“ যেই মুহূর্তে আমি ওর চোখে চোখ রাখলাম, আমার সমস্ত শরীর ঠাণ্ডায় হীম হয়ে এলো। ওর নীল রঙ এর চোখ থেকে আমি আমার চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না। ওর হাসির মধ্যে যে উষ্ণতা তা ছড়িয়ে গেলো আমার শরীরের প্রতিটি অংগে। আমার শরীরের প্রতি টি লোমকূপ বলতে থাকলো এই সেই যার মাঝে তুমি খুজে পাবে তোমার ভালবাসা”। আচ্ছা শমিত কাকা এরই নাম কি প্রথম দর্শনেই প্রেম। বলে শ্যামলী তাকালও আমার দিকে।
হাঁ হাঁ করে হেসে উঠলাম।
“হতে পারে”।
শ্যামলী আমার কাজিনের মেয়ে। থাকে কানসাসে। কলেজ বন্ধ। এসেছে বেড়াতে। ভালই লাগছিলো ওর সঙ্গ। কোলাহল হীন বাসাতে একটু প্রান সঞ্চার হয়েছে।
“কিরে থেমে গেলি কেনও। খুলে বল”।
কোনদিন প্রেম করেছ?
কেন? তোর গল্প শুনতে গেলে আগে প্রেমের পরীক্ষায় পাশ করতে হবে কি?
তা না হলে তুমি ঠিক উপলদ্ধী করতে পারবে না।
“ওই মুহূর্তটা। মনে হয় অনেক গুলো প্রজাপতি পাকস্থলী তে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। একি গভীর ভালবাসার প্রথম নিদর্শন”।
পাকামো রাখ।
তবে শোন,
গিয়ে ছিলাম আমার বান্ধবী সোনিয়ার বাসায়। থাকে শিকাগো তে। শহর নয়, শহর ছাড়িয়ে বেশ দূরে। ছোট পল্লী।
ঐখানে এক বড় খেলার মাঠে বসেছে মেলা। সোনিয়া নিয়ে এলো সেখানে। বেশ জমেছে। ছোট বড় সবাই এসেছে। বিভিন্ন ধরণের স্টল চারিদিকে।
সোনিয়া কে বললাম, কফি না খেলেই নয়। এই সময় সোনিয়াকে ডাক দিলো ওর এক বান্ধবী।
বললাম তুই দেখা করে আয়। আমি কফির লাইনে দাঁড়াই।
সোনিয়া চলে গেল,
আমি কফি কিনে সোনিয়া কে কোথাও দেখলাম না। অগত্যা দাড়িয়ে কফিতে চুমুক দিতেই মনে হোল কে যেন আমাকে ডাক দিল। আমি দ্রুত পাশ ফিরতেই ধাক্কা খেলাম একজনের সাথে।
একে অপরের চোখের দিকে তাকালাম।
ওর নীল রঙ এর চোখ আটকিয়ে গেলো আমার চোখে। সে তার চোখ সরিয়ে নিলো না। তার চোখের চাহনি মনে হোল সমুদ্রের মতো গভীর, রাতের মতো অন্ধকার। চোখের বিদ্যুৎ শিখা আমাকে গ্রাস করলো। ওর সোনালী চুল বাতাসে চোখের উপরে আসে খেলা করছিল। আমি প্রথম দেখাতেই হারিয়ে গেলাম ওর মাঝে। কে যেন জাদুর কাঠি নেড়ে আমাকে অবশ করে দিলো। আমি মাথা থেকে সব কিছু ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না, আমার হৃদয় বলতে থাকলো, এ তোমার প্রথম ভালবাসা। প্রথম প্রেম।
বাহ! এতো রীতিমত নাটকীয়তা। তারপর?
মনে হোল কে যেন হ্যালো বলছে।
তাই তো, ও হাত বাড়ীয়ে দিয়েছে। আমি ওর হাত ধরলাম। বললাম, দুঃখিত।
ও বলল, আমার নাম ডেভিড।
ডেভিড, অতি প্রচলিত নাম। কিন্তু আমার কাছে মনে হোল, এই নামে আর কেউ নেই শুধু ও ছাড়া।
আমি বললাম, আমার নাম শ্যামলী।
ও হাসি দিয়ে উচ্চারণ করতে চাইল আমার নাম টা ,পারলো না।
আমি ওর হাসি টা দেখলাম। যেন মুক্তা ঝরে পড়ছে ওর হাসিতে। হাসি টা আমার হৃদয়ের কণে গেঁথে রইল।
ওর গলার স্বর বাদ্য যন্ত্রের মতো বাজতে থাকলো আমার শিরার মাঝে। সা রে গা মা —
এখানে নতুন বুঝি?
বললাম, হাঁ, এসেছি বাড়াতে। আছি সপ্তাহ দুই। মনে মনে ভাবলাম, ও যেন বলে এই দুই সপ্তাহ প্রতিদিন আমার সাথে বেড়াবে কি?
না সে তা বলল না, শুধু বলল হাতের এক্সট্রা কফি টা চাইলে পাবো কি?
ভুলে গেলাম ওটা সোনিয়ার জন্য কিনেছিলাম। এগিয়ে দিলাম। হাতে হাত স্পর্শ করলো। বিদ্যুৎ খেলে গেলো আমার সর্ব অংগে। আগে যে কোন ছেলের হাতে হাত লাগেনি তা নয়। কিন্তু এই স্পর্শ ভিন্ন। এর মাঝে ছিল মাদকতা।
কি বললি? কোথায়? কি খেলে গেলো?
দিলে তো। দিলে তো সব পণ্ড করে।
আই এম সরি। তারপর?
তারপর ও কফির কাপে চুমুক দিলো। ঠোটের পাশে লেগে থাকা পানির কণাটা হাত দিয়ে মুছে এগিয়ে দিলো হাত টা। আমি ধরার আগেই কোথা থেকে এক শ্বেতাঙ্গ কালো চুলের মেয়ে এসে ওর হাত টা ধরলও।
“ কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমি খুঁজছি তোমাকে”। বলে তাকাল আমার দিকে।
ওর কটাক্ষ দৃষ্টি আমার ভাল লাগল না।
আমার ভাবতে অসুবিধা হোল অন্য কেউ ওর হাত ধরতে পারে।
ও পরিচয় করিয়ে দিলো। নাম লরা।
লরা ভুরু কুচকে তাকাল আমার দিকে। পরক্ষনে ডেভিডের হাত টান দিয়ে বলল, চলো, ওরা সবাই অপেক্ষা করছে।
ডেভিড এক পা এগিয়ে এলো আমার কাছে। বলল, ছোট্ট শহর, দেখা আবার হবে বৈকি। খুজে বের করবো তোমাকে।
তারপর ওরা দুজন হাটতে হাটতে চলে গেলো।
আমি তাকিয়ে থাকলাম ওদের চলার পথে।
সোনিয়া আসে কাঁধে হাত দিলো। “ ও রকম ভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস”?
পাঁচ বছরের শোভন। ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকতো বাবার দিকে। ভুলে গিয়েছিলাম ওদের কথা।
একদিন টিভির পর্দায় দেখলাম বোমার আঘাতে বাম হাত হারানো সৈনিক বলছিল তার কাহিনী। তখনি মনে পড়লো হাতকাঁটা বশীরের কথা।
না সে সৈনিক নয়। লোকে তাকে বলে হাতকাটা ভিখারি। ভিক্ষা করে।
শান্তিনগরে টুইন টায়ারের সামনে প্রতিদিন সকালে আমি তাকে দেখতাম। দারোয়ান গেট খুলে দিতো। গাড়ীটা বের হতেই জানালার কাছে এসে দাড়াত সে। আমি যৎসামান্য টাকা ওর হাতে দিতেই হাসি দিয়ে সরে যেতো।
হাত পাততো অন্যের কাছে যেয়ে। এমনি ভাবে চলছিল দিন গুলো।
হঠাৎ একদিন ও এলো না, ওকে দেখলাম না গেটের পাশে। বুকের ভিতরে খচ করে উঠল। ওর সাথে হয়ত নিজের অজান্তেই একটা যোগসূত্র হয়ে গিয়েছিল। তা নাহলে মন খারাপ লাগবে কেন?
গাড়ী থেকে নেমে দারোয়ান কে জিজ্ঞাসা করলাম সে ওকে আজ দেখেছে কিনা।
বলল, দেখেনি।
পরদিন সকালে এলিভেটর দিয়ে নিচে নামার আগে বোন ডাক দিল। “ ছোট দা, কোথায় যাচ্ছিস নাস্তা না করে?”
“ নিচের থেকে আসছি। আজ বের হবো না”। বলে বেড়িয়ে এলাম।
গেটের বাহিরে আসতেই দেখি সে দাড়িয়ে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো।
“ সালাম স্যার”। বা হাতটা কপালে ঠেকাল। ডান হাত টা কনুই থেকে নেই। কথা বলার ভঙ্গি আর সালাম শব্দের উচ্চারণে মনে হোল পেটে তার বিদ্যা আছে। ভিখারি বৃত্তি এখন তার পেশা, কিন্তু এটাই তার পরিচয় নয়। কৌতুহল জাগলো।
টাকা টা দিতে দিতে বললাম, গতকাল তো তোমাকে দেখলাম না।
গতকাল ছিল আমার জীবনের মহা আনন্দের দিন।
তাই? তা সেই আনন্দটা কি নিয়ে।
উত্তর দিতে যেয়ে থেমে গেলো। সামনে এগিয়ে যেয়ে একজনের কাছে হাত পাতলো। যা পেলো পকেটে রেখে তাকালও সামনে, দৃষ্টি তার রাস্তার ওপারে।
আমি তার রুজীর ক্ষতি করছি ভেবে জিজ্ঞাসা করলাম, দিনে কি রকম পাও।
পরিমাণ শূনে মনে হোল আমি ঐ পরিমাণ তাকে দিতে পারবো।
বললাম, আমি তোমার জীবন বৃত্তান্ত শুনতে চাই। কেনও জানি আমার মনে হয়, এই পথ তুমি ইচ্ছে করে বেছে নেওনি। কি হয়েছিল? বলবে কি?
বলব।
রাজি হতেই বললাম, তোমার আজকের দিনের ক্ষতিপূরণ টা আমি পুরন করে দেবো।
পাশের চা র দোকানে এসে বসলাম।
সেই মুহূর্তে দারোয়ান এসে বলল, স্যার আপা আপনাকে ডাকছে।
ঠিক আছে। বলে ফোন করলাম। বললাম, আমার আসতে দেরী হবে। তোরা নাস্তা করে নে।
দোকানে ঢুকতেই সে বলল, স্যার, জানলার কাছে বসতে চাই।
বা হাত দিয়ে কপাল টা মুছে বলল, আমার নাম বশীর। বি কম পাশ করে ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিলাম। আট বছর আগে। থাকতাম টিকাটুলি তে। বৌ কাজ করতো স্কুলে। প্রতিদিন রিক্সা করে ওকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আমি চলে আসতাম কাজে।
আমাদের এক ছেলে। এখন বয়স ছয়। বড় দুষ্টু স্যার। নাম শোভন। ওর মা নামটা রেখে ছিল। তার নাম ছিল শান্তি।
বললাম, ছোট বেলায় সবাই দুষ্টু থাকে।
বলল, ও আমাকে একেবারে চোখের আড়াল হতে দেয় না।
কথা টা আমার বোধগম্য হলনা। ওর আসে পাশে আমি কোন ছেলে দেখিনি। তাহলে।
ঐ যে দেখছেন রাস্তার ওপারে, লাম্প পোস্টের নিচে বসা। ঐ আমার ছেলে। সাধারণত মাথা নিচু করে রাখে। দেখতে চায়না বাবা হাত পেতে বেড়াচ্ছে। অথবা ভাবে আমি লজ্জা পাবো ও তাকিয়ে দেখছে আমি হাত পাতছি কারো কাছে।
কোথাও রেখে আসলে পারো। বললাম বশীর কে।
ও থাকতে চায়না। পাছে আমিও হারিয়ে যাই।
ওর মা? প্রশ্ন করে তাকালাম বাহিরে । শোভন তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। ওকে দেখা যাবে সেইজন্যই সে জানালা টা বেছে নিয়ে ছিল।
বললাম, ওকে নিয়ে আসি, এখানে বসবে।
বলল, না, ও সামনে থাকলে আমি কথা বলতে পারব না। ওখান থেকেই আমাদের কে দেখতে পারবে।
আপনি শান্তির কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। শান্তির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে। সে তখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ক্লাস শেষে দাড়িয়ে ছিলাম বাসের আশায়। দেখলাম সেও দাড়িয়ে। একিই বাসে উঠে নামলামও একি স্টপেজে।
পরদিন ও একি পুনরাবৃত্তি।
তৃতীয় দিন সাহস সঞ্চয় করে কাছে আসে বললাম, যদি কিছু মনে না করেন, আমরা বোধ হয় একি দিকের যাত্রী। একটা রিক্সা শেয়ার করলে একটু পয়সা বেশি পড়বে, তবে এই ঠেলাঠেলির হাত থেকে বাচা যাবে। কি বলেন?
আমার কপাল আর হাতের তালু ভিজে ভিজে মনে হোল।
সাহসের পরিচয় দিয়েছিলে বলব।
তা বলতে।
সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, যদি রিক্সা যোগাড় করতে পারেন বাস আসার আগে, আর শোনেন, এই টাকার বেশি আমি দিতে পারবো না, তাতে যদি রাজি থাকেন। টাকার পরিমাণ দেখে বুজলাম আমার গাঁটির থকে বেশ কিছু খসবে। জানেন তো
তখন টাকাটা মুখ্য নয়।
জানি, অভিজ্ঞতা আছে। তারপর।
রিক্সা পেলাম। উঠে পড়লাম। সেই শুরু।
পাশ করে চাকরি পেলাম। বিয়ে শাদীর পর্ব শেষ। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিলাম। সেও পাশ করে স্কুলে চাকরি নিলো।
শোভন এলো। ভালই যাচ্ছিল দিল গুলো।
শুধু আমার বাবা মা দুজনেই গত হলেন।
শাশুড়ি চলে গেলেন গ্রামের বাড়ীতে শ্বশুরের অবর্তমানে।
আমাদের যাওয়ার পথে শোভন কে নামিয়ে দিতাম ওর এক বান্ধবীর বাসায়। সেদিন দেরী হয়ে যাওয়াতে পাশের বাসার মহিলার কাছে শোভন কে রেখে গেলাম।
নিয়তির খেলা, কেউ জানেনা।
ঢাকা শহরে গাড়ী ঘোড়া কি ভাবে চলে তা তো আপনার অজানা নয়। হঠাৎই ফুট ফাট গুলীর শব্দ। লোকের দৌড়া দৌড়ি। যে যেদিক পারছে দৌড়াচ্ছে। কেউ কেউ রাস্তায় মাথা নিচু করে বসে পড়েছে। সেই মুহূর্তে পিছন থেকে একটা বাস ধাক্কা দিলো আমাদের রিক্সা কে। উল্টে গেলো রিক্সা। আমি শান্তি কে ধরতে যাওয়ার আগেই সে ছিটকে পড়লো রাস্তায়। সেই মুহূর্তে একটা জীপ ধাক্কা দিল ওকে। আমি পড়ে যেয়ে ওর দিকে হাত বাড়াতেই জীপ টা আমার ডান হাতের উপর দিয়ে চলে গেলো। আমি চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। এই টুকুই আমি জানি।
যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম আমি হাসপাতালে। চাদর দিয়ে ঢাকা শরীর। জিজ্ঞাসা করলাম নার্স কে, আমি কোথায়?
বলল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে।
আমার স্ত্রী?
বলল, উনি হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে পারেনি তার আগেই মারা গেছেন। আপনার মানিব্যাগ থেকে ঠিকানা পেয়ে বাসায় খবর দেওয়া হয়েছিল। আপনার ছেলে আর প্রতিবেশী বাহিরে বসে আছে।
আমি উঠতে যেয়ে অনুভব করলাম আমার ডান হাত নড়ছে না। নার্সকে বললাম আমার গায়ের চাদর টা সরিয়ে দিতে।
দেখলাম, আমার ডানহাত টা কনুই থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। আমি কাঁদতে থাকলাম। শোভন আর বাবুলের মা, বাবা এলো আমার পাশে। কি আর সান্ত্বনা দেবে। জিজ্ঞাসা করলাম, শান্তি কে কি দাফন করা হয়েছে।
বলল, না, আপনি একটু সুস্থ হয়ে মৃত দেহ সনাক্ত করলে ওরা রিলিজ করবে। তখন দাফন দেওয়া যাবে।
বাসায় এলাম দুই সপ্তাহ পরে। শোভন শুধু কেঁদে বেড়ায়। ডান হাতটার অভাবে আমি কিছুই করতে পারিনা। মানসিক দিক দিয়ে ভেঙ্গে পড়লাম। নিজের চেহারা আয়নায় দেখলে ভয় পাই।
তুমি কাজে ফিরে গেলে না? জিজ্ঞাসা করলাম।
ওরা বলল আরও কিছুদিন বিশ্রাম নাও। টাকা পয়সার টানা টানি দেখা দিল। ফিরে গেলাম কাজে মাস খানেক পর।
ম্যানেজার ডেকে পাঠাল তার অফিস রুমে। তখনি মনে হয়েছে দিন আমার ফুরিয়ে এসেছে এখানে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তা বুঝিনি।
চাকরি টা চলে গেলো। ভদ্র ভাবে জানালো আমার কাজ টা আর আমার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। তাই টাকা পয়সা সব বুঝিয়ে দিলো।
তারপর? কোথাও কিছু হোল না?
না, কে দেবে চাকরি এই অক্ষম কে। টাকা যা ছিল আস্তে আস্তে শেষে হয়ে এলো। বাসা ছেড়ে দিয়ে বস্তীর এক ঘরে এসে ঠাই নিলাম। ছেলে টার দিকে চাইতে পারতাম না। মাঝে মাঝে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম।
একদিন এই বস্তীর একজন বলল, কি করবে ভায়া। ভিক্ষাবৃত্তি তে নেমে পড়ো। তোমাকে দেখলে লোকের সহানুভূতি হবে।
রেগে ওকে অনেক গালাগালি করেছিলাম। কিন্তু পেটের জ্বালা বড় নিষ্ঠুর। ঐ জ্বালা মেটাতে এই পথে আসতে হোল।
যা পাই তাতে কোন রকমে চলে যায়।
দুই বছর হয়ে গেলো এই পথে। ছেলেটা কে কিছুঁই কিনে দিতে পারিনা।
ও দোকানের বাহিরে সুন্দর করে সাজানো জামা কাপড়, জুতো গুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কিছু বলে না। শুধু বলে, বাবা তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা।
সেই মুহূর্তটা আমি আপনাকে বুঝাতে পারব না স্যার। শুধু মনে হোল, আমার জীবন সার্থক। ছেলের মুখে আমি হাসি দিতে পেরেছি।
গত কাল শোভন ঐ জুতো পরে আমার সাথে গিয়েছিল শিশু পার্কে।
দৌড়ে দৌড়ে কখনও মেরী গো রাউন্ড কখনও দোলনা তে উঠছে। আর আমার দিকে তাকাচ্ছে। ঐ দিনটা ছিল আমার জীবনের বড় আনন্দের । ওর হাসি আমাকে ভুলিয়ে দিয়ে ছিল সবকিছু।
রোজগারের খাতা শূন্য বলে মনে কোন আপসোস ছিল না। এই দিনটা তো আর একবার আমার জীবনে ফিরে আসবে না। একটা দিনতো আমরা বাপ, ছেলে মিলে হাসতে পেরেছিলাম। এযে কত বড় পাওয়া তা শুধু আমি জানি।
বলে সে থামল। তাকাল লাম্প পোস্টের দিকে।
আমিও তাকালাম। দেখলাম, শোভন তার হাতদিয়ে জুতো টা মুচছে।
Iceland থেকে গতকাল ফিরে এলাম। পাঁচ দিন চর্কির মত ঘুরেছি। দেখেছি প্রান ভরে। তাই ভাবলাম সব কাজ ফেলে আজ বিশ্রাম নেবো। কিন্তু বিঁধি বাম। ফোনটা বেজে উঠল। ওটা বন্ধ করে রাখব ভেবেছিলাম। তা করলেই ভালো হতো।
অন্যমনস্ক ভাবে হ্যালো বলতেই বুজতে পারলাম এখন আর রেখে দেবার কোন উপায় নেই।
আমি ইয়াসমিন। বলে চুপ করে রইল।
বললাম, কোথায় তুমি। সেই যে মাস খানেক আগে কল দিয়েছিলে, আসবে বলে, তা কবে আসবে?
এসেছি, আমি JFK এয়ারপোর্টে। অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। আগের থেকে বললে কোন একটা অজুহাত হয়তো দিতে। তাই নিউইয়র্কের মাটিতে পা দিয়েই তোমাকে কল করলাম। আসছ তো নিতে?
আমার মাথায় বজ্রাঘাত। এই মুহূর্তে ইয়াসমিনের সান্নিধ্য আমার কামনা নয়। আমি চেয়েছিলাম বিশ্রাম তার পরিবর্তে- যাক তা যখন হবার নয়, বললাম, তুমি অপেক্ষা কর আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে ডেল্টা টার্মিনালে আসছি।
ভাবনা আমাকে পেয়ে বসল। সেই কম বয়সে দেখা ইয়াসমিনের সাথে আজকের ইয়াসমিনের কতটুক পার্থক্য আমার জানা নেই। সতী এই মুহূর্তে গেছে মেয়ের কাছে। সে থাকলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারতো।
চলার পথে কথা সেই বলতে থাকলো। তার নিজের কথা। আমি শ্রোতা।
অনেক পিছনে চলে গেলো সে, প্রথম স্বামী ছিল মাতাল। সরকারের কোন এক ডিপার্টমেন্টে উঁচু পদে কাজ করত।
কাজের শেষে ক্লাবে যাওয়া ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার। অনেক রাতে ফিরে আসতো মাতাল হয়ে। চেষ্টা করেছিল পথে আনার।
পারেনি। ফলে ইতি টানতে হয়েছিল তিন বছরের শেষে।
বললাম। আবারো ঐ পথে পা দিয়েছিলে ?
দিয়েছিলাম।
অনেক দিন একা একা ছিলাম, হঠাৎ আমার এক বান্ধবীর বাসাতে ওর ভাই এর সাথে দেখা। সেই ছিল আমার জীবনে দ্বিতীয় জন। অতি ভদ্র। এক মেয়ে এলো আমাদের জীবনে। ওকে মানুষ করে দিয়ে যেতে পারলো না, তার আগেই ধরা পড়ল ওর লিভার সিরোসিস। দুবছর কষ্ট করে চলে গেলো। বলতে বলতে চোখটা মুছে নিলো। আমরাও এসে পৌছালাম আমার এপার্টমেন্টের কাছে।
দরজা খুলে দিলাম। ও ভিতরে ঢুকল।
দেখছ তো, ছোট্ট এক চিমটে কামরা। তোমার হয়তো অসুবিধা হবে। সতী এলে ওর ওখানে থাকতে পারবে।
সতী, সতী কে? কৌতুহল নিয়ে তাকাল সে আমার দিকে।
আমার এক বান্ধবী।
কেন? তোমার এখানে থাকতে দেবেনা? ওর গলার স্বরে ব্যাকুলতা।
আমার আপত্তি কোথায়, আপত্তি ঐ লোকজনের।
এখনও ওই ঘুনে ধরা সমাজ নিয়ে আছো?
আমিতো ছাড়তে চাই, আমাকে ছাড়তে দেয়না।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “ আচ্ছা, তুমি তো প্রতাপের কথা শুনতে চাইলে না”।
জিজ্ঞাসা করতাম, সময় আর সুযোগ বুঝে। তা তুমিই যখন ঐ নাম টা উঠালে, বলও কি হয়েছিল।
প্রতাপ কে আমি কোন সময়ই ভালবাসিনি শমিত। ওকে আমি শুধু ব্যবহারই করেছি আমার নিজের স্বার্থে। যখন সে বুঝতে পারলো তখন নিজে থকেই সরে গেলো। শুনেছি দেশের বাহিরে কোথাও আছে। বড় ভালো ছেলে ছিল।
তুমি জানো কি, কোথায় সে?
না জানি না।
দেখে মনে হোলও ক্লান্ত সে। মানসিক না শারীরিক বুজতে পারলাম না।
খাওয়া শেষে সে গেলো বিশ্রাম নিতে শোবার ঘরে। আমি ড্রয়াইং রুমে বসে টিভি টা অন করলাম। কখন যে চোখ টা বুজে এসেছিল বলতে পারবো না। ঠক ঠকানো শব্দে ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো। টিভি টা তখনো চলছে।
দরজা খুললাম। সজীব আর তার বৌ, অনীমা।
কি ব্যাপার? অসময়ে? ভিতরে এসো।
এসে বসল। ওরা থাকে আমার দুই ব্লক দূরে। হঠাৎ পরিচয় হয়েছিল Costco তে বাজার করতে যেয়ে। বয়সে অনেক ছোট ,কিন্তু সম্পর্ক টা বন্ধুত্তের পর্যায়ে।
“শমিত দা তৈরী হয়ে নেন টম ক্রুজের নতুন মুভি এসেছে দেখতে যাবো”। বলেই অনীমা তাকাল আমার শোবার ঘরের দিকে। ওর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে আমি তাকালাম পিছনে। ইয়াসমিন এসে দাঁড়িয়েছে।
সরি শমিত দা, আমি জানিনা যে আপনার গেস্ট আছে। অত্যন্ত লজ্জিত স্বরে বলল অনীমা।
সরি হবার কিছু নেই। পরিচয় করিয়ে দেই, আমার কলেজের বান্ধবী। আজি এসেছে সানফ্রান্সীস্ক থেকে। যদি টম ক্রুজের নতুন মুভির পরিবর্তে কফি আর ঝালমুড়ি মুখরোচক মনে হয় তবে এখানে বসো, আমি কফির পানি চাপিয়ে দেই। কি বলও?
সজীবের কিছু বলার আগেই অনীমা বলল, আমি রাজি, আর ইয়াসমিন আপার সাথে গল্প করে সময় টা বেশ কাটবে।
বললাম, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সতী ও এসে হাজির হবে, টেক্সট পাঠিয়েছিল।
অনীমা আর ইয়াসমিন কফির পেয়ালা নিয়ে বসলো ব্যাল্কনীতে। কি নিয়ে কথা ওদের মাঝে বুঝলাম না তবে হাসির উচ্ছল বন্যাতে মনে হোল টপিকস টা তাদের দুজনেরই পছন্দ।
সজীব ফাইনেন্সে পাশ করে একটা বড় হেজ ফাণ্ডে কাজ করে। ফলে আমাদের আলোচনা স্টক নিয়ে। বড় বড় কোম্পানির আরনীং রিপোর্ট কি হতে পারে তাই নিয়ে। সময় কাটানো। সময় অবশ্য কেটেও গেলো। পেড়িয়ে গেছে দুই ঘণ্টা।
অনীমা ব্যাল্কনীর দরজা খুলে এলো লিভিং রুমে।
“ শমিত দা, ইয়াসমিন আপাকে বলছি আমাদের ওখানে যেয়ে থাকতে, কিন্তু রাজি হচ্ছে না”।
আমার মনে হোল ওকে বলি আর একটু পীড়াপীড়ি করো। হয়তো রাজি হতে পারে। কিন্তু হলনা।
ওরা বিদায় নিলো।
আমি আর ইয়াসমিন এসে বসলাম সোফাতে। দূরত্ব বজায় রেখে। ইয়াসমিন তার মোটা ফ্রেমের চশমাটা মুছতে মুছতে বলল,
“আচ্ছা শমিত তুমি আর ও পথে পা বাড়ালে না কেন?”
“ কারন যা পেয়েছিলাম সেটাকে হারাতে চাই না বলে”।
“ যদি বলি এটা তোমার ভুল ধারনা। মানুষ অতীতে কে নিয়ে বাচে না, তা জানো তুমি?”
“ আমি হয়তো বা ভিন্ন ওদের চেয়ে”।
জানো শমিত, আমি— , কথা শেষ হোল না, দরজায় একবার টোকা পড়ল। আমি উঠতে যাওয়ার আগেই দরজা খুলে গেলো। সতী দাড়িয়ে।
সময়ের আগেই চলে এলে। মেয়ে বাধা দিল না? আমার জিজ্ঞাসা।
বাধা যে দেয়নি তা নয়, কেনও জানি ভাবলাম চলেই যাই। অনেকদিন তো হোলও।
সতী তাকাল ইয়াসমিনের দিকে।
আপনিই সতী? বলে ইয়াসমিন উত্তরের অপেক্ষায় রইল।
আমি মনস্তাত্ত্বিক নই। কাজেই দুজনের মনের গভীরতাতে যেয়ে ঘুরপাক খাওয়া আমার সইবে না।
বললাম, “তোমরা দুজনে কথা বল, পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার আছে বলে মনে হয় না। আমি ঐ ঘরে বসে হাতের কাজ গুলো শেষ করে নেই”। দরজা খোলা রইল।
শমিত বলেছিল আপনার কথা। ওর কথা বলার সাথি। শূনে খুব ভালো লাগলো। আরও বলছিল, আপনার কাছে যেয়ে থাকতে। বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ইয়াসমিন।
সতী একটু এগিয়ে এসে বলল, তাই তো আমি তাড়াতাড়ি চলে এলাম। দুজনে মিলে অনেক গল্প করা যাবে। কি বলেন?
কিন্তু আমার তো যাওয়া হবে না বোন।
সতীর চোখে অবিশ্বাসের ছাপ। কেন? প্রশ্ন করলো সে।
আমি এসেছি শমিতের সাথে কিছুদিন কাটিয়ে যেতে। হয়ত ওর সাথে আমার আর দেখা নাও হতে পারে। এই দেখাই হয়তো শেষ দেখা। বলে সে তাকাল খোলা দরজার দিকে।
যাক, তোমাকে বলি, কেনও জানি মনে হচ্ছে তুমি আমার অনেকদিনের চেনা। শমিত কে বলও না। মনে থাকবে?
থাকবে। বলেন। সতী উৎসুক ভাবে তাকালও ইয়াসিনের দিকে।
এসে ছিলাম চিকিৎসা করাতে। তা আর হোলও না।
কিসের চিকিৎসা ?
Bone marrow transplant করতে। ডাক্তার বলল, করা যাবে না। কাজেই আমার হাতে আছে মাত্র চব্বিশ থেকে ছত্রিশ মাস। তাই ওকে দেখতে এলাম। ওর সাথে কয়টা দিন কাটিয়ে যাই।
সতী তাকিয়ে রইল ইয়াসমিনের দিকে। কোন কথা নেই মুখে।
তোমার কাছে তাই থাকা আমার হোলও না।
আমি বেড়িয়ে এলাম। দুজনের চোখ ভেজা। কোন কিছু বোধগম্য হলনা।
সতী বলল, ইয়াসমিন আপা তোমার কাছেই থাক যে কয়দিন আছে। আমি প্রতিদিন এসে দেখে যাবো।
আমি তাকালাম সতীর দিকে।
চোখ ফেরাতেই আয়নায় দেখলাম ইয়াসমিনের ঠোটের নিচে রহস্যের হাসি।
ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। আসলে স্বপ্নটাই আমার ঘুমটা কে ভেঙ্গে দিলো। এতকাল পরে লুতু ভাই কেনও আমার স্বপ্নের মাঝে দেখা দিলো তা জানিনা। সে বলে গেলো, তুই নাকি ইদানীং ছাই ভস্ম কি সব লিখছিস। তা আমাকে নিয়ে লেখ না।
ঐ পর্যন্ত।
তারপর সে হারিয়ে গেলো। আমি উঠে বসলাম। সকাল হয়ে এলো। আমি কফির পানিটা বসিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। সামনে লাল গোলাপের ঝারে দুই তিনটে চড়ুই পাখি কিচিরমিচির করে দৌড়িয়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় লোকেদের আনাগোনা এখনও নেই। আজ বন্ধের দিন।
কফিটা হয়ে গেছে। সকালে বাসি মুখে কফির সাধই আলাদা। উঠে গেলাম। কফিটা এনে হেলান দেওয়া চেয়ারে বসতেই দেখতে পেলাম চড়ুই পাখি গুলো কোথায় যেন চলে গেছে। কিচিরমিচির শব্দ আর নেই।
আমি একেলা। না একেলা নই। সঙ্গী আছে একটা ঘুঘু পাখি। আমার সামনের লনে ভয়ার্ত নেত্রে তাকাচ্ছে চারিদিকে। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল আমার দিকে। তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নেড়ে মাটিতে ঠোকর দিতে থাকলো।
ঘড়ির কাঁটা ছটা ছুঁইছুঁই করছে। মন চাইছে সতীকে কল করতে। এতো ভোরে সে উঠেনি। ফোন করাটা ভদ্রতা নয় জানি। তবুও।
লুতু ভাই। লুতু ভাই দেখা দিয়ে চলে গেলো। লুতু ভাইয়ের কথা আমি বলতে চাই সতীকে। দেরী করে নয়। তাহলে সব হারিয়ে যাবে আমার মন থেকে। বলতে চাই তার রিক্সা চালানোর কাহিনী, তার হারিয়ে যাওয়া হাতটার কথা। আয়েশা ভাবীর কথা। ছোট্ট এক চিমটে ঘরে সুখের আলো ছড়িয়ে পড়ার কথা। সেই ডাক, “ ও ছোট বাবু—-“।
“এতো ভোরে কেনও কল করেছ? সব ঠিক তো”? সতীর ঘুম থেকে জাগা কণ্ঠস্বর।
আমি তোমাকে লুতু ভাই এর কথা বলব। তুমি এসো।
কে লুতু ভাই, কোন লুতু ভাই? ওর কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর। উৎকণ্ঠার সুর।
মাঝে মাঝে সে বিরক্ত হয় আমার উপর, আমার উদভট সব আবদারের জন্য। কিছু বলে না সে। মেনে নেয়।
আজ ও তাঁই হোল।
বললাম নাস্তা করবে এখানে এসে।
যদিও তার নাস্তা তাকেই বানিয়ে নিতে হবে তা সে জানে। আমি শুধু চা র পানিটা বসিয়ে দেবো।
চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে চলে এসেছে সে। মেকাপের কোন বালাই নেই। এসেই সোজা রান্না ঘরে। কোথায় কি থাকে সে জানে।
বললাম, তোমার একটু অসুবিধা হোল, তাঁই না? হাজার হলেও বন্ধের দিন।
অমলেট টা বানাতে বানাতে বলল, আমার অসুবিধা হলে আমি কি আসতাম? থাক সে কথা, বাহিরে বসে আমি শুনতে চাই তোমার লুতু ভাই এর কথা। তুমি যেয়ে বস। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি ওখানে।
শুধু তার নাস্তা নয়, আমার জন্য এক কাপ কফি এনে বসলো সে তার পরিচিত চেয়ার টায়।
তাকাল সে।
এবার আমার পালা।
শোন।
ও ওর হাতের থালাটা নামিয়ে রাখল কফি টেবিলের উপর।
বলও।
জানো, জন্ম থেকে আমি দেখছি লুতু ভাইকে আমাদের বাসাতে।
সে কি তোমাদের বাসাতে কাজ করতো ? জিজ্ঞাসা করলো সতী।
না, কাজ করতো বাবার অফিসে। কেউ ছিল না তার। শুনেছি, একদিন বাবার অফিসের সামনে এসে বসে ছিল। বাবা অফিস থেকে বের হবার পথে ওকে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল এখানে সে বসে আছে কেন।
উত্তরে বলেছিল তার একটা কাজ দরকার।
বাবার কি মনে হয়েছিল জানিনা, দুদিন পরে আসতে বলেছিল। এই দুদিন বাবা তার বসের সাথে কথা বলে চাকরির একটা ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সেই তার শুরু। কাজের শেষে আমাদের বাসাতে আসতো। মা কে ডাকতো মা বলে।
থাকতো দুরেরে এক গ্রামে। নাম তার পরানপুর। বাবার ভিটেতে এক ছোট্ট ঘর। সেটাই তার মাথা গোঁজার জাগা।
মা বলতো, লুতু তুই আমাকে পান এনে দিতে পারবি বাজার থেকে।
না করে নি।
আমাকে কাঁধে করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো।
মা বলত, দেখিস ও যেন পড়ে না যায়।
তোমার তখন বয়স কত? সতীর কৌতূহল।
তিন কি চার।
আর ওর বয়স।
হয়তো বিশ। রাতের খাওয়া শেষে সে তার সাইকেল নিয়ে চলে যেতো পরানপুরে। মা সকালের খাওয়ার জন্য কিছু বেঁধে দিতো।
আমাকে ডাকতো সে ছোট বাবু বলে। বলতে পারো লুতু ভাই এর কোলে চড়ে চড়েই আমি একদিন বড় হয়ে গেলাম।
মা একদিন লুতু ভাই কে ডেকে বলল, ওরে লুতু তোর তো এবার বিয়ে করা দরকার। মেয়ে খুঁজবো?
লুতু ভাই সলজ নয়নে মার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাখল। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।
তুমি বিয়ে করবে লুতু ভাই? বলতেই সে বলে উঠল,
ধ্যাত। চল বাজারে যাই, মার জন্য পান আনতে হবে।
একদিন সত্যি সত্যি মা লুতু ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্তা করল। দুরের এক গ্রামে। আমরা সবাই মিলে গেলাম মেয়ে দেখতে। বাবা গেলো না। বলল, তোমরা যাও, সাথে করে মিষ্টি নিয়ে যেও।
লুতু ভাইয়ের পরনে মার দেওয়া সাদা পাঞ্জাবি। ঘোড়ার গাড়ীতে করে আমরা যাচ্ছি।
কেন? আর কোন যান বাহন ছিলনা? প্রশ্ন করে সতী তাকাল আমার দিকে।
জানো, কোন সালের কথা আমি বলছি? পঞ্চাশ দশকের। সেই সময়ে গ্রামে যেতে হলে হয় গরু গাড়ী নয়ত ঘোড়া গাড়ী।
এবার শোন।
তোমাকে কি আর এক কাপ কফি এনে দেবো।
না, এখন নয়।
বল, তারপর?
লুতু ভাইয়ের পাশে আমি বসা। মা পিছনে। সাথে মার বান্ধবী, পশু ডাক্তারের বৌ, আমেনা খালা।
লুতু ভাই আমার কানে কানে বলল, ছোট বাবু, তুই কিন্তু সব সময় আমার পাশে থাকবি।
আমরা পৌছালাম। মাটির তৈরী ঘর। মুরগী, ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে উঠানে। একটু দূরে হাত চাপা পানির কল, তারি পাশে একটা কুয়া। একটা ছোট মেয়ে কুয়া থেকে পানি উঠিয়ে গোসল করছে।
আমরা এসেছি ভর দুপুরে। ছোট্ট ঘরে একটা খাট পাতা। সেই খাটে আমরা সবাই বসলাম। মা আর লুতু ভাই সামনে, আমি আর খালা পিছনে। মেঝেতে মাদুর পাতা।
মেয়ের খালা মেয়ে কে নিয়ে এলো। হলুদ শাড়ী পড়া। পায়ে আলতা। মুখে পাউডারের ছোপ টা একটু বেশি। মাটির দিকে মাথা নুইয়ে বসলো সে মেঝেতে।
তুমি মেয়েদের এই আলতা, পাউডার এতো সব জানলে কি ভাবে। ইঁচড়ে পাকা ছিলে তুমি। তাই না?
বড় ব্যাগরা দাও কথার মাঝে। তখন আমার বয়স কত জানো? তেরো কি চোদ্দ। কাজেই—
সতী হাসতে হাসতে বলল, ঠিক আছে। এবার বলও। আমি খুব টেনশনে আছি।
মাথা নুইয়ে বসলো সে মেঝেতে। মা নেমে এলো। থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উচু করে ধরল।
দুমাস পরে লুতু ভাই বিয়ে করে নিয়ে এলো আয়েশা ভাবী কে সেই ছোট্ট ঘরে। আমি এলাম দেখতে। লুতু ভাই ভাবীকে ডেকে বলল, উনি আমাদের ছোট বাবু, তোমার এক মাত্র দেবর। খুব আদর যত্ন করবে। কোন ত্রুটি যেন না হয়।
ভাবী এসে আমার মুখ টা উচু করে ধরে বলল, বাহ, বেশ মিষ্টি চেহার। কি বলে ডাকব, ছোট বাবু?
আমি লজ্জা পেলাম, মা ছাড়া এই প্রথম কোন মেয়ের হাতের স্পর্শ আমার মুখে লেগেছে।
কি ব্যাপার ছোট বাবু, তোমার গাল টা তো লাল হয়ে গেছে। বলে হাসতে হাসতে আমার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।
আমি চলে এলাম। ওরা দরজায় ছিটকেনি উঠিয়ে দিলো।
আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম বোর্ড পরীক্ষা নিয়ে। মাঝে মাঝে লুতু ভাই আর ভাবী আসতো আমাদের বাসায়। ভাবী মার সাথে কথা শেষে আমার ঘরে এসে বসতো আমার পাশে। চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, কেমন আছো ছোট বাবু। অনেক দিন তুমি আসো না আমাদের বাসায়।
ওদের ওই ছোট্ট বাসাতে আমি গেছি। মনে হতো একটা সুখের নীড়। কিছুই নেই ঘরে। অথচ ওদের দেখে মনে হতো সব কিছুই আছে ওদের। নেই কোন অভাব নেই কোন অনটন।
একদিন বাবা বাসায় এসে মা কে বলল, জানো, লুতু কাজ ছেড়ে দেবে।
কেন? মা আকাশ থেকে পড়ল।
ও রিক্সা কিনবে।
মা বলল, তাতো ভালো কথা। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবে। ওকে বলবেন আমার সাথে যেন দেখা করে।
পরদিন এসে মা কে সালাম করে বলল, মা আপনে হবেন আমার রিক্সার প্রথম যাত্রী।
সতী জিজ্ঞাসা করলো, তারপর?
জানো সতী সুখ বড় ক্ষণস্থায়ী।
কেন বলছ? ওদের কি কিছু হয়েছিল?
তবে শোন—
আমি তখন স্কুল শেষে দূরের কলেজে চলে গেছি পড়তে। একদিন একটা চিঠি এলো মার।
লেখা, পারলে বাসাতে এসো, কথা আছে।
এই টুকুই লেখা।
পরদিন ট্রেনে চেপে চলে এলাম। মা বাবার মুখ গম্ভীর। জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? কিছু বলছ না কেন?
বাবা বলল, একটা রিক্সা করে মা কে নিয়ে লুতুর বাসায় যাও। তাহলে সব জানতে পারবে।
সারা পথ মা চুপ, আমিও ভয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করছি না।
রিক্সা এসে থামল। মা কে নামিয়ে এসে দাঁড়ালাম উঠানে। সেখানে ভাবী আলুথালু বেসে বসা। মা এগিয়ে গেলো।
মার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকলো ভাবী।
আমি কিছুই বুঝলাম না। ঘরের দরজা খোলা। পা দিলাম। মেঝে তে লুতু ভাই শোয়া। একপাশ ফিরে। গায়ে চাদর উঠানো।
আমাকে দেখে বলল, এসেছিস ছোট বাবু, বস।
বললাম, তোমার রিক্সা তো বাঁধা দেখলাম, কি হয়েছে বলত? জ্বর?
কোন কথা না বলে চাদর টা সরিয়ে দিলো শরীরের থেকে।
আমি তাকিয়ে রইলাম। কনুই থেকে শুধু একটা কাপড় ঝুলছে।
আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। আমি চেপে ধরলাম কনুই টাকে। ঝুলে পড়া কাপড় টাকে মুচড়িয়ে হাতের মধ্যে নিয়ে এলাম। মনে হোল ওটাকে টেনে ছিড়ে খণ্ড খণ্ড করে ফেলি।
তুই কাঁদিসনে ছোট বাবু। আমি আবার দাঁড়াব। এক হাতে রিক্সা চালাবো। শালা, ঐ ডাক্তার, ছোট্ট একটা ফোড়া কাটতে যেয়ে হাত টাকে বিষাক্ত করে ফেলে ছিল। গেংগীরীন হয়ে গেল। কোন উপায় ছিল না। কেটে ফেলতে হলও।
কান্না চেপে বললাম, তুমি আবারো দাঁড়াবে লুতুভাই, আমি তোমার এক হাতে চালানো রিক্সায় উঠব।
উঠেছিলাম। সেই শেষ উঠা। আমাকে নিয়ে ঘুরে ছিল সারা শহর। শুধু দুর পাল্লায় যেতে পারত না। মনের বল। শুধু তারই জোড়ে চলতো সে।
বাবা মা একদিন সেই শহরের মায়া ছেড়ে চলে এলো রাজধানী তে। আমি সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলে এলাম এদেশে।
তারপর?
অনেক বছর পরে আমি গিয়ে ছিলাম ঐ পরানপুরে। সেই বাসা আর নেই। চারিদিকে জঙ্গলে ভরা। দেখা হোল আমার বন্ধু মতলেবের সাথে। জিজ্ঞাসা করলাম লুতুভাই এর কথা। চিনতে পারলো না।
বললাম, এক হাতের রিক্সা চালক।
বলল সে নেই। একদিন রিক্সা নিয়ে চলেছিল দূরপাল্লায়। ক্লান্ত সে। দ্রুত ছুটে আসা দৈত্যের মতো ট্রাক ধাক্কা দিয়ে চুরমার করে দিলো ওকে ওর রিক্সাকে।
আর ভাবী মানে লুতু ভাইয়ের বৌ কোথায় জানিস।
না। এখান থেকে চলে গেছে। কোথায় কেউ জানেনা।
আমি ফিরে এলাম।
জানো সতী, দেখা হলে বলতাম, “ ভাবী, যাবে তুমি ছোট বাবুর সাথে, যাবে কি”?
“আচ্ছা ,আপনি আমাকে ফলো করছেন কেন? বলবেন কি?”। প্রশ্ন টা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আমি রাস্তার চারিদিকে একবার তাকিয়ে নিলাম। কারন ভদ্রমহিলার গলার স্বর একটু উচুতে। দুই একজন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। রাস্তার দুপাশের অধিকাংশ পথচারীরা আমাদের ভাষায় কথা বলে। কথাটা যে তাদের কানে যায়নি তা নয়। এবং অনেকেই ভদ্রমহিলার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে না তা বলা কঠিন। আর হঠাৎ করে উনি যে ঘুরে দাড়িয়ে প্রশ্ন করবেন তাও আবার উচ্চস্বরে ভাবতে পারিনি। আমিই একটু পা চালিয়ে উনার কাছে যেয়ে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো, এমনি ভেবে ছিলাম। তার আগেই—
যাক সামনা সামনি যখন হয়েই পরেছি আর আশে পাশে কেউ যখন এগিয়ে আসছে না তখন মনে বল নিয়ে বললাম, আপনাকে আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল এবং এখন ও হচ্ছে, তাছাড়া আপনার কাধের ব্যাগ টাও আমার খুব পরিচিত। বলবেন কি কোথা থেকে কিনেছেন?
ভদ্রমহিলা আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।
বললেন, এই ধরনের কথা আর কতজন কে বলেছেন?
বললাম, আমাকে দেখে কি আপনার তাঁই মনে হয়। আসলে ঠিক এই সাপের চামড়া দিয়ে বানান ব্যাগ, একই ডিজাইন এমন টি অনেক অনেক আগে আমি কিনেছিলাম।
তারপর?
দিয়েছিলাম একজন কে।
বাহ, আপনি তো রীতিমত নাটক তৈরী করে ফেললেন এই রাস্তায় দাড়িয়ে। লেখা টেখার অভ্যাস আছে নাকি?
লিখি, লোকে পড়ে না। যদি কিছু মনে না করেন কোন এক জাগায় বসে এক কাপ চা খেতে খেতে কথা হবে, অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে।
আপত্তি নেই, বেশ ইন্টারেস্টীং লাগছে।
ভদ্রমহিলা হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন।
ঘড়িটাও আমার চেনা। কিনে ছিলাম শিল্পভাণ্ডার থেকে। বলে থামলাম।
তার মানে এটা আপনি আমাকে দিয়েছেন, এই —
কথা শেষ হতে না দিয়ে বললাম, না তা নয়, ওটা কি সিটিজেন ঘড়ি?
কি ভাবে জানলেন।
চলুন চা খেতে খেতে কথা হবে।
লোকেরা আর আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমরা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছি। কিছু একটা ঘটতে যেয়েও ঘটলনা দেখে ওদের মনক্ষুব্ধ।
বসলাম এসে পাশের রেস্টুরেন্টে।
ভদ্রমহিলার ঠিক কপালের কাছে দুই তিন টা পাকা চুল। কানের লতী দুটো একটু ঝুলে গেছে দুল পড়তে পড়তে।
এখন কানে দুটো পার্লের টপস পড়া। ওটাও আমার পরিচিত।
বললাম, ওই কানের টপস দুটা কি ফরচুনঅফ থেকে কিনেছেন?
কোথা থেকে বললেন?
ফরচুনঅফ।
নাম শূনেনি। এটাও কি আপনার পরিচিত?
সত্যি কোথা বলতে কি ঠিক ধরেছেন।
দুই কাপ চা আর সাথে দুটো সমুচা রেখে গেলো অল্প বয়স্ক মেয়ে টা।
জিজ্ঞাসা করলাম, আরও কিছু অর্ডার দেবো কি?
বলল, না ডিপ ফ্রাইড জিনিস খুব একটা খেতে চাই না। মুখরোচক, কিন্তু সইতে পারিনা। হার্ট বার্ন হয়।
তারও হতো।
কি বললেন।
না কিছু না
ভদ্রমহিলা চা র পেয়ালায় চুমুক দিয়ে, হু,আহ্ হু,আহ্ করে উঠল।
গরম চা খাওয়ার অভ্যাস নেই? তাই কি?
ঠিক ধরেছেন। তা আপনার আর কি কি জিজ্ঞাসা করার আছে?
রাগ করলেন।
রাগ করলে তো আপনার সাথে এসে বসতাম না। কৌতুহল।
ঐ যে বললাম, আপনার ব্যাগ টা আমাকে আকর্ষণ করেছিল। একটু হাত দিয়ে দেখব কি?
ভদ্রমহিলা ব্যাগ টা এগিয়ে দিলেন। চোখের দৃষ্টি আমার মুখের দিকে।
আমি সাপের চামড়া দিয়ে বাধানো ব্যাগ টার উপর হাত বুলাতে বুলাতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
ভদ্রমহিলার ডাকে ফিরে এলাম। কি হোল? ঘোর কাটল?
জানেন এই ব্যাগ টাতে আমার অনেক স্মৃতি মেশানো।
এই ব্যাগ টা নয়, আপনার সেই ব্যাগটা। বেশ জমে উঠেছে। আপনি বলেন, আমি শুনি।
আর এক কাপ চা র অর্ডার দেই, কি বলেন?
মন্দ না।
হাত উচু করে ইশারায় জানালাম আরও দু কাপ চা দিতে।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্র। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক বন্ধুর সাথে গিয়েছিলাম। কেন? আজ তা মনে করতে পারছিনা। বন্ধু উপরে চলে গেলো। আর আমি নিচের তালায় দোকান গুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। হঠাৎ ই চোখে পড়লো ব্যাগ টা। এতো বড় হোটেলের চকচকে পলিস করা দোকানে ঢুকতে সাহস হচ্ছিল না। আবার ব্যাগটার মোহ কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। বার কয়েক দোকানের সামনে পায়চারি করে একসময় সাহস সঞ্চয় করলাম।
ভিতরে ঢুকলাম। দোকানের কর্মচারী কে বললাম, ব্যাগ টা একটু দেখাবেন কি?
অনীচ্ছুক ভাবে ভদ্রলোক আমার সামনে রাখল। আমি ব্যাগটার উপর দু এক বার হাত বুলালাম।
ব্যাগ টা নেওয়ার মতো কেউ ছিল কি?
ছিল।
তারপর?
তারপর, আমি জানি ওটা আমার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে তবুও দাম টা জানলাম। এটাও জানি ব্যাগ টা কিনতে হলে আমাকে একটু অভাবের মধ্যে পড়তে হবে।
সামনের মাসের খাওয়ার জন্য বরাদ্দ যে স্কলারশিপের টাকা আছে ওটাই আমার সম্বল। ব্যাগ টা কিনলেও মাত্র চার পাঁচ দিনের মতো খাওয়ার টাকা আমার হাতে থেকে যাবে। ভাবলাম পরের টা পরে। ব্যাগ টা আমার চাই।
ভদ্রলোক কে বললাম, কাল এসে নিয়ে যাব।
ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে উঠিয়ে রাখল ব্যাগটা।
পরদিন এসেছিলেন?
এসেছিলাম, ভদ্রলোক হাসিমুখে কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে আমার হাতে দিলো।
ওকে বলে এসেছিলাম আজ তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবো।
সারপ্রাইজ হয়েছিল কি?
ভীষণ।
আর আপনার খাওয়া? মাত্র তো তিন চারদিনের টাকা ছিল।
সে আরেক কাহিনী। খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিলাম। তাতে করে কিছু টাকা এক্সট্রা থাকল। এমন সময় দেশের রাজনৌতীক রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিলো। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দাওয়া হোল। আমি বাসায় চলে এলাম। খাওয়ার কথা চিন্তা করতে হলনা।
এতো দেখছি রীতিমত সিনেমার গল্প।
বলতে পারেন। জানেন, ব্যাগ টা ঠিক আপনারই মতো এই ভাবে কখনও ঝুলিয়ে কখন কাঁধে নিয়ে হাঁটত সে।
আমার কথা শেষ হতেই ভদ্রমহিলা পিছনের দিকে তাকাল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
তারপর তাকাল আমার চোখের দিকে।
কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো। দুজনের কারো মুখে কোন কথা নেই।
সেই কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আমিই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এবার বলুন আপনার কথা। কোথায় থাকেন?
সাফক কাউন্টী তে।
আর কেউ আছে কি?
ওর সাথে সেপারেসনে আছি।
কেন ?
কোন উপায় ছিলনা। পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল। চলে এলাম । সেই সময় কম দামে ছোট্ট একটা জায়গা পেয়ে গেলাম ,কিনে নিলাম। ওখানেই একটা রুম ওরা আমাকে বানিয়ে দিয়েছে আমি দিব্যি আছি।
একেবারে একেলা।
না তা নয়। আসে পাশে দুই একজন বন্ধু বান্ধবী আছে। ওদের সাথে কথা বলে সময় কাটে।
আপনাকে বলতে অসুবিধা নেই, ও প্রতি সপ্তাহে এক গোছা লাল গোলাপ নিয়ে দেখা করতে আসে।
এই যে বললেন সেপারেসনে আছেন।
ভদ্রমহিলা হাসল, “ সে তো বাহিরে, মনের দিক থেকে তো নয়”।
বাহ্, বড় রোম্যান্টিক মনে হচ্ছে?
আসলে তাঁই।
ওয়েট্রেস এসে জিজ্ঞাসা করল, আরও কিছু লাগবে কি?
ভদ্রমহিলা তাকাল আমার দিকে, বলল, সরপুঁটি দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু হাতে সময় নেই। আমার শেষ ট্রেন তিনটা একচল্লিশে।
তাহলে উঠতে হয়।
দীর্ঘও একটা নিশ্বাস ফেলল ভদ্রমহিলা। চোখের কোণটা কালচে মনে হোল। কাজলের দাগ নাকি ঘুমের অভাব, জানিনা।
রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম দুজন।
ও এগিয়ে গেলো।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম আবার দেখা হবে কি?
ঘাড় ফিরে তাকাল সে, মুখে হাসি, আমি থমকে গেলাম হাসি দেখে, বলল সে, দেখা হবে রোববারে।
রোববারে?
অসহ্য শব্দ কান ঝালাপালা করে দিলো। চোখ মেলে চাইলাম। অ্যালার্ম টা বাজছে। রাত তিনটা বিশ। সেহেরী খেতে হবে।
তিনটা একচল্লিশ, খাওয়ার শেষ সময়।
ওর কথাটা বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরতে থাকলো,
দেখা হবে রোববারে।
সকাল দশটা। নাস্তা শেষে গরম কফিটা উপভোগ করছিলাম। সেই সাথে সকালের খবর গুলো দেখছিলাম CNN এ। দরজা খোলার শব্দে তাকালাম। আমার ঘরের চাবি আছে কয়েক জনের কাছে। ওরা সবাই আসা যাওয়া করে শুধু একজন ছাড়া। কাজেই ধরে নিয়ে ছিলাম কে হতে পারে। তবে এতো সকালে কেনও সেটাই আমার প্রশ্ন।
না, আমার ভুল। দরজা খুলে ঢুকল সতী। আমার দিকে তাকিয়ে চাবিটা রেখে দিলো হাতে ঝুলানো ব্যাগ টার মাঝে।
কি ব্যাপার এতো সকালে?
“সকালে মানে? তুমিই না কাল রাতে কল করে বললে যত তাড়াতাড়ি পারো এসো। কথা আছে। ইদানীং তুমি অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছ, শমিত”। কথা গুলো বলে এগিয়ে গেলো আমার ছোট্ট রান্না ঘরের দিকে।
“চা র পাতা এনে রেখেছিলে”?
রেখেছি, তবে তুমি যে ব্রান্ড বলেছিলে সেটা পাইনি। অন্য টা এনেছি।
চা র পানি বসিয়ে সে এসে বসলো সোফাতে।
কোন ভূমিকা না করেই বললাম, ইয়াসমিন আসবে সামনের সপ্তাহে।
কোন ইয়াসমিন?
ঐ যে— , কথা শেষ না করে তাকালাম ওর দিকে। সে মিটমিট করে হাসছে।
বলল, সেই ইয়াসমিন যে তোমার যৌবন কালে, মানে ইয়ে, —
ফাজলামি রাখো, এখন বলও কি করব? সে আমার এখানে থাকবে।
তোমার এখানে থাকবে, মানে? তুমি কি হা বলেছ?
সতীর সেই মিটিমিটি হাসি নেই। রীতিমত সিরিয়াস। ওকে একটু রাগাতে ইচ্ছা করলো।
তা কোথায় সে থাকবে বলো। আমি নাহয় মেঝেতে থাকবো, ওকে দিয়ে দেবো আমার ঘর টা।
ইয়ার্কি করছ? ওর এখানে থাকা হবে না। উচিৎ ও নয়। আমি যাবো তোমার সাথে এয়ারপোর্টে। বলে চা টা আনতে উঠে গেলো।
তাহলে কি করা যাবে? গত বার নিউইয়র্কের বাহিরে যাচ্ছি বলে পাড় পেয়ে ছিলাম, এবার তা হচ্ছে না।
দেখা যাক কি করা যায়। তোমার চিন্তা করতে হবে না, আমি একটা ব্যবস্থা করবো। শেষ কথা হচ্ছে ওর এখানে থাকা হবে না।
সতীর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে রীতি মতো উদ্বিগ্ন । আমিও চাইছি না সে এখানে থাকুক। তবে করণীয় কি আছে সেটাও জানিনা। তবে এটা ভেবে নিশ্চিত আমার চেয়ে সতীরই গরজ বেশি।
সতী আর কথা বাড়াল না। চা টা শেষ করে বলল, আমি উঠি। দিনের দিন আমাকে নিয়ে যাবে এয়ারপোর্টে। আর তোমার চাল বাড়ন্ত। সময় করে কিনে রেখো।
বললাম, ঠিক আছে।
সতী চলে গেলো। আমি টেলিভিশন টা চালিয়ে দিলাম। সেই এক গেয়েমী খবর। নর্থ কোরিয়ার মিসাইল টেস্ট। আমেরিকা হুমকী দিচ্ছে কিছু একটা করবে এই বলে। অথবা কোথাও পুলিশ আর জনগনের মধ্যে সংঘর্ষ। পৃথিবীর কোথাও শান্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। এই সব চিন্তা ভাবনার সময় ফোন টা বেজে উঠল।
অনেকদিন পর শুভঙ্কর কল করেছে।
বললাম, কি মনে করে? বৌদি ভালো তো?
ভালো, সন্ধায় আসতে পারবি রংমহল রেস্টুরেন্টে?
কি ব্যাপার?
মুকুল এসেছে। আড্ডা দেওয়া যাবে। বড় এক ঘেয়েমী হয়ে গেছে জীবন টা।
দেখা হবে, বলে ফোনটা রেখে দিলাম।
মুকুল, বন্ধুদের মাঝে সেই ছিল সবচেয়ে কাছের।
মুকুলের শেষ কথা টা আজও মনে বাজে,
” চললাম শমিত’।
কোথায়?
উত্তর না দিয়ে সে চলে গেলো।
সেই শেষ দেখা। তাও তো আজ বিশ বছর হয়ে গেলো।
শুভঙ্কর মাধ্যমেই পরিচয় হয়েছিল ওর সাথে। বন্ধুত্ব টা গড়ে উঠেছিল খুব তাড়াতাড়ি। হয়ত ওর সুন্দর খোলা মনের জন্য। হাসতে জানে আবার হাসাতেও জানে। সেই হাসি একদিন মুছে গেলো। হয়তো ওর হাসির কোটা ফুরিয়ে গিয়েছিল।
ভুলি নি আমি সেই রাতের কথা।
নিউ ইয়ার্স ইভ। আমরা সবাই এসেছি শুভঙ্কর এর বাসায়। সারা রাতের প্রোগ্রাম। থেকে যাবো রাতে।
টাইম স্কয়ারে লোকে লোকারণ্য।
পাঁচ, চার, তিন, দুই, এতা। রাত ১২ টা। নতুন বছরের সূচনা।
আমি আমার হাতের কার্ড টা অন্য একজন কে দিয়ে উঠে এলাম।
কি হয়েছে?
আমার সাথে আয়। বলে নিয়ে এলো সেইখানে যে খানে সব ভাবী, বৌদিরা বসে দেখছে লীমীনার (মুকুলের বৌ) নাচ। নাচ বললে ভুল হবে, এ শুধু আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঘুরছে, ঘুরছে গানের সাথে, “ তোমাকে চাই, তোমাকে চাই—“ ।
মুকুল শুধু বলল, এই রুপ আমি কখন দেখিনি।
কঙ্কনা তাকালও আমার দিকে। ইশারায় ডাকল আমাকে। কাছে যেতেই কানে কানে যা বলল আমি তা শুনতে প্রস্তুত ছিলাম না। যদিও বললাম, তোমার সাথে আমি একমত নই।
ফিরে আসতই মুকুল বলল, আমার আজ বাসায় চলে যাওয়াই উচিৎ। ভাল লাগছে না।
যাই করিস ঠাণ্ডা মাথায় করিস। বললাম, তুই যা ভাবছিস তা হয়ত না।
ও ডাক দিলো লীমীনা কে। লীমীনা শুনতে পেলো বলে মনে হোল না। কাছে যেয়ে মুকুল ওর ঘারে হাত রাখতেই মনে হোল লীমীনা ফিরে এলো বাস্তবে।
কি হয়েছে?
বাসায় যেতে হবে, আমার শরীর টা ভালো লাগছে না।
লীমীনা যেতে প্রস্তুত আছে বলে মনে হোল না।
“ কেবল না পার্টি টা জমে উঠেছে এখনি যাই যাই করছ কেন? উপরে যেয়ে রেস্ট নেও তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে”। বলে গান টা বাজানোর জন্য হাত বাড়াল। হাত ঐ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই মুকুল ওর হাত টা চেপে ধরল।
আমি তাকালাম কঙ্কনার দিকে। কঙ্কনা এসে দাঁড়ালো ওদের মাঝে।
“ চলেন ভাবী, আমরা অন্য কিছু করি, আজ আর নাচ নয়। অনেক দেখলাম”। বলে নিয়ে গেলো অন্য ঘরে।
মুকুল কে নিয়ে আমি চলে এলাম। অন্যরা কেউ কিছু দেখল না, জানলো না, ওরা তাসের খেলায় মত্ত।
ভোর হওয়ার আগেই মুকুল চলে গিয়েছিল। বিদায় না জানিয়ে।
তারপর?
তারপর সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো, যে আমি কোন কিছু বোঝার আগেই দেখলাম সব শেষ।
মুকুল বলেছিল, লীমীনা আর একজনের সাথে কয়েক মাস ধরে যাওয়া আসা করছে। তাদের মধ্যে কার সম্পর্ক এতো গভীর যে ওরা নতুন করে নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়।
লীমীনা আরও বলে ছিল, মুকুল বন্ধু হিসাবে ভালো, স্বামী হিসাবে নয়।
আজ এতো বছর পর ওকে দেখব। মাঝের সময় টুকু তে কত কিছু ঘটে গেলো সবার জীবনে। তবুও মনের মাঝে একটু শিহরন।
আমি এসে দাঁড়ালাম রংমহল রেস্টুরেন্টে। দরজা খুলে ভিতরে এলাম। চশমা টা ভালো করে মুছে তাকালাম সামনে।
মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। ও উঠে দাঁড়াল। সেই মন ভুলানো হাসি। শুধু সামনের দুটো দাঁত কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তাপ মাত্রা ষাটের কোঠায়। যেতে হবে অনেক দূরে। পেন্সালভেনীয়ার এক ছোট্ট শহরে। আড্ডা মারতে। তিন ঘণ্টার পথ। ইউসুফ-সেলিমার বাসা। এক সাথে পড়তাম, ঘুরতাম, চা খেতাম, সিগারেট টানতাম। টানতাম বলছি এইজন্য যে আমার দুই আঙ্গুলের মাঝে ওটা আর আসেনা। কিন্তু ইউসুফ ছাড়তে পারেনি। আসবে ফাতেমা-সাইদ, এহসান-সেলিনা, আমিন-শেলি। রাতে ওদের বাসায় থেকে যাবো সেই ভাবে কাপড় জামা গুছিয়ে নিলাম। কফি মাগে কফি, সাথে কিছু ভাজা পোড়া বেঁধে গাড়ী টা স্টার্ট দিলাম।
ইউসুফ যে পথ দিয়ে যেতে বলেছিল সে পথে সার্ভিস ষ্টেশন নেই রাস্তার পাশে। এই বয়সে শরীরের অনেক গ্ল্যান্ড গুলোর কার্জ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। ফলে থামতে হয় বেশ কয়েক বার। তা না হলে কিডনির উপর চাপ পড়ে।
আমি অন্য পথ বেছে নিলাম। রাস্তায় যতটা ভিড় হবে মনে করেছিলাম ততটা নয়। পুলিশের আনাগোনাও কম। একেলা এতো ঘণ্টা গাড়ী চালায়নি অনেকদিন হোল। কেউ না কেউ সাথে থাকতো।
দীর্ঘও পথে কথা বলার একজন সাথি থাকলে ভালো লাগে। আজ সেটা অনুভব করলাম। I-Pod এ অনেক গান ধরে রাখা আছে। গান গুলো অনেক অনেক বার করে শোনা। মিউজিকের শুরুতেই বলে দিতে পারি কোণ গান টা শুরু হচ্ছে। তাঁই হয়তো আকর্ষণ টা কমে এসেছে।
অপূর্ব সুন্দর গলার গায়ক গায়িকা দের অনেকেই চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। ফলে তাদের মিষ্ট গলার নতুন কোন গান শুনতে পারছি না। অগত্যা বন্ধ করে দিলাম।
একটু অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ Speedometer রের দিকে তাকিয়ে দেখি গাড়ী চলছে প্রায় ৯০ মাইল বেগে।
যেখানে ৬৫ মাইলের বেশি বেগে যাওয়ার কথা নয়। আগে হলে পাশে যে থাকতো সে বলতো, এতো জোরে চালাচ্ছ কেন?
এখন আমিই আমি। বলার কেউ নেই। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম পুলিশ আছে কিনা। গতি কমিয়ে ৮০ র কাছে আনলাম। প্রায় সবাই ওই বেগে যাচ্ছে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে কেউ ব্রেকে চাপ দেয় কিনা। তাহলে বুঝতে হবে সামনে পুলিশ আছে।
দুই মাইল পরে রেস্ট এরিয়া। যদিও আমার এই মুহূর্তে নামার দরকার নেই, তবুও গাড়ীটা ঐ দিকে বাক নিলো। কারন এই রেস্ট এরিয়া তে আমার জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িত। কতবার না আমরা থেমেছি এই খানে। ছেলে মেয়ে দুটো দৌড়িয়ে এসে বলত,” আব্বু আইসক্রিম খাবো”।
কোথায় গেলো সেই দিনগুলো।
একলা এক কাপ কফি নিয়ে এসে বসলাম জানালার পাশে। বাহিরে অঝোরে ঝরছে।
মনে হচ্ছিল বাহিরে যেয়ে বৃষ্টিতে ভিজি। শরীরের ভিতরের অসহ্য জ্বালা টা যদি দুর হয়।
শমিত না?
ডাক শুনে তাকালাম,
বাবুল? কোথা থেকে?
এসেছিলাম New Jersey তে, খালাকে দেখতে। অবস্থা ভালো না। ফিরে যাচ্ছি।
তুমি?
যাচ্ছি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে, পেন্সালভেনীয়ার এক ছোট্ট শহরে। এখনও ঘণ্টা দেরেকের পথ বাকি। বসবে?
দাড়াও, বসার আগে দু কাপ কফি নিয়ে আসি। তোমার আর আমার জন্য। অনেকদিন পর দেখা। তাড়া আছে কি?
তাড়া থাকলেও তোমার সাথে সময় দিতে পারবো।
দু কাপ কফি নিয়ে চেয়ারটা টেনে বসলো সে। বলল, সেই কবে তোমার সাথে দেখা হয়েছিল তোমার বোনের বাসায়। আর কি গিয়েছিলে ওই স্টেটে?
অনেক অনেক দিন যাওয়া হয়নি । ওখানে গেলে তোমার সাথে দেখা করবও না, তাঁই কি হয়?
বলো, তোমার কথা । শেষ যখন দেখা হয়েছিল তখনো তুমি ব্যচেলার। খুজে ফিরছিলে কিন্তু চোখে পড়ছিল না তোমার মনের মতো। পেয়েছ কি?
হা। পেয়েছি। সে এক কাহিনী।
বলতে আপত্তি না থাকলে শুনতে আমার আপত্তি নেই।
অর্থনীতিতে খুব ভালো রেজাল্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেছিল বাবুল। সদ্য পাশ, দেখতে শুনতেও খারাপ ছিলনা। ফলে অনেক মেয়ের নজরে পড়েছিল। শেষ এসে ঠেকে ছিল মাগফেরের সাথে।
“ স্যার, এই প্যারাগ্রাফ টা বুঝতে পারিনি”, বলে মাগফের তাকিয়ে ছিল বাবুলের দিকে।
তারপর দুজনে অনেক ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে দিয়েছিল একটা বছর।
বাবুল কমনওয়েলথ স্কলারশীপ নিয়ে চলে এলো লন্ডনে। ফিরে এসে সবকিছুর সমাধান করবে এমনি কথা ছিল।
তা আর হয়ে উঠেনি। আস্তে আস্তে মাগফেরের ফোন কল কমে এলো। এমনি একদিন বাবুল তার বোনের কাছ থেকে শুনল,
মাগফেরের বিয়ে হয়ে গেছে এক গারমেন্ট ফ্যাক্টরির মালিকের সাথে। সে আর অপেক্ষা করেনি বাবুলের জন্য।
দেশে ফিরে বেশ কিছুদিন অধ্যাপনা করার পরে পাড়ি দিয়েছিল সে আমেরিকার পথে।
ব্যচেলারত্ত ঘুচে ছিল অনেক পরে। তাও হঠাৎ ই বলতে হবে।
তারপরের ঘটনা ওর মুখে শোনা যাকঃ
জানো শমিত, একদিন আমার এক বন্ধু, পীযুষ, বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত, আমাকে নিয়ে গেলো ওর বাসায়।
ড্রাইং রুমে বসিয়ে সে গেলো ভেতরে। আমি বসে বসে সদ্য আসা টাইম ম্যাগাজিন টার পাতা উল্টাছিলাম।
‘আপনার চা”
কণ্ঠস্বরে মাদকতা মিশানো।
মুখ তুলে চাইতেই চোখ টা আটকে গেলো। উজ্জ্বল শ্যামলা। কোঁকরা চুল। মনে হোল ঠিক এমনি তো আমি চেয়ে ছিলাম।
তাকাল সে।
চোখে চোখ পড়তেই চোখ টা সরিয়ে নিলো।
তুমি তো সিনেমার গল্প বলছ মনে হচ্ছে।
অনেকটা তাঁই। এখনও তো ক্লাইম্যাক্স বাকি।
বলে যাও।
পরনে ছিল ডোরা কাঁটা শালওয়ার কামিজ। এই মুহূর্তে যদি সে ওটা পরে আসতো তবে বলতাম, এটাতে মানাচ্ছে না। কিন্তু ঐ মুহূর্তে মনে হয়ে ছিল ঐ রঙ এর শালওয়ার কামিজ শুধু ওর জন্যই বানানো হয়েছিল।
বাহ ! তারপর।
শুধু একবার সে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। চা এর পেয়ালায় চুমুক দিতেই পীযুষ এসে ঢুকল ঘরে।
সরি দোস্ত, তোকে একলা রেখে যাওয়ার জন্য। যাক, চা দিয়ে গেছে। চল, ভিতরে যাই মা র সাথে আলাপ করিয়ে দেবো।
বললাম, কোন অসুবিধা হয়নি, তবে যে চা দিয়ে গেলো সে কে?
ওত আমার বোন, জয়ন্তী। সব পাশ দিয়ে এখন ঘরে বসা। মা র চিন্তার শেষ নেই। বয়স বাড়ছে।
ভিতরে এলাম। পীযুষ আবারও ওর মা সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কোথায় যেনো চলে গেলো। ওর মা গুরুগম্ভীর প্রকৃতির। দুই একটা কথা বলতেই বুঝলাম, কথা বেশি দুর এগোবে না। চারিদিকে তাকাচ্ছিলাম আবারও জয়ন্তী কে দেখা যায় কিনা।
কিছু খুজছো? জিজ্ঞাসা করল ওর মা।
না কিছু না। বলে বললাম, এখন আসি, দেখি পীযুষ কোথায়।
তোমার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। গা দিয়ে ঘাম ঝরছিল কি?
অনেক টা তাঁই। জয়ন্তী এসে বাচালো আমায়। বলল, দাদা বাইরে ডাকছে আপনাকে।
বাচলাম। কিন্তু আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না জয়ন্তীকে। অথচ প্রেম তো আমি একবার করেছিলাম। মুখ চোরা তো আমি নই। তাহলে?
এমন হয়। অনেকে প্রথম দর্শনে এরকম বোকা হয়ে যায়।
তোমার এমন হয়েছিল কি?
না, আমি ঠিক তোমার উল্টো ছিলাম। তারপর!
তারপর দুই তিন বার গলাটা কাশি দিয়ে পরিষ্কার করে পীযুষ কে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা তোদের সমাজে Mixed marriage হয় কি?
ও তাকাল আমার দিকে। বলল, কিছু বলতে চাস কি?
না, মানে, হাঁ, জয়ন্তী কে এক দেখাতেই খুব পছন্দ হয়ে গেলো। তুই কি বলিস?
বাসায় যেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর। তারপরে বলিস। কেনও বলছি তোর বুঝতে নিশ্চয় অসুবিধা হচ্ছে না। এই কথা বলে সে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো।
আমি বাসায় এসে অনেক ভাবলাম, কিছুদিন পর পীযুষ কে ফোন করে বলেছিলাম, যে বাধার কথা তুই বলছিস ওটা আমার কাছে কোন বাঁধা নয়।
সে বলল, আমার আপত্তি নেই, তবে মা রাজি হবে বলে মনে হয় না। তবুও আমি বলে দেখবো। তা ছাড়া জয়ন্তীর তো হা, না বলার আছে।
তারপর, শুধু অপেক্ষা ? তাঁই না?
হাঁ তাঁই। সাত দিন বাদে পীযুষ জানালো জয়ন্তী রাজি। বলেছে, দেখতে শুনতে আমি বলে মন্দ না।
তবে মা রাজি নয়। ওর বড় বোন ঘষামাজা করছে মা কে।
অবশেষে ওর মা রাজি হোল। বলতে পারো নিমরাজি।
মাস দুয়েক পরে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।
কি মতে? মানে কোন প্রথায়।
মুসলিম মতে। জয়ন্তীই আমাকে বলেছিল, আমি তোমার ঘরে যেতে চাই তোমার ধর্ম নিয়ে।
অপূর্ব!
জানো শমিত, ওকে আমি কোন কিছুতে জোড় করিনি। সে দেখত আমি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। একদিন সে পাটি এনে আমার পিছনে দাড়িয়ে পড়ল। সেদিন আমার চোখে জল এসেছিল। সত্যি বলতে কি সে হজও করে এসেছে।
একবার দেখতে চাই জয়ন্তীকে।
এসো একদিন আমার বাসায়। খারাপ লাগবে না। আরও বসতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু অনেক দুরের পথ যেতে হবে। তাঁই আজ উঠি।
হা চলো। আমিও উঠবো।
বাবুল চলে গেলো। ঘুরে ফিরে জয়ন্তীর কথা গুলো কানে ভাসতে থাকলো, “আমি তোমার ঘরে যেতে চাই তোমার ধর্ম নিয়ে”।
আমি অন্য মনস্ক ভাবে হাটতে হাটতে গাড়ীর কাছে এলাম। ফোন টা বেজে উঠল। নম্বর টা পরিচিত নয়। তবু উঠালাম।
হ্যালো বলতেই, ওপাশে থেকে ভেসে এলো অনেকদিন আগের সেই চেনা কণ্ঠস্বর ,
ভোর ছটা। ফোন টা বেজে উঠলো। ওটা পড়ে থাকে আমার পাশের বালিশের উপর। সত্যি বলতে কি সারা রাত জেগে থাকার পর চোখ টা কেবল লেগে এসেছিল। এতো ভোরে কোন কারন ছাড়া কেউ কল করবে না জানি। মাঝ রাতে অথবা অতি ভোরে ফোনের আওয়াজ আমাকে ব্যতী ব্যস্ত করে তোলে। তাঁই ফোন টা উঠালাম। ওপারে পল্লবীর ভয়ার্ত স্বর।
কি হয়েছে?
তুমি এখনি এসো শমিত দা, এখনি এসো।
কি হয়েছে বলবি তো?
তুমি এলেই দেখতে পাবে। দেড়ি করো না, Please.
অগত্যা উঠে পড়লাম। মুখে হাতে পানি ছিটিয়ে গাড়ীর কাছে এসে দাঁড়ালাম। কেনও জানি এক অজানা ভয় মনের মধ্যে। ওর আতঙ্কিত গলার স্বর আমার কানে বাজছে।
পল্লবী আমার কেউ নয়। আত্মীয়তা নেই আমার সাথে । ওর বড় বোন কে আমি চিনতাম। সেই সুবাদে ওকেও চিনি। অনেক দিনের চেনা। দেখেছি যখন ওর গলায় ওড়না পড়েনি। মাঝে মাঝে এসে বলত,” শমিত দা তুমি মেজবু কে বিয়ে করবে”?
বলতাম, না, তোমার মেজবু আমার বন্ধু।
সেই পল্লবী চোখের সামনে বড় হোল। মিষ্টি চেহারার মেয়ে টা ঘুরে বেড়াতো ওর মেজবুর পাশে। একদিন মেজবুর বিয়ে হয়ে চলে গেলো অন্য খানে সেই সাথে সেও। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমাকে নিয়ে। মাঝে অনেক গুলো গ্রীষ্ম, শীত পাড় হয়ে এলাম। আমার জীবন টা অনেক কাঁটা ছেড়ার মাঝ দিয়ে পাড় হয়ে এসে ঠেকলও এক ছোট্ট ঘরে।
এমনি একদিনে একটা ছোট্ট চিরকুট এসে পড়ল হাতে।
অনুর লেখা। সাথে একটা বিভিন্ন রঙে মাখান কার্ড।
শমিত,
আসছে মাসের ১২ তারিখে পল্লবীর বিয়ে।
তোমাকে আসতে হবে।
অনু
মনে হোল মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। পল্লবীর বিয়ে। সেই ছোট্ট মেয়েটা, যে কিনা বলত আমি ওর মেজবু কে বিয়ে করবো কি না, সেই আজ বিয়ের সাজে সাজছে। মেন্দির রঙ এ রাঙিয়ে দিয়েছে তার দুটো হাত। মাথার পড়ে লাল ওড়না।
বসে আছে নত মুখে।
আমি পৌছেছিলাম বিয়ের দুদিন আগে। ষ্টেশন থেকে অনু নিয়ে এসেছিল। পথে আসতে আসতে বলল, এক অনুশঠানে পল্লবী কে দেখে ছিল সঞ্জীবের বাবা। সেখানেই অনুর মা কে বলেছিল, আপনার মেয়ে কে আমার খুব পছন্দ। আমার ছেলের সাথে মানাবে। অনুর মা পড়ে জানাবে বলেছিল।
সঞ্জীব কেবল কম্পিউটার সাইন্সে পাশ করে এক বড় কোম্পানিতে ঢুকেছে। দেখতে মন্দ নয়। কথা বার্তায় চৌকস। বলল অনু।
বললাম, একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো, তাঁই নয় কি ? ওর তো এখনও বিয়ের বয়স হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
অনু বলেছিল, তুমি তো জানো বাবা নেই, মা র বয়স হয়েছে। মা চাইছে না এই সম্বন্ধ হাতছাড়া করতে। আর তাছাড়া পল্লবীও রাজি।
গাড়ী এসে দাঁড়ালো দরজায়। আমি আর অনু চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকলাম ঘরে। পল্লবী এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। অপূর্ব লাগছিলো ওকে দেখতে। বলেছিল, শমিত দা তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো।
বলেছিলাম, তুই তো আসছিস সেই খানে যেখানে আমিও আছি। পারবিনা আমার দেখাশুনা করতে?
পারবো বৈকি? বলেছিল সে।
ধুমধাম করে শেষ হোল সব। যাবার সময় অনু জল ভরা চোখ নিয়ে এসে বলেছিল, শমিত, ওকে দেখে রেখো।
সময় পেরিয়ে গেলো। পল্লবীর কোলে এলো এক ছেলে। মাঝে মাঝে রেখে যেতো আমার কাছে।
বলত, শমিত দা, এই থাকলো, দেখে রেখো, আমরা যাচ্ছি একটা পার্টিতে। আসতে যদি দেরী হয়, তুমি এই দুধ টা খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিও।
বাসার সামনে একটু জটলা। দেখতে পেলাম রহিত সাহেব কে, (সঞ্জীবের বাবা), সজীব, ওর বড় ভাই, সাথে আরও কয়েক জন। গাড়ীটা রাস্তার পাশে রেখে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে সঞ্জীবের বাবা এগিয়ে এলো। কোন কথা বলার আগে
বলল, ভিতরে আসুন।
ভিতরে এলাম। পল্লবী বসেছিল একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে। তাকাল। চোখে জল। কাঁদছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,” ওকে ধরে নিয়ে গেছে শমিত দা”।
ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় নিয়ে গিয়েছে? কে নিয়ে গিয়েছে? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
পুলিশ। পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। ওর উপর নজর রাখছিল ওরা। ওরা বলল সঞ্জীব বিভিন্ন খারাপ ওয়েব সাইটে ঘোরাফেরা করে। বলে থামল পল্লবী।
খারাপ ওয়েব সাইট মানে?
ওরা আমাকে ব্যাখ্যা করেনি। শুধু ওকে আর ওর সব ল্যাপটপ গুলি নিয়ে গেছে।
পাঁচ দিন পর জামিনে মুক্তি পেলো সঞ্জীব। পুলিশের মতে “ টাকার বিনিময়ে আনন্দ” এই ধরনের একটা সংস্থার সাথে সে জড়িত। ওতপ্রোত ভাবে জড়িত না থাকলেও তার নাম পাওয়া গেছে ঐ সংস্থার খাতায়। ল্যাপটপে।
দোষ স্বীকার করে নিয়ে ছিল সঞ্জীব। ফলে এক বছরের সাজা, আর এক বছর প্রবেশন। পায়ে ইলেকট্রনিক ব্রেসলেট। তার হাটা চলার পরিধি ছিল সীমিত। ল্যাপটপ তালা লাগানো, ব্যবহার করা নিষেধ।
তার বাচ্চা সে দেখতে পারবে তবে আর একজনের উপস্থিতে। একলা সে থাকতে পারবে না। ফলে সঞ্জীবকে এসে উঠতে হোল ওর বাবার বাসায়। পল্লবী বাচ্চা নিয়ে থেকে গেলো সেই বাসায় যেখান থেকে শুরু করেছিল ওদের জীবন।
বলেছিলাম, পল্লবী, মানুষ দোষ করে, তার প্রায়শিচত্ত করে। পারবি না আবার ফিরে যেতে।
না, শমিত দা, একবার যে বিশ্বাস আমি হারিয়েছি তা আর ফিরে আসবেনা কোনদিন। জীবনের শুরুতেই সব শেষ হয়ে গেলো আমার।
বললাম, নতুন করে জীবন শুরু করা বড় কঠিন। তাছাড়া তোর ছেলের কোথাও তো ভাবতে হবে। একলা তোর পক্ষে ওকে ঠিক পথে চালানো সম্ভব হবে কিনা জানিনা। কয়টা উদার ছেলে আছে এই ধরাধামে যে ছেলে সহ —
কথা শেষ করার আগেই সে বলল, শমিত দা যে আসবে সেতো সব দেখে শুনেই আসবে, আর যদি না পাই আশীর্বাদ করো যেন ছেলেটাকে মানুষ করে দিয়ে যেতে পারি।
সঞ্জীবের পায়ের বেড়ি খুলে গেছে। সে এখন মুক্ত। বাচ্চা বড় হয়েছে। নয় বছর বয়স। ছুটির দিনে বাপের কাছে আসে। কিন্তু ওরা দুজন আর হাতে হাত রাখতে পারলো না।
যা ভেঙ্গে যায় তা আর জোড়া লাগেনা। লাগলেও একটা দাগ থেকে যায়। ওদের বেলাতে তাঁই হোল। জোড়া লাগলো না।
পল্লবী চাকরি করে এক ইনভেস্টমেন্ট ফার্মে। মাঝে মাঝে আসে আমার কাছে।
বলে, শমিত দা, তুমি তো বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যাও, আমাকে নিয়ে যাবে ? আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।
বললাম, পারবো বৈকি। তবে এই ঘুনে ধরা সমাজ তোকে যেতে দেবেনা আমার সাথে। আমি একেলা, তুইও একেলা, এই হয়েছে জ্বালা। ওরা নিন্দে রটাবে।
কেন? তুমি আমার বড় ভাই।
সে তো তুই আর আমি জানি । তবে ভাবিস না। অনু কে বলব। ও যদি যায় তবেই সব সমস্যার সমাধান। কি বলিস?
ফোনটা উঠিয়ে প্রথম প্রশ্ন,” কিরে, তোর ডায়রির পাতা ইদানীং খালি যাচ্ছে, কি হোল”?
বললাম, বড় নিরামিষ যাচ্ছে দিনকাল। এক ঘেয়েমী। কোন বৈচিত্র্য নাই। খাও দাও আর ঘুমাও। এসব তো লেখা যায় না। অন্তত পক্ষে পাঠকের জন্য নয়”’
-তাহলে ভুত, প্রেত নিয়ে লেখ। যেমন, হেটে আসছিস অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে হাসতে এক বুড়ি তোর পথ আগলিয়ে ধরলও। (সুন্দরী মেয়ে বলব না, তাহলে তোর মেয়ে আমার মাথা ভেঙ্গে দেবে)
ইয়ার্কি পেয়েছিস। তবে মনে পড়ছে একজনের কথা। ঐ যে বললি ভুত, প্রেত। দেখেছিলাম।
তবে শোন,
আমার বয়স তখন পাঁচ। তোর তখনও জন্ম হয়নি। আমাদের বাসার পাশে মাঠ। মাঠের শেষে একটা টিনের ছাউনী দেওয়া বাড়ি। ওখানে থাকতো টুকু নামে আমার এক বন্ধু। আমরা এক বয়সী। ও থাকতো ওর মা আর ভাইয়ের সাথে। বাবা গত হয়েছে অনেক দিন হোল। আমি যেতাম ওদের বাড়ীতে। টুকুর সাথে মার্বেল খেলতে।
আমি যন্ত্রের মত এগিয়ে যেতাম, কিসের যেন একটা টান অনুভব করতাম। কাছে এলে আমার গালটা টিপে দিতো। কোলে বসিয়ে বলত,” তোকে আমি মধু বলে ডাকব। আর তুই আমাকে ছোটমা বলে ডাকবি। কেমন”?
-কেনও আমাকে মধু বলে ডাকবে? আমার নাম তো মিন্টু।
বলত, তুই যে আমার পরানের মধু। বলে আমাকে চেপে ধরত বুকের মাঝে।
আমি মুখ লুকাতাম ওর নরম বুকে।
তুই এখানে বস আমি আসছি ,বলে উঠে যেয়ে নিয়ে আসতো দুধ কলা। আমাকে নিজে হাতে খাইয়ে দিতো।
কপালে চুমু দিয়ে বলত, কাল এবার আসবি তো?।
বলতাম, কাল এলে কি খেতে দেবে?
মুড়ি পাটালি।
আমি খুব পছন্দ করি মুড়ি পাটালি।
একদিন আমি টুনি দের বাসায় এক্কা দক্কা খেলছিলাম। পানির পিপাসা পাওয়াতে দৌড়ে বাসায় এসে দেখি ছোটমা বসে আছে মার পাশে। দুজনে গল্প করছে। আমাকে দেখে হাসল। ডাক দিলো।
“ একে বারে ঘেমে নেয়ে গেছিস”। বলে আঁচল টা দিয়ে আমার মুখ টা মুছে দিলো।
মা বলল,” তোর খুব নাওটা হয়েছে”।
“ আমি ওকে মাঝে মধ্যে দুধ কলা খাইয়ে দেই। তুমি কিছু মনে করোনা নাতো খালা”।
না, আমি জানি কেনও তুই ওকে এতো ভালবাসিস।
আমি পানি খাওয়ার কথা ভুলে যেয়ে ওর গা ঘেঁসে বসলাম।
টুনি এসে ডাক দিল খেলতে যেতে।
বললাম, আজ আর খেলবো না।
মা বলল, খেলবি না কেনও? এখানে বসে আমাদের কথা শুনবি। তাঁই না?
বললাম, আমার আর খেলতে ইচ্ছা করছে না। আসলে ছোটমার পাশ ছেড়ে যেতে চাইছি না।
ছোটমা আমার চুলগুলো হিজিবিজি করে দিয়ে বলল, যা পাজি, খেলতে যা।
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গেলাম। এক্কা দক্কায় আর মন বসলো না।
দুদিনের জন্য মামা বাড়ীতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দৌড়ে গেলাম টুকু দের বাড়ীতে। ছোটমা বসে আছে মাটির বারান্দায়। আমাকে ডাকল না। আমি পাশে যেয়ে বসলাম। আমার দিকে তাকাল। চোখে জল। আমি হাত দিয়ে চোখটা মুছিয়ে দিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
বলল,” তুই বাসায় যা। আজ তোকে আমি খাওয়াতে পারবো না”।
আমি খেতে চাইনা। আমি তোমার পাশে বসে থাকবো। কি হয়েছে তোমার?
-তুই বুঝবি না।
আমার কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না। বাসায় এসে মা কে বললাম, মা, ছোটমা কাঁদছে? ওকে বোধ হয় কেউ মেরেছে।
মা বলল, না কেউ মারে নি। ওর বর টা আবার বিয়ে করেছে। ওর ঘরে সতীন এসেছে।
সতীন মানে কি, কিছুই বুঝলাম না। আর টুকুর ভাই কে তো ছোটমা অনেক ভালো করে খাওয়াত। তাহলে আবার বিয়ে করবে কেনও?
সেই রাতে আমার ঘুম এলোনা। সকালে উঠেই গেলাম ওদের বাড়ীতে। ছোটমার এমন অগ্নিমূর্তি আগে কখনো দেখিনি। হাতে একটা চেলা কাঠ। সামনে একটা মেয়ে দাঁড়ান। কালচে গায়ের রং। পরনে লাল শাড়ী। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলছে। ছোটমা কে বেড়িয়ে যেতে বলছে বাড়ী থেকে। ছোটমা চেলাকাঠ নিয়ে এগিয়ে যেতেই চোখ পড়লো আমার উপর।
দু পা পিছিয়ে এসে আমাকে বলল,” এখানে কি করছিস। বাসায় যা”। বলে একটা ধমক দিলো।
দুই তিনদিন যাইনি ঐ বাসায়। এক সকালে টুকু এসে হাজির। বলল,” চল এখুনি আমাদের বাসায়”।
কেন?
গেলেই দেখতে পারবি। বলল সে
যেয়ে দেখি বেশ কিছু আমার মত ছেলে মেয়ে আর বয়স্ক কিছু লোকজন সাথে টুকুর ভাই দাঁড়ানো।
ছোটমার ঘর বন্ধ। মাঝে মাঝে ঐ ঘর থেকে মোটা গলার স্বরে কে যেন কি বলছে। কিছুই বুঝলাম না।
হঠাৎ করে ঘরের ভিতর জিনিস পত্র ছুড়ে ফেলার শব্দ হোল । তারপর সব চুপ।
আমি টুকু কে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে রে। আমার ভয় করছে।
টুকু বলল, ভাবী কে জিনে ধরেছে।
জিন মানে?
আমি জানিনা। ভাই বলল।
আবারও কর্কশ গলায় ভাই কে আসতে বলল দরজার কাছে। টুকুর মা ওর ভাই কে যেতে বারণ করলো,” যাসনে খোকা”।
দরজা টা কেঁপে উঠল। ভিতর থেকে বলল, আমি আজ যাচ্ছি। আবার আসব। ওর দিকে যত্ন নিবি।
দুমাস কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেক বার ছোটমা অজ্ঞান হয়ে গেছে।
মা কে জিজ্ঞাসা করতাম, মা ছোটমার খারাপ কিছু হবে নাতো?
মা বলত, না তোর ছোটমা ভালো থাকবে। কিছু হবে না তোর ছোটমার। বলে মা আমাকে আশ্বাস দিতো।
একদিন বাবা আসে বলল, বদলির চিঠি এসেছে। সামনের মাসে চলে যেতে হবে এখান থেকে। আমি শুনলাম। সারা বাসা ঘুরে ঘুরে কেঁদে বেড়ালাম। ছোটমা কে বলিনি। শুধু যেয়ে যেয়ে আদর নিয়ে এসেছি।
এবার সময় হোল বলার। আমি এলাম। ছোটমা রান্নাঘরে। পরনে হাল্কা হলুদ রঙের শাড়ী। আমাকে দেখে বলল, কি ব্যাপার সোনা, এতো সকালে?
তোমার সাথে কথা আছে ছোটমা। বলতে যেয়ে আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ল। জড়িয়ে ধরলাম ছোটমা কে।
ছোটমা উনন থেকে হাড়ীটা নামিয়ে রেখে আমাকে নিয়ে এলো বারান্দায়।
মুখটা উচু করে ধরে বলল, কেউ বকেছে?
না।
তাহলে?
আমরা চলে যাচ্ছি ছোটমা। বলে হু হু করে কেঁদে উঠলাম।
চলে যাচ্ছি মানে?
বাবা বদলি হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে গাড়ী আসবে নিয়ে যেতে। তোমার সাথে আর দেখা হবে না ছোটমা।
ছোটমা আমাকে ওর বুকের মাঝে চেপে ধরল। কোন কথা বলল না। ওর শাড়ী ভিজে গেলো আমার চোখের জলে।
তারপর আমাকে চুমু দিয়ে বলল, তুই অনেক বড় হবি। বড় হয়ে আমাকে দেখেতে আসবি। আমি তোর পথ চেয়ে থাকব।
আর দেখা হয়েছিল?
না,
গিয়েছিলাম পঁচিশ বছর পরে কঙ্কনাকে নিয়ে। সেই জায়গা আমি চিনতে পারি নি। অনেক কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কেউ কোন খোঁজ দিতে পারেনি।
জানিস আমার ছোটমা হারিয়ে গেলো। আমার দোষ। আমি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কথা আমি রাখিনি। সে শুধু আমার পথ চেয়েই রইল। আমার পায়ের শব্দ শুনতে পেলনা।
এখনও মাঝে মাঝে যখন একলা বসে থাকি মনে হয়, কে যেন আমার গালটা টিপে দিয়ে বলছে
হঠাৎ সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। মনে হোল গায়ে জ্বর এসেছে। থারমমিটার টা খুজলাম। পেলাম না। রাত তখন তিনটা। মুখে তেঁতো তেঁতো পানি উঠছে। ড্রয়ার টা খুলে দুটো টাইলিনল বের করলাম। বুকের ব্যথাটা আসছে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে কার্ডিওলজীস্টের কাছে গিয়ে ছিলাম। বলে ছিল সব ঠিক আছে। তবে আমি হাই রীস্ক পেসেন্ট। কলেস্টেরলের ঔষধ টা দুই গুন বাড়ীয়ে দিলো, সেই সাথে প্রেসারের ঔষধ টাও। বলে ছিল ব্যথা বেশি বাড়লে তবে এসো নচেৎ ছয় মাস পরে অ্যাপএনমেন্ট করো।
এ ব্যথা কিসের ব্যথা বলা মুশকিল। তাই যখন তখন কাউকে ব্যতিব্যস্ত করা আমার কুস্টীতে নাই। তাছাড়া লেখা পড়া করে যতটুকু জেনেছি তাতে আসল ব্যথা আরম্ভ হলে খুব একটা হাতে সময় থাকবে না। তাঁই দরজার উপরের তালাটা আর লাগাই না। ওটার কোন চাবি নেই। শুধু ভিতর থেকেই বন্ধ হয়।
অসুস্থ হলে মানুষ মনের দিক থেকেও দুর্বল হয়ে পরে। আমিও যে হয়নি তা নয়। সেটাকে ঝেড়ে ফেলার জন্য ল্যাপটপ টা নিয়ে বসলাম। বিভিন্ন ইনিস্টিটিউশণের একাউন্ট গুলো আর একবার খতিয়ে দেখবার জন্য। যাতে ছেলে মেয়েদের কোন কিছু খুজে পেতে অসুবিধা না হয়।
মাথা টা ভীষণ ধরেছে। রান্না ঘরের আলোটা জ্বালাতেই চোখটা ধাধীয়ে উঠলো। মনে হোল কে যেন জোরে আঘাত করলো চোখে। বন্ধ করে দিলাম আলোটা। চোখের কণ বেয়ে পানির ধারা নেমে এলো। মুছতে যেয়ে হাতের নাপকীন টা পড়ে গেলো মেঝেতে। উঠাতে যেয়ে বাড়ি লাগলো টেবিলের কোনায়। টলে পড়ে গেলাম। হাত দিয়ে ঠেকাতে যেয়ে কব্জীতে ব্যাথা লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে জানালায় এসে আঘাত করলো দমকা হাওয়া। খুলে গেলো কপাট। টেবিলের কাগজ গুলো ছড়িয়ে পড়লো মেঝে তে।
উঠতে চাইলাম। পারলাম না। হাতটা ব্যাথায় টনটন করছে। গড়িয়ে এসে সোফাটাকে আঁকড়িয়ে ধরলাম। হাটু গেরে বসে দুই কনুই দিয়ে সোফার উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আস্তে আস্তে জানালার কাছে যেয়ে জানালাটা বন্ধ করতে যেয়ে মনে হোল কে যেন জানালাটা কে টেনে ধরে রেখেছে। যত জোরে আমি টানছি ঠিক তত জোরে কে যেন টানছে আমার বিপরীত দিকে।
ঠিক সেই সময় এক ঝরো হাওয়া আঘাত করল মুখে, শরীরে। জানালার থাকে হাত সড়ে গেলো আমার। চর্কির মত ঘুরে আমি এসে পড়লাম সোফাতে। কে যেন আমাকে টেনে এনে বসিয়ে দিলো।
বাতাস থেমে গেলো। জানালার কপাট টা আস্তে আস্তে ফিরে এলো তার জায়গায়।
হাতের ব্যাথা টা ক্রমশ বাড়ছে। একটা Motrin খাবো বলে কেবিনেট টা খুললাম। কিন্তু Child proof বোতলের ক্যাপটা খুলতে পারলাম না। ওটা বেসিনের পাশে রেখে আবারও থারমমিটার টা খুজতে এলাম বেডরুমে। শরীরের তাপের মাত্রাটা বেড়েছে মনে হচ্ছে। ড্রয়ার টা খুলতেই দেখলাম সামনেই পড়ে আছে ওটা। অথচ প্রথম বার আমি দেখিনি ওটাকে। হয়ত চোখের ভূল।
তাপমাত্রা ১০২ । টাইলিনল টা খেয়েছি প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেলো। এখনও জ্বর টা নামেনি। হাতের ব্যথা টা মনে করিয়ে দিলো কিছু একটা করা দরকার। শোয়া হলনা। কোল্ড কমপ্রেস দিতে হবে। Motrin টা খাওয়ার দরকার ছিল। ওটা ব্যথা আর ইনফ্লেমেসন দুটোরই কাজ দিতো। কিন্তু খুলতে পারলাম না বলে খাওয়া হলনা।
ফিরে এলাম রান্না ঘরে। ফ্রিজ টা খুলে কতগুলো বরফের টুকরা একটা কাপড়ে জড়িয়ে নিলাম। বেসিনের কাছে রাখা Motrin এর বোতল উঠিয়ে রাখবো বলে হাত দিতেই ক্যাপটা খুলে পড়ে গেলো। অথচ ওটাকে অনেক চেস্টা করেছি খুলতে, পারিনি।
ওর কাছে আমার ঘরের এক গোছা চাবি দেওয়া আছে। আপদে বিপদে কাজে লাগতে পারে তাঁই।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কি হয়েছে? সারা রাত সোফার উপর ঘুমিয়ে ছিলে?
-তাই তো মনে হচ্ছে। রাতে অনেক জ্বর এসে ছিল। পড়ে যেয়ে হাতে ভীষণ চোট পেয়েছিলাম। ঠাণ্ডা সেক দিয়েছি অনেকক্ষণ ধরে। জানালা টা বন্ধ করে দাওতো। কাল সারা রাত খোলা ছিল। এই বলে সতীর দিকে তাকালাম।
সে আমার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকলো। কাছে এসে হাত টা কপালে রাখল।
-এখন জ্বর নেই। এই বলে জানালা টা বন্ধ করে দিল।
হাতটা দেখে বলল, একটু ফুলেছে।
এবার ওঠো। গোসল করে নাও। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি, Motrin খেতে হবে। শান্তর বাসায় আজ সবাই কে ডেকেছে। মনে নেই?
মনে পড়ল। শুধু তাঁই নয়, খাবার তো আমাকেই নিয়ে যেতে হবে। বলেছে ১২ টার মধ্যে আসতে।
দুদিন আগে কল করে বলে ছিল,” আব্বু, তুমি কি খাবার অর্ডার দিতে পারবে”?
জানে, না আমি করবো না। এ যে কত বড় অধিকার বাবা মা র উপর তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।
লোক জন এসে পৌছায় নি। বারটায় বললে এরা আসবে একটায়। এটাই রীতিতে দাঁড়িয়েছে। সময় জ্ঞান কয়জনের আছে বলা মুশকিল। সতী যথারীতি লেগে গেলো কাজে। আমি সোফায় বসে বাস্কেট বল খেলা দেখতে থাকলাম। এর মাঝে বৌমা এসে জিজ্ঞাসা করে গেছে কফি খাবো কিনা।
বললাম, মন্দ হয় না। আমি বানিয়ে নেবো।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে অনেকে এসে গেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো সবাই। শান্তর ঘর টা বড়। ভেঙ্গে নতুন করে গড়া।
আমি দেখলাম এখানে তিন জেনারেসনের সবাই হেটে খেলে বেড়াচ্ছে।
আমাদের বয়সি, যাদের পা আর মাজায় ব্যথা অথবা চোখে ছানি পড়েছে তারা সোফায় অথবা চেয়ারে বসে গল্প করছে ওপাড়ের জগত নিয়ে। শান্তর বন্ধুরা তর্ক করছে ফুটবল, বেজবল নিয়ে। ছোটরা ছুটাছুটি করছে।
অরুন কেবল এসেছে দেশ থেকে। অনেকে ওকে ঘিরে। শুনতে চাচ্ছে দেশের কথা, কত শাড়ী এনেছে, কোথায় কোথায় বেড়িয়ে এলো, শরীর খারাপ হয়েছিল কি না সে সবের কথা। দূরে দাড়িয়ে জীনাত ভাবি। শান্তর শাশুড়ির সাথে গল্পে মশগুল, মনে হোল চেহারায় একটু মলিনতা।
তিথী, বৌমার কাজিন, হেলে দুলে হাঁটছে। ওর শরীরে ভেতরে একটা দুস্টু ছেলে মাঝে মাঝে ওকে কিক করছে। বলছে, “ অনেক দিন হয়েছে, এবার আমি পৃথিবীর আলো দেখতে চাই”।
আর এক কাজিনের একমাসের ছেলেটা বুকের মাঝে লেপ্টীয়ে শুয়ে।
মনে পড়লো সেই কথাগুলো “ এসেছে নুতন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান” । ওদের জন্য আমাদের বিদায় নেবার সময় এসেছে। কিন্তু কেউ কি যেতে চায়। থাক মরনের কথা।
বললাম, দেবে আমার কোলে।
কোলে এসে ছোট্ট করে হাই তুলল। বুকের উষ্ণতা ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। আমি ওর টুসটুসে আঙুল নিয়ে খেলা করছিলাম । ওর ছোট্ট জীবন টা টুনটুনি পাখির মত নিষ্কলঙ্ক । আমি ওর লালচে মাখনের মত গাল টা টিপে দিলাম। ওর ঠোট টা হেসে উঠল। মনে হোল ও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। আমার আঙুলটা চেপে ধরল। ঠোটের কণে সেই হাসি টা লেগে আছে।
অনেক অনেক বছর আগে সেই ছোট্ট হাতটা নিয়ে খেলা করতাম, কান পেতে শুনতাম আমি ওর নিশ্বাসের শব্দ। দুধের বোতল মুখে দিলে সে ধরত আমার আঙ্গুলটা, পিট পিট করে তাকাত আমার দিকে, ফীক করে হেসে দিতো, দুধ গড়িয়ে পড়তো গালের চার পাশে। আমার দিকে হেসে তাকিয়ে থাকতো। মনে হতো স্বর্গের থেকে এক ঝলক আলো ঝরে পড়লো আমার ঘরে। কপালে চুমু দিয়ে উঠিয়ে নিতাম আমার বুকে। পাশ থেকে সে বলতো,” ওকি দুধ টা শেষ করেছে”।
বলতাম, হাঁ করেছে।
তাহলে শুইয়ে দাও।
না ও শোবে না, ও বাদুরের মত আটকিয়ে আছে আমার বুকে। ওকে কি নামাতে পারি?
ওকে তুমি স্পয়েল করবে, বলে পাশ ফিরে শুতো।
তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। সেই ছোট ছোট হাত গুলো আজ কত বড়। কত বড় দায়িত্বশিল ছেলে সে আজ। বাড়ীর মালিক।
তদারকি করছে। দেখছে, তার করণীয় সব কিছুই করছে, যাতে সবাই আনন্দ পেতে পারে এই সীমিত সময়ের মধ্যে।
স্পয়েল হয়নি, বরং ভালোবেসে সবাই কে আকড়ে ধরেছে। কাছে টেনে নিয়েছে।
তুমি ওকে মানুষ করে দিয়ে গিয়েছিলে। তাতো সে ভোলেনি।
শুধু তুমিই দেখলে না ওর সম্পূর্ণ গড়ে উঠা নতুন ওর বাড়ীটা।