এসো, আবার মিলিত হই- শেষ

   সাতদিন পর।

সকাল নয়টা।

 শেখর উপর থেকে নেমে এলো। সেই অসহ্য যন্ত্রনা করা ব্যথাটা নেই। শেখর হাটতে পারছে। কাঁটা ছেড়ার জায়গা টায় এখনো ব্যাথা। না থাকার কথা নয়।

তনুজা বলেছে, আর যাই করো নিজের বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভেবো না। একটু সুস্থ হয়ে নাও।

ডাক্তার বলেছে, সময় দিতে হবে। আস্তে আস্তে এক পা দুই পা করে এগোতে থাকো।

শেখর নাস্তা শেষে বেড়িয়ে এলো রাস্তায়, করোনার ভয়ে লোকজন খুব একটা রাস্তায় নেই। মুখে মাস্ক পড়ে, মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে দুই এক পা যেতেই ফোন টা বেজে উঠলো।

শেখর হেড ফোন টা কানে লাগিয়ে নিলো।

-কোথায় তুমি? জিজ্ঞাসা করল সে

-রাস্তায়।

-রাস্তায়? মানে? আতঙ্কিত স্বরে বলল সে।

-হাটতে বেড়িয়েছি। দেখি কত টুকু পারি।

-এতো তাড়াতাড়ি না বের হলেই কি নয়?

-ঠিক বলেছ, মনে হচ্ছে না আমি এখনো প্রস্তুত। একটু টান লাগছে পা টা তে। বলল শেখর।

কথা বলতে বলতে বাসার সামনে রাখা চেয়ার টা তে বসলো।

কতদিন এইভাবে তাকে চলতে হবে কে জানে।

-ডাক্তারের কাছে কবে যাবে? জিজ্ঞাসা করল ওপাশ থেকে।

-আরও এক সপ্তাহ পড়ে। উত্তর দিল শেখর।

-শোন, আগামীকাল তোমার খোঁজ নেওয়া হবে না। ব্যস্ত থাকব। সাবধানে থেকো। বলে ফোন টা রেখে দিলো সে।

কথা শেষে শেখর বসে বসে ভাবছিল ফেলে আশা দিনগুলোর কথা।

নিউইয়র্কে ফিরে এসে শেখর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কাজ নিয়ে। হঠাৎ এক সকালে কল এলো ।

-খবর কিন্তু আমিই নিলাম, চিনতে পারছেন?

– অত্যন্ত লজ্জিত, কল করব করব করে আর করা হয়নি। কথাটা সত্যি না, তাও বলল শেখর।

সেটা বুঝতে ওপাশের ( দুই ভুরুর মাঝে তিল, যেটা কিনা প্রথমে শেখর মনে করেছিল টিপ), সেই ভদ্রমহিলার দেরী হয়নি।

ফোনের ওপর প্রান্তে মৃদু হাসি।

-সত্যি বলতে কি, আপনি না সত্য কথা, সত্য করে বলতে পারেন না। বলে আবারও হাসল সে।

শেখর হেসে বলল, ক্ষমা চাইছি, যদি কিছু মনে না করেন দেখা হবে কি?  

-আগামী কাল সন্ধ্যা ছয়টায়। কোন রকম সংকোচ না করেই রেস্টুরেন্টের নাম টা বললও ভদ্রমহিলা।

শেখর একটু আগেই এসেছিল। কর্নারের একটা টেবিল নিয়ে বসলো। ওখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। আগে কখনও এখানে আসেনি।

শেখর খুব একটা রেস্টুরেন্টে খেতে আসে না। বন্ধু বান্ধব নিয়ে বেশির ভাগ সময় বাসাতেই আড্ডা দেয়।

হাত ঘড়িটা দেখল শেখর। পাঁচ মিনিট পেড়িয়ে গেছে।

-সরি, একটু দেরী হয়ে গেলো।

মুখ তুলে তাকালও শেখর। ট্রেনে দেখা চেহারার সাথে মেলানোর চেষ্টা করল। সেদিনের সেই পটভূমিকাতে ওই রূপটা মানিয়ে ছিল।

আজ ভিন্ন, চুলটা উপরে উঠিয়ে বাঁধা। মার্জিত ভাবে সাঁজা মুখমণ্ডল। দেখে ভালো লাগলো শেখরের। গলায় টপসের সাথে  ম্যাচ করে স্কার্ফ বাঁধা।

-কি ব্যাপার? কি ভাবছেন। চেয়ার টা টেনে বসতে বসতে বলল সে।

-ভাবছি—কথা শেষ হওয়ার আগেই ওয়েটার এসে পাশে দাঁড়ালো।

মেন্যু টা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কোন ড্রিঙ্কস খাবে কিনা।

-ক্লাব সোডা। বললও সে

শেখর অর্ডার দিলো ডায়েট কোক।

নিতান্তই সাদাসিধে কথা বার্তা দিয়ে শুরু।

শেখর জানে প্রথম পরিচয়ে কারোর পেশা বা কোথায় থাকা হয় এসব নিয়ে আলোচনা নয়।

 আলোচনা করো, মুভি বা নতুন কোন নেটফ্লেক্সে আসা সিরিজ নিয়ে অথবা খেলাধুলা (যদি সে ইনটারেস্টেড হয়)।

কথাবার্তার মোড় ঘুরে গেলো যখন সে শেখর কে জিজ্ঞাসা করলো, তার বাসাতে কে কে আছে।

শেখর বলেছিল, সে একেলা, মেয়ে বড় হয়ে চলে গেছে তার পথে।

কথার প্রসঙ্গে কথা বলতে হয়, তাই জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার?

-আপনার মতোই একেলা, তবে ঐ পথে পা বাড়াইনি। বলতে পারেন, ক্যারিয়ার নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলাম যখন চোখ তুলে চাইলাম, দেখলাম, সময় পেড়িয়ে গেছে। 

কতক্ষণ সেদিন বসেছিল আজ শেখর মনে করতে পারল না। 

তারপর প্রতি সপ্তাহে এক দুইবার দেখা হয়েছে। বসেছে কোন নদীর পাড়ে অথবা গাড়ীতে করে চলে গেছে দুরে।  

আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে।

 ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।

 একে অপরের খোঁজ নিয়েছে প্রতিদিন। 

তনুজার ডাকে ফিরে তাকালও শেখর। তনুজা বলল ও একটু বাহিরে যাবে, কাজেই শেখর যেন ভিতরে চলে আসে।

ভিতরে আসতেই দেশ থেকে কল এলো। শেখরের বোন। খবর দিল অতি পরিচিত একজন চলে গেলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। বড় ভাবীর ছোট মামা। দেশে থাকতে শেখরের সাথে কথা হতো। যাওয়া আসা ছিল।

চেহারাটা মনে পড়লো শেখরের। আরও কতজন হয়তো চলে গেছে, সে জানে না।

শেখরের মনে হোলও এবার বাসাতে ফিরে গেলে একটু অসুবিধা হবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে। অনেকদিন আছে মেয়ের কাছে।

ডিপেনডেন্ট হয়ে পড়েছে সে।

বলেছিল সে, পারবে তো বাসায় যেয়ে সবকিছু করতে। নাকি আমাকে এসে সাহায্য করতে হবে?

তুমি এলে তো মন্দ হয় না। সকালে এসে সন্ধ্যায় চলে গেলে। বলেছিল শেখর হাসতে হাসতে।

-আসবো। বন্ধুর জন্য এইটুকু না করলে চলে। ফোনে বলেছিল।

দুইদিন ওর কোন কল এলো না।

শেখর উদগ্রীব হয়ে কল করলো।

ওর গলার স্বর ভারী। দুই একবার কাশলো।

-কি হয়েছে? কল করনি কেনও? জিজ্ঞাসা করলো শেখর।

– তোমার এই অবস্থায় আমি তোমাকে দেখতে যেতে পাড়লাম না। পাছে কিছু হয় তোমার। আর আজ তোমার ইচ্ছে থাকলেও আমাকে দেখতে আসতে পারবে না।

-কি হয়েছে? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো শেখর।

-আমাকে ভর্তি হতে হবে হাসপাতালে। বলল কান্না ভরা গলায়।   

শেখরের মনে হোলও পৃথিবীটা দুলছে।

-আসবো, আমি তোমার বাসাতেই দেখা করতে আসবো। চোখ টা মুছে বলল শেখর।

-তাই যেন হয়।

সেই শেষ কথা হয়েছিল শেখরের সাথে ওর।

Continue Reading

এসো, আবার মিলিত হই- ৩

(আগের পর্বেঃ 

Operating room.

চারিদিকে তাকাল শেখর।

পাশের দেওয়ালে বিরাট সাদা পর্দার উপরে ওর MRI এর ছবি। যেখানে সার্জেন কাঁটা ছেড়া করবে।

ডাক্তার ম্যেনডেলবাম কে কোথাও দেখল না শেখর।

একটা নার্স এগিয়ে এলো শেখরের কাছে, জিজ্ঞাসা করল নাম, জন্ম তারিখ। কেমন ফিল করছে। আরও সব কথা, যার কোন মানে নেই। শেখর কথা বলতে চাইছে, কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

তারপর।

তারপর, শেখর আর কিছু জানে না। )

      চোখ মেলে চাইল শেখর। মনে করতে চাইল কতক্ষন সে ঘুমিয়ে ছিল।

সেই নার্সটা। কি যেন বলছিল।

তারপর সব হারিয়ে গেল। কোথায় সে এখন? চারিদিক পর্দা দিয়ে ঘেরা। স্যালাইনের ব্যাগ টা এখনো ঝুলছে।

-How do you feel?

পাশ ফিরে তাকালও শেখর।  

-আমি কামিনী । আবারও জিজ্ঞাসা করল, How do you feel?

-ভালোই মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। কতক্ষণ আমি এইখানে? শেখর জানতে চাইল।

-প্রায় ঘণ্টা খানেক। আর একটু পরে তোমাকে নিয়ে যাবো তোমার প্রথম জায়গাতে। কিছু খাবে? অনেকক্ষণ তো না খেয়ে আছো।

শেখর কি যেন বলতে চাইল, না বলে সে কামিনীর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল, কার চোখের সাথে যেন মিল আছে। মনে করতে চাইল শেখর। ওর কণ্ঠস্বরে কেমন যেন এক মাদকতা।   

-হ্যালো? কি দেখছ?

– খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে।

-তাই? হয়ত বা। একি কন্টীনেন্টের ? তাই না? এখন বলও, কি খাবে? এগ স্যান্ডউইচ?

-মন্দ না। কফি হবে কি? শেখর জানতে চাইল।

কামিনী উঠে গেল।

শেখর উঠে বসতে চাইল। মাথা টা ঘুরে গেলো।

কামিনী এলো কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে।

-ওঠো।

-উঠতে চেয়ে ছিলাম, মাথা ঘুরে গেলো।

-Are you out of your mind? Never do it. পড়ে গেলে সব শেষ। কফি আর স্যান্ডউইচ টা রাখতে রাখতে বলল কামিনী।

-I know, লজ্জিত স্বরে বললও শেখর।

কামিনীর হাত ধরে উঠে বসল শেখর। বিছানা টাকে সোজা করে পিছনে বালিশ দিয়ে দিলো কামিনী।

-Make sure don’t try to do any advanturous thing. I will be right back.বলে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো কামিনী।

স্যান্ডউইচ টা শেষ করে কফিতে চুমুক দিলো শেখর। নাহ, চিনির পরিমাণ টা একটু কম।

ঠোঁট পোড়ান গরম কফি খেয়ে অভ্যাস শেখরের। সে রকম নয়। তবুও এই মুহূর্তে ওটাই অমৃত মনে হোলও।

চলো, কামিনী নিয়ে এলো শেখর কে সেই cubicle রুমে। প্রথম দেখা নার্স. অপেক্ষা করছিল শেখরের জন্য।

এবার ফিরে যাবে বাসাতে।

 শেখর, ফোন টা দেখল। কোন কল আছে কি না।

কল করলো তনুজাকে।

-হাফ এন আওয়ার লাগবে।বলল তনুজা।

-ঠিক আছে।

চারিদিকে তাকালও শেখর। আস্তে আস্তে নেমে এলো বেড থেকে। নার্সের হাত ধরে হাঁটল কিছুক্ষণ। মাথাটা টলকায় কিনা দেখতে চাইলো নার্স।

হাটতে অসুবিধা হচ্ছে না এই মুহূর্তে। তবে এনেসথেসিয়ার action আস্তে আস্তে চলে গেলে ব্যথা ফিরে আসবে. বলেছে ডাক্তার।

নেই সেই মরন কামড়ানো ব্যথা টা।  

তনুজার কল এলো।

হুইল চেয়ারে বসিয়ে শেখর কে বাহিরে নিয়ে এলো নার্সটা।  

গাড়ীতে উঠতে অসুবিধা হলনা।

-কেমন ফিল করছ বাবা। জিজ্ঞাসা করল তনুজা।

-আগের থেকে তো ভালো। বলে ফোন টার দিকে তাকাল শেখর।

ফেভারেটের তালিকা থেকে নামটা বেছে নিলো।

কল করতেই, 

-কোথায় তুমি? অপারেশন হয়ে গিয়েছে? ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠা স্বরে জিজ্ঞাসা করল।

-গাড়ীতে, বাসার দিকে যাচ্ছি। বলে পাশ ফিরে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকাল, মাজায় একটু ব্যথা অনুভব করলো শেখর।

-মেজর সার্জারি, সাবধানে থাকবে। তুমি তো আবার—-, শোন, একেবারে রেস্টে থাকবে। কেমন আছো টেস্ট করে জানিও। বেশি কথা বলা উচিৎ হবে না। উপদেশ দিলো ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।

-নেও ঠেলা, এক ডাক্তার ছেড়ে আরেক ডাক্তারের পাল্লায় পড়লাম। হাসতে হাসতে বলল শেখর। হাসতে গেলে একটু ব্যথা লাগছে মনে হোল। সেটা আর শেখর প্রকাশ করলনা।

-এখন রাখি।

-আচ্ছা বলে শেখর ফোনটা রেখে দিলো।

একটার পর একটা টেক্সট আসছে। বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই শেখরের। সবাই শুভকামনা করেছিল আসার আগে। বলেছিল, অপারেশন সাকসেসফুল হোক এই কামনা করি। দুই একটার উত্তর দিতে যেয়ে চোখ টা জড়িয়ে এলো।

না, এখন আর নয়, ফোন টা বন্ধ করে দিল শেখর।

বাসায় এসে টিভি টা খুলে বসল, চারিদিকে মিছিল, George Floyd এর মৃত্যু কে কেন্দ্র করে।

Minneapolis পুলিশের হাতে George Floyd এর মৃত্যু।

George Floyd কৃষ্ণাঙ্গ।  

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণ বৈষম্য এবং সহিংসতার ইতিহাস বেশ পুরানো।

বড় বড় সিটি গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। শেখর বসে বসে সেই খবর দেখছিল। ভাবছিল, গায়ের রং নিয়ে মানুষের মনে এতো বিদ্বেষ কেন?

স্রষ্টা তো এক জন। বৈষম্য নীতি তো সেখানে নেই। সাদা বলে অগ্রাধিকার পাবেনা।

করোনাভাইরাস, কারফেউ, লুটপাট, বন্দুকের গুলি, টিয়ার গ্যাস। পৃথিবী যেন ধ্বংসের পথে।

অনেক কিছুই মাথার মধ্যে এলো, গেলো শেখরের।

এনেসথেসিয়ার action আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। কাজেই মনোযোগ দিয়ে সংবাদ গুলো শুনতে, দেখতে চাইলেও মনটা চাইছে না। মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্ত থেকে এঁকে বেকে ব্যথা টা নিজের খুশিমত বেয়ে চলেছে পায়ের শেষ প্রান্তে। মাঝে মাঝে কামড় দিয়ে যাচ্ছে মাংসপেশীতে।

Spine এর শেষ প্রান্তে দুই ইঞ্চি কেটে ভিতরের নার্ভের জায়গাটাকে পরিষ্কার করে দিয়েছে, যাতে নার্ভের উপর আর চাপ না পড়ে। অপারেশনের পড়ে কিছুদিন ব্যথা থাকবে বলেছিল নিওরও সার্জেন।

সেই কিছুদিন কতদিন?

শেখরের আর কিছুই ভালো লাগছে না।

 অনেকদিন হোলও বন্ধুদের সাথে দেখা নেই। ফোনেই শুধু কুশল সংবাদ দেওয়া নেওয়া চলছে।

এখনকার অবস্থা ভালো থাকলে এই সময়ে তার থাকার কথা মায়ামিতে। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। সবাই মিলে হৈ হৈ করে যাওয়ার কথা ছিল। বারো, তেরো জন থাকবে এক জায়গায়। কতই না মজা হবে। সানফ্রানসিসকোর থেকে সিলভার আসার কথা। বছর দেড়েক হয়ে গেলো ওর সাথে দেখা হয়েছিল। অনেক আনন্দ করেছিল শেখর সেইখানে।

সব গেলো বেহেশতে।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল শেখরের মনে নেই। তনুজার ডাকে উঠল।

সন্ধ্যা  হয়ে এসেছে।

-এই নাও তোমার কফি, খেলে ভালো লাগবে। আর তোমার ফোন তো বেজে চলেছে।

বাংলায় নাম লেখা। বলে কাপটা এগিয়ে দিলো।

শেখর দেখল নামটা।

দেখা হয়েছিল হাই স্পীড ট্রেনে। মস্কো থেকেসেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার পথে। কফির পিপাসা পেয়েছিল শেখরের অনেকক্ষণ। উঠে একজন কে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, চার, পাঁচ টা রুমের পরেই কফির ব্যবস্থা আছে।

ধন্যবাদ বলে, এগিয়ে গেলো শেখর।

সব কটা টেবিলেই লোক, শুধু একটা টেবিলে একটা চেয়ার খালি, এক ভদ্রমহিলা বসে আছে। কাজই কফি আর একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছিল।

-কিছু যদি মনে না করেন এই চেয়ার টায় বসতে পারেন। ভদ্রমহিলা শেখরের দিকে তাকিয়ে বলল কথাটা।

স্যান্ডউইচ আর কফি টা নিয়ে ধন্যবাদ বলে চেয়ার টা টেনে বসলো।

-আমি শেখর বলে হাত টা বাড়িয়ে দিলো।

কোন রকম দ্বিধা না করে ভদ্রমহিলা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম—-

চোখে চোখ রেখে, কফি তে চুমুক দিতে দিতে অনেক কথা হোলও। ভদ্রমহিলা একাই এসেছে, সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে যাবে মস্কো তে, সেখান থেকে ফিরে যাবে নিউইয়র্কে।

 -বাহ, আমারও ডেসটিনেশন নিউইয়র্কে। তবে আমি ফিরে যাবো এখান থেকে। সময় টা ভালোই কেটে গেলো, কি বলেন?

– অবশ্যই।

– নিউইয়র্কে কি দেখা হওয়ার সম্ভবনা আছে? প্রশ্ন টা করেছিল শেখর।

-কেন হবে না? বলে ফোন নাম্বার টা একটা ন্যাপকিনের উপর লিখে শেখরের হাতে দিলো।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্রেন সেন্ট পিটার্সবার্গ ষ্টেশনে পৌছাবে।

উঠে দাঁড়াল দুজনে।

ভদ্রমহিলা তার ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো।

আবারও হাতে হাত মিলালো দুজনে।

দেখা হবে নিউইয়র্কে,বলে ভদ্রমহিলা এগিয়ে গেলো।  

সেই পুরানো ঘটনা টা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

মনে মনে হেসে ডায়েল করলো শেখর।

[চলবে]

Continue Reading

এসো, আবার মিলিত হই- ২

       বৃষ্টি আস্তে আস্তে থেমে এলো। শেখর তখনো দাড়িয়ে জানালার পাশে।

-আব্বু কফি বানিয়েছি, খাবে এসো। বলে ডাক দিলো তনুজা।

শরীর টাকে বাকিয়ে ফিরতে যেয়ে ব্যাথায় টনটনিয়ে উঠল পা টা। পড়ে যেতে যেয়ে পাশের সোফাটা আঁকড়িয়ে ধরল। সোজা হয়ে দাঁড়াল শেখর। সে জানে একবার যদি পড়ে যায় তাহলেই শেষ। বয়স কালের এই দোষ। মাজার হাড় আস্তে আস্তে খয়ে গেছে। যতই ক্যালসিয়াম আর হাড়ের ডেনসিটি বাড়ানোর ঔষধ খাওনা কেনও যা চলে গেছে তা আর ফিরে আসবেনা। কাজেই ওসবের ধাঁর ধারে না সে।

-আসছি মা, বলে  পা টা টেনে টেনে এসে টেবিলে বসলো।

অনেক কিছু বানিয়েছে তনুজা। পিঁয়াজু, পাকোড়া, ছোলা ভাজী,বেগুনী, আর সাথে মুড়ি তো আছেই।

 রোজা চলছে।

রেজোয়ান প্রতিটি রোজাই রাখছে।  

শেখর রেখেছিল তিনটা, প্রতি বছরই সে সব কটা রাখে, এবার পাড়লও না।

দুই মিনিট এখনও বাকি সন্ধ্যা হতে।

কফিটা ঢালতে ঢালতে তনুজা বলল, আর একটা সপ্তাহ তারপরেই তো  তোমার সার্জারি। ডাক্তার তো বলেছে তুমি আবার আগের মতো হাটতে পারবে। সব ব্যাথা চলে যাবে।

-সেই আশাতেই তো আছি। কফিতে দুধটা ঢালতে ঢালতে বলল শেখর। সময় হয়েছে কি রোজা ভাঙ্গার। রেজোয়ানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

যদিও সে রোজা রাখেনি তবুও নিয়ম কিছুটা মানতে হয়।

-হাঁ বাবা।

পিঁয়াজুতে কামড় দিয়ে, কফির কাপ টা মুখের কাছে উঠিয়ে আনল শেখর।

ফোনটা বেজে উঠল। শেখর এক নজর দেখে উঠিয়ে নিলো ফোন টা।

নামের তালিকাতে বাংলায় লেখা নাম।

-কফি নিয়ে বসেছ? ওপাড়ের কণ্ঠস্বর শেখরের চেনা। 

-শুধু কফি নয়, সাথে অনন্যাও অনেক মুখরচক খাবার। তনুজা বানিয়েছে, বলে তাকাল শেখর।

-তনুজার গুনের অন্ত নেই। ব্যথাটা কেমন? ওপাশ থেকে জিজ্ঞাসা করল।

শেখর হেড ফোন টা কানে লাগিয়ে বলল, গতকাল যা শুনেছিলে তার চেয়ে বেড়েছে।

-ধৈর্য ধর, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তো কটা দিন। এখন ওদের সাথে সময় দাও, আমি এখন রাখি, নামাজ পড়তে হবে। পরে কথা হবে।  

 শেখর কান থেকে হেড ফোন টা খুলে টেবিলে রেখে দিয়ে একটা বেগুনী উঠিয়ে নিলো।

তনুজা কি যেন বলতে যেয়ে থেমে গেলো।

এবারের ঈদের নাম দিয়েছে করোনাভাইরাস ঈদ। ঈদের নামাজ হবে যার যার ঘরে। কোলাকুলি নেই, নেই হাত মিলানো। ওটাই তো ছিল ঈদের আনন্দ। যাওয়া হবে না কারো ঘরে, আসবে না কেউ।

 চেয়ারে বসে ঈদের নামাজ শেষে, তাকিয়ে ছিল জয়পুর থেকে আনা

লক্ষ্ণৌ স্টীচের কাজ করা পাঞ্জাবী তার দিকে।

  এইতো কিছুদিন আগেই না ওরা গিয়েছিল ইন্ডিয়াতে। সতেরো দিন ঘুরে বেড়িয়েছিল রাজস্থানের বিভিন্ন শহরে। জয়পুর, উদয়পুর, আরও কত শহর।

 তখন কি ভেবেছিল যে পা দুটো দিয়ে সে উঠেছে পাহাড়ে, হেঁটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই পা দুটো আর পারবেনা এই ভর সইতে।  

-বাবা কবরস্থানে যেতে হবে, তৈরী হয়ে নাও, তনুজার ডাক শুনে উঠিয়ে নিলো পাঞ্জাবিটা।

দাড়িয়ে উঠে পড়তে যেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট টা কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করলো শেখর।

ফোন টা কাঁপছে। শেখর তাকালও ফোনটার দিকে।

হ্যালো!

-কাপড় পড়তে নিশ্চয় অসুবিধা হয়েছে?

-বুঝলে কি ভাবে?

-এইটুকু বুঝতে পারার মত বয়স আমার অনেক আগেই হয়েছে।  বলে হাসল ফোনের ওপর পারের সেই জন। ও, বলতেই তোঁ ভুলে গেছি, ঈদ মোবারক।
– ঈদ মোবারক। শেখর এই ব্যাথার মাঝেও যেন একটু শান্তি খুজে পেলো।

-আজকের প্রোগ্রাম কি তোমার? 

– কবরস্থানে যাবো, সেখান থেকে যেতে হবে তনুজার শ্বশুর বাড়ি। বলেছে, সোশ্যাল ডিসটেনস রেখে বসবো সবাই।  শেখরের কথা শেষ হতে না হতে তনুজা আবার ডাক দিল।

– তোমার মেয়ে ডাকছে । পরে কথা হবে, বলে ফোনটা রেখে দিল ওপর পারের সেই জন।

রৌদে ঝলমল দুপুর। সবাই এসেছে তাদের আপনজনের কবর যিয়ারত করতে।

শেখর তাকাল চারিদিকে। উচু ঢিপের সংখ্যা অনেক। করোনাভাইরাসের প্রতিফলন কিনা কে জানে। জানাশোনা অনেকেই চলে গেছে ওপারে।

তাকাল মাটির দিকে, যেখানে শুয়ে আছে তার আপনজন।

আঙ্কেল?

ডাক শুনে তাকাল পাশে। সাজীদ দাড়িয়ে কিছু দূরে ।ওর তার দেড় মাসের বাচ্চা টা শুয়ে আছে কিছু দূরে।

-ঈদ মোবারক। আঙ্কেল।  

-ঈদ মোবারক।

এসেছে কিরণ,জসীম, অরুন, রতন, সেন্টু। শেখর চেনে এদের কে। পরিচয় হয়েছিল অনেক আগে। এক সময় দহরম মহরম ছিল, আজ তা ভাটার টানে।  এখন আর দেখা সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। 

-কেমন আছেন? রতন জিজ্ঞাসা করল।

হাটতে হাটতে উত্তর দেওয়ার আগেই আবারও জিজ্ঞাসা করল রতন, ও ভাবে পা টেনে হাঁটছেন কেন?

শেখরের এই মুহূর্তে এর বিশ্লেষণ করার মানসিকতা নেই, ঈদের আনন্দ টাকে মাটি করতে চায়না। বলল,

-না ভালোই আছি। বলে অনেক কষ্টে গাড়ীতে উঠে পড়লো।

-বাবা, তোমার কি বেশি কষ্ট হচ্ছে? উৎকণ্ঠা ভরা কণ্ঠ তনুজার।

-না, মা, এইটুকু তো হবেই।  

তনুজা যদি তাকাত  শেখরের মুখের দিকে, দেখতে পেতো, শেখরের মুখের পেশী গুলো যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে, দেখতে পেতো কপালে ঘাম, আর শুনতে পেতো  দ্রুত নিশ্বাসের শব্দ। সেই শব্দ মিলিয়ে গেলো খোলা জানালা দিয়ে বাহিরের বাতাসের মাঝে।

বাহিরে বসার আয়োজন করেছে সানু ভাই আর নিশাত ভাবী।

অন্যবার এই দিনে ওদের বাসায় তিল ধরনের জায়গা থাক তো না। আসতো নিশাত ভাবীর সব ভাই, আসতো সানু ভাইয়ের বন্ধুরা। আজ শুধু শেখররা তিনজন।

কি কি রান্না করেছ ভাবী? শেখর প্রশ্ন করেই তুলে নিলো একটা জিলাপি। ওটা শেখরের খুব প্রিয়।

বেশি কিছু করিনি? কেউ তো এবার আসবে না। তুমি আগেই জিলাপি খাচ্ছও কেনও? বলে একটা কৃত্রিম ধমক দিলো ভাবী।

অনেক কিছু করেছে ভাবী। শেখর শুধু খাসীর বিরিয়ানি নিয়ে একটু দুরে যেয়ে বসল।

-তোমার অপারেশন যেন কবে? প্রশ্ন করে সানু ভাই এসে বসল দুরত্ত রেখে।

– আগামী সপ্তাহে মনে হয়। আশা করি এই nightmare থেকে মুক্তি পাবো। বিরিয়ানি টা চাবাতে চাবাতে বলল শেখর।

-ইনশাল্লাহ!  

বাসায় যখন ফিরে এলো তখন শেখরের সারা শরীর ব্যথায় ভেঙ্গে পড়ছে। দুটো ব্যথার ঔষধ মুখে পুড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো।

এক একটা দিন যেন এক একটা মাস মনে হোলও শেখরের কাছে।

শুধু অপেক্ষা।

কবে স্টেফিনি,ডাক্তার ম্যেনডেলবামের সেক্রেটারি, কল করে বলবে তোমার সার্জারির দিন অমুক তারিখে।

সেইদিন টার অপেক্ষায় শেখর।

ক্রীং ক্রীং করে ফোনটা বেজে উঠল। মাহতাবের ফোন।

হ্যালো!

-খবর শুনেছিস? মাহতাব জিজ্ঞাসা করল শেখরকে।

-কি খবর?

– এনাম ভাই মারা গেছে। আর খোকা ভাই ICU তে। অবস্থা ভালো না শুনেছি। মাহতাবের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো শেখর।

দুজনেই শেখরের খুব প্রিয়জন ছিল । এদেশে একই সময়ে এসেছিল ওরা।

একই  ডিপার্টমেন্টে পড়াশুনা করেছে দেশে। এনাম ভাই দুই বছরের আর খোকা ভাই এক বছরের বড় শেখর থেকে।

বয়সের সাথে সাথে বড় ছোট কোন ভেদাভেদ থাকে না। হয়ে যায় বন্ধুর মতো।  

ঠিক এই রকমই হয়েছিল ওরা শেখরের সাথে।

এনাম ভাই চলে গিয়েছিল হিস্টনে। চোখের আড়াল তো মনের আড়াল। হোলও তাই। আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমে এলো।

অনেক দিন এনাম ভাইএর খবর শেখর আর পায়নি।

আজ হঠাৎ করে এই খবর নিয়ে এলো মাহতাব।

অফুরন্ত আনন্দের দিন গুলো যেন অনেক দুরে চলে গেছে,  ফুরিয়ে আসছে জীবন, কেন এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলো সময়। ভাবতে অবাক লাগছে শেখরের কাছে।

মনে পড়ল কবি তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এর সেই উক্তি,

“এই খেদ মোর মনে
ভালবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এ জীবনে।
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?”

আসলেই, এঁকে এঁকে অনেকই তো চলে গেলো। চলে গেছে শেখরের—–,

-বাবা, তোমার চোখে জল কেনও? তনুজা যে কখন ঘরে এসেছে জানতে পারেনি শেখর।

মাহতাবের দেওয়া খবর, নিজের শারীরিক অসুস্থতা, এইসব মিলে মনটা একটু অশ্রু ভরাক্রান্ত হয়েছিল হয়ত।

-আজ আর রাতে খাবো না মা, বলে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল শেখর।

ফোন টা উঠিয়ে ডায়েল করল। বাজতে থাকল ফোন টা। ভয়েসমেল। বন্ধ করে দিল ফোনটা। পাশে রাখা মিশেল ওবামার, Becoming বই টা উঠিয়ে নিলো।

পাতা উলটানোর আগেই ফোনটা বেজে উঠল।

-ভাইএর বাসায়। হৈ, চৈ এর জন্য শুনতে পাইনি। কোথায় কোথায় গেলে? সেই কণ্ঠ।

-শুধু এক বাড়ীতে।

-ব্যথাটা নিশ্চয় বেড়েছে, অনেকক্ষণ গাড়ীতে বসে ছিলে তারজন্য ? প্রশ্ন করলো সে।

-সেই জন্যই তো চলে এলাম।

-তাহলে এখন বিশ্রাম নাও, দেখো কাল সার্জেনের ওখান থেকে কোন খবর আসে কি না।

 শেখর ফোন টা রেখে দিয়ে বই টা উঠিয়ে নিলো হাতে।

অবশেষে স্টেফিনির কল এলো সকাল সাড়ে নয়টায়।

বলল, আগামী পরশু সার্জারি। তবে তার আগে  আগামীকাল Covid-19 এর টেস্ট করতে হবে। যদি নেগেটিভ আসে তবেই সার্জারি হবে, নচেৎ নয়।

যাক শেখরের দুশ্চিন্তা কেটে গেলো। টেস্ট নেগেটিভ।

ভোর ছয়টায় যেতে হবে।

-সার্জারির শেষে সময় করে জানিও। কলের অপেক্ষায় থাকব। বলে ছিল ভোর পাঁচটায়। সেই কণ্ঠ।

-আচ্ছা, বলে শেখর ফোনটা রেখে দিয়েছিল।

পর্দা দিয়ে ঢাকা  Cubicle emergency room.

হাসি দিয়ে বয়স্ক নার্সটা এসে শেখরের বা হাতে একটা পোর্ট তৈরী করলো স্যালাইন দেওয়ার জন্য। ছয় টা washing cloth দেখিয়ে বলল,

-এই পাঁচটা cloth দিয়ে শরীরের সামনে টা মুছে ফেলো, পিছন টা আমি মুছে দেবো, বলে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে পর্দা টা টেনে দিলো। 

সব শেষে ওদের দেওয়া গাউন টা পরে শুয়ে রইল শেখর।  

কেটে গেলো কিছু সময়।

“ Mr, Sekhor, now we are taking you to Operating room.” সুন্দরী এক নার্স এসে বলল শেখর কে।

Operating room শব্দটার মাঝে যেন একটা ভয়ার্ত কিছু আছে মনে হয়।

শেখর চোখ বুজে সবার মুখ গুলো মনে করার চেষ্টা করল।

সে ফিরবে তো?

আবার দেখতে পারবে কি ওই মুখ গুলো।

Operating room.

চারিদিকে তাকাল শেখর।

পাশের দেওয়ালে বিরাট সাদা পর্দার উপরে ওর MRI এর ছবি। যেখানে সার্জেন কাঁটা ছেড়া করবে।

ডাক্তার ম্যেনডেলবাম কে কোথাও দেখল না শেখর।

একটা নার্স এগিয়ে এলো শেখরের কাছে, জিজ্ঞাসা করল নাম, জন্ম তারিখ। কেমন ফিল করছে। আরও সব কথা, যার কোন মানে নেই। শেখর কথা বলতে চাইছে, কিন্তু কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

তারপর।

তারপর, শেখর আর কিছু জানে না।  

(চলবে)

Continue Reading

এসো, আবার মিলিত হই

         শেখর জানালা দিয়ে তাকিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছিল। এমন বৃষ্টি পড়া সে আগেও দেখেছে। আজ যেন একটু ব্যতিক্রম। বৃষ্টির দিনে অনেকের মন একটু ভরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। অনেকে কাগজ কলম নিয়ে বসে, অনেকে বলে আজ খিচুড়ি খেলে মন্দ হতো না।

শেখরের ওসব কিছুই মনে হচ্ছে না। তাকিয়ে ছিল সে বাহিরে দিকে। বৃষ্টির জল চুইয়ে পড়ছিল তার রাস্তার পাশে রাখা গাড়ি টি বেয়ে।

 আজকাল সে চালাতে পাড়ে না গাড়ীটা।

ডান পা টা ব্যথায় টনটন করে। মাজা থেকে পা পর্যন্ত। কোন রকমে পা টাকে টেনে এনে বসতে হয় চেয়ারে। অতি কষ্টে। বসার তারতম্য হলে চিৎকার করে ওঠে শেখর।

যে শেখর ঘুরতে ভালবাসে, যে শেখর অন্যদের কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে দেশের বাহিরে। সেই শেখর আজ চেয়ে থাকে অন্যের মুখের দিকে।

সইতে পারে না সে।

দুই মাস আগের এক সকাল।

 ঘুম ভেঙ্গে পাশের ঘড়ি টা হাতে নিয়ে দেখল সকাল নয় টা।

উঠতে হবে।

যেতে হবে পেনারা তে।

 আরও চার জন বন্ধু আসবে। নাস্তা খাবে আড্ডা দেবে।

রবিবার। কারো কাজ নেই।

ডান পা টা উঠাতে যেয়ে ব্যাথা করে উঠলো। পাত্তা না দিয়ে বিছানা থেকে নামতে যেয়ে পা টা রাখতে পারলো না মেঝেতে।

মনে হোলও শেখরের কে যেন ওর পা টাকে মাজা থেকে দুমড়ে মোচরে ছিড়ে আনতে চাইছে।

চিৎকার করে উঠলো শেখর। কেউ শুনল না ওর ডাক। পড়ে যেতে যেয়ে বিছানা টাকে খামচিয়ে ধরল।

দম নিয়ে আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল শেখর।

ডান পা টা দিয়ে মেঝের উপর চাপ দিয়ে দাঁড়াতে চাইলো সে।

 পারলো না। ব্যথায় কুচকে উঠলো সমস্ত শরীর।  

বেশ কিছুটা সময় পাড় হয়ে গেলো।

ব্যাথার প্রচণ্ডতা একটু কমে আসতেই আস্তে আস্তে হেটে এসে দাঁড়াল বাথরুমে। দাঁত মাজতে যেয়ে রেখে দিল ব্রাস টা।  বাথটাবে যেয়ে গরম পানি টা ছেড়ে দিল।

পানি টা আছড়ে পড়ল শেখরের মাজা তে। দাড়িয়ে রইল শেখর। এক দুই করে দশ মিনিট কেটে গেলো।

 ব্যাথা টা কমে এলো।

বেড়িয়ে এলো শেখর বাথরুম থেকে। দুটো টাইলিনল মুখে পুড়ে দিলো। ব্যাথার তীব্রতা কমে এসেছে।

হঠাৎ করে কেনও এমন হোলও বুঝতে পারলো না।

কবীর কল করছে। শেখর জানে কেনও। কোন সময় তার দেরী হয় না। ওরা অস্থির হয়ে গেছে।

আসছি, বলে ফোন টা রেখে দিলো।

দশ মিনিট পেড়িয়ে গেছে। যেতে লাগবে আরও দশ মিনিট।

কোন রকমে কাপড়টা পড়ে বেড়িয়ে পড়লো শেখর। গাড়ী চালাতে একটু অসুবিধা হচ্ছে মনে হোলও তার। মাজায় ব্যথা টা অতটা তীব্র নয়। তবুও মাঝে মাঝে নড়ে চড়ে বসতে হচ্ছে।

কি ব্যাপার? দেরী হোলও কেনও। তোমার তো দেরী হবার কথা নয়। বলে কফিতে চুমুক দিলো রফিক।

সকালের ঘটনা টা বলতেই বাবুল তার ডেনিশ টা অর্ধেক করে শেখরের প্লেটে দিতে দিতে বলল, কি বলও? তুমি যাচ্ছ প্রতিদিন জিমে, তোমার না আছে মেদ না আছে ভুঁড়ি। তোমাকে  এই কথা বললে মানায়।

আমি ও তো তাই ভেবেছিলাম। কেনও হোলও বুঝতে পারছি না। বলে শেখর তার এগ সান্ডউইচে কামড় দিলো।

সোমবারে ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। নার্ভের কোন ব্যাপার কি না বলা যায় না। সিরিয়াস হয়ে বলল এনাম।

বাংলাদেশ, ভারতের রাজনীতির আলোচনা শেষে, কবীর জানতে চাইল করোনাভাইরাস সম্পর্কে কারো কোন আইডিয়া আছে কিনা।

ও রকম কত ভাইরাস এসেছে গেছে বলে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো রফিক।

এনামকে যেতে হবে মেয়ের বাসায়। কাজেই আড্ডা শেষ করতে হোলও। কবীর অবশ্য এতো তাড়াতাড়ি আড্ডা ভাঙ্গবে আসা করেনি।

আগামীকাল ডাক্তারকে কল করবে, কথা টা শেখরের দিকে ছুড়ে দিয়ে  এনাম গাড়ী স্টার্ট দিলো।

কয়দিন বেশ ভালই কেটে গেলো। সকালে ব্যথা হয়,আস্তে আস্তে সেরে যায়। ভুলে গেলো শেখর এনামের কথা। ডাক্তার কে আর কল করা হোলও না।

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে। নিউইয়র্ক বাদ গেলনা। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গভর্নর অর্ডার দিয়েছে  লকডাউনের। ননএসেনশিয়াল সমস্ত দোকান পাট বন্ধ। হাসপাতালে প্রতিদিন শতশত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। ইলেকটিভ সার্জারি বন্ধ।  

ঠিক সেই মুহূর্তে শেখরের ব্যথা টা তীব্রতর হোল। মনে পড়লো এনামের কথা। দেরী হয়ে গিয়েছে।

ডাক্তার কে কল করে বলতেই বলল, আপনার MRI করতে হবে। আমি Script পাঠিয়ে দিচ্ছি।

সন্ধ্যায় কল পেলো শেখর। ডাক্তার বললও সিভিয়ার Spinal Stenosis হয়েছে। অপারেশন ছাড়া উপায় নেই। নিউরো সার্জেনের সাথে আলাপ করতে বললও।

ব্যথা বাড়ছে, সেই সাথে ছোট ছোট কাজ করা দুরহ হয়ে উঠছে শেখরের পক্ষে।

 শেখরের মেয়ে থাকে সিটিতে।

বললও বাবা, চলে এসো আমার কাছে। একা একা থাকা উচিত না, তাছাড়া তোমার খাবারের ভাণ্ডার তো ফুরিয়ে এসেছে।

কে পাঠাবে খাবার? অপারেশনের তারিখ কবে পাবে কে জানে।

প্রস্তাব টা মন্দ নয়। কিন্তু নিজের স্বাধীনতাকে বর্জন করতে চাইলো না শেখর। খুড়িয়ে খুড়িয়ে প্রয়োজনীয় কাজ গুলি করতে পারে শেখর। নিচের ভাড়াটে প্রতিদিনই কিছু না কিছু খাবার দিয়ে যায়।

বাঙালি নয়। কেরালার।

বলেছিল শেখরকে, ভেবো না তুমি একা, আমরা তোঁ রয়েছি নিচে। কোন কিছু লাগলে আমাকে ডাক দেবে।

শেখরের মনে হোলও এমন ধরণের  মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো সুন্দর।

কোন কিছু করার নেই, শুধু বই পড়া, নচেৎ টিভি দেখো। ঠিক সেই মুহূর্তে নজরুলের কল এলো।

Creative একটা ছেলে। পেশায় Engineer. কিন্তু বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠীর সাথে জড়িত। লেখাতে দক্ষতা আছে। কয়েকটা বইও বেড়িয়েছে তার।

বলল, শেখর ভাই, সামনে বাংলা নববর্ষ, সবাই ঘরে বসা, ভাবছি কয়েকজন মিলে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নববর্ষে কবিতার কিছু কিছু অংশ recite করে  আর সেটা ভিডিও করে আমাকে পাঠালে আমি ঐগুলোকে কাটছাঁট করে YouTube এ দেবো।

কি বলেন?

চমৎকার আইডিয়া। বলে শেখর ভাবল কিছুদিন এই নিয়ে ব্যাস্ত থাকলে মন্দ হবে না। ব্যথাটা ভুলে থাকা যাবে।

যথারীতি সম্পন্ন হোল কাজটা। নজরুলের ব্যবস্থাপনায় সুন্দর ভাবে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নববর্ষে কবিতাটি।

দিনদিন নিউইয়র্কের অবস্থা খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শেখরের জানাশুনা অনেকে হাসপাতালে। কেউ বা ICU তে ventilator এ, কাউকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে।  দুই এক জন চলে গেছে ওপারে। মসজিদে প্রতিদিন এশার নামাজের পরে বয়ান হচ্ছে, হচ্ছে দোয়া। সবার মনে আতংক।

শেখরের মেয়ে তনুজা কল করেছে কয়েক বার। শেখর বাকা হয়ে শুয়েছিল ব্যথা টাকে উপশম করার জন্য। ফোন টা ছিল টেবিলে। ধরা হয়নি।

আবারও কল টা এলো।

তোমার কোন কথা আমি শুনছি না। এখনি কাপড় জামা নিয়ে চলে এসো। না এলে আমি আসছি তোমাকে নিতে। তনুজার হুকুম।  

শেখর আর দেরী করেনি। চলে এসেছিল।

বৃষ্টি এখনো অঝোরে ঝরছে।

 শেখরের চোখে জল।

খবর পেলো শেখরের অনেক প্রিয় খালাম্মা চলে গেলো দুর দেশে। সবাইকে ছেড়ে।  ফিরবে না আর।

একটা অদৃশ বন্ধনে বাঁধা পড়েছিল শেখর খালাম্মার সাথে। দুই বার শেখরের সাথে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। দুরপথে অনেক কথা হয়েছিল শেখরের  সাথে। সেই থেকে দেখা হলেই জড়িয়ে ধরতেন শেখরকে। বলতেন, বাবা তুমি তো এলে না বাসাতে।

শেখরের বন্ধু বলত, আমাকে তো শাশুড়ি মা কোনদিন জড়িয়ে ধরে নি, আর আপনার কথা মা র মুখে মুখে।

সেই আপনজন চলে গেলো করোনাভাইরাসে। শেখর কি না কেঁদে পাড়ে?

এই করোনাভাইরাস কবে চলে যাবে কে জানে। আরও কত ক্ষতির সংখ্যা বাড়াবে কে জানে। কবে আবার আমরা একসাথে হতে পারবো কে জানে। বসে আড্ডা দেবো। গুনে দেখব কয় জন আছে কয় জন নেই। শেখর ভাবছে এইসব।

শেখর নিজের কথা ভাবে। সে কত ভাগ্যবান, মেয়ের কাছে আছে। মেয়ের কাছে থাকা আর মা র কাছে থাকার মাঝে কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না শেখরের।

অনেকে হয়ত এতো ভাগ্যবান নয়।

করোনাভাইরাস দুরে সরিয়ে দিয়েছে এঁকে অপরকে। ইচ্ছে থাকলেও কাছে আসতে পারছে না।

 অনেকে পড়ে আছে একা।

কবে হবে এর অবসান।

শেখর ভাবে, ওই পড়ে থাকা গাড়ী টাকে নিয়ে আবারও সে বেড়িয়ে পড়তে পারবে কিনা। পারবে কি? কবে?

Continue Reading

২৭ শে এপ্রিল

                               

 -কি ব্যাপার মুড টা ভালো নেই মনে হচ্ছে?

-না নেই। বড় ঝঞ্ঝাট।

-কি হোলও?

-কি হয়নি বলও। করোনাভাইরাস বাসায় বন্দী করে রেখেছে, সেই সাথে দেখা দিয়েছে মাজায়, হিপে ব্যাথা।

-ডাক্তার দেখিয়েছ?

-দেখিয়েছি, কাজ হয়নি। যাক ভালই হয়েছে। তুমি এসেছ, চারিপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছ, মন্দ কি?

-এইদিন টাতে না এসে পারিনা। তোমাকে একলা, একলা বলব না, তোমার ছেলে মেয়েদের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। ওরা তো তোমাকে ভালোই যত্ন নিচ্ছে।

-তা নিচ্ছে। তোমার হাতে গড়া, বৃথা যেতে পারে না।

-চুলে অনেকদিন ছাঁট পড়েনি মনে হচ্ছে?

-না, পড়েনি, নাপিতের দোকান বন্ধ। এখন বাসায় এঁকে অন্যের টা করে দিচ্ছে।

– তোমার তো সে সুযোগও নেই।

না নেই, তাতে যে কোন অসুবিধা হচ্ছে তাও নয়। তবে তোমার হাতের ছোঁয়া পাচ্ছিনা বলে মনটা খারাপ হচ্ছে। থাকলে এপাশে দুই আনা ওইপাশে চার আনা করে একটা ছাঁট দিতে। হিপ্পি হিপ্পি ভাব টা দুর হতো।

-পাঁচটা বছর। মনে হয় এই তো সেদিন তোমাকে পাঁচ পদে খাইয়েছি।

-থাক সে কথা। চোখে আর জল নাই বা আনালে। তবে জানো, কি ভেবে ভালো লাগে?

-কি?

-তুমি আছো সেইখানে যেখানে বইছে নদী পায়ের নিচে, ঝিরঝিরে বাতাস, নাই ক্রন্দন, নাই মহামারি। নাই করোনাভাইরাস।

-বুঝলে কি ভাবে আমি সেখানে আছি?

-তুমিই যদি ওখানে না যাবে তবে যাবে কে? তাহলে তো আমি বলব, সবই মিছে।

সত্যি কথা বলতে কি তোমাকে প্রতিদিনই স্মরণ করি, স্মরণ করা খুবই সহজ, সহজ নয় তোমাকে হারানোর ব্যাথা।

-বাহ, তুমি তো সাহিত্যিক হয়ে গেছো দেখছি।

-সময় মনটাকে সহিয়ে দেয়, কিন্তু খত টা কি সারে?  

-কি বলব বলও। চল্লিশ টা বছর তো খুবই কম সময়, এতটা  কম সময় তোমার সাথে কাটাব তা তো ভাবিনি কখন। আমার  তো মন ভরল না।

-মন কি আমার ও ভরেছে। ভরেনি। গোঁজামিল দিয়ে জীবন টাকে চালিয়ে নেবার চেষ্টা করছি।

-মনে রেখো আমি আছি সব সময় তোমার পাশে, তোমার কাছে। ভেঙ্গে পড়োনা। আছে তোমার দুই কৃতি সন্তান, আছে টুকটুকে নাতি, ওদের মাঝে পাবে তুমি আমাকে।  বিদায়—-।

     “ অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

               চলবে না।

      এবার হৃদয়-মাঝে লুকিয়ে বোসো, কেউ      

           জানবে না, কেউ বলবে না”

Continue Reading

হাহাকার

    ক্রীং ক্রীং করে ফোন টা বাজছে।  বিপাশা উপরে। ঘর গোছাচ্ছিল। আনাচে কানাচে ধুলো পড়েছে। যে মেয়ে টা পরিষ্কার করতে আসতো প্রতি দুই সপ্তাহে সে ইদানীং আসছে না। গেছে দেশের বাড়ীতে ।  

মাহাবুব সকালে উঠে কোন রকমে নাস্তাটা খেয়েই চলে গেছে হাসপাতালে। মিটিং আছে।

 সেই সাথে কয়েকটা সিরিয়াস রোগীকে দেখতে হবে।

ফোনটা এখনো বাজছে।

বিরক্ত হয়ে বিপাশা ডাক দিল সোমা কে।

-কি করছ সোমা? ফোনটা ধরো।

সোমা ফোনে তার বান্ধবীদের  সাথে গ্রুপ চ্যাট করছিল।

-ধরছি বাবা, বিরক্ত সহকারে উঠাল ফোনটা ।

-কে ফুফু? কেমন আছো?

ভিডিও কল হলে ফুফু দেখতে পেতো সোমার কুঁচকানো কপালটা।

-মা, ফুফু কল করেছে। তুমি ধরবে নাকি বলব পরে কল ব্যাক করবে।

অস্থির হয়ে নিজের ফোন টা কাছে নিয়ে এলো সোমা। এর মাঝে কত কথাই না বান্ধবীরা বলে ফেলেছে।

-বল আমি আধা ঘণ্টা পরে কল করব। বলে বিপাশা পরে থাকা কাপড় গুলো উঠিয়ে রাখল।

স্প্রিং ব্রেক। স্কুল নেই। টিন এজ মেয়ে। বন্ধু বান্ধবীর অভাব নাই। সব সময় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে।

মাহাবুব বলেছিল,যাও। ফুফুর ওখান থেকে ঘুরে এসো।

না তাতে সে রাজি না। কয়েক জন বান্ধবী যাচ্ছে কেঙ্কুনে। সেখানে যাবে বলে বাবার কাছে কয়েক বার ধন্না দিয়েছে। জানে মা কে বললে, এক ধমক দেবে।

বাবা রাজি না।

ফলে মেয়ের মুখে হাসি নেই।  

উপর থেকে নেমে এসে রুমাকে কল করতে যাবে তখনি মনে পড়ল মাহাবুব বলেছিল আজকে রাতে সেলিম আর দিলারা আসবে আড্ডা দিতে। রেফ্রিজারেটর খুলে দেখল মাংসের পরিমাণ অতটা নেই। কাজেই বাহিরে যেতে হবে।

ভাবল আসার পথে প্রিমিয়াম থেকে মিষ্টি নিয়ে নেবে। সেলিম ভাই মিষ্টির পোকা। কত বার দিলারা মানা করেছে মিষ্টি না খেতে, কিন্তু কে কার কথা শোনে।

জানে দিলারা রাগ করবে কিন্তু দাওয়াতে মিষ্টি না থাকলে যেন দাওয়াত দাওয়াত মনে হয় না।

মাহাবুব আর সেলিম একই কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেছিল। অনেক দিনের বন্ধুত্ত।

এখানে কাজ করে একই হাসপাতালে। 

বিয়ের আগে দুজনে একটা এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকতো। ঐ এপার্টমেন্টেই এসে উঠেছিল বিপাশা। সেলিম অবশ্য চলে যেতে চেয়েছিল, মাহাবুব যেতে দেইনি।

 বলেছিল, তোর যদি কোন অসুবিধা নাহয় আমাদের কিন্তু কোন অসুবিধা নেই।

 না করে নি সেলিম।

দিন যেতে যেতে সেলিম আর বিপাশার মাঝে ভাই বোনের সম্পর্ক গড়ে উঠল।

সেলিম বিপাশা কে দেখিয়েছিল মৌসুমির ফটো। অনেক দিনের পরিচয়।

এবার যাও বিয়ে করে ঘর বাঁধও। বলেছিল বিপাশা ।

 রেসিডেনসি টা পাড় করে দেই, তারপর যাবো উত্তর দিয়েছিল সেলিম। 

সেই দিন টাও এসেছিল, এসেছিল অন্যভাবে। 

কেনাকাটা শেষ।

ওপাশ থেকে খবর এলো, এসো না এখন। দেশে এক নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ভীষণ ছোঁয়াচে ব্যাধি।

নাম Bird Flu

সেলিম জানে সে খবর। টিভি তে বলছে।

-কি করবো বলও তো ভাবী? জিজ্ঞাসা করেছিল সেলিম। 

-ওরা যখন বাড়ন করছে তখন মনে হয় না যাওয়াই ভালো। নিশ্চয় ওখানকার অবস্থা ভালো না। বলেছিল বিপাশা ।

মৌসুমি কল করে সেই কথাই বলেছিল। আরও বলেছিল আমি তো চলে যাচ্ছিনা। আর কয়েকটা দিন পরেই না হয় এলে।

চলে যাচ্ছিনা, সে কথা রাখতে পারেনি মৌসুমি।  

চলে যেতে হয়েছিল, ছোঁয়াচে রোগ টা ওকে নিয়ে গেলো।

সেই কেনাকাটা গুলো অনেক দিন পড়েছিল বিপাশার বাসায়।  

-আর কতদিন এই রকম সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটাবে বলও। অনেক বছর তো হোলও। চা এর টেবিলে একদিন কথা টা বলেছিল বিপাশা । 

-আবারো ওকে নিয়ে পড়লে? চা র কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল মাহাবুব

-ও তুমি বুঝবে না। আমার জানা একজন পাত্রী আছে। দেখতে আপত্তি কি?

 বিপাশার কথা শেষ না হতেই মাহাবুব জিজ্ঞাসা করেছিল, কে সে?

শম্পা ভাবীর বোন। বলে বিপাশা একটা গ্রুপ ফটো নিয়ে এলো।

সেলিমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, রাখো তোমার কাছে, পরে কথা বলব এই নিয়ে।

ঘটকালি টা ভালোই করেছিল বিপাশা । মাস তিনেকের মধ্যে শুভকাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। সেলিম আর দিলারা নতুন বাসা নিলো।  

মা, তুমি কিছু ভাবছ?

সোমার ডাকে ফিরে তাকালও বিপাশা ।  

না, কিছু না, একটু বাইরে যেতে হবে মাংস কিনতে। তোমার সেলিম আঙ্কেল আর দিলারা অ্যান্টি আসবে সন্ধ্যায়। 

তা হলে তুমি যাওয়ার পথে আমাকে রুমার বাসায় নামিয়ে দেও। বলে সোমা উপরে গেলো কাপড় পাল্টাতে।

বন্ধু মহলে বিপাশার রান্নার প্রশংসা আছে। শুধু তাই নয় খুব দ্রুত সে কয়েক পদ তৈরী করতে পারে।

পারুল ভাবী একদিন বলেছিল, ভাবী, আপনার ঘাড়ে কি জিন আছে?

আজও তার বেতিক্রম হোলও না।

বীফ থেহেরী, আচারি বেগুন, টুনা কাবাব, মুরগীর রোস্ট প্রথমে করতে চায়নি, কি মনে করে সেটাও করে ফেলল।

মাহাবুবের আসতে বেশি দেরী নেই। হাতের কাজ শেষ।

বিপাশা সাওয়ার  নিতে উপরে গেলো।  

কিছুক্ষণ আগে সোমা কল করেছিল, আসতে  দেরী হবে। রুমার ভাই, স্বপন নামিয়ে দেবে।

বিপাশা বলতে চেয়ে ছিল বেশি দেরী না করতে, কি ভেবে কথা বাড়ালও না।  

সাজান শাড়ী গুলোর মাঝ থেকে মাহাবুবের পছন্দের শাড়ীটা বের করলো।

বড় আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল সে, আস্তে আস্তে শাড়ীর আচল টাকে নামিয়ে দিলো। মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল শাড়ীটা।  নিজের শরীর টাকে বারবার দেখতে  থাকলো। শরীরের বিভিন্ন ভাজ গুলো সতেজ হয়ে ফুটে উঠেছে আয়নায়।

ঠোটের কোণে হাসি নিয়ে সাওয়ারের কলটা ছেড়ে দিলো।

দিলারা সব সময় স্বাস্থ্য সচেতন। ওর জন্য সাদা ভাত রান্না করে রেখেছিল। ওই কথা বলতেই সে বলে উঠল

কি যে বলও ভাবী, তোমার এই মুখরচক খাবার রেখে ঐ সাদা মাটা খাবার, না চলবে না।

বাচালে। বলে বিপাশা ওর পাতে উঠিয়ে দিলো রোস্ট টা।
কথায় কথায় এলো করোনাভাইরাসের কথা।

চায়নার হুয়ান কাউন্টীতে দুই একজন মারা গেছে এই ভাইরাসে। বলল সেলিম।

আমাদের তো দুই মাস পরে ইতালিতে যাওয়ার কথা। বলে দিলারা কোকের গ্লাস টা টেনে নিলো কাছে।

এই ধরণের ভাইরাস কত এসেছে, আর আমাদের সরকার তো খুব একটা গুরুত্ত দিচ্ছে না। ওটা হয়ত ওখানেই সীমাবদ্ধ। এই কথা বলে মাহাবুব বলল আমার খাওয়া শেষ। বসে আছি মিষ্টির জন্য।

যতই দিন যাচ্ছে খবর আসছে করোনাভাইরাসের। এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশে। ইতালির খবর খুবই খারাপ।

সকালেই বিপাশা কল করলো দিলারাকে।

বলল, টিভি তে ইতালির কথা বলছে, তোমরা কি কিছু ঠিক করলে, যাবে কি না।

এইমাত্র সেলিম কল করেছিল, বলল, যাওয়া ক্যান্সেল করতে হবে। অবস্থা ভালনা। শুধু তাই না Seattle এ একজন কে positive পেয়েছে।

তাহলে, তাহলে তো নিউইয়র্কে ও এসে পড়বে? বিপাশা ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো।

এখনো তো এখানের কথা কিছু বলছে না।  ভয় করো না ভাবী, বলে দিলারা বিপাশা কে সান্ত্বনা দেবার চেস্টা করল।  

কি ব্যাপার, মুখ টা ফ্যাকাসে কেনও। বলে পড়নের কাপড়টা পাল্টাতে গেলো মাহাবুব।

বিপাশা এসে ওর পাশে দাড়াতেই ওর দিকে চেয়ে মাহাবুব বলল, কি হয়েছে?

খবরে বলছে করোনাভাইরাস অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, অনেক লোক মারা যাচ্ছে। এখানেও তো তাহলে এলো বলে। বিপাশা চেয়ে রইল মাহাবুবের দিকে উত্তরের আশায়।

যদি না এসে তবে বলব আল্লাহর অনেক কৃপা। কিন্তু তা হবে বলে মনে হয় না। নিউইয়র্ক হচ্ছে এমন একটা শহর যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে লোক এখানে আসে। এই শহর এই ভাইরাস থেকে বাজবে কি ভাবে?

 এই রোগের নাকি কোন চিকিৎসা নেই। আর ভীষণ ছোঁয়াচে, বলল বিপাশা ।

বাহ, তোমার টিভি দেখা সার্থক। টিপুনি কাটল মাহাবুব।  

ইয়ার্কি মেরো না। আমার ভয় হচ্ছে। তোমরা ডাক্তার। তোমাদেরকেই তো সামনে থাকতে হবে। এই সব রোগীদের কে দেখতে হবে।

তা এই মুহূর্তে তো এই পেশা ছাড়তে পারবো বলে মনে হচ্ছে না, সোনা। বলে হাঁ হাঁ করে হেসে বিপাশা কে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে  বলল, এবার এক কাপ কফির ব্যাবস্থা কর।

পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হচ্ছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভয়াবহ রোগ। কোন চিকিৎসা নেই।

যে যার ঘরে বন্দি।

দোকান পাঠ, স্কুল কলেজ, অফিস আদালত বন্ধ।

রাস্তায় লোক নেই।

এ এমন রোগ যার হবে তার কাছে কেউ আসতে পারবে না।

হাসপাতালে তাকে দেখা যাবে না।

ভালো হয়ে ফিরে আসলে তবেই দেখা হবে নচেৎ দেখা হবে উন্মুক্ত মাঠে।

সবার মনে ভয়।

রাতে ফোনটা বেজে উঠতেই ধড়মড় করে উঠে বসল মাহাবুব।

হ্যালো বলতেই,

মাহাবুব ভাই আমি সাহানা। কাঁদতে কাঁদতে বলল

কি হয়েছে?

তারেক হাসপাতালে। ওর করোনাভাইরাস হয়েছে।

কোন হাসপাতালে? জিজ্ঞাসা করল মাহাবুব

আপনাদের হাসপাতালে। আমি ওর কোন খবর পাচ্ছি না, মাহাবুব ভাই। আমি কি করব। বলে কাঁদতে থাকল সাহানা।

ঠিক আছে, কাল সকালে আমি হাসপাতালে যেয়ে খবর নেবো। চিন্তা করো না।

সাহানা তারেকের আছে গ্রসারী স্টর, সাথে হালাল মাংসের দোকান। সেই খানেই পরিচয়।  কোন কিছু লাগলে বিপাশা কল করে তারেক কে বলে দেয়। মাহাবুব কাজ থেকে ফেরার পথে উঠিয়ে নেয়।

সকালে কাজে এসে খোঁজ নিলো তারেকের। যে ডাক্তার ওর তত্ত্বাবধানে তাকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, অতটা খারাপ নয়। এই যাত্রা বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পারবে।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বিপাশা কে কল করে খবর টা দিলো। সাহানা কে যেন জানিয়ে দেয়।  

অনেক রোগী এসেছে আজ। ICU ভর্তি।

সেলিমের সাথে দেখা হতেই বলল, ওর ওয়ার্ডে চার জন মারা গেছে। সাবধানতা অবলম্বন করছে, বাকি আল্লা ভরসা।

কাজে আসার আগে বিপাশা কত রকম দোয়া দরুদ পড়ে ফু দিয়ে দেয়।

ওর চেহারা দেখেই মাহাবুব বুজতে পারে ওর মনের কথা। কিন্তু কি করবে সে, রোগী দেখাই তো তার কাজ।  

ফিরতে ফিরতে সেদিন একটু রাত হয়ে গেল মাহাবুবের। বাসায় এসে  সোজা সাওয়ার নিতে চলে গেলো।

বিপাশা টেবিল সাজালো ডিনারের জন্য। শুনতে পেলো দুই তিন বার কাশির শব্দ।

 টেবিলে বসেই মাহাবুব বলল, কেন জানি খুব ক্লান্ত লাগছে। খেতে ইচ্ছে করছে না।

হাসপাতালে কি কিছু খেয়েছো? জিজ্ঞাসা করল বিপাশা ।

না, থার্মোমিটার টা আনো তো।

বিপাশার বুক টা ধক করে উঠলো।  

তাপমাত্রা একশোর একটু উপরে।

সেই মুহূর্তে নিজে কে quarantine করে ফেলল মাহাবুব।

রেজাল্ট পজেটীভ। তবে বাসায় থাকতে বলল।

বন্ধু বান্ধবীরা ফোনে খোঁজ নিচ্ছে। সেলিম দিলারা প্রতিদিন তিন চার বার ফোন করে। খাবার বানিয়ে দরজার কাছে রেখে যায়।

বিপাশা নামাজের পাটিতে বসে উপরওয়ালার কাছে বলে, কবে আমি এই অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবো।

চারিদিকে শুধু হাহাকার।

বিপাশা, বিপাশা!

ডাক শুনে দৌড়িয়ে এলো দরজার কাছে।

এম্বুলেন্স কল করো। আমার শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। অনেক কষ্টে বলল মাহাবুব।  

এম্বুলেন্স এলো নিয়ে গেলো মাহাবুব কে।

 বিপাশা পাথরের মূর্তির মতো দাড়িয়ে রইল ।  

বাহিরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে।

এ যেন তার চোখের জল।

Continue Reading

করোনাভাইরাস

                              

 বেশ তো ছিলাম। 

সকালে নাশতা শেষ বসতাম টিভির সামনে। CNN,MSNBC,BBC।

শেষে cnbc.

স্টক উঠা নামা করছে।

একটা থ্রীল।

দুপুর একটায় বেড়িয়ে পড়তে হবে, নচেৎ যোহরের নামাজ ধরা যাবে না। নামাজ  শেষে আছে mingling.

তিন বেলা যেতাম ঐটুকু পাওয়ার জন্য।

কখনো কখনো পাঁচ জন কে জোগাড় করে সকালে এসে বসতাম পেনারা তে।

গল্প চলতো।

এলো করোনাভাইরাস।

সব হারিয়ে গেলো।  

সবাই আতঙ্কিত।

Costco, Stop & shop থেকে সব কিছু উধাও।

নেই পানি, নেই হ্যান্ড সেনিটাইযার।

লোকে পাগলের মতো কিনছে। এক দুই তিন মাসের মত মজুত করে রাখবে।

লাইসলের বোতল একটা আছে।

হুমড়ি খেয়ে পড়ল পাঁচ জন। যে পেলো তার মুখে হাসি।

বাথরুম টিসু, এক এক জনের ঠেলাগাড়িতে দুই তিন বান্ডিল।

একজন বলল, ভাই অর্ধেক টা যদি দেন, তাহলে বেচে যাই। অনেক জাগায় গিয়েছি পাইনি।

কি ভাবে ছাপছুপ করব, বলেন।

মনে হোলও বলি বদনা চেনেন? বদনা?

 না এরা বদনা চেনে না। এই পরিস্থিতে যদি একটা বদনা থাকতো তাহলে এই বাথরুম টিসু নিয়ে মন কষাকষি হতোনা।

খবর এলো, মসজিদ বন্ধ।

তা হলে?

Mingling নেই।

ধস নেমেছে স্টক মার্কেটে। চলে গেছে শত শত ডলার। পরিত্রাণ নেই।

আগামীকাল দাম বাড়বে বলে যে ধরে রেখেছিল, সে হায় হায় করে উঠল মাথায় হাত দিয়ে।

 Dow নেমে গেছে ২০০০ পয়েন্ট। Nasdaq ৫০০

ইতালি তে জারী করা হয়েছে কেউ বের হতে পারবে না বাসা থেকে। নিতান্তই খুব দরকারি কাজ বা শারীরিক কারন ছাড়া।

আমেরিকাতে জারী করা হয়েছে ন্যাশনাল ইমারযেন্সী।

যাওয়ার কথা ছিল ফ্লোরিডা তে। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। বন্ধ হয়ে গেলো।

এয়ারলাইন টাকা ফেরত দেবে না। বলল, ক্রেডিট দিলাম, যখন যেতে চাও যেতে পারবে। ওই টাকা তখন ব্যবহার করবে।

এই পরিস্থিতি তে পরিনি কোনদিন।

যে বয়সে এসে পৌঁছেছি শুনলাম এই বিচ্ছু টা নাকি আমাদেরকেই খুজছে। আমাদের বয়সের লোকদের কে ধরলে আর রক্ষে নেই।

কাজেই ঘরে বন্দি।

গরম পানি দিয়ে গারগেল, নিয়মিত কয়েক বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, সেই সাথে কয়েক বোতল পানি খেয়ে চলেছি।

বিভিন্ন মহারথীরা যা যা বলছে মেনে চলার চেস্টা করছি।

বিচ্ছু টা যাতে কাছে ভিড়তে না পারে।

এক বন্ধু আছে আমারই মতো, তার ওখানেই আমি যাই কফি খেতে, সে আসে আমার এখানে।

ছেলে মেয়েরা বার বার বলছে, চলে এসো আমাদের এখানে। তোমার একলা বাসায় quarantine হয়ে থাকার দরকার নেই।

আইডিয়া টা মন্দ নয়। চিন্তা করে দেখতে হবে।

Continue Reading

বস্তীরাম

                                                 

   বস্তীরাম, তোমার সাথে হয়ত আমার আর দেখা হবে না। তাই বলে তোমাকে আমি ভুলবো না, ভুলবো না তোমার হাসি টা। ভুলবো না সেই কথা গুলো,” চিন্তা মাত করো”।

চিন্তা আমি ,আমরা কেউ আর করিনি।

দিল্লীর এয়ার পোর্ট থেকে বের হয়ে দেখা হোলও সুনীলের সাথে। ওকে অনুসরণ করে আমরা এলাম বাহিরে। গাড়ী দাড়িয়ে আছে। নয় সিটারের গাড়ী। গাড়ী থেকে নেমে এলো ড্রাইভার।

সুনীল বলল, স্যার, এ হচ্ছে বস্তীরাম, ১৩ দিন সে আপনাদের সাথে থাকবে।

তাকালাম বস্তীরামের দিকে। লম্বা, পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি হবে। দোহারা গঠন। প্যান্ট সার্টের উপরে হাফ হাতা সোয়াটার পড়া। একটু ঝুকে সামনে দাড়িয়ে নমস্কার দিয়ে বলল,   চিন্তা মাত করো, যা যা দেখানো সব দেখিয়ে দেবো।

ইংরাজিতে সে অতটা পারদর্শী নয় , হিন্দিতে কথা বার্তা।

আমার হিন্দি আসে না, তবুও বুঝতে এবং বোঝাতে অসুবিধা হোলও না।

দা রয়েল প্লাজা হোটেলে। বস্তীরাম তার স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে আমাদের কে নামিয়ে দিয়ে বলল, স্যার কাল সকাল নয়টায় আসব।

বললাম, ঠিক আছে, আমরা সবাই নিচে এই লবিতে থাকব।

কাউন্টারে দাড়িয়ে রুমের ব্যাপারে কথা বার্তা বলছিলাম।

স্যার!

ঘাড় ফিরিয়ে দেখি বস্তীরাম।

কি ব্যাপার? কোন কথা আছে?

রাতে বের হলে এক সাথে বের হবেন।  নতুন জায়গা কিনা, তাই বলতে এলাম।

আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর কি যায় আসে আমাদের খারাপ কিছু হলে। অথচ কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ে সে আমাদের কে বুঝিয়ে দিলো, এদেশে আমরা নতুন,  আমাদের ভালোমন্দ, সব কিছুর  দায়িত্ব তার।

সকাল ঠিক নয়টায় বস্তীরাম দাঁড়ান লবিতে।

স্যার, ঘুম হয়েছিল? নতুন জায়গা, তবে হোটেল টা নাম করা হোটেল।

ইউসুফ বলে উঠল, না না, কোন অসুবিধা হয়নি। itinerary অনুসারে—-

কথা শেষ করতে পারলো না ইউসুফ,

Itinerary আমার মুখস্থ। প্রথমে যাবো, বলে সে গড় গড় করে বলে গেলো কোথায় কোথায় যাবো আজ।

জামে মসজিদ দেখা শেষে, চাঁদনী চক। গাড়ী যাবে না। ছোট রাস্তা।  রিক্সা করে যেতে হবে। তিন টা রিক্সা ঠিক করে, বার বার রিক্সাওয়ালা দেরকে বলে দিল, বাবুদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। আস্তে চালাবে। তিনটে রিক্সা পর পর থাকবে।

বস্তীরাম আস্তে আস্তে আমার মনের মাঝে জায়গা করে নিলো।

আজ আমি আমাদের ভ্রমণ কাহিনী লিখতে বসিনি। সেই লেখা শেষ হয়েছিল বেশকিছু দিন আগে।

বস্তীরাম আজ আমার লেখার নায়ক।

Jaisalmer এ শেষ রাত।

এখান থেকে আমরা চলে যাব মুম্বাইতে। বস্তীরাম ফিরে যাবে তার ঘরে। চারদিন তার ছুটি।

১৩ টা দিন সে আমাদের কে নিয়ে বেড়িয়েছে। নিয়ে গেছে সেই রেস্তোরায় যেখানে খেলে আমরা তৃপ্তির সাথে খেতে পারব।

পথে থামতে হয়েছে, বাথরুমে যেতে হবে। নিয়ে গেছে সেই খানে যেখানে নাক ছিটকে ফিরে আসবো না।

বলেছি, বস্তীরাম, চল একসাথে খেয়ে নেই।

বলেছে, অনেক ধন্যবাদ স্যার, নিয়ম নেই একসাথে খাওয়া।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে Thar Desert এ। বস্তীরাম হেটে বেড়াচ্ছিল। আস্তে আস্তে আমি এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। হয়তো সে ভেবেছিল আমার কোন কিছুর দরকার। তাড়াতাড়ি কাছে আসে বলল, কিছু লাগবে স্যার।

না, বস্তীরাম। চল। ওই চেয়ার টাতে বসি, তুমি তোমার গল্প বলবে। তোমার কথা, তোমার বিবির কথা, ছেলে মেয়ের কথা।

এসে বসলাম আমরা।

কি বলব স্যার, বাবা মার একমাত্র সন্তান আমি। বাবা কাজ করতো এক কারখানায়। মা সামলাতও ঘর। পড়াশুনায় যে আমি খুব একটা খারাপ ছিলাম তা না। কিন্তু পড়াশুনা আর শেষ করতে পাড়লাম না।

বাবা একদিন বাসায় এসে বলল, শরীরটা  ভালো লাগছে না। খুস খুস করে কাশতে লাগলো।

পরদিন অর্ধেক কাজ করে ফিরে এলো। কাশি টা বাড়তে থাকলো।

বাথরুমে যেয়ে ডাক দিলো মা কে। মেঝে তে তাজা রক্ত।

যত টুকু আমাদের চেষ্টা করার করেছিলাম। কিন্তু না, পাড়লাম না বাবা কে ধরে রাখতে। সে চলে গেলো।

আমার বয়স তখন ষোল।

লেখা পড়ায় স্থগিত দিয়ে চাকরি নিলাম বাসের কন্ডাক্টার হিসাবে। সংসার চালাতে হবে।

মালিক টা খুবই ভালছিল। আস্তে আস্তে সে আমাকে গাড়ী চালানো শিখিয়ে ছিল। মঝে মাঝে আমি চালাতাম সে পাশে বসে থাকত। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও একদিন পেয়ে গেলাম।

তারপর?

একদিন মা বলল, বস্তী এবার একটা বিয়ে কর। অনেক বছর তো হয়ে গেল তোর বাবা চলে গেছে। বাসাতে আমি একলা থাকি। কখন কি হয়। বৌ টা দেখে যাই।

তাহলে মার কথা শুনেছিলে।

হাঁ স্যার। আপনাকে দেখাই বৌ এর ছবি টা।

এই বলে পকেট থেকে ছবি টা বের করে দেখালও।

কবে কার ছবি এটা?

এই তো মাস দুই এক আগে তোলা।

বাহ, খুব সুন্দর দেখতে।

হাঁ স্যার বয়স হয়েছে, তবে বোঝা যায় না।

তাই তো মনে হচ্ছে, তোমার বয়স কত?

চল্লিশ পেড়লো। ও আমার থেকে তিন বছরের ছোট।

তুমি তো আমার ছেলের বয়সী।

হাঁ, স্যার, আপনারা সবাই আমার বাবা মার মত। পনের বছর কাজ করছি এই কোম্পানিতে। আপনাদের মত এমন গ্রুপ আর পাইনি। তাই হাটতে হাটতে ভাবছিলাম, আরও কিছুদিন যদি আপনারা থাকতেন। এই কথা বলে মাথাটা বা পাশে ঘুরিয়ে চোখ টা মুছে নিলো।

এবার তোমার কথা বল।

দুই ছেলে মেয়ে। মেয়েটা পড়াশোনায় ভাল। ডাক্তারি পড়বে ভাবছে। ছেলে টার পড়াশোনায় মন নেই। আমি থাকি বাহিরে বাহিরে। ওর মা দেখাশোনা করে। ওর দাদি চলে গেছে আজ দুই বছর হোলও। কোলে পিঠে করে সেই বড় করে দিয়ে গিয়েছিল এই দুটো কে। ওরা ছিল দাদির ন্যাওটা।

ভালই হয়েছিল স্যার। দাদির কাছে ঘুরঘুর করাতে আমার বৌ টা একটু বিশ্রাম নিতে পারতো।

মনে হোলও আগ্রাতে দেখেছি প্রেমের স্মৃতি সৌধ। আর বস্তীরামের প্রেম মনকে দোলা দেয়। বৌ টা একটু বিশ্রাম নিতে পারবে এটাই তার কাছে বড়। এইতো প্রেম।

চারিদিকে অন্ধকার। আকাশে তারার ঝিলিমিলি।

বস্তীরাম তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। হয়তো ভাবছে দুরে ফেলে আসা বৌ, ছেলেমেয়ের কথা। আর কিছুদিন পরে দেখা হবে। তাও মাত্র কয়েক দিনের জন্য।

এখান থেকে কি দিল্লী ফিরে যাবে বস্তীরাম?

না, স্যার, বাড়ী আমার দিল্লী আর জয়পুরের মাঝে। তাও অনেক ঘণ্টার পথ। কাল আপনাদের কাছে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ব। মাঝ পথে এক রাত থেকে যেতে হবে। বৌ বলেছে, একটানে না যেতে। বিশ্রাম নিয়ে আসতে। পথে যদি কিছু হয় সেই ভয় তার।

ঠিকই বলেছে তোমার বৌ, বস্তীরাম। তা বৌ এর জন্য কিছু নিয়ে যাচ্ছ কি?

হাঁ স্যার। যখন আপনারা শাড়ী কিনছিলেন, তখন ওখান থেকে কম দামে একটা শাড়ী নিয়েছি, স্যার। ওকে বলিনি, সারপ্রাইজ দেবো।

হাঁহ হাঁহ করে হেসে উঠলাম আমি, চমৎকার বস্তীরাম, এই না বলে প্রেম।

আমিতো বাহিরে বাহিরে থাকি, সব কাজ তো তাকেই করতে হয়। এই ছোট্ট একটু উপহার দিলে ওর মনটা যদি ভরে উঠে তাহলেই আমি খুশি।

আমি বস্তীরামের মুখের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম, ভালবাসতে, ভালবাসা প্রকাশ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন পড়েনা, শুধু চাই মন।  

অনেক তো ঘুরলে আমাদের সাথে বস্তীরাম এরপর কোনদিকে যাবে? রাজস্থানে তো প্রচণ্ড গরম পড়বে।

সিমলার দিকে স্যার।

উঠে দাঁড়ালাম আমি, বললাম, কাল হয়তো শেষ দেখা।

গলার স্বর কান্নায় ভাঙ্গা, বলল, ও কথা বলবেন না,স্যার। আপনি, আপনারা আমার মা বাবার মত। ওরা চলে গেছে, আপনাদের কে তো আমি পেয়েছি। শেষ দেখা, এ কথা বলবেন না স্যার, এ কথা বলবেন না।  

আবার দেখা হবে। আমি পথ চেয়ে থাকবো।

Continue Reading

বার্ধক্য

 বার্ধক্য!

আগে এই শব্দটা বন্ধু মহলে উচ্চারণ করতে শুনিনি।

ইদানীং শুনছি।

কথায় কথায় বলছে সবাই,বার্ধক্যে পৌছিয়ে গেছি। আর তো কয়টা দিন।  তারপর সব শেষ। হিসেব নিকেশের খাতা কি শূন্য, নাকি ভালো কিছু যোগ হয়েছে তাতো জানার উপায় নেই। তবে ইদানীং ইনশাআল্লাহ কথাটা কথার শেষে অথবা কথার আগে যোগ হচ্ছে। কাজেই বোঝা যায় মনে ভয় ঢুকছে।

তাছাড়া টুপ টুপ করে বেশ কয়জন ঝরে পড়েছে। কারোর স্বামী কারোর সহধর্মিণী স্থান নিয়েছে  বিশাল আকাশের নিচে।

অনেকেই যারা ছিল দুজন, কথায় কথায় ভরিয়ে রাখতো খাবার টেবিল, আজ টেবিলটা নীরবতায় আচ্ছন্ন। টেবিলে আজ আর হরেক রকমের খাবার নেই। নেই হরেক রকমের বাটী। আছে শুধু একটা প্লেট, তাড়ি মাঝে দুই একটা তরিতরকারি। 

অনেকে বলে সময় টা খুব দ্রুত চলে গেছে।

হাঁ খুবই দ্রুত চলে গেলো।

সবার মনেই একই চিন্তা, বিছানায় যেন পড়ে না থাকি। কারো মুখাপেক্ষী যেন না হই।

কিন্তু এটা তো কারো হাতে নেই।

অনেকে যারা একা হয়ে গেছে, একা একা থাকে ছোট্ট দুই কামরার ঘর নিয়ে, তাঁরা ভাবে রাতের অন্ধকারে যদি সে চলে যায় দুর দুর দেশে, অথবা বুকের ব্যথায় এম্বুলেন্স ডাকতে যেয়ে হাত থেকে পড়ে যায় ফোনটা, তাহলে কত দিন পরে সবাই জানতে পারবে সে আর নেই তাদের মাঝে।

এই তো সেদিন, এই সেদিন মানে  ছেচল্লিশ বছর আগের সেদিন, শাহাদত আর শান্তি ঘর বেধেছিল এই শহরে। পিছনে ফেলে রেখে এসেছিল বাবা, মা ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন।  চোখে ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের তরী বেয়ে একদিন তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বিশাল শহরে।

সংসার বড় হোলও। ছেলে মেয়ে কে ভালবাসা দিয়ে মানুষ করলো। ওরা যার যার পায়ে দাড়িয়ে পড়লো। এবার বিশ্রামের পালা। কিন্তু বিশ্রাম পেলো কি?

সময় তোঁ বসে থাকে নি।

শাহাদত আর শান্তির চুলে পাক ধরেছে। বিশাল বাসাতে এখন মাত্র দুজন।

শাহাদত বলেছিল শান্তিকে, দেখো, দুজনে আমরা বেধেছিলাম ঘর, সেই দুজনই রয়ে গেলাম। মাঝ খানের বেশ কিছু বছর পুতুল খেলার মত দুটোকে নিয়ে খেলা করে কাটিয়ে দিলাম।  

কিরে? অনেকক্ষণ ধরে তুই কি যেন ভাবছিস। চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।

হাঁ। ভাবছি শাহাদত আর শান্তির কথা।

হঠাৎ?

কেন জানি খুব মনে পড়ছে ওদের কথা আজ।

শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল, অবশ্য সেই দেখা যে শেষ দেখা হবে জানতাম না, বলেছিল অনেক কথা।

বলতে আপত্তি আছে কি? তুই তো ছিলি ওর সব চেয়ে কাছের বন্ধু।

না আপত্তি কি? শান্তির চলে যাওয়া টা সে মেনে নিতে পারেনি। সত্যি বলতে কি আমরাও যে ওকে খুব একটা সাপোর্ট দিতে পেরেছিলাম তা মনে হয় না।

তুই ঠিক বলেছিস। আমরা ওকে কাছে টানার পরিবর্তে দুরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। ও লিখতে আরম্ভ করেছিল, আর আমরা উৎসাহ না দিয়ে, ঠ্যাটা উপহাস করতাম। বলতাম দেখো, শাহাদত ও লেখক হয়ে গেলো। 

একদিন সন্ধ্যায় ওর বাসায় না বলেই চলে গিয়েছিলাম। কয়েক বার বেল বাজানোর পর দরজা খুলল। ঘর অন্ধকার।

কিরে আলো জ্বালাস নি।

অন্ধকার ভালো লাগে, বলে সে সুইচ টা টিপে দিল। কি মনে করে? বলে তাকাল আমার দিকে। চোখ লাল।

কেন আসতে নেই?

সে কথা তোঁ বলিনি। চা দেবো?

মন্দ না বলে আমি সোফায় বসলাম। বড় বাড়ী ছেড়ে দু কামরার একটা ঘরে থাকে। এই বাসায় আজিই আমার প্রথম আসা। দেখা হলে কোন রেস্টুরেন্টে বসতাম আমরা।

কিছুক্ষণ আমার দুজনেই চুপ। আমিই নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, ইদানীং কিছু লিখেছিস।

হাঁ ওই করেই তো সময় কাটাই। ভাবছি আর নয়, কেউ পড়ে না।

আমি বেশ কয়টা তোর লেখা পড়েছি, সুন্দর সাবলীল লেখা।

হেসে বলল, তুই তো অতি ভদ্রলোক সামনা সামনি কারো  মনে আঘাত দিতে জানিস না।

তোর সাথে তর্ক করতে আমি আসিনি। তা বুঝলি কি করে যে কেউ পড়ে না।

সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে খুব ভালো হয়েছে। কাগজে ধরাধরি করে ছাপানোর জন্য বলতে হয় না। ফেসবুকে দিয়ে দেই। নয়তো অন্য একটা মিডিয়া আছে সেই খানে।

তাহলে তো খুব ভালো। অনেক পাঠক তোর।

না পাঠক আমার নেই। থাকলে কি মাত্র দুই থেকে পাঁচটা লাইক পেতাম?  বাদ দে ও কথা। রাতে যদি তুই খেতে চাস তবেঁ আমার জন্য একটু অসুবিধা হবে। আমার চাল চুলো কিছু নেই।

খেতে আসিনি,  গল্প করতে এসেছি। বলে উঠে যেয়ে চা র কাপটা নিয়ে এলাম।

হঠাৎ ই ভয় ভয় করে কথা টা পাড়লাম । বললাম, অনেক দিন তো হোলও এবার কিছু একটা চিন্তা ভাবনা করলে পারতিস?  

ও আমার দিকে তাকাল, মৃদু হেসে বলল, কেন? তোর হাতে আছে নাকি?

না না—কথা শেষ না হতেই বলল,

আমাদের এই সমাজ বড় সংকীর্ণ মনের। বিয়ে ছাড়াও ছেলে মেয়ের মাঝে যে সম্পর্ক গড়া যায় তা তারা মানতে রাজি না।

সম্পর্ক টা কি হবে? সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম।

বন্ধুত্ত। কথা বলার একটা সাথী। কোন দৈহিক সম্পর্ক নয়। পারবি মানতে তুই?

আমি পারলেও ওরা পারবে না। তোকে নিয়ে কুকথা বলবে।

তাহলে থাক, যেমন আছি এভাবেই কেটে যাবে বাকি কটা দিন।

 আরও কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়লাম সেদিনের মত।

বেশ কিছু দিন চলে গেছে, হঠাৎ একদিন দুপুরে শাহাদতের ফোন পেয়ে একটু ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলাম।

বলল, যদি হাতে সময় থাকে তবে আমার বাসায় একটু আসিস, কথা আছে।

ওর গলার স্বর আমাকে সেদিন ভাবিয়ে তুলিয়েছিল।

এলাম। কি ব্যাপার ? জরুরী তলব কেন?

উত্তর দিল না সে। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তোকে একদিন বলেছিলাম আমার লেখার কোন পাঠক নেই।

ভুল বলে ছিলাম। আমার একজন পাঠক, না পাঠিকা ছিল। আজ তাও চলে গেলো।  

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বললাম, আমি বুঝতে পারছি না তুই কি বলতে চাইছিস।

তবে শোন,

লেখক যদি পাঠকের কাছ থেকে ভালোমন্দ কিছু জানতে না পারে তবে তার উৎসাহ উদ্দীপনা নিভে যায়।

এমনি একদিন আমার একটা লেখা অদিতি সেন বলে একজন খুব প্রশংসা করলো।

একটু আশ্চর্য হলাম।

লিখতে হয় তাই লিখলাম , অনেক অনেক ধন্যবাদ।

সে লিখল, আপনার প্রতিটি লেখাই আমি পড়ি। খুব ভাললাগে।

যাক, তাহলে জানলাম আমার একটা পাঠক আছে।

সে লিখল, ফাসবুকে ফ্রেন্ডশিপ রিকোয়েস্ট করলে একসেপ্ট করবেন কি?

করেই দেখুন।

করলাম।

এরপরে মাসেঞ্জারে টেক্সটের মাধ্যমে কথা হয়। আমার লেখা গুলোর কনস্ট্রাকটিভ সমালোচনা করে।

একদিন লিখলাম, আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে তো ছবি নাই। কোনদিন দেখা হলে চিনবো কি করে।

যেমন খুশি কল্পনা করে নিও, সেই কল্পনাই হবে সত্য।

বাহ! আপনি তোঁ রবি ঠাকুরের শাপমোচনের কোট করলেন।

হাঁ হাঁ করে হেসে বলল, ধরতে পেরেছেন।

এই রকম লেখা ছোড়াছুঁড়ি চলতো।

একদিন লিখলাম, আপনার সাথে দেখা করা যায় কিভাবে?

যদি ১৯ ঘণ্টা প্লেনে জার্নি করে আসেন তবে দেখা হবে।

মানে?

মানে আমি থাকি কলকাতায়।

সেই সুদুরে বসে আপনি আমার গুনগান করে যাচ্ছেন। কেউ কিছু বলবে নাতো?

আমাকে বলার মতো কেউ নাই। তাছাড়া বন্ধু কি শুধু ঘরের কাছেই হয়, দুরের লোক কি বন্ধু হতে পারে না?

এই ভাবে কথার পিঠে কথা চলতো।

একাকীত্তের কিছুটা অবসান হয়েছিল। মুখে না হয় নাই বা হোল কথা, লেখনীর মাধ্যমে সেটা  ঘুচে গেলো।

 জিজ্ঞাসা করলাম, কতদিন ধরে চলছে।

প্রায় তিন মাস।

বার বারই মনে হচ্ছে শেষে কিছু একটা আছে যার জন্য সে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। সেটা কি ?

শাহাদত আবার বলতে আরম্ভ করল,

দুই তিন দিন কেটে গেলো তার কাছ থেকে কোন লেখা এলো না। একটু অস্থির হলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, হয়তো ব্যাস্ত।

তিনদিন পরে ফিরে এলো সে, “ আর বোধহয় লিখতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না”।

কেন?

আপনাকে বলিনি, আমার হাতের মাসেল গুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই কদিন লিখতে পারিনি। জানি আপনি চিন্তা করবেন। আপনার সাথে লেখাতে কথা বলে নতুন জীবন পেয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম আমার MS হয়েছে। পা দুটোতে আর আগের মত বল পাইনা। হয়ত হুইলচেয়ার ধরতে হবে।

আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টিও কমে আসছে।

তবে কি আমি অন্ধ হয়ে যাবো? আমি কি আর আপনার লেখা পড়তে পারবো না?

ঝাপসা চোখে লিখলাম, চিন্তা করবেন না। সমাধান তো নিশ্চয় আছে।

না, নেই। ডাক্তার বলে গেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই লেখাই হয়তো শেষ লেখা। আপনি লিখবেন আমাকে, আমি ঝাপসা চোখে পড়ব। আর কথা দিন গল্প লেখা বন্ধ করবেন না।

মনে হোলও অনেকদিন পরে একটা বন্ধু পেয়েছিলাম, কপালে সইলো না।

এই কথা বলে শাহাদত উঠে চলে গেলো। বুঝলাম সে কেঁদে হাল্কা হতে গেলো।

আমি পাঁথর মত বসে রইলাম।

তোর সাথে কি শাহাদতের আর দেখা হয়েছিল।

না, আর হয়নি। ফোন করেছিলাম, Disconnected. বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে সে আর থাকে না।

তবে তার দেখা আমি পাবো।

কোথায়?

সেই খানে যেখানে তাকে আসতেই হবে। সেই সময়টাও খুব কাছে।

শুধু দুর থেকে আমি তাকে দেখবো।

হেঁয়ালি রাখ। বল কোথায়?

Continue Reading

ভাঙা পথ

ট্রেনটা এসে দাঁড়াল ষ্টেশনে। এটাই প্রীতির ষ্টেশন। নামতে হবে। প্রতিদিনের মতো আজও অনেক কষ্টে ঠেলাঠেলি করে নেমে এলো। শীতের সন্ধ্যা। আজ যেন ঠাণ্ডাটা একটু বেশি মনে হোলও প্রীতির কাছে। বাতাস বইছে। মাফলার দিয়ে গলাটা ঢেকে নিলো। কোটের হুডটা মাথার উপর উঠিয়ে দিলো।
তিন রাস্তা পাড় হয়ে তবে তার বাসা।

আগে জহীর গাড়ী নিয়ে এসে দাড়িয়ে থাকতো। গাড়ীতে উঠেই প্রীতি ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বলত, বড্ড খিদে পেয়েছে, চল না ঐ কাছের রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসি।
দুজনে এসে বসত সেই রেস্টুরেন্টে। চা র সাথে দুটো কাবাব, নয়তো সিঙরা। ঘণ্টা খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যেতো।
জহীর ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতো।
সে তো আজ অনেকদিন আগের কথা।
প্রীতি পিছন ফিরে তাকাল। রেস্টুরেন্টের নিয়ন সাইন টা জ্বলজ্বল করছে। ঐখানে আর সে এসে বসে না।
ভাল আর ভালবাসার দিনগুলো যেন তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। কষ্টের দিনগুলো ফুরাতে চায়না।
আজ কেনই এসব কথা মনে পড়ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
মনে পড়লো মা বলেছে, বাসায় রুটি আর দুধ নেই।
ঘুরে দাঁড়ালো প্রীতি। পাশেই সুপারমার্কেট। কনকনে বাতাসটা ঝাপটা মারলও মুখে। হাতের ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো।
ভিতরে এসে দাঁড়ালো প্রীতি। চশমাটা খুলে চোখটা মুছে নিলো।

প্রীতি আপা, কেমন আছেন?
চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল সামনে দাড়িয়ে বেবী। এই মুহূর্তে কারো সাথে কথা বলতে ইচছা করছিলো না। বেবীর সাথে তো নয়ই। বড় বাচাল মেয়ে।
ভালো, তুমি?
সে কথায় না যেয়ে বেবী গলার স্বর একটু নিচে নামিয়ে বলেল, শুনেছেন নিশ্চয় করিম ভাই আর ভাবীর কেচ্ছা।
করিম আর ভাবীর কেচ্ছা শোনার ইচ্ছে প্রীতির নেই, তার নিজের জীবনেই অনেক কেচ্ছা রয়েছে।
বলল, না শুনিনি। আমার একটু তাড়া আছে, আর একদিন শুনবো। বলে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে এলো।
বেবী হতাস মনে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো।
দুধের দামটা একটু বেশি মনে হোলও প্রীতির কাছে। কে জানে। যাদের টাকা গুনে গুনে চলতে হয় তাদের কাছে সব কিছুরই দাম বেশি মনে হয়।
আগে কখনও কোনটার কত দাম দেখিনি সে। যেটা কিনতে ইচ্ছা করতো শপিং কার্টে উঠিয়ে নিতো। মাঝে মাঝে জহীর বলতো, কি ব্যপার, বাসায় মাছ, মাংস, তরিতরকারির কোন অভাব আছে বলে তো মনে হয় না, আবারও কি নিয়ে এলে।
ও তুমি বুঝবে না।
জহীর ও কথা বাড়াতও না।

মেম। কাউন্টারের মেয়ে টা ওকে বলছে।
চমকে তাকিয়ে বলল, সরি।
আজ কি যে হোলও প্রীতির।
দামটা মিটিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে এলো।
একটু দুরে বেশ একটা জটলা। অনেক গুলো পুলিশের গাড়ী, এম্বুল্যান্স। ঐ জটলা পেড়িয়েই প্রীতি কে যেতে হবে। এই ঠাণ্ডার মধ্যে এতো লোক কোথা থেকে এলো। ভাবতে যেয়ে হোঁচট খেলো ভাঙা ফুটপথের এক ইটের সাথে। ঠাণ্ডা তে হোঁচট খেলে ব্যাথা লাগে বেশি। পাশে একটু দাঁড়াল প্রীতি। রাস্তাটা সমতল নয়। উপরে উঠতে মাজা ধরে আসে।
জটলাটার কাছে এসে দাঁড়ালো প্রীতি। এক্সিডেন্ট হয়েছে, তাই এতো লোকজন। তাকালও না সে। অহরহ হচ্ছে।
আরও একটা ব্লক হাটতে হবে।

বাবা চলে যাওয়ার আগে বলেছিল। মা, তুই আর কত কষ্ট করবি। আমরা বোধহয় তোর বোঝা হয়ে গেলাম।
এমন কথা বলবে না বাবা, আমার মনে অনেক কষ্ট লাগে, বলে বাবার বুকে মুখ গুজে কেঁদেছিল। বাবা মেয়ের দুঃখ সহ্য না করতে পেরেই বোধহয় চলে গেলো।প্রীতি তাই মনে মনে ভাবে।
অথচ কি সুন্দর একটা ঝকঝকে জীবন ছিল ওর। জহীরের সাথে দেখা হওয়াটাও বলতে গেলে ঘটনা পূর্ণ।

বান্ধবী স্বাথীর বাসায় এসেছিল আড্ডা মারবে বলে। সেদিন ছিল রোববার। এক ঘেয়েমী থেকে একটু নতুনত্বের সাধ পাবে এই আশায়। ছাদের উপর আড্ডাটা ভালই জমেছিল। বাঁধ সাধলও ধমধম পায়ের আওয়াজে।
ও তুই এখানে? বলে শ্যামলা রঙের হাল্কা পাতলা ছেলেটা তাকালও ওদের দিকে।
তা এতো আওয়াজ করছ কেনও?
তুই না চা খাওয়াবি বলেছিলি।
নেও নবাব পুত্র এসেছে, উনাকে এখন চা খাওয়াতে হবে।
ওহো, পরিচয় করিয়ে দেই, আমার কাজিন, জহীর। থাকতো বোস্টনে। এখন তল্পিতল্পা গুটিয়ে চাকরি নিয়ে নিউইয়র্কে এসেছে। ছুটির দিন এসেছে চাচিকে দেখতে। আর এ হোলও—
থাক তুমি যাও আমি পরিচয় করে নেবো।
আমিও তোকে সাহায্য করি ? বলে উঠতে যাচ্ছিল প্রীতি।
আপনার আবার কি হোলও, ও একাই পারবে, আপনি বসুন।
কেনও জানি প্রীতি উঠতে যেয়েও উঠতে পারলনা । ওর কাছে মনে হোলও জহীরের চোখ দুটোতে মায়া মেশানো। আঁটকে গেলো সে।
কতদিন এসেছেন এখানে। এ যেন কথা বলতে হয় তাই বলা।
দুই মাস হোলও। লং আইল্যান্ড সিটি তে বাসা নিয়েছি। আসেন একদিন। চমৎকার ভিউ। নদীর ওপারে আকাশ চুম্বী দালান। রাতের ম্যানহাটন। অপূর্ব।
এক অপরিচিতা নারীর সাথে অবলীলাক্রমে কথা বলে গেলো। আর সে কেন পারছে না ওভাবে কথা বলতে?
না, কথা আর বলা হোলও না। স্বাথী চা নিয়ে এলো।

সন্ধাও ঘনিয়ে এলো। আবার উঠার পালা।
চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আমিও ট্রেন ধরব।

“তোমার মা কেমন আছে?”
ভাবনা থেকে সরে এসে তাকাল রহিমা খালার দিকে। বয়সে মার থেকে কিছুটা বেশিই হবে। অথচ উনি দিব্যি চলে ফিরে বেড়াচ্ছেন এই শীতের মধ্যে।
“খুব একটা ভালো নেই। বাতের ব্যথা টা বেড়েছে। হয়তো ঠাণ্ডার জন্য”।
“তোমার মা কে বল, আমি যে ঔষধ টা খাচ্ছি সেটা খেতে”। বলে ঔষধের নামটা বলল।
“বলব খালা”। বলে আবারও হাটতে শুরু করলো প্রীতি।
আজ যেন পথ শেষ হতে চাচ্ছে না।

সেদিনও জহীর বলেছিল, আচ্ছা এই পথ যদি শেষ না হয়।
তাহলে আমাদের মিল হবে না। পথের শেষেই তো বাসস্থান। সেই বাসস্থানই যদি না হলও তবে মিল কোথায়।
কি সুন্দর সে কথা বলতে শিখে গিয়েছিল। কথার পিঠে কথা বলতে পারতো। সে সবই জহীরের জন্য।
বাবা, মা বলেছিল, মাটির টুকরো ছেলে। কত বড় চাকরি করে অথচ কোন দাম্ভিকতা নেই।
বাবা মা কে পটিয়ে ফেলল কয়দিনে।
বাবা তো জহীর বলতে অজ্ঞান।
বাসায় এলে মা কত রকমের রান্না নিয়ে বসতো।
জহীর বাবা কে বলত, আঙ্কেল, এই নয়টা পাঁচটা চাকরি না করে ব্যবসা করেন।
না বাবা, ঐ রিস্ক নিতে রাজি নই। বেশ ভালো বেতন দেয় ওরা। আমার আর মা মনির বেতন দিয়ে বেশ ভালোই চলে যায় আমাদের। আর তাছাড়া হেলথ ইনস্যুরেন্স আছে। এদেশে এটা ছাড়া চলা মুশকিল। বয়স হয়েছে, ঔষধ পত্র তো প্রতিদিনই লাগে।
এই সব কত কিছু নিয়ে ওরা কথা বলতো।

একদিন বাবা প্রীতিকে ডেকে বলেছিল, এবার বোধহয় দিনক্ষণ দেখে কাজ টা শেষ করে ফেলা দরকার, মা।
প্রীতি জহীরকে সে কথা জানিয়েছিল।
একটু ইতস্তত করে জহীর বলেছিল, ঠিক আছে।

বেশি ধুমধান না করে, যথা সাধ্য যেটুকু না করলেই নয়, তাই করে বাবা প্রীতিকে উঠিয়ে দিয়েছিল জহীরের হাতে।
বড় নামকরা হোটেলে যেয়ে বাসর রাত করেনি, উঠেছিল জহীরের সাঁইত্রিশ তালার উপরে এপার্টমেন্টে।
আলো নিভিয়ে দিতেই দুরের ঝলমলে আলো এসে পড়েছিল ঘরটিতে। ঐ আলোতেই ওরা দেখছিল এঁকে অপরকে।
বিছানা এলোমেলো হয়ে গেলো, কিন্তু কোথায় যেন একটা অতৃপ্ত বাসনা রয়ে গেলো প্রীতির মনে। পূর্ণ হোল না সব সাধ।

আলুথালু বেশে সকালে উঠে পড়লো প্রীতি।
“কোথায় তোমার নাস্তার সরাঞ্জাম? দেখাও”।
পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, ঘাড়ে চুমু দিয়ে বলেছিল, আজ তা হয়না সুন্দরী, বাহিরে কোথাও নাস্তা করে নেবো। গোসল করতে হবে কি?
কি জানি? যে খেলা দেখিয়েছ কাল রাতে। বলে মুচকী হেসে টাওয়েল টা নিয়ে চলে গেলো প্রীতি।
ভালবাসায় কোন কমতি ছিল বলে মনে হয়নি প্রীতির।
তবে রাত এলেই জহীর বলতো, মাথা ধরার ঔষধ টা দেবে? অসহ্য, এ আর পারছি না।
অনেক দিন এমনও হয়েছে, ডিনার শেষে, সব কিছু গুছিয়ে এসে দেখে, জহীর ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রীতি আস্তে করে বালিশটা টেনে নিয়ে পাশে শুয়ে পড়েত।

বছর কেটে গেলো, প্রীতির মনে হয়, সব কিছু থেকেও, কি যেন নেই। কেন? জিজ্ঞাসা করবে ভেবে ছিল।
তা আর করতে হলনা।

সেই দুর্যোগ পূর্ণ রাতটা এলো।
প্রীতি বসে বসে টিভি তে খবর শুনছিল। জহীর আসতে কেনও আজ দেরী করছি এই ভেবে সময় টা দেখল। এমন কিছু রাত হয়নি। আবারও মন দিল টিভির দিকে।
কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলার শব্দ শুনল। জহীর সোজা চলে গেলো ওর বেডরুমে।
এমনতরও কখন হয়নি। একটু খটকা লাগলো প্রীতির।
উঠতে যাবে সেই সময় জহীর এসে বসলো একটু দুরে, কোন ভূমিকা না করেই বলল, তোমার সাথে কথা আছে।
কি ব্যাপার। সব ঠিক আছে?
না নেই। এটা আমারই অন্যায় তোমার উপর।
কি বলছ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
অনেক দিন ধরেই ভাবছি বলব, কিন্তু সাহস পাইনি। আজ আর না বললেই নয়।
জহীর তাকালও প্রীতির দিকে।
প্রীতি তার বুকের ধকধকানি শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আয়নায় দেখলে দেখতে পেতো তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
জহীর চুপ করে আছে দেখে প্রীতিই জিজ্ঞাসা করলো, তোমার কি অন্য কেউ আছে আমি ছাড়া?
আছে। তবে সে ভিন্ন।
প্রীতি তার রাগ সামলাতে পারলনা। চিৎকার করে বলল, হেঁয়ালি ছেড়ে সোজা উত্তর দাও।
বললাম তো, আছে, তবে সে মেয়ে নয়।
কি বলছ?
ঠিকই বলছি। আস্তে, নরম সুরে বলল জহীর।
ভেবেছিলাম তোমাকে পেয়ে হয়তো আমার পরিবর্তন হবে। আমি আমার অন্য দিকটা ভুলে যেতে পারব। পরিবর্তন আসবে আমার ভিতর। কিন্তু তা হলনা। আস্তে আস্তে তোমার প্রতি আকৃষ্ট টা কমে আসছে দেখে ভাবলাম, আর নয়, এবার সময় এসেছে বলার।
তার মানে তুমি আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলে। ছিনিমিনি খেলছিলে আমার জীবন নিয়ে। গরজে উঠলো প্রীতি।
আমি দুঃখিত।

দুঃখিত? You—– কথা শেষ না করে দাঁতে দাঁত ঘসতে ঘসতে দ্রুত পায়ে চলে গেলো তার ঘরে।
কিছুক্ষণ পর বেড়িয়ে এলো একটা সুটকেস নিয়ে।
জহীর বাঁধা দিল না।
সেই শেষ।

প্রীতি ফিরে এসেছিল বাবা, মার কাছে। জহীর যতটুকু দেওয়ার তার চেয়েও বেশি দিতে চেয়েছিল উকিলের মাধ্যমে।প্রীতি নেইনি। করুনা তার সহ্য হয়না।

বাসার সামনে টা অন্ধকার মনে হোলও আজ।
দরজা খুলল।
মা, এলি।
হাঁ, মা।

Continue Reading