পার্থর ট্রেনটা যখন মধুপুর ষ্টেশনে এসে পৌছাল তখন রাত একটা। মাঝ পথে ট্রেন লাইনের মেরামতের জন্যই সময় মাফিক এসে পৌছাতে পারেনি। পার্থ নেমে কাউকে দেখতে পেলনা। সেই আশাও সে করেনি। ছোট্ট মফঃস্বল শহর এই মধুপুর। এখানকার হাসপাতালের চীফ ডাক্তার হয়ে সে জয়েন করছে। আসার আগে সুমীতা বার বার বলেছিল,” না গেলেই কি নয়”।
উত্তরে পার্থ বুঝিয়েছিল সুমীতাকে,” ওদের টাঁকায় লেখা পড়া শেষ করেছি, শুধু তাই নয়, লিখিত দেওয়া ছিল, ডাক্তারি পাশের শেষে কোন এক গ্রামে যেয়ে আমাকে দুই বছর কাজ করতে হবে। কাজেই না করার কোন উপায় নেই। মাত্র তো দুটো বছর, একটু অপেক্ষা করো লক্ষ্মীটি। তার পড়েই আমরা ছাদনা তলায় যেয়ে বসব।“
সুমীতা আর না করেনি। শুধু বলেছিল, যেয়েই আমাকে কল করবে। মনে থাকবে তো।
মধুপুর উপজেলা। সব মিলিয়ে আশি হাজারের মতো লোকের বাস। বেশির ভাগ লোকই ব্যাবসাই। বছর পাঁচেক হোল ছোট হাসপাতাল টাকে বড় করা হয়েছে। আগে কোন বেড ছিলনা। এখন পাঁচ বেডের হাসপাতাল। ডাক্তার বলতে একজনই। বাকীরা ডাক্তারকে সাহায্য করে।
পার্থর ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরীই হোল। অনেক রাতে পৌছেছে তাছাড়া সুমীতার সাথে কথা বলতে বলতে অনেকটা রাত পেড়িয়ে গিয়েছিল। সেলিমের ডাকেই ঘুমটা ভাঙল। বাহিরে এসে দেখল নাস্তা তৌরী।
“ সেলিম, নাস্তা কে তৌরী করেছে” জিজ্ঞাসা করল পার্থ
“ বকুলের মা”
বকুলের মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে দাঁড়াল পার্থর সামনে।
“ আমি যে ডাক্তার সাব আসে তার রান্না, ঘর মোছা সব করে দেই।“ বলল বকুলের মা
“ঠিক আছে” বলে পার্থ সেলিম কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো হাসপাতালের উদ্দেশে।
সব মিলিয়ে পাঁচ জন কর্মচারী। ডাক্তারকে সাহায্য করার জন্য আছে একজন নার্স। পার্থ দারজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই সবাই আসে সামনে দাঁড়াল। সেলিম পরিচয় করিয়ে দিলো সবার সাথে। আজ কোন রোগী নাই।
চেম্বারে আসে বসতেই মতীন আসে খবর দিলো চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন দেখা করতে।
“ আসসালাম আলাইকুম” বলে চেয়ারম্যান সাহেব তার উপস্থিতি জানালেন।
আমার নাম উজির আলী, এখানকার চেয়ারম্যান। বলে চেয়ার টা টান দিয়ে বসলেন।
আপনার কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন। কথা গুলো বলে চারিদিকে একবার তাকালেন উজির আলী।
আমি একলাই, যাকে বলে ব্যাচেলার। পার্থ এই ধরনের পার্সোনাল কথা মোটেই পছন্দ করেনা। তবুও প্রথম দিনই সেটা প্রকাশ করল না।
চেয়ারম্যান সাহেব উঠে পরলেন ,”আমার সময় কম। একটা মিটিং আছে। এখন উঠি। আবার দেখা হবে।“
দুদিন পরে এক সন্ধায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খুলতেই দেখে আফজাল সাহেব দাঁড়ান। “ এই ভর সন্ধায় ঘরে বসে কি করেন? চলেন ক্লাবে আড্ডা দিয়ে আসি”। বললেন আফজাল সাহেব
“ বেশ তো,” বলেই বেরিয়ে এলো পার্থ।
ছোট্ট একটা ঘর। গোটা দশেক চেয়ার পাতা। একটা ছোট টেবিল। জনা পাঁচেক লোক বসা। দুই জন ক্যারাম খেলছে।
বাকি দের হাতে সিগারেট।
আফজাল সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ আমাদের নতুন ডাক্তার। আর উনারা এখানকার স্কুলের মাস্টার”।
একজন সিগারেটের প্যাকেট টা এগিয়ে দিতেই পার্থ বলল, অভ্যাস নেই।
বসে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলো।
পার্থ ভাবল মাঝে মধ্যে এসে আড্ডা দিলে সময় টা কেটে যাবে।
দেখতে দেখতে চার মাস কেটে গেছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কাজের ধরা বাঁধা কোন সময় নেই। কোন কোন দিন কিছুই করার থাকেনা। তখন সে কল করে সুমীতা কে।
মাঝে মাঝে মরণাপন্ন রোগী এলে রাত টা কাটিয়ে দেয় হাসপাতালে।
অন্য সময় হাটতে বেড়িয়ে পরে।
পথ চলতে যেয়ে লোকেরা “ডাক্তার সাহেব কেমন আছেন” বলে সালাম দেয়।
এমনি একদিন পার্থ হাটতে হাটতে চলে এলো বেশ দূরে, নদীর পাড়ে।
শুনে ছিল এই মধুপুর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এই নদী। নাম কঙ্কনা। এই নাম কে দিয়েছিল, কখন কিভাবে আসে ছিল কেউ জানেনা। এক সময় এই নদীতে লোকে নৌকা বইত। আজ শুধু তা গল্প কাহিনী। সংরক্ষনের অভাবে আজ কচুরী পানায় ভরে গেছে নদী। নদীর ধারে কাশফুলে ভরে গেছে। লোকে আর এপথ দিয়ে খুব একটা হাটে না। পায়ে চলা পথ এখনো আছে নদীর পাশ দিয়ে।
তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ভালোই লাগছিল। হই হুল্লা নেই। নিস্থব্ধ চারিদিক। পাখি দের কিচিরমিচির। আবছা অন্ধকার। একটা কাক চিৎকার করে কা কা করে উড়ে গেলো।
পার্থ তাকাল সামনে। মনে হোল সাদা শাড়ী পড়া একটা মেয়ে হেটে চলেছে। ছিপছিপে গড়ন। ঘন চুল এলিয়ে দিয়েছে পিঠে। পার্থ তাকাল চারিপাশে। কেউ নেই। মেয়ে টা তাকাল ফিরে। পার্থ মুখ টা দেখতে পেলনা।
এই সময়ে কেন সে এখানে একা। ভাবল পার্থ।
দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো মেয়েটার কাছাকাছি যাবে বলে। না, হারিয়ে গেলো সে, দেখতে পেলনা আর তাঁকে।
পার্থ ভাবল সে তো সামনেই ছিল, কোন বাক তো নেই নি, তবে গেলো কোথায়।
পাশে তাকাতেই মনে হোল কে যেন শিস দিয়ে ডাকল তাঁকে।
তখন অন্ধকার ভেঙ্গে চাদের আলো পড়েছে কচুরী পানার পড়ে।
“কখনো যাবেন না স্যার? ওখানে ভুত পেত্নী আছে। মরা কান্না শূনতে পায়”।
পার্থ কথা বাড়াল না। সেলিম কে বলল, তুমি এসো।
ভয় ডর পার্থের কোন কালেই ছিলনা। কলেজে পড়া কালীন মাঝে মাঝে রাতে সে শ্মশানে যেয়ে বসে থাকতো। বাঁশি বাজাতো। কেন? সে নিজেও জানেনা।
আজ যা সে দেখেছে তা কাউকে বলার নয়। মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না পার্থ। ভাবল কাল আবারও যাবে সে।
দেখি সে আসে কি না।
পরদিন। সন্ধা ঘনিয়ে এলো। পার্থ পা বাড়াতেই নঈম আসে খবর দিলো একটা রোগী এসেছে। বিরক্তির চিহ্ন ঢেকে পার্থ এসে দাঁড়াল রোগীর কাছে। দেখে শুনে ঔষধ লিখে দিতে দিতে আধা ঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো।
চাঁদের আলোয় পথ দেখে এসে দাঁড়াল নদীর পাড়ে। জনশূন্য। কেউ কোথাও নেই। বুকের মাঝে অজানা এক অনুভূতি। সামনে পড়ে থাকা একটা বড় পাথরের উপর বসল পার্থ। ঘাড়ের কাছ দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। তাকাল পিছনে।
না কেউ নেই।
“ আজ দেরী করে এলে যে?”
চমকে সামনে তাকাল পার্থ। একটু দূরে সাদা কাপড় পরা, আচল উঠিয়ে মুখটা ঢাকা।
“আমাকে তুমিই মুক্তি দিতে পারবে। আমি আর পারছিনা। ওরা আমাকে বন্দি করে রেখেছে ওই পানির নিচে”। কাঁদতে কাঁদতে বলল সে।
পার্থ ভাবল সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে নাতো ? না, সে তো সব কথাই শূনতে পেলো।
“ বন্দি করে রেখেছে? কে ? কোথায়? কেন?” এত গুলো প্রশ্ন একসাথে করলো পার্থ।
শোন তাহলেঃ
দেখতে আমি সুন্দরীই ছিলাম। লোকে তাই বলত। সেটাই আমার কাল হয়েছিল। আমি ছিলাম এক কাঠ মিস্তিরির মেয়ে। মা মারা গিয়েছিল ছোট বেলায়। বাবাই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিল। বয়সের সাথে সাথে আমার রুপের কথা ছড়িয়ে পরেছিল এই শহরে। একদিন বাবা এসে বলল, মা, বাহিরে বেশি যাসনে।
কেন? সে কথা বাবা কে জিজ্ঞাসা করিনি। বুঝে নিয়ে ছিলাম বাবা কি বলতে চাইছে।
পথে আসতে যেতে বকাটে ছেলে গুলো উত্যক্ত করতে লাগল। তার মধ্যে ছিল চেয়ারম্যানের ছেলে মহিম। যদিও আমি কোন সময়ে একলা চলাফেরা করিনা রাস্তা দিয়ে।
মহিম ছিল ওদের লিডার। একদিন ওর নির্দেশে অনন্যারা এসে আমাদের পথ আগলে ধরল। আমার বান্ধবীদেরকে চলে যেতে বলল। ওরা ইতস্তত করতেই ওদেরকে জোরে ধমক দিল। ওরা যাওয়ার আগে বার বার আমার দিকে তাকাতে লাগল।
আমি দাড়িয়ে রইলাম। মহিম এলো। দাঁড়াল আমার সামনে। কোন ভূমিকা না করেই বলল,” আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই”।
যার পেশাই হচ্ছে গুণ্ডামি, লেখাপড়ার ধার দিয়ে যায়নি। বাপের ছত্র ছায়ায় থেকে যা ইচ্ছা তাই করে চলেছে, কেউ কিছু বলার সাহস পায়না।
দেখলাম রাগে সে কাঁপছে। আমার হাত চেপে ধরল। হেঁচকা টান দিতেই, ওড়না টা পড়ে গেলো নিচে। উঠাতে যেতেই সে আমার চুল চেপে ধরল। আমার আর হিতাহিত জ্ঞান ছিলনা। কষে একটা থাপ্পড় মারলাম ওর গালে।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে ছেড়ে দিল আমাকে। ভাবতে পারিনি সবার সামনে তাঁকে আমি এমন অপমান করব।
আমিও ভাবিনি। সব কিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো যে আমি ভাববার কোন সুযোগ পাইনি।
হনহন করে বাসায় চলে এলাম। জানি এর প্রতিশোধ সে নেবে। তবে কি ভাবে সেই টাই আমি জানিনা।
বাবা কে কিছুই বলিনি। শুধু অপেক্ষায় থাকলাম।
বেশ কিছুদিন কেটে গেলো।
এক রাতে, বাবা তখনো ফেরেনি। উঠানে অনেক গুলো পায়ের শব্দ শুনলাম। কোন কিছু বোঝার আগেই ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঢুকল পাঁচ জন। সাথে মহিম। চিৎকার করার আগেই মুখে রুমাল গুজে দিলো। মাথায় কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে পাজা কোলে করে উঠিয়ে নিলো ওদের গাড়ীতে।
কোথায় নিয়ে এলো আমি জানিনা। তারপর ওরা আমার উপর যে অত্যাচার করেছিল তা আমি তোমাকে বলতে পারবনা।
শুধু এই টুকুই বলি, একদিন ওরা আমার গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দিলো কড়ি কাঠে।
তারপর আমার নিঃস্পন্দন দেহটাকে মোটা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দুপাশে ভারী লোহার বস্তা বেধে ডুবিয়ে দিলো এই মাঝ নদীতে। আমি আজও ওখানেই পড়ে আছি। আমাকে তুমি উদ্ধার করো । পারবে না?
পার্থ শুনছিল। মনে হচ্ছিল কে যেন ওর কানের কাছে এসে কথা বলছে। অথচ সে বসে আছে দুরে। শুধু সাদা শাড়ীটাই দেখা যায়।
কোথায় সেই জায়গা? জিজ্ঞাসা করলো পার্থ।
নড়ে ঊঠল সাদা কাপড়টা।
পার্থ দেখল সামনে কেউ নেই। তাকাল চারিদিকে। কোথাও দেখেতে পেলো না তাকে।
আবারো কে যেন শিষ দিয়ে ডাকলও তাকে।
তাকাল বায়ে।
দেখল মাঝ নদীতে দাড়িয়ে সে। ঝপাৎ করে শব্দ হোল। মনে হোল কি যেন ডূবে গেলো ঐখানে।
পার্থ বূঝল এই সেই জায়গা। এখানেই হয়েছে তার সমাধি।
আরও কিছূক্ষণ বসে রইল সে। ভাবল সে ডাক্তার। পুরো ঘটনাটাই Hallucination কিনা? এমন তো হয়।
নিজের কাল্পনিক চিন্তা মনে হয় বাস্তব।
ফিরে এলো বাসায়। সবকিছু ঝেড়ে ফেলতে চাইল মন থেকে।
পরদিন কাজে মন বসাতে চাইল, পারলো না। অগত্যা পার্থরই বন্ধু এখানকার পুলিশের বড় কর্তা, তার ওখানে হাজির হোল।
ওকে দেখে সমীর আশ্চর্যই হোল।
“কি ব্যাপার? আমার তো অসুখ হয়নি,ভায়া। তা কি মনে করে?
“অসুখ হয়েছে আমার, আর তার ডাক্তার তুমি”।
সমীর কিছু বোঝার আগেই পার্থ জিজ্ঞাসা করলো,” তোমার কি জানা আছে বছর দুয়েক আগে এক কাঠ মিস্ত্রীর মেয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল।“
“শুনেছি, কার সাথে যেন চলে গিয়ে ছিল”,।
“তাই কি?”
“কেন? কিছু বলতে চাইছ?”
তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না। ভাববে আমার মস্তিষ্কের কোন একটা জায়গা গড়বড় হয়ে গেছে। তাও বলি।
পার্থ বিস্তারিত সব বলে ছিল সমীরকে।
সমীর শুধু বলেছিল,” তোমাকে আমি কলেজ লাইফ থেকে চিনি। তবে, আমি বাস করি নদীতে, কুমিরের সাথে ঝগড়া করে টিকতে পারবো কি? তুমি তো জানো আমাদের শাসন ব্যাবস্থা”।
“ তোমাদের হাতে তা হলে করনীয় কিছুই নেই”। জিজ্ঞাসা করল পার্থ।
“ আছে, আমি জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাব। ওরা কেস টা ওপেন করে, সরজমিনে তদন্ত করবে। তুমি শুধু আমাকে লোকেশন টা দেখিয়ে দাও”।
এর পর কয়েক মাস কেটে গেছে। পার্থ ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে ওর কাজে। রোগী বেড়েছে। তবুও প্রতিদিন সন্ধায় সে যায় নদীর পাড়ে। বসে থাকে সেই পাথরটার উপর। সে আর আসেনা।
পার্থ ভাবে হয়তো সে অভিমান করেছে। পার্থ তো কিছুই করতে পারলো না।
এক সকালে পার্থের হাতে কোন কাজ নেই। খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছিল। সেলিম দৌড়ে এসে খবর দিলো নদীর পাড়ে অনেক পুলিশ। মাঝ নদীতে কি যেন খুজছে।
পার্থ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। অনেক লোক নদীর চারিপাশে ঘিরে দাঁড়ান। চেয়ারম্যান সাহেব কে দেখা যাচ্ছে। মহিম আর তার সাগরেদ রা এক পাশে দাঁড়ান। ফ্যাকাসে চেহারা।
পার্থে সাথে চোখাচোঁখি হোল সমীরের।
দূরে বড় নৌকা থেকে লোহার শিকল, মাথায় আংটা বাঁধা ডুবিয়ে দিয়েছে পানির নিচে। সবাই তাকিয়ে আছে দূর পানে।
“ স্যার, কিছু তোঁ বাধছে না? চলে আসব?”। বলল নৌকায় কর্মরত একজন।
পার্থ এগিয়ে এলো সমীরের কাছে। ফিসফিস করে বলল, “ দশ বারো হাত বায়ে খুজতে বলও”।
সন্ধ্যা হয় হয়। জমির আলী রিক্সাটা দাড় করিয়ে মাথার ঘামটা মুছে নিলো হাতের গামছা দিয়ে। শেষ ভাড়াটা ছিল দূরপাল্লার। প্রথমে যেতে চায়নি। বয়স হয়েছে। ইদানীং বেশি ঘণ্টা রিক্সা চালাতে অসুবিধা হয়। মাথাটা ঝিমঝিম করে। কিন্তু কোন উপায় নেই। সংসার চালাতে হবে। বৌ সকালে উঠে চলে যায় গারমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। ফিরতে রাত হয়। ছেলে মেয়ের মুখ এই জন্মে দেখা হলনা। মাঝে মাঝে বৌ মন মরা হয়ে বসে থাকে। জমির আলী সান্ত্বনা দেয়।
বলে,” মন খারাপ করোনা বৌ। সবই আল্লার ইচ্ছা”। কোন কোন দিন শেষ যাত্রীকে নামিয়ে চলে যায় জামীলার ফ্যাক্টরিতে।
দুজনে একসাথে ফেরে বাসাতে।
“ এই চলো” বলেই এক বিদেশী উঠে পড়লো ওর রিক্সাতে। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ।
“ তাড়াতাড়ি চলো” বলল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায়।
কোন কিছু ভাববার সময় পেলনা জমির আলী।
কোথায় যেতে হবে? জিজ্ঞাসা করল ।
তোমার যে দিকে মন চায়। টাকার কথা ভেবো না। শুধু অলি গলি দিয়ে জোরে চালিয়ে যাবে।
কথা শেষ হলনা। একটা কালো রং এর গাড়ী পাঁশে আসে দাড়াতেই লোকটা লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে দৌড় দিলো। হারিয়ে গেলো ভিড়ের মাঝে।
এত দ্রুত সব ঘটে গেলো যে জমির আলীর কিছুক্ষণ সময় লাগলো বাস্তবে ফিরে আসতে।
কালো গাড়ীটা জোরে শব্দ করে বেরিয়ে গেলো।
জমির আলী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকাল পিছনে। দেখল কি যেন পরে আছে রিক্সার পা দানিতে। একটা এনভেলাপ।
মলটা চেনা মনে হোল জমির আলীর। চারি দিকে তাকাল সে। অজান্তে গাটা শিরশির করে উঠল।
রিক্সার গদী টা উঠিয়ে এনভেলাপটা রেখে দিল।
এখনও দুঘণ্টা দেরী জামীলার ছুটি হতে।
“এইযে ভাই যাবেন?”
তাকাল জমির আলী।
মা তার ছোট্ট মেয়েটার হাত ধরে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।
জামির আলী ভেবেছিল আর কোন প্যাসেঞ্জার নেবেনা। বিশ্রাম নেবে। কিন্তু পরিস্থিঁতি ঘোলাটে হওয়াতে দুজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তাছাড়া এই ঘটনার পরে এখানে থাকাটাও সমীচীন নয়।
“ কোথায় যাবো”?
“ রায়ের বাজার।“
চালাতে চালাতে শুধু মনে হতে লাগল এই বুঝি কালো রঙের গাড়ীটা পাঁশে আসে দাঁড়াল।
ঘিঞ্জি এবড়ো থেবড়ো রাস্তা পাড় হয়ে সে এসে দাঁড়াল রায়ের বাজারের একতালা বাড়ীটার সামনে। টাকা মিটিয়ে দিয়ে মহিলা বাড়ীর ভিতর ঢুকতে যাওয়ার আগে জমির আলী জিজ্ঞাসা করল
“কটা বাজে, মেমসাব”?
“সাত টা” বলে ভদ্রমহিলা বাহিরের দরজা টা বন্ধ করে দিলো।
বাহিরে ছাউনী দেওয়া চা’র দোকানে এসে বসলো জমির আলী। গরম চা টা ফু দিয়ে ঠোটের কাছে ধরল। আরও একবার ফু দিয়ে কিছু পরিমাণ ঢেলে দিলো মুখের ভিতর। সারাদিনের ক্লান্তির পর এযেন অমৃত মনে হোল।
একটা নন্তা বিস্কিট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলো। এখনো হাতে কিছু সময় আছে জামীলাকে আনতে যাওয়ার।
চা টা শেষ করে রিক্সার পাঁশে এসে দাঁড়াল জমির আলী। গদীর নীচ থেকে বের করল এনভেলাপটা। দেখল আবার। কি যেন রহস্য আছে এর মাঝে মনে হোল জমির আলীর।
জামীলাকে কিছুই জানালো না সে। পরের দিন রিক্সা চালিয়ে কিছু টাকা হাতে আসতেই জমির আলী চলে এলো সেই মলের সামনে। এযেন এক অদৃশের টান। রিক্সাটা রাস্তার পাঁশে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো উপরে। হাতে এনভেলপটা। ফটো টা
আর একবার দেখল।
দোতালায় এলো জমির আলী। জয়ন্তী জুয়েলারস। এর সামনে তোলা ছবি। আশে পাঁশে কয়েকবার হাঁটল সে। ভেবে ছিল মেয়েটাকে এখানে দেখতে পাবে। আর দেখতে পেলে ওর ছবি ওকে ফিরিয়ে দেবে।
না, কোন কিছু চোখে পড়লনা জমির আলীর। ছবিটা যে কাউকে দেখাবে সে ভরসাও পেলোনা। অগত্যা এস্কেলেটর দিয়ে নিচে নেমে এলো। বাহিরে এসে দাঁড়াল। ভাবল একটা সিগারেট টানলে মন্দ হয়না।
সামনেই দোকানে। সিগারেট কিনে পাশ ফিরতেই চোখে পড়ল দুই টা লোক কিছু দূরে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । ওদের দুজন কে সে জয়ন্তী জুয়েলারসের সামনে দেখেছে। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে তাকাল সামনের দিকে ঝুলিয়ে রাখা খবরের কাগজের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কাগজটার দিকে। সারা শরীর হীম হয়ে এলো। এতো সেই মেয়ের ছবি সাথে সেই বিদেশির। বড় বড় করে লেখা, “ যমুনা হোটেলে জোড়া খুন”।
জমির আলী বুঝতে পারল নিজের অজান্তে সে কীসের মাঝে জড়িয়ে পড়েছে।
তাড়াতাড়ি রিক্সার দিকে রওনা হোল। ভাবল, বাসায় যেয়েই ছবি গুলো পুড়িয়ে ফেলবে। আর গোয়েন্দা গিরি নয়।
রিক্সা পর্যন্ত পৌছাতে পারলনা জমির আলী। সেই দুজন ষণ্ডা মার্কা লোক এসে দাঁড়াল ওর দুপাশে। ওদের চোখ এনভেলাপটার দিকে। জিজ্ঞাসা করল,” এই এনভেলপটা কোথায় পেয়েছ?”
আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই জমির আলীর মনে হোল এনভেলপটা রেগুলার এনভেলপের মতো নয়। করাতের দাতের মত দুপাশে খোঁদায় করা। আর দুইটা কোদালের ছবি। এই ভিন্ন ধরনের এনভেলাপ টাই যত নষ্টের মুল। এটার জন্যেই সে ওদের নজরে পড়েছে।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই একজন ওর হাত থেকে এনভেলপটা নিয়ে নিলো। অন্যজন ইশারা করে দেখাল ওর হাতের রিভলভারটা। জমির আলীর সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। গলা শুকিয়ে গেছে। ওকে নিয়ে এলো ওরা রাস্তার ওপাশে দাঁড়ান সাদা মারসেডিসের কাছে। কালো টিনটেড গ্লাসে ঢাকা চারিদিক। বাহিরের থেকে কিছুই দেখা যায়না।
একজন দরজা খুলে দাঁড়াল। অন্যজন আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে গাড়ীর ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো জমির আলীকে।
ভিতরে বসে আছে তিনশ পাউন্ডের একটা লোক। দরজা বন্ধ হতেই ষণ্ডা মতন লোকটা এনভেলপটা এগিয়ে দিলো মোটা লোকটার দিকে।
“বস, এই সেই এনভেলপ।“ বলে জমির আলীর দিকে তাকিয়ে নেকড়ের হাসির মতো হাসি দিলো।
মোটা লোকটা এনভেলপ থেকে ছবি গুলো বের করে পাশে রেখে দিলো। ঊল্টা পালটা করে কয়েক বার দেখলও এনভেলপটা । কি যেন খুজছে , পাচ্ছে না।
তাকাল জমির আলীর দিকে। জমির আলীর আত্মা তখন খাচা ছাড়া। বুজতে পাড়লো না কি সে খুজছে।
“ Where is that paper? কাগজটা কোথায়?” হুঙ্কার দিয়ে উঠলো মোটা লোকটা।
“কাগজ? কোন কাগজ?” কান্না কান্না স্বরে বলল জমির আলী।
লোক টা ছুরির ফলাটা গাল থেকে সরিয়ে এনে ছোঁয়াল ডান চোখের পাশে। হাতের ইংগিতে বোঝাল চোখ টা উঠিয়ে আনবে।
জমির আলীর মনে পড়ল একটা কাগজ সে দেখে ছিল এনভেলাপের মধ্যে। হিজি বিজি কি সব লেখা ছিল। ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি। ওটা সে রিক্সার পা দানিতে ফেলে দিয়ে ছিল।
মনে মনে সে ভাবল এই সুযোগ, রিক্সাতে আছে বলে সে যদি একবার এই গাড়ী থেকে বের হতে পারে তাহলে দেবে ছুট। কপালে যা থাকে।
লোকটার ছুরি টা ওর বুকের কাছে আসার আগেই জমির আলী বলল রিক্সাতে রেখে এসেছে সেই কাগজ টা।
চোখে ইংগিত করতেই একজন জমির আলিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ী থেকে।
বেরিয়েই জমির আলী দেখল সামনে দাঁড়ান দুই টা পুলিশের গাড়ী।
চারিদিকে তাকালও একবার।
চিৎকার করে উঠলো, বাচাও বাচাও বলে।
কিছু লোক তাকাল জমির আলীর দিকে। পুলিশ দৌড়িয়ে এলো স্টেনগান হাতে।
লোকটা ভড়কিয়ে যেয়ে দৌড় দিল গাড়ীর দিকে। ততক্ষণে পুলিশ এসে ঘিরে ফেলেছে গাড়ীটা।
ভিতর থেকে বের করে আনা হোল মোটা লোকটাকে। সাথে ফটো গুলো।
পুলিশের কর্তা ফটো দেখে বলল,” এই মেয়েটাই কাল রাতে খুন হয়েছে যমুনা হোটেলে। পাশে পাওয়া গেছে এই মলের ছবি”।
জমির আলী কাঁদতে কাঁদতে বলতে যাচ্ছিল সব কথা। পুলিশের বড় কর্তা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,” থানাতে যেয়ে সব শুনব।“ এই কথা বলে পাশে দাঁড়ান পুলিশ কে বলল একটা রুমাল জামির আলিকে দিতে গালের ক্ষত জাগায় চেপে ধরার জন্য।
রুমাল টা চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,” স্যার, আমি একটু আমার রিক্সার কাছে যেতে পারি?”
উদ্দেশ সেই কাগজটা। পড়ে আছে, কি নেই।
আছে, পাদানিতেই পড়ে আছে। আস্তে করে উঠিয়ে নিলো জমির আলী। পরে খতিয়ে দেখবে কি আছে ওই লেখার মাঝে।
পুলিশ মোটা লোকটা আর সাথের সঙ্গী দুজনকে উঠিয়ে নিলো পুলিশের গাড়ীতে।
জমির আলী কেও নিয়ে এলো থানাতে। ওর বয়ান শেষে চলে যেতে বলল ওকে।
বাসায় এসে সব ঘটনা বলল জামীলাকে। দেখালও চিরকুটটা। ইংরাজিতে লেখা একটা ঠিকানা।
দুই দিন পরে খবরের কাগজে বড় বড় করে লেখা ৬৬৬ বান্দর লেন থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে প্রচুর হীরক সাথে অস্ত্র, কয়েকশো রাউন্ড গুলি।
জমির আলী পড়ল সংবাদটা। কাগজটা বের করে দেখল ঠিকানাটা। ৬৬৬ বান্দর লেন।
শফিক তার তল্পী তল্পা নিয়ে এসে উঠলো এক ঘর বেষ্টিত এপার্টমেন্টে। ছেলে মেয়েরা গোছায়ে দিয়ে গেছে এক চিলতে শোবার আর এক চিলতে বসার ঘর টা। বলে গেছে, বাবা এই ক্লোজেটে থাকলো তোমার জামা আর প্যান্ট, হাঙ্গারে ঝুলানো। পাশের এই ড্রয়ারে থাকল তোমার আন্ডার গারমেন্ট গুলো। এই ঝুড়িটার ভিতর রাখবে তোমার ময়লা কাপড় গুলো। বাহিরে যেতে হবেনা । রান্না ঘরের পাশেই আছে ওয়াসার আর ড্রায়ার। পরিষ্কার করে নিও।
শফিক বলেছিল, ঠিক আছে মনে থাকবে। কবে যে সে শেষ ওয়াসার আর ড্রায়ার ব্যবহার করেছিল মনে করতে পারেনা। যদিও সেই বিশাল বাড়ীর নিচের তালাতেই ছিল সব কিছু। এসব নিয়ে মাথা সে কোনদিনই ঘামায়নি। এতদিন তো নুবীয়া এসেই সবকিছু করে দিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বলত, মিস্টার, সব কিছু ধুয়ে ভাজ করে রেখে গেলাম, এখান থেকে নিয়ে নিয়ে পড়বে। আমি আবার দুই সপ্তাহ পরে আসবো।
শফিক জিজ্ঞাসা করেছিল আসবে তো আমার এপার্টমেন্টে? দুই সপ্তাহে না হয় নাইবা এলে, তিন সপ্তাহ পরে হলেও চলবে।
নুবীয়া রাজি হয়নি। বলেছিল বন্ধের দিন সে কাজ করেনা।
শফিকের বাসাটা ছোট হলেও ছিমছাম। শোয়া বসা আর রান্না ঘর ছাড়াও একটা ছোট্ট বেলকনি আছে। ওখানে বসলে সামনের ফুলের বাগানটা চোখে পরে। রংবেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো।
সব মিলে দশটা পৃথক পৃথক তিন তালা বাড়ী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সুন্দর করে ছাটা লন। চারিদিকে লোহার বেড়া। ঝুট ঝামেলা নেই। নেই কোন পথচারীর হাঁটাচলা । নেই কোন হট্টগোল।
শফিক প্রথমে আসতে চায়নি। ছেলে মেয়েরাই জোর কোরে নিয়ে এসেছে। বলেছিল, বাবা, এত বড় বাড়ী ছেড়ে কারোর বাড়ীর নিচের তলায় মাথা গুজলে তুমি বাজবে না। তোমাকে থাকতে হবে সুন্দর খোলা মেলা নতুন তৈরী এপার্টমেন্টে।
শফিকের কোন না ছিলনা। ওরাই সব ব্যবস্থা করেছিল। সব কিছু শেষ করে এসে বলেছিল, আব্বু সব ঠিক হয়ে গেছে। দোতালায় তোমার ঘর। বেশি উপরে উঠতে হবেনা। পারকীংও কাছে। শুধু টাকাটা পাঠিয়ে দিও।
এতো এক নতুন জীবনের শুরু।
শফিক কফির পেয়ালা টা নিয়ে এসে বসলো বেলকনিতে। বিকেলের সূর্যের তাপটা উপভোগ করার মত। ভাবছিল, বিয়াল্লিশ বছর আগে এসে উঠেছিল এক এপার্টমেন্টে, আজ বিয়াল্লিশ বছর পরে ফিরে এলো সেই জায়গায়। শুধু মাঝের সময় টা সিনেমার পর্দায় দেখা ছবি। আরম্ভ হয়েছিল হাসি আনন্দ, হৈ, হুল্লা করে। শেষে হোল চোখের জল ফেলে। আলো জ্বেলে উঠলো। পর্দা সাদা। শুধু রেশটা রইল আর কিছু রইল না।
এ শুধু ওর জীবনেই নয়, একিই ঘটনার প্রতিফলন ঘটেছে অনেকের জীবনেও। কেউ আবারও জড়িয়ে গেছে অন্যের জালে। ভেবেছে এপথে সে পাবে আলোর সন্ধান, পাবে মানসিক শান্তি। কেউ বা ভাবছে নামাজ কালামের মাঝে ফিরে পাবে তার সুখ শফিক পাবে কি সে?
শফিক চাইছে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বিকেলের রৌদ টা উপভোগ করতে। উপভোগ করতে চাইছে খোলামেলা ছোট্ট এপার্টমেন্টটা। পা বাড়ালেই মুভি হল। বায়ে মোড় নিলে বিশাল পার্ক। খাবারের বড় বড় রেস্টুরেন্ট গুলো বেশি দূরে নয়।
হাটা পথ।
আগের মতো অন্ধকার ঘর গুলো আর তাকে গ্রাস করবেনা। কিছুক্ষণ আগে সবাই কে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে নতুন ঠিকানা দিয়ে। অনেকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছে, নতুন জীবন নতুন ভাবে শুরু হোক এই কামনা করি। আমরাও একদিন হবো এপথের পথিক।
ফোন টা বেজে উঠল।
ওপাশে সামন্তীর কণ্ঠস্বর। বন্ধুত্ব অনেক দিনের।
কেমন লাগছে? নতুন জায়গা, নতুন ঘর। জিজ্ঞাসা করলো সে।
অনুভূতি টা তোমাকে ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবো না। বলল শফিক
আমরা চার বন্ধু বান্ধাবী শেষ তোমার বাসাতে রাত কাটিয়ে ছিলাম মনে পরে?
তা আর পরবেনা, তুমিই তো নিয়েছিলে সবচেয়ে বড় ঘরটা। এখন একটা শোয়া আর একটা বসার ঘর। পারবে এসে থাকতে? জিজ্ঞাসা করেছিল শফিক।
কোথাও থাকতে জায়গা লাগেনা, মন লাগে। সে মন আমার আছে শফিক। বলেছিল সামন্তী।
আজ রাখি। তুমি সব গুছিয়ে নাও। আসব একদিন। শুধু একটা কথা বলি তোমাকে,” I am so proud of you.” বলে ফোন টা রেখে দিয়েছিল।
সন্ধ্যা হয় হয়। পাশের বাড়ীর ঘর গুলোতে বাতি জ্বলে উঠল। এ দৃশ্য সে দেখেনি অনেক দিন। শুধু দেখে এসেছে বড় বড় বাড়ী। এক এক বাড়ীতে এক একটা ফ্যামিলি। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ঢেকে যেতো চারিদিক। পাশের বাড়ীর কুকুরটা মাঝে মাঝে চিকন সুরে ডাক দিতো। দু একটা গাড়ী সাঁ করে চলে যেতো।
আজ মনে হচ্ছে ছোট ছোট আলোর কনা চারিদিকে। উপরে, নিচে, মধ্যে। ঘরের মাঝে দু এক জনের চলাফেরা দেখতে পাচ্ছে শফিক তার বেলকনিতে বসে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
সামনে শীতের মাস। শফিককে ভাবতে হবেনা বরফ পরিষ্কারের কথা। ভাবতে হবেনা এন্টোনিও কে ডাকার কথা। বলতে হবেনা ড্রাইভওয়ে টা পরিষ্কার করে দিয়ে যাও আমার গাড়ী বের করতে হবে। এ কথা ভাবতে যেয়ে শফিকের মনে পড়ল অনেক বছর আগে ওরা ভেবেছিল পড়ন্ত বয়সে এই রকম এপার্টমেন্টে এসেই ঠাঁই নেবে, তবে সেটা হবে দুই থেকে তিন ঘরের।
কফি টা ফুরিয়ে এলো। আবার উঠতে হবে। ভাতের চাল টা বসিয়ে দিয়ে একটু বাহিরে হাটতে যাবে, ভাবল শফিক।
অনেক দিন ঝলমলে আলোর নিচে হাটা হয়নি। অন্ধকারে পাশের পার্কে যেতে মন চাইছে না। এসে দাঁড়াল ফুলের বাগানের চত্বরে। সামনে আলোয় আলোকিত রাস্তা। শফিককে ডাকছে। শফিক পা বাড়াল সেই পথে।
আজ আমার শেষ রাত এ বাসাতে। কাল বিদায়ের পালা। গাড়ীটা ড্রাইভওয়ে তে পার্ক করে এসে দাঁড়ালাম বহু পরিচিত সিঁড়ি গুলোর সামনে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। সামনের দরজার পাশের দুটো আলো জ্বলে উঠেছে। মনে হোল এতোঁ আলো নয়। দুটো জলে ভরা চোখ। আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে।
বলছে,” তুমি আর সে এসেছিলে, আমার গায়ের ঝুল ঝেড়ে, ছানীপরা চোখটা তে এনেছিলে নতুন আলোর রশ্মি । আমি আবার দুচোখ ভরে দেখতে পেয়েছিলাম। দেখতে পেয়েছিলাম ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হেটে যাওয়া পথ। ওরা মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখত আমাকে। দেখত আমার চারিদিকে লাল নীলে ভরা ফুল গুলো”।
বললাম,” আমিতো আর তোকে আগের মতো যত্ন করতে পারবো না, তাই তোকে দিয়ে যাচ্ছি অন্যের হাতে। সে তোকে আরও সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবে। আমি তোকে ভুলবো না। তোর মাঝে কতো স্মৃতি। সুখ দুঃখ দিয়ে ভরা। তোকে সে সাজিয়ে ছিল নিজে হাতে। বলেছিল, এ বাসাতে হবে আমার ছেলে মেয়ের বিয়ে। হয়েও ছিল। তোকে তখন আরও সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল।
মনে পড়ে? তোর পিছনের ডেকে বসে কতো সন্ধ্যা আমরা কাটিয়েছি এক সাথে।
থাকা আজ সেকথা । চোখে জল আসছে। এবার আমি ভিতরে যাবো। গোছাতে হবে।
দরজা খুলে ভিতরে এলাম। থরে থরে ছোট বড় বাক্স পেঁটরা বাঁধা। মনে হোল পাশের বাক্সটা দাপাদাপি করছে। উপরে লেখা হাঁড়িপাতিল।
মনে হোল আমাকে দেখে বলছে, তুমি আমাদেরকে এভাবে বন্দি করে রেখেছ কেন? খুলে দাও। জানো, আমাদেরকে অনেক দেখে, অনেক ভাবনা চিন্তা করে সে নিয়ে এসেছিল। আমার পেট টা বড়, তাই আমি ছিলাম তার প্রিয়। সুঘন্ধ এলাচ দারচিনী আরও কত কি সব আমার পেটের ভিতর দিয়ে তৈরী করতো পোলাও। সুঘন্ধে ময়ময় হয়ে যেতো সারা ঘর। তোমাকে বলত, আমাকে উনন থেকে নামিয়ে ওভেনের ভিতর দিতে। তুমি লক্ষ্মী ছেলের মতো তাই করতে, আর বলতে, আচ্ছা, এত সুন্দর করে রান্না করো কিভাবে।
তোমাকে সে বলত, বক বক না করে আদাটা ছুলে ছোট ছোট করে কেটে দাও, বেলেন্ডারে পিষতে হবে। দেখো, হাত কেটো না।
আচ্ছা, আমাদের কে তুমি কি বন্দি করে রাখবে সারা জীবন? নাকি ফেলে দেবে জঞ্জালে ভরা মাঠে।
না, তোদেরকে কি ফেলতে পারি? আমি তোঁ রাঁধতে পারিনা। তাই তোদেরকে আমার কাছে রাখলে তোরা অথর্ব হয়ে যাবি। তোরা যাবি আমার মেয়ের কাছে। সে তোদেরকে ঘসে মেজে সুন্দর করে রাখবে। সে তার মা র স্মৃতি ধরে রাখতে চায়।
কিছু বলবি ?
হাঁ, ছোট টা তোমার সাথে কথা বলবে।
কি হোল তোর?
আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। তোমার মনে নেই। আমাকে সে এনেছিল মেসীর একদিনের সেল থেকে। অর্ধেক দামে আমাকে বিক্রি করে দিচ্ছিল। অনেক কিছুর সাথে আমাকেও নিয়ে এলো। অন্যরা আমার চেয়ে বড়। তাদেরকে ব্যাবহার করতো মাঝে মধ্যে। দরকার বশত। আমি ছিলাম তার সকাল বেলার সাথি। সকালের চা সে বানিয়ে নিতো আমার মাঝে।
কোন কোন দিন আমাকে অল্প জ্বালে বসিয়ে ওট মিলের দানা ঢেলে দিতো। আমি উত্তপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সে বসে পিউপিল ম্যাগাজিন পড়ত। আমার ভিতরের জলটা দপদপ করে ফুটে উঠতেই সে হাতের চামচ টা দিয়ে আস্তে আস্তে নাড়ত যেন আমি আঘাত না পাই। এই সব স্মৃতি কি ভোলা যায়।
ঠিক আছে তুই আমার কাছে থাকবি।
বাক্সটা খুলে উঠিয়ে নিলাম ওকে। এটাতেই আমি শেষদিন গুলোতে বানিয়ে দিতাম ওট মিল। সাথে ঢেলে দিতাম এক চামচ প্রোটিনের গুড়া।
বললাম, তোকে দেখলে আমার মনে পড়বে ফেলে আসা দিনগুলি।
ওখানে কে?
আমরা, থালা বাসন কাপ পিরিচের দল। আমাদেরকে কার হাতে তুলে দেবে তুমি?
জানো, আমাদেরকে সে যোগাড় করেছিল বিভিন্ন জাগা থেকে। একদিন দেখি আমাদের ভাই বোনের সংখ্যা অনেক।
তুমি বলতে অনেক তোঁ আছে, এটাও লাগবে কি?
সে বলত এটা অন্য ধরনের, পার্টির সময় লাগবে।
অনেক লোক আসতো তোমার বাসায়। আমাদের ডাক পড়ত। ধুয়ে মুছে ফর্সা হয়ে আমরা বসে থাকতাম টেবিলের পাশে।
একে একে সবাই উঠিয়ে নিতো আমাদেরকে। বিভিন্ন রকমের খাবার দিয়ে সাঁজাতোঁ । অনেকে কাঁটা চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ করতো আমাদের পেটে পিঠে আঁচড় দিয়ে।
অনেক দিন সেই আঁচড় আর পড়েনা। তুমি কি আমাদের কে নিতে পারবে না তোমার কাছে?
বললাম, আমি চলেছি এক ছোট্ট জাগায়। তিন থেকে পাঁচজন কে নিতে পারবো আমার সাথে।
ভাবিসনে।
আমার মেয়ে,বৌমা তোদেরকে নিয়ে যাবে। ওদের ওখানে তোরা ভালো থাকবি। অনেক ইয়াং ছেলে মেয়েদের আনাগোনা সেখানে। আবার তোরা শূনতে পাবি টুংটাং শব্দ।
ওরা আমাদের কে যত্ন করবে তোঁ? যে ভাবে সে আমাদেরকে ধুয়ে মুছে উঠিয়ে রাখতো। নাকি ফেলে রাখবে বেসিনে। আরশোলা ঘুরে বেড়াবে আমাদের গায়ে পিঠে।
ওরা থাকে বড় বড় নামকরা বিল্ডিংএ। ওখানে আরশোলা নেই। আছে তোদের গোসলখানা। খাওয়া শেষে তোদেরকে দিয়ে দেবে সেইখানে। গরম জলে ধুয়ে, শুকিয়ে বেরিয়ে আসবি।
কি হোল, তোরা কাঁদছিস কেন?
আমাদের কথা মনে পরে ? আমরা তোমার ঘরের শোভা বাড়ানোতে মগ্ন ছিলাম। দেয়ালের চারিদিকে তাকালে সবাই আমদেরকে দেখতে পেতো। কত প্রশংসাই না করতো ।
ভুলে গেলে?
আমাকে এনেছিল ফরচুনঅফ থেকে। আর ওই কোনার টাকে এনেছিলে বম্বে গ্যালারি থেকে।
সে এই ফর্মাল লিভিং রুমে বসে আমাদের কে দেখত।
এখন, এখন আমরা কোথায় যাবো। তুমি আমাদেরকে ফেলে রেখে যাবে নাতোঁ?
না তোরা যাবি আমার সাথে। ছোট বাসা হলেও চারটা দেয়াল তোঁ আছে। তোদেরকে ওখানে ঝুলিয়ে দেবো। তোদের মাঝে থাকবে ওর ছবি টা। কি, খুশি তোঁ?
উপরে উঠে এলাম।
আমার ঘরে ঢুকতেই খাট টা বলে উঠল, “ আমাকে তুমি ফেলে দেবে শুনলাম? কেন? আমি কি দোষ করেছি? তোমাদের দুজনকে নিয়েই তোঁ ছিল আমার সংসার। আমি শুনতাম তোমাদের কথোপোকথন। পরে তুমি একলাই ছিলে, পাশের বালিশটা রেখে দিয়েছিলে একই জাগায়। সরিয়ে দাওনি। এসবের সাক্ষী তোঁ শুধু আমি একা। আমাকে ফেলে দিওনা। ”
তোকে আমি আমার কাছে নিয়ে যাবো ঠিক করেছি। এত বড় ঘর তোঁ নয়। ছোট্ট একটা শোয়ার, তার পাশে ছোট্ট এক চিমটে জাগা, ওটা বসার ঘর। প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে বৈকি।
চোখে জল আসবে জানি। সবই ভাগ্যের লিখন। তুই কি কখনো ভেবেছিলি তোকে এত বড় বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হবে একদিন। পিছনে ফেলে রেখে যাবি তিলে তিলে গড়া স্মৃতিগুলো।
থাক, কাঁদিসনে।
আমি শেষ বারের মত ঘুরে আসি সব ঘর গুলো। হাতে নিয়েছি ন্যাপকিনের বাক্সটা। এদেখাই শেষ দেখা। ফিরে এসে তোর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ব।
দৌড়ে এসেও ট্রেনটা ধরা গেলনা। কপাট টা বন্ধ হয়ে গেলো। বাহিরে গরম। পাতালের নিচে আরও বেশি। পরবর্তী ট্রেন টা আসতে একটু সময় লাগবে। কাজের দিন আজ। চল্লিশ মিনিট লাগবে ফীফথ এভিনিউ তে পৌছাতে। দশ মিনিটের মধ্যে ট্রেন টা যদি আসে তাহলে ঠিক সময়ে কাজে পৌঁছানো যাবে। অগত্যা পায়চারী করতে থাকলাম।
হঠাৎ ই চোখ পড়লো দূরে দাঁড়ান মেয়ে টার দিকে। নিতান্তই সাধা মাটা। পরনে ঘিয়ে রঙের প্যান্টের উপর কালো সার্ট। খুব একটা মানান শই নয়। সদ্য গোসল করে আসাতে ভিজে চুল লতিয়ে পরে আছে কাধের পর। হলিউড, বলিউডের নায়িকাদের মতো নয়, তবুও চোখ ফেরাতে পারলাম না। কাছে যাবো ভেবেও যাওয়া হলনা। ভাবলাম দূরে থেকেই দেখি।
এই দেখো, বাড়া ভাতে ছাই দিলো কেন ওই ভুঁড়ি ওলা লোকটা? ওর ভুঁড়িটা ঢেকে দিলো ওকে। রাগ হোল লোকটার উপর। এপাশ ওপাশ করে অনেক বার দেখার চেষ্টা করলাম। ভুঁড়িটা বিশাল পর্বত হয়ে দাড়িয়ে রইল আমার আর তার মাঝে। লোকটা একবারও আমার দেখা মেয়েটার দিকে তাকাল না। মনে হোল যেয়ে বলি,” অহে তুমি না হও রসকষ হীন, তাই বলে অন্যের চোখের তৃষ্ণার মাঝে বাঁধ বাধার তুমি কে? দয়া করে তোমার এই আকাশ চুম্বী ভুঁড়িটা নিয়ে ওপাশে যাবে কি? আমাকে আমার তৃষ্ণা মেটাতে দাও”। বলা হলনা। বলতে পারতাম কি না সেটাও সন্দেহের ব্যাপার।
ট্রেন এসে গেলো। লোকের ভিড় বেড়েছে। বসার জাগা নেই। রেলিং টা ধরে দাঁড়ালাম, তাকালাম সেই দিকে যে দিক দিয়ে ওর উঠার কথা। না, সেও উঠেছে একিই কামরায়। আগের থেকে দূরত্ব একটু কম।
চোখে কাজল পরেছে একটু গাঢ় করে। ইদানীং চৌকস মেয়েদেরকে এত গাঢ় করে কাজল পরতে দেখিনি। তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
ষ্টেশনে থামতেই আরও কিছু লোক উঠল। ভিড়ের চাপটা অনুভব করলাম। দুজনের হাতের মাঝ দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওর নাক ফুলটা। ডায়মন্ড নয়। হয়ত জারকনীয়া। ওটা মানিয়েছে ওর নাকে। বাঁশির মত নাক নয় আবার চ্যাপ্টাও নয়। দুয়ের মাঝে।
আচ্ছা, পাশের লোকটা বড় বেশি ওর গায়ের সাথে ঘেঁসে দাঁড়িয়েছে। কোন অভিসন্ধি নেইতো ? ছয় ফুট উচু লোকটা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি মেয়েটার দিকে বার বার তাকাচ্ছে কেন? ভিড় ঠেলে কাছে যেয়ে বলব নাকি,” এই, তোর ঐ ঘামে ভেজা শরীর টা দিয়ে ওকে চাপ দিচ্ছিস কেন?” ভয়ও হোল। আমি পাঁচ-ছয়। গলাটা টিপে ধরলে জানটা নিয়ে ফিরে আসতে পারবো না।
অগত্যা ঐ চিন্তা বাদ দিলাম।
একটু অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আবার ঘাড় ফেরাতেই ওকে আর দেখা গেলনা। তাহলে? কোথায় গেলো? স্টেশন তো আসেনি। বুকের মাঝে শিরশির করে উঠল। এই কি প্রেম? সেই গানটা মনে পড়ল,” তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে”। ভাবলাম সামনা সামনি হলে এই গান দিয়েই ওকে প্রথম সম্বোধন করব। কিন্তু আমার ভাষা যদি সে না জানে? ইংরেজিতে তর্জমা করার মত বিদ্যে আমার নেই। তাছাড়া আসল মানেটাও ফুটে উঠবে না। তাহলে? মাথার মধ্যে শত চিন্তা।
সীটে বসে পড়েনি তো? না, তাই বা কি করে হবে। কেউ তো উঠা নামা করেনি। ঐ লোকটাই যত নষ্টের মুল।
ঐ তো। জানালার কাঁচে ওর অবয়ব টা দেখা যাচ্ছে। হয়ত ডান হাতটা অবশ হয়ে এসেছিল। হাতটা পাল্টাতে যেয়ে সরে গিয়েছিল শরীর টা। এই ভালো হোল। জানালার কাচেই ওকে দেখব। জানালাটার নিচেই বসা আর একটি মেয়ে। ও না ভাবে আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি? আসলে আমিতো দেখছি জানালায় ওর ছবি।
কয়েকটা চুল ওর কপালের উপর আসে পড়েছে। কি অপরূপ দেখাচ্ছে। আহা! আমি যদি আঁকতে পারতাম তবে এই ছবির স্থান হতো মনালিসার পরে। বড় বড় সমজদাররা ব্যাখ্যা করতে বসতো এই ছবি নিয়ে। বিভিন্ন ধরেনের বিশ্লেষণ হতো। আমরা হয়ে যেতাম বিশ্ববিখ্যাত। ওর কপালে পড়ে থাকা চুল আরা আমার হাতের কাজ।
ঝাঁকি দিয়ে ট্রেনটা থামতেই ফিরে এলাম বাস্তবে। এতো আমার স্টেশন। ফীফথ এভিনিউ। নামা হলনা। আসলে নামতে ইচ্ছে করল না। ওর সাথেই আমি যাবো। আমার যাত্রা শেষ হবে ওর ষ্টেশনে।
প্রতিদিনই তো কাজে যাই। আজ না হয় নাই বা গেলাম। অজুহাত দেওয়া যাবে। পেটে ব্যাথা। ইচ্ছে থাকা সত্তেও আসতে পারেনি কাজে। পেটে ব্যাথা চোখে দেখা যায়না। হাত দিয়ে অনুভব করা যায় না। এ জ্বর নয়। টাইলিনল খেলেই চলে যাবে না। কাজেই আমি নিশ্চিত।
ট্রেনটা থামল ষ্টেশনে। কিছু লোক নেমে গেলো। উঠল দু এক জন। ও সরে আসে দাঁড়াল, সোজা ভাবে। এবার আমি ওর পূর্ণ শরীর টা দেখতে পেলাম। পায়ে অল্প হিলের স্যান্ডেল। রং টা বোঝা গেলনা। হয়ত পুরান। আমার কাছে মনে হোল এই রং টাই মানিয়েছে। তাকাল সে আমার দিকে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকালাম কামরার ছাদের দিকে। গুনতে থাকলাম কতো গুলো পেরেক গেথে এই ছাদ টা বানাও হয়েছে। ভাবলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখছে, আমার কথা ভাবছে। এই ভাবনা টা ভাবতে আমার খুব ভালো লাগলো। এবার কড়িকাঠ গোনা শেষ করে তাকালাম ওর দিকে। ও ফিরে দাঁড়িয়েছে। কাধের ব্যাগটা কে ঠিক করে নিলো। পিছনে পড়ে থাকা চুল গুলো ডান হাত দিয়ে একটু এলোমেলো করে দিলো। আমার মনে হোল যেন সাগরের ঢেউ আসে আছড়ে পড়লো ওর পিঠে।
আমিও ঠিক করে নিলাম আমার ব্যাগ টা। কি বলে সম্বোধন করবো সেটা ঝালাই করে নিলাম। আমি এদেশে আছি অনেকদিন। জানি, হিতে বিপরীত হলে “সরি” শব্দটা আগুনে জল দেওয়ার মতো কাজ করবে। যেমন করে পলিটিশিয়ান দের ব্যাপারে। ডাহা মিছে কথা বলে পরের দিন “সরি” বলে নুতন দিনের সুচনা করে।
আমি মিছে কথা বলতে চাইছি না, আমার মনের ভিতর তার যে অবয়ব আমি এঁকেছি তারই প্রকাশ। বলব তারে,” সবই তো শুনলেন। কাজের শেষে বসবেন ঐ রেস্তোরায় এক কাপ চা খেতে”?
হয়ত গটমট করে চাইবে, নয়ত বলবে , আমি বিবাহিত অথবা এনগেজড। এনগেজড আমি সামলাতে পারবো। বিবাহিত হলেই মুশকিল। কাজেই উপরওয়ালার নাম জপতে লাগলাম।
ট্রেনটা চলতে শুরু করলো। এক মিনিটের মধ্যে আসে দাঁড়াল ষ্টেশনে।
এক্সকীউজ মি বলে সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। আমিও লোকদের পাশ কাটিয়ে আসে দাঁড়ালাম ওর একটু পিছনে।
দরজা খুলে গেলো। ও তড়িৎ বেগে নেমে হাঁটতে থাকলো গেটের দিকে। আমি একটু পিছিয়ে পড়লাম। দুজন কে ধাক্কা দিয়ে, দুজনের পাশ কাটিয়ে আসে পৌছালাম ওর একটু পিছনে। আমাকে দাড়াতে হবে ওর পাশে। নচেত কথা গুলো বলব কি ভাবে?
ও কাঠবেরালির মতো দু তিন ধাপ দিয়ে সিঁড়ি গুলো পেরিয়ে আসে দাঁড়াল রাস্তায়। আমি আবারও পিছিয়ে গেলাম কিছুটা।
রাস্তায় আসে তাকালাম দুদিকে। দেখলাম সে দাড়িয়ে রাস্তার কোনায়। এগিয়ে যেতেই দেখলাম ওপার থেকে দৌড়ে এলো একটা মেয়ে। জড়িয়ে ধরল ওকে। গভীর ভাবে চুমো খেলো। দুজনে মিশে গেলো একে অন্যের মাঝে। থেকে থেকে চুমো দিতে লাগলো একে অপরকে। হাত ধরাধরি করে পেড়িয়ে গেলো রাস্তা টা।
আমি তাকিয়ে দেখলাম। ভাবলাম এই হোল ভালো। আমার আঁকা ছবি থাক আমারি মাঝে। ফিরে দাঁড়ালাম। পা বাড়ালাম পাতাল রেলের সন্ধানে।
“ সাপের খেলা সাপের খেলা কে দেখবি আয়” এই বলে চিৎকার করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত গফুর। বড় এক
লাঠির দুপাশে দুটো বাক্স। তার ভিতর গোখরো, চন্দ্রবোড়া, কালসাপ। আমরা ছোট ছোট ছেলেরা ওর পিছন পিছন যেতাম, বলতাম, “ গফুর ভাই, নতুন সাপ ধরেছ? অজগর?” হাসি দিয়ে বলত,” ধরেছি। বড় গোখরো। বিষ দাত এখনও আছে। দেখবি আয়”। ভয়ে আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে যেতো। রহিমের ভয় ডর ছিল কম। ও এগিয়ে যেতো। আমরা ওর পিছনে।
গফুর ভাই আবারও হাসি দিয়ে বলত,” এই বাক্সটা তে হাতদে”। রহিম হাত ছোঁয়াতেই ফোঁস করে শব্দ। আমরা দৌড় দিতাম। রহিম হি হি করে হাসত।
আমার বয়স তখন দশ। গফুর প্রায় আসতো আমাদের বাসাতে। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে বসতো এসে বারান্দায়। বাক্স দুটো পাঁশে রেখে গামছা দিয়ে মুখটা মুছে দালানে হেলান দিয়ে বসত । আমি বাক্স গুলোর পাঁশে ঘুর ঘুর করতাম। গফুর আমার দিকে তাকিয়ে বলত,’ দাড়া, তোকে বড় গোখরো সাপের খেলা দেখাই”। বলে বাক্স থেকে বের করতো গোখরো সাপটা। ফোঁস করে ফনা বের করে হেলে দুলে দাঁড়াত সে। গফুর তার হাতের বাঁশীটা বাজাতেই সাপ টা মাথা নাড়িয়ে ছোবল দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতো গফুরের দিকে। আমি ভয়ে লাফ দিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরতাম। গফুর খপকরে সাপটার গলা ধরে ফেলতও। আস্তে করে ছেড়ে দিতো বাক্সটার মধ্যে। সুবোধ বালকের মতো গোল হয়ে শুয়ে পড়ত সে বাক্সটার মাঝে।
মা বলত,” গফুর, দুপুরে কিছূ খেয়েছিস?”
“না, খালাম্মা”।
“ তা খাবি কেনও? সারাদিন এই রৌদের মধ্যে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়িয়েছ ?” মা রাগ করতো।
গফুর হাসত।
আমার মনে হতো মার একটা আলাদা টান আছে ওর উপর। গফুরও সেটা বুঝত।
মা ডাকতো ওকে রান্না ঘরে। বলত,” আয়, এখানে বসে খেয়েনে।“
মাকে হারিয়েছে সে ছোট বেলায়। তখন ওর বয়স ছিল ছয়। বাবা ছিল কাঠের মিস্ত্রি। পাশের বাসার কানুর মার কাছে রেখে কাজে যেতো। এই ভাবে দুটো বছর কাটল। বাবা আবার বিয়ে করলো। ভেবে ছিল বৌ এসে ছেলেটাকে দেখে শুনে রাখবে।
বিঁধি বাম। হোল উল্টো। গফুর হোল সৎমার চোখের শুল।
বাবা ওকে ভর্তি করে দিয়ে ছিল ক্লাস ওয়ানে। রং চং এ আঁকা বই নিয়ে সে যেতো স্কুলে। ওরই মতো গুঁড়ি গুঁড়ি বাচ্চাদের সাথে। স্কুল থেকে ফিরে আসতো হাতে পায়ে ধুলো মেখে। বাবা কাজ সেরে ফিরে এসে ছেলের হাত পা মুখ ধুইয়ে দিতো। পাঁশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করত,” আজকে কি শিখেছ ক্লাসে?”
গফুর তার বইটা বের করে দেখাতো বাবা কে।
সেই দিনগুলো শেষ হয়ে গেলো খুব তাড়াতাড়ি।
তিনটে মাস যেতে না যেতে সৎমার আসল রুপ বেরিয়ে এলো। স্কুল থেকে এসে মার কাছে বলত,” মা খিদে পেয়েছে? খাওয়া দাও।“
ঝামটা মেরে উঠত কামিলা। “ ছেলে আমার নেদা পড়া করে এসেছে। খাওয়া দাও”।
কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যেতো গফুর।
বছর না ঘুরতেই বাবা বুঝতে পেরেছিল এ বাসায় গফুরের স্থান নেই। এদিকে কামিলা সন্তান সম্ভবনা।
একদিন কাজ থেকে ফেরার পথে এসেছিল গফুরের মামা বাড়ী। বলল সব কথা। গফুর কে তারা স্থান দিতে পারবে কিনা। জয়নাল উদ্দিন না করে নি। গফুর এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল মামার বাসায়। গফুরকে রেখে বাবা চোখ মুছতে মুছতে চলে যাওয়ার আগে বলেছিল,” ভালো থাকিস বাবা। আমি আবার আসব তোকে দেখতে”।
মামা সাপুড়ে। মামার কাছেই গফুরের হাতেখড়ি। মামার সাথে যেতো সাপ ধরতে। শিখিয়েছিল কোন সাপ কিভাবে ধরতে হয়। স্কুলে আর যাওয়া হয়নি গফুরের। তার বদলে শিখে ছিল বাঁশি। বাঁশির তালে তালে সাপের নাচ দেখত সে।
একদিনের জ্বরে মামী চলে গেলো সবাই কে ছেড়ে। মামা ভেঙ্গে পড়ল। গফুর তখন ষোল বছরের যুবক। মামার উপযুক্ত ছাত্র সে। ধরেছিল হাল। মামাকে বলেছিল বিশ্রাম নিতে। সাপের বাক্স নিয়ে বেরিয়ে পরেছিল রাস্তায়।
“ সাপের খেলা সাপের খেলা কে দেখবি আয়” বলে ঘুরত রাস্তায় রাস্তায়। জড়ো হতো লোকেরা। বাচ্চারা চোখ বড় বড় করে দেখত সাপের খেলা। লোকে ছুড়ে দিতো পয়সা।
এমনি ভাবে ঘুরতে ঘুরতে এসেছিল সে আমাদের বাসায়। মাকে বলেছিল,” সাপের খেলা দেখবেন খালাম্মা?”
“দেখাও, বয়স কতো তোমার?” মা জিজ্ঞাসা করেছিল।
খেলা শেষে মা আলমারি খুলে কয়েকটা টাকা এনে ওর হাতে দিয়ে ছিল। বলেছিল, বসো,
পাটালি আর মুড়ি এনে ওর সামনে দিয়ে বলল,” খেয়ে নাও। সারাদিন নিশ্চয় কিছু খাওয়া হয়নি”?
সেই থেকে দেখেছি গফুর দিনের শেষে একবার হলেও মা কে দেখা দিয়ে যেতে।
একদিন মা আমাকে ডেকে বলেছিল,”শোন, ভাগ্যের খেলায় হয়ত গফুর হেরে গেছে কিন্তু সে তোমার বড়, তাঁকে ভাই বলে সম্বোধন করবে”। সেই থেকে সে আমার গফুর ভাই। মাঝে মাঝে গফুর ভাই আমার জন্য নিয়ে আসতো লেবেঞ্চুস।
বলত,” মা কে দেখিও না, এখনি খেয়ে নাও”।
এক ঈদে নামাজ শেষে গফুর ভাই এসেছিল মার সাথে দেখা করতে। পরনে পুরানো পাজামা, পুরানো জামা। মাকে সালাম করল। মা ওকে বসতে বলে ভিতরে গেলো। ফিরে এলো নতুন পাজামা পাঞ্জাবি হাতে। বলল,” গফুর এটা পরে এসো”।
গফুর ভাই তাকিয়ে ছিল মার দিকে। এই প্রথম তাঁকে কাঁদতে দেখে ছিলাম। মা কে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদে ছিল।
বলেছিল,” মার চেহারা মনে পরেনা, তুমিই আমার মা”।
অনেক বছর পেরিয়ে আমি তখন স্কুলের শেষ বর্ষে। পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। একদিন মা ডাক দিলো। বলল,” খোকা, গফুর তো বেশ কিছু দিন হয় আসেনি ।একটু ওর বাসায় যেয়ে দেখবি। ভালো আছে কিনা”?
জানি, না করার উপায় নেই।
যাচ্ছি, বলে বাবার সাইকেল টা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পনের মিনিটের পথ। বাসার চত্বরে এসে জোরে ডাক দিলাম।
গফুর ভাই ডাক শুনে বলল,” ঘরে আয়”।
ঘরে ঢুকে দেখি গফুর ভাই চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। নিচে একটা ছোট গামলা। তার মধ্যে লালচে দাগ।
”কি হয়েছে তোমার”? জিজ্ঞাসা করতেই বলল
“ জ্বর, তবে—-“ কথা শেষ হলনা। ভীষণ ভাবে কাশতে থাকলো। একটু থেমে কফটা থু করে গামলাতে ফেলতেই মনে হলও রং টা লালচে।
আমি কিছু বলার আগেই সে বলল,” জানিস পীন্টু, একটা অনেক বড় গোখরো ধরেছি। এখনও বিষদাঁত ভাঙ্গা হয়নি। চল তোকে দেখাবো”। বলে উঠতে গেলো। পারলনা। মাথাটা টলকে উঠল। শুইয়ে দিলাম বিছানায়।
বললাম, কাল এসে আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
বাড়িতে এসে মা কে বললাম, গফুর ভাই এর শরীর খুব খারাপ । তুমি যাবে?
হাঁ, কাল আমাকে নিয়ে যাবি। ওর জন্য খাবার নিয়ে যাবো। তোর বাবা কে বলিস ভালো একটা রিক্সা ঠিক করে দিতে।
সেই কাল আর আসেনি।
সকালে এসে জাফর খবর দিলো, গফুর মারা গেছে সাপে কেটে ।
সাইকেল চালিয়ে দ্রুত যেয়ে পৌছালাম। অনেক লোক এসেছে। দৌড়িয়ে গেলাম বাক্সটার কাছে। ডালা খোলা। বিষধর গোখরো টা নাই।
পাঁশে পরে আছে গামলাটা, জমাট রক্ত।
আমি কাঁদছি। মনে পড়ছে সেই লেবঞ্চুসের কথা। মনে পড়ছে ঈদের দিনে মা র দেওয়া নতুন জামা,পাজামা পরে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,”দেখত আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?”
মনে হচ্ছিল ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেই। বলি, চলো গফুর ভাই, সময় তো হোল, বাঁশি টা নাও, ডাক দাও ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দেরকে, বলও,” সাপের খেলা সাপের খেলা কে দেখবি আয়”।
আকাশ ভেঙ্গে জল ঝরছে। আনন্দ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। লাবন্য আর আমেনা এসেছে আজ চার মাস হয়ে গেলো। কি ধুমধাম করেই না ওরা গিয়েছিল এয়ারপোর্টে ওদেরকে আনতে। সু, দীপ, রেজ, বৌমা গল্পে মেতে গিয়েছিল লাবন্যর সাথে। লাবন্যকে বুঝতে দিলোনা সে নতুন কোন জাগায় এসেছে। লাবন্যও মিশে গিয়েছিল ওদের সাথে। আমেনার চোখে জল। আমেনা বলেছিল,” দাদা এতো সুন্দর করে ওদেরকে মানুষ করেছিলে কি ভাবে?”। প্রতি উত্তরে আনন্দ বলেছিল,”কৃতিত্ব তার, আমার নয়”।
সানন্দা বাসাতে ছিল ওদেরকে অভ্যর্থনা করার জন্য। খাওয়া শেষে বলেছিল আমেনাকে “ এবার তুমি বুঝে নাও। আমার শেষ, তোমার শুরু”।
“তাতো হবার নয়। আমি তার বোন, তুমি তার বন্ধু। তুমি যা দিতে পারবে আমি তা দিতে পারবো না। তোমার সাথে কথা বলে তার যে আনন্দ, আমার সাথে তা সে পাবেনা। কাজেই তোমার ছুটি নেই, বোন”।
আজ হঠাৎ করে কেন এসব মনে পড়ছে আনন্দ জানেনা।
“কি ভাবছ কাকুমনি?”
লাবন্য দাড়িয়ে। আনন্দ তাকাল ওর দিকে। খুব সুন্দর করে সেজেছে। বৌমা,সু মিলে শিখিয়েছে কোন রং এর সাথে কোন রং যাবে।
“কোথায় যাবে?”
“দীপ ভাইয়া, সু আর ভাবী আসবে নিতে। আটলানটিক সিটি তে যাবো। তুমি কি ভাবছ”?
সে কথার উত্তর না দিয়ে আস্তে করে ওর কপালের চুল টা সরিয়ে দিলো আদর করে।
ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল মহীউদ্দীনের কথা। মেয়েটাকে সে দিয়ে গেছে তার হাতে। এ যে কত বড় দায়ীত্ব আনন্দ ছাড়া আর কেউ জানেনা। মানুষ করে দিয়ে যেতে হবে ওকে। তুলে দিতে হবে ভাল পাত্রের হাতে। আনন্দের কতটুকু সময় আছে সে নিজেও জানেনা। ওর জন্য একটা ফান্ড খুলেছে বাঙ্কে। আনন্দের অবর্তমানে দীপ আর সু র উপর দায়ীত্ব দিয়েছে দেখাশুনা করার।
দীপ আর সু বলেছিল,” তোমার এই হার্ট ব্রেকীং কথা বার্তা একটু থামাবে?”। সানন্দাও তাতে যোগ দিয়েছিল। আমেনা অন্য দিকে তাকিয়ে শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছেছিল।
সু র চীৎকার শুনে আনন্দ ফিরে তাকাল। চীৎকার লাবন্যর সাঁজ দেখে। “ অপূর্ব লাগছে দেখতে। খুব সুন্দর হয়েছে”,
বলে আনন্দের কাছে এসে বলল,” কেমন আছো আব্বু?”।
“ ভাল, কখন ফিরবে?”।
“রাত হবে, লাবন্য আমাদের বাসায় থেকে যাবে”। বলে আমেনার কাছে চলে গেলো।
কথা শেষে ওরা উঠে গেলো গাড়ীতে। আনন্দ তাকিয়ে থাকলো। গাড়ীটা মোড় নিতেই আনন্দ ফিরে তাকিয়ে দেখল আমেনা পাশে দাড়িয়ে।
“বলবি কিছু?”
“তুমি বেশি আস্কারা দিচ্ছ মেয়েটা কে’?
“ ভাবিস না। এদেশে থাকলে এদেশের মতো করে মানুষ করতে হবে। কিছুটা ছাড়তে হবে আবার কিছুটা টানতে হবে”।
“ তুমি যা ভাল বোঝ তাই কর”।
“ সানন্দা আসবে না আজ?” জিজ্ঞাসা করল আনন্দ
“আসবে, একটু দেরী হবে বলেছে”। বলে আমেনা চলে গেলো রান্না ঘরের দিকে।
বাহিরে বৃষ্টি। তবুও জানালাটা একটু খুলে দেবে ভাবল। ঘরটা গুমট হয়ে রয়েছে। তাপমাত্রা আজকে নব্বই এর উপরে যাবে। জানালাটা খুলতে যাবে ফোন টা বেজে উঠল। ফ্লরেন্তার ফোন। অনেকদিন ওর সাথে কথা হয়নি আনন্দের।
হ্যালো বলতেই ফ্লরেন্তা কল কল করে উঠল। মনে হোল তার মন আজ আনন্দে ভরপুর।
“কি ব্যাপার? খুব মুডে আছো মনে হচ্ছে?”
“ সত্যি তাই। একজনের সাথে ডেটিং করছিলাম অনেকদিন ধরে। মনের মত। গতকাল সে প্রপজ করেছে”।
“কনগ্রাচুলেশন! তা সে ভাগ্যবানটা কে?”
“দেখা হয়েছিল আমার এক বান্ধবীর পার্টিতে”।
“ আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি। শুভদিনটা জানিও। অবশ্যই যাবো”। বলল আনন্দ।
কথা শেষে জানালাটা খুলে দিলো। বৃষ্টিটা কমে এসেছে।
কখন যে আমেনা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি আনন্দ। “ কিছু বলবি?”
“ কে ফোন করেছিল?”
“ ফ্লরেন্তা, মনে আছে তোকে বলেছিলাম, লন্ডনে থাকে। ওকে প্রপজ করেছে ওর ফীয়ান্সে”।
“একটা কথা বলি দাদা” “বল”
“ কয়েক দিন থেকে দেখছি তুমি বুকের বা পাশটা হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখো। কেন”?
“ ওসব নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবেনা।“ বলল আনন্দ
“ আমি সানন্দা দি আর সু কে বলব ভাবছি। যদি কিছু করতে পারে তবে তারাই পারবে”।
আর একটা কথা আছে।
কি?
“একটু চিন্তা করে দেখবে কি? অনেক দিন তো হোল”।
আনন্দ তাকাল আমেনার দিকে। কিছু বলল না।
ডি অ্যান্ড জে আবার ভরে উঠেছে কোলাহলে। রাশেদ ছাড়াও আরও দুজন যোগ দিয়েছে এই ফার্মে। ডেভিড একদিন আনন্দকে ডেকে নিয়ে বলেছিল ,” এবার আমার গুছানোর পালা। রিটায়ার করব ভাবছি। জেনীফারও চাচ্ছে অবসর নিয়ে বাকি দিন গুলি একসাথে ঘুরে বেরিয়ে কাটিয়ে দিতে”।
না, উত্তর দিয়ে ছিল আনন্দ। “ জানি বয়স অনেক হোল। সব ছেড়ে দিলে বুড়ীয়ে যাবো তাড়াতাড়ি। আজকাল বাহিরে একেলা যেতে ভরসা পাইনা। দুটো স্টেনট লাগানো। যদি কিছু হয় তবে এখানেই হোক। বাহিরে কিছু হলে টানা হেঁচড়া করবে কে?”
কথা ওখানেই শেষ হয়েছিল।
তিন টা বছর চলে গেলো জীবনের খাতা থেকে। কত কিছুই ঘটে গেলো। লাবন্য চলে গেছে হোস্টেলে। ডেভিড অবসর নিয়ে বাস করছে ফ্লোরিডায়। দীপ আর সু র পরিবারে যোগ হয়েছে দুটো কীউটি পাই।
ডেভিডের ফেয়ারওয়েল পার্টি হয়েছিল খুব ধুমধাম করে। সবাই এসেছিল। এসেছিল বেলাল-কল্যানী, এমিলির বাবা,মা, এসেছিল জনের মা। আনন্দ বলেছিল সবাইকে। ওদের মধ্যে দেখেনি কোন হিংসাত্মক ভাব। ডেভিড সবাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিল সে যা পেয়েছে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু নয়।
এক অলস বেলায় আনন্দ বসেছিল Drawing রুমে। নতুন একটা বই দিয়েছে তার বন্ধু ফেরদৌস। সেই বই এর মধ্যে ডুবে ছিল। অন্ধের কাহিনী। জন্মান্ধ। পৃথিবীর সৌন্দর্য সে দেখেনি। নিজে তৈরী করে নিয়েছে। সে দেখেনি সুন্দরের পাশে অসুন্দর। অপূর্ব লেখা।
কলিং বেলটা বেজে উঠল। একটু বিরক্তই হয়েছিল আনন্দ। এই ভঁর দুপরে কে এলো?।
আমেনা দরজাটা খুলে বলল,” এসেছ, এসো”। মনে হোল যে এসেছে তাকে সে আসা করছিল।
আনন্দ তাকাল। Drawing রুম থেকে দেখা গেলনা। জিজ্ঞাসা করল,” কে এসেছে আমেনা?”
“সানন্দা দি”।
সানন্দা, এই সময়?
“কেমন আছো?” বলে এসে দাঁড়াল সে।
“ এই ভঁর দুপুরে?”
“কেন? আসতে নেই? এসেছি আমেনার সাথে গল্প করতে”।
আনন্দ হাসল। সানন্দা চলে গেলো আমেনার ঘরে।
আনন্দ বইটা উঠিয়ে নিলো চোখের সামনে।
“দাদা”।
ডাক শুনে তাকাল আনন্দ। আমেনা আর সানন্দা সামনে দাড়িয়ে। মনে হোল কি যেন হয়েছে। হাসি হাসি মুখ নয়। আনন্দের বুকটা ধক করে উঠল।
“ কি কিছু বলবি?”
“হা। লাবন্যর ব্যাপারে”।
“ কি হয়েছে ওর?”
“একজন কে তার পছন্দ। তবে–”।
“ কে সে?”
“এদেশি” ভয়ে ভয়ে বলল আমেনা। “ আমেরিকান”।
“তা অসুবিধাটা কোথায়? যদি উদার মন হয়। আমার মেয়েকে ভালবেসে সুখী রাখতে পারে সারা জীবন, তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই”।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমেনার। ভেবেছিল আনন্দ রাজি হবেনা। যদিও সানন্দা বলেছিল,” দেখো, তোমার দাদা আপত্তি করবেনা যদি ছেলে ভালো হয়”। সানন্দা আজ এসেছিল শুধু আমেনাকে সাহস দেওয়ার জন্য। কথার জের টেনে সে আমেনার দিকে তাকিয়ে বলল,” তোমার দাদাকে বলেছ যে ছেলে মুসলমান হতে রাজি আছে”। আমেনা মাথা নেড়ে সাই দিলো। আনন্দ দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,” তোমার মেয়েকে বলো, ওকে একদিন ডিনারে নিয়ে আসতে। সু,দীপ,রেজ বৌমা কেও ডেকো। যদিও জানি ওরা সবই জানে”। একটু থেমে বলল,” এক কাপ কফি নিয়ে আয় আমার জন্য”। আমেনা যাওয়ার আগেই সানন্দা বলল,” তুমি বিশ্রাম নাও আমি বানিয়ে আনছি”।
“ কার্ডিওলজীস্টের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করেছি আগামীপরশু সকাল দশটায়। আমি নিয়ে যাবো”।
আনন্দ জানে এখানে দর কষাকষি করে লাভ নেই। অগত্যা মাথা নেড়ে সাই দিল। বলল,” এই ভাবে আর কতদিন ঠেকা দেবে।“
“আল্লাহ যতদিন আমাকে দিয়ে করতে দেয় ততদিন করে যাবো”। বলে খালি কফির কাপটা হাতে নিয়ে উঠে গেল রান্না ঘরের দিকে।
আরও একটা বছর কোথা দিয়ে চলে গেলো। লাবন্যর বিয়ের কথা বার্তা চলছে। মাঝে মাঝে সু, দীপ বিচ্ছু দুটোকে রেখে যায় আনন্দের কাছে। ওরা আনন্দকে ঘোড়া বানিয়ে পিঠে চড়ে খেলা করে। আমেনা হাসে। আনন্দ ভুলে যায় সব কিছু।
সেদিন আমেনাকে ডেকে আনন্দ বলেছিল,” তুই কি জানিস সানন্দা কোথায়? বেশ কিছুদিন হোল সে কলও করে না আসেও না। আমি কল করেছিলাম, উত্তর নাই”।
“ না জানিনে তো,” বলে তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে চলে গিয়েছিল।
বেলা পড়ে এসেছে। পশ্চিমের আকাশ টা লাল রংএ ছেয়ে গেছে। আনন্দ বাহিরে Deckএ বসে চোখ বূজে রবীন্দ্র সংগীত শুনছিল আর ভাবছিল, কত কিছুই না দেখল সে। এমিলি, জন চলে গেলো। ফ্লরেন্তা পেলো নুতন জীবন। ছোট্ট বোবা মেয়েটাও কোথায় হারিয়ে গেলো। মহীউদ্দীনের সেই হাসিতে উদ্ভাসিত উজ্জ্বল মুখ। আর সবশেষে সানন্দা। হাঁ, সানন্দা, ভাবনাটা শেষ হলনা। ডাক শুনতে পেলো।
“কেমন আছো?”
আনন্দ তাকাল। সানন্দা। “ এতদিন কোথায় ছিলে?”
সানন্দা সে কথার উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল আনন্দের মুখের দিকে। কি যেন বলতে চাইছে।
“কিছু বলবে?”
“ভাবছি কথাটা কীভাবে বলব। সহজ ভাবে বলার নয়”।
“ তা নাইবা বললে”। বলল আনন্দ।
“ বলতে আমার হবেই। আর সেই জন্যই এই কদিন তোমার সামনে আসেনি। সাহস সঞ্চয় করছিলাম। আজ তোমার সামনে এসে সেই সাহস আমি হারিয়ে ফেলেছি , আনন্দ দা”।
“নির্ভয়ে বলো”।
“আমি চলে যাচ্ছি, আনন্দ দা, আমি চলে যাচ্ছি নিউইয়র্ক ছেড়ে”।
স্ল্যাইডিঙ্গ ডোরের ওপাশ থেকে ভেসে এলো আমেনার কান্নার ফুঁপানো শব্দ।
আনন্দ চেয়ে রইল সানন্দার দিকে। বুকের মাঝটা খালি হয়ে এলো। মনে হোল অনেক কিছু সে হারিয়েছে জীবনে, আজ আবারও কি যেন সে হারাতে চলেছে।
অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞাসা করলো, “ কোথায়”?
“ডালাসে, আমার বোনদের কাছে”। বলে চোখ মুছলো ওড়নার আঁচল দিয়ে।
কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে থেকে আনন্দ বলল,” তুমি তো জানো, আমার জীবনটা ছিল আনন্দে ভরপুর, সে তার সব কিছু উজাড় করে দিয়েছিল আমায়। মাঝ পথে এসে একদিন দেখলাম সে নেই। খুঁজেছি তাকে পর্বতের শিখর চুড়ায়। আবার ফিরে এসেছি চার দেয়ালের মাঝে। খুঁজেছি ঘরে ঘরে। খুঁজেছি ধু ধু মাঠের প্রান্তে যেখানে সবাই ঘূমায়ে। অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসেছিল। সেই সময় তুমি কোথা থেকে এসে সেই ভেসে যাওয়া নৌকাকে পাড়ে নিয়ে এলে। তোমার সাথে গড়ে উঠল এক অমঘ বন্ধুত্ব। যা ভাঙ্গার নয়। আমি চেয়েছিলাম এক কথা বলার সাথী। তুমি এলে সেই কথা বলার সাথী হয়ে। তুমি বলেছিলে,” সে হারিয়ে যায়নি আনন্দ দা। তোমার পাশে পাশেই আছে। আমাকে দেখো, আমিতো বেচে আছি সন্তানদের আঁকড়ে ধরে। তোমাকেও বাঁচতে হবে”। সেই থেকে তুমি ছিলে আমার পাঁশে।
মনে পড়ে? তোমার বাসায় ডিনার শেষে তুমি বলেছিলে, “এক টুকরো মাছ আছে, দিয়ে দেবো”? সে দেওয়া তো আজও থামেনি, শুধু দিয়েই গেলে, নিলেনা কিছু”। বলে আনন্দ থামল।
“ না,তুমি আমাকে দিয়েছ অনেক, তুমি আমাকে শিখিয়েছ, কি ভাবে কথা বলতে হয়। যে আমি দু মিনিটের বেশি কারো সাথে কথা বলতে পারতাম না, সেই আমি তোমার সাথে ঘণ্টা ধরে কথা বলি, সে তো তোমারই দান, আনন্দ দা। তুমি বলতে, আমি জেনো কখনো নিজেকে ছোট না ভাবি, বলতে, কখনো বলবে না তোমার কোন গুন নেই। এযে কত বড় প্রেরনা তুমি আমাকে দিয়েছিলে তা তুমি বুঝবে না আনন্দ দা, তা তুমি বুঝবে না। দূরে গেলেও আমি তোমারই পাশে আছি জেনো। আমি যত দূরেই থাকি না কেন তোমার আমার বন্ধুত্ব চিরদিন অটুট থাকবে আনন্দ দা”।
আনন্দ সানন্দার চোখের দিকে তাকিয়ের রইল, কি জেনো খুজছে সে, বলল,”জানি তোমাকেও কোথাও যেয়ে আজ ঠাই নিতে হবে। তোমারও তো চুলে পাক ধরল। অনেক তো করলে। এবার পাখা গুটিয়ে বসার সময়। আমার জন্য ভেবো না। আমি বাঁচবো, আমি বাঁচবো ওই কিউটি পাঁই দুটোকে বুকে আগলে ধরে, ওদের নানা দাদা ডাক শুনে। ওদের মাঝেই আমাকে বাঁচতে হবে সানন্দা, ওদের মাঝেই আমাকে বাঁচতে হবে। ওর রক্ত রয়েছে ঐ দুটো নিষ্পাপ শিশুর মাঝে। ওরাই আমাকে পথ দেখাবে, ওদের মাঝেই আমি খুজে পাবো তাকে, ওদের মাঝেই আমি খূজে পাবো”। আনন্দের গলার স্বর ভাঙ্গা।
সানন্দা আনন্দের হাতটা চেপে ধরল। কান্না ভরা গলায় বলল,” কথা দাও, নিজের দিকে খেয়াল রাখবে? ঔষধ গুলি খেতে ভুলবে না? আমার মাথার দিব্যি রইল”। টপ টপ করে চোখের জল পড়লো ওর হাতের পরে।
“কথা দিলাম”।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আকাশে তারার ঝিলিমিলি। দূরে ঝিল্লির ডাক। জোনাকি পোকারা তাদের আলো জ্বালিয়ে ঘুরছে চারিদিকে। নিস্তব্ধ অন্ধকার। তার মাঝে চাপা কান্নার শব্দ। সানন্দা কাদছে। আনন্দ জল ভরা চোখে তাকিয়ে আছে দূরে বহু দূরে।
“কোথায় যাবো শুনবে? মালয়েশিয়া”। সানন্দা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। বিশ্বাস হচ্ছেনা।
“ আকরাম আর আমি এক সাথে লেখা পড়া করতাম। থাকে কুয়ালা লামপুর। ডাক্তার, কাজ করে এক নাম করা হাসপাতালে। ওর ঐখানে উঠবো। তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে কিছু বলিনি”। বলল আনন্দ।
টিকিট কেটেছ? প্রশ্ন সানন্দার
সব ঠিক। দুদিন পরে রওনা দেবো। সব কিছু গুছিয়ে নিও।
গোছান শেষ। এবার যাত্রা কুয়ালা লামপুর এর পথে। সানন্দা বসে ছিল জানালার পাশে। ওটা ওর প্রিয় জায়গা। বলল,” কোনদিন ভাবিনি এই দেশটা দেখতে পাবো”।
“তোমার ভাষায় উপরওয়ালার ইচ্ছা। তা না হলে কি দেখতে পেতে?”
সারে তিন ঘণ্টা পরে উড়োজাহাজ এসে পৌছাল কুয়ালা লামপুর এর ইনটারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। কাস্টমস ক্লীয়ারেন্স এর লাইনে দাড়িয়ে দেখতে পেলো আকরামকে। ওর পাস থাকাতে চলে এসেছিলো একেবারে কাছে।
বেরিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিলো সানন্দার সাথে।
“তুই শেষ পর্যন্ত এলি তাহলে। কতদিন পরে দেখা”।বলল আকরাম।
সুন্দর ছিমছাম বাসা। বড় বড় ঘর। সানন্দা এসেই আকরামের বৌ দীপার সাথে গল্প জুরে দিলো। মনেহোল অনেক দিনের চেনা। এ গুনটা সানন্দার সব সময়। যে পাত্রে রাখো সেই আকার ধারন করে।
আনন্দের সাথে দীপার এই প্রথম দেখা। দীপা এগিয়ে এসে আনন্দকে বলল,” আনন্দ দা তোমার কথা খুব যে একটা শুনেছি তা নয়। তবে দেখে মনে হচ্ছে, কোথায় যেন দেখেছি তোমাকে”।
“ একথা কস্মীন কালেও তোমার স্বামীকে বলবে না। তা হলে —“। কথা শেষ হওয়ার আগেই আকরাম হাসতে হাসতে বলল, “ তোর ইয়ার্কি ঠাট্টা রাখবি? খেতে বস”।
খাওয়া শেষে আনন্দ সোফাতে হেলান দিলো। সানন্দা গেলো তার রুমে।
বিকেলে আনন্দ সানন্দাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আনন্দ আসার আগে পড়াশুনা করে এসেছে এই জাগার উপর। কি কি দেখবে, কি কি কিনবে। আনন্দ সনন্দাকে বলল, “ আজতো সময় হাতে বেশি নেই চলো দেখে আসি বড় মল টা ”।
খেতে খেতে কথা হোল, দীপা আকরাম এক সাথে পড়া কালীন পরিচয়। সেই সুবাদে বিয়ে। তাও অনেক বছর হয়ে গেলো। বাসা খালি। কাল আমরা বের হব পেট্রোনাস টাওয়ার দেখতে, বলল আকরাম।
সকাল সকাল বেরিয়ে পরেছিল ওরা। সাথে পানির বোতল, চিপস নিয়ে নিলো দীপা। সানন্দা সাদা কালো কামীজের সাথে ম্যাচ করে প্যান্ট পরে নিলো। চোখে প্রাদা সান গ্লাস।
পেট্রোনাস টাওয়ার, পৃথিবীর সব চেয়ে টলেসস্ট বিল্ডিং। আনন্দ সানন্দাকে বলল,” জানো এই টাওয়ারে Mission Impossible মুভির শুটিং হয়েছিল”। অবজারভেসন টাওয়ার থেকে দেখেছিল কুয়ালা লামপুর শহর। সব কিছু দেখা শেষে আনন্দ সানন্দাকে জিজ্ঞাসা করল কেমন লাগছে।
অপূর্ব। অতুলনীয়।
নিউইয়র্ক থেকে একটা ফোন এলো। তারপরই সানন্দা বলল তার শরীরটা ভাল লাগছে না।
” আমাদের তাড়াতাড়ি নিউইয়র্কে ফিরে যেতে হবে আনন্দ দা। তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো।“
সানন্দা উত্তর দেয়নি। শুধু বলেছিল,” দোয়া করো ওখানে যেয়ে যেন সব কিছু ভালো দেখতে পাই”।
আনন্দ দুদিনের মধ্যে ঠিক করে ফেলল সব কিছু। যাওয়ার আগে আমেনা ভাবী কে বলে গেলো ভিসার বাপারে। দিয়ে গেলো সব কাগজ পত্র।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আনন্দ দেখল অঞ্জলী দাড়িয়ে। সানন্দা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। গাড়ীতে করে এলো হাসপাতালে। আনন্দ কিছুই বুঝতে পারলনা। জিজ্ঞাসা করতে মন চাইছে কিন্তু পারছেনা। অবশেষে না জিজ্ঞাসা করে পারলনা।
“ বলোতো, কি হয়েছে?”
অঞ্জলী বলল,” খালুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে”।
আনন্দ বাচ্চু কে চেনে। ওই বাসাতেই সানন্দা আনন্দকে প্রথম দেখে ছিল।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সামনে সবায় দাঁড়ান। সানন্দা এসে ওর বোনকে জড়িয়ে ধরল। দুজনে কাঁদল অনেকক্ষণ। আনন্দ এসে বাহিরে দাঁড়াল।
জমের সাথে যুদ্ধ করে হার মানতে হোল বাচ্চু কে। চলে যেতে হোল এই পৃথিবী থেকে। আনন্দ সানন্দার পাশে এসে দাড়িয়েছিল এই দুঃসময়ে। যতটুকু করার সে করেছিল।
দিন শেষে মাস এলো। আস্তে আস্তে সানন্দা দুঃখের ভার কাটিয়ে উঠল।
“তুমি বলেছিলে দেখতে চাও সেই বাসাটা যেখানে আমি প্রথম সূর্যের আলো দেখেছিলাম। সেই তেঁতুল গাছটা যার নীচে এক্কা দোক্কা খেলতাম আমারই মতো ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে। সেই বকুল গাছটা। ভোরের আলো ফোটার আগে কুড়িয়ে নিতাম বকুল ফুলগুলো। আম গাছটা। দাদির ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যেতো। দাদি দুপুর বেলা তাকিয়ে তাকিয়ে পাহারা দিতো। যেনও বিচ্ছু ছেলে গুলো ঝাঁপিয়ে না পড়ে গাছটিতে। বলেছিলে দেখতে চাও সেই মাঠটা যেখানে সরু সরু দুটো পা দিয়ে জাম্বুরাকে লাথি মেরে গোল দিতাম। দেখতে চাও সেই চোঁরাস্তার মোড়, যেখানে তিন বন্ধু সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে দৃশ উপভোগ করতাম। হয়ত দেখবে হারিয়ে গেছে সেই মাঠ অট্টালিকার মাঝে। তেতুলের গাছ খড়ি হয়ে জ্বলছে কারোর উননে। বকুল ফুল আর ফোটে না। তবুও তোমাকে দেখাব সেই জায়গা গুলো”। এত গুলো কথা বলে আনন্দ থামল। তাকাল সানন্দার দিকে।
সানন্দা বলল, “আমি আরও দেখতে চাই সেই পথ যে পথ দিয়ে তোমরা দুজন পায়ে পায়ে হেটে গিয়েছিলে। সেই গাছ, সেই মাঠ, সেই ফুল বাগান যারা তোমাদের সান্নিধ্য পেয়েছিল। সেই গেট, যেখান থেকে সে বেরিয়ে এলে তুমি বলেছিলে কাঠবেড়ালিরা থমকে দাড়িয়ে যেতো। সেই বাসা যেখানে সে তোমার বাহুর বন্ধনে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল”।
আনন্দ সানন্দাকে উলেন কোটাটা পড়ে জীপার টা লাগিয়ে নিতে বলল। “অনেক দিন পরে এসেছ , আবহাওয়ার সাথে এডজাস্ট করতে সময় লাগবে”, বলল আনন্দ।
সানন্দা তাকাল আনন্দর দিকে, একটু হেসে জীপারটা টেণে উপরে উঠিয়ে দিলো। গেট থেকে দেখতে পেলো ঝুম্পা দাড়িয়ে। হাত নেড়ে জানালো তার অবস্থান। বের হয়তেই ঝুম্পা জড়িয়ে ধরল সানন্দাকে।
যান জট পেরিয়ে বাসাতে এলো দুঘণ্টা পর। আনন্দ ক্লান্ত। ওরা তিনজন হাসির ফোয়ারা ছড়াল। আনন্দের চোখ জড়িয়ে এলো ঘূমে। কাল যেতে হবে শাশুড়ি মার বাসায়
আনন্দের এপথ চেনা। কতবারই না সে এসেছে এই পথ দিয়ে। দুধারে ফসলের ক্ষেত। পীচ ঢালা রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে গরু ছাগল আস্তে আস্তে হেটে পাড় হচ্ছে। কোন কোন কৃষক টানা গাড়ীতে উঠিয়েছে তার মাঠের ফসল। বেচতে চলেছে দূর বাজারে।
আনন্দ সানন্দাকে বলে,”কেমন লাগছে?”
অপূর্ব।
সানন্দাকে নিয়ে যখন এসে পৌছাল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ওকে নিয়ে উপরে উঠে এলো। বলল, “এসো তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই আমার শাশুড়ি মার সাথে”।
দুজনে জড়িয়ে ধরে কাঁদলও অনেক। সানন্দা উঠিয়ে নিয়ে এলো শাশুড়ি মাকে। বসিয়ে দিল বাহিরের চেয়ারে। খাইয়ে দিল নিজে হাতে। শাশুড়ি মা তাকিয়ে রইল সানন্দার দিকে। কি যেনও খুজছে সে।
“এই যে দেখছ স্কুলটা এখান থেকে সে পাশ করে বেরিয়ে ছিল । প্রথম বিভাগে ভাল রেজাল্ট করে। এর আগে এত ভাল রেজাল্ট এই স্কুল থেকে কেউ করেনি। এদিকে এসো, পাশ দিয়ে হাঁটো, রিক্সায় ধাক্কা লাগতে পারে”।
“কনার নাম কেন স্কুলের দেয়ালে”?
“বলবো, দেখবে চলো”।
দুজনে এলো ভিতরে। দোতালায় কণার একটা বিরাট ছবি টাইলস দিয়ে নিখুঁত ভাবে আঁকা। অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে।
“তুমি তো আমাকে এসব কিছু বলোনি আনন্দ দা? কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে? তুমি তার স্মৃতি আজীবন ধরে রাখলে এই নিখুঁত আঁকা ছবিটার মাঝে। এই স্কুলের সবেই দেখবে ছবিটা। জানবে তাকে। তাদের মাঝে সে বেচে থাকবে। সে হারিয়ে যায়নি আনন্দ দা। সে হারিয়ে যায়নি”।
“এই তো আমি চেয়েছিলাম। দোতালাটা ওর নামে উৎসর্গিত। জানো, এখান থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার পথ যেখানে আমার জন্ম। অথচ দেখা হয়েছিল সেই সুদুর প্রান্তে”।
চলো, বাসায় ফেরা যাক। ওরা অপেক্ষা করছে।
আনন্দ, সানন্দা এসে দাঁড়াল বারান্দায়। সন্ধ্যা হয়ে এলো। একটা টিকটিকি টিকটিক করে ডেকে বেড়াচ্ছিল আলোটার পাশে। সানন্দা গায়ের চাদরটা টেনে দিলো মাথায়। দূরে আজানের ধ্বনি। রাস্তায় সাইকেলের টুং টুং শব্দ। পথিক ফিরে চলেছে তার ডেরায়। নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে গেলো একটা পাখির আত্ম চিৎকারে। পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে গেলো সে।
“খাবেনা আপা?” ডাক দিলো শোভনের মা।
খাওয়া শেষে সানন্দা শুয়ে পড়লো শাশুড়ি মার পাশে। শোভনের মা ঠাই নিলো নিচে।
মাঝ রাতে আনন্দ শুনতে পেলো শেয়ালের ডাক। মনে হোল অতি কাছে। জানালাটা খুলে তাকাল আনন্দ। জোছনা রাত। আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পরেছে আম বাগানে। ঝলমল করছে চারিদিক। আনন্দ কতক্ষণ দাড়িয়ে ছিল জানালার পাশে মনে করতে পারেনা। ডং শব্দ করে বাহিরের ঘড়িটা জানালো রাত দুটা।
সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আনন্দের। হাত ঘড়িটাতে দেখল সকাল আটটা। বাহিরে সানন্দার কথা শুনতে পেলো। সুন্দর ভাবে মিশে গেছে সবার সাথে। কারোর মনে কোন দ্বিধা নেই। দ্বিধা নেই সম্পর্ক নিয়ে।
নাস্তা শেষে ট্যাক্সি ডেকে বেরিয়ে পড়লো দুজন। আধা ঘণ্টার পথ। সানন্দা বলল,”জানো আনন্দ দা আমি খুব একটা থ্রীল অনুভব করছি। মনে মনে তোমার ছোট বেলার চেহারাটা একে নিয়েছি”।
ট্যাক্সিটাকে রাস্তার পাশে দাড়াতে বলে আনন্দ সানন্দাকে নেমে আসতে বলল। “রিক্সা করে ঘুরব, তা নাহলে সব কিছু দেখতে পাবেনা”। বলল আনন্দ।
“এইযে দেখছ দালান বাড়ীটা, এখানে আমার জন্ম।“
“মিল পাচ্ছিনা?”
“পাবে, আগে তোমাকে ভিতরটা দেখিয়ে নিয়ে আসি, এইযে দেখছ ভাঙা কুয়াটা, এই জানালা, ওই দেখো আম গাছটা, পুব পাশে ছিল তেঁতুল গাছটা, আজ আর নেই। এবার তুমি চোখ বন্ধ করে ফিরে যাও পঞ্চাশ দশকে।
খড়ের ছাউনী দেওয়া বাসা। বছরে বছরে লোকেরা এসে পুরানো খড় ফেলে নতুন খড় লাগিয়ে দিয়ে যেতো। পরে টিনের ছাদ লাগানো হয়েছিল। এরেই একটা ছোট্ট ঘরে আমার জন্ম। ওই যে কুয়াটা দেখলে ওটা ছিল পানিতে ভরা আর গভীর। ওখান থেকে পানি উঠিয়ে গোসল করতাম। বেড়া দিয়ে ঢাকা ছিল চারপাশ, মধ্যে একটা গেট। গেট খুলে যেতাম অনুদের বাসায়। ওখানে ছিল তেঁতুল গাছ টা। তারি নীচে ওর সাথে এক্কা দক্কা খেলতাম। এইযে বড় ঘরটা দেখলে ওটা অত বড় ছিলনা। ওখানে দাদি আমাদেরকে (মানে আমি আমার ভাই এর এক বোন) নিয়ে শুতেন।
তোমাকে একটা মজার গল্প না বলে পারছিনা। সেই আমলে দাদি ছিল স্বাস্থ্য সচেতন। প্রতিদিন ভোর বেলা আমাদের সবাই কে নিয়ে প্রাতঃ ভ্রমনে বের হতেন। একদিন ভোরে দাদি ডাক দিলো আমাদের সবাইকে। আমরা সবাই গভীর ঘুমে। উঠতে হবে। চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। কাক পক্ষী কেও নাই । শুধু আমরা চার জন। রাস্তা আলোয় আলোকিত। এমন সময় হুইসেল শুনলাম। কে জেনো পিছন থেকে ডাকছে। আমরা দাঁড়ালাম। লোকটা আগিয়ে এলো। পাহারাদার। আমাদের পরিচিত। দাদিকে চেনে। জিজ্ঞাসা করল এত রাতে রাস্তায় কেন?
দাদিতো আকাশ থেকে পড়ল। “ এত রাত মানে? এখন তো সকাল”।
পাহারাদার তার পুরান হাত ঘড়ি দেখাল। রাত তিনটা। ফুটফুটে জোছনার আলো। দাদির মনে হয়েছিল ভোর হয়ে গেছে।
এইযে ডান দিকে ভাঙ্গা জায়গাটা দেখছ এখানে ছিল রান্না ঘর। মাটির তৈরী। তুমি যেখানে দাড়িয়ে আছো সেখানে আমরা তিন ভাইবোন মাদুর পেতে হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করতাম। রাতের খাওয়া আমরা খেতাম দাদির হাতে। দাদি হুক্কা টানত। হুক্কার আওয়াজ বন্ধ হলে আমরা জানি আমাদের খাওয়ার ডাক পরবে। আমরা উচ্চস্বরে পড়ার মাঝে মাঝে কান পেতে থাকতাম কখন হুক্কার আওয়াজ বন্ধ হয়। সে আজ কতকাল আগের কথা”, এই বলে আনন্দ থামল।
“চোখ খুলব?”
খোলো, কেমন দেখলে?
অপূর্ব, আমার চোখে ভাসছে দাদির চেহারা আর তোমার সেই অনু, আর দেখা হয়েছিল কি?
না, জানিনা কোথায় সে, হয়ত কয়েক ছেলে মেয়ের জননী, অথবা হারিয়ে গেছে এই ধরাধাম থেকে।
এবার চলো, তোমাকে নিয়ে যাই মোড়টাতে। যেখানে আমরা তিন বন্ধু দাড়িয়ে থাকতাম সাইকেল নিয়ে। এখানে আগে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়াত। গাড়ী নিয়ন্ত্রণ করত। এখন সেখানে সাদা কবুতরের ভাস্কর্য।
জানো আমি প্রথম যখন সাইকেল চালানো শিখি, বয়স ছয়, বাবার সাইকেলটা নিয়ে বেড়িয়ে ছিলাম। এই মোড়ে এসে
ঘাবড়ে গেলাম। ডানে যাব না বায়ে। সাইকেল থেকে মেনে ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলাম কোন দিক দিয়ে ঘুরতে হবে। জানো সে কি বলেছিল?
কি?
বলেছিল তিনবার ঘুরে তারপর সোজা যাবে।
তুমি তাই করেছিলে? সানন্দা মিটমিট করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করেছিল।
তোমার কি মনে হয়?
সানন্দা হো হো করে হাসে উঠল।
চলো এবার দেখবে সেই সিনেমা হল যার সামনে সন্ধ্যা বেলা আমরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে গান শুনতাম। দেখবে সেই রাস্তা টা যার উপর দিয়ে টুং টুং ঘণ্টা বাজিয়ে সাইকেল চালাতাম। হয়ত কোন জানালার কপাট খুলে কারো মুখ এক ঝলকের জন্য দেখা দিতেও পারে সেই আশায়।
সানন্দা শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল। বিদায়ের শেষে শাশুড়ি মা আনন্দকে বলেছিল, আবার এসো বাবা, পারলে আমার এই মেয়েটা কেও নিয়ে এসো।
ওরা ফিরে এলো ঝুম্পার বাসায়। সন্ধ্যা হয় হয়। ঝাল পিয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে ঝুম্পা ডাক দিলো ওদেরকে। সানন্দা বসলো ঝুম্পার সাথে। আনন্দ চা র পেয়ালা টা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালো বাহিরের বেল্কনীতে। ভাবে, কবে এর শেষ? জীবনের এই উঁচু নীচু গ্রাফ আর কত দিন চলবে? বেশ কাটে সানন্দার সাথে কথা বলে, আবার হারিয়ে যায় ফেলে আসা দিন গুলোর মাঝে।
“কি ভাবছ?” সানন্দা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
উত্তর আসেনা। আনন্দ তাকিয়ে ছিল দূরে। সানন্দা জানে আনন্দ ফিরে গেছে অনেক পিছনে।
তাকিয়ে থাকে আনন্দের দিকে।
পরদিন আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল সানন্দাকে,” কোথা থেকে শুরু করবো, বলো”?
“ সেই বাড়ী যেখানে পাতাবাহার গাছের ফাকে তোমাদের ছবি আমি দেখে ছিলাম তোমার ঘরে। ওর পরনে ছিল বিয়ের সাজ। সাধা কালো ছবি”।
“ যাবো সেখানে, তবে আশা তোমার পূর্ণ হবেনা”।
তিন চাকার স্কুটারটা এসে দাঁড়াল জরাজীর্ণ পাঁচতালা বাড়ীটার সামনে।
“জিজ্ঞাসা করোনা কেন বাড়ীটার আজ মলিন চেহারা। আমি শুধু তোমাকে দেখাতে এসেছে আমার অতীত, আমাদের অতীত।
আটচল্লিশ বছর আগে টিনের ছাদ দেওয়া চার ঘরের একটা বাসা ছিল এইখানে। এই যে দেখছ বা পাশে ভাঙ্গা ঘরটা ওটা ছিল রান্না ঘর। সামনে ছিল অনেক জাগা, ওখানে ছিল পাতাবাহারের গাছ।
ডান দিকে চার ঘরেরে শেষ ঘরটা তে আমরা সময় কাটাতাম, হাসতাম, তাস খেলতাম।
তুমি কি ভাবছ? এটা বিয়ের পরে? না, এসব বিয়ের আগে। হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে একদিন মনে হোল আমরা জড়িয়ে পরেছি কোন এক বন্ধনে। তারই শেষ হয়েছিল এই ঘরটাতে। হয়েছিল আমাদের বাসর রাত।
তারপর?
তারপর আমরা চলে গিয়েছিলাম বাহিরে। এই টিনের বাড়ী ভেঙ্গে উঠেছিলো পাঁচ তালা দালান বাড়ী। আমরা এলে মার সাথে ওই পাঁচতালাতে থাকতাম”। বলে আনন্দ থামল।
একটা লোক বেরিয়ে আসতেই জিজ্ঞাসা করল পাঁচতালায় যাওয়া যাবে কিনা।
লোকটা বলল,”আসুন আমার সাথে”।
“পারবে তো?” আনন্দ জিজ্ঞাসা করল সানন্দাকে।
“ আজ আমি সব দেখব আনন্দ দা”।
উঠে এলো ওরা পাঁচ তালায়। দেওয়ালের রং উঠে গেছে, খসে পরছে কিছু কিছু জাগা, মাকড়সা বেধেছে তাদের বাসা।
“ এই ডান দিকের ঘরটাতে আমরা থাকতাম। মা থাকত আমাদের পাশের ঘরে। ওই যে কর্নারটা দেখছ, ওখানে মা পানের বাটা নিয়ে বসতো। কনা বসে মার সাথে গল্প করতো আর পান খেতো। সব এলোমেলো হয়ে গেলো, তাই না সানন্দা”।
“ এইতো নিয়ম। চলো নিচে যাই।“
“চলো”।
ফিরে এলো সেইখানে, সেই গেটের কাছে। সানন্দা বলল,” এই সেই গেট?”
“হা, তখন এত লোকের আনাগোনা ছিলনা। রাস্তা পেরিয়ে এসে ওই যে গাছটা দেখছ ওর ছায়ায় বসতাম। সময় কোথা দিয়ে পার হয়ে যেতো বুজতে পারতাম না”।
তারপর? তারপর তোমরা বসতে ইউনিভারসিটির মাঠে, হাটতে পীচে ডালা এই পথ দিয়ে। তাই না?
শেষ এসে দাড়িয়ে ছিলে এই মাঠে, বই মেলার দিন। তোমার কাধে মাথা রেখে বলেছিল, আর নয় এবার ফিরে চলো।
তাই, আনন্দ অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটতে থাকল। সানন্দা কিছু বলল না। চেয়ে চেয়ে দেখল আনন্দের মুখটা। দেহটা আছে মনটা চলে গেছে অনেক দূরে। এই আনন্দকে সে চেনে। দেখেছে। ভেবেছে, কোন ভাবেই কি ওর মন টাকে ফিরিয়ে আনা যায়না? উত্তর মেলেনি।
সানন্দা যখন আনন্দকে নিয়ে বাসায় এলো তখন রাত দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। খাবার টেবিল সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল। বলল,” তুমি কাপড় জামা ছেড়ে গোসল করে এসো আমি খাবার গুলো গরমে দেই।”
“রাত অনেক হয়েছে, তুমি এসো, আমি সব ব্যাবস্থা করে নেবো।” বলল আনন্দ। যদিও জানে সানন্দা যাবেনা। সানন্দা একবার তাকাল আনন্দের দিকে, কিছু বলল না। কথা বলার সাথী বলতে তো সেই।
গোসল সেরে নেমে এলো আনন্দ। শরীর চলছেনা। অথচ এই কদিন চর্কির মত ঘুরেছে। ক্লান্তি আসেনি। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দুজনকে হারিয়ে। নিজেকেও হারাতে চলেছিল শুধু ছক্কার চাল ঠিক থাকাতে এই যাত্রা বেচে গেছে।
“কাল অফিসে যেতেই হবে? না গেলেই নয়?” জিজ্ঞাসা করলো সানন্দা।
“ওরা সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। সমস্ত ঘটনার ব্যাখ্যা তো আমাকেই করতে হবে।”
সানন্দা আর কথা বাড়াল না।
খাওয়া শেষে সমস্ত কিছু গুছিয়ে রেখে বলল,” আমি আসি, তুমি বিশ্রাম নাও।”
ডেভিড বলল,” This is a tremendous blow for this organization. কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদেরকে সামনে চলতে হবে। আমরা লাকি তুমি এখনও আমাদের মধ্যে আছো।”
সবাই এসে বসলো কনফারেন্স রুমে। আনন্দ একে একে জানাল সব ঘটনা। বলল সে স্টিভের সাথে আলাপ করবে আইন গত ভাবে আমাদের করনীয় কি।
জেনীফার উঠে আনন্দের কাছে এলো। বলল,”এবার তুমি কিছুদিনের জন্য বাহির থেকে ঘুরে এসো। মনটা ভাল লাগবে।”
আনন্দ সাই দিলো। বলল,” দেশে যাবো ভাবছি।”
“যাও, তবে যাওয়ার আগে একটা কাজ করতে হবে, আমি একা করতে চাইনা।” বলল ডেভিড।
কি?
“আগামীকাল একজনের ইন্টারভীউ আছে। এমিলির পজিশনটার জন্য। তুমি ইন্টারভীউ নেবে। আমি থাকব। তবে সব ভার তোমার উপর। ঠিক আছে?”
হা, বলে আনন্দ বলল সে উপরে স্টিভের সাথে দেখা করতে যাবে। উঠে পড়ল।
জনের মা কল করেছিল আনন্দ কে। বলেছিল একবার আসতে ওদের বাসাতে। ফিলাডেলফীয়ায়। আনন্দ না করেনি। বলেছিল দুই একদিনের মধ্যেই আসবে।
সব কাজ শেষে আনন্দ বাসাতে ফিরবে ভেবে গাড়ীটা স্টার্ট দিলো। সানন্দা বলেছিল কাজ শেষে ওর সাথে চা খেতে। তা আর হলনা। গাড়ীটা ঘোরালো সে এমিলিদের বাসার দিকে।
এমিলির মা বাবা আনন্দকে দেখে চোখের জল বেঁধে রাখতে পারেনি। আনন্দকে দেখিয়ে ছিল এমিলির রুমটা। সুন্দর করে সাজানো ঘর। এক কোণে একটা পেন্টিং। উপুড় করা। আনন্দ উঠিয়ে নিলো। তাকাল। আনন্দের অবয়ব। এমিলির আঁকা। ফিরতে রাত হোল।
আজ আনন্দ হাতে অনেক সময় নিয়ে অফিসে এসেছিল। লরেন্সের সাথে বসে কফিটা শেষ করার আগেই ডেভিড এলো। সামান্তা খবর দিলো যে ছেলেটার ইন্টারভীউ নেওয়া হবে সে বাহিরে বসে আছে।
আনন্দ চশমার কাচটা মুছে নিয়ে ছেলেটার জীবনবৃতান্ত টা আর একবার পড়ল। রাশেদুল ইসলাম। নামটা পরিচিত মনে হোল। সামান্তা কে বলল রাশেদকে ডাকতে। দরজা খুলে ভিতরে এলো রাশেদ। হ্যান্ডসাম, টোন বড
কোঁকড়া চুল, শ্যামলা। আনন্দ তাকিয়ে রইল ওর দিকে। বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে একটা শব্দ,” তুমি?”
“চেনও নাকি?” জিজ্ঞাসা করলো ডেভিড।
“চিনি।”
রাশেদ কে বসতে বলল। রাশেদ আনন্দের দিকে চেয়ে রইল।
আনন্দও তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। শেষ দেখে ছিল বারো বছর আগে ওর বাবার কবরের পাশে। তারিকুল ইসলাম।
তারেকের সাথে আনন্দের দেখা হয়ে ছিল দেশের রাজধানীর এক এলিট কলেজে। আনন্দ এসেছিল এক মফস্বল শহর থেকে। তারেকের জন্ম রাজধানীতে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তারেক এসে বাসা বেঁধে ছিল আনন্দের রুমে। ঠোটে হাসি লেগেই আছে। প্রাণবন্ত। বলত,” চল, মুভি দেখে আসি।”
আনন্দের যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যেতে চাইত না, পকেট শূন্য। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অনেক ভেবে চিন্তে চলতে হয় এই রাজধানীর বুকে।
পাশ করে দুজন চলে গিয়েছিল দু দিকে। আনন্দ আর্কিটেকচার কলেজে ভর্তি হলো। তারেক ইংলিশে মেজর নিয়ে ইউনিভারসিটিতে এলো। দেখা সাক্ষাত কমে গেলো । আর্কিটেক্ট হয়ে আনন্দ চলে এলো আমেরিকাতে স্কলারশিপ নিয়ে। সেতো অনেক দিনের কথা।
এক সন্ধ্যায় আনন্দ কণাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হল ঘরের লাউঞ্চে। এসেছিল বাংলা শিল্পীদের গান শুনতে। পিঠে হাতের স্পর্শে তাকাল পিছনে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল। তারেক?
“কিরে ,অবাক হয়ে গেলি? অনেক খুঁজেছি। আজ পেলাম।’”
ভেঙে যাওয়া বন্ধন আবারো জোড়া লাগলো। সময় পেলেই চলে আসতো আনন্দের বাসায়। কণা খুব পছন্দ করেছিল ওকে।
“বিয়ে শাদী করবি? মেয়ে আছে।” জিজ্ঞাসা করেছিল আনন্দ
“না, মা বাবার পছন্দ এক মেয়ে আছে, তার সাথে হবে। সামনের বছরে যাবো।”
এক শীতে ঝরা সন্ধ্যায় নিয়ে এলো সাকীলাকে। কণা যেয়ে সাজিয়ে রেখেছিল ওদের ঘর। দিন শেষে মাস, মাস শেষে বছর পেড়িয়ে গেল। এলো ওদের ঘরে এক ছেলে। রাশেদ। দুরন্ত। আনন্দের বাসায় এলে জিনিস পত্র ভেঙ্গে তছনছ করত। কনা কিছু বলত না।
এক রাতে ব্যাথায় টিকতে না পেরে আনন্দকে ফোন করেছিল। আনন্দ নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। সারারাত ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলল। সকালে আনন্দ কে ডাক্তার ডেকে নিয়ে গেল পাশের রুমে। বলল,” He has Multiple Myeloma. It is form of bone marrow cancer. Stage 3”. আনন্দ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলো তাকে ব্যাখ্যা করতে। চিকিৎসা আছে কি না। বাঁচার সম্ভবনা কতটুকু।
খুব একটা সময় হাতে নেই, বলল সে। “ It’s a serious incurable malignancy.”
তাড়াতাড়ী চিকিৎসা শুরু করতে হবে। বলল সে।
ডাক্তার ফিরে এলো তারেকের রুমে। বলল সবকিছু। তারেক আনন্দের দিকে তাকিয়ে থাকল, চোখের কোণে জল। সাকীলার কোন ভাবান্তর নেই।
চিকিৎসা শুরু। Chemoর ভয়াবহতা সহ্য করতে পারলো না তারেক। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে আনন্দ এসে বসে থাকে তারেকের পাশে। গল্প করতো ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। ওর হাসিটা ম্লান হয়ে এলো। রক্ত শূন্যতা। মুখটা কুঁচকানো কাগজের মত। বলে,” আর কতদিন আমি বাঁচব রে আনন্দ, সত্যি করে বল।”
“নতুন নতুন অনেক চিকিৎসা বের হয়েছে। চিন্তা করিস না।” বলে বাথরুমে যাবার ছল করে বাহিরে যেয়ে কাঁদত।
দিনে দিনে খাওয়ার রুচি চলে যেতে থাকলো। গায়ের রঙ পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। বলে,” আমি আর পারছি নারে আনন্দ।“
মাঝে মাঝে আনন্দ এসে সাকীলাকে কোথাও না দেখে জিজ্ঞাসা করতো। তারেক বলত “ও বাহিরে গেছে দরকারে”। একদিন তারেক বলল ,” জানিস আনন্দ আমার খুব ইয়োলোস্টোন পার্ক টা দেখেতে ইচ্ছা করে। নিয়ে যেতে পারবি?”
“পারবো”। বলে সব ব্যাবস্থা করল আনন্দ। শেষ সময়ে সাকীলা বলল সে যেতে পারবেনা। বলল “তোমরা ঘুরে এসো। আমি এদিকটা সামলাব।“
যথা রীতি ওরা বেরিয়ে পরেছিল। আনন্দ দেখেছিল তারেকের হাসৌজ্জল মুখ। হুইল চেয়ারে বসে বসে দেখল তার সাধের ইয়োলোস্টোন পার্ক। মাঝে মাঝে মাথাটা এলিয়ে দিতো । আনন্দ ওকে নিয়ে এসে দাঁড়াত গাছের ছায়ায়।
চার দিন আনন্দ তারেককে বাচ্চার মতো আগলিয়ে রেখেছিল। ফিরে যাওয়ার দিন তারেক একটা এনভেলপ আনন্দকে দিয়ে বলল ,” কথা দে, এটা খুলবি আমি চলে যাওয়ার একমাস পরে। কথা দে? ”
আনন্দ কথা দিয়েছিল।
ফিরে আসার পরে তারেকের শরীর আরও খারাপের দিকে গেলো। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মরফিনে ব্যাথা যায়না। হাঁসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোল। ডাক্তার আনন্দ আর সাকীলাকে পাশে ডেকে নিয়ে বলল,” এবার ওকে যেতে দিতে হবে।“
দুদিন পরে সবকিছুর মায়া কাটিয়ে তারেক চলে গেল।
দিন যেয়ে মাস এলো। এক পরন্ত বিকেলে আনন্দ কড়া নাড়াল সাকীলার বাসায়। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক আমেরিকান ভদ্রলোক। আনন্দ ভুল বাড়িতে এসেছে ভেবে দুঃখিত বলে চলে যাচ্ছিল। মহিলার ডাক শুনে ফিরে তাকাল। সাকীলা। প্যান্ট সার্ট পড়ে দাঁড়ান।
ভিতরে আসতে বলতেই আনন্দ বলল, আজ নয় আর একদিন আসবো।
ফিরে আসতে আসতে মনে হোল সেই চিঠিটার কথা। বাসায় এসে খুলল চিঠিটা। দুকলম লেখা।
“I was cheated on”.
আনন্দ ? ডাক শুনে বাস্তবে ফিরে এলো।
“প্রশ্ন করো”? বলল ডেভিড
তাকিয়ে রইল আনন্দ রাশেদের দিকে।
“না, আমি না। I have a soft corner for him. ঠিক জাজমেন্ট করতে পারব না। হয়তোবা পক্ষপাতিত্ব করা হবে। তুমিই ওর ইনটা্রভিউ নেও।“ বলে আনন্দ দরজার দিকে পা বাড়াল। রাশেদ তাকিয়ে থাকলো ওর চলার দিকে।