পিছনে যেয়ে বসলো। আমি আমার স্মৃতির পাতা উল্টাতে থাকলাম। খুজে পেলাম না। মহিলা দুই স্টপ পরে নেমে যাওয়ার আগে তাকাল, হাসল, নেমে গেলো।

পরের দিনও একই ঘটনা। এলো, হাসল, নেমে গেলো।

তৃতীয় দিন, বাসে আর কেউ নেই, তাই সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।

নামতে যেয়ে ফিরে তাকাল, বলল, অনেক অনেক দিন আগে আমার স্বামী কে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মনে পরে? বলে নেমে গেলো।

কেন জানি ওর চেহারা টা আমি আমার মন থেকে মুছতে পারলাম না।

এরপর, প্রতিদিন ও ওঠে, নেমে যাওয়ার আগে এসে দাড়ায় দরজার কাছে। কথা হয়।

জানলাম, ওর স্বামী মারা গেছে। থাকে এই গ্রামে।

কোনদিন যদি দেখি সে আসেনি, মন টা বিগড়িয়ে যায়।

এর মাঝে একদিন ঘটলো এক মর্মান্তিক ঘটনা। প্রতিদিন সকালে মা আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়।

ঐ দিন মা এলো না। আমি ঘুম থেকে উঠে কোন সারা শব্দ পেলাম। বাহিরে এলাম। মা র ঘর বন্ধ।

আস্তে আস্তে দরজা তে ধাক্কা দিলাম। খুলে গেলো। দেখলাম মা শুয়ে আছে। মনে হোলও ঘুমাচ্ছে। কাছে যেয়ে গায়ে হাত দিতেই মনে হোলও মা র সারা শরীর ঠাণ্ডা।

পাশ ফেরাতেই হাত টা ঝুলে পড়লো।

মা চলে গেছে।

কতক্ষণ পাশে বসে কেঁদেছিলাম বলতে পারবো না।

আমি একেলা হয়ে গেলাম।

চার পাঁচ দিন পর কাজে ফিরে এলাম। সেই স্টপ, মহিলা উঠলো। নামার আগে পাশে এসে দাঁড়ালো, জিজ্ঞাসা করল, এতদিন কোথায় ছিলেন?

সব ঘটনা বললাম।

নামতে যেয়ে ফিরে তাকাল। বলল, কাল আমার ছুটি। এই মেঠো পথ ধরে গেলে মনিহরপুর গ্রাম। ওখানে আমি থাকি। চিনতে অসুবিধা হবে না। বিরাট একটা আম গাছ, তার পাশেই আমার কুড়ে ঘর।

ও নেমে গেলো।

পরদিন কাজ শেষে এলাম। মেঠো পথ ধরে পৌছালাম ওর কুড়ে ঘরে। মাটির তৈরী। শোয়ার ঘরের পাশে রান্না ঘর।

বসলাম ওর ঘরে। বলল, রাতে খেয়ে যেতে।

স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন রাতে চলে এসেছিল এই খানে। বাসাটা ছিল ওর দূরসম্পর্কে এক খালার। অনেক দিন পর শুনেছিল ওর স্বামী মারা গেছে। কি ভাবে জানে না।

বলেছিল, বড় উৎপাত করে এখানকার ছেলেরা।  

এর পর অনেক বার গিয়েছি ওর বাসায়।

কথা হয়। দুরত্ত বজায় রেখে বসি দুজনে।

এক সন্ধ্যায়, আসতে না আসতেই নামলো বৃষ্টি। বাহিরে আকাশ গজরাচ্ছে। ভিতরে আমি এর ও।

অন্ধকার হয়ে এলো।

হ্যারিকেন টা জ্বালিয়ে উপরে রাখল সে। সেই হ্যারিকেনের আলোটা পড়ল ওর মুখে।

আমি তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে।

 শাড়ীর আঁচলটা ঠিক করল।

আমার ভিতরের পশুটা আস্তে আস্তে জেগে উঠল। আমি যেন তখন মানুষ নই, হিংস্র জানোয়ার।

 আমি এগিয়ে গেলাম। ও পিছনে সরে গেলো।

আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরলাম।

ও ছাড়িয়ে নিতে চাইলো।  

আমি ওর আচল টেনে নিচে নামিয়ে দিলাম।

ও বলে উঠল, না, না।

ও পারলো না। আমি ওর উপরে চেপে বসলাম।

ও কেঁদে কেঁদে বলল, এ কি করলেন আপনি।

আমি বাহিরে এসে দাঁড়ালাম বৃষ্টির মাঝে। মনে মনে বললাম, এ আমি কি করলাম।

দুদিন পরে ফিরে গেলাম ওর বাসায়। ইচ্ছে আমার, ওকে নিয়ে আসবো, ঘর বাধবো।

কিন্তু ঘর তালা মারা। জিজ্ঞাসা করালাম পাশের বাসার মহিলা কে। বলল, সে চলে গেছে এই গ্রাম ছেড়ে।  

আর তার দেখা পাইনি। আমিও বাসা ছেড়ে দিয়ে ছোট্ট একটা ফ্লাটে উঠলাম।

বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। আমারও বয়স বেড়েছে। প্রতিদিন আর বাস চালাই না। মাঝে মাঝে কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে আসে। ডাক্তার দেখিয়েছি। বলেছে, মরণ রোগ। চিকিৎসা করার মত টাকা পয়সা আমার নেই। কাজেই দিন গুনতে থাকলাম।

এমনি একদিন, সেই স্টপ থেকে এক মহিলা, বোরখা পরা, উঠতে যেয়ে দাড়িয়ে রইল, আমার হাতে এক টুকরা কাগজ দিয়ে দ্রুত নেমে গেলো।

আমি কাগজ টা খুললাম। লেখা, আপনার মেয়ে রহীমা এতীম খানায় আছে।  ঠিকানা রইল। পারলে দেখতে যাবেন। আমি চললাম, সে আর আমার দেখা পাবেনা।

আমি দ্রুত বাস থেকে নেমে এলাম। কিন্তু মহিলা কে কোথাও দেখতে পেলাম না।

তারপর আমি গিয়েছি সেই এতিম খানায়। সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটার সাথে বসে গল্প করেছি। পরিচয় দেই নি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ও জিজ্ঞাসা করতো, মা কবে আসবে?

ওকে আমার কাছে আনতে পারিনি। ভেবেছি আমার অবর্তমানে কে দেখবে ওকে?

 আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে।

তাই তোকে লিখে যাচ্ছি। যদি পারিস আমার মেয়ে টা কে দেখিস। ও যেন এই পৃথিবীতে হারিয়ে না যায়।

আসি দোস্ত।

ক্ষমা করে দিস আমাকে।

মহি।

চিঠি শেষ। রফিক কাঁদছে।

কখন যে আলেয়া এসে পাশে দাঁড়িয়েছে জানতে পারেনি।

কাঁধে হাত রাখল আলেয়া। রফিক তাকালও ওর দিকে। চিঠি টা দিলো ওর হাতে।

বলল, তৈরী হয়ে নিও।

কাল সকালে যাবো তোমার মেয়ে কে আনতে।

Continue Reading

তৃষ্ণার্ত মন

-আমি বাইরে যাচ্ছি। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো শিপলা।

ইমন জানে কোথায় যাচ্ছে শিপলা, কার সাথে। কাজেই জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই, তাতে কথাই বাড়বে, তিক্ততার সৃষ্টি হবে।

ইমন তাকালও না, বই টার থেকে মাথা তুললও না। 

দরজা বন্ধের শব্দ হোলও।

শিপলা ফিরবে অনেক রাতে। সোজা চলে যাবে তার ঘরে। কাপড় ছেড়ে যাবে মুখের প্রসাধন ওঠাতে।

তারপর বিছানা। ইমন জেগে থাকে তার ঘরে।

এমন তো ছিলনা।

সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার সে। মহসীন স্যারের জন্যই চাকরিটা পেয়েছিল হারুন বিল্ডার্স লিমিটেডে।

রশিদ হারুন।

সাদাসিধা যে কিশোর বড় হয়েছে পাঁচগুলিয়া গ্রামে, আজ তিনি দেশের অন্যতম উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি। জাপানের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বাস, ট্রাক, মিনিবাস প্রভৃতি মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ সংযোজনের সাথে জড়িত।

পাশাপাশি তিনি পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি উৎপাদনের কারখানা নির্মাণের কাজও শুরু করতে যাচ্ছেন। এ মুহূর্তে প্রায় দুই হাজার কর্মচারী-কর্মকর্তা রয়েছেন তার প্রতিষ্ঠানগুলোয়। বর্তমানে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

সব শুনেছে ইমন মহসীন স্যারের কাছ থেকে।

হারুন বিল্ডার্স  নাম এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। হাই রাইজ বিল্ডিং উঠছে এই শহরের চারিদিকে। কোম্পানির হাতে নতুন অনেক গুলো প্রোজেক্ট। কোম্পানিতে কাজ করে রাজীব, সাদি, রোকেয়া,শিপলা। পরিচয় হয়েছিল।

শিপলা কাজ করে ফ্রন্ট অফিসে।  আসতে যেতে শিপলার সাথে দেখা হলে হাই, হ্যালো, কেমন আছেন এই পর্যন্ত।

কাজ নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো ইমন।

নতুন শহর গড়ে উঠছে আসল শহর থেকে বিশ মাইল দুরে। নাম প্রগতি। সেখানে হারুন বিল্ডার্স গড়ে তুলবে এক বিশাল মল। সেই প্রোজেক্টের দায়িত্ব পড়েছে ইমনের উপর। কেন হারুন সাহেব অনেক সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার থাকতে ইমনের উপর দায়িত্ব দিয়েছিল তা সে আজও জানে না।

একদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার পরও অফিসে কতগুলো দরকারি কাগজ পত্র দেখছিল। আগামীকাল ইনেস্পেকশনে আসবে সরকারি কর্মকর্তারা।

-কি ব্যাপার এখনো অফিসে?

মুখ তুলে চাইল ইমন। হারুন সাহেব দাঁড়ানো।

দুই একটা কথা বার্তার পর হারুন সাহেবই বললেন,

-হাতীর বাগানে আমাদের যে বিল্ডিং আছে তার ছয় তালায় একটা এপার্টমেন্ট খালি। আপনি চাইলে নিতে পারেন। বলে হারুন সাহেব উত্তরের অপেক্ষায় তাকাল ইমনের দিকে।

-অত দাম দিয়ে আমার পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বলল ইমন।

– দামদর পরে, আগে পছন্দ হয় কিনা দেখেন। এই কথা বলে চলে গিয়েছিলন।

ইমন দেখেছিল। পছন্দ হয়েছিল। আর হারুন সাহেব পানির দরে ওকে দিয়েছিল। কেন? আজও জানে না।

সেদিন শনিবার, রাজীব কল করে বলেছিল ওর বাসাতে কয়েকজন কে বলেছে, ইমন যদি আসে তবে সে খুব আনন্দিত হবে।

সবে মিলে সাতজন। ইমন ফুলের তোঁড়া টা রাজীবের স্ত্রী সাহানার হাতে দিয়ে চারিদিকে তাকাল। দুজন কে চিনতে পারলো না। রাজীব এগিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল না চেনা দুইজনের সাথে।

শিপলার পাশের জায়গা টা খালি। ইমন বসতে বসতে বলল, কেমন আছেন?

-ভালো। আপনি?

-টায়ার্ড। বলল ইমন।

-আপনার উপর তো বিরাট প্রোজেক্টের –

শিপলার কথা শেষের আগেই ইমনের হাতের কোকের গ্লাসটা এই হাত থেকে ওই হাতে নিতে যেয়ে ছোঁয়া লাগলো শিপলার হাতে।

-সরি বলে ইমন একটু সরে বসার চেষ্টা করল। যদিও খুব একটা জায়গা নেই।

শিপলা একটু হাসল।

-মামা, টেবিলে খাবার দেবো? জিজ্ঞাসা করলো আমেনা।

ইমন ফিরে এলো পিছনে ফেলে আসা দিন গুলো থাকে।

-হ্যাঁ, দে, তোকে তো ফিরে যেতে হবে।

আমেনা আসে সকালে, সেই রান্না করে। সকালের নাস্তা টা সেই দেয় ইমনকে। তখনো শিপলা ঘুমায়

আমেনাই ঔষধ গুলো এনে রাখে ইমনের সামনে। কোনটা ফুরিয়ে গেলে সেই মনে করিয়ে দেয়।

খাওয়া শেষে আমেনা কে বিদায় দিয়ে দরজা টা বন্ধ করে দিল ইমন।

বাহিরে আকাশ গুরুগুরু করে ডাকছে। বৃষ্টি নামবে। গুমোট গরম। বৃষ্টি নামলে হয়তো কিছুটা ঠাণ্ডা হবে।

ব্যালকনিতে এসে বসলো ইমন। বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে ভালই লাগছে।

 বৃষ্টি নামলো। গুমোট গরম শেষে স্বস্তির বৃষ্টি।

আমেনা কি ভিজতে ভিজতে গেলো? ভাবল ইমন।

সেদিনও বৃষ্টি ছিল। গা ছমছমে দুপুর।  ইমন আর অনু, দুজনে হাটতে হাটতে গিয়েছিল ধোপা পাড়ায়।

 ইমন ষোল, অনু চোদ্দ।

হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টি নামলো তো নামলোই, আর থামাথামির কোনো নামগন্ধ নেই। এমন বৃষ্টিকে বলে মুষলধারে বৃষ্টি

দৌড়ে এসে ওরা দাঁড়ালো বিরাট বট গাছটার নিচে।

ছোট্ট কালে দুজনে এক্কা দক্কা খেলেছে। পাড়ার পর পাড়া ঘুরে বাড়িয়েছে।

কখন যে বড় হয়েছে। বুজতে পারেনি।

 বুজতে পেরেছিল সেদিন, যেদিন ইমন ডাকতে গিয়েছিল অনুকে। বড় মাঠে ফুটবল খেলা আছে। ওদের স্কুলের সাথে ভবানীপুর স্কুলের।

-না বাবা ও তো যেতে পারবে না। বলেছিল অনুর মা।

-কেন? কি হয়েছে? অসুখ করেছে?

-না, অসুখ করেনি। তোমরা এখন বড় হয়েছ। একসাথে ঘোরা ফেরা টা ভালো দেখায় না। বলেছিল অনুর মা।

তারপরও ওরা পালিয়ে পালিয়ে একসাথে মিলেছে। হাটতে হাটতে গেছে অনেক দুর।

সেই হারং ব্রিজে।

আঁখের ক্ষেত থেকে আঁখ ভেঙ্গে খেয়েছে ব্রিজের নিচে বসে।

বটের পাতাতে আটকালও না বৃষ্টির জল। আস্তে আস্তে দুজনেরই কাপড় ভিজিয়ে দিলো।  

বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ল অনুর গায়ে। অনু জড়িয়ে ধরল ইমন কে। 

 কেন জানি সেদিন হঠাৎ করে অনু কে অন্য অনু মনে হোলও ইমনের কাছে।

ইমনের মাথাটা নুয়ে এলো, ওর ঠোঁট টা ছুলো অনুর ঠোঁটে।  

সেই ছোট্ট শহর ছেড়ে বড় শহরে আসার দিন অনু বলেছিল,

-আবার কবে আসবে ইমন ভাই?

-খুব তাড়াতাড়ি। দেখিস, ভুলে যাসনে যেন আমাকে।

না, অনু ভোলে নি। পথ চেয়ে থাকতো।

 ইমনও ভুলে যায়নি অনুকে। তবে ফিরে আর যাওয়া হয়নি।  

জীবন যুদ্ধে অনেক উপরে উঠে গেছে ইমন। অনেক লোকের জীবিকা আজ নির্ভর করছে তার নিজস্ব ফার্মের উপর।

ষোল তালার উপরে তার এপার্টমেন্ট। ব্যালকনি তে দাঁড়ালে দেখা যায় লেক।

গাছ দিয়ে সাজানো চারিদিক। অনেকে এসে বসে থাকে লেকের পাড়ে।

সবই ছিল তার। তবে পেলো না শুধু মনের মত সঙ্গিনী।

প্রথম দিকে যে ছিল না তা নয়।

 তখনও সে চাকুরীজীবী। ইনকাম মন্দনয়।একটা রিকন্ডিশন গাড়ীও কিনেছিল।

একদিন অফিস থেকে বের হতে যেয়ে দেখে বাহিরে ভীষণ বৃষ্টি। শিপলা দাড়িয়ে। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে।

কোন রিক্সাই যেতে রাজি নয়।

-যদি কিছু মনে না করেন আমি পৌছে দিতে পাড়ি।

শিপলা কিছু মনে করেনি।

তারপর আস্তে আস্তে দুজনে কাছে এসেছে। বসেছে নির্জনে। হাতে হাত। ঠোঁটে ঠোঁট।

একদিন মা,বাবা, বন্ধু বান্ধব আর হারুন সাহেব কে নিয়ে ধুমধাম করে বিবাহ পর্ব টা শেষ হোলও।

শিপলা সংসার টা সুন্দর করে গুছিয়ে নিলো।

কোলে এলো নবনী।

ইমনের মনে হোলও ও তার ছোট্ট ছোট্ট হাত পা ছুড়ে যেন বলছে, আমি তোমার মা, আমি এসেছি তোমার ভাগ্য খুলতে।

সেই থেকে ইমনের উন্নতি।

হারুন সাহেবের সাহায্যে গড়ে তুলল নিজস্ব  ফার্ম। নাম দিল নবনী- শিপলা ইন্ডাস্ট্রি।

নবনী বড় হোলও। দেশের বাহিরে চলে গেলো উচ্চশিক্ষার্থে।

 টাকা এলো, সুখ চলে গেলো।

শিপলা মেতে উঠলো পার্টি নিয়ে। মাঝে মাঝে ইমন যেতো। কোনদিন সে পার্টির পাগল ছিল না। তবুও যেতে হতো।

ইমন একদিন বলেছিল শিপলা কে, প্রতিদিন পার্টিতে কি না গেলেই নয়।

উত্তরে শিপলা বলেছিল, তোমার মত বেরসিকের সাথে বাসায় বসে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।

উত্তর দিয়ে কোন লাভ নেই ভেবে, সেদিন কোন উত্তর দেই নি।

মাঝে মাঝে ফেসটাইম করে মেয়ের সাথে কথা বলে। ওটাই তার মনের খোরাক। 

বৃষ্টি টা থেমে এলো। ইমন ভাবছিল, আজ যদি শিপলার পরিবর্তে অনু হতো ওর জীবন সঙ্গিনী তাহলে কি অন্য রকম হতো ওর জীবন টা। কেন জানি মনে হয় সব আছে তবুও কি যেন নেই।

ঘড়িটা দেখল ইমন। রাত দেড়টা।

দরজা খোলার শব্দ পেলো। ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে এলো।

শিপলা জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবে?

মুখের গন্ধটা একটু উগ্র।

-হ্যাঁ, কাল আমি একটু বাহিরে যাবো। ফিরতে কয়েকদিন দেরী হবে।

কোনকিছু জিজ্ঞাসা না করেই শিপলা চলে গেলো তার ঘরে।

-আচ্ছা ভাই, এখানে একটা গলি ছিল, এখন তো দেখছি পাকা রাস্তা। ফজলুল হক নামে একজন থাকতেন। অনেকদিন পরে এসেছি, কিছুই চিনতে পারছি না।

-হ্যাঁ, থাকতেন, ওই যে, ওই বাসাটা। 

বাসাটা চেনার উপায় নেই। দোতালা বাড়ী।

কড়া নাড়তেই এক ভদ্রমহিলা এসে দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে খুজছেন?

ইমন নাম টা বলল।

না, সে চেনে না। বলে দরজা টা বন্ধ করে দিলো।

ইমনের মনে পড়লো সাবুর কথা। একই ক্লাসে পড়তো।

একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়ল। চিনে যেতে পারবে কিনা মনে মনে ভাবল সে। সবই অচেনা মনে হচ্ছে।

যাক অবশেষে পাওয়া গেলো বাসাটা। খুব একটা পরিবর্তন হয়নি বাসাটার।

দরজায় টুকটুক করে শব্দ করলো। দরজা খুলে দিলো ছোট্ট একটা মেয়ে।

-সাবু আছে।

নানা তোমার কাছে এসেছে, বলে দৌড়ে চলে গেলো।

লাঠিতে ভর করে যে এসে দাঁড়ালো, সে তার নামটা না বললে চিনতে অসুবিধা  হতো ।

-ইমন না? বলে জড়িয়ে ধরলও সাবু। এতদিন পরে কি মনে করে?

-ঘুরতে ঘুরতে, তবে, একটু থেমে ইমন জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা, তোর মনে আছে, ওই পাড়ায় আমাদের বাসার কাছে ফজলুল হক বলে একজন ছিলেন।

-হ্যাঁ, কেন? তারা তো কবেই চলে গেছে এখান থেকে।

-অনু বলে উনার এক মেয়ে ছিল, তুই কি জানিস, কোথায় সে?

-তার বিয়ে হয়েছিল এক ব্যাবসায়ীর সাথে, থাকে গোপালগঞ্জে।

-ওর স্বামীর নাম কি? জিজ্ঞাসা করল ইমন।

-কি ব্যাপার। মতলব ভালো তো?

-ঠাঠামি ছাড়। নামটা বল।

-মতলেবুর রহমান।

কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়ল ইমন। একটা ইস্কুটার ভাড়া করে গেলো সে গোপালগঞ্জে।

ছোটছোট দোকান পাট। রাস্তায় বসে কেউ বা সিগারেট টানছে, কেউ বা গল্প করছে।

জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিলো কি ভাবে যেতে হবে বাড়ীতে।

মাটির রাস্তা, চওড়া বেশি নয়। দুপাশে খাল। ইটের পাকা বাড়ীটা দেখা যাচ্ছে।

ইমন ভাবল, অনু ওকে দেখে চিনতে পারবে কি? কেমন যেন শিরশির করছে বুকের মাঝে।

– দরজা খুলে কাকে চাই বলে, তাকিয়ে রইল ইমনের দিকে। চোখে পলক পড়ছে না। ইমন ভাই, তুমি?

-হ্যাঁ, চিনতে পেরেছিস তাহলে ? তা, দরজায় দাড় করিয়ে রাখবি, না কি ভিতরে যেতে দিবি। 

অনুর মনে হোলও সে এই জগতে নেই।  সে স্বপ্ন দেখছে। অনুর চোখ বিশ্বাস করতে চাইছে না।

-এসো।

ড্রয়াইং রুমে দুটো চেয়ার পাতা। পাশে একটা পরিপাটি করে সাজানো বিছানা। ছোট্ট একটা টেবিল কর্নারে রাখা।

-ভর দুপুরে এলে, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়? যা আছে তাই দিয়ে খাবে। চলো হাত মুখ টা ধুয়ে নেবে। এতগুলো কথা একসাথে বলে গেলো অনু।

-তুই বস, আমি তোকে দেখি।

-কি আর দেখবে আমাকে বলও। যে অনুকে তুমি শেষ দেখে গিয়েছিলে সেই অনু আজ আর নেই। আজ আমি তিন ছেলে মেয়ের মা। বলেছিলে আসবে আবার, এই তোমার আসার সময় হোলও। বলে চোখ টা মুছল শাড়ীর আচল দিয়ে।

দাড়াও আমি আসছি। বলে ভিতরে চলে গেলো। হয়তো কান্না থামাতে।

নিয়ে এলো, প্লেট, ভাত, ভাজি, ডাল।

ইমন বসলো প্লেটটা টেনে। মনে হোলও অনেকদিন সে অভুক্ত। অনু সামনে বসে পাতে উঠিয়ে দিলো ভাত।

কবে শিপলা ওর পাতে ভাত উঠিয়ে দিয়েছিল মনে করতে পারে না।

-ভাজি আর একটু দেই, তুমি কিন্তু অনেক কম খাও ইমন ভাই।

এমন কথা কি এখনো খাবার টেবিলে বলা হয়। ইমন ভাবতে চেষ্টা করল।

-তোর কর্তা কোথায়?

-শহরে গেছে। আসতে একটু দেরী হবে। তুমি কি আজই ফিরে যাবে?

-হ্যাঁ, সন্ধ্যা ছয়টায় আমার প্লেন।

-জানো ইমন ভাই, তোমাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। পরে মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি এই বলে, তুমি হয়তো অনেক ব্যাস্ত,সময় পাওনা এইদিকে আসার। কেন এলে ইমন ভাই। আবার তো মনে পরে গেলো ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ইমন ভাই তোমার সেই দিনটার কথা মনে আছে? সেই বট গাছ, মুষল ধারে বৃষ্টি—।

-মনে থাকবে না কেন? তোর যে মনে আছে সেটাই আশ্চর্যের।

-জানো ইমন ভাই, সেদিন, যে তীব্র আনন্দ পেয়েছিলাম, তার কোন তুলনা হয় না।

হঠাৎ কি অনুর গলায় কান্না এসে গেলো?  দ্রুত পায়ে চলে গেলো ভিতরে।

সেই বট গাছ, বৃষ্টি, পর পর তিনটা চুমু খেয়েছিল সে। অনু অবাক হয়নি, প্রথমবারের পর, পাখির বাচ্চা যেমন পাখী-মায়ের সামনে ঠোঁট ফাঁক করে থাকে, সেইভাবে অনু এগিয়ে দিয়েছিল ঠোঁট।

তাদের দুজনের সেই প্রথম অভিজ্ঞতা।

তারপর নদী দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেছে। অনেক কিছু বদলে গেছে। তবু অনু যে আজ বলল, সেই তীব্রতা আর তার জীবনে আসেনি।  সেই কথা বলতে অনুর চোখে জল এলো, এই স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাবে ইমন।

Continue Reading

অন্নপূর্ণা

      কাস্টমসের ধকল শেষ করে পাঁচ নম্বর carousel এর সামনে এসে দাঁড়ালাম। তখনও সুটকেস এসে পৌঁছায়নি।  যখন পেলাম তখন বেশ কিছু সময় পেড়িয়ে গেছে।

 এয়ারপোর্টের বাহিরে এসে দাড়িয়ে চারিদিকে তাকালাম। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক আসার কথা। কিন্তু চেনা পরিচিত কাউকে দেখলাম না।

আমাকে ঘিরে বেশ কিছু লোক। তারা চাইছে কে আমার সুটকেসটা নেবে। আমাকে পৌছিয়ে দেবে আমার গন্তব্য স্থানে।

যতবার বলছি, আমার লোক আছে, তোমাদের গাড়ী আমার লাগবে না, কিন্তু কে কার কথা শোনে।

একজন তো আমার হাত থেকে সুটকেসটা প্রায় নিয়ে নিয়েছিল, ঠিক সেই সময় শুনতে পেলাম উচু গলায় এক মেয়ের কণ্ঠস্বর, এই সড়ে যাও। ধমক দিলো ওদের কে।

আমি তাকালাম ওর দিকে। চিনতে পারলাম না।

কোন কথা বলার আগেই আমার হাত থেকে সুটকেস টা নিয়ে বলল,

– ছোট মামা অ্যান্টি পাঠিয়েছে আমাকে। বাসায় কেউ নেই যে আসবে তোমাকে নিতে। আমাকে তোমার একটা ফটো দিয়ে অ্যান্টি বলেছে চিনে নিতে। তা তুমি যে আবার দাড়ি রেখেছ তা তো জানিনা। সেই জন্যই তো একটু দেরী হয়ে গেলো খুজে পেতে। এক সাথে এতগুলো কথা বলে বলল, তাড়াতাড়ি পা চালাও। গাড়ীতে বসে কথা হবে।

সেই প্রথম দেখা তার সাথে। ইউনিভারসিটির শেষ বর্ষের ছাত্রী। এই বাসাতে যাতায়েত আছে।

আমার মন টা জয় করে নিতে খুব একটা সময় লাগেনি তার। মনে হোলও যেন সে আমার অনেক দিনের চেনা।

যতদিন ছিলাম সেই নিয়ে গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। বইয়ের দোকান থেকে আরম্ভ করে নতুন চশমা বানানোর দোকান পর্যন্ত। করিৎকর্মা মেয়ে। ওর অ্যান্টি কে মাঝে মধ্যে সাহায্য করে।

সুতীর শাড়ী, সুতীর সালওয়ার কামিজ ছাড়া অন্য কিছু পড়তে দেখিনি তাকে।

ভালো গান গায়। নিজেদের বাড়ীতে গানের চর্চা হয়।

যত দিন গেলো দেখলাম তার কুকুর, বেড়ালের উপর মায়া। ওদেরকে ভালবাসে।

মনে পড়ে গেলো আমার শৈশবে ছোট্ট একটা ছেলে আমার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল একই ভাবে।

আমাদের বাসাতে কাজ করত আয়েশা। তার ছেলে বিলটু। ঘুরঘুর করতো আমার আশেপাশে।

আমার পড়ার টেবিলের পাশে চুপকরে বসে থাকতো।

মা র লুকিয়ে রাখা বিস্কিটের বাক্স থেকে বিস্কিট এনে ওকে দিতাম।

ও চোখ বড়বড় করে চারিদিকে চেয়ে ছোট্ট ছোট্ট দাঁত দিয়ে টুসটুস করে কামড়িয়ে খেতও।

ওর মা মাঝে মাঝে ডাক দিয়ে বলত, এই বিলটু, মামা কে বিরক্ত করিস নে।

না, সে বিরক্ত করতো না, শুধু চেয়ে থাকতো আমার দিকে। মায়াময় চেহারা।

স্কুল থেকে এসে ওকে নিয়ে যেতাম মাঠে। ও বসে থাকতো। আমরা ফুটবল খেলতাম।

একদিন সে চলে গেলো। চলে গেলো অনেক দুরে।

ওর মা র বিয়ে হোলও। দুরের এক গ্রামে।

গরুর গাড়ী এলো। ওরা উঠে বসলো। ওর মা কাঁদছে।

ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কি যেন বলতে চাইছে।

চোখের পানি মুছে ওকে যেয়ে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, তোকে আমি নিয়ে আসবো ওই গ্রাম থেকে।

না, আর আনা হয়নি। আর দেখা হয়নি।

এখনো সেই ছোট্ট দাঁত দিয়ে কুচকুচ করে বিস্কিট খাওয়া আমার চোখের সামনে ভাসে।

এতদিনে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে বিলটু। আমার কথা হয়ত তার আর মনে নেই।   

  -মামা, কি ভাবছ? তোমার না রেডি হয়ে থাকার কথা।  নৃত্যাঞ্চল গোষ্ঠীর নাচের অনুষ্ঠান দেখতে যাবো?

-তাইতো? বলে তাড়াতাড়ি হাতের কাছে যা পেলাম পড়ে নিলাম।

-একি? এই বেশে যাবে নাকি তুমি? পাঞ্জাবি নাই? বলে তাকালও আমার দিকে।

– পাঞ্জাবি আনবো কেনও এখানে। আমি কি বিয়ে বাড়ীতে যাবার জন্য এসেছি নাকি?  হাসতে হাসতে বললাম তাকে।

বেরিয়ে গেলো সে ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো একটা পাঞ্জাবি নিয়ে। লালের উপর কাজ করা।

-এই কটকটে লাল আমাকে মানাবে না। আমার বয়স টা কত তা তুই জানিস? বললাম,

কিন্তু কে কার কথা শোনে। অগত্যা ওটা পড়েই রওয়ানা দিলাম।

সুন্দর একটা অনুষ্ঠান দেখে যখন বের হলাম তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই।

অনেক কে সে চেনে, তাই হাই, হ্যালো বলতে বলতে আরও কিছুটা সময় ব্যায় হোলও।

-তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে এক বন্ধুর বাসাতে যেতে হবে। বলে সে রিক্সার উদ্দেশে হাত উঠালো।

আমি একাই চলে যেতে পারবো বলতেই সে ধমকের সুরে বলল, জানো, এখানে কতকিছু ঘটছে ইদানীং?

আমার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগলো। বললাম, এখানে আমার জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি তা জানিস।

অগত্যা সে একটা রিক্সা ঠিক করে দিল। বলল, পৌছিয়েই যেন আমি তাকে কল করি।

রিক্সা ডিমে তেতালে চলেছে। আমারও তাড়া নেই। চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি। যে শহর ছেড়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছে এই শহর সেই শহর নয়। অনেক নতুন নতুন রাস্তা, নতুন নতুন দোকান পাঠ। চেনা শহর অপরিচিত মনে হচ্ছে।

বড় রাস্তা থেকে রিক্সাটা ঢুকে গেলো এক গলিতে। ছোট,চিপা রাস্তা। দুদিকে নর্দমা।  এ কোথায় এলাম। কোথা দিয়ে সে নিচ্ছে আমাকে। জিজ্ঞাসা করতে যেয়ে থেমে গেলাম। পাছে সে বুঝতে পাড়ে আমি এখানকার বাসিন্দা না।

মনে পড়ল, কে যেন বলেছিল, অনেক কিছু ঘটতে পাড়ে, Ransom, খুন খারাবি।

সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞাসা করলাম, ঐ বড় রাস্তা ছেড়ে এই গলিতে ঢুকলে কেন?

-ওই দিকে রাস্তা বন্ধ স্যার। আপনি হুড টা উঠিয়ে শক্ত করে ধরে রাখেন। সামনে আবার ঐ মানে—

ঠিক সেই সময় ফোন টা বেজে উঠল। অনীকা কল করেছে।

-মামা কোথায় তুমি?

-জানিনা।

-জানিনা মানে? উৎকণ্ঠা জড়িত স্বরে জানতে চাইল।

-ইংরাজি তে বললাম, গলিতে? যাতে রিকশাওয়ালা বুঝতে না পাড়ে আমার মনে ভয়ের সঞ্চারের হয়ছে। 

-গলিতে? ঠিক আছে তুমি কথা বলতে থাকো। আর চারিদিকে নজর রাখো।

আমি তাই করলাম। হঠাৎ পাশের দোকান থেকে দুটো লোক দৌড়ে এলো। সামনে এগিয়ে যেয়ে পিছনে ফিরে তাকালও।

– এই এই এখনি ওরা আমাকে ধরবে। গলা দিয়ে যেন স্বর বের হচ্ছে না।

-কারা তোমাকে ধরতে যাচ্ছে? তুমি কি—

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই রিকশাওয়ালা বললও,

– স্যার, এই জাগাটা সুবিধার না। বলে একবার পিছনে ফিরে তাকাল সে।

আমার আত্মা তখন গলার কাছে।  

ঝম করে শব্দ হোলও। আমি চিৎকার করে পড়ে যেতে যেতে সীটের পাশটাকে জোড়ে চেপে ধরলাম।

-আমি বলেছিলাম না স্যার এই জাগাটা সুবিধার নয়। গর্ত আছে।  সেই জন্য আপনাকে বলেছিলাম শক্ত করে ধরতে।

ঐ যে, ঐ যে, আমরা বড় রাস্তায় এসে গেছি স্যার। বাঁক নিলেই আপনার বাসা।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার।

ফিরে এসেছি আমি। এয়ারপোর্টে সেই এসেছিল আমাকে বিদায় দিতে। বলেছিল, ছোটমামা আবার কবে আসবে।

-জানিনা।

ওর চোখ টা ছলছল করে ছিল হয়ত। প্রকাশ করতে দেইনি।

প্রায় ম্যাসেঞ্জারে কথা হয়। ভালোই আছে। ব্যাস্ত। সামনে পরীক্ষা।

এলো করোনাভাইরাস। দেশে দোকান পাঠ, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলো। দিন আনে দিন খায় যারা তাদের ঘরে নাই চাল, নাই ডাল। বেরাল,কুকুর রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, খাবার পায় না।

 আমরাও এখানে বন্দী।

 হঠাৎ ই দেখলাম ফেসবুকে অনীকা আর কয়জন মিলে খুলেছে একটা সংস্থা। দেশের এই পরীস্থীতে গরীব আর পশু প্রানীদের সাহায্যার্থে।

নাম দিয়েছে এক বেলার অন্নপূর্ণা।

ও আমার কাছে চায়নি। আমিই পাঠিয়েছিলাম আমার সাধ্যমত।

প্রতি উত্তরে সে লিখেছিল,

 ধন্যবাদ ছোট মামা! তোমার পাঠানো এই উপহার যে কত মানুষ ও প্রাণির কাজে লেগেছে! তোমার এই উপহার কাজে লেগেছে একজন দিনমজুরের, একজন গাড়ি হেল্পারের, জাহাংগীরনগরের চা ভাই কালাম ভাইয়ের,রাজশাহীর প্রাণিকল্যাণকারী এক গ্রুপের আর এক মায়ের ডায়ালিসিসে।

চোখে জল এলো।

এরা আছে বলেই দেশটা আজও সুন্দর।

মনে মনে বললাম, ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস।

 উপরওয়ালাই তোকে পুরস্কার দেবে।

Continue Reading