জাপানের পথে ২

সন্ধ্যা ছয়টায় আমাদের প্লেন ছাড়বে । তিনটার সময় আমি আর শান্তা এয়ার পোর্টে পৌছিয়ে গেলাম। বাকি সবাই পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে হাজির।
চেক ইন করে, সিকিউরিটি পাড় হয়ে গেট ৯ এসে পৌঁছাতে বেশি দেরী হলোনা।
ঘন্টা দেড় পরে প্লেন ছাড়বে । না তা আর হলো না। আধা ঘন্টা দেরী হলো।
১৪ ঘন্টার পথ। ইদানিং এতো ঘন্টার পথ মন আর শরীর দুটোকেই পীড়া দেয়।
টেগ এয়ার পোর্টে হাটহাটি করে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ প্লেনের ছোট্ট জাগায় বন্দি হওয়াতে অস্থির হয়ে উঠল।
টোকিও বিমান বন্দরে যখন নামলাম তখন টোকিওর সময় রাত ৯ টা বেজে বিশ মিনিট।
ইমিগ্রেশন শেষ করে মালপত্র নিয়ে টেক্সি নিয়ে গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে রাত সাড়ে এগারটা বেজে গেলো।
ভোরে যেতে হবে টোকিও ট্রেন স্টেশনে। জাপান রেল লাইন (JR)।
যাবো Kyoto. দুই ঘন্টার পথ।

Railway pass কাটা ছিল ।
নয়টা তিনের ট্রেন ধরলাম।
Kyoto র পথে।

এপ্রিল ৬,২০১৯
ছুচালো মুখের ট্রেনটা ছাড়লো নয়টা তিনে টোকিও রেলস্টেশন থেকে। ধীরে ধীরে তার গতি বৃদ্ধি করে Kyoto র দিকে এগোতে মনে পড়লো বেশ কিছুদিন আগে এই ধরনের ট্রেনে করে গিয়েছিলাম মসকো থেকে সেন্ট পিটার্সবারগ।
আমাদের সাথে টেগর তার যথারীতি মুচকি হাসি দিয়ে সবার কোলে কোলে ঘুরতে থাকল।
এগারো টার কিছু পরে ট্রেন এসে দাঁড়ালো Kyoto স্টেশনে।
ঝকঝকে প্লাটফরম। শনিবারের সকাল ।তবুও লোকের আগমনের কমতি নেই।
ম্যাপ দেখে মনে হলো আমাদের থাকার জায়গাটা খুব একটা দুরে নয়।
দুই একটা রাস্তা পেরিয়ে, দুটো বাঁক নিয়ে এসে পৌঁছালাম বাসার সামনে। পুরোটা কাঁঠের তৈরী। একটু পুরানো।
আমাদের হাতে মাত্র চারদিন । অনেক দেখার,সব দেখা হবে না। ছক কেটে কয়েকটা জাগার নাম লেখা আছে কাগজের পাতায়।প্রথম Nishiki Market.
ছোট্ট গলির মাঝে বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট দোকানে ওরা তৈরি করছে হরেক ধরনের খাবার। লোকে হাটছে খাচ্ছে। কাঠির মাঝে গাঁথা চিংড়ি । সালমন মাছের ফিলে। সুসি।আরও হরেক রকমের খাবার। ভীড় ভীড় আর ভীড় । লোকে লোকারণ্য ।
রাস্তা শেষে এলাম চৌ রাস্তার মোডে।
যেতে হবে Kyomyizu-Dara.

Kyomyizu-Dara, iconic Buddhist temple. Mount Otowaর উপরে।
অপুর্ব দৃশ্য ।
চিকন রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের দোকান।
ঐ রাস্তা ধরে আমরা উপরে উঠছি। সবাই কে দেখতে পেলাম না। ওরা হয়তবা উপরে উঠে গেছে।
আমি, শান্তা, আর জীবন। উঠছি উপরে।
গাড়ো লাল রং এর টেমপেল। সুর্যের শেষ আভা এসে পরেছে ওর চুড়ায়। লাল রং ছড়িয়ে পরেছে । অপুর্ব ।
উপরে এসে দেখা পেলাম সবার।

বুদ্ধের মুর্তি। অনেকে ওর সামনে মাথা নত করে দাড়িয়ে । আমরা এগিয়ে গেলাম ওদেরকে পিছনে রেখে।
সুর্যের আলো নিভে এলো।
সাদা চেরী ফুল গাছের ভিতরে আলো জ্বলে উঠলো।
আমরা দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করলাম।

এপ্রিল ৭, ২০১৯
ধীরে ধীরে ঢালু রাস্তা বেয়ে আমরা নেমে এলাম টেম্পল কে পিছনে রেখে। শানতনু তাসমিয়া টেগোর কে নিয়ে আগেই চলে গেছে।ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাপটা মারছে মুখে। এসে দাঁড়ালাম ট্যাক্সি স্টেন্ড ।

দুই দিন এসেছি এই দেশে। বলতে বাঁধা নেই
এই দুই দিনে মুগ্ধ করলো ওদের ভদ্রতা । রাস্তায় হাটছে, কারো হাতে সেল ফোন নেই।
যে দৃশ্য অহরহ দেখে অভ্যাস। দৃষ্টি তে আঘাত হানলো। যে দৃশ্য দেখে অভ্যাস নেই তা দেখলে আশচার্য হতে হয় বইকি।
বড় শহরের নোংরা রাস্তা দিয়ে হেটেছি। দেখেছি উপচে পড়া গার্বেজ ।
আর এখানে গার্বেজ ক্যান নেই কোনো রাস্তার পাশে। অথচ ছোট গলি থেকে আরম্ভ করে বড় রাস্তা ঝকঝকে পরিষ্কার ।
একেই বলে সভ্যতা।

ভ্রমনের পথে ছোট ছোট কত কিছু চোখে পড়ে , মনকে দোলা দেয়।
ফিরে আসি Fushimi-Inari Tanisha র কথায়, যা দেখতে এসেছিলাম পরের দিন।
এ এক মন্দির ।
সব চেঁয়ে বড় God Inari র মন্দির ।

২৩৩ মিটার উপরে এই মন্দির । অরেনজ রং এর ৫০০০ গেট। একটার পর একটা গেট পাড় হয়ে উপরে উঠে যেতে হবে। চারিদিকে তাকালে দেখা যায় শিয়ালের মুর্তি।
কথিত আছে শিয়াল Inari র ম্যাসেনজার।
আর Imari, God of Rice.

Trail ধরে উপরে উঠে এলাম। সবাই আসেনি।
উপর থেকে ফিরে আসতে আসতে দুপুর হয়ে এলো।
যেতে হবে Tea Ceremony তে ।

Matcha tea ceremony. চা পরিবেশন যে এত সুন্দর হয়, না দেখলে বোঝা যাঁয না।
সুন্দর করে Kemono পড়ে বাউ করে এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। নিয়ে বসালো একটা ঘরে। আসন গেরে বসলাম।
সালাম করার মত মাথা মেঝেতে ঠেকিয়ে অভিনন্দন জানালো।
বলল, এটা আমাদের রিতি। অতিথি কে সমমান জানানো।
চা র কাপটা আলতো ভাবে উঠিয়ে দেখালো কোন টা সামনে কোনটা পিছন দিক। জানা ছিল না কাপের ও সামনে এবং পিছন আঁছে।
সামনে টা থাকবে অতিথির দিকে। অতিথি ওদের কাছে দেব তুল্য।
এই সব ছোট ছোট রিতি আছে ওদের সমাজে।
Ceremony শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে এলো।
ঝিরঝির বাতাসে হাটতে ভালোই লাগছিল।
কাল যাবো Osaka তে।

এপ্রিল ৮,২০১৯
Osaka তে যাওয়ার আগে Himeji শহর টা দেখবে বলে সবাই রাজি হলো। Kyoto থেকে দেড় ঘন্টার পথ। জাপানের Kansai Region র একটা সিটি। শহরটা বিখ্যাত White Himeji Castle এর জন্য।

সকালের নাস্তা রোজি আর চয়ন ভাবী তৈরি করে নিয়ে এলো। ডিম ভাজি, পাউরুটির সাথে জেলি। মুখরচক।
বিদেশ বিভুয়ে গরম গরম হাতে তৈরি নাস্তা ।
এর চেয়ে বেশি কি আশা করা যায়।

বের হয়ে পড়লাম । সকাল ১০ টায় ট্রেন ।
Himeji র মাটি তে পা দিয়েই দেখলাম কয়েক শত লোক আমাদের আগেই এসে গেছে।
আকাশে নীল মেঘ, নিচে সারিসারি চেরি গাছে গোলাপি, সাদা ফুলে ভরা। তার উপর পডেছে সুর্যের আলো।
অপুর্ব সংমিশ্রণ ।
একে সামনে রেখে দাড়িয়ে আ্ছে পাঁচ তালা White Himeji Castle।
১৩৩৩ সালে এটা ব্যভরিত হতো Fortress হিসাবে, ১৩৪৬ সালে পরিনিত হয় Castle এ।
খাড়া সিঁড়ি বেয়ে আমরা উপরে উঠতে লাগলাম। শান্তনু, তাসমিয়া টেগর কে নিয়ে এত উপরে কি ভাবে উঠবে সেই চিন্তা আমাকে পেয়ে বসল।
সব দেখে নেমে এলাম।একটু বসতেই দেখি শানতনু রা নেমে আসছে।
এবার ফিরে যাওয়ার পালা।
আজ আর সময় নেই লেখার।
উঠি।

এপ্রিল ৯, ২০১৯
Osaka তে সেদিন আর যাওয়া হলো না। বিকেলে আকাশ টা কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। ঝিরিঝির বাতাস। তাপমাত্রা কমের দিকে। সেই সাথে ছিটে ফোটা বৃষ্টি ।
শানতনু খুঁজে বের করলো এক সুসি রেস্টুরেন্ট
বসার জায়গা সীমিত। এখানকার অধিকাংশ ছোট ছোট রেঁস্তোরা গুলোতে বসার জায়গা এই রকম। তাই বলে কেউ না খেয়ে চলে যাচ্ছে না। লাইনে দাড়িয়ে আছে।কারন বাহিরে হেটে হেটে খাওয়ার রীতি এদেশে নেই।
প্রত্যেক প্লেটে দশ রকমের সুসি। সামনে বানিয়ে দিচ্ছে । জাপানে এসে সুসি খাবোনা
তা তো হতে পারে না।
বাসায় ফিরতে রাত হলো।

পরদিন Arashyama হয়ে Osaka .
তৈরি হয়ে বের হতে হতে দশ টা বেজে গেলো।
JR Train এ Saga Station নেমে হাটে যাবো Bamboo Forest দেখতে। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে Kinkakuji Temple.

Arashyama, Kyoto র second most sightseeing district. Shrine এবং Temple চারিদিকে।
তবে প্রধান আকর্ষণ হলো Arashyama Bamboo Grove.

সুর্য উজার করে তার আলো ছরিয়ে দিয়েছে সবখানে। ঠান্ডা অতটা নয়। টেগরকে নিয়ে হাটতে হাটতে বাঁশ ঝারের মাঝে এলাম।

বলা যেতে পারে বাঁশ ঝার ? তাও দেখতে হবে?
হবে বৈকি।
Kyoto র সকালে হাজার হাজার বাঁশ , আকাশ ছুঁই ছুঁই, বাতাসে হেলছে দুলছে, ভোরের আলোয় চিকমিক করছে ওদের শরীর, মনে হচ্ছে ওরা একে অপরের সাথে কথা বলছে কানে কানে।
দেখতে হবে বৈকি? অনুভব করতে হবে। সত্যই অপুর্ব।
হাটতে হাটতে এসে দাঁড়ালাম বাগানের শেষ প্রান্তে।
ওখানে ছোট ছোট তাঁবু খাটিয়ে ভাজা হচছে
চিংড়ি মাছ, আগুনে পুড়ানো হচছে ভুট্টা।
শান্তা বলল, খাবে?
বললাম, মন্দ কি?
বাঁধাকপির প্যাটি নিয়ে এলো সে।
রওয়ানা হলাম গোল্ডেন টেমপেল দেখতে।

Kinkaku-ji (Temple of the Golden Pavilion) . ট্যাক্সি করে এলাম। আধা ঘনটার পথ।
গোল্ডেন টেমপেল ছিল Shogun Ashikaga Yoshimitsu এর retirement villa. Yoshimitsu এর মৃত্যুর পর ওর ছেলে বাবার ইচ্ছা কে ব্যস্তবায়িত করে villa কে Temple হিসাবে মননিত করে।

পুকুরের পাড়ে Golden Temple, ওর ছায়া পরেছে পুকুরের পানিতে। রৌদ ঝলমল দিনে অপুর্ব সেই দৃশ্য ।
আমরা কিছুটা ক্লান্ত । এসে বসলাম গাছের নিচে।
যাবো Osaka তে। সবাই যেতে রাজি নয়।
আমরা ছয় জন বেরিয়ে পড়লাম।
JR ট্রেনে ৪ টা স্টেশন পরেই Osaka. ভুল হবার সম্ভবনা আছে স্টেশন নিয়ে। কারন তার আগের স্টেশন টার নাম Shin- Osaka.
ভুল হতে পারে তাই বারবার বলা হচ্ছে পরের স্টেশন Osaka.
শানতনু বার বার বলল ঐখানে পৌছিয়ে আমাকে text করো। চিন্তা তার বাবা যদি হরিঁযে যায়। বললাম, আব্বু, চিন্তা করোনা ।
স্টেশন নেমে Information এ Osaka Castle র কথা বলতেই ম্যাপে দেখিয়ে দিলো কিভাবে যেতে হবে। তবে বনধ হয়ে যাবে ৪:৩০ এ । হাতে আঁছে আধা ঘন্টা।
সমঁয মত পৌঁছানো গেলো না। শুধু বাহিরের থেকে দেখা।
শানতনু বলে দিয়েঁছে neon- lighted Dotombori তে যেও। ওখানে রাতের খাওয়া খেয়ে নিও।
পাতাল ট্রেনে বেশ কিছু পথ। কয়েকটা ট্রেন পাল্টিয়ে যেতে হবে। পেয়ে গেলাম এক young couple. ওরাও ঐ পথে যাবে। এসেছে Vancouver থেকে। ওদের কাছে আছে ট্রেনের ম্যাপ। কাজেই অসুবিধা হলো না।
Dotombori, আলোয় আলোকিত। লোকে লোকারণ্য। জমজমাট ।
আমরা ছয় জন হাটছি। ছবি তুলছি। ছোট ছোট রেস্তরাঁর সামনে দাড়িয়ে দেখছি কোথায় খাওয়া যেতে পারে।
পাওয়া গেলো ৯ তালার উপর । শান্তা অর্ডার দিলো। খাবার একটার চেয়ে একটা অমৃত।
খাওয়া শেষে ফিরে এলাম ট্রেন স্টেশনে।
তখনই চয়ন আপার বিয়াই বলে উঠল, আমার iPhone রেখে এসেছি।
অগত্যা আমি আর বিয়াই বেরিয়ে এলাম।
রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে ওরাই বলল, iPhone, iPhone?
হারাবে না , আগেই জানতাম।
সবকিছু দেখে ফিরে এলাম বাসায়। ঘড়ি তে ১১ টার ঘর পেরিয়ে গেছে।
কাল যাব টোকিও তে।

এপ্রিল ১০, ২০১৯

দুপুর ১২ টার ট্রেনে যাবো টোকিও তে। সকাল থেকে আকাশ মুখ গোমরা করে আছে। বৃষ্টির সাথে বাতাস। বেশ কিছুটা পথ হেটে ট্রেন স্টেশনে যেতে হবে। কিছু করার নেই।
বেশ কয়েকটা ছাতা আছে । তাই মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
১১ নম্বর প্লাটফরম থেকে Shinkansen ( Bullet train) টা ছাড়ল টোকিওর দিকে।
২০০ মাইল বেগে চলছে। গাছ পালা বাড়ী ঘর চোখের পলকে পিছনে চলে যাচ্ছে ।
দুই ঘন্টার কিছু উপরে টোকিও স্টেশনে এসে পৌঁছালাম।
আমি চারিদিক তাকিয়ে দেখছি স্টেশনের পরিচ্ছন্নতা। টোকিও স্টেশন পৃথিবীর মধ্যে একটা ব্যস্ততম স্টেশন। কিভাবে সম্ভব এই রকম পরিস্কার রাখা।
কারো হাতে খাবার আমি দেখিনি।দেখিনি সিগারেট জ্বলতে ।

এখানেও বৃষ্টি ।
আমাদের airbnb Shinjuku তে। ট্যাক্সি করে এলাম ।
বাসাটা গলির ভিতরে। ছোট বাসা। দুই তালা।
শুনেছি জাপানের সব বাসাই ছোট।
তবে মন্দ নয়। ছয়টা শোবার রুম। বসার জায়গা আছে । আছে রান্না ঘর, আছে দুইটা বাথরুম।
Shinjuku, কথা ছিল আজ ঘুরে বেড়াব এই খানে।
হলো না।,
বৃষ্টি।
সন্ধ্যায় এক seafood রেঁস্তোরায় ডিনার খেতে যাওয়ার কথা। নাম Kaikaya by the sea.
টোকিওর Shibuya district এ।মডার্ন জাপানিজ রেঁস্তোরা । বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এলাম। রিজারভেশন থাকাতে ওরা টেবিল রেডি করে রেখেছিল।
সুহাইয়া, শানতনু মিলে বিভিন্ন ধরনের মাছ. সুসির অর্ডার দিলো।
অমৃত ।
পরিচয় হলো আমাদের দেশের তিন জনের সাথে। ওরা কাজ করে রাতে। দিনে কলেজে যায়। কথায় বলে বিদেশে বাংগালি স্বজন ।
ওদের আন্তরিকতা মুগ্ধ করলো।
খাওয়া শেষে বাসা।
পরদিন itinerary তে আছে National Garden, Halal Ramen, Shibuya Crossing, আর কেনাকাটা।
বাসায় এসে আড্ডাতে বসলাম । আমরা তিন জন।
অন্যরা যে যার মত ঘরে চলে গেল।

এপ্রিল ১১, ২০১৯

সাকুরা, জাপানের Cherry Blossoms কে বলে সাকুরা। দুর দুরান্ত থেকে লোকেরা আসে এই সাকুরা দেখার জন্য। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি গোলাপি ফুলের আচ্ছাদনে ঢাকা থাকে এই দেশ।
আমরা দেখলাম। ক্যামেরায় ধরে রাখলাম এই অপুর্ব দৃশ্য ।

সকালে উঠে শান্তা জিগগাসা করল, আজ কোথায় কোথায় যাবো বলত?
কেবল তো এসে পৌছিয়েছ টোকিও তে, অনেক কিছু দেখার মাঝে আজ যাব, National Gardenএ, খাবে হালাল Ramen, দেখবে Shibuya Crossing, কিছু কেনা কাটি করবে কি?
ইচ্ছা আছে।
তবে তাও হবে।
ও চলে গেল সাজতে গুঁজতে ।
Airbnb র এই একটা সুবিধা, রান্নাঘর আছে, আছে রান্না করার পাত্র। সকালে পাউরুটি, ডিম, জেলি আনা হলো। কফি আর দুধ নিয়েছিলাম আমি, জিবু এনেছিল চা আর চিনি।
রোজি বিয়াইন, চয়ন আপা মিলে তৈরি করল
অমৃত কর নাস্তা ।
আহা।
বের হতে হতে দশ টা বেজে গেলো। সুন্দর ঝকঝকে রৌদ, তাপমাত্রা ৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট । কে বলবে গতকাল বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া মাথায় করে এসেছিলাম।
যেখানে আছি সেখান থেকে কেনা কাটা করার দোকান গুলো খুব একটা দুরে নয়।
অলি গলি পেরিয়ে এলাম । দোকান খুলবে আরো দশ মিনিট পরে।
আমার আর শানতনুর কেনাকাটা করার কিছু নেই।
টেগোর কে নিয়ে আমি আর শানতনু রাস্তা পেরিয়ে এলাম Starbucksএ।
১২:৩০ মিনিটে নিদৃষ্ট জাগায় মিলিত হবো সবাই।
টেগোরকে ছেড়ে দিলাম বিরাট সান বাঁধান চত্তরে। সে ছাড়া পেয়ে হাঁটি হাঁটি করে ঘুরতে লাগলো চারিদিকে।
সময় পেরিয়ে গেলো।
আমি আর শানতনু হাতে কফি নিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। হাটতে হাটতে চলেছি । মাঝে মাঝে সিপ দিচ্ছি কফির কাপে। ঠিক সেই মুহুর্তে লক্ষ করলাম শুধু আমাদের দুজনের হাতেই কফির পেয়ালা।
রাস্তায় হাটতে হাটতে খাওয়ার রিতি এখানে নেই।
So embarrassing.

সবাই কিছু না কিছু কিনেছে। শুধু আমরা দুজন ছাড়া ।
কাছেই Tokyo Tower. বললাম চল ঘুরে আসি।
উপরে Observatory tower থেকে দেখলাম
Panoramic view of Tokyo.

এবার আমাদের যাওয়ার কঁথা হালাল Ramen খেতে। অনেকেই হয়ত জানেন Ramen কি। তবুও বলি । Ramen
জাপানিজ ডিস। সাধারণত নুডুলের সাথে Pork এর broth আর উপরে ছড়িয়ে দেয় porkএর টুকরা।

এই রেঁস্তোরার (Halal Ramen Ouka) র মালিক মুসলমান। বৌ, মেয়ে আর নিজে মিলে তৈরি করে হালাল Ramen । pork এর পরিবর্তে বিফ অথবা মুরগির broth.

এই রেঁস্তোরার নাম আছে মনে হলো। আমরা এসে দাঁড়ানোর পরপরই অনেকে এসে লাইনে দাঁড়াল। ভিতরে জাগা কম।
আমরা বসার পর দরজায় “ভর্তি “ সাইন লাগিয়ে দেওয়া হলো। অন্যান্য রা দাড়িঁযে রইল।
হাসি মুঁখে।

তৃপ্তি করে খেয়ে সবাই বেরিয়ে এলো। ন্যাশনাল পার্ক খুব একটা দুরে নয়। হাঁটা পথ। পার্কের সব গাছে এখন সবুজ পাতা আসেনি।তবু মন্দ নয়।
দেখা শেষে তাসমিয়া টেগোর কে নিয়ে চলে গেলো বাসাতে।
ছোট্ট “কিউটি পাই “ টা ক্লান্ত।

আমরা রওয়ানা দিলাম Shibuya Crossing দেখতে।
Shibuya Crossing. ব্যাখ্য না করে পারছিনা ।
চার টা রাস্তা মিলেছে এক জাগায়। চার রাস্তার ট্রাফিক লাইট একসাথে নিল থেকে লাল হয়। আর হাজার হাজার লোক পাড় হয় একই সময়ে। পৃথিবীর কোন দেশে এক সাথে এমন ভাবে লোক পাড়া পাড় হয় না।
আমরা JR ট্রেন নিয়ে এসে দাঁড়ালাম চৌরাস্তার মোড়ে। হাজার লোকের মাঝে আমরাও পাড় হলাম ঐতিহাসিক Crossing.

ঐখানে আঁছে এক কুকুরের মুর্তি ।
এর এক কাহিনি আছে।
কুকুরের নাম Hachiko. প্রতিদিন সে তার মালিক, প্রোফেসরের সাথে আসত স্টেশনে।
মালিক কাজে চলে গেলে সে বসে থাকত ঐখানে যতক্ষন না তার মালিক ফিরে আসত।
এই সুন্দর রুটিন একদিন অস্বাভাবিক ভাবে শেষ হলো, যেদিন হঠাৎ করে কাজে প্রফেসার মারা গেলো Heart attack এ। এই ঘটনা ঘটেছিল ১৯২৫ সালে।
Hachiko ঐখানেই বসেছিল, দেখত ট্রেন আসছে, যাচ্ছে আশা করত তার মালিক আসবে। দেখা হবে । কিন্তু তা আর হলো না
এমনি ভাবে দশ বছর কেটে গেল।
একদিন এই অপেক্ষার অবসান হলো।
১৯৩৫ সাল ।
Hachiko তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো ঐখানে।
খুব করুন কাহিনি। তাই না?
আগামি কালের কাহিনি আগামি কাল বলব।

এপ্রিল ১২,২০১৯

আজ আমাদের কর্মসুচি তে রয়েছে যে যার মতো বেরিয়ে পরো।
চয়ন আপা, বিয়াই বিয়াইন, জীবন কে নিতে আসবে চয়ন আপার জানা একজন। সারাদিন ওর কাটাবে তাদের সাথে।
শানতনু রা যাবে Hakone র Hot Spring এ। বাদ বাকি রয়ে গেলাম আমি আর রুমা আপা।
ঠিক হলো আমরা যাবো Lake Ashi দেখতে। আবহাওয়া ভাল থাকলে MT. Fuji দেখা যেতে পারে।

সম্ভবনা কম। আকাঁশ মেঘলা।
নাস্তা শেষে চয়ন আপারা চলে গেল ওদের গন্তব্য স্থলে।
আমরাও বেরিয়ে পড়লাম ।
JR ট্রেনে Odawara Station। সেখান থেকে শানতনু রা চলে যাবে ওদের পথে।
আমরা নেবো Hakone Tozan Railway.

Hakone র কথা বলতে গেলে বলতে হয়, ছোট্ট শহর। লোক সংখ্যা সাড়ে তেরো হাজার।
আছে Hot Spring, আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য , আছে Lakes , MT Fuji ও দেখা যেতে পারে । সব মিলিয়ে এই কতদিনের ঘোরাঘুরির পরে একটু ব্রেক ।

যথারীতি ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়ালাম । এই কতদিনে বেশ রপ্ত হয়ে গিয়েছে ট্রেন সিস্টেম ।
ফলে অসুবিধা হলো না।
ঘন্টা খানেকের পথ Odawara.
দেখতে না দেখতে চলে এলাম। ওখান থেকে শানতনু দের বিদায় দিয়ে আমরা উঠে বসলাম Hakone Tozan Rail এ। লাল রংয়ের।
মাত্র ১৫ মিনিটের পথ।
একে বেকে পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে চলেছে। অপুর্ব সুন্দর দৃশ্য চারিদিকে।
আমাদের গন্তব্য স্থান Hakone-Yumoto station.
এখান থেকে Lake Ashi. যেতে হবে বাসে।
জিগগাসা করতেই মিষ্টি হাসি দিয়ে মহিলা বলল, নিচে যেয়ে বাস নাম্বার H নিয়ে চলে যাও।
যথা সময়ে বাস এসে দাঁড়াতেই আমরা উঠে পরলাম। বাসের অধিকাংশ লোকই টুরিস্ট মনে হলো। সাথে বড় সুটকেস। হয়ত কয়েক দিন থাকবে উপভোগ করবে এখানকার সৌন্দর্য । আমরা এসেছি একদিনের সফরে।
দেখব, উপভোগ করব, চলে যাবো।
বাসটা ধীরে ধীরে পাহাড়ের উপরে উঠছে। চারিদিকে সবুজ গাছের সারি। খাদ নেমে গেছে নিচে। চিকন রাস্তার দুই পাশ দিয়ে গাড়ী আসছে। সময় সময় বাঁকের কাছে একে অপরকে দেখতে পারছে না।
এই দৃশ্য মনের মাঝে গেথে রাখা যাঁয। বোঝানো যায় না।
ধীরে ধীরে নেমে এলো উপর থেকে নিচে।
বাস থেকে নেমে এলাম।সামনে লেক।
কনকনে বাতাস। রুমা আপা আর আমার দুজনের ই কফির তৃষ্ণা।
সামনে একটা কঁফি হাউজ। দুজনে বসলাম।
আমার পকেটের মানিব্যাগ যেখানে ছিল সেখানেই রইল, হাত দিতে হলোনা।
এই ঠান্ডায় এই গরম কফি। আহ!

এসেছি দেখতে ঠান্ডাতে পিছপা হলে চলবে না। এলাম লেকের পাশে। ঠান্ডার জন্য লোকে বোট নিয়ে বের হয়নি। MT, Fuji দেখা যাচ্ছে না, আশাও করিনি।
লেকের পাড় থেকে দেখা যায় দুরের পাহাড় ।
দেখা শেষে এলাম বাস স্টপ এ । এবার H নয়. নাম্বার K নিয়ে এলাম স্টেশনে ।
মনোমোহন একটা দিন কেটে গেলো।

এপ্রিল ১৩, ২০১৯

আজ টোকিওতে আমাদের শেষ দিন। অনেক দেখলাম। স্মৃতির পটে রয়ে গেলো আন্দনমুখর দিনগুলো। যুনেদ, সুহাইয়া, শানতনু, তাসমিয়া দের এই ভ্রমনের পরিকল্পনায় আমরা এসে যোগ দিয়েছিলাম।
বারো জন আর কিউটি টেগোর মিলে উপভোগ করলাম প্রতিটি মুহুর্ত ।

আজ যাবো Tsukiji Fish Market, Emperial Palace আর Sensoji temple দেখতে।
সকালের নাস্তায় আজ ছিল সিদ্ধ ডিম, জেলি , পাউরুটি আর গতকাল চয়ন আপা এনেছিল উনার আত্মিয়ের হাতে বানানো কেক। সাথে রোজি বিয়াইনের বানানো কফি।
এই কতদিনের নাস্তা না বানানোর আলসেমি টা ফিরে যেয়ে পেয়ে না বসলেই হয়।
ওখানে আমাকেই আমারটা বানাতে হবে নচেৎ ——।

দশ টায় আমরা বেড়িয়ে পরলাম। Tsukiji Fish Market এ আসতে খুব একটা বেশি সময় লাগলো না।
জমজমাট মার্কেট। এই বাজার পৃথিবীর বৃহতম Whloesale fish এবং seafood র বাজার। ছোটো ছোটো রাস্তা চলে গেছে ভিতরে। দুই পাশের দোকানে বিক্রি হচছে বিভিন্ন ধরনের মাছের প্যাকেট।
সুসি ও অন্যান্য খাবারের দোকান। আমি, শান্তা, রুমা আপা, জীবন এক সাথে ঘুরছি।
অন্যান্য রা চলে গেছে অন্যদিকে।
ছোট্ট একটা দোকানে ভীড় উপচে পড়ছে।
জানলাম এখানের সুসি বিখ্যাত। অগত্যা লাইনে যোগদিলাম।
সত্যিই সুসির সেই স্বাদ ভুলিবার নয়।
১২:৩০ টা সবাই এসে মিলিত হলাম নিদৃষ্ট জাগায়।
রোজি বিয়াইন কিনেছে অনেক কিছু। চয়ন আপা ও কম যায়নি।
এখান থেকে আমরা ছয় জন চলে গেলাম
Sensoji temple দেখতে। অন্যান্যরা চলে গেলো মিউজিয়ামর উদ্দেশ্যে।

Sensoji temple , অনেক পুরানো Buddhist temple, টোকিওর Asakusa তে।
This temple is dedicated to the Bodhisatva Kannon.
কথিত আছে Sumida River এ দুই জেলে ( দুই ভাই Hinokuma Hamanari এবং Hinokuma Takenari) Kannon র মুর্তি টাকে পেয়েছিল। গ্রামের প্রধান এই মুর্তির পবিত্রতা বুঝতে পেরে নিজের বাসাটাকে নতুন করে তৈরি করে মুর্তি টাকে ওখানে রেখে
বাসাটাকে Temple রুপ দেয়। যাতে করে গ্রামবাসীরা এই মুর্তির পুজা করতে পারে।
এই Temple তৈরি হয়েছিল 645 AD, সেইজন্যই এটা টোকিওর সবচেয়ে পুরাতন Temple.
Temple ঢোকার শুরুতে Thunder Gate. সেখানে বিরাট এক কাগজের লণ্ঠন। লাল, কালো রংএ আঁকা।
এই Thunder Gate থেকে Temple এর চারপাশে আছে Souvenir র দোকান। লোকে কিনছে।
অগণিত মানুষ। পুজা করছে।

বেশ কিছুটা সময় কেটে গেলো এখানে| জীবন, রুমা আপা কিছু Souvenir কিনে নিলো।

শেষ যাবো Emperial Palace দেখতে। এই খানে মিলিত হবো অন্যান্য দের সাথে।
যখন পৌঁছালাম , সময় পাড় হয়ে গেছে। ৪:৩০ মিনিটে বন্ধ হয়ে গেছে । Palace এর চারিধারে ঘোরাঘুরি করে রওয়ানা দিলাম বাসার পথে।

যাওয়ার পথে Tully’s Coffee না খেলেই নয়। রাস্তার ও পাশেই লেখা আছে Tully’s Coffee.
এলাম। রুমা আপা তার পার্স খুললো।

ক্লান্ত সবই। সুটকেস গোছাতে হবে। টেগোর ঘুমিয়ে পরেছে।
সকাল ৭ টায় বের হতে হবে।
আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিলাম।
বিদায় টোকিও, বিদায়

Image may contain: tree, plant, sky, outdoor and nature

Continue Reading

জাপানের পথে

                            জাপানের পথে

চোখটা খুলে জানালা দিয়ে আলোর আভাস না পাওয়াতে বুঝতে পারলাম আজও আকাশ গোমরা করে আছে। পাশে রাখা ঘড়িটার দিকে চোখ বুলাতেই দেখতে পেলাম ছোট কাঁটা আটটা ছাড়িয়ে গেছে।
উঠতে হবে।
পেট টা চিন চিন করছে। খিদে না অন্য কিছু বোঝা দায়। তবুও আড়ামোড়া কাটতে ইচ্ছা করলো। কাজে যাওয়ার দায় নেই। আশে পাশে কেউ নেই যে বলবে, উঠো, নাস্তা তৈরি।
অগত্যা কম্বল টা মাথার উপর উঠিয়ে দিলাম।
কোথায় যেন চি চি আওয়াজ হচ্ছে। বুঝতে চেষ্টা করলাম। হঠাৎ মনে হোল ফোন টা নিঃশব্দ সংকেতে দেওয়া আছে, এটা তারই আওয়াজ।
শান্তনুর কল।
এতো ভোরে কল করলে অজানা একটা ভয় শরীরেরে মাঝে খেলে যায়। আজও তার ব্যাতীক্রম হোল না।
এতো ভোরে? সব ঠিক আছে? জিজ্ঞাসা করতেই বলল, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কিছু করছি কিনা।
বললাম না, কেন বলতো?
জাপান যাবো। ছুটি পেয়ে গেলাম, তাসমিয়ার ছুটি আছে। টেগোরের বছর পূর্তি হোল। তুমি রাজি তো? ও হাঁ , This vacation will be my treat.
এতো গুলো কথা একসাথে বলে একটু চুপ করে রইল আমার উত্তর শোনার জন্য।
মনে পড়ল, কল্পনা বলতো ওদের কে “অনেক কষ্টে তোমাদের কে মানুষ করেছি, যখন আমাদের বয়স হয়ে যাবে তখন তোমরা প্রতি ছয়মাসে আমাদের কে বেড়াতে নিয়ে যাবে দুর দেশে”।
হায়রে কপাল, ভোগ টা শুধু আমি একই করছি।
বললাম, চিন্তা করে দেখি। এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।
আমি এক ঘণ্টা পড়ে কল করবো বলে ফোনটা রেখে দিলো।

জানি যেতে আমাকে হবে। তাই আমিই কল করে জিজ্ঞাসা করলাম, তা কতজন যাচ্ছি?
সব মিলিয়ে বারো জন।
নামের তালিকায় চোখ বুলিয়ে দেখলাম সবাই চেনা পরিচিত। মন্দ না। দিনগুলো কাটবে ভাল।

জাপান যাওয়ার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। আমার নয়, বলব আমাদের ছিল।
একটু দেরী হয়ে গেলো। তাই আজ আমিই যাবো, ওদের সাথে।

প্রথম দিনের কথা থেকে বেশ কয়টা মাস কেটে গেছে।
শান্তনু, জুনায়েদ মিলে ছক কেটে রেখেছে, কোথায় কি কি দেখবো।
প্রথম রাতে টোকিও থেকে পরদিন যাবো Kyoto। সেখানে তিন রাত। সেখানে থেকে ওসাকা। ডে ট্রিপ।
ফিরে আসে টোকিও তে চার রাত।
দুই জাগায় Airbnb ভাড়া করে রেখেছে।
আজ সেই দিন। ছয়টায় প্লেন ছাড়বে।
আমি যাবো আমার বাসা থেকে। শান্তা বলে রেখেছে, সে যাবে আমার সাথে এয়ারপোর্টে।
ইসাক ভাই পৌছে দেবে।
বাক্স এখনো বন্ধ করিনি। কাল রাতে জীবু দুই একটা খাবার জিনিস দিয়ে দিয়েছে। ঐ গুলো ঢোকাতে হবে।
সেই সাথে ঔষধ গুলো আর একবার দেখে নিতে হবে।
এবার উঠি।
পথের অভিজ্ঞতার সাথে কি কি দেখলাম, তার বর্ণনা পরবর্তী তে জানাবো।
সবাই কে কুশল জানিয়ে আজকের মতো
বিদায়।

Continue Reading

কালো বিড়াল

কান্নার শব্দে ঘুম ভেংয়ে গেলো কবীরের। পাশে রাখা ঘড়িটার দিকে তাকালও।
রাত তিনটা।
মিসকালো ঘর।
কান্নার শব্দ নেই।
ভাবল, হয়তো স্বপ্ন দেখছিল। কম্বল টা মাথার উপর টেনে পাশ ফিরল সে।
গলাটা শুকিয়ে আসছে। কম্বল টা মাথার উপর থেকে সরিয়ে অন্ধকারে পাশে রাখা পানির বোতল টা হাত দিতেই মেঝে তে পড়ে গেলো।
ধুত্তোর, বলে কম্বল টা আবার মাথার উপর টেনে নিলো। ঘুম টা চলে যাওয়ার আগেই আবার ওটাকে জড়িয়ে ধরতে হবে। এই ভেবে চোখ টা বুঝল সে।
না কান্নার শব্দ নেই তবেঁ কে যেন তার কম্বল টা টানছে মনে হোল।
হিস হিস শব্দ।
ভয়ে হীম হয়ে এলো কবীরের শরীর। মাথার কম্বল সরে গেছে। চোখ খুলতে চাইলো না সে।
টুং করে শব্দ হোল।
কি যেন মেঝে তে পড়ে গড়িয়ে চলেছে। থেমে গেলো শব্দ টা।
ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে চাইল কবীর।
অন্ধকার টা সয়ে এলো। বিছানা থেকে নামতে যেয়ে হোঁচট খেলো পড়ে যাওয়া পানির বোতলের সাথে।
আলো টা জ্বালালও।
মেঝেতে কিছুই দেখতে পেলনা।
দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো।
নিচের তালায় আলো জ্বলছে।
মনে করতে পারলো না রাতে উপরে উঠার আগে আলোটা নিভিয়ে ছিল কিনা।
অ্যালার্ম টা অফ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো।
টিভি টা চলছে।
শব্দ নেই।
হাল্কা একটা হওয়া বয়ে গেলো মনে হোল কবীরের কাছে।
উপরে তাকাল সে।
ফ্যান টা বন্ধ।
গা টা শিরশির করে উঠল।
Sliding door টা খুলতে যেয়ে থমকে দাঁড়াল কবীর।
বাহিরে জ্বালানো অল্প আলোতে দেখতে পেলো এক কালো কুচকুচে বিড়াল ।
বসে আছে।
চোখ টা জ্বলজ্বল করছে।
কবীরের মনে হোল বিড়াল টা ওর দিকে তাকিয়ে, কি যেন বলতে চাইছে।
হঠাৎ করে দৌড়ে এসে Sliding door এ খামছা মারলও।
মাউ মাউ করে কয়েক বার ডেকে আবার পিছিয়ে যেয়ে তাকিয়ে রইল কবীরের দিকে ।
এই বিড়াল টাকে সে আগে দেখেনি।

বাহিরে বড় রেড ম্যপেল গাছ টা হঠাৎ দুলে উঠলো। এক ঝলক ঝোড়ও হাওয়া গাছটাকে দুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
ঘুমন্ত পাখি গুলো কিচিমিচি শব্দ করে উড়ে গেলো অন্ধকারের মাঝে।
ভৌতিক রাত মনে হোল কবীরের কাছে।

পাশের বাড়ীর বাহিরের আলো টা আজ কেনও নিভানো বুঝতে পারলনা কবীর।
ওরা কি নেই বাড়ীতে?
Sliding door টা খোলার সাহস হোল না কবীরের।
পিছন ফিরতেই বিড়াল টা আবারও আছড়ে পড়লো Sliding door এর উপর।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে সব আলো গুলো নিভে গেলো।
বাহিরে অন্ধকার। ভিতরে অন্ধকার।
শুধু জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ।
পিছন ফিরে হাটতে যেয়ে কফি টেবিলে আছাড় খেলো।
উহ! করে পড়তে পড়তে আবার উঠে দাঁড়াল কবীর।
ঢং করে বেজে উঠল মাস্টার ক্লক টা।
জানিয়ে দিলো রাত সাড়ে তিনটা।
কবীরের গলা শুকিয়ে এলো।
অন্ধকারে হাতড়িয়ে চলতে যেয়ে হাতটা পড়লো পিয়ানোর উপর।
ঝনঝন করে বেজে উঠল ।
কবীর ভয়ার্ত চিৎকার করে পিছিয়ে এলো।
শীতের রাতেও ওর সর্ব শরীরে ঘামের কনা।
আলোটা ফিরে আসছে না কেনও ভাবতে যেয়ে মনে হোল কে যেন ওর পিঠের উপর হাত রেখেছে।
কে?
বলে পিছন ফিরতেই হাতটা সরে গেলো মনে হোল, কালো কুচকুচে অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলনা।
শুধু দেখতে পেলো জ্বলজ্বলে দুটো চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে।


Continue Reading

আমার দেশ

হঠাৎ করেই মনে হোল দেশে যাবো।
অফুরন্ত সময় আমার হাতে। যদিও বছর ঘুরেনি শেষ যখন দেশে গিয়েছিলাম।
ভাল লাগে যেতে।
ফোন করলাম বোন কে। ওখানেই উঠি। পৈতৃক ভীটা আজ আর নেই।
ছিল।
পাঁচ তালা দালান। আজ নেই।
কাজেই যখনই আসি, ওখানেই উঠি। প্রান ঢেলে করে সে। কোন কিছুর ত্রুটি নেই। মা যে ভাবে করতো।
সেই সাথে আছে দিলারা। ওকে ছাড়া সব অচল।
লোকে বলবে, ওত কাজের মেয়ে।
আমরা বলি ও আমাদের পরিবারের একজন।
আমি এলে প্রথমে বলবে, মামা তোমার স্যান্ডেল আর তোয়ালে নামিয়ে রেখেছি, তুমি আসবে শুনে।
আমিও ওর উপরেই নির্ভরশিল হয়ে পরি। ছোট খাটো দরকারি জিনিস ঐ করে দেয়। ডেকে বলি, দিলারা, আমার ফোনে টাকা নেই।
হাসি দিয়ে বলবে, কোন সমস্যা নেই, মামা। ঐ হাসি টা আমার মনে গেঁথে থাকে।

আমি আসবো শুনে বোন বলেছিল, তুমি যে দিন আসবে সেদিন আমরাও ব্যাংকক যাবো। মাত্র পাঁচ দিনের জন্য। তোমার অসুবিধা হবে না। দিলারা থাকবে।
মনে মনে ঠিক করলাম, আমিও না হয় বাড়িয়ে পড়ি ঐ কয়দিনের জন্য। পাশের দেশ ভারত। কলকাতায় গিয়েছি কয়েক বার তবে শান্তিনিকেতনে যাওয়া হয়নি।
যেই কথা সেই কাজ। ভাগ্নে অপু কে বললাম, কি রে যাবি?
সে এক পায়ে খাড়া। বলল, মামা, আমি সব ঠিক করছি, চলে এসো।

এখানে ছেলে, মেয়েদের বললাম। দেশে যাবো। কলকাতায় যাবো তিনদিনের জন্য। সাথে সাথে ফর্দ এসে গেলো হাতে।
দেখে মনে হোল খুব একটা কমে সারা যাবে বলে মনে হয় না।
যথারীতি দেশের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। পথের ধকল শেষে এসে পড়লাম ঢাকার এয়ারপোর্টে। পাক্কা দুই ঘণ্টা লাগলো Immigration এর হাত থেকে বের হতে। দেরী আগেও হয়েছে, কিন্তু এতো দেরী কখন হয়নি।
যাহোক, পথের যানজট পেড়িয়ে যখন বাসায় এলাম রাত তখন নয়টা।
বোন বললও, খেয়ে নেও, কাল ভোরেই তো তোমার ফ্লাইট।

ভাবছিলাম শরীর টা এই ধকল সইতে পারবে কি না।
পেরেছিল।
কলকাতায় যখন এসে পড়লাম তখন সকাল ১১ টা। পার্ক ষ্ট্রীটের উপর আমাদের হোটেল। নাম The Park.
ট্যাক্সি নামিয়ে দিলো হোটেল।
কাউন্টারে এসে নাম বলতেই এক সুন্দরী রিশিপসনিস্ট কাগজ পত্র গুলো সামনে এনে দিলো।
সই করতে যেয়ে চশমাটা খুজে পেলাম না। মনে পড়লো ওটা ট্যাক্সির সিটের পাশে রেখেছিলাম। ওখানেই রয়ে গেছে।
ওটা ছাড়া চলা মুশকিল। কি করি। অগত্যা সানগ্লাস টা দিয়ে কাজ চালাতে হবে।
অপু দেখে বলল, বাহ, তুমি তো Celebrity হয়ে গিয়েছো।
কি আর করা, আসতে না আসতেই ঝঞ্ঝাট।

যেহেতু সকাল সকাল পৌছে গেছি তাই ভাবলাম পুরো দিনটাই তো আমাদের হাতে। কাজে লাগাতে হবে।
অপুকে বললাম, চল আজকে কেনা কাঁটা গুলো সেরে ফেলি। আবার সময় নাও পেতে পারি। পার্ক ষ্ট্রীটের উপরেই দোকান।
কেনা কাটাতে আমি নিতান্তই আনাড়ি। দামদর করা আমার হয়ে উঠে না।
ওখান থেকে বলে দিয়েছিল নিউ মার্কেট থেকে কিনতে। আগে যখন এসেছিলাম সাথে দামদর করার লোক ছিল।
আজ নেই।
কাজেই ঐ ঝঞ্ঝাট আমার পোষাবে না ভেবে ঢুকে পড়লাম পার্ক স্ট্রীটের এক দোকানে।
যা চাইছি তার ফিরিস্তি শুনে ভদ্রলোক বললেন, এখানে Sabyasachi নয়, তবুও Sabyasachi র মত যা চাইছেন তা মিলবে না। তবে ভদ্রলোক অন্য এক দোকানের নাম দিয়ে দিলেন।
দুরে নয়। এক ব্লক হাটতেই দেখা গেলো দোকান টা।
ফোন থেকে ছবি গুলো ( মেয়ে আর বৌমা ছবি দিয়ে দিয়েছিল) দেখাতেই, সেলস ম্যান বলল, আছে, এই দিকে আসেন।
ঠাণ্ডা খাবেন না গরম ।
মনে মনে ঠিক করেছি, আর যাই হোক ঠকবো না। কারন, আসার আগে আমার এক নিকট জন, যার কিনা শাড়ী কাপড়ের দামের উপর অঘাত জ্ঞান, রিসার্চ করে বলেছিল, মামা, তোমাকে যা দাম বলছি তার উপরে যাবে না।
আমি যাই নি।
ওরা অনেক আদর আপ্যায়ন করেছিল আমাদের কে। ভুলবার নয়।

পর দিন ভোরে যাবো শান্তিনিকেতনে। জাহাঙ্গীর ভাই ঠিক করে রেখেছিল এক ট্যাক্সি কে ঢাকা থেকে। ড্রাইভারের নাম, সাহাবুদ্দীন। ফোন করে জেনে নিলাম কখন আসবে।
বলল, সকাল আটটার মধ্যে বের হয়ে যেতে হবে। সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথ।
অনেক দিনের শখ, আজ তা পুরন হতে চলেছে।
রাতে ঘুম এলো না। তাতে কিছু যায় এসে না। না ঘুম আমার নিত্ত দিনের সাথী।

ঠিক আটটায় সাহাবুদ্দীন এসে হাজির। বয়স পঁচিশ থেকে তিরিশের উপর হবে না। প্রথম দেখায় ওকে পছন্দ হয়ে গেলো আমার। হাসি খুশি মানুষ আমার সব সময় প্রিয়।
আমাদের কোন কিছু ভাবতে হবে না বলে, সে গাড়ী ছেড়ে দিলো। শহর থেকে বের হতে দেরী হয়ে গেলো। পুরন শহরের গলি পথ থেকে বের হওয়া চাট্টি খানি কথা নয়।
অবশেষে এসে পড়লাম দিল্লি এক্সপ্রেস ওয়ে তে। গাড়ীর স্পীড একটু উপরের দিকে মনে হোল। চারিদিকে বাস আর বড় বড় ট্রাকের সারি।
সাহাবুদ্দীন কে একটু আস্তে চালাতে বলে বাহিরের দৃশ্য দেখায় মগ্ন হলাম। বর্ধমান পেড়িয়ে অবশেষে শান্তিনিকেতনে এসে যখন এসে পৌছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা দুটো ছুঁই ছুঁই।

শান্ত, ছায়া ঘেরা পরিবেশ। হাঁটি হাঁটি করে চত্বরে এলাম। লাল সুরকীর পথের দুদিকে গাছের সারি। পথ ধরে এগুতেই কানে এলো রবীন্দ্র সঙ্গীত ভেসে আসছে একটা বাসা থেকে।
আসলে ওখানে চলছে সঙ্গীত চর্চা। একটু এগোতেই দেখলাম বিড়লালয় ছাত্রী নিবাস। মৃণালিনী ছাত্রী নিবাস।
এমন শান্ত পরিবেশ দেখিনি অনেক দিন।
গাইড না থাকাতে কোণটা কি তার বিশ্লেষণ পেলাম না। তবে হা সেই স্বাদ মিটাল এক তিন চাকার স্কুটার ড্রাইভার। ভিতরে তাদের প্রবেশ নিষেধ। বাহির দিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল, কোন গাছের নিচে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা লিখতেন।
দেখাল ছাতিমতলা।
দেখা শেষ। বিকেল গড়িয়ে গেছে। এবার ফেরার পালা।
শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ থেকে এসে পড়লাম হট্টগোল রাস্তায়।
সাহাবুদ্দীন বলল, মাঝ পথে কিছু খেয়ে নেবো।
ঠিক আছে। বলে গাড়ীতে এসে চোখটা বুঝলাম।

কোলকাতা শেষে ঢাকায় ফিরে এলাম।
এবারে ঢাকায় একটা অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়।
আমি আর অনীকা চলেছি রিক্সায়। রাস্তায় জামে দাড়িয়ে। হঠাৎ এক মহিলা। সুন্দর করে সাঁজা। বলল, কেমন আছো?
আমি ভড়কে যেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মনে হোল ও দেখতে আমার ভাগ্নির মতো। অনেক দিন ওকে দেখিনি।

তুই এখানে? বলতে যেয়ে অনীকার কনুএর গুতা খেয়ে ওর দিকে তাকাতেই ও বলল, মামা পঞ্চাশ টা টাকা দিয়ে দেও।
কিছু বলতে যাওয়ার আগে আবারও কনুএর গুতা খেলাম।
অগত্যা টাকা দিতে না দিতেই রিক্সা চলতে আরম্ভ করল।
আমারও চোখের সামনে পর্দাটা সরে গেলো। মনে পড়ল ছোট বেলায় যখন ওদের কে দেখেছি, দেখেছি অন্য ভাবে।
Transgender.
অনীকা বলল, আজ ওদের কে দেখে কেউ নাক ছিটকায় না। সিটি দেয় না।
ওরা এখন বিভিন্ন জাগায় চাকরিও করে।
শুনে ভাল লাগল। ওকে বললাম, আমাদের মানসিকতা অনেক পালটিয়ে গেছে। আমরা কিছুটা উদার হতে শিখেছি।
এর পরেও ওদের সাথে আমার কয়েক জাগায় দেখা হয়েছে। তবেঁ প্রথম বারের দেখার স্মৃতি ভুলিনি আজও।

কোথা দিয়ে সময় গুলো কেটে গেলো জানতে পারলাম না।
এবার সুটকেস গুছানোর পালা।
দিলারা হাসি মুখে এসে বলল, মামা, তোমার প্যান্ট গুলো ভাজ করে তোমার ঘরে রেখে এসেছি।
স্যান্ডেল আর তোয়ালে টা আমি উঠিয়ে রেখেছি। আগামী বছর এলে নামিয়ে দেব।
আগামী বছর।
আসব বৈকি?

Continue Reading

সমস্যা

 

 সকাল বেলা কম্পিউটারটা খুলে বসে ব্যাংকিং এর কিছু কাজ করতে যেয়ে দেখি আমার একাউন্ট থেকে কে বা কারা টাকা সরিয়ে নিয়েছে। টাকার পরিমাণ অনেক না হলেও আমার জন্য অনেক বেশি।

আমি ছাই পোষা মানুষ। আমার একাউন্টে হাত দেওয়া কেন?
দৌড়ে গেলাম বাঙ্কে।
আমার সমস্যা শুনে ম্যানেজার মহাশয় খুব একটা বিচলিত হলেন না। হয়ত এই ধরনের পরিস্থিতি তাদের কে প্রায় পোহাতে হয়। কিন্তু আমার জন্য এটা একটা বিরাট বিষয়।
সব দেখে বলল, আমরা এর ব্যবস্থা নেবো, তবেঁ সময় সাপেক্ষ। এই মুহুর্তে এই একাউন্ট বন্ধ করে নতুন একাউন্ট খুলুন।
নতুন একাউন্ট খুলে এলাম।
এই খানেই তোঁ সমস্যার সমাধান নয়। যে যে পাওনাদাররা আমার এই একাউন্ট থেকে প্রতি মাসে টাকা উঠিয়ে নেয় তাদের কে নতুন একাউন্টের কথা জানাতে হবে। জানাতে হবে সরাসরি আমার কাজের থেকে যে টাকা জমা হয় তাদেরকে।
ভোগান্তির শেষ নেই।

এই তো সে দিন। নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। সামনের থেকে তৃতীয় সাড়িতে বসা এক রুপসী মহিলা বার বার ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে চাইছে। দুই দুই বার চোখাচোখি হোল। মহিলা একটু হাসলেন।
কেনও? জানিনা।
অস্বস্তি লাগছিলো। চিনিনা জানি না কেন আমার দিকে তাকানো।
নাটক শেষে বাহিরে আসতেই মহিলা এসে আমার সামনে দাঁড়াল।
চিনতে পারছেন?
বললাম, না, চিনতে তোঁ পারছি না।
আমার নাম — , আমার বড় বোনের সাথে আপনার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। ওর নাম —-।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এই নাম আমি কস্মিনকালে ও শুনিনি।
বললাম, আপনি বোধ হয় অন্য কারো সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন।
না তা কেনও হবে? ওই যে ওই পাড়াটা। নাম হচ্ছে— ।
ওই পাড়ার কাছে দিয়েও কোনদিন গেছি বলে মনে পড়ছে না।
তাহলে কি আমি ভুল করলাম। বলে একটু সময় নিয়ে আবার বললেন, আমার বোনটা আজ থাকলে সে হয়তো বলতে পারতো।
উনি আসেনি?
না সে বেচে নেই।
অত্যন্ত দুঃখিত। তাহলে তো সমস্যার সমাধান হোল না।
না তা হোল না। তবে কথা আমরা চালিয়ে যেতে পারি এক কাপ চা খেতে খেতে।
বললাম, এক জাগায় যেতে হবে। তাড়া আছে। চলি।
কোন রকমে পালিয়ে বাচলাম।

দুইদিন আগে এক বন্ধু ফোন করে বলল, মস্কো যাবি?
একটু সময় নিলো ওর কথা টা বুঝতে।
ভোর বেলা। তখনো আমার চা র পেয়ালা শেষ হয়নি।
কি রে চুপ করে রইলি যে।
না, তোর কথা টা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
মস্কো, মস্কো যাবি?
তোর সকাল টা কি চা দিয়ে না অন্য কোন তরল পদার্থ দিয়ে শুরু হয়েছে।
না, সত্যি বলছি, ভাল একটা ডিল আছে।
রাজি হলাম।
ছেলে কে বলতেই সে হৈ হৈ করে উঠল।
মস্কো, মাথা খারাপ। ওই খানে গেলেই তোমার পিছনে চর লেগে যাবে। আর ফিরে আসতে হবে না। অন্য কোন দেশে যাও আমার আপত্তি নাই।
চর, কেন, আমার পিছনে চর লাগবে কেন? আমি কি এখান কার কেউকেটা কিছু।
যত সব জুট ঝামেলা।
অগত্যা যাওয়া হলনা। মা মরা ছেলের কথা ভেবে ওদিকে আর পা বাড়ালাম না।

সমস্যার সীমা নেই।
এইতো গতকাল। গাড়ীটা নিয়ে বের হয়েছি। যাবো এক বন্ধুর বাসায়। থাকে তিরিশ মাইল দুরে। বাহিরে বৃষ্টি।
ইচ্ছা ছিলনা যাওয়ার। কিন্তু বন্ধু আমার নাছোড় বান্ধা। আরও কয়েক জন আসবে।
বলেছিল, প্রণতি আসবে।
প্রণতি ,ঐ নামটা আমাকে টেনে নিয়ে গেলো। এক সময় ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল।

আমার দশ বছরের পুরানো গাড়ীটার সিডি কম্পারটমেন্টে রবীন্দ্র সংগীতের একটা সিডি চালিয়ে দিলাম। গানের সাথে গুনগুণ করে গাইছি।
হঠাৎ দেখি পিছনে ফ্লাশিং লাইট।
ওহ, নো। পুলিশের গাড়ী। আমাকে সাইড করতে বলছে।
অগত্যা পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম।
বৃষ্টি মাথায় পুলিশটা এসে দাঁড়াল আমার গাড়ীর জানালার কাছে।
জানালা খুলে জিজ্ঞাসা করলাম আমি কি অন্যায় করেছি। গাড়ী যে খুব একটা জোড়ে চালিয়েছি তাও নয়।
তাহলে?
বাহিরে বৃষ্টি, অয়াইপার চলছে, কিন্তু তোমার গাড়ীর বাতি জ্বলছে না। এই তোমার অপরাধ। বলল, পুলিশটা।
মনে পড়ল আইন করেছে অয়াইপার চললে বাতি জ্বলতে হবে। আমার পুরান গাড়ীতে অটোম্যাটিক এসব হয় না।
মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম অপরাধ হয়ে গেছে।
শুনল না। টিকিট টা ধরিয়ে দিলো।
মাটি হয়ে গেলো প্রণতির সাথে দেখার আগ্রহ। রবীন্দ্র সংগীত বন্ধ করে দিলাম।
মেজাজ খিঁচিয়ে গেলো।
মেজাজ আরও খিঁচিয়ে গেলো প্রণতি কে দেখে।
হাল্কা লিকলিকে বাহু, মোটা গ্লাসের চশমা চোখে, পড়নের শাড়ী টা যেমন তেমন করে পরা। সিঁথিতে সিঁদুর নেই।
আমার দেখা সেই প্রণতি কোথায়?
যার বুক সমুদ্রের ঢেউ এর মতো উঠা নামা করত, আজ তা নদীর মতোই শান্ত। যার চোখের দৃষ্টি অর্জুনের ছোড়া তীরের মতো তীক্ষ্ণ। বুকে এসে আঘাত হান্ত। আজ তা হারিয়ে গেছে মোটা চশমার অন্তরালে।

দুহ ছাই! বলে চৌকাঠের দিকে পা বাড়াতেই ডাক শুনলাম।
পিছন ফিরে দেখি শাহিন।
চলে যাচ্ছিস?
হাঁ।
কারন?
কোন কিছুই মনের মতো হচ্ছে না।
নদীর জল অনেক গড়িয়ে গেছে বন্ধু। এখন মনের মতো চাইলে তো মনের মতো হবে না।
হেঁয়ালি রাখ, কি বলবি, বল।
হাকিমের কথা মনে আছে?
আছে।
যোগাযোগ?
না।
সে সব সমস্যার সমাধান করতে চলেছে।
আবারও হেঁয়ালি?
পেনক্রীয়াটিক ক্যান্সার। শেষের পথে। চিকিৎসা করাবে না বলেছে।
কি বলছিস?
সে বলেছে, চিকিৎসা করিয়ে কি লাভ? একমাসের পরিবর্তে না হয় দুই মাস বাজবো। দুমাস বাচতে যেয়ে ঐ বিষাক্ত ঔষধের যে প্রতিক্রিয়া তা আমার সইবে না।
যাবি দেখতে?
শাহিনের দিকে চেয়ে নিজের সমস্যা সমস্যা বলে মনে হোল না।
বললাম,
চল।

Continue Reading

সনীতা

                          সনীতা           

অস্তগামী সূর্যের শেষ ক্ষীণ রোশনি টা এসে পড়েছে অনীকের ড্রয়াইং রুমে। আলো টা জ্বালাতে মন চাইছে না। অলসতা নয়। অন্ধকারটা ভাল লাগছে। অস্থির মনটা অন্ধকারে পাক খাচ্ছে। চোখ বুজে পিছনে ফেলে আসা কয়েকটা দিনের স্মৃতি ভাবতে যেয়ে অনিকের মনে হচ্ছে কি যেন সে ফেলে এসেছে সেই প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে।

মনে পড়ে। প্লেনে উঠার আগে সনীতা বলেছিল, পারলে প্লেনে একটু ঘুমিয়ে নিও। শরিফ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ব্রাদার, প্রতিটা দিনকে ভাগ করে নিও, কখন কি করবে, তাহলে একাকীত্ব হয়তো কিছুটা ঘুজবে।

ক্লান্ত শরীর টাকে সোফার উপর এলিয়ে দিয়ে অনীকের মনটা চলে গেলো বেশ কিছু পেছনে। সেই কাক ডাকা ভোরে যে ফোন টা এসেছিল। সেই মিহি মিষ্টি কণ্ঠস্বর।
অনীক?
এই কণ্ঠস্বরের সাথে অনীক পরিচিত নয়।
কে বলছেন?
চিনতে পারলে না তো। অবশ্য চিনতে না পারারই কথা। কি ভাবে তোমার ফোন নাম্বার টা পেলাম সে কথা পড়ে আসবে।
মনে পড়ে কি সনীতার কথা। প্রশ্নটা করে কিছুক্ষণ চুপ করেছিল।
সনীতা, সনীতা, অনীক চেষ্টা করল স্মৃতির পাতা গুলো উল্টিয়ে কোথায়, কখন এই কণ্ঠস্বর সে শুনেছিল। স্মৃতির দুয়ার খুলে ভেসে উঠলো সেই হাস্যজ্জল মুখটা। স্মৃতির ভাজে ভাজে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ভেসে উঠলো অনীকের চোখে।

পরিচয় হয়েছিল কবীরের বাসায়।
ঘরে ঢুকতেই চোখাচোখি হয়েছিল। সদ্য পা দিয়েছে এই দেশে অনীক। লজ্জা টা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
চোখ নামাতেই, শুনতে পেলো সেই মিষ্টি কণ্ঠস্বর, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। নতুন বুঝি?
হাঁ।
আমার নাম সনীতা।
অনীক আমতা আমতা করে বলেছিল তার নামটা।
কবীর বুঝি আপনার বন্ধু?
জি।
কবীর আমার চাচাতো ভাই।
ঠিক সেই সময়ে কবীর এসে বাঁচিয়ে ছিল অনীককে।
পরিচয় হয়েছে তোদের?
হয়েছে, বলে সনীতা অনীক কে বলেছিল, চলেন আমার সাথে, আড্ডা দেবো সবাই মিলে।
সেই আড্ডা তে অনীকের সাথে পরিচয় হয়েছিল কণার সাথে। সে তো আজ অনেক অনেক আগের কথা।

সনীতাও একদিন হারিয়ে গেলো। শরিফকে বিয়ে করে সেও পাড়ি দিল দূরদেশে।
আজ সেই কণ্ঠস্বর বেজে উঠলো অনীকের কানে, সেই চোখ, সেই মুখ, সেই ডোরা কাঁটা নীল রঙ এর শাড়ী।

একটু দেরী হোল চিনতে, মনে কিছু করো না।
মনে করবো, পাগল, তোমাকে অনেক খুঁজেছি। কবীর কে জিজ্ঞাসা করেছি। সেও জানেনা তোমার খবর।
নিজেকে গুটিয়ে ফেললে কেন, বলতো? আজ যখন তোমার খবর পেলাম, বলি কি, এসো আমার এখানে।
কোথায়?
সানফ্রানসিসকো তে। আসবে বলও। অনেক কথা আছে তোমার সাথে।
অনীক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
আজ থেকে তিরিশ বছর আগে একবার সে গিয়েছিল সানফ্রানসিসকো তে। সবাই মিলে। আজ সব ভেঙ্গে চুরে খানখান।

না করতে পারলো না অনীক। সনীতার ডাকের মাঝে যে আন্তরিকতা তাকে অবহেলা করে পাশে ঠেলে দিতে পারলো না অনীক।
বলল, কবে আসতে বলও?
থাঙ্কসগিভীং এর ছুটিতে চলে আসো। অনেক মজা হবে। শফিককে বলব বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটি নিতে।
আসবে তো?
আসব।
কথা শেষে অনেকক্ষণ চোখ বুজে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করছিল অনীক।
ফোনটা বেজে উঠলো আবার।
সনীতা আনন্দ মেশানো স্বরে বলল, শোন, ওকল্যান্ড এয়ারপোর্টে নামবে। ওটা আমাদের বাসার কাছে।
ঠিক আছে। বলে অনীক একটু হাসল।

জীবনের একঘেয়েমি অনীককে বাতীব্যাস্ত করে তুলেছিল। নিরানন্দ দিনগুলো ওকে যেন পাগল করে তুলেছিল। সেইক্ষণে এই প্রস্তাব।
সনীতার সাথে শেষ দেখা স্ট্যাচু অফ লিবার্টির নিচে। সনীতা বলেছিল, তোমার সাথে আজকের দিন টা এতো সুন্দর কাটল সারা জীবন মনে থাকবে অনীক।
অনীক ও ভোলেনি।

ফেলে আসা দিনগুলোর কথা পড়ে ভাবা যাবে ভেবে অনীক উঠে পড়ল। টিকিট কাটতে হবে। ছন্নছাড়া জীবনের কোথায় কি পড়ে আছে সেগুলো গুছিয়ে নিতে হবে। সপ্তাহ খানেকের জন্য মনটাকে সজীব করতে পারলে মন্দ কি?

সনীতাকে জানিয়ে দিল সে আসছে Thanksgiving এর তিনদিন আগে।
সনীতার আনন্দ ধরে না।
কি কি খাবে বলও? উচ্ছ্বাসিত আনন্দে ভরপুর সনীতা।
ওর এই উচ্ছাস অনীক কে আগেও আনন্দ দিয়েছে।
তুমি যা রাঁধবে তাই খাবো। তাই হবে অম্মৃত। হাসতে হাসতে বলেছিল অনীক।

রাত এগারটায় অনীকের প্লেন ল্যান্ড করল ওকল্যান্ড এয়ারপোর্টে। গেট দিয়ে বাড়িয়ে আসতেই দেখতে পেলো সনীতা আর শফিক কে। সনীতা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল অনীককে।
শফিক হাতটা এগিয়ে দিল। চিরকালই ও একটু সলজ প্রকৃতির।
জানো, আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, যে তোমার সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে। তুমি দেখতে সেই রকমই আছো।
আচ্ছা, তোমরা কি এইখানে দাড়িয়ে সারা বছরের কথা শেষ করবে, নাকি বাসার জন্য কিছু রাখবে? শফিক কৃএিম রাগান্বিত স্বরে বলল।
সনীতা, শফিক থাকে ফ্রীমন্ট, Silicon Valley তে। শফিক ইঞ্জিনিয়ার। কাজকরে একটা নাম করা কোম্পানিতে। দুই মেয়ে। আন্তারা আর আনুসা।
কথায় কথায় শফিক বলল, এই রাস্তা গুলো বড় করেছে এই কয়েক বছর হোল। জনসংখ্যা বাড়ছে। অনেক নতুন নতুন কোম্পানি এসেছে এই দিকে। শফিকের চোখের সামনে গড়ে উঠা এই শহর।
তিরিশ মিনিটের পথ। এয়ারপোর্ট থেকে বাসা।

শফিক বায়ে টার্ন নিয়ে ওদের বাড়ীর রাস্তায় ঢুকল। পাশাপাশি দুই তালা বাড়ীর সাড়ি। নতুন তৈঁরি। রাতের আলোতে অপূর্ব লাগছিল। সনীতাদের বাড়ীর সামনে গোলাপের ঝার। সুন্দর করে ছাটা।
অনীকের খুব ভাল লাগল।
আমি প্রথম দেখাতেই তোমাদের এই বাড়ীটাকে ভালোবেসে ফেললাম, সনীতা। বলে হাতের ক্যরীওন টাকে টেনে উপরে নিয়ে এলো অনীক।
জানো, তুমি আসবে বলে আমার দুই মেয়ে বাড়ীটাকে আলোর মালা দিয়ে ডেকোরেট করেছে। দেখবে চলো তোমার রুমটা। আলো বাতির ঝারী দিয়ে ঝলমল। সনীতার খুশি যেন উপছে পড়ছে।
আন্তারা আর অনুসা এসে দাঁড়াল। হেসে বলল, আসতে কষ্ট হয়নি তো আঙ্কেল।
ঠিক ওর মায়ের ধারা। হাসি খসে পড়ছে।

যাও হাতমুখ দুয়ে এসো। আমি খাবার টেবিলে বাড়ছি। শুধু তাই না শফিক নিজে হাতে রান্না করেছে বিরয়ানী টা।
এতো রাতে খাবো? আমতা আমতা করে অনীক বলতে চাইল।
আপনার বান্ধবী কে তো আপনি চেনেন, কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না। আর আমার নিজের হাতের রান্না , একটু চেখে তো দেখতে হবে। বলে শফিক বিরিয়ানির পাত্র টা মাইক্রোওয়েভে দিল গরম করতে।

শফিককে অনেক কাছের বলে মনে হোল অনীকের। জীবনের ভাঙ্গা তরী বাইতে বাইতে হাঁপিয়ে উঠেছিল অনীক।
সেই ক্ষণে ওরা দুজন এলো। অনীকের দুমড়ে কুচকে যাওয়া মনটা আবার সজীব হয়ে উঠল ওদের সান্নিধ্যে।

কি ভাবছ?
তোমাদের কথা। কতদিন পরে দেখা। অথচ মনে হচ্ছে প্রতিদিন আমি তোমার সাথে কথা বলতাম। আবার যে তোমার দেখা পাবো, ভাবিনি।
আমিও ভাবিনি। তবে অনেক খুঁজেছি তোমাকে, আমি শফিক দুজনে। এই বলে সনীতা ভাতের প্লেট টা এগিয়ে দিল অনীকের দিকে।

খেতে খেতে শফিক বলল, সনীতা কি বলেছে আপনাকে Thanksgiving Party হবে আমার বন্ধু টিটুর বাসায়। খুব ভাল লাগবে আপনার। অনেক বন্ধুরা আসবে। পরিচয় হবে। বলে শফিক একটু থামল। তাকাল সনীতার দিকে।

সুন্দর পরিপাটি করা ঘরে ঘুম আসবে কিনা অনীক জানেনা। রাত অনেক। শুভরাত্রি বলে দরজাটা ভেজিয়ে দিল অনীক।

টুংটাং শব্দ। চোখ মেলে চাইল অনীক। নয়টা বাজে। উঠে পড়ল। প্যেরাকেট পাখির ব্রুব্রু আওয়াজ কানে এলো অনীকের। আন্তারা আর অনুসার প্রিয় পাখি। উড়ে উড়ে সবার হাতে, মাথায় বসে।

উঠে এলো অনীক। শফিক নাস্তা বানানোতে ব্যাস্ত। পরোটা, আলুভাজী, ডিম। অনীক ভাবছিল, সে শফিকের ঠিক উল্টো। শুধু ডিম টাই ভাজতে পারে। সবাই কে দিয়ে তোঁ সব কিছু হয় না। কনা তাকে কোনদিন কোন কিছু করতে দেইনি। অবশ্য তার কোন চেষ্টাও ছিল না।
সনীতা এলো, ফীকে হলদে টপস এর সাথে সাদা পাজামা। সকালে উঠে হাল্কা একটু প্রলেপ মুখে লাগানো। বেশ লাগছে দেখতে।
বাহিরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। পেঁজা পেঁজা নীল মেঘ হেসে খেলে ভেসে বেড়াচ্ছে। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল অনীক। এমন দিনে কেন জানি অনীকের মন টা অনেক দুরে হারিয়ে যায়। কে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে।

কি ভাবছ? বলে পাশে এসে দাঁড়াল সনীতা। মিষ্টি পারফীউমের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে।
ভাবছি এই কদিনের আনন্দের পর ফিরে গেলে কেমন লাগবে।
থেকে যাও এখানে, তুমি তোঁ হাত পা ঝারা।
হাসল অনীক।
শফিক বলে উঠলো, তোমাদের এই ছোট ছোট কথা বার্তা বাদ দিয়ে এসো নাস্তা খেতে। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
Monterey তে যেতে দুই ঘণ্টার বেশি লাগবে। তোমাদের যত কথা পরে আছে ওখানে সমুদ্রের ধারে বসে শেষ করো।
অনীকের মনে হোল শফিক উদার চেতা। সংকীর্ণতা তার কাছে ঘেঁসতে পারেনি, যেটা কি না অনীক দেখেছে অনেকের মাঝে যে খানে তার বাস সেইখানে।

সমুদ্রের পাড় ঘেঁসে আঁকা বাকা রাস্তা। নিচে বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বীচে। নীল আকাশ নেমে গেছে দুরে। মিশে গেছে সমুদ্রের সাথে।
শফিক গাড়ী থামাল। এখান থেকে নিচে নেমে গেছে চিকন রাস্তা। শেষ প্রান্তে বীচ।

আমি এখানে গাড়ীতে থাকবো, তোমরা নিচে নেমে যাও। বলে দরজা টা খুলে দিল শফিক।
কত ছবি সনীতা আর অনীক উঠিয়েছিল তার হিসাব নেই।
সনীতা বলেছিল অনীক কে, তোমার মতো একটা বন্ধু পেয়ে আমি যে কি খুশি তোমাকে বুঝাতে পারবো না অনীক।
তোমার কাছে প্রান খুলে আমি সব কথা বলে পারি।
সময় কোথা দিয়ে চলে গেলো অনীক জানে না। বন্ধন টা দৃঢ় হোল সনীতা, শফিকের সাথে। এ ভাঙবার নয়। হারিয়ে যাওয়া সনীতা শফিক কে নতুন করে ফিরে পেলো অনীক।

এয়ারপোর্টে বসে ভাবছিল অনীক, টিটু ভাই এর কথা। বিশাল বাড়ীতে Thanksgiving party. অনীকের মনে হয়নি ও ওদের একজন নয়। খাওয়া শেষে গানের পার্টি।
অনীক কে জোড় করে দাড় করিয়ে দিয়েছিল ডুয়েট গাইতে।
নিঃশব্দে অনীক হাসল।
ছোট ছোট ঘটনা, কত মধুর।
খাবার প্লেটে জোড় করে সনীতার উঠিয়ে দেওয়া মাছ। ব্যস্ততার মধ্যেও শফিকের সাত দিন ছুটি নেওয়া শুধু তার জন্য।
শফিকের আপ্যায়ন, সনীতার উচ্ছলতা।
সব কিছু কেন অনীকের মনে এসে দোলা দিল অনীক জানেনা।
অনীক জানে না, যা সে পেলো, তার কতোটুকু সে দিতে পারলো ওদের কে ।
হঠাৎ তার মনে কাব্যের সঞ্চার হোল।
সে লিখল সনীতাকে,
যেতে নাহি চাই, তবু চলে যেতে হয়।
এলাম,
তোমরা আমাকে বরন করলে মনপ্রান উজাড় করে।
আজ যাবার বেলায় শুধু তোমাদের কথাই মনে পড়ছে।
পাওয়ার খাতা আমার পূর্ণ।
শুধু বলি কি, মনে রেখো আমাকে।
বিদায়।

Continue Reading

রাশিয়ার পথে ৩

কেন জানি ইদানিং দুরে এলে একটু ভয় ভীতি মনের মধ্যে থেকে যায়। যদি কিছু হয়। শারীরিক ভাবে । এটা আবার আমাকে মানসিক ভাবে ভাবিয়ে তোলে। মনের মাঝে ঐ ভাবনা টাকে দূর করার চেষ্টা করে শুয়ে পড়লাম।
ক্লান্ত। এতটা পথ পাড়িয়ে এসেছি।
নাহ, প্রথম প্রহরে ঘুম এলো না। যখন সে এলো, তখনি অ্যালার্ম টা বেজে উঠলো। অগত্যা আড়া মোড়া করে উঠে পড়লাম।
তৈরী হয়ে বাহিরে আসে দেখলাম কেউ আসেনি। আমি একটু আগেই আসে পড়েছি। সুন্দর ঝকঝকে আলো। মাথার উপরের কাচ দিয়ে এসে পড়েছে বিশাল বারান্দাতে। কাউন্টারে দুজন সুন্দরী মহিলা। ব্যাস্ত।
আমাদের গ্রুপের একজন, সাথে অর্ধাঙ্গিনী অথবা বান্ধবী ব্রেকফাস্ট রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করল আমাকে, যাবে?
না, অপেক্ষা করছি আমার সাথের অন্যদের জন্য। ধন্যবাদ।
ওরা চলে গেলো।
জীবু, আন্না আপা, দোজা ভাই এলো।
জানালার কাছের টেবিল টা বেছে নিলাম। বাহিরে ঝলমলে আকাশ। খুরশেদ ভাই, ভাবী এসে যোগ দিলো।
থরে থরে সাজানো খাবার। কোন টা থুয়ে কোন টা নেবো।
গেলীনা বলেছে ঠিক নয়টায় চত্বরে থাকতে। সাড়ে নয়টায় বাস ছেড়ে যাবে।
নাস্তা শেষ করে বাহিরে আসতেই দেখলাম প্রায় সবাই এসে গেছে।

মস্কোতে এসেছি অপেরা দেখবো না, তাতো হতে পাড়ে না। বুঝি আর না বুঝি। কথাটা পারতেই সবাই রাজি।
কাউন্টারে আসতেই অল্প বয়স্ক মেয়েটা এগিয়ে এলো। নাম ক্রিস্টিনা। কথার ফাকে ফাকে তার হাসি দোজা ভাই লক্ষ করেছিল। পরে বলেছিল, ও সুন্দরী তবে দাতের বাধন ভাল নয়।
হাজার হলেও উনি দাঁত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।

Bolshoi Theatre এ আমরা টিকেট পেলাম না। শুনেছি এই বিখ্যাত theatre এর নাম। এর বিবরণ আসবে পরে। টিকেট পেলাম তারই পাশে নতুন গড়ে উঠা আর একটি থিয়েটার। চলছে ওথেলো। আগামীকাল সন্ধ্যার টিকিট পাওয়া গেলো।
গেলীনা ডাক দিলো সবাইকে। আমরা ওকে ঘিরে দাঁড়ালাম।

প্রথম দিনের তালিকায় আছে The Kremlin, Armory Museum, Arbat Center. বাস এসে দাড়িয়ে আছে গেটের সামনে। একে একে আমরা সবাই উঠে বসলাম। গেলীনা পরিচয় করিয়ে দিল মারিয়ার সাথে। আজকের গাইড সে।
গেলীনার পরিচয় না দিলেই নয়। গাইডই তার এক মাত্র পেশা নয়। মস্কো Universityর ইতিহাসের প্রফেসর সে । University বন্ধ কালীন সে এই কাজ টা করে। অনেক দিন ধরে আছে Gate1 ট্রাভেলের সাথে। অবাক হলাম।

ছোট পথ ধরে বাসটা এসে পড়ল বড় রাস্তায়। দুই পাশে বিশাল অট্টালিকার সারি। একটু এগিয়ে যেতেই ডান দিকে কার্ল মার্ক্সের বিরাট মূর্তি।এখন আর কার্ল মার্ক্স নিয়ে কেউ আলোচনা করে না।
সকালে রাস্তায় ভিড়। আধা ঘণ্টার মাঝে আমরা এসে পৌছালাম।
The Kremlin.
The symbolic heart and soul of Russia. চারিদিকে বিশাল লাল দেওয়াল। Czars এর বাসস্থান ছিল। এখন রাশান প্রেসিডেন্টের অফিসিয়াল রেসিড্যান্স এখানে । অনেক অনেক লোকের আগমন। কোথাও কোন পুলিশের আনাগোনা নেই। মারিয়াকে অনুসরণ করে Kutafy Tower দিয়ে আমরা এসে পৌছালাম Kremlin এর পশ্চিম দালানের দিকে। র‍্যাম্প এর শেষ মাথায় Alexander Garden.
অপূর্ব। দোজা ভাই ছবির পর ছবি তুলে চলেছে। আমিও কখনো সেলফী কখন অন্যকে দিয়ে সবাই মিলে ছবি উঠাচ্ছী। স্মৃতির মাঝে ধরে রাখা।
Kremlin wall কে পাশে রেখে একটু এগিয়ে গেলে Trinity Tower. লাল দালান। এর নাম হয়েছিল the Trinity Monastery of St.Sergius থেকে। এই Tower দিয়ে Tsar এর স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েরা আসা যাওয়া করতো।

Trinity Tower

ছবি তোলাতে ব্যস্থ থাকায় মারিয়ার উচু লাঠিতে বাঁধা গেট ১ আমি দেখতে পেলাম না। ওদেরকে হারালে আমার সর্বনাশ। গলা শুকিয়ে এলো।
দুর থেকে জীবুর ডাক শুনলাম, ও ডাকছে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
একটু সামনে এগিয়ে গেলে Annunciation Cathedral. চোখ জুড়ানো Artistic View, ভিতরের ডিজাইন না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। কথিত আছে এটা পেইন্ট করেছিল মঙ্ক Feodosius. ১৪ সেঞ্চুরি তে এটাই ছিল সব চেয়ে মস্কোর Important Church.

Annunciation Cathedral

Annunciation Cathedral কে পিছনে ফেলে আমরা এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম Ivan the Great Bell Tower, ডিজাইন করেছিল Marco Bon Friazin. অনেক পুরান ইতিহাস জড়িত এই Kremlin এ। বিস্ময়। দেখার শেষ নেই।

সামনে বিরাট Great Kremlin Palace. সাদা হলুদ রঙ। Tsar Nicholas 1 এর সময় রয়েল ফ্যামিলি St.Petersburg থেকে মস্কো আসলে এখানে থাকতো। সেই সময় রাশিয়া র রাজধানী ছিল St.Petersburg।
আগের থেকেই আমাদের টিকিট কাঁটা ছিল। মারিয়া আর গেলীনা কে অনুসরন করে আমরা ঢুকলাম প্রথম তালায়। ফটো উঠানো নিষেধ নয় তবে ফ্ল্যাশ জ্বলতে পারবে না। প্রথম তালা রয়েল ফ্যামিলির luxurious private room.
উপর তালায় সেরীমনিয়াল হল। প্রায় আধা ঘণ্টা লেগে গেলো বাহিরে আসতে।

এর পর যাবো State Armoury দেখতে। মারিয়া State Armouryএর উপর একটা ছোট খাটো লেকচার দিল। এই State Armoury তে দেখতে পাবে Russian Prince এবং tsar এর বিশাল পরিমাণ ধন সম্পদ।

ভিতরে এসে দেখতে পেলাম হরেক রকমের জুয়েলারি, বিভিন্ন ধরেনের অস্ত্র, রয়েল ক্রাউন্স, আর গাউন। আরও দেখলাম বিখ্যাত Jeweled Faberge Eggs. অতুলনীয়।
চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

অপূর্ব Alexander Garden এর ভিতর দিয়ে হাটতে হাটতে মনে হোল একটু ক্লান্ত। কিন্তু না এখনও তোঁ দেখার বাকি রেড স্কয়ার। ছবিতেই দেখেছি আজ দেখবো নিজের চোখে।
রেড স্কয়ার। বিশাল চত্বর।

Red Square

St.Basil Cathedral

পশ্চিম দিকে St.Basil Cathedral. আগে এই রেড স্কয়ারে প্রত্যেক বছর মে ডে তে প্যারেড হতো। এখন এখানে কালচারাল প্রোগ্রাম হয়।
এই স্কয়ারে লেনিনের কবর। ভিতরে যাওয়া হলনা। বিরাট লাইন। অগত্যা মারিয়া বলল, চলো কিছু খাবে।
তোমাদের কে নিয়ে যাব রাশিয়ার সব চেয়ে বড় মল। নাম GUM.

Gum Department Store

এবার আমাদের মত আমরা। গেলীনার সাথে মিলবো এক ঘণ্টা পরে। সবাই ক্ষুধার্ত। Food Court এ এসে বসলাম। আন্না আপা, জীবু মিলে বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে এলো। আমি দেখছিলাম মলে লোকের আনাগোনা। আমেরিকান মলের সাথে পার্থক্য architecturaly. দামের তুলনায় আমরা এখনো সর্ব নিম্নে।

খাওয়া শেষে জীবু আন্না আপা কিছু কিনবে বলে স্টোর গুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।

প্রায় এক হাজারের উপর দোকান। ফার থেকে আরম্ভ করে সিল্ক সব পাওয়া যায়।

আছে Benetton, Estee Lauder, Christian Dior আরও অন্যান্য Western Firm.

আছে Western style এ ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট।

ঘণ্টা কেটে গেলো। ফিরে এলাম গেলীনা, মারিয়ার কাছে।  ফিরে যাবো হোটেলে।

সন্ধ্যার পরে আসবো রাতের রেড স্কয়ার দেখতে।

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প (১৫ পর্ব)

                                     ১৫ পর্ব

     সানন্দা যখন আনন্দকে নিয়ে বাসায় এলো তখন রাত দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। খাবার টেবিল সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল। বলল,” তুমি কাপড় জামা ছেড়ে গোসল করে এসো আমি খাবার গুলো গরমে দেই।”

“রাত অনেক হয়েছে, তুমি এসো, আমি সব ব্যাবস্থা করে নেবো।” বলল আনন্দ। যদিও জানে সানন্দা যাবেনা। সানন্দা একবার তাকাল আনন্দের দিকে, কিছু বলল না। কথা বলার সাথী বলতে তো সেই।

গোসল সেরে নেমে এলো আনন্দ। শরীর চলছেনা। অথচ এই কদিন চর্কির মত ঘুরেছে। ক্লান্তি আসেনি। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দুজনকে হারিয়ে। নিজেকেও হারাতে চলেছিল শুধু ছক্কার চাল ঠিক থাকাতে এই যাত্রা বেচে গেছে।

“কাল অফিসে যেতেই হবে? না গেলেই নয়?” জিজ্ঞাসা করলো সানন্দা।

“ওরা সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। সমস্ত ঘটনার ব্যাখ্যা তো আমাকেই করতে হবে।”

সানন্দা আর কথা বাড়াল না।

খাওয়া শেষে সমস্ত কিছু গুছিয়ে রেখে বলল,” আমি আসি, তুমি বিশ্রাম নাও।”

গাড়ীটা চোখের আড়াল হলে দরজাটা বন্ধ করে দিলো আনন্দ।

সকাল দশটা। আনন্দ গাড়ীটা পার্ক করতেই এটেনডেন্ট এগিয়ে এলো। আনন্দের হাতটা চেপে ধরে বলল সে খুবই দুঃখিত। আনন্দ ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেল এলিভেটারের দিকে। দরজা খুলতেই দেখল ডেভিড, লরেন্স জেনীফার মাইক দাঁড়িয়ে। মাইক এসে আনন্দকে জড়িয়ে ধরল। সবাই দাঁড়াল ওর পাশে ।

ডেভিড বলল,” This is a tremendous blow for this organization. কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদেরকে সামনে চলতে হবে। আমরা লাকি তুমি এখনও আমাদের মধ্যে আছো।”

সবাই এসে বসলো কনফারেন্স রুমে। আনন্দ একে একে জানাল সব ঘটনা। বলল সে স্টিভের সাথে আলাপ করবে আইন গত ভাবে আমাদের করনীয় কি।

জেনীফার উঠে আনন্দের কাছে এলো। বলল,”এবার তুমি কিছুদিনের জন্য বাহির থেকে ঘুরে এসো। মনটা ভাল লাগবে।”

আনন্দ সাই দিলো। বলল,” দেশে যাবো ভাবছি।”

“যাও, তবে যাওয়ার আগে একটা কাজ করতে হবে, আমি একা করতে চাইনা।” বলল ডেভিড।

কি?

 “আগামীকাল একজনের ইন্টারভীউ আছে। এমিলির পজিশনটার জন্য। তুমি ইন্টারভীউ নেবে। আমি থাকব। তবে সব ভার তোমার উপর। ঠিক আছে?”

হা, বলে আনন্দ বলল সে উপরে স্টিভের সাথে দেখা করতে যাবে। উঠে পড়ল।

জনের মা কল করেছিল আনন্দ কে। বলেছিল একবার আসতে ওদের বাসাতে। ফিলাডেলফীয়ায়।  আনন্দ না করেনি। বলেছিল দুই একদিনের মধ্যেই আসবে।

সব কাজ শেষে আনন্দ বাসাতে ফিরবে ভেবে গাড়ীটা স্টার্ট দিলো। সানন্দা বলেছিল কাজ শেষে ওর সাথে চা খেতে। তা আর হলনা। গাড়ীটা ঘোরালো সে এমিলিদের বাসার দিকে।

এমিলির মা বাবা আনন্দকে দেখে চোখের জল বেঁধে রাখতে পারেনি। আনন্দকে দেখিয়ে ছিল এমিলির রুমটা। সুন্দর করে সাজানো ঘর। এক কোণে একটা পেন্টিং। উপুড় করা। আনন্দ উঠিয়ে নিলো। তাকাল। আনন্দের অবয়ব।  এমিলির  আঁকা। ফিরতে রাত হোল।

আজ আনন্দ হাতে অনেক সময় নিয়ে অফিসে এসেছিল। লরেন্সের সাথে বসে কফিটা শেষ করার আগেই ডেভিড এলো। সামান্তা খবর দিলো যে ছেলেটার ইন্টারভীউ নেওয়া হবে সে বাহিরে বসে আছে।

    আনন্দ চশমার কাচটা মুছে নিয়ে ছেলেটার জীবনবৃতান্ত টা আর একবার পড়ল। রাশেদুল ইসলাম। নামটা পরিচিত মনে হোল। সামান্তা কে বলল রাশেদকে ডাকতে। দরজা খুলে ভিতরে এলো রাশেদ। হ্যান্ডসাম, টোন বড

কোঁকড়া চুল, শ্যামলা। আনন্দ তাকিয়ে রইল ওর দিকে। বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে একটা শব্দ,” তুমি?”

“চেনও নাকি?” জিজ্ঞাসা করলো ডেভিড।

“চিনি।”

রাশেদ কে বসতে বলল। রাশেদ আনন্দের দিকে চেয়ে রইল।

আনন্দও তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। শেষ দেখে ছিল বারো বছর আগে ওর বাবার কবরের পাশে। তারিকুল ইসলাম।

তারেকের সাথে আনন্দের দেখা হয়ে ছিল দেশের রাজধানীর এক এলিট কলেজে। আনন্দ এসেছিল এক মফস্বল শহর থেকে। তারেকের জন্ম রাজধানীতে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তারেক এসে বাসা বেঁধে ছিল আনন্দের রুমে। ঠোটে হাসি লেগেই আছে। প্রাণবন্ত। বলত,” চল, মুভি দেখে আসি।”

আনন্দের যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যেতে চাইত না, পকেট শূন্য। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অনেক ভেবে চিন্তে চলতে হয় এই রাজধানীর বুকে।

পাশ করে দুজন চলে গিয়েছিল দু দিকে। আনন্দ আর্কিটেকচার কলেজে ভর্তি হলো। তারেক ইংলিশে মেজর নিয়ে ইউনিভারসিটিতে এলো।  দেখা সাক্ষাত কমে গেলো । আর্কিটেক্ট হয়ে আনন্দ চলে এলো আমেরিকাতে স্কলারশিপ নিয়ে। সেতো অনেক দিনের কথা।

 এক সন্ধ্যায় আনন্দ কণাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হল ঘরের লাউঞ্চে। এসেছিল বাংলা শিল্পীদের গান শুনতে। পিঠে হাতের স্পর্শে তাকাল পিছনে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল। তারেক?

“কিরে ,অবাক হয়ে গেলি? অনেক খুঁজেছি। আজ পেলাম।’”

ভেঙে যাওয়া বন্ধন আবারো জোড়া লাগলো। সময় পেলেই চলে আসতো আনন্দের বাসায়। কণা খুব পছন্দ করেছিল ওকে।

“বিয়ে শাদী করবি? মেয়ে আছে।” জিজ্ঞাসা করেছিল আনন্দ

“না, মা বাবার পছন্দ এক মেয়ে আছে, তার সাথে হবে। সামনের বছরে যাবো।”

এক শীতে ঝরা সন্ধ্যায় নিয়ে এলো সাকীলাকে। কণা যেয়ে সাজিয়ে রেখেছিল ওদের ঘর। দিন শেষে মাস, মাস শেষে বছর পেড়িয়ে গেল। এলো ওদের ঘরে এক ছেলে। রাশেদ। দুরন্ত। আনন্দের বাসায় এলে জিনিস পত্র ভেঙ্গে তছনছ করত। কনা কিছু বলত না।

প্রায় তারেক কমপ্লেন করত পিঠে ব্যাথা, বুকে ব্যাথা। বমি বমি ভাব। দুর্বল লাগে।

খাওয়ার রুচি কমতে থাকল, সেই সাথে ওজন। ওর হাসি হাসি মুখটা ব্যাথায় কুচকিয়ে থাকত।

আনন্দ বলেছিল ডাক্তার দেখাতে। যায়নি। সাকীলাকেও বলেছিল। সেও গরজ করেনি।

এক রাতে  ব্যাথায় টিকতে না পেরে আনন্দকে ফোন করেছিল। আনন্দ নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। সারারাত ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলল। সকালে আনন্দ কে ডাক্তার ডেকে নিয়ে গেল পাশের রুমে। বলল,” He has Multiple Myeloma. It is  form of bone marrow cancer. Stage 3”. আনন্দ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে  ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলো তাকে ব্যাখ্যা করতে। চিকিৎসা আছে কি না। বাঁচার সম্ভবনা কতটুকু।

খুব একটা সময় হাতে নেই, বলল সে। “ It’s a serious incurable malignancy.”

তাড়াতাড়ী চিকিৎসা শুরু করতে হবে। বলল সে।

ডাক্তার ফিরে এলো তারেকের রুমে। বলল সবকিছু। তারেক আনন্দের দিকে তাকিয়ে থাকল, চোখের কোণে জল। সাকীলার কোন ভাবান্তর নেই।

চিকিৎসা শুরু। Chemoর ভয়াবহতা সহ্য করতে পারলো না তারেক। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে আনন্দ এসে বসে থাকে তারেকের পাশে। গল্প করতো  ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ওর হাসিটা ম্লান হয়ে এলো। রক্ত শূন্যতা। মুখটা কুঁচকানো কাগজের মত।  বলে,” আর কতদিন আমি বাঁচব রে আনন্দ, সত্যি করে বল।”

“নতুন নতুন অনেক চিকিৎসা বের হয়েছে। চিন্তা করিস না।” বলে বাথরুমে যাবার ছল করে বাহিরে যেয়ে কাঁদত।

দিনে দিনে খাওয়ার রুচি চলে যেতে থাকলো। গায়ের রঙ পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। বলে,” আমি আর পারছি নারে আনন্দ।“

মাঝে মাঝে আনন্দ এসে সাকীলাকে কোথাও না দেখে  জিজ্ঞাসা করতো। তারেক বলত “ও বাহিরে গেছে দরকারে”।  একদিন তারেক বলল ,” জানিস আনন্দ আমার খুব ইয়োলোস্টোন পার্ক টা দেখেতে ইচ্ছা করে। নিয়ে যেতে পারবি?”

“পারবো”। বলে সব ব্যাবস্থা করল আনন্দ। শেষ সময়ে সাকীলা বলল সে যেতে পারবেনা। বলল “তোমরা ঘুরে এসো। আমি এদিকটা সামলাব।“

যথা রীতি ওরা বেরিয়ে পরেছিল। আনন্দ দেখেছিল তারেকের হাসৌজ্জল মুখ। হুইল চেয়ারে বসে বসে দেখল তার সাধের ইয়োলোস্টোন পার্ক। মাঝে মাঝে মাথাটা এলিয়ে দিতো । আনন্দ ওকে নিয়ে এসে দাঁড়াত গাছের ছায়ায়।

 চার দিন আনন্দ তারেককে বাচ্চার মতো আগলিয়ে রেখেছিল। ফিরে যাওয়ার দিন তারেক একটা এনভেলপ আনন্দকে দিয়ে বলল ,” কথা দে, এটা খুলবি আমি চলে যাওয়ার একমাস পরে। কথা দে? ”

আনন্দ কথা দিয়েছিল।

ফিরে আসার পরে তারেকের শরীর আরও খারাপের দিকে গেলো। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মরফিনে ব্যাথা যায়না। হাঁসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোল। ডাক্তার আনন্দ আর সাকীলাকে পাশে ডেকে নিয়ে বলল,” এবার ওকে যেতে দিতে হবে।“

দুদিন পরে সবকিছুর মায়া কাটিয়ে তারেক চলে গেল।

দিন যেয়ে মাস এলো। এক পরন্ত বিকেলে আনন্দ কড়া নাড়াল সাকীলার বাসায়। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক আমেরিকান ভদ্রলোক। আনন্দ ভুল বাড়িতে এসেছে ভেবে দুঃখিত বলে চলে যাচ্ছিল। মহিলার ডাক শুনে ফিরে তাকাল। সাকীলা। প্যান্ট সার্ট পড়ে দাঁড়ান।

ভিতরে আসতে বলতেই আনন্দ বলল, আজ নয় আর একদিন আসবো।

ফিরে আসতে আসতে মনে হোল সেই চিঠিটার কথা। বাসায় এসে খুলল চিঠিটা। দুকলম লেখা।

“I was cheated on”.

আনন্দ ? ডাক শুনে বাস্তবে ফিরে এলো।

“প্রশ্ন করো”? বলল ডেভিড

তাকিয়ে রইল আনন্দ রাশেদের দিকে।

 “না, আমি না। I have a soft corner for him. ঠিক জাজমেন্ট করতে পারব না। হয়তোবা পক্ষপাতিত্ব করা হবে।  তুমিই ওর ইনটা্রভিউ নেও।“ বলে আনন্দ দরজার দিকে পা বাড়াল। রাশেদ তাকিয়ে থাকলো ওর চলার দিকে।

ক্রমশ

Continue Reading