গত মঙ্গলবার ঘূর্ণিঝড় স্টেলা ছড়িয়ে দেয়ে গেছে বরফের স্তূপ। মনে হচ্ছে ছোট ছোট সাদা বরফের পাহাড় চারিদিকে ছড়ান। আমি দেখছিলাম আমার জানালা দিয়ে। শান্ত আর বউমা আসবে লাঞ্চ করতে আমার সাথে। মেয়ে কে কল করেছিলাম সেও এসে যোগদান করবে কি না। বলল, না, ও আর রেজ যাবে বন্ধুদের সাথে। ফোনটা রেখে কফির কাপ টা হাতে নিতেই আবারও বেজে উঠল ওটা।
নাম্বার টা দেখে মনে হোল দেশ থেকে কেউ কল করেছে।
শমিত?
হাঁ
চিনতে পাড়ছ কি?
গলার স্বরে চিনতে পারার কথা নয়।
বললাম, না চিনতে পারছিনা। আপনি কে বলছেন?
কি আপনি আপনি করছ। তোমাকে তো আমি তুমি বলে বলছি।
গলক ধাঁধায় না রেখে যদি নাম টা বলেন।
আবারও সেই,বলেন, আমি ইয়াসমিন।
ইয়াসমিন? মনে করার চেষ্টা করলাম।
ইয়াসমিন, মনে পড়ছে? বলল অপর প্রান্ত থেকে। আরও বলল, আমি আগামী বুধবার আসবো নিউইয়র্কে। অনেক দিন পর তোমার সাথে দেখা হবে, কি যে আনন্দ লাগছে।
মনে পড়ছে নাম টা তবে আমার আনন্দ লাগছে না। লাগছে না তার কারন হোল,
ফিরে গেলাম অনেক পিছনে। প্রতাপ আর আমি একি পাড়ার ছেলে। একি সাথে পড়ি। বন্ধুত্ব আমাদের অনেক দিনের। স্কুল শেষে আমি ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে, ও গেলো নটরডেমে। মাঝে মাঝে প্রতাপ আসতো আমার হোস্টেলে। একদিন দুপুরে এসে হাজির। আমি দিবা নিদ্রা নেওয়ার চেস্টা করছিলাম। হোল না। বলল,” চল, কাপড় পরে নে, এক জাগায় যাবো”।
ইডেন কলেজের হোস্টেলে? সেখানে কি”? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
সেই একি কথা, গেলেই দেখতে পারবি।
হোস্টেলের কাছে এসে দাড়াতেই একটা মেয়ে এগিয়ে এলো প্রতাপের দিকে। দুজনের মুখেই হাসি। বুঝে নিতে আমার বেশি বেগ পেতে হলনা। প্রতাপই আলাপ করিয়ে দিলো।
আমার বন্ধু শমিত, আর এ হচ্ছে, ইয়াসমিন।
সাদা,হলুদ, শালওয়ার কামিজের সাথে লাল ওড়না। মোটা বলব না, আবার চিকন ও নয়, দুয়ের মাঝা মাঝি। গায়ের রঙ শ্যামলা। হাসল সে। সাদা দাঁত গুলো সমান্তরাল ভাবে বসানো নয়। এতো আমার চোখে দেখা।
তিন জন হাটতে থাকলাম। ওরা দুজন কাছাকাছি, আমি পাশে একটু দূরে। ইচ্ছে করেই। ওদের মিটিমিটি হেসে কথা বলার মাঝে আমার কোন বক্তব্য রাখতে চাইনা।
এসে বসলাম নিউ মার্কেটের ভিতরে এক আইস ক্রীমের দোকানে। আমি স্বল্পভাষী নই। কিন্তু আজ কেন জানি কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম ইয়াসমিন মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে আমার দিকে, হেসে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। উত্তরে আমিও হেসে তার জবাব দিচ্ছি।
ঘণ্টা খানেক পরে বেড়িয়ে এলাম। ইয়াসমিন চলে গেলো। যাওয়ার আগে তাকাল আমার দিকে। চোখে চোখ রেখে হাসল আবার।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। প্রতাপের সাথেও দেখা হয়নি বেশ কিছুদিন হোল। পরীক্ষা সামনে। এক বিকেলে নিউ মার্কেটের গেটের কাছে দাড়িয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছি।
হঠাৎ ই নাম ধরে ডাক শুনে ফিরে তাকালাম।
ইয়াসমিন।
এগিয়ে এলো।
জিজ্ঞাসা করল,”কেমন আছো? অনেক বার তোমার কথা মনে হয়েছে। তোমার হোস্টেলে একবার যাবো ভেবেছিলাম। পরে তা আর হয়ে উঠেনি”।
আমি সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললাম,” কেনা কাঁটা করতে এসেছ বুঝি”?
হাঁ
বন্ধুরা একটু পাশে যেয়ে দাড়িয়ে আছে।
ইয়াসমিন আরও একটু কাছে এসে বলল,” তুমি কি ব্যস্ত”?
কেন বলত?
আমার সাথে একটু জিকাতলায় যাবে মামার বাসায়। একা যেতে চাইছি না, তাড়াতাড়ি চলে আসব।
সেদিন না করতে চাইলেও না করতে পারলাম না। না করলেই ভালো হতো।
বললাম, চলো।
রিক্সায় উঠে বসলাম। এতো কাছে কোন মেয়ের পাশে আমি বসিনি আগে। ওর কাধের সাথে আমার কাধ, ওর কনুই এঁর সাথে আমার কনুই গসা লাগছে। ওর ওড়না বাতাসে উড়ে আমার মুখে ঝাপটা মারলও। ও আরও সরে এলো আমার দিকে। ওর গায়ের উত্তাপ আমি পাচ্ছি। ওর নিশ্বাসের উষ্ণতা আমার গালে এসে আঘাত হানছে। ওর ভরাট বুকের উঠানামা আমি দেখতে পাচ্ছি।
ও পাশে হাত দিয়ে রিক্সার হুড টা উঠিয়ে দিলো। ডান হাতটা উঠিয়ে আমার ঘাড়ের পিছনে নিয়ে এলো। রিক্সার ঝাকুনেতে আমার কনুই বার বার ছুয়ে যাচ্ছে ওর শরীরের বিভিন্ন নরম অংশ। ওর কোন ভাবান্তর নাই। আরও চেপে এলো আমার দিকে।
সত্যি বলতে কি আমি তো ঋষি,মহর্ষি নই। রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। হরমোনের স্রোত আমার শরীরেও বইছে। তার প্রতিক্রিয়া আমি বুঝতে পারছি আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গে।
রিক্সা এসে থামল বাড়ীর সামনে। প্যান্টের ভিতরে গোজা জামাটা উপরে উঠিয়ে দিলাম।
নেমে এলাম দুজনে। দরজা টোকা দিতেই খুলে দাঁড়াল কাজের মেয়েটা। ও দুটো টাকা দিয়ে দোকান থেকে কি যেন আনতে বলল। আমি বাহিরে দাড়িয়ে।
ইয়াসমিন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভিতরে এসো”।
ভিতরে এলাম, দেখলাম বাসায় কেও নেই। ও তাকাল আমার দিকে। আমি দেখতে পেলাম ওর কামার্ত দুই চোখ। ওড়না টা সোফার উপরে পড়ে আছে। কামিজের দুটা বোতাম খোলা।
সেদিন আমার বিবেক আমাকে বাঁধা দিয়ে ছিল। প্রতাপের কথা মনে পরে ছিল।
আমি ঘৃনার সঙ্গে ওর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আমি দৌড়ে বাহিরে এসে রিক্সাওয়ালা কে বললাম, একটু জোরে চলো, তাড়া আছে।
সেই শেষ দেখা ।
না শেষ নয়, আরও একবার দেখা হয়েছিল, কার্জন হলের চত্বরে অনেক দিন পরে।
হাঁটছি কঙ্কনা আর আমি। ডাক শুনে ফিরে তাকালাম।
ইয়াসমিন।
কাছে এসে হাত চেপে ধরল।
“ অনেক কাল পরে দেখা। কেমন আছো?”
কিছু বলার আগেই বলল,”পরিচয় করিয়ে দিলে নাতো”?
পরিচয় শেষে একটা কাগজে ঠিকানা লিখে বলল, এই রইল, এসো একদিন।
আজ বাহিরে বের হওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলনা। গতকাল সন্ধায় গোটা চারেক বন্ধু তাদের সহধর্মীদের কে নিয়ে এসেছিল আমার এপার্টমেন্টে। আমিই বলেছিলাম। মেয়ে আমার খাবারের অর্ডার দিয়েছিল “নিউ চিলি এন্ড কারি”থেকে । আড্ডা সেরে সবাই যখন উঠল তখন ঘড়ির কাঁটা একটা পেরিয়ে গেছে।
সতী ছিলনা। সে গেছে বস্টনে তার মেয়ের কাছে। থাকলে সেই সবকিছু গুছিয়ে রাখতো।
ধোয়া মোছা শেষ করে যখন বেড রুমের দিকে এগোলাম তখন দুটো বাজে।
সকালে একটু দেরী করে উঠে কফির কাপ টা নিয়ে বসলাম। কয়েকটা ফোন কল সারতে হবে। দেশে বেশ কিছুদিন হোল কল করা হয়নি। আর ওই যে বললাম বাহিরে যাবার তাগাদা নেই আজ। অলস ভাবে কাটাব দিন টা।
তা আর হলনা। মানিব্যাগ থেকে ফোন কার্ড টা বের করতে যেয়ে সব কাগজ পত্র গুলো পরে গেলো মেঝে তে। ওগুলো উঠাতে যেয়ে চোখে পড়লো একটা ভিসা গিফট কার্ড। কবে পেয়ে ছিলাম কোথা থেকে পেয়ে ছিলাম মনে করতে পারিনা।
উঠিয়ে নিয়ে এপাশ ওপাশ করে দেখতেই চোখে পড়লো Expiration Date টা। আজই শেষ দিন।
অলস ভাবে আর কাটানো হোল না দিনটা।
রুজভেল্ট ফিল্ড মল খুব একটা দূরে নয় আমার এপার্টমেন্ট থেকে। বাহিরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। গাড়ীটা অটো স্টার্ট দিয়ে ফিরে এলাম ঘরে। এই অটো স্টার্টের চাবি সতীর দেওয়া গিফট। না করেছিলাম। শোনে নি।
ঠাণ্ডার জন্যই মলে লোকজনের ভিড় কম। গায়ে গায়ে ঠেলা ঠেলি করে কেনাকাটা করার মানসিকতা আগেও ছিলনা, আজও নেই। ভিসা কার্ড টা শেষ করাই আমার উদ্দেশ। কার্ডে অংকের পরিমাণ মন্দ ছিলনা।
কেনাকাটা শেষ করে ফুড কোর্টে এলাম। এক কাপ কফি খেলে মন্দ হয়না। সেই সাথে ফোন কল গুলো সারতে হবে। এই ভেবে নিরিবিলি একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসলাম। কাপে দুই চুমুক দিয়ে ফোনটা বেড় করে ডায়েল করতে যাব, এই সময়,
“ মিন্টু ভাই”
থতমত খেয়ে হাত কেঁপে ফোনটা পরে যাওয়ার আগেই আবার আঁকড়ে ধরে ঘাড় ফিরে তাকালাম যেদিক থেকে ডাকটা এলো।এই নামে আমাকে এদেশে ডাকেনি কেউ। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার Nick name টা। কে সে যে এখনও মনে রেখেছে আমার এই নাম টা। তাকালাম মহিলার দিকে। হাসির আভা ঠোঁটে।
“চিনতে পারছেন”?
অনেক পিছনে ফিরে গেলাম যেখানে আমাকে চিনত এই নামে। সেই স্মৃতির পাতায় এই মুখ ভেসে উঠলো না।
বললাম,” কিছু মনে করবেন না, চিনতে পারলাম না”
“ না চেনারই কথা। আমি দাড়িয়ে থাকতাম —“ কথা শেষ না করে বলল,” বসতে পারি”
“নিশচই।
“ কতকাল পরে দেখলাম আপনাকে,মিন্টু ভাই”। কথাটা ছুড়ে দিতেই আমার বুকে দুরুদুরু কম্পন শুরু হোল। এমন নয় যে মেয়েদের সাথে কথা বলতে আমি আড়ষ্টতা বোধ করি। শুধু আমার এক বান্ধবীর একটা কথা মনে করিয়ে দেয়। সে বলেছিল,” শমিত, তুমি কিন্তু এখন Most Eligible bachelor. সাবধানে থেকো”। এই সাবধানতা বজায় রাখতে যেয়ে অনেক কে আমি সন্দেহের মাপ কাঠিতে ফেলেছি। আজও যে তার বেতীক্রম তা নয়।
“ আমার এই নাম তো সবার জানার কথা নয়। আপনি জানলেন কি ভাবে”?
“ যা বলছিলাম, তার আগে বলি, আমার নাম সাধনা। চিনবেন না। কঙ্কনা আর আমি একি ক্লাসে একি হলে থাকতাম। তাই বলে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তা নয়”
“ ওর বন্ধুদের কে তো আমি চিনি। রেখা,মাগফের, ডলি, শান্তি”। বললাম
“ হাঁ, জানি, কঙ্কনার সাথে মাঝে মধ্যে কথা হতো। ওর কাছ থেকেই আপনার এই নামটা শুনেছিলাম। আজ যখন ওকে আপনার পাশে দেখছি না তখন আর কিছু জিজ্ঞাসা করবো না শুধু জানতে ইচ্ছে করে কতদিন হোল”।
“দু বছর, আপনি একা না সাথে কেউ আছে”।
“ একা”।একটু থেমে আরও বলল,” আপনাদের দুজনের জোড়া টা আমার খুব ভালো লাগত। হলের গেটের পাশে দাড়িয়ে আপনাদের কে দেখতাম। মনে মনে আপনাদের মত কাউকে নিয়ে এরকম জোড়া বেঁধে হাটতে চাইতাম। কিন্তু আমার ভাগ্যে তা আর হোল না”।
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। সতী কল করেছে। বললাম,” কিছু মনে করেন না, এই কল টা আমাকে ধরতে হবে”।
সতীর জিজ্ঞাসা আমি কোথায়, কি করছি।
আমি কোথায় কার সাথে সেটা কিছুটা বিশ্লেষণ করতেই, ও বলল,”শমিত দা, কি বলছ? কার সাথে, মাথা মুণ্ডু কিছু বুজতে পারছিনা”
বুঝলাম অর্ধেক কথা গলার ভিতরে রেখে বলাতে ওর বোধগম্য হচ্ছে না। এদিকে সাধনা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
বললাম, টেক্সট করে জানাচ্ছি।
পাল্টা টেক্সটে সতী জানালো, কোন ক্রমেই যেন আমি সাধনা কে টেলিফোন নাম্বার টা না দেই। আর সবশেষে ওকে যেন কল করতে না ভুলি। বিস্তারিত না জানা পর্যন্ত সে মোটেই স্বস্তি পাচ্ছে না।
সাধনার বয়স টা আন্দাজ করতে আমার বেগ পেতে হলনা। সেই তুলনায় একটু বুড়িয়ে গেছে মনে হোল। মাথার চুলে ঘনতা কম,তাতে কলপ দিলেও চোখের নিচ আর গলায় রীঙ্কেল গুলো ফুটে উঠেছে প্রকট ভাবে । পরনে সাদামাটা শালওয়ার কামিজ। সত্যি কথা বলতে কি আমি তো ধোয়া তুলসীপাতা নই, কাজেই সাধনাকে দেখতে যেয়ে তার বুকের অসমতলতা চোখে পড়ল।
সরি, কি যেন বলছিলেন?
আমার ভাগ্যের কথা। থাক, আপনাকে বিরক্ত করবো না। কঙ্কনার সাথে দেখা হলে ভালো হতো।
তাতো হবার নয়। আমার সাথে আপনার পরিচয় নেই তবু ও বলি, নিজের মনের ভার যদি লাঘব করতে চান তবে আমাকে বলতে পারেন।
নিজের কাজ আর করা হোল না। শুনলাম সাধনার কথা। আমাদের মত জোড়া বেঁধে চলতে চেয়ে ছিল। কিন্তু হলনা।
পল্লবের সাথে দেখা হয়েছিল ডিপার্টমেন্টে। সে এসেছিল ওর বোনের সাথে দেখা করতে। ঠিক সেই সময় সাধনা বেড়িয়ে আসছিল ক্লাস শেষ করে। করিডোরে দেখা। সেই থেকে পল্লব সাধনার পিছ ছাড়েনি।
বললাম,” সে তো খুব ভালো কথা। সে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, এই তো আপনি চেয়েছিলেন”।
চেয়েছিলাম, পেয়েও ছিলাম কিছুদিনের জন্য।
কিছুদিন, মানে?
বিয়ের পরে জানলাম শুধু আমি নই ওর আরও কয়েক জন মেয়ে বন্ধু আছে যাদের সাথে সে হোটেলে রাত কাটায়।
কিছু বলতে যেয়ে ধমক খেয়েছি।
ডিভোর্স নেননি কেন? প্রশ্ন টা করে ভাবলাম আমি বলার কে।
নিয়েছি, নিয়েছি বললে ভুল হবে, সেই দিয়েছে, সে আরেক কাহিনী।
বলতে যখন শুরু করেছেন, বলেন।
সাধনা চোখ ফিরিয়ে নিলো আমার দিক থেকে।
আজিই প্রথম ডাইরি লিখতে শুরু করেছি। না প্রথম বলব না। ক্লাস নাইনে যখন পড়তাম তখন কিছুদিন লিখেছিলাম। বয়স ছিল ১৪। তাতে শুধু থাকতো সিনেমার কথা। খেলতে যেয়ে কাকে লেং মেরে ফেলে দিয়েছি। কোন মেয়েটা একবার তাকিয়ে হেসেছিল , তাই নিয়ে এক পাতা লিখে ফেলেছি। ভাগ্য ভালো বাবার হাতে পরেনি সেই লেখা। তা হলে খবর ছিল।
সে লেখা আর বেশি দুর এগোইনি।
আজ আবার শুরু করলাম।
সাধনা তাকাল, বলল, কিছুদিন যেতেই বুঝতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। পল্লব এলে ওকে বললাম। খুশীর পরিবর্তে রাগ হোল তার। কোন রকমে কিছু করতে পারি কিনা জিজ্ঞাসা করল। বললাম, না, হবেনা।
আমার লেখা টা যদি এখানেই শেষ হতো তাহলেই বোধ হয় ভালো ছিল।
কিন্তু হলনা, সাধনা বলতে থাকল,
গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে মার সাথে। ডাক্তার পরীক্ষা শেষে বলেছিল একটা মেমোগ্রাম করা দরকার। বা পাশের ব্রেস্টে একটা লাম্প আছে মনে হচ্ছে।
দুদিন পরে ডাক্তার ফোন করে বলেছিল, রেজাল্ট ভালো আসেনি। কেন্সেরাস। তবে ফার্স্ট স্টেজ। বলেছিল, নয় মাস অপেক্ষা করতে। তারপর masactomy করবে।
সাধনা রাজি।
পল্লব কে বলতেই সে বলেছিল,” কেন্সার, কেন্সের হলে মানুষ বাচেনা। শুধু গাদা গাদা টাকা নস্ট”। বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল। আর ফেরে নি। তার পরিবর্তে পাঠিয়ে দিয়েছিল ডিভোর্সের কাগজ পত্র।
নয় মাস পর এলো এক পরী এই পৃথিবী তে। সেই সাথে একটা ব্রেস্ট কেটে ফেলতে হোল। রেডিয়েশন দিতে হয়েছিল। ভবিষ্যতে ভালো থাকার জন্য।
বড় বোনের সহযোগিতায় আমেরিকায় এসেছে। তাও আজ দশ বছর হয়ে গেল। শুনেছে পল্লব আবার বিয়ে করে লস এঞ্জেলিসে আছে ।
বললাম,যাক সব ঝামেলা চুকে গেছে।
না, চুকেনি। বিঁধি আমার সাথে আর একটু খেলায় মত্ত হয়েছে। দশ বছর পর আবার সেই বদ রোগ টা ফিরে এসেছে। এবার আর প্রথম স্টেজ নয়, ফীফথ স্টেজ। বলে তাকাল পাশে।
বুঝলাম চোখ মুছছে।
একটু চুপ করে থেকে বলল আজ উঠি মিন্টু ভাই। এই আমার ফোন নাম্বার, থাকি Commack এ। সময় পেলে কল দিয়েন।
আজ শেষ দিন এই Langkawi তে। আলী এলো আমাদের কে নিতে। গাড়ীতে উঠতেই বলল,” তোমরা তো মুসলমান। আজ শুক্রবার। জুম্মা নামাজে যাবে”?
আমি কিছু বলার আগেই সতী বলে উঠল,” নিশচই। মসজিদ কতদুর”?
“ Eagle Square থেকে কাছে। তোমরা সব দেখা শেষ করে আমাকে কল করলে আমি এসে তোমাদেরকে নিয়ে যাবো”।
Eagle Square। Kuah জেটির পাশে । এই Squareর প্রধান আকর্ষণ হোল বিশাল আকারের মানুষের তৈরী লালচে রঙের ঈগল। মনে হচ্ছে এখনি সে উড়ে যাবে। একে ঘিরে চারিদিকে ফুলের বাগান, ছোট ছোট পুকুর। সুভেনীয়ার আর খাবারের দোকান।
সমুদ্রের থেকে বেড়িয়ে আসা Bayর পেছনে সবুজ পাহাড়। এই দৃশ্য চোখ মন দুই কেড়ে নেয়।
এখানে আসতে হলে সকালে অথবা সন্ধায় আসা শ্রেয়। কারন রৌদের তাপের সাথে সাথে Concrete এর মেঝের তাপও বাড়তে থাকে। দাঁড়ান অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। আমরা যখন এসেছিলাম সূর্যমামা তখন মধ্য গগনে। কাজেই কিছুক্ষণ বসেই উঠে পড়লাম। সামনে সবুজ গাছে ঘেরা বাগানের ভিতর দিয়ে হেটে এলাম ফুড কোর্টে।
জুম্মা একটায়। এখনও আধা ঘণ্টা বাকি। আলীকে কল করে আসতে বলে আমরা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ আর আইসক্রিম নিয়ে বসলাম ম্যাকডনাল্ডে। পনের মিনিটের ভিতর আলী এসে হাজির। আমাদেরও খাওয়া শেষ।
দশ মিনিটের পথ। এসে পৌছালাম” মসজিদ আল হানা” তে।
সতীকে একজন পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো যেখানে মহিলাদের বসার জায়গা ।
সতী কে বললাম, নামাজ শেষে ঠিক এই পিলারের কাছে এসে দাঁড়াবে আমি না আসা পর্যন্ত।
ও দাড়িয়ে ছিল আমার অপেক্ষায়। আমার দেরী হয়ে গেলো কারন আমার জুতো জোড়া খুজে পেলাম না। তার পরিবর্তে দেখলাম পড়ে আছে এক জোড়া জুতা আমার জুতার মতো দেখতে। ওটা পড়ে এসে সতী কে দেখালাম।
সে বলল,”ভুল করে কেউ নিয়ে গেছে। ভুল বুঝতে পারলে হয়তো এসে রেখে যাবে। চলো, আলীকে কল দাও”।
আলী কে কল দিলাম। সে বলল তার দশ মিনিট লাগবে আসতে। অগত্যা একটা গাছের ছায়ার নিচে এসে দাঁড়ালাম দুজনে। আস্তে আস্তে ভিড় কমে এলো। সতী বলল,” আচ্ছা, এখন তো ভিড় নেই, দেখে আসত জুতো টা কেউ রেখে গেছে কিনা”।
বললাম,” তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে”।
বলল,” এখানে দাড়িয়েই তো আছো, একটু যেতে অসুবিধা কি”?
অগত্যা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলাম। দেখলাম আমি যেখানে রেখেছিলাম ঠিক সেই খানে সাজানো রয়েছে আমার জুতাটা।
অনেক দেখলাম। এবার Langkawi থেকে বিদায় নেবার পালা।
গাড়ীতে এসে সতীকে বললাম অনেক তো দেখলে মন ভরল কি?
” উপরওয়ালা আমাকে তোমার মতো বন্ধু মিলিয়ে দিয়েছে, তোমার সাথে এলাম, চোখ ভোরে তার সাজানো সৌন্দর্য দেখলাম, এমনকি জুম্মার নামাজ টাও মসজিদে পড়তে পারলাম। আমার আর কি চাওয়ার থাকতে পারে, বলতো”?
ওর দিকে চেয়ে মনে হোল আরও একজন ছিল, সেও অতি অল্পতেই খুশি হতো।
বলতো,” আমার আর কি পাওয়ার থাকতে পারে বলও, তোমার মতো স্বামী পেয়েছি, প্রান জুড়ান দুটো ছেলেমেয়ে, আর আমার কি চাই বলও”?
তাইতো, তার আর কিছুই চাওয়ার ছিলনা।
আমিও পেয়ে ছিলাম, পেয়ে হারালাম।
কি ভাবছ শমিত দা।
না, কিছুনা, চলো।
সতী আলীর দিকে তাকিয়ে বলল,” আলী, ফিরে চলো হলীডে ভিলাতে”।
দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল উপর থাকে। যে বন্ধনে বেঁধে ছিল আমাদের কে আজ তা খুলে দিতে হবে।
“ যেতে নাহি দিবো হায়, তবু যেতে দিতে হয়”।
সামনে এগিয়ে যেতে হবে এই তো নিয়ম। পিছনে যা রেখে গেলাম তা রইল আমার স্মৃতির পাতায়।
আমি ,সতী, Langkawi।
কোন এক অলস মুহূর্তে বসে রইব আমার বেল্কনীতে। আকাশে জ্বলবে সন্ধ্যা তাঁরা। হাতের কাছে সদ্য পান করা কফির পাত্র। সামনে খোলা এ্যালবামের পাতায় পাতায় সতীর হাসি, আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউ।
বাবা বলে জড়িয়ে ধরে মেয়েটা বলবে,” কি দেখছ বাবা”?
আরও পরে, সেই আমি, চিনতে পারব না এ্যালবামের ছবি গুলো, আমার স্মৃতির পাতা থেকে বিলীন যাবে ওরা। মনে হবে ওরা দূর দেশের কেউ, ওদের কে আমি চিনি না। সেই হাসি, যাকে আমি শুইয়ে দিয়েছি বিশাল অন্ধকারের মাঝে, সেই হাসি, যাকে আমি রেখে এসেছি অস্ত যাওয়া সূর্যের লাল আভায় ভরা সমুদ্রের পাড়ে। আমি চেষ্টা করছি ফিরিয়ে আনতে আমার ওই স্মৃতি গুলো, আমি পারছি না, আমি পারছি না।
বাবা বলে ডাক দিয়ে মেয়ে টা বলবে,” ঔষধ টা তো খাওনি বাবা”।
“শমিত দা, তোমাকে ডাকছে ওই কাউন্টারের লোকটা। মাঝে মাঝে তুমি কি ভাবো”?
“ তাই তো”।
কাউন্টারে এসে দাড়াতেই লোকটা চোখ বুলিয়ে নিলো আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। লোক বলব না, বলব ছেলে। নিতান্তই কম বয়সি। পাশে একটা মেয়ে। মনে হোল ছেলেটা নতুন, কাজে হাতখরী নিচ্ছে। মেয়ে টা মাস্টার।
বললাম,” যদি কোন অসুবিধা না হয় তবে জানালার পাশে সীট দেবেন”।
“ চেষ্টা করব”। বলে মাথা নিচু করে কাজ করতে থাকলো।
মনে হোল আজকে তার দিন টা ভালো যায় নি। নিশ্চয় বকা খেয়েছে। অগত্যা চুপ করে রইলাম।
কিছুক্ষণ পরে বোর্ডিং পাশ দুটো হাতে এগিয়ে দিলো, মুখ গোমরা করে। কিছু আর জিজ্ঞাসা করলাম না। তাকিয়ে দেখি সীট নম্বর
A & B —- হেসে বললাম,” ধন্যবাদ”।
উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে এলাম দুজনের হ্যান্ড ব্যাগ গুলো নিয়ে।
ওয়েটিং রুমে এসে বসলাম। সব মিলে গোটা বিশ জন বসা। সতী বার বার ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখছিল। বললাম,” কি ব্যাপার, আমাকে নুতন করে দেখছ বুঝি”?
বলল,” আচ্ছা শমিত দা, যদি আমার সাথে তোমার দেখা না হতো তাহলে কি করতে”?
হাসতে হাসতে বললাম,” জানো না সেই লাইন টা,” যদি তোর ডাক শুনে কেউ না এসে তবে একলা চলো রে”।
“না, তুমি একলা চলতে পারতে না। তোমার মাঝে একটা আকর্ষণ আছে যার জন্য কেউ না কেউ তোমার পাশে এসে দাড়াত। তা সে বন্ধু ভাবেই হোক বা অন্য কোন ভাবে”।
“ তা তুমি সেই প্রজাপতি, উড়তে উড়তে এসে বসেছ পাশে। তোমার ঐ দার্শনিকতা রেখে, চলো, ওরা লাইনে যেতে বলছে, প্লেনে উঠতে হবে”।
একঘণ্টা পনেরো মিনিট পর পৌছালাম কুয়ালা লাম্পুর ইন্টারনেশনাল এয়ারপোর্টে। বাহিরে বের হতেই দেখলাম শুভঙ্করের নাম লিখে দাড়িয়ে আছে ড্রাইভার। কাছে এসে বললাম সেই একি কথা, আমরা দুজন, অন্য দুজন আসতে পারেনি। হাসি দিয়ে বলল, আমার নাম শম্ভু করমা। বলে আমাদের দুজনের লাগেজ নিতে চাইল। বললাম আমার টা আমিই টানতে পারবো তুমি সতীর টা নাও।
গাড়ীটা একটু দূরেই পার্ক করা। হাটতে হাটতে বলল,” এখান থেকে এক ঘণ্টা লাগবে হোটেলে যেতে”।
তিন লেন তিন লেন ছয় লেনের হাইওয়ায়। রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ গাছারী। মাঝে মাঝে পরে থাকা মাঠের পরে বড় বড় বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম শম্ভু কে, এই নির্জন এলাকায় এতো কাজ কেন হচ্ছে।
শম্ভু করমা খবর রাখে। বলল, শহরের উপর লোকের চাপ যাতে না পরে সেই জন্য অফিস আদালত কে দূরে নিয়ে আসা হবে।
হোটেল Furama Bukit Bintang এ যখন এসে পৌছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। শম্ভু করমা বিদায় নিলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো কাল একজন সকাল নয়টায় আসবে। ঘুরে নিয়ে বেড়াবে কুয়ালা লামপুরের বিভিন্ন দেখার জায়গায়।
কাগজপত্র আর পাসপোর্ট গুলো কাউন্টারে রাখলাম। ভদ্রলোক আমার কাগজ গুলো এপাস ওপাশ করে বলল তোমার নামে বুকিং নাই। আকাশ থেকে পড়লাম। “নাই মানে, এই যে কাগজে বুকিং কনফার্ম লেখা আছে’?
বলল আছে, তবে তোমার নামে নেই,আছে শুভঙ্করের নামে।
বললাম, আমি তো ওই দলের একজন।
তুমি যে সেই দলের একজন তা আমরা কীভাবে জানি? তোমার বা অন্য কারো নাম তো এখানে লেখা নেই।
মনে মনে বললাম, তোমার নিকুচি করি, তা কি করতে হবে?
সতী এতক্ষণ দেখছিল। ও আমার ধৈর্যের বহর জানে। আমাকে ডাক দিয়ে বলল,” ওদের সাথে রাগ করে কোন লাভ নেই”।
এবার গলার স্বর নামিয়ে বললাম,” বড্ড খিদে পেয়েছে, এই আমার সব কাগজ পত্র থাকলো, আমি ঐ সোফাতে যেয়ে বসলাম, তুমি তোমার বড় সাহেবের সাথে কথা বলে যা ইচ্ছা তাই কর”। বলে চলে এলাম।
কিছুক্ষণ পর ভিতর থেকে ফিরে এসে বলল, “ এসো একটা রুম হলেই তো চলবে”?
আবারও সেই একি সমস্যা। সতী মিটমিট করে হাসছে।
বললাম,” না, চলবে না”।
রুম পাওয়া গেলো। একটা রুম খালি হয়ছে, অন্যটা পরে পাওয়া যাবে। খিদেয় পেটের নাড়ী চোঁ চোঁ করছে। সতী জানে খিদে পেলে আমার মাথার ঠিক থাকেনা। তাই সে বলল,” সব ল্যাগেজ এই রুমে রেখে চলো আমরা খেয়ে আসি”।
খোঁজ নিয়ে জানলাম খাওয়ার জায়গা হোটেল থেকে দুই মিনিটের পথ। Berjaya Time square. চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমাদের ওখানকার Time square। আসলে তা নয়। এটা সাত তালা বিল্ডিং। বড় একটা মল। তার ভিতর ফুড কোর্ট।
সতী বলল, তুমি চয়েস করবে না আমি।
বললাম, কোনদিন আমাকে খাবার চয়েস করতে দেখেছ?
নুডুলসের সাথে বিভিন্ন শাকসবজি দিয়ে তৈরী খাবার টা ভালোই লাগলো। খাওয়া শেষে আমি নিয়ে এলাম Frozen Yogart.
বড় বড় শহর বড় বড় মল, বড় বড় বিল্ডিং আমাকে আকর্ষণ করেনা। আমরা এসেছি পৃথিবীর অনেকের মধ্যে এক বৃহত্তম শহর থেকে। তবুও দেখে যেতে হবে।
রাজার বাড়ী, Istana Negara. চারিদিকে লোহার বেড়া। জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। গেটের সামনে দুটো ঘোড়ায় চড়া Royal Calvary guard. দেখার কিছু নেই।শুধু ফটো অপ। সেখান থেকে Petronas Tower। এক সময় ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উচু বিল্ডিং। আজ আর নয়। এখন নাম তার Tallest Twin Structure. ৮৮ তালার এই বিল্ডিং। বিয়াল্লিশ তালাতে স্কাই ব্রিজ করে দুটো টাওয়ার কে সংযুক্ত করা হয়েছে। উপর থেকে নিচে দৃশ্য দেখতে খুবই মনোরম। বলেছি আগে এই সব বড় বড় বিল্ডিং পৃথিবীর নামকরা ডিজাইনার শপ মন কারে না আর।
শহর ছাড়িয়ে এক ঘণ্টার পথ পেড়িয়ে এলাম Genting Highlands এ। ৬০০০ ফুট উচুতে Resorts World Genting. এখানে আসা যায় cable Car( Genting Skyway)এ করে অথবা গাড়ীতে। আকাবাকা পাহাড়ের পাশ দিয়ে গাড়ী উঠছে উপরে। পেঁজা পেঁজা মেঘ পাহাড়ের গা বেয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব। শহরেরে কোলাহল থেকে দূরে। নিরিবিলি। Resort এ আছে Casino, আছে ছোট ছোট খাবার জায়গা। খাবার নিয়ে আমরা বসলাম জানালার পাশে।
সতী তাকিয়ে ছিল দূরে। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সে। আমি বাঁধা দেইনি। ওর চোখের কণে কি যেন জ্বলজ্বল করছে।
আর আমি তাকিয়ে দেখছিলাম হাতের কাছ দিয়ে সাদা সাদা মেঘগুলো খেলা করতে করতে চলে যাচ্ছে, আমি ধরতে পারছিনা।
“শমিত দা”
“কি বলও”
“আবার কবে তোমার সাথে এই লাগাম হীন ভাবে ঘুরতে বের হবো”
“ তা তো জানিনা”।
ফিরে এলাম হোটেলে। রাতের খাওয়া শেষে Dessert নিয়ে এসে বসলাম ছাদে ঢাকা সুইমিং পুলের পাশে। বাহিরে অঝোরে ঝরছে জল শুধু আমরা দুজন পুলের পাশে। সতী পা টা উঠিয়ে দিলো আর একটা চেয়ারের উপর। বলল, শমিত দা, বলবে কি ওই গান টা কবিতা আকারে।
” আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো”
না ওটা নয়, শোন আর একটা
” বন্ধু, রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণপ্রাতে।
ছিলে কি মোর স্বপনে সাথিহারা রাতে॥
বন্ধু, বেলা বৃথা যায় রে
আজি এ বাদলে আকুল হাওয়ায় রে–
কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখো হাতে”।
সতী হাত টা বাড়ীয়ে দিলো।
শপিং শেষ, বেড়ানো শেষ। এবার বাড়ী ফেরার পালা। প্রান ভরে দেখলাম এখানকার সৌন্দর্য। অতি কাছ থেকে দেখলাম সতীকে। এতো কাছ থেকে সতী কে দেখিনি কখনো। দেখলাম। মনে হোল ওর আর আমার বন্ধুত্বের যে বিশালতা তা হারিয়ে যাবার নয়।
সতী বলল, শমিত দা আমরা একটা মাইলস্টোন তৈরি করলাম, তাই না?
হাঁ তাই।
ক্যাপ্টেনের নির্দেশ ঘোষিত হোল। সতী তার মাথা টা এলিয়ে দিলো পাশের জানালায়।
“শমিত দা, শমিত দা, ওঠো—“ সতীর ধাক্কায় ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঘুমের ঘোর টা কেটে উঠার আগেই সে বলল, “ বিড়বিড় করে কি বলছিলে? আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুমি তো এভাবে অঘোরে ঘুমাও না জানি। আজ কি হয়ে ছিল”?
“ জানিনা, তবে ভালোই হোল, স্বপ্নে অনেকদিন যা দেখিনি, তা দেখলাম। আর আমার একটা প্রিয় কবিতা পড়ছিলাম স্বপ্নের মাঝে। শুনবে?
বলও।
,” আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরনীতে মুগ্ধ ললিত অশ্রুগলিত গীতে” বিড়বিড় করে হয়তো ঐটা ই পড়ছিলাম।
“ তুমি তো স্বর্গ এখানেই গড়েছিলে শমিত দা”
“গড়েছিলাম আবার তা বানের জলে ভেসেও গেলো। যাক সে সব কথা। আসে গেছি, তাই না?”
“হাঁ,”
সতী আর আমি নামলাম গাড়ী থেকে। সেলিমের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম,” তুমি লাঞ্চ খেয়ে নিও”।
ও চলে গেলো।
আমরা যেখানে এসে দাঁড়ালাম সেখান থেকে রাস্তা টা খাড়া হয়ে নেমে গেছে বীচে।
সতী কে আমার হাত ধরতে বললাম। ও ইতস্তত করছিল।
বললাম,” আমার হাত ধরলে তোমার মহাভারত অশুদ্ধ হবে না বরং পড়ে গেলে তোমাকে আমার কোলে করে নিতে হবে”।
মাঝে মাঝে ওর এই ধরনের শুচিবাই আমাকে বড় বিরক্ত করে।
অবশেষে সে আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে নেমে এলো।
কালো বালির বীচ। কালো কুচকুচে নয়। সাদা কালো মিশানো। বৈজ্ঞানিকদের মতে কেমিক্যাল Reaction এর জন্য এই রঙ ধারন করেছে। আমার Black Sand Beach দেখা এই প্রথম নয়। দেখেছিলাম Santorini Perissa Beach। আমরা চারজন। সে অনেক বছর আগের কথা। মাঝে মাঝে স্মৃতি মন্থন করি। ফিরে যাই অনেক অনেক পিছনে। চোখে জল আসে।
থাক সে কথা। আজ বলব আজকের কথা।
Langkawi আর সতী। Langkawi থাকবে তার চিরন্তন সৌন্দর্য নিয়ে। লোকে আসবে, দেখবে, মুগ্ধ হবে।
আর সতী, যে সতীকে আজ আমি দেখছি কালকের সতীর সাথে তার মিল নাও থাকতে পারে।
সাদাটে একটা হ্যাট নিয়ে আসে বললাম, এটা নাও, মানাবে তোমাকে।
এবার চলো ডাবের পানি খাবে। দুজনে এসে বসলাম চেয়ারে। লোকটা একটা ডাব কেটে দুটো স্ট্র ভিতরে দিয়ে নিয়ে এলো।
সতীকে বললাম,” দেখেছ, দুটো স্ট্র সে আমাদের হাতে না দিয়ে ভিতরে দিয়ে নিয়ে এলো, তারমানে আমাদের দুজনকে একসাথে খেতে হবে। পারবে?”
“আমার আপত্তি নেই। তোমার”?
দাড়াও ওকে বলি একটা ছবি উঠাতে, দুজনে একসাথে মাথা ঠোকাঠুকি করে ডাবের পানি খাচ্ছি। জমবে ভালো। যারা দেখবে তার কি বলবে বলতো?
“ আমি কেয়ার করিনা”। বলে সে চুমুক দিলো, আমিও মাথাটা নামালাম।
চারিদিকে খোলা, শুধু মাথার উপরে ছাদ। তারি নিচে এসে বসলাম লাঞ্চ করবো বলে। হাওয়া বইছে। সমুদ্রের নীল পানি, উড়ছে গাংচিল, হাঁটছে Seagulls পানির পাশে, আমরা প্রায় ৩০০ ফুট দূরে রেস্তোরায় বসে অর্ডার দিলাম Pad Thai আর Green papaya salad। সতীর মুখের লাল আভা মিলিয়ে এসেছে।
বলল,” সমুদ্রের এত কাছে বসে কোনদিন লাঞ্চ করেছ কি”?
“না করিনি, তুমি”?
“ আমি তো এই প্রথম ঘর ছেড়ে এতদূর এলাম। যখন সময় এসেছিল তখন তাকিয়ে দেখি শুধু আমিই আছি সে নেই। তাই বৌদির প্রস্তাবে প্রথমে দ্বিধা থাকলেও পরে আর তা ছিলনা। তোমার মতো বন্ধু কোথায় পাবো, বলও”? বলে ওড়না দিয়ে চোখের কোণা টা মুছে নিলো।
সেলিম দাড়িয়ে ছিল গাড়ীর কাছে। আমরা আসতেই বলল,” লাঞ্চ কেমন খেলেন স্যার”?
সতী বলল,” খুবই ভালো ছিল। তুমি কোথায় খেলে”?
খাওয়া হয়নি ।
কেন? প্রশ্ন করলো সতী।
এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল অনেকদিন পরে। না দেখা হলেই বোধ হয় ভালো ছিল।
কেন?
“ওর পাঁচ বছরের মেয়ে টা গত মাসে একদিনের জ্বরে মারা গেছে। হাসপাতালে নেওয়ার ঘণ্টা দুএকের মধ্যে সব শেষ। কেন হোল,কি ভাবে হোল, কি রোগ তার কোন সঠিক ব্যাখা তারা দিতে পারেনি। ওর বৌ পাগলের মতো হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টার পর এই মেয়েটা এসেছিল ওদের কোলজুড়ে। ওর বৌ এখন বাপের বাড়ী। কান্না এখনও থামে না। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যায়। এই খবর শুনে আর খাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা। আমারও একটা ছেলে আছে চার বছরের”। কথা শেষে সে সতীর দিকে তাকাল।
সতী বলল,” সব উপরওয়ালার ইচ্ছা। তোমার আমার করার কোন ক্ষমতা নাই”। কথা হচ্ছিল গাড়ী চলতে চলতে। আমি তাকালাম সতীর দিকে, সেও তাকালও আমার দিকে।
বললাম,” তুমি ফিরে যাবে নাতো অতীতে”?
ওর পূর্ব ইতিহাস আমি জানি।
বলল, “না, আজ যা দেখতে এসেছি তাই দেখব। পিছনে ফেলে আসা ঘটনা কে টেনে আনবো না”।
এসে পৌছালাম KILIM নদীর পাশে। ঘাটে অনেক স্পীড বোট বাঁধা।
Langkawi Mangrove Tour হচ্ছে মাঝারি সাইজের স্পীড বোটে করে kilim নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে দেখা Mangrove Swamp। ভিতরে বিভিন্ন ধরনের সবুজ গাছ, শ্যাওলা পড়া পাঁথরের পড়ে শুয়ে থাকা বড় বড় Lizards.
আমাদের বোটে আমরা ছয় জন।
বোটের রঙ সতীর ওড়নার রঙের সাথে একাকার হয়ে গেছে।
বললাম,” দেখেছ কি? তোমার গায়ে পেঁচানো কাপড়ের রঙ মিশে গেছে বোটের রঙ এর সাথে। ওরা কি জানতো তুমি আসবে আজ”? ও কিছু না বলে শুধু হেসে সলজ নেত্রে তাকাল আমার দিকে।
Kilim নদীর এক পাশে গভীর সবুজ Mangrove অন্য পাশে বিশাল Limestone rocks। কিছু কিছু Limestone rocks দেখতে পাহাড়ের মতো। বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন রঙের পাখি উড়ছে। সাদাটে বানর হেটে বেড়াচ্ছে নদীর পাশে পাথরের উপর। অনেক লালচে রঙ এর ঈগল ঘুরছে মাথার পড়ে।
Eagle Feeding দেখার মতো। শান্ত পানিতে এসে বোট টা থামে, স্টার্ট বন্ধ করলেই ওরা বুঝতে পারে ওদের খাবার আসছে। ঝাক ঝাক ঈগল ঘুরতে থাকে মাথার উপর। বোটের চালক ছুড়ে দেয় মুরগীর ছোট টুকরা। ছোঁ মেরে ঈগল উঠিয়ে নেয় মাংস টা ।
ঈগল খাওয়ানো শেষে এবার বোট এলো Bat Cave এ। অন্ধকার, গাইডের টর্চের আলোয় দেখা যায় ছোট ছোট অনেক বাদুড় ঝুলে আছে দেয়ালের গায়ে। শব্দ করতে নেই। আস্তে আস্তে হেটে যাও।
এখানেই শেষ নয়। বোটের চালক নিয়ে এলো উন্মুক্ত সমুদ্রে। ওখান থেকে দেখা যাচ্ছে Street of Malacca. পাহাড়ের গায়ে লেখা KILIM GEOFOREST PARK. বোট এসে দাঁড়াল পাহাড়ের কাছে। ফটো সেশন।
সতীকে বললাম,” তুমি এসে বসো বোটের মাথায় ঐ লেখাটা নিয়ে ফটো উঠাবো”।
দুঘণ্টা বাদে বোট এসে যখন পাড়ে ভিড়ল তখন বিকেল পাঁচটা। সতী ক্লান্ত, আমিও। আজকের মতো দেখা শেষ। ফিরে যাবো আমাদের ভিলাতে। সতী বলল,” ফিরে যেয়ে বীচের পাড়ে একটু বসব, কি বলও?”
“কোন আপত্তি নেই, তবে তার আগে বীচের পাশে কফি হাউজে বসে গলাটা ভিজিয়ে নিলে হয়না”?
“মন্দ কি”?
গাড়ীতে এসে বসতেই সেলিম বলল,” কাল তোমাদের রীলাক্সের দিন, তোমরা তোমাদের মতো ঘুরবে, কোন প্লান আছে কি”?
বললাম,”না, নেই”।
“ তাহলে কাল আমি আমার এক বন্ধুকে পাঠিয়ে দেবো, সে তোমাদেরকে Langkawi শহর টা ঘুরিয়ে দেখাবে”।
আমরা দুজনেই রাজি। সকাল দশ টায় আসবে সে।
সেলিম যখন আমাদেরকে নামিয়ে দিলো তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আমরা এসে বসলাম কফি হাউজে। প্রথম দিনের সেই মেয়ে টি। এসে বলল,” কফি, চা, আর সেই বিস্কিট, না অন্য কিছু”।
বললাম,” মনে রেখেছ দেখছি”?
সে হেসে চলে গেলো।
আমরা এসে বসলাম সেই চেয়ার দুটো তে যেখান থেকে দেখা যায় সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ।
বিস্কিটে কামড় দিয়ে সতী জিজ্ঞাসা করল,” আচ্ছা শমিত দা এই ভাবেই কি কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন টা”?
“ মন্দ কি? কথা বলার সাথি, তুমি তো আছো”।
“দোয়া করো শমিতদা আমি যেন তোমার কথা বলার সাথি হয়েই থাকে পারি”।
“ চলো, সমুদ্রের পাড়ে বসবে বলেছিলে”?
“ না আজ থাক, আজ হাটতে ইচ্ছা করছে তোমার সাথে। এই পটভূমিকা আমার জীবনে আবার নাও আসতে পারে।
মনে পরে কি শমিত দা, তোমার বেল্কনীতে বসে এক চাঁদিনী রাতে তুমি আমাকে শুনিয়ে ছিলে সেই গান, কবিতা আকারে। বলবে কি? আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে”।
মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন,তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম ॥
“তোমার চোখে জল”?
“ তোমার চোখেও তো কি যেন চিকচিক করছে, শমিত দা। আসলে আমরা দুজিনেই তো একি পথের পথিক। শমিত দা তুমি আমাকে শুধু এই আশীর্বাদ করো আমি যেন তোমার বন্ধুত্বের ছায়ায় আমার শেষ জীবন টা কাটিয়ে দিতে পারি”।
রাত সাড়ে আটটা। চারিদিক অন্ধকার। দূরে নোঙর করা এক জাহাজের মিটিমিটি আলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। লোকেরা চলে গেছে যার যার ঘরে। শুধু আমরা দুজন বসে আছি।
“এবার উঠতে হবে সতী”।
“হাঁ, চলো”।
পাড় থেকে উঠে এলাম। বসলাম এসে সুইমিং পুলের পাশে বিছানো দুটা হেলান দেওয়া চেয়ারে। সন্ধায় পুলে নামা নিষেধ। কিছু দূরে আলোর নিচে এক মেয়ে স্বল্প কাপড় পড়ে শুয়ে আছে। আমাদের জায়গাটা আলো আধারে ভরা । পিছনে ছোট ছোট গাছের ভিতর থকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। ওরা চুপ করলে চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু আমাদের দুজনের কথা, সতী বলছে তার স্মৃতির ভাজে ভাজে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
ছোট বেলা, পায়ের নুপুরের টুংটাং শব্দ। আলতা পায়ে বাবা কে বলেছিল,”দেখত বাবা আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, তাই না”?
“হাঁ মা, রাজপুত্র আসবে রাজকন্যা কে নিতে”।
এসেছিল, আবার চলেও গেলো। সতীর কান্নায় বুজে আসা গলা। আমি তাকালাম ওর দিকে। পাশের ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলোর রশ্মি এসে পড়েছে ওর চোখের জলের উপর। চিকচিক করছে হীরের কনার মত। ও তাকাল আমার দিকে।
“চলো, রাত সাড়ে নটা হোল। ডিনারে বসে শুনবো অন্য কথা”।
থাই রেস্টুরেন্ট টা সতী পছন্দ করে রেখেছিল। আমরা যেয়ে বসলাম। সতী মেন্যু উল্টিয়ে দেখে দুটো আইটেম আনতে বলল। সাথে একটা এপিটাইযার। জিজ্ঞাসা করলো, আমি মেন্যু টা দেখব কি না?
বললাম,” দরকার আছে কি”?
বলল,” জানি তুমি কোনদিনই কোন কিছু চয়েস করনি। তোমার কথায়, তুমি বাচার জন্য খাও, খাওয়ার জন্য বাচো না।“
“তুমি মনে রেখেছ কথাটা, দেখছি”?
ও কোন উত্তর দিলো না।
খাবার এলো। সতী কে বললাম,” তোমার Item Selection এর তারিফ না করে পারছিনা”।
ও হাসল। “ কেমন হয়েছে খাবার গুলো?”
“খুউব ভালো। সেইজন্যই তো মেন্যু নিয়ে ঘাটাঘাটি আমি করিনি”।
খাওয়া শেষে বেড়িয়ে এলাম রাস্তায়। চারিদিক ঝলমল করছে চাঁদের আলোতে। শুধু আমরা দুজন রাস্তায়। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ী পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। পাশের পাহাড় বেয়ে আলোর ঝরনা ঝরে ঝরে পড়ছে। রাস্তার পাশে বেঞ্চে বসে একজন কাসার থালে টুংটুং করে বাজনা বাজাচ্ছে। চোখ বন্ধ। অন্ধ কি না জানিনা।
সতী গুনগুণ করে গেয়ে উঠলো,” ধন্য ধন্য ও বলি তারে—————– “ দু এক বার গেয়ে থেমে গেলো।
বললাম,” থামলে কেন”?
“ আর তো জানিনা”।
“ ঐ লাইন টাই বার বার গাও, শুনতে ভালো লাগছে এই পরিবেশে।“
সতী গুন গুনিয়ে উঠলো।
আমি ফিরে গেলাম দূরে,বহু দূরে টেমস নদীর পাড়ে। সেই রাতেও ছিল পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে। সে বলেছিল,” তোমার বেসুরো গলায় গাও তো সেই গানটি,” আমারও পরানো যাহা চায়, তুমি তাই, তাই গো—–“
আজ মনে হোল পরিবেশ এক, পটভূমি আলাদা, সম্পর্ক আলাদা।
হাত বাড়ালেই যাকে পাওয়া যেতো, না চাইতেই যে কাধে মাথা রাখতো সে আজ বহু দূরে। আজ যে কাছে সে কাছে থেকেও মনে হয় অনেক দূরে। তবুও সময় কাটে ওর সাথে। এটাও তো বড় পাওয়া। ভাবি, কোন দমকা হাওয়ায় এই সেঁকো যেন ছিড়ে না যায়।
কি ভাবছ?
ভাবছিলাম আমার অতীত। তুমি তো বলেছিলে, ভবিষ্যৎ ভেবোনা, তুমি ওটা জাননা, বর্তমান আমার পথের পাথেয়। তাই অতীত আর বর্তমানের মধ্যে যোগ সুত্র বাধতে চাইছিলাম।
“ মাঝে মাঝে তোমার কথার মাথা মুণ্ডু খুজে পাইনা। এইযে এসে গেছি আমাদের ভিলাতে। আচ্ছা সত্যি করে বলতো কি ভাবছিলে?”
“ বললাম তো, অতীত”।
“ অতীত কে টেনে এনো না, তাতে শুধু দুঃখই পাবে। বর্তমানকে আঁকড়িয়ে ধরো”।
“ আচ্ছা, জানো মাঝে মাঝে তুমি দার্শনিকদের মতো কথা বলও”।
“ ঠেকে শিখেছি। এখন বলও কাল গাড়ী আসবে কখন”?
“আটটায়। তবে সাতটায় আমরা নিচে নামব নাস্তা করতে। তোমাকে কি ঘুম থেকে উঠাতে হবে”?
“না, তুমি নামার আগে আমাকে কল করো”।
দুজনে এসে দাঁড়ালাম যার যার ঘরের সামনে।
শুভরাত্রি, বলে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
সকাল সাতটা। এসে বসলাম ব্রেকফাস্ট রুমে। সতীর পরনে নীল কামিজ, সাদা সালওয়ার, মাথার উপর আলতো করে টানা নীল ওড়না। মনে হোল সাজতে যেয়ে জানালা দিয়ে বাহিরের আকাশ টা দেখেছিল সে। আকাশে নীলের ছড়াছড়ি।
অপূর্ব লাগছিল দেখতে ওকে। বললাম,” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে”?
সলজ্জ নয়নে তাকাল সে আমার দিকে।
লোকজনের আনা গোনা ততটা নয়। বিভিন্ন জাগায় বিভিন্ন রকমের খাবার। এক জাগায় বাবুর্চি মাথায় কাগজের টুপি, গায়ে আপ্রন পড়ে ডিম ভাজছে। অন্য খানে একজন পরাটা আর ফ্রেঞ্চ টোস্ট করতে ব্যস্ত।
দুটা পরাটা সাথে দুটা ডিম পোঁচ আর একটা ডেনিস নিয়ে এলাম। কফি আমার চাই খাবারের সাথে। সতী ঘুরে ঘুরে দেখছিল কোথায় কি কি আছে। অবশেষে সে নিয়ে এলো দুটা পাউরুটি টোস্ট আর একটা অমলেট। এক প্লেট ভরা ফলমূল। আমাকে ফলের প্লেট টা এগিয়ে দিয়ে বলল,” এটা তোমার জন্য”।
অনেকের প্লেটে ভাত, নুডুলশ, সাথে ডিম পরাটা। পিরামিড করে সাজান।
সতীকে দেখিয়ে বললাম, “ এত সকালে এত সব খাবে কি ভাবে”?
“ সবাই কি তোমার মতো? ওরা খাওয়ার জন্য বাচে”। বলে উঠে গেলো ফল আনতে।
বাহিরে এসে যখন দাঁড়ালাম তখন আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। সতীকে বললাম,” তুমি দাড়াও এই ফুল আর ফোয়ারার পাশে, হলিডে ভিলা লেখাটা নিয়ে ধরে রাখি তোমার স্মৃতি আমার এই ক্যামেরার মাঝে”।
ও বলল,” শুধু আমার কেন, আমাদের দুজনের স্মৃতি ধরা থাক এর ভিতর। ঐ লোক টাকে বলও ছবিটা উঠাতে”।
বলল ,”স্যার, আমরা প্রথমে যাবো স্ক্যাইক্যাব দেখতে, তারপর কালো বালির বীচে, ক্রকডাইল ফীডিং, শেষে বোট বিহারে”।
গাড়ী চলছে একেবেকে। কখনো পাহাড়ের পাশ দিয়ে, কখনো সমুদ্রের থেকে বেড়িয়ে আসা নদীর কিনারায় বাঁধা বোট গুলোকে বায়ে রেখে। সতী তাকিয়ে ছিল জানালা দিয়ে। সূর্যের আলো পরা ওড়না থেকে নীলাভ রঙ ছড়িয়ে দিলো ওর মুখমণ্ডলে। চিক চিক করছিল ওর পাথর কুচিতে গাঁথা কানফুল টা। মনে হচ্ছে আগুনের রশ্মি ছিটকে পড়ছে ওর কানফুল থেকে। আমি ক্যামেরা বের করলাম, সূর্যের তাপে ভেজা মুখটা ভেসে উঠল ক্যামেরার লেন্সএ। ক্লীক। গেঁথে গেলো অপূর্ব মুখমণ্ডলটা মেমোরি কার্ডের মাঝে।
গাড়ী এসে দাঁড়াল Machincang Mountain এর পাদদেশে। এখান থেকে আমরা যাবো ক্যাবেল কারে করে। Base Station থেকে Middle Station তারপর সেখান থেকে Top Stationএ। Langkawi Cable Car কে বলে SkyCab.
এটার অবস্থান Langkawi Island এর সাউথওয়েস্ট কোস্টে।
সেলিম বলল,” আপনাদের দের ঘণ্টা লাগবে দেখে ফিরে আসতে। আমি পিছনের পারকীং লটে থাকবো। নেমে এসে ফোন করেন”। আমাদের টিকিট কাঁটা ছিল। উঠে বসলাম। চার জনের বসার জায়গা। আমাদের সাথে একটা অল্প বয়স্ক যুগল। হতে পারে স্বামী স্ত্রী। হতে পারে প্রেমিক প্রেমিকা। ঢলে পড়ছে হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে। মনে করিয়ে দিলো পিছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। আমরা করেছি, এরা করছে, ওরাও করবে। এত চিরন্তন সত্য।
Base Station থেকে Middle Station এর দূরত্ব পাঁচ হাজার পাঁচশ ফিটের কিছু বেশি। আমরা যাচ্ছি ২০০০ ফুট উপর দিয়ে। নিচে বিভিন্ন রঙের বন্য ফুল। পাশে উঠে গেছে পাহাড়। এ শুধু দেখে উপলব্ধি করা যায়, বলে বোঝানো যায়না। সতী তাকিয়ে ছিল বাহিরের দিকে। অপর দিক থেকে ফিরে আসা একটা কেবেল কার থেকে একজন আমাদেরকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালো।
সতী হঠাৎ বলে উঠল,” দেখো, দেখো শমিত দা, পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনা পড়ছে। নিচে তাকাও তোমার মাথা ঘুরে যাবে”। ওর উচ্ছলতা আমার মনে এনে দিলো এক পরিতৃপ্তের ছোঁয়া।
আবারও আমি ফিরে গেলাম পিছনে। Alberta, Canada, ফিরছিলাম Glacier Mountain দেখে। সতীর মতো সে ও সেদিন বলে উঠেছিল,” দেখো, পাহাড় ভেঙ্গে ঝরনা বইছে। এই মন ভোলানো দৃশ্য কি আর আমি কোনদিন দেখতে পারবো তোমার সাথে”?
সে দেখাই ছিল শেষ দেখা।
“সতী, তাকাও আমার দিকে, পিছনের উচু পাহাড়টা নিয়ে তোমার ফটো উঠাবো”। ও তাকালও। ওর চোখে প্রাদা সানগ্লাসটা খুব সুন্দর মানিয়ে ছিল। বলল,” দেখি শমিত দা, কেমন উঠেছে”।
সামনের ছেলেটা বলল,” তোমার ক্যামেরাটা দাও, তোমাদের দুজনের ছবি উঠিয়ে দেই। আরও একটু closely বস, তা না হলে পিছনের রক পাহাড়টা আসছেনা”। আমি তাকালাম সতীর দিকে। সতী হেসে বলল,” সব জেন্ডার প্রবলেম”।
আমাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হোল Viewing Platformএ। সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছি Main island, আর সেই সাথে আসে পাশের Island গুলোর panoramic দৃশ্য। কাছের থেকে দেখা বন্য ফুল। মন কেড়ে নেয়।
এবার আমরা এলাম Top Stationএ। সেখান থেকে একটু হেটেই ২৩০০ ফিটের উপরে Machincang Mountainএর চুড়ায়,Sky bridgeএ। এটা হচ্ছে The Longest Free Span and Curved Bridge In The World। ৪১০ ফুট লম্বা এই ব্রিজ।
সোজা ব্রিজের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে এর অপর প্রান্ত দেখা যায় না। সোজা ব্রিজে দেখার মাঝে যেমন একটা এক ঘেয়েমী এটাতে তা নেই। শেষ প্রান্তের দৃশ্যটা জানা নেই কি দেখবো সেখানে যেয়ে।
আমি একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। পাশ ফিরে সতীকে না দেখে পিছনে তাকালাম। সতী আস্তে আস্তে হেটে আসছে একটা যুগলের সাথে। ওদের হাতে স্ট্রলার। একটা বাচ্চা বসা। কাছে আসতেই পরিচয় করিয়ে দিল, বিক্রম আর দ্রীবনী। দিল্লীতে থাকে। এসেছে তিনদিন হোল, এখান থেকে যাবে সিঙ্গাপুর। আমি আর বিক্রম কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম। বিক্রম ইঞ্জীনিয়ার। আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো কি ভাবে এই সাসপেন্ডেড ব্রিজ বানানো হয়েছে। আমার মাথায় কিছুই ঢুকলও না। ও কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল সামনে। যেখানে নীল আকাশ মিলেছে পাহাড়ের চুড়ায়। পিছনে ফিরে দেখি দ্রীবনী সতীকে কি যেন বলছে। সতীর চোখ ছলছল করছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
অবশেষে বিদায়ের পালা। বিক্রম বলল,” এই আমার ঠিকানা, কোন সময় দিল্লীতে এলে আমাকে কল করতে ভুলবেন না”।
অপুরুপ,মনোমুগ্ধকর, দৃশ্য দেখা শেষে নিচে নেমে এলাম। সতী বলল,” জানো দ্রীবনী কি বলছিল? ঐ ছোট্ট ছেলে টা—“
“ থাক সতী আমি শুনতে চাইনা। হৃদয় বিদারক ঘটনা আর নাই বা শুনলাম”।
“ তবে থাক, চলো ঐ ছায়ার নিচে বসি। তোমার ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করো। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে”।
বাহিরে তাপমাত্রা নব্বুই ডিগ্রী ফারেনহাইট। এখানে গ্রীষ্ম, শীত, বসন্ত বলে কোন ঋতু নেই। তাপমাত্রা সব সময় আশি, নব্বুই এর কোঠায়। সতী বলল,“ আমি একটু রেস্ট রুম থেকে হাতে, মুখে পানি দিয়ে আসি। তুমিও যাবে কি”?
বললাম,” না, তুমি যাও, আমি সেলিম কে কল করে গাড়ী আনতে বলি”।
সেলিম ফোন ধরল না। হয়তো ব্যস্ত কোন কারনে। অগত্যা আমাদেরকে যেতে হবে পারকীং লটে। সতী ফিরে এলো, হাতে দুটো ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে। বলল,” এই ঠাণ্ডা পানিটা খাও, তোমাকে আমি একেবারেই পানি খেতে দেখিনি”।
“ঠিক আছে। এখন চলো, সেলিম কে খুজতে হবে, ও ফোন ধরছে না”, বলে একটু এগোতেই দেখলাম সেলিম হেটে আসছে।
কাছে আসে বলল,” আমরা এখন যাবো কালো বালির বীচ দেখতে। আধা ঘণ্টার উপর লেগে যাবে। ওখানে যেয়ে লাঞ্চ করবো”।
ভোর চার টায় এসে পৌছালাম কুয়ালা লাম্পুর এয়ারপোর্টে। এত ভোরে লোক জনের আনাগোনা নেই বললেই চলে।
দুই একটা দোকান খোলা। সতী পুরো জার্নিতে ঘুমিয়ে এসেছিল। ফলে কিছুটা ফ্রেশ হয়েই সে নামলো। তবুও চেহারায় কিছুটা মলিনতার ছাপ।
আমরা ট্রানজিট যাত্রী। এর পরের প্লেন পাঁচ ঘণ্টা পর। আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। যাবো Langkawi. মাত্র এক ঘণ্টা লাগবে যেতে। ইমিগ্রেশন শেষে গেটের কাছে এলাম। বসার জাগায় শুধু আমরা দুজন। সতী কে বললাম,” সতী, তুমি তোমার ব্যাগটা মাথায় দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়। অনেকক্ষণ থাকতে হবে এখানে। আমি একটু ঘুরে দেখে আসি কোথাও নাস্তা পাওয়া যায় কিনা”।
“ যাও, তবে তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি তো সারা রাত ঘুমাও নি। একটু শুয়ে নিলে পারতে”?
এখন নয়। একেবারে হোটেলে যেয়ে ঘূমাবো।
ভালো লাগলো এই ভেবে যে সতীর স্বাভাবিক আচরণ ফিরে এসেছে। ও শুধু হাসলও। ও জানে হোটেলে যেয়ে ঘুমানোর বান্ধা আমি নই।
একটা ফাস্ট ফুডের দোকান খোলা। ম্যাকডনালের আকারে সাজানো। তবে স্যান্ডউইচের আকার অনেক ছোট। করণীয় কিছু নেই। অন্যান্য দোকান গুলো খুলতে অনেক দেরী । সতী ও আমি দুজনেই রাতে কিছু খাইনি। এই মুহূর্তে পেটে কিছু দেওয়া দরকার। শুধু তাই নয়, সতী ঔষধ খেতে পারবেনা কিছু না খাওয়া পর্যন্ত। অগত্যা দুটো স্যান্ডউইচ, সাথে এক কাপ কফি আর একটা চা (সতী চা ছাড়া কিছু খায়না) নিয়ে এলাম।
খাওয়া শেষে সতী উঠে গেলো রেস্ট রুমে। যাবার আগে বলল,” আমি একটু রুপচর্চা করে আসি। চেহারার যা শ্রী হয়েছে?
ও চলে গেলো। আমি বসে সুটকেস গুলো পাহারা দিতে লাগলাম। এর মধ্যে বেশ কিছু লোক এসে গেছে। সময়ও পেরিয়ে গেছে। সতী এলো। হাল্কা করে প্রলেপ লাগানো মুখে। সকালের কমল কুসুম আলোয় ওকে সুন্দর লাগছিল।
জিজ্ঞাসা করলাম,” কি বলও, বৌদির কথা শুনে ভুল করেছ বলে মনে হয়”?
“না, ভুল করিনি”।
যথা সময় প্লেনে এসে বসলাম। একঘণ্টা দশ মিনিটের পথ। সেই তুলনায় প্লেন টি বড়ই বলতে হবে। দুই তিন দুই এই সমন্বয়ে সীট ভাগ করা। আবারও জানালার পাশের দুটো সীট আমাদের জন্য বরাদ্দ। অবশ্য চেয়ে নিয়েছি। আগেই বলেছি সতীর পছন্দ জানালার পাশে বসা।
সকাল সাড়ে দশটায় এসে পৌছালাম Langkawi এয়ারপোর্টে। প্লেনে আরোহী খুব একটা বেশি না থাকাতে লাগেজ পেতে দেড়ি হলনা। বাহিরে বেড়িয়ে দেখলাম শুভঙ্করের নাম কাগজে লিখে একজন দাড়িয়ে। যেহেতু সেই সবকিছু ঠিক করেছিল।
হাত উঁচু করতেই ভদ্রলোক এগিয়ে এলো । চারিদিকে সে একবার তাকাল।
বললাম,” অন্য দুজন আসতে পারেনি”। একটু হেসে বলল,” আমার নাম রাম। এই মুহূর্তে আমি আপনাদের গাইড। আসুন”। এই বলে সে সুটকেস দুটো টেনে নিয়ে গেলো তার গাড়ীতে।
বললাম, “ মিস্টার রাম আমার সিম কার্ড লাগবে, কোথায় পাবো’?
কোন অসুবিধা নেই আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি “। এই কথা বলে পাশে সিম কার্ডের দোকানে নিয়ে গেলো। পকেট থেকে টাকা বের করতে যেয়ে টাকা গুলো পেলাম না। মনে আছে দুশ ডলার ভাঙিয়ে ছিলাম এয়ারপোর্টে। অস্থির হয়ে এ পকেট ও পকেটে বার বার হাত দিতেই সতী ডাকল আমাকে।
“শমিত দা, টাকা তুমি প্যান্টের পকেটে রাখুনী, রেখেছ জ্যাকেটের পকেটে। আর সেই জ্যাকেট আমার কাছে। এই নাও”। বলে টাকা গুলো বের করে দিলো।
বললাম,” দেখতও, তুমি না থাকলে কি অবস্থা হতো। হন্নে হয়ে খুজতাম। আর চুল ছিঁড়তাম”।
“জানি, তোমার ধৈর্য একটু কম”।
সতী সব কিছুতেই কাম এন্ড কুল। কোন কিছুতেই বিচলিত হয়না। এ একটা মস্ত বড় গুন ওর।
“ এদেশেই আমার জন্ম স্যার”। বলে আবারও বলল,” আমার বাবা কেরালা থেকে এসে ছিলেন এই দেশে অনেক আগে। আর ফিরে যায়নি। এদেশের পপুলেশনে ইন্ডীয়ানদের পারসেন্টেজ অনেক, স্যার”। বলে গর্বিত ভাবে আমার দিকে তাকাল।
রাস্তার চারিদিকে সারি সারি নারকেল গাছ। ছোট ছোট বাড়ী। মনে করিয়ে দিল বাংলাদেশের ফেলে আসা যশোর শহরের কথা, ফেলে আসা কোটচাদপুরের কথা। আম, কাঁঠাল, নারকেল গাছের সারি। কিছুক্ষণের জন্য অন্নমস্কক হয়ে গিয়ে ছিলাম।
সতীর ডাকে ফিরে এলাম। “ এসে গেছি”। বলে হাতের ব্যাগ টা কাধে ঝুলিয়ে নিলো।
গাড়ী আসে থামল হলিডে ভিলার সামনে। সুন্দর ছিমছাম হোটেল। সামনে বিভিন্ন রঙে সাজানো বাগান। পাশে পানির ফোয়ারা। আমার ভালো লাগলো, সতীর ও। ও বলল,” কি সুন্দর তাই না শমিত দা”। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে। চোখে রৌদ ঠেকানো প্রাদা চশমা। আমার দিকে তাকাতেই পকেট থেকে কাগজের নেপকিণটা এগিয়ে দিলাম।
“ মুছে নাও কপালের ঘামটা”।
“ কি করে বুঝলে?”
“অনেক দিন ধরে চলছি তোমার সাথে, এটুকু বুঝব না”?
ও হাসল।
রাম গাড়ী থেকে নামিয়ে দিলো সুটকেস গুলো। বলল,” স্যার, আজকে রেস্ট নিন, কাল আমাদের গাড়ী আসবে ভোর আটটায়। আপনাদের কে সব ইম্পরটেন্ট জাগা গুলো ঘুরে ঘুরে দেখাবে”।
জিজ্ঞাসা করলাম,” তুমি আসবে না”?
“ আমি যদি না আসতে পারি, এমন একজন কে পাঠাবো আপনাদের তাঁকে পছন্দ হবে”। বলে সালাম দিয়ে গাড়ী স্টার্ট দিলো।
কাউন্টারে এসে দাঁড়ালাম। দুইজন মহিলা কাজ করছে, দুইজনই ব্যাস্ত। সতী পাসপোর্ট দুটি আমার হাতে এগিয়ে দিলো।
বললাম,” ঐ চেয়ারটাতে বসো। দরকার পড়লে তোমাকে ডাক দেবো”।
এই মুহূর্তে মনে হোল ওর ভালো মন্দ সবকিছু দেখার ভার আমার। এই বিদেশ বিভুয়ে আমিই ওর একমাত্র বন্ধু। সে সবকিছু আমার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। এই মহান দ্বায়িত্ব আমার উপর দিয়েই বৌদি ওকে পাঠিয়েছে আমার সাথে। আমাকে পালন করতে হবে সেই দ্বায়িত্ব।
Can I help you?
ভদ্রমহিলা ডাকছে আমাকে। এগিয়ে গেলাম। পাসপোর্ট আর রিজার্ভেশনের কাগজ গুলো সে হাতে নিলো। আবারও চারিদিকে চাইল সে। বললাম চারজনের পরিবর্তে দুজন এসেছি। দেখতে চাইল অন্য জন কে।
সতীকে আসতে বললাম কাউন্টারে।
“Do you need two rooms?” বলে তাকাল আমার দিকে।
বুঝলাম এই সমস্যা আমাকে ফেস করতে হবে সবখানে। কারন আপাতদৃশটিতে এই ধরনের সম্পর্ক চিন্তা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বললাম,” Yes, two rooms side by side if possible”.
সতী আস্তে আস্তে আমার কানে কানে বলল,” এ সবই জেন্ডারের প্রবলেম”।
দুটা রুম পাওয়া গেলো পাশাপাশি। ভদ্রমহিলা তার হাসি বজায় রেখে বলল, এক ঘণ্টা পরে এসো। রুমগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে।
“চলো, লাঞ্চ টা সেরে নেই”। বলে দুজন যেয়ে বসলাম হোটেলের ডাইং রুমে। সতী কে বললাম, তুমি পছন্দ মতো অর্ডার দেও। সে মালয়েশিয়ান ডিস আনতে বলল। আমরা বসে বসে কথা বলছিলাম। ডাইং রুমের চারিদিক খোলা। হয়ত বাহিরের
সৌন্দর্য দেখানো টাই মুল উদ্দেশ। অপূর্ব। চারিদিকে বিভিন্ন ফুলের সমারহ। একটু দূরেই সুইমিং পুল। আর একটু দূরে দেখতে পাচ্ছি হোটেলের প্রাইভেট বীচ। ঠিক করলাম বিকেলে হাটতে যাবো বীচের পাড়ে। আজ রীলেক্সের দিন।
একজন আসে খবর দিলো ঘর তৈরী। সতীকে বললাম,” বিশ্রাম নাও। বিকেল পাঁচটায় বের হবো”। ও চলে গেলো ওর, আমি এলাম আমার ঘরে।
সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। ছোট্ট বেল্কনী আছে। সেখান থেকে সুইমিং পুলটা দেখা যায়। অনেক ছোট বড় ছেলে মেয়েরা সাঁতার কাটছে, ডুব দিচ্ছে। কেউ বা রৌদ পৌহাচ্ছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে দেখলাম। তারপর বিছানায় এলিয়ে দিলাম ক্লান্ত শরীর টা।
“ এক মিনিট সময় দাও” বলে চোখে মুখে পানি দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
বিকেলের ঝিরঝিরে বাতাস সকালের রৌদ্রের তাপটাকে কমিয়ে দিয়েছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি দুজনে। একদিকে অনেক উচু পাহাড়। সবুজের সমারোহ। আর এক দিকে বিভিন্ন ধরনের দোকান পাট, বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্ট।
বললাম,”সতী, কোন ধরনের খাবার রাতে খাবে ঠিক করে নেও। আর বীচে হাটতে গেলে বীচ স্যান্ডেল লাগবে, চলো, ঐ দোকান থেকে কিনে নেই”।
“চলো” বলে দুজনে এসে ঢুকলাম দোকানে। আমি নিলাম একটা ফ্লীপ-ফ্ললপ। সতী অনেক খুজে পারপেল রঙ এর একটা স্যান্ডেল পেলো। ওটার রঙ এর সাথে ওর পরনের আউট ফিটের রঙ মিলে গেলো।
বললাম,” নতুন স্যান্ডেল টা পড়ে নাও। আমরা বীচের দিকে যাব”।
আমিও ফ্লীপ-ফ্ললপ টা পায়ে দিয়ে নিলাম।
পরিষ্কার সচ্ছল পানি। কোন দিকে অপরিচ্ছন্নের বিন্দু মাত্র চিহ্ন নাই। কিছু লোক শুয়ে আছে বীচ বেঞ্চে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। দূরে স্পীড বোটে বাঁধা উরন্ত রঙ্গিন বালুনের মাঝে মানুষ উড়ছে। সতী আস্তে আস্তে গোড়ালি ভেজা পানিতে যেয়ে দাঁড়াল। ঢেউ আছড়ে এসে পড়ল ওর পায়ে।
বললাম ,”তাকাও, ছবি উঠাচ্ছি”।
ও তাকালও। হাসির রেখা ওর ঠোঁটে।
সূর্য ঢলে পড়লো সমুদ্রের শেষ প্রান্তে। আমরা এসে বসলাম বীচ বেঞ্চে।
সতী বলতে থাকলো তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। আমি শুনতে শুনতে তাকিয়ে রইলাম, যেখানে আকাশ মিশেছে সমুদ্রের জলে।
ষোলই পৌষ, পয়লা জানুয়ারী। বাহিরে শীতের প্রকোপ ততটা নয়। সকালে সতীর দেওয়া সাদা সাল টা গায়ে দিয়ে বেল্কনীতে এসে বসলাম। হাতে কফির পেয়ালা। আকাশে পেজা পেজা নীল মেঘ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে । নরম সূর্যের আলো এসে পড়েছে আমার বেল্কনীতে। সামনের ছোট্ট বাগানে দুটো শালিক কোথা থেকে এলো জানিনা। দেখছিলাম শালিক দুটোকে। একে অপর কে মাঝে মাঝে ঠোকর দিচ্ছে আবার দূরে সড়ে যাচ্ছে। হয়তো এটাই ওদের ভালবাসা জানানোর প্রকাশ। আরও কিছুক্ষণ হয়তো ওদের নিয়ে ভাবতাম। কিন্তু হলনা।
দরজায় দুমদাম শব্দ। একমাত্র শুভঙ্করই জানায় এইভাবে তার আগমন বার্তা। দরজা খুলতেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল। কোন কিছু না বলে সোজা চলে গেলো আমার রান্না ঘরে। আমি শুধু চেয়ে রইলাম ওর দিকে। কফি মেশিনে তার পছন্দ ফ্লেভারের K-cupটা বসিয়ে আমার দিকে তাকাল।
“ কিরে? এত সকালে তুই কি কারনে? আর এত দুমদাম শব্দই বা করছিস কেন?” জানি একথা ওকে বলে কোন লাভ নেই।
ঠিক যা ভেবেছিলাম। এইসব কথা ওর কান দিয়ে ঢুকালো না। ও ভাবে এটা ওর বাসা। ওর অধিকার আছে যখন তখন আসার। সত্যি বলতে কি আমার বাসার এক গোছা চাবি ওর কাছে থাকে। ছোট বেলা থেকে দুজন এক সাথে বড় হয়েছি। হাসি কান্না ভরা দিন গুলো পাড় করেছি। কাজেই আমার এই ছোট্ট এপার্টমেন্টের উপর ওর যে অধিকার তা আমি কেড়ে নেইনি। ওর উচ্ছ্বাস, ওর হাসি আমাকে আনন্দ দেয়।
“কি ভেবে এত সকালে?” আবারও আমার জিজ্ঞাসা।
“ খুব ভালো একটা ডিল দিয়েছে মালয়েশিয়া যাওয়ার। দশ দিনের মধ্যে রওয়ানা দেবো। তোর পাসপোর্ট টা দে টিকেট কাটতে হবে। আর সতী কে খবর দে। ওকেও যেতে হবে আমাদের সাথে। তোর কোন প্রশ্ন থাকলে আমাকে নয় তোর বৌদিকে কল কর”। এত গুলো কথা বলে সে আমার দিকে তাকাল।
“ ধীরে বন্ধু, ধীরে। আমার যে সময় আছে তোকে কে বললে। আর সতী ই যে যাবে তার গ্যারান্টি তোঁ আমি দিতে পারব না”। জানি একথা ধপে টিকবে না। আমি রিটায়ার্ড। অফুরন্ত সময় আমার হাতে। সে সেই কথা জানে। আমারও যে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তা নয়। অনেক দিন ধরে গুমট অন্ধকারে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটু আলো বাতাস দরকার। কবে যে শেষ বেড়াতে বেড়িয়েছিলাম আজ তা মনে পড়ে না।
সতী আমার বান্ধবী। আমার সাথে সতীর সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্তের। একে অপরের সান্নিধ্য উপভোগ করি সেই সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলি। কথার ছলে ঠাট্টা, আবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সময় কেটে যায় আমাদের।
শুভঙ্কর বলে উঠলো,” কি ভাবছিস?”
“ না, কিছু না। তুই আমার পাসপোর্ট নিয়ে যা। আর আমি সতীর সাথে কথা বলে দেখি।“
“ গুড বয়,” এই কথা বলে সে কফির শেষ অংশ টা গলায় ঢেলে দিলো। পাসপোর্ট টা হাতে পেয়েই যে ভাবে ঝরের মতো এসে ছিল সেই ভাবেই বেড়িয়ে গেলো।
শুভঙ্করের বাসায় আড্ডাটা ভালোই জমেছিল। বৌদির হাতের রান্নার কোন তুলনা নেই। মাঝে মাঝে তার ছিটে ফোঁটা আমার বাসাতেও আসে। সতীর মুখে চোখে আনন্দের ধারা বইছে। কলকল করে বলে উঠল,” জানো বৌদি I am so excited. শোন তুমি আর আমি কিন্তু এক রুমে থাকব। ওরা দুজন অন্য ঘরে”।
শুভঙ্কর শুনে চিৎকার করে উঠল,” সে কি, আমি আমার বৌ কে নিয়ে থাকতে পারবো না বিদেশ বিভুয়ে। আমার যে অনেক দিনের সাধ বিদেশ বিভুয়ে এক সাথে এক রুমে থাকা ”।
“না,” হাসতে হাসতে সতী বলল। “ অনেক থেকেছ, ছয়টা দিন না থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হবেনা”। বলে বৌদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,” কি বলও,বৌদি”?
সাতদিন পরে আমরা রওয়ানা দেবো। প্রথমে Langkawi. সেখানে তিন রাত। তারপর কুয়ালা লাম্পুর। দিন গুনছি। অনেকদিন পর বাহিরে যাবো বলেই হয়তো এক অজানা শিহরন সাড়া মনে।
দিন গুলো পেরিয়ে চার দিনে এসে দাড়িয়েছে। সকাল আটটা। ফোনটা বেজে উঠল। শুভঙ্করের। গলারা স্বরে আতংক।
শুভঙ্কর বলল, “ একশ চার জ্বর। সেই সাথে বমী। রাত থেকে। এক বন্ধু ডাক্তার দেখে গেছে। ঔষধ পড়াতে এখন বমী বন্ধ হয়েছে। তোর বৌদি তোকে আসতে বলেছে। কথা আছে।“
“কি কথা?”
“সেই বলবে, তুই বোস।“ বলে শুভঙ্কর বেড়িয়ে গেলো।
বৌদি ডাকল ওর পাশে বসার জন্য।
আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল “ শমিত দা, আমার মালয়েশিয়ায় যাওয়া হবেনা। এই শরীর নিয়ে যেতে পারবো না। তুমি আর সতী ঘুরে এসো”।
এই কথা শোনার জন্য তৈরী ছিলাম না। বললাম “ না, বৌদি। তা হয়না। তুমি তো বোঝো কেন আমি না করছি। আর তাছাড়া সতীই বা রাজি হবে কেন?” বৌদি কে বোঝাবার চেষ্টা করলাম।
সে বলল,” তুমি সতী কে আসতে বলও। আমি ওর সাথে কথা বলব। আর তোমরা একে অপর কে চেনও। জানো, বন্ধুত্ত দিয়ে গড়া তোমাদের সম্পর্ক। তোমাদের মধ্যে যে পবিত্রতা আমি দেখেছি তাতে কে কি বলল তা নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন”।
আমি আর কথা বাড়াই নি। সতী কে আসতে বললাম।
সতী এলো। আমি উঠে অন্য ঘরে চলে গেলাম।
কিছুক্ষণ পড়ে আমার ডাক পড়ল। বৌদির মাথার কাছে সতী বসা। বৌদি বলল,”সতী রাজি আছে। তুমি বাবস্থা কর যাওয়ার”।
আমি চাইলাম সতীর দিকে।
২
রাত সাড়ে এগার টায় ফ্লাইট। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে। আমরা দুজন। এই ভ্রমনের সবকিছু যারা ঠিক করেছিল আজ তাঁরাই রয়ে গেলো পিছনে। বিধাতার কি খেলা। সতীর মুখ দেখে মনে হোল এই যাত্রা না হলেই বোধহয় ভালোছিল।
কথার মাঝে মাঝে অন্যমনস্কতা । বললাম,” যদি comfort ই feel না করো তবে রাজি হলে কেন”?
বলল,” বৌদি বলেছিল “আমি তোমার বড় বোন। আমি যদি মনে করতাম শমিতের সাথে তোমার একলা যাওয়া উচিত নয় তবে তোমাকে আমি যেতে বলতাম না। আমি চাই তোমরা ঘুরে আসো”।” এই বলে সতী তাকাল আমার দিকে।
“ তাহলে তোঁ সব ল্যাটা চুকে গেছে। এবার ইনজয় করার চেষ্টা কর”। বলে আমি ঊঠে গেলাম ফ্লাইট বোর্ডে গেট নম্বার দিয়েছে কিনা দেখার জন্য।
“কেন, তোমার লাগবে না”? বলে সে সীট বেল্ট টা বেধে নিলো।
“না, যার নরম বিছানায় ঘুম আসেনা সে এই হেলান দেওয়া চেয়ারে ঘুমাবে কি ভাবে? তার চেয়ে একজনের ঘুমটা যেন সম্পূর্ণ হয় তাই কি ভালো না?” বলে বালিশ টা এগিয়ে দিলাম।
আব্বু, বলে দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমার ছেলে মেয়ে। সানী আর ছায়া। পাশে এসে দাঁড়াল বউমা আর রোকন। আসতে দেরী হোল যে?” একসাথে কলকলিয়ে উঠল ওরা।
“ এখন Christmas dayর মেলা চারিদিকে, রাস্তায় ভিড়। দেরীতো হবেই”। বলে ওদেরকে আশ্বস্ত করলাম।
সানীর জন্মদিন। চলে গেছে বেশ কিছুদিন আগে। আমরা সেলিবারেট করছি আজ। সুন্দর Sea Food store, Astoria তে। পছন্দ করেছে বৌমা।
রেস্টুরেন্ট টার বৈশিষ্ট হচ্ছে প্রথমে বিভিন্ন কাঁচা মাছ থেকে পছন্দ করে দিতে হবে কোন মাছ টা খেতে চাও তারপর সেই মাছ রান্না করে সামনে আসবে বিভিন্ন ভাবে ডেকোরেশন করে। সত্যিই এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
ছবি উঠল। রেস্টুরেন্ট এর মালিক আধো অন্ধকারে Happy Birthday বলতে বলতে নিয়ে এলো কেক। ছায়া নিয়ে এসেছিল টা। উপস্থিত সবাই একিই স্বরে গেয়ে উঠল “ Happy Birthday to you”. হৃদয় স্পর্শ করা মুহূর্ত।
হৈ হৈ করে কাটিয়ে দিলাম সন্ধ্যা টা।
সব কিছুরই শেষ আছে। আনন্দ মুখর সন্ধ্যার পর আসে বিষণ্ণতা। তারপর বাসায় ফেরার পালা। গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। কয়েক ঘণ্টার আনন্দটা মুছে যেতে দিলাম না তাড়াতাড়ি। অবশেষে গাড়ীটা বের করলাম। পিছনের গাড়ীর হর্ন শুনে বুঝলাম একটু অন্য মসস্ক হয়ে পড়েছিলাম। গাড়ীটা ডানে চলে গেছে বেশ কিছু খানি। উচিৎ নয়।
আমি বুঝি। হয়ত একদিন দ্রুত ছুটে আসা কোন গাড়ী চুরমার করে দেবে আমার গাড়ীটা। রক্তাত দেহটা টেনে হেঁচড়ে বের করবে ঐ দুমড়ে যাওয়া গাড়ীটার থেকে। না ওসব চিন্তা থাক।
পরদিন। বৃস্টি ভেঝা সকাল। বাহিরে অঝরে ঝরছে। গতকালের হাসি, আজ কান্নায় রূপান্তরিত হয়ছে। সেই সাথে আমার
মনটা। গত রাতে দুচোখের পাতা শুধু চেয়েই রইল। বন্ধ হলনা। এগার বারো,—– চার, পাঁচ ছয়। ভোর হোল। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। ঘরের চারিদিকে কোন কিছুর দিকে তাকালেই বিরক্ত লাগছে। ছোট বোনটা ফোন করল। হ্যালো বলতে ইচ্ছে করলো না। বিক্ষিপ্ত মন। কেন? জানিনা।
পাউরুটি দুটো টোস্টার ওভেনে দিয়ে কফির পানি টা বসিয়ে দিলাম। ড্রয়াইং রুমটা আগছাল। সাধারণত এ রকম থাকেনা। আজ ঘুচাতে ইচ্ছে করলো না। টাকা পয়সা গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টেবিলের পরে। সেভ করতে যেয়ে কেটে গেলো গালের পাশটা। রক্তের ক্ষীণ রেখা গড়িয়ে আসছে চোয়ালের দিকে। হাতের কাছে কিছু নেই। চেপে ধরলাম টিসু পেপার টা দিয়ে। লাল হয়ে গেলো পেপার টা। বাণ্ডেড টা খুঁজতে যেয়ে পড়ে গেলো পুরো বাক্সটা। ছড়িয়ে পড়ল ঔষধের বোতল গুলো। খুলে গেলো কয়েকটার মুখ। কিছু ট্যাবলেট একশো মিটার দৌড়ের প্রতিযোগিতায় মেনে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল বিভিন্ন দিকে। আমি দাড়িয়ে রইলেম ওদের মাঝে। বাণ্ডেড টা নেই। মনটা আরও তিরিক্ষি হয়ে গেলো। পা দিয়ে সরিয়ে রেখে তাকালাম আয়নার দিকে। নিজের চেহারা আমি নিজেই চিনতে পারলাম না। এত মলিনতা এত বিষণ্ণতা কেন ?
গালের ধারের রক্তের রেখা তখনও থামেনি। তবে গতিবেগ কম। এমন এবড়ো থেবড়ো মুখে একটা চামড়ার অংশ হয়তো উঁচু হয়েছিল, বিক্ষিপ্ত মন সেটার সন্ধান পায়নি, রেজারের ব্লেড ওটাকে সমতল করে দিয়েছে। আর তাই এই ভুগান্তি।
পোড়া পোড়া গন্ধ এলো রান্নাঘর থেকে। মনে পড়ল পাউরুটি টা টোস্ট করতে দিয়ে ছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম সে কথা। মনের সাথে পেটের সম্পর্ক। এতো আজ নতুন নয়। অনন্তকাল ধরে চলে আসছে এই সম্পর্ক। আজ এই মনের বিষণ্ণতা ভুলিয়ে দিয়েছে আমি ক্ষুধার্ত। ফিরে এলাম রান্না ঘরে। টোস্ট টা একটু বেশিই পুড়ে গেছে। মন চাইল না খেতে। শুধু কফির পেয়ালা টা নিয়ে এসে বসলাম সোফাতে।
কেন এই বিষণ্ণতা। আমি নিজেও জানিনা। আছে আমার সুন্দর দুটো ছেলে মেয়ে। আছে তাদের হৃদয় কারা বউ, স্বামী। তবে কেন? কেন আমি অতল তলে ডুবে যাচ্ছি। এর থেকে কি কোন পরিত্রাণ নেই। শুধু সেই দিনটাই কি দেবে পরিত্রাণ ?
এসে দাঁড়ালাম বাহিরের বেল্কনীতে। মাঝে মাঝে বৃস্টি ভেজা বাতাস ঝাপট দিয়ে যাচ্ছে চোখে মুখে । ঠাণ্ডার প্রখরতা ততটা নয়। মনে হোল হাত বাড়ালেই বন্ধু নেই, তবে পা বাড়ালেই তোঁ পথ। বেরিয়ে পড়ি।
কিছু কেনা কাঁটা আছে। দেশে যাবো কদিন পর। ক্রিসমাস শেষ। ভীড় ততটা নয়। কেন জানি এখন ভীড় সহ্য হয়না। গুমট ছোট্ট ঘরে বসে থাকতে মন চাইছে না। বেরিয়ে এলাম। রাস্তার ওপর প্রান্তে টার্গেট। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। কয়েকটা জিনিস মাত্র। শেষ মুহূর্তের অর্ডার। বেশিক্ষণ সময় ব্যয় করিনি। মাথার ভিতর অসংখ্য চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। সব গুলিই মূল্যহীন।
বিষণ্ণ মনের এটাই খোরাক। অনেক আগের ঘটনা যা আজকের দিনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই, ওটাকে সামনে এনে মনটাকে আরও ভরাক্রান্ত করা। অথবা কে যেন কি বলেছিল গত বছর সেটাই আজ হয়ে উঠল মুখ্য।
ক্ষণিকের তরে এই সব ফেলে আসা ঘটনা আমাকে নিয়ে গেলো আরও অতলে।
আমি দেখতে পাচ্ছি আমার সামনে ভবিষ্যৎ নেই। আছে বর্তমান। নিষ্ঠুর বর্তমান। আর অতীত আমাকে টেনে হিঁচড়ে পেছনে নিচ্ছে।
উহ! করে উঠলাম। পিছনের মহিলা তার হাতের ঠেলাগাড়ি টা দিয়ে আমার পায়ে জোরে আঘাত করেছে। অবশ্য ইচ্ছা ক্রীত নয়। সেল ফোনে কথা, সেই সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাটা, এই দুয়ের ফল স্বরূপ আমার পায়ে ধাক্কা।
সরি বলে অতি করুন দৃস্টি দিয়ে তাকাল আমার দিকে।
ঠিক আছে বলে আমি পা বাড়ালাম গাড়ীর দিকে।
বিকেল চারটা। টেলিভিশন টা চালিয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ ওটার দিকে। একটার পর একটা চ্যানেল পালটালাম। কিচ্ছু ভাল লাগছেনা। বন্ধ করে দিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম ছোট্ট লিভিং রুমে উদ্দেশহীন ভাবে। ভাবলাম কারো সাথে কথা বলতে হবে। মনটা হাল্কা করতে হবে। বিষণ্ণতা দূর করতে হবে।
দুজন বলল তাঁরা ব্যস্ত, অন্যজন ফোন ধরলনা।
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। স্নিগ্ধা। বান্ধবী বলতে সেই। আর একজন আছে তবে সে থাকে একটু দূরে।
ওর সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। কথা হয় অনেকক্ষণ ধরে। সেইসব কথা যে সব কথার কোন গভীরতা নেই। অথচ তাল কাটেনা। সময় কেটে যায়।
আজও মনে হোলও তাই হবে । কিন্তু হলনা। তাল কেটে গেলো। আমিই তাল কেটে দিলাম। আমিই কথা বলে হাল্কা হতে চেয়েছিলাম, যখন পেলাম তখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। শুধু হূ, হা, এই বলেই গেলাম।
রাগ হতে থাকল এই ভেবে, ও কেন জিজ্ঞাসা করছেনা, আমি কেন শুধু হু, হাঁ করছি কোন কথা না বলে,কেন জিজ্ঞাসা করছেনা আমার কি হয়েছে?
ও ওর কথাই বলে যাচ্ছে, একবারো তো আমার দিক থেকে সাড়াশব্দ নেই কেন সে কথা জানতে চাইছে না।
জানি অন্য অনেক দিন গেছে ও কথা বলেছে আমি শুনে গেছি, অথবা তার বিপরীত। আজ এটা আমি সইতে পারলাম না।
মাঝ পথে বললাম,” আজ রাখি” বলে ফোন টা রেখে দিলাম। এটা অভদ্রতা। কিন্তু আজ আমার কাছে ভদ্রতা অভদ্রতার কোন বালায় নেই। ভাবলাম ও আবার হয়ত কল করবে। বলবে,” কি হোল তোমার”?
না, সে আর কল করেনি। তিরিক্ষি হয়ে গেল মেজাজটা। আরও এক ডিগ্রী নেমে এলো মানসিক ভারসাম্য।
পোস্ট মরটমের রিপোর্ট অনুসারে খুন হয়েছে রাত বারোটার পরে। আফসারউদ্দিন বার বার রিপোর্ট টা পড়ল। পাঁচটা
ছুরির একটাতেও হাতের ছাপ নেই এটাই রহস্য।
রহমত এসে খবর দিলো পাঁচজনের খোজ পাওয়া গেছে। সবাইকে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। আফসার উদ্দিন বাহিরে এসে দাঁড়াল। আকাশটা আজ মেঘলা। লোকদের মনে খুশীর বন্যা বইছে। রাখাল মারাগেছে। দু এক জাগায় ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। একথা আফসারউদ্দিনের কানে এসেছে।
কনেস্টবল রহমান খোদেজা আর ওর মাকে নিয়ে এলো পুলিশ ষ্টেশনে। খোদেজার মাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলে আফসারউদ্দিন রহমত কে বলল খোদেজাকে ইনটারোগেশন রুমে নিয়ে যেতে। খোদেজা বোরখা পরে এসেছিল যাতে লোকেরা চিনতে না পারে। পাঁশে খুলে রেখে দিলো। বয়স ষোল সতেরো হবে। চোখে হিংস্রতার ছাপ।
“ ওর যে গলা কাটা হয়নি তা তুমি জানলে কি ভাবে? তুমি তো থাকো অনেক দুরের গ্রামে”?
“ঐ লম্পটের মরার খবর বাতাসের আগেই চলে এসেছিল। এখন বলেন আমাকে ডেকে এনেছেন কেন”?
“ ঐ রাতে তুমি কোথায় ছিলে?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন ।
“কেন? আমাকে সন্দেহ করছেন?”
“অস্বাভাবিক তো কিছু নয়। তবে প্রমান সাপেক্ষ”।
“ওর গলাটা আর একটা অঙ্গ যদি আমি নিজে হাতে কাটতে পারতাম তবে আমার প্রান জুড়াত। যে সর্বনাশ সে আমার করেছে আপনি তা বুঝবেন না। আপনারা জানেন শুধু টাকা খেয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে। সেদিন কেন তার বিচার হয়নি? সেদিন কেন প্রমান হোল আমি খারাপ মেয়ে আর সে সাধু”। উত্তেজিত হয়ে কথা গুলো বলে একটু থামল সে।
তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বলল,“ঐ রাতে আমি আমার বান্ধাবী রওশন আর তার স্বামীর সাথে গোপালপুরের মেলায় গিয়েছিলাম। খোজ নিয়ে দেখতে পারেন। ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল”।
“ আমি খুন করিনি”। তীব্র স্বরে বলল খোদেজা। “বললাম না আপনাকে ওকে খুন করতে পারলে আমার হাড় জুড়াত”।
সেই রাতে আমি মেলাতে ছিলাম” বলল সে।
আফসারউদ্দিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, ভাবল ওর এই কঠোর ভাবে কথা বলার মাঝে কোন রহস্য আছে কিনা।
আমি আসছি বলে বেরিয়ে গেলো, ডাক দিলো রহমত কে, বলল দীলীপকে ডেকে আনতে।
দীলীপ আসতেই ওকে একটা চিরকুট দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। বলল, গাড়ী নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি যাবে আর আসবে”।
দীলীপ দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
আফসারউদ্দিন রহমত কে ডাক দিয়ে বলল খোদেজা কে নিয়ে যেতে। ওয়েটিং রুমে বসাতে বলল।
বেরিয়ে এসে আফসারউদ্দিন দেখল খোদেজার মা বসে আছে। বাম চোখ কালো ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা।
আফসারউদ্দিন একবার তাকাল খোদেজার মার দিকে।
রহমত কে বলল চম্পা কে নিয়ে আসতে।
“তোমার নাম চম্পা, চম্পা কি?”
“চম্পা বিশ্বাস।‘
“ তুমি তো কলেজে যাচ্ছও? তাই না?”
“হা”
তোমাকে আমি কেন ডেকেছি বুঝতে পারছ?
“জানি কেন ডেকেছেন এবং আপনি খোজ নিন আমার কলেজে। জানতে পারবেন সে রাতে আমার ইস্পেশাল ক্লাস ছিল।
খুন আমি করিনি, তবে ইচ্ছা যে হয়নি তা নয়। সময়, সুযোগ, পরিস্থিতি যদি আমি পেতাম তবে ওকে খুন করতে আমি দ্বিধা করতাম না। কে করেছে যদি জানতে পারতাম তবে তাকে সহস্রও বার প্রনাম করতাম। আজও লোকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে আড়চোখে তাকায়। বাবা মা কে রাস্তায় অপদস্ত করে। আর আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। এক গ্রাম ছেড়ে আর এক গ্রামে চলে গেছি তাও রেহায় নেই। বলতে পারেন কবে আমি আবার চোখ তুলে চাইতে পারব। বলতে পারেন কবে একজন এসে আমাকে বলবে “তোমার অতীত আমি জানতে চাইনা জানতে চাই তোমাকে”। আপনারা তোঁ পুতুল। যখন যে যে ভাবে নাচায় সেই ভাবে নাচেন।“
আফসারউদ্দিন কিছু বলার আগেই রহমত এসে পাশে দাঁড়াল। চোখে ইঙ্গিত করতেই আফসারউদ্দিন বেরিয়ে গেলো।
বাহিরে দাঁড়ান রওশন আর তার স্বামী।
আফসারউদ্দিন তাদেরকে ডেকে নিয়ে গেলো তার চেম্বারে। জিজ্ঞাসা করল খোদেজা যা বলেছে সত্যি কি না।
ওদের হাঁ সূচক উত্তরে আফসারউদ্দিন ওদেরকে যেতে বলে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল।
কোথায় যেন একটা গরমিল আছে মনে হোল আফসারউদ্দিনের। ডাক দিল রহমত কে। বলল,” ওদের পাঁচজন কে যেতে বলও তবে গ্রাম ছেড়ে বাহিরে যেন না যায়।“
আর শোন, এখনি একটু বের হতে হবে। গাড়ী ঠিক করেতে বলও।
রহমত বেরিয়ে গেলো।
গাড়ী নিয়ে আফসারউদ্দিন আর রহমত এসে পৌছাল সেই বাংলো তে। ঘরের ভিতর টা আর একবার ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে চায়। ঘরের ভিতর এসে দাঁড়াল দুজন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলো কোন কিছু চোখে পড়ে কিনা।
“স্যার?”
রহমতের দিকে তাকাল আফসারউদ্দিন।
রহমত আঙ্গুল দিয়ে দেখালও ঘরের কোনে পড়ে থাকা বস্তু টির দিকে। চকচক করছে।
বড় একটা বোতাম। কোটের বোতামের মতো মনে হোল আফসারউদ্দিনের। হাতে গ্লভস পড়ে বোতামটা উঠিয়ে নিয়ে রাখল পকেট থেকে বের করা রুমালের ভিতর। চারিদিকে তাকাল আর একবার। বের হয়ে এলো রুম থেকে।
বলল রহমতকে “ আশে পাশের বাড়ীর লোকদের কে জিজ্ঞাসা বাদ করতে হবে। কেউ কিছু হয়তো দেখেছে যা আমাদের কাজে লাগতে পারে”।
বাংলোর পিছনে বাঁশঝাড়। তার মাঝ দিয়ে পায়ে চলা পথ। সেই পথ যেয়ে পড়েছে বড় রাস্তায়। তার পাশে লোকদের বসতি।
সেই পথ দিয়ে চলতে যেয়ে আফসারউদ্দিনের চোখে পড়ল সাদা একটা কাপড়ের টুকরা বেধে আছে ছোট্ট একটা বাঁশের মাথায়। শাড়ীর ছেড়া অংশ মনে হোল। উঠিয়ে নিয়ে সযত্নে করে রেখে দিলো পকেটে।
প্রথম বাসাতে টোকা দিতেই সুলতান বেরিয়ে এলো। পুলিশ দেখে ঘাবরিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো সেই রাতে এমন কিছু তার চোখে পড়েছে কিনা অথবা কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে কিনা ঐ বাংলো থেকে যা স্বাভাবিক নয়।
না দেখেনি। বলল সুলতান
পাশের বাসায় থাকে শমশের আলী। রহমত ডাক দিলো শমশের আলীকে। বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে দাঁড়াল শমশের।
পিছন ফিরে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই শুনতে পেলো এক মহিলার কণ্ঠস্বর।
“ উনাদেরকে দাড়াতে বলো ”।
“ কিছু বলবেন?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন।
“ দেখেছি একজন কে সাদা শাড়ী পড়া”।
“সাদা শাড়ী পড়া”? প্রশ্ন করলো, সাথে সাথে মনে হোল পকেটে রাখা সাদা টুকরো অংশ টার কথা।
“হাঁ”
“ চিনতে পেরেছেন?”
“না, তবে—“
“তবে কি?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন
“ একটা চোখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা”।
“ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা?” বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল আফসারউদ্দিন।
“আপনি ঠিক বলছেন?”
“জি, আমি সেই রাতে বাঁশ বাগানের ঐ রাস্তায় গিয়েছিলাম ছাগল টাকে আনার জন্য। হনহন করে সাদা কাপড় পড়া মেয়েটা আমার পাশ দিয়ে চলে গেলো। একটু হলেই আমাকে ধাক্কা দিতো।“
“ ঠিক আছে”। কিছু জিজ্ঞাসা না করে আফসারউদ্দিন রহমতকে নিয়ে ফিরে এলো থানায় । মাথার মধ্যে ঘুরছে শুধু একটা কথা, “ এক চোখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা”।
রহমত কে বাসায় যেতে বলে সেও ফিরে এলো তার বাসায়। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। কোন রকমে রাতটা কাটিয়ে
ভোর হতেই নাস্তা শেষ করে বাড়ীর কাজের লোকটাকে বলল রহমত কে ডেকে আনার জন্য।
রহমত এসে দাড়িয়ে ছিল বাহিরে। বুঝে উঠতে পারলনা এতো ভোরে কেন তার ডাক পড়ল।
আফসারউদ্দিন বেরিয়ে এসে রহমত কে বলল এখনি খোদেজার মা কে প্রথমে, এবং অন্য চার জনের মা কে পরে নিয়ে আসতে। রহমত বেরিয়ে যেতেই আফসারউদ্দিন এসে বসল তার চেম্বারে। মনে মনে ভাবল আবার রহস্যের জাল খুলবে।
আধাঘণ্টা পরে রহমত ফিরে এলো খোদেজার মা কে নিয়ে। ওয়েটিং রুমে বসিয়ে আফসারউদ্দিনকে খবর দিলো।
বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করলো আফসারউদ্দিন। পেরিয়ে গেলো এক ঘণ্টা।
ডাক দিলো রহমত কে।
খোদেজার মা কে ইনটারোগেশন রুমে নিয়ে যেতে বলে একটা সিগারেট ধরিয়ে দুই টান দিয়ে ফেলে দিলো আফসারউদ্দিন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল বাহিরের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো ইনটারোগেশন রুমের দিকে।
খোদেজার মা মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। আফসারউদ্দিন ঢুকতেই চোখ তুলে চাইল সে। আফসারউদ্দিনের দৃষ্টি ওর কালো ব্যান্ডেজে বাঁধা চোখটার দিকে।
“ ওরা চারজন স্বীকার করেছে তোমরা রাখালকে হত্যা করেছ। আর তুমি দলের নেত্রী।“ এই মিথ্যে কথার চালটা চেলে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
“না আমি করিনি”। দৃঢ় তার সাথে বলল খোদেজার মা।
আফসারউদ্দিন উঠে বাহিরে যেয়ে ফিরে এলো হাতে সাদা একটা শাড়ী নিয়ে। সেটা সে খোদেজার মার বাসা তল্লাশি করে আগেই এনে রেখেছিল।
“ এই শাড়ীটা টা তোমার, তাই না?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন
“ হাঁ, তাতে কি প্রমান হয়েছে?”
আফসারউদ্দিন শাড়ীটার ভাজ খুলল। একটা জাগায় কিছুটা অংশ নেই।
দেখাল খোদেজার মা কে। তারপর পকেট খেকে বের করলো সেই অংশ টুকু।
“ এই অংশ টুকু পাওয়া গেছে বাঁশঝাড়ে। দেখো চিনতে পারো কিনা?” বলে তাকিয়ে থাকলো ওর মুখের দিকে।
আমরা এসে দাঁড়ালাম ওর সামনে। পাঁচটা ছুরি এগিয়ে দিলো মুকুল। প্রতিশোধ নিতে হবে। রাখালের চোখে আতংকের ছাপ। আমাদের শরীরের রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে। আমরা পাচজন ছুরি উঠিয়ে নিলাম হাতে। কিন্তু পারলাম না। পারলাম না ওর বুকে বিঁধিয়ে দিতে।
মুকুল ছুরি গুলো নিয়ে নিলো আমাদের হাত থেকে। গেঁথে দিলো এক একটা ছুরি এক একটা মেয়ের নামকরে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরল। ভয় আমরা পাইনি। কোন অনুশোচনা হয়নি আমাদের । বরং একটা পিশাচ মরেছে, বেচে গেছে অনেকে”। বলে থামল খোদেজার মা।
মুকুলের গায়ে কি কোট ছিল? জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন।
“হাঁ”
আফসারউদ্দিন আর কোন প্রশ্ন না করে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ডাক দিলো রহমত কে।
“গাড়ী বের করতে বলো । সাথে চারজন পুলিশ নিয়ে নাও। সলেমানপুরে যেতে হবে”।
রাখালের লাশ বাঁধা তার বাংলো বাড়ীর এক পিলারের সাথে। পাঁচটা তীক্ষ্ণ ছুরি গাঁথা তার বুকে। একটা ছুরি হৃদপিণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে গেছে ওপর পাঁশে। রক্ত ঝরছে।
রাখালের অত্যাচারে অতিষ্ঠও হয়ে উঠেছিল এই উপজেলার লোক। খুন খারাবি, চাঁদা বাজি, নারী ধর্ষণ এ ছিল তার নিত্য নৈমিত্বিক ব্যাপার। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল টাকা দিয়ে। কেউ কোন নালিশ জানালে পরদিন তার লাশ পাওয়া যেতো নদীর ধারে। ভয়ে সবাই তটস্থ।
রাখালের বাবা কাজ করতো এক কাপড়ের দোকানে। বাড়ী ছিল আরাপপুর গ্রামে। একদিন বাসায় এসে তাহেরা কে ডাক দিয়ে বলল,” রাখালের মা আমাকে এক গ্লাস পানি দাও, বুকটা যেন কেমন করছে”। পানি আর পান করা হয়নি। তার আগেই সব শেষ। রাখালের বয়স তখন বারো। ওর মা দিশাহারা। শোঁকের ছায়া মিলিয়ে যেতেই দেখতে পেলো সে কর্পদহীন। আত্মীয় স্বজন চলে গেছে যার যার পথে। কাজ নিয়ে ছিল চেয়ারম্যানের বাড়িতে। কাজ শেষে কিছু খাবার নিয়ে আসত বাসায়। তাই খেয়ে দুজনে রাত কাটাত। কিছু কিছু দুষ্ট লোকের উপদ্রব যে ছিলনা তা নয়। মার বাড়ন সত্ত্বেও রাখাল কাজ নিয়ে ছিল বাবার এক বন্ধুর দোকানে। অতি অল্প বয়সে পৃথিবী টাকে চিন্তে শিখলো।
শেফালী, তাহেরার এক দুঃসম্পর্কের খালাতো বোন, খবর পেয়ে এলো দেখা করতে। থাকে কাঞ্চনপুর উপজেলায়। অবস্থা ভালো। ছেলে,মেয়ে নেই। তাহেরার চেয়ে বয়সে বড়। শেফালীকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল তাহেরা।
“ আমার কি হবে শেফালী আপা ? কি হবে?” বলতে বলতে কান্নার স্বর দ্বিগুণে উঠল।
শেফালী ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,” সেই জন্যই তো আমি এসেছি। তোকে নিয়ে যাবো আমার কাছে। আমার তো কোন অভাব নেই। শুধু একটারই অভাব। বাসা খালি। উনি তো বাইরে বাহিরেই থাকে কাজ কর্ম নিয়ে। আমার কথা বলার লোক নেই। তোর সাথে কথা বলে সময় কাটবে ”।
তাহেরার চোখের জলের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ল। কি উত্তর দেবে সে জানিনা। শুধু বিধাতার কাছে হাত তুলে বলেছিল,” তুমি আছো। তুমি আমার দিকে মুখ তুলে চেয়েছ”।
রাখাল যেতে চায়নি। বলেছিল,” আমরা কষ্ট করে দাড়াতে পারবো না? মা?”
না, পারবো না। রাতে বেরাতে উপদ্রব সহ্য করেতে পারবো না। তুমি ছোট, তুমি বুঝবেনা।
সাত দিনের মধ্যে তল্পিতল্পা গুছিয়ে রওয়ানা হয়েছিল। ফেলে রেখে গেলো পুরনো দিনের স্মৃতি।
মনে পড়লো তাহেরার, কাজ শেষে জসীম ফিরে আসতো এই ছোট্ট ঘরে। তাহেরা আগিয়ে দিতো গামছা টা। বলত,” হাত মুখ ধুয়ে এসো, আমি ভাত বাড়ছি”।
তাহেরা ছেলেকে সামাল দিতে যেয়ে বলত,” মাঠে গেছে বন্ধুদের সাথে খেলতে। এখনি আসবে”।
“ ভালো করে লেখা পড়া করতে বলো, তা না হলে আমার মতো পরের দোকানে কাজ করে সারা জীবন কাটাতে হবে”।
যেতে যেতে আজ সব কথা মনে পড়ছে তাহেরার। বার বার ফিরে ফিরে তাকাল বাড়ীটার দিকে। দিয়ে গেলো জসীমের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে। বলেছিল,” ভাইজান, আপনি রইলেন, দেখা শোনা করে রেখেন। বাকি আল্লাহ ভরসা”।
পৌছাতে পৌছাতে রাত হয়ে গিয়েছিল। কুতুব আলী, শেফালীর স্বামী তখনো ফেরেনি। খাওয়া শেষে শেফালী ওদের ঘর দেখিয়ে দিয়ে বলেছিল,” শুয়ে পড়। কাল সকালে রাখাল কে নিয়ে আমি স্কুলে যাবো। ওকে ভর্তি করে দেবো”।
রাখাল শুনছিল। একটা কথাও বলল না। স্কুলে যাওয়ার মন তার আর নেই। শুধু থেকে থেকে বাবার কথা মনে পড়ে।
মার মতো এতো সহজ ভাবে সে এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারে নি।
আফসারউদ্দিন, কাঞ্চনপুর উপজেলার দারোগা। ক্রাইম সিনের কাছে এসে বললেন সবায় কে সরে যেতে এখান থেকে। রহমত তার এসিসটেন্ট। দুজনে ঘরে ঢুকল। আসবাব পত্র সব ঠিক মতো সাজানো। কেউ জোর করে ঢুকেছে মনে হোল না। হত্যা করার আগে মনে হোল রাখালকে বাঁধা হয়েছিল পিলারের সাথে। মুখে ছেড়া কাপড় ঢুকানো। যাতে চিৎকার করতে না পারে। পাঁচটা ছুরির কোনটাতে হাতের ছাপ নাই। হত্যাকারী অথবা হত্যাকারীদের হাতে গ্লোভস ছিল মনে হয়। খুব প্লান মাফিক এই হত্যা করা হয়েছে। আফসারউদ্দিন লাশ পোস্ট মরটম করতে পাঠিয়ে দিতে বলে অফিসের দিকে রওয়ানা হোল। যাবার আগে রহমতকে বলে গেলো কাজ শেষে তার সাথে দেখা করতে।
রহমতের কাজ শেষ করে আসতে আসতে দুই ঘণ্টা লেগে গেলো। ঘরে ঢুকতেই আফসারউদ্দিন বলল,” রাখালের যারা ডান হাত তাদের কে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো । এরেস্ট করে নয়। বলবে, ইনটারওগেশনের জন্য ডাকছে। সেই সাথে রাখালের বিপরীতে, যারা ওর শত্রু তাদের নাম গুলো আমার দরকার”।
রহমত চলে গেলো।
নিয়ে এলো ফরিদ, পিকলু, শাহাদত কে। অনেক কুকর্মের সাথে জড়িত।
“ জুভীনাইল ডিটেসশন সেন্টারে ওর সাথে আমার দেখা। আমাদের দুজনের বয়স ছিল বারোর কাছাকাছি। ওকে গ্রেফতার করা হয়েছিল খুনের দায়ে”। বলে একটু থামল।
তারপর? কাকে খুন করেছিল ?
“ কুতুব আলিকে, যার বাসাতে ওরা থাকত। ও বলেছিল, একদিন স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল সময়ের আগে। বাসায় আসতেই শূনতে পেলো মার চিৎকার। দৌড়ে যেয়ে মার ঘরের দরজা খুলতেই দেখতে পেলো কুতুব আলী ওর মা কে জাপটে ধরেছে বিছানাতে। ওর মা চিৎকার করছে আর পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা করছে। হিতাহিত জ্ঞান ছিলনা রাখালের। পাঁশে পড়েছিল এক বড় কাঠের টুকরা। সেটা উঠিয়ে জোড়ে মারলও কুতুব আলীর মাথায়। ছিটকে পড়লো কুতুব আলী। উঠবার চেষ্টা করতেই আর একটা আঘাত আনলো ওর মুখে। নীস্তেজ হয়ে গেলো কুতুব আলীর দেহটা। রক্ত ছিটকে পড়েছিল রাখালের গায়ে। ওর মা থরথর করে কাঁপছিল। জড়িয়ে ধরেছিল রাখালকে। বলেছিল,” তুই চলে যা। আমি বলব আমি মেরেছি”। রাখাল যায়নি।
শেফালি বাহিরের থেকে ফিরে আসতেই তাহেরা বলেছিল সব। সে বিশ্বাস করেছিল কিনা জানেনা। পুলিশ ডেকে ছিল।
রাখালকে হাতকরা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল থানায়। মাকে সেই তার শেষ দেখা। রাখালের জেল হয়েছিল দশ বছরের। সেই খানে আমার সাথে তার দেখা”। বলে থামল।
“আমি তো শুনেছি তোমাদের মধ্যে মন মালিন্য ছিল বিভিন্ন কুকর্মের নেতৃত্ব নিয়ে?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন।
ফরিদ সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “আমি খুন করিনি স্যার। ঐ সময়ে আমি কাঞ্চনপূরে ছিলাম না স্যার। আপনি খোজ নিয়ে দেখতে পারেন”।
ঠিক আছে বলে আফসারউদ্দিন ওকে যেতে বলল। আরও বলল এই এলাকা থেকে বাহিরে কোথাও যেন না যায়।
এরপর পিকলু কে ডেকে পাঠালও। বডি বিলডার। উচ্চতা ছয় ফুটের কাছাকাছি।
বসতে বলে বলল, তুমি তো রাখালের বডিগার্ড ছিলে? তাইনা?
কোন উত্তর দিলো না পিকলু। আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো কি ভাবে তার সাথে পরিচয়।
“ দেখা হয়েছিল মদন মোহন সরকারের চা র দোকানে। রাখাল আর ফরিদ এসেছিল টাকা নিতে। প্রতিমাসে বরাদ্দ ছিল কোন দোকান কত টাকা দেবে। ফরিদের কাছে শুনেছি জেল থেকে বেরিয়ে সে খুজেছিল মা কে। ওর মা ফিরে গিয়েছিল দেশের বাড়িতে। পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। সেই শুরু। খোজ নিয়ে ফরিদের সন্ধান পেয়েছিল। দুজনে মিলে গরে তুলেছিল সংগঠন। ফরিদ এসে আমাকে বলেছিল দেখা করতে রাখালের সাথে। সেই থেকে পরিচয়”।
“পুলিশের রিপোর্ট অনুসারে পাঁচটা মেয়ের সে সর্বনাশ করেছিল ঐ বাসাতে এবং তুমিই তাদেরকে ধরে নিয়ে এসেছিলে। তাই না”?
“ আপনি তো জানেন, আদালতে তা প্রমান হয়নি”।
“ জানি, এবং এটাও জানি টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল”।
পিকলু এই কথার কোন উত্তর দিলো না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো।“ খুনের দিন রাতে কোথায় ছিলে? তুমি তো সব সময় ওর সাথে থাকো। পাহারা দাও। ঐ দিন রাতে ছিলেনা কেন। তার মানে তুমি জানতে কিছু একটা ঘটতে চলেছে?”
“ না স্যার, আমার মা অসুস্থ থাকায় আমি ছুটি চেয়ে ছিলাম। রাখাল বলেছিল চলে যেতে। আজ আর সে কোথাও যাবেনা। আপনি খোজ নিতে পারেন আমার গ্রামের বাড়িতে।“
“ যদি সে বলে থাকে আর কোথাও আজ সে যাবেনা, তাহলে কার পরামর্শে এত রাতে বাংলো বাড়িতে গিয়েছিল?”
‘জানিনা স্যার”।
“ হু, ঠিক আছে তুমি যাও।“ বলে আফসারউদ্দিন রহমত কে ডাক দিলো।
রহমত আসতেই আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো।“ আচ্ছা তোমার কি মনে আছে বছর দুয়েক আগে ঐ বাংলো তে বিভিন্ন সময়ে পাঁচটা মেয়ের সর্বনাশ করা হয়েছিল। যেটা কিনা আদালতে প্রমান হয়নি।“?
“ হাঁ স্যার, মনে আছে।“
“ কোথায় সেই পাঁচ জন? গ্রামে আছে না গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। খোজ নিয়ে তাদেরকে এখানে আনার ব্যবস্থা করো সাথে যেন গার্ডিয়ান থাকে।
“ আমি এখনি যাচ্ছি স্যার” বলে রহমত বেরিয়ে গেলো
আফসারউদ্দীন তাকিয়ে ছিল সামনের দেয়ালের দিকে। বিভিন্ন ক্রিমিনাল দের ছবি আটকানো। মাথায় শুধু একটা ভাবনাই ঘুরে ফিরে আসছে।