সানন্দা যখন আনন্দকে নিয়ে বাসায় এলো তখন রাত দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। খাবার টেবিল সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল। বলল,” তুমি কাপড় জামা ছেড়ে গোসল করে এসো আমি খাবার গুলো গরমে দেই।”
“রাত অনেক হয়েছে, তুমি এসো, আমি সব ব্যাবস্থা করে নেবো।” বলল আনন্দ। যদিও জানে সানন্দা যাবেনা। সানন্দা একবার তাকাল আনন্দের দিকে, কিছু বলল না। কথা বলার সাথী বলতে তো সেই।
গোসল সেরে নেমে এলো আনন্দ। শরীর চলছেনা। অথচ এই কদিন চর্কির মত ঘুরেছে। ক্লান্তি আসেনি। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দুজনকে হারিয়ে। নিজেকেও হারাতে চলেছিল শুধু ছক্কার চাল ঠিক থাকাতে এই যাত্রা বেচে গেছে।
“কাল অফিসে যেতেই হবে? না গেলেই নয়?” জিজ্ঞাসা করলো সানন্দা।
“ওরা সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। সমস্ত ঘটনার ব্যাখ্যা তো আমাকেই করতে হবে।”
সানন্দা আর কথা বাড়াল না।
খাওয়া শেষে সমস্ত কিছু গুছিয়ে রেখে বলল,” আমি আসি, তুমি বিশ্রাম নাও।”
ডেভিড বলল,” This is a tremendous blow for this organization. কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদেরকে সামনে চলতে হবে। আমরা লাকি তুমি এখনও আমাদের মধ্যে আছো।”
সবাই এসে বসলো কনফারেন্স রুমে। আনন্দ একে একে জানাল সব ঘটনা। বলল সে স্টিভের সাথে আলাপ করবে আইন গত ভাবে আমাদের করনীয় কি।
জেনীফার উঠে আনন্দের কাছে এলো। বলল,”এবার তুমি কিছুদিনের জন্য বাহির থেকে ঘুরে এসো। মনটা ভাল লাগবে।”
আনন্দ সাই দিলো। বলল,” দেশে যাবো ভাবছি।”
“যাও, তবে যাওয়ার আগে একটা কাজ করতে হবে, আমি একা করতে চাইনা।” বলল ডেভিড।
কি?
“আগামীকাল একজনের ইন্টারভীউ আছে। এমিলির পজিশনটার জন্য। তুমি ইন্টারভীউ নেবে। আমি থাকব। তবে সব ভার তোমার উপর। ঠিক আছে?”
হা, বলে আনন্দ বলল সে উপরে স্টিভের সাথে দেখা করতে যাবে। উঠে পড়ল।
জনের মা কল করেছিল আনন্দ কে। বলেছিল একবার আসতে ওদের বাসাতে। ফিলাডেলফীয়ায়। আনন্দ না করেনি। বলেছিল দুই একদিনের মধ্যেই আসবে।
সব কাজ শেষে আনন্দ বাসাতে ফিরবে ভেবে গাড়ীটা স্টার্ট দিলো। সানন্দা বলেছিল কাজ শেষে ওর সাথে চা খেতে। তা আর হলনা। গাড়ীটা ঘোরালো সে এমিলিদের বাসার দিকে।
এমিলির মা বাবা আনন্দকে দেখে চোখের জল বেঁধে রাখতে পারেনি। আনন্দকে দেখিয়ে ছিল এমিলির রুমটা। সুন্দর করে সাজানো ঘর। এক কোণে একটা পেন্টিং। উপুড় করা। আনন্দ উঠিয়ে নিলো। তাকাল। আনন্দের অবয়ব। এমিলির আঁকা। ফিরতে রাত হোল।
আজ আনন্দ হাতে অনেক সময় নিয়ে অফিসে এসেছিল। লরেন্সের সাথে বসে কফিটা শেষ করার আগেই ডেভিড এলো। সামান্তা খবর দিলো যে ছেলেটার ইন্টারভীউ নেওয়া হবে সে বাহিরে বসে আছে।
আনন্দ চশমার কাচটা মুছে নিয়ে ছেলেটার জীবনবৃতান্ত টা আর একবার পড়ল। রাশেদুল ইসলাম। নামটা পরিচিত মনে হোল। সামান্তা কে বলল রাশেদকে ডাকতে। দরজা খুলে ভিতরে এলো রাশেদ। হ্যান্ডসাম, টোন বড
কোঁকড়া চুল, শ্যামলা। আনন্দ তাকিয়ে রইল ওর দিকে। বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে একটা শব্দ,” তুমি?”
“চেনও নাকি?” জিজ্ঞাসা করলো ডেভিড।
“চিনি।”
রাশেদ কে বসতে বলল। রাশেদ আনন্দের দিকে চেয়ে রইল।
আনন্দও তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। শেষ দেখে ছিল বারো বছর আগে ওর বাবার কবরের পাশে। তারিকুল ইসলাম।
তারেকের সাথে আনন্দের দেখা হয়ে ছিল দেশের রাজধানীর এক এলিট কলেজে। আনন্দ এসেছিল এক মফস্বল শহর থেকে। তারেকের জন্ম রাজধানীতে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তারেক এসে বাসা বেঁধে ছিল আনন্দের রুমে। ঠোটে হাসি লেগেই আছে। প্রাণবন্ত। বলত,” চল, মুভি দেখে আসি।”
আনন্দের যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যেতে চাইত না, পকেট শূন্য। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অনেক ভেবে চিন্তে চলতে হয় এই রাজধানীর বুকে।
পাশ করে দুজন চলে গিয়েছিল দু দিকে। আনন্দ আর্কিটেকচার কলেজে ভর্তি হলো। তারেক ইংলিশে মেজর নিয়ে ইউনিভারসিটিতে এলো। দেখা সাক্ষাত কমে গেলো । আর্কিটেক্ট হয়ে আনন্দ চলে এলো আমেরিকাতে স্কলারশিপ নিয়ে। সেতো অনেক দিনের কথা।
এক সন্ধ্যায় আনন্দ কণাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হল ঘরের লাউঞ্চে। এসেছিল বাংলা শিল্পীদের গান শুনতে। পিঠে হাতের স্পর্শে তাকাল পিছনে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল। তারেক?
“কিরে ,অবাক হয়ে গেলি? অনেক খুঁজেছি। আজ পেলাম।’”
ভেঙে যাওয়া বন্ধন আবারো জোড়া লাগলো। সময় পেলেই চলে আসতো আনন্দের বাসায়। কণা খুব পছন্দ করেছিল ওকে।
“বিয়ে শাদী করবি? মেয়ে আছে।” জিজ্ঞাসা করেছিল আনন্দ
“না, মা বাবার পছন্দ এক মেয়ে আছে, তার সাথে হবে। সামনের বছরে যাবো।”
এক শীতে ঝরা সন্ধ্যায় নিয়ে এলো সাকীলাকে। কণা যেয়ে সাজিয়ে রেখেছিল ওদের ঘর। দিন শেষে মাস, মাস শেষে বছর পেড়িয়ে গেল। এলো ওদের ঘরে এক ছেলে। রাশেদ। দুরন্ত। আনন্দের বাসায় এলে জিনিস পত্র ভেঙ্গে তছনছ করত। কনা কিছু বলত না।
এক রাতে ব্যাথায় টিকতে না পেরে আনন্দকে ফোন করেছিল। আনন্দ নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। সারারাত ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলল। সকালে আনন্দ কে ডাক্তার ডেকে নিয়ে গেল পাশের রুমে। বলল,” He has Multiple Myeloma. It is form of bone marrow cancer. Stage 3”. আনন্দ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলো তাকে ব্যাখ্যা করতে। চিকিৎসা আছে কি না। বাঁচার সম্ভবনা কতটুকু।
খুব একটা সময় হাতে নেই, বলল সে। “ It’s a serious incurable malignancy.”
তাড়াতাড়ী চিকিৎসা শুরু করতে হবে। বলল সে।
ডাক্তার ফিরে এলো তারেকের রুমে। বলল সবকিছু। তারেক আনন্দের দিকে তাকিয়ে থাকল, চোখের কোণে জল। সাকীলার কোন ভাবান্তর নেই।
চিকিৎসা শুরু। Chemoর ভয়াবহতা সহ্য করতে পারলো না তারেক। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে আনন্দ এসে বসে থাকে তারেকের পাশে। গল্প করতো ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ওর হাসিটা ম্লান হয়ে এলো। রক্ত শূন্যতা। মুখটা কুঁচকানো কাগজের মত। বলে,” আর কতদিন আমি বাঁচব রে আনন্দ, সত্যি করে বল।”
“নতুন নতুন অনেক চিকিৎসা বের হয়েছে। চিন্তা করিস না।” বলে বাথরুমে যাবার ছল করে বাহিরে যেয়ে কাঁদত।
দিনে দিনে খাওয়ার রুচি চলে যেতে থাকলো। গায়ের রঙ পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। বলে,” আমি আর পারছি নারে আনন্দ।“
মাঝে মাঝে আনন্দ এসে সাকীলাকে কোথাও না দেখে জিজ্ঞাসা করতো। তারেক বলত “ও বাহিরে গেছে দরকারে”। একদিন তারেক বলল ,” জানিস আনন্দ আমার খুব ইয়োলোস্টোন পার্ক টা দেখেতে ইচ্ছা করে। নিয়ে যেতে পারবি?”
“পারবো”। বলে সব ব্যাবস্থা করল আনন্দ। শেষ সময়ে সাকীলা বলল সে যেতে পারবেনা। বলল “তোমরা ঘুরে এসো। আমি এদিকটা সামলাব।“
যথা রীতি ওরা বেরিয়ে পরেছিল। আনন্দ দেখেছিল তারেকের হাসৌজ্জল মুখ। হুইল চেয়ারে বসে বসে দেখল তার সাধের ইয়োলোস্টোন পার্ক। মাঝে মাঝে মাথাটা এলিয়ে দিতো । আনন্দ ওকে নিয়ে এসে দাঁড়াত গাছের ছায়ায়।
চার দিন আনন্দ তারেককে বাচ্চার মতো আগলিয়ে রেখেছিল। ফিরে যাওয়ার দিন তারেক একটা এনভেলপ আনন্দকে দিয়ে বলল ,” কথা দে, এটা খুলবি আমি চলে যাওয়ার একমাস পরে। কথা দে? ”
আনন্দ কথা দিয়েছিল।
ফিরে আসার পরে তারেকের শরীর আরও খারাপের দিকে গেলো। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মরফিনে ব্যাথা যায়না। হাঁসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোল। ডাক্তার আনন্দ আর সাকীলাকে পাশে ডেকে নিয়ে বলল,” এবার ওকে যেতে দিতে হবে।“
দুদিন পরে সবকিছুর মায়া কাটিয়ে তারেক চলে গেল।
দিন যেয়ে মাস এলো। এক পরন্ত বিকেলে আনন্দ কড়া নাড়াল সাকীলার বাসায়। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক আমেরিকান ভদ্রলোক। আনন্দ ভুল বাড়িতে এসেছে ভেবে দুঃখিত বলে চলে যাচ্ছিল। মহিলার ডাক শুনে ফিরে তাকাল। সাকীলা। প্যান্ট সার্ট পড়ে দাঁড়ান।
ভিতরে আসতে বলতেই আনন্দ বলল, আজ নয় আর একদিন আসবো।
ফিরে আসতে আসতে মনে হোল সেই চিঠিটার কথা। বাসায় এসে খুলল চিঠিটা। দুকলম লেখা।
“I was cheated on”.
আনন্দ ? ডাক শুনে বাস্তবে ফিরে এলো।
“প্রশ্ন করো”? বলল ডেভিড
তাকিয়ে রইল আনন্দ রাশেদের দিকে।
“না, আমি না। I have a soft corner for him. ঠিক জাজমেন্ট করতে পারব না। হয়তোবা পক্ষপাতিত্ব করা হবে। তুমিই ওর ইনটা্রভিউ নেও।“ বলে আনন্দ দরজার দিকে পা বাড়াল। রাশেদ তাকিয়ে থাকলো ওর চলার দিকে।