একটা ভ্রমন কাহিনী ৩
স্কোয়ার দেখব,দেখব সেই বিখ্যাত বাজার। তাইতো ক্লান্তিকে তুচ্ছ করে আমরা ঠিক তিন টার সময় বেড়িয়ে পড়েছিলাম। সবাই ক্ষুধার্ত। ইব্রাহিম জিজ্ঞাসা করেছিল, ঠিক মতো যেতে পারবে তো স্কোয়ারে?
বলে ছিলাম বেড়িয়ে ডানে, একটু এগিয়ে আবার ডানে মোড়, তারপর বায়ে, শেষ মাথায় যেয়ে আবার বায়ে মোড় নিলে স্কোয়ারের যাওয়ার রাস্তায় উঠে যাবো। ঠিক বলিনি? সে হেসে বলেছিল, সব ঠিক আছে।
সেদিন তোমরা তাড়াতাড়িই সেজে নিয়ে ছিলে।
তোমার পরনে সাদা কামিজ,কালোর উপর সাদা নক্সা করা সালওয়ার। মাথায় অফ হোয়াইট দোপাট্টা।
শম্পা পড়েছে ম্যাজেন্টা রঙের টপস, কালোর উপর ফুলফুল আঁকা প্যান্ট, মাথায় পীঙ্ক রঙএর হেড ব্যান্ড, চোখে ডিজাইনার সানগ্লাস। ভাবীর পরনে নানা রঙ এর সমারহে বানানো কামিজ আর কচি কলাপাতা রঙের সালওয়ার। মাথা ডেকেছে লাল ওড়না দিয়ে। তোমাদের সবাই কে সত্যিই অপূর্ব লাগছিল।
এতোও তোমার মনে থাকে? এবার আমি বলি। ভুল হলে শুধরে দিও।
এসে দাঁড়ালাম রাস্তা যেখানে এসে শেষ হয়ে গেল। Jemaa-el- Fnaa. The square. বিখ্যাত মার্কেট প্লেস মারাকাসের। খালি আকাশের নিচে ব্যবসাদাররা বসেছে তাদের মালা মাল নিয়ে। কানের দুল, গলার মালা। আছে ফলের রসের দোকান। আমি, শম্পা আর ভাবী চেয়েছিলাম আম,ডালিম আর কমলা দিয়ে বানানো রস।
তুমি কেন যে খেলেনা, শুধু শম্পার থেকে এক সিপ নিয়ে ছিলে। বলে ছিলে আগে দুপুরের খাওয়া তারপর এইসব।
সূর্য মাথার উপর থেকে সরে এসেছে। সহ্য করার মতো রৌদ্রের তাপ। দূরে দেখা যাচ্ছে কুতুবীয়া মসজিদ। দুপুরের তাপের মাঝেও অনেক লোকের আগমন। আমরা এসে বসলাম রেস্টুরেন্ট সেগ্রনীতে। দোতালায়। চারিদিক খোলা। বাজারের দিকে মুখ করে। মাথার উপরে ছাতি।
সজন ভাই ভোজন প্রিয়। অনেকক্ষণ ধরে মেন্যুটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। ওয়াটার এসে মীন্ট চা দিয়ে গেলো। মীন্ট চা হচ্ছে মরক্কান দের কালচারের সাথে জড়িত। তা তুমি কসমোপলিটান কাসাব্ল্যাংকাতে যাও অথবা অ্যাটলাস পাহাড়ের বারবার ভীলেজে যাও। শুধু একটি মাত্র দ্রুব সত্য the tea is served.
চা বানানোর প্রক্রিয়া বিভিন্ন জাগায় বিভিন্ন রকম, কিন্তু ভেতরের মালমসলা এক। green tea, mint leaves and sugar.
সজন ভাই বলল, কি খাবে?
তুমি বলেছিলে Tagine, শুনে এসে ছিলে তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে।
বীফ Tagine, চিকেন Tagine, ল্যাম্ব Tagine, সাথে থাকে তরিতরকারি। যেমন carrot, beans, peas.
রান্না করে মাটির পাত্রে উপরে লম্বা cone shaped এর ঢাকনা দিয়ে।
আমরা তিন রকমের খাবার আনতে বলেছিলাম। তোমরা বেশ পছন্দ করেই খেয়েছিলে।
খাওয়া শেষে নামে এলাম রাস্তায়। পড়ন্ত বিকেল। লোকের ভিড় বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে বিভিন্ন ধরণের স্টল।
কেউ দেখাচ্ছে জাদুর খেলা। কেউবা পাশে ঘুর ঘুর করে ঘুরে বলছে, নেবেন স্যার, এই হ্যাট টা। ১০০ দেরহাম।
শম্পা কে পেয়ে বসলো লোকটা। হ্যাটটা ওর মাথায় চাপিয়ে দিয়ে বলল, কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে।
বললাম, না শম্পা মোটেও ভাল দেখাচ্ছেনা। দাড়াও তোমার ছবি উঠাই ওর সাথে, মাথায় হ্যাট পরে।
এ এক আজব জায়গা। ছবি উঠিয়েছি তার সাথে, ওর চেহারা তো patent করা। বিনে পয়সায় কিছু হয় না এখানে। ওর সাথে ছবি উঠানোর খেসারত দিতে হোল। খসে গেলো দশ দেরহাম।
একটু এগিয়ে যেতেই দেখা গেলো সাপুড়ে তিনটা অজগর সাপ নিয়ে বসে আছে। খেলা দেখাবে পয়সা দিলে। তুমি, ভাবী ভয়ে চলে গেলে অন্য দিকে। আমি আর শম্পা এগিয়ে গেলাম। একজন একটা সাপ নিয়ে এলো। বলল, গলায় ঝুলিয়ে দিলে ৩০ দেরহাম দিতে হবে। বললাম, না, শুধু ছবি উঠাব। তাহলে ১০ দেরহাম। ওতেই রাজি আমরা। আমি, শম্পা আর অজগর সাপ।
বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা এলো। আলো জ্বলে উঠলো চারিদিকে। সাপুড়ে মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে। চারিদিকে আলোর মেলা।
ছোট্ট মেয়েটা তার হাতের খেলনা টা আকাশে ছুড়ে দিল। বিভিন্ন আলোর রঙয়ে রঞ্জিত হয়ে সে ফিরে এলো মাটিতে।
এগিয়ে এলো সে তোমার আর ভাবীর কাছে।
নেবেন, নেবেন ম্যদাম। সে পাঁচটা উরন্ত খেলনার দাম চাইল ২০ দেরহাম। শম্পা এগিয়ে এলো। বলল, আমারও ওটা চাই ।
ইব্রাহীম বলে দিয়েছিল, দরাদরি করবে। যা চাইবে তার চার ভাগের এক ভাগ দাম বলবে।
আমরা কিন্তু পাঁচ দেরহামে নিয়েছিলাম পাঁচটা। মনে পরে? মনে পরে ঐ মেয়েটা, যে কি না হেনা লাগাচ্ছিল মেয়েদের হাতে। আমাকে বলেছিল, হাতটা দাও, হেনা দিয়ে এঁকে দেবো ফুলের বাগান তোমার হাতে। পাশে থেকে একটা ছেলে তোমাকে বলেছিল, পানি খাবে? তুমি তাকিয়ে ছিলে ওর পরনের চোখ জুড়ান পোশাকের দিকে। হাতে তার চামড়ার পাউচে পানি।
তোমাকে অনেক সেধে ছিল। তুমি ঐ পানি খাওনি।
বাজারের মাঝখানে শুঁখানো ফলের স্টল। আপ্রীকট, কলা, চিনির আবরনে মোড়া বাদাম, আরও কত কি।
বাজারের শেষ প্রান্তে কুতুবীয়া মসজিদ মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে। ১১ শতাব্দীতে বানানো। মসজিদের মাথার উপর তিনটা সোনার বল। কথিত আছে, সাদীয়ান সুলতান আহমেদ এল মানসুর এর মা এই সোনার বল গুলো দিয়ে ছিলেন।
মসজিদের চারিদিকে হাটা পথ, সুন্দর পরে ছাটা বাগান।
সজন ভাই বলেছিল, আমরা একদিন এই মসজিদে নামাজ পড়ব।
উত্তর পশ্চিম কোণে বিভিন্ন জামা কাপড়, খেলনা সরঞ্জামের দোকান। লোকের ভিড় ওদিকেও কম নয়। আমরা হাটতে হাটতে গেলাম ঐ কর্নারে। ভাবী আমার কানে কানে এসে বলেছি্ল, আমার কিন্তু খুব কেনাকাটা করতে ইচ্ছা করছে।
তুমি ভাবী কে বলেছিলে, আজ নয়। আজ আমরা সবাই ক্লান্ত। রাত এখন নয়টা। কাল ভোর সাতটায় মুস্তাফা আসবে আমাদের কে নিতে। রুমে ফিরে আমাদের বিশ্রাম আর ঘুমানো উচিৎ। কি বলেন?
আমরা রাজি হয়ে ছিলাম। সাহারায় যেতে পথে একরাত কাটাতে হবে। আর এক রাত কাটাব খোলা আকাশের নিচে।
আমরা ফিরে এলাম।
তোমার ফোন বাজছে?
হাঁ। আমার বান্ধবী কল করেছে।
তাহলে কি চলে যাবে?
না, ওখানে পরে গেলেও কিছু হবে না। তোমার সান্নিধ্য আবার কবে পাবো জানি না। ভাল লাগছে পুরানো দিনের গল্প করতে।
তারপর ?
তারপর শম্পা চলে গেলে আমাদের রুমে। ভাবী আর ভাই তাদের দরজা বন্ধ করে দিল।
তুমি আর আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি পেড়িয়ে রুফ টপে এসে বসলাম।
দূরে আলোয় ঝলমল করা বাজার টা দেখা যাচ্ছে। আকাশে তারার ঝিকিমিকি। আধা চাঁদের আলো তোমার শরীরে মাখা।
তুমি গুনগুণ করে গাইছিলে, —“-আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে– আমি তাইতে কি ভয় মানি! জানি জানি, বন্ধু, জানি– তোমার আছে তো হাতখানি”.
তুমি তাকালে আমার দিকে। জানি তুমি আমাকে দেখছ না, দেখছ অনেক দূরে ফেলে আসা সেই মুখ খানি।
একটা ভ্রমন কাহিনী ২
আচ্ছা সমীতা তুমি তো কফি খেতে না, চা ছিল তোমার প্রিয়। কবে থেকে এই পরিবর্তন? ঐ টেকো মাথাটা —
না তুমি যা ভাবছ তা নয়। তবে চা খাওয়া ছেড়ে দেইনি, কফি হলে মন্দ হয়না। তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি। সেই মারাকাসের পথে তুমি খুজে খুজে চার কাপ কফি আর একটা চা র অর্ডার দিতে। আর দোকানদার কে বলতে দুই পাতা দেবে।
হায়রে!
এখন বল, প্লেনে উঠার পর কি হোল। স্মৃতির পাতাটা একটু ঝালিয়ে নেই। আমার নিজের কথা খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।
তুমি জানালার পাশে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে। মাঝে মাঝে একটু অস্বাভাবিক শব্দ কানে আসছিল। পাত্তা দেই নি।
শম্পা আমাকে খোঁচা দিয়ে বলল, শুনতে পাচ্ছ?
হেসে বললাম,সহ্য করতে শেখ।
শম্পার ডাকে আমি জেগে উঠেছিলাম। ক্যাবিন ক্রু রাতের খাবার দিয়ে গেছে। পিছন ফিরে ভাবী আর ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, খাবার খাওয়া যাবে তো? উত্তরে ভাবী তার স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বলল, খাওয়া যাবে।
তুমি অবশ্য চেটে পুটে সব শেষ করেছিলে। শম্পাও কম যায়নি। খাওয়া শেষে রেস্টরুমে যাবে বলে সেই যে গেলে, ফিরে আসার সময় পেড়িয়ে গেলো , তুমি এলেনা, আমি আর শম্পা দুজনেই উদগ্রীব। শম্পা আমাকে বলল, একটু দেখে আসবে ওর কি হোল।
আমি সামনে এসে দেখলাম তুমি একটা খালি জাগা পেয়ে শুয়ে পড়েছ। তোমাকে ডিস্টার্ব না করে আমি ফিরে এলাম, শম্পা কে বললাম তুমিও শুয়ে পরো। পা টা উঠিয়ে দেও আমার কোলে। পিছনে ভাবী তার ছোট্ট শরীর টা গুটিয়ে নিয়েছে দুটো সীটের মাঝখানে। সজন ভাইয়ের চোখ বন্ধ।
ভোর নয়টায় আমরা আসে নামলাম কাসাব্ল্যাংকাতে। বাহিরে তাপমাত্রা ৭৫ ডিক্রি ফারেনহাইট। তুমি তোমার গায়ের সোয়েটার টা ছোট সুটকেসে ঢুকিয়ে নিলে। শম্পা তার কাপড়ের ব্যাগ টা কাধে নিলো। আমার কাধে একটা ব্যাগপ্যাক। ভাবীর হাতে ব্যাথা। বললাম আপনার সুটকেস টানতে হবে না আমার হাত খালি।
কাসাব্ল্যাংকা থেকে আমরা যাব মারাকাশে। একঘণ্টার পথ বিমানে। বিমান বন্দরের গরিবিয়ানা হাবটা চোখে পড়ল। তুমি বলেছিলে বিমান বন্দরটা দেখতে আমাদের ঢাকার বিমান বন্দরের মত।
সত্যি বলিনি ?
সত্যি বলেছিলে। আমরা ভিতর দিয়ে হেটে এসে আভ্যন্তরীণ বিমান বন্দরের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে পৌছালাম। গোটা বিশ জন লোক বসা। ছোট্ট একটা দোকান এক কর্নারে। মনে হচ্ছে যেঁ কোন সময় সেটা মুখ থুবড়ে পরে যাবে। মলিন পরিবেশ। শুধু দোকান টাই নয় পুরো লাউঞ্ছ টাই। প্লেনে পানি খাওয়া হয়নি বলে এক বোতল পানি কিনতে গেলাম। দোকানের কর্মচারী ইংরাজি জানেনা। হাত দিয়ে ছোট পানির বোতল দেখালাম। পকেটে মরক্কোর দেহ্রাম নেই। ডলার দেখাতেই দুই ডলার চাইলো। অগত্যা, কিছু করার নেই। বাহিরে এসে তোঁ তুমি দেখেছিলে বড় বোতল দশ দেহ্রামে পাওয়া যায়।
কনভার্সন যেন কত ছিল।
এক ডলারে সাড়ে নয় দেহ্রাম । ও বেটা আমার কাছ থেকে খসিয়ে নিয়েছে।
কিছু করার নেই। তোমার চেহারায় আমেরিকান ছাপ ছিল। ওর দোষ নেই।
ইয়ার্কি পেয়েছ?
ইয়ার্কি করবো কেনও। তারপর। বলও
শম্পা কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ভাই আর ভাবীর চেহারায় ক্লান্তির ছায়া। বিমান ছাড়বে এগারোটায়।
এবারো কিন্তু আমি জানালার ধারেই বসে ছিলাম। একঘণ্টার পথ। দেখতে না দেখতে আমরা আসে পৌছালাম মারাকাস ইন্টারন্যাশনাল বিমান বন্দরে। তুমি বলেছিলে, দেখো, কি সুন্দর দেখতে, মনে হচ্ছে নতুন তৈরি করেছে। দেয়ালের চারিদিকে বড় বড় নাম করা কোম্পানির বিজ্ঞাপন। আলোয় আলোকিত। ভাবী একটু পিছিয়ে পড়তেই তুমি উনার হাতের ব্যাগ টা তোমার হাতে নিয়ে নিলে। আমরা এসে দাঁড়ালাম পাসপোর্ট কন্ট্রোলের লাইনে।
বাহ ! খুব সুন্দর ভাবে কাহিনী টাকে এগিয়ে নিচ্ছ। বলে যাও। তার আগে ওয়েটার কে বলি দুটো রেড ভেলভেট কেক আর দুই কাপ কফি দিতে।
কয় কাপ হোল মনে আছে?
আজ আর মনে করতে চাইনা। এই ক্ষণ আবার আসবে কিনা জানিনা। রবি ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে তার সেই গানটা আমার মতো করে বলি, আজ তোমারে দেখতে পেলেম অনেক দিনের পরে। ভয় করোনা সুখে থাকো অনেকক্ষণ থাকবো আরও—–, হাসছ কেন?
একেবারে পাল্টাও নি তুমি।
পাল্টিয়েছি, তুমি দেখতে পাওনি। এবার বলও, তারপর?
না, এবার তোমার পালা।
তোমরা সবাই একে একে পাড় হয়ে গেলে পাসপোর্টের উপর ছাপছুপ নিয়ে। আমি এসে দাঁড়ালাম কাউন্টারে। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল বোর্ডিং পাসের ছেড়া টুকরা টা দেখাও। আমি কাসাব্ল্যাংকা থেকে মারাকাসের ছেড়া টুকরা টা দিলাম।
সে বলল, এটা নয় নিউইয়র্ক থেকে কাসাব্ল্যাংকা টা চাই। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তন্য তন্য করে সব পকেট খুজলাম। কোথাও নেই। বললাম, পাচ্ছি না।
সে বলল, ওটা লাগবে।
বিদেশ বিভুয়ে একি ঝামেলা। ভাবলাম, ওটা হয়তো আমি সীটের সামনের পকেটে রেখে এসেছি। তাহলে। করুন দৃষ্টিতেঁ তাকালাম ওর দিকে। ওতে ওর মন গল্লো না।
হঠাৎ ই কি মনে করে মানিব্যাগ টা বের করলাম। দেখলাম মানিব্যাগের কোনায় 35C লেখা কাগজটা জ্বলজ্বল করছে।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
তোমাদের কাছে আসতেই তুমি বললে,কি হয়েছিল?
বললাম ঘটনা টা।
আর আমি বলেছিলাম, বোর্ডিং পাস সব সময় কাছে রাখতে হয়। ফেলতে নেই।
হা, মনে আছে তোমার লেকচার। তারপর আমরা লাগেজ গুলো নিয়ে বেড়িয়ে এলাম বাহিরে। RIAD ANDALLAর গাড়ীর ড্রাইভার আমার নাম লিখে বাহিরে দাড়িয়ে থাকার কথা।
তুমি তাকে না দেখে অস্থির হয়ে উঠলে। এটা তোমার মজ্জাগত। ধৈর্য তোমার সব সময় কম। আমি বলেছিলাম, এখানে কোথাও আছে। অনেক লোকের ভিড়। আমাদের চোখে পড়ছে না।
হাঁ, পরে দেখলাম, আমার নাম নয়, ওদের হোটেলের নাম লেখা একজন দাড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই সে এগিয়ে এলো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজিতে বলল ওকে অনুসরণ করতে।
মাইক্রোবাস, এয়ারকন্ডিশন নেই। বাহিরে গরম। ড্রাইভার ইংরাজি জানেনা। তাতে আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। আমরা দেখছি বাহিরের খোলা মাঠ। মাঝে মাঝে খেজুর গাছের সারি। সূর্যের আলো এসে পড়েছে কাচা পাকা খেজুরের থোকার মাঝে। সোনালী আলোয় ঝলমল করছে।
আধা ঘণ্টার পথ। হাইওয়ে ছাড়িয়ে আমরা এসে পড়লাম শহরের মাঝে। আমাদের হোটেল ( হোটেল নয় বলে Riad) মদিনাতে। তোমাকে আমি প্লেনে বলেছিলাম আমরা থাকবো মদিনাতে। তুমি অবিশ্বাসের মতো আমার দিকে চেয়ে বলেছিলে, তুমি মরক্কো যাচ্ছ না সৌদী আরবে। আমি বলেছিলাম, এই মদিনা সেই মদিনা নয়। এ হচ্ছে পুরানো দেয়ালে ঘেরা এক শহর যেখানে আছে সব রকমের আকর্ষণীয় বস্তু। এখানে দেখবে সাপের খেলা, দেখবে বড় বড় মসজিদ। আমরা থাকবো ঠিক এইসবের মাঝে। আমাদের RIAD আকর্ষণীয় বাজার Djemaa el Fna র কাছে।
তুমি আমাকে Riad কি ব্যাখ্যা করনি। বলেছিলে পরে করবে। আমাদের গাড়ী বড় রাস্তা পেরিয়ে গলির ভিতর এলো। এরকম গলি আমি পুরানো ঢাকাতে দেখেছি। সজন ভাই বলল, কোন হোটেল তো দেখছি না। আমাদেরকে ঠিক জাগায় নিয়ে এসেছে তো।
গলিতে সব দোতালা তিনতালা বাড়ী। এখানে হোটেল কোথায়? আমরা দেখে এসেছি হোটেল সেরাটন, দেখেছি হলিডে ইন। এতো ঠাঠারি বাজার। আমি তোমার দিকে তাকালাম। মনে হোল তুমি ও যেন কি খুজছো। ড্রাইভার এক গলির পাশে নামিয়ে দিলো। Riad Andalla বলে কোন নামের চিহ্ন কোথাও দেখলাম না। তুমি ড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করলে ,”এ কোথায় নামালে”। ভুলে গিয়েছিলে সে ইংরাজি জানেনা। সেই মুহূর্তে এক মহিলাকে হন্তদন্ত করে এগিয়ে আসতে দেখলাম । আমাদের নামানো একটা সুটকেস হাতে নিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে তাকে অনুসরণ করতে বলল।
এবড়ো থেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে ছোট্ট চিপা গলিতে এসে পড়লাম। একটু এগিয়ে ডানে মোড় নিয়ে আর একটা গলিতে ঢুকলাম। আমার চিন্তা লুই ভাটনের ক্যারীঅন টা নিয়ে। ওর চাকা গুলো ঘজ ঘজ শব্দ করছে মনে হোল।
তোমার চেহারায় তা ফুটে উঠেছিল। আমাদের কে আর একটা বাকও নিতে হয়েছিল। আমরা এসে দাঁড়ালাম Riad Andalla র সামনে।
লোহার দরজা খুলে গেলো। হ্যালো বলে অভ্যর্থনা জানাল ইব্রাহিম। তখনি তোমাকে আমি বলেছিলাম, এই দেখো Riad। এটা হোটেল নয়, মরক্কোর ট্র্যাডিশনাল বাসা। এই বাসা তিন থেকে চার তালার বেশি হয় না। আমাদের টা তিনতলা।
সাধারণত এর মাঝ খানে পানির ফোয়ারা আর ফুলের ঝার থাকে। আমাদের Riad টা অতো বড় না হওয়াতে ওরা উঠান টাকে বসার জাগা করেছে। Riad দে জানালা বাহিরের দিকে থাকে না। তুমি দেখছ সব ঘরের জানালা ভিতরের দিকে। উঠানের দিকে মুখ করে। আমার খুব ভাল লেগেছিল। শুধু আমার নয়, নার্গিস ভাবী আর সজন ভাই এসে বলল, একটা নতুনত্বের স্বাদ পাচ্ছি।
তোমার কথা শেষ হতেই ইব্রাহিম এসে বললও আমাদের সবার রুম দোতালায়।
তুমি চাবি চেয়েছিলে। সে হেসে বলেছিল এটা বাসা, এখানে চাবি লাগে না। সব কিছু খোলা রেখে চলে যেতে পারো, কেউ হাত দেবে না।
পা বাড়ালেই সেই বিখ্যাত OPEN SQUARE, Djemaa el Fna, তুমি বলেছিলে এই স্কোয়ারে ঘিরে আছে বাজার, আছে মসজিদ, আছে কাফে। আমাদের সবার মন চাইছে কখন দেখবো সেই জাগা। তুমি বললে, এখন দুইটা বাজে আমরা তিনটায় বের হবো, ফিরে আসতে হবে তাড়াতাড়ি। কারন গাইড আসবে কাল ভোরে। আমরা রওয়ানা হবো সাহারার পথে।
একটা ভ্রমন কাহিনী
পিঠের উপর আলতো হাতের ছোঁয়ায় ঘাড় ফিরে তাকালাম।
সমীতা।
ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কি? চিনতে অসুবিধা হচ্ছে? বলে হাসল সে।
সেই হাসি। আজও মুছে যায়নি আমার মন থেকে।
তোমাকে চিনতে পারবো না, তাই কি হয়? কি মনে করে এই অবেলায়, এই ছোট্ট কনফেক্সনারীতে।
বান্ধবীর বাসাতে যাব, ভাবলাম কিছু একটা হাতে করে নিয়ে যেতে হয়, সেই সুবাদে নেমেছিলাম। নেমে এসে তোমাকে দেখবো তাতো ভাবিনি।
বিধাতার খেলা বোঝা দায়।
কবে থেকে তুমি আমার ভাষায় কথা বলতে শুরু করলে? আমি কথার আগে পিছে ইনশাল্লাহ, মাশাল্লা লাগাতাম বলে তুমি বলতে ওটা আমার ভাষা।
এখন আমি দুই ভাষাতেই কথা বলি। তোমার কোন তাড়া আছে কি?
না অতটা নয়, কেন?
তাহলে চলো কোথাও বসি। অনেকদিন পরে দেখা। স্মৃতির পাতা গুলো উল্টিয়ে দেখতে আপত্তি কি?
চলো।
এসে বসলাম হাউজ অফ কাফে তে। বাহিরের বাতাস টা আরামদায়ক। তাই ছাতার নিচে দুটো চেয়ার টেনে নিলাম।
ওয়েটার এসে দুটো মেন্যু দিয়ে গেলো।
সমীতা মেন্যু নিয়ে নাড়া চাড়া করছিল। আমার চোখ পড়ল ওর আঙ্গুলের আংটি টার দিকে।
ওয়াটার এসে পাশে দাড়াতেই বললাম, কি খাবে?
শুধু কফি।
কফির সাথে আরও কিছু আনতে বলে তাকালাম ওর চোখের দিকে।
কি? কি দেখছ?
তোমাকে। একটুও পাল্টাও নি তুমি। মনে পরে কবে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল।
পরে বইকি।
শম্পা কোথায় ?
যে শম্পাকে তুমি দেখেছিলে সে শম্পা আর নেই। বিয়ে হয়ে গেছে।
দোষ আমারই। যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তুমিও চলে গেলে অন্য ষ্টেটে। আমিও ছন্নছাড়ার মতো বেড়িয়ে পড়লাম। বেশ কিছু বছর ঘুরে গেলো। কে কোথায় তার খোঁজ আর রাখতে পারিনি।
মনে পরে, দেখা হলেই শম্পা বলতো, খালেদ দা এবার অন্য কোন দেশে বেড়াতে গেলে আমাকে নিয়ে যাবেন তো?
ওর কথা আমি রেখেছিলাম।
জানি। ও ছিল বলেই আমারও যাওয়া হয়েছিল। কি খুশিই না সে হয়েছিল। তোমার সাথে তোমার হাত ধরেই তো সে ঘুরে বেড়াতো মারাকাসের পথে পথে।
যেদিন প্লেনের টিকিট কেটে ওকে বলেছিলাম , শম্পা সব গুছিয়ে নাও, আমরা মারাকাস যাব।
ওর বিশ্বাস হয়নি, বলেছিল, যেদিন মারাকাসে পৌছাব, সেদিন আমার স্বপ্ন পুরন হবে। সেদিন তোমাকে বলব তুমি তোমার কথা রেখেছ।
ও যে কখন আপনি থেকে তুমিতে এসেছে বুঝতে পারিনি। ওর মুখে তুমি ডাক টা খুব ভাল লেগেছিল, ও যেন আপন করে নিলো আমাকে।
আচ্ছা তোমার মনে আছে সেই ভ্রমনের দিনগুলো। সবকিছু ঠিক হয়েও হচ্ছীলনা।
কেন থাকবে না।
আমি কাজে ব্যস্ত, হঠাৎ তোমার ফোন, বললে, মরক্কো যাবে? এই রকম হঠাৎ হঠাৎ আজগুবি চিন্তা তোমার মাথায় আসে। তাই গুরুত্ব না দিয়ে বলে ফেলেছিলাম মন্দ কি? সেই “মন্দ কি” টা তুমি ধরে নিলে আমি রাজি।
কদিন পরে ফোন করে বললে, একমাস পরে আমরা রওনা দেবো মারাকাসের পথে।
তুমি হায় হায় করে উঠেছিলে। বলেছিলে, পাগল নাকি? আমার যাওয়া হবে না।
কিন্তু হয়েছিল। শম্পা এসে যোগ দিয়েছিল আমাদের সাথে।
ওয়েটার এসে পাশে দাঁড়াল, জিজ্ঞাসা করলো আরও কিছু লাগবে কি না।
বললাম আর এক কাপ কফি হলে মন্দ হয় না। সে অর্ডার নিয়ে চলে গেল। সমীতা ছোট্ট আয়না বের করে ঠোটের উপর আঁকা রঙ টা একবার দেখে নিলো।
আমি তাকিয়ে ছিলাম নিখুঁত ভাবে থ্রেড করা ওর ভুরু দুটোর দিকে। ও মুখ তুলে চাইল। বলল, আচ্ছা খালেদ, আর একবার আমরা বেড়িয়ে পড়তে পারিনা? মরুভূমি নয়। ট্রেনে ট্রেনে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরবো।
হাসতে হাসতে বললাম, তা মন্দ বলোনি। তোমার ওই টাঁক মাথা লোকটা আমাকে শট গান দিয়ে গুলি করবে।
না তা সে করবে না, সে জানে তোমার আমার বন্ধুত্বের কথা।
জানো সমীতা, এয়ারপোর্টে যে ভাই ভাবীর সাথে পরিচয় হয়েছিল উনারা এখন আমার খুব কাছের মানুষ। কত সহজেই না মানুষ আপন হয়ে যায়। তাই না?
রতনে রতন চেনে।
বাহ, কবে থেকে এই ভাষায় কথা বলতে শিখলে, টাঁক মাথার গুন আছে দেখছি?
না, শিখে ছিলাম তোমার কাছ থেকে। জানো, মনে হয় এই তো সেদিন তুমি, আমি আর শম্পা। তোমার গাড়ী রেখে গেলে আমার ড্রাইভওয়ে তে। এয়ারপোর্টে পৌছে দিয়ে গেলো তোমার মেয়ে। রাত নয়টায় আমাদের ফ্লাইট। Royal Air Marco. ঐ দেশের এয়ার লাইন। আমরা লাউঞ্ছে বসে আলাপ করছিলাম মরুভূমির কথা, রাত কাটাবো খোলা আকাশের নিচে।
আপনারা মারাকাসে যাচ্ছেন বুঝি? প্রশ্ন শূনে তুমি তাকালে পিছনে। পরিচয় হোল। নার্গিস আর সজন। ওরাও একি পথের যাত্রী। শুধু তাই নয়, একই হোটেলে আমাদের অবস্থান। Riad Andala.
সজন ভাই বলল, আমাদের কে বোর্ডিং করার জন্য লাইন দিতে বলছে, চলেন লাইনে দাঁড়াই। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। শম্পা ঘুরে ঘুরে দোকান গুলো দেখে বেড়াচ্ছিল। তুমি বললে, ও পনের বছর বাহিরে কোথাও যায়নি, ওর দেখে স্বাদ মিটছে না।
তোমার এতো সবও মনে আছে।
কেন থাকবে না। এইসব স্মৃতি তো ভুলবার নয়।
মনে আছে তুমি ইচ্ছে করে জানালার পাশে সীট নিয়েছিলে। জানতে আমি জানালার পাশে বসতে পছন্দ করি। শম্পা বসতে চেয়েছিল, তুমি বলেছিলে, থাক শম্পা, রাতে কিছুই দেখতে পাবেনা, জানালা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, মাথাটাও রাখতে পারবে না। শম্পা কি বুজেছিল জানিনা, তবে সে আর বসতে চাইনি।
ঠিক আমাদের পিছনেই নার্গিস ভাবি আর সজন ভাইএর সীট। ভাবী তার মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেছিল, আল্লার রহমত, আপনাদের কে পেলাম এই যাত্রায়। কি ভালই না লাগছে আমার।
এয়ার হস্টেস হেডফোন আর ছোট একটা পার্স দিয়ে গেলো। ওর ভিতরে আছে রাত ও সকালের সরঞ্জাম।
তুমি জানালাতে বালিশ দিয়ে মাথাটা এলিয়ে দিলে। শম্পা হেডফোন কানে লাগিয়ে টিভির চ্যানেল গুলো পাল্টাতে লাগল।
আমি এয়ার হস্টেস কে ডেকে বললাম, এক গ্লাস পানি দিতে পারবে কি?
ক্রমশঃ
ছন্দা
মানুষের জীবনে দুইবার ভাঙ্গন আসতে কেউ দেখেছে কি? আমি দেখেছি। দেখেছি আমি সেই মেয়েটার চোখে যার সাথে আমার পরিচয় তার ছোট বেলায়।
দীর্ঘও দিন পাড় হয়ে গেছে। আমি ব্যস্ত আমাকে নিয়ে, সে বাস্ত তার সংসার নিয়ে।
কোন একদিন বিকেলে রিক্সায় ফিরছিলাম। যানজটের মাঝে পড়ে আছি। ডাক শুনলাম, “ এই মিন্টু, এই মিন্টু”।
রাস্তার ওপাশে একটা গাড়ীর থেকে শব্দটা আসছে মনে হোল। তাকালাম। কাউকে দেখলাম না। ভাবলাম আমার মনের ভুল।
এই যানজটের মাঝে শুধু শব্দ আর শব্দ। চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
আবার ও সেই ডাক। এবার তাকাতেই দেখলাম রাস্তার ওপারে এক ভদ্রমহিলা গাড়ী থেকে নেমে আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে। যানজটে তার গাড়ীও দাঁড়ান।
যদিও অনেক দিন পড়ে দেখা তবুও চিনলাম। চিৎকার করে বললাম, কেমন আছিস।
সে সেই কথার উত্তর দিলোনা। চিৎকার করে বলল, নেমে আয়।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, লোকেরা আমাদের কথা ছোড়া ছুড়িতে বেশ আনন্দ উপভোগ করছে। কে যেন একজন বলে উঠলো,
এটা সিনেমার শুটিং নয় তো।
না আর দেরী নয়। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে, অনেক কসরত করে, ওপারে এসে পৌছালাম। সে গাড়ীর দরজা খুলেই রেখেছিল, আমি মাথা নিচু করে ডুকে পড়লাম।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, আচ্ছা ছন্দা, কতদিন পরে দেখা তাই না। এই যানজটই আমাদের কে মিলিয়ে দিলো। জয় বাবা যানজট।
তুই একটুও পালটাস নি মিন্টু। কবে ফিরলি?
মাস খানেক হোল। সামনের মাসের চার তারিখে ফিরে যাওয়ার কথা। তোর কথা বল। যাচ্ছিস কোথায়।
পপুলার ল্যাবয়ে। ব্লাড রিপোর্ট টা আনতে।
কার রিপোর্ট?
হুমায়ুনের
কি হয়েছে?
সে অনেক কথা। চল আগে রিপোর্ট টা উঠাই, তারপর কোথাও বসে বলব সব। তোর তাড়া নেই তো?
না, মোটেও নেই।
গাড়ী চলতে শুরু করল। শুধু একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছিল, “ বিয়ে শাদি কি করেছিস”?
বলেছিলাম, না, ওই সুযোগ আসেনি ।
ও চেয়ে রইল বাহিরের দিকে। মনে হোল একটা কালচে হাওয়া ওর মুখের উপর এসে থমকে দাড়িয়ে গেছে । কোনকিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেলাম না।
আমি ফিরে গেলাম অনেক পিছনে, সেই ছোট্ট মফস্বল শহরে।
পাশের বাসায় থাকতো ছন্দারা। বয়সে আমার চেয়ে চার বছরের ছোট সে। আসতো আমাদের বাসায়। বসে বসে দুজনে গল্প করতাম। ছন্দা বলতো, এই মিন্টু তুই আমার ভাই হবি। ওর ও কোন ভাই নেই, আমারও কোন বোন নেই।
ঠিক আছে, কিন্তু তুই আমাকে আপনি বলে কথা বলবি। তা আর হয়ে উঠেনি। সেই তুইতে রয়ে গেছি আমরা।
স্কুল শেষ করে আমি চলে এলাম রাজধানী তে। ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটাতে কাটাতে হঠাৎ দেখা ওর সাথে মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে। কয়েক জন বান্ধবীর সাথে।
কিরে চিনতে পারছিস?
মিন্টু তুই। অনেক খোঁজ করেছি তোকে, কোন হদিস পাইনি। কোথায় থাকিস?
ইউনিভারসিটির এক হলে । কার্জন হলের পিছনে।
তুই?
আমি আছি স্বামীবাগে। বোনের বাসায়। এই আমার ঠিকানা।
বলে একটা চিরকুট এগিয়ে দিল।
কবে আসবি?
আসব সময় করে।
ওরে বাবা, তোর এখনও সেই হেঁয়ালি করে কথা বলা গেলনা। বলে হাসতে লাগল। ওর হাসিতে সব সময় একটা মিষ্টতা ঝরে পড়তো।
ইয়ার্কি রাখ। আগামী রবিবার আসবো। চলি, একটু তাড়া আছে।
এরপর কত বার ওদের বাসায় গেছি, দেখা হয়েছে।
অনেক গুলো ক্যালেন্ডারের পাতা আস্তে আস্তে পিছনে চলে গেলো। ওর বাবা মা এসে বাসা বাধলও মালীবাগে।
একদিন শুনলাম ওর বিয়ে। এক জারনালীস্টের সাথে। দেখা হতেই পরিচয় করিয়ে দিলো।
ভালো লাগলো মুশফিক কে। প্রাণবন্ত। বছর ঘুরতে ছন্দার কোলে এলো এক ছেলে। বাসা নিয়ে ছিল টিকাটুলিতে। মাঝে মাঝে আমিও যেতাম সেখানে আড্ডা দিতে।
এরই মাঝে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টাতে শুরু করেছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেও সরকার গঠনের আগেই ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সেনা বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের উপর। দাবানল জ্বলে উঠল সারা দেশে।
সেনা বাহিনী কে পৃষ্ঠপোষকতা করতে গঠন হোল রাজাকার, আলবদর।
ধর পাকড় আরম্ভ হোল।
এমনি একদিন ছন্দা, মুশফিক আর তার ভাই বোনেরা মালিবাগের বাসায়। গল্প যখন জমে উঠেছে সেই ক্ষণে দরাম দরাম করে বাহিরের দরজায় প্রচণ্ড আওয়াজ। ওর বাবা দরজা খুলতেই তিন চারজন রাজাকার বন্দুক হাতে বাবা কে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে চলে এলো। কর্কশ স্বরে চিৎকার করে সবাইকে বাহিরে এসে লাইন করে দাড়াতে বললও। ছন্দার বড় ভাই কি যেন বলতে চেয়েছিল। রাজাকারের একজন রাইফেলের বাট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত হানল ওর পেটে। ওর দাদা কুচকিয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। সারা বাসা তল্লাশি করে নিয়ে এলো একটা রেডিও। সবার নাম সেই সাথে মুশফিকের নাম ঠিকানা লিখে রেডিও টা নিয়ে চলে গেলো। ওরা ভেবে ছিল এই বোধ হয় শেষ। কিন্তু তা হবার নয়। নিয়তির খেলা তখনো শেষ হয়নি।
দুইদিন পড়ে এক কাক ডাকা সকালে ছন্দা এসে কেঁদে পড়ল মালিবাগের বাসায়। মুশফিক কে রাজাকাররা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। সেই শেষ। মুশফিকের খোঁজ আর পাওয়া যায় নি। খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছিলাম। দেখেছিলাম তার কান্না ভরা চোখ। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা সেদিন ছিলনা।
কিরে বাহিরেরে দিকে চেয়ে কি ভাবছিস?
তাকালাম ওর দিকে। কেনও জানি বুকটা দুর দুর করে উঠল।
এসে গেছি। তুই বোস গাড়ীতে, আমি দৌড়ে যেয়ে রিপোর্টটা নিয়ে আসি, বলে সে বেরিয়ে গেলো।
ফিরে এলো, হাতে একটা কাগছ। যে ছন্দা দৌড়ে গিয়েছিল, ফিরে এলো ধীর পদক্ষপে। গাড়ীতে বসে বলল, চল কোথাও নির্জনে যেয়ে বসি। কোলাহল ভাল লাগছে না।
বসলাম ছোট্ট একটা রেস্তোরায়।
কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার মতো সাহস আমার হোল না।
আমি শুধু এক কাপ চা র অর্ডার দিলাম। সে ও তাই।
কিছুক্ষণ চুপ করে, চার কাপে দুই তিন সিপ দিয়ে বলল, তুই তো আমার আগের সব কথাই জানিস।
দেশ স্বাধীন হোল। তুইও চলে গেলি বাহিরে।
মুশফিক আর এলোনা। ওর আর কোন খোঁজই পেলাম না। সেই সময় আমি অন্তসস্তা। মেয়েটা এলো পৃথিবীতে। দুটো কে নিয়ে এসে উঠলাম মা বাবার বাসায়। মা বাবা অনেক করেছিল। কোলে পীঠে করে ওদেরকে মানুষ করেছিল। ওরা না থাকলে আমার কি হতো আমি জানিনা।
একটা চাকরি নিলাম। আস্তে আস্তে নিজের পায়ে দাড়াতে শিখলাম। কাজ আর কাজ। কাজ শেষে বাসায় ফিরে ছেলে মেয়ের লেখাপড়া দেখা। বুঝতেই পারছিস। পন করেছিলাম বাচ্চা গুলো কে মানুষ করে তারপর আমি বিশ্রাম নেবো।
সেই সময় আমি দেখা পেলাম হুমায়ুনের। চলতে পথে দুজনেরই দুজন কে ভাল লাগল।
আমি অনেক বছর পড়ে এবার ঘর বাধলাম। আমি সুখের মুখ দেখলাম। ছেলে মেয়ে দুটোকে হুমায়ুন কাছে টেনে নিলো। এর চেয়ে সুখ আর কি আছে বল।
এই বলে সে উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল। হয়তো চোখের জল মুছতে। আমি চা র পেয়ালায় চুমুক দিলাম। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। হাতের ইশারায় ওয়েট্রেসকে বললাম আর এক কাপ চা দিতে।
ছন্দা এসে বসলো।
বললাম, আজ থাক। বাকি টুকু না হয় আর একদিন শুনবো।
বলল, না, তোর সাথে আবার কবে দেখা হবে জানিনা।
জানিস, খুব ধুমধাম করে ছেলে আর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম।
ওদের সুখ দেখে আমার খাটনির সার্থকতা খুজে পেয়েছিলাম।
সময় যে কোথা দিয়ে পাড় হয়ে গেলো টের পাই নি।
একদিন দেখলাম আমার চুলে পাক ধরেছে। ভাবলাম এবার পাখা গুটানোর পালা। চাকরি তো অনেক দিন করলাম।
অবশেষে রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাসায় এসে বসলাম। হুমায়ুন তার ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। আমি ব্যস্ত বই পড়া নিয়ে। মাঝে মাঝে দুজনে বেড়িয়ে পড়ি ভিন্ন দেশ দেখতে।
একবার হুমায়ুনকে ব্যবসার প্রয়োজনে কলকাতায় যেতে হোল। ফিরে এলো অসুস্থ হয়ে। হাসপাতালে ভর্তি করতে হোল। সমস্ত রকমের পরীক্ষা করার পর ডাক্তার আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো অন্য ঘরে। প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি ডাক্তার কি বলতে চাইছে।
বুঝে উঠতে পারিসনি মানে? ডাক্তার পরিষ্কার করে বলেনি? জিজ্ঞাসা করলাম।
বলেছে, তবে মেডিক্যাল টার্ম গুলো বুঝতে দেরী হোল। বলল, হুমায়ুনের Multiple Myeloma হয়েছে। অর্থাৎ ওর Bone Marrow তে রক্ত কনা ঠিকমত তৈরী হচ্ছেনা। তাছাড়া হেমগ্লবীন অনেক কমে গেছে। এই মুহূর্তে দুই ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। ওর ব্লাড গ্রুপের লোকের সন্ধান করতে বলল। যারা রক্ত দিতে ইচ্ছুক তাদেরকে অতিসত্বর হাসপাতালে আসার কোথা বলল।
বুঝতে পারছিস আমার অবস্থা।
পারছি।
পায়ের তোলার মাটি কেঁপে উঠল। আমি কিচ্ছুক্ষণ ডাক্তারের সামনে হতভম্বের মতো বসে রইলাম। ভাবলাম, কেন, কেন আমার উপরে এতো পরীক্ষা করবে উপরওয়ালা। আমি কাঁদতে চাইলাম, পারলাম না।
হুমায়ুনের পাশে আমাকে দাড়াতে হবে। ওকে ভালকরে তুলতে হবে এই পন করে ডাক্তারের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম।
সেই থেকে হসপিটাল,বাসা আর ল্যাবে দৌড়িয়ে বেড়াচ্ছি।
একটু থেমে বলল, তোকে আমি বিরক্ত করছি নাতো?
তোর কি তাই মনে হচ্ছে? বল, তারপর?
চিকিৎসা চলছে। বেশ কয়েক মাস হয়ে গেলো। কিছুটা ভাল হতে হতে আবার ফিরে আসে আগের জাগায়। আমি শুধু আল্লাহর কাছে বলি, আমাকে তুমি দুই বার একি আঘাত দিওনা।
এই বলে সে থামল।
রিপোর্টার দিকে তাকাল। আমার দিকে এগিয়ে দিল।
হাতে নিয়ে সংখ্যা গুলো দেখলাম। এই বিষয়ে আমি একেবারেই আনাড়ি। তবুও ভাল এবং মন্দের ঘরের ভিতরে মন্দের ঘরেই সংখ্যা বেশি।
তাকালাম ওর দিকে। বললাম, আমার দেখা একজনকে জানি, কেউ আশা করেনি সে ফিরে আসবে কিন্তু সে ফিরে এসেছে। দেখবি হুমায়ুন আবার আগের মতো হাসবে, খেলবে নাতিদের সাথে, মাতাবে আসর। তোকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
হাঁ তাই করব, চোখ টা মুছে বললও, চল তোকে নামিয়ে দিয়ে আমি বাসায় ফিরবো।
বললাম না, আমি একটা রিক্সা নিয়ে চলে যাব। তুই ভাল থাকিস। কথা হবে।
ও গাড়ীতে উঠল, আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর চলে যাওয়ার পথে।
অতীত কথা কয়
আকাশ ছিড়ে রৌদের আলো এসে পড়েছে উদয়ের বিছানাতে। চোখ না মেলেই পাশে হাত দিয়ে অনুভব করতে চাইল রাতের বাসি শরীর টা। না, কেউ নেই। কখন যে কেয়া উঠে গেছে, সে টের পাইনি। পাশের টেবিলে ঘড়ি টার দিকে তাকাল উদয়। নয় টা বেজে চল্লিশ মিনিট। বেলা হয়ে গেলো ভেবে আবারও কেয়ার বালিশ টা চেপে ধরে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করল।
কোন সারাশব্দ নেই। ভাবল কেয়া হয়তো গোসলে ঢুকেছে। রাতের কথা একবার ভাবল উদয়। হাসি পেলো। পঞ্চাশের কোঠায় পা দিয়েও কেয়ার শরীরের গঠন মনে করিয়ে দেয় সে যেন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই করছে। অবশ্য এর পুরো ক্রেডিট টা উদয় নিতে চায়।
বলে, আমার দেখা পেয়েছিলে, সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি তোমাকে তাই না তোমার এই মাধুর্য। এই উপচে পড়া সৌন্দর্য। বিয়ে করতে ওই সব, মানে ওদের একজন কে, বুঝতে, এতো দিনে পাঁচ সাত টা গুঁড়ি গুঁড়ি হেটে বেড়াতো, আর তোমার গাল চুপসে– কথা শেষ হতে পারতো না, কেয়া এসে ঠোট টা বন্ধ করে দিতো।
এই সব ভাবতে ভাবতে উঠে বসল উদয়। কলের পানির শব্দ সে শুনতে পেলো না। তাহলে কি কেয়া বারান্দায়?
নেমে এলো সে, ড্রয়াইং রুমে এসে দেখল কেয়া চেয়ারে বসা। চেহারায় বন্ধের দিনের সেই হাস্যজ্জল আভাস টা নেই। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতোই থমথমে ভাব।
এতক্ষণে ওর হাতে কফির পেয়ালা থাকার কথা, সেটা নেই।
কেয়া তাকাল উদয়ের দিকে। চোখের কোনের পানির বিন্দুটা দেখতে পেলো উদয়। সহসা মনে হোল, কাল রাতে কি কোন কিছু বলেছিল যা কেয়াকে আঘাত দিয়েছে।
না, মনে তো পড়ে না। কিছু হলে তো সে শেষ চুমু টা দিয়ে বলত না, “ এবার ঘুমোও”।
তাহলে ?
কি হয়েছে?
প্রশ্ন করতেই কেয়া ডাকল তাকে কাছে আসতে। বললও, বসো আমার পাশে।
উদয় অনুভব করল হঠাৎ তার হৃদপিণ্ডের কার্জ র্ক্ষমতা বেড়ে গেছে। যেখানে তার হার্ট বীট থাকে পঞ্চান্ন থেকে ষাট এখন একশর কাছাকাছি।
কি হয়েছে? আবারও প্রশ্ন তার।
বাবা মারা গেছে।
কার বাবা? তোমার না আমার? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল সে।
তোমার। কিছুক্ষণ আগে কল এসেছিল। তুমি ঘুমিয়েছিলে।
উদয় বিশ্বাস করতে চাইল না। বলল, না তুমি ভুল শুনেছ। কয়দিন আগেই তো কথা হোল। বলেছিল, কবে আসবি? বলেছিলাম, সামনের বছরের প্রথম দিকে আশা রাখি।
জন্ম, মৃত্যু তো কারোর হাতে নেই। বলে কেয়া উদয়ের মাথা টা ওর বুকের কাছে নিয়ে এলো।
উদয় কাঁদতে চাইল কিন্তু কাঁদতে পারলো না। থেকে থেকে বুকের মাঝে একটা ব্যাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকলো।
আস্তে আস্তে মাথাটা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল, ব্যাল্কনী তে এসে তাকালও দূরে।
মা কে হারিয়েছে অনেক আগে। ভাল মন্দ সবকিছু শেয়ার করতো বাবার সাথে। বয়সের এক পর্যায়ে বাবা হয়ে যায় বন্ধুর মতো। সেই সম্পর্কে এসে দাড়িয়ে ছিল উভয়ের মধ্যে।
উদয় আবদার করেছিল বাবা কে, এখানে এসে থাকার জন্য।
বাবা রাজি হয়নি। বলেছিল, এই বয়সে ওখানে যেয়ে থাকতে পারবো নারে। আর তাছাড়া তোর মার স্মৃতি জরানো এখানে।
উদয় আর কথা বাড়ায় নি।
কিন্তু একটা খত আজও তার বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। ভুলতে পারে না সে। যে অন্যায় সে সেদিন করেছিল, তার প্রায়শ্চিত্ত আজও করতে পারেনি। সেদিন এতো অবুঝ কেনও সে হয়েছিল? জানে না।
বাবা কেঁদে ছিল কিনা বলতে পারেনা, তবে আঘাত পেয়েছিল নিঃসন্দেহে।
কেয়া এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। পাশ ফিরে কেয়ার মুখটা হাতের মাঝে নিয়ে বলল,
আজ তোমাকে বলব, আজ আমি বলে হাল্কা হতে চাই। অনেক অনেক আঘাত আমি দিয়ে ছিলাম আমার বাবা কে। সে হয়ত মনেও রাখেনি সেই কথা। কিন্তু আমি তো ভুলতে পারিনি। কেন সেদিন আমি যেয়ে বলিনি, বাবা আমি দুঃখিত।
আজ নয়। আরেকদিন বলও, আমি শুনবো।
না, আজই। শোন,
বাবা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। কোন কিছুর দরকার হলে অনন্যরা চাইতো মার কাছে, আর আমি চাইতাম বাবার কাছে।
তবে বাবা কে যে ভয় পেতান না তা নয়। পড়া শোনার ব্যাপারে বাবা কোন কিছুর সাথে সন্ধি করতে রাজি নয়।
কথায় কথায় বাবা একদিন বলেছিল,
“জানিস উদয়, আমি খুবই ভাল ছাত্র ছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডিগ্রীটা আমি নিতে পারিনি। তার আগেই তোর দাদা মারা গেলো। আমিই সবার বড় ছেলে। আমার পড়ে আরও চার টা ভাই বোন। তোর দাদি দিশাহারা হয়ে পড়ল। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে এলাম। চাকরি নিলাম। সংসারের হাল ধরলাম।
তোর মা এলো।
সংসারের ভিতরের হাল ধরলও সে, আমি ধরলাম সামনে। এক সময় তোর চাচা ফুফুরা মানুষ হয়ে বেড়িয়ে গেলো। তোর দাদি রয়ে গেলো আমার সাথে। তোকে তো সেই বড় করেছিল কোলে পিঁঠে করে”।
সেইজন্য বাবার কাছে লেখাপড়া আগে। বলেছিল, আমার মতো তোকে অর্ধেক পথে লেখাপড়ার পাঠ চুকাতে হবেনা।
মনে পড়ে, আরও মনে পড়ে একরাতে জ্বরে যখন আমি ছটফট করছি, সারা রাত বাবা মাথার কাছে বসে পানিতে ভেজা কাপড় দিয়ে কপাল মুছিয়েছে। বলে উদয় থামল। কি যেন চিন্তা করল।
কেয়া বলল, তুমি তাই বলছ, তোমার সাথে বিয়ে হয়ে আমি যখন এই বাড়ীতে এলাম একবারও আমার মনে হয়নি আমি এই বাড়ীতে আগে কখন আসিনি। বাবা আমাকে বৌমা বলে ডাকতো ঠিকই কিন্তু তার মেয়েদের থেকে আমাকে কম ভালোবাসতো না।
আমার চিকেনপক্স হয়েছিল, মনে আছে?
আছে।
মশারির ভিতর বাবা নিজে হাতে খাবার এনে আমাকে খাইয়ে দিতো।
মনে পড়ে?
পড়ে।
তুমি তো বললে না বাবা মনে আঘাত পেয়েছিল তোমার কোন ব্যবহারে।
বলছি।
বাবা তখন রিটায়ার করেছে। শহরের এক কোনায় ছোট্ট একটু জমি কিনে সেখানে বাসা বেঁধে আমরা আছি। যেই বাসাতে তুমি এসে উঠেছিলে।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। হলে থাকি। সেখানে থাকার যে খুব একটা দরকার ছিল তা নয়। বাসা থেকে ক্লাস করা যেতো। কিন্তু পড়াশোনার সাথে সাথে আড্ডার নেশা টা আমাকে পেয়ে বসেছিল।
বাবা বলেছিল, হলে না থাকলেই কি নয়।
যুক্তি দিয়েছিলাম, হলে থাকলে লাইব্রেরি তে যখন তখন যেতে পারবো, অন্যান্য ছাত্রদের সাথে কোশ্চেন নিয়ে কন্সালট করতে পারবো, ভেবে দেখিনি বাবার উপর চাপ টা কতটুকু পড়বে।
সে না করে নি।
সেই সময়ে একটা সুযোগ এলো বিদেশে আসার। বাবা কে বললাম। বাবা বলল, নিশ্চয় যাবে।
ভেবে নিলাম, আর কি, আমার দায়িত্ব কাগজ পত্র গোছান, বাদবাকি দায়িত্ব বাবার। সেদিন মনে হয়নি বাদবাকি দায়িত্বটা যে কত বড় দায়িত্ব একজন রিটায়ার মানুষের পক্ষে।
ফুর্তি ফুর্তি ভাব আমার। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ভিসা পেয়ে গেলাম। ট্রাভেল এজেন্সিতে যেয়ে টিকিট বুক করতে গেলে ওরা বলল, দুই দিনের মধ্যে যদি টিকেট না কিনি তবে ওরা আর আগের দামে দিতে পারবেনা। যদিও আমার যাওয়ার দিন আরও তিন মাস পড়ে।
সেই রাতে বাসায় এলাম। বাবা কে বললাম আগামীকাল আমার এতো টাকা লাগবে।
বাবা বলল, আগামীকালই? কয়দিন পড়ে দিলে হয় না? ধর, চার পাঁচ দিন পরে?
না, টিকিটের দাম বেড়ে যাবে?
কিন্তু কালকের মধ্যে তো আমি দিতে পারবোনা বাবা।
তাহলে থাক। রাগ করে আমি বেড়িয়ে আসছি, মা ডাক দিলো। উদয় খেয়ে যা। যাসনে বাবা।
খিদে নেই। বলে চলে এলাম হলে।
সারা রাত শুধু একটা কথাই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলো,” আমার আর যাওয়া হোল না, বিদেশে”।
যেহেতু পরীক্ষা সামনে, ক্লাস নেই, কাজেই সকালে ঘুম থেকে উঠার তাড়া নেই।
ভোর সাত টায় দরজায় টোকার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দরজা খুললাম। বাবা দাড়িয়ে। হাতে একটা ব্যাগ।
সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল কি ভুলই না আমি করেছি। আমার কর্মের মাসুল দিতে বাবা কে আসতে হয়েছে এই কাক ডাকা ভোরে। টাকা জোগাড় করে।
কেন সেদিন আমি বলতে পারিনি, বাবা আমি সত্যিই দুঃখিত।
বাবার চোখে কোন রাগ দেখিনি সেদিন। শুধু বলেছিল, “ টাকা টা সাবধানে রাখিস, পারলে আজই যেয়ে টিকিটের বাবস্থা করিস”।
কোথা থেকে টাকা জোগাড় হয়েছিল আজও আমি তা জানিনা। অনেক কষ্ট করে তাকে জোগাড় করতে হয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
সেই টিকিট আমি কেটে ছিলাম আরও দশ দিন পর। ট্রাভেল এজেন্সির লোক টা ছুটি নিয়ে বাড়ী চলে গিয়েছিল। টিকিটের দামও বাড়েনি।
বলতে পারো, কেনও সেদিন আমার ঐ মতিভ্রম হয়েছিল। যার খেসারত আমি আজও দিয়ে চলেছি।
আজ বাবা চলে গেলো, আমি বলতে পারলাম না, বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও।
কেয়া উদয়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
ভেবো না, বাবা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। যেমন তুমি তোমার ছেলের কোন দোষ দেখো না। সেই রকম বাবাও তোমার কোন দোষ দেখিনি।
এসো, এবার আমার কোলে মাথা রেখে শোবে, চলো।
দুই কন্যা
এক
এই চিঠি যখন তুমি পাবে তখন আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছি। তাতে তোমার কিছু আসে যায় না। দূরে তো আমি সব সময় তোমার কাছ থেকে। কেন? আজও তা জানতে পারলাম না। তুমিও জানতে দাওনি।
দুটো কলেমা উচ্চারণ করে আমাদের বিয়ে হয়েছিল।
ঐ পর্যন্তই।
তোমার হাত কোনদিন আমার হাত ছুঁইনি।
বিয়ের রাতে প্রতিটি বর যেমন স্ত্রীকে কাছে টানতে চায়, আমিও তাই চেয়েছিলাম।
তুমি সাপ দেখার মতো ঝটকে সরে দাড়িয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলে,” তুমি আমার স্বামী, শুধু বাহিরের লোকে জানবে। এর বেশি নয়”।
আরও বলেছিলে, কোনদিন যদি আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা কর, তবে আমার মড়া মুখ দেখবে।
আমি চমকে তোমার দিকে চেয়ে ছিলাম। দেখলাম তোমার রাগান্বিত মুখ।
সেটা কি আমার উপর?
আমার উপর কেনও ই বা হবে। তুমি তো আমাকে জানতে, চিনতে চাওনি। তবে কেন?
মনে পড়েছিল অনেক আগে পড়া রবীন্দ্রনাথের সেই গল্প-“মহামায়া”, বাড়ন করা সত্ত্বেও রাজীব মহামায়ার আগুনে পোড়া মুখটা দেখে ছিল। সেই তার কাল। হারালও সে তাকে।
তাই আমিও তোমার হাত ছুঁই নি। চেষ্টা ও করিনি। মনে হয়ে ছিল থাক না, আজ না হয় কাল সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিজের উপর এতো খানি আস্থা কোথা থেকে এসেছিল জানিনা। যদি সেই দিন সেই ক্ষণে ইতি টেনে দিতাম তাহলে আজ এই চিঠি লেখার দরকার পড়তো না।
কিন্তু পারিনি।
কেন, জানো?
আমাকে দেখানো তোমার সেই পুরান ছবি টা দেখে ভাল লেগেছিল। বলেছিলাম, বাহ, বেশ তো মিষ্টি দেখতে। ঐ ভাল লাগাটা মনের মাঝে গেঁথে গিয়েছিল। আজও গেঁথেই রইল।
তুমি এলে বিদেশ থেকে। মাত্র একদিন তোমাকে দেখেছিলাম। তাও কয়েক মিনিটের জন্য। বলেছিলে, বিয়ের আগে মেলামেশা তুমি পছন্দ করোনা। তোমার গম্ভীর মুখটাকে আমার মনে হয়েছিল লজ্জায় নুয়ে পড়া লজ্জাবতী লতা।
তারপর এলো সেই রাত। তুমি নিচে বিছানা পাতলে। আমিই বলেছিলাম, উপরে এসো। আমার মেঝেতে শোয়ার অভ্যাস আছে। তুমি না করনি।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই যদি তোমার অভিপ্রায় তবে বিয়েতে রাজি হয়েছিলে কেনও?
“প্রতিশোধ”। বলে ওপাশ ফিরে শুয়েছিলে।
তা সেই প্রতিশোধ আমার উপর কেন? আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি।
তার উত্তর তুমি দাও নি।
সকাল হয়ে এলো। দুচোখের পাতা বন্ধ হয়নি সাড়া রাত।
দরজা খোলার আগেই মেঝের বিছানা উঠিয়ে রেখে ছিলাম।
কপাট খুলতেই দেখি ভাবী দাঁড়ানো।
“ কি দেবর মশাই, গালে, মুখে লাল দাগ কোথায়? যা দিয়েছিলাম কাজে লাগিয়েছ তো?” বলে হাসলও আমার দিকে তাকিয়ে। ওর চোখের চাহুনীতে রহস্যের আভাস। মেয়েরা মেয়েদের কে চিনতে পারে। হয়তো সেও পেরেছিল। তা না হলে বিদায়ের দিন ভাবী কানের কাছে এসে কেনও বলবে, “ বড্ড একটা ভুল হয়ে গেল দেবর পো”।
এয়ারপোর্টে তুমি নিতে এলেনা। আসবে না সেটা আমি জানতাম। তবে কাজ থেকে ফিরে এসে যখন আমাকে দেখলে, একবারো জিজ্ঞাসা করলে না, জার্নি টা কেমন ছিল। শুধু আমার ঘর টা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলে। আস্তে আস্তে আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম সব কিছুতে।
কাজ নিলাম। নয়টা পাঁচটা।
একি সময়ে দুজনে ফিরে আসি।
তুমি তোমার চায়ের কাপটা সাজিয়ে নিয়ে বাহিরে ছোট্ট এক চিলতে জাগাটায় বসতে । আর আমি ঘরের ভিতর।
জানো, আমার নিজের অজান্তেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলে ছিলাম। তা না হলে এরকম জীবন আমি কেনও কাটাতে যাবো। যাক সে সব কথা।
তোমার অতীত আমি কোনদিন জানতে চাইনি, তবে কি জানো অতীতকে বর্তমানের সাথে না মেশানোই ভাল। তাতে শুধু কষ্টই পাবে।
আমি কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে নিয়ে ঘর বাধতে। ভেবেও ছিলাম একদিন সব ঠিক হওয়া যাবে। কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না।
কেন?
বছর পেরিয়ে গেলো।
এই লুকোচুরি খেলার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সেদিন কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। দুঃস্থ বয়স্ক দের সেবায় নিয়জিত এক সংগঠনে লোক দরকার। দরখাস্ত পাঠিয়েছিলাম। যেতে বলেছে।
আর নয়।এবার নুতন করে জীবন শুরু করব ঐ বয়স্কদের মাঝে।
আমার দস্তখৎ দেওয়া কাগজ পত্র গুলো টেবিলের উপর রইল। উকীল কে দেখাতে পারো।
পারলে নতুন করে আবার জীবন শুরু করো।
বিদায়।
ইতি।
দুই
“এই টুনি তুই মেয়ে পেলি কনে”, চিৎকার করে বলতাম আর ওর পিছনে পিছনে হাঁটতাম। আমার মতো তিন চার জন,
বয়স ছয়, সাত। টুনি ওর মেয়েটাকে কোলে করে ফিরে চাইত আমাদের দিকে। চোখে আগুনের হল্কা। মাঝে মাঝে বলত,
যা, তোদের মা কে যেয়ে জেজ্ঞাসা কর।
কেন বলতাম, এর মানেই বা কি কিছুই বুঝতাম না। সবাই বলতো, আমরাও বলতাম।
বয়স টা যখন বারো চৌদ্দর কোঠায় পৌছাল তখন কথার মানে টা বুঝতে পারলাম, আমরা তখন আর ওর পিছনে যাই না। সেই জাগা পুরন করেছে অন্য আরেক দল।
দেখতে দেখতে অনেক গুলো বছর পেড়িয়ে গেলো। আসা যাওয়ার পথে টুনি কে দেখি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমি লজ্জায় মুখ নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। ভাবি ওকি আমার সেই ছয় সাত বছরের চেহারা টা মনে রেখেছে। ছোট্ট শহর সবাই তো সবাই কে চেনে। লজ্জাটা আমার সেই জন্য। মেয়েটা এখন আর কোলে নেই, হাত ধরে হাটে।
তারপর আমি এই শহর ছেড়ে চলে গেছি। বহু দূরে। অনেক দিন পর ফিরে এলাম দেশে। এলাম আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শহরে। উঠলাম আমার এক বন্ধুর বাসায়। পিছনে ফেলে আসা দিন গুলো মনের পর্দাতে ভেসে উঠল। আলাপে আলাপে প্রসঙ্গ এলো টুনি পাগলির কথা।
কোথায় সে? জিজ্ঞাসা করলাম।
চলে গেছে এই ধরাধাম থেকে। বলল আমার বন্ধুটি।
ওর সেই মেয়েটা?
আছে, এই তো দুই মাইল দূরে, সাকোর পাড় গ্রামে থাকে।
যাওয়া যায় সেখানে? হঠাৎ প্রশ্ন করলাম আমি।
যাওয়া যায়। তবে ওর বাসা আমি চিনি না। খোঁজ নিয়ে বের করতে হবে।
ওঠ চল, আমি এখনি যাবো। বলে তাকালাম ওর দিকে।
কেনও জানি টুনির চেহারা টা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। রাগান্বিত নয়। অসম্মানে কুচকিয়ে যাওয়া চেহারা। যার জন্য দায়ি আমরা।
ছোট বেলার অনেক স্মৃতি ভোলা যায়না। ফিরে ফিরে আসে। হয়ত আমার অবচেতন মনে ফেলে আসা টুনির চেহারা টা দাগ কেটে ছিল। ওর প্রসঙ্গ উঠতেই আমার মনে হোল ওর উপর যে অন্যায় আমরা করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত করতে যাবো আজ তার মেয়ের কাছে, বলব, আমি দুঃখিত।
রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম আমরা দুজন। সাকোর পাড় গ্রামের ভিতরে রিক্সা যেতে পারলো না।
পায়ে চলা পথ। নেমে পড়লাম।
বন্ধুটি অনেক খোঁজ নিয়ে বের করলো বাসাটা। উঠানে দাড়িয়ে জোরে বলল,” কেউ আছে বাসাতে”। ওর গলার স্বর সব সময় উচুতে খেলা করে।
বেড়িয়ে এলো পাতলা গড়নের একটি মেয়ে। বয়স বোঝা যায় না। এক পেচে পড়া শাড়ী।
কাকে চাই? জিজ্ঞাসা তার।
তোমারি নাম—-? বন্ধুটির প্রশ্ন
হাঁ।
এবার আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, তোমার মাকে আমি চিনতাম। ছোট বেলায় খুবই খারাপ ব্যবহার করেছি তার সাথে। তাকে তো পেলাম না। বলতে পারো ক্ষমা চাইতেই এসেছিলাম।
সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। অবশেষে বলল, শুধু আপনি নয়, আমার মা কে অনেকেই খুব খারাপ কথা বলেছে রাস্তা ঘাটে। কোন কিছু না জেনে। আমি তখন ছোট বুঝতে পারিনি কি বলছে ওরা, আপনারা। কেন? বলতে পারেন, কেনও এতো খারাপ কথা বলতেন?
ওর প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। শুধু এই টুকুই মনে হোল , ওর মার কাছে আমি অপরাধী রয়ে গেলাম সাড়া জীবনের জন্য।
বললাম, তোমার মা থাকলে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম, তা যখন হলনা পারলে তুমি ক্ষমা কর।
সে ঘরের ভিতর চলে গেলো, ফিরে এলো একটা মাদুর নিয়ে। পেতে দিয়ে বলল, বসেন, সব বলব আজ আপনাদের কে।
মা আমাকে সব বলে গেছে। সব ঘটনা। কেন তাকে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যেতে হয়ে ছিল।
শোনেন।
বলও।
নানা ছিল গাদনপুরের চেয়ারম্যান। প্রতিপত্তি ছিল। লোকে যেমন সামনে সম্মান করতো, পিছনে তেমনি ভেংচি কাটত। শত্রুর তার অভাব ছিলনা। গদী রাখতে হলে অনেক ভাল মন্দ লোক কে পুষতে হয়। নানাও পুষেছিল অনেক কে। ওই গদী টিকিয়ে রাখতে যেয়ে সে মা কে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক মদখোরের কাছে বিয়ে দেয়। নানী বাধা দিয়ে ছিল। কিন্তু পারেনি। মা ছিল নানার একমাত্র মেয়ে। এই গদীর লোভ বড় ভয়ঙ্কর।
আমি ঐ মদখোরের মেয়ে।
কোন এক সময়ে নানার সাথে আমার বাপের টাকা পয়সা নিয়ে মনোমালিন্য হয়। নানা তার লোকজন দিয়ে চেম্বার থেকে বের করে দিয়েছিল ঐ মদখোর কে।
এই বলে থামল সে।
আমি পিছন ফিরে চাইতেই দেখলাম লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়া একজন দাড়িয়ে।
টুনির মেয়ে বলল, আমার স্বামী। এখানকার পাঠশালাতে মাস্টারি করে।
এগিয়ে আসতেই আমার উঠে দাঁড়ালাম।
আমার নাম কছম আলী, এখানে কি ব্যাপারে?
কিছু বলার আগেই টুনির মেয়ে বিস্তারিত সব বলল।
কছম আলী শুধু একটা কথাই বলল, অনেক কাঁদিয়ে ছিলেন আমার শাশুড়িকে। বলে ঘরের ভিতর চলে গেলো।
আমরা বসলাম। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই।
আমিই মৌনতা ভাঙলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর?
সেই সময় আমার মা অন্তঃসত্ত্বা। একদিন বাবা নানার উপর প্রতিশোধ নিতে যেয়ে মা কে বের করে দিল বাসা থেকে মিথ্যে দোষারোপ দিয়ে। আমার পিতৃ অস্বীকার করে। বলেছিল, আমার মা কুলাঙ্গার।
মা এসে উঠল নানার বাসায়। কিন্তু সেখানে সে থাকতে পারলনা। আমার বাবা, মার নামে মিথ্যে সব ঘটনা রটনা করতে থাকল। বিষিয়ে উঠল বাসার পরিবেশ।
এক রাতে মা এক কাপড়ে বেড়িয়ে পড়ল। চলে এলো বহু দূরে। আশ্রয় নিলো এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায়।
সেখানেই আমার জন্ম। বাবার কোন সন্ধান না থাকাতে লোকে মার নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে থাকল। সেই অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে, ভিক্ষা করে মা আমাকে তিলেতিলে মানুষ করেছিল।
আমার মা নষ্টা নয়। আমার কাছে আমার মা দেবী, আপনাদের মার মতই সেও একজন মা। সারা জীবন শুধু অপবাদই পেয়ে গেল।
এই বলে একটু থামতেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি বেড়িয়ে এলো। আমি আমার হাতের রুমাল টা এগিয়ে দিলাম।
আমার বন্ধু উঠে উঠানের এককোণে যেয়ে দাড়িয়ে রইল।
জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নানা খোঁজ নেই নি?
না, জানিনা সে বেচে আছে কিনা। তিক্ততা মেশানো গলার স্বর।
বললাম, আমি আবারও ক্ষমা চাইছি। ছোট বেলার ঐ খেলা বড় নিষ্ঠুর খেলা ছিল। আজ তা বুজতে পারছি।
বলে তাকালাম ওর দিকে। সে চেয়ে রইল দূরে, দুর আকাশের কোনে।
আমার চোখের কোণটা যে ভেজেনি তা নয়।
উঠে দাঁড়ালাম।
সে শাড়ীর আচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভিতর চলে গেলো।
সন্ধ্যা তাঁরা
দাদু, দাদু ওঠো, তুমি না খেলনা কিনতে নিয়ে যাবে বলেছিলে? ওঠো।
কেন? গতকালই না কিনে দিলাম সাইকেল টা?
না, আমি বারবী চাই। বারবী কিনে এনে তুমি আমাকে গল্প বলবে। সেই রাক্ষস খোক্কসের গল্প।
জানো দাদু, বাবা বলে আমি নাকি রাজকন্যার মতো দেখতে। আর মা শুধু বলে, দুধ খাও, দুধ খাও।
আচ্ছা দাদু, আমার মা তোমার কি হয়।
বৌমা।
কি—ব,ব,ব, ম,ম,– ধ্যাত।
তোমার মা কোথায় দাদু।
চলে গেছে।
দাদির মতো চলে গেছে ?
হাঁ।
দাদি দেখতে রাজকন্যার মতো ছিল?
ঐ দেখো ছবিটা ঠিক তোমার মতো, তাই তোঁ ভাবছি তোমাকে বিয়ে করব।
ধ্যাত, তুমি দেখতে মোটেই সুন্দর না। তুমি বলেছিলে বিয়ে করতে রাজপুত্র আসে ঘোড়ায় চড়ে।
হাঁ, আমি আসবো সাদা গাড়ীতে চড়ে, লাল টুকটুকে রাজকন্যাকে নিতে।
ধ্যাত, তুমি দেখেতে পচা। কখন যাবে দোকানে?
এই তোঁ যাবো, দুধ টা খেয়ে নাও।
না, আমি চকলেট দুধ চাই।
মা চকলেট দুধ দিতে বারণ করেছে। চকলেট দুধ খেলে তোমাকে অনেক বার বাথরুমে যেতে হবে।
জানো দাদু আমি এখন পটিতে বসতে পারি। আমি অনেক বড় হয়ে গেছি তাই না, দাদু।
হাঁ, অনেক বড় হয়েছ, এবার ঢকঢক করে দুধ টা খেয়ে নাও তোঁ দাদুমনি।
তুমি ও মার মতো দুধ খাও দুধ খাও বলও।
এই তোঁ লক্ষ্মীটি, সব দুধ শেষ, চলো আবার আমরা দোকানে যাবো।
উঠে Car Seat টা তে বসো।
না, আমি সামনে বসবো।
সামনে বসলে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে।
না, আমি বলব আমি বড় হয়েছি, পটিতে বসতে পারি।
Car Seat এ না বসলে আমি যেতে পারবো না, যেতে না পারলে বারবী কেনা হবে না।
জানো দাদু, বাবা বলেছে তোমাকে বিরক্ত না করতে। আমি কি তোমাকে বিরক্ত করি?
না, না আমি তোমার বাবা কে বলে দেবো, দাদুমনি আমাকে একটুও বিরক্ত করে না।
নামো, আসে গেছি।
ঐ দেখো দাদু, ট্রেন। আমি ট্রেনে চড়বো।
“ এরা কেন যে এইসব ট্রেন/ফ্রেম মলের মধ্যে নিয়ে আসে”।
দাদু দেখো ঐ ছেলেটার হাতে, আইসক্রিম। আমি আইসক্রিম খাবো।
আগে বারবী ,তারপর ট্রেন, তারপরই না আইসক্রিম খাবে।
না, আমি আগে আইসক্রিম খাবো।
ঠিক আছে, চলো লাইনে দাড়াও।
কেন? ঐ মেয়ে টা কে যেয়ে বলও।
দেখছ না, সবাই লাইনে দাড়িয়ে?
ধ্যাত।
এই ধ্যাত কথাটা কোথা থেকে শিখেছ?
মা বলে ধ্যাত—।
হু।
চলো ওই সোফাতে বসে আইসক্রিম টা শেষ করবে।
দাদু তুমি একটু খাবে?
দাও।
না না অতো বড় হা করে না। এই ভাবে চেটে চেটে খাবে। তুমি কিচ্ছু জানো না।
দাদু, দাদু দেখো, আইসক্রিমটা জামায় পড়ে গেছে। কি হবে ? মা তো বকবে।
কাদে না। বাসায় যেয়ে ধুয়ে ঠিক করে দেবো, মা জানতেই পারবে না।
তুমি সত্যি বলছ?
হাঁ।
আমার ঘুম পাচ্ছে।
চলো, সব কেনা কাঁটা শেষ। আইসক্রিম খেয়েছ, বারবী কিনেছ, ট্রেনে চড়েছ।
এসে গেছি।
দাদুমনি, দাদুমনি, ঘুমিয়ে পড়েছ?
একটু ওঠো, এবার এসো আমার কোলে, মাথাটা রাখো আমার কাঁধে।
এবার বিছানায় শুয়ে থাকো, আমি তোমার জুতো টা খুলে দেই।
গল্প বলো দাদু।
গল্প শুনবে, রাক্ষস খোক্কসের গল্প।
হ্যাঁ
তবে শোন,
সাতসমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে————————
ঠক ঠক ঠক, চোখ মেলে চাইলাম। পাশে তাকালাম। বিছানা খালি।
উঠে দরজা খুলতেই দেখি শান্ত আর বউমা।
হঠাৎ? কি মনে করে?
তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছি। বলল বউমা।
শান্ত একটা সাদাকালো ফটো এগিয়ে দিল। “দেখোতো কিছু বুঝতে পারো কি না”?
দেখলাম, ছোট্ট একটা হাত, শুধু আঙ্গুল গুলো দেখা যাচ্ছে। যেন বলছে, “ কি দাদু চিনতে পারছ”?
সাত নম্বর টেবিল
টেবিল নাম্বার সাত। কত হাসি কান্না ভরা কাহিনীর নীরব সাক্ষী। আমারও কাহিনী লেখা হয়ে ছিল ওরই বুকে। শেষ অধ্যায় টা সে দেখে যেতে পারেনি। এসে ছিলাম দেখা করতে, তখন সে হারিয়ে গেছে।
সাত সমুদ্র তেরো নদী পেড়িয়ে এসে ঐ সাতে কেন আমি ডুবে গিয়ে ছিলাম, জানিনা। সবই ভবিতব্য।
এসে ছিলাম এক ছোট্ট দেশ থেকে। একেলা। বন্ধুরা ঠাই দিয়ে ছিল। ইংরাজি পড়তে পাড়ি, বুজতে পাড়ি, বলতে গেলে বেঁধে যায়। অনেক কষ্টে মনে মনে গ্রামার ঠিক করে যদিও বা বলি ওরা বুঝতে পারে না আমার এক্সেনট।
হোয়াট, হোয়াট করতে থাকে। এমত অবস্তায় এক বন্ধুর সাহায্যে চাকরি পেলাম এক রেস্টুরেন্টে।
নাম মাদ্রাজ উডল্যান্ড। ওয়াটারের পদ।
বন্ধু আমাকে নিয়ে এসে পরিচয় করি দিলো ম্যানেজার ভাটিয়া সাহেবের সাথে। দরদী লোক। ডাক দিল দস্তগীর কে। ওয়াটার দের সে প্রধান। সাদা কালো সার্ট প্যান্ট পরা। গলায় কালো বো টাই। গায়ে কালো জ্যাকেট। শুধু ওরই এই বেশ। কারন সে প্রধান।
ভাটিয়া সাহেব বললেন, শিখিয়ে পড়িয়ে নেও। বলে উঠে পড়লেন। আমাকে সে নিয়ে এলো হলঘরে। পরিচয় করিয়ে দিলো শঙ্কর, আর সাত্তারের সাথে। শঙ্কর সাউথ ইন্ডিয়ান, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। এদেশে সে ওয়াটার, শুধু অপেক্ষায় আছে কবে পাশ করে এখানকার লাঈসেন্স টা নেবে। অমাইক। বন্ধুত্ত ওর সাথে খুব তাড়াতাড়ি গড়ে উঠেছিল, যেটা কোনদিন সম্ভভ হয়নি দস্তগীরের সাথে, ওর দাম্ভিকতার জন্য। সাত্তার ভাই, বয়সে আমার অনেক বড়। একি দেশের। সাহায্য করতো সব কিছুতে।
প্রথমে হাতে খড়ি হোল কি ভাবে ককটেল বানাতে হবে।
কি কি নাম। যেমন, ব্লাডি মেরী, জিন এন্ড টনিক ইত্যাদি। তারপর অর্ডারের প্লেট গুলো কি ভাবে হাতে নিয়ে আসবো। প্রথম প্রথম যে নার্ভাস হয়নি তা নয়, তবে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে রপ্ত হয়ে এলো।
এবার আমাকে টেবিল ভাগ করে দেওয়া হোল। সাত নম্বর টেবিল টা তার ই একটা। বেশ ভালই চলছিল ,বাদ সাধলও একদিন।
ঠিক সাড়ে নয়টায় সাত নম্বর টেবিলে এসে বসলো এক শ্বেতাঙ্গিনি। এই পর্যন্ত একলা আসা কোন সাদা মহিলার অর্ডার আমি নেইনি। শঙ্কর পিঠ চাপড়িয়ে বলল, নার্ভাস কেন, ভাই? এবার তোমার পরীক্ষা।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। আমার দিকে তাকাল সে। ঠোটের দুপাশে হাসির রেখা।
বললাম, কোন ড্রিঙ্কস খাবে কি?
বলল ব্লাডি মেরী।
আমার কি হোল জানিনা, শুধু মনে হোল এযেন কোকিলের কণ্ঠে কুহু কুহু ডাক। আমি তাকিয়ে রইলাম ওর নীল রঙের চোখের দিকে।
ও এবারও বলল, ব্লাডি মেরী।
আমি তাকালাম ওর মুখের দিকে। লালচে ভাব সেখানে। হাতটাতে সাদার চেয়ে লালের ভাব বেশি। ব্লাডি মেরী ওর জন্য পারফেক্ট। এ সবই আমার কল্পনা।
নিয়ে এলাম। ও সীপ দিলো। বলল, পারফেক্ট।
জিজ্ঞাসা করলাম, অর্ডার দেবে কি?
বলল, তুমি কি সাজেস্ট কর? এই প্রথম আমি কোন সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছি।
বললাম, যদি খিদে বেশি না লেগে থাকে তবে Dosa খাও। খুব সুস্বাদু।
এটা শঙ্করের শেখানো। বলেছিল, ভায়া অন্য কিছু সাজেস্ট করবে না। তুমি ব্যাখ্যা করতে পারবে না।
খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়াল সে। আমি এলাম। বলল, চমৎকার আইটেম। কটায় বন্ধ করো।
বললাম, সাড়ে দশটায়।
ও ঘড়ি দিকে তাকাল। ওহ, আই এম সো সরি। এগারটা বাজতে চলল।
একটু হেসে পা বাড়াল দরজার দিকে। আমি তাকিয়ে রইলাম ওর চলার দিকে।
পরদিন ঠিক একি সময়ে দরজা খুলে ভিতরে এলো সে। আমি দেখতে পাইনি। শঙ্করের কনুএর গুতা খেতেই তাকালাম। দেখলাম। সে যেয়ে বসলো সাত নম্বর টেবিলে। কি যেন খুজছে সে। আমি এগিয়ে গেলাম। আবারও সেই হাসি।
আমি ভাবছিলাম, ওর ঐ হাতটা যদি আমি ধরতে পারতাম, ওর ঐ লালচে ঠোঁটে যদি আমার ঠোটটা ছোঁয়াতে পারতাম।
হোঁচট খেতে যেয়ে সামলিয়ে নিলাম।
আজ শুধু সে অর্ডারই দিলো না, আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আমার পরিচয়, কোথা থেকে, কতদিন, কে আমি, এই সব।
এই টেবিল টা তে আমার বেশি সময় কাটান টা দস্তগীর ভাল চোখে দেখছিল না। আমি ফিরে আসতেই বলল, তোমার অন্য টেবিলেও লোক আছে ওদের দিকেও খেয়াল দিতে হবে।
কেনও জানি প্রথম থেকেই দস্তগীরের চোখে আমি প্রিয় পাত্র নই।
আমার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলো শঙ্কর, এলো সাত্তার ভাই।
কেয়া ইয়ার। উসকো যানে দো। উই উইল টেক কেয়ার হিজ আদার টেবিল। বলল দুজনে।
আমি অপেক্ষা করতাম কখন সাড়ে নয়টা বাজবে। সে আসবে। এ একটা রুটিনে দাড়িয়ে গেলো আমার জীবনে। দুই এক মিনিট দেরী হলেই বুকের ভিতর খচখচ করতো। এরই নাম হতো প্রেম।
অথচ আমি তার কিছুই জানিনা। সে আমার সব কিছুই জানে।
একদিন সাড়ে নয়টা থেকে দশটা বাজতে চলল। আমি উদ্গ্রীব হয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকলাম। অন্য এক জোড়া এসে বসলো সাত নম্বর টেবিলে। আমি গম্ভীর হয়ে যেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কি চাই তাদের।
বলল, একটু সময় দিতে।
বললাম, সাড়ে দশটায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। কথাটা আমার নিজের কানেই বিশ্রী শোনালো।
সে এলো না। শেষ কাস্টমার বিদায় দিয়ে জিন এন্ড টনিক নিয়ে বসলাম। সাত্তার ভাই চলে গেলো। শঙ্কর, আমি আর দস্তগীর। আজ আমি মাতাল হতে চাইলাম।
দস্তগীর বলল, চলো Striptease দেখে আসি। আমাদের বন্ধুর মনটা একটু খোলসা হতে পারে।
আজ আমি সব কিছু করতে রাজি। অথচ আমি নিজও জানি এ এক তরফা। শুধু শুধুই আমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলছি এক অদৃশ্য মোহর মধ্যে।
সেদিন অনেক রাতে ফিরলাম। রুমমেট রা জেগে। এতো রাত কোনদিন হয়নি। ওরা উদগ্রীব। মুখে আমার মদের গন্ধ। পা টলকাচছে। জসীম উঠে এলো। কোন কিছু জিজ্ঞাসা না করে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপরের ঘটনা আমার মনে নেই। পরদিন অসহ্য মাথা ব্যাথা নিয়ে ঘুম ভাঙ্গল। আয়নায় দেখলাম আমার চেহারা টা। চোখ জবাফুলের মত লাল। দুটো টাইলিনল মুখে পুড়ে দিলাম।
ওর নিটোল হাতদুটো আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকলো। আমি কল্পনায় ওর বুকের মাঝে মুখ গুজে দিলাম। ওর পারফিউমের গন্ধ আমার বিভিন্ন অংগে ভিন্ন রকমের সাড়া জাগাল। সবই আমার জাগ্রত মনের উদ্ভট চিন্তা। তবুও মনে হোল আজ সে সামনে থাকলে আমি আমার ভারজেনিটি হারাতাম।
কফির পানিটা বসিয়ে দিলাম।
আজ আমার ছুটির দিন। সময় কাটানো আমার পক্ষে দুরহ। মন টানছে মাদ্রাজ উডল্যান্ড এর দিকে। টাগ অফ ওয়ার চলছে। যাবো কি যাবনা। জিত হোল “যাবোর”।
আমি এলাম রাত নয় টায়। শঙ্কর, দস্তগীর অবাক হয়ে তাকাল।
শঙ্করের ভাগে আজ সাত নম্বর টেবিল। আমি বসে রইলাম বারে। সিগারেট টা ধরাতে যেয়েও ধরালাম না। সাড়ে নয়টা বাজতে কিছু সময় বাকি। দুরুদুরু করছে আমার বুক। আমি বার বার তাকাচ্ছি দরজার দিকে। দরজা খুললও। ঠিক সাড়ে নয়টা। সে নয়, অন্য এক কাপল। শঙ্কর এগিয়ে যেয়ে বসতে বলল দশ নম্বর টেবিলে। ওরা হাত দিয়ে দেখালও সাত নম্বর টেবিল টা। শঙ্কর তাকালও আমার দিকে। আমি হাত দিয়ে চোখ ডাকলাম।
সাত্তার ভাই আমার নাম ধরে ডাকতেই চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলাম।
লাল Skirt এর উপর কালো ব্লাউজ। চুলটা টেনে পিছনে বাঁধা। দস্তগীর হ্যালো বলতেই, কি যেন বলল সে। দস্তগীর হাত তুলে বার দেখালও। আমার সাথে চোখে চোখ হতেই হেসে এগিয়ে এলো।
আজ কাজ নেই বুঝি? জিজ্ঞাসা করলো সে। হেসে বলল, আজ তোমাকে অন্য রকম লাগছে।
বললাম, হলুদ জ্যাকেট টা নাই তো, তাই?
বলল, আজ আর বসবো না, তোমারও তো কাজ নেই, চলো তোমাকে এক জাগায় নিয়ে যাবো।
বলে ওর চোখের দৃষ্টিটা রাখল আমার চোখের উপর। আমি দেখলাম ওর নাকের কাছে ঘামের রেখা। মনে হোল হাত দিয়ে মুছিয়ে দেই। ওর লাল রঙের লিপস্টিক আঁকা ঠোট থেকে রঙ টা এনে লেপ্টীয়ে দেই ওর সাদা কপাল টিতে।
কি যাবে?
আমি আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে বললাম, চলো।
বেড়িয়ে আসতে যেয়ে পিছনে তাকালাম, শঙ্কর চোখ টিপে, আঙ্গুলে বিভিন্ন ইংগিত করে বোঝাতে চাইল, এনজয় দা নাইট।
পাশে পাশে হাটতে যেয়ে পায়ে পায়ে যে আমার বারি লাগেনি তা নয়। সে আমার হাতটা একবার ধরেই ছেড়ে দিলো। আমরা বা দিকে মোড় নিলাম। দুই কদম এগোতেই ডানদিকে বিশাল দশ তালা বিল্ডিং। সামনে এসে দাড়াতেই বলল, এই বিল্ডিং এ আমি থাকি। পাঁচ তালায়। তোমাকে আমার এপার্টমেন্ট টা দেখাবো। আপত্তি নেই তো।
আপত্তি? এই তো আমি চেয়েছিলাম। দুজনে একেলা। ও উজাড় করে দেবে ওর সব কিছু। আমি নিংড়ে নিংড়ে তা উপভোগ করব।
জিজ্ঞাসা করলাম একলা থাকো কি?
না, তবে এই মুহূর্তে সে নেই।
“তবে এই মুহূর্তে নেই” কথাটা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো আমার হৃদয়ে। কল্পনার তুলি দিয়ে যে চিত্র আমি এঁকেছিলাম মনে হোল তা মুহূর্তে ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেলো। তবুও আমি এর শেষ দেখতে চাইলাম।
উপরে উঠে এলাম। দুই বেডরুমের এপার্টমেন্ট। সাদা সোফার পরা লাল ডেকোরেটড বালিশ পাতা। কর্নারে ফুল গাছের মধ্যে নীল এলো। ড্রয়াইং রুমের জানালার পাশে একটা ছোট টেবিল। তার উপরে দুটো ছবি। একটু দুর থেকে ঝাপসা লাগল।
বলল, তুমি বসো, আমি আসছি। বলে সে ভিতরে চলে গেলো।
আমি উঠে ফটো গুলোর সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাচ্চা কোলে ছবি।
ওটা আমারই বাচ্চা, পাঁচ বছর বয়স।
ও যে কখন এসে পিছনে দাড়িয়েছে জানতে পারিনি।
এসো, তোমাকে সব বলছি। এই জন্যই তোমাকে আজ এখানে নিয়ে এসেছি। তোমার চোখের ভাষা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তাই তোমাকে সব কিছু জানানো আমার কর্তব্য।
আমি জুলিয়েটের দিকে তাকালাম। আমি যে আনন্দের স্রোতে আজ হারিয়ে যাবো ভেবেছিলাম, কোথায় যেন তার প্রতিবন্ধকতা আমি দেখতে পেলাম। জুলিয়েট কে মনে হোল সে অন্য কেউ।
বসো।
আমি বসলাম ওর সামনে। আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে দেখতে লাগল। তারপর বলল, তোমার ইনোসেন্ট ফেস টাই আমাকে আকর্ষণ করেছিল। বলতে বাধা নেই, তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আমি দেখছি,পরক্ষনে আমার অতীত আমাকে বাধা দিয়েছে।
এ হতে পারেনা। তোমার জীবন টাকে নস্ট করার অধিকার আমার নেই। তোমার হাসি তোমার উচ্ছলতা আমাকে প্রতিদিন টেনে এনেছে ঐ মাদ্রাজ উডল্যান্ডে, ঐ সাত নম্বর টেবিলটা তে ।
শোন আমার অতীত।
রজারসের সাথে দুবছর লীভ টুগেদার করার পর একদিন জানলাম আমি প্রেগন্যান্ট। রজারস বলেছিল যে আসছে তাকে পৃথিবীতে না আসতে দেওয়াই ভাল। আমি রাজি হয়নি। সেই থেকে তার সাথে আমার মনমালিন্য। একদিন এই বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হওয়াতে সে তল্পিতল্পা নিয়ে চলে গেলে। সেই শেষ আমি তাকে দেখেছিলাম।
মা বাবার কাছে থেকে বাচ্চা মানুষ করতে থাকলাম।
জসের বয়স যখন দুই কেন যেন মনে হোল স্বাভাবিক ছেলেদের মতো সে নয়।
কারোর সাথে খেলতে পারে না, মিশতে চায় না। কথা বলতে গেলে উচ্চারণ ঠিক হয়না। চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। সে যে কি চায় বলতে না পেরে ছবি দেখিয়ে দেয়।
মা আমাকে একদিন ডেকে বলল, জুলিয়েট, আমার মনে হয় Josh has Autism symptoms.
আমি মানতে চাইনি। বলেছি, ছোট কালে সব বাচ্চাই এই রকম থাকে। মা অনেক করে বলল, ডাক্তারের কাছে নিয়ে পরীক্ষা করিয়ে আনতে।
অবশেষে গেলাম। ওদের কথাই সত্যি। Josh has Autism symptoms. খুব সহজ নয় এই বাচ্চা মানুষ করা। তবু আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাস্তব বড় কঠিন পার্থ। বড় কঠিন।
এই বলে উঠে যেয়ে দুই গ্লাস হুইস্কি নিয়ে এলো। এগিয়ে দিয়ে বলল, খাও খারাপ লাগবে না। তারপর চেয়ার টা এগিয়ে এনে আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল, আমার এই জীবনের মধ্যে তোমাকে জড়াতে চাইনা। তোমাকে আমারও ভাল লেগেছিল। আজিই তার সমাপ্তি হউক। এই বলে সে উঠে দাঁড়াল।
আমি দাড়াতেই সে আলতো করে আমার ঠোঁটে চুমো দিয়ে বলল, ভাল থেকো, পেছনের দিকে তাকিও না।
তারপর?
তারপর শমিত দা, সে এক গল্প, তুমি লিখতে পারবে এই নিয়ে।
বলও।
আমি কিভাবে সেদিন বাসায় ফিরে এসেছিলাম বলতে পারবো না। মাদ্রাজ উডল্যান্ডএ আর ফিরে যাইনি। ওর কথাই আমি রেখে ছিলাম পিছনে আর ফিরে চাইনি। দেশ থেকে যে ডিগ্রী নিয়ে এসেছিলাম এখানে সেই ডিগ্রী নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম।
কোনদিন একবার কল ও করনি তাকে?
না। এইভাবে বছর চারেক পেড়িয়ে গেলো। আমি এক হাসপাতালে কাজ করি। আমার মনের সেই ক্ষত মিশে যেতে যেও মিশল না। একদিন ক্যাফেটেরিয়া কয়েক জন মিলে আড্ডা দিচ্ছি। একটু দূরে এক ভদ্রমহিলা তার চার বছরের বাচ্চা কে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, আর সে চিৎকার করে সব কিছু ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। ভদ্রমহিলা অপ্রস্তুত এবং লজ্জিত ভাবে চারিদিকে তাকাচ্ছে। আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। Autistic Child
ওর বাবা এসে কোলে তুলে নিলো। ও ওর বাবার গালে চড় ছাপ্পড় মারছে আর বাবা ওকে জড়িয়ে ধরে দুই গালে চুমো দিচ্ছে।
মনে পড়ল জুলিয়েটের কথা। মনে পড়ল যশের কথা। আমার পুরানো ক্ষতে নুতন করে বেদনা অনুভব করলাম।
বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
তখন সূর্য ডুবু ডুব। জুলিয়েট দের দশ তালা বিল্ডিং এর মাথায় সূর্যের শেষ আভা এসে পড়েছে। আমি তাকালাম চুড়ার দিকে। দরজা খুলে ভিতরে এলাম। এলিভেটর টা আসতে অনেক দেরী করছে মনে হোল। প্রতিটি মুহূর্ত মনে হচ্ছে এক যুগ। অবশেষে পাঁচ তালায় এসে দাঁড়ালাম। দরজায় টোকা দিলাম।
মনের ভিতর আমার ঝড় বইছে। দরজা খুলে গেলো।
জুলিয়েট।
সেই লালচে আভা গাল আরও লালচে মনে হোল। ও আমার দিকে তাকালও তার কাজলে আঁকা চোখ তুলে।
শুধু বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে।
তারপর?
তারপর, বলে, পার্থ তার ওয়ালেট থেকে একটা ফটো বের করে দিল।
ওরা তিন জন। বিয়ের সাজে জুলিয়েট, পার্থর ঠোট তার ঠোঁটে আর যশ জড়িয়ে ধরে আছে পার্থকে ।
যে কথা বলা হয়নি
শ্যামলী চলে গেলো। ঘরটা ফাকা। মেয়েটা আমার বুকের মাঝে একটা আঁচড় দিয়ে গেলো। বেশ তো ছিলাম। ছেলে মেয়েরা আসতো, দিনে দিনে চলে যেতো। এতো দিন ধরে তো কেউ থাকে নি আমার ঘরে।
পান থেকে চুন খসতে দেয়নি। চশমা, ঘড়ি ঘুচিয়ে রাখতো। মাঝে মাঝে বলতো, শমিত কাকা ইদানীং তুমি সব কিছু ভুলে যাচ্ছ। আমার কি ভয় হয় জানো?
কি?
না থাক। আমি ও কথা ভাবতে চাই না। শুধু উপরের ছিটকিনি টা লাগাবে না।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেনও রে?
বলেছিল, শুধু যা বললাম তাই শোন। আর তোমার কথা বলার একটা সাথি দরকার। ছেলে বন্ধু নয় মেয়ে বন্ধু। সতী খালা কে বলও মাঝে মাঝে এখানে চলে আসতে।
হাসতে হাসতে বলেছিলাম, শোন আমাদের সমাজ এখনও কুসংস্কার আর নীচমনা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। যদি দুই পা এগিয়ে কোন ভদ্র মহিলার সাথে কথা বলেছি অমনি সবার চক্ষু আমার দিকে। মনে হয় আমি যেন অস্পৃশ্য।
তোকে একটা ঘটনা বলি, আমার কয়জন বন্ধু আর বান্ধবী একদিন বেড়াতে গিয়েছিলাম। সবাই দুজন করে শুধু আমিই একা। হঠাৎ ই এক বান্ধবী কে বললাম, এসো তোমার সাথে সেলফী উঠাই। উঠালাম। বললাম, ফেসবুকে দেবো।
সে হৈ হৈ করে উঠলো। বলল, না না দিও না। তোমার সাথে ছবি দেখলে লোকে অন্য কিছু ভাববে। বললাম কেন আগে তো উঠিয়েছো?
তখন তুমি দোকলা ছিলে, এখন একলা।
বুজতে পারছিস। কাজেই অনেক ভেবে চিনতে চলতে হয়।
কত কথাই না ওর সাথে বসে বসে বলতাম।
যাওয়ার সময় চোখ টা মুছে বলেছিল, আমাকে মাঝে মাঝে কল করবে তো।
বলেছিলাম, করবো, যা সামনের থেকে, আর মায়া বাড়াস নে।
মনের মধ্যে মাকড়সার জালের মতো অনেক অনেক আগের ঘটনা গুলো ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। যা কিনা বলা হয়নি কাউকে।
মনে পরে কি ইয়াসমিনের কথা।
ও থেকে গিয়েছিল আমার বাসায়। একটু অস্বস্তি বোধ যে হয়নি তা নয়। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। বয়স বলে কথা। এখন সব কিছু শুষ্ক মরুভূমির মতো। তাতে দুব্বা গজাবে না। কাজেই ভয় এর কোন কারন নেই।
অনেক রাত পর্যন্ত দুজনে গল্প করেছিলাম। খুব যে একটা ওকে আমি চিনি তা নয়। দুই একটা ঘটনার মধ্যেই পরিচয়। তবুও মনে হয়েছিল ও অনেক পাল্টেছে। জীবনের উচু নিচু পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে আজ এখানে আসে পৌছেছে সেও ,আমিও। ফেলে আসা অবুঝ দিনের ঘটনা গুলো কোথায় যেন ভেসে গিয়েছে।
সামনে নেই ভবিষ্যৎ পিছনে হাসি কান্নায় ভরা। ওরও আমারও।
সেই সব কথা বলতে বলতে সতীর কল এসেছিল মনে আছে। কোন কারন নয়, শুধু জানতে চাওয়া। মনের ভিতরে একটু হাসি এলো, “ মেয়েলি মন”।
কথা শেষে ইয়াসমিন চলে গিয়েছিল ঘরে। আমি উপরের তাক থেকে লোটা কম্বল পেড়ে ড্রয়াইং রুমে শোবার আয়োজন করেছিলাম। ঢং করে পাশের ঘড়িটা জানালো রাত দুটো। চোখ টা বুজে এলো।
গরম নিশ্বাস আমার কপাল ছুয়ে গেলো। একটা ভেজা আঙ্গুল আমার ঠোট ছুঁইয়ে আস্তে আস্তে গ্রীবা পেরিয়ে বুকের কাছে এসে থেমে রইল কিছুক্ষণ। সারা শরীরে নেমে এলো আফিং এর মাদকতা। আমি আঙ্গুল টা ধরতে চাইলাম, পারলাম না। চোখ খুলতে গেলাম কে যেন দুই হাত দিয়ে বন্ধ করে দিল। আঙ্গুল টা আরও নিচে নেমে এলো। নাভীর কাছে। আমি না না বলে চিৎকার করে উঠলাম। ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো। এতো স্বপ্ন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
ইয়াসমিন দরজা খুলে বেড়িয়ে এসেছিলো। বলেছিল, কি হোল।
বলেছিলাম, দুঃস্বপ্ন। তুমি শুয়ে পড়।
এরপর আমরা দুজন বন্ধুত্তের বেড়া জালে আটকিয়ে গেলাম। নিউইয়র্ক শহর ঘুরেঘুরে ওকে দেখিয়ে ছিলাম। মাঝে মধ্যে সতী যোগ দিতো। যাওয়ার দিন বলে গিয়েছিল, দেশে এলে আমার বাসায় উঠবে।
রক্তে কেফিন দরকার বুঝতে পারছি। বাহিরের আকাশ টাও মেঘলা হয়ে এলো। দুই একবার বিদ্যুৎ চমকিয়ে গেছে। আজ আবহাওয়ার পূর্বাভাসে মেঘের ঘনঘটার কথা ছিল না। বলেছিল আকাশে থাকবে নীল মেঘের ছড়াছড়ি। কিন্তু কোথায়, হঠাৎ করে কোথা থেকে জড়ো হয়েছে এক গুচ্ছ কালো মেঘ। মাঝে মাঝে গর্জন করে তার উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে। আমি বাহিরে বসে কফিতে চুমক দিয়ে স্মৃতি মন্থন করবো ভেবেছিলাম। হোল না।
ভিতরে এসে বসলাম। ফোন টা বাজছে। শুভঙ্করের ফোন। না, আজ কারোর ফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না। তার চেয়ে শোন আমার কথা।
আমার খামখেয়ালি, অন্যমনস্কতা, অথবা উপেক্ষা করা, যাই বলা হোক না কেনও, দোষ টা আমার। আমি ছয় মাসের মধ্যে তার কোন খোঁজ নেইনি। সে তার ফোন নাম্বার টা রেখে গিয়ে ছিল, বলেছিল, মিন্টু ভাই, এই রইল আমার নাম্বার, পারলে কল করেন।
মনে পরে কি সাধনার কথা। স্বামী থেকে বিতাড়িত, কেন্সারে সর্ব শরীর জর্জরিত। কি ভাবে ভুলে গিয়েছিলাম তাকে। এমনি হয়।
সবাই নিজের বাস্ততায় মগ্ন। আমি বা তার ব্যতিক্রম হবো কেনও। খুজতে থাকলাম সেই কাগজ টা। যেখানে সে লিখে দিয়েছিল নাম্বার টা। কোথাও পেলাম না। অস্থির হয়ে এ ঘর ও ঘর করলাম অনেক বার। সতী কে কল করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে জানে কিনা।
বলে ছিল , সে কিভাবে জানবে।
তাই তো তার তো জানার কথা নয়। দুদিন পেড়িয়ে গেলো। হঠাৎ মনে পড়ল পুরানো মানিব্যাগ টার কথা। ওটার ভিতরে রেখেছিলাম। ওটা যে কেনও এতদিন ফেলে দেইনি তা উপরওয়ালাই জানেন।
চিরকুট টা পাইয়েছিলাম, কলও করেছিলাম। বলেছিলাম সাধনার সাথে দেখা করতে চাই, আসতে পারি কি?
ওপার থেকে বলেছিল, একটু দেরী হয়ে গেলো। গত মাসে সে চলে গেছে।
আমার নামটা জানার পরে বলেছিল, আপনার নামে একটা খাম সে রেখে গেছে। বলে গেছে কোনদিন যদি আপনি আসেন তবে আপনাকে দিতে।
সেদিন বসে ছিলাম অন্ধকার ঘরের মাঝে। বাহিরে আজকের মতো অঝোরে ঝরছিল। এ যেন আমার কান্না। আমি কাঁদতে পারিনি বলেই হয়তো বাহিরে তার প্রতিফলন হয়েছিল।
পৌঁছেছিলাম কমেকে। ওর বোনের বাসায়। দরজা খূলে দাঁড়াল যে সে অবিকল দেখতে সাধনার মতো। ভিতরে এসে বসতেই মেয়েটা একটা তোয়ালে এনে দিয়েছিল, সাথে একটা খাম। বলেছিল, মা বাসায় যেয়ে পড়তে বলেছে।
বড় বড় করে খামের উপর লেখা , মিন্টু ভাই।
চিঠি তে লেখা ছিল,
মিন্টু ভাই,
আপনার ফোনের আশায় থাকতে থাকতে আজ মনে হচ্ছে আর হয়তো দেখা হবে না। সময় আমার ফুরিয়ে এসেছে। কেন যে সেদিন আপনার নাম্বার টা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম তা জানিনা। এই চিঠি যদি আপনার হাতে পৌছায় তবে একটা অনুরোধ আমার মেয়ে টা কে রেখে গেলাম ওর খালার কাছে, আপনি শুধু মাঝে মধ্যে ওর খোঁজ নিয়েন। দাবি করবো না শুধু অনুরোধ। কেন জানি সব সময় আমার মনে হতো আপনি আমার বড় ভাই। যাওয়ার আগে আপনার দেখা পেলাম না। দুর থেকে আশীর্বাদ করেন যেন উপরে যেয়ে দুঃখের ভাঁড় আবারো বহন করতে না হয়।
ইতি
সাধনা
পড়া শেষে চুপ করে বসেছিলাম। ভাবলাম পাথরের গা বেয়ে পানি ঝরতে তো আমি দেখেছি । তবে আমার চোখ দিয়ে সেদিন পানি ঝরল না। কেন? হয়তো নিজেকে দোষী মনে হয়েছিল। তাই।
সুবর্ণ কে নিয়ে এসেছিলাম কিছুদিনের জন্য। ছিল আমার বাসায়। মাঝে মাঝে চলে আসে সে। মামা ভাগ্নী মিলে সময় আমাদের ভালই কেটে যায়।
দরজায় খট খট শব্দ। দরজা খুলতেই দেখি শুভঙ্কর। ভিজে একশেষ। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সোজা বাথরুম যেয়ে তোয়ালে টা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল, ফোন উঠাস নি কেন?
ইচ্ছা করে নি।
ওসব ভোগলামী ছাড়। তোর বৌদি তোকে যেতে বলেছে।
অগত্যা উঠতে হোল।