এক অসমাপ্ত গল্প ( ১২ পর্ব)

                                                                       ১২ পর্ব

        মাস খানেক হয়ে গেল শুভ্র মারা গেছে। বেলাল, কল্যাণী ফিরে গেছে তাদের নিজেস্ব জাগায়। আনন্দ তার চেম্বারে। কয়েকটা প্লান তাকে অ্যাপপ্রুভ করতে হবে। এমীলী গেছে ডালাসে। একটা কাজের তদারকিতে। জন ছুটিতে। ডেভিড ইদানিং অফিসে খুব কম আসে। আনন্দ থাকলে সে এদিকে পা মারায়না। ফোনে খবরা খবর নেয়। কাজের শেষে লরেন্স আর মাইক বাস্কেটবল খেলা দেখতে যাবে ম্যাডিশন স্কয়ার গার্ডেনে। আনন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে যাবে কিনা। এক্সট্রা একটা টিকেট আছে। আনন্দ বলেছিল, না, তার স্টিভের সাথে যাওয়ার কথা।

ওরা চলে গেল। আনন্দ স্টিভ এর সাথে যেয়ে বসলো বারে। স্টিভ বললও,” মহিউদ্দীনের বউ এর একমাসের মধ্যেই ডাক পরবে ভিসার জন্য। তুমি তো দেশে যাবে বলছিলে, তখনি সব ব্যবস্থা করে আসতে পারবে।”

আনন্দ কোন উত্তর না দিয়ে ক্লাব সোডা তে চুমুক দিলো।

“কি ব্যাপার? কথা বলছো না যে?”

“ ভাবছি, তোমাকে বলতে বাধা নেই। সকালে কাশি দিতেই কিছুটা লাল রং এর কফ বেড়িয়ে এলো। হয়ত কিছুই

নয়। অনেক সময় ড্রাই কফ থেকে হয়।”

ডাক্তারের কাছে কবে যাবে?

দেখি, যেদিন সময় হবে।

স্টিভ আনন্দের দিকে তাকিয়ে বলল, দোহাই তোমার। গাফিলতি করোনা।

তাছাড়া আরও একটা কারণেও আনন্দ মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছে। সানন্দার সাথে উইকএন্ডে যাওয়ার কথাছিল ওর ছোট মেয়ের বাসায়। তিন ঘণ্টার পথ। থাকে সে আলবেনীতে। কথা ছিল দুজনে যাবে। সকালে যেয়ে রাতে ফিরবে। শেষ সময়ে সানন্দা আরও একজনকে এই যাত্রায় সঙ্গী করাতে আনন্দ আর যেতে চাইনি। বলেছিল, তোমরা যাও আমার যাওয়া হবেনা। ভেবেছিল এটা সানন্দার একলা ওর সাথে না যাওয়ার অভিপ্রায়।

আনন্দর আত্মসম্মানে লেগেছিল। তার জের এখনও রয়ে গেছে আনন্দের মনে।

মেয়ে টার গানটা আজকে বেসুরো মনে হচ্ছে আনন্দের কাছে। তাল ঠিক নেই। দোষ গায়িকার নয়। আনন্দের মাথায় অজস্র চিন্তারই পরিণতি। অন্যদিন এই গায়িকারই গানের সাথে সাথে আনন্দ তাল দেয়। আজ মন, চোখ আর কান সমতল রেখায় অবস্থিত নয়। তাই সুরটা তার ভাল লাগছে না ।

স্টিভ কে গুডবাই বলে সে উঠে পড়ল। যাবার সময় কিছু খাবার নিয়ে নিলো তার পরিচিত রেস্টুরেন্ট থেকে। বাসায় আজ খাবার বাড়ন্ত। যেখান থেকে মাঝে মধ্যে খাবার আসতো সেখানের হাড়ী খালি।

সানন্দা বলেছিল, কটা দিন কোনমতে চালিয়ে নেও। পারবে নিশ্চয়?

আনন্দ বলেছিল, যা পাচ্ছি তাতো পরে পাওয়া পাঁচআনা। আমার জন্য ভেবোনা, এক পেট, কোন রকমে চালিয়ে নিতে পারব।

খাওয়া শেষে অলস ভাবে কিছুক্ষণ বসে ছিল ডাইনিং টেবিলে আনন্দ। আমেনা ভাবীর সাথে বেশ কিছুদিন হলো কথা হয়নি। ফোনটা উঠিয়ে ডায়েল করলো। ভোর আটটা ওখানে।

কেমন আছো আনন্দ দা? জিজ্ঞাসা করলো ভাবী।

ভালো, স্টিভের সাথে কথা হয়েছিল, খুব শীঘ্রই তোমাদেরকে ডাকবে ভিসার জন্য। সানন্দা কে বলেছি তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে, যদিও আমিই সব দেখাশোনা করব। তোমাদের কোন অসুবিধা হবেনা।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আমেনা ভাবি। বললও,” ভাই থাকতে আমি অন্যের বাসায় থাকতে যাবো কেন আনন্দ দা। তোমার ভাগ্নি না তোমাকে বলেছিল তোমার কাছে আমাদেরকে রাখতে পারবে কি না। আজ তুমি নিজে হাতে আমাদেরকে সরিয়ে দিচ্ছো”।

না তা নয়। আমি থাকি একলা।

সেই জন্যই আমাকে থাকতে হবে তোমার কাছে। ভাইকে বোন ছাড়া কে দেখবে বলো।

ঠিক আছে। তাই হবে। সব কিছু বুঝে নিও। অনেক দিন তো হোল এ বাসায় উনন জ্বলেনা। তুমি এসে জ্বালিও।

জানো আনন্দ দা আমার শুধু মনে হয় কবে সানন্দা দি কে দেখব। খুব দেখতে ইচ্ছে করে উনাকে। নিঃস্বার্থ ভাবে তোমাকে দেখে রাখছে।

সত্যিই এমন বান্ধবী পাওয়া দুর্লভ। ও ছিল বলেই কথা বলে আমার সময়টা কেটে যায়। নচেৎ জীবন টা কোন দিকে মোড় নিতো আমি নিজেও জানিনা।

আজ রাখি। এই বলে কথার সমাপ্তি টেনে ছিল আনন্দ।

রাত দশটা। উপরে উঠে এলো। কখন যে চোখের পাতা টা বুঝে এসেছিল সে নিজেও মনে করতে পারেনা। ফোনের শব্দে ধড়মড় করে উঠে পড়ল। ঘড়িটার দিকে তাকাল। রাত চার টা। ডালাস থেকে ফোন। এমীলীর কথা মনে হোল। হ্যালো বলতেই, পুরুষের গলা।

আনন্দ আছে ?

বলছি।

আমি ডিডেকটিভ জো থম্পসন। ডালাস থেকে বলছি।

আনন্দের ঘুমের ঘোর তখনও কাটেনি। “হোয়াট?”

পুনর্বার বললও “আমি ডিডেকটিভ জো থম্পসন। ডালাস থেকে বলছি। এমীলী স্মিথ কে চেনেন?”

আনন্দের বুকটা খালি হয়ে এলো। অশুভ কোন খবর। “আমার কলীগ। হোয়াটস রং?”

“ মারা গেছে, কেউ হত্যা করেছে মনে হচ্ছে। তোমার নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার ওর ব্যাগে ছিল। “

আনন্দ চুপ করে রইল, সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। এমেলী খুন হয়েছে। ও স্বপ্ন দেখেছে না তো? চামড়ায় চিমটি কেটে দেখল, না সে জেগে আছে।

“ এমীলীর মা বাবা কে খবর দেওয়া হয়ছে?” প্রশ্ন করলো আনন্দ।

“ না, ওদের ফোন নাম্বার টা থাকলে দাও।” বললও ডিডেকটিভ থম্পসন

ফোন নাম্বার টা দিয়ে আনন্দ বললও,” আই উইল বি ফার্স্ট ফ্লাইট আউট।”

রাত অনেক, ফোন করলো ডেভিড কে। বিস্তারিত সব কিছু জানিয়ে বললও,” আমি প্রথম ফ্লাইটে ডালাস যাচ্ছি সঙ্গে লরেন্সকে নেবো ভাবছি।”

ডেভিড ইতি বাচক উত্তর দিয়ে বললও,”আমাকে টাইম টু টাইম খবর দেবে।”

আনন্দ তাঁকে আশ্বাস দিলো, বললও “চিন্তা করোনা তোমার হার্টের প্রবলেম।” আনন্দ জানে ডেভিডের হার্টের পেলপিটিসন বেড়ে গেছে। নিজের কোম্পানির এমপ্লোই, খুন হয়েছে অন্য স্টেটএ। সব খবর না পাওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই।

লরেন্স কে কল করে এয়ারপোর্টে আসতে বললও। ভোর সাতটায় ফ্লাইট।

যথা সময়ে পৌছে, আনন্দ আর লরেন্স এলো হোটেলের চত্বরে। চারিদিকে ব্যারিকেড দেওয়া। লেখা আছে “ Do not cross the line.” আনন্দ নিজের পরিচয় দিয়ে ডিডেকটিভ থম্পসন কে চাইল। পরিচয় হতেই আনন্দ জিজ্ঞাসা করলো মৃতদেহের কাছে সে যেতে পারে কিনা।

না, বললও মিস্টার থম্পসন, “This is a crime secne. You will see the body in the morgue to indentify.”

“ তোমাকে আমার সাথে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে, এমীলী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য।” বলল মিস্টার থম্পসন।

দুর থেকে আনন্দ দেখল এমীলীর বাবা মা আসছে। ক্রন্দন রত। আনন্দ, লরেন্স, মিস্টার থম্পসন এগিয়ে গেল। আনন্দ জড়িয়ে ধরল এমীলীর বাবা কে। শেষ দেখা হয়েছিল ফার্মের বর্ষপূর্তি উৎসবে। সান্ত্বনা দেবার কিছু নেই। মিস্টার থম্পসন বলল, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো হত্যাকারী কে বের করতে।

আনন্দ লরেন্সকে বললও জনকে জানানোর জন্য, সে এমীলীর ফিআন্সে।

লরেন্স কে হোটেলে চলে যেতে বলে আনন্দ পুলিশ স্টেশনে এসে পৌছাল বিকেল তিন টায়। এমীলীর বাবা মার সাথে। জিজ্ঞাসা বাদ শেষে মিস্টার থম্পসন দুটো ফটো দেখাল আনন্দকে। প্রথমটা এমীলীর সাথে এক কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক এলিভেটরের কাছে দাঁড়ান। বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ। আনন্দ চেনে কিনা জানতে চাইলে বলল কোনদিন দেখেনি। অন্যটা হুড দিয়ে ঢাকা মুখ। চেনা যায় না।

তাহলে কি — , আনন্দের কথা শেষ না হতেই মিস্টার থম্পসন বলল, “Don’t come to the conclusion”.

“তুমি এখানে কিছুদিন থাকলে ভালহয়। “

আনন্দ আপত্তি করেনি। মিস্টার থম্পসন আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল,” তুমি বলেছিলে এমিলীর ফীয়ান্সে আছে। কাজ করে একি ফার্মে। নাম জন। তাই না?”

হাঁ

ওর ফোন নাম্বার আছে? জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার থম্পসন

ওর সাথে যোগাযোগ করেছি, আগামীকাল আসবে।

আনন্দ ফিরে এলো হোটেলে এমিলীর বাবা মার সাথে। এমিলীর বডী পোষ্টমরটমে পাঠানো হয়েছে। মিস্টার থম্পসন বলেছে, যে লোকটার সাথে এমিলীকে দেখা গেছে তাকে তল্লাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া তে তার ফটো দেখানো হচ্ছে। অতি তাড়াতাড়ি তার খোজ পাওয়া যাবে আসা করছে।

আনন্দ ফোন করলো ফার্মে। ডেভিড কে বিশ্লেষণ করলো সব কিছু। বিষাদের কালো ছায়া সেখানে।

সন্ধ্যা হয়ে এলো। লরেন্স কে জিজ্ঞাসা করলো বারে যাবে কিনা। অস্থির লাগছে। না, সে এই মুহূর্তে কোথাও যেতে রাজি নয়। বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে লবিতে এসে বসলো লরেন্স।

আনন্দ বেড়িয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। লোকের চলাচল ততোটা নয়। রাস্তার পাশের গাছগুলো কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে পথ টাকে। এমিলীর হোটেলের দুই ব্লক দুরে আনন্দের হোটেল। সেখানে পুলিশের আনাগোনা এখন। একটা মাতাল পথ আগলিয়ে ধরে পয়সা চাইল। পুলিশের গাড়ী হর্ন বাজাতে বাজাতে আনন্দের থেকে কিছুদূরে যেয়ে দাঁড়াল। আনন্দ তার চলার গতি কমিয়ে দিলো। এই মুহূর্তে সে পুলিশের সাথে কথোপকথন করতে রাজি নয়। কিছুক্ষণ থেমে আবারো হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে গেল। রাস্তা নির্জন। এখনো চার ব্লক যেতে হবে। হঠাৎ করে গা টা শিরশির করে উঠল। আনন্দের মনে হোল কে জেনো ওকে ফলো করছে।

পিছন ফিরে থাকাল। কিছুদূরে একটা লোক আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে। মাথায় টুপি। হাতে ধরা একটা লম্বা আকারের জিনিস। কি সেটা এতো দুর থেকে বোঝা গেলনা। আনন্দ তাকাতেই লোকটা হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো। আনন্দের হার্টের দপদপানি বেড়ে গেল, হাতের তালু ভিজে। চারিদিকে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পেলনা।

পিছনে ফিরে এবার তাকাতেই ধাক্কা দিলো সামনে হেঁটে আসা লোকটা।

মাথায় হুড। এক ঝলক ফিরে তাকাল সে । অন্ধকারে আনন্দ দেখেতে পেলোনা মুখটা।

ক্রমশ

***স্থান কাল চরিত্র সব কাল্পনিক***

Continue Reading