এক অসমাপ্ত গল্প ( ১৩ পর্ব)

                                                ১৩ পর্ব

     বারে এসে বসলো আনন্দ। বারটেনডার ক্লাব সোডার গ্লাস টা এগিয়ে দিতেই আয়নায় দেখতে পেলো মাথায় টুপি ওয়ালা লোকটা তার পিছনে দাঁড়িয়ে। হাতে ধরা গ্লাসটা কেঁপে উঠে কিছুটা সোডা পরে গেল গ্লাস বেয়ে। লোকটার হাতের সেই বস্তুটা দেখতে পেলনা আনন্দ।

“ বসতে পারি?” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে পাশের চেয়ার টাতে বসলো। বয়স চল্লিশের কাছা কাছি। কপালের উপড়ে কাটা দাগ। বেশী দিনের নয়। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললও, “আমার নাম জন টেলর।” আনন্দ তার নাম বলতেই বললও ,” তোমার নাম আমি শুনেছি এমিলির কাছে। সরি, এই দুর্ঘটনার জন্য।”

“ এমিলিকে চেনো কি ভাবে?” জিজ্ঞাসা করতেই মিস্টার টেলর বলল,” যে কাজের খবরা খবর জানতে এমিলি কে পাঠানো হয়েছিল আমি সেই কোম্পানির একাউনটেন্ট। এমিলি, সত্যি খুব স্মার্ট লেডি। Again sorry for your loss.” বলে আনন্দ কোন কিছু বলার আগেই দ্রুত বের হয়ে যেতে যেয়ে বললও,” সাবধানের মার নেই”।

আনন্দ তখনো হুড ওঠানো লোকটার চেহারা টা মনে করার চেষ্টা করছে। একে অন্ধকার, তারপর চোখে বড় ফ্রেমের কালো চশমা, ঠোটের পাশে ক্ষীণ হাসি। সব মিলিয়ে এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। রহস্যময় ব্যক্তির হাটার ছন্দটা আনন্দের পরিচিত মনে হয়ে ছিল। কোথায় যেন দেখেছে, মনে করতে পারলনা।

সকাল দশটায় কড়া নাড়িয়ে আনন্দকে ঘুম থেকে উঠালো মিস্টার থম্পসন। রাতে বিভিন্ন চিন্তায় ঘুম এসেছিল ভোর পাঁচটায়। দরজা খুলে থম্পসন কে বসতে বলে আনন্দ গেল মুখ হাত ধুতে। রুমের ফোনটা বেজে উঠতেই আনন্দ থম্পসনকে ফোনটা ধরতে বলে শাওয়ারের কলটা ছেড়ে দিলো। অপর প্রান্তে এমিলির বাবার গলা। গলার স্বর ভারী। থম্পসন আসতে বলল আনন্দের রুমে। কথা আছে।

আনন্দ ড্রেস আপ করে আসতেই এমিলির বাবা ও উপস্থিত। থম্পসন কোন ভূমিকা না করে বলল, “ মাথায় ভারী বসতুর আঘাতে এমিলি মারা গেছে। যার সাথে এমিলি কে দেখা গিয়েছিল তাকে পাওয়া গেছে। জবান বন্দি নাওয়া হয়েছে।”

এমিলির মা ফুফিয়ে কেঁদে উঠল

“সে কি সন্দেহর মধ্যে পড়ে?” জিজ্ঞাসা করলো এমেলির বাবা।

“ সবায়ই সন্দেহর মধ্যে পড়ে যতক্ষণ পর্যন্ত আসল খুনি কে না পাওয়া যায়।” বলল থম্পসন “ আপনারা মৃত দেহ নিয়ে যেতে পারেন।” কথা শেষে বাই বলে উঠার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে জন ঢুকল। আলুথালু বেশ। “এমিলিকে কোথায় দেখতে পাবো” বলে চারিদিকে তাকাল। আনন্দ পরিচয় করিয়ে দিলো থম্পসনের সাথে।

“ মর্গে গেলে দেখতে পাবে, সনাক্ত ও করতে পারবে। আমি ঐ দিকে যাচ্ছি, তুমি আমার সাথে এসো। কথা আছে।” বলল থম্পসন। আনন্দ গত রাতের কোন কথাই থম্পসনকে জানাল না। এমনকি হুড ওঠানো লোকটার কথাও না।

ওরা বেড়িয়ে পরতেই আনন্দ গেল লরেন্সের রুমে। দুজনে মিলে গেল সেই সাইট টা তে। সবাই মর্মাহত। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন প্রশ্ন। দরকারি কথা শেষে বেড়িয়ে পড়ল । রাস্তায় ভিড় বাড়ছে। সূর্যের তাপ প্রখর। ট্যাক্সির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল ল্যাম্প পোষ্টের নীচে। এই মুহূর্তে ট্যাক্সি পাওয়া দুরহ ব্যাপার। ভ্যাপসা গরমে দুজনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা। লরেন্স কি জেনো বলতে চাইছিল তার আগেই একটা কালো রং এর মারসেডিজ-বেঞ্জ জানালা গুলি কালো টিনটেড গ্লাসে ঢাকা পাশে এসে দাঁড়ালো। জানালা খুলতেই আনন্দ দেখতে পেলো মিস্টার টেলার, ইশারায় ডাকল, দরজা খুলে ভিতরে আসতে বলল।

“ কোথায় যাবে?”

“ পুলিশ স্টেশন।”

“ কাছা কাছি নামিয়ে দিতে পারি। কোন সুরাহা হোল ?” জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার টেলর

“ না, এই মুহূর্তে নয়।” বলল আনন্দ

“ আমাদের সার্ভেলেন্স ক্যামেরায় তোলা কিছু ছবি। দেখো, কাজে লাগলেও লাগতে পারে। “ বলে একটা এনভেলপ এগিয়ে দিলো আনন্দের দিকে। আনন্দ খুলল এনভেলপটা। নিজে দেখল। লরেন্স কে দেখালো। এমিলির ছবি। কন্সট্রাকশন সাইটের বিভিন্ন জাগায় তোলা। সাথে একজন যার ছবি থম্পসন দেখিয়ে ছিল। হোটেলে দেখা গেছে তাকে। দুরে কে জেনো দাড়িয়ে, আবছা। চেনা যায়না। মাথায় বেজবল ক্যাপের মত কিছু একটা পড়া। মুখটা ঢেকে আছে। লরেন্স তাকাল আনন্দের দিকে।

টেলর আনন্দ আর লরেন্স কে পুলিশ স্টেশনের কাছে নামিয়ে দিয়ে গুড লাক জানিয়ে চলে গেল। ওরা থম্পসনের ঘরে ঢুকে দেখল জন আর এমিলির বাবা মা বসা। জন লরেন্স কে দেখে জড়িয়ে ধরল। চোখে জল। লরেন্স ওকে বাহিরে নিয়ে গেল সান্ত্বনা দিতে।

চেয়ার টা টেনে বসতেই এমিলির বাবা বলল,” এমিলির বডি নিয়ে কাল আমরা রওনা হচ্ছি, তুমি যাবে সাথে?”

কথার উত্তর দেওয়ার আগে আনন্দ ছবি গুলো থম্পসনের দিকে এগিয়ে দিলো। বলল কোথা থেকে পেয়েছে সে।

বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর, “হু” শব্দ করে রেখে দিলো ড্রয়ারে।

লরেন্স আর জন ঘরে ঢুকতেই থম্পসন আনন্দের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি আর জন আর কয়েকটা দিন এখানে থাকবে। আমার দরকার পরবে তোমাদেরকে।”

আনন্দ লরেন্সকে বলল, আগামীকাল এমিলির বাবা মার সাথে বডি নিয়ে নিউইয়র্কে চলে যেতে। সবায়ই বেড়িয়ে এলো। দুই পা এগিয়ে আনন্দ ওদেরকে যেতে বলে ফিরে এলো থম্পসনের রুমে। থম্পসন আনন্দর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,” ফিরে এলে যে।”

“ আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছুটা ক্লু পেয়েছ। তবে এখনো সন্দেহ। হত্যাকারী কে? তাই না?”

সে কথার উত্তর না দিয়ে সে বলল,” আমার স্টাফ অনেক দুর এগিয়েছে, বাকি আছে কয়েকটা ল্যাব টেস্ট, ডিএনএ টেস্ট”।

“ আমাকে একবার এমিলির রুম টাতে নিয়ে যেতে পারবে?” বললও আনন্দ। “ অনেক দিনের চেনা, অনেক কাছের মানুষটা, কত কাটাছেড়া করেছি ড্রয়াইং এর উপর, বসেছি কফির পেয়ালা নিয়ে পাশের রেস্টুরেন্টে। হারিয়ে গেল। একবার দেখতে চাই সেই জাগাটা যেখানে সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল।”

“ নিয়ে যাবো, তবে একটা কথা তুমি অ্যাড করলেনা।”

“ কি?”

“ She had a crush on you. Is it right?”

“ অনেক রিসার্চ করেছ দেখছি এই ক’দিনের মধ্যে? আমিও কি তোমার সন্দেহের মধ্যে পড়ি?”

“ কে জানে, বলাতো যায়না। এটাই তো আমাদের কাজ সবায়কে সন্দেহ করা। তাই না?” বলে থম্পসন আনন্দকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। বাহিরে ওরা চার জন দাড়িয়ে। আনন্দ বলল সে এমিলির রুমে যাচ্ছে। জন যেতে চাইলে থম্পসন বলল,” না, তুমি গেলে তোমার মানসিক অশান্তি বাড়বে ছাড়া কমবেনা।”

আনন্দের হাতে গ্লভোস। কোন কিছু স্পর্শ করা নিষেধ। থম্পসন দরজা খুলল। নর্মাল সাইজের এক বেডরুম এপার্টমেন্ট। কাঠের মেঝে। ডান পাশে ক্লোজেট। কপাট খোলা। এমিলির কাপড় হাঙ্গারে ঝুলছে। এক পা এগোতেই বসার জায়গা। দুটো চেয়ার। একটা উল্টিয়ে পড়ে আছে। দুরে একটা রিক্লায়নার। সামনের কফি টেবিলটার উপরে রক্ত ছিটানো। কিছু কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিল্ডিংএর নকসা আকা কাগজটা মেঝেতে পরা। বা দিকে একটা টেবিল ল্যাম্প মেঝেতে ভেঙ্গে পরে আছে। তার পাশে প্রচুর শুকনো রক্ত। এমিলির দেহটা এখানে পরেছিল। সাদা চক দিয়ে আকা। রক্তের ছিটা দেয়ালে।

শোয়ার ঘরের বিছানা এলোমেলো। চাদর কুঁচকানো। একটা বালিশ আর কম্বল মেঝেতে। সাদা চাদরের মাঝে দুটো কালচে দাগ। হয়তো—,

থম্পসন ডাকল, “ দেখা শেষ হোল?”

বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে দুজনে।

“ দুই তিন দিনের মধ্যে ইনভেশটিগেসন শেষ করতে পারবো বলে আসা করছি।” বলল থম্পসন। “ সেই সাথে হত্যাকারীও হাতের মধ্যে এসে যাবে।”

আনন্দ জানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এর বাহিরে থম্পসন আর কিছু বলবেনা।

সন্ধ্যা আটটা। সবাই মিলে ডিনার করবে। লরেন্স বলল, “ তোমাদের কারো আপত্তি না থাকলে ডিনার হবে আমার তরফ থেকে।” সবাই রাজি। জন বলল তার একটু কাজ আছে পরে এসে মিলিত হবে। তাড়াহুড়া করে চলে গেল। মনে হোল কি জেনো খুঁজছে সে। এমিলির মা কিছুক্ষণ পর পর ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে উঠছে। বাবার চোখ ছলছল। ডিনার শেষে এমিলির বাবা আনন্দ কে বলল,” তুমি তো কিছুদিন থাকবে। নিশ্চয় এর মধ্যে হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়া যাবে। জন ডিনারে এলোনা কেন বুঝলাম না।”

“মানসিক দিক দিয়ে সে ও তো আঘাত কম পায়নি? হয়তো একাকী থাকতে চায়।” বললও আনন্দ।

পরদিন সকাল। ওরা ফিরে গেল নিউইয়র্কে এমিলির লাশ নিয়ে। জন আসে নি এয়ারপোর্টে। আনন্দ ফিরে আসে জনের খোজ করলো। ফোন করলো তার সেলে। ফোন বন্ধ। ভয়েস মেল ভরাট। আনন্দ হোটেলের লবিতে খোজ নিলো। কেউ জনকে দেখেছে কিনা, কোন মেসেজ আছে কি না। না, কিছুই নেই। ওর রুমে যেয়ে কয়েক বার ধাক্কা দিলো । কোন শব্দ নেই। আনন্দের মাথায় খারাপ চিন্তা ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। ম্যানেজার কে বলল রুমটা খুলতে।

কেউ নেই ঘরে। বিছানা পরিপাটি করে সাজানো। জন রাতে ফেরেনি। আনন্দের হার্ট বিট বাড়তে শুরু করলো। ক্লজেট টা খুলল। কয়েকটা জামা ঝুলছে। একটা ডাফেল ব্যাগ পরে আছে। আনন্দ উঠাল ব্যাগটা। ভিতরে হাত দিতেই আঠালো পদার্থের মত কি যেন হাতে লাগলো। রেখে দিলো । ক্লজেট টা বন্ধ করে দরজার দিকে ফিরতে যেয়ে আবারো ঘুরে দাড়ালো। বিছানার দু পাশের বালিশ সমতল ভাবে অবস্থিত নয়। একটা উচু অন্যটার চেয়ে। এগিয়ে গেল আনন্দ। বালিশটা সরাতেই দেখতে পেলো হুডেড সোয়েট সার্ট। মনে পড়ল সেই রাতে ধাক্কা দেওয়া লোকটার কথা। হুড দিয়ে ঢাকা মুখ, ওর চলার ছন্দ ছিল পরিচিত। ফটোতে দেখা সেই লোকটা। একই রং এর সোয়েট সার্ট। মাথাটা ঘুরে উঠল আনন্দের। তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এলো। বন্ধ করে দিলো দরজাটা।

নিচের বারে এসে বসলো আনন্দ। হাত কাপছে। চিন্তা শক্তি লোপ পাচ্ছে মনে হোল। ক্লাব সোডার পরিবর্তে হুইস্কি দিতে বলল। গ্লাসটা ঠোটের কাছে আনল আনন্দ। চুমুক দেবার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।

থম্পসনের ফোন। “আনন্দ, বিশ্বাস হয়? We got the killer. He is in our custody. You will be surprised.”। হাসতে হাসতে বলল থম্পসন।

আনন্দের সারা শরীর কেঁপে উঠল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো “কে সে?”।

“ আজ নয়, কাল বলব। এদেশ থেকে চলে যেতে চেয়েছিল। ঠিক সময়ে এয়ারপোর্ট থেকে ধরে আনা হয়েছে।” বললও থম্পসন ।

আনন্দ গ্লাসের তরল পানীয়টা গলার মধ্যে ঢেলে দিলো।

“ আগামীকাল দেখা হবে” বলে থম্পসন ফোন টা রেখে দিলো।

আনন্দ বুকের ভিতর একটা জ্বালা অনুভব করল। সে চায় এমিলির হত্যাকারী ধরা পরুক। কিন্তু ও যা ভাবছে সেভাবে নয়। উঠে পরতেই পা টা একটু টলকিয়ে উঠল। আবারো বসে পড়ল টুল টাতে। কাধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। ফিরে তাকাল সে। চোখটা কচলিয়ে নিয়ে  তাকাল। অবিশ্বাস্য। ভুলে গেল পারিপার্শ্বিকতা। চিৎকার করে বলে উঠল,

” জন? ইজ ইট ইউ? কোথায় ছিলে ?” বলে জড়িয়ে ধরল জন কে।

ক্রমশ

Continue Reading