“ সাপের খেলা সাপের খেলা কে দেখবি আয়” এই বলে চিৎকার করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত গফুর। বড় এক
লাঠির দুপাশে দুটো বাক্স। তার ভিতর গোখরো, চন্দ্রবোড়া, কালসাপ। আমরা ছোট ছোট ছেলেরা ওর পিছন পিছন যেতাম, বলতাম, “ গফুর ভাই, নতুন সাপ ধরেছ? অজগর?” হাসি দিয়ে বলত,” ধরেছি। বড় গোখরো। বিষ দাত এখনও আছে। দেখবি আয়”। ভয়ে আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে যেতো। রহিমের ভয় ডর ছিল কম। ও এগিয়ে যেতো। আমরা ওর পিছনে।
গফুর ভাই আবারও হাসি দিয়ে বলত,” এই বাক্সটা তে হাতদে”। রহিম হাত ছোঁয়াতেই ফোঁস করে শব্দ। আমরা দৌড় দিতাম। রহিম হি হি করে হাসত।
আমার বয়স তখন দশ। গফুর প্রায় আসতো আমাদের বাসাতে। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে বসতো এসে বারান্দায়। বাক্স দুটো পাঁশে রেখে গামছা দিয়ে মুখটা মুছে দালানে হেলান দিয়ে বসত । আমি বাক্স গুলোর পাঁশে ঘুর ঘুর করতাম। গফুর আমার দিকে তাকিয়ে বলত,’ দাড়া, তোকে বড় গোখরো সাপের খেলা দেখাই”। বলে বাক্স থেকে বের করতো গোখরো সাপটা। ফোঁস করে ফনা বের করে হেলে দুলে দাঁড়াত সে। গফুর তার হাতের বাঁশীটা বাজাতেই সাপ টা মাথা নাড়িয়ে ছোবল দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতো গফুরের দিকে। আমি ভয়ে লাফ দিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরতাম। গফুর খপকরে সাপটার গলা ধরে ফেলতও। আস্তে করে ছেড়ে দিতো বাক্সটার মধ্যে। সুবোধ বালকের মতো গোল হয়ে শুয়ে পড়ত সে বাক্সটার মাঝে।
মা বলত,” গফুর, দুপুরে কিছূ খেয়েছিস?”
“না, খালাম্মা”।
“ তা খাবি কেনও? সারাদিন এই রৌদের মধ্যে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়িয়েছ ?” মা রাগ করতো।
গফুর হাসত।
আমার মনে হতো মার একটা আলাদা টান আছে ওর উপর। গফুরও সেটা বুঝত।
মা ডাকতো ওকে রান্না ঘরে। বলত,” আয়, এখানে বসে খেয়েনে।“
মাকে হারিয়েছে সে ছোট বেলায়। তখন ওর বয়স ছিল ছয়। বাবা ছিল কাঠের মিস্ত্রি। পাশের বাসার কানুর মার কাছে রেখে কাজে যেতো। এই ভাবে দুটো বছর কাটল। বাবা আবার বিয়ে করলো। ভেবে ছিল বৌ এসে ছেলেটাকে দেখে শুনে রাখবে।
বিঁধি বাম। হোল উল্টো। গফুর হোল সৎমার চোখের শুল।
বাবা ওকে ভর্তি করে দিয়ে ছিল ক্লাস ওয়ানে। রং চং এ আঁকা বই নিয়ে সে যেতো স্কুলে। ওরই মতো গুঁড়ি গুঁড়ি বাচ্চাদের সাথে। স্কুল থেকে ফিরে আসতো হাতে পায়ে ধুলো মেখে। বাবা কাজ সেরে ফিরে এসে ছেলের হাত পা মুখ ধুইয়ে দিতো। পাঁশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করত,” আজকে কি শিখেছ ক্লাসে?”
গফুর তার বইটা বের করে দেখাতো বাবা কে।
সেই দিনগুলো শেষ হয়ে গেলো খুব তাড়াতাড়ি।
তিনটে মাস যেতে না যেতে সৎমার আসল রুপ বেরিয়ে এলো। স্কুল থেকে এসে মার কাছে বলত,” মা খিদে পেয়েছে? খাওয়া দাও।“
ঝামটা মেরে উঠত কামিলা। “ ছেলে আমার নেদা পড়া করে এসেছে। খাওয়া দাও”।
কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যেতো গফুর।
বছর না ঘুরতেই বাবা বুঝতে পেরেছিল এ বাসায় গফুরের স্থান নেই। এদিকে কামিলা সন্তান সম্ভবনা।
একদিন কাজ থেকে ফেরার পথে এসেছিল গফুরের মামা বাড়ী। বলল সব কথা। গফুর কে তারা স্থান দিতে পারবে কিনা। জয়নাল উদ্দিন না করে নি। গফুর এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল মামার বাসায়। গফুরকে রেখে বাবা চোখ মুছতে মুছতে চলে যাওয়ার আগে বলেছিল,” ভালো থাকিস বাবা। আমি আবার আসব তোকে দেখতে”।
মামা সাপুড়ে। মামার কাছেই গফুরের হাতেখড়ি। মামার সাথে যেতো সাপ ধরতে। শিখিয়েছিল কোন সাপ কিভাবে ধরতে হয়। স্কুলে আর যাওয়া হয়নি গফুরের। তার বদলে শিখে ছিল বাঁশি। বাঁশির তালে তালে সাপের নাচ দেখত সে।
একদিনের জ্বরে মামী চলে গেলো সবাই কে ছেড়ে। মামা ভেঙ্গে পড়ল। গফুর তখন ষোল বছরের যুবক। মামার উপযুক্ত ছাত্র সে। ধরেছিল হাল। মামাকে বলেছিল বিশ্রাম নিতে। সাপের বাক্স নিয়ে বেরিয়ে পরেছিল রাস্তায়।
“ সাপের খেলা সাপের খেলা কে দেখবি আয়” বলে ঘুরত রাস্তায় রাস্তায়। জড়ো হতো লোকেরা। বাচ্চারা চোখ বড় বড় করে দেখত সাপের খেলা। লোকে ছুড়ে দিতো পয়সা।
এমনি ভাবে ঘুরতে ঘুরতে এসেছিল সে আমাদের বাসায়। মাকে বলেছিল,” সাপের খেলা দেখবেন খালাম্মা?”
“দেখাও, বয়স কতো তোমার?” মা জিজ্ঞাসা করেছিল।
খেলা শেষে মা আলমারি খুলে কয়েকটা টাকা এনে ওর হাতে দিয়ে ছিল। বলেছিল, বসো,
পাটালি আর মুড়ি এনে ওর সামনে দিয়ে বলল,” খেয়ে নাও। সারাদিন নিশ্চয় কিছু খাওয়া হয়নি”?
সেই থেকে দেখেছি গফুর দিনের শেষে একবার হলেও মা কে দেখা দিয়ে যেতে।
একদিন মা আমাকে ডেকে বলেছিল,”শোন, ভাগ্যের খেলায় হয়ত গফুর হেরে গেছে কিন্তু সে তোমার বড়, তাঁকে ভাই বলে সম্বোধন করবে”। সেই থেকে সে আমার গফুর ভাই। মাঝে মাঝে গফুর ভাই আমার জন্য নিয়ে আসতো লেবেঞ্চুস।
বলত,” মা কে দেখিও না, এখনি খেয়ে নাও”।
এক ঈদে নামাজ শেষে গফুর ভাই এসেছিল মার সাথে দেখা করতে। পরনে পুরানো পাজামা, পুরানো জামা। মাকে সালাম করল। মা ওকে বসতে বলে ভিতরে গেলো। ফিরে এলো নতুন পাজামা পাঞ্জাবি হাতে। বলল,” গফুর এটা পরে এসো”।
গফুর ভাই তাকিয়ে ছিল মার দিকে। এই প্রথম তাঁকে কাঁদতে দেখে ছিলাম। মা কে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদে ছিল।
বলেছিল,” মার চেহারা মনে পরেনা, তুমিই আমার মা”।
অনেক বছর পেরিয়ে আমি তখন স্কুলের শেষ বর্ষে। পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। একদিন মা ডাক দিলো। বলল,” খোকা, গফুর তো বেশ কিছু দিন হয় আসেনি ।একটু ওর বাসায় যেয়ে দেখবি। ভালো আছে কিনা”?
জানি, না করার উপায় নেই।
যাচ্ছি, বলে বাবার সাইকেল টা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পনের মিনিটের পথ। বাসার চত্বরে এসে জোরে ডাক দিলাম।
গফুর ভাই ডাক শুনে বলল,” ঘরে আয়”।
ঘরে ঢুকে দেখি গফুর ভাই চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। নিচে একটা ছোট গামলা। তার মধ্যে লালচে দাগ।
”কি হয়েছে তোমার”? জিজ্ঞাসা করতেই বলল
“ জ্বর, তবে—-“ কথা শেষ হলনা। ভীষণ ভাবে কাশতে থাকলো। একটু থেমে কফটা থু করে গামলাতে ফেলতেই মনে হলও রং টা লালচে।
আমি কিছু বলার আগেই সে বলল,” জানিস পীন্টু, একটা অনেক বড় গোখরো ধরেছি। এখনও বিষদাঁত ভাঙ্গা হয়নি। চল তোকে দেখাবো”। বলে উঠতে গেলো। পারলনা। মাথাটা টলকে উঠল। শুইয়ে দিলাম বিছানায়।
বললাম, কাল এসে আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
বাড়িতে এসে মা কে বললাম, গফুর ভাই এর শরীর খুব খারাপ । তুমি যাবে?
হাঁ, কাল আমাকে নিয়ে যাবি। ওর জন্য খাবার নিয়ে যাবো। তোর বাবা কে বলিস ভালো একটা রিক্সা ঠিক করে দিতে।
সেই কাল আর আসেনি।
সকালে এসে জাফর খবর দিলো, গফুর মারা গেছে সাপে কেটে ।
সাইকেল চালিয়ে দ্রুত যেয়ে পৌছালাম। অনেক লোক এসেছে। দৌড়িয়ে গেলাম বাক্সটার কাছে। ডালা খোলা। বিষধর গোখরো টা নাই।
পাঁশে পরে আছে গামলাটা, জমাট রক্ত।
আমি কাঁদছি। মনে পড়ছে সেই লেবঞ্চুসের কথা। মনে পড়ছে ঈদের দিনে মা র দেওয়া নতুন জামা,পাজামা পরে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,”দেখত আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?”
মনে হচ্ছিল ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেই। বলি, চলো গফুর ভাই, সময় তো হোল, বাঁশি টা নাও, ডাক দাও ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দেরকে, বলও,” সাপের খেলা সাপের খেলা কে দেখবি আয়”।