এক অসমাপ্ত গল্প ( ১৩ পর্ব)
১৩ পর্ব
বারে এসে বসলো আনন্দ। বারটেনডার ক্লাব সোডার গ্লাস টা এগিয়ে দিতেই আয়নায় দেখতে পেলো মাথায় টুপি ওয়ালা লোকটা তার পিছনে দাঁড়িয়ে। হাতে ধরা গ্লাসটা কেঁপে উঠে কিছুটা সোডা পরে গেল গ্লাস বেয়ে। লোকটার হাতের সেই বস্তুটা দেখতে পেলনা আনন্দ।
“ বসতে পারি?” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে পাশের চেয়ার টাতে বসলো। বয়স চল্লিশের কাছা কাছি। কপালের উপড়ে কাটা দাগ। বেশী দিনের নয়। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললও, “আমার নাম জন টেলর।” আনন্দ তার নাম বলতেই বললও ,” তোমার নাম আমি শুনেছি এমিলির কাছে। সরি, এই দুর্ঘটনার জন্য।”
“ এমিলিকে চেনো কি ভাবে?” জিজ্ঞাসা করতেই মিস্টার টেলর বলল,” যে কাজের খবরা খবর জানতে এমিলি কে পাঠানো হয়েছিল আমি সেই কোম্পানির একাউনটেন্ট। এমিলি, সত্যি খুব স্মার্ট লেডি। Again sorry for your loss.” বলে আনন্দ কোন কিছু বলার আগেই দ্রুত বের হয়ে যেতে যেয়ে বললও,” সাবধানের মার নেই”।
আনন্দ তখনো হুড ওঠানো লোকটার চেহারা টা মনে করার চেষ্টা করছে। একে অন্ধকার, তারপর চোখে বড় ফ্রেমের কালো চশমা, ঠোটের পাশে ক্ষীণ হাসি। সব মিলিয়ে এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। রহস্যময় ব্যক্তির হাটার ছন্দটা আনন্দের পরিচিত মনে হয়ে ছিল। কোথায় যেন দেখেছে, মনে করতে পারলনা।
সকাল দশটায় কড়া নাড়িয়ে আনন্দকে ঘুম থেকে উঠালো মিস্টার থম্পসন। রাতে বিভিন্ন চিন্তায় ঘুম এসেছিল ভোর পাঁচটায়। দরজা খুলে থম্পসন কে বসতে বলে আনন্দ গেল মুখ হাত ধুতে। রুমের ফোনটা বেজে উঠতেই আনন্দ থম্পসনকে ফোনটা ধরতে বলে শাওয়ারের কলটা ছেড়ে দিলো। অপর প্রান্তে এমিলির বাবার গলা। গলার স্বর ভারী। থম্পসন আসতে বলল আনন্দের রুমে। কথা আছে।
আনন্দ ড্রেস আপ করে আসতেই এমিলির বাবা ও উপস্থিত। থম্পসন কোন ভূমিকা না করে বলল, “ মাথায় ভারী বসতুর আঘাতে এমিলি মারা গেছে। যার সাথে এমিলি কে দেখা গিয়েছিল তাকে পাওয়া গেছে। জবান বন্দি নাওয়া হয়েছে।”
এমিলির মা ফুফিয়ে কেঁদে উঠল
“সে কি সন্দেহর মধ্যে পড়ে?” জিজ্ঞাসা করলো এমেলির বাবা।
“ সবায়ই সন্দেহর মধ্যে পড়ে যতক্ষণ পর্যন্ত আসল খুনি কে না পাওয়া যায়।” বলল থম্পসন “ আপনারা মৃত দেহ নিয়ে যেতে পারেন।” কথা শেষে বাই বলে উঠার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে জন ঢুকল। আলুথালু বেশ। “এমিলিকে কোথায় দেখতে পাবো” বলে চারিদিকে তাকাল। আনন্দ পরিচয় করিয়ে দিলো থম্পসনের সাথে।
“ মর্গে গেলে দেখতে পাবে, সনাক্ত ও করতে পারবে। আমি ঐ দিকে যাচ্ছি, তুমি আমার সাথে এসো। কথা আছে।” বলল থম্পসন। আনন্দ গত রাতের কোন কথাই থম্পসনকে জানাল না। এমনকি হুড ওঠানো লোকটার কথাও না।
ওরা বেড়িয়ে পরতেই আনন্দ গেল লরেন্সের রুমে। দুজনে মিলে গেল সেই সাইট টা তে। সবাই মর্মাহত। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন প্রশ্ন। দরকারি কথা শেষে বেড়িয়ে পড়ল । রাস্তায় ভিড় বাড়ছে। সূর্যের তাপ প্রখর। ট্যাক্সির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল ল্যাম্প পোষ্টের নীচে। এই মুহূর্তে ট্যাক্সি পাওয়া দুরহ ব্যাপার। ভ্যাপসা গরমে দুজনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা। লরেন্স কি জেনো বলতে চাইছিল তার আগেই একটা কালো রং এর মারসেডিজ-বেঞ্জ জানালা গুলি কালো টিনটেড গ্লাসে ঢাকা পাশে এসে দাঁড়ালো। জানালা খুলতেই আনন্দ দেখতে পেলো মিস্টার টেলার, ইশারায় ডাকল, দরজা খুলে ভিতরে আসতে বলল।
“ কোথায় যাবে?”
“ পুলিশ স্টেশন।”
“ কাছা কাছি নামিয়ে দিতে পারি। কোন সুরাহা হোল ?” জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার টেলর
“ না, এই মুহূর্তে নয়।” বলল আনন্দ
“ আমাদের সার্ভেলেন্স ক্যামেরায় তোলা কিছু ছবি। দেখো, কাজে লাগলেও লাগতে পারে। “ বলে একটা এনভেলপ এগিয়ে দিলো আনন্দের দিকে। আনন্দ খুলল এনভেলপটা। নিজে দেখল। লরেন্স কে দেখালো। এমিলির ছবি। কন্সট্রাকশন সাইটের বিভিন্ন জাগায় তোলা। সাথে একজন যার ছবি থম্পসন দেখিয়ে ছিল। হোটেলে দেখা গেছে তাকে। দুরে কে জেনো দাড়িয়ে, আবছা। চেনা যায়না। মাথায় বেজবল ক্যাপের মত কিছু একটা পড়া। মুখটা ঢেকে আছে। লরেন্স তাকাল আনন্দের দিকে।
টেলর আনন্দ আর লরেন্স কে পুলিশ স্টেশনের কাছে নামিয়ে দিয়ে গুড লাক জানিয়ে চলে গেল। ওরা থম্পসনের ঘরে ঢুকে দেখল জন আর এমিলির বাবা মা বসা। জন লরেন্স কে দেখে জড়িয়ে ধরল। চোখে জল। লরেন্স ওকে বাহিরে নিয়ে গেল সান্ত্বনা দিতে।
চেয়ার টা টেনে বসতেই এমিলির বাবা বলল,” এমিলির বডি নিয়ে কাল আমরা রওনা হচ্ছি, তুমি যাবে সাথে?”
কথার উত্তর দেওয়ার আগে আনন্দ ছবি গুলো থম্পসনের দিকে এগিয়ে দিলো। বলল কোথা থেকে পেয়েছে সে।
বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর, “হু” শব্দ করে রেখে দিলো ড্রয়ারে।
লরেন্স আর জন ঘরে ঢুকতেই থম্পসন আনন্দের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি আর জন আর কয়েকটা দিন এখানে থাকবে। আমার দরকার পরবে তোমাদেরকে।”
আনন্দ লরেন্সকে বলল, আগামীকাল এমিলির বাবা মার সাথে বডি নিয়ে নিউইয়র্কে চলে যেতে। সবায়ই বেড়িয়ে এলো। দুই পা এগিয়ে আনন্দ ওদেরকে যেতে বলে ফিরে এলো থম্পসনের রুমে। থম্পসন আনন্দর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,” ফিরে এলে যে।”
“ আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছুটা ক্লু পেয়েছ। তবে এখনো সন্দেহ। হত্যাকারী কে? তাই না?”
সে কথার উত্তর না দিয়ে সে বলল,” আমার স্টাফ অনেক দুর এগিয়েছে, বাকি আছে কয়েকটা ল্যাব টেস্ট, ডিএনএ টেস্ট”।
“ আমাকে একবার এমিলির রুম টাতে নিয়ে যেতে পারবে?” বললও আনন্দ। “ অনেক দিনের চেনা, অনেক কাছের মানুষটা, কত কাটাছেড়া করেছি ড্রয়াইং এর উপর, বসেছি কফির পেয়ালা নিয়ে পাশের রেস্টুরেন্টে। হারিয়ে গেল। একবার দেখতে চাই সেই জাগাটা যেখানে সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল।”
“ নিয়ে যাবো, তবে একটা কথা তুমি অ্যাড করলেনা।”
“ কি?”
“ She had a crush on you. Is it right?”
“ অনেক রিসার্চ করেছ দেখছি এই ক’দিনের মধ্যে? আমিও কি তোমার সন্দেহের মধ্যে পড়ি?”
“ কে জানে, বলাতো যায়না। এটাই তো আমাদের কাজ সবায়কে সন্দেহ করা। তাই না?” বলে থম্পসন আনন্দকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। বাহিরে ওরা চার জন দাড়িয়ে। আনন্দ বলল সে এমিলির রুমে যাচ্ছে। জন যেতে চাইলে থম্পসন বলল,” না, তুমি গেলে তোমার মানসিক অশান্তি বাড়বে ছাড়া কমবেনা।”
আনন্দের হাতে গ্লভোস। কোন কিছু স্পর্শ করা নিষেধ। থম্পসন দরজা খুলল। নর্মাল সাইজের এক বেডরুম এপার্টমেন্ট। কাঠের মেঝে। ডান পাশে ক্লোজেট। কপাট খোলা। এমিলির কাপড় হাঙ্গারে ঝুলছে। এক পা এগোতেই বসার জায়গা। দুটো চেয়ার। একটা উল্টিয়ে পড়ে আছে। দুরে একটা রিক্লায়নার। সামনের কফি টেবিলটার উপরে রক্ত ছিটানো। কিছু কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিল্ডিংএর নকসা আকা কাগজটা মেঝেতে পরা। বা দিকে একটা টেবিল ল্যাম্প মেঝেতে ভেঙ্গে পরে আছে। তার পাশে প্রচুর শুকনো রক্ত। এমিলির দেহটা এখানে পরেছিল। সাদা চক দিয়ে আকা। রক্তের ছিটা দেয়ালে।
শোয়ার ঘরের বিছানা এলোমেলো। চাদর কুঁচকানো। একটা বালিশ আর কম্বল মেঝেতে। সাদা চাদরের মাঝে দুটো কালচে দাগ। হয়তো—,
থম্পসন ডাকল, “ দেখা শেষ হোল?”
বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে দুজনে।
“ দুই তিন দিনের মধ্যে ইনভেশটিগেসন শেষ করতে পারবো বলে আসা করছি।” বলল থম্পসন। “ সেই সাথে হত্যাকারীও হাতের মধ্যে এসে যাবে।”
আনন্দ জানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এর বাহিরে থম্পসন আর কিছু বলবেনা।
সন্ধ্যা আটটা। সবাই মিলে ডিনার করবে। লরেন্স বলল, “ তোমাদের কারো আপত্তি না থাকলে ডিনার হবে আমার তরফ থেকে।” সবাই রাজি। জন বলল তার একটু কাজ আছে পরে এসে মিলিত হবে। তাড়াহুড়া করে চলে গেল। মনে হোল কি জেনো খুঁজছে সে। এমিলির মা কিছুক্ষণ পর পর ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে উঠছে। বাবার চোখ ছলছল। ডিনার শেষে এমিলির বাবা আনন্দ কে বলল,” তুমি তো কিছুদিন থাকবে। নিশ্চয় এর মধ্যে হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়া যাবে। জন ডিনারে এলোনা কেন বুঝলাম না।”
“মানসিক দিক দিয়ে সে ও তো আঘাত কম পায়নি? হয়তো একাকী থাকতে চায়।” বললও আনন্দ।
পরদিন সকাল। ওরা ফিরে গেল নিউইয়র্কে এমিলির লাশ নিয়ে। জন আসে নি এয়ারপোর্টে। আনন্দ ফিরে আসে জনের খোজ করলো। ফোন করলো তার সেলে। ফোন বন্ধ। ভয়েস মেল ভরাট। আনন্দ হোটেলের লবিতে খোজ নিলো। কেউ জনকে দেখেছে কিনা, কোন মেসেজ আছে কি না। না, কিছুই নেই। ওর রুমে যেয়ে কয়েক বার ধাক্কা দিলো । কোন শব্দ নেই। আনন্দের মাথায় খারাপ চিন্তা ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। ম্যানেজার কে বলল রুমটা খুলতে।
কেউ নেই ঘরে। বিছানা পরিপাটি করে সাজানো। জন রাতে ফেরেনি। আনন্দের হার্ট বিট বাড়তে শুরু করলো। ক্লজেট টা খুলল। কয়েকটা জামা ঝুলছে। একটা ডাফেল ব্যাগ পরে আছে। আনন্দ উঠাল ব্যাগটা। ভিতরে হাত দিতেই আঠালো পদার্থের মত কি যেন হাতে লাগলো। রেখে দিলো । ক্লজেট টা বন্ধ করে দরজার দিকে ফিরতে যেয়ে আবারো ঘুরে দাড়ালো। বিছানার দু পাশের বালিশ সমতল ভাবে অবস্থিত নয়। একটা উচু অন্যটার চেয়ে। এগিয়ে গেল আনন্দ। বালিশটা সরাতেই দেখতে পেলো হুডেড সোয়েট সার্ট। মনে পড়ল সেই রাতে ধাক্কা দেওয়া লোকটার কথা। হুড দিয়ে ঢাকা মুখ, ওর চলার ছন্দ ছিল পরিচিত। ফটোতে দেখা সেই লোকটা। একই রং এর সোয়েট সার্ট। মাথাটা ঘুরে উঠল আনন্দের। তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এলো। বন্ধ করে দিলো দরজাটা।
নিচের বারে এসে বসলো আনন্দ। হাত কাপছে। চিন্তা শক্তি লোপ পাচ্ছে মনে হোল। ক্লাব সোডার পরিবর্তে হুইস্কি দিতে বলল। গ্লাসটা ঠোটের কাছে আনল আনন্দ। চুমুক দেবার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।
থম্পসনের ফোন। “আনন্দ, বিশ্বাস হয়? We got the killer. He is in our custody. You will be surprised.”। হাসতে হাসতে বলল থম্পসন।
আনন্দের সারা শরীর কেঁপে উঠল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো “কে সে?”।
“ আজ নয়, কাল বলব। এদেশ থেকে চলে যেতে চেয়েছিল। ঠিক সময়ে এয়ারপোর্ট থেকে ধরে আনা হয়েছে।” বললও থম্পসন ।
আনন্দ গ্লাসের তরল পানীয়টা গলার মধ্যে ঢেলে দিলো।
“ আগামীকাল দেখা হবে” বলে থম্পসন ফোন টা রেখে দিলো।
আনন্দ বুকের ভিতর একটা জ্বালা অনুভব করল। সে চায় এমিলির হত্যাকারী ধরা পরুক। কিন্তু ও যা ভাবছে সেভাবে নয়। উঠে পরতেই পা টা একটু টলকিয়ে উঠল। আবারো বসে পড়ল টুল টাতে। কাধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। ফিরে তাকাল সে। চোখটা কচলিয়ে নিয়ে তাকাল। অবিশ্বাস্য। ভুলে গেল পারিপার্শ্বিকতা। চিৎকার করে বলে উঠল,
” জন? ইজ ইট ইউ? কোথায় ছিলে ?” বলে জড়িয়ে ধরল জন কে।
ক্রমশ
এক অসমাপ্ত গল্প ( ১২ পর্ব)
১২ পর্ব
মাস খানেক হয়ে গেল শুভ্র মারা গেছে। বেলাল, কল্যাণী ফিরে গেছে তাদের নিজেস্ব জাগায়। আনন্দ তার চেম্বারে। কয়েকটা প্লান তাকে অ্যাপপ্রুভ করতে হবে। এমীলী গেছে ডালাসে। একটা কাজের তদারকিতে। জন ছুটিতে। ডেভিড ইদানিং অফিসে খুব কম আসে। আনন্দ থাকলে সে এদিকে পা মারায়না। ফোনে খবরা খবর নেয়। কাজের শেষে লরেন্স আর মাইক বাস্কেটবল খেলা দেখতে যাবে ম্যাডিশন স্কয়ার গার্ডেনে। আনন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে যাবে কিনা। এক্সট্রা একটা টিকেট আছে। আনন্দ বলেছিল, না, তার স্টিভের সাথে যাওয়ার কথা।
ওরা চলে গেল। আনন্দ স্টিভ এর সাথে যেয়ে বসলো বারে। স্টিভ বললও,” মহিউদ্দীনের বউ এর একমাসের মধ্যেই ডাক পরবে ভিসার জন্য। তুমি তো দেশে যাবে বলছিলে, তখনি সব ব্যবস্থা করে আসতে পারবে।”
আনন্দ কোন উত্তর না দিয়ে ক্লাব সোডা তে চুমুক দিলো।
“কি ব্যাপার? কথা বলছো না যে?”
“ ভাবছি, তোমাকে বলতে বাধা নেই। সকালে কাশি দিতেই কিছুটা লাল রং এর কফ বেড়িয়ে এলো। হয়ত কিছুই
নয়। অনেক সময় ড্রাই কফ থেকে হয়।”
ডাক্তারের কাছে কবে যাবে?
দেখি, যেদিন সময় হবে।
স্টিভ আনন্দের দিকে তাকিয়ে বলল, দোহাই তোমার। গাফিলতি করোনা।
তাছাড়া আরও একটা কারণেও আনন্দ মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছে। সানন্দার সাথে উইকএন্ডে যাওয়ার কথাছিল ওর ছোট মেয়ের বাসায়। তিন ঘণ্টার পথ। থাকে সে আলবেনীতে। কথা ছিল দুজনে যাবে। সকালে যেয়ে রাতে ফিরবে। শেষ সময়ে সানন্দা আরও একজনকে এই যাত্রায় সঙ্গী করাতে আনন্দ আর যেতে চাইনি। বলেছিল, তোমরা যাও আমার যাওয়া হবেনা। ভেবেছিল এটা সানন্দার একলা ওর সাথে না যাওয়ার অভিপ্রায়।
আনন্দর আত্মসম্মানে লেগেছিল। তার জের এখনও রয়ে গেছে আনন্দের মনে।
মেয়ে টার গানটা আজকে বেসুরো মনে হচ্ছে আনন্দের কাছে। তাল ঠিক নেই। দোষ গায়িকার নয়। আনন্দের মাথায় অজস্র চিন্তারই পরিণতি। অন্যদিন এই গায়িকারই গানের সাথে সাথে আনন্দ তাল দেয়। আজ মন, চোখ আর কান সমতল রেখায় অবস্থিত নয়। তাই সুরটা তার ভাল লাগছে না ।
স্টিভ কে গুডবাই বলে সে উঠে পড়ল। যাবার সময় কিছু খাবার নিয়ে নিলো তার পরিচিত রেস্টুরেন্ট থেকে। বাসায় আজ খাবার বাড়ন্ত। যেখান থেকে মাঝে মধ্যে খাবার আসতো সেখানের হাড়ী খালি।
সানন্দা বলেছিল, কটা দিন কোনমতে চালিয়ে নেও। পারবে নিশ্চয়?
আনন্দ বলেছিল, যা পাচ্ছি তাতো পরে পাওয়া পাঁচআনা। আমার জন্য ভেবোনা, এক পেট, কোন রকমে চালিয়ে নিতে পারব।
খাওয়া শেষে অলস ভাবে কিছুক্ষণ বসে ছিল ডাইনিং টেবিলে আনন্দ। আমেনা ভাবীর সাথে বেশ কিছুদিন হলো কথা হয়নি। ফোনটা উঠিয়ে ডায়েল করলো। ভোর আটটা ওখানে।
কেমন আছো আনন্দ দা? জিজ্ঞাসা করলো ভাবী।
ভালো, স্টিভের সাথে কথা হয়েছিল, খুব শীঘ্রই তোমাদেরকে ডাকবে ভিসার জন্য। সানন্দা কে বলেছি তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে, যদিও আমিই সব দেখাশোনা করব। তোমাদের কোন অসুবিধা হবেনা।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আমেনা ভাবি। বললও,” ভাই থাকতে আমি অন্যের বাসায় থাকতে যাবো কেন আনন্দ দা। তোমার ভাগ্নি না তোমাকে বলেছিল তোমার কাছে আমাদেরকে রাখতে পারবে কি না। আজ তুমি নিজে হাতে আমাদেরকে সরিয়ে দিচ্ছো”।
না তা নয়। আমি থাকি একলা।
সেই জন্যই আমাকে থাকতে হবে তোমার কাছে। ভাইকে বোন ছাড়া কে দেখবে বলো।
ঠিক আছে। তাই হবে। সব কিছু বুঝে নিও। অনেক দিন তো হোল এ বাসায় উনন জ্বলেনা। তুমি এসে জ্বালিও।
জানো আনন্দ দা আমার শুধু মনে হয় কবে সানন্দা দি কে দেখব। খুব দেখতে ইচ্ছে করে উনাকে। নিঃস্বার্থ ভাবে তোমাকে দেখে রাখছে।
সত্যিই এমন বান্ধবী পাওয়া দুর্লভ। ও ছিল বলেই কথা বলে আমার সময়টা কেটে যায়। নচেৎ জীবন টা কোন দিকে মোড় নিতো আমি নিজেও জানিনা।
আজ রাখি। এই বলে কথার সমাপ্তি টেনে ছিল আনন্দ।
রাত দশটা। উপরে উঠে এলো। কখন যে চোখের পাতা টা বুঝে এসেছিল সে নিজেও মনে করতে পারেনা। ফোনের শব্দে ধড়মড় করে উঠে পড়ল। ঘড়িটার দিকে তাকাল। রাত চার টা। ডালাস থেকে ফোন। এমীলীর কথা মনে হোল। হ্যালো বলতেই, পুরুষের গলা।
আনন্দ আছে ?
বলছি।
আমি ডিডেকটিভ জো থম্পসন। ডালাস থেকে বলছি।
আনন্দের ঘুমের ঘোর তখনও কাটেনি। “হোয়াট?”
পুনর্বার বললও “আমি ডিডেকটিভ জো থম্পসন। ডালাস থেকে বলছি। এমীলী স্মিথ কে চেনেন?”
আনন্দের বুকটা খালি হয়ে এলো। অশুভ কোন খবর। “আমার কলীগ। হোয়াটস রং?”
“ মারা গেছে, কেউ হত্যা করেছে মনে হচ্ছে। তোমার নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার ওর ব্যাগে ছিল। “
আনন্দ চুপ করে রইল, সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। এমেলী খুন হয়েছে। ও স্বপ্ন দেখেছে না তো? চামড়ায় চিমটি কেটে দেখল, না সে জেগে আছে।
“ এমীলীর মা বাবা কে খবর দেওয়া হয়ছে?” প্রশ্ন করলো আনন্দ।
“ না, ওদের ফোন নাম্বার টা থাকলে দাও।” বললও ডিডেকটিভ থম্পসন
ফোন নাম্বার টা দিয়ে আনন্দ বললও,” আই উইল বি ফার্স্ট ফ্লাইট আউট।”
রাত অনেক, ফোন করলো ডেভিড কে। বিস্তারিত সব কিছু জানিয়ে বললও,” আমি প্রথম ফ্লাইটে ডালাস যাচ্ছি সঙ্গে লরেন্সকে নেবো ভাবছি।”
ডেভিড ইতি বাচক উত্তর দিয়ে বললও,”আমাকে টাইম টু টাইম খবর দেবে।”
আনন্দ তাঁকে আশ্বাস দিলো, বললও “চিন্তা করোনা তোমার হার্টের প্রবলেম।” আনন্দ জানে ডেভিডের হার্টের পেলপিটিসন বেড়ে গেছে। নিজের কোম্পানির এমপ্লোই, খুন হয়েছে অন্য স্টেটএ। সব খবর না পাওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই।
লরেন্স কে কল করে এয়ারপোর্টে আসতে বললও। ভোর সাতটায় ফ্লাইট।
যথা সময়ে পৌছে, আনন্দ আর লরেন্স এলো হোটেলের চত্বরে। চারিদিকে ব্যারিকেড দেওয়া। লেখা আছে “ Do not cross the line.” আনন্দ নিজের পরিচয় দিয়ে ডিডেকটিভ থম্পসন কে চাইল। পরিচয় হতেই আনন্দ জিজ্ঞাসা করলো মৃতদেহের কাছে সে যেতে পারে কিনা।
না, বললও মিস্টার থম্পসন, “This is a crime secne. You will see the body in the morgue to indentify.”
“ তোমাকে আমার সাথে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে, এমীলী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য।” বলল মিস্টার থম্পসন।
দুর থেকে আনন্দ দেখল এমীলীর বাবা মা আসছে। ক্রন্দন রত। আনন্দ, লরেন্স, মিস্টার থম্পসন এগিয়ে গেল। আনন্দ জড়িয়ে ধরল এমীলীর বাবা কে। শেষ দেখা হয়েছিল ফার্মের বর্ষপূর্তি উৎসবে। সান্ত্বনা দেবার কিছু নেই। মিস্টার থম্পসন বলল, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো হত্যাকারী কে বের করতে।
আনন্দ লরেন্সকে বললও জনকে জানানোর জন্য, সে এমীলীর ফিআন্সে।
লরেন্স কে হোটেলে চলে যেতে বলে আনন্দ পুলিশ স্টেশনে এসে পৌছাল বিকেল তিন টায়। এমীলীর বাবা মার সাথে। জিজ্ঞাসা বাদ শেষে মিস্টার থম্পসন দুটো ফটো দেখাল আনন্দকে। প্রথমটা এমীলীর সাথে এক কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক এলিভেটরের কাছে দাঁড়ান। বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ। আনন্দ চেনে কিনা জানতে চাইলে বলল কোনদিন দেখেনি। অন্যটা হুড দিয়ে ঢাকা মুখ। চেনা যায় না।
তাহলে কি — , আনন্দের কথা শেষ না হতেই মিস্টার থম্পসন বলল, “Don’t come to the conclusion”.
“তুমি এখানে কিছুদিন থাকলে ভালহয়। “
আনন্দ আপত্তি করেনি। মিস্টার থম্পসন আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল,” তুমি বলেছিলে এমিলীর ফীয়ান্সে আছে। কাজ করে একি ফার্মে। নাম জন। তাই না?”
হাঁ
ওর ফোন নাম্বার আছে? জিজ্ঞাসা করলো মিস্টার থম্পসন
ওর সাথে যোগাযোগ করেছি, আগামীকাল আসবে।
আনন্দ ফিরে এলো হোটেলে এমিলীর বাবা মার সাথে। এমিলীর বডী পোষ্টমরটমে পাঠানো হয়েছে। মিস্টার থম্পসন বলেছে, যে লোকটার সাথে এমিলীকে দেখা গেছে তাকে তল্লাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া তে তার ফটো দেখানো হচ্ছে। অতি তাড়াতাড়ি তার খোজ পাওয়া যাবে আসা করছে।
আনন্দ ফোন করলো ফার্মে। ডেভিড কে বিশ্লেষণ করলো সব কিছু। বিষাদের কালো ছায়া সেখানে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। লরেন্স কে জিজ্ঞাসা করলো বারে যাবে কিনা। অস্থির লাগছে। না, সে এই মুহূর্তে কোথাও যেতে রাজি নয়। বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে লবিতে এসে বসলো লরেন্স।
আনন্দ বেড়িয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। লোকের চলাচল ততোটা নয়। রাস্তার পাশের গাছগুলো কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে পথ টাকে। এমিলীর হোটেলের দুই ব্লক দুরে আনন্দের হোটেল। সেখানে পুলিশের আনাগোনা এখন। একটা মাতাল পথ আগলিয়ে ধরে পয়সা চাইল। পুলিশের গাড়ী হর্ন বাজাতে বাজাতে আনন্দের থেকে কিছুদূরে যেয়ে দাঁড়াল। আনন্দ তার চলার গতি কমিয়ে দিলো। এই মুহূর্তে সে পুলিশের সাথে কথোপকথন করতে রাজি নয়। কিছুক্ষণ থেমে আবারো হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে গেল। রাস্তা নির্জন। এখনো চার ব্লক যেতে হবে। হঠাৎ করে গা টা শিরশির করে উঠল। আনন্দের মনে হোল কে জেনো ওকে ফলো করছে।
পিছন ফিরে থাকাল। কিছুদূরে একটা লোক আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে। মাথায় টুপি। হাতে ধরা একটা লম্বা আকারের জিনিস। কি সেটা এতো দুর থেকে বোঝা গেলনা। আনন্দ তাকাতেই লোকটা হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো। আনন্দের হার্টের দপদপানি বেড়ে গেল, হাতের তালু ভিজে। চারিদিকে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পেলনা।
পিছনে ফিরে এবার তাকাতেই ধাক্কা দিলো সামনে হেঁটে আসা লোকটা।
মাথায় হুড। এক ঝলক ফিরে তাকাল সে । অন্ধকারে আনন্দ দেখেতে পেলোনা মুখটা।
ক্রমশ
***স্থান কাল চরিত্র সব কাল্পনিক***
এক অসমাপ্ত গল্প ( ১১ পর্ব)
১১ পর্ব
ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল মাথা থেকে গালের পাশ বেয়ে। রক্তের স্রোত ততোটা নয়। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। পকেটের রুমাল টা দিয়ে মাথা টা চেপে ধরে পাশের গাছে হেলান দিয়ে বসলো আনন্দ। আকাশে তখনো জ্যোৎস্না। ভোর হতে কিছু বাকি। লোক টা রেগে গিয়েছিল। রেগে গিয়েছিল কারণ আনন্দের পকেটে কিছুই ছিলনা। মানিব্যাগ টা রেখে এসেছিল গাড়ীতে, ফোন টা কোথায় মনে করতে পারেনা। গালাগালি দিয়েছিল লোকটা। “ হারামজাদা, কিছু নেই পকেট ? আজকের প্রথম বউনী আমার মাঠে মারা গেল ?” বিড়বিড় করে আরও কি জেনো বললও। তারপর পিস্তলটা আনন্দের বুকের কাছে ধরল। আনন্দ দেখতে পেলো হুডের নীচে ওর চোখের হিংস্রতা। দ্রুত তার মাথার মধ্যে খেলে গেল, “দিনের শুরুতে তার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে আজ। দীপ, সু তাদের মা কে হারিয়েছে আজ তারা বাবা কেউও হারাতে চলেছে। পিস্তল টা যেখানে ধরা সেখানেই হৃদপিণ্ড। গুলিটা হৃদপিণ্ড কে ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে যাবে। ও লুটিয়ে পরবে মাটিতে। পুলিশ আসবে। কোন আইডেনটিটিকার্ড নেই ওর কাছে। ও হয়ে যাবে জন ডো।”
না, লোক টা গুলি না করে এক পা পিছিয়ে গেল। তারপর পিস্তলের বাঁট দিয়ে জোড়ে মেরেছিল আনন্দের মাথায়। লুটিয়ে পড়েছিল আনন্দ। কতক্ষণ জানেনা। চোখ খুলতেই মনে হল গালের পাশটা ভিজে ভিজে। রক্ত।
গাছে হেলান দিয়ে বসে আনন্দ ভাবল এবার উঠতে হবে। রক্ত গুলো জমাট বেঁধে গেছে। ফিরে যেতে হবে পুলিশ আসার আগেই। পুলিশে ছুলে আঠারো ঘা। ওরা বিভিন্ন জিজ্ঞাসা বাদ করবে। কাজের কাজ কিছুই হবেনা। সময় নষ্ট। হাসপাতালে সে যেতে রাজি নয়। বিভীষিকা ময় ER সে দেখেছে। বাসায় ফিরে এলো আনন্দ। রুমাল টা রক্তে ভেজা। গালের পাশের জমাট বাধা রক্ত গুলো গরম জল দিয়ে পরিষ্কার করলো। আঠা আঠা চুলগুলো সরিয়ে আয়না দিয়ে দেখতে চাইলো ডেমেজ টা কতটুকু। ততোটা নয়। ইস্টিচ লাগবে বলে মনে হোল না। আশেপাশের চুল গুলো কেটে জাগাটা পরিষ্কার করলো আনন্দ। এলকোহল প্যাড টা চেপে ধরল কাটা জাগায়। ঠোট দুটো কামড়িয়ে জ্বালাটা কমাতে চাইল । এনটিবাওটিক ওয়েনটমেনট লাগিয়ে সোফাতে এসে বসলো আনন্দ।
সকাল হয়ে এলো। বন্ধের দিন আজ। এতো ভোরে কাউকে বিরক্ত করতে চাইলনা। একবার ফোনটা উঠিয়ে ছিল সানন্দাকে ঘটনাটা জানানোর জন্য। পরে রেখে দিয়েছিল। ইদানিং সবকিছুতে না সুচক উত্তরের জন্যই হয়তবা।
সকাল দশটা। আনন্দ টেক্সট মেসেজ পাঠাল ওদের চার জন কে। বিস্তারিত না জানিয়ে। শুধু লিখেছিল, মাথাটা কেটে গেছে, রক্ত এসেছিল, এখন বন্ধ। আনন্দ জানে এটাই যথেষ্ট। এখনি ফোন আসা আরম্ভ হবে। ঠিক তাই। সু র ফোন।
কি বললে তুমি? রক্ত এসেছিল ? কিভাবে? কখন?
আনন্দ কিছু বলার আগেই সে বললও,” তুমি ফোন রাখো, আমি দীপ কে কল করে থ্রি ওয়ে কথা বলব।”
সব কিছু বিশ্লেষণ করতেই দীপ বললও,” আমরা এখনি আসছি।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে চার জন এসে হাজির। বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। কেন এতো রাতে বের হয়েছিল। বের যদি হবেই তবে পার্কে যাওয়ার কি দরকার। অবশেষে ওদের প্রস্তাব আনন্দকে দুজনের যেকোনো এক বাসাতে থাকতে হবে। একা আর নয়।
আনন্দ একটু হাসল। ওদের ছেলে মানুষি দেখে। আসলে বাবাকে ভালবাসে তাই। সহজ সরল সমাধান।
তা হয়না, বললও আনন্দ। আমার নিজস্ব একটা স্বত্বা আছে। তাছাড়া আমিতো পঙ্গু হয়ে যাইনি। তোমাদের উৎকণ্ঠা আমি বুঝি। শোন, কথার মোড় ঘুরিয়ে বললও, “ বউমা, তোমার ডাক্তার ফারুক আঙ্কেল কে কল করে বল যদি পারে তবে একবার জেনো আসে এখানে”।
সু, দীপ, রাজ বউমা এদের নিয়েই আনন্দের সংসার। প্রতিদিন দুই তিন বার করে ফোন করবে। বাবার কি অবস্থা। ওরা ভাবে আনন্দের নিজেকে টেক কেয়ার করার ক্ষমতা ফুরিয়ে এসেছে। খুব বেশি ভালবাসার এটাই হয়ত নিদর্শন।
দরজার বেলটা বেজে উঠল। রাজ দরজাটা খুলে দিতেই সানন্দা ঘরে ঢুকল।
“ আমাকে জানাওনি কেন।”
বিরক্ত করতে চাইনি। বললও আনন্দ।
“সেই রাতে তুমি যে ফোন করেছিলে কথা বলবে বলে, যদি কথা বলতাম তা হলে হয়ত এ ঘটনা নাও ঘটতে পারতো। নিজেকে খুব দোষী মনে হচ্ছে।”
“ তুমি কি করবে বলো, বিধির বিধান তুমি তো খণ্ডাতে পারবেনা।”
সানন্দাকে খবর সু দিয়ে ছিল। জানে সানন্দা আসলে একটু স্বস্তি। সেই সব দেখাশুনা করতে পারবে।
বউমা বললও, “অ্যান্টি তুমি বাবার পাশে বসো আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।” বলে সবায় কে ইঙ্গিত করলো অন্য ঘরে যেতে।
ওরা উঠতে যাওয়ার আগেই সানন্দা সু কে বললও এলকোহল প্যাড, ডিসপজেবল গ্লভস, অ্যান্টিবাওটিক অইনটমেন্ট আর ব্যান্ডেট টা আনতে। কাটা জাগা টা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেট টা লাগিয়ে দিয়ে বললও,” এসব পাগলামি বন্ধ করো। রাত বেরাতে বেড়িয়ে একটা না একটা অঘটন করবে আর অন্যদেরকে ভোগাবে।”
আনন্দ সানন্দাকে দেখছিল। ভাবছিল, শুধুতো বান্ধবী তার বেশি তো কিছু নয়। সব কিছুই সে করছে অথচ কোথায় জেনো একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
মনে পরে একদিন আনন্দ বলেছিল,”যাবে কি আমার সাথে, আমি লন্ডন হয়ে মারাকাশ যাবো। তোমার আপত্তি আছে?”
যেতে চাইলেও যেতে পারবো না বলেছিল সে।
কেন? বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল সানন্দার দিকে।
আমি বিধবা, সমাজ নিয়ে চলতে হয়। তোমার মত উদার মনের মানুষ তো সবায় নয়। অনেকে অনেক কিছু মনে করতে পারে।
মনে করতে পারে ? কি মনে করতে পারে ? ছেলে মেয়ে একসাথে ভেকেসনে যেতে পারবেনা ? তাতে অসুবিধা কোথায় ? আনন্দ কিছুটা উত্তেজিত হয়েই কথা গুলো বলেছিল।
সানন্দা ধীর স্থির। উত্তেজিত হতে আনন্দ তাঁকে দেখিনি কখনো। সেটাকে বজায় রেখে বলেছিল, লোকের মুখতো বন্ধ করতে পারবেনা। তারা দেখবে অন্য চোখে। সে সুযোগ নাই বা দিলে। তোমার সাথে বোস্টনে তোমার বান্ধবীর বাসাতে তো গিয়েছিলাম। সেখানে ছিল তোমার বান্ধবী ও তার স্বামী। অসুবিধা হয়নি কারণ সেখানে তুমি আমি একা নই। এখন বুঝলে?
বুঝেছি? গজগজ করতে করতে আনন্দ বলেছিল, এই ঘুণধরা সমাজটার মানসিক চিন্তা ধারা যদি পাল্টানো যেতো।
সানন্দা হাসতে হাসতে বলেছিল তুমি তো সমাজ কর্মী নও, নিতান্তই ভালো মানুষ। তোমাদের মত মানুষরা শুধু দুঃখই পায় ।
দুমাস পরে আমি দেশে যাবো, কয়েকটা কাজ হাতে নিয়ে তখন যাবেতো। আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল সানন্দা কে।
যাবো। তোমার বোনের বাসায় উঠবে তো। তাতে আমার আপত্তি নেই।
কি ভাবছ? সানন্দার ডাকে আনন্দ ফিরে এলো বাস্তবে।
উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। বেলালের ফোন। অনেক দিন পরে। সানন্দা ফোনটা উঠিয়ে হ্যালো বোলতেই , সরি, রং নাম্বার বলে বেলাল রেখে দিচ্ছিল।
“ বেলাল ভাই , আমি সানন্দা।”
“ আমি কি তোমার ফোনে কল করেছি?”
“ না, তুমি আনন্দ দার ফোনে কল করেছ। সে একটু বাস্ত। তুমি ধর।”
হ্যালো বলতেই ,” আনন্দ দা আমি নিউইয়র্কে। শুভ্র মারা গেছে।” বলে একটু থামল বেলাল। “ তুমি আসতে পারবে? একটু এসো, কল্যাণী কে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে আমার পক্ষে। পারবে আসতে?”
ওর বেদনা ভরা কণ্ঠস্বর আনন্দ কে ব্যাকুল করে তুলল।
“ঠিক আছে, ঠিকানা টা দাও আমি আসছি”। যদিও মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ব্যাথার ঔষধ খেয়েছে কিনতু না গেলেই নয়।
সানন্দকে সব বুঝিয়ে বলতেই সে বলল,” আমি তোমার সাথে যাবো”।
সু,দীপ জানে বাবা কে বলে কোন লাভ নেই। সে যখন মনস্থির করেছে যাবে, তখন সে যাবেই। তবে সান্ত্বনা সানন্দা সাথে যাচ্ছে।
লোকের ভিড় বেশি নয়। কল্যাণী কাঁদছে। সানন্দা এগিয়ে গেল ওর দিকে। বেলাল আনন্দকে জড়িয়ে ধরল।
ড্রাগ ওভারডোজ। বললও বেলাল।
মা মারা গিয়েছিল ছোট বেলায়। কল্যাণী দশ, শুভ্র আট। বাবা বিয়ে করেছিল এক বছরের মাথায়। সৎ মার সাথে বনিবনা হয়নি ওদের দুজনের। বাবা বুঝেও না বুঝের ভান করে থাকতো। মামা একদিন ওদের কে নিয়ে গিয়েছিল তার বাসায়। বাবা না করেনি। সন্তান হীন মামা কোলে পিঠে করে ওদের দুজন কে মানুষ করেছিল। দিয়ে ছিল উচ্চশিক্ষা। কল্যাণী ভালো চাকরি নিয়ে চলে গিয়ে ছিল ডালাসে। শুভ্র নিউইয়র্কে এপার্টমেন্ট ভাড়া করেছিল।
পিটার লুগারের সাথে শুভ্রর দেখা হয়েছিল এক কন্সার্টে। সম বয়সী। অতি ভদ্র, যুক্তি তর্ক দিয়ে কথা বলে। কথায় মাধুরী মিশানো। বন্ধুত্ব হয়েছিল। পিটার শুভ্রকে নিয়ে গিয়েছিল এক পার্টিতে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল লোটাসের সাথে। ড্রাগ ডিলার। শুভ্রকে হুকড আপ করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি লোটাসের। সেই শুরু।
ভাইকোডিন। প্রথমে একটা দুটো পিল। তারপর ক্রমেই বাড়তে থাকল পিলের পরিমাণ। সেই সাথে কাজে যাওয়া কমে আসল। শুভ্রর বস কল্যাণী কে বলেছিল ওর কাজের অনিয়মের কথা। অনেক চেষ্টা করেছিল কল্যাণী ওকে এই নেশার থেকে ফেরাতে। পারেনি।
এক রাতে পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ডাক্তার বললও Pancreatites. শুভ্র তার এডিকশনের কথা বলেনি। তাঁকে prescribe করা হোল ভাইকোডিন। ব্যাথার জন্য। বাসায় ফিরে এসে কল্যাণীকে ফোন করে বলেছিল, আপা আমি বোধ হয় আর বাচবো নারে। সেই রাতে ব্যাথার যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে ভাইকোডিনের পুরো বোতল ঢেলে দিয়েছিল গলার ভিতর। সব ব্যাথার অবসান হয়েছিল। চোখ আর খোলেনি শুভ্র।
আনন্দ ধীর পায়ে এগিয়ে গেল কল্যাণীর কাছে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। কল্যাণী,সানন্দা,বেলাল কাঁদছে। দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবা। চোখে জল নেই। তাকিয়ে আছে সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশের দিকে। আর নয়। এবার শুভ্রর যাবার পালা হিম শীতল কক্ষে। কান্নার ধনী চারিদিকে। ফুঁপিয়ে উঠল কল্যাণী।
কাল শুভ্রর শেষ যাত্রা।
ক্রমশ
এক অসমাপ্ত গল্প
১০ পর্ব
সাত দিন পর আনন্দ ফিরে এসেছিল। সাতটা সুন্দরতম দিন কাটিয়েছিল ফ্লরেন্তার সাথে। বসে ছিল টেমস নদীর ধারে। সময় ক্ষণ, ঝিরঝির বাতাস, নির্মল সন্ধ্যা, আকাশে চাঁদ এই সব বেস্টিত জগত ফ্লরেন্তাকে করেছিল ব্যকুল। সেই সন্ধ্যায় অনর্গল বলে গিয়েছিল তার জীবনের ডায়রি।
এক ভাই এক বোন। ডেভিড আর ফ্লরেন্তা। ফ্লরেন্তা সাত বছরের ছোট। যখন তার বয়স পঁচিশ. গাড়ী দুর্ঘটনায় বাবা মার মৃতু গভীর দাগ কেটেছিল ওর মনে। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে চেয়েছিল, পারেনি। মা বাবার আদর আর ভাইয়ের ভালবাসায় বড় হয়েছিল। হঠাৎ জীবনের এই একটা অংশ হারিয়ে যাওয়া সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। মানসিক ডাক্তারদের মতে এ শুধু সময় সাপেক্ষ।
ইন্টারনেট খুঁজে জেনেছিল, মানসিক শান্তির পথ আছে শুধু মেডিটেশন আর ইয়োগার মাধ্যমে। যেতে হবে আশ্রমে। কোথায় সে আশ্রম ?
ভারতের কেরালা স্টেটে।
ডেভিড কে বলেছিল। ডেভিড না করেনি। শুধু বলেছিল তার এক বন্ধু থাকে দিল্লিতে সেই সব ব্যবস্তা করে দেবে।
দিল্লী বিমান বন্দরে যথাসময়ে জনাথন ফ্লরেন্তাকে রিসিভ করে নিয়ে গিয়েছিল ওর এপার্টমেন্টে। ফ্লরেন্তার থাকার ব্যবস্থার কোন ত্রুটি জনাথন করেনি।
জনাথন বলেছিল,” চলো, আশ্রমে যাওয়ার আগে তোমাকে ঐতিহাসিক জাগা গুলো দেখিয়ে নিয়ে আসি। রাজি তো?”
ফ্লরেন্তা রাজি হয়েছিল। কেন জানি জনাথনের সান্নিধ্য তার ভালোই লাগছিল। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, উচ্চতা সাত ফুটের কাছা কাছি। এক কন্সট্রাকশন কোম্পানির উচ্চপদে অধিসঠিত। জনাথন কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ফ্লরেন্তাকে দেখিয়ে ছিল লাল কেল্লা,কুতুব মিনার। গিয়েছিল তাজমহল দেখতে।
তাজমহলের চত্বরে বসে সেই প্রথম জনাথন চুমো দিয়েছিল ফ্লরেন্তা কে। ফ্লরেন্তা বাধা দেইনি। এক নতুন আনন্দের শিহরনে তার সর্ব শরীর শিহরিত হয়ে উঠেছিল। আশ্রমে আর যাওয়া হয়নি। থেকে গিয়েছিল জনাথনের সাথে। ডেভিড কে জানিয়ে ছিল সব কথা। বলেছিল ওদের বিবাহর দিন ঠিক হয়েছে। ওরা জেনো আসে এই অনুষ্ঠানে।
কিছু মাস পর জনাথন নূতন কাজ নিয়ে চলে এসেছিল লন্ডনে ফ্লরেন্তাকে নিয়ে। ফ্লরেন্তা আরম্ভ করেছিল স্কুলের মাস্টারি। কাজের ফাকে ফাকে দুজনে চলে যায় বিভিন্ন জাগায়। বাবা মা হারিয়ে যাওয়ার বেদনা লাঘব হয়েছে ফ্লরেন্তার। মানসিক ভারসাম্য ফিরে পেয়েছে।
একদিন ফ্লরেন্তার স্কুল ছুটি হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের আগে। ঠিক করেছিল জনাথন কে ফোন করে বলবে লাঞ্চ করবে একসাথে। কি মনে করে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। ভেবেছিল তার নিজেস্ব কিছু কাজ আজে, সময়ের অভাবে শেষ করা হয়ে ওঠেনি। তাই বাসায় ফিরে যাওয়াটাই মনস্থ করল ।বাসার ড্রাইভওয়েতে অচেনা একটা গাড়ী। জনাথনের গাড়ীও এই মুহূর্তে এখানে থাকার কথা নয়। ভয়ে ভয়ে দরজাটা খুলেছিল ফ্লরেন্তা।
জনাথন সোফাতে গভীরভাবে মিশে গেছে এক অচেনা মেয়ের মাঝে। শুধু শুনতে পেলো ইস,উঃ,আঃ,আঃ শব্দ। হাতের কাছের ফুলদানী টা ছুড়ে ফেলেছিল। ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে পড়েছিল দুরে। জনাথন কে বেড়িয়ে যেতে বলেছিল বাসা থেকে।
সেই শেষ।
তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। স্কুলের এক মিটিং এ দেখা হয়েছিল এনড্রুর সাথে। এনড্রু বলেছিল ওর এনড্রু কমিউনিটি প্রজেক্টের কথা। ফ্লরেন্তার ভালো লেগেছিল। হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়ে গুলোকে ভালবাসা দিয়ে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়ে ছিল। আর পিছনে ফিরে তাকায়নি।
বিমান বন্দরে বিদায় দিতে এসে বলেছিল, আনন্দ তোমার সান্নিধ্য আমার খুব ভালো লেগেছে। পারলে আবার এসো।
আনন্দের কেন জানি অস্বস্তি লাগছে আজ। দুদিন ঘুম আসেনি। গতকাল আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল সানন্দাকে ,” যাবে নিউপোর্টে বেড়াতে? খুব একটা দুর নয়। সকালে যেয়ে রাতে ফিরে আসবো। যাবে?”
হা, না কিছুই সে বলেনি। যেতে ইচ্ছুক্ক নয় মনে হোল। কোথায় জেনো একটা দ্বিধা। আনন্দ আর কোথা বাড়ায়নি। আনন্দের স্বভাব, একবার চাইলে যদি না পাওয়া যায়, দ্বিতীয় বার সেটা চাইতে সে রাজি নয়। আজ হঠাৎ করে কেন সব কিছুর পরে বিতৃষনা আসছে সে বুঝতে পারছেনা। রাত দশটা। মনে হচ্ছে কারো সাথে যদি একটু কথা বলেতে পারতো হয়ত ভালো লাগত। সানন্দা কে ফোন করেছিল।
বলল,” ভাল লাগছেনা। তাই কথা বলে কিছুটা সময় পার করতে চেয়েছিলাম। তুমি কি বাস্ত?”
একটু, কাল কথা বলবো?
ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো আনন্দ। নীচে নেমে টিভি টা অন করলো। ভালো খবর নেই। শুধু মারামারি কাটাকাটি। বন্ধ করে দিলো। মাথার পোকাটা আজ আনন্দকে পেয়ে বসেছে। রাত এগারটা।
গাড়ীর চাবিটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। রাস্তা নির্জন। ভাবল কিছুক্ষণের জন্য উদ্দেশহীন ভাবে ঘুরবে। একটু ড্রাইভ করতেই পাশে একটা পার্ক দেখে থামালো গাড়ীটা। পার্কের ভিতরে পায়ে চলা পথ। কিছুদুরে একটা ছোট্টও দীঘি। শান বাধানো। আনন্দ এসে বসলো সিঁড়িটার পরে। ফুটফুটে জোছনা। চাঁদের এলো ঝরেঝরে পড়ছে দীঘির জলে। নিস্তব্ধ চারিদিক। নিস্তব্ধটাকে ভাঙতে চাইল আনন্দ। ছোট্টও একটা পাথর ছুড়ে মারল দীঘির জলে। টলমল করে উঠল জল। চাঁদের আলো জলের ঢেউএ মিশে সৃস্টি করলো এক অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ। আনন্দের মনে হোল অসংখ্য হীরের টুকরা ঝলমল করছে।
চোখ বুজে এলো। শুয়ে পড়ল দীঘির পাড়ে।
ফিরে গেল অনেক পিছনে।
বসুন্ধরা মার্কেটে ঘুরছিল ওরা দুজন।
কণার ব্যাগে টান পড়তেই হাতটা চেপে ধরেছিল। ছোট্টও বাচ্চার হাত। ফিরে তাকাতেই দেখল চোখ ছলছল করা এক সাত আট বছরের ছেলে।
বললও, “ আমাকে পুলিশে দিয়েন না মেম সাব ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”
একাজ কেন করছিস ? ধমক দিয়েছিল কণা।
ওরা আমাকে করতে বাধ্য করেছে, তা না করলে আমার হাত কেটে ফেলবে।
ওরা কারা? জিজ্ঞাসা করেছিল কণা
যাদের কাছে মা বাবা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল।
বিক্রি করে দিয়েছিল?
হা, মাত্র পাঁচশ টাকা দিয়ে। আমার অনেক খিদে পেয়েছে মেমসাব।
কণার হাসি পেয়েছিল। সে এসেছিল চুরি করতে, এখন চাচ্ছে ভাত। কণা নিয়ে গিয়েছিল পাশের হোটেলে।
খাওয়া শেষে বলেছিল, আমরা ছিলাম দুই ভাই এক বোন। কোন দিন পেট ভরে খেতে পারিনি। বাবা ছিল অসুস্থ।
মা অন্যের বাসায় ধোয়া মোছার কাজ করত। মার পাশে আমরা দুই ভাই শুয়ে থাকতাম। রাতে দেখতাম মা কাঁদছে। একদিন দেখলাম দুটা লোক এসে মা বাবার সাথে কি জেনো গুজগুজ ফুসফুস করছে। আমি আসতেই ওরা কথা বন্ধ করে দিলো। আরও একদিন দেখলাম ওদেরকে। শুনলাম টাকার কথা বলছে। পাঁচশো, পাঁচশো।
এর পর কথা নয়। শুধু খসখস শব্দ শুনলাম। শুনলাম কান্নার আওয়াজ। মার কান্না মনে হোল।
কিছুই বুঝলাম না। ভাই আমার দু বছরের বড়। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম। ও একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে কি জেনো গুনতে থাকল। সেই শেষ দেখা তার সাথে আমার।
ওরা বেড়িয়ে এলো। বাবা শুয়ে ছিল। ডাকল আমাদেরকে। শুধু দুজনের মাথায় হাত বুলাল। কিছু বলল না।
চোখের কোণ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।
মা পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে যেয়ে বলেছিল, ওদের সাথে যেতে, ভালো ভালো খেতে পারবো। নতুন নতুন জামা কাপড় পাবো। এখানে তো একবেলাও খাওয়া জোটেনা। ছেড়া কাপড় পরে থাকি।
ওরা শিখিয়ে ছিল কেমন ভাবে পকেট কাটতে হবে। বলেছিল যদি প্রতিদিন এই পরিমাণ টাকা না আনতে পারি তবে খাওয়া বন্ধ। আর চাবুক দিয়ে পিঠ ছিলে দেবে।
পিঠের কাপড় উঠিয়ে দেখিয়েছিল দাগ গুলো। দু একটা জাগা এখনো শুকিয়ে যায়নি।
কণা উঠে চলে গিয়েছিল। গিয়েছিল রেস্টরুমে। আনন্দ জানে কণা ওখানে যেয়ে কাঁদবে।
ফিরে এসেছিল চোখ লাল করে। কিছু টাকা ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, “ তুই যা, এর বেশি আমি তোকে কিছু করতে পারবোনা। ওদের হাত থেকে আমি তোকে বাঁচাতে পারবোনা।”
সে চলে গেল, মিশে গেল ভিড়ের মাঝে।
কোথায় একটা খসখস শব্দ। উঠে বসল আনন্দ। সেল ফোনটা খুঁজল। পেলোনা। হয়ত গাড়ীতে। কিছুই মনে করতে পারলনা। চাঁদটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। পাখিদের কলকাকলী নাই। ভোর হতে দেরী আছে। আনন্দ চিন্তা করলো কোথায় সে তার গাড়ীটা পার্ক করেছিল। পায়ে চলা পথ দিয়ে এগুতেই দেখতে পেলো কে একজন সামনে এগিয়ে আসছে। ভাবল ওরই মত দুঃখ বেদনা দুর করতে এসেছে এই নির্জনে। কাছে এসে দাঁড়ালো। এই গরমেও মাথা হুডটা দিয়ে ঢাকা। চাঁদের আলোতে ঝলমল করে উঠল ওর হাতের সিলভার রংএর পিস্তল টা।
ক্রমশ
এক অসমাপ্ত গল্প ( ৯ পর্ব)
নয় পর্ব
ডি এন্ড জে এসোসিয়েটের কর্মক্ষেত্র আজ আনন্দে ভরপুর। ডেভিড ফিরে আসছে পাঁচ মাস পর। এমিলি, জন, লরেন্স মিলে তৈরি করেছে “ওয়েল কাম ব্যাক” কার্ড। খুবই সুন্দর দেখতে । সবাই লিখেছে কিছুনা কিছু। ছোট্টও করে আনন্দ লিখেছিল, লং লীভ দা কিং।
ডেভিড এলো এগারটায়। জেনিফারের সাথে। সবার সাথে হাত মেলানোর পর কিছু বলতে যেয়ে আবেগে বলতে পারলনা। চশমাটা কয়েকবার মুছতে হোল। অবশেষে সবাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে বললও সে কোনদিন ভুলবে না যে সাপোর্ট সে পেয়েছে সবার কাছ থেকে। সব শেষে সে যেয়ে বসলো তার নিজের রুমে। আনন্দকে বললও সে যেন দেখা করে তার সাথে।
আনন্দ রুমে আসতেই ডেভিড দরজা টা বন্ধ করে দিতে বললও। জেনিফার বসে আছে একটু দুরে। কোন ভণিতা না করেই ডেভিড সরাসরি বললও,” তোমাকে আমি আমার ফার্মের অর্ধেক পার্টনারশিপ দিতে চাই। রাজি আছো?’
আনন্দের একটু সময় লাগলো ডেভিড কি বলছে সেটা বুঝে উঠতে। ডেভিড আবারো বললও, আমি হয়ত আর পুরোপুরি সময় দিতে পারবোনা এই ফার্মের জন্য। । এই পাঁচমাস তুমি এক হাতে যে ভাবে ফার্ম টাকে এগিয়ে নিয়ে গেছো তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। এটা শুধু আমার পরিকল্পনা নয়, জেনিফারের ও। এই ফার্মের হাল একমাত্র তুমিই ধরতে পারবে। কি বল, রাজি?
জেনিফার এগিয়ে এলো আনন্দের কাছে। “ তোমাকে এই মুহূর্তে কথা দিতে হবেনা। চিন্তা করে দেখো।”
আনন্দ তাকাল দুজনের দিকে। “ এটা আমার স্বপ্নের অতীত যে এ ধরনের প্রস্তাব তোমরা আমাকে দিতে পারো। আই রিয়েলি অ্যাপরিসিয়েট ইট। কিন্তু,” বলে আনন্দ থামল।
ডেভিড জেনিফার দুজনেই তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে।
“ অর্ধেক পার্টনারশিপ নিতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা আমার কাছে নাই, ডেভিড।’ বললও আনন্দ
“ তোমার যাতে হার্ডশিপ না হয় সে বাবস্থা আমি করবো” ডেভিড বললও।
“ তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই”
ডেভিড উঠে এসে জড়িয়ে ধরল আনন্দ কে। জেনিফার গালটা এগিয়ে দিলো।
আনন্দ উঠে চলে যেতে যেয়ে আবার ফিরে এলো। একটা কথা আছে।
বলো।
আমি কিছুদিনের জন্য একটু বাহিরে যেতে চাই। পারবে এক সপ্তাহ সামলাতে এদিকটা। বললও আনন্দ।
ডেভিড মাথা নেড়ে হাঁ সূচক ইঙ্গিত দিয়ে বললও,” ডেফিনিট”। শোন?
আনন্দ ফিরে তাকাল।
ফ্লরেন্তা তোমাকে ফোন করতে বলেছে, এই ওর সেল নাম্বার। বলে, হাতের কাগজ টা এগিয়ে দিলো ডেভিড আনন্দের দিকে।
হাতের কাজ গুলো শেষ করে ডায়েল করলো আনন্দ। লন্ডনে এখন রাত নয় টা। পাঁচ বার রিং হওয়ার পর ফোন টা ধরল ফ্লরেন্তা।
“ কেমন আছো?” জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ
“ভালো,এখানে ইউরো সকার ফাঁইনাল। দুটো টিকেট আছে। অনেক কষ্টে পেয়েছি । চলে এসো।” বললও ফ্লরেন্তা
আনন্দ রাজি, যথারিতি দরকারি জিনিস পত্র ক্যারিঅনে নিয়ে পরদিন রওনা হয়ে গেল।
হিতরো এয়ার পোর্টে যখন এসে নামল তখন ভোর পাঁচটা। ফ্লরেন্তা দাঁড়িয়েছিল বাহিরে। ওকে দেখে দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। “ ফ্লাইটে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”
“মোটেও না” বললও আনন্দ।
ফ্লরেন্তার গাড়ীতে করে এসে পৌছালো ওর এপার্টমেন্টে। আধা ঘণ্টার পথ। সুন্দর ছিমছাম করে সাজানো ঘর। ফ্লরেন্তা আনন্দকে তার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললও। “ এখন অনেক সকাল, তুমি রেস্ট নেও। নয় টার দিকে আমরা নাস্তা করব। কেমন?”
আনন্দ রাজি। সেও ভীষণ ক্লান্ত। কিছুক্ষণ ন্যাপ নেওয়াতে শরীরটা একটু ঝরঝরে মনে হোল আনন্দের। বসার ঘরে এসে দেখে ফ্লরেন্তা খবরের কাগজ পড়ছে।
“ কি ঘুম হয়েছে ?” জিজ্ঞাসা করলো ।
“গোসল করে নাও। নাস্তা শেষে আমরা বের হবো। কেমন? তোমাকে নিয়ে যাবো আমার কাজের জাগায়।” বলল ফ্লরেন্তা।
আনন্দ বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবল, ফ্লরেন্তার সাথে দেখা হয়ে ছিল মাত্র একবার। অথচ মনে হচ্ছে সে অনেক দিনের চেনা।
লন্ডন শহরে সূর্যের মুখ দেখা দুরহ। আজ তার ব্যতিক্রম। ঝলমলে রোদ। মনে একটা আলাদা আমেজ এনে দিচ্ছে। আনন্দ ভাবে, সে এসেছিল লন্ডনে অনেক অনেক আগে। হেঁটেছিল দুজনে এই টেমস নদীর পাশ দিয়ে। বসে ছিল বিগ বেনের সামনে। ও আনন্দের কাঁধে মাথা রেখে তাকিয়ে ছিল চোখের দিকে। ভালবাসার ফুলগুলো ঝড়ে পড়ছিল চোখের চাউনী থেকে। সবই আজ স্রীতী।
কি ভাবছ?
কিছুটা জীবনের পিছনে চলে গিয়েছিলাম। “চলো।”
যাওয়ার পথে টমকে উঠিয়ে নিতে হবে। আমার কলীগ। বললও ফ্লরেন্তা।
টমের বাসা, গলিতে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের বসবাস এখানে নয় মনে হোল আনন্দের। খোলা ডাস্টবিনের ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দুরে ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। হর্ন দিতেই টম বেড়িয়ে এলো। বয়স বিশ থেকে পঁচিশ এর কোঠায়। গাড়ীতে আসতেই ফ্লরেন্তা পরিচয় করিয়ে দিলো। একটু লাজুক প্রক্রিতির। কথার মাঝে সে জিজ্ঞাসা করলো আনন্দকে কতদিন থাকবে।
আনন্দ বললও,” এসেছি ফাইনাল খেলা দেখতে। শেষ হওয়ার পর আরও দু এক দিন থাকব, তারপর প্যারিস, জার্মানি হয়ে স্টেটসে ফিরে যাবো।”
তিন তালা বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো ফ্লরেন্তা। লেখা এন্ডড্রুস কমিউনিটি। জিজ্ঞাসা করতেই ফ্লরেন্তা বললও,” এন্ডড্রু নামের এক বিশাল ধনী লোক এর খরচ চালায়। দেখবে, কত হারিয়ে যেতে পারতো এমন ছেলে মেয়েরা আজ তাদের জীবনের সন্ধান খুঁজে পেয়েছে।”
আনন্দ দেখল বিভিন্ন রুমে বয়স বারো থেকে বিশ বছরের ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন কাজ নিয়ে বাস্ত। ফ্লরেন্তা আর টম চলে গেল তাদের নিজের কাজে। ফ্লরেন্তা যাওয়ার আগে বলে গেল,” আনন্দ তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো। আমি মিটিং সেরে তোমার সাথে দেখা করবো।”
দুরে একটা মেয়ে কাঠের সরঞ্জাম দিয়ে কি জেনো বানানোর চেষ্টা করছিল। আনন্দ এগিয়ে গেল মেয়েটার কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তার হাতের কাজ। মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল।
“কিছু বলবে” জিজ্ঞাসা করলো
“ না, তোমার হাতের কাজ দেখছি। খুব সুন্দর। কার কাছ থেকে শিখেছ?”
“ এনড্রিয়ার কাছ থেকে।”
নাম কি তোমার?
আলভীনা।
সুন্দর নাম। কিভাবে এলে এখানে?
সে এক বিরাট কাহিনী।
বলবে কি?
দুটোয় আমার লাঞ্চ ব্রেক, তখন এসো বলবো।
সে বলেছিল, আনন্দের চোখের জল বাঁধ মানেনি সেদিন।
বারো বছর বয়সে তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। বাপের হাতের পিটুনি, মার গঞ্জনার থেকে বাঁচতে যেয়ে ধরেছিল ড্রাগস। সেই আসক্তি মেটাতে যেয়ে ধরতে হয়েছিল চুরির পথ। ধরা পড়ে জেলে ছিল তিন মাস। বেড়িয়ে এসে দেখে বাবা বাসা ছেড়ে চলে গেছে। মা নিয়ে এসেছে নতুন পার্টনার, নাম চার্লস। থাকে মার সাথে।
দিনের পর দিন চার্লস পাশবিক অত্যাচার করেছে আলভীনার পরে। মা দেখেও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে না দেখার ভান করে। তখন আলভীনার বয়স মাত্র তেরো। মাঝে মাঝে আলভীনার মাকে মারতে ও দ্বিধা করেনি চার্লস। বাসাটা হয়ে উঠেছিল নরক কুণ্ডো। এক বছর ধরে এই অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। আলভীনা আর নিতে পারেনি এই যন্ত্রণা। একদিন বাধ্য হয়ে সে তার মা কে বলেছিল চার্লসকে বের করে দিতে বাসা থেকে। মা রাজি হয়নি। অগত্যা আলভীনা কেই বের হয়ে যেতে হয়েছিল রাস্তায়।
থেকেছে বন্ধুদের বাসায় কিছু রাত। শুয়েছে অন্য লোকদের সাথে শুধু মাথার উপর ছাদের আশায়। শেষপর্যন্ত এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল আলোকোজ্জ্বল নগরীর পোড়ো বাড়ীর ছাদের নিচে। রাস্তায় কাটিয়েছে ওরই মত হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়েদের সাথে।
আনন্দ কে দেখিয়েছিল ওর হাতের কাটা দাগ।
আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল, “ এ দাগ কীসের।”
“ছুরি দিয়ে কেটে ছিলাম মানসিক যন্ত্রণাকে সরিয়ে শারীরিক যন্ত্রণাকে আঁকড়িয়ে ধড়ার জন্য।”
আলভীনা বেচে থাকার কোন মানে খুঁজে পায়নি, জীবনের সব লেনদেন চুকিয়ে দিতে চেয়েছিল। সে ভাবতো, সে চলে গেলে কার কি আসে যায়। কেউ তো তার জন্য এক ফোটা চোখের জল ফেলবেনা। এই রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলে মেয়েদের কথা কেউ ভেবেছে কি? কেউ কোনদিন জিজ্ঞাসা করেছে কি, তোমাদের কি সমস্যা? তাই একদিন সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সে তার হাতের রগ কেটে ফেলে ছিল, রক্তাত অবস্থায় পড়েছিল রাস্তার গলিতে।
নিয়তির খেলা, সে দিন মরণের হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারতনা আলভীনাকে, যদি না এনড্রিয়া ওই পথ দিয়ে না যেতো তার কর্মস্থলে।
এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, কাজে আর যাওয়া হয়নি এনড্রিয়ার সেদিন। আলভীনা সুস্থ হয়ে উঠলে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অ্যালেক্স আর রবার্টের সাথে। ওরা নিয়ে এসেছিল এন্ডড্রুস কমিউনিটিতে। ওদের চেষ্টায় আলভীনা আজ খুঁজে পেয়েছে তার নিজস্ব পরিচয়। জেনেছে কাউ না কেউ আছে যে কি না তার দুঃখে দুঃখিত, তার ব্যাথায় ব্যাথিত হয়।
“ ওরা আমাকে আশ্রয় দিয়ে ছিল, গ্রহণ করেছিল। জানতে চায়নি আমি কে। এযে কতবড় পাওয়া তুমি বুঝবে না” বলেছিল আলভীনা।
আনন্দ তাকিয়ে ছিল দুরে, ভাবল ফ্লরেন্তা, এনড্রিয়া, অ্যালেক্স, রবার্টের মত মানুষ ছিল বলেই আজ আলভীনা আর ওর মত কিছু হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়ে আবারো নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারলো। নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি করলো।
“ কি ব্যাপার, কি হোল, সব ঠিক তো?”
ডাক শুনে ফ্লরেন্তার দিকে তাকাল আনন্দ। বললও , চলো, বাসার পথে কি?
হা, টম কে নামিয়ে দেবো যাওয়ার পথে। টুমরোঁ ইজ এ বিগ ডে। দা ফাইনাল।
ক্রমশ
**** সমস্ত চরিত্রই কাল্পনিক, কারোর সাথে মিল থাকলে তা নিতান্তই কাকতালীয়”***
এক অসমাপ্ত গল্প (৭ পর্ব)
৭ম পর্ব
আনন্দ অফিসে ফিরে সোজা চলে গিয়েছিল স্টিভের চেম্বারে। স্টিভ ক্লায়েন্টের সাথে বাস্ত থাকায় বাহিরে সোফায় বসে কয়েকটা ফোন কল সেরে নেবে ঠিক করলো। জেনিফারের সাথে কথা হয়নি বেশ কিছুদিন। সানন্দার খবরও নেওয়া হয়নি। জেনিফার কে পাওয়া গেল, জিজ্ঞাসা করতেই বললো,” ডেভিডকে দুই এক দিনের মধ্যে বাসায় পাঠিয়ে দেবে।” সময় পেলে আজ বিকেলে আনন্দকে একবার আসতে বললো জেনিফার। কোন অসুবিধা হবেনা জানালো আনন্দ। সানন্দাকে কল করেতে যাওয়ার আগেই স্টিভ দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো।
“ কোন কথা আছে কি?”
“মহিউদ্দিনের স্ত্রী আর ওর মেয়ের ইমিগ্রেশনের স্ট্যাটাস টা জানতে এসেছিলাম।”
আনন্দ আমেনা ভাবী কে বলেছিল, তোমাদের এখানে তো আপন বলতে কাউ রইলনা, আমি চেষ্টা করবো তোমাদের কে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া কিনা। স্টিভ ছিল তার একমাত্র ভরসা। সে সমস্ত কাগজপত্র জোগাড় করে জমা দিয়েছিল।
বলল,” দুই এক মাসের মধ্যে আশা করছি উনাকে ডেকে পাঠাবে ভিসার জন্য।”
আনন্দ?” স্টিভ ডাক দিলো
বলো।
নিজের খবর রাখো?
হোয়াট ডু ইউ মিন?
শেষ কবে ওজন নিয়ে ছিলে? চোখের কোণটার পাশে যে কালো ছায়া, দেখেছ কি?
আনন্দ কোন উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে গুডবাই বলে বেড়িয়ে এলো।
নিচে এসে দেখল লরেন্স ফিরে এসেছে ডালাস থেকে। কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে আনন্দ এসে বসলো তার রুমে।
সামান্তা কফির কাপটা সামনে দিয়ে বললও,” পিটার হাসব্র আর জর্জ সয়েঞ্জার আসবে সাড়ে বারটার সময়। ওদের বিল্ডিং এর ডিজাইনের ব্যাপারে।”
সামান্তা চলে যেতেই আনন্দ ফোন করলো সানন্দা কে। আজ বুধবার। সানন্দা বলেছিল বুধবারে তার কাজের চাপ কম, কথা বলতে অসুবিধা নেই।
“কেমন আছেন” বলে অভ্যর্থনা জানালো সানন্দা।
সরি, অনেকদিন খোজ নিতে পারিনি বলে দুঃখিত। বলল আনন্দ
আপনি বাস্ত মানুষ, আসেন আরেক দিন আমার বাসায়।
“ এবার আমার পালা, শনিবার সন্ধ্যা সাত টায় আসবো আপনাকে নিতে। কোন আপত্তি আছে কি?”
না নেই, আমি রেডি থাকব।
সামান্তা এসে জানাল পিটার আর জর্জ এসেছে।
আনন্দ বলল সানন্দা কে, “একটা মিটিং আছে আমার, আজকের কথোপকথন যদি এখানে শেষ করি কিছু মনে করবেন নাতো?”
কি যে বলেন, কাজ আগে না কথা? যদি আবারো কথা না হয় তবে দেখা হবে শনিবারে।
আনন্দ কনফারেন্স রুমে এসে দেখল পিটার আর জর্জ কাগজে কি জেনো লেখা লেখি করছে। আনন্দ কে দেখে গুড আফটারনুন বলে অভ্যর্থনা জানাল। ওদের এসোসিয়েশন একটা synagogue বানাতে চায়। তার ডিজাইনের জন্য এসেছে।
পিটার বলল,” তোমাদের ফার্ম কে রেকমেন্ড করেছে আমাদের এক বন্ধু এবং তাদের এসোসিয়েশন”। আনন্দ ধন্যবাদ দিয়ে বলল, “কাগজপত্র রেখে যাও, আমাদের একজন আর্কিটেকট সাইটে যাবে, সমস্তকিছু দেখে আসবে। তারপর আমরা ডিজাইন এবং টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা করব, কেমন?”
ওরা রাজি।
আনন্দ উঠে পড়ল। বিকেল চারটা। ওকে যেতে হবে জেনিফারের বাসায়।
ঘরে ঢুকতেই জেনিফার এসে আলিঙ্গন করলো আনন্দকে। পাশে দাঁড়ান ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।
“ ফ্লরেন্তা, ডেভিডের বোন, থাকে লন্ডনে।”
“ ফ্লরেন্তা, আনন্দ, ডেভিডের ডান হাত। ডেভিডের অবর্তমানে আনন্দই সবকিছু দেখাশুনা করছে। তোমরা বসে গল্প করো, আমি এখনি আসছি”। বলে জেনিফার বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
ফ্লরেন্তা, বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। ডিভোর্স। সাদা উজ্জ্বল গায়ের রং। তার সাথে মিলিয়ে গলায় কানে পার্লের নেকলেস, কান ফুল। “আপনার কথা জেনিফারের কাছে শুনেছি, আমার আসতে একটু দেরী হয়ে গেল। আন প্রিভিলাইযড বাচ্চাদের স্কুলে আমি পড়াই। কাজেই বুঝতে পারছেন, যখন তখন ওদেরকে রেখে চলে আসতে পারিনা।”
“ আমি বলব, আপনি মহান কাজ নিয়ে আছেন। অনেক ধরজো, অনেক সহিষ্ণুতা থাকলে তবেই পেশা হিসাবে এই কাজকে লোকে বরন করে। কতদিন থাকবেন?” জিজ্ঞাসা আনন্দের।
“ সপ্তাহ খানেক। সময় করে আসেন একবার লন্ডনে। “
“ আপনি সময় দিতে পারবেন তো?”
ফ্লরেন্তা উত্তর দেবার আগেই জেনিফার ফিরে এলো। হাতে কতগুলো কাগজ। আনন্দকে দিয়ে বললও, “ ডেভিড তোমাকে দিতে বলেছে। “
আনন্দ কাগজ গুলি হাতে নিয়ে বললও,’ আসি। “
ফ্লরেন্তা আবারো বললও,’ ভুলবেন না কিন্তু আমার ওখানে আসতে। ‘ চোখে উজ্জ্বলতার ছাপ।
“ না ভুলব না”
গাড়ীতে এসে আনন্দের মনে হোল সে ভীষণ ক্লান্ত। এক কাপ কফি খেলে ভাল হতো। না, বাসাতেই ফিরে যাবে সে। এলিয়ে দেবে শরীরটাকে সোফার উপর।
ঘরের ভেতর একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ। জানালা গুলো খুলে দিলো । বাতাস খেলে গেল এপাশ থেকে ওপাশে। টুং টুং শব্দ করে বেজে উঠল ছোট্ট গাছে ঝোলানো ঘণ্টা টা, ওটা কণা এনেছিল সালজবারগ, অস্ট্রিয়া থেকে। কত স্রীতি আনাচে কানাচে পড়ে আছে। সোফাটা ডাকছে তাকে। মাথাটা এলিয়ে টিভি টা অন করতেই গমগম করে উঠল সারা ঘর। তার মানে দীপ এসেছিল। ফুটবল খেলা দেখেছে ফুল ভলুম দিয়ে। বন্ধ করে দিলো টিভি টা। চোখটা বুজে আসল।
আনন্দ দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে এক ধু ধু মাঠের মাঝ প্রান্তে। উপরে হাস্যজ্বল আকাশ। হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ কোথা থেকে এসে মাথার উপর ঘোরা ফেরা করছে। ডানে গেলে সে যায় ডানে, বাঁয়ে গেলে সে যায় বাঁয়ে। আনন্দের মনে হোল এ যেন এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। সেই চোখ, সেই কান, সেই মুখ। রৌদরজ্বল আকাশে নেমে এলো কালো ছায়া। বিদ্যুতের রেখা একে দিলো কালো মেঘের বুকে। নেমে এলো জল। আকাশ পানে তাকাল আনন্দ। হারিয়ে গেছে মেঘটা। ভিজিয়ে রেখে গেছে তাকে চোখের জলে। চিৎকার করে ডাকতে চাইল তাকে। পারলনা। ঘুম ভেঙ্গে গেল। সারা শরীর ঘামে ভেজা। তাকিয়ে ছিল সে দুরে ছবিটির দিকে।
ফোন টা বেজে উঠল। বেলালের ফোন। স্বপ্নের রেশ তখনো কাটেনি আনন্দের। হ্যালো বলতেই বেলাল বললও
“ তোমাকে কি ঘুম থেকে জাগালাম”?
“ না তুমি জাগাওনি, অন্য কেও জাগিয়ে দিয়েছিল আমাকে । বল, কি খবর?”
“ একটা জরুরী দরকার ছিল তোমার সাথে। তুমি ছাড়া আর কারো সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করতে চাইনা। তোমার উপর আমার একটা অধিকার জন্মে গেছে। তাই না আনন্দ দা।”
“ এত ভণিতা না করে আসল কথাটা বলবে কি?”
“ কল্যাণীর ভাই, নাম শুভ্র। কাজ করে ফার্মাসীউটিকাল কোম্পানিতে। অনেক দিন ওর খোজ পাচ্ছিনা। বুঝতেই পারছো কল্যাণীর অবস্থা। আমি তোমাকে ঠিকানাটা টেক্সট করে দেই, একটু খোজ নিতে পারবে কি?”
আনন্দ বললও সে চেষ্টা করবে। সময় করে খোজ নিয়ে জানাবে। বেলাল জানে আর কিছু বলার দরকার নিই। আনন্দ সময়
বের করে নেবে।
আনন্দ পৌছেছিল ব্রুকলিনের এক গলিতে। বেল টিপতেই দরজা খুলে দাঁড়াল এক মহিলা।
কাকে চাই?
শুভ্র আছে? জিজ্ঞাসা করতেই মহিলা ভেতরে আসতে বললও
সোফায় বসে আনন্দ পর্যবেক্ষণ করছিল ঘরের চারিদিক। আগোছাল ঘর। জিনিস পত্র ছড়ানো ছিটানো। টেবিলের পরে ঔষধের বোতল। লেখা ভাইকোডিন। আনন্দ জানে এ কীসের ঔষধ।
শুভ্র এলো ঘরে। চোখের কোনে কালি। আলুথালু বেস। চেহারায় রুক্ষতার ছাপ।
আনন্দ নিজের পরিচয় দিলো। বেলাল এবং কল্যাণীর সাথে কি সম্পর্ক তাও জানালো।
“ তোমার খোজ না পাওয়াতে তোমার বোন ভীষণ বিচলিত।” বললও আনন্দ
“ আমি আজিই কল করব,” বলে শুভ্র এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে।
আনন্দ ওর বিজনেস কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বললও, “ কোন দরকার হলে কল করতে ভুলো না। অনেক ডাক্তার বন্ধু আছে আমার।”
শুভ্র আনন্দের দিকে তাকাল। বুঝতে পারলো আনন্দ কি বলতে চাইছে। ভাইকোডিনের বোতলটা হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললও ,” অবশ্যই”।
আনন্দ আর কিছু না বলে বেড়িয়ে এলো।
আজ শনিবার। সানন্দাকে উঠানোর কথা সন্ধ্যা সাতটায়। যথাসময়ে আনন্দের গাড়ী এসে দাড়াল সানন্দার ড্রাইভওয়ায় তে। সানন্দা বেড়িয়ে এলো। পরনে কালো জমিনের উপর মেজেন্টা পাড়ের শাড়ী।
দাড়ান, আপনার একটা ছবি নেবো ওই গোলাপ গাছের কাছ থেকে। বলেই আনন্দ সানন্দার দিকে তাকাল।
সানন্দা না করলো না।
কোথায় যাবো আমরা আজকে? জিজ্ঞাসা করলো সানন্দা।
“ সুশি রেস্টুরেন্টে? একটু দুরে। তবে দিস ইজ দা বেষ্ট।”
“ তাই! জানলেন কি ভাবে আমি সুশি পছন্দ করি?”
“ সবই ইমাজিনেসন।”
আগে থেকে রিজার্ভ থাকাতে টেবিল পেতে অসুবিধা হলনা। বাহিরে অনেক লোক লাইনে দাঁড়ানো। কোনের একটা টেবিল। সুন্দর জায়গা। আনন্দ বলল সানন্দা কে,” অডার দেওয়াতে আমি অভ্যস্ত নই। ওটা আপনার দায়িত্বে।
“ খাওচ্ছেন আপনি আর অডার দেবো আমি।”
“ হা, তাই।
আনন্দ ভাবে, ওর আর সানন্দার জীবনের সুর এক। ওদের মধ্যে আছে নিটোল বন্ধুত্ব। শুধুই বন্ধুত্ব। ওরা একে অন্যের দুঃখ বোঝে। ওরা একে অন্যকে সান্ত্বনা দেয়। ফিরে যায় অতীতে। অতীত যখন কথা বলে তখন দুজনের চোখ জলে ভরে আসে।
কি ভাবছেন?
ভাবছি এইযে আপনি এলেন বান্ধবী হয়ে, এটাও কি একদিন শেষ হয়ে যাবে?
জীবনে কোন কিছুরই গ্যারান্টি নেই। আছে কি? আগে থেকে সে ভাবনা ভেবে লাভ কি?
আসলেই তাই! চলেন উঠি। আনন্দ বলে, আজকের সন্ধ্যাটা থাক আমাদের মনের মধ্যে সন্ধ্যা তারার মত।
বাহিরে আসে দাঁড়ালো দুজনে। আকাশে তারার ঝিলিমিলি।
সানন্দা কে পৌছে দিয়ে আনন্দ ফিরে এলো বাসাতে। চিঠির বাক্স থেকে চিঠি গুলো কুড়িয়ে নিলো। ফেলে আসা সন্ধ্যার আমেজটা হারিয়ে যেতে দিতে চায়না সে। অলস নয়নে তাকিয়ে রইল ছড়িয়ে ছিটেয়ে পড়া চিঠি গুলোর দিকে। চোখটা আটকিয়ে গেল একটা খামের পরে। অজানা এই খাম। কখনো দেখিনি আগে। বাংলায় লেখা আনন্দের নাম। সে হাত বাড়াল খাম টার দিকে।
ক্রমশ:
এক অসমাপ্ত গল্প (৬ পর্ব)
ছয় পর্ব
আনন্দ আরো কাছে এগিয়ে গেল। বুকটা ধুঁকধুঁক করছে। একটু দুরে মাটিতে পড়ে থাকা মেয়েটার পায়ের স্যান্ডেলটা দেখতে পেলো আনন্দ। ভিড় ঠেলে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলো সে। উকি দিয়ে দেখার আগেই শুনতে পেলো তার নাম ধরে কে যেন ডাকছে রাস্তার ওপার থেকে। “আনন্দ”। সামান্তা ।
সামান্তার হাতে খাবার। আনন্দের জমে যাওয়া বুকটা আবার নিশ্বাসে ভরপুর হয়ে উঠল।
কাছে এসে সামান্তা বললও, “ তুমি ভেবেছিলে ওটা আমি, তাই না?’
হা,
আনন্দ বললও,’ তুমি খাবার নিয়ে উপরে চলে যাও, আমি খবরের কাগজটা কিনে নিয়ে আসছি।”
মুহূর্তে মধ্যে চারিদিক থেকে পুলিশের গাড়ী, এ্যাম্বুলেন্স এসে জাগাটা ঘিরে ফেলল। লোকের ভিড় কমছে। উৎসুক পথচারীরা উকিঝুঁকি মেরে চলে যাচ্ছে।
আনন্দ আর দাঁড়ালনা। এসে পৌছালো খবরের কাগজ নিয়ে বসে থাকা লোকটার সামনে। আনন্দ কাছে আসতেই উর্দুতে বলল,” আপ কায়সা হেয়, সাব?”
ভালো।
আজ আনন্দের মনে পড়ছে মহিউদ্দিনের কথা। এই জাগাতেই সে বসতো কাগজ নিয়ে।
এইখানেই প্রথম দেখা হয়েছিল মহিউদ্দিনের সাথে। আনন্দকে দেখে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলত, “ কেমন আছেন?” প্রতিদিন সকালে আনন্দ আসতো কাগজ নিতে। কথা হতো। একটা বন্ধন তৈরি হয়েছিল দুইজনের মধ্যে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক। হাতে সময় থাকলে আনন্দ একটা টুল নিয়ে ওর পাশে বসে গল্প করতো। এক কাপ কফি হাতে তুলে দিত।
কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মহিউদ্দিন বলত তার সংসারের কথা। বলত তার স্ত্রী, তার মেয়ের কথা, যাকে সে এখনো দেখেনি। পনেরো বছর হয়ে গেল। বলত,” জানেন আনন্দ দা মেয়ে আমার আজ পনেরো বছরের যুবতী. অনেক কিছুর জন্য আবদার করে। সবচেয়ে বড় আবদার তার কি জানেন আনন্দদা?
বলো ?
বলে,” কবে আসবে তুমি বাবা, কবে তোমাকে দেখব,” বলতে বলতে মহিউদ্দিনের চোখটা ছলছল করত।
বলেছিল,” সেই যে দেশ ছাড়লাম অন্নের সন্ধানে, আর ফিরে যেতে পারলাম না।”
প্রথমে সে গিয়েছিল জার্মানি। দুই বছর কাজ করেছিল সুতার ফ্যাক্টরিতে। ইল্লিগাল ইমিগ্রান্টদের বের করে দাও, এই অভিযানের শুরুতে মহিউদ্দিন পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকার উদ্দেশ্যে। অনেক কাঠখর পুড়িয়ে একদিন কানাডার বর্ডার পেড়িয়ে এসে পৌছেছিল নিউ ইয়র্কে। সেই শুরু।
“ অনেক রকম কাজই করেছি। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন পরামর্শে চেষ্টা করেছি গ্রিনকার্ড পাওয়ার। আইনজীবিদের কাছে গিয়েছিলাম, টাকার অভাবে ওই পথটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যখন এসেছিলেম, চুল ছিল কালো। আজ সাদাতে ভরে গেছে। কাগজ বেচা শেষ করে, বাসায় যেয়ে দু মুঠো খেয়ে বেরিয়ে পরি আর এক কাজের পথে, ফিরতে ফিরতে রাত একটা।”
আনন্দ বলেছিল, “ কোন এক রবিবারে ছুটি পেলে বলবেন, বেড়িয়ে পরবো দুর পাল্লায়।”
সময় হয়েছিল মহিউদ্দিনের। আনন্দ তাকে নিয়ে গিয়েছিল “মনটক পয়েন্টে”। প্যাকেটে বাধা লাঞ্চ নিয়ে বসেছিল পার্কে। বসেছিল সমুদ্রের ধারে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিউদ্দিন বলেছিল, অনেকদিন পর প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম আনন্দদা।” সুন্দর একটা দিন ওরা কাটিয়ে ছিল একসাথে।
আনন্দ আলাপ করেছিল স্টিভিন রসের সাথে মহিউদ্দিনের ব্যাপার নিয়ে। স্টিভিন রস আইনজীবি। ওর চেম্বার আনন্দের বিল্ডিং এর আট তালায়। মাঝে মাঝে দুইজন একসাথে সময় কাটায় বারে। আনন্দের হাতে থাকে সফট ড্রিঙ্কস, স্টিভ হুস্কির পেয়ালায় বুদ হয়ে যায়। অনেক সময় আনন্দ তাকে বাসাতে নামিয়ে দেয়। গাড়ী চালানোর মত অবস্থা তার থাকতনা। মেয়ে বন্ধু তার থেকেও নেই। কাপড় পাল্টানোর মত সে মেয়ে বন্ধু পাল্টায়। তবে মনটা তার উদার।
আনন্দ তাকে বলেছিল, পারবে কি উপকার করতে? টাকা আমি দেবো। যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে সে কাজটা হাতে নিয়েছিল। আনন্দ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মহিউদ্দিনকে স্টিভের সাথে। মহিউদ্দিন একদিন আনন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিল,” কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করলেন”।
প্রতিদিন সকালে দেখা হলেই বলত, “ আনন্দদা, অপেক্ষায় আছি।”
একদিন আনন্দকে দেখে দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল।
“কি ব্যাপার! কি হয়েছে?”
খবর এসেছে। অ্যাপরুভাল লেটার এসেছে। ছয় মাসের মধ্যে গ্রীনকার্ড হয়ে যাবে।
আবারো জড়িয়ে ধরে বললও, সব আপনার জন্য।
না, আমার জন্য নয়। বল, উপরওয়ালার জন্য। স্টিভ কে আমি বলবো।
“ উনি ফেরেশতা, আমার কাছ থেকে টাকা নেইনি, বললেন আপনার বন্ধু তাই।”
আনন্দ সে কথার উত্তর না দিয়ে বললও,” আমি দেশে যাচ্ছি সামনের সপ্তাহে, দেখা করব কি ভাবীর সাথে?”
“ নিশ্চয়!” বলে ঠিকানা দিয়েছিল, সাথে কিছু টাকা।
আনন্দ দেখা করেছিল আমেনা ভাবীর সাথে। মহিউদ্দিনের দাওয়া টাকার সাথে নিজের কিছু টাকা মিশিয়ে ভাবীর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল,” সুসংবাদ আছে! ছয় মাসের মধ্যেই আপনার কর্তা দেশে আসবে।”
অনেক আপ্যায়ন করেছিলেন আমেনা ভাবী।
ঠিক সময় মত গ্রীনকার্ড পেয়েছিল মহিউদ্দিন। আনন্দের সাথে দেখা হতেই বলেছিল, “ আগামী পরশু দেশে যাচ্ছি। দোয়া করবেন”।
আগামী পরশু আর আসেনি মহিউদ্দিনের জীবনে। সেই রাতে আনন্দের ফোন বেজে উঠেছিল। রাত তখন তিনটা। ওপাশের কান্নায় ভাঙা স্বর। আমি মহিউদ্দিনের রুমমেট বলছি,” আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন”।
আনন্দ দেরী করেনি। হাসপাতালে পৌছিয়েছিল। একটু দেরী হয়ে গেছে। চলে গেছে মহিউদ্দিন এই ধরাধাম ছেড়ে। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, আনন্দদা যেন আমার পাশে থাকে।
মেয়েটাকে সে বুকে চেপে ধরতে পারলনা, পারলনা মেয়েটা তার বাবা কে দেখতে। যখন সে পেলো তার আকাঙ্ক্ষিত কার্ডটা তখনি বন্ধ হয়ে গেল তার হৃদক্রিয়া।
আনন্দ ছুটি নিয়ে গিয়েছিল লাশের সাথে। আমেনার কান্না সহ্য করার নয়। আনন্দকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,” আপনি বলেছিলেন, ও আসবে। ও এসেছে, ও এসেছে আনন্দদা, এসেছে লাশ হয়ে।”
সাব, আপকা চেঞ্জ।
ও, হা, দাও। আনন্দ ফিরে এলো বাস্তবে।
কাগজটা নিয়ে পা বাড়ালো অফিসের দিকে।
ক্রমশ
অসমাপ্ত গল্প ৫
৫ পর্ব
বৃস্টি ঝরা সকাল। অঝরে ঝরছে। ডালাসের মাটি গ্রীষ্মের তাপ থেকে কিছুটা রেহাই পেলো। সানন্দা ভিজে মাথায় এসে দাঁড়ালো ডেলটা এয়ার লাঈন্সের কাউনটারের সামনে। কোথাও আনন্দকে দেখতে পেলো না। ভাবল, হয়ত সে ভেতরে চলে গেছে। ছয় নম্বর গেঁটের কাছে এসেও আনন্দের খোজ পেলনা। হয়ত ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। অথবা নতুন কোন কাজের চাপে রয়ে গেছে। সেদিন রাতে ফোন নাম্বারটা আদান প্রদান না হওয়াতে সানন্দা আনন্দের কোন খোজেই পেলো না।
সেই রাতে যা ঘটেছিল আনন্দ তার জন্য প্রস্তুত ছিলনা। রাত দুটার সময় যে ফোন টা এসেছিল তাঁর অপর প্রান্তে ক্রন্দন রত জেনীফার। ডেভিডের স্ত্রী।
“ তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। ডেভিড এর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।”
আনন্দ পরের দিন প্রথম ফ্লাইটে চলে এসেছিল নিউ ইয়র্কে। সোজা চলে গিয়েছিল হাসপাতালের বারো তালায়, ইনটেনসীভ কায়ার ইউনিটের সামনে। সবাই দাঁড়ানো। জেনীফার কাঁদছে। অনন্যাদের মুখ মলিন। ডাক্তারে ভাষ্যে এ যাত্রা ডেভিড রক্ষা পাবে মনে হয়। তবে সবই সময় সাপেক্ষ। জেনীফার কে আশ্বাস দিয়েছিল আনন্দ।
বলেছিল,” তুমি ডেভিড কে দেখো, অন্য দিকটা আমি সামলাবো।
পরদিন অফিসে এসে আনন্দ খবর পাঠিয়েছিলো সবাইকে কনফারেন্স রুমে আসতে। ডেভিড এর পরেই তাঁর স্থান। ডি এন্ড যে আসোসিয়েটে সব মিলে ষোল জন কর্মচারী। পাঁচ জন আরকিটেকট আনন্দকে নিয়ে। লরেন্স, জন, এমীলী, মাইক।
“ গুড আফটারনুন, আমরা সবাই প্রাথনা করি ডেভিড তাড়াতাড়ী ভালো হয়ে উঠুক। ডেভিডের অবর্তমানে যে দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে তা শুধু আমার নয়, আমাদের সবার। এই ফার্ম আমাদের। এর ভালো মন্দ আমাদের। ডেভিড ফিরে এসে যেন বলতে পারে,” আমি এই ফার্ম দিয়ে গিয়েছিলাম কতগুলো নিঃস্বার্থবান লোকেদের কাছে।” কারো কোন বক্তব্য থাকলে বলতে পারো।” এই বলে আনন্দ থামল।
সবাই চুপ। আনন্দ জানে যদি কোন প্রবলেম আসে তবে আসবে লরেন্সের কাছ থেকে। লরেন্স চেয়েছিল ডেভিডের পরে তাঁর স্থান করে নিতে। ডেভিড দূরদর্শিতা সম্পন্ন লোক, তাই আনন্দকে ডেকে নিয়েছিল পাশে।
আর একজন হতে পারে সে এমীলী।
এমিলী আনন্দের সাথে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গোড়ে তুলতে চেয়েছিল। আনন্দ সেটা হতে দেইনি। কারণে অকারণে খুঁটী নাটি কাজ নিয়ে সে আনন্দের রুমে আসত। কাজের শেষে যেতে চাইতো আনন্দকে নিয়ে কোন নির্জন জাগায়। একদিন আনন্দ ওকে বলেছিল,” এমীলী তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট, কাজে মন দেও, তোমার সামনে যে ভবিষ্যৎ, সেটা নষ্ট করোনা।” এমীলী আর কোনদিন আনন্দকে বিরক্ত করেনি। তবে একটা চাপা আক্রোশ রয়ে গেছে আনন্দের উপর।
রুমে আসতেই ইনটারকমে সামান্তা জানালো হিউস্টন থেকে একটা কল আছে আনন্দ ধরবে কিনা? আনন্দ ফরওয়ার্ড করে দিতে বলে হাতের ঘড়িটাতে দেখল দুটা বাজতে চলেছে, জেনীফার তাকে কল করে ডেভিডের খবর দেওয়ার কথা ছিল। নিশ্চয় সে বাস্ত। খারাপ দিকে টার্ন নিলো কিনা ভাবতে ভাবতে ফোনটা উঠিয়ে হ্যালো বলতেই ঐপাশ থেকে রেমীর গলা। রেমী হিউস্টনের সাব অফিসটার তত্ত্বাবধানে। বললও, “ লরেন্সে কে একবার পাঠাতে পারবে কি এখানে? সেন্ডপোর্ট মাল্টি কন্সট্রাকসন টার ব্লুপ্রিন্ট টা একটু পাল্টাতে হবে, লরেন্স বুঝবে ভাল।” আনন্দ লরেন্স কে ডেকে সব বুঝিয়ে বললো। আগামীকালই যেন সে রওয়ানা হয়ে যায় হিউস্টনের পথে।
বিকেল পাঁচটা। জেনীফারের কল না পেয়ে আনন্দ বেড়িয়ে পড়ল হাঁসপাতালের পথে।
“
বের হবার পথে মাইক ডাকল আনন্দ কে। “ তুমি হাসপাতালে গেলে আমিও যাবো” বললও মাইক।
“চলো” বলে দুজনে বেড়িয়ে পড়ল।
মাইক হেসীয়ান। বাবা মার একমাত্র ছেলে। ওর যখন ৮ বছর বাবা চলে গিয়ে ছিল আর এক মেয়ের সাথে। অনেক কষ্ট করে মা তাকে মানুষ করেছে। আনন্দকে বলেছিল সব কথা। আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল,” মেয়ে বন্ধু তো আছে জানি, বিয়ে করছো না কেনো?” উত্তর দিয়েছিল, বলেছিল,” আজকাল কজন মেয়ে চায় শাশুড়ী থাকবে একি চালার নীচে? বউ না থাক ভালো , মা কে আমি ছাড়বনা।” আনন্দের চোখটা জলে ভরে এসেছিল, কোন উত্তর দেইনি।
গাড়ীতে উঠে স্টার্ট দিতেই ফোন টা বেজে উঠল। চেনা নম্বর নয়। ইতস্তো করে ফোনটা উঠালো আনন্দ।
“ কেমন আছেন।” সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর। যার সাথে দেখা হওয়ার কথা ছিল এয়ারপোর্টে কিন্তু বিধির নির্দেশে দেখা হয়নি। “ অনেক কষ্টে আপনার নম্বর টা পেয়েছি। সব ভাল তো?”
আনন্দ বিশ্লেষণ করলো সব। শুনে সানন্দা বললও,” আমিও ভেবেছিলাম কিছু একটা হয়েছে। তা না হলে
আপনার কথার কোন নড়চড় হয়না শুনেছি আমি।”
“ বাহ! অনেক কিছুই তো শুনেছেন দেখছি।”
উত্তর না দিয়ে সানন্দা বললও,” আসবেন কি, আমার বাসায় রোববার বিকেলে চা খেতে? অবশ্য যদি বাস্ত না থাকেন।”
“ আসবো, ঠিকানা টা টেক্সট করে দিন।”
কথা আর বেশি দুরে আগায়নি।
“ দেখা হলে কথা হবে, আজ তাহলে রাখি।” বলে সানন্দা ফোন রেখে দিয়েছিল।
হাসপাতালে পোঁছে আনন্দ দেখল জেনীফার ভিজিটর রুমে বসে। মাথা টা হেলিয়ে দিয়েছে দেয়ালে। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। স্বাভাবিক। আনন্দ এপথ দিয়ে গেছে, সে জানে শারীরীক এবং মানসিক যন্ত্রণা।
আনন্দ কে দেখে বললও,” আজ ডেভিডকে রেগুলার রুমে নিয়ে গেছে। এসব নিয়ে বাস্ত থাকাতে তোমাকে কল করতে পারিনি। চলো।”
আনন্দ ঢুকতেই ডেভিড চোখ মেলে চাইল। ডেভিডের হাতটা চেপে ধরে আনন্দ বললও,” সব ঠিক মত চলছে। তোমাকে কিছু চিন্তা করতে হবেনা।” ডেভিডের চোখের কণে জলের রেখা। জেনীফার বললও, ডেভিড কে রীহেবে নিতে হবে কয়েক মাসের জন্য। আশা করছে সব ঠিক হবে। আগের মত না হলেও কাজ করার মত শক্তি ফিরে পাবে। জেনীফারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আনন্দ আর মাইক বেড়িয়ে এলো।
রোববার বিকেল পাঁচটায় আনন্দের গাড়ী এসে দাঁড়ালো সানন্দার বাসার সামনে। একগোছা ফুল সাথে করে এনেছে সে। এই ধরনের ফর্মালিটি সে করেনি অনেকদিন। আজ নিয়ে এলো। কেন? নিজেও জানেনা। বেল বাজাতেই ঠোটের কোণে হাসিটা দিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল সানন্দা। পরনে কচি কলাপাতা রংএর শাড়ী। মাথায় সেই একি ভাবে আলতো করে ফেলে রাখা আঁচল।
“ শুনেছি আপনার সময় জ্ঞানের কথা। আজ পেলাম তাঁর নিদর্শন.”
“ কোথা থেকে এসব কথা শুনছেন?” বলে আনন্দ ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিলো সানন্দার দিকে।
ধন্যবাদ দিয়ে বললও,” বাতাসে তো সে কথাই বলে, দেখুনতো অভদ্রের মত দরজা আগলিয়ে কথা বলছি, ঢুকতে না দিয়ে। আসুন”।
ছিমছাম ভাবে সাজানো বসার ঘর। টেবিলে হরেক রকম বিকেলের নাস্তা।
“ আর কেউ আসবে কি?” আনন্দ প্রশ্ন করে।
“কেন?”
“ নাস্তার পরিমাণ দেখে বলছি। সব কিছু শুনেছেন, আর আমার খাবারের পরিমাণের কথা শোনেননি।?”
“ তাও শুনেছি, পাখীর মত খান আপনি।”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ,” এবার বলুন আপনার কথা। “
“ দুই মেয়ে। বড়টার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটটা কলেজে।”
“ বুঝলাম, অন্যজন ওপারে।”
সানন্দার চোখের কোণটা ভিজে মনে হোল আনন্দের কাছে। কথার মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে বললও,” অনেকদিন পর একজন কথা বলার সঙ্গী পেলাম। আপনার আপত্তি নেই তো মাঝে মধ্যে যদি বিরক্ত করি.”।
না , মোটেও নয়।
ঘটে যাওয়া ঘটনার পর আনন্দ মিশেছে অনেকের সাথে। কথাও বলেছে। কিন্তু সুর মেলেনি। একি প্রশ্ন বারবার। উহ, আহ, শব্দ। ভাঙা, ছেড়া মনটাকে আরও ভেঙ্গে দেওয়াই যেন তাদের অভিপ্রায়। সেই জন্যই আনন্দ সরে গিয়েছিল ওদের মাঝ থেকে।
পেয়েছিল আরেক বান্ধবী কে। একসাথে লেখা পড়া শেষ করেছিল। থাকে একটু দুরে। বলেছিল,” আনন্দ, তোমার দরকার কথা বলার সাথী। আমিতো আছি। ফোন করবো তোমাকে প্রতিদিন, কথা হবে, দেখবে ভালোই লাগবে।” আজও সেই ধারা বজাই রয়েছে।
“ কিছু ভাবছেন?”
কিছুক্ষণের জন্য আনন্দ ফিরে গিয়েছিল পেছনে। “ জানেন, আমার এক বান্ধবী, আমার দুঃসময়ে ফোন করতো প্রতিদিন, শুধু আমাকে উৎফুল্ল করে রাখার জন্য। আপনাদের দুজনের মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল আছে। নামের সাথেও। আপনার নাম সানন্দা ওর নাম শাশ্বতী।”
“তাই! আপনার সেই শাশ্বতী কে দেখা করিয়ে দেবেন কি আমার সাথে?”
“ দেবো, সময় আসুক।”
আনন্দের সন্ধ্যাটা অতিবাহিত হোল খুব সুন্দর ভাবে। এবার উঠার পালা।
সানন্দা বললও ,” কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা বলি।”
“ বলেন”
“ ঘরে উনন জ্বলে কি?”
“না, জ্বলেনা।”
“ আমার অতিরিক্ত একটা মাছের টুকরা রান্না করা আছে। দিয়ে দেই?”
আনন্দ তাকিয়ে ছিল সানন্দার দিকে। করুণা নয়, আন্তরিকতার ছাপ সারা মুখে ছড়ান।
না করতে পারেনি। শুধু বলেছিল ,” এটা যেন জীবনের রুটিনের মধ্যে না এসে পরে।”
আনন্দ গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বসেছিল কিছুক্ষণ। পুরো সন্ধ্যাটার একটা বিশ্লেষণ মনে মনে আঁকার চেষ্টা করছিল।
ফোন টা বেজে উঠল। সু র ফোন।
“ কেমন আছো মা মনি। “
“ ভালো, আমার প্রমোশন হয়েছে। এক ধাপ উপরে উঠেছি। কাল রাজের “পেটেন্ট ল” পরীক্ষা। খুব টেনশনে আছি। বাড়ীর মরটগেজ অ্যাপরুভ হবে কিনা তাও কাল জানাবে। সব একসাথে। টেনশণ আর টেনশণ।”
এতগুলি কথা একবারে শেষ করে সে যেন বাঁচল।
“ চিন্তা করোনা সোনা, আমি তো আছি।”
সোমবার সকাল, রাস্তায় ভিড়। বিশ মিনিটের পথ ঘণ্টা নিয়ে টান দেয়। আজও তাঁর ব্যতিক্রম নেই। আনন্দের অফিসে পোঁছাতে একটু দেরী হয়ে গেল আজ। রুমে ঢুকে বসতেই দরজাতে টোকা পড়ল। জন দাঁড়িয়ে।
“ কিছু বলবে?” আনন্দ জিজ্ঞাসা করলো।
“ বাবার শরীর খুব খারাপ। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। “
“ তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কেন? চলে যাও তাড়াতাড়ি। ফিলাডেলফিয়া যেতে দুঘণ্টার উপর লেগে যাবে। “ বললও আনন্দ।
জন ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। ছেলেটা চটপটে। গত তিন বছর আগে পাশ করে বেড়িয়েছে। এমীলীর উপর একটু আসক্তি ছিল, কার্যকরি হয়নি।
বারো টার দিকে সু ফোন করলো। “ আব্বু, রাজ পাশ করেছে। মরটগেজও অ্যাপরুভড। আম্মু খুব প্রাউড হতো আজ, তাই না?” গলার স্বর টা কান্নায় ভেজা।
“ হা, মা মনি, মামি এখনো প্রাউড হচ্ছে। দেখছে তোমাকে। আমরা সেলিবারেট করবো উইক এন্ড এ, ঠিক আছে?”
আনন্দের মনটা আজ প্রসন্ন। মেয়ের প্রমোশন, রাজের পরীক্ষায় পাশ, ওদের নতুন বাসা। সবাই কে ডেকে বললো সে কথা। বলল, “ বাহির থেকে নিয়ে আসি খাবার সবায় মিলে খাওয়া যাবে.”
সামান্তা কাছেই ছিল, বললও ,” আনন্দ, তুমি বসো, আমি যাচ্ছি.”
আনন্দ ডলার ওর হাতে দিয়ে নিজের কামরায় ফিরে এলো। সামান্তা নেমে গেল নীচে।
দীপকে ফোন করতে হবে মনে পড়ল আনন্দের। তাম্মানা কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা।
ফোনটা উঠিয়ে ডায়াল করতে যাবে এমন সময় শুনতে পেলো বাহিরে লোকদের আর্ত চিৎকার, সেই সাথে
গাড়ীর ব্রেক করার শব্দ। কিচ কিচ কিচ চ চ–। জানালা দিয়ে তাকাল আনন্দ। লোকের ভিড়। জোড়ও হয়ে কি যেন দেখছে। পাশে কালো গাড়ী টার থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আনন্দের পেটটা অজানা ভয়ে মোচড় দিয়ে উঠল। সামান্তার এতক্ষণ রাস্তায় পৌছানোর কথা। আনন্দ দৌড়ে গেল নীচে। লোকের ভিড়ে কিছুই দেখতে পেলোনা।
ক্রমশ
এক অসমাপ্ত গল্প ৪
৪ পর্ব
ভোরে ঘুম থেকে উঠা আনন্দের অভ্যাস। সেই কাঁক ডাকা ভোরে উঠে জিমে যাওয়া ছিল তার নিত্যনৈমিততিক ব্যাপার। এখন ও সে ভোরে উঠে। তবে জিমে আর যায়না। ছেলে মেয়েরা জিজ্ঞাসা করলে বলে,” ছয় প্যাক দেখানোর মানুষ টাই যখন নেই তখন ওটা বানিয়ে লাভ কি।”
“ লাভ তোমার নিজের জন্য, বাঁচার জন্য, তোমার কিছু হলে তোমাকে সেবা শুশ্রষা করার কেউ নেই।” বলে সু।
আনন্দ তা জানে। শুনেছিল এক বন্ধুর স্ত্রী কাছ থেকে। বলেছিল,” আনন্দ দা, নিজেকে সুস্থ রাখবেন। কিছু হলে আপনাকে কিন্তু আমরা দেখতে আসতে পারব না ।”
চোখ বড় বড় করে আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল,” কেন?”
“ কারণ, আপনি পরপুরুষ।”
হায়রে, চল্লিশ বছর একসাথে উঠা চলাফেরা করেও আনন্দ পরপুরুষই রয়ে গেল।
ইদানীং আনন্দের অনেক গানই শুনতে ভালো লাগেনা। শুধু দুটো গান সে গাড়ীতে রেখে দিয়েছে। সকালে কফির পেয়ালা নিয়ে গাড়ীতে উঠে চালিয়ে দেয় গান টা “ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে—“ ফেরার পথে শুনতে থাকে “ আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি—“ আজও তার ব্যতিক্রম হলনা। গান শেষ হোল, আনন্দ এসে পৌছাল অফিসের পারকিং লট এ।
ফোন টা বেজে উঠল।
“ আনন্দ দা, কোথায় তুমি” বেলালের কণ্ঠস্বর। এক সাথে এই আর্কিটেক্ট ফার্ম এ কাজ করতো। চলে গেছে ডালাসে।
“ এতো ভোরে, কি মনে করে?”
“ আসতে পারবে এই উইক এন্ডে? আগে, পিছে ছুটি নিয়ে এসো। এলে পড়ে সব বলবো”
ডেভিড কে বলেছিল ছুটির কথা। সে বস। না করেনি। বস হলেও বন্ধুর মত। আনন্দের অসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বলেছিল,” মন শক্ত হলে কাজে এসো। আমি এদিক টা সামলাবো।”
ডালাসে আনন্দের এই প্রথম আসা। গ্রীষ্ম কাল। সূর্যের তাপ টা একটু বেশি। বেলাল এসে ছিল এয়ারপোর্টে। আনন্দের চেয়ে বয়সে সে অনেক ছোট। পঞ্চাশের কোঠায়। একটা মিষ্টতা আছে ওর মধ্যে। যা কিনা আকর্ষণ করে।
“ তুমি কোনদিন একলা আসবে, ভাবি নি। সবই ভবিতব্য। যাক সে সব কথা, যার জন্য তোমাকে ডেকে আনলাম। আমার বিয়ে.”
কথাটা বেলাল এতো দ্রুত, ভণিতা না করে বলে ফেলল যে আনন্দ প্রথমে বুজে উঠতে পারলো না সে কি বলছে।
“ কি বললে?”
“ বিয়ে, হ্যাঁ, বিয়ে করতে যাচ্ছি, তাই তোমার আশীর্বাদ চাই।”
বেলাল গত পাঁচ বছর ধরে ডিভোর্স। প্রেম করেই বিয়ে করেছিল, কিন্তু সব প্রেমের ধারা বিয়ের পড়ে এক গতিতে চলেনা। ওরও চলেনি।
“তা ভাগ্যবতী টা কে?”
“ কল্যাণী! একই ফার্মে কাজ করি। ডিভোর্স। আমারই মত। বুঝতেই পারছো। প্লাসে প্লাসে, প্লাস। এবার নেগেটিভ হওয়ার কোন উপায় নেই। নাম কল্যাণী, কাজেই কল্যাণ কর কিছু একটা হবে মনে হচ্ছে।”
ওর এই উচ্ছ্বসিত ভাব, অতীতকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, হাস্যজ্বল মুখ, এর জন্যই বেলাল কে তার ভালো লাগে।
গাড়ী এসে থামল বিরাট এক অট্টালিকার সামনে।
“ এই আমার এপার্টমেন্ট। এখানে থাকতে তোমার কোন অসুবিধা হবে নাতো আনন্দ দা?”
কি যে বলো? আমি কোন কাজে লাগতে পারি?
না, তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।
যথা রীতি খুব সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হোল অনুষ্ঠান। অপূর্ব লাগছিল কল্যাণী কে। সিম্পল ভাবে সাজা। সব কিছুর মধ্যে মার্জিত ভাব। দুজন কে মানিয়েছে। আনন্দের কাছে এসে দাড়াতেই বললও,” আশীর্বাদ করি, ভালো থেকো।”
কল্যাণী বললও “ তোমার কথা অনেক শুনেছি আনন্দ দা, আজ দেখলাম। আশীর্বাদ করো যেন তোমার আর ভাবির মত মন নিয়ে চলতে পারি। তুমি তো ওর মেনটর।”
ওরা চলে গেল। হোটেলের সুইট অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। যাওয়ার আগে বেলাল আনন্দের কানে কানে বললও,”
কাল হবে বড় অনুষ্ঠান, সুট এনেছ তো?”
না আনি নি, তুমি তো বলনি।
নিজের কপালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে, ইস বলে, বললও “ আমি ফিরে আসি, একটা ব্যবস্থা হবে”।
আনন্দ ফিরে গেল বেলালের এপার্টমেন্টে। তখন রাত বারটা।
অনেক লোকের আগমন। বিভিন্ন রংএর শাড়ী পরিহিতা মহিলারা বিভিন্ন ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তড়িঘড়ি করে একটা সুট সে কিনে ছিল। ভালোই ফিট করেছে। বেলাল কে আনন্দ বলেছিল ,” আজ তোমার দিন, আমাকে নিয়ে ভেবোনা, আমি আমার মত আনন্দ করবো, তুমি করো তোমার মত।”
আনন্দ দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশে, হাতে সফট ড্রিঙ্কস।
“ আপনি বুঝি একলা? আগে দেখেছি বলে মনে পরছেনা।” কথা শুনে তাকাল আনন্দ। লম্বা ছিপছিপে গড়ন। সাজটা একটু উগ্র মনে হল।
“আমার নাম প্রতিমা।”
ছোট বেলায় আনন্দ ওর হিন্দু বন্ধুদের সাথে প্রতিমা দেখতে যেতো। নিখুঁত টানা চোখ, দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং। আনন্দের কাছে এ প্রতিমা সে প্রতিমা মনে হলনা।
তবুও বলতে হোল,” আমি একলা এসেছি, বেলালের বন্ধু, থাকি নিউ ইয়র্কে।” একসাথে সব তথ্য বলে গেল আনন্দ যাতে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন না আসে।
“ চলুন না ঐ টেবিল টা বসে গল্প করা যাবে।”
আনন্দ একটু হোঁচট খেলো, জিজ্ঞাসা করলো,” আপনিও একলা বুঝি?”
“ হাঁ, কর্তা আসতে পারলো না, মাজায় ব্যথা।” বলে মিটমিট করে হাসল।
আনন্দ আমতা আমতা করতেই কোথা থেকে এসে হাজির হোল বেলাল।
“ কেমন আছো প্রতিমা দি?”
“ তোমার বন্ধু খুবই লাজুক।”
“হাঁ, ও সব সময় লাজুক প্রকৃতির”। বলেই আনন্দের দিকে তাকিয়ে বললও” আনন্দ দা তোমার সাথে কোথা আছে।” বলে আনন্দ কে হেঁচকা টান দিয়ে পাশে নিয়ে গেল বেলাল।
“ কি কথা?” জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ।
“ কোন কথা না, শুধু তোমাকে বাঁচানো, উনার হাত থেকে। দাড়াও তোমাকে আমি পরিচয় করিয়ে দেই কয়েক জনের সাথে,”
বলে, আনন্দ হাতের ইশারায় কাকে যেন ডাকতে চাইল, এমন সময়,
“ কেমন আছেন।”
কথা শুনে দুজনেই তাকাল। কাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন বোঝার আগেই, বেলাল বলে উঠল, “ আরে সানন্দা, তুমি? কবে এলে?”
উত্তর দেওয়ার আগেই আনন্দ বললও,” আপনি এখানে?”
বেলাল ঢোক গিলে জিজ্ঞাসা করলো,” তোমরা এঁকে অপর কে চেনো নাকি?”
“ চিনি বললে ভুল হবে। তবে শেষ দেখে ছিলাম মলের এস্কেলেটরে।” বললও আনন্দ।
মুখের সাজের সাথে মেলানো রুচিময় শাড়ীর আঁচল আলতো ভাবে মাথার পরে ফেলা সানন্দার।
“ আমি আপনাকে দেখেছি আমার বোনের বাসায়। দেখেছি ভাবীর সাথে। তাও অনেকদিন হয়ে গেল। তা এখানে কি মনে করে?”
“ সেই প্রশ্ন তো আমারও” আনন্দের জিজ্ঞাসা।
“ আমার কাজিন থাকে এখানে। এসেছি তার বাসায়। শুনলাম বেলাল ভাই এর বিয়ের রিসেপশান। চলে এলাম”।
“ খুব ভালো করেছ। আনন্দ দা কে আমিই টেনে নিয়ে এলাম। তা, তোমরা দুজন বসে গল্প করো, আমি ওই দিকটা সামলাই” বলে সে চলে যেতে যেয়ে একবার তাকাল আনন্দের দিকে রহস্যময় হাসি হেসে।
“ যদি কোন আপত্তি না থাকে তবে চলুন ঐ টেবিল টাতে যেয়ে বসি। সব অপরিচিত, অপরিচিতা দের মধ্যে আপনিই কিছুটা পরিচিত। কথা বলে সময় টা কাটবে। অবশ্য —,”
সানন্দা আনন্দের কথা শেষ করতে না দিয়ে বললও,” আমার আপত্তি নেই। চলুন।”
কোনার টেবিলে যেয়ে বসলো দুজন। এই মুহূর্তে টেবিল টা খালি তবে বেশীক্ষণ আর খালি থাকবে বলে মনে হয়না। সবাই বসতে শুরু করেছে।
“ কবে ফিরবেন?” সানন্দার প্রশ্ন
“মঙ্গল বারে।”
“ ঐ দিন তো আমিও ফিরছি? তাহলে আবারো দেখা হবে।”
“ তাই তো মনে হচ্ছে?” আনন্দ হাসল একটু।
“ আপনার দুঃখ আমি বুঝি। কারণ,
কথা শেষ হলনা সানন্দার, কলকল করতে করতে চার পাঁচ জন মহিলা ঘিরে ধরল সানন্দা কে।
“ কি রে পরিচয় করিয়ে দে আমাদের সাথে?” এক সাথে সবাই বলে উঠল।
আনন্দ নিজেই নিজের পরিচয় দিলো। ওরা নাছোড় বান্ধা। কিছুক্ষণের জন্য রসালো একটা খবর নিয়ে আনন্দ করতে পারলে মন্দ কি? এই ওদের অভিপ্রায়। কিন্তু আনন্দ ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে বললও,” উনি ও নিউ ইয়র্ক বাসী, আমিও। সেই সুবাদে পরিচয়। বসুন না আপনারা সবাই। আলাপ করি।”
ওরা বসলো। স্টেজ থেকে ভেসে এলো স্বপ্নার রবীন্দ্র সঙ্গীত। সবাই চুপ। নিস্তব্ধ চারিদিক। কারো মুখে কথা নেই। গানের ঝঙ্কারে হলঘর হয়ে উঠল মুখর। করতালি দিয়ে শেষ হোল সুন্দর একটা সন্ধ্যা। এবার যাবার পালা।
আনন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বললও,” আসি ! এবার দেখা হবে আপনাদের সাথে কোথাও, কোনখানে ।”
সানন্দা আনন্দর দিকে তাকিয়ে বললও,” দেখা হবে এয়ারপোর্টে।”
আনন্দ হা সূচক অর্থে মাথা নাড়িয়ে বললও ,” অবশ্যই”।
বেলাল, কল্যাণী চলে গেল ওদের সুইটে। আনন্দ ফিরে এলো ঘরে। চোখের সামনে ভেসে উঠল, প্রতিমা, সানন্দা, আরও অনন্যাদের মুখ। আনন্দের মনে হোল তার জীবদ্দশায় এরকম একটা সুন্দর সন্ধ্যা আবারো আসবে কি না কে জানে।
রাত তখন দুটা।
আনন্দের টেলিফোন বেজে উঠল। ওপাশে কান্নার স্বর। এপাশে আনন্দের মুখ ফ্যাঁকাসে।
ক্রমশ: