ভবিতব্য

অস্তগামী সূর্যের লাল রশ্মি টা এসে পড়েছে তৌফিকের ড্রয়াইং রুমে। মনে হচ্ছে যেন আলো আধারের খেলা চলছে। একটু পড়ে সন্ধ্যা নামবে। দুরের আকাশ টা লালচে রঙে ছেয়ে যাবে। প্রতিদিন এই সময়টা তৌফিক বড় জানালাটার কাছে দাড়িয়ে দুর পানে চেয়ে থাকে। আস্তে আস্তে অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারিদিক।
অন্যদিন তৌফিক টিভি টা চালিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে বসতো। আজ আর তা করলো না।
গতকালের ঘটনা গুলো মনে করার চেষ্টা করলো।
শোভা আপার বাসায় ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যেতে হয়েছিল লাঞ্চ খেতে। সাথে ছিল সাধনা আর প্রতিমা।
তৌফিকের বান্ধবী। অনেকদিনের পরিচয়। অনেকে অনেক কথা বলে সাধনা আর তৌফিককে ঘিরে। তৌফিক পাত্তা দেয় না। ব্যচেলার থাকার এই একটা উটকো ঝামেলা, মনে করে তৌফিক।

এক গানের অনুষ্ঠানে সাধনা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তৌফিক কে।
“ এই তৌফিক, এদিকে এসো”।
প্রথমে ডাক টা শুনতে পায়নি তৌফিক। গান চলছে। একটু হট্টগোল।
দ্বিতীয় বারের ডাকে তাকাতেই হাত দিয়ে ইশারা করলো সাধনা। একজন কে ঘিরে দুই তিন জন।
কাছে আসতেই সাধনা বলল, চেন উনাকে? সামনে দাঁড়ানো মহিলা কে হাত দিয়ে দেখালও।
না চিনলাম না।
শোভা আপা। দেশে আমাদের বাসা আর উনাদের বাসা পাশাপাশি ছিল। সেই থেকে পরিচয়। আজ অনেকদিন পরে দেখা।
অনেকেই চেনে উনাকে। খুব পপুলার।
তুমিতো আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলে উনাকে চিনতে না পারাতে। বলে তৌফিক মৃদু হাসল।
মাফ করবেন, হয়তো দেখেছি কোথাও এইক্ষণে মনে করতে পারছি না।
না না তা কেন। একদিন আসেন আমার বাসায়। সাধনা কে নিয়ে। আমিই কল করে জানাবো।
অবশ্যই।
শোভা আপা কল করেছিল। আসতে বলেছিল। বয়সে দুই এক বছরের ছোট হতে পারে বলে মনে হোলও তৌফিকের।
নতুন পরিচয়ে নাম ধরে ডাকাটা শোভনীয় নয় বলে আপা শব্দ টা যোগ থাকলো।

ঘরে ঢুকতেই, তৌফিক দেখল বেশ কিছু পরিচিত লোকজন। যাক, তাহলে সে একা নয়। একটু স্বস্তি পেলো তৌফিক।
ফুলের তোড়া টা এগিয়ে দিতেই শোভা আপা বলল, কি ব্যাপার, একলা না সাথে কেউ আছে?
আছে, একজন নয়, দুজন। হাসতে হাসতে বলল তৌফিক।
আপনার সাথে আমার কথা আছে।
আমার সাথে? আপনি তো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলেন।
আমি আসছি, বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো শোভা আপা।
তৌফিক টেবিলের উপর থেকে কয়েকটা বাদাম উঠিয়ে নিয়ে আসতেই আসমা ভাবী ডাক দিল।
লেখা টা পড়লাম। খুব ভালো লাগলো।
আপনিই আমার একমাত্র পাঠক। তৌফিক হেসে বলল।
দেশের বাহিরে কি যাওয়া হবে।
এই মুহূর্তে না। নেক্সট ইয়ারে।
শোভা আপা ফিরে এলো। হাতে একটা ছবি।
তৌফিকের হাতে দিয়ে বললও, দেখেন তো চিনতে পারেন কিনা?
অনেক পুরানো ছবি। রং ফেড হয়ে গেছে। তবুও চেনা যায়। ছয় জন দাড়িয়ে। একপাশে তৌফিক। তারপর শোভা আপার স্বামী তার পাশে শোভা আপা।
তাহলে আপনি আমাকে চিনতেন? তাই না?
অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। জলজ্যান্ত প্রমান।
আপনাকে দেখেই মনে হয়েছিল কোথায় যেন দেখেছি। বাসায় এসে পুরনো এ্যালবাম গুলো খুলে দেখতে লাগলাম। অবশেষে আমি জয়ী।
আপনিতো রীতিমত সারলক হোমস। বলে হাসতে লাগলো তৌফিক।
নিচে ছেলেদের জন্য জায়গা করা হয়েছে।
আড্ডা বেশ ভালোই জমে উঠলো। মহিই কথা বলছে বেশি।
পলিটিক্স শেষে যার যার ছোট বেলার কৃতি কলাপ। তৌফিক চুপ করে শুনছিল।
এর মাঝে আরম্ভ হোলও ভুত, প্রেত এর জিন এর কথা।
মহি তার জিনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে যাবে সেই সময় ডাক এলো উপর থেকে।
খাওয়া রেডি।
খাওয়া শেষে এবার ফেরার পালা।

সাধনা, প্রতীমাকে নিয়ে বের হতে হতে সন্ধ্যা সাত টা বেজে গেলো তৌফিকের। বাহিরে তখনো অঝোর ধারায় ঝরছে।
তৌফিক বলল, তোমাদের কে নামিয়ে দিয়ে আমি যাবো রফিকের বাসায়। ওর বৌ আগামীকাল দেশে যাবে। দেখা করতে হবে।
তাহলে তো বাসায় ফিরতে তোমার দেরী হবে। রাতে খাবে কোথায়। বাসায় কিছু আছে? সাধনা জিজ্ঞাসা করতেই তৌফিক বলল রফিকের ওখানেই খেয়ে নেবো।

আচ্ছা তৌফিক ভাই আপনি বিয়ে করলেন না কেন? কেউ কি এসেছিল আপনার জীবনে কোন এক সময়।
অকস্মাৎ প্রতিমার এই প্রশ্নে তৌফিক কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও সাথে সাথে সামলে নিয়ে প্রতিমার দিকে তাকাল।
তোকে এতো পার্সোনাল প্রশ্ন করতে কে বলেছে? ধমকের সুরে সাধনা প্রতিমাকে বলল।

গাড়ীতে YouTube ভেসে আসা গান টা বন্ধ করে দিল তৌফিক। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।
নিস্তব্ধ ভিতরে। বাহিরে বৃষ্টির শব্দ।
সাধনা তাকাল প্রতিমার দিকে। প্রতিমা হাত জোড় করে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে জানাতে চাইল সে দুঃখিত।

এমনি বরষা ছিল সেদিন— নিস্তব্ধটা ভাঙ্গল তৌফিক।

ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি। প্রথম বর্ষে যা হয়। অত্যন্ত মনোযোগী পড়াশোনার ব্যাপারে। কাজেই লাইব্রেরিতে ঘনঘন যাতায়েত। এমনি একদিন লাইব্রেরির কাজ শেষ করে বাহিরে এসে দাঁড়ালাম। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। ছাতা টা খুলতে যাবো সেইক্ষণে, শুনতে পেলাম কে যেন বলছে, শুনছেন?
চারিদিকে চেয়ে দেখলাম আর কেউ নেই। আছি শুধু আমি আর সে। তবুও বললাম, আমাকে বলছেন?
জি, কোন রিক্সা তো দেখছিনা, যদি কিছু মনে না করেন আমাকে আপনার ছাতা দিয়ে ঐ গেট পর্যন্ত পৌছে দিলে ওখানে রিক্সা পেয়ে যাবো।
আসুন, তবে ছাতা টা খুব একটা বড় না, কিছুটা ভিজতে হবে।
পাছে শরীর স্পর্শ করে তাই অধিকাংশ ছাতাটা ওর দিকে দিয়ে আমি ভিজতে ভিজতে এগিয়ে চললাম। তবুও হাতে হাত লাগলো। শরীর স্পর্শ করলো। আমার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে খেলে গেলো এক উচ্ছল তোরঙ্গ। কোন মেয়ের সংস্পর্শে আগে কখন আসিনি তো।
বাহ! বড় রোমটিক্টার আভাস পাচ্ছি। প্রতিমা বলে উঠলো।
থামবি তুই? সাধনা ধমক দিলো।

আমার নাম তৌফিক, কেমিস্ট্রি মেজর।
আমি মলি, soil science মেজর। আপনার ডিপার্টমেন্ট থেকে খুব একটা দুরে নয়।
সাদা শাড়ী, কালো পাড় পরনে, দুই ভুরুর মাঝে কালো ফোঁটা। প্রথমে ভেবে ছিলাম ওটা তিল, সুন্দর মানিয়েছে। ওর গায়ের মিষ্টি গন্ধ বৃষ্টির সোঁদা গন্ধকে হার মানালো।
দুজনে ছাতাটাকে ধরতে যেয়ে ওর হাত টা এসে পড়লো আমার হাতের উপর।
ও চকিতে চেয়ে সরিয়ে নিলো।
তারপর? প্রতিমার আবার জিজ্ঞাসা।
গেটে এসে পৌছালাম। ভাবছিলাম, না পৌছালে বেশ হতো।
বৃষ্টি টা আরও জোড়ে কেনও এলোনা। কেন রিক্সা গুলো ওখান থেকে চলে গেলো না।
তাহলে আরও কিছুক্ষণ এক সাথে থাকা যেতো। তা আর হোলও না।
ও রিক্সায় উঠে বসলো।
বলল, অনেক ধন্যবাদ। আপনি তো আমাকে বৃষ্টি থেকে বাচাতে যেয়ে নিজে ভিজে একাকার।
বললাম, আমার হল কাছে, অসুবিধা হবে না।
দেখেন, ঠাণ্ডা যেন না লাগে। আপনি প্রতিদিনই কি লাইব্রেরি তে আসেন।
আসি এবং একই সময়।
জানা থাকলো।
ও চলে গেলো, আর আমার মনে হোলও ছাতাটা বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমি গাইতে থাকি
,”পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার মন জেগে ওঠে’
সাধনা চুপ করে শুনছে, প্রতিমা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, আবারও দেখা হয়েছিল।
হয়েছিল। সেই জাগায় সেই সময়ে প্রতিদিন।
কোথা দিয়ে দুটো বছর কেটে গেলো বুজতে পারিনি। তখন আমরা দুজনেই তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রী।
ইউনিভার্সিটি বন্ধ হোলও বেশ কিছুদিনের জন্য। ও চলে গেলো ওর দেশের বাড়ীতে।
সময় চলে গেলো, ও ফিরে এলো। গম্ভীর।
কি হোলও? জিজ্ঞাসা করতেই বলল,
বাবা বিয়ে ঠিক করছে।
লেখা পড়া শেষ হোলও না, বিয়ে ঠিক করছে মানে?
ভালো পাত্র পেয়েছে, বিদেশে থাকে। ইঞ্জিনিয়ার।
আমার তো এখনো কয়েক বছর বাকি পাশ করার। চল, কোর্ট ম্যরেজ করে ফেলি। কোন কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেললাম।
পাগল। বলে সে চুপ করে রইল। দেখি, চিন্তা করো না।
দুই তিন মাস কেটে গেলো। হঠাৎ একদিন দেখি আমার ডিপার্টমেন্টের সামনে সে দাড়িয়ে।
কি ব্যাপার?
ওর হাতে ধরা টেলিগ্রাম টা আমাকে দিলো। লেখা, মা ভীষণ অসুস্থ। যত তাড়াতাড়ি পারো চলে এসো।
বলল, আজ রাতের ট্রেনে চলে যাচ্ছি। ফিরে এসে সব বলব।

খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না তৌফিক ভাই।
ঠিক বলেছ,তার আর বলা হয়ে উঠেনি। সেই দেখাই ছিল শেষ দেখা। তার আর খোঁজ আমি পাইনি।
কি বলছেন?
ঠিকই বলছি।
শুনেছিলাম ওর বান্ধবীর কাছ থেকে। সে ক্যানাডায় চলে গিয়েছিল বিয়ে করে। এই পর্যন্তই।
আজ অনেক অনেক বছর হয়ে গেলো। আমিও চলে এলাম এই দেশে। বেশ আছি।

গাড়ী এসে দাঁড়াল সাধনার বাসার সামনে। প্রতিমা কোন কোথা বলল না। কিছুক্ষণ নীস্তব্দ থাকার পর তৌফিকই বলল, আবার এসো তোমরা।

যাবে কি বন্ধুর বাসায়। সাধনা জিজ্ঞাসা করলো।
যাবো।
সাবধানে যেও। বেশি রাত করো না। আর বৃষ্টি তে ভিজো না।

তৌফিক চলে গেলো।
ওখানে দাড়িয়েই প্রতিমা জিজ্ঞাসা করল, তৌফিক ভাই এর কথা একবার ভাববি কি?
না, বন্ধুত্ব টা হারাতে চাই না।

থাঙ্কসগিভীং এসে গেলো। মাত্র কয়েটা দিন বাকি। এমনি এক সকালে ঘুম ভাঙ্গলও সাধনার ফোনের আওয়াজে।
কি ব্যাপার? এতো সকালে ঘুমটা ভাঙলে তো।
সকাল মানে, বাজে দশ টা। শোন, বুবু কল করেছিল মিনিশোটা থেকে। ওখানে থাঙ্কসগিভীং করতে। তোমাকেও যেতে হবে আমার সাথে।
একি অর্ডার না অনুরধ?
দুটোই। আগামী পরশু যাবো। সকালের ফ্লাইট।
অগত্যা তৌফিককে যেতে হোলও। পৌছাল থাঙ্কসগিভীং এর একদিন আগে।
রানু আপা, সাধনার বুবু, অনেক আয়োজন করেছে। জিজ্ঞাসা করতেই বললও, তা প্রায় তিরিশ জনের মতো গেস্ট আসবে।
তৌফিককে কিছু করতে হচ্ছেনা। বসে বসে দেখছে। মাঝে মাঝে এটা ওটা এগিয়ে দেয়।
সময় হয়েছে লোকজন আসার।

টুং করে বেলটা বেজে উঠল। প্রথম অতিথি।
তৌফিক বলল, আমি দেখছি, তোমরা এইদিক টা দেখো।
আবারও টুং করে বাজলো।
তৌফিক খুলে দিলো দরজা টা।
সামনে দাঁড়ান সাদা শাড়ী কালো পাড় পড়া এক ভদ্রমহিলা। শুধু দুই ভুরুর মাঝে কালো ফোঁটাটা নেই।
অবিশ্বাস দৃষ্টিতে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল।

Continue Reading

ওল্ড ইজ গোল্ড

মিসেস পিটারশন আমার প্রতিবেশী। সকাল, সন্ধ্যায় ঘরের সামনে ছোট্ট চত্তরে চেয়ার নিয়ে বসে থাকে।
আসতে যেতে আমি হ্যালো বলি। মাঝে মধ্যে পাশের চেয়ার টা টেনে নিয়ে বসে গল্প করি।
এমনি এক সকালে কথায় কথায়, ওল্ড ইজ গোল্ড কথাটা বলতেই মিসেস পিটারশন ক্ষেপে উঠল।
ওল্ড ইজ গোল্ড কে বলেছিল কথাটা, একবার তাকে দেখতে ইচ্ছে করে। ভালই তো ছিলাম। যেই ষাট পাড় হলাম অমনি রাজ্যের অসুখ এসে হানা দিলো। এখন গিটে গিটে ব্যাথা, সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয়টা ঔষধ খেতে হয়।
৬৫ বছর আমার ছেলেমেয়েরা ধুমধাম করে পালন করলো। বললও, আবার তুমি রিটায়ার করো।
করলাম। এখন প্রতিটি ঔষধে কো পেমেন্ট দিতে হয়। এই তোমার ওল্ড ইজ গোল্ড। গজরাতে গজরাতে মিসেস পিটারশন ভিতরে চলে গেলো।
আমিও রওয়ানা দিলাম। কয়েকজন মিলে আড্ডা দেওয়ার কথা।
ইদানীং আড্ডার সুর পাল্টিয়েছে। আগের মতো হৈহৈ নেই। বয়স সবার মিসেস পিটারশনের মত। কাজেই আড্ডা যদিও আরম্ভ হোল হাস্য রসিকতা নিয়ে, কিন্তু একটু জমে উঠতেই একজন বলে উঠল তার প্রেশার আজ তুঙ্গে উঠেছে। অমনি আর একজন সুর ধরল তার আজ দুদিন ধরে হার্টবীট টা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। আলোচনা সীমাবদ্ধ হোল শারীরিক আর মানসিক অবস্থার মঝে।
Depressing.
বললাম, এইসব আলোচনা থাক।
রফিক বলে উঠল, তা আর কি নিয়ে আলোচনা করবো বলও। স্টক মার্কেট? ওটা একদিন নর্থে গেলে দুইদিন যায় সাউথে। বুক ধড়ফড় করে।
৪০১কে।
ওটাই তো সম্বল। বৌ সেদিন রাগ করেছিল। বলল, সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে মানি মার্কেটে রেখে দাও। তাহলেই তো কোন চিন্তা নেই। শোন কথা। বুক ধড়ফড় করলেও ওটাই একমাত্র excitement দেয়। কি বলিস?
হাঁ, অন্য সব excitement তো লাঠে উঠেছে। হাসতে হাসতে বললও শমিত।
আসলেই, বার্ধক্য খুব সুখের নয়। নানা রকম সমস্যা। শুধু তাই নয়, অন্যদেরকে ও বাতিব্যাস্ত করে তোলা।

মানুষ মানতে রাজি নয় যে সে বার্ধক্যে পৌছে গেছে।
এইতো কিছুদিন আগেও তো সে জোড়ে হাটতে পারতো, আজ কেনও তার হাঁটুতে ব্যাথা। সময় যে পেড়িয়ে গেছে তা সে জানতে পারেনি। ব্যস্ত ছিল ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া নিয়ে। বাড়ী ঘর নতুন করে সাজান নিয়ে। ধাপে ধাপে উন্নতির পথে এগোন নিয়ে। বলা যায় এ এক কম্পিটিশন। শরীরে রোগ দেখা দেয়নি। শুধু কাশি সর্দি।
খেয়ে নেও দুটো Zartec, চলো এগিয়ে।
সেই চলতে চলতে একদিন আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখল কয়েক টা পাকা চুল। চোখের নিচে পানির থলি।
হাটতে যেয়ে মনে হোলও একটু বিশ্রাম নিলে ভালো হতো।
সাড়া জীবন ব্যায়ামের ধার ধারেনি। কলকব্জা গুলোতে মরিচা পড়ে গেছে।
ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি অনেকদিন হোল।

কি ব্যাপার খাওয়া দাওয়াতে কোন কন্ট্রোল নেই আপনার?
ডাক্তারের কথাতে হুঁশ ফিরে আসে।
কেন? কি হয়েছে।
কলেস্ট্রল তো চুঙ্গে উঠেছে। ব্লাড প্রেসার তো আকাশ ছুঁই ছুঁই। ব্লাড সুগার আর নাইবা বললাম।

রোজ চার থেকে পাঁচটা ঔষধ খাওয়া আরম্ভ হোলও।
বাসায় এসে গেলো প্রেসার মাপার যন্ত্র, এসে গেলো সুগার মাপার যন্ত্র।

কি রে কিছু ভাবছিস?
কি আর ভাববো, বড় বোন বাথরুমে যেতে যেয়ে পড়ে গেছে। মাথা তে চোট লেগেছে।
তারপর?
সিটি স্ক্যান করেছে। খুব একটা ভালো না। মাথায় রক্ত জমেছে। কথা জড়িয়ে আসছে।

আমাদের সবাই কে সাবধানে চলতে হবে। বললও গিয়াস।
তা আর বলতে। এইতো সেদিন হাটতে যেয়ে বা দিকটাতে একটু চাপ অনুভব করলাম। পাত্তা দিলাম না।
বৌ এর চাপে পড়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। বলে বাবুল একটু দম নিলো।
কি বলেছে ডাক্তার, জিজ্ঞাসা করলো সানু।
Angiogram করতে হবে। দেখবে কোন ব্লক আছে কিনা।

আমাদের সবাই কে এখন স্ট্রেস টা কমাতে হবে। স্ট্রেস কুড কিল ইয়ু। বললও সানু বিজ্ঞের মত।
স্ট্রেস কমাতে চাইলেই কমাতে পারবো ? মেয়েটার এখনো বিয়ে হয়নি। বয়স তো কম হোল না। বলে উদাস ভাবে তাকালও আকাশের দিকে বাবুল।

শোন, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। বাবা যখন রিটায়ার করল পঞ্চান্ন বছর বয়সে, ভেবে ছিলাম অনেক বয়স হয়েছে বাবার। আমাদের কিন্তু অনেক আগেই তা পেড়িয়ে গেছে। কাজ কমিয়ে দে। চল, জিমে যাওয়া আরম্ভ করি। বডি টাকে ফিট রাখতে হবে।
আমার কথা শেষ না হতেই রফিক বলে উঠল, কাজ কমিয়ে দেবো? এখনো মর্টগেজ রয়েছে। রিটায়ার করবো ভেবেছিলাম। হিসাব করে দেখলাম পোষাবে না।
যতটুকু গিলতে পারবে তার চেয়ে বেশি গলার ভিতর দিয়ে বসে আছো। তখন ভাবোনি। আসলে আমরা কেউই ভাবিনি একদিন বার্ধক্য আসবে। বিজ্ঞের মত বলল আমিন।
কিছুদিন আগে একজন আমার মেসেঞ্জারে কিভাবে চির তরুন ও নিরোগ থাকা যায় তার পদ্ধতি লিখে পাঠিয়েছি।
অবশ্য এটা একটা বিশ্বখ্যাত চিকিৎসকের পরামর্শ।
কি বলেছে সে? উদগ্রীব হয়ে শুনতে চাইল সানু।
সকালে ঘুম থেকে উঠে গরম পানি খাওয়া। দুধ ছাড়া চা। সারা দিনে আট থেকে বারো গেলাস পানি খেতে হবে।
ধূমপান নিষিদ্ধ। রেড মিট অর্থাৎ গরু,খাসি, ভেড়ার মাংস খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে।
হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না, ওসব আমার দাড়া হবে না। মাঝ পথে থামিয়ে দিলো আমিন। কবে, কখন কোথায় মরবো তাতো লেখা আছে। এসব তথ্য শুনে লাভ নেই।
খোদা না করে যদি তোর স্ট্রোক হয়। একটা দিক অবশ হয়ে যায়। তোকে দেখবে কে? তুই তো বোঝা হয়ে থাকবি অন্যের।
বলে সানু তাকাল আমিনের দিকে।

শোন আলোচনা এখানেই শেষ কর। যেতে হবে নাতিকে দেখতে। তবে আমার একটা প্রস্তাব।
কি?
প্রতি সপ্তাহে রবিবার সকালে আমরা সবাই মিলিত হবো নাস্তা খেতে। একঘণ্টা দুইঘন্টা কাটাবো গল্প করে। অসুখের কথা নয়। শুধু মন মাতানো কথা। রাজি?
রাজি? আমি আর একটা জিনিস যোগ করতে চাই। বলল আমিন।
কি?
প্রতি মাসে একবার আমরা মুভি দেখতে যাবো। রাতের শো তে। গৃহিণী দের কে বাসায় রেখে?
হাসতে হাসতে সবাই বললও রাজি।
আলবৎ রাজি।

Continue Reading

ছাব্বিশে অক্টোবর

    আজ কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই নন্টুর। অনেক বছর আগে হলে, দুজনে হাত ধরাধরি করে বেড়িয়ে পড়তো। কোন একটা ভাল রেস্টুরেন্টে দুটো সিট আগের থেকেই রিজার্ভ করে রাখতো। মাঝ রাতে উঠে যে কার্ড টা আগের দিন কিনে রেখেছিল সেটা বিছানার পাশের টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতো। সাথে এক গোছা লাল গোলাপ। 

আজ তার পরিবর্তে সে এসে বসলো সোফাতে। সামনে স্তূপ করা পুরানো চিঠি।
যে গুলো সে লিখেছিল আর প্রতি উত্তরে পেয়েছিল বিয়ের আগে।
সে গুলো পড়তে যেয়ে চশমাটা ঝাপসা হয়ে এলো নন্টুর। চিঠির মাঝে ভেসে এলো সাদাটে ফ্রেমের চশমা পড়া মুখটা। যেন সে নিজেই পড়ে পড়ে শুনাচ্ছে। বলছে, এক সাথে পড়বো ভেবেছিলাম তা আর হয়ে উঠলো না।
দেখো, দেখো কি ছেলেমানুষি কথা লিখেছি এই চিঠি টা তে। বলে যেন সে হাসছে।
চিঠির তারিখ গুলো দেখেছ?
দেখেছি। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে লেখা।
এখনো রেখে দিয়েছ কেনও?
অন্য সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছি। এটা আমার। এক মাত্রই আমার। তাই।
আজ এলে যে। বলে নন্টু নাক টা ঝেড়ে নিলো।
না এসে পারি। আজ যে ছাব্বিশে অক্টোবর। আমার বাবা আমাকে শপে দিয়েছিল তোমার হাতে।
বলেছিল, সুখে দুঃখে তুমি ওর পাশে থাকবে। ও আমার বড় আদরের মেয়ে। কিন্তু বাবা বেশিদিন দেখে যেতে পারলো না আমার সুখ টা।
গতকাল ঐ এ্যালবাম টা দেখছিলাম। বলল নন্টু।
কোনটা?
ছাব্বিশে অক্টোবর, উনিশ শো —– টা
চুয়াল্লিশ বছর হয়ে গেলো। কি সুন্দর করেই না তুমি রেখে দিয়েছ। কাজের ভিড়ে যখন ছিলাম তখন আর ওই গুলো দেখা হয়ে উঠেনি। শুধু তোমার সাথে ঘুরেই বেড়াতাম। আজও কি ঐখানেই আছে ঐগুলো ?
না সেখানে নেই। ছোট্ট দুটো কামরা নিয়ে আছি। একটা ঘরে রেখেছি তোমার সব ছবির এ্যালবাম গুলো।
বলে নন্টু উঠে কয়েকটা ন্যাপকীন নিয়ে এলো।

জানো মনে হয় এইতো সেদিন ছিল আমাদের একসাথের সুখের দিন গুলো।
বেশ কিছু বছর কেটে গেলো তুমি নাই, কি ভাবে বোঝাই বলও, I miss you.
মনে হয় তুমি আবার আসবে, আমরা আবার আগের মত হাসবো।
এ জনমে নয় পরের জনমে আমরা আবার একসাথে হবো।
মৃত্যু আমাদের ভালবাসা কে ছিনিয়ে নিতে পারেনি, আমরা আজ দুজনে দুই জাগায়, তবু তুমি আছো আমার মাঝে।
যে স্মৃতি আমরা দুইজনে গড়ে তুলে ছিলাম আজ আমার মনের মাঝে তা চির জাগ্রত।
তুমি স্বর্গে আছো শান্তিতে, মুক্ত বিহঙ্গের মত।
যখন আমার ডাক আসবে দেখা হবে তোমার সাথে Pearly Gate এ। হবে তো ?
হবে।

নন্টু তাকালও চারিদিকে ঝাপসা চোখে। ঘরটা অন্ধকার। আলো জ্বালানো হয়নি।
অন্ধকারে চিঠি গুলো ভাজ করল। রাখল পাশে।
দাঁড়াল যেয়ে জানালার সামনে। বাহিরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।

Continue Reading

কান্না

                                           কান্না             

মা, বাবা কে হারিয়ে যখন ছোট্ট তপুর দায়িত্ব আমার উপর এলো তখন সবে মাত্র আমি চাকরি তে ঢুকেছি।
তপু আমার ছোট্ট ভাই। শেষ বয়সের মা বাবার নাড়ী পোঁছা ছেলে। দাদা বলতে অজ্ঞান। সব সময় আমার পিছনে ঘুর ঘুর করে বেড়াত।
বাবা চলে গিয়েছিল অনেক আগে।
কান্সারে আক্রান্ত জর্জরিত শরীর নিয়ে একদিন মা আমাকে ডেকে বলেছিল, সানু, আমার সময় বোধ হয় এলো। তুই তপু কে দেখিস। তোর কাছে রেখে গেলাম। ওর সব দায়িত্ব তোর।
কথা দিয়ে ছিলাম মা কে।

এক রাতে মা চলে গেলো। তপুর চোখে জল আমি দেখিনি। শুধু আমার দিকে ভাষাহীন চোখে চেয়েছিল।
সব কৃত্যকর্ম শেষ করে যখন বাসায় ফিরে এলাম তখন অনেক বন্ধু বান্ধব এলো সহানুভূতি জানাতে।
নিয়ে এলো খাবার।
বসলো পাশে।
জহীর বলেছিল, দরকার পড়লে আমাকে ডাকিস।
অনেক বন্ধুর মাঝে সেই আমার একান্ত প্রিয়। সময়ে অসময়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আস্তে আস্তে বাসাটা খালি হয়ে গেলো। সবাই চলে গেলো। শুধু রইলাম আমি আর তপু।
বাস্তবতার সামনে দাড়িয়ে মনে হোল পারবো কি? পারবো কি মা কে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে।

সেই দিন তপু এসে আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছিল। একটা কথাও বলে নি।
আমি ওর চুলের মাঝে হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলাম, ভাবিস নে তপু, আমি তো আছি।
সে কি বুজেছিল জানি না।
কিছুদিন কেটে গেলো। আস্তে আস্তে সয়ে এলো নির্জনতা।
একদিন জহীরকে আসতে বললাম। ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার জন্য।

ও এলো।
কফির পানি বসিয়ে দিয়ে এসে বসলাম সোফাতে।
জহীর জিজ্ঞাসা করল, কিছু ভেবেছিস কি?
না। তবে এইটুকু জানি তপুর মনে যেন কোনদিন কোনক্রমে এই ভাবনা না আসে যে সে মা বাবা হারা।
বুজেছি। বলে জহীর চুপ করে রইল।
বললাম, একটা ছক কেটেছি।
কি?
আমার আয় দিয়ে সংসার টা চালাতে একটু কষ্ট হবে । তাই ভাবছি, বাড়ীর উপরের অংশ টা ভাড়া দিয়ে দেবো। আমরা দুজনা নিচের দুটো ঘর নিয়ে থাকবো। কি বলিস?
মন্দ না। তবে একটু ছোট হয়ে গেলো না কি?
তা বটে। তবে মানিয়ে নিতে পারবো মনে হয়।

উপরের টা ভাড়া দিয়ে নিচে চলে এলাম আমরা দুজনে। ছোট্ট দুটো ঘর। এক চিলতে বসার জায়গা। তপু কে বললাম, একটু অসুবিধা হবে তাই না?
সে বলল, না দাদা, কোন অসুবিধা হবে না।
সমস্যা দেখা দিলো খাওয়া দাওয়ার। জীবনে কোন দিন রান্না ঘরে ঢুকিনি। মার বর্তমানে কেই বা আসে রান্না ঘরে। ফলে ডিম ভাজী ছাড়া আর কিছু আমার আয়ত্তে নেই।
বাহিরের থেকে কিনে খাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
অপু কিছুই বলে না। তবে বুঝতে পারি বাহিরের ওই তেলের উপরে ভাসা তরকারি গুলো ওর পছন্দ নয়।

সাধন দা আর বৌদি। আমার উপর তালার ভাড়াটে। নিতান্তই ভাগ্য ক্রমে এত ভাল একটা ভাড়াটে পেয়েছিলাম। বয়স ষাটের উপরে হবে সাধন দা র। ছেলে মেয়ে নেই। একটা কোম্পানি তে আইটি ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। বৌদি বাসাতেই থাকে।
এটা ওটা ভাল কিছু রান্না হলে পাঠায়ে দেয়।
সাধন দা একদিন বলেছিল, তোমাদের যদি ধর্মীয় কোন কারনে আপত্তি না থাকে তবে এসো, মাঝে মধ্যে এক সাথে বসে রাতের আহার খাওয়া যাবে। আর গল্পও করা যাবে।

বৌদি উপর থেকে ডাক দিতো। ও ঠাকুরপোরা, এসো তোমার দাদা এসেছে। গল্প করবে, একটু পরে টেবিল সাজাবো।
তপু তার লেখাপড়া নিয়ে ব্যাস্ত থাকাতে পরে এসে যোগ দিত।
এই ভাবে দিনগুলো ভালই কেটে যাচ্ছিল।
একদিন, রাত এগারটা। সবে মাত্র বিছানায় গেছি।
বৌদি চিৎকার করে ডাকদিল। ঠাকুরপৌ তাড়াতাড়ি আসবে।
তড়িঘড়ি করে আমি আর তপু দৌড়িয়ে গেলাম।
কি হয়েছে? বলেই সাধন দার দিকে তাকাতেই বুঝলাম উনার নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে।
দেরী না করে ৯১১ কল করলাম।
বৌদি অঝোরে কাঁদছে।
এ্যাম্বুলেন্স তাড়াতাড়ি এলো। ওরা সাধন দা কে নেওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে মনে হয়?
হার্ট অ্যাটাক।
বৌদি সাধন দাকে নিয়ে পিছনে বসলো। আমি সামনে ড্রাইভারের সাথে।
হাসপাতাল খুব একটা দুরে নয়। ওখানে আসতেই EMS এর লোকেরা দ্রুত সাধন দা কে নিয়ে গেলো কার্ডিয়াক অপারেটিং রুমে।
আমি আর বৌদি বসে রইলাম বাহিরে, ওয়েটিং রুমে।
সময় যেন যেতে চায় না।
বৌদি কে জিজ্ঞাসা করলাম, কফি খাবে?
না। আমার ভয় করছে।
ভয় কিসের, ইদানীং এইসব সার্জারি, ডালভাত।
বৌদি যে খুব একটা ভরসা পেলো মনে হোল না। ।
কয়েক ঘণ্টা পড়ে ডাক্তার বেড়িয়ে এলো।
জিজ্ঞাসা করতেই বলল, এই মুহূর্তে বলতে পারব না। আটচল্লিশ ঘণ্টা গেলে বুঝতে পারবো। হার্ট অ্যাটাক নয়। স্ট্রোক হয়েছে।
সাধন দা কে ইনটেনশিভ কেয়ারে নিয়ে যাওয়া হোল। দেখতে গেলাম। নানা রকম যন্ত্রপাতি লাগানো। বৌদি একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। কি বলে সান্ত্বনা দেবো বুঝে পেলাম না।
সকাল হয়ে এলো। জানি আজকে আর কাজে যাওয়া হবে না। বৌদি কে বললাম, চল বাসায় যেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আসব।
যাবার পথে জহীরকে জানিয়ে রাখলাম। এসে দেখি তপু স্কুলে চলে গেছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারবনা। জহীরের টেলিফোনে ঘুম ভাঙ্গলো।
দরজাটা খোল, আমি তো বাহিরে দাঁড়ান। কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বিকেল চারটা। বৌদিকে বলেছিলাম হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
ডাক দিলাম, নেমে এলো। চোখ জবা ফুলের মত লালা। সারাক্ষন বোধহয় কান্না করেছে।
জহীরকে বললাম,চল, তোকে আর বাসায় ঢুকতে হবে না। হাসপাতালে যেতে যেতে কথা হবে। বলে গাড়ীতে উঠলাম।
কথা যে খুব একটা হোল তা নয়।
শুধু বৌদি একবার বললও, ঠাকুরপো, তোমার দাদা ভাল হবে তো? না হলে আমাদের কি হবে আমি ভাবতে পারছিনা, ঠাকুরপো। বলেই অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
কি বলে সান্ত্বনা দেবো বুঝতে পারলাম না।
জহীর বলল, ভাবছেন কেনও ভাবী, আমরা তো আছি।

দিন যেয়ে মাস এলো। সাধন দা বাড়ীতে। বাম পাশটা পুরোপুরি অবশ। কোন অনুভূতি নেই। চেয়ে থাকে, কিন্তু দৃষ্টি যে কোথায় বোঝা যায়না। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ বের হয়। মনে হয় কি যেন বলতে চাইছে।
আমরা কেউ বুঝতে পারছিনা দেখে, ডান হাত দিয়ে হাতের কাছে যা কিছু আছে ছুড়ে ফেলে দেয়।
বৌদি সবকিছু কুড়িয়ে এনে আবার সামনে রাখে।
ডাক্তারের মতে কোন মিরাকেল ঘটার সম্ভবনা নেই। এইভাবেই চলবে যতটুকু সময় তার আছে।

একমাত্র তপুকে দেখলে চেহারায় উজ্জলতা আসে। তপু পাশে বসে বিভিন্ন গল্পের বই পড়ে শোনায়। তখন সাধন দা চোখ বুজে থাকে। ডান হাতটা দিয়ে তপুর হাতটা নিয়ে খেলা করে। আমি ভাবতে থাকি এ বোধহয় পুত্রস্নেহ। যার সাধ দাদা বৌদি পাইনি।
তপুর জ্ঞান হওয়ার আগেই বাবা চলে গিয়েছিল। তাই বাবার স্নেহ সে পাইনি। এটা বোধ হয় তার কাছেও একটা বড় পাওয়া।
একদিন রাতে তপু উপরে যেয়ে সাথে সাথে ফিরে এলো।
কিরে ফিরে এলি যে?
সাধন দার বোধ হয় শরীর টা ভাল না। বমি করছে।
তাড়াতাড়ি উপরে এলাম।
সাধন দা হুইলচেয়ারে বসা। সামনে বড় একটা পাত্র। কিছুক্ষণ পরপর বমি করছে। আর গোঁ গোঁ করে কি যেন বলার চেষ্টা করছে।

কি করব ঠাকুরপো? হাসপাতালে নিয়ে যাবো কি?
বললাম, দাড়াও, আমার এক ডাক্তার বন্ধুকে কল করি। দেখি সে কি বলে।
দুবারের মাথায় ফোন ধরল সে। বুঝিয়ে বলতেই, বলল, আমি ফার্মেসিতে কল করে দিচ্ছি। তুই যেয়ে ঔষধ টা নিয়ে আয়। আর স্যালাইন ওয়াটার খাওয়াতে থাক। যদি রাতের মধ্যে না থামে তাহলে হাসপাতালে নিয়ে যাবি।
বৌদিকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে এসে দেখি তপু বালিশে মাথা গুজে শুয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করতেই বলল, আমার কিছু ভাল লাগছেনা, সাধন দা ভাল হবে তো?
ও যে কখন এতো এটাচট হয়ে গেছে সাধন দার সাথে বুঝতে পারিনি।

দিন দিন সাধন দার শরীর অবনতির দিকে যেতে থাকলো। আমিও ব্যাস্ত কাজ নিয়ে। একটা প্রমোশন হওয়াতে কাজের চাপ আরও বেড়েছে। প্রতিদিনই দেরী করে বাসায় ফিরতে হয়। উপরে যাওয়া হয়ে উঠে না। খবর পাই তপুর কাছ থেকে।

সেদিন ছুটি আমার। সকালে উপরে এলাম। বৌদির দিকে তাকিয়ে মনে হোল, বৌদি অনেক শুকিয়ে গেছে।
আমাকে দেখে বলল, অনেকদিন তুমি আসোনি ঠাকুরপো। গতকাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।
কি বলল?
কি আর বলবে।
বলল, একটা একটা করে অর্গান গুলোর ক্ষমতা কমে আসছে। আমাকে প্রস্তুত থাকতে বলল।
এ শুধু সময়ের অপেক্ষা ঠাকুরপো। আমার চোখের সামনে আস্তে আস্তে ও নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। আমার হাতে মাথা রেখে ও একদিন চলে যাবে ঠাকুরপো।
আমার চোখে জল এলো। ঠেকাতে যেয়েও ঠেকাতে পারলাম না। ঝরে পড়ল।
বৌদি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
শুনতে পারলাম নিচের থেকে তপুর কান্নার শব্দ।

Continue Reading

জন্মদিন

 

সকালে পিনাট বাটার আর জেলির প্রলেপ দেওয়া টোস্ট রুটি টা টেবিলে রেখে কফির মগ টা মাইক্রওয়েব থেকে বের করতে যাবো ঠিক সেই সময় ফোন টা বেজে উঠল।
মেয়ে ফোন করেছে।
এতো ভোরে তার ফোন করার কথা নয়। সচরাচর করে না। তারপর আজ ছুটির দিন। স্বাভাবিক সময়ের বাহিরে কিছু হলে বুকের ভিতরে টা ধক করে উঠে। আজও তার ব্যাতীক্রম হোল না। ভাল চিন্তার পরিবর্তে খারাপ চিন্তাটা আসে আগে।
হন্তদন্ত হয়ে ফোনটা উঠিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সব খবর ভাল তো।
হ্যা, ভাল। আজ তোমার জন্মদিন, মনে আছে?
ও হ্যা তাই তো। জন্মদিন। মনে যে খুব একটা দোলা দেয় এই দিনটাতে তা নয়। কারন কোনদিন পালন করা হয়নি, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী বাবা দের আমলে উদযাপন করা হতো বলে মনে পড়েনা।
পরের প্রশ্নটা আমার মেয়ের ছিল, এটা তোমার আসল না নকল জন্মদিন, আব্বু?
বললাম কি জানি মা, আসল না নকল তাতো জানিনা। তবে তোমার দাদা যেদিন আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছিল, সেদিন এই তারিখ টাই ভর্তির ফর্মে লিখেছিল। এখনকার মতো সেই যুগে বার্থ সার্টিফিকেট বলে কিছু ছিল না।
কাজে আমি জানি এই তারিখ টাই আমার জন্মদিন।
ওর সন্দেহ অহেতুক নয়। এই রকম আমাদের দেশে হয়। হয় যে না তাতো নয়।

যাহোক, ওসব নিয়ে ওর মাথা ব্যাথা নেই। আজ তার বাবার জন্মদিন এটাই তার কাছে বড়।
বলল, চলো আমি খুব সুন্দর একটা সিফুড রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের জন্য বুক করেছি। সমুদ্রের পাশে। ওখানে তোমার বার্থডে সেলিবারেট করব। তৈরী হয়ে থেকো। আমি ঠিক বারটায় তোমাকে পিক করব।
ক্লোজেটা খুলে ওরই দেওয়া পলো টি সার্ট টা বেছে নিলাম।
কিছুদিন আগে নিয়ে এসেছিল। দেখিয়ে বলেছিল, দেখতও আব্বু পছন্দ হয় কিনা।
কালো রং আমার সবসময় পছন্দ। তার উপর সে আমার নামের প্রথম অক্ষর গুলো embroidery করে এনেছে। পছন্দ না হয়ে পারে?
ওটাই বেছে নিলাম।
ঠিক সময় মতো এসে হাজির। ঘরে ঢুকে প্রথম জিজ্ঞাসা, দিনের, রাতের খাবার আছে?
রেফ্রিজারেটর খুলে দেখে নিলো আছে কিনা।
-আছে। আর তাছাড়া ইদানিং এক ভদ্রমহিলার কাছ থেকে সপ্তাহের খাবার অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসি। উনি ক্যাটারিং করে। ভাল রাঁধে।
-তাহলে তো খুবই ভাল। একথা বলোনি তো?
হয়ত ভুলে গেছি।
চলো, বেড়িয়ে পড়ি।
রেজোয়ান এলো না?
না, আজ তুমি আর আমি, ফাদার ডটার ডে। তোমার সাথে পুরো দিন কাটাব। বলে জড়িয়ে ধরল।
চোখের কোণ টা ভিজে উঠল। বুঝতে দেই নি। পাছে ওর মনটা ভেঙ্গে পরে।
সমুদ্রের কোল ঘেঁসে রেস্টুরেন্ট। সূর্যের আলোতে সমুদ্রের পানি ঝলমল করছে। তাপমাত্রায় গরমের ভাব টা কম। সেই সাথে মৃদু হওয়া। হিউমিডিটি নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে বলতে হয় পারফেক্ট ডে।
বাহিরে ছাতার তলে বসলাম।
ঘাটে বাঁধা অনেক বোঁট। বড়লোক দের। মাঝে মাঝে তারা বেড়িয়ে পরে দুর পাল্লায়। এইখান থেকে অনেকে বোটে চড়ে যায় ফায়ার আইল্যান্ডে।
ওয়াটার মেন্যু দিয়ে গেলো। বেশির ভাগ সময় মেন্যু আমি খুলে দেখিনা। ওদের কে বলি যেটা ভাল মনে করো সেটা অর্ডার দিয়ে দাও।
আমার জন্য ওয়াটার কে বলল, shrimp filled with crabstaff। সাথে সুপ।
ওয়াটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলো।
কিছুক্ষনের জন্য হয়ত অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, মেয়ের ডাকে ফিরে এলাম।
কি কিছু ভাবছ?
কই নাতো?
জানো তোমার জন্য Toms এর জুতো অর্ডার দিয়েছি। সাইজ কত? সাড়ে আট, তাই না? বলে তাকাল আমার দিকে।
হাঁ, তাই, তবে—
কথা শেষ হতে দিলো না সে, বলল, জানো আব্বু আমি চেয়েছিলাম, তুমি আমার সাথে থাকো। অসুবিধা কি? থাকলে আমারও ভাল লাগতো। জানি তুমি স্বাধীন চেতা, কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা তোমার কুষ্ঠিতে লেখা নেই। থাকবে?
না মা, এই তো বেশ আছি। তুমি তো প্রতিদিনই খোঁজ নিচ্ছ। না চাইতেই অনেক কিছু নিয়ে হাজির হও। এর চেয়ে বড় আর কি আছে বলও।
তুমি চাইবে? কারো কাছে ? বলে হাসল সে।
ওর মুখ টার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হোল যেন খোদাই করে ওর মার মুখ টা কেউ বসিয়ে দিয়েছে। চোখের তারায় ভালবাসার ছোঁয়া। আমায় নিয়ে ভাবনা তার। হারাতে চায় না। দেখতে চায় হাঁঠছি, চলছি ওর সামনে।

shrimp filled with crabstaff কোথায় রাখবো? ওয়েটার মৃদু কণ্ঠে বলল।
দেখিয়ে দিলাম কোথায় রাখতে হবে। জিজ্ঞাসা করলো, কোন ড্রিঙ্কস?
জীঞ্জারেল।
ও চলে গেলো।

হঠাৎ ই মেয়ে আমার বলে উঠল, আব্বু তোমার ছোটবেলার গল্প বলও।
ছোটবেলা?
হাঁ, মনে পরে?
এখনো জ্বলজ্বল করে মনের পর্দায়। তোমাদের ছোটবেলা আর আমাদের ছোটবেলার মধ্যে পার্থক্য অনেক।
বলও। খুব ইন্টারেস্টিং। তাই না?
তবে শোন।
সুপে চুমক দিতে দিতে বললাম, তুমি তো জানো তোমার কয় ফুফু আর চাচা।
হাঁ, তোমরা সাত ভাই বোন।
আমি পাঁচ নম্বর। শুনেছি আমি নাকি হাংলা পাতলা ছিলাম। পেটে কিছুই সহ্য হতো না।
তুমি হাসছ?
হাঁ, তোমাকে এখন দেখে তো মনে হচ্ছে না তুমি একসময় ঐ যে ওয়ার্ড টা বললে, হাংলা ছিলে।
না এখন অবশ্য বোঝার উপায় নেই। তখন এমনও পরিস্থিতি হয়েছিল আমাকে বাঁচানো দায় হবে বলে সবার মনে হয়েছিল। একথা শুনেছি বড় হয়ে। যাক অনেক চেষ্টা করে আর উপরওয়ালার কৃপায় আমি বেচে গিয়েছিলাম।
বোঝার বয়স হওয়ার পর থেকেই দেখেছি বাসা ভর্তি লোক। তোমার গ্রেট গ্র্যান্ড মা থাকতো আমাদের সাথে। আর সাথে থাকতো তোমার আর এক দাদা। আমার বাবার মেজভাই।
আমাদের রাতের খাওয়ার ভাঁড় ছিল আমার দাদির অর্থাৎ তোমার গ্রেট গ্র্যান্ড মার হাতে।
বাসার বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে হারিকেনের আলোয় আমরা চার ভাই বোন পড়াশুনা করতাম।
হারিকেনের আলো মানে? Electricity নেই?
না মা, সেই পঞ্চাশ দশকে বিদ্যুৎ আসেনি ঐ ছোট্ট শহরে।
তারপর?
তারপর দাদি তার কাজ কর্ম শেষে আমাদের কে ডাক দিতো। আমাদের অপেক্ষার অবসান হতো।
তোমার বন্ধু ছিল না?
বন্ধু? সেলিম, তীতু, টিপু, মহি, গোপাল, আরও অনেক, নাম মনে পড়ছে না। কোন কোন দিন স্কুল থেকে এসে কোন রকমে বই গুলো রেখে, ঘুড়ি, লাটাই নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম। অন্যান্যরা এসে হাজির হতো মাঠে। পল্টূ ছিলও সবার ছোটো। ও দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো দেখত।
মাঝে মাঝে এসে আমাকে বলতো, দাওনা আমাকে লাটাই টা, একটু ধরি।
জানো একদিন কি হয়েছিল?
কি?
ওকে আমি লাটাই টা দিয়ে বললাম, তুই ধরে রাখ, আমি পানি খেয়ে আসি।
ওর মুখের হাসি যদি দেখতে।
এসে দেখি ও কাঁদছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে?
ওকে আর বলতে হোল না, তাকিয়ে দেখি আমার ঘুড়ি টা ছৌ মেরে নিচে এসে একটা ছোট আমগাছের ডালে আঁটকে গেছে।
তুমি ওর উপর রাগ করেছিলে।
না, বললাম চল, আম গাছে উঠতে হবে।
উঠেছিলে?
হাঁ, ও নিচে দাড়িয়ে রইল, আমি তড় তড় করে উঠে গেলাম, হাত বাড়িয়ে ঘুড়ি টা ধরতে যাবো ঠিক সেই সময় একটা কাটবেড়ালি লাফ দিয়ে আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে দৌড়ে গেলো। আমার হাত ছুটে গেলো ডাল থেকে।
ধপাস করে পড়লাম মাটিতে।
তারপর? বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞাসা করলো সু।
তপু, মহি দৌড়ে এলো।
আমি তখন উঠে দাঁড়িয়েছি। মনে হোল কিছু হয়নি। বাড়ীতে চলে এলাম। কাউকে কিছু বললাম না। রাতে হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা আরম্ভ হোল। কাঁদছি দেখে দাদি জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে।
বললাম গাছে উঠতে যেয়ে পড়ে গেছি। বাবা কে ডাক দিল। বাবা দেখে বলল, মনে হচ্ছে হাত টা ভেঙ্গেছে।
ভেবে ছিলাম বাবা বকবে। না, বকা দিলোনা।
সেই রাতে বাবা তার এক বন্ধু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। সে দেখে বলল, কাল সকালে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।
ভেঙ্গে ছিল?
হাঁ, পরদিন হাসপাতালের ডাক্তার দেখে হাতে Cast লাগিয়ে দিলো।
ওহ, মাই গড।
আর কোন এডভেঞ্চার আছে তোমার ছোট বেলায়।
হাসতে হাসতে বললাম, একটা? অনেক। একটার কথা বলি।

একদিন আমি, তপু, আর সেলিম মেঠো পথ দিয়ে হাটতে হাটতে যাচ্ছিলাম হারানের বাসায়। পথে চোখে পড়ল আঁখের বাগান, আঁখ মানে সুগার ক্যান। সেলিম বলে উঠল, চল কয়েকটা আঁখ ভেঙ্গে নিয়ে আসি। যেই কথা সেই কাজ।
বাগানে ঢুকে কয়েকটা আঁখ ভেঙ্গে যেই বাগান থেকে বের হতে যাবো, দেখি সামনে দাড়িয়ে একজন, হয়তো বাগানের মালিক, হাতে একটা অস্ত্র, আঁখ কাঁটার অস্ত্র।
তারপর?
সবকিছু ফেলে দিয়ে আমরা দিলাম দৌড়। সেও পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে, আর গালি গালাজ করছে। হঠাৎ মাটির ঢেলাতে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়লাম মাটিতে। সেলিম আর তপু কিছুটা এগিয়ে যেয়ে আবার ফিরে এলো। দেখলাম লোকটা আর আমাদের পিছনে নাই।
উঠে দাঁড়ালাম। তপু বলল, অ্যাই, তোর কনুই দিয়ে রক্ত পড়ছে।
তাকিয়ে দেখি বেশ কিছুটা জাগা ছেঁচে গেছে মাটিতে গসা লেগে। অগত্যা কি করি। একটু হাটতেই দেখতে পেলাম কয়েকটা কচু গাছ। ওর পাতা ছিরে রস টা লাগিয়ে দিলাম কাঁটা জাগায়। শুনেছি ওটা লাগালে রক্ত পড়া বন্ধ হয়।

আঁখ তো খাওয়া হোল না। হারানের বাসাতেও যাওয়া হলনা। বাড়ী ফিরে এলাম।
দাদি দেখে জিজ্ঞাসা করলো, এই সর্বনাশ কি ভাবে হোল?
বললাম, ফুটবল খেলতে যেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।
সু হেসে উঠলো হাঁ হাঁ করে। বাহ, বুড়ো দাদি কে বেশ তো বুঝিয়ে ছিলে।
তা ঠিক।
এই রকম আরও কত এডভেঞ্চার আছে সেই ছোট্ট বেলায়। আজ মনে হলে হাসি পায়।
তবে জানো কি মা, এটা একটা অভিজ্ঞতা। ছোট বেলার ছোট ছোট ঘটনা ছোট বেলাতেই মানায়। বড় হয়ে ঐ গুলোর স্মৃতি মন্থন করতে ভালই লাগে।
সত্যি আব্বু, তোমাদের ছোট বেলা, আর আমাদের ছোট বেলার মধ্যে পার্থক্য অনেক। যুগ পাল্টিয়েছে। তাই না?
তাতো বটেই। চল, সূর্য পড়ে এলো। এবার বাসার দিকে যাই।
আব্বু, চলো না আজ আমার সাথে। আমার বাসায় থাকবে।
আজ নয় মা, আর একদিন। আজ বাসায় যেয়ে পুরো দিনটাকে আবার আমি ফিরিয়ে আনবো আমার কল্পনায়। উপভোগ করব নতুন করে, তোমার সাথে কাটান দিন টা। কি বলও?
ঠিক আছে, তুমি যা ভাল মনে করো। চলো, উঠি।

Continue Reading

অস্পৃশ্য

চারিদিকে অসুখ আর মৃত্যুর খবর। খবরের কাগজে আছে খুন খারাবি আর ধর্ষণের। টিভি তে আছে পলিটিক্সের মারপ্যাঁচ।
এই সব দেখে ধুত্তর, বলে টিভি টা বন্ধ করে দিল আমজাদ। বলতে গেলে সারাদিন আজ সে বাসাতে বন্দি। বাহিরে একবার বেড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণের জন্য, চা এর দুধ টা ফুরিয়ে গেছে, ওটা আনতে।
বাবুল কে ফোন দিল। এই একটা স্বভাব তার। সাথে সাথে ফোন ধরবে না। বললে বলবে, ফোন টা পড়েছিল বেডরুমে। অথবা সে ছিল বাথরুমে। ঠোটের কাছে কথা এসে থাকে। সেটা আমজাদ জানে। তবু ও কল করে তাকে। একমাত্র সেই অন্যদের মতো নয়।
অন্যদের সাথে কথা বললে মনে হবে ওরা কবে গোড়ে অর্থাৎ মাটির নিচে যাবে সেই চিন্তায় মগ্ন। ওদের ধ্যান ধারনা ইহকালের নয়, সব পরকালের। ফলে কথা বেশিক্ষণ চলে না।
আর একবার কল করতেই, ফোন টা উঠাল বাবুল।
কি ব্যাপার আমজাদ ভাই। কি করেন?
বসে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজছি।
চলে আসেন। ডিনার করবো একসাথে।
এইজন্য বাবুলের সাথে মেলে ভাল। আড্ডা মারতে জানে। আমজাদ ও মনে মনে তাই চাইছিল। ঘরে আজ খাবার বাড়ন্ত না হলেও, ওই একই খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া মন টাও বিগড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ আগে কাকলি কল করে বলেছিল, সে যেতে পারবে না আমজাদের সাথে অনুষ্ঠান দেখতে।
পাঁচ ছয় জন বন্ধু বান্ধবী মিলে যাওয়ার কথা।
কাকলিই আমজাদকে একদিন বলেছিল, আমজাদ ভাই কোন দিন যদি কোন প্রোগ্রাম করেন তাহলে আমাকে জানাবেন। আমি যেতে চাই। মোহিত তো এই সবে ইন্টারেস্টেড না।
সেই জন্যই আমজাদ ওকে জানিয়েছিল, নামকরা কিছু আর্টিস্ট আসছে, ভাল অনুষ্ঠান হবে, যাবেন?
রাজি হয়েছিল, টিকিট ও কাঁটা হয়েছে।
এখন বলে সে যেতে পারবেনা কারন মোহিতের সম্মতি নেই।
আমজাদের বুঝতে বাকি নেই, কারন টা যে তারই জন্য। সেইজন্যও মেজাজ টা খিঁচিয়ে আছে।

সাড়ে সাতটার দিকে আসবো। খাওয়ায় কম পড়বে না তো?
আপনি যে পরিমাণ খান, তাতে কম হবে না বরং কিছু বেচে যেতে পারে। বেঁধে দেবো? বলে হাসতে থাকলো বাবুল।
ওপাশ থেকে সাথী অর্থাৎ বাবুলের বৌ এর গলা শুনতে পেলো আমজাদ।
জিজ্ঞাসা করতে বললও, আমজাদ ভাই পাতলা না ঘন ডাল খাবে।
যে কোন একটা হলেই চলবে, ফকিরের আবার চয়েস। বললও আমজাদ।
সন্ধ্যা টা ভালই কেটে গিয়েছিল আমজাদের। বেঁধে দিয়ে ছিল সাথী ভাবী।
অনেক বার না করেছিল আমজাদ, বলেছিল, সামনের সপ্তাহ থেকে একজন কে পেয়েছি, সে পাঁচ দিনের খাবার সাপ্লাই দেবে। এতদিন পড়ে একটা সুরাহা হোল। কি বলেন, ভাবী।

কেন আমাদের কাছ থেকে খাবার নিতে আপনার বাধে।
না না তা কেন। আপনাদের উপর ভরসা করেই তো এতদিন চলেছি। ডিমান্ড এর চেয়ে সাপ্লাই ছিল প্রচুর। বলে হাসতে থাকলো আমজাদ।
সন্ধ্যাটা ভালই কেটে গেলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল নয়টা বাজতে তখনো পাঁচ মিনিট বাকি। এশার নামাজ টা ধরতে পারবে। গাড়ীতে উঠে আমজাদ ভাবল সে তো একসময় এপথের পথিক ছিল না। পরিস্থিতি তাকে এই পথে এনেছে।
না, সে গোঁড়ামি পছন্দ করে না। যার জন্য অনেকের বিরাগভাজন। কথা কাটাকাটিতে সে যেতে চায় না।
যে এই পথে এনেছিল সে তো পাড়ি জমালও।
যাওয়ার সময় আমজাদ কে বলেছিল, আমি তো চললাম, তুমি আমার হয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করো।
আমজাদ কথার খেলাপ করেনি।
মসজিদে এসে দেখল খুব একটা লোকজন তখনো আসেনি। ইমাম সাহেব তার রুমে বসে কি যেন লিখছে।
বিরক্ত করতে চাইলো না আমজাদ।
ইমাম সাহেবই ডাক দিলো।
কি কারনে যেন ইমাম সাহেবের সাথে একটা অদৃশ বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। আমজাদ আজও বুজতে পারেনি কেন হোল, কি ভাবে হোল।
এই তো কিছুদিন আগের কথা, ইমাম সাহেব আমজাদ কে দাওয়াত করেছিল উনার বাড়ীতে। প্রথমে আমজাদ বুজতে পারেনি ইমাম সাহেব কি বলতে চাইছে।
জিজ্ঞাসা করেছিল, কি বলছেন?
আমার বাসায় আপনার দাওয়াত।
কথাটা আমজাদ রিপিট করে বলেছিল, আপনার বাসায় আমার দাওয়াত?
হা। আমিতো সহজ বাংলাতে বলছি। ইমাম সাহেবের মুখে হাসির আভা। আসবেন তো?
অবশ্যই। ইমামের বাসায় দাওয়াত কস্মিনকালেও শুনিনি তো, তাই একটু দেরী হোল বুজতে। বলে হাসতে থাকলো আমজাদ।

আমজাদ গিয়েছিল। বসে বসে শুনছিল উনার চার ভাই আর অন্যান্য দের আলোচনা। কাটখোটটা আলোচনা নয়। বর্তমান পরিস্থিতি, সেই সাথে হাদিস নিয়ে আলোচনা।
ইমাম সাহেবেরা চার ভাই। চার ভাই ই হাফেজ। শুধু তাই নয় বড় বড় ইউনিভারসিটি থেকে পাশ। গোঁড়ামি নাই।
সেইজন্যই হয়তো আমজাদের সাথে মেলে ভাল।

কি ব্যাপার চেহারায় মলিনতা কেন? শরীর ভালত? নতুন জোক শুনাবো?
আপনার জোক শুনলে তো আমাকে আবার অজু করতে হবে।
দুজনই হো হো করে হেসে উঠলো।
ইমাম সাহেব, একটা কথা বলব? আমজাদ প্রশ্ন করে তাকাল।
নির্বিঘ্নে।
ছোট বেলায় কোরান শরিফ পড়ার চেস্টা করেছিলাম, হয়ে উঠেনি। একটু যদি সময় করে দেখিয়ে দিতেন।
অবশ্যই। ফজরের পরে আপনাকে নিয়ে বসব। ঠিক আছে।
আমতা আমতা করে আমজাদ বলেছিল, মানে কত দিতে —-
কথা শেষ হতে দেইনি ইমাম সাহেব, বলেছিল, ওই কথা যদি বলেন, তবে আপনার আসার দরকার নেই।

বাসায় ফিরে আসতেই ফোন এলো ছোট বোনের কাছ থেকে।
ছোটদা, জাহাঙ্গীর ভাইএর শরীর টা ভাল না। আবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। তুমি কি একটু কল করবে ঊর্মিকে।
আমজাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল হয়েছে বাংলাদেশে।
ঊর্মি ফোন ধরেই বললও, বাবার হার্ট অ্যাটাক মত হয়েছে। আই সি উ তে আছে। এযাত্রা কি হয় বলতে পারছি না।
আমজাদের এই বোনটার উপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে। প্রথম স্বামী কে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় রাজাকাররা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বাসা থেকে। আর ফিরে আসেনি। ঊর্মি তখন পেটে। ও বাবা কে দেখতে পায়নি।
অনেক কষ্ট করে দুই ছেলে মেয়ে কে মানুষ করেছিল সে।
দেখা হয়েছিল জাহাঙ্গীরের সাথে। সুখের সংসার। কিন্তু তা আর ওর কপালে সইল না। জাহাঙ্গীরের ব্লাডে ক্যান্সার ধরা পড়ল। বাসা হাসপাতাল নিয়েই ব্যাস্ত সে। আমজাদ মাঝে মাঝে ফোন করে। কি বলবে সে? সান্ত্বনা দিয়ে লাভ কি?

শুয়ে শুয়ে আমজাদ ভাবছিল, সুখের দিনগুলো বড় তাড়াতাড়ি চলে গেল। সামনে শুধু এবড়ো থেবড়ো পথ। আলো টা নিভিয়ে দিলো। অন্ধকারে ঢেকে গেলো ঘর টা।

চি চি আওয়াজ করে ফোন টা বাজছিল। সকালের দিকেই ঘুমটা আসে আমজাদের। প্রথমে ঘুমের ঘোরে বুজতে পারানি কোথা থেকে আওয়াজ টা আসছে। বুজতে পেরে ফোনটা উঠিয়ে দেখল নয়টা বেজে গেছে। সেলিমা কল করেছে।
কি ঘুম ভাঙালাম?
অনেক টা তাই।
শোন, কে কি নিয়ে যাবে ঠিক করেছি। তুমি শুধু Disposible কাপ প্লেট আর কফির সরঞ্জাম আনবে। ঠিক আছে?
দুই দিনের জন্য পাঁচ বন্ধু বান্ধবী সাথে রোড আইল্যইন্ডে যাওয়ার কোথা। আমজাদ সব ব্যবস্থা করেছে। Airbnb পাওয়া গেছে। নদীর পাশে।
আমজাদ, সেলী, ইউসুফ, আমিন, সেলিমা, ফাতিমা। ঢাকা তে ইউনিভারসিটি পড়া কালিন এই ছয় জন একসাথে ঘোরাঘুরি করত। সেলিমার ছিল ফীয়াট গাড়ী। ওই ছোট্ট গাড়ীর ভিতর ছয়জন কি ভাবে আঁটত আমজাদ ভেবে পায় না। অবশ্য আমজাদের ওজন ছিল তখন নব্বই পাউন্ড। অন্যদের ও একই অবস্থা।
হাসি পায়। আজ একশো পঞ্চাশে দাঁড়িয়েছে।
প্রতি বছর ওরা কোথাও না কোথাও যায়। ওদের সাথে আমজাদের জমে ভাল। চুল ছেড়া ছেড়ির গল্প নেই। পলিটিক্স নিয়ে আলোচনা। তাও এখানকার পলিটিক্স। পলিটিক্স শেষে গান চলছে। রাত একটা দুটো পর্যন্ত।
আমিন, শেলী Democratic পার্টির সাথে ভীষণ ভাবে সংযুক্ত। বলতে গেলে শেলী ফিলাডেলফিয়ায় ওদের জাগার Democratic পার্টির হর্তাকর্তা বিধাতা।

দোতালা বাসা। পিছনে নদী। হৈ হট্টগোল নেই। চারিদিকে নীরব নীঝুম। পাখির কল কাকুলী। কাটবেড়ালি গুলো গাছের উপরে উঠছে নামছে। এক কথায় অপূর্ব দৃশ্য।
সকালের নাস্তা সেলিমা তৈরি করে। ফাতেমা জোগান দেয়। সবাই বসে গল্প করতে করতে খায়। প্রতিদিনের এক ঘেয়েমী থেকে বেড়িয়ে আসার মাঝে যে কি আনন্দ তা ওরা উপলব্ধি করে।
দুটো দিন আনন্দের মাঝে কেটে গেলো আমজাদের। কথা হোল এবার ওরা সবাই মিলে ইন্ডিয়া যাবে।
আমজাদকে বলল সব ব্যবস্থা করতে।
আমজাদ রাজি।
এবার ফেরার পালা। বিদায় নিয়ে আমজাদ উঠে পড়ল গাড়ীতে। ওকে একলা ফিরে যেতে হবে।
কথা হোল মাঝ পথে থামবে কোন সার্ভিস ষ্টেশনে। সেখানে হবে শেষ কফি খাওয়ার পর্ব।
তারপর গুড বাই।

Continue Reading

টেগোর

 

নাতি আমার দেড় বছর হবে আর কিছুদিন পর। সেই একদিন বয়সের টেগোর আর আজকের টেগোরের মাঝে পরিবর্তন আমি লক্ষ করছি।
ও হাঁ, টেগোর শুনে অনেকে মনে করবে এ কোন টেগোর।
না, আমি আমার নাতির কথাই বলছি।
এই নাম কোথা থেকে এলো?
ওর বাবা, মা, অর্থাৎ আমার ছেলে আর বৌমা একদিন এক রেস্টুরেন্টে খেতে বসে বলল, জানো আব্বু আমরা আমাদের মাঝে আসছে নতুন অতিথির কি নাম হবে তা ঠিক করেছি।
তাই?
অনুমান করো, কি নাম হবে?
অনেক নামই বললাম, আমি, সুষমা আর জীবন(হবু নাতির নানী) ।
না হোল না। বলে তাকালও সে তাসমিয়ার দিকে।
বলব, তবে কাউকে বলবে না। ঠিক আছে? করাল কাটিয়ে নিলো আমাদের কাছ থেকে।

ওর নাম হবে টেগোর কামরুল আলম।
আকাশ থেকে পড়লাম আমি। না শুধু আমিই নই , সবাই।
টেগোর? তুমি কি জানো টেগোর কে?

কেনও জানবো না? স্টাডি করেছি টেগোরের উপর। আর তোমার গাড়ীতে চলতে চলতে তো শুধু টেগোরের গানই শুনতাম।
বলল সে।
এদেশে জন্মে, ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলে, ওরা যে টেগোর কে ওদের ঘরে নিয়ে এসেছে,এঁর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে।
বললাম, আমি মুগ্ধ। আমি হয়তো থাকবো না ও যখন বড় হবে, তোমরা ওকে শিখিও, জানতে দিও টেগোর কে। তবেই হবে ওর নামের সার্থকতা।

তারপর বেশ কিছুদিন গড়িয়ে গেছে।
হঠাৎ একদিন তাসমিয়া, শান্তনু ডাক দিলো আমাকে। বলল, চলে এসো আমাদের বাসায়। দেখবে টেগোরের ঘরটা কি ভাবে সাজিয়েছি।
তখনো সেই ছোট্ট তুলতুলে টা এসে পৌছায় নি।

আমি এলাম। দেখলাম ঘরটা। ছোট্ট শোয়ার বিছানা। পাশে Reclining chair. দুধ খাওয়ার সময় দোল খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়বে ছোট্ট মনি।
দালানের রঙ অফ হোয়াইট। তার মাঝে বড় বড় করে করে রবীন্দ্রনাথের অনন্ত প্রেমের কোটেশন
“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে অনিবার”।
অপূর্ব।
পছন্দ হয়েছে? দুজনে একি সাথে বলে উঠল।
খুউব-।

সেই তুলতুলে টা একদিন ঝড়, বাদল, বরফ মাথায় নিয়ে এসে হাজির হোল। জানালো তার আগমন বার্তা।
আমি এসে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াই। ডাইপার পালটিয়ে দেই।
চোখ মেলে চাইতো না সে।
শান্তনু জিজ্ঞাসা করেছিল, আব্বু পারবে এসব করতে?
হেসে বলেছিলাম, তোমাদের দুই ভাই বোনকে তো করেছিলাম, সেই রাতে উঠে দুধ খাওয়ানো, ডাইপার পালটানো।
তখন করতে পারলে, আজ ও পারবো।

দিনে দিনে দিনগুলো পাড় হয়ে গেলো।
মায়া বাড়তে থাকলো।
দরজা খুলে আমাকে দেখলে ফিক করে হেসে দিতো। দুই হাত বাড়িয়ে দিলে ঝাঁপিয়ে পড়তো।
তখনো সে হামাগুড়ি দিতে শিখেনি।
লোকে বলে আসলের চেয়ে ফাউ এঁর উপর মায়া বেশি।
ওর দাদি বলতো, নাতি, নাতনী যাই হোক, আমি ওদের কে স্পয়েল করে দেবো। সে সুযোগ সে আর পেলো না। তাই মাঝে মাঝে ওর দাদির ছবি দেখিয়ে বলি, চিনতে পারো, কে এই সুন্দরী?

একদিন সন্ধ্যায় বসে চা পান করছি। শান্তনু বলল, আজ টেগোরের sleep traning হবে।
sleep traning মানে?
তখনও টেগোরের বর্ষ পূর্তি হওনি
ঠিক সাত টায় ওকে গোসল দিয়ে খাওয়া দাওয়া করিয়ে, পাশে বসে বুক রিডিং করে, শুইয়ে দেবো।
তারপর?
ও আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়বে।
যদি না ঘুমিয়ে কাঁদে।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়বে।
ঠিক আছে।
বেশিক্ষণ আমি বসতে পারিনি। কান্নার আওয়াজ আমার কানে আঘাত হানল। বললাম, আমি চললাম, এই কান্না আমি সহ্য করতে পারবো না।
আব্বু, আস্তে আস্তে সয়ে যাবে তোমার।
জানিনে বাবা, আমরা সেকেলে হয়ে গেছি। তোমাদের নতুন পদ্ধতি আমার পোষাবে না। আমি চললাম।
সারাটা পথ আমার কানে ওর কান্নার স্বর বাজছিল। ও আমাকে এতো মায়ায় কেন জড়িয়ে ছিল, জানিনা।

দুদিন পর এলাম, আমাকে দেখে ওর নানীর কোল থেকে আমার কোলে এলো। জীজ্জাসা করলাম, রাতের কি অবস্থা?
ওর নানী বলল, এই দুদিন কাঁদেনি।
ওর নানী বাসা বাড়ী, কাজ, সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নাতি পালতে এসেছে। ঝড় তার উপর দিয়েই যায় বেশি।
আমি আসি। ওর নানী কিছুটা সময় পায় তার নিজের কাজ ঘুছাতে।
সেই সাথে মায়া বাড়ে।
প্রতিদিন না আসতে পারলেও Taggy Fan Club এর মাধ্যমে দেখতে পাই টেগোরকে। ওর নানী সকাল সন্ধ্যায় ওর বিভিন্ন ধরণের দুষ্টুমি গুলো তুলে ধরে। আমি দেখি, সবাই কে দেখাই। মাঝে মাঝে শেয়ার করি দুরে যারা আছে। এ যেন আমার নতুন চাকরি।
এখন সে হাটতে শিখেছে। একটা কথা স্পষ্ট করে বলে, বাইরে।
মানে ওকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
ঠ্যাঁটামি বেড়েছে।
ওর ইচ্ছে মত আমাকে দাড়িয়ে থাকতে হবে অথবা বসতে হবে। না করলে চলবে না। মাথা খুঁটবে। ফেক কান্না কানবে।
নাতি আমার চালাক কম নয়।
এই তোঁ সেদিন ওর মা নিয়ে গেছে পার্কে। বাসার পাশেই পার্ক। ওখানে তার নিত্যদিনের যাওয়া আসা।
দোলনায় দুলে দুলে হাত দিয়ে দেখালও এবার সে পানির ফোয়ারাতে খেলবে। খেলছে সে, ঠিক সেই মুহূর্তে ছোট্ট একটা ওরই বয়সের তুরবুরানী মেয়ে পানিতে ভিজতে ভিজতে এসে ওর গালে চুমু দিয়ে দিলো।
এই বয়সে? আমি হাঁ হাঁ করে হেসে উঠলাম।

মাঝে মাঝে সকাল সন্ধ্যা কাটিয়ে দেই ওর সাথে। বলি কি, বড় দেড়ি করে এলি, এখন আমার মাজায় ব্যাথা, বয়স হয়েছে, তোর সাথে পাল্লা দিয়ে কি আমি পারি।
মায়ায় ভরা হাত দুটো মেলে দেয়, কোলে উঠবে। কোলে উঠে মাথা টা গুজে দেয় আমার কাঁধে।
ঘুমাবে না, আদর নেবে।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। আমার চলে যাবার পালা।
কত বার শান্তনু তাসমিয়া বলেছে, থেকে যাও আব্বু, তোমার জন্য নিচে থাকার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
মাঝে মাঝে থাকি। কিসের টানে যেন চলে যেতে হয়।
যাবার সময় চুমো দি য়ে বলি, আসি সোনা।
ওর চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারি ও যেতে দিতে চায় না। ছলছল চোখ।
ফিরে আসি দরজার থেকে।
ঝাঁপিয়ে পড়ে কোলে। কিছুক্ষণ থাকি আরও।
ওর নানীর কোলে দিয়ে বলি এবার যেতে হবে।
ওকে নিয়ে ওর নানী চলে যায় অন্য দিকে।
আমি দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়ি। ভাসতে থাকে আমার চোখে ওর জলে ভরা চোখ দুটো।

Continue Reading

সেদিন দুজনে

 

কয়েকটা দিন খুব আনন্দে কেটে গেলো।
তাই না?
তুমি আসার আগে বলে ছিলে, আমাকে নিয়ে কিন্তু অনেক ঘুরতে হবে।
আমি তার কার্পণ্য করিনি।
কি বলো?
কুয়াশা ঘেরা সকালে তুমি এসে নামলে। তখন ও শিশির কনা ঝরে যায়নি ঘাসের পাতা থেকে।
দুর থেকে দেখতে পেলাম তোমার সেই হাস্যময় মুখটা।
কাছে এসে হেসে বললাম,দাও তোমার সুটকেস টা|
উঠাতে যেয়ে মনে হলো ওজন অনেক বেশি।
বললাম. এর ভিতর কি লোহা লক্কর না আর কিছু?
ও তুমি বুঝবে না? মেয়েদের অনেক জিনিস পত্র লাগে।
তা আমি জানি।
কোন এক সময় আমার সাথেও একজন ছিল। কত জোড়া জুতো এনেছো।
তা তোমাকে বলতে যাবো কেন?
বাহ! আমি টানছি সুটকেস আর আমি জানতে পারবো না।
বড় বেশি বকবক করছ তুমি। চলো তো। বলে তুমি উঠে পড়লে গাড়ী তে।
এই ভোরে এয়ার পোর্টে আসতে তোমার খুব কষ্ট হয়েছে। তাই না? বলে ক্লান্ত দৃষ্টি দিয়ে তাকালে আমার দিকে।
তা একটু হয়েছে বৈকি। বলে একটু হাসলাম।
শামির বাসায় আসতে ঘন্টা খানেক লেগে গেলো।
নাস্তা তৈরি করে রেখেছিল তাননার মা।
তুমি নাস্তা শেষে উপরে উঠে গেলে। ঘুমে তোমার চোখ ঢুলো, ঢুলো।
আমি বসে রইলাম। গল্প করলাম তাননার মার সাথে।

সেই রাতে তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম ঝলমলে আলোয় সাজানো রাতের Time Squareএ ।
শিশুদের মত চোখ বড় বড় দেখতে থাকলে।
বিভিন্ন ভঙ্গিতে তোমার অসংখ্য ছবি রইল আমার ক্যামেরাতে।
আমাদের দুজনের সেলফি গুলো, দারুন! তাই না?
পোস্ট করবো কি ফেস বুকে? বলতেই বললে,
সমস্যা কি?
না মানে —-
রাখো তোমার মানে মানে।
সত্যি বলতে কি তোমার আমার বন্ধুত্বের মাপ কাঠি অনেক উপরে।
অনেকেই তা বুঝবে না।

আজ নির্জন ঘরে বসে মনে পড়ছে পরের দিন তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম গ্রিন পোর্টে।
আঁকা বাকা রাস্তা ।
দুদিকে ফলের বাগান। চারিদিক সবুজে ভরা।
আমি আবৃত্তি করছিলাম, জীবনানন্দ দাশের, বনলতা সেন।
তুমি বললে, বাহ তুমি তো সুন্দর আবৃত্তি করতে পারো। তোমার যে এই গুন ছিল তা তো জানতাম না।
এই আবৃত্তি শুনেই তো কত মেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল।
আমি তো জানি তুমি একজন কেই পাগল করে ছিলে।
তাই?
হা।
শুনবে আর একটা।
না, বাহিরের দৃশ্য টা উপভোগ করবো। বড় বড় দালান কোঠা দেখতে দেখতে চোখ ক্লান্ত হয়ে এসেছে।
তুমি সুন্দর মনোরম একটা পরিবেশ দেখালে।
আর কতদূর সেই সমুদ্রের পাড় টা। তুমি বলেছ ওর পাড়ে বসে আমরা দুপুরের খাওয়া খাবো।
ধীরে বন্ধু ধীরে। উৎকন্ঠার মধ্যেই তো আনন্দ ।
তোমার হেয়ালি কথা আমি বুজতে পারিনা। বলে তুমি তাকালে বাহিরের দিকে।

Claudio’s রেস্টুরেন্ট। পানির পাশে। ঘাটে বাঁধা অনেক বোট । আমরা বসে ছিলাম পানির কোল ঘেঁষে।
ফিস এন্ড চিপস আর কালামারির অর্ডার দিলে তুমি।
মাঝে মাঝে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। তুমি বললে. খুব সুন্দর একটা জাগায় নিয়ে এসেছ।
চল , খাওয়া শেষে একটু হাঁটব , দোকান পাট গুলো দেখব।
সে আর বলতে। কেনা কাটা তো তোমার নেশা। তাই না?
বাজে বকোনা। ঘুরে দেখতে ভাল লাগে।
চল তবে যাই।
অবশেষে কত কিছু কিনেছিলে মনে আছে?
কানের দুল. নেটের বোনা জামার উপর আলতো করে ফেলে রাখা কারডিগান ।

সন্ধ্যা হওয়া এলো।
তুমি বললে, এবার চলো ফিরে যাই। বোনেরা সবাই উদগ্রীব হওয়া আছে।
সন্ধ্যায় আলো আঁধারের মাঝে গাড়ী চলেছে, দুপাশের মাঠ অন্ধকারে ঢুবে গেছে। দুরে দুই একটা আলোর রেখা। রোমানটিক পরিবেশ। 
কি ব্যাপার কথা বলছ না যে? বলে মৃদু ধাক্কা দিলে।
আহা। তুমি আমার স্বপ্ন টা ভেস্তে দিলে তো।
ওসব স্বপ্ন টপন দেখতে হবে না। চারিদিক দেখে গাড়ী চালাও।
আমাকে ফিরতে হবে মেয়েদের কাছে, ফিরতে হবে স্বামীর কাছে।
দিলে তো দিলে তো পরিবেশটা মাটি করে।
কেনও আমি আবার কি মাটি করলাম? বলে অবাক দৃষ্টি তে তাকালে।
পরদিন তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম আর একটা জাগায়, যেখানে আমিও যাইনি আগে।

Hudson Yards.
নতুন Development.
৭ নম্বর ট্রেনের শেষ স্টেশন ।
পাতাল থেকে যখন উঠে তুমি চারিদিক তাকালে।
বললে, অপূর্ব। না আসলে মিস করতাম।
সত্যিই তোমার ভাল লেগেছিল। নতুন ধরনের নতুন স্টাইল এ বানান বিল্ডিং । সাথে আছে শপিং মল।
কি কি যেন তুমি কিনেও ছিলে সেখান থেকে।
সেই শেষ। বেড়ানোর শেষ দিন।

তোমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে আমার সময় গুলো ভালই কেটে ছিল।
সময় এসে গেল। তোমাকে ফিরে যেতে হবে তোমার পরিবেশে। ব্যস্ত হয়ে পরবে বিভিন্ন কাজ নিয়ে। আমিও।
যাওয়ার সময় বলেছিলে , কবে আসবে আর একবার আমাদের কাছে?
বলেছিলাম, বন্ধু , সময় যেদিন আসিবে সেদিন যাইবো তোমার কুঞ্জে।
প্লেন ছাড়ার আগে তুমি কল করেছিলে। বললে, চোখে পাঁথর কুঁচি পড়েছে কিনা জানিনা, চোখটা পানিতে ভরে গেলো কেনও?
ভাল থেকো।
তুমিও।
বিদায় বন্ধু, বিদায়।

আমি ফিরে এলাম আমার শুন্য ঘরে।
থাকল শুধু মধুর স্মৃতি গুলো।

Continue Reading

মেক্সিকোর পথে

জুলাই ১
Mexico City, Mexico র দিকে রওয়ানা দেবো আমরা পাঁচ জন। আমি, সুষমা, রেজওয়ান, নার্গিস ভাবী আর বেয়াই সজল ভাই। হাতের সুটকেসটা গুছিয়ে নিঁয়েছি। মাত্র চার দিনের সফর। দুটো প্যান্ট , চারটা শার্ট । আর আনুসংগিক জিনিষ পত্র । ছোট্ট ব্যাগপ্যাকের মাঝে ঔষধ গুলো নিতে ভুল হলো না। ভুলে গিয়েছিলাম সেভিং এর জিনিষ পত্র গুলো নিতে। যখন মনে পড়ল তখন সেই ব্যাগটা আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। ওটা আমার তৈরি থাকে বিদেশ বিভুয়ে যাওয়ার জন্য।
অগত্যা উঠতে হলো। ভেবেছিলাম আর বের হবো না। কিন্তু বিধি বাম। ওয়ালমারট টা কাছেই। ট্রাভেল সাইজের যা যা দরকার নিয়ে নিলাম।
সকালে ৭টায় আমার বন্ধু মুজিব আসবে । নামিয়ে দেবে JFK এয়ার পোর্টে । বন্ধু দের এই সাহায্য গুলো ভোলার নয়।
রাতে ঘুম হলে না। এপাশ ওপাশ করে ভোর পাঁচটায় উঠে পড়লাম । সুষমার চলে যাবে ওদের বাসা থেকে।
সজলভাই আর ভাবী আসবে আমার বাসায়।

মুজিব এলো সময় মতো। রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যা কম। কারন এটা ৪ জুলাই , স্বাধীন দিবসের সপ্তাহ । অনেক লোক আগেই ছুটি নিঁযে বেরিয়ে গেছে।
ভীড় রাস্তায় নয় , ভীড় এয়ার পোর্টে । অসংখ্য লোকের আগমন।
সুষমারা আগেই এসে গেছে। ইদানিং আর কাউনটারে যেতে হয় না। বাহিরের মেসিন থেকে বোর্ডিং পাশ বের করা যায়।
ছেলে মেয়েদের সাথে বের হলে এই একটা সুবিধা নিজের কিছু করতে হয় না। আমার কিছু করতে হলো না।
সুষমাই সব করল।
এসে দাঁড়ালাম সিকিউরিটি চেকে।
আমাদের গেট নাম্বার ছয়। সকালের কফি টা আনন্দ সহকারে খাওয়া হয়নি।
ভাবী ভাইকে বললাম, খাবে কিছু।
বলল, না
আমি সুসু, রেজ, ডানকিন ডোনাটের কফি আর সাথে স্যান্ডউইচ নিয়ে এসে বসলাম।
বিমান ছাড়বে ১০টা ১০ এ।

গাড়ী চলতে শুরু করলো। দুই দিকের দৃশ্য দেখে মনে হলো ঢাকার রাস্তা দিয়ে চলেছি। শুধু নেই রিক্সার বহর, নেই যানজট।
রাস্তায় ইংরেজীতে কোনো লেখা চোখে পড়ল না।
সুষমা airbnb ভাড়া করে রেখে ছিল । নাম Viadora.
এয়ার পোর্ট থেকে আসতে আধাঘন্টার একটু বেশি লেগে গেলো।
সাত তালা বাড়ীর পাঁচ তালা টা আমাদের। ঢুকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বিশাল লিভিইং রুমের সাথে রান্নাঘর ।.তিনটা বড় বড় শোবার ঘর। অপুর্ব ।
সুষমা একটা নাম করা সিফুড রেস্টুরেন্টে ডিনারের জন্য রিজার্ভ করে রেখেছিল।
নাম Contramar. অর্ডারে ছিল Tostadas, Fish Tacos, Salad, Fish-meat balls, আর Whole Fish.
রান্নার তুলনা নেই।
খাওয়া শেষে হেটে হেটে ফিরে এলাম । পথে কিছু সকালের নাস্তার জন্য কেনা কাটা করা হলো। ডিম. পাউরুটি ইত্যাদি

আগামীকাল হাঁটবো । দেখবো শহরের নামকরা জায়গা গুলো।

জুলাই ২

নাস্তা শেষে নিচে নেমে এলাম সকলে।
। সুষমা উবার কল করেছিল। আজ পায়ে হেটে দেখব মেক্সিকো সিটির বিভিন্ন নাম করা জায়গা গুলো।
২০ মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছালাম Alameda  Central এ।
এটা শহরের কেন্দ্র স্থান। সবচেয়ে বড় সবুজে ভরা বিশাল পার্ক । পার্কের দুই দিকে বড় Avenue. দুটা মেট্রো স্টেশন ।
বড় বড় গাছের ফাকে দিয়ে সকালের নরম সুর্যের আলো এসে পড়েছে।
আমরা হাটতে হাটতে এলাম বড় একটা ফোয়ারার কাছে। একটু এগিয়ে এলাম The Palace de Bellas Artes . সিটির Flagship cultural Institution. বিভিন্ন নাম করা শো, আর্ট exhibition হয় এই খানে।
দেখা শেষে বড় রাস্তা ছেড়ে এলাম ছোট রাস্তায় ।
উদ্দেশ্য সুভিনিয়ার কেনা। ভাঙ্গা কিন্তু পরিস্কার রাস্তা ধরে এলাম যেখানে সেটা ঢাকার গাউসিয়া মার্কেটের মত। বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট দোকান। টুরিস্টের জন্য লোভ নিয়।
কম পয়সায় ভাল জিনিস পাওয়া । সুষমা খবর নিয়ে এসেঁছিল
কেনা কাটা কম হলো না । সবার ই দুই হাত ভরে গেলো।
হাটতে হাটতে সবাই ক্লান্ত। বসতে হবে কোথাও।
El Moro নামে একটা snack খাওয়ার রেস্টুরেন্ট আছে।
Churros র জন্য বিখ্যাত। অনেক হাঁটার পর এসে পৌঁছালাম । অনেক লোকের ভীড়। অবশেষে জায়গা পাওয়া গেলো।
Churros নিউইয়র্কে খেয়েছি, তবে এই Churros তুলনা নেই। একটি ঘটনা না বললেই নয়।
মনে রেখো ছেলেদের Restroom কে Spanish এ বলে hombres আর মহিলা দের Restroom কে বলে mujeres।
এই রেস্টুরেন্টে দরজায় লেখাছিল M এবং H
ভাবলাম M মানে Men . ঢুকে পড়লাম । ভাগ্য ভালো কেউ ছিলনা।
এর পর যেখানে এলাম তার নাম The Zocalo.
পরিচিত the plaza de la Constitución.
পাবলিক Square. ১৩২৫ সালে Tenochtitlan তৈরি করে ছিল। এর পাশেই Temple নাম The Temple Mayor.
Tenochtitlan র পতনের পর Zocalo হয়েছে center of Mexico City . এই বিরাট Square এ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হয়। ধর্মিয় বল, বা গান বাজনা বলো।

আজকের মত দেখা শেষ। এবার ফিরে যাবার পালা।
আগামি কাল উঠবো Hot Air Balloon এ । দেখব পিরামিড ।

জুলাই ৩

রাত ৪ টায় উঠতে হলো। যাবো Hot Air Balloon এ করে আকাশে। খুবই excited আমরা সবাই । সুষমা ব্যবস্থা করে রখেছিল। আমাদের কে নিতে আসবে ভোর পাঁচ টায়।
এক ঘন্টার পথ।
ঠিক সময়ে গাড়ী এসে হাজির। বাহিরে তখনও রাত। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তা ভেজা।
সন আর পাবল, বাবা , ছেলে। ওদের আছে Hot Air Balloon tour বিজনেস। সন এসেছিল London থেকে।
এখানে Hot Air Balloon নের বিজনেস করবে বলে। দেখা হয়েছিল ডায়ানার সাথে। কি হয়েছিল সনের ,সন জানে না। London এ ফিরে যাওয়া হয়নি। এখানেই সংসার পেতে ছিল ডায়ানাকে নিয়ে।
বিরাট মাঠের পাশে ছোট্ট তাঁবু পাতা। আমাদের কে অভ্যর্থনা জানালো এক মেয়ে এসে। সামনের মাঠে বেলুন গুলো ফোলানো হচ্ছে ।
কিছু পরে বেলুনের পাইলট এসে বলল, বেলুন রেডি।
আমরা উঠলাম। সবাই excited. বেলুন উড়ল । দুরে আরও অনেক বেলুন আকাশে। অপুর্ব দৃশ্য ।

নাম না জানা লোক এসে তৈরি করেছিল The ancient city of Teotihuacán in the northern Valley of Mexico. এখানে পিরামিড আর বড় বিল্ডিং তৈরি করে ছিল ওরা।
ঐ পিরামিড দেখতে এলাম। গাইড লুইস বলল, Pirámide Del Sol(Pyramid of the Sun) এর উচ্চতা ৭০ মিটার। ছোট ছোট সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে।
আর একটা পিরামিড, নাম তার Pirámide De La Luna।এর উচ্চতা ৪৬ মিটার। সহজেই উপরে উঠা যায়।
সব দেখা শেষ করে যখন ফিরে এলাম তখন বিকেল চার টা
সন্ধ্যায় যাবো Ballet Folklorico de Mexico দেখতে।

জুলাই ৪

মেক্সিকো সিটিতে আজ শেষ দিন। আমাদের দেখার বাকি
ভাসমান বাজার। সকাল ১০ টায় বের হলাম। ৪০মিনিটের পথ।
বিভিন্ন রং এ সজ্জিত সব ভেলা। দুই ঘন্টার জন্য ভাড়া করলাম। অনেক ভেলা এই canal এ। বিভিন্ন ভেলায় বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন জিনিস। অনেকে কিনছে অনেকে দেখছে।
নতুন এক experience.

Frida Kahlo. ফ্রিদা কাহলো, মেক্সিকান আর্টিস্ট, তার অনেক আকা ছবি যা কিনা inspired by the nature and artifacts of Mexico . ফ্রিদার আঁকা ছবি Inspired by the country’s popular culture।
এলাম ওর বাসাতে। যেখানে সে ওর স্বামী Diago Kahlo
থাকতো।
অনেক লোকের আগমন। আধা ঘন্টার টুর। তার আঁকা ছবি বিভিন্ন ঘরে। দেখা হলো।
এবার ফিরার পালা

রাতের ডিনারের জন্য এলাম Asian Bay তে।
চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ।
এত দিন Tacos, Tostados খেয়ে মুখের রুচি পাল্টাতই এখানে আসা।
মুখরচক?
নাহ!

এলাম, দেখলাম এবার বিদায় মেক্সিকো সিটি ।
বিদায়।

Continue Reading

সেই দেখা

সেই দেখা

রাতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল সনির। কামাল আর মৌসুমি ডেকে ছিল তাদের বাসায়। ঘরোয়া পরিবেশে গান বাজনা হবে। দেশ থেকে আসা এক শিল্পীর একক অনুষ্ঠান।
বিশাল বাড়ী কামালের। ইন্ডাস্ট্রির মালিক। পয়সা কড়ির অভাব নেই। দেদার খরচ করে। মুক্ত হস্তে দানও করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।
একদিন সনি জিজ্ঞাসা করেছিল, এই যে তুই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সময় পাশ কোথায় কাজ করার। তোকে তো তোর ইন্ডাস্ট্রিও দেখতে হয়।
হেসে বলেছিল, আমি নিজেই জানি না আমি কোন সংঘটনের চেয়ারম্যান আর কোনটার ট্রাষ্টি বোর্ডে আমার নাম রয়েছে।
ওরা এসে বলে, কামাল ভাই শুধু আপনার নামটা আমরা চাই। ওটা থাকলে অন্যান্যরা এসে যোগ দেবে আমাদের সংঘটনে।
আমার ক্ষতি কি? নামটা প্রচার হোল।
সনি আর কথা বাড়ায় নি।
বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব, সেই সাথে নাম না জানা কয়েক জনের সাথে গল্প করতে খারাপ লাগেনি।
গান শেষ হতে হতে রাত প্রায় একটা।

ঘুম টা এসেছিল সনির ভোর হওয়ার কিছু আগে। ভেঙ্গে গেলো সারেগামার শব্দে। ছোট্ট দুটো ছেলেমেয়ে গলা সাধছে।
বয়স চার পাঁচ। একই বাসার উপরে সনি থাকে আর নিচে ওরা চার জন।
মেয়েটা সাঁ বলে টান দিতে দিতে ছেলে টা রে ধরেছে।
রাগ হলনা সনির । বরং ভালই লাগছিল ওদের গলা সাধা শুনতে।
সপ্তাহর শুরুতে ওরা রপ্ত করে রাতের বেলা।
আজ স্কুল বন্ধ। তাই সকালে সাধছে গলা।
মাঝে মাঝে ওর মা বসে পূজাতে। টুং টুং ঘণ্টীর শব্দ। পুজা অর্চনা চলে।

সামন্ত এসেছিল সেদিন। শুধু বলতে, বাচ্চাদের কলাহলে সনির কোন অসুবিধা হয় কি না।
“অসুবিধা? কি যে বলও, আমি উপভোগ করি, বরং যেদিন কোন সাড়াশব্দ পাইনা সেদিন মনে হয় বাসাটা ঝিমিয়ে গেছে” বলে ছিল সনি।
সামন্ত শুধু হেসেছিল।
সামন্ত সনির অনেক ছোট। এসেছে ভারতের কেরালা থেকে। দুই বছরের কন্ট্রাক্ট।
মুখে হাসি, বলেছিল সনি কে, তোমার কোন দরকার পড়লে আমাকে জানিও।
তার ত্রুটি সে করেনি।
হঠাৎ একদিন সনির ৬০ ইঞ্চি টিভি টা অন্ধকারে ডূবে গেলো।
কথা শুনা যাচ্ছে কিন্তু ছবি নেই।
মেজাজ টা খিচিয়ে উঠল সনির।
Netflexএ প্রিয় শো Narcos দেখছিল।
হঠাৎ ই নিচে সামন্তর গলার স্বর শুনতে পেলো সনি। কাজ থেকে ফিরেছে সামন্ত।
মনে পড়ল সনির, ও বলেছিল দরকার পড়লে ডাক দিতে।
দোটানায় পড়ল সে । এই মুহূর্তে ওকে ডাকা সমীচীন কি না।

কথায় বলে, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তাই হোল।
সামন্তর কল। সে উপরে আসতে পারে কিনা জানতে চাইছে। বাড়ীভাড়া টা সনির কাছে দিয়ে যাবে। সে যেন বাড়ীর মালিকের কাছে পৌছে দেয়।
“নিশ্চই। সময় মতো এসো। তাড়াহুড়ার দরকার নেই। আমি বাসাতেই আছি”। বলেছিল সনি।
যাক আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে হোল না বলে একটু স্বস্তি পেলো সনি।
না, সে দেরী করেনি। এসে হাজির।
টাকাটা গুনে নিয়ে বলল সে , তুমি কি ব্যাস্ত?
না, কেন?
টিভি টার ব্যারামের কথা বলতেই লেগে গেলো সমস্যার সমাধান করতে। সনির কাছে যন্ত্রপাতি বিশেষ কিছু নেই।
সে নিয়ে এলো তার টুলবক্স। ইউটিউবে দেখে নিলো কি কি সমস্যা হতে পারে।
পরিশেষে জানা গেলো ভিতরের টিউব টা নষ্ট হয়ে গেছে।
অগত্যা সনির শোবার ঘরে যে বড় টিভি টা আছে, ওটা কে আনতে হবে এখানে। প্রচণ্ড ভারী।
সনি বলেছিল সে কোন রকম সাহায্য করতে পারে কিনা।
বলল, পাগল, তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। আমিই সব করব।
সনি চেয়ে চেয়ে দেখল, সে এ ঘরের টা ও ঘরে, ও ঘরের টা এ ঘরে এনে টিভি টা অন করল ।
আলো জ্বলে উঠলো টিভি তে।
সনি কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে শুধু বলল, “কি করে এই ঋণ শোধ করবো বলতো”।
বলল, শুধু খেয়াল রেখো আমার ছেলে মেয়ে দের কে। মাঝে মধ্যে ওরা সাইকেল নিয়ে ছোটা ছুটি করে।
ভয় হয়।
আমি থাকি কাজে। ওর মা ও ব্যাস্ত থাকে অনেক সময়।
অবশ্যই। কোন চিন্তা করোনা। আমি তো আছি। বলে সনি ওর হাতটা বাড়িয়ে দিলো সামন্তর দিকে।

বাহিরে ঝড় বৃষ্টি। আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন। ছোট ছোট ঘটনা সনির মনে পড়ল।
এই তো সেদিন, ষ্টেশনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ট্রেনের।
সনি না?
পাশ ফিরে তাকালও সনি। শাড়ী পরনে। চোখে চিকন কালো ফ্রেমের চশমা। আধা পাকা চুল। হাতে মাইকেল কোরের ব্যাগ।
চিনতে পারলো না সনি।
মনে পড়ে গায়ত্রীর কথা? সেই সত্তর শনে, কলকাতার যাদবপুরে। বলে তাকিয়ে রইল সনির দিকে।
হাঁ, মনে পড়েছিল সনির।
ইউনিভার্সিটি থেকে গিয়েছিল ওরা কয়েকজন কলকাতায়। এক্সকারসনে। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির হলে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।
দেখা হয়েছিল গায়ত্রীর সাথে। হঠাৎ ই।
রাতে সিনেমা দেখে সনি আর কামাল ভুল রেলওয়ে ষ্টেশনে নেমে ছিল। রাত তখন দশটা। বুঝে উঠতে পারছিল না কি করবে। পকেটে টাকার পরিমাণ খুবিই কম। ট্যাক্সি নিতে পারবে না।
নতুন জায়গা। বন্ধুরা না করেছিল। ওরা শোনেনি। দিলীপ কুমারের নতুন মুভি। দাস্তান।
ভয় পেয়ে ছিল ওরা। ঠিক সেই সময়, “ হারিয়ে গেছেন বুঝি। কোথায় থাকেন?”
ওরা জাগার নাম বলতেই মেয়ে টা বলল, আমিও ঐখানে যাচ্ছি। আসুন, এখনি ট্রেন আসবে।
আমার নাম গায়ত্রী। আমিও যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। তবে থাকি বাসাতে।
সনির একটা গুন সবাই জানে। অতি সচ্ছল ভাবে সে কথা বলতে পারে সবার সাথে। মনে হবে অনেক দিন ধরে সে চেনে।
এখানেও ব্যতিক্রম হোল না।

ওদের কথা শেষ হোল তখন, যখন উভয়ে এসে পৌছাল নিদৃষ্ট ষ্টেশনে।
আমি যাবো আপনাদের উল্টো পথে। আপনারা সোজা চলে যান, সামনের ঐ লাইটে ডানে মোড় নিলে আপনাদের হোস্টেল। বলে হাসল।
আর দেখা হবে কি? কেন বলেছিল সনি জানেনা।
হবে বৈকি? এক জাগায় যখন থাকি। আর আপনি হচ্ছেন আমাদের গেস্ট। আমিই আসবো দেখা করতে।
গায়ত্রী এসেছিল। দেখা হয়েছিল। ওরা বসে অনেক কথা বলেছিল হলের ক্যান্টিনে। আপনি থেকে তুমি সম্বোধন। কত যে কথা যার কোন মানে ছিল না।
যাওয়ার দিন গায়ত্রী একটা রুমাল দিয়েছিল সনি কে। কোনায় এমব্র্যডারি করে একটা অক্ষর শুধু লেখা ছিল “গ”।
না আর দেখা হয়নি। ডিপার্টমেন্টে দুই টো চিঠি এসেছিল গায়ত্রীর।
উত্তর দেওয়া হয়নি সনির।

কি চিনতে পারলে না?
পেরেছি, অনেকদিন পরে তো।
তুমি একদম পাল্টাওনি। ঠিক সেই রকম আছো।
কোথায় থাকো? জিজ্ঞাসা করলো সনি।
এখান থেকে দুই ষ্টেশন পরে। এই আমার ঠিকানা, এই আমার সেল নাম্বার। কল দিও। অনেক কথা আছে তোমার সাথে।
সেই রুমাল টা আছে কি?
গায়ত্রীর ট্রেনটা এসে গেলো। উত্তরের অপেক্ষা না করে ও উঠে পড়লো ট্রেনে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল সানি যেখানে দাড়িয়ে সেই দিকে।

বাহিরে বৃষ্টি টা কমে এসেছে। সনি উঠে দাঁড়াল। এসে দাঁড়াল টেবিলের কাছে। ড্রয়ার টা খুলল।

Continue Reading