এক অসমাপ্ত গল্প (শেষ পর্ব)

                                                                    এক অসমাপ্ত গল্প  (শেষ পর্ব)

              আকাশ ভেঙ্গে জল ঝরছে। আনন্দ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। লাবন্য আর আমেনা এসেছে আজ চার মাস হয়ে গেলো। কি ধুমধাম করেই না ওরা গিয়েছিল এয়ারপোর্টে ওদেরকে আনতে। সু, দীপ, রেজ, বৌমা গল্পে মেতে গিয়েছিল লাবন্যর সাথে।  লাবন্যকে বুঝতে দিলোনা সে নতুন কোন জাগায় এসেছে। লাবন্যও মিশে গিয়েছিল ওদের সাথে। আমেনার চোখে জল। আমেনা বলেছিল,” দাদা এতো সুন্দর করে ওদেরকে মানুষ করেছিলে কি ভাবে?”। প্রতি উত্তরে আনন্দ বলেছিল,”কৃতিত্ব তার, আমার নয়”।

সানন্দা বাসাতে ছিল ওদেরকে অভ্যর্থনা করার জন্য। খাওয়া শেষে বলেছিল আমেনাকে “ এবার তুমি বুঝে নাও। আমার শেষ, তোমার শুরু”।

“তাতো হবার নয়। আমি তার বোন, তুমি তার বন্ধু। তুমি যা দিতে পারবে আমি তা দিতে পারবো না। তোমার সাথে কথা বলে তার যে আনন্দ, আমার সাথে তা সে পাবেনা। কাজেই তোমার ছুটি নেই, বোন”।

আজ হঠাৎ করে কেন এসব মনে পড়ছে আনন্দ জানেনা।

 “কি ভাবছ কাকুমনি?”

লাবন্য দাড়িয়ে। আনন্দ তাকাল ওর দিকে। খুব সুন্দর করে সেজেছে। বৌমা,সু মিলে শিখিয়েছে কোন রং এর সাথে কোন রং যাবে।

“কোথায় যাবে?”

“দীপ ভাইয়া, সু আর ভাবী আসবে নিতে। আটলানটিক সিটি তে যাবো। তুমি কি ভাবছ”?

সে কথার উত্তর না দিয়ে আস্তে করে ওর কপালের চুল টা সরিয়ে দিলো আদর করে।

ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল মহীউদ্দীনের কথা। মেয়েটাকে সে দিয়ে গেছে তার হাতে। এ যে কত বড় দায়ীত্ব আনন্দ ছাড়া আর কেউ জানেনা। মানুষ করে দিয়ে যেতে হবে ওকে। তুলে দিতে হবে ভাল পাত্রের হাতে। আনন্দের কতটুকু সময় আছে সে নিজেও জানেনা।  ওর জন্য একটা ফান্ড খুলেছে বাঙ্কে। আনন্দের অবর্তমানে দীপ আর সু র উপর দায়ীত্ব দিয়েছে দেখাশুনা করার।

দীপ আর সু বলেছিল,” তোমার এই হার্ট ব্রেকীং কথা বার্তা একটু থামাবে?”। সানন্দাও তাতে যোগ দিয়েছিল। আমেনা অন্য দিকে তাকিয়ে শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছেছিল।

সু র চীৎকার শুনে আনন্দ ফিরে তাকাল। চীৎকার লাবন্যর সাঁজ দেখে। “ অপূর্ব লাগছে দেখতে। খুব সুন্দর হয়েছে”,

বলে আনন্দের কাছে এসে বলল,” কেমন আছো আব্বু?”।

“ ভাল, কখন ফিরবে?”।

“রাত হবে, লাবন্য আমাদের বাসায় থেকে যাবে”। বলে আমেনার কাছে চলে গেলো।

কথা শেষে ওরা উঠে গেলো গাড়ীতে। আনন্দ তাকিয়ে থাকলো। গাড়ীটা মোড় নিতেই আনন্দ ফিরে তাকিয়ে দেখল আমেনা পাশে দাড়িয়ে।

“বলবি কিছু?”

“তুমি বেশি আস্কারা দিচ্ছ মেয়েটা কে’?

“ ভাবিস না। এদেশে থাকলে এদেশের মতো করে মানুষ করতে হবে। কিছুটা ছাড়তে হবে আবার কিছুটা টানতে হবে”।

“ তুমি যা ভাল বোঝ তাই কর”।

“ সানন্দা আসবে না আজ?” জিজ্ঞাসা করল আনন্দ

“আসবে, একটু দেরী হবে বলেছে”। বলে আমেনা চলে গেলো রান্না ঘরের দিকে।

   বাহিরে বৃষ্টি। তবুও জানালাটা একটু খুলে দেবে ভাবল। ঘরটা গুমট হয়ে রয়েছে। তাপমাত্রা আজকে নব্বই এর উপরে যাবে। জানালাটা খুলতে যাবে ফোন টা বেজে উঠল। ফ্লরেন্তার ফোন। অনেকদিন ওর সাথে কথা হয়নি আনন্দের।

হ্যালো বলতেই ফ্লরেন্তা  কল কল করে উঠল। মনে হোল তার মন আজ আনন্দে ভরপুর।

“কি ব্যাপার? খুব মুডে আছো মনে হচ্ছে?”

“ সত্যি তাই। একজনের সাথে ডেটিং করছিলাম অনেকদিন ধরে। মনের মত। গতকাল সে প্রপজ করেছে”।

“কনগ্রাচুলেশন! তা সে ভাগ্যবানটা কে?”

“দেখা হয়েছিল আমার এক বান্ধবীর পার্টিতে”।

“ আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি। শুভদিনটা জানিও। অবশ্যই যাবো”। বলল আনন্দ।

কথা শেষে জানালাটা খুলে দিলো। বৃষ্টিটা কমে এসেছে।

কখন যে আমেনা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি আনন্দ। “ কিছু বলবি?”

“ কে ফোন করেছিল?”

“ ফ্লরেন্তা, মনে আছে তোকে বলেছিলাম, লন্ডনে থাকে। ওকে প্রপজ করেছে ওর ফীয়ান্সে”।

“একটা কথা বলি দাদা”  “বল”

 “ কয়েক দিন থেকে দেখছি তুমি বুকের বা পাশটা হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখো।  কেন”?

“ ওসব নিয়ে তোর  চিন্তা করতে হবেনা।“ বলল আনন্দ

“ আমি সানন্দা দি আর সু কে বলব ভাবছি। যদি কিছু করতে পারে তবে তারাই পারবে”।

আর একটা কথা আছে।

কি?

“একটু চিন্তা করে দেখবে কি? অনেক দিন তো হোল”।

 আনন্দ তাকাল আমেনার দিকে। কিছু বলল না।

ডি অ্যান্ড জে আবার ভরে উঠেছে কোলাহলে। রাশেদ ছাড়াও আরও দুজন যোগ দিয়েছে এই ফার্মে। ডেভিড একদিন আনন্দকে ডেকে নিয়ে বলেছিল ,” এবার আমার গুছানোর পালা। রিটায়ার করব ভাবছি। জেনীফারও চাচ্ছে অবসর নিয়ে বাকি দিন গুলি একসাথে ঘুরে বেরিয়ে কাটিয়ে দিতে”।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল, “ কবে নেবে। চিন্তা ভাবনা করছো কিছু ?”

“খুব তাড়াতাড়ি। তুমি কিছু ভাবছ কি”?

না, উত্তর দিয়ে ছিল আনন্দ। “ জানি বয়স অনেক হোল। সব ছেড়ে দিলে বুড়ীয়ে যাবো তাড়াতাড়ি। আজকাল বাহিরে একেলা যেতে ভরসা পাইনা। দুটো স্টেনট লাগানো। যদি কিছু হয় তবে এখানেই হোক। বাহিরে কিছু হলে টানা হেঁচড়া করবে কে?”

কথা ওখানেই শেষ হয়েছিল।

 তিন টা বছর চলে গেলো জীবনের খাতা থেকে। কত কিছুই ঘটে গেলো। লাবন্য চলে গেছে হোস্টেলে। ডেভিড অবসর নিয়ে বাস করছে ফ্লোরিডায়। দীপ আর সু র পরিবারে যোগ হয়েছে দুটো কীউটি পাই।

ডেভিডের ফেয়ারওয়েল পার্টি হয়েছিল খুব ধুমধাম করে। সবাই এসেছিল। এসেছিল বেলাল-কল্যানী, এমিলির বাবা,মা, এসেছিল জনের মা। আনন্দ বলেছিল সবাইকে। ওদের মধ্যে দেখেনি কোন হিংসাত্মক ভাব। ডেভিড সবাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিল সে যা পেয়েছে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু নয়।

এক অলস বেলায় আনন্দ বসেছিল Drawing রুমে। নতুন একটা বই দিয়েছে তার বন্ধু ফেরদৌস। সেই বই এর মধ্যে ডুবে ছিল। অন্ধের কাহিনী। জন্মান্ধ। পৃথিবীর সৌন্দর্য সে দেখেনি। নিজে তৈরী করে নিয়েছে। সে দেখেনি সুন্দরের পাশে অসুন্দর। অপূর্ব লেখা।

কলিং বেলটা বেজে উঠল। একটু বিরক্তই হয়েছিল আনন্দ। এই ভঁর দুপরে কে এলো?।

আমেনা দরজাটা খুলে বলল,” এসেছ, এসো”। মনে হোল যে এসেছে তাকে সে আসা করছিল।

আনন্দ তাকাল। Drawing রুম থেকে দেখা গেলনা। জিজ্ঞাসা করল,” কে এসেছে আমেনা?”

“সানন্দা দি”।

সানন্দা, এই সময়?

“কেমন আছো?” বলে এসে দাঁড়াল সে।

“ এই ভঁর দুপুরে?”

“কেন? আসতে নেই? এসেছি আমেনার সাথে গল্প করতে”।

আনন্দ হাসল। সানন্দা চলে গেলো আমেনার ঘরে।

আনন্দ বইটা উঠিয়ে নিলো চোখের সামনে।

“দাদা”।

ডাক শুনে তাকাল আনন্দ। আমেনা আর সানন্দা সামনে দাড়িয়ে। মনে হোল কি যেন হয়েছে। হাসি হাসি মুখ নয়। আনন্দের বুকটা ধক করে উঠল।

“ কি কিছু বলবি?”

“হা। লাবন্যর ব্যাপারে”।

“ কি হয়েছে ওর?”

“একজন কে তার পছন্দ। তবে–”।

“ কে সে?”

“এদেশি” ভয়ে ভয়ে বলল আমেনা। “ আমেরিকান”।

“তা অসুবিধাটা কোথায়? যদি উদার মন হয়। আমার মেয়েকে ভালবেসে সুখী রাখতে পারে সারা জীবন, তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই”।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমেনার। ভেবেছিল আনন্দ রাজি হবেনা। যদিও সানন্দা বলেছিল,” দেখো, তোমার দাদা আপত্তি করবেনা যদি ছেলে ভালো হয়”। সানন্দা আজ এসেছিল শুধু আমেনাকে সাহস দেওয়ার জন্য। কথার জের টেনে সে আমেনার দিকে তাকিয়ে বলল,” তোমার দাদাকে বলেছ যে ছেলে মুসলমান হতে রাজি আছে”। আমেনা মাথা নেড়ে সাই দিলো। আনন্দ দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,” তোমার মেয়েকে বলো, ওকে একদিন ডিনারে নিয়ে আসতে। সু,দীপ,রেজ বৌমা কেও ডেকো। যদিও জানি ওরা সবই জানে”। একটু থেমে বলল,” এক কাপ কফি নিয়ে আয় আমার জন্য”। আমেনা যাওয়ার আগেই সানন্দা বলল,” তুমি বিশ্রাম নাও আমি বানিয়ে আনছি”।

বইটা সরিয়ে রেখে আনন্দ কফির কাপে চুমুক দিলো। সানন্দা সামনে বসা।

“ কিছু বলবে?”

“ কার্ডিওলজীস্টের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করেছি আগামীপরশু সকাল দশটায়। আমি নিয়ে যাবো”।

আনন্দ জানে এখানে দর কষাকষি করে লাভ নেই। অগত্যা মাথা নেড়ে সাই দিল। বলল,” এই ভাবে আর কতদিন ঠেকা দেবে।“

“আল্লাহ যতদিন আমাকে দিয়ে করতে দেয় ততদিন করে যাবো”। বলে খালি কফির কাপটা হাতে নিয়ে উঠে গেল রান্না ঘরের দিকে।

আরও একটা বছর কোথা দিয়ে চলে গেলো। লাবন্যর বিয়ের কথা বার্তা চলছে। মাঝে মাঝে সু, দীপ বিচ্ছু দুটোকে রেখে যায় আনন্দের কাছে। ওরা আনন্দকে ঘোড়া বানিয়ে পিঠে চড়ে খেলা করে। আমেনা হাসে। আনন্দ ভুলে যায় সব কিছু।

সেদিন আমেনাকে ডেকে আনন্দ বলেছিল,” তুই কি জানিস সানন্দা কোথায়? বেশ কিছুদিন হোল সে কলও করে না আসেও না। আমি কল করেছিলাম, উত্তর নাই”।

“ না জানিনে তো,” বলে তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে চলে গিয়েছিল।

বেলা পড়ে এসেছে। পশ্চিমের আকাশ টা লাল রংএ ছেয়ে গেছে। আনন্দ বাহিরে Deckএ বসে চোখ বূজে রবীন্দ্র সংগীত শুনছিল আর ভাবছিল, কত কিছুই না দেখল সে। এমিলি, জন চলে গেলো। ফ্লরেন্তা পেলো নুতন জীবন। ছোট্ট বোবা মেয়েটাও কোথায় হারিয়ে গেলো। মহীউদ্দীনের সেই হাসিতে উদ্ভাসিত উজ্জ্বল মুখ। আর সবশেষে সানন্দা। হাঁ, সানন্দা, ভাবনাটা শেষ হলনা। ডাক শুনতে পেলো।

“কেমন আছো?”

 আনন্দ তাকাল।  সানন্দা। “ এতদিন কোথায় ছিলে?”

সানন্দা সে কথার উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল আনন্দের মুখের দিকে। কি যেন বলতে চাইছে।

“কিছু বলবে?”

“ভাবছি কথাটা কীভাবে বলব। সহজ ভাবে বলার নয়”।

“ তা নাইবা বললে”। বলল আনন্দ।

“ বলতে আমার হবেই। আর সেই জন্যই এই কদিন তোমার সামনে আসেনি। সাহস সঞ্চয় করছিলাম। আজ তোমার সামনে এসে সেই সাহস আমি হারিয়ে ফেলেছি , আনন্দ দা”।

“নির্ভয়ে বলো”।

“আমি চলে যাচ্ছি, আনন্দ দা, আমি চলে যাচ্ছি নিউইয়র্ক ছেড়ে”।

 স্ল্যাইডিঙ্গ ডোরের ওপাশ থেকে ভেসে এলো আমেনার কান্নার ফুঁপানো শব্দ।

আনন্দ চেয়ে রইল সানন্দার দিকে। বুকের মাঝটা খালি হয়ে এলো। মনে হোল অনেক কিছু সে হারিয়েছে জীবনে, আজ আবারও কি যেন সে হারাতে চলেছে।

 অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞাসা করলো, “ কোথায়”?

“ডালাসে, আমার বোনদের কাছে”। বলে চোখ মুছলো ওড়নার আঁচল দিয়ে।

কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে থেকে আনন্দ বলল,” তুমি তো জানো, আমার জীবনটা ছিল আনন্দে ভরপুর, সে তার সব কিছু উজাড় করে দিয়েছিল আমায়। মাঝ পথে এসে একদিন দেখলাম সে নেই। খুঁজেছি তাকে পর্বতের শিখর চুড়ায়। আবার ফিরে এসেছি চার দেয়ালের  মাঝে। খুঁজেছি ঘরে ঘরে। খুঁজেছি ধু ধু মাঠের প্রান্তে  যেখানে সবাই ঘূমায়ে। অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসেছিল। সেই সময় তুমি কোথা থেকে এসে সেই ভেসে যাওয়া নৌকাকে পাড়ে নিয়ে এলে। তোমার সাথে গড়ে উঠল এক অমঘ বন্ধুত্ব। যা ভাঙ্গার নয়। আমি চেয়েছিলাম এক কথা বলার সাথী। তুমি এলে সেই কথা বলার সাথী হয়ে। তুমি বলেছিলে,” সে হারিয়ে যায়নি আনন্দ দা। তোমার পাশে পাশেই আছে। আমাকে দেখো, আমিতো বেচে আছি সন্তানদের আঁকড়ে ধরে। তোমাকেও বাঁচতে হবে”। সেই থেকে তুমি ছিলে আমার পাঁশে।

মনে পড়ে? তোমার বাসায় ডিনার শেষে তুমি বলেছিলে, “এক টুকরো মাছ আছে, দিয়ে দেবো”? সে দেওয়া তো আজও থামেনি, শুধু দিয়েই গেলে, নিলেনা কিছু”। বলে আনন্দ থামল।

“ না,তুমি আমাকে দিয়েছ অনেক, তুমি আমাকে শিখিয়েছ, কি ভাবে কথা বলতে হয়। যে আমি দু মিনিটের বেশি কারো সাথে কথা বলতে পারতাম না, সেই আমি তোমার সাথে ঘণ্টা ধরে কথা বলি, সে তো তোমারই দান, আনন্দ দা। তুমি বলতে, আমি জেনো কখনো  নিজেকে ছোট না ভাবি, বলতে, কখনো বলবে না তোমার কোন গুন নেই। এযে কত বড় প্রেরনা তুমি আমাকে দিয়েছিলে তা তুমি বুঝবে না আনন্দ দা, তা তুমি বুঝবে না। দূরে গেলেও আমি তোমারই পাশে আছি জেনো। আমি যত দূরেই থাকি না কেন তোমার আমার বন্ধুত্ব চিরদিন অটুট থাকবে আনন্দ দা”।

আনন্দ সানন্দার চোখের দিকে তাকিয়ের রইল, কি জেনো খুজছে সে, বলল,”জানি তোমাকেও কোথাও যেয়ে আজ ঠাই নিতে হবে।  তোমারও তো চুলে পাক ধরল। অনেক তো করলে। এবার পাখা গুটিয়ে বসার সময়। আমার জন্য ভেবো না। আমি বাঁচবো, আমি বাঁচবো ওই কিউটি পাঁই দুটোকে বুকে আগলে ধরে, ওদের নানা দাদা ডাক শুনে। ওদের মাঝেই আমাকে বাঁচতে হবে সানন্দা, ওদের মাঝেই আমাকে বাঁচতে হবে। ওর রক্ত রয়েছে ঐ দুটো নিষ্পাপ শিশুর মাঝে। ওরাই আমাকে পথ দেখাবে, ওদের মাঝেই আমি খুজে পাবো তাকে, ওদের মাঝেই আমি খূজে পাবো”।  আনন্দের গলার স্বর ভাঙ্গা।

সানন্দা আনন্দের হাতটা চেপে ধরল। কান্না ভরা গলায় বলল,” কথা দাও, নিজের দিকে খেয়াল রাখবে? ঔষধ গুলি খেতে ভুলবে না? আমার মাথার দিব্যি রইল”। টপ টপ করে চোখের জল পড়লো ওর হাতের পরে।

“কথা দিলাম”।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আকাশে তারার ঝিলিমিলি। দূরে ঝিল্লির ডাক। জোনাকি পোকারা তাদের আলো জ্বালিয়ে ঘুরছে চারিদিকে। নিস্তব্ধ অন্ধকার। তার মাঝে চাপা কান্নার শব্দ। সানন্দা কাদছে। আনন্দ জল ভরা চোখে তাকিয়ে আছে দূরে বহু  দূরে।

                                         সমাপ্ত।

 

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প (১৭ পর্ব)

                                                   এক অসমাপ্ত গল্প (১৭ পর্ব)

    “কোথায় যাবো শুনবে? মালয়েশিয়া”। সানন্দা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। বিশ্বাস হচ্ছেনা।

  “ আকরাম আর আমি এক সাথে লেখা পড়া করতাম।  থাকে কুয়ালা লামপুর। ডাক্তার, কাজ করে এক নাম করা হাসপাতালে। ওর ঐখানে উঠবো। তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে কিছু বলিনি”। বলল আনন্দ।

টিকিট কেটেছ? প্রশ্ন সানন্দার

সব ঠিক। দুদিন পরে রওনা দেবো। সব কিছু গুছিয়ে নিও।

গোছান শেষ। এবার যাত্রা কুয়ালা লামপুর এর পথে। সানন্দা বসে ছিল জানালার পাশে। ওটা ওর প্রিয় জায়গা। বলল,” কোনদিন ভাবিনি এই দেশটা দেখতে পাবো”।

“তোমার ভাষায় উপরওয়ালার ইচ্ছা। তা না হলে কি দেখতে পেতে?”

সারে তিন ঘণ্টা পরে উড়োজাহাজ এসে পৌছাল কুয়ালা লামপুর এর ইনটারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। কাস্টমস ক্লীয়ারেন্স এর লাইনে দাড়িয়ে দেখতে পেলো আকরামকে। ওর পাস থাকাতে চলে এসেছিলো একেবারে কাছে।

বেরিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিলো সানন্দার সাথে।

“তুই শেষ পর্যন্ত এলি তাহলে। কতদিন পরে দেখা”।বলল আকরাম।

গাড়ী চলছে। অপূর্ব দৃশ্য চোখকে আকর্ষণ করে। আকরামের বাসা  হাসপাতালের  কম্পাউনডে। আসতে আসতে দুপুর পেড়িয়ে গেলো।

সুন্দর ছিমছাম বাসা। বড় বড় ঘর। সানন্দা এসেই আকরামের বৌ দীপার সাথে গল্প জুরে দিলো। মনেহোল অনেক দিনের চেনা। এ গুনটা সানন্দার সব সময়। যে পাত্রে রাখো সেই আকার ধারন করে।

আনন্দের সাথে দীপার এই প্রথম দেখা। দীপা এগিয়ে এসে আনন্দকে বলল,” আনন্দ দা তোমার কথা খুব যে একটা শুনেছি তা নয়। তবে দেখে মনে হচ্ছে, কোথায় যেন দেখেছি তোমাকে”।

“ একথা কস্মীন কালেও তোমার স্বামীকে বলবে না। তা হলে —“। কথা শেষ হওয়ার আগেই আকরাম হাসতে হাসতে বলল, “ তোর ইয়ার্কি ঠাট্টা রাখবি? খেতে বস”।

খাওয়া শেষে আনন্দ সোফাতে হেলান দিলো। সানন্দা গেলো তার রুমে।

   বিকেলে আনন্দ সানন্দাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আনন্দ আসার আগে পড়াশুনা করে এসেছে এই জাগার উপর। কি কি দেখবে, কি কি কিনবে।  আনন্দ সনন্দাকে বলল, “ আজতো সময় হাতে বেশি নেই চলো দেখে আসি বড় মল টা ”।

“ তুমি যেখানে নেবে সেখানেই আমি যাবো আনন্দ দা”

“ তোমরা কিন্তু বাহিরে খেয়ে এসোনা”। বলল দীপা ভাবী।

  আনন্দ সানন্দা এলো বুকীত বীনটাং ডিসট্রিক্টএ। নামকরা বড় বড় শপিং মল। হাটার পথে বিরাট ফোয়ারা। পাশে সান বাধানো।

“এ যেন আমাদের ওখানকার টাইম স্কয়ার। তাই না?” বলল সানন্দা।

“ হা, বসবে ওই সান বাধানো জাগায়?” বলল আনন্দ।

  “ না চলো, ওই মলটার মধ্যে।“

  সুন্দর একটা পার্লের নেকলেস পছন্দ হোল সানন্দার।

“ পছন্দ হয়?”

“কার জন্য”। জিজ্ঞাসা করল আনন্দ

“ আমার বড় মেয়ে অঞ্জলীর জন্য।“

“ খুব সুন্দর, নিয়ে নাও” বলল আনন্দ।

  কিনে নিয়ে ওরা বেরিয়ে এলো। বাহিরে ঝিরঝিরে বাতাস। শানবাঁধানো চত্বরে এসে বসলো। আনন্দ দুটো আইস ক্রীম কন নিয়ে এলো।

 খাওয়া শেষে উঠে পড়ল দুজন।

বাসায় এসে যখন পৌছাল তখন রাত ৯ টা। আকরাম দীপা বসে টিভি দেখছিল।

“ কোন পর্যন্ত গিয়েছিলে?” জিজ্ঞাসা করল দীপা

বীনটাং ডিসট্রিক্টএ।

“ তোমাদের বড় শপিং মল দেখা হয়ে গেলো। চলো খেতে বসি।“

খেতে খেতে কথা হোল, দীপা আকরাম এক সাথে পড়া কালীন পরিচয়। সেই সুবাদে বিয়ে। তাও অনেক বছর হয়ে গেলো। বাসা খালি। কাল আমরা বের হব পেট্রোনাস টাওয়ার দেখতে, বলল আকরাম।

 সকাল সকাল  বেরিয়ে পরেছিল ওরা। সাথে পানির বোতল, চিপস নিয়ে নিলো দীপা। সানন্দা সাদা কালো কামীজের সাথে ম্যাচ করে প্যান্ট পরে নিলো। চোখে প্রাদা সান গ্লাস।

পেট্রোনাস টাওয়ার, পৃথিবীর সব চেয়ে টলেসস্ট বিল্ডিং। আনন্দ সানন্দাকে বলল,” জানো এই টাওয়ারে Mission Impossible মুভির শুটিং হয়েছিল”। অবজারভেসন টাওয়ার থেকে দেখেছিল কুয়ালা লামপুর শহর। সব কিছু দেখা শেষে আনন্দ সানন্দাকে জিজ্ঞাসা করল কেমন লাগছে।

অপূর্ব। অতুলনীয়।

 নিউইয়র্ক থেকে একটা ফোন এলো। তারপরই সানন্দা বলল তার শরীরটা ভাল লাগছে না।

” আমাদের তাড়াতাড়ি নিউইয়র্কে ফিরে যেতে হবে আনন্দ দা। তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো।“

কি যে বোলো।

পরের দিনই রওয়ানা দিয়ে আনন্দ সানন্দা ফিরে এলো ঝুম্পার বাসায়। আনন্দ সানন্দাকে জিজ্ঞাসা করেছিল “কি হয়েছে”।

সানন্দা উত্তর দেয়নি। শুধু বলেছিল,” দোয়া করো ওখানে যেয়ে যেন সব কিছু ভালো দেখতে পাই”।

আনন্দ দুদিনের মধ্যে ঠিক করে ফেলল সব কিছু। যাওয়ার আগে আমেনা ভাবী কে বলে গেলো ভিসার বাপারে। দিয়ে গেলো সব কাগজ পত্র।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আনন্দ দেখল অঞ্জলী দাড়িয়ে। সানন্দা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। গাড়ীতে করে এলো  হাসপাতালে।  আনন্দ কিছুই বুঝতে পারলনা। জিজ্ঞাসা করতে মন চাইছে কিন্তু পারছেনা।  অবশেষে না জিজ্ঞাসা করে পারলনা।

“ বলোতো, কি হয়েছে?”

 অঞ্জলী বলল,” খালুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে”।

আনন্দ বাচ্চু কে চেনে। ওই বাসাতেই সানন্দা আনন্দকে প্রথম দেখে ছিল।

 ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সামনে সবায় দাঁড়ান। সানন্দা এসে ওর বোনকে জড়িয়ে ধরল। দুজনে কাঁদল অনেকক্ষণ। আনন্দ এসে বাহিরে দাঁড়াল।

জমের সাথে যুদ্ধ করে হার মানতে হোল বাচ্চু কে। চলে যেতে হোল এই পৃথিবী থেকে।  আনন্দ সানন্দার পাশে এসে দাড়িয়েছিল এই দুঃসময়ে। যতটুকু করার সে করেছিল।

দিন শেষে মাস এলো। আস্তে আস্তে সানন্দা দুঃখের ভার কাটিয়ে উঠল।

আনন্দ একদিন বলল, “ সানন্দা এবার তোমার বিশ্রাম নেবার সময়। অনেক করেছ সবার জন্য”।

সানন্দা  তাকাল আনন্দের দিকে।

ক্রমশঃ

***** আগামী পর্ব হবে এক অসমাপ্ত গল্পের শেষ পর্ব ****

 

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প ( ১৬ পর্ব)

                                         ১৬ পর্ব

     “তুমি বলেছিলে দেখতে চাও সেই বাসাটা যেখানে আমি প্রথম সূর্যের আলো দেখেছিলাম। সেই তেঁতুল গাছটা যার নীচে এক্কা দোক্কা খেলতাম আমারই মতো ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে। সেই বকুল গাছটা। ভোরের আলো ফোটার আগে কুড়িয়ে নিতাম বকুল ফুলগুলো। আম গাছটা। দাদির ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যেতো। দাদি দুপুর বেলা তাকিয়ে তাকিয়ে পাহারা দিতো। যেনও বিচ্ছু ছেলে গুলো ঝাঁপিয়ে না পড়ে গাছটিতে।  বলেছিলে দেখতে চাও সেই মাঠটা যেখানে সরু সরু দুটো পা দিয়ে জাম্বুরাকে লাথি মেরে গোল দিতাম। দেখতে চাও সেই চোঁরাস্তার মোড়, যেখানে তিন বন্ধু সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে দৃশ উপভোগ করতাম। হয়ত দেখবে হারিয়ে গেছে সেই মাঠ অট্টালিকার মাঝে। তেতুলের গাছ খড়ি হয়ে জ্বলছে কারোর উননে। বকুল ফুল আর ফোটে না। তবুও তোমাকে দেখাব সেই জায়গা গুলো”। এত গুলো কথা বলে আনন্দ থামল। তাকাল সানন্দার দিকে।

সানন্দা বলল, “আমি আরও দেখতে চাই সেই পথ যে পথ দিয়ে তোমরা দুজন পায়ে পায়ে হেটে  গিয়েছিলে। সেই গাছ, সেই মাঠ, সেই ফুল বাগান যারা তোমাদের সান্নিধ্য পেয়েছিল। সেই গেট, যেখান থেকে সে বেরিয়ে এলে তুমি বলেছিলে কাঠবেড়ালিরা  থমকে দাড়িয়ে যেতো। সেই বাসা যেখানে সে তোমার বাহুর বন্ধনে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল”।

“কবে যাবে”? জিজ্ঞাসা করল সানন্দা।

“টিকিট কেটেছি । আগামী সপ্তাহে রওয়ানা দেবো। গুছিয়ে নিও। বোনের ওখানে উঠব। তোমার অসুবিধা হবে নাতো?

না। অসুবিধা হবেনা। বলল সানন্দা।

উড়োজাহাজ এসে নামলো বিমান বন্দরে। সকাল নয় টা বেজে বাইশ মিনিট। কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারিদিক। শীতের সকাল।  সূর্যের আলো লুকোচুরি খেলছে কুয়াশার সাথে। ঠাণ্ডা প্রকোপ নয়।

আনন্দ সানন্দাকে উলেন কোটাটা পড়ে জীপার টা লাগিয়ে নিতে বলল। “অনেক দিন পরে এসেছ , আবহাওয়ার সাথে এডজাস্ট করতে সময় লাগবে”, বলল আনন্দ।

সানন্দা তাকাল আনন্দর দিকে, একটু হেসে জীপারটা টেণে উপরে উঠিয়ে দিলো। গেট থেকে দেখতে পেলো ঝুম্পা দাড়িয়ে। হাত নেড়ে জানালো তার অবস্থান। বের হয়তেই ঝুম্পা জড়িয়ে ধরল সানন্দাকে।

“অনেক শুনেছি তোমার কথা। আজ দেখলাম। মণটা জুড়িয়ে গেলো”।

আমারও তাই, তোমার দাদা বলত তোমার আর তোমাদের কথা। মনে হচ্ছে অনেক দিনের চেনা।

আনন্দ এতক্ষণ তাকিয়ে দেখেনি পাশে দাঁড়ান ভদ্রমহিলা কে

“আমিনা ভাবী? তুমি? আমি তো তোমাকে জানায়নি, সারপ্রাইজ দেবো ঠিক করেছিলাম”।

“আমি তোমাদেরকে দেখছিলাম” বলে সানন্দাকে জড়িয়ে ধরল। “তোমাকে দেখার আমার বড়ো সাধ ছিল। আজ তা পূরণ হোল। ভাবতাম কে সে যে আমার ভাইটাকে আগলিয়ে রেখেছে”।

দুজনের চোখে জল ছলছল করছে। “ আমি তো করার কিছু নই, উপরওয়ালা তোমার ভাইকে দেখছে”।

“তোমরা এখানেই থাকবে, নাকি বাসাতে যাবে?” বলল আনন্দ।

 যান জট পেরিয়ে বাসাতে এলো দুঘণ্টা পর। আনন্দ ক্লান্ত। ওরা তিনজন হাসির ফোয়ারা ছড়াল। আনন্দের চোখ জড়িয়ে এলো ঘূমে। কাল যেতে হবে শাশুড়ি মার বাসায়

আনন্দের এপথ চেনা। কতবারই না সে এসেছে এই পথ দিয়ে। দুধারে ফসলের ক্ষেত। পীচ ঢালা রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে গরু ছাগল আস্তে আস্তে হেটে পাড় হচ্ছে। কোন কোন কৃষক টানা গাড়ীতে উঠিয়েছে তার মাঠের ফসল। বেচতে চলেছে দূর বাজারে।

আনন্দ সানন্দাকে বলে,”কেমন লাগছে?”

অপূর্ব।

 সানন্দাকে নিয়ে যখন এসে পৌছাল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ওকে নিয়ে উপরে উঠে এলো। বলল, “এসো তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই আমার শাশুড়ি মার সাথে”।

 দুজনে জড়িয়ে ধরে কাঁদলও অনেক। সানন্দা উঠিয়ে নিয়ে এলো শাশুড়ি মাকে। বসিয়ে দিল বাহিরের চেয়ারে। খাইয়ে দিল নিজে হাতে। শাশুড়ি মা তাকিয়ে রইল সানন্দার দিকে। কি যেনও খুজছে সে।

দুপর গড়িয়ে বিকেল। আনন্দ সানন্দাকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো রাস্তায়। হাটতে হাটতে দুজনে এলো স্কুল ঘরের কাছে।

“এই যে দেখছ স্কুলটা এখান থেকে সে পাশ করে বেরিয়ে ছিল । প্রথম বিভাগে ভাল রেজাল্ট করে। এর আগে এত ভাল রেজাল্ট এই স্কুল থেকে কেউ করেনি। এদিকে এসো, পাশ দিয়ে হাঁটো, রিক্সায় ধাক্কা লাগতে পারে”।

“কনার নাম কেন স্কুলের দেয়ালে”?

“বলবো, দেখবে চলো”।

দুজনে এলো ভিতরে। দোতালায় কণার একটা বিরাট ছবি টাইলস দিয়ে নিখুঁত ভাবে আঁকা। অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে।

“তুমি তো আমাকে এসব কিছু বলোনি আনন্দ দা? কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে? তুমি তার স্মৃতি আজীবন ধরে রাখলে এই নিখুঁত আঁকা ছবিটার মাঝে। এই স্কুলের সবেই দেখবে ছবিটা। জানবে তাকে। তাদের মাঝে সে বেচে থাকবে। সে হারিয়ে যায়নি আনন্দ দা। সে হারিয়ে যায়নি”।

“এই তো আমি চেয়েছিলাম। দোতালাটা ওর নামে উৎসর্গিত। জানো, এখান থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার পথ যেখানে আমার জন্ম। অথচ দেখা হয়েছিল সেই সুদুর প্রান্তে”।

চলো, বাসায় ফেরা যাক। ওরা অপেক্ষা করছে।

 আনন্দ, সানন্দা এসে দাঁড়াল বারান্দায়। সন্ধ্যা হয়ে এলো। একটা টিকটিকি টিকটিক করে ডেকে বেড়াচ্ছিল আলোটার পাশে। সানন্দা গায়ের চাদরটা টেনে দিলো মাথায়। দূরে আজানের ধ্বনি। রাস্তায় সাইকেলের টুং টুং শব্দ। পথিক ফিরে চলেছে তার ডেরায়। নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে গেলো একটা পাখির আত্ম চিৎকারে। পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে গেলো সে।

“খাবেনা  আপা?” ডাক দিলো শোভনের মা।

খাওয়া শেষে সানন্দা শুয়ে পড়লো শাশুড়ি মার পাশে। শোভনের মা ঠাই নিলো নিচে।

মাঝ রাতে আনন্দ শুনতে পেলো শেয়ালের ডাক। মনে হোল অতি কাছে। জানালাটা খুলে তাকাল আনন্দ। জোছনা রাত। আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পরেছে আম বাগানে। ঝলমল করছে চারিদিক। আনন্দ কতক্ষণ দাড়িয়ে ছিল জানালার পাশে মনে করতে পারেনা। ডং শব্দ করে বাহিরের ঘড়িটা জানালো রাত দুটা।

সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আনন্দের। হাত ঘড়িটাতে দেখল সকাল আটটা। বাহিরে সানন্দার কথা  শুনতে পেলো। সুন্দর ভাবে মিশে গেছে সবার সাথে। কারোর মনে কোন দ্বিধা নেই। দ্বিধা নেই সম্পর্ক নিয়ে।

“আনন্দ, তোমার ঘুম হয়েছিল বাবা?” জিজ্ঞাসা করল শাশুড়ি মা।

আনন্দ বলল রাতের কথা, শেষ রাতে চোখটা বুজেছিল।

নাস্তা শেষে ট্যাক্সি ডেকে বেরিয়ে পড়লো দুজন। আধা ঘণ্টার পথ। সানন্দা বলল,”জানো আনন্দ দা আমি খুব একটা থ্রীল অনুভব করছি। মনে মনে তোমার ছোট বেলার চেহারাটা একে নিয়েছি”।

“চেহারা টা কেমন আঁকলে, বলো?”

“সরু সরু ধুলা মাখা পা, রংটা কালোর দিকে, কি হাসছো কেন?”

“হাসছি, কারন তুমি ঠিক বলেছ বলে”।

ট্যাক্সিটাকে রাস্তার পাশে দাড়াতে বলে আনন্দ সানন্দাকে নেমে আসতে বলল। “রিক্সা করে ঘুরব, তা নাহলে সব কিছু দেখতে পাবেনা”। বলল আনন্দ।

“এইযে দেখছ দালান বাড়ীটা, এখানে আমার জন্ম।“

“মিল পাচ্ছিনা?”

“পাবে, আগে তোমাকে ভিতরটা দেখিয়ে নিয়ে আসি, এইযে দেখছ ভাঙা কুয়াটা, এই জানালা, ওই দেখো আম গাছটা, পুব পাশে ছিল তেঁতুল গাছটা, আজ আর নেই। এবার তুমি চোখ বন্ধ করে ফিরে যাও পঞ্চাশ দশকে।

খড়ের ছাউনী দেওয়া বাসা। বছরে বছরে লোকেরা এসে পুরানো খড় ফেলে নতুন খড় লাগিয়ে দিয়ে যেতো। পরে টিনের ছাদ লাগানো হয়েছিল। এরেই একটা ছোট্ট ঘরে আমার জন্ম। ওই যে কুয়াটা দেখলে ওটা ছিল পানিতে ভরা আর গভীর। ওখান থেকে পানি উঠিয়ে গোসল করতাম। বেড়া দিয়ে ঢাকা ছিল চারপাশ, মধ্যে একটা গেট। গেট খুলে যেতাম অনুদের বাসায়। ওখানে ছিল তেঁতুল গাছ টা। তারি নীচে ওর সাথে এক্কা দক্কা খেলতাম। এইযে বড় ঘরটা দেখলে ওটা অত বড় ছিলনা। ওখানে দাদি আমাদেরকে (মানে আমি আমার ভাই এর এক বোন) নিয়ে শুতেন।

তোমাকে একটা মজার গল্প না বলে পারছিনা। সেই আমলে দাদি ছিল স্বাস্থ্য সচেতন। প্রতিদিন ভোর বেলা আমাদের সবাই কে নিয়ে প্রাতঃ ভ্রমনে বের হতেন। একদিন ভোরে দাদি ডাক দিলো আমাদের সবাইকে। আমরা সবাই গভীর ঘুমে। উঠতে হবে। চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। কাক পক্ষী কেও নাই । শুধু আমরা চার জন। রাস্তা আলোয় আলোকিত। এমন সময় হুইসেল শুনলাম। কে জেনো পিছন থেকে ডাকছে। আমরা দাঁড়ালাম। লোকটা আগিয়ে এলো। পাহারাদার। আমাদের পরিচিত। দাদিকে চেনে। জিজ্ঞাসা করল এত রাতে রাস্তায় কেন?

দাদিতো আকাশ থেকে পড়ল। “ এত রাত মানে? এখন তো সকাল”।

পাহারাদার তার পুরান হাত ঘড়ি দেখাল। রাত তিনটা। ফুটফুটে জোছনার আলো। দাদির মনে হয়েছিল ভোর হয়ে গেছে।

এইযে ডান দিকে ভাঙ্গা জায়গাটা দেখছ এখানে ছিল রান্না ঘর। মাটির তৈরী। তুমি যেখানে দাড়িয়ে আছো সেখানে আমরা তিন ভাইবোন মাদুর পেতে হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করতাম। রাতের খাওয়া আমরা খেতাম দাদির হাতে। দাদি হুক্কা টানত। হুক্কার আওয়াজ বন্ধ হলে আমরা জানি আমাদের খাওয়ার ডাক পরবে। আমরা উচ্চস্বরে পড়ার মাঝে মাঝে কান পেতে থাকতাম কখন হুক্কার আওয়াজ বন্ধ হয়। সে আজ কতকাল আগের কথা”, এই বলে আনন্দ থামল।

“চোখ খুলব?”

খোলো, কেমন দেখলে?

অপূর্ব, আমার চোখে ভাসছে দাদির চেহারা আর তোমার সেই অনু, আর দেখা হয়েছিল কি?

না, জানিনা কোথায় সে, হয়ত কয়েক ছেলে মেয়ের জননী, অথবা হারিয়ে গেছে এই ধরাধাম থেকে।

এবার চলো, তোমাকে নিয়ে যাই মোড়টাতে। যেখানে আমরা তিন বন্ধু দাড়িয়ে থাকতাম সাইকেল নিয়ে। এখানে আগে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়াত। গাড়ী নিয়ন্ত্রণ করত। এখন সেখানে সাদা কবুতরের ভাস্কর্য।

জানো আমি প্রথম যখন সাইকেল চালানো শিখি, বয়স ছয়, বাবার সাইকেলটা নিয়ে বেড়িয়ে ছিলাম। এই মোড়ে এসে

ঘাবড়ে গেলাম। ডানে যাব না বায়ে। সাইকেল থেকে মেনে ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলাম কোন দিক দিয়ে ঘুরতে হবে। জানো সে কি বলেছিল?

কি?

বলেছিল তিনবার ঘুরে তারপর সোজা যাবে।

তুমি তাই করেছিলে?  সানন্দা মিটমিট করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করেছিল।

তোমার কি মনে হয়?

সানন্দা হো হো করে হাসে উঠল।

চলো এবার দেখবে সেই সিনেমা হল যার সামনে সন্ধ্যা বেলা আমরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে গান শুনতাম।  দেখবে সেই রাস্তা টা যার উপর দিয়ে টুং টুং ঘণ্টা বাজিয়ে সাইকেল চালাতাম। হয়ত কোন জানালার কপাট খুলে কারো মুখ এক ঝলকের জন্য দেখা দিতেও পারে সেই আশায়।

আনন্দ দা তুমি অনেক টাংকি মেরেছ। বলল সানন্দা

ঐ বয়সে কে টাংকি মারেনি বোলো।

কেমন দেখলে আমার ছোটবেলার সব কিছু ?

দেখলাম, মন ভরে গেলো। বলল সানন্দা।

“সানন্দা, তুমি এলে, দেখলে, কেড়ে নিলে সবার মন, এবার তো বিদায় নেবার পালা”। বলল আনন্দ।

 সানন্দা শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল।  বিদায়ের শেষে শাশুড়ি মা আনন্দকে বলেছিল, আবার এসো বাবা, পারলে আমার এই মেয়েটা কেও নিয়ে এসো।

ওরা ফিরে এলো ঝুম্পার বাসায়।  সন্ধ্যা হয় হয়।  ঝাল পিয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে ঝুম্পা ডাক দিলো ওদেরকে। সানন্দা বসলো ঝুম্পার সাথে।  আনন্দ চা র পেয়ালা টা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালো বাহিরের বেল্কনীতে। ভাবে, কবে এর শেষ?  জীবনের এই উঁচু নীচু গ্রাফ আর কত দিন চলবে?  বেশ কাটে সানন্দার সাথে কথা বলে, আবার হারিয়ে যায় ফেলে আসা দিন গুলোর মাঝে।

“কি ভাবছ?” সানন্দা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।

উত্তর আসেনা। আনন্দ তাকিয়ে ছিল দূরে। সানন্দা জানে আনন্দ ফিরে গেছে অনেক পিছনে।

তাকিয়ে থাকে আনন্দের দিকে।

পরদিন আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল সানন্দাকে,” কোথা থেকে শুরু করবো, বলো”?

“ সেই বাড়ী যেখানে পাতাবাহার গাছের ফাকে তোমাদের ছবি আমি দেখে ছিলাম তোমার ঘরে। ওর পরনে ছিল বিয়ের সাজ। সাধা কালো ছবি”।

“ যাবো সেখানে, তবে আশা তোমার পূর্ণ হবেনা”।

তিন চাকার স্কুটারটা এসে দাঁড়াল জরাজীর্ণ পাঁচতালা বাড়ীটার সামনে।

“জিজ্ঞাসা করোনা কেন বাড়ীটার আজ মলিন চেহারা। আমি শুধু তোমাকে দেখাতে এসেছে আমার অতীত, আমাদের অতীত।

 আটচল্লিশ বছর আগে টিনের ছাদ দেওয়া চার ঘরের একটা বাসা ছিল এইখানে। এই যে দেখছ বা পাশে ভাঙ্গা ঘরটা ওটা ছিল রান্না ঘর। সামনে ছিল অনেক জাগা, ওখানে ছিল পাতাবাহারের গাছ।

ডান দিকে চার ঘরেরে শেষ ঘরটা তে আমরা সময় কাটাতাম, হাসতাম, তাস খেলতাম।

তুমি কি ভাবছ? এটা  বিয়ের পরে? না, এসব বিয়ের আগে। হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে একদিন মনে হোল আমরা জড়িয়ে পরেছি কোন এক বন্ধনে। তারই শেষ হয়েছিল এই ঘরটাতে। হয়েছিল আমাদের বাসর রাত।

তারপর?

তারপর আমরা চলে গিয়েছিলাম বাহিরে। এই টিনের বাড়ী ভেঙ্গে উঠেছিলো পাঁচ তালা দালান বাড়ী। আমরা এলে মার সাথে ওই পাঁচতালাতে থাকতাম”। বলে আনন্দ থামল।

একটা লোক বেরিয়ে আসতেই  জিজ্ঞাসা করল পাঁচতালায় যাওয়া যাবে কিনা।

লোকটা বলল,”আসুন আমার সাথে”।

“পারবে তো?” আনন্দ জিজ্ঞাসা করল সানন্দাকে।

“ আজ আমি সব দেখব আনন্দ দা”।

উঠে এলো ওরা পাঁচ তালায়। দেওয়ালের  রং উঠে গেছে, খসে পরছে কিছু কিছু জাগা, মাকড়সা বেধেছে তাদের বাসা।

“ এই ডান দিকের  ঘরটাতে আমরা থাকতাম। মা  থাকত আমাদের পাশের ঘরে। ওই যে কর্নারটা দেখছ, ওখানে মা পানের বাটা নিয়ে বসতো। কনা বসে মার সাথে গল্প করতো আর পান খেতো। সব এলোমেলো হয়ে গেলো, তাই না সানন্দা”।

“ এইতো নিয়ম। চলো নিচে যাই।“

“চলো”।

ফিরে এলো সেইখানে, সেই গেটের কাছে। সানন্দা বলল,” এই সেই গেট?”

“হা, তখন এত লোকের আনাগোনা ছিলনা। রাস্তা পেরিয়ে এসে ওই যে গাছটা দেখছ ওর ছায়ায় বসতাম। সময় কোথা দিয়ে পার হয়ে যেতো বুজতে পারতাম না”।

তারপর? তারপর তোমরা বসতে ইউনিভারসিটির মাঠে, হাটতে পীচে ডালা এই পথ দিয়ে। তাই না?

শেষ এসে দাড়িয়ে ছিলে এই মাঠে, বই মেলার দিন। তোমার কাধে মাথা রেখে বলেছিল, আর নয় এবার ফিরে চলো।

 তাই, আনন্দ অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটতে থাকল। সানন্দা কিছু বলল না। চেয়ে চেয়ে দেখল আনন্দের মুখটা। দেহটা আছে মনটা চলে গেছে অনেক দূরে। এই আনন্দকে সে চেনে। দেখেছে। ভেবেছে, কোন ভাবেই কি ওর মন টাকে ফিরিয়ে আনা যায়না? উত্তর মেলেনি।

পরদিন, আনন্দ ডাকে সানন্দা কে

সানন্দা?

ডাকছ?

দেখাতো হোল, এবার ফিরে যাওয়ার পালা। কোথায়? জানতো।?

না, কোথায়?

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প (১৫ পর্ব)

                                     ১৫ পর্ব

     সানন্দা যখন আনন্দকে নিয়ে বাসায় এলো তখন রাত দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। খাবার টেবিল সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল। বলল,” তুমি কাপড় জামা ছেড়ে গোসল করে এসো আমি খাবার গুলো গরমে দেই।”

“রাত অনেক হয়েছে, তুমি এসো, আমি সব ব্যাবস্থা করে নেবো।” বলল আনন্দ। যদিও জানে সানন্দা যাবেনা। সানন্দা একবার তাকাল আনন্দের দিকে, কিছু বলল না। কথা বলার সাথী বলতে তো সেই।

গোসল সেরে নেমে এলো আনন্দ। শরীর চলছেনা। অথচ এই কদিন চর্কির মত ঘুরেছে। ক্লান্তি আসেনি। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দুজনকে হারিয়ে। নিজেকেও হারাতে চলেছিল শুধু ছক্কার চাল ঠিক থাকাতে এই যাত্রা বেচে গেছে।

“কাল অফিসে যেতেই হবে? না গেলেই নয়?” জিজ্ঞাসা করলো সানন্দা।

“ওরা সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। সমস্ত ঘটনার ব্যাখ্যা তো আমাকেই করতে হবে।”

সানন্দা আর কথা বাড়াল না।

খাওয়া শেষে সমস্ত কিছু গুছিয়ে রেখে বলল,” আমি আসি, তুমি বিশ্রাম নাও।”

গাড়ীটা চোখের আড়াল হলে দরজাটা বন্ধ করে দিলো আনন্দ।

সকাল দশটা। আনন্দ গাড়ীটা পার্ক করতেই এটেনডেন্ট এগিয়ে এলো। আনন্দের হাতটা চেপে ধরে বলল সে খুবই দুঃখিত। আনন্দ ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেল এলিভেটারের দিকে। দরজা খুলতেই দেখল ডেভিড, লরেন্স জেনীফার মাইক দাঁড়িয়ে। মাইক এসে আনন্দকে জড়িয়ে ধরল। সবাই দাঁড়াল ওর পাশে ।

ডেভিড বলল,” This is a tremendous blow for this organization. কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদেরকে সামনে চলতে হবে। আমরা লাকি তুমি এখনও আমাদের মধ্যে আছো।”

সবাই এসে বসলো কনফারেন্স রুমে। আনন্দ একে একে জানাল সব ঘটনা। বলল সে স্টিভের সাথে আলাপ করবে আইন গত ভাবে আমাদের করনীয় কি।

জেনীফার উঠে আনন্দের কাছে এলো। বলল,”এবার তুমি কিছুদিনের জন্য বাহির থেকে ঘুরে এসো। মনটা ভাল লাগবে।”

আনন্দ সাই দিলো। বলল,” দেশে যাবো ভাবছি।”

“যাও, তবে যাওয়ার আগে একটা কাজ করতে হবে, আমি একা করতে চাইনা।” বলল ডেভিড।

কি?

 “আগামীকাল একজনের ইন্টারভীউ আছে। এমিলির পজিশনটার জন্য। তুমি ইন্টারভীউ নেবে। আমি থাকব। তবে সব ভার তোমার উপর। ঠিক আছে?”

হা, বলে আনন্দ বলল সে উপরে স্টিভের সাথে দেখা করতে যাবে। উঠে পড়ল।

জনের মা কল করেছিল আনন্দ কে। বলেছিল একবার আসতে ওদের বাসাতে। ফিলাডেলফীয়ায়।  আনন্দ না করেনি। বলেছিল দুই একদিনের মধ্যেই আসবে।

সব কাজ শেষে আনন্দ বাসাতে ফিরবে ভেবে গাড়ীটা স্টার্ট দিলো। সানন্দা বলেছিল কাজ শেষে ওর সাথে চা খেতে। তা আর হলনা। গাড়ীটা ঘোরালো সে এমিলিদের বাসার দিকে।

এমিলির মা বাবা আনন্দকে দেখে চোখের জল বেঁধে রাখতে পারেনি। আনন্দকে দেখিয়ে ছিল এমিলির রুমটা। সুন্দর করে সাজানো ঘর। এক কোণে একটা পেন্টিং। উপুড় করা। আনন্দ উঠিয়ে নিলো। তাকাল। আনন্দের অবয়ব।  এমিলির  আঁকা। ফিরতে রাত হোল।

আজ আনন্দ হাতে অনেক সময় নিয়ে অফিসে এসেছিল। লরেন্সের সাথে বসে কফিটা শেষ করার আগেই ডেভিড এলো। সামান্তা খবর দিলো যে ছেলেটার ইন্টারভীউ নেওয়া হবে সে বাহিরে বসে আছে।

    আনন্দ চশমার কাচটা মুছে নিয়ে ছেলেটার জীবনবৃতান্ত টা আর একবার পড়ল। রাশেদুল ইসলাম। নামটা পরিচিত মনে হোল। সামান্তা কে বলল রাশেদকে ডাকতে। দরজা খুলে ভিতরে এলো রাশেদ। হ্যান্ডসাম, টোন বড

কোঁকড়া চুল, শ্যামলা। আনন্দ তাকিয়ে রইল ওর দিকে। বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে একটা শব্দ,” তুমি?”

“চেনও নাকি?” জিজ্ঞাসা করলো ডেভিড।

“চিনি।”

রাশেদ কে বসতে বলল। রাশেদ আনন্দের দিকে চেয়ে রইল।

আনন্দও তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। শেষ দেখে ছিল বারো বছর আগে ওর বাবার কবরের পাশে। তারিকুল ইসলাম।

তারেকের সাথে আনন্দের দেখা হয়ে ছিল দেশের রাজধানীর এক এলিট কলেজে। আনন্দ এসেছিল এক মফস্বল শহর থেকে। তারেকের জন্ম রাজধানীতে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তারেক এসে বাসা বেঁধে ছিল আনন্দের রুমে। ঠোটে হাসি লেগেই আছে। প্রাণবন্ত। বলত,” চল, মুভি দেখে আসি।”

আনন্দের যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যেতে চাইত না, পকেট শূন্য। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অনেক ভেবে চিন্তে চলতে হয় এই রাজধানীর বুকে।

পাশ করে দুজন চলে গিয়েছিল দু দিকে। আনন্দ আর্কিটেকচার কলেজে ভর্তি হলো। তারেক ইংলিশে মেজর নিয়ে ইউনিভারসিটিতে এলো।  দেখা সাক্ষাত কমে গেলো । আর্কিটেক্ট হয়ে আনন্দ চলে এলো আমেরিকাতে স্কলারশিপ নিয়ে। সেতো অনেক দিনের কথা।

 এক সন্ধ্যায় আনন্দ কণাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হল ঘরের লাউঞ্চে। এসেছিল বাংলা শিল্পীদের গান শুনতে। পিঠে হাতের স্পর্শে তাকাল পিছনে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল। তারেক?

“কিরে ,অবাক হয়ে গেলি? অনেক খুঁজেছি। আজ পেলাম।’”

ভেঙে যাওয়া বন্ধন আবারো জোড়া লাগলো। সময় পেলেই চলে আসতো আনন্দের বাসায়। কণা খুব পছন্দ করেছিল ওকে।

“বিয়ে শাদী করবি? মেয়ে আছে।” জিজ্ঞাসা করেছিল আনন্দ

“না, মা বাবার পছন্দ এক মেয়ে আছে, তার সাথে হবে। সামনের বছরে যাবো।”

এক শীতে ঝরা সন্ধ্যায় নিয়ে এলো সাকীলাকে। কণা যেয়ে সাজিয়ে রেখেছিল ওদের ঘর। দিন শেষে মাস, মাস শেষে বছর পেড়িয়ে গেল। এলো ওদের ঘরে এক ছেলে। রাশেদ। দুরন্ত। আনন্দের বাসায় এলে জিনিস পত্র ভেঙ্গে তছনছ করত। কনা কিছু বলত না।

প্রায় তারেক কমপ্লেন করত পিঠে ব্যাথা, বুকে ব্যাথা। বমি বমি ভাব। দুর্বল লাগে।

খাওয়ার রুচি কমতে থাকল, সেই সাথে ওজন। ওর হাসি হাসি মুখটা ব্যাথায় কুচকিয়ে থাকত।

আনন্দ বলেছিল ডাক্তার দেখাতে। যায়নি। সাকীলাকেও বলেছিল। সেও গরজ করেনি।

এক রাতে  ব্যাথায় টিকতে না পেরে আনন্দকে ফোন করেছিল। আনন্দ নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। সারারাত ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলল। সকালে আনন্দ কে ডাক্তার ডেকে নিয়ে গেল পাশের রুমে। বলল,” He has Multiple Myeloma. It is  form of bone marrow cancer. Stage 3”. আনন্দ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে  ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলো তাকে ব্যাখ্যা করতে। চিকিৎসা আছে কি না। বাঁচার সম্ভবনা কতটুকু।

খুব একটা সময় হাতে নেই, বলল সে। “ It’s a serious incurable malignancy.”

তাড়াতাড়ী চিকিৎসা শুরু করতে হবে। বলল সে।

ডাক্তার ফিরে এলো তারেকের রুমে। বলল সবকিছু। তারেক আনন্দের দিকে তাকিয়ে থাকল, চোখের কোণে জল। সাকীলার কোন ভাবান্তর নেই।

চিকিৎসা শুরু। Chemoর ভয়াবহতা সহ্য করতে পারলো না তারেক। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে আনন্দ এসে বসে থাকে তারেকের পাশে। গল্প করতো  ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ওর হাসিটা ম্লান হয়ে এলো। রক্ত শূন্যতা। মুখটা কুঁচকানো কাগজের মত।  বলে,” আর কতদিন আমি বাঁচব রে আনন্দ, সত্যি করে বল।”

“নতুন নতুন অনেক চিকিৎসা বের হয়েছে। চিন্তা করিস না।” বলে বাথরুমে যাবার ছল করে বাহিরে যেয়ে কাঁদত।

দিনে দিনে খাওয়ার রুচি চলে যেতে থাকলো। গায়ের রঙ পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। বলে,” আমি আর পারছি নারে আনন্দ।“

মাঝে মাঝে আনন্দ এসে সাকীলাকে কোথাও না দেখে  জিজ্ঞাসা করতো। তারেক বলত “ও বাহিরে গেছে দরকারে”।  একদিন তারেক বলল ,” জানিস আনন্দ আমার খুব ইয়োলোস্টোন পার্ক টা দেখেতে ইচ্ছা করে। নিয়ে যেতে পারবি?”

“পারবো”। বলে সব ব্যাবস্থা করল আনন্দ। শেষ সময়ে সাকীলা বলল সে যেতে পারবেনা। বলল “তোমরা ঘুরে এসো। আমি এদিকটা সামলাব।“

যথা রীতি ওরা বেরিয়ে পরেছিল। আনন্দ দেখেছিল তারেকের হাসৌজ্জল মুখ। হুইল চেয়ারে বসে বসে দেখল তার সাধের ইয়োলোস্টোন পার্ক। মাঝে মাঝে মাথাটা এলিয়ে দিতো । আনন্দ ওকে নিয়ে এসে দাঁড়াত গাছের ছায়ায়।

 চার দিন আনন্দ তারেককে বাচ্চার মতো আগলিয়ে রেখেছিল। ফিরে যাওয়ার দিন তারেক একটা এনভেলপ আনন্দকে দিয়ে বলল ,” কথা দে, এটা খুলবি আমি চলে যাওয়ার একমাস পরে। কথা দে? ”

আনন্দ কথা দিয়েছিল।

ফিরে আসার পরে তারেকের শরীর আরও খারাপের দিকে গেলো। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মরফিনে ব্যাথা যায়না। হাঁসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোল। ডাক্তার আনন্দ আর সাকীলাকে পাশে ডেকে নিয়ে বলল,” এবার ওকে যেতে দিতে হবে।“

দুদিন পরে সবকিছুর মায়া কাটিয়ে তারেক চলে গেল।

দিন যেয়ে মাস এলো। এক পরন্ত বিকেলে আনন্দ কড়া নাড়াল সাকীলার বাসায়। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক আমেরিকান ভদ্রলোক। আনন্দ ভুল বাড়িতে এসেছে ভেবে দুঃখিত বলে চলে যাচ্ছিল। মহিলার ডাক শুনে ফিরে তাকাল। সাকীলা। প্যান্ট সার্ট পড়ে দাঁড়ান।

ভিতরে আসতে বলতেই আনন্দ বলল, আজ নয় আর একদিন আসবো।

ফিরে আসতে আসতে মনে হোল সেই চিঠিটার কথা। বাসায় এসে খুলল চিঠিটা। দুকলম লেখা।

“I was cheated on”.

আনন্দ ? ডাক শুনে বাস্তবে ফিরে এলো।

“প্রশ্ন করো”? বলল ডেভিড

তাকিয়ে রইল আনন্দ রাশেদের দিকে।

 “না, আমি না। I have a soft corner for him. ঠিক জাজমেন্ট করতে পারব না। হয়তোবা পক্ষপাতিত্ব করা হবে।  তুমিই ওর ইনটা্রভিউ নেও।“ বলে আনন্দ দরজার দিকে পা বাড়াল। রাশেদ তাকিয়ে থাকলো ওর চলার দিকে।

ক্রমশ

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প ( ১৪ পর্ব)

                                                                                                       ১৪ পর্ব

       জনের কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে হেটে আনন্দ এসে বসলো লাউঞ্জের সোফাতে। তাকিয়ে থাকল জনের দিকে। পরিতৃপ্তির হাসি। হাল্কা মন। কিছুক্ষণ আগেও যা ছিল সমুদ্রের গর্জনে ভরা, এখন তা শিথিল। একজন চলে গেছে। দ্বিতীয়কে হারাতে সে রাজি ছিল না।

ভীষণ ক্লান্ত। জনকে বলল সে ভাবছে দুই তিন দিন পরে ফিরে যাবে নিউইয়র্কে। জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো ঘরে।

কতক্ষণ শুয়ে ছিল আনন্দ মনে করতে পারেনা। টেলিফোনর শব্দে চোখটা খুলে ঘড়িটা দেখল। পাঁচটা বাজে। ফোনটা বাজছে। বিরক্তের সাথে ফোন টা উঠালো।

“ এখনি আসতে পারবে?” বলল থম্পসন।

“ ঠিক আছে ।” বলে উঠে বসল। দেখল দরজার কাছে একটা কাগজ পরে আছে। আগে দেখেনি। কাগজটা উঠাল।

অক্ষর গুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে কেটে কেটে বসানো হয়েছে। লেখা আছে, “ Your life is in danger. Say nothing to anyone. You must leave the city immediately and never return. Repeat: say nothing—“.

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল কাগজটার দিকে। কয়েকবার পড়ল। ভয় যে পেলোনা তা নয়। একটু থ্রীলও অনুভব করলো। জন কে ফোন করলো । বিজি টোন।

ট্যাক্সি ডেকে বেড়িয়ে পড়ল পুলিশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। পিছনে তাকাতেই মনে হোল একটা ট্যাক্সি তাকে ফলো করছে। ড্রাইভার কে একটু জোড়ে যেতে বলে আবারো পিছনে তাকাল আনন্দ। ট্যাক্সিটার গতিও বেড়ে গেল। আনন্দ ড্রাইভারের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বলল, “ ডান দিকে মোড় নিয়ে গলিতে ঢুকে একটু আস্তে যাবে, আমি নেমে পরার সাথে সাথে তুমি জোড়ে চালিয়ে চলে যাবে।”

আনন্দ যথারীতি নেমে পাশের দোকানে ঢুকে পড়ল। ট্যাক্সিটা গলিতে ঢুকে সোজা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আনন্দ বেড়িয়ে এসে আর একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ল।

থম্পসন অপেক্ষা করছিল। আনন্দ ঢোকার সাথে সাথে থম্পসন বলল দরজাটা বন্ধ করে দিতে। বলল” যাকে ধরা হয়েছে সে হত্যাকারী নয়।”

আনন্দ আকাশ থেকে পড়ল। “ তুমি বলে ছিলে প্রমাণ আছে।”

“ আছে, তবে সেই প্রমাণে কাজ হবেনা। তার alibi আছে। এমিলি যে সময়ে মারা গেছে সেই সময় সে ছিল অন্যখানে। তার প্রমাণ আছে। সেখানের সারভেলেন্স ক্যামেরায় তার ছবি পর্যন্ত আছে। একটা লোক একই সময়ে দু’জাগায় থাকতে পারেনা।”

“ছেড়ে দিয়েছ কি?”

“হা, তবে এই স্টেটের বাহিরে যেতে পারবে না”।

এই বলে থম্পসন দুটা এমিলির ছবি আনন্দকে দেখাল। একটা মারা যাওয়ার আগের। অন্যটা মেঝেতে পরে আছে।

বুঝতে পারো কিছু ?

আনন্দ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লনা।

“প্রথম ছবিটায় এমিলির আঙ্গুলে আংটি। দ্বিতীয়টাতে নেই। Who ever is the killer, took the ring. But why?”

কথা বলতে বলতে আনন্দ রুমে পাওয়া কাগজটা থম্পসনের দিকে এগিয়ে দিলো। দেখতে পেলো থম্পসন দাঁতে দাঁত কামড়াচ্ছে। চোয়ালের পেশী গুলো ওঠা নামা করছে। ভুরু কুঁচকিয়ে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকল।

“ I wish I will be lucky –“

কথা শেষ হবার আগেই আনন্দ জানতে চাইলো সে কি বলতে চাইছে।

থম্পসন একটা মেগনিফাইন গ্লাস নিয়ে এলো। হাতে গ্লোভস পরে খুব সাবধানে danger ওয়ার্ড টাকে ফোকাস করলো।

“ কিছু দেখতে পাচ্ছো?”

না

“ ছোট্ট কালো –“

“ হা, পাচ্ছি। ওটা কি”?

“ চুলের অংশ। That could be the turning point.”

থম্পসন ওর অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডাক দিয়ে সাবধানে কাগজটা জীপ লক ব্যাগে ভরে ক্রাইম ল্যাবে পাঠিয়ে দিলো।

আনন্দ বুঝে উঠতে পারলনা কেন তাঁকে ফলো করা হচ্ছে। সে কথা বলতেই থম্পসন বলল, “ তুমি খুব বেশি মাথা গলিয়ে ফেলেছ। অনেক কিছু জেনেছ। পিছনে ফেরার পথ নাই। শুধু সাবধানে থাকবে।”

আনন্দ গুডবাই বলে উঠতে যাবে এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল থম্পসনের অ্যাসিস্ট্যান্ট।

“ খবর আছে। আংটি পাওয়া গেছে।”

“ কোথায়?” জিজ্ঞাসা করলো থম্পসন

“ Pawn Shopএ বিক্রি করতে এসেছিল। ওকে ধরে রাখা হয়েছে।”

থম্পসন আনন্দ কে জিজ্ঞাসা করলো সে যাবে কিনা। আনন্দ রাজি।

সব গোল্ড বেচা কেনার দোকানে আংটিটার ছবি দিয়ে রাখা হয়েছিল। থম্পসনকে দেখেই লোকটা হাউমাউ করে পা চেপে ধরল। “ আমি কিচ্ছু জানিনা। পড়ে পেয়ে ছিলাম,”

থম্পসন উত্তর না দিয়ে বলল, থানায় যেতে হবে। সেখানে সব শুনব।

লোকটা বলল যে হোটেলে খুন হয়েছে সে ওই হোটেলের রান্নাঘরে কাজকরে। সেদিন সেসময়ে সে ছিল একেলা। বাসন পত্র সাজিয়ে রাখছিল। একজন অচেনা লোক মাথায় বেজবল ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে দ্রুত হেটে যাচ্ছিল। সে ভেবে ছিল নতুন কর্মচারী হয়ত। টুং করে একটা শব্দ হোল। প্রথমে ভ্রুক্ষেপ করেনি। পরে চেয়ে দেখে একটা আংটি পরে আছে। জ্বলজ্বল করছিল। লোভ সামলাতে পারেনি। উঠিয়ে নিয়েছিল।

থম্পসন দেরী না করে লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে এলো হোটেলে। ম্যানেজার কে নিয়ে এলো ওই রান্নাঘরে। জিজ্ঞাসা করলো কোন সারভেলেন্স ক্যামেরা আছে কি না।

বলল,” আছে”

“ নিয়ে এসো ওই দিনের টেপ গুলি।” নির্দেশ দিলো থম্পসন।

যথারীতি আনন্দ কে হোটেলে নামিয়ে সে চলে গেল থানায় লোকটাকে নিয়ে।

হোটেল লাউঞ্জে ঢুকতেই জন ডাক দিলো আনন্দকে। বসেছিল কর্নারের সোফাতে।

কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞাসা করাতে আনন্দ সঠিক উত্তর না দিয়ে বলল, “একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম।” জনের চোখের চাহুনিতে মনে হল সে বিশ্বাস করলো না কথাটা।

ফোনটা বেজে উঠল। থম্পসনের ফোন। জিজ্ঞাসা করলো কাছে কেউ আছে কিনা।

বলল,” আছে”। কোন উত্তর না দিয়ে শুধু শুনতে বলল।

লাউঞ্জ ছেড়ে কোথাও যেন না যায়, বলল থম্পসন। আনন্দ রহস্যের ঘন্ধ পেলো। ভয়ও হোল।

জন উঠে যাবার সময় আনন্দকে বলল সে মলে যাবে কিনা। আনন্দ না বলে সোফাতে বসে পড়ল।

আবারো থমস্পনের ফোন। একি প্রশ্ন। জানা শোনা কেউ কাছে আছে কিনা।

বলল, না

“ রুমে চলে যাও। আমি আসবো রাত নটায়। দরজা খুলবেনা। আমি তিন টোকা দিয়ে আমার নাম বলব, তখন দরজা খুলবে।”

আনন্দের সারা শরীর ছমছম করছে। কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

রাত নটা। যথা রীতি দরজায় টোকা দিয়ে নাম বলতেই আনন্দ দরজা খুলল। থম্পসনের সাথে আর একজন। নাম এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড ঘরে ঢুকতেই থম্পসন আনন্দকে বাহিরে আসতে বলল, দ্রুত উল্টো দিকের রুমটাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে আনন্দ কোনকিছু জিজ্ঞাসা করার সময় পেলোনা।

থম্পসন বলল, “ আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে তোমার রুমে আমি আশা করছি এবং সেটাই হবে ঘটনার শেষ অধ্যায়।”

থম্পসনের আদেশে হলওয়ের আলো গুলি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আনন্দের রুমের অপর দিকের রুমে থম্পসন, Peep hole দিয়ে দেখছে কেউ আসে কিনা।

রাত একটা। পা এর আওয়াজ শোনা গেল। এগিয়ে আসছে। কাছা কাছি এসে দাঁড়াল। আবার ফিরে গেল। আর কোন শব্দ নেই। থম্পসন তার নিজের হার্ট বিট শুনতে পাচ্ছে। Peep hole থেকে চোখ সরিয়ে নিতেই পা এর শব্দ ফিরে এলো। এসে থামল দরজার কাছে। হলওয়ের নাইট লাইটে থম্পসন দেখতে পেলো লোকটাকে। এপাশে ওপাশে তাকাল। ছয় ফুট লম্বা। হাতে গোল আকারের একটা বস্তু। পকেট থেকে ইলেকট্রনিক চাবি বের করলো। স্লটের ভিতর দিতেই ক্লিক আওয়াজ করে দরজাটা খুলে গেল। আস্তে করে ঢুকে পড়ল।

থম্পসন বেড়িয়ে এলো। দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। আনন্দ ঘরের ভিতরে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে গেছে।

দড়াম করে শব্দ হোল। চিৎকার। থম্পসন তাড়াতাড়ি দরজা খুলে পিস্তল টা বের করে আলো জ্বালিয়ে দিলো।

এডওয়ার্ড লোকটাকে মেঝেতে জাপটিয়ে ধরে রেখেছে। আনন্দ দৌড়িয়ে এসে রুমে ঢুকল। লোকটার হাতের সেই গোল বস্তুটা বিছানায় পরা। এডওয়ার্ড বলল এটা দিয়ে সে আঘাত করেছিল বালিশে। ভেবে ছিল আনন্দ ওখানে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ভাবেনি বিছানাতে কেউ নাই। দেখে মনে হচ্ছিল কেউ শুয়ে আছে। এডওয়ার্ড লুকিয়ে ছিল ক্লজেটে। বেড়িয়ে এসে জাপটিয়ে ধরেছিল।

মাথায় হুড উঠানো। এডওয়ার্ড মাথার হুডটা সরিয়ে দিলো। আনন্দ তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। চোখে পলক পড়েনা। শুধু জিজ্ঞাসা করলো,” Is that you?”

কোন উত্তর এলোনা জনের কাছ থেকে।

   সকাল দশটা। থম্পসন কফির কাপটা এগিয়ে দিলো আনন্দের দিকে।

মুখে কথা নেই আনন্দের। সমস্ত ব্যাপার টা তখনো তার বোধগম্য হচ্ছেনা। কেন জন এপথে গেল। আর তাকেই বা কেন টার্গেট করেছিল। জিজ্ঞাসা করলো থম্পসন কে।

জনের জবানবন্দির মাঝে ফাঁক ছিল অনেক। তখনি থম্পসনের সন্দেহ হয়েছিল। খোজ নিয়ে জেনে ছিল সে ডালাসে এসেছে চার দিন আগে অথচ বলল ফোন পেয়ে এসেছে। গাড়ী সে রেখে ছিল লং টার্ম পারকীং লটে। এসেছিল এমিলিকে সারপ্রাইজ দিতে। সারপ্রাইজ দিতে এসে এমিলিকে দেখেছিল আর এক জনের সাথে, খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। ওদেরকে অনুসরণ করে জেনে ছিল কোন রুমে এমিলি থাকে।

একদিন লোকটা এমিলির ঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর সে টোকা দিয়েছিল। এমিলি অবাক হয়ে গিয়েছিল জনকে দেখে। ওর পড়নে ছিল ব্রা আর প্যান্টি, তার উপরে নাইট গাউনটা চাপানো। জন জিজ্ঞাসা করেছিল লোক টা কে, কি সম্পর্ক। শোবার ঘরের আগোছাল বিছানা দেখে রাগে বেড়িয়ে চলে গিয়েছিলে রুম থাকে। এই ঘটনা লেখা ছিল এমিলির ডাইরিতে। পরে এমিলি ডাইরির ওই পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ডাস্ট বিনে।

পরদিন জন এসেছিল এমিলির রুমে, হাতে ছিল লোহার বল। ওটা দিয়ে আঘাত করেছিল এমিলির মাথায়।

থম্পসন থামল। বলল, “ হুড দিয়ে ঢাকা মুখ, চেনা যায়নি। কিন্তু হাতের ঘড়িটা ঢাকতে পারেনি। জনের হাতে ওই ঘড়ি আমি দেখে ছিলাম। অনেক চুলের মাঝে একটা চুলের ডিএনএ ম্যাচ করেছিল জনের সাথে। তবুও তাকে ছেড়ে দিয়ে ছিলাম। কারণ এই প্রমাণ আদালতে ধোপে টেকবেনা। তবে তোমাকে লেখা চিঠির থেকে যে চুল পাওয়া গিয়েছিল সেটা ম্যাচ করেছিল ওর ডিএনএ র সাথে। রান্না ঘরের সারভেলেন্স ক্যামেরায় ওঠা ছবিতে দেখা গিয়ে ছিল ওর মুখ।

ডাইরির পাতাটা রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করেছিল। ডাইরিটা খুঁজে পাওয়া যাইনি এমিলির ঘরে। পাওয়া গিয়েছিল জনের গাড়ীতে। এমিলির ডাইরিতে লেখা ছিল তোমার কথা। এমিলি তোমাকে ভুলতে পারেনি। কাল্পনিক ভাবে তোমাকে জড়িয়ে লেখা ছিল অনেক প্রভোকেটিভ কথা। তারই মাসুল তোমাকে দিতে হচ্ছিল সেই রাতে।” বলে থম্পসন থামল। “খুন করতে সে আসেনি। এসেছিল সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু ভাগ্যের লিখনতো খণ্ডাতে পারবেনা।”

থম্পসন শেষ করলো তার বক্তব্য। নীস্তবতা গ্রাস করে রইল কিছুক্ষণের জন্য।

আনন্দ বলল ,” এবার আমার ছুটি। বাড়ী ফেরার পালা।”

সানন্দা কে কল করলো।

“ কবে আসবে” জিজ্ঞাসা করল সানন্দা

“কাল”

“ সাবধানে এসো। আমি এয়ারপোর্টে থাকব।”

ক্রমশ

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প ( ১৩ পর্ব)

                                                ১৩ পর্ব

     বারে এসে বসলো আনন্দ। বারটেনডার ক্লাব সোডার গ্লাস টা এগিয়ে দিতেই আয়নায় দেখতে পেলো মাথায় টুপি ওয়ালা লোকটা তার পিছনে দাঁড়িয়ে। হাতে ধরা গ্লাসটা কেঁপে উঠে কিছুটা সোডা পরে গেল গ্লাস বেয়ে। লোকটার হাতের সেই বস্তুটা দেখতে পেলনা আনন্দ।

“ বসতে পারি?” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে পাশের চেয়ার টাতে বসলো। বয়স চল্লিশের কাছা কাছি। কপালের উপড়ে কাটা দাগ। বেশী দিনের নয়। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললও, “আমার নাম জন টেলর।” আনন্দ তার নাম বলতেই বললও ,” তোমার নাম আমি শুনেছি এমিলির কাছে। সরি, এই দুর্ঘটনার জন্য।”

“ এমিলিকে চেনো কি ভাবে?” জিজ্ঞাসা করতেই মিস্টার টেলর বলল,” যে কাজের খবরা খবর জানতে এমিলি কে পাঠানো হয়েছিল আমি সেই কোম্পানির একাউনটেন্ট। এমিলি, সত্যি খুব স্মার্ট লেডি। Again sorry for your loss.” বলে আনন্দ কোন কিছু বলার আগেই দ্রুত বের হয়ে যেতে যেয়ে বললও,” সাবধানের মার নেই”।

আনন্দ তখনো হুড ওঠানো লোকটার চেহারা টা মনে করার চেষ্টা করছে। একে অন্ধকার, তারপর চোখে বড় ফ্রেমের কালো চশমা, ঠোটের পাশে ক্ষীণ হাসি। সব মিলিয়ে এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। রহস্যময় ব্যক্তির হাটার ছন্দটা আনন্দের পরিচিত মনে হয়ে ছিল। কোথায় যেন দেখেছে, মনে করতে পারলনা।

সকাল দশটায় কড়া নাড়িয়ে আনন্দকে ঘুম থেকে উঠালো মিস্টার থম্পসন। রাতে বিভিন্ন চিন্তায় ঘুম এসেছিল ভোর পাঁচটায়। দরজা খুলে থম্পসন কে বসতে বলে আনন্দ গেল মুখ হাত ধুতে। রুমের ফোনটা বেজে উঠতেই আনন্দ থম্পসনকে ফোনটা ধরতে বলে শাওয়ারের কলটা ছেড়ে দিলো। অপর প্রান্তে এমিলির বাবার গলা। গলার স্বর ভারী। থম্পসন আসতে বলল আনন্দের রুমে। কথা আছে।

আনন্দ ড্রেস আপ করে আসতেই এমিলির বাবা ও উপস্থিত। থম্পসন কোন ভূমিকা না করে বলল, “ মাথায় ভারী বসতুর আঘাতে এমিলি মারা গেছে। যার সাথে এমিলি কে দেখা গিয়েছিল তাকে পাওয়া গেছে। জবান বন্দি নাওয়া হয়েছে।”

এমিলির মা ফুফিয়ে কেঁদে উঠল

“সে কি সন্দেহর মধ্যে পড়ে?” জিজ্ঞাসা করলো এমেলির বাবা।

“ সবায়ই সন্দেহর মধ্যে পড়ে যতক্ষণ পর্যন্ত আসল খুনি কে না পাওয়া যায়।” বলল থম্পসন “ আপনারা মৃত দেহ নিয়ে যেতে পারেন।” কথা শেষে বাই বলে উঠার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে জন ঢুকল। আলুথালু বেশ। “এমিলিকে কোথায় দেখতে পাবো” বলে চারিদিকে তাকাল। আনন্দ পরিচয় করিয়ে দিলো থম্পসনের সাথে।

“ মর্গে গেলে দেখতে পাবে, সনাক্ত ও করতে পারবে। আমি ঐ দিকে যাচ্ছি, তুমি আমার সাথে এসো। কথা আছে।” বলল থম্পসন। আনন্দ গত রাতের কোন কথাই থম্পসনকে জানাল না। এমনকি হুড ওঠানো লোকটার কথাও না।

ওরা বেড়িয়ে পরতেই আনন্দ গেল লরেন্সের রুমে। দুজনে মিলে গেল সেই সাইট টা তে। সবাই মর্মাহত। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন প্রশ্ন। দরকারি কথা শেষে বেড়িয়ে পড়ল । রাস্তায় ভিড় বাড়ছে। সূর্যের তাপ প্রখর। ট্যাক্সির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল ল্যাম্প পোষ্টের নীচে। এই মুহূর্তে ট্যাক্সি পাওয়া দুরহ ব্যাপার। ভ্যাপসা গরমে দুজনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা। লরেন্স কি জেনো বলতে চাইছিল তার আগেই একটা কালো রং এর মারসেডিজ-বেঞ্জ জানালা গুলি কালো টিনটেড গ্লাসে ঢাকা পাশে এসে দাঁড়ালো। জানালা খুলতেই আনন্দ দেখতে পেলো মিস্টার টেলার, ইশারায় ডাকল, দরজা খুলে ভিতরে আসতে বলল।

“ কোথায় যাবে?”

“ পুলিশ স্টেশন।”

“ কাছা কাছি নামিয়ে দিতে পারি। কোন সুরাহা হোল ?” জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার টেলর

“ না, এই মুহূর্তে নয়।” বলল আনন্দ

“ আমাদের সার্ভেলেন্স ক্যামেরায় তোলা কিছু ছবি। দেখো, কাজে লাগলেও লাগতে পারে। “ বলে একটা এনভেলপ এগিয়ে দিলো আনন্দের দিকে। আনন্দ খুলল এনভেলপটা। নিজে দেখল। লরেন্স কে দেখালো। এমিলির ছবি। কন্সট্রাকশন সাইটের বিভিন্ন জাগায় তোলা। সাথে একজন যার ছবি থম্পসন দেখিয়ে ছিল। হোটেলে দেখা গেছে তাকে। দুরে কে জেনো দাড়িয়ে, আবছা। চেনা যায়না। মাথায় বেজবল ক্যাপের মত কিছু একটা পড়া। মুখটা ঢেকে আছে। লরেন্স তাকাল আনন্দের দিকে।

টেলর আনন্দ আর লরেন্স কে পুলিশ স্টেশনের কাছে নামিয়ে দিয়ে গুড লাক জানিয়ে চলে গেল। ওরা থম্পসনের ঘরে ঢুকে দেখল জন আর এমিলির বাবা মা বসা। জন লরেন্স কে দেখে জড়িয়ে ধরল। চোখে জল। লরেন্স ওকে বাহিরে নিয়ে গেল সান্ত্বনা দিতে।

চেয়ার টা টেনে বসতেই এমিলির বাবা বলল,” এমিলির বডি নিয়ে কাল আমরা রওনা হচ্ছি, তুমি যাবে সাথে?”

কথার উত্তর দেওয়ার আগে আনন্দ ছবি গুলো থম্পসনের দিকে এগিয়ে দিলো। বলল কোথা থেকে পেয়েছে সে।

বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর, “হু” শব্দ করে রেখে দিলো ড্রয়ারে।

লরেন্স আর জন ঘরে ঢুকতেই থম্পসন আনন্দের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি আর জন আর কয়েকটা দিন এখানে থাকবে। আমার দরকার পরবে তোমাদেরকে।”

আনন্দ লরেন্সকে বলল, আগামীকাল এমিলির বাবা মার সাথে বডি নিয়ে নিউইয়র্কে চলে যেতে। সবায়ই বেড়িয়ে এলো। দুই পা এগিয়ে আনন্দ ওদেরকে যেতে বলে ফিরে এলো থম্পসনের রুমে। থম্পসন আনন্দর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,” ফিরে এলে যে।”

“ আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছুটা ক্লু পেয়েছ। তবে এখনো সন্দেহ। হত্যাকারী কে? তাই না?”

সে কথার উত্তর না দিয়ে সে বলল,” আমার স্টাফ অনেক দুর এগিয়েছে, বাকি আছে কয়েকটা ল্যাব টেস্ট, ডিএনএ টেস্ট”।

“ আমাকে একবার এমিলির রুম টাতে নিয়ে যেতে পারবে?” বললও আনন্দ। “ অনেক দিনের চেনা, অনেক কাছের মানুষটা, কত কাটাছেড়া করেছি ড্রয়াইং এর উপর, বসেছি কফির পেয়ালা নিয়ে পাশের রেস্টুরেন্টে। হারিয়ে গেল। একবার দেখতে চাই সেই জাগাটা যেখানে সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল।”

“ নিয়ে যাবো, তবে একটা কথা তুমি অ্যাড করলেনা।”

“ কি?”

“ She had a crush on you. Is it right?”

“ অনেক রিসার্চ করেছ দেখছি এই ক’দিনের মধ্যে? আমিও কি তোমার সন্দেহের মধ্যে পড়ি?”

“ কে জানে, বলাতো যায়না। এটাই তো আমাদের কাজ সবায়কে সন্দেহ করা। তাই না?” বলে থম্পসন আনন্দকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। বাহিরে ওরা চার জন দাড়িয়ে। আনন্দ বলল সে এমিলির রুমে যাচ্ছে। জন যেতে চাইলে থম্পসন বলল,” না, তুমি গেলে তোমার মানসিক অশান্তি বাড়বে ছাড়া কমবেনা।”

আনন্দের হাতে গ্লভোস। কোন কিছু স্পর্শ করা নিষেধ। থম্পসন দরজা খুলল। নর্মাল সাইজের এক বেডরুম এপার্টমেন্ট। কাঠের মেঝে। ডান পাশে ক্লোজেট। কপাট খোলা। এমিলির কাপড় হাঙ্গারে ঝুলছে। এক পা এগোতেই বসার জায়গা। দুটো চেয়ার। একটা উল্টিয়ে পড়ে আছে। দুরে একটা রিক্লায়নার। সামনের কফি টেবিলটার উপরে রক্ত ছিটানো। কিছু কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিল্ডিংএর নকসা আকা কাগজটা মেঝেতে পরা। বা দিকে একটা টেবিল ল্যাম্প মেঝেতে ভেঙ্গে পরে আছে। তার পাশে প্রচুর শুকনো রক্ত। এমিলির দেহটা এখানে পরেছিল। সাদা চক দিয়ে আকা। রক্তের ছিটা দেয়ালে।

শোয়ার ঘরের বিছানা এলোমেলো। চাদর কুঁচকানো। একটা বালিশ আর কম্বল মেঝেতে। সাদা চাদরের মাঝে দুটো কালচে দাগ। হয়তো—,

থম্পসন ডাকল, “ দেখা শেষ হোল?”

বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে দুজনে।

“ দুই তিন দিনের মধ্যে ইনভেশটিগেসন শেষ করতে পারবো বলে আসা করছি।” বলল থম্পসন। “ সেই সাথে হত্যাকারীও হাতের মধ্যে এসে যাবে।”

আনন্দ জানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এর বাহিরে থম্পসন আর কিছু বলবেনা।

সন্ধ্যা আটটা। সবাই মিলে ডিনার করবে। লরেন্স বলল, “ তোমাদের কারো আপত্তি না থাকলে ডিনার হবে আমার তরফ থেকে।” সবাই রাজি। জন বলল তার একটু কাজ আছে পরে এসে মিলিত হবে। তাড়াহুড়া করে চলে গেল। মনে হোল কি জেনো খুঁজছে সে। এমিলির মা কিছুক্ষণ পর পর ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে উঠছে। বাবার চোখ ছলছল। ডিনার শেষে এমিলির বাবা আনন্দ কে বলল,” তুমি তো কিছুদিন থাকবে। নিশ্চয় এর মধ্যে হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়া যাবে। জন ডিনারে এলোনা কেন বুঝলাম না।”

“মানসিক দিক দিয়ে সে ও তো আঘাত কম পায়নি? হয়তো একাকী থাকতে চায়।” বললও আনন্দ।

পরদিন সকাল। ওরা ফিরে গেল নিউইয়র্কে এমিলির লাশ নিয়ে। জন আসে নি এয়ারপোর্টে। আনন্দ ফিরে আসে জনের খোজ করলো। ফোন করলো তার সেলে। ফোন বন্ধ। ভয়েস মেল ভরাট। আনন্দ হোটেলের লবিতে খোজ নিলো। কেউ জনকে দেখেছে কিনা, কোন মেসেজ আছে কি না। না, কিছুই নেই। ওর রুমে যেয়ে কয়েক বার ধাক্কা দিলো । কোন শব্দ নেই। আনন্দের মাথায় খারাপ চিন্তা ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। ম্যানেজার কে বলল রুমটা খুলতে।

কেউ নেই ঘরে। বিছানা পরিপাটি করে সাজানো। জন রাতে ফেরেনি। আনন্দের হার্ট বিট বাড়তে শুরু করলো। ক্লজেট টা খুলল। কয়েকটা জামা ঝুলছে। একটা ডাফেল ব্যাগ পরে আছে। আনন্দ উঠাল ব্যাগটা। ভিতরে হাত দিতেই আঠালো পদার্থের মত কি যেন হাতে লাগলো। রেখে দিলো । ক্লজেট টা বন্ধ করে দরজার দিকে ফিরতে যেয়ে আবারো ঘুরে দাড়ালো। বিছানার দু পাশের বালিশ সমতল ভাবে অবস্থিত নয়। একটা উচু অন্যটার চেয়ে। এগিয়ে গেল আনন্দ। বালিশটা সরাতেই দেখতে পেলো হুডেড সোয়েট সার্ট। মনে পড়ল সেই রাতে ধাক্কা দেওয়া লোকটার কথা। হুড দিয়ে ঢাকা মুখ, ওর চলার ছন্দ ছিল পরিচিত। ফটোতে দেখা সেই লোকটা। একই রং এর সোয়েট সার্ট। মাথাটা ঘুরে উঠল আনন্দের। তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এলো। বন্ধ করে দিলো দরজাটা।

নিচের বারে এসে বসলো আনন্দ। হাত কাপছে। চিন্তা শক্তি লোপ পাচ্ছে মনে হোল। ক্লাব সোডার পরিবর্তে হুইস্কি দিতে বলল। গ্লাসটা ঠোটের কাছে আনল আনন্দ। চুমুক দেবার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।

থম্পসনের ফোন। “আনন্দ, বিশ্বাস হয়? We got the killer. He is in our custody. You will be surprised.”। হাসতে হাসতে বলল থম্পসন।

আনন্দের সারা শরীর কেঁপে উঠল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো “কে সে?”।

“ আজ নয়, কাল বলব। এদেশ থেকে চলে যেতে চেয়েছিল। ঠিক সময়ে এয়ারপোর্ট থেকে ধরে আনা হয়েছে।” বললও থম্পসন ।

আনন্দ গ্লাসের তরল পানীয়টা গলার মধ্যে ঢেলে দিলো।

“ আগামীকাল দেখা হবে” বলে থম্পসন ফোন টা রেখে দিলো।

আনন্দ বুকের ভিতর একটা জ্বালা অনুভব করল। সে চায় এমিলির হত্যাকারী ধরা পরুক। কিন্তু ও যা ভাবছে সেভাবে নয়। উঠে পরতেই পা টা একটু টলকিয়ে উঠল। আবারো বসে পড়ল টুল টাতে। কাধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। ফিরে তাকাল সে। চোখটা কচলিয়ে নিয়ে  তাকাল। অবিশ্বাস্য। ভুলে গেল পারিপার্শ্বিকতা। চিৎকার করে বলে উঠল,

” জন? ইজ ইট ইউ? কোথায় ছিলে ?” বলে জড়িয়ে ধরল জন কে।

ক্রমশ

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প ( ১২ পর্ব)

                                                                       ১২ পর্ব

        মাস খানেক হয়ে গেল শুভ্র মারা গেছে। বেলাল, কল্যাণী ফিরে গেছে তাদের নিজেস্ব জাগায়। আনন্দ তার চেম্বারে। কয়েকটা প্লান তাকে অ্যাপপ্রুভ করতে হবে। এমীলী গেছে ডালাসে। একটা কাজের তদারকিতে। জন ছুটিতে। ডেভিড ইদানিং অফিসে খুব কম আসে। আনন্দ থাকলে সে এদিকে পা মারায়না। ফোনে খবরা খবর নেয়। কাজের শেষে লরেন্স আর মাইক বাস্কেটবল খেলা দেখতে যাবে ম্যাডিশন স্কয়ার গার্ডেনে। আনন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে যাবে কিনা। এক্সট্রা একটা টিকেট আছে। আনন্দ বলেছিল, না, তার স্টিভের সাথে যাওয়ার কথা।

ওরা চলে গেল। আনন্দ স্টিভ এর সাথে যেয়ে বসলো বারে। স্টিভ বললও,” মহিউদ্দীনের বউ এর একমাসের মধ্যেই ডাক পরবে ভিসার জন্য। তুমি তো দেশে যাবে বলছিলে, তখনি সব ব্যবস্থা করে আসতে পারবে।”

আনন্দ কোন উত্তর না দিয়ে ক্লাব সোডা তে চুমুক দিলো।

“কি ব্যাপার? কথা বলছো না যে?”

“ ভাবছি, তোমাকে বলতে বাধা নেই। সকালে কাশি দিতেই কিছুটা লাল রং এর কফ বেড়িয়ে এলো। হয়ত কিছুই

নয়। অনেক সময় ড্রাই কফ থেকে হয়।”

ডাক্তারের কাছে কবে যাবে?

দেখি, যেদিন সময় হবে।

স্টিভ আনন্দের দিকে তাকিয়ে বলল, দোহাই তোমার। গাফিলতি করোনা।

তাছাড়া আরও একটা কারণেও আনন্দ মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছে। সানন্দার সাথে উইকএন্ডে যাওয়ার কথাছিল ওর ছোট মেয়ের বাসায়। তিন ঘণ্টার পথ। থাকে সে আলবেনীতে। কথা ছিল দুজনে যাবে। সকালে যেয়ে রাতে ফিরবে। শেষ সময়ে সানন্দা আরও একজনকে এই যাত্রায় সঙ্গী করাতে আনন্দ আর যেতে চাইনি। বলেছিল, তোমরা যাও আমার যাওয়া হবেনা। ভেবেছিল এটা সানন্দার একলা ওর সাথে না যাওয়ার অভিপ্রায়।

আনন্দর আত্মসম্মানে লেগেছিল। তার জের এখনও রয়ে গেছে আনন্দের মনে।

মেয়ে টার গানটা আজকে বেসুরো মনে হচ্ছে আনন্দের কাছে। তাল ঠিক নেই। দোষ গায়িকার নয়। আনন্দের মাথায় অজস্র চিন্তারই পরিণতি। অন্যদিন এই গায়িকারই গানের সাথে সাথে আনন্দ তাল দেয়। আজ মন, চোখ আর কান সমতল রেখায় অবস্থিত নয়। তাই সুরটা তার ভাল লাগছে না ।

স্টিভ কে গুডবাই বলে সে উঠে পড়ল। যাবার সময় কিছু খাবার নিয়ে নিলো তার পরিচিত রেস্টুরেন্ট থেকে। বাসায় আজ খাবার বাড়ন্ত। যেখান থেকে মাঝে মধ্যে খাবার আসতো সেখানের হাড়ী খালি।

সানন্দা বলেছিল, কটা দিন কোনমতে চালিয়ে নেও। পারবে নিশ্চয়?

আনন্দ বলেছিল, যা পাচ্ছি তাতো পরে পাওয়া পাঁচআনা। আমার জন্য ভেবোনা, এক পেট, কোন রকমে চালিয়ে নিতে পারব।

খাওয়া শেষে অলস ভাবে কিছুক্ষণ বসে ছিল ডাইনিং টেবিলে আনন্দ। আমেনা ভাবীর সাথে বেশ কিছুদিন হলো কথা হয়নি। ফোনটা উঠিয়ে ডায়েল করলো। ভোর আটটা ওখানে।

কেমন আছো আনন্দ দা? জিজ্ঞাসা করলো ভাবী।

ভালো, স্টিভের সাথে কথা হয়েছিল, খুব শীঘ্রই তোমাদেরকে ডাকবে ভিসার জন্য। সানন্দা কে বলেছি তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে, যদিও আমিই সব দেখাশোনা করব। তোমাদের কোন অসুবিধা হবেনা।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আমেনা ভাবি। বললও,” ভাই থাকতে আমি অন্যের বাসায় থাকতে যাবো কেন আনন্দ দা। তোমার ভাগ্নি না তোমাকে বলেছিল তোমার কাছে আমাদেরকে রাখতে পারবে কি না। আজ তুমি নিজে হাতে আমাদেরকে সরিয়ে দিচ্ছো”।

না তা নয়। আমি থাকি একলা।

সেই জন্যই আমাকে থাকতে হবে তোমার কাছে। ভাইকে বোন ছাড়া কে দেখবে বলো।

ঠিক আছে। তাই হবে। সব কিছু বুঝে নিও। অনেক দিন তো হোল এ বাসায় উনন জ্বলেনা। তুমি এসে জ্বালিও।

জানো আনন্দ দা আমার শুধু মনে হয় কবে সানন্দা দি কে দেখব। খুব দেখতে ইচ্ছে করে উনাকে। নিঃস্বার্থ ভাবে তোমাকে দেখে রাখছে।

সত্যিই এমন বান্ধবী পাওয়া দুর্লভ। ও ছিল বলেই কথা বলে আমার সময়টা কেটে যায়। নচেৎ জীবন টা কোন দিকে মোড় নিতো আমি নিজেও জানিনা।

আজ রাখি। এই বলে কথার সমাপ্তি টেনে ছিল আনন্দ।

রাত দশটা। উপরে উঠে এলো। কখন যে চোখের পাতা টা বুঝে এসেছিল সে নিজেও মনে করতে পারেনা। ফোনের শব্দে ধড়মড় করে উঠে পড়ল। ঘড়িটার দিকে তাকাল। রাত চার টা। ডালাস থেকে ফোন। এমীলীর কথা মনে হোল। হ্যালো বলতেই, পুরুষের গলা।

আনন্দ আছে ?

বলছি।

আমি ডিডেকটিভ জো থম্পসন। ডালাস থেকে বলছি।

আনন্দের ঘুমের ঘোর তখনও কাটেনি। “হোয়াট?”

পুনর্বার বললও “আমি ডিডেকটিভ জো থম্পসন। ডালাস থেকে বলছি। এমীলী স্মিথ কে চেনেন?”

আনন্দের বুকটা খালি হয়ে এলো। অশুভ কোন খবর। “আমার কলীগ। হোয়াটস রং?”

“ মারা গেছে, কেউ হত্যা করেছে মনে হচ্ছে। তোমার নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার ওর ব্যাগে ছিল। “

আনন্দ চুপ করে রইল, সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। এমেলী খুন হয়েছে। ও স্বপ্ন দেখেছে না তো? চামড়ায় চিমটি কেটে দেখল, না সে জেগে আছে।

“ এমীলীর মা বাবা কে খবর দেওয়া হয়ছে?” প্রশ্ন করলো আনন্দ।

“ না, ওদের ফোন নাম্বার টা থাকলে দাও।” বললও ডিডেকটিভ থম্পসন

ফোন নাম্বার টা দিয়ে আনন্দ বললও,” আই উইল বি ফার্স্ট ফ্লাইট আউট।”

রাত অনেক, ফোন করলো ডেভিড কে। বিস্তারিত সব কিছু জানিয়ে বললও,” আমি প্রথম ফ্লাইটে ডালাস যাচ্ছি সঙ্গে লরেন্সকে নেবো ভাবছি।”

ডেভিড ইতি বাচক উত্তর দিয়ে বললও,”আমাকে টাইম টু টাইম খবর দেবে।”

আনন্দ তাঁকে আশ্বাস দিলো, বললও “চিন্তা করোনা তোমার হার্টের প্রবলেম।” আনন্দ জানে ডেভিডের হার্টের পেলপিটিসন বেড়ে গেছে। নিজের কোম্পানির এমপ্লোই, খুন হয়েছে অন্য স্টেটএ। সব খবর না পাওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই।

লরেন্স কে কল করে এয়ারপোর্টে আসতে বললও। ভোর সাতটায় ফ্লাইট।

যথা সময়ে পৌছে, আনন্দ আর লরেন্স এলো হোটেলের চত্বরে। চারিদিকে ব্যারিকেড দেওয়া। লেখা আছে “ Do not cross the line.” আনন্দ নিজের পরিচয় দিয়ে ডিডেকটিভ থম্পসন কে চাইল। পরিচয় হতেই আনন্দ জিজ্ঞাসা করলো মৃতদেহের কাছে সে যেতে পারে কিনা।

না, বললও মিস্টার থম্পসন, “This is a crime secne. You will see the body in the morgue to indentify.”

“ তোমাকে আমার সাথে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে, এমীলী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য।” বলল মিস্টার থম্পসন।

দুর থেকে আনন্দ দেখল এমীলীর বাবা মা আসছে। ক্রন্দন রত। আনন্দ, লরেন্স, মিস্টার থম্পসন এগিয়ে গেল। আনন্দ জড়িয়ে ধরল এমীলীর বাবা কে। শেষ দেখা হয়েছিল ফার্মের বর্ষপূর্তি উৎসবে। সান্ত্বনা দেবার কিছু নেই। মিস্টার থম্পসন বলল, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো হত্যাকারী কে বের করতে।

আনন্দ লরেন্সকে বললও জনকে জানানোর জন্য, সে এমীলীর ফিআন্সে।

লরেন্স কে হোটেলে চলে যেতে বলে আনন্দ পুলিশ স্টেশনে এসে পৌছাল বিকেল তিন টায়। এমীলীর বাবা মার সাথে। জিজ্ঞাসা বাদ শেষে মিস্টার থম্পসন দুটো ফটো দেখাল আনন্দকে। প্রথমটা এমীলীর সাথে এক কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক এলিভেটরের কাছে দাঁড়ান। বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ। আনন্দ চেনে কিনা জানতে চাইলে বলল কোনদিন দেখেনি। অন্যটা হুড দিয়ে ঢাকা মুখ। চেনা যায় না।

তাহলে কি — , আনন্দের কথা শেষ না হতেই মিস্টার থম্পসন বলল, “Don’t come to the conclusion”.

“তুমি এখানে কিছুদিন থাকলে ভালহয়। “

আনন্দ আপত্তি করেনি। মিস্টার থম্পসন আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল,” তুমি বলেছিলে এমিলীর ফীয়ান্সে আছে। কাজ করে একি ফার্মে। নাম জন। তাই না?”

হাঁ

ওর ফোন নাম্বার আছে? জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার থম্পসন

ওর সাথে যোগাযোগ করেছি, আগামীকাল আসবে।

আনন্দ ফিরে এলো হোটেলে এমিলীর বাবা মার সাথে। এমিলীর বডী পোষ্টমরটমে পাঠানো হয়েছে। মিস্টার থম্পসন বলেছে, যে লোকটার সাথে এমিলীকে দেখা গেছে তাকে তল্লাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া তে তার ফটো দেখানো হচ্ছে। অতি তাড়াতাড়ি তার খোজ পাওয়া যাবে আসা করছে।

আনন্দ ফোন করলো ফার্মে। ডেভিড কে বিশ্লেষণ করলো সব কিছু। বিষাদের কালো ছায়া সেখানে।

সন্ধ্যা হয়ে এলো। লরেন্স কে জিজ্ঞাসা করলো বারে যাবে কিনা। অস্থির লাগছে। না, সে এই মুহূর্তে কোথাও যেতে রাজি নয়। বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে লবিতে এসে বসলো লরেন্স।

আনন্দ বেড়িয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। লোকের চলাচল ততোটা নয়। রাস্তার পাশের গাছগুলো কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে পথ টাকে। এমিলীর হোটেলের দুই ব্লক দুরে আনন্দের হোটেল। সেখানে পুলিশের আনাগোনা এখন। একটা মাতাল পথ আগলিয়ে ধরে পয়সা চাইল। পুলিশের গাড়ী হর্ন বাজাতে বাজাতে আনন্দের থেকে কিছুদূরে যেয়ে দাঁড়াল। আনন্দ তার চলার গতি কমিয়ে দিলো। এই মুহূর্তে সে পুলিশের সাথে কথোপকথন করতে রাজি নয়। কিছুক্ষণ থেমে আবারো হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে গেল। রাস্তা নির্জন। এখনো চার ব্লক যেতে হবে। হঠাৎ করে গা টা শিরশির করে উঠল। আনন্দের মনে হোল কে জেনো ওকে ফলো করছে।

পিছন ফিরে থাকাল। কিছুদূরে একটা লোক আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে। মাথায় টুপি। হাতে ধরা একটা লম্বা আকারের জিনিস। কি সেটা এতো দুর থেকে বোঝা গেলনা। আনন্দ তাকাতেই লোকটা হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো। আনন্দের হার্টের দপদপানি বেড়ে গেল, হাতের তালু ভিজে। চারিদিকে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পেলনা।

পিছনে ফিরে এবার তাকাতেই ধাক্কা দিলো সামনে হেঁটে আসা লোকটা।

মাথায় হুড। এক ঝলক ফিরে তাকাল সে । অন্ধকারে আনন্দ দেখেতে পেলোনা মুখটা।

ক্রমশ

***স্থান কাল চরিত্র সব কাল্পনিক***

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প ( ১১ পর্ব)

                                                                     ১১ পর্ব

        ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল মাথা থেকে গালের পাশ বেয়ে। রক্তের স্রোত ততোটা নয়। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। পকেটের রুমাল টা দিয়ে মাথা টা চেপে ধরে পাশের গাছে হেলান দিয়ে বসলো আনন্দ। আকাশে তখনো জ্যোৎস্না। ভোর হতে কিছু বাকি। লোক টা রেগে গিয়েছিল। রেগে গিয়েছিল কারণ আনন্দের পকেটে কিছুই ছিলনা। মানিব্যাগ টা রেখে এসেছিল গাড়ীতে, ফোন টা কোথায় মনে করতে পারেনা। গালাগালি দিয়েছিল লোকটা। “ হারামজাদা, কিছু নেই পকেট ? আজকের প্রথম বউনী আমার মাঠে মারা গেল ?” বিড়বিড় করে আরও কি জেনো বললও। তারপর পিস্তলটা আনন্দের বুকের কাছে ধরল। আনন্দ দেখতে পেলো হুডের নীচে ওর চোখের হিংস্রতা। দ্রুত তার মাথার মধ্যে খেলে গেল, “দিনের শুরুতে তার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে আজ। দীপ, সু তাদের মা কে হারিয়েছে আজ তারা বাবা কেউও হারাতে চলেছে। পিস্তল টা যেখানে ধরা সেখানেই হৃদপিণ্ড। গুলিটা হৃদপিণ্ড কে ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে যাবে। ও লুটিয়ে পরবে মাটিতে। পুলিশ আসবে। কোন আইডেনটিটিকার্ড নেই ওর কাছে। ও হয়ে যাবে জন ডো।”

না, লোক টা গুলি না করে এক পা পিছিয়ে গেল। তারপর পিস্তলের বাঁট দিয়ে জোড়ে মেরেছিল আনন্দের মাথায়। লুটিয়ে পড়েছিল আনন্দ। কতক্ষণ জানেনা। চোখ খুলতেই মনে হল গালের পাশটা ভিজে ভিজে। রক্ত।

গাছে হেলান দিয়ে বসে আনন্দ ভাবল এবার উঠতে হবে। রক্ত গুলো জমাট বেঁধে গেছে। ফিরে যেতে হবে পুলিশ আসার আগেই। পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা। ওরা বিভিন্ন জিজ্ঞাসা বাদ করবে। কাজের কাজ কিছুই হবেনা। সময় নষ্ট। হাসপাতালে সে যেতে রাজি নয়। বিভীষিকা ময় ER সে দেখেছে। বাসায় ফিরে এলো আনন্দ। রুমাল টা রক্তে ভেজা। গালের পাশের জমাট বাধা রক্ত গুলো গরম জল দিয়ে পরিষ্কার করলো। আঠা আঠা চুলগুলো সরিয়ে আয়না দিয়ে দেখতে চাইলো ডেমেজ টা কতটুকু। ততোটা নয়। ইস্টিচ লাগবে বলে মনে হোল না। আশেপাশের চুল গুলো কেটে জাগাটা পরিষ্কার করলো আনন্দ। এলকোহল প্যাড টা চেপে ধরল কাটা জাগায়। ঠোট দুটো কামড়িয়ে জ্বালাটা কমাতে চাইল । এনটিবাওটিক ওয়েনটমেনট লাগিয়ে সোফাতে এসে বসলো আনন্দ।

   সকাল হয়ে এলো। বন্ধের দিন আজ। এতো ভোরে কাউকে বিরক্ত করতে চাইলনা। একবার ফোনটা উঠিয়ে ছিল সানন্দাকে ঘটনাটা জানানোর জন্য। পরে রেখে দিয়েছিল। ইদানিং সবকিছুতে না সুচক উত্তরের জন্যই হয়তবা।

সকাল দশটা। আনন্দ টেক্সট মেসেজ পাঠাল ওদের চার জন কে। বিস্তারিত না জানিয়ে। শুধু লিখেছিল, মাথাটা কেটে গেছে, রক্ত এসেছিল, এখন বন্ধ। আনন্দ জানে এটাই যথেষ্ট। এখনি ফোন আসা আরম্ভ হবে। ঠিক তাই। সু র ফোন।

কি বললে তুমি? রক্ত এসেছিল ? কিভাবে? কখন?

আনন্দ কিছু বলার আগেই সে বললও,” তুমি ফোন রাখো, আমি দীপ কে কল করে থ্রি ওয়ে কথা বলব।”

সব কিছু বিশ্লেষণ করতেই দীপ বললও,” আমরা এখনি আসছি।

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে চার জন এসে হাজির। বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। কেন এতো রাতে বের হয়েছিল। বের যদি হবেই তবে পার্কে যাওয়ার কি দরকার। অবশেষে ওদের প্রস্তাব আনন্দকে দুজনের যেকোনো এক বাসাতে থাকতে হবে। একা আর নয়।

     আনন্দ একটু হাসল। ওদের ছেলে মানুষি দেখে। আসলে বাবাকে ভালবাসে তাই। সহজ সরল সমাধান।

   তা হয়না, বললও আনন্দ। আমার নিজস্ব একটা স্বত্বা আছে। তাছাড়া আমিতো পঙ্গু হয়ে যাইনি। তোমাদের উৎকণ্ঠা আমি বুঝি। শোন, কথার  মোড় ঘুরিয়ে বললও, “ বউমা, তোমার ডাক্তার ফারুক আঙ্কেল কে কল করে বল যদি পারে তবে একবার জেনো আসে এখানে”।

সু, দীপ, রাজ বউমা এদের নিয়েই আনন্দের সংসার। প্রতিদিন দুই তিন বার করে ফোন করবে। বাবার কি অবস্থা। ওরা ভাবে আনন্দের নিজেকে টেক কেয়ার করার ক্ষমতা ফুরিয়ে এসেছে। খুব বেশি ভালবাসার এটাই হয়ত নিদর্শন।

   দরজার বেলটা বেজে উঠল। রাজ দরজাটা খুলে দিতেই সানন্দা ঘরে ঢুকল।

“ আমাকে জানাওনি কেন।”

বিরক্ত করতে চাইনি। বললও আনন্দ।

“সেই রাতে তুমি যে ফোন করেছিলে কথা বলবে বলে, যদি কথা বলতাম তা হলে হয়ত এ ঘটনা নাও ঘটতে পারতো। নিজেকে খুব দোষী মনে হচ্ছে।”

“ তুমি কি করবে বলো, বিধির বিধান তুমি তো খণ্ডাতে পারবেনা।”

সানন্দাকে খবর সু দিয়ে ছিল। জানে সানন্দা আসলে একটু স্বস্তি। সেই সব দেখাশুনা করতে পারবে।

বউমা বললও, “অ্যান্টি তুমি বাবার পাশে বসো আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।” বলে সবায় কে ইঙ্গিত করলো অন্য ঘরে যেতে।

ওরা উঠতে যাওয়ার আগেই সানন্দা সু কে বললও এলকোহল প্যাড, ডিসপজেবল গ্লভস, অ্যান্টিবাওটিক অইনটমেন্ট আর ব্যান্ডেট টা আনতে। কাটা জাগা টা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেট টা লাগিয়ে দিয়ে বললও,” এসব পাগলামি বন্ধ করো। রাত বেরাতে বেড়িয়ে একটা না একটা অঘটন করবে আর অন্যদেরকে ভোগাবে।”

আনন্দ সানন্দাকে দেখছিল। ভাবছিল, শুধুতো বান্ধবী তার বেশি তো কিছু নয়। সব কিছুই সে করছে অথচ কোথায় জেনো একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে।

মনে পরে একদিন আনন্দ বলেছিল,”যাবে কি আমার সাথে, আমি লন্ডন হয়ে মারাকাশ যাবো। তোমার আপত্তি আছে?”

যেতে চাইলেও যেতে পারবো না বলেছিল সে।

কেন? বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল সানন্দার দিকে।

আমি বিধবা, সমাজ নিয়ে চলতে হয়। তোমার মত উদার মনের মানুষ তো সবায় নয়। অনেকে অনেক কিছু মনে করতে পারে।

মনে করতে পারে ? কি মনে করতে পারে ? ছেলে মেয়ে একসাথে ভেকেসনে যেতে পারবেনা ? তাতে অসুবিধা কোথায় ? আনন্দ কিছুটা উত্তেজিত হয়েই কথা গুলো বলেছিল।

সানন্দা ধীর স্থির। উত্তেজিত হতে আনন্দ তাঁকে দেখিনি কখনো। সেটাকে বজায় রেখে বলেছিল, লোকের মুখতো বন্ধ করতে পারবেনা। তারা দেখবে অন্য চোখে। সে সুযোগ নাই বা দিলে। তোমার সাথে বোস্টনে তোমার বান্ধবীর বাসাতে তো গিয়েছিলাম। সেখানে ছিল তোমার বান্ধবী ও তার স্বামী। অসুবিধা হয়নি কারণ সেখানে তুমি আমি একা নই। এখন বুঝলে?

বুঝেছি? গজগজ করতে করতে আনন্দ বলেছিল, এই ঘুণধরা সমাজটার মানসিক চিন্তা ধারা যদি পাল্টানো যেতো।

সানন্দা হাসতে হাসতে বলেছিল তুমি তো সমাজ কর্মী নও, নিতান্তই ভালো মানুষ। তোমাদের মত মানুষরা শুধু দুঃখই পায় ।

দুমাস পরে আমি দেশে যাবো, কয়েকটা কাজ হাতে নিয়ে তখন যাবেতো। আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল সানন্দা কে।

যাবো। তোমার বোনের বাসায় উঠবে তো। তাতে আমার আপত্তি নেই।

কি ভাবছ? সানন্দার ডাকে আনন্দ ফিরে এলো বাস্তবে।

উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। বেলালের ফোন। অনেক দিন পরে। সানন্দা ফোনটা উঠিয়ে হ্যালো বোলতেই , সরি, রং নাম্বার বলে বেলাল রেখে দিচ্ছিল।

“ বেলাল ভাই , আমি সানন্দা।”

“ আমি কি তোমার ফোনে কল করেছি?”

“ না, তুমি আনন্দ দার ফোনে কল করেছ। সে একটু বাস্ত। তুমি ধর।”

হ্যালো বলতেই ,” আনন্দ দা আমি নিউইয়র্কে। শুভ্র মারা গেছে।” বলে একটু থামল বেলাল। “ তুমি আসতে পারবে? একটু এসো, কল্যাণী কে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে আমার পক্ষে। পারবে আসতে?”

ওর বেদনা ভরা কণ্ঠস্বর আনন্দ কে ব্যাকুল করে তুলল।

“ঠিক আছে, ঠিকানা টা দাও আমি আসছি”। যদিও মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ব্যাথার ঔষধ খেয়েছে কিনতু না গেলেই নয়।

সানন্দকে সব বুঝিয়ে বলতেই সে বলল,” আমি তোমার সাথে যাবো”।

সু,দীপ জানে বাবা কে বলে কোন লাভ নেই। সে যখন মনস্থির করেছে যাবে, তখন সে যাবেই। তবে সান্ত্বনা সানন্দা সাথে যাচ্ছে।

লোকের ভিড় বেশি নয়। কল্যাণী কাঁদছে। সানন্দা এগিয়ে গেল ওর দিকে। বেলাল আনন্দকে জড়িয়ে ধরল।

ড্রাগ ওভারডোজ। বললও বেলাল।

মা মারা গিয়েছিল ছোট বেলায়। কল্যাণী দশ, শুভ্র আট। বাবা বিয়ে করেছিল এক বছরের মাথায়। সৎ মার সাথে বনিবনা হয়নি ওদের দুজনের। বাবা বুঝেও না বুঝের ভান করে থাকতো। মামা একদিন ওদের কে নিয়ে গিয়েছিল তার বাসায়। বাবা না করেনি। সন্তান হীন মামা কোলে পিঠে করে ওদের দুজন কে মানুষ করেছিল। দিয়ে ছিল উচ্চশিক্ষা। কল্যাণী ভালো চাকরি নিয়ে চলে গিয়ে ছিল ডালাসে। শুভ্র নিউইয়র্কে এপার্টমেন্ট ভাড়া করেছিল।

     পিটার লুগারের সাথে শুভ্রর দেখা হয়েছিল এক কন্সার্টে। সম বয়সী। অতি ভদ্র, যুক্তি তর্ক দিয়ে কথা বলে। কথায় মাধুরী মিশানো। বন্ধুত্ব হয়েছিল। পিটার শুভ্রকে নিয়ে গিয়েছিল এক পার্টিতে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল লোটাসের সাথে। ড্রাগ ডিলার। শুভ্রকে হুকড আপ করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি লোটাসের। সেই শুরু।

ভাইকোডিন। প্রথমে একটা দুটো পিল। তারপর ক্রমেই বাড়তে থাকল পিলের পরিমাণ। সেই সাথে কাজে যাওয়া কমে আসল। শুভ্রর বস কল্যাণী কে বলেছিল ওর কাজের অনিয়মের কথা। অনেক চেষ্টা করেছিল কল্যাণী ওকে এই নেশার থেকে ফেরাতে। পারেনি।

এক রাতে পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ডাক্তার বললও Pancreatites. শুভ্র তার এডিকশনের কথা বলেনি। তাঁকে prescribe করা হোল ভাইকোডিন। ব্যাথার জন্য। বাসায় ফিরে এসে কল্যাণীকে ফোন করে বলেছিল, আপা আমি বোধ হয় আর বাচবো নারে। সেই রাতে ব্যাথার যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে ভাইকোডিনের পুরো বোতল ঢেলে দিয়েছিল গলার ভিতর। সব ব্যাথার অবসান হয়েছিল। চোখ আর খোলেনি শুভ্র।

আনন্দ ধীর পায়ে এগিয়ে গেল কল্যাণীর কাছে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। কল্যাণী,সানন্দা,বেলাল কাঁদছে। দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবা। চোখে জল নেই। তাকিয়ে আছে সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশের দিকে। আর নয়। এবার শুভ্রর যাবার পালা হিম শীতল কক্ষে। কান্নার ধনী চারিদিকে। ফুঁপিয়ে উঠল কল্যাণী।

কাল শুভ্রর শেষ যাত্রা।

ক্রমশ

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প

                                                                                     ১০ পর্ব

       সাত দিন পর আনন্দ ফিরে এসেছিল। সাতটা সুন্দরতম দিন কাটিয়েছিল ফ্লরেন্তার সাথে। বসে ছিল টেমস নদীর ধারে। সময় ক্ষণ, ঝিরঝির বাতাস, নির্মল সন্ধ্যা, আকাশে চাঁদ এই সব বেস্টিত জগত ফ্লরেন্তাকে করেছিল ব্যকুল। সেই সন্ধ্যায় অনর্গল বলে গিয়েছিল তার জীবনের ডায়রি।

এক ভাই এক বোন। ডেভিড আর ফ্লরেন্তা। ফ্লরেন্তা সাত বছরের ছোট। যখন তার বয়স পঁচিশ. গাড়ী দুর্ঘটনায় বাবা মার মৃতু গভীর দাগ কেটেছিল ওর মনে। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চেয়েছিল, পারেনি। মা বাবার আদর আর ভাইয়ের ভালবাসায় বড় হয়েছিল। হঠাৎ জীবনের এই একটা অংশ হারিয়ে যাওয়া সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। মানসিক ডাক্তারদের মতে এ শুধু সময় সাপেক্ষ।

ইন্টারনেট খুঁজে জেনেছিল, মানসিক শান্তির পথ আছে শুধু মেডিটেশন আর ইয়োগার মাধ্যমে। যেতে হবে আশ্রমে। কোথায় সে আশ্রম ?

ভারতের কেরালা স্টেটে।

ডেভিড কে বলেছিল। ডেভিড না করেনি। শুধু বলেছিল তার এক বন্ধু থাকে দিল্লিতে সেই সব ব্যবস্তা করে দেবে।

দিল্লী বিমান বন্দরে যথাসময়ে জনাথন ফ্লরেন্তাকে রিসিভ করে নিয়ে গিয়েছিল ওর এপার্টমেন্টে। ফ্লরেন্তার থাকার ব্যবস্থার কোন ত্রুটি জনাথন করেনি।

জনাথন বলেছিল,” চলো, আশ্রমে যাওয়ার আগে তোমাকে ঐতিহাসিক জাগা গুলো দেখিয়ে নিয়ে আসি। রাজি তো?”

ফ্লরেন্তা রাজি হয়েছিল। কেন জানি জনাথনের সান্নিধ্য তার ভালোই লাগছিল। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, উচ্চতা সাত ফুটের কাছা কাছি। এক কন্সট্রাকশন কোম্পানির উচ্চপদে অধিসঠিত। জনাথন কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ফ্লরেন্তাকে দেখিয়ে ছিল লাল কেল্লা,কুতুব মিনার। গিয়েছিল তাজমহল দেখতে।

তাজমহলের চত্বরে বসে সেই প্রথম জনাথন চুমো দিয়েছিল ফ্লরেন্তা কে। ফ্লরেন্তা বাধা দেইনি। এক নতুন আনন্দের শিহরনে তার সর্ব শরীর শিহরিত হয়ে উঠেছিল। আশ্রমে আর যাওয়া হয়নি। থেকে গিয়েছিল জনাথনের সাথে।  ডেভিড কে জানিয়ে ছিল সব কথা। বলেছিল ওদের বিবাহর দিন ঠিক হয়েছে। ওরা জেনো আসে এই অনুষ্ঠানে।

কিছু মাস পর জনাথন নূতন কাজ নিয়ে চলে এসেছিল লন্ডনে ফ্লরেন্তাকে নিয়ে। ফ্লরেন্তা আরম্ভ করেছিল স্কুলের মাস্টারি। কাজের ফাকে ফাকে দুজনে চলে যায় বিভিন্ন জাগায়। বাবা মা হারিয়ে যাওয়ার বেদনা লাঘব হয়েছে ফ্লরেন্তার। মানসিক ভারসাম্য ফিরে পেয়েছে।

একদিন ফ্লরেন্তার স্কুল ছুটি হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের আগে। ঠিক করেছিল জনাথন কে ফোন করে বলবে লাঞ্চ করবে একসাথে। কি মনে করে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। ভেবেছিল তার নিজেস্ব কিছু কাজ আজে, সময়ের অভাবে শেষ করা হয়ে ওঠেনি। তাই বাসায় ফিরে যাওয়াটাই মনস্থ করল ।বাসার ড্রাইভওয়েতে অচেনা একটা গাড়ী। জনাথনের গাড়ীও এই মুহূর্তে এখানে থাকার কথা নয়। ভয়ে ভয়ে দরজাটা খুলেছিল ফ্লরেন্তা।

জনাথন সোফাতে গভীরভাবে মিশে গেছে এক অচেনা মেয়ের মাঝে। শুধু শুনতে পেলো ইস,উঃ,আঃ,আঃ শব্দ। হাতের কাছের ফুলদানী টা ছুড়ে ফেলেছিল। ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে পড়েছিল দুরে। জনাথন কে বেড়িয়ে যেতে বলেছিল বাসা থেকে।

সেই শেষ।

তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। স্কুলের এক মিটিং এ দেখা হয়েছিল এনড্রুর সাথে। এনড্রু বলেছিল ওর এনড্রু কমিউনিটি প্রজেক্টের কথা। ফ্লরেন্তার ভালো লেগেছিল। হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়ে গুলোকে ভালবাসা দিয়ে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়ে ছিল। আর পিছনে ফিরে তাকায়নি।

বিমান বন্দরে বিদায় দিতে এসে বলেছিল, আনন্দ তোমার সান্নিধ্য আমার খুব ভালো লেগেছে। পারলে আবার এসো।

   আনন্দের কেন জানি অস্বস্তি লাগছে আজ। দুদিন ঘুম আসেনি। গতকাল আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল সানন্দাকে ,” যাবে নিউপোর্টে বেড়াতে? খুব একটা দুর নয়। সকালে যেয়ে রাতে ফিরে আসবো। যাবে?”

হা, না কিছুই সে বলেনি। যেতে ইচ্ছুক্ক নয় মনে হোল। কোথায় জেনো একটা দ্বিধা। আনন্দ আর কোথা বাড়ায়নি। আনন্দের স্বভাব, একবার চাইলে যদি না পাওয়া যায়, দ্বিতীয় বার সেটা চাইতে সে রাজি নয়। আজ হঠাৎ করে কেন সব কিছুর পরে বিতৃষনা আসছে সে বুঝতে পারছেনা। রাত দশটা। মনে হচ্ছে কারো সাথে যদি একটু কথা বলেতে পারতো হয়ত ভালো লাগত। সানন্দা কে ফোন করেছিল।

বলল,” ভাল লাগছেনা। তাই কথা বলে কিছুটা সময় পার করতে চেয়েছিলাম। তুমি কি বাস্ত?”

একটু, কাল কথা বলবো?

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো আনন্দ। নীচে নেমে টিভি টা অন করলো। ভালো খবর নেই। শুধু মারামারি কাটাকাটি। বন্ধ করে দিলো। মাথার পোকাটা আজ আনন্দকে পেয়ে বসেছে। রাত এগারটা।

গাড়ীর চাবিটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। রাস্তা নির্জন। ভাবল কিছুক্ষণের জন্য উদ্দেশহীন ভাবে ঘুরবে। একটু ড্রাইভ করতেই পাশে একটা পার্ক দেখে থামালো গাড়ীটা। পার্কের ভিতরে পায়ে চলা পথ। কিছুদুরে একটা ছোট্টও দীঘি। শান বাধানো। আনন্দ এসে বসলো সিঁড়িটার পরে। ফুটফুটে জোছনা। চাঁদের এলো ঝরেঝরে পড়ছে দীঘির জলে। নিস্তব্ধ চারিদিক। নিস্তব্ধটাকে ভাঙতে চাইল আনন্দ। ছোট্টও একটা পাথর ছুড়ে মারল দীঘির জলে। টলমল করে উঠল জল। চাঁদের আলো জলের ঢেউএ মিশে সৃস্টি করলো এক অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ। আনন্দের মনে হোল অসংখ্য হীরের টুকরা ঝলমল করছে।

চোখ বুজে এলো। শুয়ে পড়ল দীঘির পাড়ে।

ফিরে গেল অনেক পিছনে।

বসুন্ধরা মার্কেটে ঘুরছিল ওরা দুজন।

কণার ব্যাগে টান পড়তেই হাতটা চেপে ধরেছিল। ছোট্টও বাচ্চার হাত। ফিরে তাকাতেই দেখল চোখ ছলছল করা এক সাত আট বছরের ছেলে।

বললও, “ আমাকে পুলিশে দিয়েন না মেম সাব ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”

একাজ কেন করছিস ? ধমক দিয়েছিল কণা।

ওরা আমাকে করতে বাধ্য করেছে, তা না করলে আমার হাত কেটে ফেলবে।

ওরা কারা? জিজ্ঞাসা করেছিল কণা

যাদের কাছে মা বাবা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল।

বিক্রি করে দিয়েছিল?

হা, মাত্র পাঁচশ টাকা দিয়ে। আমার অনেক খিদে পেয়েছে মেমসাব।

কণার হাসি পেয়েছিল। সে এসেছিল চুরি করতে, এখন চাচ্ছে ভাত। কণা নিয়ে গিয়েছিল পাশের হোটেলে।

খাওয়া শেষে বলেছিল, আমরা ছিলাম দুই ভাই এক বোন। কোন দিন পেট ভরে খেতে পারিনি। বাবা ছিল অসুস্থ।

মা অন্যের বাসায় ধোয়া মোছার কাজ করত। মার পাশে আমরা দুই ভাই শুয়ে থাকতাম। রাতে দেখতাম মা কাঁদছে। একদিন দেখলাম দুটা লোক এসে মা বাবার সাথে কি জেনো গুজগুজ ফুসফুস করছে। আমি আসতেই ওরা কথা বন্ধ করে দিলো। আরও একদিন দেখলাম ওদেরকে। শুনলাম টাকার কথা বলছে। পাঁচশো, পাঁচশো।

এর পর কথা নয়। শুধু খসখস শব্দ শুনলাম। শুনলাম কান্নার আওয়াজ। মার কান্না মনে হোল।

কিছুই বুঝলাম না। ভাই আমার দু বছরের বড়। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম। ও একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে কি জেনো গুনতে থাকল। সেই শেষ দেখা তার সাথে আমার।

ওরা বেড়িয়ে এলো। বাবা শুয়ে ছিল। ডাকল আমাদেরকে। শুধু দুজনের মাথায় হাত বুলাল। কিছু বলল না।

চোখের কোণ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

মা পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে যেয়ে বলেছিল, ওদের সাথে যেতে, ভালো ভালো খেতে পারবো। নতুন নতুন জামা কাপড় পাবো। এখানে তো একবেলাও খাওয়া জোটেনা। ছেড়া কাপড় পরে থাকি।

ওরা শিখিয়ে ছিল কেমন ভাবে পকেট কাটতে হবে। বলেছিল যদি প্রতিদিন এই পরিমাণ টাকা না আনতে পারি তবে খাওয়া বন্ধ। আর চাবুক দিয়ে পিঠ ছিলে দেবে।

পিঠের কাপড় উঠিয়ে দেখিয়েছিল দাগ গুলো। দু একটা জাগা এখনো শুকিয়ে যায়নি।

কণা উঠে চলে গিয়েছিল। গিয়েছিল রেস্টরুমে। আনন্দ জানে কণা ওখানে যেয়ে কাঁদবে।

ফিরে এসেছিল চোখ লাল করে। কিছু টাকা ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, “ তুই যা, এর বেশি আমি তোকে কিছু করতে পারবোনা। ওদের হাত থেকে আমি তোকে বাঁচাতে পারবোনা।”

সে চলে গেল, মিশে গেল ভিড়ের মাঝে।

কোথায় একটা খসখস শব্দ। উঠে বসল আনন্দ। সেল ফোনটা খুঁজল। পেলোনা। হয়ত গাড়ীতে। কিছুই মনে করতে পারলনা। চাঁদটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। পাখিদের কলকাকলী নাই। ভোর হতে দেরী আছে। আনন্দ চিন্তা করলো কোথায় সে তার গাড়ীটা পার্ক করেছিল। পায়ে চলা পথ দিয়ে এগুতেই দেখতে পেলো কে একজন সামনে এগিয়ে আসছে। ভাবল ওরই মত দুঃখ বেদনা দুর করতে এসেছে এই নির্জনে। কাছে এসে দাঁড়ালো। এই গরমেও মাথা হুডটা দিয়ে ঢাকা। চাঁদের আলোতে ঝলমল করে উঠল ওর হাতের সিলভার রংএর পিস্তল টা।

ক্রমশ

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প ( ৯ পর্ব)

                                                                                                      নয় পর্ব

        ডি এন্ড জে এসোসিয়েটের কর্মক্ষেত্র আজ আনন্দে ভরপুর। ডেভিড ফিরে আসছে পাঁচ মাস পর। এমিলি, জন, লরেন্স মিলে তৈরি করেছে “ওয়েল কাম ব্যাক” কার্ড। খুবই সুন্দর দেখতে । সবাই লিখেছে কিছুনা কিছু। ছোট্টও করে আনন্দ লিখেছিল, লং লীভ দা কিং।

     ডেভিড এলো এগারটায়। জেনিফারের সাথে। সবার সাথে হাত মেলানোর পর কিছু বলতে যেয়ে আবেগে বলতে পারলনা। চশমাটা কয়েকবার মুছতে হোল। অবশেষে সবাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে বললও সে কোনদিন ভুলবে না যে সাপোর্ট সে পেয়েছে সবার কাছ থেকে। সব শেষে সে যেয়ে বসলো তার নিজের রুমে। আনন্দকে বললও সে যেন দেখা করে তার সাথে।

   আনন্দ রুমে আসতেই ডেভিড দরজা টা বন্ধ করে দিতে বললও। জেনিফার বসে আছে একটু দুরে। কোন ভণিতা না করেই ডেভিড সরাসরি বললও,” তোমাকে আমি আমার ফার্মের অর্ধেক পার্টনারশিপ দিতে চাই। রাজি আছো?’

আনন্দের একটু সময় লাগলো ডেভিড কি বলছে সেটা বুঝে উঠতে। ডেভিড আবারো বললও, আমি হয়ত আর পুরোপুরি সময় দিতে পারবোনা এই ফার্মের জন্য। । এই পাঁচমাস তুমি এক হাতে যে ভাবে ফার্ম টাকে এগিয়ে নিয়ে গেছো তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। এটা শুধু আমার পরিকল্পনা নয়, জেনিফারের ও। এই ফার্মের হাল একমাত্র তুমিই ধরতে পারবে। কি বল, রাজি?

জেনিফার এগিয়ে এলো আনন্দের কাছে। “ তোমাকে এই মুহূর্তে কথা দিতে হবেনা। চিন্তা করে দেখো।”

আনন্দ তাকাল দুজনের দিকে। “ এটা আমার স্বপ্নের অতীত যে এ ধরনের প্রস্তাব তোমরা আমাকে দিতে পারো। আই রিয়েলি অ্যাপরিসিয়েট ইট। কিন্তু,” বলে আনন্দ থামল।

ডেভিড জেনিফার দুজনেই তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে।

“ অর্ধেক পার্টনারশিপ নিতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা আমার কাছে নাই, ডেভিড।’ বললও আনন্দ

“ তোমার যাতে হার্ডশিপ না হয় সে বাবস্থা আমি করবো” ডেভিড বললও।

“ তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই”

ডেভিড উঠে এসে জড়িয়ে ধরল আনন্দ কে। জেনিফার গালটা এগিয়ে দিলো।

আনন্দ উঠে চলে যেতে যেয়ে আবার ফিরে এলো। একটা কথা আছে।

বলো।

আমি কিছুদিনের জন্য একটু বাহিরে যেতে চাই। পারবে এক সপ্তাহ সামলাতে এদিকটা। বললও আনন্দ।

ডেভিড মাথা নেড়ে হাঁ সূচক ইঙ্গিত দিয়ে বললও,” ডেফিনিট”। শোন?

আনন্দ ফিরে তাকাল।

ফ্লরেন্তা তোমাকে ফোন করতে বলেছে, এই ওর সেল নাম্বার। বলে, হাতের কাগজ টা এগিয়ে দিলো ডেভিড আনন্দের দিকে।

হাতের কাজ গুলো শেষ করে ডায়েল করলো আনন্দ। লন্ডনে এখন রাত নয় টা। পাঁচ বার রিং হওয়ার পর ফোন টা ধরল ফ্লরেন্তা।

“ কেমন আছো?” জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ

“ভালো,এখানে ইউরো সকার ফাঁইনাল। দুটো টিকেট আছে। অনেক কষ্টে পেয়েছি । চলে এসো।” বললও ফ্লরেন্তা

আনন্দ রাজি, যথারিতি দরকারি জিনিস পত্র ক্যারিঅনে নিয়ে পরদিন রওনা হয়ে গেল।

হিতরো এয়ার পোর্টে যখন এসে নামল তখন ভোর পাঁচটা। ফ্লরেন্তা দাঁড়িয়েছিল বাহিরে। ওকে দেখে দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। “ ফ্লাইটে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”

“মোটেও না” বললও আনন্দ।

ফ্লরেন্তার গাড়ীতে করে এসে পৌছালো ওর এপার্টমেন্টে। আধা ঘণ্টার পথ। সুন্দর ছিমছাম করে সাজানো ঘর। ফ্লরেন্তা আনন্দকে তার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললও। “ এখন অনেক সকাল, তুমি রেস্ট নেও। নয় টার দিকে আমরা নাস্তা করব। কেমন?”

আনন্দ রাজি। সেও ভীষণ ক্লান্ত। কিছুক্ষণ ন্যাপ নেওয়াতে শরীরটা একটু ঝরঝরে মনে হোল আনন্দের। বসার ঘরে এসে দেখে ফ্লরেন্তা খবরের কাগজ পড়ছে।

“ কি ঘুম হয়েছে ?” জিজ্ঞাসা করলো ।

“গোসল করে নাও। নাস্তা শেষে আমরা বের হবো। কেমন? তোমাকে নিয়ে যাবো আমার কাজের জাগায়।” বলল ফ্লরেন্তা।

আনন্দ বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবল, ফ্লরেন্তার সাথে দেখা হয়ে ছিল মাত্র একবার। অথচ মনে হচ্ছে সে অনেক দিনের চেনা।

লন্ডন শহরে সূর্যের মুখ দেখা দুরহ। আজ তার ব্যতিক্রম। ঝলমলে রোদ। মনে একটা আলাদা আমেজ এনে দিচ্ছে। আনন্দ ভাবে, সে এসেছিল লন্ডনে অনেক অনেক আগে। হেঁটেছিল দুজনে এই টেমস নদীর পাশ দিয়ে। বসে ছিল বিগ বেনের সামনে। ও আনন্দের কাঁধে মাথা রেখে তাকিয়ে ছিল চোখের দিকে। ভালবাসার ফুলগুলো ঝড়ে পড়ছিল চোখের চাউনী থেকে। সবই আজ স্রীতী।

কি ভাবছ?

কিছুটা জীবনের পিছনে চলে গিয়েছিলাম। “চলো।”

যাওয়ার পথে টমকে উঠিয়ে নিতে হবে। আমার কলীগ। বললও ফ্লরেন্তা।

টমের বাসা, গলিতে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের বসবাস এখানে নয় মনে হোল আনন্দের। খোলা ডাস্টবিনের ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দুরে ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। হর্ন দিতেই টম বেড়িয়ে এলো। বয়স বিশ থেকে পঁচিশ এর কোঠায়। গাড়ীতে আসতেই ফ্লরেন্তা পরিচয় করিয়ে দিলো। একটু লাজুক প্রক্রিতির। কথার মাঝে সে জিজ্ঞাসা করলো আনন্দকে কতদিন থাকবে।

আনন্দ বললও,” এসেছি ফাইনাল খেলা দেখতে। শেষ হওয়ার পর আরও দু এক দিন থাকব, তারপর প্যারিস, জার্মানি হয়ে স্টেটসে ফিরে যাবো।”

তিন তালা বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো ফ্লরেন্তা। লেখা এন্ডড্রুস কমিউনিটি। জিজ্ঞাসা করতেই ফ্লরেন্তা বললও,” এন্ডড্রু নামের এক বিশাল ধনী লোক এর খরচ চালায়। দেখবে, কত হারিয়ে যেতে পারতো এমন ছেলে মেয়েরা আজ তাদের জীবনের সন্ধান খুঁজে পেয়েছে।”

আনন্দ দেখল বিভিন্ন রুমে বয়স বারো থেকে বিশ বছরের ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন কাজ নিয়ে বাস্ত। ফ্লরেন্তা আর টম চলে গেল তাদের নিজের কাজে। ফ্লরেন্তা যাওয়ার আগে বলে গেল,” আনন্দ তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো। আমি মিটিং সেরে তোমার সাথে দেখা করবো।”

দুরে একটা মেয়ে কাঠের সরঞ্জাম দিয়ে কি জেনো বানানোর চেষ্টা করছিল। আনন্দ এগিয়ে গেল মেয়েটার কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তার হাতের কাজ। মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল।

“কিছু বলবে” জিজ্ঞাসা করলো

“ না, তোমার হাতের কাজ দেখছি। খুব সুন্দর। কার কাছ থেকে শিখেছ?”

“ এনড্রিয়ার কাছ থেকে।”

নাম কি তোমার?

আলভীনা।

সুন্দর নাম। কিভাবে এলে এখানে?

সে এক বিরাট কাহিনী।

বলবে কি?

দুটোয় আমার লাঞ্চ ব্রেক, তখন এসো বলবো।

সে বলেছিল, আনন্দের চোখের জল বাঁধ মানেনি সেদিন।

বারো বছর বয়সে তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। বাপের হাতের পিটুনি, মার গঞ্জনার থেকে বাঁচতে যেয়ে ধরেছিল ড্রাগস। সেই আসক্তি মেটাতে যেয়ে ধরতে হয়েছিল চুরির পথ। ধরা পড়ে জেলে ছিল তিন মাস। বেড়িয়ে এসে দেখে বাবা বাসা ছেড়ে চলে গেছে। মা নিয়ে এসেছে নতুন পার্টনার, নাম চার্লস। থাকে মার সাথে।

দিনের পর দিন চার্লস পাশবিক অত্যাচার করেছে আলভীনার পরে। মা দেখেও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে না দেখার ভান করে। তখন আলভীনার বয়স মাত্র তেরো। মাঝে মাঝে আলভীনার মাকে মারতে ও দ্বিধা করেনি চার্লস। বাসাটা হয়ে উঠেছিল নরক কুণ্ডো। এক বছর ধরে এই অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। আলভীনা আর নিতে পারেনি এই যন্ত্রণা। একদিন বাধ্য হয়ে সে তার মা কে বলেছিল চার্লসকে বের করে দিতে বাসা থেকে। মা রাজি হয়নি। অগত্যা আলভীনা কেই বের হয়ে যেতে হয়েছিল রাস্তায়।

থেকেছে বন্ধুদের বাসায় কিছু রাত। শুয়েছে অন্য লোকদের সাথে শুধু মাথার উপর ছাদের আশায়। শেষপর্যন্ত এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল আলোকোজ্জ্বল নগরীর পোড়ো বাড়ীর ছাদের নিচে। রাস্তায় কাটিয়েছে ওরই মত হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়েদের সাথে।

আনন্দ কে দেখিয়েছিল ওর হাতের কাটা দাগ।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল, “ এ দাগ কীসের।”

“ছুরি দিয়ে কেটে ছিলাম মানসিক যন্ত্রণাকে সরিয়ে শারীরিক যন্ত্রণাকে আঁকড়িয়ে ধড়ার জন্য।”

আলভীনা বেচে থাকার কোন মানে খুঁজে পায়নি, জীবনের সব লেনদেন চুকিয়ে দিতে চেয়েছিল। সে ভাবতো, সে চলে গেলে কার কি আসে যায়। কেউ তো তার জন্য এক ফোটা চোখের জল ফেলবেনা। এই রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলে মেয়েদের কথা কেউ ভেবেছে কি? কেউ কোনদিন জিজ্ঞাসা করেছে কি, তোমাদের কি সমস্যা? তাই একদিন সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সে তার হাতের রগ কেটে ফেলে ছিল, রক্তাত অবস্থায় পড়েছিল রাস্তার গলিতে।

নিয়তির খেলা, সে দিন মরণের হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারতনা আলভীনাকে, যদি না এনড্রিয়া ওই পথ দিয়ে না যেতো তার কর্মস্থলে।

এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, কাজে আর যাওয়া হয়নি এনড্রিয়ার সেদিন। আলভীনা সুস্থ হয়ে উঠলে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অ্যালেক্স আর রবার্টের সাথে। ওরা নিয়ে এসেছিল এন্ডড্রুস কমিউনিটিতে। ওদের চেষ্টায় আলভীনা আজ খুঁজে পেয়েছে তার নিজস্ব পরিচয়। জেনেছে কাউ না কেউ আছে যে কি না তার দুঃখে দুঃখিত, তার ব্যাথায় ব্যাথিত হয়।

“ ওরা আমাকে আশ্রয় দিয়ে ছিল, গ্রহণ করেছিল। জানতে চায়নি আমি কে। এযে কতবড় পাওয়া তুমি বুঝবে না” বলেছিল আলভীনা।

আনন্দ তাকিয়ে ছিল দুরে, ভাবল ফ্লরেন্তা, এনড্রিয়া, অ্যালেক্স, রবার্টের মত মানুষ ছিল বলেই আজ আলভীনা আর ওর মত কিছু হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়ে আবারো নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারলো। নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি করলো।

“ কি ব্যাপার, কি হোল, সব ঠিক তো?”

ডাক শুনে ফ্লরেন্তার দিকে তাকাল আনন্দ। বললও , চলো, বাসার পথে কি?

হা, টম কে নামিয়ে দেবো যাওয়ার পথে। টুমরোঁ ইজ এ বিগ ডে। দা ফাইনাল।

 ক্রমশ

**** সমস্ত চরিত্রই কাল্পনিক, কারোর সাথে মিল থাকলে তা নিতান্তই কাকতালীয়”***

Continue Reading