পিকু তুই কোথায়?

পিকু তুই কোথায়? তোকে অনেক খুঁজেছি আমি, আজও খুজে চলেছি। ফেসবুকে তোকে খুঁজেছি। ভেবেছি হয়তো একদিন দেখতে পাবো তোর ছবি।
চিনতে পারব কি?
সেই ছেলেবেলার তোর আমার সাদাকালো ছবিটা আজও আছে আমার এ্যালবামে। এইতো সেদিন এ্যালবাম গুলো বাক্সবন্দি করতে যেয়ে ঝরঝর করে কতোগুলো ছবি মেঝেতে পড়ে গেলো। উঠাতে যেয়ে ঐ ছবিটা দেখতে পেলাম। কত কত কত আগের সেই ছবি। ওটাকে কুড়িয়ে নিয়ে আমি এসে বসলাম আমার ছোট্ট ড্রয়াইং রুমে।

ফিরে গেলাম আমি অনেক অনেক পেছনে। তোর সাথে তখনো আমার বন্ধুত্ব হয়নি। তুই একটু মুখচোরা ছিলি। আর আমি ছিলাম তার উল্টো।
মনে পড়ে কি সেই দিনের কথা?
তোদের বাসার পাশে বড় আম গাছটার নিচে আমরা চারজন মধু, মহি, সন্তোষ আর আমি মার্বেল নিয়ে খেলা করছিলাম। তুই দাড়িয়ে ছিলি পাশে। মার্বেল খেলায় আমি সিদ্ধহস্ত। হার জিতের মাঝে জিতের সংখ্যাই আমার বেশি।
তুই বড় বড় চোখ করে খেলা দেখছিলি। হঠাৎ ই আমার চোখ পড়লো তোর উপর।
বললাম, খেলবে?
মনে হোল তুই কিছুই বুঝতে পারলিনা।
আবারও বললাম। খেলবে? এই নাও চার টি মার্বেল।
তুই ভয়ার্ত মুখ করে বলেছিলি, না, বাবা বকবে।
মহি তোর মাথায় একটা চাট্টি দিয়ে বলেছিল, তাহলে এখানে দাড়িয়ে কেনও, বাসায় যাও।
তুই আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে বাসার দিকে চলে গেলি।
আমি মহি কে বলেছিলাম, ওকে মারলি কেন?
মারি নি তো, শুধু একটা চাট্টি দিয়েছি, বলে হাসতে লাগল।
খেলা শেষ করতে হোল। স্কুলে যেতে হবে।

আচ্ছা বলতো তখন আমাদের বয়স কত? ক্লাস ফাইভে পড়ি। তাই না?
সেইদিন স্কুলে এসে তোকে দেখলাম আমাদের ক্লাসে। আগেও তুই এসেছিস। কিন্তু আমি খেয়াল করিনি। অন্য বন্ধুদের সাথে ক্লাস শেষে খেলায় মত্ত ছিলাম। তোরা কেবল নতুন এসেছিস এই পাড়ায়।
তোর বাবা বদলি হয়ে এসেছে এই খানে। আমাদের বাসার ঠিক পিছনেই তোদের বাসা।

আমি তোর কাছে যেয়ে বলেছিলাম, মহি ওই রকমই। তুই আজ বিকেলে আমাদের বাসার সামনের মাঠে চলে আসিস, ফুটবল খেলব।
তুই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলি আমার দিকে। বন্ধু বলতে সেই মুহূর্তে আমিই। হয়ত তাই ভাবছিলি।
কিরে ? বাবা মানা করেছে ফুটবল খেলতে। বলে হাসতে হাসতে ওর ঘাড়ে একটা থাপ্পর দিলাম। অবশ্য আস্তে।
না, বাবা মানা করেনি, আসব।

জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে আমাদের খেলা।
আজ এইক্ষণে ফেলে আসা ঘটনা গুলো মনে পড়ছে, মনে হচ্ছে এইতো সেদিন সেই দিনগুলো। চলে গেলো কত তাড়াতাড়ি।
তুই ছিলি গোলকিপার। নাদুস নুদুস, বাবা মার আদরের ছেলে। দৌড়ানোর অভ্যাস ছিল বলে মনে হয় না। তাই তোকে আমরা গোলকিপার বানিয়ে ছিলাম। দেখা গেলো তুই তাতেও আনাড়ি।
খেলা শেষে তুই জাম্বুরাটাকে হাতে নিয়ে বলেছিলি, চলো, তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো।
আমি আবার তোকে থাপ্পর দিয়ে বলেছিলাম, ধ্যাত, কি তুমি তুমি করছিস।
সেই ময়লা পা, ময়লা জামা নিয়ে চলে এলাম তোদের বাড়ীতে।
তোর মা (পরে খালাম্মা বলে ডাকতাম) কি যেন ভাজছিল।
-দেখো মা, কাকে নিয়ে এসেছি? আমার বন্ধু, ঐ বাসাতে থাকে। আমরা এক ক্লাসে পড়ি। এই জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলছিলাম।
তোমার নাম কি? বলে খালাম্মা উননের দিকে নজর দিল।
নান্টু।
তোমার বাবা কি করে?
বললাম বাবার কথা।
ও হা তোমার খালু বলছিল তোমার বাবার কথা। তোমরা তো অনেক দিন এখানে আছো।
যাক ভালই হোল, পিকু একটা বন্ধু পেলো। ওর বন্ধু পাতাতে অনেক দিন লাগে।
তারপর তোর মা রুটির মধ্যে কি যেন দিয়ে গোল করে আমার হাতে দিয়ে বলল, খেয়ে নাও।
আমি ওই ময়লা হাতে সেটাকে গবগব করে খেয়ে ফেললাম।
ভীষণ খিদে পেয়েছিল।

সব কোথায় হারিয়ে গেলো, তাই না রে?
আজ লিখতে বসে চোখ টা ভিজে আসছে। আজ তুই কোথায়, জানিনা, আজ আমি কোথায় তুই ও জানিস না। হয়তো তুই আছিস, হয়তো নেই, আমি জানিনা।

মনে পরে কি, দুপুর বেলার সেই বাঁদরামি গুলো। স্কুল থেকে এসে, বই গুলো ছুড়ে ফেলে, দৌড়ে চলে আসতাম তোদের বাড়ীতে। তুই আমি আর কি যেন ওর নাম, ও হাঁ, সন্তু, মিলে ঝোপে ঘেরা পুকুর পাড়ে বসতাম।
ওই ঝোপ ঝারে বসে থাকতো, দয়েল, ঘুঘু, শালিক। আমার হাতে গুলতি। পকেটে মার্বেল।
তুই বলতি, ঐ ঐ দেখ, ঐ শালিক টাকে মার।
আমি গুলতি টাকে টেনে, নিরিখ করে, ছেড়ে দেতাম মার্বেল টা।
আমার আনন্দ ওটাকে বধ করা, তোর আনন্দ দেখে।
বলতাম, এবার পুকুরে ঝাপ দেবো। সন্তু গায়ের জামা খুলে প্রস্তুত। তুই বলতি, না না আমি যাবো না।
সাঁতার জানিস না?
না
তুই একটা হদ্দ। সিঁড়ি বেয়ে গলা জলে দাড়িয়ে থাকিস। আমরা সাঁতার দিয়ে ওপারে যাবো।
ভিজা প্যান্টে বাড়ী গেলে মা মারবে।
এই চাতালে শুয়ে থাকবি, তাহলে রোদেই শুকিয়ে যাবে।
আর চোখ লাল হয়ে থাকলে?
ঐ যে গাছটা দেখছিস ওর পাতা চোখের উপরে দিয়ে শুয়ে থাকবি, তা হলে চোখের লাল চলে যাবে।
তুই ঠিক বলছিস তো?
তোর ভয় কাটে না। পরে অবশ্য কেটেছিল।
এই ভাবে বাঁদরামি করে করে আমাদের অনেক গুলো বছর কেটে গিয়ে ছিল।
মনে পরে তুই বলেছিলি, আচ্ছা, এতো সব করেও তুই ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করিস কি ভাবে?
বলেছিলাম, জানিনা।

তোদের বাসার পাশ দিয়ে, পায়ে চলার পথের রাস্তা টা, দুপাশে বাঁশের ঝার, তার মাঝ দিয়ে পথ এসে থেমে ছিল ধোপাদের বাসায়। তার পাশেই ছিল একটা মাঠ।
মনে পরে কি?
সেই মাঠে খেলা হতো কাবাডি।
তুই আর আমি বিকেলে বসে বসে ঐ কাবাডি খেলা দেখতাম।
খুব খেলতে ইচ্ছা করত। একদিন রাখালকে বলেছিলাম, আমাকে নেবে।
-তুই বাচ্চা। পা ভেঙ্গে যাবে।
-আমি অনেক দম রাখতে পাড়ি, নিয়েই দেখনা।
নিয়েছিল ওরা আমাকে।
তোকে বলেছিলাম, খেলবি?
না, আমি পারবো না। আমার পা ভেঙ্গে যাবে। বলে ভয় ভয় চোখ করে চেয়ে রইলি।
তুই অনেক ভীতু ছিলি।

সেই ছোটবেলা থেকে আজ। মাঝে অনেক টা পথ পেড়িয়ে গেছে।
জানিস কোথায় যেন পড়েছিলাম, নদী যেমন সোজাসুজি সমুদ্রে বাক খায় না, নানা বাঁক করে তারপর মোহনায় পৌছায়, মানুষের জীবনটাও তাই। সোজা পথে চলতে চলতে কখন যে বাঁক নেবে তা তুই ও জানিস না আমিও না।
অনেক সময় অঙ্ক মেলে না।
কি যা তা বকছি।
যাক যা বলছিলাম—
মনে আছে কি, চুয়াডাঙ্গা রাস্তা ধরে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলে বা দিকে বড় বড় দুটো গাছের মাঝ দিয়ে যে ঢাল নেমে গেছে, ওটা ধরে একটু এগিয়ে গেলে বনের মাঝে ছোট্ট একটা লাল ঘর। ওটা কে বলে মড়া কাঁটা ঘর।
শুনেছিলাম ওখানে নাকি মানুষ কে কাঁটা হয়।
কেনও? তখনও তা জানার বয়স হয়নি।
তুই, আমি, সন্তু আর সেলিম একদিন আখের বাগান থেকে আখ নিয়ে পরিমল দের বাসার পাশের মেঠো পথ ধরে হাটতে হাটতে আসার পথে বললাম, যাবি মড়া কাঁটা ঘরে।
তুই ভয়জড়িত কণ্ঠে বললি, না না আমি যাবো না। ওখানে ভুত থাকে।
ধ্যাত, কিছু থাকে না।
সন্তু সেলিম রাজি।
তুই অবশ্য পরে রাজি হয়েছিলি। তোর মুখ টা ফ্যাকাসে ফ্যাকাসে লাগছিল।

লালা ঘর টা দেখা গেলো। আমার ভিতরে অজান্তে একটা ভয় আকুপাকু করছেল। তোদের সামনে প্রকাশ করিনি।
ঝোপ ঝারে ভরা চারিদিক। কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে তারপরে দরজা। তালা লাগানো। পাশের দালানের উপরে একটা ছোট্ট জানালা। আমাদের নাগালের বাহিরে।
সন্তু বলল, আমার ভয় করছে, চল চলে যাই।
ঠিক সেই সময় কোথা থেকে বিশাল কালো এক লোক, গায়ে ছেড়া জামা, পরনে লুঙ্গি, কাছা মারা। আমার জামাটা টেনে ধরল। আমি চিৎকার করে উঠলাম।
নেহি ছরেঙ্গা আজ। বলে হুঙ্কার দিল লোক টা।
সেলিম কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি কিছু জানিনা, নান্টু নিয়ে এসেছে।
কহী বাত নেহি, সব কো ভী ঘর কা ভিতর তালা বন্দ করকে রাখে গা।
বলে চাবি টা দেখালও লুঙ্গির কোছা থেকে।
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ছেড়ে দাও, আর কোনদিন আসবো না।
নেহি ছরেঙ্গা আজ। বলে আবারও হুঙ্কার দিল।
সন্তু এবার হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল।
হয়তো সন্তুর কান্না দেখে লোকটা আমার জামাটা ছেড়ে দিল। তোর দিকে তাকানোর মতো অবস্থা আমার নেই।
সবাই ভয়ে কাঁপছি।
ঠিক হ্যায়, কহী বাত নেহি, আজ ছোঁড় দেতা হ্যায়, ইধাঁর পর মাত আনা, সাপ খোপ হ্যায় ইধাঁর পর। সামাল কে জানা।
বলে লোক টা উধাও হয়ে গেলো।
আমরা তরী কি মরি করে দৌড়।
সেই দিন আমরা সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সারাটা পথ তুই কথা বলিস নি। আমিও না।
আহা রে সেইদিন গুলো ছিল নিষ্পাপে ভরা, তাই না?

তারপর এলো সেই দিন টা।
যে দিন তুই আমাকে এসে বললি, আমরা চলে যাবো এখান থেকে। বাবা বদলি হয়ে গেছে।
আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আমার অনেক বন্ধু, কিন্তু তুই ছিলি আমার সব চেয়ে কাছের।
জানিস আমি সেই রাতে ঘুমাতে পারিনি। মা কে বলেছিলাম। মা বলেছিল, খুব দুরে তো যাচ্ছে না, এইখান থেকে যশর।
মাত্র দুই ঘণ্টার পথ।
আমার মনে হচ্ছিল তুই অনেক অনেক দুরে চলে যাচ্ছিস।
তখন আমরা কোন ক্লাসে? ক্লাস সেভেন এ।

আমি এলাম তোদের বাসায়। খালাম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, বাবা, তুমি তোমার মা কে নিয়ে এসো আমাদের নতুন জাগায়। শুনেছি তোমার বাবা প্রায় যায় অফিসের কাজে।

বাসার সামনে ট্রাক টা দাঁড়ানো। মালপত্র উঠানো হচ্ছে। আমি আর তুই সেলিম দের বাসার সিঁড়িতে বসে দেখছি। খালু তদারকি করছে। তোর বড় বোন, আজ নামটা ভুলে গেছি, ডাক দিল, বলল, তোরা দুজন আয় খেয়ে নে। তোদের বাসার বাড়া ভাত কত দিন যে আমি খেয়েছি তার কি কোন হিসেব আছে?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলো। সব ঠিক। এবার যাওয়ার পালা। খালু যাবে ট্রাকের সাথে। তোদের জন্য এসেছে আর একটা গাড়ী।
ট্রাক টা চলে গেলো। ঘর টা শূন্য।
তুই আর আমি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম পাশাপাশি। তোর চোখে কি পানি ছিল?
খালাম্মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কাঁদিস নে।
আমি কি কাঁদছিলাম? জানিনা। মনের অগোচরে কান্না এসেছিল।
গাড়ীর পিছনে পিছনে আমি হেটে ছিলাম। আস্তে আস্তে গাড়ীটা মিলিয়ে গেলো।
জানিস আমি আর কোনদিন ফিরে আসিনি তোদের ঐ বাসায়।
তোর সাথে সেই আমার শেষ দেখা। দুই ঘণ্টার পথ, কিন্তু দুই বছরেও যাওয়া হোল না।

আস্তে আস্তে আমার দুরন্তপনা মিলিয়ে গেলো। আমি একের পর এক ক্লাস পাড় হয়ে শেষ বর্ষে এসে পৌছালাম।
আমি তখন স্কুলের ফুটবল টীমের ক্যাপ্টেন। আমাদের টিম গিয়েছিল তোদের জেলা স্কুলের সাথে ফাইনাল ম্যাচ খেলতে।
তখনো টিমটিম করে তোর স্মৃতি টা মনের মাঝে ভাসছে। একেই বলে চোখের আড়াল তো মনের আড়াল।
আমি তোদের টীমের ক্যাপ্টেন কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোর কথা।
বলেছিল, ওরা তো নেই এখানে, গত বছর চলে গেছে এখান থেকে।

তোর খোঁজ আর পেলাম না।

জানিস মাঝে মাঝে ভাবি যদি একটা বার কয়েক ঘণ্টার জন্য ফিরে যেতে পারতাম ঐ ছোটবেলা আর মাঝবেলা তে।
দেখতে পেতাম তোকে, দেখতে পেতাম আমার প্রিয় আর একজন কে।
তা হবার নয়।
আশায় রইলাম, হয়তো একদিন দেখা হবে তোর সাথে। সেদিন তুই চিনতে পারবি তো?

Continue Reading

শান্তির নীড়

Can you give me a glass of water। মারগারেটের ডাক শুনে আহমেদ উঠে এলো। ড্রয়াইং রুমে বসে সদ্য আসা একটা মেডিক্যাল জার্নালের পাতা উল্টাচ্ছিল। যদিও ডাক্তারি প্রাকটিস ছেড়ে দিয়েছে আজ অনেক বছর হোল। তবুও এই জার্নাল গুলো পড়তে ভালই লাগে।
পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিলো মারগারেটের হাতে। হাতটা ছোঁয়ালও কপালে। জ্বর দেখতে নয়, আদরের ভঙ্গিতে। মারগারেট ওর বা হাতটা দিয়ে চেপে ধরলও আহমেদের হাতটা। ঝাপসা চোখে বলল, আর কতদিন এইভাবে করে যাবে।
ও কথা বলতে নেই। ঠাণ্ডা লাগছে নাতো? বলে চাদরটা পায়ের উপরে আর একটু উঠিয়ে দিল।
ফেলীসীয়াকে চলে যেতে বলেছি। ও কাল সকাল আটটায় আসবে। তোমাকে একটু পরে দুধ টা গরম করে এনে দেবো। এই বলে আহমেদ ড্রয়াইং রুমে এসে বসলো।
জার্নাল টা আবারও উল্টাল কিন্তু মন বসলো না।

ড্রয়াইং রুমের দেয়ালে টাঙ্গানো অনেক আগে মারগারেটের সাথে তোলা ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল আহমেদ। বয়স তখন কতো? তিরিশের কাছা কাছি। মিশিগানের এক হসপিটালে Residency করে আহমেদ।
ষাটের দশকের শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে সেরা ছাত্র হয়ে বেড়িয়ে এসেছিল আহমেদ। আহমেদের মামা ছিল ডাক্তার। সেই খোঁজ নিতে বলেছিল। বলেছিল USIS(United States Information Services) যেয়ে জানতে কিভাবে আমেরিকান হসপিটালে কাজ নিয়ে যাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জেনে ছিল ECFMG দিতে হবে। দিয়ে ছিল। ভাল রেজাল্ট করে চলে এসেছিল মিশিগানের ঐ হাসপাতালে Residency নিয়ে। ঐখানেই পরিচয় মারগারেটের সাথে।

মারগারেট নার্স। একই ওয়ার্ডে দুজনের ডিউটি।
একদিন কাজের ফাকে আহমেদ ঘুমিয়ে পড়েছিল সোফাতে। মারগারেটের ছোট্ট একটা ধাক্কায় চোখ মেলে তাকাল আহমেদ। প্রতিদিন আঠারো ঘণ্টা করে ডিউটি করে শরীর ক্লান্ত হয়ে এসেছিল আহমেদের। ভেবে ছিল একটু চোখ টা বুজে নেই। একশো দশ নম্বর রুমের রোগী টাকে এই মুহূর্তে দেখতে হবে না। শেষ চার্ট টা সে দেখে এসেছে। নতুন কোন ওষুধ যোগ করতে হবে না। তাই ডাক্তারদের ওয়েটিং রুমে এসে চোখটা বুজেছিল।
ছুটি পাবে ভোর সাতটায়। তাও চার ঘণ্টার জন্য।

মারগারেটের ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসল আহমেদ। মারগারেটের কথায় একশো চোদ্দ নম্বরের রোগীর শ্বাস নিতে অসুবেধা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। রাতে ডাক্তার থাকে না। রেসিডেন্ট দিয়ে রাত টা কাভার করে।
রোগীকে দেখে অক্সিজেন মাস্ক আর লেসীক্সের পরিমাণ টা বাড়িয়ে দিতে বলে বেড়িয়ে এলো আহমেদ।
বাহিরের কর্নারের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল সে।
বাহিরে জ্যোৎস্নার আলো।

ফিরে গেলো বহু পিছনে, মনে পড়ল একসময় ছাত্র থাকা কালিন হঠাৎ করেই একদিন অনন্যাকে দেখেছিল করিডোরে দাড়িয়ে থাকতে। এমন করে কোন মেয়েকে দেখেনি সে।
কি জানি কি হয়েছিল সেদিন। অনন্যার চেহারা সে ভুলতে পারেনি। রুমমেট কে বলেছিল।
রুমমেট প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি। আহমেদ করবে প্রেম। অবিশ্বাস।
বলেছিল, বন্ধু, হৃদয়ে দুব্বা গাছ জন্মেছে তাহলে। হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

গল্প লেখার চেষ্টা করেছিল। চেষ্টা করেছিল অনন্যা কে নিয়ে লিখতে। দুই একটা কবিতার বই পড়ে সে ভেবে ছিল সাহিত্যিক হয়ে গেছে।
জীবনানন্দ দাশকে কোট করে,
“ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার- রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল, চুল তার শাওনের মেঘ—আর আঁখি গোধূলীর মতো গোলাপী রঙ্গীন, আমি দেখিয়াছি তারে ঘুম পথে- স্বপ্নে- কতদিন”। সাথে আরও কিছু নিজস্ব লেখা। সব মিলিয়ে একটা চিরকুট তৈরী করেছিল।
ছুরি কাচি চালাতে যার হাত কাপেনি, আর আজ ছোট্ট একটা চিরকুট দিতে হাতের কাপন থামানো দায়। তবুও ক্লাস শেষে বের হয়ে দেখল অনন্যা দাড়িয়ে আছে দুই বান্ধবীর সাথে। আহমেদ এগিয়ে আসতেই অন্য দুই বান্ধবী বাই বলে চলে গেলো।
মেয়েদের সাথে কথা বলতে আহমেদ মোটেই তুখর নয়। সে আছে লেখাপড়া, বিভিন্ন দেশের খবরাখবর নিয়ে ব্যাস্ত।
শিক্ষকদের প্রিয় পাত্র সে। প্রেমের ব্যাপারে নিতান্তই অনভিজ্ঞ।

আহমেদ এগিয়ে আসতেই অনন্যাই প্রথমে বলেছিল, কেমন আছেন আহমেদ ভাই। বলে অনন্যা আরও এগিয়ে এলো আহমেদের কাছে।
আহমেদ পরিচিত সবার কাছে। পরিচিত অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হিসাবে।
আহমেদের কপালে কুচিকুচি ঘামের রেখা। হাতে ধরা চিরকুট টার পাশ টা ভিজে গেছে।
আপনাকে খুব নার্ভাস লাগছে আহমেদ ভাই। সব ভালত?
একটু নার্ভাস, সামনে পরীক্ষা কি না। তাই।
এই পর্যন্ত। চিঠি টা আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। প্রেমের সমাধি সেখানে।

“ কফি টা খাও, ভাল লাগবে”।
ফিরে তাকালও আহমেদ। মারগারেটের হাতে কফির কাপ। তাকাল মারগারেটের চোখের দিকে। অনেকদুরে যার চোখের মাঝে খুজতে চেয়েছিল নিজেকে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। হয়ে ওঠেনি তার নিজের ভীরুতার জন্য। আজ যেন তাই খুজে পেলো
মারগারেটের চোখে।
অনেকদিনই তো সে মারগারেটের সাথে কাজ করেছে। কিন্তু এমন ভাবে তো দেখেনি তাকে। দেখেনি তার সোনালী চুল, নীল চোখ। এসব সবই তো আগেও দেখেছে, আজ কেন তা ভিন্ন মনে হোল। কেন তার হাতের ছোঁয়ায় সমস্ত শরীর বীনার ঝংকারে ঝংকৃত হোল।
কফিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল মারগারেটের দিকে।
কিছু বলবে?
“আজ তোমাকে অন্য রকম লাগছে ম্যাগ”। এমন ধরণের কথা সে কখন বলেনি কাউকে। আজ কেনও? তবে কি? নিজের মনেই প্রশ্ন করল সে।
কি রকম লাগছে? আগলি?
না তা নয়। কি যেন দেখছি তোমার মাঝে যা আগে কখন দেখেনি। — এই বাচালতা কেনো এলো তার মাঝে। কথার ফুলঝুরি আগে তো ফোটেনি। তবে আজ কেনও?

পরদিন মারগারেট কে না দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল লিজ কে। শুনল তার আজ ছুটি। কেমন যেন একটা অস্থিরতা মনের মধ্যে বিচরণ করতে লাগল। আজ পাঁচটায় সে বেড়িয়ে যাবে হাসপাতাল থেকে। ম্যাগের সাথে বসে কফি খেলে মন্দ হতো না ভেবে লিজের কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিলো। কয়েক বার ডায়েল করতে যেয়ে রেখে দিল।
দ্বিধা, দন্দের মাঝে সে। ম্যাগের নীল চোখ টা ভেসে ওঠে তার মনে। ফোনটা বের করলো আহমেদ। আর দ্বিধা নয়।
ফোন করা হলনা। শুনতে পেলো মাইক্রোফোন বলছে, ডক্টর আহমেদ পিক আপ এক্সটেনশন ২০৫৪।
হ্যালো,
এতো মেঘ না চাইতেই জল। ওপাশে ম্যাগের কণ্ঠস্বর।
“ তোমার তো আজ পাঁচটা পর্যন্ত কাজ তাই না?”
হাঁ, কেনও?
আহমেদ তার নিজের দুর্বলতা কে এই মুহূর্তে প্রকাশ করতে চাইল না। হঠাৎ করে সে এতো সুন্দর খেলা কবে থেকে খেলতে শিখল তা নিজেই ভেবে পেলোনা।
–কাজের শেষে আসবে কি মেইন ষ্ট্রীটের কফি শপে। বিকেল ছয়টায়। কিছুক্ষণ সময় কাটান যাবে। অবশ্য তুমি যদি ব্যস্ত না থাকো।
আহমেদ ভেবে পেলনা কি ভাবে মারগারেট তার মনের খবর পেলো। তাকে আর এগিয়ে যেতে হোল না, সেই তোঁ এসে ধরা দিল।
আসব। ঠিক ছয়টায়। বলে ফোন টা রেখে এগিয়ে গেলো একশো বারো নম্বর রুমের রোগী কে দেখতে।

ঠিক ছয় টায় কফি ডিলাক্সের সামনে এসে দেখল মারগারেট দাড়িয়ে আছে। লাল স্কারটের সাথে গাড় নীল টপস। সোনালী চুল গুলো উঁচু করে বাঁধা। গলায় সাধা পার্লের নেকলেস। মনে হোল এতো সেই মারগারেট নয়, যাকে সে প্রতিদিন দেখে।
হাই! বলতেই মারগারেট এসে আহমেদের ডান গালে চুম দিলো।
ইয়াং ছাত্র দের আড্ডা খানা এই কফি ডিলাক্স। কোনায় একটা টেবিল নিয়ে বসলো ওরা দুজন। কথা আর খাওয়ার মাঝে মারগারেট আহমেদের হাতের উপর হাত রেখে তাকাল ওর দিকে। আহমেদ ওর আর একটা হাত টেনে নিলো ওর হাতের উপর।
সেই শুরু।
দুটো বছর কোথা দিয়ে কেটে গেলো দুজনের কেউ বুজতে পারলো না। একে অন্যনের মাঝে মিশে গিয়েছিল।
আহমেদর Residency শেষ। পরীক্ষা দিয়ে সে এখন ডাক্তার। নামের শেষে এমডি।

ঠিক সেই সময় দেশ থেকে খবর এলো মার শরীরে খুব খারাপ। এখনি এসো।
মারগারেট কে বলতেই সে বলল, যাওয়ার আগে আমাদের শুভকাজটা সম্পূর্ণ করে গেলে হয় না। আমিও না হয় তোমার সাথে যাবো। দেখবো তোমার মা কে।
এই ভয় টাই সে করছিল। আজও পর্যন্ত সে মা কে জানায় নি। মা সেকেলে। মেনে নেবে কিনা জানে না। বাবা বেচে থাকলে অসুবিধা হতো না।
বলল, থাক না, এই মুহূর্তে তাড়াহুড়া করে নাই বা করলাম।
মারগারেট আর কোন কোথা বলে নি। শুধু জেনে নিয়েছিল এখান থেকে দেশে যাওয়ার রুট কোণটা। কোথায় Lay over.
আহমেদ বলেছিল লন্ডনে বন্ধুর বাসায় দুদিন থেকে তারপর দেশের দিকে পাড়ি দেবে। বন্ধুর ঠিকানা টা মারগারেট নিয়ে রেখেছিল।
যথা সময় বিদায় দিয়ে মারগারেট ফিরে এসেছিল তার বাসায়।

সকালে দুই বন্ধু চার টেবিলে বসে পুরানো দিনের ঘটনার স্মৃতি মন্থন করছিল।
টিং টিং শব্দ। দরজায় কে যেন বেল টিপছে।
মহী এগিয়ে যেয়ে দরজা খুলতেই, মহিলা জিজ্ঞাসা করল, আহমেদ আছে?
আপনি?
মারগারেট।
মারগারেট? মহী জানে মারগারেট কে।
আসুন, আসুন। বলে নিয়ে এলো ডাইনিং রুমে।
আহমেদের কিছুটা সময় লাগল বুঝে উঠতে।
তুমি? এখানে।
হাঁ, এলাম, ভেবে দেখলাম একা থাকা আমার হবে না। তোমার সাথেই আমি দেশে যাবো। ওখানেই আমাদের বিয়ে হবে।
কি বলও?
আহমেদ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। মাথা ঠিক মত কাজ করছে বলে মনে হোল না।
সমাধান করে দিল মহী।
কোন চিন্তা নেই, এই লন্ডনেই তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেবো আমি। এখান থেকে তোমরা স্বামী স্ত্রী হয়ে দেশে নামবে।
তাই হোল। ধুমধাম না হলেও দুই একজন মহীর বন্ধুসহ আহমেদ- মারগারেটের বিয়ে হয়ে গেলো সেইদিনই।
এ যেন এক রুপকথা।

দুরুদুরু বক্ষে মা র সামনে এসে দাড়িয়ে ছিল। মা দুজন কে আশীর্বাদ করেছিল। চলে যাওয়ার সময় শুধু এইটুকুই বলে ছিল। তোমরা এ দেশেই থেকে যাও এই কামনা করি।
আহমেদ আর মারগারেটার আর ফিরে যাওয়া হয়নি। বড় একটা হাসপাতালে আহমেদ চাকরি পেলো। মারগারেট সংসার নিয়ে ব্যস্ত রইল।
বছর ঘুরতেই কোলে এলো ইব্রাহীম। সাদা কালো মিলিয়ে ইব্রাহীম দেখতে হোল এক মিষ্টি সোনার টুকরা। আহমেদের জান। কাজ থেকে এসে ওকে নিয়েই মত্ত থাকে।
দিন যায় রাত আসে এমনি করে অনেক অনেক বছর কেটে গেলো। ইব্রাহীম এখন যুবক।

একদিন আহমেদ হসপিটাল ফিরলে মারগারেট বলল, জানো আমার না কতো দিন থেকে Bowel Movment টা ঠিক মতো হচ্ছে না। সেই সাথে bladder এ প্রবলেম মনে হচ্ছে।
প্রথম প্রথম খুব একটা গুরুত্ত দেই নি আহমেদ।
কিন্তু ক্রমেই মারগারেট বুজতে পারে আগের মতো আর এনার্জি নাই। Mental depreesion। মুখএ শার্প pain অনুভব করে। মাঝে মাঝে চোখে ঝাপসা দেখে।
আহমেদ ডাক্তার, সব শুনে বুজতে পারে এটা স্বাবাভিক নয়।
নিয়ে গিয়েছিল Specialistর কাছে।
অনেক অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলল, “It’s a symptoms of MS,” তুমি তো ডাক্তার তুমি জানো এর কোন চিকিৎসা নেই। শুধু সেবা করা ছাড়া।
সেই থেকে আহমেদ সেবা পরে চলেছে মারগারেট কে। বুজতে দেয় না তাকে। ছোট বাচ্চার মতো আগলিয়ে রাখে।

ইব্রাহীমের বিয়ে দিয়ে ছিল ধুমধাম করে। কিন্তু টেকেনি।
আহমেদের বয়স আজ পড়ন্ত বেলায়।
মাঝে মাঝে ভাবে মারগারেট তাকে অনেক দিয়েছিল। সমস্ত সংসারটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিল। কাজ থেকে এলে মনে হতো সে যেনও এলো এক শান্তির নীড়ে। সেই শান্তির নীড় আজও আছে।
শুধু সে বসে আছে হেলান দিয়ে। তাকিয়ে থাকে আহমেদের দিকে। আহমেদ তাকে বই পড়ে শোনায়।
ফেলে আসা দিনের ছবি গুলো দেখে একসাথে। হাতে হাত রাখে।
রাতে ওর ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে, “ এবার তোমার ঘুমানোর সময় হোল। ম্যাগ।“

Continue Reading

শ্যামলী

  মানুষের মন কেন এতো সংকীর্ণতায় ভরা। কেন মানুষ ভাবতে পারেনা একটা মেয়ে আর একটা ছেলে পাশাপাশি হাঁটলে, হেসে কথা বললেই তাঁরা প্রেমিক প্রেমিকা নয়। তাদের সম্পর্ক অন্য কিছু। এইসব চিন্তা গুলো সেলিমের মাথায় যট পাকাচ্ছীল। কাল সারা রাত ঘুমাতে পারেনি সেলিম।

ওয়ার্ল্ড কাপ দেখছিল সেলিম  । আর্জেন্টিনা ভার্সেস করেসীয়া। আর্জেন্টিনার পক্ষে সে। আর্জেন্টিনা এক গোলে পিছিয়ে আছে। সেলিম উত্তেজিত। কোন ক্রমেই যেন আর্জেন্টিনা না হারে এই দোয়া করছিল। মধ্যে পথে উঠে যেয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে এনেছিল।

আর্জেন্টিনার পায়ে বল। করেসীয়ার গোলের কাছে, ঠিক সেই সময়ে ফোনটা বেজে উঠল। শ্যামলীর ফোন।

এই সময়ে তার তো কাজে থাকার কথা। কেন কল করলো? ঠিক সেই সময় বলটাকে কিক করলো, কিন্তু না বলটা গোল পোস্টের পাশদিয়ে বেড়িয়ে গেছে।

ফোন টা উঠিয়ে হ্যালো বলতেই, শ্যামলী বলল, তুমি কি ব্যস্ত।

সেলিম না বলতেই, শ্যামলী উত্তেজিত ভাবে বলল, সময় হবে তোমার?

শ্যামলীর কণ্ঠস্বরেই সেলিম বুজতে পারলো, কিছু একটা ঘটেছে। খেলা টা আর দেখা হবে বলে মনে হচ্ছে না।

কেন কি ব্যাপার? এই অসময়ে – কথা শেষ হবার আগেই শ্যামলী বলে উঠল, তুমি আর আমাকে কল করবে না। আমিও না। আমিও তোমাকে কোন ভাবে কন্টাক্ট করবোনা, আর তুমিও করবেনা।

কথা গুলো শ্যামলী এতো তাড়াতাড়ি উত্তেজিত ভাবে বলে গেলো সেলিম বুঝে উঠতে পারছিলনা কি হয়েছে।

তা বলবে তো কি হয়েছে।

নীলা টেক্সট পাঠিয়েছে।

কি টেক্সট পাঠিয়েছে? আর নীলা তো তোমার ছোট বোন। সে কি এমন টেক্সট পাঠাল যার জন্য তুমি আমাকে কল করতে বাড়ন করছ, আর তুমিও আমাকে কল করবে না।

ও একটা ইডিয়েট। আমার ছোট সে আর ও কিনা বলে আমি খুব খারাপ কিছু করে বেড়াচ্ছি তোমার সাথে। ওর শ্বশুরবাড়িতে নাকি ও মুখ দেখাতে পারছে না। তাই সে চায় না আমি তোমার সাথে মেলা মেশা করি।

সেলিম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তা তোমার আত্মীয় স্বজন যদি তাই চায়, তবে তাই হোক। কিন্তু ওরা কি জানে  তোমার আমার সম্পর্ক বড় ভাই আর ছোট বোনের মত।

ওটা বোঝার মত এতটা উদার মন ওদের নেই।

তাহলে নীলা কে বল কি সম্পর্ক তোমার আর আমার মাঝে।

কোন ইচ্ছা আমার নেই ওকে বলা। তার চেয়ে তুমি আর কোনদিন আমাকে কল এবং কোন রকম কন্টাক্ট করবে না।

তা হলে তো তুমি ওদের টাই মেনে নিলে। ওদের সন্দেহ টাকে ঠিক বলে প্রমান করে দিলে। এটা কি ঠিক করলে। এই বলে সেলিম চুপ করে রইল।

সেলিমের সাথে শ্যামলীর দেখা হয়েছিল এক বিয়ের আসরে। সেলিমের বন্ধুর ছেলের সাথে শ্যামলীর বোনের মেয়ে। শ্যামলীরা তিন বোন। শ্যামলীর বিয়ে হয়েছিল । এক ছেলে। আজ সে একাই।

বন্ধুই ডেকে এনে বসিয়ে ছিল ওদের টেবিলে। শ্যামলীর পাশেই। আড়ষ্ট তা কাটিয়ে উঠে সেলিম জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার নাম টা জানতে পারি কি? বলে কাঁটা চামচ দিয়ে কয়েকটা লেটুস পাতা উঠিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।

আমার নাম শ্যামলী। আপনি যদি মতীন ভাইয়ের বন্ধু হন, তবে আমার আর আপনার মাঝে বয়সের ব্যবধান বিশ বছরের কম হবে না। কাজেই আপনি আমাকে তুমি বলেই বলবেন।

শ্যামলীর চেহারা টা বাচ্চা সুলভ। কাজেই বয়স টা অনায়সে লুকিয়ে ফেলা যায়। সেলিমের হিসেব অনুসারে চল্লিশের কিছু উপরে। ওকে দেখে সেলিমের মনে পড়লো ওর ছোট বোন লতার কথা। বোনটা ছিল সেলিমের নেওটা। দাদা  দাদা বলে দাদার পিছনে ঘুরে বেড়াত। কোন কিছু চাইলে না বলতে পারতো না সেলিম।

মা বাবা দুজনেই বলত, বড় আস্কারা দিচ্ছিস তুই ওকে।

সেলিম বলত, এটুক তো ওর প্রাপ্য। পরের ঘরে গেলে ওটা হয়তো নাও পেতে পারে।

পরের ঘরে ওর আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। সেলিম যখন লন্ডনে তখন একদিন খবর এসেছিল, ওর আদরের বোন টা নেই।

কি এক রোগে সে চলে গেছে। কেউ বলে মেনীনযাইটিস, কেউ বলে অন্য কিছু। ডাক্তারেরাও বলতে পারে না।

আজ শ্যামলী কে দেখে সেলিমের লতার কথা মনে হোল। ও আজ বেচে থাকলে শ্যামলীর মতন ই হতো।

আমি ড্রিঙ্কস আনতে যাবো, কারো কেছু লাগবে? বলে সেলিম উঠতেই শ্যামলী বলল, চলুন আমিও যাবো।

দুজনে এসে দাঁড়িয়েছিল ড্রিঙ্কসের কাউন্টারে।

কি নেবে তুমি?

পীনাকোলাডা। আপনি?

জীঞ্জারেল। একটা কথা বলি।

বলেন।

যদিও প্রথম দেখা তবুও বলি, তোমার মতো আমার একটা ছোট বোন ছিল, সে আমাকে তুমি বলে বলত।

বুজেছি। ঠিক আছে।

পার্টি শেষে সেলিম বিদায় নেবার কালে শ্যামলী বলেছিল, তোমার ফোন নাম্বার টা আর ফেবুকে কি নামে আছো নিতে পারি কি সেলিম ভাই?

ওটা যখন Unlisted নয় তখন না দাওয়াটা ভদ্রতার পর্যায়ে পড়বে বলে মনে হয় না। আর ফেসবুক তো সোশ্যাল মিডিয়া।

ফোন নাম্বার আদান প্রদানের পরে সবাইকে শুভ রাত্রি জানিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল সেলিম।

বেশ কিছুদিন গত হয়েছে। হঠাৎই বন্ধু আকরামের ডাকে এসেছিল Calgary থেকে। অনেকদিন থেকেই বলছিল, একবার ঘুরে যা এখান থেকে, ভাল লাগবে।

আকরাম কলেজ কালের বন্ধু। সিভিল ইনজিনিইয়ারিং এ পাশ করে ক্যানাডা তে চলে এসেছিল। তাও অনেক দিন আগে।

যোগাযোগ ছিল না। একদিন ফাসবুকের people you know খুজতে যেয়ে একটা ফটোর মাঝে আটকিয়ে গেলো সেলিম।

অনেকক্ষণ দেখার পর মনে হোল এতো আকরাম। এক কালে দহরম মহরম ছিল। জীবনের ব্যস্ততার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল।

ফেসবুকের মাধ্যমেই ফিরে পেয়েছিল আকরাম কে।

সকালে আকরামের বৌ মলিনার মচমচে ভাজা পরোটা আর সুজির হালুয়া দিয়ে নাস্তা টা ভালই লাগছিল। সেই সাথে বাহিরে ঝলমলে রৌদ।

কি সেলিম ভাই, হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন? আর একটা পরোটা উঠান। বলে মলিনা উঠিয়ে দিতে গেলে সেলিম বলে উঠল,

পাগল। একটাই যথেষ্ট।

আকরাম টিপ্পনী করে বললও, দেখছ না শরীর টা। আমার মত ভুঁড়িটা ও বানাতে পারেনি এই খাওয়া কনট্রোলের জন্য।

এবার কাউকে আনেন ঘরে। বলে মলিনা তাকাল সেলিমের দিকে।

সকাল টা মাটি করো নাতো? বলে উঠল আকরাম।

ঠিক সেই সময় সেলিমের ফোনটা বেজে উঠল।

শ্যামলীর ফোন।

খুব ঘুরে বেড়াচ্ছ, তোমার সুন্দর সুন্দর ছবি দেখলাম। আমাকে নিলে না কেন? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে ঐ জাগা  গুলো।

বেশ তো, পরের বার যেদিকে যাবো নিয়ে যাবো তোমাকে।

কথা দিলে কিন্তু।

কথা দিলাম।

টুকি টাকি কথা শেষ করে রেখে দিতেই আকরাম জিজ্ঞাসা করেছিল, কে?

তুই তো লতাকে চিনতি, ওরই মতো আর একজন।

দুই দিন বাদে ফিরে এসে শ্যামলী কে কল করেছিল সেলিম। গলার স্বর নিচের দিকে।

কি হয়েছে?

বাসার ছাদ দিয়ে পানি পড়ছে। সাল কে খবর দিয়েছি। গাড়ী টায় ইঞ্জিন চেক সাইন দিচ্ছে। ছেলেটার বাস্কেট বল প্রাকটিস আছে। ভীষণ ডিপপ্রেস লাগছে।

শোন গাড়ীটা আমার এখানে রেখে আমার গাড়ী নিয়ে যাও। ওটার ব্যবস্থা আমি করব।

শ্যামলী আধো আধো কান্না গলায় বললও, তুমি ছাড়া তো আমার কোন পথ আছে বলে মনে হয় না। এক মাত্র তোমার সাথেই আমি মন খুলে কথা বলতে পারি। আমার কোন বড় ভাই নেই । দুলাভাই আমাকে খুব ভালবাসত। সে চলে যাওয়ার পরে এই প্রথম আমি তোমার কাছ থেকে সেই কেয়ারীং আর বড় ভাই এর ভালবাসাটা পেলাম।

শ্যামলী থাকে ছোট্ট একটা নিজেস্ব বাসায়। সিঙ্গেল মা। অনেক কষ্ট করে ছেলে টাকে মানুষ করছে। সেলিম একদিন বলেছিল, আচ্ছা শ্যামলী, কাউকে খুজে পাওয়ার চেষ্টা করছ কি?

করেছিলাম। কিন্তু তোমার সাথে তুলনা করলে আর এগোতে পারিনা। ওদের মাঝে তোমার মতো উদারতা নেই।

ভুল করলে। এসব ব্যপারে কারো সাথে তুলনা করতে নেই। একেক জনের একেকটা নিজেস্ব সত্ত্বা আছে। শুধু দেখবে সে তোমাকে আর তোমার ছেলে টাকে প্রাধান্য দেয় কিনা।

আচ্ছা সেলিম ভাই এতো সব জানো কি করে? তুমি তো একলা। কোনদিন তোমাকে জিজ্ঞাসা করিনি, একলা কেনও?

একলা ছিলাম না। যা চেয়েছিলাম, তা পেয়েও ছিলাম। কিন্তু গাঁটছড়া আর বাঁধা হয়ে উঠেনি। ঘোরাঘুরি করেছি দুজনে অনেক বছর।

তারপর?

তারপর একদিন আমার মোটরসাইকেলের পিছনে ওকে নিয়ে চলতে যেয়ে একটা বাস এসে ধাক্কা দিয়েছিল। ছিটকে যেয়ে পড়েছিলাম দুরে। মোটরসাইকেল টা চুরমার হয়ে গেলো। সেই সাথে সেও চলে গেলো। অনেক দিন লেগেছিল সুস্থ হয়ে উঠতে। এরপর আর ও পথে পা বাড়াইনি।

সরি, সেলিম ভাই।

এই ভাবে চলতে যেয়ে সেলিম পেয়েছিল হারিয়ে যাওয়া লতা কে ওর মাঝে। তাইতো একদিন কল করে বলেছিল,

নতুন মুভি এসেছে শারুখহ খানের, যাবে দেখতে?

দুজনে এসে হলে ঢোকার আগেই দেখা হোল শ্যামলীর ছোট বোনের বান্ধবী নীলুফারের সাথে। আড় চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করে এগিয়ে গেলো হলের দিকে।

নীলুফার কি জানিয়ে ছিল শ্যামলীর বোন কে সেলিমের তা জানা নেই। সেই সুত্র ধরেই আজকের এই বজ্রপাত।

সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলো শুধু মানুষের মনের সংকীর্ণতার জন্য। সেলিম চেষ্টা করেছিল শ্যামলীর সাথে যোগাযোগ করার। বলতে চেয়েছিল, ওদের কথাকে প্রশ্রয় দিওনা। সংকীর্ণ মনের লোকের সংখ্যাই বেশি।

নিজের মনকে তুমি চেনও। নিজের মনকে প্রশ্ন করো। ওদের কে বলও তোমরা যা ভাবো তা নয়। সুন্দর মনের মানুষ হও।

এই কথা গুলো সেলিমের আর বলা হয়ে উঠেনি।

তাই ছোট্ট একটা কাগজে লিখে ছিল,

যদি কোনদিন দেখা না হয়, তবে ভাল থেকো। সুন্দর মনের কাউকে নিয়ে সামনের পথ টা পেড়িয়ে যেও। আমার আশীর্বাদ রইল।

Continue Reading

তনয়া তুমি

যেখানে তনয়া আর আমার শেষ দেখা হয়েছিল, সেই খানে আমি আবার ফিরে এসেছিলাম তিন মাস পর। কথা আমি দিয়েছিলাম, কথা আমি রেখেছি।
বলতে গেলে ডেভিডই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, অন্য মনস্ক ভাবে কাজ করলে, এই ফার্ম তোমাকে রাখবে না। ডেভিড আমার কলীগ। একি জাগায় কাজ করি। তনয়ার কথা তাকে বলেছিলাম।
শুনে বলেছিল, এতদিনে তোমার হৃদয়ে ঝর্নার জল ধারা বইতে শুরু করেছে মনে হচ্ছে। এ স্বপ্ন নয়তো।
বলেছিলাম মনে তো হচ্ছে না। তবে –
তবে মানে?
মানে প্রেম শব্দ টা কোনদিনই আমার ডিকশনারিতে ছিল না। ওটা আমার কাছে সবসময়ে মনে হয়েছে সময়ের অপব্যবহার।
ছোট ছোট কথা বলা, এঁকে অপরেরে দিকে তাকিয়ে থাকা, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বিদায়ের পর্ব। এসবের কোন মানে ছিল না আমার কাছে যদিনা দেখা হতো তনয়ার সাথে।
দেখেছো কি সরুসরু আঙ্গুলের নখের উপরে ট্রান্সলুসেন্ট নেল পলিসের প্রলেপ। দেখেছো কি ভিজে ভিজে ঠোটের পরে লালের আভা।
রাখ তোমার কাব্য। কথা হয়েছে কি?
বলেছিলাম, না, ঐ চিরকুট টা আমি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু তাই নয় আমার ফোন নাম্বার টা তাকে দেওয়া হয়নি।
তাহলে তো সব কর্মের অবসান এইখানে। বলি কি ঐ যে দেখছ মিস ললিতা, যার দুর্বলতা আছে তোমার উপর, তাকে তনয়া মনে করতে আপত্তি কি?
ওর মাঝে আমি দেখতে পাইনা তনয়ার চোখের গভীরতা। শুনতে পাইনা আমার ভাষায় গুনগুণ করে মধুর স্বরে গাওয়া গান গুলো।
তা তোমাকে টেগোরের গান না শুনিয়ে যদি সেক্সপীয়ারের মাকবেথ আবৃতি করে তাতে দোষ কি?
দোষের কিছু নয়। ওর সাথে আমি দুই এক বার যে বের হয়নি তা নয়।
অবাক হয়ে ডেভিড কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। বের হয়েছিলে? কবে? আমাকে তো বলোনি?
বলার মতো কিছু ঘটে নি, তাই।
ব্যাখ্যা কর?
একদিন কাজের শেষে ললিতা এসে বলেছিল, খুব তাড়া আছে কি তোমার?
বললাম, না, কেনও বলতো?
তাহলে একসাথে কোথাও বসে বিকেল টা উপভোগ করতাম।
বললাম, কোন স্পট তোমার জানা আছে কি? মনে মনে ভাবছিলাম উল্টো টা হওয়ারই তো কথা? ছেলেরাই তো প্রস্তাব দেয়।
যাক, ঐ ভাবনা বাদ দিয়ে এসে বসলাম দুই ব্লক দুরে স্টারবাকসে।
ও অর্ডার দিলো Ice coffee with milk, আমি নিলাম টল কফি।
নিতান্তই সাদা মাটা কথা দিয়ে শুরু। বললও, আগে ছিল ক্লিভল্যান্ডে, মন টেকে নি। এখানেও বন্ধু বান্ধবী খুব একটা কেও নেই। কাজের পরে সময় কাটতে চায় না। আমিও কি একা? প্রশ্ন করেছিল সে।
একা শুনে বলেছিল তাহলেই কি আমরা এঁকে অপরের সান্নিধ্যে সময় কাটাতে পারিনা?
তোমার উত্তর? ডেভিডের প্রশ্ন।
তুমি তো জানো। অনেক না হলেও বেশ কিছু বান্ধবী আমার আছে। তাড়া শুধু বান্ধবীই। এর বেশি নয়। কিন্তু সেদিন ললিতার চোখে আমি শুধু বন্ধু নই, অন্য কিছুর আভাস আমি পেয়েছিলাম। তাই আমি ওর দ্বিতীয় দিনের প্রস্তাব রাখতে পারিনি।
তাহলে আমি কি মনে করবো তুমি মানে তুমি—
বুজেছি কি বলতে চাইছ। না, আমি তা নই। তনয়া কি তাহলে আমাকে আকৃষ্ট করতো?
তা হলে এখন কি করবে?
উপায় আছে,
কি?
জানো সেদিন ও ড্রাইভার কে বলেছিল ঠিকানাটা, ওটা আমার মনে আছে।
তাহলে তো সোনায় সোহাগা। আর দেরী কেনও।

এই মুহূর্তে আমি এয়ারপোর্টে। ট্যাক্সি ওয়ালাকে বললাম ঠিকানা টা।
সে বললও, যাবে তবে দশ ইউরো বেশি লাগবে। শহরের বাহিরে কিনা?

শহরের বাহিরে, হট্টগোল নেই, পরিপাটি, ছিমছাম। তনয়ার মত। আমার মনটা উচ্ছলতায় ভরে উঠলো। হঠাৎ করে দেখবে যখন, কি ভাববে সে? এখন সকাল আটটা। কাজে যাই নি? হয়তো গোসলে। হয়তো বা গোসল সেরে ভিজে চুল এলিয়ে দিয়েছে খোলা পিঠের পরে। হয়তোবা চোখের কোনের শেষ তুলীর টান টা শেষ করলো সে। হয়তো গুনগুণ করে গাইছে,
“ তোমার হোল শুরু, আমার হোল সারা”।
না এ গান নয়। সবে তো শুরু।

স্যার এসে গেছি। ড্রাইভেরের কথায় ফিরে এলাম আমার কল্পনার জগত থেকে। ছোট একতালা বাড়ী। চারিদিকের পরিবেশ আমার মনের মাঝে আকা পরিবেশের সাথে মিল নেই।
নেমে এলাম। সাথে আছে একটা ব্যাগপ্যাক।
দরজায় কড়া নাড়াতেই খুলে দাঁড়াল এক মহিলা। ভাবলাম ভুল ঠিকানা শুনেছিলাম সেদিন আমি।
সরি, এই ঠিকানা নয়। বলে এক পা পেছতেই মহিলা বলল, কাকে চান?
নাম বলতে, বলল এই নামে তো এখানে কেউ থাকে না।
হঠাৎ ই মনে পড়লো সেলফী তুলে ছিলাম লীসবন এয়ারপোর্টে।
ফটো টা দেখাতেই বলল, ও টিয়ারা?
টিয়ারা? ভাবলাম তনয়া হয়ে গেছে টিয়ারা।
সে তো আমার রুমমেট ছিল। মাস খানেক হোল চলে গেছে এখান থেকে। কতো দিনের পরিচয়?
সে কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিকানা টা দিতে পারবে?
ঠিকানা দিতে নিষেধ করে দিয়াছে।
ফোন নাম্বার টা। নাকি সেটাও দেওয়া নিষেধ?
হাঁ। তবে যেখানে কাজ করে সেখান কার ঠিকানা দিতে পারি।
তবে তাই দাও। বলতেই মহিলা ভিতরে চলে গেলো।
ঠিকানাটা হাতে দিয়ে বলল, এই নাও। তুমি কি ওর ক্লাইণ্ট?
মানে?
মানে ওর কাজের সাথে তুমি জড়িত কিনা।
না জড়িত নই, বলে ধন্যবাদ দিয়ে পিছন ফিরতেই। মহিলা বলল, এখন ওর কাজের জাগায় গেলে ওকে পাবে না। রাতে যেও।
রাতে কেনও? ওর অফিস কি রাতেও খোলা থাকে?
হাঁ। নতুন কাজ নিয়েছে নাইট শিফটে। কোন হোটেলে উঠেছেন?
এখনো হোটেলে উঠিনি?
ভাল একটা হোটেলের নাম দিতে পারি। ওখানে উঠে এই ঠিকানা দেখালে ওরা সব ব্যবস্থা করে দেবে।

ট্যাক্সি টা তখনো দাড়িয়ে ছিল। বললাম, চলো এই ঠিকানায়।

স্বপ্নের পর্দা টা হঠাৎ করেই সরে গেলো। আর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করছে না। স্বপ্নের বেড়াজাল ছিড়ে মনে হচ্ছে কখন আসবে সন্ধ্যা। দেখা হবে? চমকে উঠবে?
কেন সে রাতের চাকরি নিলো? দিনে কাজের চাপ বেশি। হয়তো বা তাই।

ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, জানিনা। হঠাৎ ই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আলো ঝলমল প্যারিসে সন্ধ্যা বোঝা দায়।
ঘড়িতে দেখি রাত আটটা।
নেমে এলাম। কাউন্টারে ঠিকানা টা দেখাতেই লোকটা তাকালও আমার দিকে। বলল, আপনি রুমে যান আমি সব ব্যবস্থা করছি।
What do you mean? কি ব্যবস্থা করবে? এটাতো একটা অফিসের ঠিকানা?
না, এটা একটা Escort Service এর ঠিকানা। আপনার যদি particular কোন পছন্দ থাকে বলতে পারেন, তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চাঁছা ছোলা কথা।
হঠাৎ মনে হোল দেখিই না খেলা করে। এ খেলার শেষ কোথায়।
বললাম টিয়ারা, টিয়ারা কে চাই।

এলাম আমার রুমে। হৃদপিণ্ডের শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। ওটা কাঁপছে।
এক দুই তিন করে এক ঘণ্টা কেটে গেলো। আমি জানি এই চিন্তা আমার ভুল। এ হতে পারে না। এ হবে না।
এমনি সময় টুক টুক, দুটো টোকা।
আমি এগিয়ে যেয়ে দু পা পিছিয়ে এলাম দরজা থেকে।
আবারও টুক টুক টুক।
দরজা খুললাম।
সামনে দাঁড়ান যে তার পরনে কচি কলাপাতা রঙের লো কাট ব্লাউজ, কালো স্কারট। হাত খোপা বাঁধা চুল। কাজল টানা চোখ টা দেখে মনে হোল অনেক আগে দেখাছিলাম। সেই চোখ, সেই চিকন ভুরু। শুধু হাসি টা নেই।
শুদ্ধ ভাষায় শুধু একটা কথা সে বলল,
তুমি?

Continue Reading

ছোট্ট একটা পার্স

ছোট্ট একটা পার্স। আমার না। উনার। উনার নাম তনয়া। তনয়ার সাথে দেখা না হলে আজ খাতা কলম নিয়ে না বসলেও চলতো। কিন্তু না। বসতে হোল কারন ঐ পার্সটা আমাকে অনেক ভোগান্তি দিয়াছিল। সেই সাথে দিয়েছিল তার সান্নিধ্যতা, অন্য আরও কিছু।

আমি তনয়ার শুদ্ধ বাংলা কথায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। না বলতে পারিনি যখন  সে বলেছিল এই বিদেশ বিভুয়ে আপনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। এই সমস্যার সমাধান আমি একলা করতে পারবনা। আমার ভয় হচ্ছে। ঐ পার্সটা আমার ভীষণ দরকার।  অল্পক্ষনের পরিচয়ে মনে হচ্ছে আপনি আমার অনেক কাছের। তাই তো আপনাকে আমি অনুরোধ করছি, আপনি আমার সাথে থাকুন। প্লীজ।

ঘটনা টা আরম্ভ হয়েছিল ঠিক এই ভাবেঃ

রোমে কয়েকটা দিন কাটিয়ে এসে পৌছালাম লীসবনে। সেখান থেকে আমার গন্তব্যস্থল প্যারিস। সকাল এগারটায় আমার ফ্লাইট। যথারীতি হাতে বেশ কিছু সময় নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌছালাম। গেটের কাছে বসে আছি। আধা ঘণ্টা বাকি প্লেন ছাড়বার। কিন্তু তখনো বোর্ডিং এর জন্য না ডাকাতে বুঝলাম সময় মতো যাওয়া হবে না। যাহা চিন্তা তাহাই বাস্তব ।

এনাউন্স করলো প্লেন এক ঘণ্টা লেট। অগত্যা না শেষ করা উপন্যাস টা খুলে বসলাম। দুপাতা উল্টাতেই, শুদ্ধ বাংলায়, আপনি বাঙালি,কথাটা শুনে ফিরে তাকালাম।

 উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, কাঁটা কাঁটা চেহারা, লাল ব্লাউজের সাথে কালো ট্রাউযার, গলায় সাদা পার্লের মালা, কাঁধে ঝোলান ছোট্ট একটা পার্স। চোখ সড়াতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। সেটা আমার দোষ নয়, দোষ ঐ সুন্দর চেহারার। নিখুঁত ভাবে বানিয়ে পাঠানো হয়েছে এই দরাধামে।

পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, বসতে পারি?

নিশ্চয়?

কার লেখা বই?

জিজ্ঞাসা করতেই উপরের কাভার টা দেখালাম।

প্রিয় লেখক বুঝি? আমারও।

এই বলে লেখকের আরও কতগুলো বইএর কথা বলতেই বুঝলাম কথা চালাতে অসুবিধা হবে না।

 জিজ্ঞাসা করলাম, এই লীসবনের মাটিতে কতদিন। উত্তরে বললও, এসেছিলাম মাদ্রিদে বান্ধবীর বাসাতে। সেখান থেকে লীসবন। তিনদিন কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছি প্যারিসে।

দেখুন তো, আমার নাম টাই বলা হলনা। আমি তনয়া।

হ্যান্ডসেক করে আমি আমার নাম বললাম।

একলা বুঝি?

পাশে যখন কেউ নেই, তখন তো একলাই বলতে হবে। এই মুহূর্তে আপনি আছেন। কথাটা বলে ভাবলাম বলাটা কি ঠিক হোল?

একটু হেসে বললও, আমিও আপনারই মতো। এই ক্ষণে আমি আর আপনি। আপনি আর আমি।

সেইক্ষণে ওর ডান গালের টোলটা আমার চোখে পড়ল।

এতো সহজ ভাবে তনয়া  কথা গুলো বলল যে মনে হোল ওর সাথে আমার পরিচয় আজকের নয়।

এনাউন্সমেন্ট কানে এলো। বোর্ডিং শুরু হতে যাচ্ছে।

তনয়া তার নিখুঁত ভাবে সাঁজা চোখ দুটো দিয়ে তাকাল আমার দিকে,” আপনার সীট নাম্বার কতো?”

দেখালাম।

উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলো, ভবিতব্য।

আচমকা উচ্চকণ্ঠে ভবিতব্য বলে উঠাতে আমি চারিদিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার?

আমরা সীট টা ঠিক আপনার পাশেই, গল্প করতে করতে সময়টা পার করে দেয়া যাবে।

শুনে আমি যে আনন্দিত হয়নি তা নয়, তবে তার প্রকাশ বাহিরে না দেখিয়ে বললাম, দুই থেকে তিন ঘণ্টার গল্পের খোরাক আছে কি?

আমার আছে। তবে আপনি যদি আমার সান্নিধ্যে বিরক্ত বোধ করেন তাহলে আমার বলার কিছু নেই। আমি কিন্তু আপনার সান্নিধ্য ভীষণ ভাবে উপভোগ করছি। এই যাত্রা তিন ঘণ্টা না হয়ে যদি পাঁচ ঘণ্টা হতো তাহলে অনেক কথা বলা হতো যা কখনো—-।

কথা শেষে হওয়ার আগেই কাউন্টারের মেয়ে টা ডাকদিলো।

ওর কথা গুলো আমার মনে ছন্দ জাগালো, এ যেন তরঙ্গমালা, প্রতিটি শব্দ গুঞ্জরিত হতে থাকলো আমার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।

শেষ কথাটার শেষ কি ভাবে শেষ হতো সেই কথা ভাবতে ভাবতে আমি ও এগিয়ে গেলাম কাউন্টারের দিকে।

প্লেনের মাঝামাঝি অংশে আমাদের সীট। আমার হাতের ছোট্ট সুটকেস টা উপরে উঠিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তার হাতের ব্যাগটা দেবে কিনা।

বলল না ওটা আমার পায়ের কাছেই থাকবে।

বেল্ট টা বেঁধে তাকালাম তনয়ার দিকে। বললাম এবার আপনার কথা শুরু হোক। প্রথম থেকে। এখনো আমাদের পরিচয়ের পর্ব শেষ হয়নি।

কোথা থেকে আরম্ভ করবো বলুন। বলে সে তার কাঁধে ঝোলানো পার্স টা পায়ের কাছে রেখে দিলো।

সেই জন্মস্থান থেকে।

বাড়ী আমার বাংলাদেশের রাজশাহী তে। বাবা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকনমিক্সে ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাশ করাতে একটা অফার পেয়েছিলাম উচ্চশিক্ষারতে লন্ডনে আসার।

 মা আসতে দিতে চায়নি। বাবা রাজি থাকাতে মা আর বাড়ন করেনি।

লন্ডন থেকে প্যারিস?

শিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে এলাম প্যারিসে। তাও অনেক দিন হয়ে গেলো।

দেশে শেষ কবে গিয়েছিলেন।

আর ফিরে যাওয়া হয়নি। মা কেও আমার আর শেষ দেখা হয়নি।

ব্যক্তিগত একটা প্রশ্ন করব যদি কিছু মনে না করেন।

প্রশ্ন শুনে বলল, আপনি কিন্তু দুরেই রয়ে গেলেন। এখনো কাছে আসতে পারলেন না। জানেন রবি ঠাকুরের একটা গান আমার খুব প্রিয়।

কোন টা?

“না চাহিলে যারে পাওয়া
যায়। তেয়াগিলে আসে হাতে
দিবসে সে ধন হারায়েছি

আমি পেয়েছি আঁধারও রাতে”

এখন প্রশ্ন করুন?

ওর এই গানের মানে টা আমি খুজতে চাইছিলাম। কেনও হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথ কে টেনে আনল।

রহ্যসের জাল ওখানে রেখেই বললাম, না মানে, বলছিলাম কি, আপনি কি প্যারিসে একা ?

ও উত্তরের দেওয়ার  আগেই ক্যাপ্টেনের ঘোষণা,

 অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি মেকানিক্যাল প্রবলেমের জন্য আমাদের এই প্লেন উড়তে সক্ষম নয়। আপনাদেরকে অন্য আর একটা প্লেনে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। আপনারা যার যার ল্যাগেজ নিয়ে নেমে আসুন।

তাড়াতাড়ি করে মানতে যেয়ে হোঁচট খেলাম সামনের ভদ্রমহিলার টানা সুটকেসের সাথে। ভদ্রমহিলা কটমট করে চাইল আমার দিকে। দোষটা আমার নয় তার। চলতে চলতে হঠাৎ করে সে দাড়িয়ে পড়েছিল। পিছনে খিলখিল করে হাসতে শুনে তাকিয়ে বললাম, আপনি হাসছেন?

কি করব বলেন, উনি যে ভাবে আপনার দিকে তাকালেন মনে হোল আপনাকে উনি ভস্ম করে দিতে পারে চোখের চাহুনী দিয়ে।

কি মনে হচ্ছে জানেন, ঐ যে বলে, সকালে উঠিয়া এ মুখো দেখিনু দিন যাবে আজি ভাল।

আমার বেলায় হয়েছে উলট। বলতে গেলে, সকালে উঠিয়া যে পেঁচা দেখেছি, দিন আজ ভাল নাহি যাবে।

সে হাসতে হাসতে বলল, তা সে পেঁচাটা কে?

ঐ পেঁচা মার্কা রীসেপ্সনীস্ট।

কথা বলতে বলতে আমরা নেমে এলাম প্লেন থেকে। নিচে বাস অপেক্ষা করছে আমাদের কে নিয়ে অন্য প্লেনের কাছে পৌছে  দেবার জন্য। তনয়া তার হাতের ব্যাগ নিয়ে উঠতে অসুবিধা হওয়াতে আমি আমার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। ও ধরল আমার হাতটা। ওর মসৃন শীতল হাতটা আমার উষ্ণ হাতটাকে শীতল করে দিলো।

ও তাকাল, বলল, আপনার হাতটা গরম, জ্বর আসেনি তো?

  বললাম, না। আমার শরীরের তাপমাত্রা একটু বেশিই থাকে। ওর কথাটা কানে আমার বাজতে থাকলো।

বাস আসে থামল নতুন প্লেনের কাছে। নেমে এলাম। বিরক্ত বোধ করছিলাম কয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে গেলাম পৌছাতে। বন্ধু এসে দাড়িয়ে থাকবে এয়ারপোর্টে। যার যার সীটে এসে বসতেই ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলো, আমাদের প্লেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে যাবে, শুধু মালপত্র উঠার অপেক্ষায়।

আমার কিন্তু বেশ ভালই লাগছে, এক প্লেন থেকে আর এক প্লেন, সাথে আপনি, কথা বলার সাথী, শুধু সাথীই নন, আরও—

আমার পার্স ?

কোন পার্সের কথা বলছেন, যেটা আপনার কাঁধে ঝোলান ছিল ?

হাঁ। কোথায় সেটা?
শেষ আমি দেখেছিলাম আপনার পায়ের কাছে ঐ আগের প্লেনে।

কান্না কান্না স্বরে তনয়া বলল, ওটা যে আমার ভীষণ দরকার। ওর ভিতরে আমার সব দরকারি কাগজ, শুধু তাই নয় আমার কাজের আইডেন্টীফিকেস্ন কার্ড আর চাবি। ওটা যে আমার না হলেই নয়।

ওর কথা শুনে মনে হোল আমিই একমাত্র ব্যাক্তি যে কিনা এটা উদ্ধার করতে পারি। ওর চোখের দিকে চেয়ে মনে হোল এখনি সে কেঁদে ফেলবে।

বললাম দেখি কি করা যায়।

প্লেনের সিঁড়ি তখনো সরিয়ে নেওয়া হয়নি। উঠে যেয়ে প্লেনের ক্রু দের প্রধান কে জানালাম, ওর পার্সের কথা।

সব শুনে সে বলল, দেখি কি করতে পারি।

তনয়ার সেই হাস্যজল চেহারায় মলিনতার ভাব। উৎকণ্ঠা। আমাকেও ভাবিয়ে তুলল।

এক মিনিট দুই মিনিট করে পাঁচ মিনিট কেটে গেলো।

এগিয়ে আসতে দেখলাম সেই ক্রু কে।

পাওয়া গেছে? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো তানয়া।

পাওয়া গেছে, তবে সেটাকে লস্ট এন্ড ফাউন্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওটা নিতে হলে যার পার্স তাকে নেমে যেতে হবে এই প্লেন থেকে। চেক ইন ল্যাগেজ গুলো নামিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে টার্মিনালে। পরের ফ্লাইটে চেক ইন করতে হবে নতুন করে। মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

ওর ফ্যাকাসে মুখটার দিকে তাকালাম।

ও আমার দিকে চেয়ে বলল, আপনি থাকুন আমার সাথে, প্লীজ।

ওর কথার মধ্যে কি ছিল জানিনা, আমি রাজি হয়ে গেলাম। মনে হোল আমি যেন কি জয় করতে চলেছি। ওকে ওর সমস্যার থেকে উদ্ধার না করলেই নয়।

ও ছলছল নয়নে বলল, আপনাকে আজ পাঠানো হয়েছিল আমারই জন্য। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।

নেমে এলাম আমরা দুজন। বাস আমাদের কে নিয়ে এলো টার্মিনালে।  যত সহজ মনে হয়েছিল আসলে তা নয়। ক্রু আমাদের কে সঠিক ইনফরমেশন দেয়নি।

লস্ট এন্ড ফাউন্ডে এসে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, এই ধরণের কোন পার্স আমাদের এখানে জমা দেওয়া হয়নি।

তবে যে প্লেন থেকে বলল, এখানে—

কথা শেষ করার আগেই মেয়ে টা গম্ভীর ভাবে রাগন্ত স্বরে বলল, ওরা কি বলেছে জানিনা আমার কম্পিউটারে ওটার হদিস নাই। তোমরা এয়ার লাইন্সের লস্ট এন্ড ফাউন্ডে যেয়ে জিজ্ঞাসা করো।

ওটা কোথায়।

টার্মিনালের বাহিরে।

তাহলে তো আমাদের কে আবার নতুন করে ইমিগ্রেশন করে ঢুকতে হবে।

হাঁ, আবারও রাগন্ত স্বরে বলল, তাই করতে হবে।

ভয়ে ভয়ে তনয়া জিজ্ঞাসা করল, আর আমাদের ল্যাগেজ?

ওটা পড়ে থাকবে ব্যাগেজ ক্লেমে। নেক্সট যে ফ্লাইটে যাবে সেখানে উঠিয়ে দেওয়া হবে। তবে  তার আগে নেক্সট কোন ফ্লাইটে তোমরা সীট পাবে তার ব্যবস্থা করো যেয়ে।

আমি আপনাকে খুব অসুবিধার মধ্যে ফেললাম, তাই না? কি করে আমি আপনার এই ঋন আমি পরিশোধ করবো। আমি জানি না।

আমি  উদার কণ্ঠে বললাম, সে কথা থাক, চলুন আগে টিকিটের ব্যবস্থা করি। তারপর আবার ফিরে আসবো এই খানে।

আমি  উদার কণ্ঠে বললাম, সে কথা থাক, চলুন আগে টিকিটের ব্যবস্থা করি। তারপর আবার ফিরে আসবো এই খানে। এর মঝে ওদের কম্পিউটারে ওটা এসে যেতেও পারে।

নতুন করে টিকিটের লাইন বড় না হলেও সময় লাগছে অনেকক্ষণ। যারা লাইনে তাদের সবারই সমস্যা। এই লাইন সমস্যার লাইন।

এক ঘণ্টা পেড়িয়ে যাওয়ার পরও খুব বেশি দুর যে এগিয়েছি মনে হোল না।

তনয়ার আবারও বলল, আমার পার্স টা পাবো তো ?

তাতো জানি না তবে এক কাজ করুন, আপনি ফিরে যান আগের সেই লস্ট এন্ড ফাউন্ডে। দেখুন কোন খবর এসেছে কি না।

তনয়া চলে গেলো। আমি হিসেব কষতে বসলাম। লাভ লোকসানের পাল্লায় কোন পাল্লাটা ভারী। মনে হলো ও যেন কি বলতে চাইছে অথচ বলছে না। আবার সব টাই হয়তো আমার তৈরি করা মনের খোরাক।

আমি গুটি গুটি পা করে বেশ কিছুটা এগিয়ে এসেছি। সামনে মাত্র তিনজন। তনয়ার কোথাও চিহ্ন আমি পাচ্ছিনা। অস্থিরতা আমার বেড়েই চলল। এই উটকো ঝামেলা আমি নিজে হাতে তৈরী করেছি। নিজের উপর এই মুহূর্তে রাগ হোল। আমার সামনে এর একজন লোক।

ঠিক সেই মুহূর্তে আমি দেখতে পেলাম তনয়াকে। সে হাসছে। সে দৌড়িয়ে আসছে। কাঁধে তার পার্স।

কি হোল?

পেয়েছি।

তা তো দেখতে পারছি? কি ভাবে।

আর একটা মেয়ে সাহায্য করেছিল। খুব ভাল মেয়ে টা। কোথায় যেন ফোন করল, তারপর বললও আর একটা লস্ট এন্ড ফাউন্ডের জাগা আছে, সেখানে যাও। জাগাটা খুজেতে একটু সময় লেগেছিল তাই দেরী হয়ে গেল। আপনি খুব সুন্দর সাজেসন দিয়েছিলেন। ধন্যবাদ।

আমরা কাউন্টারে এসে গেলাম। বুঝিয়ে বললাম। বলল, পরের ফ্লাইটে সীট আছে তবে দুই ঘণ্টার মধ্যে ছাড়বে। তোমাদের কে বের হয়ে যেয়ে নতুন করে ঢুকতে হবে।

ল্যাগেজ?

জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ওটা ওই ফ্লাইটে চলে যাবে।

দৌড় দিলাম। তনয়ার পায়ে হিলের জুতা।

বললাম, ভ্রমনে বেড়িয়ে এই জুতা কি মানায়।

ফিরে যাচ্ছি, তাই পড়েছিলাম। বলে হাসল।

বাহ এখন তো বেশ হাসি আসছে। আবারও হাসল সে

ইমিগ্রাসনের লাইন দেখে আতকীয়ে উঠলাম। হাতে আছে এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট।

তনয়া তার হাত ঘড়িটা দেখল। তাকাল আমার দিকে।

পারবো কি যেতে? এর পরে তো আবার সীকুরিটি চেক আছে। বলে আবারও দেখল ঘড়িটা।

বললাম, ওপরওয়ালা কে ডাকা ছাড়া এর কোন উপায় আছে বলেত মনে হচ্ছেনা।

বাঁধা বিঘ্ন পেড়িয়ে অবশেষে প্লেনের ভিতরে এলাম। শরীর টা এলিয়ে দিলাম সীটে। ভীষণ ক্লান্ত আমি, তনয়া উভয়ে।

কিন্তু সামনে যে আরও কিছু অপেক্ষা করছে তা তো জানা ছিলনা। সে কথা আসবে পরে।

তনয়াকে বললাম আর নয়। এবার চোখ বন্ধ। ঘুম।
না। আমার কথা তো এখনো শেষ হয়নি।

শেষ হয়নি। আমি দু চোখ মেলে জিজ্ঞাসা করলাম।

এর মাঝে ড্রিঙ্কস আর স্যান্ডউইচ দিয়ে গেলো।

ড্রিঙ্কসে চুমুক দিয়ে বললও, আমি কিন্তু আমার সব কিছুই বলেছি, আপনার কিছুই আমি জানিনা।

আপনার শেষ গন্তব্য স্থান, ভ্রমনের পরে কি করবেন, বলবেন কি?

বললাম, থাকি স্টেটসে, কাজ করি একটা ল ফার্মে। ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলাম এক মাসের ছুটিতে। ফিরে যেয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ব কাজ নিয়ে।

শুধু কাজ নিয়ে? আর কিছু নিয়ে নয়। বলে তনয়া আমার চোখের থেকে দৃষ্টি সরাল না।

ও কি বলতে চাইছে আমার বুঝতে বাকি রইল না। মনে হোল এই মরীচিকার পিছনে না ছোটাই ভাল। বললাম, না আর কিছু নেই। শুধু আমি।

ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। জানালার দিয়ে তাকিয়ে রইল দুরে ভেসে যাওয়া মেঘ গুলোর দিকে। কিছুটা রোদের আভা জানালা দিয়ে ওর মুখে এসে পড়েছিল। মনে হোল আমি যদি তুলি দিয়ে আঁকতে পারতাম, তাহলে এই মুহূর্তে এক অসাধরন ছবির জন্ম হতো।

নাহ, মনের এই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। আর কয়েক ঘণ্টা পরে হবে ওর সাথে আমার শেষ দেখা। তাই হোক।

ও মুখটা ফিরিয়ে নিলো জানালা থেকে। বলল, আচ্ছা আমাদের কি আর কখন দেখা হতে পারে না। আপনার কি ইচ্ছে করে আবার আপনার সাথে আমার দেখা হোক।

আপনার করে কি?

করে। ইচ্ছে করে আবার দেখা হোক। আপনার উত্তর আমি পাইনি। বলে তাকাল।

ওর চোখের ভাষা আমার বুঝতে বাকি রইল না। তবু সোজা ভাবে উত্তর না দিয়ে বললাম। পৃথিবী টা খুব ছোট, আর গোল। কাজেই দেখা হবে বৈকি?

ক্যাপ্টেনের কথা ভেসে এলো। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই প্যারিসে অবতরন করব। আপনারা যার যার সীট বেল্ট বেঁধে নিন।

তনয়া তার পার্স টা দেখে নিলো।

আমাদের ল্যাগেজ আসবে পাঁচ নম্বর Corousel এ। যথারীতি প্লেন ল্যান্ড করলো। আমরা নেমে এলাম। আবারও সেই

ইমিগ্রাসনে। আবারও সেই ভিড়। তনয়াকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আমিও ক্লান্ত।

সব শেষ করে বের হতে আধা ঘণ্টার উপর হয়ে গেলো। Corousel এর কাছে এসে দেখলাম আমদের প্লেনের মালপত্র এসে গেছে। দুই একটা সুটকেস পরে আছে। আমাদের টা নেই।

হায়রে কপাল।

“ আর কত দুরে নিয়ে যাবে হে সুন্দরী—“ তনয়া গুনগুণ করে বলে উঠল।

আপনার এখনও কবিতা আসছে।

কেন আসবে না। সমস্ত ভোগান্তি টা হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছি।

ভোগান্তি, সামনে আরও কতো ভোগান্তি আছে সেটা ভাবতে যেয়ে মনে হোল, ভোগান্তি ছিল বলেই যে মিষ্টতা আমি পেলাম তার পরিমাণ তোঁ কম নয়। তনয়ার সান্নিধ্য আমাকে আনন্দ দিয়েছে। বৃষ্টির শেষেই তো রোদ আসে।

এসে দাঁড়ালাম আবারও সেই লস্ট এন্ড ফাউন্ডে। সব কিছু বলতেই ভদ্রলোক তার কম্পিউটারে কি যেন দেখল।

বলল, কোণটা শুনতে চাও আগে, ভাল টা না মন্দটা?

এতো রাতে রসিকতা ভাল লাগছিল না। তবুও রাগের প্রকাশ না করে বললাম, সুখবর আগে দাও।

সে বলল, তোমাদের সুটকেস আসছে।

আসছে? আসছে মানে? তনয়ার বিস্ময়।

আসছে মানে, সুটকেস গুলো আসবে নেক্সট ফ্লাইটে। এবং সেটা আসবে আরও দেড় ঘণ্টা পরে।

রাত তখন এগারটা। ল্যাগেজ নিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম বাইরে।

দুজনে তাকালাম দুজনের দিকে।

জিজ্ঞাসা করলাম কেউ নিতে আসবে কি?

বলল, না আসবে না, আমি একা। আমার কি মনে হচ্ছে জানেন।

বলেন।

এ যেন সেই “ Solva Saal” মুভি। সকাল থেকে রাত আমরা কাটিয়ে দিলাম এক সাথে। আর কি দেখা হবে না আমাদের?

হবে, তিন মাস পরে আবার আমি আসব এই খানে। কথা দিলাম।

এই চিরকুট তে আমার ফোন নম্বার। ট্যাক্সিতে যেয়ে খুলবেন, তার আগে নয়। এই বলে সে ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে গেলো, পিছন ফিরে তাকাল, বলল, তিন মাস পরে দেখা হবে। কথা দিয়েছেন।

ওর ট্যাক্সির আলো মিলিয়ে গেলো দুরে।

আমার ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। চিরকুট টা খুললাম।

ফোন নাম্বার, নিচে লেখাঃ

“তুমি না হয় রহীতে কাছে

,কিছুখন আরও না হয় রহীতে কাছে,

 আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে।—“

Continue Reading

ফীদেল

   নিত্য দিনের মত আজও সকালে ম্যাকডোনাল্ডে এলাম নাস্তা করবো বলে। লাইনে আমার সামনে এক বয়স্ক মহিলা।

কি কি যেন অর্ডার দিতেই কাউন্টারের মেয়ে টা ডলার পরিমাণ টা জানালো। মহিলা তার পার্স এবং জ্যাকেটের

সবগুলো পকেট খুজে ডলার গুলো মেয়েটার সামনে রাখতেই সে বলল, আরও এক ডলার লাগবে। মহিলা তাকালও মেয়েটার দিকে। বলল, তাহলে হাসব্রাউন টা উঠিয়ে নাও, ওটা আজ আর খাবো না।

আমি পিছনে থাকাতে সব কথাবার্তাই আমার কানে আসছিলো। উদারতা দেখানো আমার চরিত্রে আছে বলে মনে হয় না।

কেনও সেদিন সেই মনভাব আমার মাঝে এসেছিল আমি জানি না।

একটু এগিয়ে যেয়ে বললাম, বাকি পয়সাটা যদি আমি দিয়ে দেই আপনি কি কিছু মনে করবেন।

মহিলা তাকালও আমার দিকে, বলল, না। একদিন হাসব্রাউন নাই বা খেলাম।

না, বলার মাঝে আমি দেখতে পেলাম তার ব্যাত্তিত্ব।

ধন্যবাদ দিয়ে সে তার ট্রে টা নিয়ে চলে গেলো।

আমি নাস্তাটা নিয়ে আমার নিদির্স্ট জায়গায় যেয়ে বসলাম।

বাহিরে চলমান গাড়ী দেখতে আমার ভাল লাগে। পাশের স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হৈ হৈ করে রাস্তা দিয়ে চলছে দেখলে আমার ছোট বেলার কথা মনে পরে। আজ তার সাথে যোগ দিয়েছে ঝিরি ঝিরি বরফের কনা।

বসতে পারি?

চোখ তুলে চাইলাম। সেই মহিলা। মনে হোল বয়স সত্তর পেরিয়েছে।

বললাম অবশ্যই।

হাতের লাঠিটা পাশে রেখে বসল সে। চোখে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। কোন ভূমিকা না করে জিজ্ঞাসা করল, আজ তারিখ টা কত?

বললাম, ১৯ শে জানুয়ারি।

দশ বছর আগে এইদিনে আমার নাতিকে ওরা গুলি করে মেরেছিল। বেচে থাকলে আমার নাতি আজ ২৬ বছরের যুবক হতো। বলে চোখ টা মুছে নিলো হাতের নাপকীন টা দিয়ে।

হঠাৎ ভূমিকা ছাড়াই গল্পের আবির্ভাবে আমি একটু অবাকই হলাম। তবুও বললাম, এতো কম বয়সে কে, কারা মারলও ওকে?

তাহলে বলি, আমার বুকটাকে একটু হাল্কা করতে চাই। এই দিনটা এলে আমি অস্থির হয়ে যাই। তোমাকে আমি চিনি না জানি না, তবুও মনে হচ্ছে তুমি অনেক আপন। শুনবে আমার কথা?

কথা গুলো বলে আমার দিকে তাকাল সে।

ওর চোখের চাহুনীতে মনে হোল সে যেন দুরে কোথাও কি যেন খুজছে। বললাম, বলও তোমার নাতির কাহিনী?

গরীব হলেও আমি আমার স্বামী ভালভাবেই জীবন যাপন করছিলাম আমাদের দেশে।

কোন দেশ?

জিজ্ঞাসা করতেই বলল, নাই বা শুনলে দেশের নাম।

ঠিক আছে, বলও।

ও কাজ করতো এক কারখানায়। ভোর সকালে বেড়িয়ে যেতো, ফিরত রাতে। মেয়েদের কোন কাজ ওখানে ছিল না, তাই আমাকে বাসাতেই থাকতে হতো। ভালই কেটে যাচ্ছিল দিন গুলো।

একদিন ও রাতে কাজ থেকে ফিরতেই বললাম, আমি প্রেগন্যান্ট। ওর খুশি যদি  তুমি দেখতে। বছর ঘুরতেই এক মেয়ে এলো।

সংসারের টানা পোড়নের মাঝেও ওকে মানুষ করতে পেরেছিলাম। তখনকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা  আর আজকের পারিপার্শ্বিক অবস্থার  মাঝে অনেক ব্যবধান। এই বলে দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো।

বললাম, এক কাপ কফি নিয়ে আসি, কি বলেন?

রাজি হোল।

জানো মেয়েটার কপালই খারাপ। লেখাপড়া খুব একটা করেনি। অল্প বয়সে এক ছেলের পাল্লায় পড়েছিল। বলতে পারো বকাটে ছেলে। বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিতে হয়েছিল। কারন ফীদাল তখন পেটে। হতচ্ছাড়া ছেলেটা কাজকর্ম না করে পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানি করে বেড়াতো। আর থাকতো আমার বাসায়। ফীদাল জন্মানোর কয়েক মাস পড়েই বকাটে ছেলেটা যে কোথায় চলে গেলো আর ফিরে এলো না।

লোকে বলে ওকে কেউ খুন করে গুম করে দিয়েছে।

আমার মেয়ে কাজ নিলো এক দোকানে। সকালে যায় রাতে ফেরে। ফিদেলের দেখাশোনার ভার পড়ল আমার উপর।

ফীদেলের যখন বয়স পাঁচ তখন ওর মা ওকে রেখে দিয়ে আর একজনের সাথে ঘর করতে চলে গেলো অনেক দুরের এক গ্রামে। সেই থেকে ফীদেল আমার কাছেই মানুষ হয়ে ছিল।

একটু থেমে কফি তে চুমুক দিয়ে তাকাল বাহিরের দিকে। পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো বরফ পড়ছে বাহিরে। অন্যমনস্ক সে।

আমি চুপ করে রইলাম। নীস্তব্দ টা ভাঙ্গতে চাইলাম না।

দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো বাহিরের থেকে, তাকাল আমার দিকে, বলল, জানো, সময়ের সাথে সাথে দেশের পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে তখন, উঠতি বয়সের ছেলেদের সরকারের পক্ষ থেকে কাজে ঢোকাবার কোন পরিকল্পনা নেই। এরা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে। কোন দলের নেতাদের সাথে মিলে তার স্বার্থ উদ্ধারে লিপ্ত হয়। খুন করতেও দ্বিধা করেনা।

সেই সাথে এসেছে ড্রাগ।

আমি ভয়ে ভয়ে থাকি ফীদেল কে নিয়ে। একদিন ফীদেল ফিরছিল স্কুল থেকে। তিন মাস্তান এক গলির মাঝে দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল। ফীদেল ওদেরকে না দেখার ভান করে হেটে যেতেই, ওরা ডাক দিল ওকে। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসতেই, একজন তার হাতের সিগারেট টা ওর হাতে দিয়ে বলল, জোড়ে টান দে।

ফীদেল চেনে ওদেরকে। এক বিরাট বড়লোকের চেলা এরা। বড়লোকের ড্রাগের ব্যবসা। সব নেতারা তার হাতের মুঠোয়।

কি রে টান দে? বলে মাথায় একটা চাপড় মারলও একজন। জামাটা সরিয়ে দেখালও পিস্তল ।

বাসায় আসতেই ওর চেহারা দেখেই বুঝতে পাড়লাম কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করতেই বলল, সব ঘটনা।

এরপর আস্তে আস্তে ফীদেল বদলে যেতে লাগলো। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলো।

ওকে প্রশ্ন করতেই বলল আমি আর স্কুলে যাবনা। কি হবে যেয়ে ? কয় টাঁকা বেতন পাবো চাকরি করে?

ওর কথা শুনে আমি ভয়ে জড় সর। বললাম, আমাকে সব খুলে বল। কি করছিস তুই ইদানীং।

বলল, নানী, ওরা বাধ্য করেছে আমাকে এই পথে যেতে। তুমি জাননা ওদের কি ক্ষমতা। আমাকে ওরা পিস্তল চালানো শিখিয়েছে। বলেছে ওদের কথা মতো না চললে তোমাদের সবাই কে শেষ করে দেবে। ওদের কথা মতো আমাকে চলতেই হবে নানী। এই বলে অঝোরে কাঁদতে থাকলো আমার নাতি।

আসলে ও ভাল ছেলে ছিল, পরিবেশ ওকে থাকতে দিলো না।

এই বলে মহিলা চুপ করে থাকল।

বললাম, আজ এই পর্যন্তই থাক, কাল শুনবো।

না, তোমাকে বলে আমি হাল্কা হতে চাই।

ফীদেল বাসা নিয়েছিল কিছু দুরে। মাঝে মাঝে আসতো।

একদিন এসে আমার হাতে অনেক গুলো টাকা দিয়ে বলল, এটা রাখো, নানা কে জানাবে না।

আমি নিতে পারিনি। বলেছিলাম, এই টাকা আমি রাখতে পারবো না। তুই ফিরে আয় আমার কাছে।

বলেছিল, আমার আর ফেরার পথ নেই। ইচ্ছে করলেও পারবো না।

সেই শেষ দেখা তার সাথে। আর ফেরে নি সে।

এর পরের ঘটনা গুলো ওর মেয়ে বন্ধুর কাছ থেকে শোনা। তাও ফীদেলের মৃত্যুর অনেক দিনপর।

ফীদেলের বন্ধুদের মধ্যে রোনাল্ডো ছিল ও কাছের মানুষ। একদিন সে  নিয়ে এলো ফীদেলকে ভিক্টরের কাছে।

 ভিক্টরের আছে বিভিন্ন ব্যাবসা। টাকা পয়সার অভাব নেই। অসৎ পথে এসেছে এই ধন সম্পদ।

সাগরেদদের কথায় এবার তার মন্ত্রিত চাই। তার বিপরীতে সান্তস।

 অনেক অনেক পরিচিত নাম।

ভোটে জিততে হলে একটাই পথ, সান্তস কে সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবী থেকে। সেই জন্য রোনাল্ডো নিয়ে এসেছে ফীদেল কে ভিক্টরের কাছে।

ভিক্টর জানে ফীদেল এখনো বয়স্কদের পর্যায়ে আসেনি। ও খুন করলেও ফাসী তার হবেনা।

ভিক্টরের হয়ে ফীদেল অন্য কাজ করেছে। মারপিটে অংশ নিয়েছে। তবে কোনদিন খুন করেনি। ভিক্টরকে সে দুই একবার দেখেছে, কথা হয়নি। কাজের শেষে টাকা সময় মতো তার হাতে এসে গেছে।

ভিক্টর বসেছিল তার প্যালেসের ফুল দিয়ে ঘেরা উঠানে।

ফীদেল এসে ওর সামনে দাড়াতেই ওকে বসতে বলল সামনের চেয়ারে। অনন্যাও দেরকে চলে যেতে বলে  শুধু রোনাল্ডো কে থাকতে বললও।

ফীদেলের হার্ট বীট উৎরতর বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে সে ভিক্টর কে প্রশ্ন না করে থাকতে পারলো না।

“ আমাকে কি কোন কাজের জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন, স্যার?” প্রশ্ন টা করে হাতের রুমাল টা দিয়ে কপালের ঘাম টা মুছে নিলো ফীদেল।

হাঁ। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। তার জন্য তোমাকে প্রচুর  টাকাও দেওয়া হবে।  রোনাল্ডো তোমাকে Details বলবে। কথা শেষে ভিক্টর তাকালও রোনাল্ডোর দিকে।

রোনাল্ডো ফীদেলের হাতে টিপ দিয়ে বলল, চল।

ছোট্ট একটা জলাশয়, কচুরি পানায় ভরা। ফীদেল এতদূরে কোনদিন আসেনি। রোনাল্ডোই নিয়ে এলো। পথের সময় টুকু কোন কথা না বলেই কেটে গিয়েছিল। দুইজনে এসে বসলো জলাশয়ের পাশে।

কোন ভূমিকা না করেই রোনাল্ডো বলল, “ শোন, সান্তসকে সরিয়ে দিতে হবে এই পৃথিবী থেকে। এই কাজ তোকে করতে হবে আগামীকাল। সান্তসের বাসায় তার দলের মিটিং আছে। মিটিং শেষে সান্তস যাবে পাঞ্ছুতে মিছিলে অংশ নিতে। ওর গাড়ী বেড়িয়ে বড় রাস্তায় টার্ন নেওয়ার সময় তোকে এই কাজ শেষ করতে হবে।

সান্তস সব সময় বসে গাড়ীর পিছনের সীটে। বা দিকে। হেলমেট পরে নিবি, যাতে কেউ চিনতে না পারে।

কাজ শেষে সোজা এসে দাঁড়াবি কেন্টন আর পার্থ রাস্তার কর্নারে। ওখানে তোকে পাওনা মিটিয়ে দেবো”। এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে সে উঠে দাঁড়াল।

ফীদেল জানে এই কাজ তাকে করতেই হবে। এক হচ্ছে টাকা অন্য দিকে মরনের ভয়। ভিক্টর তাকে বাচতে দেবেনা যদি সে পিছিয়ে যায়। এ দ্রুবসত্য।

সকাল দশটা। মোটর সাইকেলের উপর বসে ছিল ফীদেল। গলি আর বড় রাস্তার উল্টো দিকে দাড়িয়ে আছে রোনাল্ডো। ওর ইশারা পেলেই সে মোটর সাইকেল স্টার্ট দেবে। সান্তসের বাসার সামনে অনুগামীদের জটলা। সংখায় ততটা নয়। তবুও ছোট গলি বলেই জটলা টা অনেক মনে হচ্ছে।

সান্তস বেড়িয়ে আসতেই কিছু লোক এগিয়ে গেলো কর্মদন করতে। সান্তস দুই একজনের সাথে হাত মেলাল। হাত নেড়ে অভিনন্দন জানিয়ে গাড়ীতে উঠতেই দেহরক্ষী গাড়ীর দরজা বন্ধ করে দিল।

ধীর গতিতে গাড়ি বড় রাস্তার কাছে আসতেই সান্তস জানালা টা খুলে আবারও হাত নাড়িয়ে অভিনন্দন জানানোর মুহূর্তে ফীদেলের ছুটে আসা মোটর সাইকেল থেকে দুটো ঘুলি সান্তসের কপাল ভেদ করে বেড়িয়ে গেলো।

ঢলে পড়লো সান্তস। বিকট শব্দ করে ফীদেলের মোটর সাইকেল মিলিয়ে গেলো। চারিদিকে শুধু হৈ চৈ।

ফীদেল এসে দাঁড়ালো কেন্টন আর পার্থ রাস্তার কর্নারে।

জাগাটা নিরিবিলি। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ী ছুটে চলে যাচ্ছে।

মোটর সাইকেল টা রাস্তার পাশে পার্ক করে সিগারেট টা ধরাল। বুকের ধরপড়ানি একটু কমে এসেছে। রোনাল্ডো তার টাকা পয়সা মিটিয়ে দিলেই সে ঠিক করেছে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। আর নয়।

রোনাল্ডোর আসতে দেরী হওয়াতে একটু চিন্তিত হোল ফীদেল। তার জানা মতে ভিক্টর কখনো কথার খেলাপ করেনি।

দুরে একটা মোটর সাইকেল আসতে দেখে ফীদেল এগিয়ে এলো।  মোটর সাইকেল টা এসে দাঁড়ালো ফীদেলের কাছে। চালকের মাথায় কালো হেলমেট। পিছনে ব্যাগপেক।

এই রোনাল্ডো, বলে ফীদেল এগিয়ে আসতেই লোকটা তার কোমরে গোজা রিভলভার বের করে গুলি করলো ফীদেল কে।

ফীদেল পড়ে গেলো মাটিতে। রক্তে ভিজে গেলো তার টি সার্ট।

ভিক্টর তার অপকর্মের কোন ছিন্ন রাখতে চায় নি। পাছে ফীদেল ধরা পড়ে। সবকিছু ফাঁস হয়ে যায়।

আমাকে খবর দিয়েছিল ওর এক বন্ধু। লাশ সনাক্ত করে দিয়ে এলাম। সেই শেষ।

মহিলা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। গাল বেয়ে পানি পড়তে দেখে ন্যাপকীন টা এগিয়ে দিলাম। চোখটা মুছে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। মনে হোল তার দৃষ্টি এখানে নয়, চলে গেছে সেই সুদুর দেশে যেখানে ফীদেল ঘুমিয়ে আছে।

Continue Reading

অদৃশ্য কণ্ঠস্বর

     টেগোর কামরুল আলম। তুমি যেদিন এলে, সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে সাদা সাদা পেঁজা পেঁজা বরফ ঝরে ঝরে পড়ছিল। বাতাসের শব্দ আমার কানে এসে বাজছিল। কে যেন আমাকে বলছে, যাবে না দেখতে?  আমি তাকিয়ে দেখছিলাম সাদা হয়ে যাওয়া রাস্তাটার দিকে। ঝাপসা হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি, আমি আর কিছু দেখতে পেলাম না।

শুধু তাঁর কণ্ঠস্বর।

যাও, দেখে এসো।

আমি দেখে এসেছি। কথা বলেছি মনে মনে।

ছোট, ছোট হাত, পা ছুড়ে সে তাঁর অস্থিত ঘোষণা করছে। আমি হাত দিয়ে ছুঁতে পারিনি। কোলে নিয়ে বুকের মাঝে চেপে ধরতে পারিনি।

বলতে পারিনি, কতদিন আমি তোর আশায় বসেছিলাম,

তোকে নিয়ে কত স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। আমাকে তুই চিনতে পারবি শুধু ছবির মাঝে।

তোর আমার ছবি কোথাও থাকবে না, থাকবে শুধু তোর মনের মাঝে।

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম,পারবি না আঁকতে সেই ছবি?

মনে হোল সে বলছে সে পারবে । ওর নামই তো বলে দিচ্ছে ও  পারবে।

আমি বলেছি, আমাকে তুই বিভিন্ন ভাবে তোর মনের মতো করে সাজাবি। বিভিন্ন ভাবে তোলা আমার ছবি পাবি তোর দাদার কাছে। ওখান থেকে বেছে নিবি সবচেয়ে ভাল, সুন্দর ছবি টা।

তোর দাদা বলতো আমার সব ছবিই নাকি খুব সুন্দর। ওর কথা শুনবি না। ও সব কিছুই একটু বাড়িয়ে বলত।

তুই বেছে নিবি তোর সবচেয়ে পছন্দের টা।

তারপর, তারপর আমি আর তুই।

কল্পনায় পারবি না, আমার হাত টা তোর হাতের মুঠোয় ধরে সমুদ্রের পাড়ে হাটতে।

বলতে পারবি কি আমি তোর মাঝে রয়েছি, থাকব অনন্ত অনন্ত কাল ধরে।

তুই অনেক বড় হবি, তোর নাম যশ ছড়িয়ে পড়বে। তখনও তুই আমায় তোর মনের মাঝে রাখবি তোঁ ?

আমি চলব তোর পাশে পাশে। ধরব তোর হাত টা। বলবি কি, দাদি জড়িয়ে ধর আমায় , পাড় করিয়ে দেই রাস্তা টা।

তোর ঘর টা আমি দেখে এসেছি। তোর বাবা, মা কি সুন্দর করেই না সাজিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার কোটেশন দালানে লেখা। তোর ছোট্ট  বিছানার  পাশে দোলনা। আমি ধাক্কা দিয়ে দোলনা টা দুলিয়ে এসেছি। ওটা দুলছে, দুলছে।

তোর ওয়ারড্রবে থরে থরে সাজানো তোর কাপড় গুলো আমি হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে এসেছি।

এই ছোট্ট পুতুলের কাপড় গুলো আমি শেষে দেখেছিলাম যখন তোর ফুফু এসেছিল। অনেক অনেক বছর আগে।

আজ আবারও দেখলাম, কিন্তু কি জানিস, তোকে আমি নিজ হাতে পড়াতে পাড়লাম না।

তোমার চোখে পানি কেনও? আজ তোঁ তোমার আনন্দের দিন। যাও ওকে নিয়ে এসো।

শুধু তোমায় বলি, একদিন ওকে দেখিয়ে এনো আমার জন্ম স্থান টা। দেখিয়ে এনো সেই জাগাটা, যেখানে তুমি প্রথম আমার হাতে হাত রেখেছিলে। যেখানে বসে আমরা গল্প করতাম, সেই গাছতলা টা। সেই রাস্তা টা যার পরে কত স্মৃতি জড়ান তোমার  আমরা।  গল্প করে বলও তোমার আমার কথা।

ওকে তুমি প্রথম যখন কোলে তুলে নেবে, আমার হয়ে চুমো দিও। কানের কাছে মুখ নিয়ে আমার নাম টা বলও।

আমি রইলাম তোমাদের মাঝে।

আলম? আলম?

হোয়াট?

সামবডি অয়ান্টস টু টক উঈথ উ।

তাল টা কেটে গেলো। আমি ফিরে চাইলাম। ভিজে যাওয়া চশমাটা মুছে নিলাম।

Continue Reading

অবশেষে অবসর

কি ভাবছ মিন্টু?
অতীত।
হঠাৎ অতীত। অতীত কেন?
ভবিষ্যৎ তো দেখা যায় না।
আর বর্তমান তো সব সময় অতীতের মাঝে ডুবে যাচ্ছে, তাই নয় কি?
বুঝলাম না।
এই যে তুমি জিজ্ঞাসা করলে “ বুঝলাম না”, এই প্রশ্ন টা আর বর্তমানে নেই, পিছনে চলে গেছে, ওটা অতীত।
ওই সব তাল বাহানা ছাড়ো। বলও কি ভাবছিলে।
সব কিছু ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম আজ। পিছনে ফেলে এলাম আমার চুয়াল্লিশ বছরের কর্ম জীবন। সেই অতীতের দিনগুলো বার বার মনে করার চেস্টা করছিলাম।
একটু সহজ করে বলও।

আজ কর্ম জীবন থেকে ইস্থাফা দিলাম।
মানে?
মানে রিটায়ার করলাম।
আর আমাকে ভোর ছয়টায় উঠতে হবে না। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিতে হবে না। বাহিরে অঝোর ঝরে বৃষ্টি আমাকে বাতীব্যস্ত করবে না। আমি পাশের বালিশটাকে বুকে চেপে ধরে আবারও ঘুমের মাঝে ঢলে পরবো।
হাসালে তুমি।
কেনও?
কারন আমি তোমাকে চিনি বলে। তোমাকে আমি দেখেছি তিলেতিলে বড় হয়ে উঠতে। তোমার মাঝে আছে অস্থিরতা। তুমি দুদণ্ড এক জাগায় বসতে পারনা। মনে পরে সে কি বলেছিল তোমাকে। বলেছিল, “ আচ্ছা, তোমাকে কি সব সময় বল্লায় কামড়ায়”।
তুমি যাও এখান থেকে। আমার আনন্দ টাকে মাটি করোনা। অফুরন্ত সময় আজ থেকে আমার হাতে।
কি করবে? এই অফুরন্ত সময় কি ভাবে কাটাবে ভেবেছ কি?
বেড়িয়ে পড়বো বিভিন্ন দেশ দেখতে। জড়িয়ে পড়বো বিভিন্ন সংগঠনের সাথে। সময় পাড় হয়ে যাবে।
তাই যেন হয়। তবে বলি কি, যাওয়ার আগে একটা কথা মনে রেখো।
কি?
ঐ যে ছোট বেলায় শুনেছ, Old is Gold, বড় বাজে কথা।
কেনও?
হার্ট বীট টা কত বার উঠা নামা করছে সেটা তো প্রতি রাতেই একবার দেখে নেও। তাই না? বিছানা থেকে উঠতে গেলে সাবধানে উঠতে হয়, কারন তা না হলে মাজার ব্যাথা টা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাই নয় কি? আর কন্সটীপেসানের কথা নাই বা বললাম। এই যদি গোল্ড হয় তবে আমি তোমার সাথে একমত নই।
এই যে বলছিলে বেড়িয়ে পড়বে? এতসব প্রবলেম নিয়ে কোথায় বেড়িয়ে পড়বে বলও? বেড়িয়ে পড়তে গেলে সঙ্গে কাউকে তো নিতে হবে। একটা কথা বলার লোক। কোথায় পাবে? চারিদিকে তাকিয়ে একবার দেখো? আছে কি? তোমার পরিস্থিতি ভিন্ন। তোমার কথা বলার লোকের অভাব। কার সময় আছে তোমার সাথে বসে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করার।

এই সবের মাঝ থেকেই আমি খুজে নেবো কি ভাবে অতিবাহিত করবো অবসর সময় টাকে । ও হা তুমি তো জানো, নাতি আসছে আমার। সবাই বলে, এই ফাও টার উপর নাকি মায়া হয় বেশি। ওটাকে নিয়ে সময় টা ভালই কেটে যাবে। কি বলও।
তা হয়তো যাবে। তবে একবারও কি মনে হয় না সময় টা খুব দ্রুত পেড়িয়ে গেলো।
আসলে তাই। কে যেন বলেছিল, “ জীবন এতো ছোট ক্যেনে”। আজ এই আসন্ন সন্ধ্যায়, সূর্যের আলো নিভে আসছে। পশ্চিমের আকাশ লাল, আমি বারান্দায় একা। কি মনে হচ্ছে জানো?
কি?
আস্তে আস্তে অনেক গুলো ফুল তো ঝরে গেছে। আরও কিছু যাবার পথে, আমিও তাদের দলে। কোনদিন কি একবারও ভেবেছিলাম আমি একদিন অবসর প্রাপ্ত নাগরীক হবো, আমি সিনিয়র সীটিযেন হবো। আমি সিনেমা হলে, বাসে, ট্রেনের টিকিটে দশ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট পাবো। রাস্তায় চলতে যেয়ে একজন কাছে আসে বলবে, দাদু আপনার রুমাল টা পরে গেছে। আর আমি চশমাটা দুবার মুছে, মাথাটা দুদিক ঘুরিয়ে দেখবো কোথায় পড়েছে রুমাল টা।
তাই আমি অথর্ব হওয়ার আগেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম আমার অতীত কে খুজতে।
কি দেখলে?
তবে শোন? তার আগে বলও তুমি কে?

নাই বা জানলে আমি কে? আমি বাস করি তোমার মনের মাঝে। তোমার অন্তনিহিত শক্তি।

হাঁ বেড়িয়ে ছিলাম। অবসর নেয়ার আগে ভেবেছিলাম একবার খুজে দেখি ওদেরকে যাদের সাথে আমার ছোটবেলা কেটেছিল। তারও কি আমার মতো আজ অবসর প্রাপ্ত ?
খুজে পেয়ে ছিলে কি?
পেয়েছিলাম মীনু কে। আমার ছোটবেলার খেলার সাথী। এক্কা দক্কা খেলার সাথী। ছোট ছোট হাঁড়িপাতিলে মিছিমিছি রান্না করে বলতো, এই নাও, সব টুকু খেয়ে নাও। সেই মীনু যখন ওড়না গায়ে দিয়ে এসে একদিন বলল, মা, বারন করে দিয়েছে তোমার সাথে খেলতে।
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, কেন?
সেই মীনু কে আমি খুজে পেয়েছিলাম সুন্দরপুরের এক গ্রামে। অবশ্য কৃতীত সব তৈয়েবের। ওর বাসায় উঠেছিলাম। বলেছিলাম, আমার আসার অভিপ্রায়।
সে বলেছিল, যা দেখবি, যা শুনবি তাতে করে তোর মন ভরবে না, বরং ব্যথাই পাবি। তোর চোখে রয়েছে তোর সেই ফেলে যাওয়া স্মৃতি। মাঝে যে অনেক জল গড়িয়ে গেছে সেটা তো তুই দেখতে পাসনি।
এই আমাকে দেখ। যে তৈয়েব কে তুই শেষ দেখেছিলি আমি কি সেই।

না। তুই সেই তৈয়েব না। তোর শ্যামলা রঙ টা আজ কালচে তে রুপ নিয়েছে। কপালে, গালে আচুলীতে ভরা, চোখের নিচে থলথল করছে জলের থলি। তোর সেই ঘন চুল আজ নেই বললেই চলে। এক কালে ফুটবল খেলায় তোর পারদর্শিতার অন্ত্য ছিলনা, সেই তৈয়েব আজ কাজ থেকে অবসর নিয়ে চা র দোকানে বসে আড্ডা দেয়। মোটা কাচের চশমা টাকে বার বার মুছতে হয়। দুরে হেটে আসা লোক টাকে ঝাপসা লাগে।

শুধু তাই নয়। আড্ডা দিতে আরম্ভ করেছিলাম চার জন মিলে। আজ দুজনে এসে ঠেকেছি। বলে তৈয়েব তাকাল আমার দিকে।

কাকে চাই?
বলে যে মহিলা টা এসে দাঁড়াল আমার সামনে তাকে আমি চিনতে পারিনি। রুগ্ন দুটো হাতে দুটো সোনার চুড়ি। ঢলঢল করছে। চোখের নিচে মনে হোল কে যেন কালো কালি লেপটে দিয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে।
বললাম, মীনু নামে কেউ থাকে কি এখানে?
সে বলল, কেন? কি দরকার তার সাথে?
বললাম, দেখা করতে এসেছিলাম, ছোট বেলার বন্ধু। আমার নাম মিন্টু।
আর আমার নাম মীনু।
বড় দেরী করে এলে। কোথায় ছিলে এতদিন? তোমাকে আমি চিনতে পারিনি, তুমিও আমাকে চিনতে পারোনি। তোমার সেই ঠোটের নিচের হাসি টা হারিয়ে গেছে।
আর তোমার হারিয়ে গেছে সেই বড় বড় চোখ দুটো।
আমিও তো হারাবার পথে। বলে করুন দৃষ্টি দিয়ে তাকাল আমার দিকে।
কেন? কি হয়েছে।
রাজ রোগ। স্বামী চলে গেলো একরাতে, হার্ট অ্যাটাকে। আর আমাকে ধরলও এই রোগ।
এই বলে সে ভিতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। হাতে একটা এ্যালবাম।
বলল, দেখো, আমার বিয়ের ছবি। দেখাতে দেখাতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
আমি বললাম, ছেলে, মেয়ে—
বিধাতা দেইনি।
তাহলে কে দেখাশুনা করে।
আমার ভাই।
চিকিৎসা।
করিনি। কি হবে করে? কাড়িকাড়ি টাঁকা। কে দেবে? আর ভাল হবার নিশ্চয়তা বা কি? তাই যে কটা দিন আছি এই ভাবেই চলে যাবে। তুমি কি করছ?
কাজ থেকে অবসর নিতে চলেছি।
তুমি অনেক পালটিয়ে গেছো। মাথার চুলে কলপ দিয়ে কি বয়স টাকে লুকিয়ে রাখতে পারবে? কপালের রেখা গুলো প্রকট হয়ে উঠেছে। দেখেছ কি? তোমার চোখে মুখে কেনও জানি একটা বিষণ্ণতার ছাপ। তোমার সেই হাসিটা আমার মনে আজও গেঁথে রয়েছে। ওটাকে হারালে কি ভাবে?
ঝড় ঝাপটা তো অনেক গেছে হয়ত ঝড়ের দাপটে হারিয়ে গেছে ঐ হাসিটা। তবু ভাল লাগলো তুমি মনে রেখেছ সেই ছোট্ট বেলার হাসিটা।

তারপর ছোট ছোট কথা।
বিদায় কালে বললাম, হয়ত আর দেখা হবে না। কথা টা বড় মর্ম বিদায়ক, কিন্তু কি বলব বলও। এটাই তো চরম সত্য। তাই না?
হা, তাই। এবার এসো।

আমি আর তৈয়েব ফিরে এলাম। আসার পথে তৈয়েব বলল, মহী বেচে নেই, ওয়াহেদ অনেক আগেই চলে গেছে, সহীদুল্লাও যাওয়ার পথে, তবে তোকে একজনের কাছে নিয়ে যাবো চিনতে পারবি কিনা জানিনা।
ওর রহস্য আমি ভাঙ্গতে চাই নি। সে নিয়ে এলো উচু প্রাচীর দেওয়া এক দোতালা বাড়ীর সামনে। এইখানে এই বাড়ীর কথা আমার মনে পরে না।
জিজ্ঞাসা করলাম, এইখানে কি আগে এই বাড়ী ছিল।
না ছিল না, তোর মনে পরে কুসুমদের কথা। ওদের জমি দখল করে এই বাড়ী বানান হয়েছে। সে অনেক কথা, পরে বলব।

বেল বাজাতেই দারোয়ান এসে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই?
সামসুদ্দীন সাহেব কে বলও, তৈয়েব আর মিন্টু এসেছে।
কে এই সামসুদ্দীন? জিজ্ঞাসা করতেই, তৈয়েব বলল, দেখ না, আগে চিনতে পারিস কিনা।

দারোয়ান ভিতরে নিয়ে এলো। ড্রয়াইং রুম দামী আসবাব পত্র দিয়ে নিখুঁত ভাবে সাজানো।
আমাদের কে বসতে বলে দারোয়ান ভিতরে চলে গেল। এক মিনিট, দুই মিনিট করে পনের মিনিট পার হয়ে গেলো।
আমার ধর্জের সীমানা পাড় হতেই বললাম, চল উঠি।
ঠিক সেই সময় মাথায় টুপি, গোলগাল, সাদা দাড়ি ওয়ালা এক ভদ্রলোক পাশের দরজা খুলে আসতেই আমার চোখ আটকিয়ে গেলো বা হাতের সোনার বালার দিকে।
তৈয়েবের দিকে চেয়ে, সরি দোস্ত, বলে কোলাকুলি সেরে আমার দিকে তাকাল।
তৈয়েব বলল, চিনতে পারছিস ওকে। তাকিয়ে রইল আমার দিকে, হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল, মিন্টু না?
হা, তবে আমি তো—
কথা শেষ না হতেই আবারও চিৎকার করে বলল, মনে পরেনা ? তুই আমাকে মাঝে মাঝে অঙ্ক দেখিয়ে দিতি। আমি আসতাম গোপালপুর থেকে। মনে পরে?
আস্তে আস্তে আমার মনের পর্দায় সামসুদ্দীনের চেহারা ভেসে উঠল। হ্যাংলা পাতলা ছেলে। আমাদের সাথে পড়ত। মঝে মাঝেই আমাকে বিরক্ত করত ক্লাস শেষে। অঙ্ক, ফিজিক্স দেখিয়ে দিতে হতো। বন্ধুত্ত গড়ে উঠেনি।
ম্যাট্রিকে নকল করতে যেয়ে ধরা পরে। তারপর ওর খবর আর আমি জানি না। জানার কথাও নয়।
সেই সামসুদ্দীনের এই বাড়ী, দারোয়ান। আসবাব পত্র।
তা ইদানীং কি করছিস? ব্যাবসা করছিস বুঝি?
জিজ্ঞাসা করতেই দুপাটি দাঁত বের করে হেসে (একটা দাঁত নতুন বাধিয়েছে, চক চক করছে) বলল,
আমি এই জেলার রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান। হা, ব্যবসা যে নেই তা নয়, ওগুলো আমার ছেলেরা দেখে।
আমি অন্য দিকটা সামলাই।
অন্য দিকটা মানে?
জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ও তুই বুঝবি না।
তা বেশ তো ভালই আছিস মনে হচ্ছে?
তা তোদের দোয়ায় একটা ইন্ডাস্ট্রি করতে পেরেছি। দুটো বাড়ী আছে। সংসারে অভাব অনটন নাই বললেই চলে।
তোরা বোস, তোদের জন্য খাবার আনতে বলি।
আমার মন চাইল না ওর ওখানে বসতে। বললাম, আজ আসি।
বেড়িয়ে এলাম।

আরও কাউকে খুজে বের করব কি? তৈয়েব প্রশ্ন করতেই বললাম,
না আর নয়। আবার ফেরার পালা। তবে একটা কথা বলি, নিতান্তই আমার কথা।
কি?
এই ছোট্ট জীবনের জন্য এত হিংসা, এত খুনাখুনি কেন?
এই সব নিয়েই তো জীবন। তা নাহলে তো সবাই সন্ন্যাসী হয়ে যেতো। তাতে আনন্দ কোথায়। কোণটা ভাল, কোণটা মন্দ বুঝবি কি ভাবে?
হয়তো তাই।
কথা শেষে বিদায় নিলাম ওর কাছ থেকে। এই হয়ত শেষ দেখা।

দেখে তো এলে, তা কি মনে হচ্ছে? নতুন জীবন টাকে মানিয়ে নিতে পারবে তো?
একটু সময় লাগবে। জীবন শক্তি তো আমার এখনও হারিয়ে যাই নি। মনের বল টাই প্রধান। ওটাকে আমার যে করেই হোক ধরে রাখতেই হবে। তা নাহলে ঐ দুস্টু টার সাথে আমি পেরে উঠব না। ওর মাঝে হয়ত আমি আবার নতুন জীবন ফিরে পেতে পারি। কি বলও, পাবো না ?
পাবে বৈকি?
তুমি শুধু এই প্রার্থনা করো।

Continue Reading

কলগার্ল

ভেলেন্টাইনস ডে।
বসুন্ধরা মলের সামনে দাড়িয়ে একটা সি এন জি র অপেক্ষায় অনন্ত এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। হঠাৎই মনে হোল কে যেন ডাকছে তাকে। দুদিকে তাকিয়ে অনন্ত কাউকে দেখতে পেলনা। ভাবল হয়ত শুনতে ভুল করেছে।
না আবারও সেই ডাক। এবার নাম নয়, অন্য নামে ডাকছে কে যেন।
“ এই উজবক, ডানদিকে তাকা। দুটা গাড়ীর পরে আমার গাড়ী”।
ডানে তাকাতেই অনন্ত দেখতে পেলো গাড়ীর জানালা খুলে মাথা বের করে ডাকছে নজীব।
অনন্ত এগিয়ে কাছে যেতেই, নজীব বলে উঠল, এই উজবক, ডাকতে ডাকতে গলা বসে গেলো আর তুই এদিক ওদিক চেয়ে মস্করা করছিলি”।
খিলখিল করে হাসির শব্দ শুনতে পেলো অনন্ত। ভিতরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো এক ভদ্রমহিলা। তখনো তার সারা মুখে হাসির ছোঁয়া। বলল, ভিতরে চলে আসুন, তা নাহলে আরও বিভিন্ন নামে বকুনি শুনতে হবে।
ড্রাইভারের পাশে বসে পিছন ফিরে তাকালও অনন্ত। নজীবের বৌ কে আগে সে দেখেনি। শ্যামলা রঙ। মাথার পিছনে খোঁপার পরে লাল ফুল গোজা। মুখের উপর অতিমাত্রায় প্রসাধনীর প্রলেপ দেওয়া। সাঁজ টা একটু উগ্র মনে হোল অনন্তর কাছে।
“ ওর এই ধরনের ডাক শুনে আমি অভ্যস্ত ভাবী। যদিও অনেক দিন পরে দেখা”। চোখে চোখ রেখে কথা শেষ করল অনন্ত।
“ কাকে ভাবী বলছিস?”
কেন? বলে অনন্ত তাকালও ওদের দিকে।
“ আমি ওর বৌ নই, বান্ধবী”।
“ বান্ধবী?” একটু থেমে অনন্ত বলল, “ আজ তো ভেলেন্টাঈন্স ডে”।
“ So? নজীবের প্রশ্ন।
“ না, মানে –“
“ এই শালা সারা জীবন সেকেলে রয়ে গেলো। বিদেশ থেকে ঘুরে এলি, আর এই সব বুঝলি না। ওইযে কোথায় যেন পড়েছিলাম, কে যেন লিখে ছিল, বৌ হচ্ছে ডোবা, ওখানে ডুব দেবো, আর এ হচ্ছে নদী, শুধু সাঁতার কাটবো।“
“ থাক তোর ভুল কোটেশন দিতে হবে না, আমাকে শান্তিনগরের মোড়ে নামিয়ে দে”। বলে অনন্ত তাকাল নজীবের দিকে।
“পৌছে দেবো তবে এখন নয়। We are going to have a dinner toghether. “
অনন্ত জানে ওর সাথে জোরাজুরি করে লাভ নেই। তবুও বলল,আজকের সন্ধ্যা তোদের জন্য, আমার জন্য নয়”
সুশীলাই বলল, থাকেন না আমাদের সাথে, আমাদের যখন কোন অসুবিধা হচ্ছে না তখন আপনার অসুবিধা কোথায়?
আন্তরিকতা ভরা গলা সব সময় অনন্তকে দোলা দেয়, আজও তার ব্যাতীক্রম হলনা।

গাড়ী অনেক ঘুরে এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরল। কিছুক্ষণ সবাই চুপ। নিঃশব্দতা ভেঙ্ঘে সুশীলাই জিজ্ঞাসা করল,
“আপনি কি একাই নাকি কেউ আছে?”
নজীব ধমকের সুরে বলল, আচ্ছা তোমাদের উন্টীপুন্টী না জানলেই নয়। ওটা ওর ব্যাক্তীগত ব্যাপার।
অনন্ত সাচ্ছন্দে বলল, বলব, ডিনার খেতে খেতে।

গাড়ী এসে দাঁড়াল রেস্টুরেন্টের সামনে। বাহিরে দারোয়ান । দরজা খুলে দাঁড়াল। ভিতরে এলো ওরা তিনজন।
অনন্ত এই এলাকার সাথে খুব একটা পরিচিত নয়। দুই একবার এসেছিল। তাও এক বন্ধুর সাথে। কাজেই সবই তার কাছে নতুন
ভেলেন্টাইনস ডে বলেই হয়ত ভিড় টা একটু বেশি। নজীবের এখানে আসা যাওয়া আছে মনে হোল অনন্তের কাছে। দুই একজন এসে সালাম দিলো, কেউ বা হ্যালো, হাই, বললও। টেবিল পেতে দেরী হলনা, যোগ সুত্র আছে বলেই হয়ত, অনন্তের কাছে তাই মনে হোল।
“Hard drink, চলে?” নজীব প্রশ্ন করলো অনন্তকে
“এক সময় চলত, ছেড়ে দিয়েছি”।
“সবকিছুতেই বৈরাগ্য কেন?”
উত্তর দেওয়ার আগেই সুশীলা বলল অনন্ত দা আপনার কথা বলেন, ডিনার খেতে খেতে বলবেন বলেছিলেন।

ওয়েটার এসে পাশে দাড়াতেই অনন্ত কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেলো। আশে পাশে তাকিয়ে পরিবেশ টাকে অনুভব করার চেষ্টা করল অনন্ত। ইয়াং ছেলে মেয়েদেরই সংখ্যা বেশি মনে হোল অনন্তর কাছে।
পাশের টেবিলে দুইজন। তিরিশের কোঠা পেরিয়েছে। ঘোলাটে চোখের চাহুনী দেখে বোঝা যায় নতুন প্রেমে মত্ত।

কি ব্যাপার, কি ভাবছেন?
না ভাবছি না, দেখছি। বলে সংক্ষেপে সুশীলার উত্তর টা শেষ করল অনন্ত। সফট ড্রিঙ্কস এসে যাওয়াতে, দুই সিপ দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলো অনন্ত। তারপর গ্লাস টা পাশে সরিয়ে রেখে সুশীলার দিকে তাকিয়ে বলল, এবার শোনেন আমার কথা।

লন্ডনে গিয়েছিলাম পি এইচ ডি করতে। প্রথম প্রথম খুব একেলা লাগতো। একটা দোতালা বাড়ীর উপর তালাতে ছিল আমার বাস। বন্ধু বান্ধব জোগাড় করা আমার কাছে ছিল এক দুরহ ব্যাপার। আমি ছিলাম একটু লাজুক প্রকৃতির । হয়তো সেইজন্য কোন মেয়ের সাথে আমার বন্ধুত্ত গড়ে উঠেনি। আমিও তাতে কোন অভাব অনুভব করতাম না।
এমনি একদিন ইউনিভারসিটি থেকে বেড়িয়ে হাঁটছিলাম। সন্ধ্যা হয় হয়। ছিটে ছিটে বৃষ্টি আসাতে রাস্তার পাশে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। খেতে আসিনি,এসেছি সময় কাটাতে। অগত্যা বারে বসলাম। একটা বীয়ার অর্ডার দিয়ে পাশে তাকাতেই চোখাচোখি হোল মেয়েটার সাথে। চোখ ফিরিয়ে বীয়ারের গ্লাসে চুমুক দিতেই মনে হোল পাশের থেকে কে যেন বলছে, আমার নাম এলিয়েট। হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে আমার দিকে, আমিও আমার হাত দিয়ে ওর হাত টা ধরে বললাম, আমার নাম অনন্ত।
বাহ, গল্পটা তো জমে উঠেছে, অনন্ত দা।
এতো সবে শুরু। এলিয়েট বলল সে কাজ করে একটা ফাঈন্যন্সীয়াল কোম্পানিতে। আমি আমার পরিচয় দিলাম। যেহেতু কথা বলাতে আমি ততটা পারদর্শী নই কাজেই সেই বলল বেশি। কিন্তু সে যে আমাকে খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারলো তা নয়।
দেখতে কি মোটেই ভাল ছিল না? সুশীলা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করল।
দেখতে মন্দ নয়। তবে আহা মরি কিছু নয়। আমি বীয়ারের গ্লাসটাতে শেষ চুমুক দিয়ে, বললাম এবার আমি উঠব।
এলিয়েট তার পার্স থেকে বিজনেস কার্ড বের করে দিয়ে বলল, এখানে আমার ফোন নাম্বার আছে, কল করলে আনন্দিত হবো। যদি কিছু মনে না করো তবে বলি, কাল আমি এখানে থাকব।
পরের দিন এসেছিলেন?
এসেছিলাম। তবে বইয়ে পড়ার মতো নতুন প্রেমের সেই যে আকর্ষণ তা আমার মাঝে ছিলনা। এযেনো আসতে হয় তাই আসা।
তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। প্রতিদিন দেখা হয় প্রতিদিন কথা হয়। অনেক সময় কেটে যায় কথা বলে।
একদিন সেই বলল, চলো আমার এপার্টমেন্টে। তোমাকে আমার আঁকা কতগুলো ছবি দেখাবো।
ও যে ছবি আঁকতে পারে এতদিন সে তা বলে নি।
বললাম, তোমার যে এতো গুন তাতো আগে বলোনি।
ও শুধু হাসলও।

এপার্টমেন্ট টা বেশ ছিমছাম। একটা শোয়ার, আর একটা বসার ঘর। আমি সোফাতে বসে সামনে রাখা একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছীলাম। এলিয়েট বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে। পরনে ঘরে পড়ার পোশাক। বসলো আমার পাশে। আমি কোন কিছু বলার আগেই সে তার ঠোট দিয়ে চেপে ধরলও আমার ঠোট টা। আমার মধ্যে কোন সাড়া জাগলনা। কোন স্পন্ধন এলো না আমার শরীরে। বরং একটা বিতৃষ্ণা এলো। ওকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। বললাম, আমার মনে হয় না আমি কোন মেয়ে তে আকৃস্ট হবো। সে দুরে সরে বসে বলল, তাহলে কি তুমি—।
বললাম, আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।
এটা আমার নিজেকে নিজের প্রথম আবিষ্কার।
তার মানে? বলে তাকাল সুশীলা।
এতক্ষণে নজীব কথা বলল, মানে বুঝতে পারছ না, ওকে আমি তোমার বডিগার্ড হিসাবে রাখলেও আমার কোন চিন্তা নেই, ও হচ্ছে তাই।
সেই জন্যই আপনি একলা। বলে সুশীলা তাকাল অনন্তর দিকে।

এই সময়ে একটা ফোন এলো নজীবের। নাম্বার টা দেখে বলল, আমার এই কল টা ধরতে হবে। বলে উঠে গেলো।
ফিরে এলে কয়েক সেকেন্ড পরে। বলল, আমাকে এখুনি একটু যেতে হবে, কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবো। তোমরা ডিনার করতে থাকো আমি এসে জয়েন করব। বলে সে বেড়িয়ে গেলো।

অনন্ত আর সুশীলা সামনা সামনি বসা, অথচ হঠাৎ করেই কারো মুখে কোন কথা নেই। শুধু টুংটাং কাঁটা চামচের শব্দ। নীরবতা প্রথমে ভঙ্গ করে অনন্ত জিজ্ঞাসা করল, আমি বললাম আমার কথা এবার আপনি বলেন আপনার কথা।

সুশীলা সামনে রাখা সেভেন আপের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, জানিনা আপনি আমাকে কি চোখে দেখছেন, খারাপ চোখে দেখা টাই স্বাভাবিক। তবে আজ নজীব না থাকলে আমার পরিস্থিতি কি হতো আমি জানি না।
আমার জীবন কাহিনী শুনতে চাচ্ছেন তবেঁ বলি।
এই বলে সুশীলা বলল তার কাহিনী অনন্তর কাছে।

মফস্বল শহরে ছিল আমাদের বাস। বাবা নিতান্ত একটা ছোট খাটো চাকরি করতেন। আমি বড়, আমার ভাই আমার চেয়ে অনেক বছরের ছোট। বাবার ইচ্ছা আমি কলেজ শেষে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেই সুবাদে এসেছিলাম রাজধানীতে। ভর্তি হয়ে ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুটি বছর ভালভাবেই কেটে গেলো। হঠাৎ করেই একদিন বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন।
আমি দিশাহারা হয়ে গেলাম। কি করব, কি ভাবে চলবে, কিছুই বুজে উঠতে পারছিলাম না।
আমার এক বান্ধবী কে বললাম, সে বলল, এই মুহূর্তে তোর দরকার টাঁকা। তাই না?
বললাম, হাঁ, তাই। আমার একটা চাকরি নিতে হবে।
“ তোর জন্য চাকরি নিয়ে সবাই বসে আছে। তাই কি?”
তাহলে?
একটা পথ আছে। আজ সন্ধ্যায় তোকে এক জাগায় নিয়ে যাবো, চাকরির সন্ধানে।
কি চাকরি, কি ধরণের চাকরি তা ভাবার সময় নেই। সন্ধ্যায় নিচে নেমে এলাম। শিউলি আমাকে দেখে আঁতকে উঠল।
বলল, এই বেশে, এই ধরণের সাজগোজে ওখানে যাওয়া যাবেনা। চল আমার রুমে।
ওর সবকিছু দিয়ে নতুন করে সাজাল সে আমাকে। বেড়িয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়ালাম। একটা সি এন জি পাশ দিয়ে যেতেই ওটাকে ডেকে উঠে পড়লাম আমরা দুজন। এসে পৌছালাম এক ঝলমল করে সাজানো বিরাট হোটেলের সামনে।
একটু ইত্যস্ত করে নেমে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে কেন?
একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো সেই তোকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে।
লবিতে আসতেই এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলো।শিউলি পরিচয় করিয়ে দিলো। বলল, আমার বান্ধবীর চাকরি দরকার।
ইতিমধ্যে আমি আঁচ করতে পেরেছি কি ধরণের কাজের জন্য শিউলি আমাকে নিয়ে এসেছে।
ভদ্রমহিলা শিউলির হাতে একটা কাগজ দিতেই সে ওটা দেখে বলল তুই উনার সাথে কথা বল আমি আসছি।
আমরা যেয়ে বসলাম কোণার একটা সোফা তে। কোন ভূমিকা না করেই সে বলল, লোকের আনন্দ দেওয়াই আমাদের কাজ। তুমি ওদের সাথে যাবে, কিছুটা সময় ব্যায় করবে, তার বিনিময়ে তুমি যা পাবে তা তোমার।
লজ্জায়, ক্ষবে, আমি মাটির সাথে মিশে যেতে চাইছিলাম। বললাম, একাজ আমার দাড়া হবে না। আমার বান্ধবী কে বলবেন আমি চলে গেছি। এই বলে বেরিয়ে এলাম। একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে এলাম আমার জাগায়।
তারপর! জিজ্ঞাসা করল অনন্ত।
তারপর, ফিরে যেতে হয়েছিল ওই পথে। আমার টাঁকার দরকার। মা কে ভাই কে বাচাতে হবে, বাঁচতে হবে আমাকে। এরপর আর পিছনে ফিরে চাইনি। মাকে বলেছি, চিন্তা করো না একটা বড় চাকরি পেয়েছি। তোমাকে টাকার জন্য ভাবতে হবে না।
নজীবের সাথে দেখা কি ঐখানে হয়েছিল?
হাঁ। একদিন বসে আছি লবিতে। নজীব সাথে আরও দুইজন। এক মহিলার সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলতে বলতে তাকাল আমার দিকে। আবারও তাকাল। তারপর ওর সাথের লোকদের কে কি যেন বলে এলো আমার কর্নারে।
বসতে পারি? বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বসে পড়ল। কেউ আসবে কি? জিজ্ঞাসা করল।
ইদানীং আমি কথা বলতে শিখেছি। বললাম, কেনও আপনার কোন দরকার আছে কি আমার সাথে।
ছিল। চলেন বাহিরে কোথাও যেয়ে ডিনার করি?
বললাম, আমি রাজি।
সে তার বন্ধুদের ইশারায় কি যেন বলল। আমরা বেড়িয়ে এলাম। বসলাম এসে এক রেস্তোরায়। ঘণ্টা দুয়েক ওর সাথে থাকলাম। শুধু কথা। আর কিছু নয়। যাবার সময় বলল, কাল আমার জন্য অপেক্ষা করো।
এরপর আর কারো সাথে আমাকে মিশতে হয়নি। শুধু ওর সাথেই বিভিন্ন রেস্তোরায় গেছি, দেখেছি কনসার্ট।
একদিন সে বলল, তোমার জন্য একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করেছি। এখন থেকে তুমি ওখানে থাকবে। তোমার যাবতীয় খরচ আমার। এ যেন শাপে বর পাওয়া।
এমনি সময় একদিন মার কাছ থেকে ফোন এলো। বলল, খুকি তুই একবার আয়। জরুরী দরকার আছে।
নজীব কে বললাম।
সে তাড়াতাড়ি সব ব্যাবস্থা করে দিলো। আমি পৌছালাম। মা বিছানায় শুয়ে।
বললাম, কি হয়েছে তোমার?
সে একটা কাগজ এগিয়ে দিলো। ডাক্তারের প্যাডে লেখা। শুধু এইটুকু লেখা, রাজধানী তে নিয়ে বড় ডাক্তার দেখান।
পরের দিনই মা কে নিয়ে চলে এলাম। সাথে ভাই টা এলো।
অলক্ষে নজীব ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়েছিল। এলাম ডাক্তারের চেম্বারে। সব দেখে বলল, কয়েকটা টেস্ট করবো। পরশু আসুন সব বলতে পারবো।
দুদিন পরে সময় মতো এসে হাজির হলাম ডাক্তারের চেম্বারে। উনি কাগজ পত্র গুলো সামনে নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বুঝতে পারলাম কঠিন কোন রোগ মার হয়েছে। কিন্তু কি সেটা?
বললেন, তোমার মার ব্রেস্ট ক্যান্সার। শেষ পর্যায়। ছড়িয়ে গেছে সব দিকে। এই পর্যায়ে এদেশে এর চিকিৎসা আছে বলে মনে হয় না। বিদেশে নিলে কি হবে জানিনা।
বাসায় এসে মনটাকে শক্ত করলাম, মা র কাছে এসে পাশে বসলাম। মা যেন সবই জানতো মনে হোল।
বললাম ডাক্তার খুব একটা ভাল কিছু বলে নি।
মা বলল জানি, আমার হাতে খুব একটা সময় নেই। তুই আমার পাশে বস। তোকে কয়েকটা কথা বলি।
মা তাকালও আমার দিকে। হাত দিয়ে কপালের চুল টা সরিয়ে দিলো। চোখের কোণে জ্বল জ্বল করছে পানি।
বলল, খুকি মানুষের বিচার হয় তার মন দিয়ে, কর্ম দিয়ে নয়। তুই আমার কাছে যে খুকি ছিলি সেই খুকিই আছিস।
মনে হোল মা যেন সবই বুঝতে পেরেছিল।
তারপর? অনন্ত আবারও জিজ্ঞাসা করল।
তারপর মা আর বেশীদিন বাচেনি। বলে সুশীলা অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে চোখের পানিটা মুছে নিলো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুশীলা তাকালও অনন্তর দিকে।
বলল,আর একটা কথা আপনাকে না বললেই নয়। আপনার বন্ধুর সাথে দৈহিক কোন সম্পর্ক আমার কোনদিন হয়নি। সে আসে আমার কাছে সময় টা ব্যায় করতে। তার দুঃখের ভাঁড়টা সরিয়ে একদিনের জন্য যদি সুখ দিয়ে থাকি সেটাই আমার বড় পাওনা। তার বাসার খবর আমি কোনদিন নেই নি। নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করিনি।
ওর প্রেমে আপনি পড়েছেন। তাই না? জিজ্ঞাসা ছিল অনন্তের।
আমাদের তো প্রেম করতে নেই। এই বলে সুশীলা বলল, খাবার টা শেষ করুন, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
অনন্ত কাবাব টা মুখে দিয়ে বলল, আপনার কথা আমার মনে থাকবে।

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। অনন্ত তার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।এক সন্ধ্যায় বাসার কাছেই এক রেস্টুরেন্টে আড্ডা সেরে ফেরার পথে ফোন টা বেজে উঠল। নজীবের ফোন। গলার স্বরে কান্নার আভাস।
অনন্ত জিজ্ঞাসা করতেই বলল, সুশীলা চলে গেলো আজ।
কোথায়?
সেই না ফেরার দেশে।
কি বলছিস? অনন্তর গলাটা কান্নায় ভরা।
হাঁ। ক্যান্সারে।আস্তে আস্তে কুড়ে কুড়ে ওকে খেয়েছে। ওর কঙ্কালসার দেহ টা কতবার নিয়ে গেছি ডাক্তারের কাছে, বলেছি, ওকে বাচাও ডাক্তার। ওকে বাচাও।
তোর কথা সে প্রায়ই বলত। দেখতে চেয়েছিল তোকে।
দেখা আর হোল না। আমারই দোষ। তোকে জড়াতে চাইনি এর মাঝে। ভাল থাকিস।
বলে ফোন টা রেখে দিলো।
অনন্ত দাড়িয়ে রইল রাস্তার পাশে। মনে হোল সেই কথা গুলো, মানুষের বিচার হয় তার মন দিয়ে, কর্ম দিয়ে নয়।

Continue Reading

তামান্না সে ও আমি

                         মায়ামি থেকে নিউইয়র্কে আসব। ফ্লাইট ভোর ছয়টায়। আমার Brother-in-Law ভোর চার টায় নামিয়ে দিল এয়ারপোর্টে। সীকুরিটি শেষ করে গেটের কাছে এসে দেখলাম ফ্লাইট দেরীতে ছাড়বে। ঘণ্টা পাচেক পড়ে। নিউইয়র্কে বরফ পড়ছে। প্লেনের কর্মকর্তারা আমরা যারা প্যাসেঞ্জার সবার হাতে দশ ডলারের একটা ভাউচার ধরিয়ে দিয়ে বলল, সরি, এটা দিয়ে আপাতত নাস্তা করে নিন। সময় মত জানাব কখন আমরা রওয়ানা দেবো।

 অগত্যা কফি আর পেস্ট্রি কিনে এনে বসলাম এক কর্নারে।

হঠাৎ ই সামনের দশ নাম্বার গেটের লাউঞ্ছে চোখ পড়তেই অনেক লোকের মাঝে এক জনের মুখটা চেনা মনে হোল ।

সেলিম।

একসময় গাড় বন্ধুত্ত ছিল। সময়ের ব্যাবধানে তাতে মরচে পড়ে গেছে। কিন্তু চিনতে অসুবিধা হোল না। স্মরণশক্তি যে এখন ও প্রখর তাই ভেবে নিজেকে বাহবা দিলাম।

কফি আর পেস্ট্রি টা হাতে, আর ব্যাগপ্যাক টা পিছনে বেঁধে ওর সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। তারপরই উচ্ছ্বাসিত হয়ে দাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরার আগেই বললাম, হলড অন, হলড অন কফিটা পড়ে যাবে।

চিনতে পেরেছিস তাহলে।

না চেনার তো কথা নয়। তোর কপালের ওই দাগ টা তো মার্কা মারা।

সানফ্রান্সীস্কর দিকে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে, ঐখানে থাকা হয় বুঝি?

হা, দেখনা প্লেন তিন ঘণ্টা ডিলে।

তোর তো তিন, আমার আপাতত পাঁচ। চল কোথাও গিয়ে বসি।

আমরা এসে বসলাম একটা নিরিবিলি জাগায়। আমার প্রথম প্রশ্ন, তামান্নাকে দেখছিনা?

ও তাকাল আমার দিকে। ওর চোখের চাহুনী দেখে মনে হোল এই প্রশ্ন আমার এই মুহূর্তে করা উচিৎ হয়নি। তার আগে আরও কিছু ফেলে আসা কথা বলা উচিৎ ছিল। আসলে তামান্নাকে আমিও চিনতাম অনেক কাছ থেকে, হয়ত সেই কারনেই ওর নামটা আমার প্রথমে মনে এসে ছিল। আর শুধু তাই নয়। তামান্না সেলিমের বৌ।

না, আমি একাই এসেছিলাম একটা কনফারীন্সে। আর বলতে কি ও আমার সাথে নেই। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।

ঠিক এই রকম উত্তর পাবো আশা করিনি।

আমি সত্যিই দুঃখিত।

না দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। নয় বছর ঘর করার পর মনে হোল আমরা দুজনে দুই মেরুর। জোড়াতালি দিয়ে তো ঘর করা চলে না। তাই বেড়িয়ে এলাম, তাও তো আজ ছয় বছর হয়ে গেলো।

ভালোবেসে তো বিয়ে করেছিলি। তাহলে?

বিয়ের আগের ভালবাসা আর বিয়ের পরের ভালবাসার মাঝে পার্থক অনেক। বোঝা দায়। তোর কি মনে হয়।

আমিতো ঐ পথে পা বাড়াই নি বন্ধু।

এখনো ব্যাচেলার।

হাঁ।  তোর কথা বল, বাধন ছিড়ে গেলো কেনও?

তবে শোন, তুই তো আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলি তামান্নার সাথে।

মনে পড়ে তোর, ক্যান্টিনে বসে তোরা দুজন চা নাস্তা খাচ্ছিলি। আমাকে দেখে ডাক দিয়ে বসতে বললি তোদের টেবিলে। সেই প্রথম তামান্নাকে আমি দেখি। তুই পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললি, তামান্না, ইকনমিক্সে মেজর।

মনে পড়ে?

পড়বে বৈকি। কিছুক্ষণ পর তামান্না উঠে চলে গেল। ওর ক্লাস আছে। তুই বলেছিলি, এই শমিত, লাইন লাগিয়ে দিবি আমার সাথে। প্রথম দেখায় প্রেম। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলি, আমার সাথে কি ধরনের সম্পর্ক। বলেছিলাম, সে আমার বান্ধবী, এতটুকুই। তুই চাইলে প্রেম সম্পর্কিত সম্পর্ক গড়তে পারিস।

তারপর তুই চলে গেলি নেপথ্য।

পরের দিন আমি দাঁড়িয়েছিলাম ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টের সামনে। তামান্না বেড়িয়ে আসতেই বলেছিলাম, শমিত আসতে  পারলনা, ও একটু কাজে ব্যস্ত, (পুরো টাই বানান।) যদি কিছু মনে না করেন, ক্যান্টিনে বসতে পারি কি  চা খেতে। তামান্না   আপত্তি করে নি। তুই তো জানিস, তোর মতো, মেয়েদের সাথে অনর্গল কথা বলার মতো চৌকস আমি নই।

একটু বারিয়ে বলছিস। তাই যদি হবে, তবে আজও শিকে ছিঁড়ল না কেনও?

তার বিশ্লেষণ আজ আমি করবো না। সেটা তোর নিজেস্ব ব্যাপার। তবে সেদিন রুমাল দিয়ে বার বার ঘাম মুছতে দেখে তামান্না জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার শরীর ভাল তো?

হাঁ, সে খবর আমার কাছে এসেছিল।

মানে?

মানে তামান্না আমাকে বলেছিল, তোমার বন্ধু একটু নার্ভাস সবকিছুতে । তাই না?

বলেছিলাম, তা হয়তো হবে, তবে মনটাই আসল। ঠকবে না।

সে কথা তো তুই আগে আমাকে বলিস নি।

ইচ্ছে করেই বলিনি, তাতে তোর নার্ভাসনেস টা আরও বেড়ে যেতো। মেয়েরা নার্ভাস প্রকৃতির ছেলেদের কে মোটেই পছন্দ করে না।

না আর মুছতে হয়নি। নার্ভাসনেস কেটে গেছে। আমরা দুজন কখন ক্যান্টিনে, কখন ইগলু তে বসেছি। কথা বলেছি, যার কোন মাথা মুণ্ডু নেই। তামান্নাই বলত বেশি। তুই মাঝে মাঝে এসে যোগ দিতি। আজ বলতে বাধা নেই, আমি চাইতাম না তুই আমাদের সময়টাতে ভাগ বসাস।  বলতে পারিস এটা একরকম সেলফীস্নেস। এটাই স্বাভাবিক। প্রেমের রাজ্যে দুজনের মাঝে তৃতীয় জনের ঠাই নাই। তুই বুঝতে পারতিস কিনা জানিনা। তবে আমার মনে হতো, তোকে বলি, বন্ধু, এবার কেটে পরো।

কেটে আমি পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্ত তামান্না আমাকে চলে যেতে দেই নি।

কি বলছিস?

আজতো বলতে বাধা নেই, তামান্না তোরা কোথায় কখন বসবি, আমাকে জানাত। না করলে বলত, তুমি এলে আমার আর সেলিমের সম্পর্কে কোন ঘুন ধরবে না। আমি চাই তুমি এসো। বরং তুমি ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করবে। আর তাছাড়া আমি দেখতে চাই সেলিমের মনে কোন সন্দেহ জাগে কিনা। যদি না জাগে তবে বুজব সে সত্যিই আমাকে ভালবাসে।

বাহ, এই পরীক্ষার কথা তো আমার জানা নেই। তবে তোকে এইটুকু বলতে পারি, ওকে সত্যিই আমি ভালবেসেছিলাম। আপাতদৃষ্টিতে মনে না করার কোন উপায় ছিলনা যে সে আমাকে ভালবাসে না। শুধু একটা ছবি—- যত নষ্টের মুল।

ছবি?

হা, ছবি। ছবি টা ছিল আমার আর রাবেয়ার।

রাবেয়া? রাবেয়া কে?

রাবেয়া আমার স্কুল জীবনের একজন। সে আর এক কাহিনী।

তখন বয়স আমার ১৫ কি ১৬। আমাদের বাসার সামনে রাস্তা। রাস্তা পেড়িয়ে এক শান বাধানো পুকুর। পাশে কৃষ্ণচুড়া গাছ।  ঐ রাস্তা দিয়ে আমি প্রতিদিনই আসা যাওয়া করি, কিন্তু সেদিন আমাদের বাড়ীর গেটের দরজা খুলে বের হতেই চোখ পড়ল পুকুরের দিকে। একটা মেয়ে। সিঁড়ির পাড়ে দাঁড়ানো। চিনতে পারলাম না। কে সে? চোখে চোখ হোল।

মেয়েটা সরে এসে কৃষ্ণচুড়া গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল।  তাকাল আর একবার। পরক্ষনে সরে যেয়ে দাঁড়াল সে পুকুরের সিঁড়িতে। আস্তে আস্তে নেমে গেলো পানিতে।  আমি দাড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ষোল বছরের শরীরের রক্তে ঢেউ খেলে উঠল।

বাহ,বাহ! এতো সিনেমার প্রথম পর্ব। তারপর? তা সেই ফটোর সাথে কি সম্পর্ক?

আহা, বলছি। পরের দিন একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমার মনে হোল আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি। এবং দৃঢ় ধারনা হোল সেও আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু কে সে সেটাই জানা হোল না।

এই বয়সে এই ঘটনা নিজের মাঝে চেপে রাখা সহজ নয়। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কে বললাম। সে সব বিষয়ে তুখর।

বলল, চল আমি দেখছি।

পরদিন, সে ঘাটের সিঁড়ির পরে বসা। আমাদের দুজন কে এক সাথে দেখে সে আর পানিতে নামলো না। সোজা চলে গেলো ঘাট ছেড়ে উলটো দিকে।

আমার বন্ধু চিনে ফেলেছে। বলল, ও তো শফিকদের বাসাতে থাকে, শফিকের মামাতো বোন। চল, আজ শফিকদের বাসাতে যাবো। ওদের বাসার সামনে ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। ব্যাডমিন্টন খেলতে এসেছি বলে শফিককে ডাক দেবো, এবং ওদের বাসাতে ঢুকে পরবো। এই তার পরিকল্পনা।

মাথা খারাপ। আমার দাড়া হবে না। বলে আমি হাটতে আরম্ভ করলাম।

বন্ধু টি খেপে গেলো। বলল, তবে প্রেম করতে এসেছ কেনও। প্রেম করতে হলে অনেক কাঁটার আঁচড় খেতে হবে।

মনে হোল সে জীবনে অনেক বার এপথ মাড়িয়েছে।

সাহস করে বললাম, ঠিক আছে।

যেই কথা সেই কাজ। আমরা বিকেলে এসে হাজির হলাম শফিকের বাসায়। ডাক দিতেই সে বেড়িয়ে এলো।

বন্ধুটি বলল, কিরে বাহিরে দাড় করিয়ে রাখবি না ভেতরে বসাবি।

শফিক নিয়ে এলো ভিতরে। ঢুকতেই দেখি মেয়ে টি বাহিরে শুকনো কাপড় গুলো উঠাচ্ছে। তাকাল সে। আমার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।

সেই বয়স থেকেই তোমার নার্ভাসনেস।

আসলেই তাই। সে তাকাল আমার দিকে। বিশ্বাস হচ্ছে না তার, আমি আসতে পারি ওদের বাসাতে।

দ্রুত ঢুকে গেলো সে ঘরের ভিতর।

বন্ধু টি ওর নাম টা জেনে নিলো।

বলল, আজই একটা চিঠি লেখে ফেলবি। আমি ওর হাতে পৌছে দেবার বন্দোবস্ত করব।

চিঠি, আমি লিখব চিঠি। তাও প্রেমপত্র।

প্রেম করবা আর প্রেমপত্র লিখতে পারবে না।

লিখে ছিলি তুই?

হা, লিখেছিলাম। শুধু তাই নয়। আমার বন্ধু টি শফিকের মাধ্যমে পৌছিয়ে দিয়ে ছিল। তার উত্তর অবশ্য আমি পাই নি। পরিবর্তে একদিন বন্ধুটি বলল, আগামীকাল বিকেলে আমার বাসায় আসবি।

কেন?

সে কথা পরে হবে।

বিকেলে পৌছে দরজায় টোকা দিতেই শফিক এসে দরজা খুলে দিলো। ওকে দেখে আমি অবাক। তাকিয়ে দেখি ড্রয়াং রুমে রাবেয়া বসা।

তুই আমার অবস্থা বুজতে পারছিস।

হাঁ, তা পারছি।

শফিক হঠাৎ করে কোথায় চলে গেলো। বন্ধুটির কোন পাত্তা নেই।

সেদিন কি কথা হয়েছিল আজ আর তা মনে নেই। শুধু এই টুকু মনে পরে রাবেয়া বলেছিল, সামনের মাসে সে গ্রামের বাড়ীতে চলে যাবে। তার বাবা আর তাকে এখানে রাখবে না।

সেই কথা শুনে ষোল বছরের প্রেম গুমরে উঠল। হঠাৎ বলেছিলাম, চল আমরা একটা ফটো উঠিয়ে রাখব।

 ও অবিশ্বাসও দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকাল। ঠিক সেই সময় আমার বন্ধুটি এসে হাজির।

ওকে বলতেই, বলল, এ একটা ব্যাপার। চল আমরা চারজন মিলে মিল্টনের স্টুডিওতে ফটো উঠাব।

বললাম, চারজন কেন?

সে বলল, দুজন মিলে উঠালে এই ছোট্ট শহরে ঢি ঢি পরে যাবে। চল।

আগে পিছে করে এলাম স্টুডিওতে।

চারজন বসলাম। ওরা দুজন বসল দুই দিকে একটু ব্যবধান রেখে।

ফটো তোলা শেষ। রেবেয়া চলে গেলো। সেই শেষ দেখা।

তারপর? সেই ফটো?

চারদিন পর বন্ধুটি নিয়ে এলো ফটো টা আমার বাড়ীতে। বললও, একটা কেঁচি নিয়ে আয়।

কেঁচি কেন?

যা বলছি তাই শোন।

নিয়ে এলাম। ও ছবি টা বের করলো। দুই দিক থেকে ওর আর শফিকের ছবি কেটে বাদ দিয়ে আমাকে আমাদের দুজনের ছবিটা দিয়ে বলল, এবার বুকের মাঝে রেখে দাও।

এই ছবিই সেই ছবি?

হা। কেন এই ছবি আমার অনেক অনেক পুরানো এ্যালবামে রয়ে গিয়েছিল আমি নিজেও জানি না।

তামান্না সেই ছবি পেয়ে প্রশ্নের পরে প্রশ্ন। যতই বোঝানোর চেষ্টা করি সে বুঝতে নারাজ। আস্তে আস্তে সন্ধেহের বাতীক দেখা দিল তার মধ্যে। তুই তো জানিস সন্দেহ একটা রোগ। এ যদি একবার কারো মাঝে বাসা বাধে তবে তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ নয়। আমারও ভাগ্যে তাই হোল।

আমি কলেজের প্রফেসর। সেই সুবাদে কত মেয়েই আসে আমার কাছে প্রশ্ন নিয়ে। তারই খেসারত আমাকে দিতে হয়। সন্দেহ প্রবন মন। সবকিছুতেই সন্দেহ। সেটা চরমে উঠল যে দিন অলকা এসে বেল বাজিয়ে ছিল আমাদের বাসায়।

অলকা কে?

আমার ছাত্রী।

কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই দেখি অলকা। কি ব্যাপার ?  জিজ্ঞাসা করতেই বলল, কাল আমার এনগেজমেন্ট। আপনি আর ভাবী অবশ্যই আসবেন। বলেই যে রিক্সায় এসেছিল, তাতে করেই চলে গেল।

কখন যে তামান্না আসে পাশে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি।

জিজ্ঞাসা করল মেয়ে টি কে?

বললাম।

মনে হোলনা  সে বিশ্বাস করেছে। বলল, মেয়েটি আমাকে কিছু না বলে চলে গেলো যে।

বললাম, হয়ত তাড়া আছে। অথবা ভেবেছে একজন কে বললেই যথেষ্ট।

সে কথা সে শুনতে রাজি নয়। এরপর আমাদের মধ্যে যে ধরণের কথোপকথন হয়েছিল তা আমার মাঝেই থাক।

সেই শেষ। আর নয়। বুঝলাম এবার বিচ্ছিন্ন হবার পালা। আমাদের দুজনের দুটিপথ দু দিকে বাক নেওয়াই ভাল।

কিছুক্ষণ আমরা দুজনেই নীরব।

নীরবতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করলাম, বেল তলায় আবার গিয়েছিস কি?

হাঁ, গিয়েছি।

ঠিক সেই মুহূর্তে এনাউসমেন্ট হোল, সানফ্রানসীস্ক যাওয়ার যাত্রীদের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বোর্ডিং এর জন্য ডাকা হবে।

বিদায় নিয়ে উঠে দাড়ালাম। এক দু পা এগোলাম। সেলিম ডাক দিল পিছন থেকে।

ফিরে এলাম।

সেলিমের চোখটা মাছের চোখের মত ঘোলাটে মনে হোল। সে চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মনে হোল যেন ঝরের পূর্বাভাস।

আমিই বললাম, কিছু বলবি?

হা। খুব কর্কশ গলায় বলল,  তুই জানতিস তামান্না তোকে ভালবাসে। তাইনা?

না, আমি জানিনা, আমি জানতাম না ? বলে ওর গম্ভীর মুখের দিকে তাকালাম।

তাহলে শোন, তামান্না কোনদিনই আমাকে ভালোবাসেনি। ভালবেসেছিল তোকে। আমার মাঝে তোকে দেখতে পেতো সে রাতের অন্ধকারে। তাইতো আলো জ্বলতেই আলুথালু বেসে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতো আমাকে। নয়টা বছর আমি তোর হয়ে শুধু প্রক্সী দিয়েছি। তুই এই খেলা না খেললেও পারতিস।

এই বলে সে এগিয়ে যেয়ে লাইনে দাঁড়াল।

আস্তে আস্তে গেট পেরিয়ে চলে গেলো চোখের আড়ালে । পিছন ফিরে তাকালো না।

আমি কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। কানে শুধু বাজতে থাকলো একটি কথা,

আমি শুধু প্রক্সীই দিয়ে গেলাম, নটি বছর শুধু প্রক্সীই দিয়ে গেলাম।

Continue Reading
1 2 3 8