হাই স্পীড ট্রেনে St.Petersburg পৌছাতে চার ঘণ্টা লেগে গেলো। বিকেল হয়ে এলো। গেলীনা বলেছে কারো লাগেজ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, পোর্টার রা বাসে উঠিয়ে দেবে। সূর্যের এলো নিয়ে বাড়িয়ে ছিলাম মস্কো থেকে, এখানে বৃষ্টি। সেই সাথে বাতাস।
এখানে একটু বলে রাখি St.Petersburg এক সময় ছিল রাশান এম্পায়ার এর রাজধানী। এটা তৈরী হয়েছিল ১৭০৩ সালে। অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে এই শহরের উপর দিয়ে। St.Petersburg রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। নেভা নদীর পাশে অবস্তীত।
*হোটেলে যাওয়ার আগে এলাম রেস্টুরেন্টে নৈশ ভোজের জন্য। Marlinsky Theater কাছে। আসার পথে দেখলাম এই শহরেরে চোখ জুড়ানো দৃশ্য। আলোয় আলোকিত শহর। বৃষ্টির ছিটায় এক অপূর্ব রুপ ধারণ করেছে।
*ডিনার শেষে রাত নয়টায় এলাম Ambassador Hotel.
পরদিন ভোরে আমাদের St.Petersburg দেখার যাত্রা শুরু। সকালে আমরা ছয় জন এসে মিলিত হলাম বিরাট ডাইনিং *রুমে সকালের নাস্তার জন্য। সাত তালার উপরে ডাইনিং রুম। জানালার ধারে আমাদের টেবিল। রৌদে ঝলমল দিন।
বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের সমারহ। কোণটা থেকে কোণটা নেবো।
গেলীনা বলে দেয়েছে নয়টার মধ্যে নিচে থাকতে হবে।
সেই মত আমরা খাওয়া শেষে নেমে এলাম। দুই একজন করে আমাদের গ্রুপ এসে জড়ো হোল।
গেলীনা তার স্বভাব মত বলতে থাকলো, পিটার দ্যা গ্রেট ইউরোপের সবচেয়ে বিখ্যাত architects, craftsmen, এবং artists দিয়ে এই সিটি তৈরী করেছিল। প্রায় ১০০ Island আছে, একটার সাথে একটার সংযোগ প্রায় ৬০০ ব্রিজ দিয়ে। এই সিটি কে বলা হয় Venice of the North.
*আমাদের সারা দিনের ট্যুর শুরু হোল St.Issac’s Square থেকে। ঠিক Square মাঝে এক বিরাট মনুমেন্ট ঘোড়ায় চড়ে দাঁড়ানো Nicolas I এর মূর্তি, তৈরী হয়ে ছিল ১৮৫৬ থকে ১৮৫৯ এর মধ্যে।
বাস ঘুরিয়ে নিয়ে এলো St Peter and paul Cathedral এ। * 18th century তে তৈরী এই Cathedral বলা হতো সেই সময়কার উচ্চ বিল্ডিং।
এই Cathedral এর ভিতরে আছে Peter the Great এর টম্ব। আরও আছে শেষ Russian Emperor Nicholas II এর কবর যাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল ১৯১৮ সালে Ekaterinburg এ।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা শব্দ গুলো আজ চোখের সামনে দেখছি, সত্যিই বিস্ময়। কোন দিন ভাবিনি, এখানে আসবো। দেখবো।
এরপর আমরা এলাম The mariinsky Palace এ। এটা St.Petersburg এর এক Historic Centre. ঠিক Isaac’s Square উল্টো দিকে। বিশাল কারুকার্য খচিত রুম । রেড রুম, Stair Case না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না কি অপূর্ব ভাবে তৈরী।
** এরপর আমাদের কে নেয়ে এলো Palace Square এ। এই Square ১৯০৫ সালে Tsarist troops বন্দুক চালিয়ে ছিল অস্ত্রহীন strikers দের বিরুদ্ধে। এটাকে বলা হয় ‘Bloody Sunday’,
ঠিক বিশাল চত্তরের মাঝে বিরাট কলাম, গ্রানাইটের তৈরী। নাম Alexander Column
**
আজ এই বিশাল চত্তরে শান্তিতে বিরাজমান। টুরিস্ট আসে, এই বিশাল চত্বর দেখে ইতিহাস ঘাটে। স্মরণ করে সেই ফ্বেলে আসা ঘটনার কথা।
Alexander Column symbolize করে নেপলীয়ানের সাথে যুদ্ধে রাশিয়ার জয়। এই স্তম্ভের উপরে এক এঞ্জেলের ছবি যা দেখতে Emperor Alexander I. এর মতো।
সব কিছু দেখে শেষ করতে বিকেল হয়ে এলো। বাস এগোতে থাকলো Nevsky Prospect ধরে। এটা মেন Avenue চারিদিকে সুন্দর সুন্দর ডেকরেটেড বিল্ডিং, আর সুন্দর করে সাজানো ব্রিজ। আজকের মতো বেড়ানো শেষ।
রাতে গেলাম আমরা ছয়জন গেলাম ফোক ড্যান্স দেখতে।
Hermitage Museum। বাহিরের অপূর্বতা আর ভিতরে অনেক অনেক আর্ট, নাম করা আর্টিস্টের আঁকা। যেমন মাইকেল এঞ্জেলো, পিকাসো, দ্য ভেংচি, রাফায়েল, আরও অনেকের আঁকা।
এটা Catherine the Great এর নিজেস্ব গ্যালারি।
এই খানে ছিল ওদের Winter Palace.
দেখা শেষে বেড়িয়ে এলাম। আবার আমরা আমাদের মতো।
আজ শেষ দিন। গেলাম Peterhof দেখতে। অসম্ভভ সুন্দর Summer Palace of Peter the Great এর। সুন্দর করে ছাটা লন, ঝর্না বহিছে, দেখা যায় Gulf of Finland.
ছবির পর ছবি উঠিয়ে চলেছে দোজা ভাই।
সব বর্ণনা ঠিক মত হোল কিনা জানিনা। এ শুধু চোখে দেখার।
ঠক ঠক ঠক শব্দ শুনে ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো। একটু সময় নিলো ভাবতে শব্দ টা কোথা থেকে আসছে। দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে। পাশের থেকে হাত ঘড়ি তে তাকিয়ে দেখি সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। নাস্তা করতে যাওয়ার কোথা।
দরজা খুলে দেখি দোজা ভাই।
“আমরা তো তোমার জন্য চিন্তিত। কি ব্যাপার?”
“ পনের মিনিট সময় দিন, আপনারা টেবিল নিয়ে বসেন, আমি আসছি”। এই বলে বাথরুমে যেয়ে গরম পানিটা ছেড়ে দিলাম।
প্রস্তুত হয়ে আসতেই ওরা ওদের উদ্বিগ্নতার কথা জানালো।
“সত্যিই তুমি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিলে। সবসময় তুমি আসো প্রথমে আর আজ কিনা তুমি নেই”। বললও আন্না আপা।
ব্রেকফাস্ট শেষে আমরা এলাম লবি তে ।
আজ দেখতে যাবো Tretyakovsky State Gallery. পৃথিবীর বিখ্যাত আর্ট মিউজিয়ামের মধ্যে এটা একটা। এই মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা Pavel Tretyakov.
আমরা সবাই এসে মিলিত হলাম হোটেলের বারান্দায়। গেলীনা এই গ্যালারীর উপর অল্প বিস্তর বক্তব্য রাখল। ওর বক্তব্যে জানতে পারলাম, এই গ্যালারীতে আছে কম পক্ষে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পেইন্টিং, দশতম চেঞ্চুরী থেকে আরম্ভ করে উনিশতম সেঞ্চুরি পর্যন্ত আঁকা এই পেইন্টিং গুলো। বিখ্যাত আর্টিস্টরা হচ্ছে, Brullov, Kiprensky, Karavak, Fedotov, Repin আরও অনেকে।
বাস আমাদের নামিয়ে দিলো বেশ দুরে। খুব সুন্দর আবহাওয়া। হাটতে হাটতে আমরা এসে পৌছালাম Tretyakovsky State Galleryর কাছে।
মারিয়া আজও আছে আমাদের সাথে। হাতের লাঠিটা উঁচু করে ধরে বলল, আমাদের ট্যুর আরম্ভ হবে দ্বিতীয় তালা থেকে।
সেখানে আছে ১৮ তম সেঞ্চুরিতে আঁকা ছবি গুলো।
একের পর এক ছবি গুলো দেখা শেষ করে যখন বাহিরে এলাম তখন মুষল ধারে বৃষ্টি। এসে ছিলাম রোদ মাথায় করে এখন ভিজতে ভিজতে যেতে হবে বাসের কাছে।
অঝোরে ঝরছে। আমি খুরশেদ ভাই, ভাবী আর জীবু। অন্যান্যরা বৃষ্টি মাথায় বেড়িয়ে গেছে । ভাবীর ঠাণ্ডা লেগেছে, কাজেই বৃষ্টি মাথায় বের হওয়া যাবেনা। অগত্যা খুরশেদ ভাই গেলো ছাতার খোজে।
ঠিক যখন উনি ছাতা কিনে ফিরে এলো তখনি বাসের ড্রাইভার ছাতা নিয়ে হাজির।
যেয়ে শুনলাম ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
লাঞ্চের সময়। এটা আমাদের তালিকার মধ্যে। নির্ধারিত সময়ে পৌছাতে হবে। একটু দেরী হয়ে গেলো বৃষ্টির জন্য। তাতে খুব একটা কিছু এলো গেলো না।
ওরা অপেক্ষা করছিল। পুরো রেস্টুরেন্টে শুধু আমাদের দল।
যেখানেই যাচ্ছি আমরা ছয়জন এক সাথে বসি। এবার আমাদের সাথে যোগ দিল অন্য একটা কাপল। থাকে লসএঞ্জেলীস আর হংকং মিলিয়ে। প্রাথমিক আবাস ছিল হংকং। পরে লসএঞ্জেলীসে এসেছিল চাকরি নিয়ে। দুজনেই রিটায়ার।
আমাদের জন্য Sea Foodর ব্যবস্থা। খাবার মন্দ নয়। ভ্রমনে বেড়িয়ে থাকা খাওয়া নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না।
খওয়া শেষ।
এবার আমাদের গন্তব্য স্থান মস্কোর পাতাল রেলপথ। প্রথমে ভেবেছেলাম পাতাল রেলপথ, এমন কি আর হবে। অনেক দেশের পাতাল রেলপথ দেখেছি। শেষ দেখেছিলাম চায়নাতে। মুগ্ধ হয়েছিলাম। আরও বেশি মুগ্ধ হওয়া যে বাকি ছিল তা জানা ছিল না।
অনেক জাগায় ভ্রমন করেছি, দেখেছি অনেক পাতাল রেলপথ। কিন্তু এতো অভিভূত হয়নি কখন।
স্টালিনের vision ছিল, মস্কোর মেট্রো কে “People Palaces” করবে, সেই চিন্তা করে ১৯৩৫ শোনে মাত্র ১৩ টা স্টেশন দিয়ে তৈরী হয় এই মেট্রো। আজ ১৮০ টা স্টেশন। আরও হচ্ছে। প্রতিদিন কমপক্ষে নয় মিলিয়ন যাত্রী যাতায়েত করে।
প্রত্যেকটা স্টেশন Unique ভাবে ডিজাইন করা। রাশান ইতিহাসের সাথে জড়িত।
মারবেল দিয়ে তৈরী, স্যান্ডেলিয়ার ঝুলছে। বিভিন্ন জায়গায় Mosaic arts, এক কথায় অপূর্ব।
Mayakovskaya Station যুদ্ধের সময় বম্ব সেলটার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, হাসপাতাল এবং Supreme Command Headquarter ছিল।
Komsomolskay staion দেখলে মনে হবে এটা স্টেশন নয়, এ যেন গ্র্যান্ড বলরুম।
এই ভাবে তৈরী বিভিন্ন স্টেশন গুলো।
দেখতে দেখতে দুই ঘণ্টা কেটে গেলো। ফিরে এলাম হোটেলে। তখন বাজে পাঁচটা।
আমরা যাবো Othelo অপেরা দেখতে সন্ধ্যা সাত টায়।
মস্কো বেড়ানো শেষ। কাল যাত্রা করবো St. Petarsburg এর দিকে।
কেন জানি ইদানিং দুরে এলে একটু ভয় ভীতি মনের মধ্যে থেকে যায়। যদি কিছু হয়। শারীরিক ভাবে । এটা আবার আমাকে মানসিক ভাবে ভাবিয়ে তোলে। মনের মাঝে ঐ ভাবনা টাকে দূর করার চেষ্টা করে শুয়ে পড়লাম।
ক্লান্ত। এতটা পথ পাড়িয়ে এসেছি।
নাহ, প্রথম প্রহরে ঘুম এলো না। যখন সে এলো, তখনি অ্যালার্ম টা বেজে উঠলো। অগত্যা আড়া মোড়া করে উঠে পড়লাম।
তৈরী হয়ে বাহিরে আসে দেখলাম কেউ আসেনি। আমি একটু আগেই আসে পড়েছি। সুন্দর ঝকঝকে আলো। মাথার উপরের কাচ দিয়ে এসে পড়েছে বিশাল বারান্দাতে। কাউন্টারে দুজন সুন্দরী মহিলা। ব্যাস্ত।
আমাদের গ্রুপের একজন, সাথে অর্ধাঙ্গিনী অথবা বান্ধবী ব্রেকফাস্ট রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করল আমাকে, যাবে?
না, অপেক্ষা করছি আমার সাথের অন্যদের জন্য। ধন্যবাদ।
ওরা চলে গেলো।
জীবু, আন্না আপা, দোজা ভাই এলো।
জানালার কাছের টেবিল টা বেছে নিলাম। বাহিরে ঝলমলে আকাশ। খুরশেদ ভাই, ভাবী এসে যোগ দিলো।
থরে থরে সাজানো খাবার। কোন টা থুয়ে কোন টা নেবো।
গেলীনা বলেছে ঠিক নয়টায় চত্বরে থাকতে। সাড়ে নয়টায় বাস ছেড়ে যাবে।
নাস্তা শেষ করে বাহিরে আসতেই দেখলাম প্রায় সবাই এসে গেছে।
মস্কোতে এসেছি অপেরা দেখবো না, তাতো হতে পাড়ে না। বুঝি আর না বুঝি। কথাটা পারতেই সবাই রাজি।
কাউন্টারে আসতেই অল্প বয়স্ক মেয়েটা এগিয়ে এলো। নাম ক্রিস্টিনা। কথার ফাকে ফাকে তার হাসি দোজা ভাই লক্ষ করেছিল। পরে বলেছিল, ও সুন্দরী তবে দাতের বাধন ভাল নয়।
হাজার হলেও উনি দাঁত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
Bolshoi Theatre এ আমরা টিকেট পেলাম না। শুনেছি এই বিখ্যাত theatre এর নাম। এর বিবরণ আসবে পরে। টিকেট পেলাম তারই পাশে নতুন গড়ে উঠা আর একটি থিয়েটার। চলছে ওথেলো। আগামীকাল সন্ধ্যার টিকিট পাওয়া গেলো।
গেলীনা ডাক দিলো সবাইকে। আমরা ওকে ঘিরে দাঁড়ালাম।
প্রথম দিনের তালিকায় আছে The Kremlin, Armory Museum, Arbat Center. বাস এসে দাড়িয়ে আছে গেটের সামনে। একে একে আমরা সবাই উঠে বসলাম। গেলীনা পরিচয় করিয়ে দিল মারিয়ার সাথে। আজকের গাইড সে।
গেলীনার পরিচয় না দিলেই নয়। গাইডই তার এক মাত্র পেশা নয়। মস্কো Universityর ইতিহাসের প্রফেসর সে । University বন্ধ কালীন সে এই কাজ টা করে। অনেক দিন ধরে আছে Gate1 ট্রাভেলের সাথে। অবাক হলাম।
ছোট পথ ধরে বাসটা এসে পড়ল বড় রাস্তায়। দুই পাশে বিশাল অট্টালিকার সারি। একটু এগিয়ে যেতেই ডান দিকে কার্ল মার্ক্সের বিরাট মূর্তি।এখন আর কার্ল মার্ক্স নিয়ে কেউ আলোচনা করে না।
সকালে রাস্তায় ভিড়। আধা ঘণ্টার মাঝে আমরা এসে পৌছালাম।
The Kremlin.
The symbolic heart and soul of Russia. চারিদিকে বিশাল লাল দেওয়াল। Czars এর বাসস্থান ছিল। এখন রাশান প্রেসিডেন্টের অফিসিয়াল রেসিড্যান্স এখানে । অনেক অনেক লোকের আগমন। কোথাও কোন পুলিশের আনাগোনা নেই। মারিয়াকে অনুসরণ করে Kutafy Tower দিয়ে আমরা এসে পৌছালাম Kremlin এর পশ্চিম দালানের দিকে। র্যাম্প এর শেষ মাথায় Alexander Garden.
অপূর্ব। দোজা ভাই ছবির পর ছবি তুলে চলেছে। আমিও কখনো সেলফী কখন অন্যকে দিয়ে সবাই মিলে ছবি উঠাচ্ছী। স্মৃতির মাঝে ধরে রাখা।
Kremlin wall কে পাশে রেখে একটু এগিয়ে গেলে Trinity Tower. লাল দালান। এর নাম হয়েছিল the Trinity Monastery of St.Sergius থেকে। এই Tower দিয়ে Tsar এর স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েরা আসা যাওয়া করতো।
ছবি তোলাতে ব্যস্থ থাকায় মারিয়ার উচু লাঠিতে বাঁধা গেট ১ আমি দেখতে পেলাম না। ওদেরকে হারালে আমার সর্বনাশ। গলা শুকিয়ে এলো।
দুর থেকে জীবুর ডাক শুনলাম, ও ডাকছে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
একটু সামনে এগিয়ে গেলে Annunciation Cathedral. চোখ জুড়ানো Artistic View, ভিতরের ডিজাইন না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। কথিত আছে এটা পেইন্ট করেছিল মঙ্ক Feodosius. ১৪ সেঞ্চুরি তে এটাই ছিল সব চেয়ে মস্কোর Important Church.
Annunciation Cathedral কে পিছনে ফেলে আমরা এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম Ivan the Great Bell Tower, ডিজাইন করেছিল Marco Bon Friazin. অনেক পুরান ইতিহাস জড়িত এই Kremlin এ। বিস্ময়। দেখার শেষ নেই।
সামনে বিরাট Great Kremlin Palace. সাদা হলুদ রঙ। Tsar Nicholas 1 এর সময় রয়েল ফ্যামিলি St.Petersburg থেকে মস্কো আসলে এখানে থাকতো। সেই সময় রাশিয়া র রাজধানী ছিল St.Petersburg।
আগের থেকেই আমাদের টিকিট কাঁটা ছিল। মারিয়া আর গেলীনা কে অনুসরন করে আমরা ঢুকলাম প্রথম তালায়। ফটো উঠানো নিষেধ নয় তবে ফ্ল্যাশ জ্বলতে পারবে না। প্রথম তালা রয়েল ফ্যামিলির luxurious private room.
উপর তালায় সেরীমনিয়াল হল। প্রায় আধা ঘণ্টা লেগে গেলো বাহিরে আসতে।
এর পর যাবো State Armoury দেখতে। মারিয়া State Armouryএর উপর একটা ছোট খাটো লেকচার দিল। এই State Armoury তে দেখতে পাবে Russian Prince এবং tsar এর বিশাল পরিমাণ ধন সম্পদ।
ভিতরে এসে দেখতে পেলাম হরেক রকমের জুয়েলারি, বিভিন্ন ধরেনের অস্ত্র, রয়েল ক্রাউন্স, আর গাউন। আরও দেখলাম বিখ্যাত Jeweled Faberge Eggs. অতুলনীয়।
চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
অপূর্ব Alexander Garden এর ভিতর দিয়ে হাটতে হাটতে মনে হোল একটু ক্লান্ত। কিন্তু না এখনও তোঁ দেখার বাকি রেড স্কয়ার। ছবিতেই দেখেছি আজ দেখবো নিজের চোখে।
রেড স্কয়ার। বিশাল চত্বর।
পশ্চিম দিকে St.Basil Cathedral. আগে এই রেড স্কয়ারে প্রত্যেক বছর মে ডে তে প্যারেড হতো। এখন এখানে কালচারাল প্রোগ্রাম হয়।
এই স্কয়ারে লেনিনের কবর। ভিতরে যাওয়া হলনা। বিরাট লাইন। অগত্যা মারিয়া বলল, চলো কিছু খাবে।
তোমাদের কে নিয়ে যাব রাশিয়ার সব চেয়ে বড় মল। নাম GUM.
এবার আমাদের মত আমরা। গেলীনার সাথে মিলবো এক ঘণ্টা পরে। সবাই ক্ষুধার্ত। Food Court এ এসে বসলাম। আন্না আপা, জীবু মিলে বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে এলো। আমি দেখছিলাম মলে লোকের আনাগোনা। আমেরিকান মলের সাথে পার্থক্য architecturaly. দামের তুলনায় আমরা এখনো সর্ব নিম্নে।
খাওয়া শেষে জীবু আন্না আপা কিছু কিনবে বলে স্টোর গুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।
প্রায় এক হাজারের উপর দোকান। ফার থেকে আরম্ভ করে সিল্ক সব পাওয়া যায়।
আছে Benetton, Estee Lauder, Christian Dior আরও অন্যান্য Western Firm.
আছে Western style এ ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট।
ঘণ্টা কেটে গেলো। ফিরে এলাম গেলীনা, মারিয়ার কাছে। ফিরে যাবো হোটেলে।
রাশিয়ার পথে রওয়ানা দিলাম আমরা চার জন। আমি, জীবু, দোজা ভাই, আর আন্না আপা। মস্কো তে যেয়ে মিলবো খুরশেদ ভাই আর ভাবীর সাথে। ওরা যাবে এরোফ্লটে। আমাদের এয়ার ফ্রান্স। প্যারিস হয়ে মস্কো।
রাত নয়টা পঞ্চান্ন তে ফ্লাইট। এয়ার পোর্টে পৌছে দিল ইসাক ভাই আমাকে আর জীবুকে।
তখন সন্ধ্যা সাতটা।
দোজা ভাই তখনও এসে পৌছায়নি। দশ মিনিটের মাথায় এসে গেলো।
সিকিউরিটি পাড় হয়ে গেটের কাছে এলাম। বেশ কিছু লোক বসে আছে। বাহির থেকে খাবার কিনে এনে ছিলাম। ভেতরে ওরা ডিনার দেবে দেরীতে।
যথা সময়ে ডাক পড়ল। মালপত্র উপরে রেখে বসতে যেয়ে মনে হোল সিটের আয়তন একটু কমিয়ে দিয়েছে। আমার মতো পাতলা চিকন মানুষেরও বসতে অসুবিধা। পা রাখার জায়গা কম।
সাত ঘণ্টার পথ। কোন রকমে কষ্ট করে বসে পড়লাম। এমনিই আমার ঘুমের প্রবলেম। তার উপরে প্লেনে। কি আর করা। আমি আর দোজা ভাই পাশাপাশি। গল্প করতে করতে কিছুটা সময় পাড় করে দাওয়া যাবে।
সামনের ছোট টিভি টা নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করলাম। নাহ, ভাল কিছু নাই।
সময় মতো প্লেন আকাশে উড়ল। ভাবতে অবাক লাগছে। মস্কো যাচ্ছি। কোনদিন ভাবিনি। আমার ভ্রমণ খাতায় ঐ নামটা ছিলনা। ছেলে মেয়ে বার বার করে বলে দিয়েছে, সাবধানে ওখানে চলতে। কেউ অনুসরণ করছে কিনা খেয়াল রাখতে। হাজার হলেও রাশিয়া।
এয়ার হস্টেসরা ব্যাস্ত রাতের খাবারের তদারকি নিয়ে। এরই মধ্যে এক জন এসে আমার হাতে কোসার খাবারের একটা বাক্স ধরিয়ে দিল। ইন্সট্রাকশন দেওয়া ছিল হালাল খাবারের। আমার কোসার, অন্যদের এলো মুসলিম খাবার। উনন থেকে কেবল নামিয়ে এনেছে মনে হোল। অত্যন্ত গরম। অনেক কষ্টে প্যাকেট খুলে মুখে দিয়ে বুঝলাম আজ রাত টা উপোষ করেই কাটাতে হবে।
দোজা ভাই এর পাত্রেও আহা মরি কিছু নয়।
অগত্যা এক গ্লাস পানি খেয়ে চোখ টা বুজার চেষ্টা করলাম। হোল না।
বাকি সময় টুকু আমি আর দোজা ভাই গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। জীবু, আন্না আপা ঘুমিয়েছে, শব্দে তার আভাস পেলাম।
ছয় ঘণ্টার ব্যবধানের জন্য সকাল হয়ে এলো খুব তাড়াতাড়ি। ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিলো আর পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা প্যারিসে অবতারণ করছি। রৌদের আলো এসে পড়েছে জানালা দিয়ে।
সকাল এগারটায় আমরা নামলাম চার্লস দ্য গোল এয়ার পোর্টে।
মাত্র দের ঘণ্টার মধ্যে আমাদের কে আর একটা প্লেনে উঠতে হবে মস্কোর পথে।
তড়িঘড়ি করে সিকিউরিটি পার হয়ে গেটে এসে দাঁড়ালাম। প্লেন সময় মতো ছাড়বে লেখা আছে।
সময়ের ব্যবধান প্যারিস মস্কোর মধ্যে মাত্র এক ঘণ্টা।
মস্কোতে পৌছাতে লাগবে প্রায় চার ঘণ্টা।
মস্কোতে এলাম বিকেল ছয়টায়। ভাবছিলাম ইমিগ্রাশেনে কি না কি হয়। ভিসা মাত্র সাতদিনের দিয়েছে। যেদিন এন্ট্রি করব ঠিক সেইদিন থেকে যেদিন চলে যাবো ঠিক সেই দিন পর্যন্ত।
কি অদ্ভুত তাই না? যদি এর মাঝে অঘটন কিছু ঘটে, তাহলে। এই চিন্তা মাথায় যে আসেনি তা নয়। এসেছিল।
মস্কো এয়ারপোর্ট আহা মরি কিছু মনে হলনা। নিতান্তই সাদাসিধে। আটপৌরে বলা যায়।
সবকিছু শেষ করে বাহিরে এসে দেখলাম Gate1 ট্রাভেলের লোক বড় একটা ব্যানার নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমরা কাছে আসতেই বলল, আরও তিন জনের জন্য ও অপেক্ষা করছে। সব মিলিয়ে আমাদের দলে আমরা আঠাইশ জন।
বাকীরা এসে যোগ দিতেই ট্রাভেল এজেন্টের লোক টা নিয়ে এলো বাসের কাছে। বাসে উঠার আগে আমরা চারজন মিলে সেলফী উঠালাম বাসটাকে নিয়ে।
যাত্রা শুরু। হাসি হাসি মুখ আমাদের।
সূর্য তখন অস্ত গেছে।
আমাদের গন্তব্য স্থান Courtyard Moscow City Center, Voznesensky Pereulok. Moscow.
গাড়ী চলতে শুরু করেছে। ঝলমলে আলোতে সাজানো নয়। একটু মনঃক্ষুণ্ণ আমি । জীবুকে বললাম, দেখে মন ভরছে না।
বলল সে, হয়তো চলতে চলতে আসবে কিছু যা দেখে আপনার মন ভরবে।
হয়তো তাই।
রাস্তায় গাড়ীর ভিড়। লোকেরা কাজ শেষে বাড়ী ফেরার পথে। আমাদের ওখানকার মতো। পনের মিনিট চলার পর এলাম আলোয় আলোকিত রাস্তায়। এমনই তো আমি চেয়েছিলাম। প্রশস্ত রাস্তা। দুই পাশে মার্সেডিস, বিএমডবলুর ডিলারশিপ।
গাড়ী মোড় নিয়ে ঢুকল একটা ছোট রাস্তায়। দুই পাশের দালান ইউরোপিয়ান ধাঁচে তৈরী। নিচের তালায় বিভিন্ন ধরনের দোকান। কিছু রেস্তোরা। চওড়া ফুটপথের পরিবর্তে দুজন পাশাপাশি হাটা যায় এমন তড়ো।
গাড়ী এসে দাঁড়ালো আমাদের হোটেলের সামনে।
এঁকে এঁকে আমরা নেমে এলাম। আমাদের কে স্বাগতম জানালো আমাদের গাইড গেলীনা। নিতান্তই সাধামাটা কাপড় পরনে। বয়স বোঝা মুশকিল। কোঁকড়ান চুল কিছুটা ছেড়ে দেওয়া, কিছুটা উপরে বাঁধা।
ডাক দিল আমাদের কে।
সে মাঝে, আমরা চতুর্দিকে।
“তোমাদের ডিনার রেডি। রুমে যেয়ে হাত মুখ ধুয়ে, পনেরো মিনিটের মধ্যে ডিনার রুমে চলে এসো”। বলে তাকালও আমাদের দিকে।
একটু এগিয়ে এসে বলল, তোমরা তো ভেজিটেরিয়ান, তাই না?
দোজা ভাই বলল, মাংস বাদে অন্য সবকিছু আমাদের জন্য বরাদ্দ করতে পারো।
ঠিক আছে, বলে সে চলে গেল।
রুম গুলো আমাদের নিচের তালায়।
জীবুর রুমের কাছে আন্না আপাদের রুম। আমার টা একটু দুরে।
কোন রকমে হাতমুখ ধুয়ে এসে দাঁড়ালাম হোটেলের চত্বরে। ওরা তখন আসেনি।
চারিদিক তাকিয়ে দেখছিলাম। অনেক উচু সিলিং। কাঁচে ঘেরা। সকালে সূর্যের আলো এসে পড়বে এই কাচ ভেঙ্গে। কালকের আবহাওয়া দেখিনি। ভাল যেন থাকে এই কথা ভাবতে ভাবতেই জীবু, দোজা ভাই, আন্না আপা এলো।
চল, বলে দোজা ভাই এগিয়ে গেলো।
ডাইনিং রুমে ঢুকতেই দেখলাম, খুরশেদ ভাই আর ভাবী। ঐ টেবিলে আরও কয়েকজনের সাথে উনারা। উনারা এসেছেন দুপুরে।
পাশের টেবিলটাতে আমরা চারজন।
ওয়াটার সুপ এনে দিয়ে গেলো। স্বাদ মন্দ না।
“সারাদিন কি করলেন”? জিজ্ঞাসা করতেই খুরশেদ ভাই বলল, টানা ঘুম দিয়েছি। রীলাক্স। আপনার ভাবীর একটু ঠাণ্ডা লেগেছে মনে হচ্ছে।
ঔষধ পত্র আছে তো?
আছে, নিয়ে এসেছি। সাবধানের মার নেই। বলে উনারা উঠল।
গেলীনা বলেছে খাওয়া শেষে চত্বরে আসতে। আগামীকালের প্রোগ্রাম বলবে।
মাছ দিয়ে তৈরী ডিশ টা শেষ করে আমরা উঠে পড়লাম।
অনেকে এসে গেছে।
গেলীনা বলল, কাল আমাদের অনেক প্রোগ্রাম। সকাল নয় টায় এখানে হাজির হবে। বাস ছেড়ে যাবে নয়টা তিরিশ মিনিটে।
ভীষণ ক্লান্ত আমরা।
কয়টায় নাস্তা করতে আসব? জিজ্ঞাসা করতেই দোজা ভাই বলল, সাড়ে সাতটায়।
আমার আর খুরশেদ ভাই এর রুম কাছাকাছি।
ওদেরকে বিদায় জানিয়ে আমরা পা বাড়ালাম আমাদের হল পথে।
আজ থেকে ছয়মাস আগের এক সকাল।
সেই সকালে ঘুমের আমাজ টা তখনো কাটেনি। আড়ামোড়া করে সেল ফোনটা পাশে টেনে নিলাম। ঘড়িতে ছিল সকাল নয়টা।
উঠার তাড়া নাই। সকালে খিদে লাগেনা। কফির আমেজটার জন্য উঠতে হয়। রাতে শুতে শুতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। রফিক ভাবীকে নিয়ে এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। থাকে ক্যানাডায়। এসেছে বোনের বাসায় বেড়াতে। ওর সাথে আড্ডা দিতে দিতে তাকিয়ে দেখি ঘড়ির কাঁটা দুটোতে।
ভাবীর ডাকে টনক নড়েছিল। অনেক দিন পরে দেখা। বন্ধুত্ত আজকের নয়। কলেজ জীবনের।
অতীত ঘাটতে কারই না ভাললাগে। যদি সেই অতীত হয় উজ্জ্বল আকাশের মত সচ্ছল, নিলে ভরা। সেই অতীতের দিনগুলো নিয়ে আমরা খেলা করছিলাম।
না এবার উঠতে হবে, Keurig টা অন করে হাতমুখ ধুয়ে এলাম। কফির ঘ্রান পাচ্ছি। কফির মাগটা নিয়ে এসে বসলাম বাহিরে ছোট্ট বেলকনি তে। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। তখনো কফির পেয়ালায় চুমুক দেইনি।
ফোন টা বেজে উঠল।
ইসাক ভাই।
অত্যন্ত আপনার জন। অমাইক। কথা বলে আনন্দ আছে।
অনেক আগে একবার কথায় কথায় বলেছিলাম, আপনারা যদি কোন সময় বাহিরে ভ্রমনে যান আমাকে আপনাদের দলের সাথে যোগ করেন। অবশ্য আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে।
“ রাশিয়ায় যাবে?”
উনার প্রশ্নে প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
“ কি ব্যাপার উত্তর দিচ্ছ না যে?”
বললাম, ঠিক বুঝতে পারছি না।
না বোঝার তোঁ কোন কারন নাই। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে রাশিয়ায় যাবো। ভাল ডিল পেয়েছি। তুমি বলেছিলে তোমাকে সঙ্গে নিতে তাই তোমাকে জানাচ্ছি। আর শোন জীবু যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করো ওকে।
না না আমি আছি আপনাদের সাথে। তবে ওর কথা তো বলতে পারবনা। সে তো Edmontonএ।
জিজ্ঞাসা করে দেখো। হাতে তিন দিন সময় আছে। এর মধ্যে কিছু টাকা অগ্রীম দিয়ে ডিল টাকে বুক করতে হবে।
-আমাকে আধা ঘণ্টা সময় দেন। আমি সব কিছু ঠিক করে আপনাকে জানাচ্ছি।
এই বলে ফোনটা রেখে দিলাম।
জীবু কে পাওয়া সহজ নয়। এঁকে তো ক্যানাডায়, তারপর অধিকাংশ সময় সে ফোনের কাছে থাকে না।
এক দুই তিন। ফোন বাজছে। ভয়েস মেলে চলে গেলো।
বললাম, এই মুহূর্তে আমাকে কল করো। জরুরী দরকার আছে। দুই তিন বার পাইচারি করে, ভাবলাম, টেক্সট পাঠালে মন্দ কি?
পাঠালাম। গেলনা। মাঝ পথে আটকিয়ে গেলো।
মনে হোল আজকের এই সকাল আমার অনুকুলে নয়।
ঠিক সেই সময় ফোন টা বেজে উঠল, জীবুর ফোন।
কি ব্যাপার? এই সাত সকালে। সবকিছু ঠিক আছে ঐখানে?
তা আছে। রাশিয়ায় যাবে?
কি বললেন?
ঠিক আমারি মতো। প্রথমে একটু ভড়কিয়ে যাওয়া।
রাশিয়া, রাশিয়া তে যাবে। ইসাক ভাই আর অনন্যাও সবাই মিলে ছয় ফ্যামিলি যাচ্ছে। ইসাক ভাই তোমার কথাও বলল।
আমি রাজি আছে, আমাকে কি কি করতে হবে।
তোমাকে কিছুই করতে হবে না এই মুহূর্তে। আমিই সব ব্যবস্থা করব।
ঘড়িতে দেখলাম আধা ঘণ্টা পাড় হয়নি।
ইসাক ভাইকে কল করে জানিয়ে দিলাম আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।
রাশিয়া! মস্কো! সেন্ট পিটারসবারগ।
স্বপ্নেরও অতীত ছিল কোনদিন যাবো সেইখানে।
মস্কো, কসমোপলিটান ক্যাপিটাল। ঐতিহাসিক Kremlin, a complex that’s home to the president and tsarist treasures in the Armoury. Outside its walls is Red Square, Russia’s symbolic center. Lenin’s Mausoleum. আহা, স্বপ্ন দেখছি নাতো?
মস্কো থেকে সেন্ট পিটারসবারগ। হাই স্পীড ট্রেনে যাবো। কি মজাই না হবে। সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে যাওয়া যাবে। সবাই চেনা। যদিও অনন্যারা আমার বড় ভাই। কিন্তু একটা বয়সে এসে সবাই বন্ধু হয়ে যায়।
যাওয়ার দিন অনেক দেরী।
১৩ই সেপ্টেম্বর রওয়ানা হবো।
ট্রাভেল এজেন্ট, তানিয়া, ইমেইল করে জানিয়ে দিলো, সবার পাসপোর্ট নাম্বার, জন্ম তারিখ, আর পাসপোর্টের মেয়াদ কতদিন আছে। তাকে জানাতে।
অন্তত পক্ষে ছয় মাসের মেয়াদ থাকতে হবে।
জীবু কে কল করে বললাম, তোমার পাসপোর্ট টার ছবি উঠিয়ে আমাকে টেক্সট কর।
যথারীতি টেক্সট এসে গেলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে যেয়ে পাসপোর্টের মেয়াদের অঙ্কটা বসাতে যেয়ে দেখলাম ওটার মেয়াদ ছয় মাস নেই।
আবারও কল করতে হোল।
কি ব্যাপার?
ব্যাপার গুরুতর, তোমার এই পাসপোর্ট দিয়ে যাওয়া চলবে না। ওটার মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে আমাদের যেতে যেতে।
তাহলে, তাহলে আমার যাওয়া হবেনা?
হবে, এখনো সময় আছে। এই ক্ষণে নতুন পাসপোর্টের জন্য অ্যাপ্লাই কর। আর আমি এই পাসপোর্টের সমস্ত তথ্য দিয়ে তানিয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। বলে ফোন টা রাখলাম।
যথারীতি পাঠিয়ে দিলাম ওর তথ্য।
পরদিন তানিয়া জানালো, জীবুর টা হবে না। নতুন পাসপোর্ট এলে তাকে জানাতে।
তিন সপ্তাহর মাঝে এসে গেলো জীবুর নতুন পাসপোর্ট।
দিন যায় ক্ষণ যায়। আস্তে আস্তে যেন ভুলেই যেতে বসেছি আমরা যাবো রাশিয়া তে। মাঝে অনেক ওলট পালট হয়ে গেলো।
এক অনেক কাছের বন্ধুর ধরা পড়লো এক মর্মান্তিক অসুখ। বিছানায় শয্যাগত।
মনটা বিষিয়ে গেলো।
একদিন তানিয়ার ইমেইল পেলাম। বাদবাকি টাকা দেওয়ার তাগীদা। নিদৃষ্ট সময়ে।
টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার কিছুদিন পরে ইসাক ভাই কে কল করতেই উনি বললেন, আমাদের কয়েক জনের বোধ হয় যাওয়া হবে না।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কি বলছেন? আপনি আছেন বলেই না আমার যাওয়া।
কি বলব, আমরা ভাবি এক আর উপরে যিনি বসে আছেন তিনি ভাবেন আরেক।
আমাদের এক বন্ধু খুবই অসুস্থ। ওকে রেখে আমরা যাবনা। তোমরা ঘুরে এসো। আবার কোনদিন যদি একসাথে যাওয়ার সুযোগ আসে, যাবো বৈকি। বলে থামলেন। গলার স্বরে বিষণ্ণতা।
আমি চুপ করে শুনলাম। শুধু ভাবলাম, আমরা কত নীরুপায়। কোন কিছুরই কোন গ্যারান্টি নাই।
বারো জন যাবো। সেই খানে ছয় জনে এসে দাঁড়ালাম।
আজ সেই ১৩ই সেপ্টেম্বর।
আমাদের যাত্রার দিন। সুটকেস টা বন্ধ করে দিয়েছি। ছেলে, মেয়ে বোনরা কল করে শুধু একি কথা, ঔষধ গুলো সাথে নিতে ভুলনা। পাসপোর্ট টা সাবধানে রেখো। ওখানে পৌছিয়ে ফেস টাইম করবে।
বলি, একাতো যাচ্ছি না, আরও কয়জন তো সাথে আছে।
ওদের দুশ্চিন্তা, আমার জীবন থেকে অনেক গুলো বছর তো পেড়িয়ে গেছে। এখন তো নড়বড়ে শেকড়ের উপর দাঁড়ান। তাই ওরা দুশ্চিন্তা গ্রস্থ।
সময় এলো।
ইসাক ভাই পৌছে দেবে এয়ারপোর্টে।
বিধির কি খেলা। যে আমাকে নিতে চেয়েছিল তার সাথে, আজ সে শুধু পৌছে দেবে এয়ারপোর্টে।
দুদিন আগেও যে বাড়ী ছিল হৈ হুল্লোড় ভরপুর আজ এই নীস্তবততা কানে বাজে।
আমি এসে পা দিলাম বাহিরের সিঁড়িতে।
সকাল ১০ টা।
ফিরে তাকালাম শূন্য গাড়ী বারান্দা টার দিকে। সুহাই এঁর গায়ে হলুদের দিন এইখানেই লাবু ভাই গরম গরম জিলেপি ভেজে সবাই কে ডেকেছিল।
আসুন গরম গরম জিলেপি খান। সেই সাথে ঝাল মুড়ি আরও মুখরোচক খাদ্য।
আজ শূন্য বারান্দা।
আমি বেল টিপতেই দরজা খুলে দাঁড়াল চয়ন আপা।
সকালের নাস্তার দাওয়াত আমার। শফিক ফোন করে বলেছিল, কি করেন শফি ভাই? ঘুম ভাঙালাম?
না, ঘুম ছুটে গেছে অনেক আগে। শুয়ে শুয়ে আড়া মোড়া কাটছি।
চয়ন আপা আপনাকে আসতে বলেছে, একসাথে নাস্তা করব।
তথাস্তু।
সেই সুবাদেই এই সাতসকালে আমার আগমন।
ঢুকতেই দেখলাম ইলোরা ব্যাস্ত পরোটা ভাজায়। রতু বিয়ান ব্যস্ত ডিমের সরঞ্জাম নিয়ে।
আর সবাই কোথায়? বলে তাকালাম চারিদিকে।
মহারানীরা আস্তে আস্তে নামবে উপর থেকে। বলে হাসল চয়ন আপা।
জীবু চলে গেছে, ওর তাড়া আছে।
নেমে এলো লাজ, এলো মুন্না এলো শুকলা বিয়ান। শেষে নেমে এলো সিলভা।
নাস্তার টেবিলে ছোট ছোট কথা। যার কোন মানে নেই। যাকে বলে টেবিল টক।
সিলভার চেহারাতে উদ্বিগ্নতা লক্ষণীয়। মাঝেমাঝে হারিয়ে যাচ্ছে কথার মাঝ থেকে।
কি ভাবছ?
আচ্ছা শফি ভাই আপনার কি কোন প্রোগ্রাম আছে বৃহস্পতি বারে?
কেনও বলত?
ঐ দিনটা আমার ফিরে যাওয়ার দিন। নামিয়ে দিতে পারবেন JFK AIRPORT এ? ভীষণ ভয় করছে একা একা যেতে।
শাহিন চলে গেছে ওর দুই মেয়েদের কে নিয়ে। কাজের থেকে ছুটি পাই নি।
সিলভা থেকে গিয়েছিল আরও কয়েক দিন। আবার কবে আসবে কে জানে। বোনদের সাথে আরও কিছুদিন কাটান, বিয়ে বাড়ীর শেষে রেশ টুকু সে উপভোগ করতে চায়।
বললাম, আমার কোন আপত্তি নেই। অঢেল সময় আমার।
একটা কিন্তু আছে। বলে তাকালও সে
পরোটার কিছু অংশ আলু ভাজীর সাথে মিশিয়ে মুখে দিতে দিতে বললাম, কিন্তু টা কি?
আপনাকে থাকতে হবে সীকুরীটী চেক না হওয়া পর্যন্ত।
হাসতে হাসতে বললাম, কোন ভয় নেই তোমার, শুধু সীকুরীটী চেক নয়, আমি থাকবো সেই পর্যন্ত যেই পর্যন্ত তুমি গেটের কাছে যেয়ে আমাকে কল না কর। হোল তো? এইবার নাস্তা করতে বস।
একটু স্বস্তি পেলো সে।
একটু হেসে বলল, জানেন শফি ভাই কতবার এসেছি নিউইয়র্কে আজ পর্যন্ত Statue of Liberty দেখা হয়নি।
তাহলে আর দেরী কেনও? কাল সকালেই আমরা বেড়িয়ে পড়ব।
ওর দৃষ্টি আমার চোখে। সেখানে অবিশ্বাসের ছায়া।
বললাম তোমার কোন আপত্তি না থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে ভেবে দেখো। You and I against the world. বুঝেছ তো আমি কি বলতে চাইছি।
না আমার আপত্তি নেই। শাহিন অনেক উদার। ওকে আমি চিনি, ওকে আমি জানি। আমার খুব আনন্দ লাগছে। কখন পিক করবেন।
ঠিক সকাল সাড়ে দশ টায়।
আরও কিছুক্ষণ বসে আমি উঠে পড়লাম। যেতে হবে Asotria তে।
পরদিন সকালে এলাম তপুর বাসার সামনে। সিলভা ওখানে। গাড়ীতে থেকে নামতেই ও বেড়িয়ে এলো। চোখে সানগ্লাস। পড়নে গোলাপি টপসের উপর গোলাপি, সাদা, কালো চেকের জামা। ফেডেড জিন। কাঁধে বড় ব্যাগ।
এই গোলাপ ফুল গাছের কাছে আমার ফটো তোল, বলে পোজ দিয়ে দাঁড়াল।
বললাম, মাথাটা একটু বা দিকে ফিরে, আমার দিকে তাকাও।
ও তাকাল।
আপনি থেকে তুমি তে এসেছে শুনে ভাল লাগল। আমিও ওই ডাকে বিশ্বাসী।
ফটো উঠাতে আমার যেমন আনন্দ, ফটো উঠতে সেই পরিমাণ আনন্দ ওর মাঝে, শুনেছি ওর বোনদের কাছে।
আরও কয়েক টা বিভিন্ন পজে ফটো উঠিয়ে বললাম, এবার চলো। দেরী হয়ে যাবে। অনেক কিছু আমাদের কভার করতে হবে।
এগার টা বেজে গেলো।
শান্তনুর বাসার কাছে গাড়ী পার্ক করে সাবওয়ে নিয়ে আমরা যাবো। অনেক দিন হয়ে গেলো পাতাল রেলে চড়ে কোথাও যাইনি। সাবওয়ের ম্যাপ টা দেখে নিয়েছি, লোড করে নিয়েছি Iphone এ।
N ট্রেন ধরে নামতে হবে ৫৯ স্ট্রীটে, সেখান থেকে ৫ নম্বর ট্রেন নিয়ে সোজা বওলিং গ্রীন। উপরে উঠলেই Statue of Liberty।
খুব আনন্দ লাগছে, বলে তাকাল সিলভা।
গাড়ী যখন পার্ক করলাম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগার পেড়িয়ে গেছে।
বললাম হাটতে পারবে তো ? ট্রেন ষ্টেশনে যেতে পনের মিনিট লেগে যাবে কিন্তু।
পারবো, হেটে আমার অভ্যাস আছে।
প্রথম কিছুটা পথ হিলি, পরে সমতল রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। আমার কাঁধে ব্যাগপাক। নিয়েছি কয়েকটা পানির বোতল। সাথে আছে মুড়ি ভাজা, চানাচুর, কলা। পথের জন্য।
আবহাওয়া টা আজ আমাদের অনুকুলে। না গরম না ঠাণ্ডা। উজ্জ্বল আকাশ। নীল মেঘ খেলা করছে সূর্যের আলোর সাথে।
সকালে নাস্তা করে বের হয়নি, শফি ভাই। বলে কাচু মাচু করে তাকাল আমার দিকে সিলভা।
বাহ, তা আগে বলবে না? বলে তাকালাম চারিদিকে।
ঐ যে ডানকিন ডোনাট। ওখানে নাস্তা করে নেবো।
দেরী হয়ে যাবে নাতো?
আমাদের আজ তাড়া নেই। অফুরন্ত সময় আছে। চিন্তা করোনা। বলে ডানকিন ডোনাটে এসে বসলাম।
নাস্তা শেষে ট্রেন ষ্টেশনে এসে দেখলাম ট্রেন দাড়িয়ে আছে।
উঠে পড়লাম।
একটা ছবি তোল। আমরা দুজনে বসে আছি ট্রেনের ভিতর। ঐ লোকটাকে দেও। বলল সে।
আগে সেলফী টা উঠাই, তারপর দিচ্ছি ওকে। বলে কয়েকটা ছবি ক্যামেরাতে ধরে রাখা হোল।
কোনটা সানগ্লাস পরে, কোনটা সানগ্লাস ছাড়া। বিভিন্ন ভঙ্গিতে।
ট্রেনে বসে টুকি টাকি গল্প। বলল সে, ছাব্বিশ বছর বিয়ে হয়েছে। কোথা দিয়ে সময় চলে গেলো বুজতে পারলাম না।
চলো এসে গেছি। বওলিং গ্রীন। এই ষ্টেশনে নামব আমরা।
উঠে এলাম পাতাল থেকে রাস্তায়।
ঐ দেখো Statue of Liberty ।
তাকিয়ে দেখে বলল, এবার আমার নিউইয়র্কে আসাটা সার্থক হোল।
টিকিট কেটে ফেরীতে উঠলাম।
চলো উপর তালাতে। ওখান থেকে ছবি উঠাব।বলল সে
ভীষণ বাতাস। সিলভার ঘাড় পর্যন্ত এলানো চুল গুলো হওয়ায় উড়ছে। সূর্যের তাপে মুখমণ্ডলে লালচে আভা।
ঐ দিক থেকে উঠাও। বলে সে তাকাল ক্যামেরার দিকে।
অনেক গুলো ছবি বিভিন্ন ভাবে উঠিয়ে বললাম, জানো কত গুলো উঠিয়েছি।
আমার না ছবি উঠাতে অনেক ভাল লাগে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
ফেরী এসে ভিড়ল Liberty Island এ।
সামনে বিরাট মূর্তি টা দাড়িয়ে। অনেক লোকের আগমন আজ। হয়তো প্রতিদিনই এই পরিমাণ লোক আসে।
জিজ্ঞাসা করলাম এর ইতিহাস জানো কি?
না, বলতো?
এই কপার স্ট্যাচু টা a gift from the people of France to the people of the United States.
স্ট্যাচু টা ডীজাইন করে ছিল ফ্রান্স স্কাল্পটর Frédéric Auguste Bartholdi। আর তৈরী করেছিল Gustave Eiffel.
এই robed woman মূর্তি টা রিপ্রেজণ্ট করে Libertas, a Roman liberty goddess।
ঐ যে দেখছ ডান হাতে টর্চ মাথা ছাড়িয়ে গেছে, আর বা হাতে যেটা দেখছ, ওটা কে বলে, tabula ansata ওর মাঝে লেখা আছে July 4, 1776, the date of U.S. Declaration of Independence.
আর পায়ে দেখছ ভাঙ্গা চেন, ওর মানে হচ্ছে ফ্রীডম। Freedom of United States.
অনেক শেখা হোল। এবার ওটাকে পিছনে রেখে আমার একা এবং তোমার সাথে অনেক গুলো ছবি উঠাও।
উঠিয়ে ছিলাম, অনেক অনেক ছবি।
এবার বিশ্রামের দরকার কি বলও। পেটে কিছু দিতে হবে না?
ফিস এন্ড চিপস কিনে এসে বসলাম ছায়ার নিচে টেবিল চেয়ারে।
খেতে খেতে দুই তিনটা সেলফী উঠালে কেমন হয়, বলতো।
মন্দ বলোনি।
দুই তিনটা নয় আরও অনেক উঠিয়ে বললাম, মন ভরেছে?
খাওয়া শেষে ঘড়ি দেখলাম। চারটা বাজে।
বললাম, আরও তো দেখার বাকি। ফ্রীডম টাওয়ার দেখবে না? যেখানে ছিল Twin Tower।
ফিরে এলাম Statue of Liberty দেখে। সিলভার মুখে শুধু এক কথা। কি সুন্দর আজ দিন টা কাটছে। এমন আশা করিনি আগে।
ফ্রীডম টাওয়ার এসে পৌছালাম পাঁচটার পর। ভিতরে যাওয়া হোল না। বাহিরের থেকে ছবি উঠিয়ে এলাম টাইম স্কোয়ারে।
বললাম, টাইম স্কোয়ার দেখতে হয় রাতে। ঝলমল করে চারিদিক। না দেখলে বুজতে পারবে না। তবুও দেখো চারিদিক তাকিয়ে। মন ভোলানো দৃশ্য। তাই না?
সময় কেটে গেলো ছবি উঠিয়ে।
ক্লান্ত আমি। ক্লান্ত সে।
এবার ফেরার পালা।
ফেরার পথে ট্রেনে বসে সিলভা ছবি গুলো দেখছিল।
–এই ছবি গুলো আমাকে পাঠিয়ে দিও। সুন্দর সময় কাটল তোমার সাথে। মনে থাকবে অনন্ত অনন্ত কাল ধরে।
হঠাৎ ই ফোন টা বেজে উঠল।
শান্তনু কল করেছে।
–কোথায় তোমরা?
–এইতো ট্রেনে। কুঈন্স বোরো প্লাজা সামনে।
–আমি তোমাদের আগের ট্রেনে। তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। এক সাথে ডিনার করব। তাসমিয়া কে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওরাও এসে জয়েন করবে। নাম করা SeaFood রেস্টুরেন্টে বসব।
রাজি হয়ে গেলাম। গাড়ী ওর বাসার সামনে।
নেমে দেখলাম ও দাড়িয়ে।
জীবু, তাসমিয়ে, টেগোর এসে জয়েন করল আমাদের সাথে।
এটা একটা উপরি পাওনা।
খাওয়া শেষে হেটে হেটে এলাম শান্তনুর বাসার সামনে। ওদের কে বিদায় দিয়ে গাড়ীতে এসে বসলাম।
শরীর ভেঙ্গে এলো। ক্লান্ত দুজন।
রাত দশটায় সিলভাকে নামিয়ে দিলাম যেখান থেকে ওকে উঠিয়ে ছিলাম।
বললাম মনে থাকবে তোমার সান্নিধ্য।
নামতে যেয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, কবে আসবে আমাদের ওখানে, সানফ্রান্সীস্কতে।
একটু নাটকীয়তা করে বললাম, “সময় যে দিন আসিবে সেদিন যাইবও তোমার কুঞ্জে”।
বলল, বাহ, তুমিতো গানের সুরে কথা বলছ।
বলে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।
ফোনের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ভাইবারের আওয়াজ। রিংএর শব্দটা শুনলেই বোঝা যায়। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভোর ছয়টা। এতো ভোরে একমাত্র দেশের থেকেই কল করা সম্ভব। ফোনটা তখনো বাজছে। নাছোড় বান্ধা। সাধারণত আমার পাশের বালিশের উপরেই ওটা থাকে। হাত দিলাম। পেলাম না। অগত্যা মাথা টা উঠিয়ে দেখতে চাইলাম। ওটা দু বালিশের মাঝে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ততক্ষণে শব্দ টা বন্ধ হয়ে গেছে।
থাক ওখানে পড়ে। উঠাতে ইচ্ছা করলো না। যে ব্যাক্তিই হয়ে থাক বুঝতে পেরেছে, এখানে এখনো ভোরের আলো এসে পৌছায় নি।
বন্ধের দিন।
কাজেই পাশ ফিরে গায়ের কম্বল টা চেপে ধরলাম। ঠিক সেই সময়ে ঝমঝম করে আবার বেজে উঠল ফোনটা। দাঁত খিচিয়ে ফোন টা উঠালাম। ভেবে ছিলাম প্রথমে একটা কষে ধমক দেবো। তা এর হোল না।
হ্যালো বলার আগেই, খুব কাকুতি মিনতি করে বললও, সরি দুলাভাই, আমি ডলি, আপনার ঘুম ভাঙ্গালাম। অনেক বার কল করেছি আপনাকে, বিভিন্ন সময়ে, পাইনি। তাই এই অসময়ে আমাকে ফোন করতে হোল। ক্ষমা করে দিয়েন দুলাভাই।
মনে পড়লো, অনেক গুলো কল এসেছিল ঠিকই, নাম্বার টা চেনা নয়, তাই খুব একটা গুরুত্ত দেই নি। কাজেই দোষটা কিছুটা আমার। এই ভেবে অতি ভদ্র গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, সব খবর ভাল তো?
সুসংবাদ আছে দুলাভাই।
কি?
আমার ছোট মেয়ে মৌর বিয়ে?
কোথায়? দেশে?
না, আপনাদের ওখানে। নিউইয়র্কে না, অরলান্ডো তে। আপনাকে আসতেই হবে দুলাভাই।
ডলির এই আন্তরিকতা শুধু আজ নয়। যেদিন থেকে ওকে আমি দেখেছি, ওর সাথে পরিচিত হয়েছি, সেদিন থেকে। ও আমার কেউ নয়। ও আমার শ্যালিকার ছোট বেলার বান্ধবী। এক পাড়ার মেয়ে। আমার বৌ কে আপা বলে ডাকতো। সেই সুবাদে আমি দুলাভাই। দেশে গেলে ওর বাসায় একবেলা হলেও আমাদেরকে যেতে হতো।
বলত, আপনার কথা আপার কাছে ফোনে শুনতে শুনতে আমি আপনার অতি ভক্ত হয়ে গেছি।
সেই হৃদয়ের টান টা আজও রয়ে গেছে।
বললাম, তারিখ টা বলও, আমি চেষ্টা করব।
বলল, ৭ ই ডিসেম্বর গায়ে হলুদ, ৮ ই ডিসেম্বর বিয়ে। আপনাকে দুটোতেই আসতে হবে।
সবুর করো, ছুটি ছাটার ব্যবস্থা করতে হবে। তোমাকে আমি জানাবো। এই বলে কথার ইতি টেনে, কম্বল টা মাথার উপরে টেনে দিলাম।
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে আটটা বেজে গেলো। রবিবারের সকাল। জানালার Blinds গুলো টেনে উপরে উঠিয়ে দিতেই এক ঝলক নরম সূর্যের আলো এসে ড্রয়াইং রুম টা ভিজিয়ে দিলো। আমি Keurig এ বানানো কফির পেয়ালাটা এনে জানালার পাশে বসলাম। বাহিরে ফুলের গাছগুলো তাদের সজীবতা হারিয়ে ফেলেছে শীতের তীব্রতায়। । দুমাস আগের উজ্জ্বল নানা রঙে রঞ্জিত আবরণ কোথায় যেন লুকিয়ে রেখে আজ ভিখারির সাজে সজ্জিত। আমি তাকিয়ে ছিলাম দুর পানে।
ফোনটা বেজে উঠল। ঝর্না, আমার শ্যালিকার ফোন। এতো ভোরে সাধারণত সে কল করেনা। আশ্চর্য না হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি, ডলির কল পেয়েছ নিশ্চয়?
কি করে বুঝলেন?
এতো ভোরে তুমি তো কল করার বান্দা নও।
কিছু চিন্তা করেছেন? জিজ্ঞাসা করে একটু থেমে বলল, আপনি যদি বিয়েতে আসেন তবেঁই আমার যাওয়া হবে।
তাহলে তো অবশ্যই চেষ্টা করতে হয়। বললাম, আগামী সপ্তাহে তোমাকে জানাবো।
নানা কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়াতে ভুলে গিয়েছিলাম ডলির প্রস্তাব টা। হঠাৎ ফেসবুকে জয়ার ছবি দেখে মনে পড়ে গেলো ডলির কথা।
জয়া মৌ র বড় বোন।
ওই আমার বেশি পরিচিত। মাঝে মধ্যে টেক্সটে, ফোনে কথা যে হতো না তা নয়। বড্ড মিষ্টি মেয়ে। আমার ভীষণ ভাল লাগত। ওরা তিন বোন। জয়া, জেসী, আর মৌ। শেষ যখন মৌকে দেখেছিলাম সে ছিল ছোট্ট, স্কুলে পড়া একটি মেয়ে। আজ সে বিয়ের পাটিতে বসতে চলেছে।
মনে হোল মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। বুঝতে পারিনি।
চড়াই উতরাই পাড় হয়ে আজ আমি যেখানে এসে পৌঁছেছি তাতে করে মনে হোল হাতে সময় হয়তো বেশি নাও থাকতে পারে। তাই সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আমি যাবো। অনেক দিন দেখিনি ওদেরকে।
ঝর্নাকে কল দিলাম। বললাম আমি আসছি। সে থাকে মায়ামীতে।
ওখান থেকে গাড়ী নিয়ে অরলান্ডো যাবো।
টিকিট কাঁটা শেষ।
জয়া কে জানালাম, আমরা আসছি। সে থাকে লসএনযেলিসে । বললাম, বিয়ের ভেনুর কাছাকাছি কিছু হোটেলের নাম পাঠাও।
উত্তরে তার উচ্ছলতা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করলো।
“আমি যে কি excited খালু তুমি আর ঝর্না খালা আসবে শুনে। আমি এখনি মৌ কে বলে দিচ্ছি, সে তোমাকে সব জানাবে”।
মিনিটের মধ্যে টেক্সট এসে গেলো। আমি হোটেল বুক করে ফেললাম।
জানি, এখনি ডলি কল করবে, ঠিক তাই। ফোনটা বেজে উঠল। ওর মেয়েরা জানিয়ে দিয়েছে, আমরা আসছি বিয়েতে।
ডলির সেই একই কথা, আমি কি যে খুশি হয়েছি দুলাভাই, আপনাকে বুঝাতে পারবো না।
দিন এলো। আমি রওয়ানা হয়ে গেলাম। মায়ামীতে এক রাত কাটিয়ে, আমি আর ঝর্না বেড়িয়ে পড়লাম গাড়ী নিয়ে। সকাল দশটা। যেতে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগবে। পথের জন্য বেঁধে নিয়েছি বিস্কুট ,বাদাম আরও সব মুখরোচক ভাজা পোড়া।
গল্প করতে করতে সময় পেড়িয়ে গেলো। সেই পুরানো দিনের ফেলে আসা সব ঘটনা। মাঝে মাঝে ফিরে যাচ্ছি অনেক পিছনে। কে যেন হাতছানি দিয়ে বলছে, এসো, আমার আবার মিলি দুজনে।
গাড়ী চালাতে চালাতে চোখ ঝাপসা হলে চলবে না। তাই ঝর্না কে বললাম, এবার বলও অন্য কথা।
ঠিক তিন টায় এসে পৌছালাম হোটেলে।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় অনুষ্ঠান।
বাহিরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। পনের মিনিটের পথ হোটেল থেকে বিয়ের ভেনু। আমার শ্যালিকা সুন্দর করে সেজেছে। বলল, দুলাভাই টিপ টা আনতে ভুলে গেছি।
বললাম, আহা, ওটা থাকলে সপ্তকলা পূর্ণ হতো। তবে যাই বলও, ওটার অবর্তমানেও তোমাকে যা লাগছে তাতে আমাকে তোমার উপর নজর রাখতে হবে যাতে কেউ যেন নজর না দেয়।
থাক ঠাট্টা করতে হবে না, এবার চলেন।
এসে পৌছালাম Maitland Civic center এ। এই বৃষ্টি মাথায় করে অনেক লোক এসে গেছে। আমরা কাউকে চিনিনা। নতুন বৌ তখনও এসে পৌছায়নি। আশেপাশে তাকাতেই একজন এসে বলল, আপনারা এখানে?
ঝর্নার পরিচিত।
যাক একজন কে পাওয়া গেলো। সে ছেলের মা কে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিলো। নিউইয়র্ক থেকে এসেছি শুনে বলল, খুবই ঘনিষ্ঠ বুঝি?
খুবই।
কথা বলে ভাল লাগলো। আন্তরিকতা পূর্ণ ব্যবহার। আমিই বললাম, আপনি ছেলের মা, অনেক দায়িত্ব । অনেক লোকজন আসছে। আপনি ওদেরকে দেখাশোনা করুন।
বসে আছি। একজন এসে বলল, বৌ এসেছে, বৌ এসেছে।
আমরা উঠে দাঁড়ালাম।
বাপের হাত ধরে যে মেয়েটি সলজ নয়নে এলো, তাকে আমি দেখলাম বহুদিন পড়ে। লাল রঙের শাড়ী পেঁচিয়ে উঠেছে মাথা অবধী। ঘোমটা টানা। গয়না দিয়ে ঢাকা গলা, কপালে স্বর্ণ খচিত অলঙ্কার। নাকে নথ।
এ এক লজ্জাবতী লতা।
মনে হোল এ পানিতে ভাসা পদ্মফুলের কুড়ি। আস্তে আস্তে উদ্ভাসিত হবে।
আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।
ওর মুখের উপর আর একটা মুখ ভাসছে। ওরা সবাই দেখতে একি রকম। এই দিনে ওদের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। ওদের হাসিতে ঝরে মুক্তো। ওদের চাহুনী বলে, আমি এলাম, আমি জয় করলাম তোমাকে, তোমাদের সবাই কে।
দুলাভাই? কি হোল, ছবি উঠাবেন না?
হাঁ, তাইতো, দেখছিলাম মৌ কে।
খুব সুন্দর লাগছে দেখতে তাই না?
অপূর্ব। দেখো জয়া আর জেসী কে। কি সুন্দর সাঁজ। খুউব মানিয়েছে।
ডলি এসে পাশে দাঁড়ালো।
মৌ আর সউমিক পাশাপাশি বসল স্টেজে।
ফ্লাস পড়ছে। ওরা হাসছে। ওদের হোল নতুন জীবন শুরু।
ডলিকে বললাম, সার্থক হোল আমা্র আসাটা।
কিছুটা সময় কেটে গেলো সবার সাথে কথা বলতে বলতে। হঠাৎ ই কাধে আলতো ছোঁয়া।
ফিরে তাকালাম।
মৌ।
এসো খালু তোমার সাথে একটা ছবি উঠাই।
আমি তাকালাম ওর কাজলে টানা চোখ দুটোর দিকে। ও চোখে মায়া ঝরছে।
চারিদিকেছরিয়েপড়েছেকনারঅসুস্তারকথা।দলেদলেবন্ধুবান্ধবশুভআকাংকিরাআসছেওকেদেখতে।ওজানতোনাসবাইওকেকতভালোবাসে।ভালবাসতোওরউদারমনেরজন্য, ভালবাসতোওরসততার জন্য।
শুরুহলোকিমোথেরাপিদেওয়া।ডক্টররেফএরত্তাবধানে। বায়োপসির রেজাল্টএসেছে।ভালোনয়।দুটোমিউটেশন। এক্সন ২০ এক্সন ২১ । এক্সন ২০ রচিকিৎসাআছে। এক্সন ২১ এরচিকিৎসানেই।ডক্টররেফআশাবাদী।বলল।” আমরাদুটোঔষধএকসাথেদেবো, প্র্তিতিনসপ্তাহপরপর”।তাতে আশা করছি টিউমার টা ছোটো হয়ে যাবে”। এসে ছিলো কৌশিকের বোন Ohio থেকে। সেবা করে ছিলো আড়াই মাস। দাড় করিয়ে ছিলো কনাকে চলার মত করে। এসে ছিলো দেশ থেকে কনার ভাবী, এসে ছিল বোন। তাদের সেবা কৌশিক দেখেছে, দেখছে তাদের অকেলানত পরিসরম। কৌশিক নিভর্তে চোখের জল ফেলেছে। বিধাতার কাছে প্র্াথর্না করেছে তার জীবনের পরিবর্তে কনার জীবন ফিরিয়ে দিতে।এই অসহায় মুহুর্তে কৌশিক ,কনার পাশে এসে দারিয়ে ছিল বিয়াইন (সুসানতুর শাশুড়ি), দাড়িয়ে ছিল জলি ভাবি, চমন ভাবী, রিতা ভাবী। কৌশিক জানে তাদের সেবার ৠন কোন দিন শোধ দেবার নয়। নিঃস্বার্থ ভাবে তারা করে গেছে।
কনা ভালোর পথে। তবুও এ রোগের কোন বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস নেই বলেই সুসানত খোজ নিয়েছে Yale University তে। ওরা বলেছে, সব দরজা যখন বন্ধ হয়ে যাবে তখন এক মাত্র্ উপায় Clinical Trial Medicine.যদি কাজ হয়। কৌশিক মনের জোড় ফিরে পায় কনার শারিরিক সুস্থতা দেখে। বলে, চলো দেশ থেকে ঘুরে আসি। গিয়ে ছিলো। কৌশিক দেখে ছিলো কনার উচছলতা দেশের মাটিতে। যত টুকু আনন্দ করার তা সে করে ছিলো। হয়ত তার অদ্রিশট বুঝতে পেরেছিলো এই তার শেষ আনন্দ।
দেশ থেকে ফিরে এলো। ঔষুধের কর্মোক্ষমতা একটা একটা করে কমতে থাকলো। কনা বুঝতে পারলো তার সময় বেশি নেই। বলল, “সুসমিতা কে ডাকো।” সুসমিতা কে বলল, মা তুমি রেজ কে বলো ওর বাবা মা কে বলতে, আমি থাকতে থাকতে সবকিছু করে দিয়ে যেতে চাই” রেজ সুসমিতার সমপরকো কৌশিক কনা জানে। রেজের বাবা মাকেও ওরা চেনে। অনেক আগের পরিচয়। রেজের বাবাও ফারমাসিসট। কৌশিকের তিন বছরের সিনিয়র। বিধাতার আশীর্বাদে সূশটো ভাবে সম্পন্ন হলো ওদের বিবাহ। রেজকে কনার খুব পছন্দ। কৌশিকের ও।
কনার শাস কোষ্ঠও ক্রমেই বাড়তে থাকলো। কৌশিক কে ডেকে বলল,”আমার সময় এসে গেছে সোনা”। কৌশিক পাগলের মত ছুটে গেলো Yale University Smilow Cancer center এ, বলল,” ওকে Clinical Trial Medicine দাও,”
দেওয়া হলো। কাজ হলো না। সে তখন কষ্টের শেষ সীমায় পৌছে গেছে। কৌশিক কে কাছে ডেকে বল, বাই। কেনো এমন বলছো। ধীরে ধীরে বলল, আমাকে যেতে দাও। কনা চলে গেলো।
কান্নার রোল উঠল Smilow Cancer Center এর ২২২ কক্ষে। কাদঁছে ছেলে সুশান্ত, কাদছে মেয়ে সুস্মিতা। কৌশিক চোখের পানির অঝোর ধারাকে ধরে রাখতে পারেনি। চোখের পনিতে ঝাপসা হয়ে আসা দৃশটি ফেরাতে পারছিল না কনার দিক থেকে। সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ওকে। মুহুর্ত কয়েক আগেও যে ছিল জীবন্ত , এখন সে লাশ। কেনসারের সাথে কনার আড়াই বছরের লড়াই শেষ হয়ে গেল। জীবনের সব আড়ম্বর হারিয়ে সে আজ রিক্ত হাতে বিদায় নিল। নিঃশেষ হয়ে গেল কৌশিক। দীর্ঘ প্রায় চল্লীশটি বছর পায়ে পা মিলিয়ে পথ চলেছে যার সাথে, হাতে হাত ধরে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে গেছে যার সাথে, সে আজ তাকে অসহায় ফেলে রেখে চলে গেল। চলে গেল সেই রহসময় অজানা জগতে, যেখান থেকে কেউ আর কোনোদিন ফেরে না।
কৌশিক আজ একলা বসে সৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে দেখে চল্লিশটি বছরের বিবাহিত জীবনে একটা দিনও খুজেঁ পেলোনা যেখানে হাসি আর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু ছিল। বাড়ীটার আনচে কানাচে তার স্রীতী এখনও উজ্জ্বল। যেদিকে তাকায় ওর অস্তিত্ব অনুভব করে। কোথাও শান্তি পায়না। শান্তি পায় যখন তার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে। চারিদিক নিস্তব্ধ। কোন হট্টগোল নেই। শান্ত পরিবেশ। মাঝে মাঝে গাংচিল উড়ে যাচছে। হাত টা এগিয়ে দিয়ে বলে,” সোনা আমি তোমার কাছে আছি, তোমার পাশে।মনে হয় সে হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে , সোনা অনেক দিন তুমি আমার হাত ধরোনা , এবার ধরো।
চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবন ,তার আগে তিন বছরের জানা শোনা। এই ৪৩টা বছর কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতে পারলো না। কৌশিকের মনে হয় এইতো সেদিন। মনে হচ্ছে শুরু তেই সব শেষ হয়ে গেল। কৌশিকের চিৎকার করে বলতে ইচছা করে , দিস ইজ নট ফেয়ার, লাইফ ইজ নট ফেয়ার।
বিশাল বাড়ীটা আজ শূন্যতায় গ্রাস করছে। ছেলে মেয়েরা যার যার বাসায় চলে গেছে। ওদের নতুন দুটো পাতানো সংসার কনা দেখে গিয়েছিলো। ছেলে মেয়ে ছিল তার চোখের মনি। যখন জীবনটা পরিপুরনতায় বিকশিত হলো, কৌশিক তাকিয়ে দেখে তার চারপাশে সব রইল শুধু রইল না সে।
শূন্য বাড়ীতে আজ সে একা। স্রীতীর ভারে আজ সে ক্লান্ত। জানেনা এর শেষ কোথায়।
দুমাস পেড়িয়ে গেছে। মনের ভীতরের ক্রন্দন থামে না। আজ এই অসহায় একাকিততে তার সৃতির পাতাগুলি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ যেন এক সেলুলয়েডের ফিতা, একটার পর একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে আসছে। এ সূতি যে এত হৃদয় বিদারক তা সে আগে বোঝেনি। এ যনত্র্না তো দারিদরের যনত্র্না নয়, এতো পায়ে কাটা ফুটার যনত্র্না নয়, এ হৃদয় নিংড়ে নেওয়া যনত্র্না। এ যনত্র্না শুধু সেই উপলবধি করতে পারবে যে এই পথ দিয়ে পায়ে পায়ে চলেছে। ঝাপসা চোখে দুরে তাকিয়ে থাকে মনে হয় সিড়ি দিয়ে সে নেমে আসছে ওপর থেকে। এখনি শুনবে তার কণ্ঠস্বর, ওটমিলটা বসিয়েছ? প্র্টিন একটু কম দিও। না সেই কণ্ঠ সে শোনে না। সে আসে না। সে নেই।
অনেক দিন তো হয়ে গেলো, তবু কৌশিকের চোখে জল ভেসে আসে। ছেলে সুশান্ত, মেয়ে সুস্মিতা ,বৌমা, জামাই সবাই পালা করে রযেছে কৌশিকের সাথে। একলা থাকতে দিতে চায়না। পাছে কিছু হয়। ওরাও ওদের মা কে হারিয়েছে। ওদের মনের বেথা অপরিসীম। কনা যত দিন ছিলো ওরা প্র্তি বলদিন প্র্তি রাতে ফোন করতো। ফেস টাইমে দেখতো তাদের মা কেমন আছে। সুস্মিতা তার মাকে ডাকত গরজ বলে (মানে গরজিয়াস)।
দিনের শেষে সন্ধ্যা নামে। কৌশিকের কাজ শেষ, বাড়ী ফেরার পালা। জানে কেউ অপেক্ষা করছে না তার জন্য। সারা দিনের ভালো মন্দ ঘটনা গুলো শোনানোর মানুষটা আজ তার হারিয়ে গেছে, চলে গেছে অজানা দেশে। চাবি দিয়ে দরজাটা যখন খোলে, নিস্তব্দতা তাকে গ্রাস করে। মনে হয় ভুতুরে বাড়ী। মেয়ে কোন এক সময় এসে সাজিয়ে রেখে গেছে ভাতের থালা। গরম করে খেয়ে নেবে। সেই পাচঁ পদের বাটিতে সাজিয়ে রাখা দিনগুলি আজ আর নেই। কৌশিক জানে একটু পরে ফোনটা বেজে উঠবে, ছোট বোন রিনা কল করবে। বলবে,”দাদা ভাত খেয়েছ? ওষুধটা খেতে ভুলোনা।” রাত বাড়লে ধীর পায়ে কৌশিক সিড়িঁ বেয়ে উপরে উঠে যায় ঘুমাতে। বিছানায় এখন দুটি বালিশ পাশাপাশি সাজানো আছে। কেন তা সে জানেনা। হয়ত তার অবচেতন মন এখনো ভাবে সে হয়ত আসবে। নীস্তব্দ ঘর। এপাশ ওপাশ করতে করতে রাতটা কেটে যায়।
সাত সকালে সেই পরিচিত মধুর ডাকটা আর শোনেনা। যখন কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি সে, কনা বলতো, সেল ফোনটা নিয়েছ? মানিবেগটা কোথায়, চাবি নিতে ভুলোনা। সে কণ্ঠ আর নেই। সে কণ্ঠ হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। আজ তার পরিবর্তে সকাল পৌনে সাতটায় রিনা ফোন করে বলে, সব কিছু নিয়ে বেড়িও ছোটদা, সাবধানে গাড়ী চালিও।
কৌশিকের কাছে মনে হয় জীবন বেহালার তার ছিড়েঁ গেছে, সুরটা আর ঠিক মত বাজছে না। এ তার আর কখনই জোড়া দেবার নয়। এ আর ঠিক হবার নয়। তবুও নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিতে প্র্তি সপ্তাহে কৌশিক গিয়ে বসে থাকে সেখানে, যেখানে কনা ঘুমিয়ে আছে। চড়া রোদ, যেখানে সে ঘুমিয়ে আছে, জায়গাটা রুক্ষ। আর সেখানে মাটি নয় বালি।পার্ক কর্মকর্তাদের কে কৌশিক বলল,” একটা ছোট মাপেল গাছ লাগাতে পারি ওর কবরের পাশে? একটু ছায়া হবে।” ওরা বললো,” না, তা হবেনা।” তা হলে? কৌশিকের মন ছটফট করতে লাগল। সারাক্ষনই মনে হতে লাগল, এই রুক্ষতা তো ওর সইবে না। নিয়ে এলো সে তিন বস্তা মাটি। ছড়িয়ে দিলো কনার কবরের উপর। সেই সাথে ঘাসের বিচি। ঘাস বড় হবে , রুক্ষতা চলে যাবে। কবরের ওপর ঘাসের একটা আবরন হবে। হয়ত কিছুটা শান্তির ছায়া নেমে আসবে তাতে।
অনেকে বলেন সব কিছুর পিছনে একটা মানে আছে। ওর চলে যাওয়ার পিছনে কি মানে ছিল?
একথা কৌশিক কাকে জিগগাসা করবে? যাকে জিগগাসা করতে পারতো সে তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবু জানতে ইচছা করে এতো সুখ যদি সে দিয়েছিলো তবে এত তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন? বড় সাঁধ ছিলো কনার নাতি পুতি দেখার। বলত, ওদেরকে আমি ইসপয়েল করে দেবো আদর দিয়ে দিয়ে। তা আর হলো না। গাড়ী চালাতে চালাতে একটা গান কৌশিকের মনের ভেতর গুমরে ফেরে,” আমার জীবনের এত হাসি এতো খুশি আজ কোথায় গেলো,”। এই পথ দিয়ে অননানন যারা গেছে তারাও কি কৌশিকের মত জীবনের সমাধান খুজতে চেয়েছিল? কৌশিক ভাবে, যে পথের শেষে আলোর নিশানা নেই সে পথে চলে লাভ কি? তবু চলতে হবে।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে কৌশিকের। কিনতু তা হলে তো চলবে না, আজ তো তার গুছানোর পালা।
কনার ক্লোজেট টা খুলে দেখে এখনো সাজানো রয়েছে ওর চলে যাওয়ার আগে যে কাপড় গুলো সে নিয়ে এসে ছিলো ধোপার দোকান থেকে। থরে থরে সাজানো তার শাড়ীর বহর। সুসমিতা, বৌমা ভাগ করে নিয়ে যাবে সেগুলো।
ছেলেমেয়েরা বলে, “ বাবা বাড়ীটা বিক্রি করে দাও। এতে তোমার অনেক স্রীতী জড়ানো,” সুসমিতা বলে,” তুমি আমার কাছে থাকবে। তোমার স্বাধীনতাতে কোন হস্তক্ষেপ হবেনা। তোমার ছোট একটা ঘর থাকবে তোমার নিজেস্ব।” তাই কি? ছোট একটা ঘরে গেলে কি কৌশিকের সৃতি কৌশিক কে কাতর করবে না। পেছনের সুখময় দিনগুলি কি তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে না? এই স্রীতী তো তার মনের প্র্তিটি রন্দ্রে রন্দ্রে গাথাঁ হয়ে রয়েছে। সুসানত সুসমিতা বলে, তোমার নাতি পুতি হবে। ওদেরকে নিয়ে তোমার দিন কেটে যাবে আববু।
হয়ত তাই। কৌশিক ভাবে নাতি-পুতি এলে ওদেরকে আকাশের চাদঁটা দেখিয়ে বলবে,” ঐ দেখ ওটা হচছে অজানা দেশ। ওই খানে তোদের নানি দাদি রয়েছে। ওখান থেকে সে তোদেরকে চুমো দিচছে।” যখন ওরা আসবে হয়ত শান্তি পাবে ওদের কে আকড়ে ধরে।
প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো কনা চলে গেছে, রেখে গেছে এক বিরাট শূন্যতা কৌশিকের জীবনে।
ঈদের দামাঢোল বাজছে, কৌশিকের ঘর অন্ধকার। জ্বলছে শুধু বসার ঘরের আলোটা। টুং করে সেল ফোনে শব্ধ হলো, মেসেজ এসেছে, কাল ঈদ। এমন তো ছিলোনা ঈদের আগের দিন। কনার হাড়ি পাতিলের শবদে মুখর হয়ে থাকতো বাসাটা। কৌশিক বলত,” কখন শেষ হবে তোমার এই টুংটাং।
কনা বলত, অনেক রাত হবে, তুমি ঘুমাতে যাও। কৌশিক বলত,” রসমালাইয়ের জন্য তোমার বানানো ছানাটা গোল করে দেবো? সে বলত, না, ও তুমি পারবে না। নাছোড়বানদা কৌশিক বলত, বাসন পাত্র্ গুলি ধুয়ে দেবো? তাই দেও। কৌশিক বলত,” এত কিছু বানাচছ, কজন লোক আসবে? সে তুমি বুঝবেনা এটাই আমার আনন্দ। কিনতু আমার মনে হচ্ছে তোমার কষ্ট হচ্ছে। কনা কথায় কান দিতো না বলত,” বক বক না করে ওপরে ঘুমাতে যাও”। আচছা যাচ্ছি। কৌশিক জানে ঘুম তার আসবে না যতক্ষন না সে আসবে। কনার আসতে আসতে রাত প্রায় দুটো হয়ে যাবে। সেই দিনগুলি আজ কোথায়। সেই দিনগুলি চিরতরে হারিয়ে গেছে ।
কৌশিক তাকিয়ে আছে টিভি টার দিকে, ওটার পর্দা টা কালো, চলছে না। ইচছা করেই সে চালাই নি। ভালো লাগছে না। একটা অস্থিরতা তাকে তারিয়ে ফিরছে। মেয়ে সুসমিতা আর রেজ আসবে অনেক রাতে। ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে কৌশিক। কনার ওয়ারডরোবটা খুলে ভাজে ভাজে রাখা শাড়ীগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলো। ভাবলো বেচে থাকলে কোনটা সে কালকে পরত। চোখ ভিজে আসাতে বনধো করে দিলো ওয়ারডরোবটা। আলোটা নিভিয়ে নিসংগ বিছানায় বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পড়লো।
আজ ঈদুল ফিতর। প্র্থম জামাত আটটায়। সুস্মিতা আর রেজ কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কৌশিক।অনেক লোক এসেছে জামাতে। নামাজ শেষে কোলাকুলি। এটার আনন্দই আলাদা। মেয়ে বলে,” তুমিতো হাত মিলাতে পছন্দ করো আববু”। হা, করি। তবে ঈদের কোলাকুলি একটা ভিন্ন আনন্দ আছে।
কিন্তু আজ আর সেই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দটা কৌশিকের অনুভবে আসছে না। কিছুতে যেন আনন্দ পাচ্ছেনা সে। কেন তা সে জানেনা। বুকের ভেতর একটা বিরাট শূন্যতা। দুই একজন সহানুভুতি জানালো। দুই একজন উপদেশ দিলো, কি করা উচিত, কি করা উচিত না। কৌশিক শুধু শুনলো।
আজ কৌশিককে যেতে হবে সেই জাগায় যেখানে কনা ঘুমিয়ে আছে। লাল গোলাপ কিনেছে সে। লাল গোলাপ ছিল কনার খুব পছন্দের।সুশান্তর শাশুড়ি জিবু বিয়াইন বললেন,” কৌশিক ভাই আপনি কবরস্থানে যাবার সময় আমাকেও নিয়ে যাবেন।” বিয়াইন তার স্বামী হারিয়েছেন পাচঁ বছর হয়ে গেল। তার মনটাও কৌশিকের মতো কেঁদে বেড়াচছে।। বেড়িয়ে পড়ল কৌশিক সবাইকে নিয়ে। কবরস্থান ঘণ্টা খানেকের পথ। গাড়ীতে অরুন বিয়াইন, জিবু বিয়াইন, বৌমা, বুসরা। বুসরা বৌমার খালাতো বোন। কথা বলতে বলতে কৌশিক জিবু বিয়াইনকে জিজ্ঞাসা করলো,” আপনি অনেক শক্ত মনের দিক থেকে,। কি ভাবে হলেন।” তিনি বললেন,” সব আল্লার ইচছা, বান্ধার কিছু করার নেই,” আপনি তো আল্লা আর বান্ধা নিয়ে বেশ আছেন, আমি পারছিনা কেনো” প্রশ্ন কৌশিকের।
ওরা পৌছে গেলো কবরস্থানে। আকা বাকা পথ ধরে গাড়ি যাচছে সেখানে যেখানে চির নিদ্রায় শায়িত। অনেক লোকের সমাগম আজ। এসেছে প্রিয়জনের কবর যিয়ারত করতে। কেউ কাদঁছে, কেউ বসে কলমা পড়ছে। ঝিরঝির বাতাস বইছে।
শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। গাড়িটা দাড়ালো। যেখানে দাড়ালো সেখান থেকে কিছু দুরেই কনার কবর। বৌমা রক্ত গোলাপ গুলো নিয়ে এলো। বুসরা পাশে, জিবু বিয়াইন আর অরুন বেয়ান দাড়িয়ে একটু দুরে। এই প্র্থম একটা ঈদ, যে ঈদে কনা কৌশিকের পাশে নেই। জিয়ারতের পর কৌশিক বলল,” আমিতো তোমার কাছে এসেছি, সোনা, আমার ঈদ তো আজ এখানে।”
চোখে জলের বাধ মানছে না। কৌশিকের মনে হলো কনা বলছে, কেদোঁ না, আমি তো তোমার পাশেই আছি। তোমার মধ্যেই আছি, তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাইনি। বৌমা আর বুসরা কৌশিককে জড়িয়ে ধরে বলল,” কেদোঁ না বাবা কেদো না।” বৌমার বাবাও শুয়ে আছে এখান থেকে কিছু দুরে। ওর মনের কথা কৌশিক বুঝতে পারছে, ও প্র্কাশ করছেনা। বেয়াই এর কবর। জিবু বিয়াইন দুরে দাড়িয়ে। এটই হয়ত নিয়ম। কৌশিক জানেনা। তার চোখ কালো চশমার নিচে নিশ্চয় ছলছল করছে। দু ফোটা জল হয়ত গড়িয়েও পড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। বৌমা কাদছে। কৌশিক যেদিকে তাকায় দেখে সবারই মুখ মলিন। কিছু দুরে একটা নতুন কবর খোঁড়া হয়েছে। কোন অভাগার বুকের ধন সবাইকে কাঁদিয়ে আজ এসেছে এখানে ঘুমাতে।
সবাই বলল, চলো এবার সময় হয়েছে, ওদের কে বিদায় দাও।
কৌশিককে যেতে হবে সুস্মিতার শশুড় বাড়ী। সেখানে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর হয়ে গেলো। কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লো কৌশিক। ভীষন ক্লান্ত সে। জিবু বিয়াইন কে নামাতে হবে। কেন জানি একটা অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচছিলো। বাসায় চলে এলো। সুস্মিতা পড়ছে। রেয এলে ওরা রেজের বাবার বাসায় যাবে।
রেজ এলো, ওরা চলে যাচছে। সুস্মিতা বলল,” আব্বু তুমি একলা থাকতে পারবে তো।” হা, মা মনি, পারবো। গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে বাই জানিয়ে মেয়ে টা চলে গেলো। ও দেখতে পেলোনা ওর বাবার চোখটা জলে ভর্তি। সেই ভালো। দেখতে পেলে সে কষ্ট পেতো।
ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসে কৌশিকের শরীর। মন চাইছে না বাইরে যেতে। হয়ত যে উদ্দীপনা আগে ছিলো আজ তা ভাটার দিকে। যে নৌকায় সে ভাসতো দমকা হাওয়ায় তার পাল আজ ছিড়ে গেছে।ওটা আর ভাসবে না, ওটা ডুবন্ত। মন চাইছেনা তবু কৌশিক গেলো বিয়ইনের বাসায়। দেখা হলো অনেকের সাথে। সব পরিচিত মুখ। কথা হলো। শেষে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো কৌশিক।
বাহিরে এসে দাড়ালো। অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারিদিক। নিস্তব্ধ রাস্তা। বুকের ভিতর হাহাকার। ও নেই, কেউ নেই। এই প্র্থম একটা ঈদ যে ঈদে কেউ তার পাশে নেই।
একটা চাপা ব্যথা অনুভব করছে বুকে। হয়ত কিছু নয়। গাড়িটা একটু দুরে। পাশের দালানে হেলান দিয়ে একটু দাড়িয়ে নিলো কৌশিক। ব্যথা টা বাড়ছে। Stent লাগানো আর্টারি টা হয়ত বুজে এসেছে। গাড়ীর কাছে এসে পৌছালো কৌশিক। ER এ সে যেতে রাজি নয়। বীভীশিকা ময় ER সে দেখেছে। বাসায় পৌছালো। উপরে উঠে এলো। ব্যথাটা বাম হাতের থেকে উপরে উঠে আসছে। কৌশিক জানে এ কিসের ব্যথা। এর থেকে মুক্তি নেই। শুয়ে পড়লো সে। ভেসে উঠলো কনার মুখ। সে জেনো ডাকছে তাকে। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হলো।সুশান্ত ,সুস্মিতার মুখটা ভেসে উঠলো, ওরা চিৎকার করে বলছে, যেওনা বাবা যেওনা” কৌশিক ফোন টা আকরিয়ে ধরলো। ডায়েল করতে চাইলো ৯১১। কিন্তু পারলো না। ৯-১—- শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। হাত থেকে পড়ে গেলো ফোনটা। নিস্থব্ধ হয়ে গেল চারিদিক। সে চলে গেলো। চলে গেলো কার কাছে। যাকে সে দেখেছিলো, যাকে সে পেয়েছিলো, যাকে সে হারিয়েছিলো তার কাছ
হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে গেল একটা দিন। আনন্দ হাসি গানে ভরপুর একটা দিন। কতদিন এমন আনন্দ হয়নি। কতদিন এমন ভাবে হাসিনি। হাসি তো আর আসে না। আনন্দ তো আর আমাকে হাতছানি দেয় না। পুরো বাড়ি জুড়ে আমার বিষাদ। বিষাদ আমার আস্টেপৃস্টে জড়িয়ে রেখেছে। বিষাদই আজ আমার নিত্যসঙ্গী। বিষাদই আজ আমার প্রিয় বন্ধু।
কতদিন কতদিন হোল সে আমাকে ছেড়ে গেছে। দিনগুলি একটি একটি করে আমার প্রাণের উপর দিয়ে চলে গেছে। একটি একটি দিন, হ্রদয়ে আমার বিষাদের পাহাড় তৈরি করে দিয়ে গেছে। আহা বিষাদ । বিষাদ এখন আমার ভাল লাগে।
এরই মধ্যে হঠাৎ একটা দিন। হঠাৎ সেদিন ওরা এসেছিল কলকল করতে করতে। আমার নীস্তব্দ বাড়ীটা হঠাৎ করে জেগে উঠেছিল। জেগে উঠেছিল ওদের কোলাহলে। ওরা এসেছিল একসাথে, এসেছিল আমার ভেতরের নিঃস্বপ্রভো আলোটাকে সপ্রতিভ করতে। হাসির বন্যা বহিয়ে দিয়েছিল। প্রাণ পেয়ে ছিল আমার ঘুমিয়ে পরা বাসাটা। এসে ছিল শেলী, আমিন, সালিমা- ইউসুফ, ফাতেমা- সাইদ ভাই। এসেছিল জীবু বিয়েন, জিজ্ঞাসা করেছিল,” ওরা কবে আসবে শাফি ভাই, আপনের ঘরে উনন জ্বলেনা অনেক দিন। আমিই না হয় জ্বালিয়ে ওদের নাস্তার ব্যবস্থা করবো।”
সেই কাঁক ডাকা ভোঁরে উনি এসেছিলেন , বলতে হয়নি কিছু, নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিলেন সব কিছু। জিজ্ঞাসা করে ছিলাম “ আমি কি কোন সাহায্যে লাগতে পারি.”।
“ না, আজ আপনি আনন্দ করবেন ওদের সাথে, এ দিকটা সামলাবো আমি”।
মেয়ে আমার বলেছিল,” আব্বু, লাঞ্চ এর ব্যবস্থা আমি করবো, তুমি ভেবোনা, ম্যাডিটেরিয়ান খাবার নিয়ে আসবো, তুমি শুধু ওদের সঙ্গ দেবে। এসেছিল সুষমা আর রেজ, সান্তনু আর তাসমিয়া। আমার ঘর ছিল কানায় কানায় ভরা।
দুপুরের আগেই ওদের গাড়ী এসে দাঁড়ালো আমার ড্রাইভওয়ে তে। হৈ হৈ করতে করতে নেমে এলো ওরা। সবাই ভিতরে আসতেই পরিচয় করিয়ে দিলাম জীবু বিয়েন আর সাথে।
কথা বলছে শেলি, ফাতেমা আর সেলিমা । আমিন আর ইউসুফ কথার ফাকে ফাকে বাহিরে যেয়ে ধূমপান করে আসছে।
গল্প কথায় ওদের সাথে মিশে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল ৪৭ বছর আগের কথা। মেয়েদের সাথে তখন ছিল আমাদের একটা দুরের সম্পর্ক।
সম্পর্ক। কিন্তু একবার কলকাতায় এক্সকারসনে গিয়ে হয়ে গেল ওরা হোল আমাদের অনেক কাছের বন্ধু। সেই বন্ধুত্বই অটুট রয়েছে এতদিনও।
বাহিরে আবহাওয়া টা একটু মিনমিনে। রোদের আভাস কম। বাতাস বইছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে ঠাণ্ডার প্রকোপ টা ততোটা না হলেও, গায়ে গরম কাপড় ছাড়া বের হওয়া যায় না।
আমার মেয়ে জামাই, সুষমা, রেজ এলো এলো ভড় দুপুরে লাঞ্চ নিয়ে। অনেক কিছু নিয়ে এসেছে মেয়েটা। সবাই মিলে সাজিয়ে নিলো খাবার টেবিল। মনে হচ্ছে এ বাসা আমার একার নয়। এ বাসা সবার। সেলীমা, শেলি, ফাতেমা ওরা নিজেরাই সব কিছু খুঁজে বের করে নিচ্ছে নিজের প্রয়োজন মত। বিয়ান জানে বাসার কোথায় কোণটা থাকে। দরকার মত সব কিছুর তত্ত্বাবধান উনিই করছেন।
এক সময় সাইদ ভাই বললও, “ চলো, খাওয়ার পর কল্পনার কবর টা যিয়ারত করে আসি। আজ শুক্রবার। ভালো দিন।” সবাই সমর্থন তার কথায়।
খাওয়া শেষে বেড়িয়ে পড়লাম কবরস্তানের উদ্দেশ্যে। লাল গোলাপ কিনে নিলাম। এক গাড়ীতে সবাই। শেলি বলল, “ দেখো, অদ্দ্রীষ্টের কি পরিহাস, কল্পনা নেই, আমরা যাচ্ছি তার কবর যিয়ারত করতে।”
গাড়ী এসে থামল। নেমে এলাম সবাই। লাল গোলাপ ওর খুব পছন্দ ছিল। রেখে দিলাম ওর কবরের পাশে। আমিন দোয়া করলো। সবার চেহারার মধ্যে মলিনতা। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। কনকনে বাতাস বইছে। এবার ফেরার পালা।
ঘরে ঢুকে দেখলাম সুষমা সুন্দর করে টেবিল সাজিয়ে রেখেছে বিকালের নাস্তার জন্য। কফিটা দরকার । না এবার হবে চা র প্রস্তুতি। বললাম, আমি ভালো মসলা চা বানাতে পারি। বিয়ান সমর্থন দিলো।
অনেক দিন পর আবার প্রান খুলে হাসলাম ওদের সাথে। ফাতেমা আনন্দে আত্মহারা, স্লাম্বার পার্টি হবে আজ। কারো মাঝে আজ নৈরাশ নেই। আছে উদ্দাম উচ্ছল আনন্দ। এই ভাবে যদি জীবনটা চলে যেতো। কিন্তু তা তো হবার নয়।
রাতের খাবার বিয়ান আর সুষমা মিলে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। খাওয়া শেষে বিয়ানের যাবার পালা। খাওয়া শেষে বিদায় নিয়ে তিনি গাড়ীতে স্টার্ট দিলেন।
রাত গভীর। ঘড়ির কাটায় ২ টা। আমাদের আড্ডা চলছে। টিভি’র পর্দায় মুভি চলছে একটার পর একটা। অবশেষে সময় হোল আসর ভাঙার। এলিয়ে দিতে হবে সারা দিনের পরিশ্রান্ত দেহটাকে বিছানায়। জানি ঘুম আমার আসবে না। ওরা বেছে নিয়েছে যার যার ঘর। আলো নিভিয়ে দিলাম।
সকালে উঠে নিচে নামতেই দেখলাম আমিন বসে আছে। কফি আমাদের দুজনেরই প্রিয়। ফোন টা বেজে উঠল। এই সাতসকালে বিয়ানের কণ্ঠস্বর।
তিনি এসে নাস্তা বানাতে চান। বলেছিলাম প্রয়োজন হবেনা ।
কিন্তু যথা সময়ে তিনি এসে হাজির। মুখে হাসি। কোন কিছুতে তার না নেই। অনেক করেছিলেন চির বিদায় নেয়া আমার আনন্দ , আমার চল্লিশ বছরের জীবনসাথী কল্পনার জন্য। আজও করে চলেছেন ।
সব পর্ব শেষ। এবার সবাই মিলে জাক্সন হাইটসে যাবো। সাইদ ভাই এর পকেট ভেঙ্গে আমরা লাঞ্চ করবো। বিয়ান যেতে চাইলন না। তাকে যেতে হবে অন্য খানে।
জাক্সন হাইটসের রেস্টুরেন্টে ঢুকেই শেলির মনে হোল সে ভীষণ ক্ষুধার্ত। একের পর এক সে আনতে বলছে নানান খাবার। বললাম, ধীরে শেলি, ধীরে। খাওয়া শেষে উঠে পড়লাম। ওদের যেতে হবে দূর পাল্লায়। শেষ হয়ে এলো আনন্দ ভরা ৩০ টা ঘণ্টা। কোণ দিক দিয়ে কাটল এতোটা সময়। মনে হচ্ছিল, সময় টা কেন আরও দীর্ঘ হোল না। তাহলে তো আরও কিছুক্ষণ আনন্দ ফুর্তিতে কাটানো যেতো। আরও কিছু সময় মুক্ত থাকা যেতো বিষাদ থেকে। কিন্তু সময় তো থেমে থাকেনা। ঘড়ির কাঁটাকে তো থামানো যায়না। কাল তো বয়ে চলে নিরবধি। আমার কি ক্ষমতা তা বেঁধে রাখি। ?
বন্ধুদের বিদায় নেয়ার সময় এলো। আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওরা চলে গেল। আমি আবার ফিরে এলাম আমার সেই পরিচিত বলয়ে। সেই বলয়ে যেখানে কেটে যাচ্ছে বিষণ্ণতায় ভরা আমার একাকী দিনগুলি। ফিরে এলাম হঠাৎ একদিনের কল-কাকলীতে মুখর হয়ে ওঠা আমার সেই নীস্তব্দ বাড়ীতে। আমি ফিরে এলাম আমার নিজের জগতে। আলো নেবানো ঘরে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দৃস্টি মেলে দিলাম সামনে। কি দেখতে চাই দুচোখ মেলে? দৃস্টি আমার কাকে খুঁজে ফেরে অতল আঁধারে? নেই কেউ নেই। নেই, কারো হাসির শব্দ নেই। কারো উচ্ছলতায় বাড়ী টা আজ আর ভরে থাকেনা। যে ছিল, আনন্দ হাসিতে যে বাড়িটা ভরিয়ে রাখত, সে আজ চির নিদ্রায় শায়িত ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালের গভীর শীতলতায়। এখন আমার চারিদিক জুড়ে শুধু অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে আমাকে আস্টেপৃস্টে জড়িয়ে রয়েছে আমার এই সময়ের একান্ত সঙ্গী বিষাদ।