শেষ গোধূলিতে

চন্দন পুর জেলা শহর থেকে একটা রাস্তা পশ্চিমের দিকে চলে গেছে গোপাল গনজ। পিচের রাস্তা। দুদিকে বড় বড় গাছের সমারহ। সেই গাছের ছায়ায় ক্লান্ত পথিক দুদন্ড বিশ্রাম নেয়। পাশে ধান আর আখের ক্ষেত। দুরে ছোট ছোট বাড়ী। কোনোটা মাটির কোনোটা ইটের। বাচ্চারা খেলা করে রাস্তার পাশে। বড় বড় টা্র্ক পাট নিয়ে যায় দুর পাল্লায়। এই এলাকা পাটের চাষের জন্য প্র্সিদ্ধ। গোপাল গন্জ থেকে বায়ে বাক নিয়ে

যে রাস্তা টা চলে গেলো   সে রাস্তা ধরে ১৮ কিলোমিটার গেলে একটা ছিম ছাম শহর নাম সুন্দর পুর। গা্র্ম নয় উপজেলা। লোক সংখা বেশি নয়। এক কালে হিন্দু অধুসসিত ছিলো এই শহরটি। যাতা্র্ নাটক সবই হোতো। সাংসকি্র্তির দিক দিয়ে ছিলো উচ্চমানের। এখন আর হয়না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে গেছে অনেক কিছু।

এই শহরের মাঝে আছে ছেলে দের আর মেয়েদের হাই স্কুল। আছে কলেজ। এই শহরের বেশির ভাগ লোকই ব্যবসাই।

জমির আলি সাহেব ছেলেদের হাইস্কুলের হেড মাস্টার। কোলকাতা থেকে পড়াশুনা করে এই শহরে এসে উঠে ছিলেন। দুর গা্র্মে প্র্তরিক বাড়ী। লোকে সমিহ করে। সল্প ভাসি, কথা বলে কম। যত টুকু প্র্য়োজন তার অধিক কথা উনাকে কেউ বলতে শুনিনি। স্কুলের দায়িত্ত পালনের সাথে সাথে পাটের আর কাঠ কাটা কলের ব্যবসা আছে। কাঠ কাটা কলের নাম রেখেছে বড় মেয়ের নামে। অন্যন্না মিল। অন্যন্নার দাদা অন্যন্নাকে কপালি বলে ডাকতো। বলতো এ মেয়ের জন্ন্য জামাই খুজতে হবেনা। খুজতে অবশ্য হয়নি। সে কথা থাক।

হেড মাস্টার সাহেবের দুই মেয়ে। অন্যন্না আর সম্পা। অন্যন্না দুই বছরের বড়। উজ্জল ফর্সা বলা চলে, মানান সই লম্বা, শরিরের গঠন ভালো, সম্পা শ্যেমলা কোকরানো চুল, চেহারায় মিস্টতা ভাব। এক জন ধির স্থির অন্যজন চনচ্ল , দুরোন্ত। দুজন দুজন কে ছাড়া চলেনা। মাঝা মাঝে অন্যন্না তার অধিকার ফলায় সম্পার উপর, “ শুধু বাইরে বইরে টো টো করে বেড়াবি নাকি মা কে একটু সাহ্যায্য করবি।” ওর জন্ন্য তো তুমি রয়েছো, আমাকে ডাকছো কেনো? আমি যচ্ছি রহিমাদের বাসায়, ওখানে সবাই মিলে আড্ডা দেবো।” অন্যন্না মার কাছে বসে সাহায্য করে মাকে, তেল টা, নুন টা এগিয়ে দেয়। সম্পার মধ্যে আছে উচছলতা যা সচারচর দেখা যায়না। হেড মাস্টার সাহেবের বাসাটা পা্র্য় এক বিঘা জমির উপর, পেছনে সেগুন গাছ, আম গাছ, পাশে ছোট্ট পুকুর, এক সময় কিছু মছের চাস করা হোতো। আজ আর নেই। খরাতে জল শুকিয়ে এসেছে। বাগানের মাঝ দিয়ে হাটা পথ। এপথ ছিলোনা মানুষ জনে হেটে হেটে বানিয়ে নিয়েছে।

স্কুল শেষে দৌরিয়ে এলো সম্পা, “ মা, কিছু কাঠ আর চাল ডাল দিতে পারবে? আমি, টুনি আর পরুল মিলে বোনভোজন করবো পুকুর পাড়ে। “ বাবা শুনলে বকবে। দাও না মা। নাছর বান্দা। “ যা আমি সব পাঠিয়ে দিচ্ছি ওসমান কে দিয়ে, ওসমান ঠেকা খাটে মাস্টার মশাই এর বাসায়। অন্যন্না শুনছিলো সব কথা, বলল,” চল আমিও তোদের সাথে বোনভোজন করবো” আবার তুমি কেনো? সম্পা চিৎকার কর উঠলো। আপা গেলে ওর মাত্ববড়ি থাকবে না। বোনভোজনে যোগ দেওয়া অন্যন্নার প্র্ধান উদ্দেশ না, উদ্দেশ বোনকে চোখে চোখে রাখা।

দুরন্ত সে, আগুন নিয়ে খেলা করতে যেয়ে কখন কি হয় বলা যায়না। বোনটা তার খুব আদরের। সে কথার সংগি। সে তার নিত্তদিনের ছায়া।

বাবার চোখের মনি দুবোন। ওরা মাকে বলে, “ আচ্ছা মা বাবা অনেক মজার মজার কথা বলে , তাই না?”

জানিনা বাছা, তোমাদের কাছে কেনো এত ভালোলাগে। ওরা জানে বাবাকে ছাড়া মা অচল। মনে পরে সম্পার, সে মা কে বলে ছিলো,” আচ্ছা মা, তুমি শুয়ে বসে কাটাও গা ব্যথা হয়না।” বাবা সে কথা শুনে দুবোন কে ডেকে বলেছিলো, “ তোমাদের মা অনেক কষ্ট করে তোমাদের কে মানুষ করছে, মার চোখে কোনোদিন জল আনাবে না।”

সেদিন ওরা বুঝেছিলো বাবা মাকে কত ভালোবাসে।

দেখতে দেখতে সম্পার গলায় ওড়না এলো। বুঝতে পাড়লো সে বড় হয়েছে। পাড়া বেড়ানো কমে এলো। বকাটে ছেলেদের তো অভাব নেই। অন্যন্না তৈরি হচ্ছে মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্ন্য। বরাবরি ভালো ছাতি্র্ সে। সম্পার পটুতা অন্য দিকে। লেখার হাত ভালো। বাবা বলেছে অন্যন্না ভালো রেজালট করলেওকে ঢাকাতে পাঠিয়ে দেবে, ভালো কলেজে ভর্তি হবে। সম্পা শুনেছে সে কথা। অন্যন্নার কাছে এসে বলে,” আপা তুমি চলে যাবে।” কান্নায় গলা বুজে আসে। আপা ছাড়া তার মনের কথা বলার কেউ নেই। আপাই তার সো্র্তা। আপাই সব।

মনে পড়ে ছোটবেলায় সে আপাকে বলেছিলো,” আচ্ছা আপা আমাদের এক বাড়ীতে বিয়ে হোলে আমরা এক সাথে থাকতে পারবো, তাই না?” আপা শুধু হেসে ছিলো।

অন্যন্না ভালো রেজাল্ট করেছে। ভর্তি হবে ঢাকার নাম করা কলেজে। চলে যেতে হবে। সম্পার চোখে জল।

জানতে দেয়না আপাকে, পাছে আপা দুক্ষো পায়। পুকুরের পাশে বসে অঝরে কাঁদে। তার খেলার সাথি, তার কথা বলার সাথি চলে যাবে অনেক দুরে। গুমরিয়ে উঠছে বুকের ভিতর। তবু যেতে দিতে হবে। অন্যন্না ওকে চেপে ধরে বলে, “ কাদিঁস নে, আমিতো ছুটি ছাটায় আসব, চিঠি দিস।”

অন্যন্না চলে গেলো। সম্পা ধিরে ধিরে দুরন্তপনা ছেড়ে মার পাশে এসে দাড়ালো। বাবার ওজুর পানি এগিয়ে দেয়, মাকে রান্না ঘরে সাহায্য করে। অন্যন্নার চিঠি আসে। নতুন জীবনের খবর, নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ। অন্যন্নাকে উঠিয়ে দিয়ে এসেছিলো ওর বাবা অন্যন্নার এক ভাই ভাবীর কাছে। বলে এসেছিলো বাবা রফিক ওকে দেখে রেখো। অল্প ছুটি ছাটায় ওদের বাসাতে উঠতো অন্যন্না।

অন্যন্নার কলেজ শেষ। সম্পা মাদ্ধোমিক পরীক্ষা শেষ করলো। গরমের ছুটি। দুজনে বাসাতে। কথা শেষ হয়না। অন্যন্না বলে ঢাকার অভিগ্গতার কথা। বলে,”জানিস একজনের দেখা পেয়েছি। “ কি? কার। তার মানে তুমি পে্র্মে পড়েছ।” ওকে দেখলে পে্র্মে না পড়ে থাকা যায় না” “কি বলছ,তোমার মুখের সামনে টিকতে পাড়লো,”

তুই দেখলে বুঝতে পারবি। ফটো টটো আছে, না সব বুকের মধে্য। “ না নেই।” বাবা মাকে বলবো। “ না না এখন নয়”। ওব বাবা। নাম কি? সাহারিয়া। আধুনিক নাম মনে হচ্ছে। কি নামে ডাকো? এখনো নাম ধরে ডাকিনি, তবে সোনা টোনা এসব বলে ডেকে ফেলবো। তুমি আমাকে লজ্জায় ফেললে আপা।

আপার আনন্দে সেও আনন্দিতো। একটা চিঠি লেখে হবু দুলাভাই কে পাঠিয়ে দিয়েছিলো আপার সাথে।

লেখাতে সে ছিলো পারদর্শি। বাংলায় অনর্াস নিয়ে সম্পা ভর্তি হলো Universityতে। দুই বোন একে অপরের রুমমেট। নতুন বন্ধু, নতুন শহর, আর আছে অন্যন্নার উপদেশ। অনেক ছেলে পে্র্ম নিবেদন করবে, ফিরেও তাকাবি না। যদি সাহরিয়ার মত কাউকে পাশ তবে চিন্তা ভাবনা করিস। সম্পা বলে ছিলো,” আচ্ছা আপা, তোমার এই সাহরিয়া তো দুটো জন্মেছে বলে মনে হয়না, তা আমি আর একটা সাহরিয়া কোথায় পাবো”।

সেই সাহরিয়া কে খুজতে যেয়ে সম্পা কে একলা থাকতে হলো বেশ কিছু বছর।

এর মাঝে নদীর পানি অনেক গড়িয়ে গেছে। অন্যন্না আর সাহরিয়া হয়ে গেছে স্বামী স্তী্র্। চলে গেছে বহু দুরে আর এক দেশে জীবিকার সন্ধানে।

সম্পা আজ একা। পড়াশুনা শেষ করে উঠেছে সেই ভাই এর বাসায়। মাঝে মাঝে অন্যন্নার সাথে কথা হয় ফোনে। দিনের শেষে রাত আসে, বছর ঘুরে যায়, সাথে সাথে বয়সের ছাপ এসে পড়ে সম্পার জীবনে। একটার পর একটা পাশ দিতে থাকে। অবশেষে একটা ছোটদের স্কুলে শিক্ষয়েত্র্ হয়ে যোগদান করে। বাচ্চারা কেনো জানি ভীষন ভালবাসতো ওকে। ভালোবাসার মতই মন ছিলো ওর। দেখা পেলো একজনের। জানালো আপাকে।

“আপা পেয়েছি, তবে তোমার সাহরিয়ার মত কিনা জানিনা”। আপার চিন্তা লাঘব। তার বোনকে অনেক দিন সে দেখেনা। জীবনের কাটা ঘুরে চলেছে। একটা চিঠি এসে পড়লো অন্যন্নার হাতে। সম্পার লেখা। “ মেরুদন্ডহীন লোকের সাথে ঘর করার আগেই ভেংএ দিলাম, আপা”। অন্যন্না কোনো কিছু জিগ্গাসা করেনি, শুধু চোখের জল ফেলেছিলো। সম্পা ভেংএ পড়েনি। জীবনে হোচট খেয়ে সে চলতে শিখেছে। স্কুলের ছোট ছটো ছেলে মেয়ে দের মধে্য আপামনি হয়ে বাচতে চেয়েছে।

ভাই এর আনা এক পাত্র্রর সাথে পরিচয় হোলো। নাম মহিম। প্র্থম দেখাই পে্র্ম তা নয়। দেখা সাক্ষাত। দিন ধার্য হলো। সম্পার কুমারি জীবনের অবসান। আপা খুশি। মহিম কে সম্পার ভালো লেগেছিল। সল্প ভাসি। নিজেস্য পি্র্ন্টিং পে্র্স আছে । কাজের ফাকে ফাকে সম্পা কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো দুর পাল্লায়। রাংয়ামাটি, কক্সবাজার, বন্দর বন। বছর ঘুরতেই কোলে এলো এক ফুট ফুটে ছেলে, আনন্দ। সম্পা লিখে ছিলো তার আপাকে, “ তোমার সাহরিয়াকে আমি খুজে পাইনি, আমি আনন্দের মাঝে খুজে পেয়েছি আমার আনন্দ”।

বিধাতার দাবা খেলায় কোন গুটি কখন কাটা পড়ে কেউ জানানা। জানেনি সম্পা। দুদিনের জ্বরে মহিম হারিয়ে গেলো। চলে গালো এই পৃথিবির মায়া ছেড়ে। রেখে গেলো সম্পা আর আনন্দ কে। সম্পা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল। এই পৃথিবীর আলো তার কাছে মনে হলো কালো ধোঁয়া। জীবনের শুরুতেই সব শেষ। শুক পাখি বাসা বেধে ছিলো অন্য খানে তার কাছে নয়।   আপা জানলো, জলে ভিজিয়ে দিলো বালিস। কাঁদতে কাঁদতে বলে ছিলো,”কাদিস নে আমি তোকে নিয়ে আসব এখানে।”

স্কুলের চাকরিটা রেখে ছিলো। কস্ট করে সংসার আর ছেলেকে গড়ে তোলার দায়িত্ত সে পালন করেছিলো।   ভাবতো পৃথিবিতে কিছু লোক জন্মায় ভ্যাগের সাথে লড়াই কোরে বাচার জন্ন্য, সে তাদেরই একজন।

আড়াই বছরের আনন্দ কে নিয়ে সে এলো আপার কাছে। বোন কে পেয়ে আনন্দ ধরেনা। বলে, “তোর কোনো অসুবিধা হবেনা এখানে, মনে করবি এটা তোরই বাসা।” সেদিন সম্পা ঠাই পেয়েছিলো। ঠাই পেয়েছিলো বিশাল হূদয়ে সমপ্ননো তার বোনের কাছে।

বিধাতার দাবার চাল তখনো বাকি। তা না হোলে আজ সাহরিয়াই বা কেন ভাবতে বসবে, ভুল কি তার হয়েছিলো? যদি সে ছয় মাসের মাথায় সম্পাকে খালেদের হাতে সমর্পন না করতো তাহলে কি আজ সম্পার জীবন কাহিনি অন্ন্য ভাবে লেখা হতো? এ দন্দ তার হূদয়ে, কোনদিন সে বলেনি অন্ন্যনাকে। খালেদ সম্পাকে নিয়ে বাসা বাধলো বেশ কিছু দুরে। সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠেনি। তবুও জীবন চলবে তার গতিতে।

অন্ন্যনাকে সম্পা বলে ছিলো, আমার কপালের খন্ঢন তো তুমি পাল্টাতে পারবে না, আপা। বিধাতা লিখেছে এই ভাবে, কাকে আমি প্র্শ্ন করবো?;”   সাতদিন কাজ করে সে সংসার চালায়, ছেলে কে বড় করেছে, কলেজ শেষ করে সে এখন ছোটো খাটো চাকরি করে।

এক দিন অন্ন্যনা সাহরিয়াকে বলেছিলো,” আমার অবর্তমানে তুমি আমার বোনটাকে দেখো,” সে কথা দিয়েছিলো।

সময় থেমে থাকেনি। অন্ন্যনার সাথে কথা হয় সম্পার প্র্তি রাতে। কথা ফুরাতে চায় না। সাহরিয়া বলে,” কি কথা বলো তোমরা প্র্তি রাতে।” ও তুমি বূঝবে না। সাহরিয়া কথা বারায়নি।

বিধাতার শেষ খেলা দেখে সম্পা ইসত্মভিতো হয়ে গিয়েছিলো। সাহরিয়া ফোন করে জানিয়েছিলো অন্ন্যনার কঠিন অসুখের কথা। সম্পা শুনতে চাইনি, বিশ্বাস করতে চাইনি, তার আদরের আপা আজ মূতু পথ যাতি্র্।

অন্ন্যনা বলেছিলো, আয় কদিন এসে আমার কাছে থেকে যা। এসেছিলো, থেকে ছিলো, সেবা করে ছিলো অন্ন্যনার চলে যাওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত।

পাষানের ভাড় সম্পার হূদয়ে, তার ত্নতি্র্তে তনতি্র্তে। ভালো মন্দ মিশিয়ে কথা বলার মানুষটা তার হারিয়ে গেলো চিরতরে। চেষ্টা করে স্বামি, ছেলেনিয়ে ভুলে থাকতে। পারেনা। ভেসে ওঠে তার মনের পর্দায় তার আপার চেহারা যে দিতো পে্র্ররনা, দিতো উপদেশ   দিতো বেচে থাকার নতুন পথ।

সন্ধা ঘনিয়ে আসে ।আকাশের লালচে আভা এসে পড়েছে সম্পার ছোট্ট বারান্দায়। চা এর কাপে চুমুক দিয়ে তাকিয়ে থাকে দুর আকাশের দিকে। ভেসে আসে সুর “কি পাই নি তার হিসাব মিলাতে মনো মর নহে রাজি কি পাই নি।”

সুযর্ ঢলে পড়ে। মিলিয়ে যায় পূথিবির আলো, নেমে আসে অন্ধকার।

Continue Reading