হঠাৎ কি হয়েছিল আনন্দের সে নিজেও জানেনা। হয়ত ব্লাড সুগার নিচে
নেমে গিয়েছিল অথবা শরীরের উপর যে অন্যায় অত্যাচার চলছে তার ই প্রতিক্রিয়া।
পড়ে যেতে যেয়ে রেলিং টাকে আঁকড়িয়ে ধরেছিল আনন্দ, বাঁচিয়েছিল মাথা টাকে, নচেৎ আজ আনন্দের ইতিহাস লেখা হতো অন্যভাবে। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে দরজা টা খুলল আনন্দ। ঘর অন্ধকার। সেঁতসেঁতে, মাকড়সার জাল। জলে ভরে এলো চোখ, এমন তো ছিলনা এ বাড়ি। একজনের অবর্তমানে ভেঙ্গে চোঁচির হয়ে গেল সব। সোফাতে বসলো সে।
কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। মাথার দুপাশের শিরা দুটোর দপদপানি অস্থির করে তুলল আনন্দকে। দীপ আর সু কে ফোন করলো। ওরা আসবে।
আনন্দ তাকিয়ে ছিল বড় ছবিটার দিকে। নাকে নথ, কপালে টিকলি, মুখে আধো হাসি, আধো লজ্জা, ফিরে গিয়েছিল আনন্দ অনেক পিছনে। ভাবতে চেয়েছিল সেদিন টার কথা, হোলনা, দরজার বেল টা বেজে উঠল। খুলে দিতেই হূরমুড় করে ঢুকল ওরা চারজন।
সু জড়িয়ে ধরল বাবা কে। মাথায় হাত রেখে দাঁড়ালো বৌমা। “ তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো বাবা, চোখের কণে কালি, দেখেছ একবার তাকিয়ে আয়নাতে?” বলে সু মুখ টা গুঁজে দিলো বাবার বুকে।
বৌমা বললও,” বাবা শেভ করে গরম পানি দিয়ে গোসল টা সেরে নাও। আমি খাবারের অরডার দিচ্ছি, এখনি এসে পড়বে।”
“ দাড়ি আর কাটবো না বৌমা, ভালোই তো দেখাচ্ছে?”
“ না, মোটাও না, দাড়িতে তোমাকে মানায় না বাবা।” বললও বৌমা।
কপালের দপদপানি টা ম্লান হয়ে এলো ওদের কে দেখ। দীপ আর রাজ এসে বসলো বাবার পাশে। আনন্দ জড়িয়ে ধরল সবাইকে। কেন জানি চোখের জল আটকিয়ে রাখতে পারলো না। বয়ে এলো দুগাল বেয়ে।
“ পেয়েছ, পেয়েছ শান্তি কোথাও যেয়ে?” দীপের প্রশ্ন।
“ তোমার প্রশ্ন পরে, এখন নয়, বাবা, তুমি গোসল করে এসো।” বলে বৌমা গেল টেবিল গোছাতে।
আনন্দ উঠে এলো উপরে। আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল, ভেসে উঠল সামীতার মুখটা। মেয়ে টা কেঁদে ছিল অনেক। কেন জানি বুঝতে পেরে ছিল আনন্দ হয়ত আর কোনদিন ফিরে আসবেনা। আনন্দ তাকে চেপে ধরে বলে ছিল,” আসবো, আমি আবার আসবো এখানে।”
টেবিলে বসে দীপের আবার এঁকেই প্রশ্ন। আনন্দ বলে,” পেয়েছিলাম,পেয়েছিলাম সাদা পাহাড়ের চুড়ায়, পেয়েছিলাম ছোট্ট মুখটার মাঝে। এ যেনো পেয়েও না পাওয়া।”
আসলে আমার চারিদিকে ছিল শান্তির নীড়, ওটাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল আমার কাছ থেকে। তাই আমি খুঁজে ফিরি তার সন্ধানে। হয়ত পাবো না সেই রূপে, আসবে অন্য রূপে, অথবা আসবেনা কোনদিন।
“ কেন? তুমি না প্রেম করতে? মা কে লিখতে চিঠি। তাতে নিশ্চয় অনেক কিছু লেখা থাকতো।” বললও সু।
“ তা লিখতাম, তোমার মা কি বলেছিল শোনও, বলেছিল,” আচ্ছা, আমি তো তোমার বৌ হয়নি, এখনো প্রেমিকা, ইনিয়ে বিনিয়ে তো কিছু লিখলে পারো, তা নয় , সব দরকারি কথা। সাবধানে থাকবে, বাহিরে গেলে কার্ডিগান গায়ে দেবে, ঠাণ্ডা লাগতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।” কাজেই বুঝতে পারছ আমার লেখার ধরন। ও আমার দাড়া হবে না। লোকে চায় সাহিত্য, আমি ওটার মানেই বুঝিনা।”
কথা বলতে বলতে আনন্দের চোখ দুটো জড়িয়ে এলো। ভীষণ ক্লান্ত সে।
কিছু ঠিক করলে? সু র প্রশ্ন।
কাজে ফিরে যাবো। দেখি, কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পারি কি না। এই বলে আনন্দ উঠে পড়ল। ওরা বাড়িয়ে পড়ল যার যার পথে। এটাই জীবন।
মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল আনন্দের। অস্থির হয়ে পায়চারি করছিল সারা ঘর। বাহিরে তখন অঝরে বৃষটি। যেন কেও কাঁদছে।
ভোর হয়ে এলো। আবছা আলো আবছা অন্ধকারের মধ্যে আনন্দ বেড়িয়ে পড়ল এক গোছা লাল গোলাপ নিয়ে। যখন সে ফিরে এলো সূর্য তখন মাথার পড়ে। অত্যন্ত ক্ষুধার্ত সে। গাড়ী পার্ক করলো মলের নিচের তালায়। দৌড়ে যেয়ে পা দিলো এসকেলেটরে। নতুন ফুড কোর্ট খুলেছে। অনেকদিন আসেনি সে। এসকেলেটরের মাঝ পথে চোখা চোখী হোল কালো সালওয়ার কামিজ পরা, মাথায় কালো ওড়না আলতো ভাবে জড়ানো, শ্যামলা উজ্জ্বল রং এক মহিলার সাথে। হাতে দুটো চিকন সোনার চুড়ি। হাসির রেখা দেখতে পেলো আনন্দ মহিলার ঠোটে। মনে হোল কোথায় যেন দেখেছে সে। সৃতির ভাজে রয়ে গেছে, মনে এলো না তার। আর একবার পিছনে তাকাতেই দেখল মহিলাও তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। সেই হাসিটা মিলিয়ে যায়নি। নিচের তালায় পা দিলো সে, আনন্দ হোঁচট খেয়ে দাঁড়ালো দোতালায়।
আনন্দ নয়। আনন্দের হাতে অফুরন্ত সময়। বছর পেরিয়ে গেল সে একেলা। সে ভাবে, কি আশ্চর্য্য এখনো সে হেসে খেলে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাচ্ছে কারো বাসায়, দেখছে টিভি, শুনছে গান। তর্ক করছে পলিটিকস নিয়ে. বাড়ছে ভাত একলা ঘরে। সব চলছে তার নিজের গন্ডিতে।
ওর জানালার পরদাটা কাজ করছে না। ইচ্ছে নেই ওটাকে ঠিক করার। যাক সব ভেঙে টুকরো হয়ে। সেদিন উনুন জ্বালাতে যেয়ে আংগুলটা পুড়ে গেল, ঔষধ ছিল, সময় চলে গেছে ঔষধের। চা বানানো, ডিম ভাজা ছাড়া আর কোন কিছু করার মুরোদ তার নেই. রান্না ? এই শব্দ টা তার ডিকসনারির বাহিরে ।
বড় রান্না ঘর আজ কাজের অভাবে কাঁদছে। আদা রসুন পেঁয়াজ আজ আর আসে না ঘরে। রেফরিজারেটর খালি। আছে শুধু কটা ডিম, আর চা র দুধ । মাঝে মাঝে থাকে পুরানো ভাত। আর অন্যর দেওয়া মাছ, ডাল।
ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বলল,” তোমার মুখের চাপা হাসিটা আর নেই।”
হায়রে পোড়া কপাল. কবে যে সে প্রান খুলে হেসে ছিলো মনে করতে পারে না।
বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। বাসার সামনে টাতে আর আগের মত জৌলুশ নেই। চিঠির স্তুপ পড়ে আছে । ঘরের আনাচে কানাচে মাকড়সার জাল। টেবিল, চেয়ারে ধুলো। প্রিসিলা আসেনি অনেক দিন। দুটা ডিম এখনো আছে রেফরিজারেটরে. দুধটা খারাপ হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার । আলো আর জ্বলে না।
দ্বিতীয় পর্ব
রুক্ষ চেহারা, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উস্খখুস্ক চুল, চিরুনি পরেনি চুলে কত দিন জানা নেই, ব্যাগপ্যাক টা কাঁধে নিয়ে আনন্দ দাঁড়িয়ে ছিল বাসার সামনে। ফিরে এলো এক মাস পর। বেড়িয়ে ছিল মনের শান্তির সন্ধানে। পেয়েছে কি? যাওয়ার আগে ডেকে ছিল তার দুই সন্তান কে। দিপ আর সু আনন্দকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,” তোমার কি না গেলেই নয় বাবা ? বাধা তোমাকে দেবনা, এই যদি তোমার শান্তির পথ হয় তবে তাই হোক। আমরা তোমার অপেক্ষায় থাকব”।
ব্যাগপ্যাক নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে ছিল আনন্দ। ভুলে গিয়েছিল বয়স তার ষাটের কোঠা পেরিয়ে গেঁছে অনেক আগে। কি এক নেশা তাকে পেঁয়ে বসে ছিল. কোথায় গেলে শান্তি । সেই মোহের টানে এসে পড়েছিল নেপালের বকতাপুরে। রাত তখন ১১:৩০। ছোট্ট হোটেলের ছোট্ট একটা কামরাঁয় ঘুমিয়ে ছিল আনন্দ । ভোরে দরজায় টুক টুক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। সুর্যের আলো এসে পড়েছে জানালা দিয়ে। দুরে পাহাড়ের চুড়া সাদা বরফে ঢাকা। মুহুর্তে আনন্দের মনে হলো ঐ সাদা চুড়া তাকে ডাকছে। ওটা তো বরফ নয়, সাদা কাপড় পরা পরিচিত মুখ, ডাকছে তাকে, “এসো, এতদূর যদি এলে, আর একটু পথ এসো ,পাবে আমাকে”।
টুক টুক শব্দ আবার। ফিরে এলো বাস্তবে , আনন্দ। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো এক মহিলা, হাতে কাপ। ” বাবু আপনার চা.” চা র কাপ হাতে নিয়ে আনন্দ জিজ্ঞেসা করেছিল, ” বলতে পার কিভাবে যাবো চানগু নারায়ন মন্দিরে”?
“হা বাবু” আগে চলুন আমার বাসাঁয় ওখান থেকে যাব মন্দিরে। ” তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়েছিল আনন্দ । এসে দাঁড়াল ছোট ছিম ছাম এক বাসার সামনে। উঁঠানে গাছের ছায়া। মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা সেই বাসা যেখানে সে আংটি পরিয়ে ছিল ওর আংগুলে.
হাতে টান পড়তেই তাকিয়ে দেখে ছোট্ট একটা মেয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কোকরা চুল, কপালের পাশে কালো
টিপ। আনন্দের কি হলো সে নিজেও জানে না। কোলে তুলে নিলো তাকে, মনে হলো সে জেনো বলছে,”দাদুমনি, তুমি কি আমার মাঝে বাঁচতে পারনা?
খুজে পাবে দাদিকে আমার মাঝে”
নাম কি তোমার?
উত্তর এলো ওর মা র কাছ থেকে। ” ও কথা বলতে পারেনা, বাবু জি” শুনে আনন্দ ওঁকে চেপে ধরেছিল বুকের মাঝে। ওর গরম নিশ্বাস পরেছিল আনন্দের মুখে। চুপটি করে মুখটা গুঁজে দিয়ে ছিল আনন্দের বুকে।
হোটেলে আর ফিরে যাওয়া হয়নি, যায় নি মন্দির দেখতে। সামিতাদের বাসাতেই থেকে গিয়েছিল বাকি দিন গুলো। বসে থাকত পাহাড়ের পাদ দেশে
সামিতাকে পাশে নিঁয়ে, তাকিয়ে থাকত চুড়ার দিকে।
পাশের বাসার টেমীর ডাকে ফিরে এলো আনন্দ তার জগত থেকে।
” এই এলেন বুঝি?”
হা, উত্তর দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল আনন্দ । দরজা টা খুলতে যেয়ে খুলতে পারল না,
মাথা টলকে উঠল, অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেলো টেমীর চিৎকার ,
কেমন আছো? ডাক শুনে চোখ তুলে চাইল অনির্বাণ। বিশ্বাস হচ্ছেনা। চোখ দুটো কচলিয়ে আবারো চাইল। এই বয়সে চোখে ছানি পড়ার কথা নয়।
অঞ্জনা তুমি?
হা আমি। কি করছো একলা বসে।
কিছু নয় । কফি টা শেষ করে উঠবো ভাবছিলাম। তুমি যখন এলে তাহলে আরও একটু বসব। তুমিও বসো। সেই যে চলে গেলে বাই বলে, পেছনে আর তাকাওনি। আমারও বলার কিছু ছিলনা।
হা আমাকে বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল। আমার করনীয় কিছু ছিলনা।
নতুন জায়গা কেমন লাগছে ?
যার হাত ধরে চলে গিয়েছিলাম, বলতে পার যে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তার খোজ আমি আর পরে পাইনি। পরিচয় হয়েছিল অন্যদের সাথে। তারা তাদের মত, নিজেদের নিয়ে বাস্ত। আমি আমার মতই আছি। ঘুরি ফিরি। হই হট্টগোল নাই। ফিরে যে আসবো তোমার কাছে তারও উপায় নেই। তোমাকে যে বলবো এসো আমার এখানে তা বলতে মনে দ্বিধা লাগে। অন্য পথে পা দেওনি দেখছি? এখনো একলাই রয়ে গেলে।
ঠিক ধরেছ ? লোকে কানা ঘুসা করে। কান দেইনে। তোমার উপর রাগ দুঃখ কোনটাই নেই। পারিপার্শ্বিক অবস্থা তোমাকে বাধ্য করেছিল। সেই কথা ভেবেই কাটিয়ে দিচ্ছি দিনগুলি।
সারাদিন কি করো?
কাজ শেষে বাসায় এসে চাল টা চাপিয়ে দেই। তুমি চলে যাবার পরে উনন আর আমার জলেনী। কিনে আনা অথবা অনন্যের দেওয়া খাবার গরম করে গলাধী করন করি।
এই ডিপার্টমেন্ট তো তোমার আয়েত্তে কোন সময় ছিলনা।
কি করবো বলো ? বাধ্য হয়ে অল্প কিছু করতে হয় বেচে থাকার জন্য।
ছুটির দিন গুলি কি ভাবে কাটে?
দূরে ধুধু মাঠে একলা বসে থাকি। বাঁশি বাজাতে জানলে ভালো হতো। জনও শূন্য মাঠে বাঁশির সুর বিরহের বেদনা এনে দেয়। বল তোমার কেমন লাগছে নতুন জাগা। বললে তো যার সাথে হাত ধরে গেলে সে এখন তোমার সাথে নেই।
না নাই। তাকেও বাধ্য হোয়েও অনন্যদের কাছে যেতে হয়। ওই যে বললাম একা একাই কাটাই। জাগা টা সুন্দর । বলেতে পারো মনমুগ্ধ কর। যেনো হাতে আকা ছবি । ফলের গাছের অভাব নেই। নদী বইছে নিচে। ওখানকার যারা বাসিন্দা তাঁরা সবাই যে যার মত বাস্ত। বন্ধুত্ব করার কোন উপায় আছে বলে মনে হয়না । আমি যে শহরে থাকি সেটা বিশাল। ওখান কার আইন কানুন এমন ভাবে তোইরি, যে তোমাকে কিছু করতে হবেনা। তুমি শুধু থাকবে ধ্যানএ মগ্ন। হত্যা রাহাজানি বলে কিছু নাই।
তা জাগা টা কোথায় বলবে কি? তা হলে আমিও না হয় তল্পী তল্পা ঘুছিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম।
না তোমার এখনো সময় হয়নি । বুঝেছি তোমার দিন আগের মত আর কাটছে না । আমি যে তোমার কাছে আবার আসবো তারও কোন উপায় নেই। আজ অনেক দিন পরে এই শহরে এসে ছিলাম, তোমাকেই খুঁজছিলাম , পেয়েও গেলাম। তাও আবার একেলা।
ভালো করেছ। অনেক দিন পরে তোমাকে দেখে ভালোই লাগছে।
মনে আছে আমরা কাঞ্চন জঙ্ঘা দেখতে গিয়েছিলাম। ভোরের সূর্যের রশ্মি এসে পরেছিল পাহাড়ের চুড়ায়। অপূর্ব আলোর খেলা। তুমি আমার কোলে মাথা রেখে বলেছিলে , কি বলতে দেবেনা ?
না , পিছনে আমি ফিরে যেতে চাইনা । তুমি ও না । তাতে করে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে মনের দিক থেকে । তোমাকে সামনে চলতে হবে। সেই যে গুন গুন করে গাইতে “ নদীর নাম সই আঞ্জনা” এখনো গাওকি?
গাই মাঝে মাঝে। জানো কাল তোমার দুটো ছবি অনেক বড়ো করে বাধিয়ে রেখেছি আমাদের শোবার ঘরে, যাবে দেখতে ?
না থাক , যে বাসা তুমি ছেড়ে গিয়েছিলে নাই বা গেলে সেখানে । কতক্ষন থাকবে?
বেশিক্ষণ নয়। ফিরে যেতে হবে । তোমার সাথে আবার কবে দেখা হবে জানিনা । ভালো থেকো।
অনির্বাণ হাঁটছিল অন্যমস্ক ভাবে। অফিস শেষে যে ট্রেন টা তার ধরার কথা ছিল সেটাতে যাবেনা ঠিক করলো। কেন, সে নিজেও জানেনা। বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই। কোনদিন যে ছিল তাও নয়। আজ অস্বাভাবিক ভাবেই দেরী করছে সে। গতকাল পাওয়া চিঠি টা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। শান্তি, শান্তি অনেক খুঁজে অনির্বাণের সন্ধান পেয়েছে। তাইতো লিখেছে সে,” আসতে পাড়বি একদিন আমার এখানে”।
সামনের কফি শপ টাতে বসে এককাপ কফি খেয়ে নেবে ভাবল অনির্বাণ। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ফিরে গেল সে অনেক পিছনে।
ছোট্ট শহর। অনির্বাণদের বাসার পাশের বাসাটা ছিল শান্তিদের। বয়স তখন কত ? চার, পাঁচ। এক্কা দোক্কা খেলার সাথী। হারিয়ে যেতো দুজনে পুকুর পাড়ে। জাম গাছের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরা জাম তুলে খেতো। সারা মুখ হয়ে যেতো নীল।
শান্তি বলত,” অণু, চল যাই ওই শালিক পাখি টাকে ধরি।” শান্তি সবসময় মাতব্বরি করতো অনির্বাণের উপর। অনির্বাণও সেটা মেনে নিয়েছিল। হাত ধরাধরি করে দুবন্ধু একদিন খেলতে খেলতে বড় হয়ে গেল। অনির্বাণ ষোল, শান্তি পনেরো।
অনির্বাণ চলে যাবে দূর শহরে। শান্তি তাকে বলেছিল,” জানিস অণু, তুই চলে গেলে আমি একেবারে একলা হয়ে যাবো। অনেক কাঁদবো। তুই একমাত্র আমাকে বুঝতে পারতিস।” অনির্বাণ চোখ মুছে বলেছিল,” ভাবিস না, আমি তোর খোজ রাখবো।”
না, কথা সে রাখেনি। ভুলে গিয়েছিল সে শান্তি কে, মেতে উঠে ছিল নতুন জীবন নিয়ে, ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছিল অতীত কে। কিন্তু আজ চিঠি টার দিকে তাকিয়ে চোখের কোণ টা ভিজে উঠল। আবারো পড়ল সে চিঠি টা। করুন ভাবে লেখা। “ পারবি অণু, পারবি কি একবার আসতে, আমাকে দেখতে।”
যাবে সে। ঠিকানা দেখল। কানাডার।
তিন দিনের ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল অনির্বাণ তার গাড়ী নিয়ে। টরেন্ট শহরের কিছু দূরে শান্তির ঠিকানা। অনির্বাণ যখন পৌছালো সূর্য তখন অস্তাচলে। বাড়ী চিনতে অসুবিধা হয়নি। দুরু দুরু বুক কাঁপছে। প্রায় বিশ বছর পরে শান্তির সাথে দেখা হবে। আনন্দ নয়, কোথা থেকে একটা ভয় তাকে গ্রাস করছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে। গাড়ীর আয়নায় চেহারা টা দেখে নিলো অনির্বাণ। নেমে এসে দরজায় টোকা দিতেই এক বয়স্ক ভদ্র মহিলা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলো,” কাকে চাই?”
“ শান্তি আছে?” অনির্বাণ জানতে চাইলো।
“ আপনি বুজি অনির্বাণ?”
অনির্বাণ বুঝল সে এখানে অপরিচিত নয়।
“জী” শব্দ টা সে অনেকদিন পর ব্যবহার করলো।
“ আসুন” বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো ভদ্রমহিলা।
ছোট্ট ঘর,দুটো লাভ চেয়ার, তার সামনে কফি টেবিল, একটু দূরে সাধারণ একটা টুল। পাশে লম্বা আয়না। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। দেয়াল গুলোতে রংএর ছোপ পড়েনি অনেকদিন। অনির্বাণের মনে হোল ঘরটাতে দারিদ্র্যতার ছাপ।
উঠে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে দাড়াতেই পাশের দরজা খুলে এলো ঘোমটায় মুখ ঢাকা এক ভদ্রমহিলা। ছিপছিপে শরীর। “ কেমন আছিস অণু”?
অনির্বাণ থমকে যেয়ে তাকালও ঘোমটা ঢাকা অতি পরিচিত অথচ অনেক দূরের মহিলার দিকে। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না, পলক পড়েনা চোখে।
“ ঘোমটা সরাবি ? নাকি পর পুরুষের সামনে মুখ দেখাতে না করে দিয়েছে কেউ?” অনির্বাণের জিজ্ঞাসা।
এ কথার উত্তর না দিয়ে শান্তি বললো, “ শানু, সেই যে তুই চলে গেলি আর ফিরে এলি না, খোজ ও নিলিনা।”
“ আমি তার জন্য অনুতপ্ত। কি হয়ে ছিল আমার জানিনা, পিছনে ফেলে আসা দিনগুলি আর আমার মনের মধ্যে আসেনি। আমাকে ক্ষমা করিস।”
“ ওসব ক্ষমার কথা বাদ দে। তোকে ডেকে এনেছি একটা কাজে। সেটা বলবো পরে।”
অনির্বাণ বুঝতে চেষ্টা করলো শান্তি কি বলতে চাইছে। ওর মনে হোল উঠে যেয়ে শান্তির হাত টা চেপে ধরবে কিনা। যে ভাবে দুজন হাত ধরাধরি করে দৌড়িয়ে বেড়াতো। কোথায় জেনো সংকোচ, দ্বিধা।
শান্তি বলে ,” জানিস অনু, যে শহর তুই ছেড়ে এসেছিলি ওটা অনেক পালটিয়ে গিয়েছিল। মাস্তানদের উপদ্রব আরম্ভ হোল। তখন আমার উঠতি বয়স। স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। বুঝতেই পারছিস -। আচ্ছা দেখ, আমি শুধু বক বক করছি। হোটেল ঠিক করে আসিস নিতো ?”
“না হোটেল ঠিক করিনি।”
“তা হলে এখানে থেকে যা। একটা ঘর আমার। তোকে এই ড্রয়াইং রুমের মেঝেতে থাকতে হবে, অসুবিধা হবে না তো? “ বলল শান্তি।
“ অত ফর্মালিটি করিসনাতো? তুই বল তোর কথা, আমি শুনতে এসেছি আর দেখতে এসেছি তোকে।”
অনির্বাণ তাকিয়ে ছিল শান্তির কাপড়ে ঢাকা হাতটার দিকে। মনে হলো সমস্ত শরীর টাকে সে কাপড়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু কেন?
“ বল কি বলছিলি” অনির্বাণ ফিরে যেতে চাইল সেখানে, যেখানে কথা অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল।
“ যা বলছিলাম, উঠতি বয়স আমার, তারপর দেখতে শুনতে খারাপ ছিলাম না। ঐ হোল আমার কাল। তারপর হিন্দুর মেয়ে আমি। স্কুলের পথে আসতে যেতে উতক্তা করেতে লাগলো মাস্তানরা। মাস্তান দের সর্দার একদিন আমাদের বাসাতে এলো। বাবা কে বললও সে বিয়ে করবে আমাকে। যদি রাজি না হই তবে উচিত শিক্ষা দেবে।”
বাবা তাকে বের করে দিয়েছিল বাসা থেকে। স্কুলে যাওয়া আমার বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে থাকি।
“ আইনের আশ্রয় নিসনি কেন?” প্রশ্ন অনির্বাণের।
“ তুই কি পাগল হলি? ওরাই তো আইন, ওরাই সব। আমাকে যে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাইনি সেটাই তো ভাগ্য।” বললও শান্তি।
বলল,” অনু, ভালই হতো, যদি নিয়ে যেতো আমাকে, তাহলে আজ তোকে ডেকে পাঠাতাম না। তুই অস্বস্তি বোধ করছিস না তো?”
“ কি যে বলিস ? বল তোর কথা।”
“বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ভাবলাম ঝড় হয়ত থেমে গেছে। রহীমাদের বাসাতো তুই চিনতিস। ওখানে যাবো ঠিক করলাম। কাউকে কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। রাস্তার থেকে গলিতে মোড় নিতেই পড়লাম ওদের মুখোমুখি। ভয়ে আমার শরীর আড়ষ্ট হয়ে এলো। দেখলাম মাস্তানদের সর্দারের দুটো হিংস্র চোখ। এগিয়ে এলো। কোন কথা বলেনি। শুধু ঢেলে দিয়েছিল এক বোতল এসিড আমার মুখের পরে।”
অনির্বাণ শিউরিয়ে উঠল কথা শুনে। তারপর,—-
“ চীৎকার করে ওখানে লুটিয়ে পড়েছিলাম। যখন জ্ঞান হোল দেখলাম, হাঁসপাতালের বেডে শুয়ে। সমস্ত মুখ ব্যান্ডেজে বাধা। “ এই বলে শান্তি একটু থামল.
“ বল শানু, থামিস না” অনির্বাণ উৎকণ্ঠিত
শানু বলে,” অনু, মনে আছে তুই বলতিস আমার গালের সেই ছোট্ট তিল টা তোর খুব পছন্দ। সেটা হারিয়ে গেছে।”
অনির্বাণের চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মুখে কোন কথা নেই। শান্তির
নিজের অজান্তে কখন যে ঘোমটা একটু সরে গিয়েছিল সে নিজেও জানে না। পাশের আয়নায় ফুটে উঠেছিল ঝলসে যাওয়া মুখটা। অনির্বাণের সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠেছিল। চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল । তাকাতে পারেনি দ্বিতীয় বার।
“ শানু থাক বলতে হবে না। কি শাস্তি হয়েছিল ওই বদমাশদের?” অনির্বাণ জানতে চাইল।
শান্তি একটু হাসলো। শাস্তি, কোথায় শাস্তি? প্রমাণ হয়েছিল ওই সময় ওরা ছিল অন্য গ্রামে। তুই ভাবছিস আজ আমি এখানে এলাম কি ভাবে, তাইনা? এক জনের দয়ায়। আমাকে দেখেছিল হাসপাতালে। এসেছিল তার মা কে দেখতে। পাশের রুমে। পরিচয় হয়েছিল বাবার সাথে। শুনেছিল সব।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমরা সেই শহর ছেড়ে অন্য শহরে বাসা বেধে ছিলাম। বছর না পেড়োতেই একদিন কামাল এসেছিল আমাদের বাসায়। বাবাকে প্রস্তাব দিয়ে ছিল। বাবা প্রথমে রাজি হয়নি। বলেছিল তাকে, “দয়া দেখাতে আসোনি তো? তুমি দেখেছ শান্তিকে? পারবে সহ্য করতে? তোমরা, আমরা এক গোত্রের নই। পারবে কি সে দন্ধ থেকে বেড়িয়ে আসতে?”
সে শুনেছিল। বলেছিল তার কোথা। নিয়েছিল আমাকে।
এখনো কিছু ভাল মানুষ আছেরে অনু। এই বলে শান্তি উঠে দাঁড়াল। বললও
“ চল খেতে বসি, সেখানে শেষ করবো সব কথা।”
অনির্বাণ জিজ্ঞাসা করলো,” তোর সেই দেবতা কোথায়?”
“ সব বলবো তোকে, আগে হাত মুখ ধুয়ে নে।”
খাবার টেবিলে বসে শান্তি বলে,” কি জানিস অনু, এখন মনে হয় উপরওয়ালা বলে কিছু আছে। তা না হলে আমার দেবতা যখন চলে গেল তখন তোর খোজ আমি পেয়ে গেলাম। আমার এক দরজা বন্ধ হোল আর এক দরজা খুলে গেল।
হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে ও চলে গেল একদিনের মধ্যে। রেখে গেল আমার তিন বছরের মেয়েকে। অনু, পারবি ? পারবি আমার অবর্তমানে অনন্যাকে মানুষ করতে? পারবি অনু?”
অনির্বাণ কথা দিয়েছিল। বলেছিল,” ভাবিসনে শানু, একবার ভুলেছিলাম, আর নয়।”
কয়েক বছর পাড়িয়ে গেছে। এক রোঁদরো ঝরা বিকেলে অনির্বাণ তার ড্রয়াইং রুমে বসে বই পড়ছিল, এমন সময় কোথা থেকে দুষ্টু মেয়ে টা কাকু কাকু বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল অনির্বাণের বুকে, গালে গালে রেখে বললও,” তুমি না বলেছিলে জোন্স বীচে নিয়ে যাবে কাকুমনি?”
চন্দন পুর জেলা শহর থেকে একটা রাস্তা পশ্চিমের দিকে চলে গেছে গোপাল গনজ। পিচের রাস্তা। দুদিকে বড় বড় গাছের সমারহ। সেই গাছের ছায়ায় ক্লান্ত পথিক দুদন্ড বিশ্রাম নেয়। পাশে ধান আর আখের ক্ষেত। দুরে ছোট ছোট বাড়ী। কোনোটা মাটির কোনোটা ইটের। বাচ্চারা খেলা করে রাস্তার পাশে। বড় বড় টা্র্ক পাট নিয়ে যায় দুর পাল্লায়। এই এলাকা পাটের চাষের জন্য প্র্সিদ্ধ। গোপাল গন্জ থেকে বায়ে বাক নিয়ে
যে রাস্তা টা চলে গেলো সে রাস্তা ধরে ১৮ কিলোমিটার গেলে একটা ছিম ছাম শহর নাম সুন্দর পুর। গা্র্ম নয় উপজেলা। লোক সংখা বেশি নয়। এক কালে হিন্দু অধুসসিত ছিলো এই শহরটি। যাতা্র্ নাটক সবই হোতো। সাংসকি্র্তির দিক দিয়ে ছিলো উচ্চমানের। এখন আর হয়না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে গেছে অনেক কিছু।
এই শহরের মাঝে আছে ছেলে দের আর মেয়েদের হাই স্কুল। আছে কলেজ। এই শহরের বেশির ভাগ লোকই ব্যবসাই।
জমির আলি সাহেব ছেলেদের হাইস্কুলের হেড মাস্টার। কোলকাতা থেকে পড়াশুনা করে এই শহরে এসে উঠে ছিলেন। দুর গা্র্মে প্র্তরিক বাড়ী। লোকে সমিহ করে। সল্প ভাসি, কথা বলে কম। যত টুকু প্র্য়োজন তার অধিক কথা উনাকে কেউ বলতে শুনিনি। স্কুলের দায়িত্ত পালনের সাথে সাথে পাটের আর কাঠ কাটা কলের ব্যবসা আছে। কাঠ কাটা কলের নাম রেখেছে বড় মেয়ের নামে। অন্যন্না মিল। অন্যন্নার দাদা অন্যন্নাকে কপালি বলে ডাকতো। বলতো এ মেয়ের জন্ন্য জামাই খুজতে হবেনা। খুজতে অবশ্য হয়নি। সে কথা থাক।
হেড মাস্টার সাহেবের দুই মেয়ে। অন্যন্না আর সম্পা। অন্যন্না দুই বছরের বড়। উজ্জল ফর্সা বলা চলে, মানান সই লম্বা, শরিরের গঠন ভালো, সম্পা শ্যেমলা কোকরানো চুল, চেহারায় মিস্টতা ভাব। এক জন ধির স্থির অন্যজন চনচ্ল , দুরোন্ত। দুজন দুজন কে ছাড়া চলেনা। মাঝা মাঝে অন্যন্না তার অধিকার ফলায় সম্পার উপর, “ শুধু বাইরে বইরে টো টো করে বেড়াবি নাকি মা কে একটু সাহ্যায্য করবি।” ওর জন্ন্য তো তুমি রয়েছো, আমাকে ডাকছো কেনো? আমি যচ্ছি রহিমাদের বাসায়, ওখানে সবাই মিলে আড্ডা দেবো।” অন্যন্না মার কাছে বসে সাহায্য করে মাকে, তেল টা, নুন টা এগিয়ে দেয়। সম্পার মধ্যে আছে উচছলতা যা সচারচর দেখা যায়না। হেড মাস্টার সাহেবের বাসাটা পা্র্য় এক বিঘা জমির উপর, পেছনে সেগুন গাছ, আম গাছ, পাশে ছোট্ট পুকুর, এক সময় কিছু মছের চাস করা হোতো। আজ আর নেই। খরাতে জল শুকিয়ে এসেছে। বাগানের মাঝ দিয়ে হাটা পথ। এপথ ছিলোনা মানুষ জনে হেটে হেটে বানিয়ে নিয়েছে।
স্কুল শেষে দৌরিয়ে এলো সম্পা, “ মা, কিছু কাঠ আর চাল ডাল দিতে পারবে? আমি, টুনি আর পরুল মিলে বোনভোজন করবো পুকুর পাড়ে। “ বাবা শুনলে বকবে। দাও না মা। নাছর বান্দা। “ যা আমি সব পাঠিয়ে দিচ্ছি ওসমান কে দিয়ে, ওসমান ঠেকা খাটে মাস্টার মশাই এর বাসায়। অন্যন্না শুনছিলো সব কথা, বলল,” চল আমিও তোদের সাথে বোনভোজন করবো” আবার তুমি কেনো? সম্পা চিৎকার কর উঠলো। আপা গেলে ওর মাত্ববড়ি থাকবে না। বোনভোজনে যোগ দেওয়া অন্যন্নার প্র্ধান উদ্দেশ না, উদ্দেশ বোনকে চোখে চোখে রাখা।
দুরন্ত সে, আগুন নিয়ে খেলা করতে যেয়ে কখন কি হয় বলা যায়না। বোনটা তার খুব আদরের। সে কথার সংগি। সে তার নিত্তদিনের ছায়া।
বাবার চোখের মনি দুবোন। ওরা মাকে বলে, “ আচ্ছা মা বাবা অনেক মজার মজার কথা বলে , তাই না?”
জানিনা বাছা, তোমাদের কাছে কেনো এত ভালোলাগে। ওরা জানে বাবাকে ছাড়া মা অচল। মনে পরে সম্পার, সে মা কে বলে ছিলো,” আচ্ছা মা, তুমি শুয়ে বসে কাটাও গা ব্যথা হয়না।” বাবা সে কথা শুনে দুবোন কে ডেকে বলেছিলো, “ তোমাদের মা অনেক কষ্ট করে তোমাদের কে মানুষ করছে, মার চোখে কোনোদিন জল আনাবে না।”
সেদিন ওরা বুঝেছিলো বাবা মাকে কত ভালোবাসে।
দেখতে দেখতে সম্পার গলায় ওড়না এলো। বুঝতে পাড়লো সে বড় হয়েছে। পাড়া বেড়ানো কমে এলো। বকাটে ছেলেদের তো অভাব নেই। অন্যন্না তৈরি হচ্ছে মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্ন্য। বরাবরি ভালো ছাতি্র্ সে। সম্পার পটুতা অন্য দিকে। লেখার হাত ভালো। বাবা বলেছে অন্যন্না ভালো রেজালট করলেওকে ঢাকাতে পাঠিয়ে দেবে, ভালো কলেজে ভর্তি হবে। সম্পা শুনেছে সে কথা। অন্যন্নার কাছে এসে বলে,” আপা তুমি চলে যাবে।” কান্নায় গলা বুজে আসে। আপা ছাড়া তার মনের কথা বলার কেউ নেই। আপাই তার সো্র্তা। আপাই সব।
মনে পড়ে ছোটবেলায় সে আপাকে বলেছিলো,” আচ্ছা আপা আমাদের এক বাড়ীতে বিয়ে হোলে আমরা এক সাথে থাকতে পারবো, তাই না?” আপা শুধু হেসে ছিলো।
অন্যন্না ভালো রেজাল্ট করেছে। ভর্তি হবে ঢাকার নাম করা কলেজে। চলে যেতে হবে। সম্পার চোখে জল।
জানতে দেয়না আপাকে, পাছে আপা দুক্ষো পায়। পুকুরের পাশে বসে অঝরে কাঁদে। তার খেলার সাথি, তার কথা বলার সাথি চলে যাবে অনেক দুরে। গুমরিয়ে উঠছে বুকের ভিতর। তবু যেতে দিতে হবে। অন্যন্না ওকে চেপে ধরে বলে, “ কাদিঁস নে, আমিতো ছুটি ছাটায় আসব, চিঠি দিস।”
অন্যন্না চলে গেলো। সম্পা ধিরে ধিরে দুরন্তপনা ছেড়ে মার পাশে এসে দাড়ালো। বাবার ওজুর পানি এগিয়ে দেয়, মাকে রান্না ঘরে সাহায্য করে। অন্যন্নার চিঠি আসে। নতুন জীবনের খবর, নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ। অন্যন্নাকে উঠিয়ে দিয়ে এসেছিলো ওর বাবা অন্যন্নার এক ভাই ভাবীর কাছে। বলে এসেছিলো বাবা রফিক ওকে দেখে রেখো। অল্প ছুটি ছাটায় ওদের বাসাতে উঠতো অন্যন্না।
অন্যন্নার কলেজ শেষ। সম্পা মাদ্ধোমিক পরীক্ষা শেষ করলো। গরমের ছুটি। দুজনে বাসাতে। কথা শেষ হয়না। অন্যন্না বলে ঢাকার অভিগ্গতার কথা। বলে,”জানিস একজনের দেখা পেয়েছি। “ কি? কার। তার মানে তুমি পে্র্মে পড়েছ।” ওকে দেখলে পে্র্মে না পড়ে থাকা যায় না” “কি বলছ,তোমার মুখের সামনে টিকতে পাড়লো,”
তুই দেখলে বুঝতে পারবি। ফটো টটো আছে, না সব বুকের মধে্য। “ না নেই।” বাবা মাকে বলবো। “ না না এখন নয়”। ওব বাবা। নাম কি? সাহারিয়া। আধুনিক নাম মনে হচ্ছে। কি নামে ডাকো? এখনো নাম ধরে ডাকিনি, তবে সোনা টোনা এসব বলে ডেকে ফেলবো। তুমি আমাকে লজ্জায় ফেললে আপা।
আপার আনন্দে সেও আনন্দিতো। একটা চিঠি লেখে হবু দুলাভাই কে পাঠিয়ে দিয়েছিলো আপার সাথে।
লেখাতে সে ছিলো পারদর্শি। বাংলায় অনর্াস নিয়ে সম্পা ভর্তি হলো Universityতে। দুই বোন একে অপরের রুমমেট। নতুন বন্ধু, নতুন শহর, আর আছে অন্যন্নার উপদেশ। অনেক ছেলে পে্র্ম নিবেদন করবে, ফিরেও তাকাবি না। যদি সাহরিয়ার মত কাউকে পাশ তবে চিন্তা ভাবনা করিস। সম্পা বলে ছিলো,” আচ্ছা আপা, তোমার এই সাহরিয়া তো দুটো জন্মেছে বলে মনে হয়না, তা আমি আর একটা সাহরিয়া কোথায় পাবো”।
সেই সাহরিয়া কে খুজতে যেয়ে সম্পা কে একলা থাকতে হলো বেশ কিছু বছর।
এর মাঝে নদীর পানি অনেক গড়িয়ে গেছে। অন্যন্না আর সাহরিয়া হয়ে গেছে স্বামী স্তী্র্। চলে গেছে বহু দুরে আর এক দেশে জীবিকার সন্ধানে।
সম্পা আজ একা। পড়াশুনা শেষ করে উঠেছে সেই ভাই এর বাসায়। মাঝে মাঝে অন্যন্নার সাথে কথা হয় ফোনে। দিনের শেষে রাত আসে, বছর ঘুরে যায়, সাথে সাথে বয়সের ছাপ এসে পড়ে সম্পার জীবনে। একটার পর একটা পাশ দিতে থাকে। অবশেষে একটা ছোটদের স্কুলে শিক্ষয়েত্র্ হয়ে যোগদান করে। বাচ্চারা কেনো জানি ভীষন ভালবাসতো ওকে। ভালোবাসার মতই মন ছিলো ওর। দেখা পেলো একজনের। জানালো আপাকে।
“আপা পেয়েছি, তবে তোমার সাহরিয়ার মত কিনা জানিনা”। আপার চিন্তা লাঘব। তার বোনকে অনেক দিন সে দেখেনা। জীবনের কাটা ঘুরে চলেছে। একটা চিঠি এসে পড়লো অন্যন্নার হাতে। সম্পার লেখা। “ মেরুদন্ডহীন লোকের সাথে ঘর করার আগেই ভেংএ দিলাম, আপা”। অন্যন্না কোনো কিছু জিগ্গাসা করেনি, শুধু চোখের জল ফেলেছিলো। সম্পা ভেংএ পড়েনি। জীবনে হোচট খেয়ে সে চলতে শিখেছে। স্কুলের ছোট ছটো ছেলে মেয়ে দের মধে্য আপামনি হয়ে বাচতে চেয়েছে।
ভাই এর আনা এক পাত্র্রর সাথে পরিচয় হোলো। নাম মহিম। প্র্থম দেখাই পে্র্ম তা নয়। দেখা সাক্ষাত। দিন ধার্য হলো। সম্পার কুমারি জীবনের অবসান। আপা খুশি। মহিম কে সম্পার ভালো লেগেছিল। সল্প ভাসি। নিজেস্য পি্র্ন্টিং পে্র্স আছে । কাজের ফাকে ফাকে সম্পা কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো দুর পাল্লায়। রাংয়ামাটি, কক্সবাজার, বন্দর বন। বছর ঘুরতেই কোলে এলো এক ফুট ফুটে ছেলে, আনন্দ। সম্পা লিখে ছিলো তার আপাকে, “ তোমার সাহরিয়াকে আমি খুজে পাইনি, আমি আনন্দের মাঝে খুজে পেয়েছি আমার আনন্দ”।
বিধাতার দাবা খেলায় কোন গুটি কখন কাটা পড়ে কেউ জানানা। জানেনি সম্পা। দুদিনের জ্বরে মহিম হারিয়ে গেলো। চলে গালো এই পৃথিবির মায়া ছেড়ে। রেখে গেলো সম্পা আর আনন্দ কে। সম্পা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল। এই পৃথিবীর আলো তার কাছে মনে হলো কালো ধোঁয়া। জীবনের শুরুতেই সব শেষ। শুক পাখি বাসা বেধে ছিলো অন্য খানে তার কাছে নয়। আপা জানলো, জলে ভিজিয়ে দিলো বালিস। কাঁদতে কাঁদতে বলে ছিলো,”কাদিস নে আমি তোকে নিয়ে আসব এখানে।”
স্কুলের চাকরিটা রেখে ছিলো। কস্ট করে সংসার আর ছেলেকে গড়ে তোলার দায়িত্ত সে পালন করেছিলো। ভাবতো পৃথিবিতে কিছু লোক জন্মায় ভ্যাগের সাথে লড়াই কোরে বাচার জন্ন্য, সে তাদেরই একজন।
আড়াই বছরের আনন্দ কে নিয়ে সে এলো আপার কাছে। বোন কে পেয়ে আনন্দ ধরেনা। বলে, “তোর কোনো অসুবিধা হবেনা এখানে, মনে করবি এটা তোরই বাসা।” সেদিন সম্পা ঠাই পেয়েছিলো। ঠাই পেয়েছিলো বিশাল হূদয়ে সমপ্ননো তার বোনের কাছে।
বিধাতার দাবার চাল তখনো বাকি। তা না হোলে আজ সাহরিয়াই বা কেন ভাবতে বসবে, ভুল কি তার হয়েছিলো? যদি সে ছয় মাসের মাথায় সম্পাকে খালেদের হাতে সমর্পন না করতো তাহলে কি আজ সম্পার জীবন কাহিনি অন্ন্য ভাবে লেখা হতো? এ দন্দ তার হূদয়ে, কোনদিন সে বলেনি অন্ন্যনাকে। খালেদ সম্পাকে নিয়ে বাসা বাধলো বেশ কিছু দুরে। সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠেনি। তবুও জীবন চলবে তার গতিতে।
অন্ন্যনাকে সম্পা বলে ছিলো, আমার কপালের খন্ঢন তো তুমি পাল্টাতে পারবে না, আপা। বিধাতা লিখেছে এই ভাবে, কাকে আমি প্র্শ্ন করবো?;” সাতদিন কাজ করে সে সংসার চালায়, ছেলে কে বড় করেছে, কলেজ শেষ করে সে এখন ছোটো খাটো চাকরি করে।
এক দিন অন্ন্যনা সাহরিয়াকে বলেছিলো,” আমার অবর্তমানে তুমি আমার বোনটাকে দেখো,” সে কথা দিয়েছিলো।
সময় থেমে থাকেনি। অন্ন্যনার সাথে কথা হয় সম্পার প্র্তি রাতে। কথা ফুরাতে চায় না। সাহরিয়া বলে,” কি কথা বলো তোমরা প্র্তি রাতে।” ও তুমি বূঝবে না। সাহরিয়া কথা বারায়নি।
বিধাতার শেষ খেলা দেখে সম্পা ইসত্মভিতো হয়ে গিয়েছিলো। সাহরিয়া ফোন করে জানিয়েছিলো অন্ন্যনার কঠিন অসুখের কথা। সম্পা শুনতে চাইনি, বিশ্বাস করতে চাইনি, তার আদরের আপা আজ মূতু পথ যাতি্র্।
অন্ন্যনা বলেছিলো, আয় কদিন এসে আমার কাছে থেকে যা। এসেছিলো, থেকে ছিলো, সেবা করে ছিলো অন্ন্যনার চলে যাওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত।
পাষানের ভাড় সম্পার হূদয়ে, তার ত্নতি্র্তে তনতি্র্তে। ভালো মন্দ মিশিয়ে কথা বলার মানুষটা তার হারিয়ে গেলো চিরতরে। চেষ্টা করে স্বামি, ছেলেনিয়ে ভুলে থাকতে। পারেনা। ভেসে ওঠে তার মনের পর্দায় তার আপার চেহারা যে দিতো পে্র্ররনা, দিতো উপদেশ দিতো বেচে থাকার নতুন পথ।
সন্ধা ঘনিয়ে আসে ।আকাশের লালচে আভা এসে পড়েছে সম্পার ছোট্ট বারান্দায়। চা এর কাপে চুমুক দিয়ে তাকিয়ে থাকে দুর আকাশের দিকে। ভেসে আসে সুর “কি পাই নি তার হিসাব মিলাতে মনো মর নহে রাজি কি পাই নি।”
সুযর্ ঢলে পড়ে। মিলিয়ে যায় পূথিবির আলো, নেমে আসে অন্ধকার।
My name is Khan মুভি টা দেখে বেড়িয়ে আসতেই দেখে হোল অনেক দিনের পরিচিত এক ভাবীর সাথে। “ কেমন আছেন” জিজ্ঞাসা করল ভাবী। “ ভালো, আপনি?” কুশল সংবাদ আদান প্রদানের পরে বললও “ পরিচয় করিয়ে দেই, আমার বোন।” পরিচয় হোল। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মুখে কসমেটিকের ব্যবহার খুব একটা নয়, মাথায় আলতো করে ঘোমটা টানা। বয়স বোঝা মুশকিল। একটু হেসে চোখ টা সরিয়ে নিলো। হয়তো অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলতে অভ্যস্ত নয়। সেটাই স্বাভাবিক। ভাবীর সাথে কথা শেষে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ছোট্ট একটা জিনিষ কিনতে মলে গিয়ে ছিলাম, পেলাম না। তাই উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল এক পরিচিত মুখ। হাতে ভিক্টোরিয়া সিক্রেটের শপিং ব্যাগ। সামনা সামনি হতেই বললাম “ চিনতে পারছেন”? তাকালো, এবার আর চোখ নামিয়ে নিলো না। “ হা পারছি, অনেক দিন পর দেখা, তাই না?”
শপিং শেষ না শুরু ?
মাঝা মাঝি। আপনার?
যেটা কিনতে এসে ছিলাম, পেলাম না। তাড়া আছে কি?
না ততটা নয়
কোথাও বসে এক কাপ কফি খেতে বললে আপত্তি করবেন কি?
না বলা টা আমার মজ্জা গত, তবে আজ আর না বলব না। কোথায় বসবেন?
ওই তো ওখানে, Food court এ।
দুকাপ কফি নিয়ে বসলাম মুখোমুখি। আজ লজ্জার আভা দেখলাম না। সাবালীল ভঙ্গি।
জিজ্ঞাসা করলো,” কি করা হয়?” ফ্রি লেন্স রাইটার। যখন যা মনে আসে অথবা চতুর্দিকে যা দেখি তা নিয়ে লেখি। কেউ যদি ছাপায় ভালো, নতুবা নিজের মধ্যে রাখী। “ বোনের সাথে পরিচয় হোল কি ভাবে?। আপনার দুলাভাই কে চিনতাম আগে থেকে। কোন এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল , সেই সুবাদেই পরিচয়। “ কেউ আছে কি? “বলতে পারেন আছে। এক ছেলে, একমেয়ে। তারা তাদের নিজেদের সংসার নিয়ে বাস্ত। আমি আমাকে নিয়ে”।” বুঝলাম। আমিও আপনার মত।”
তাই কি?
জানি না। আপনার জীবনের বিশ্লেষণ আমার জীবনের বিশ্লেষণের সাথে নাও মিলতে পারে। আপনি দেখছেন হারানোর বেদনাটা এক ভাবে, আমি দেখছি অন্য ভাবে। প্রশ্ন হয়তো এক। কেনো হোল?
এই কেনো খুঁজতে যেয়ে আমিও দিশাহারা। তা কি করে হোল? প্রশ্ন তার।
সে অনেক কথা। আপনি বলুন আপনার কথা দেখি কোঁথাও মিল আছে কিনা
বলল, আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমার। সাত বোন দুই ভায়ের মধ্যে আমি ত্রিতিয়। বাবা সরকারী চাকরী করতেন। বদলীর চাকরী। বিভিণ্ণ সময়ে বিভিন্ন জাগায় থেকেছি। সব বোনের মধ্যে আমিই ছিলাম স্বল্পভাষী। অনেকে জানতোই না আমি বলে কেউ আছে এই বাসাতে।
একদিন বাবা এসে মা কে বলল তার এক বন্ধুর ছেলে এসেছে আমেরিকা থেকে। বাসাতে নিয়ে আসতে চায়। মা রাজী। তাদের মনে কি ছিল জানিনা। আমরা বোনেরা ভীষণ খুশী। গল্প শোনা যাবে আমেরিকার। এলো সে। সব বোনরা মিলে ঘিরে বসলাম। খুব একটা অপ্রস্তুত হোল বলে মনে হোল না। পাতাল রেলের কথা, বড় বড় বাড়ী এই সব বলতে বলতে এক গেলাস পানি চাইল। বুঝলাম নার্ভাস হচ্ছে। এত গুলো মেয়ের সামনে কথা বলা চাট্টি খানি কথা নয়।
চলে গেল সে। আমরাও আমাদের কাজে বাস্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ মা একদিন আমাকে ডেকে পাঠাল। বলল,” বাহিরে খুব একটা যাওয়া আসা করোনা।” বুঝলাম না কেন। বললাম” হঠাৎ কি হোল? বলল।” তোমার বাবার বন্ধুর ছেলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে তোমার জন্য।”। আকাশ থেকে পড়লাম। “ কি বলছ?” আমার আগে আরো দুবোন রয়েছে। “ কিন্তু তোমাকেই তার পছন্দ।”। বিদেশে যাওয়ের সখ আমার চিরওদিনই ছিল। তাই বলে এই ভাবে?
তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্তা করতে হবে, কারণ সে ফিরে যাবে আমেরিকাতে। কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল বুঝার আগেই শুধু এটুকু জানলাম আমার আমিত্ব শেষ। আমি এখন অন্যের স্ত্রী।
এলাম এদেশে। স্বামী আমার দেবতুল্য। কোনদিন কুটো টা ছিঁড়তে দেয়নি। হয়তো বয়স আমার কম ছিল বলে। কিছুদিন পর ওরই এক বন্ধুর সাথে বিয়ে হয়ে আমার বড় বোন (আপনার ভাবী) এলো এদেশে।
আমার স্বামী অনেক পাশ দিয়ে পরে এক ফার্মাসীউটিকাল ইন্ডাস্ট্রি তে ভালো পজিশনে চাকরী পেলো। সংসারের সচ্ছলতার সাথে সাথে কোল জুড়ে এলো এক মেয়ে। ওর বাবার অনেক আদরের। তিন বছরের ব্যবধানে আরও একটা ফুটফুটে মেয়ে এলো আমাদের সংসারে। হই হুল্লো করে দিন গুলো আমার ভালোই কাটছিল, যদি না সে এসে একদিন বলত তার বুকের কাছে একটা চাঁপা
ব্যথা। দুলাভাই কে ফোন করলাম, বলল, এখনি নিয়ে যা হাসপাতালে। দুটো Artary ব্লক। স্টেনট লাগিয়ে দিলো। মনের মধ্যে অজানা একটা ভয়। কখন কি হয় কে জানে। এভাবে চলে গেল অনেক বছর। বড় মেয়ে তখন কলেজের ত্রীতীয় বর্ষের ছাত্রী।
এক রাতে ওর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা, তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স ডাকলাম। হাসপাতাল পর্যন্ত পোঁছাতে পারেনি, তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। আমার জীবনের বড় খুঁটিটা বন্যার জলে ভেসে গেল। “
এই বলে সে থামল, আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত ওর জীবন কাহিনী শুনছিলাম। থেমে যেতেই বললাম– তারপর।
তারপর , দুলাভাই আর বোন বুকে টেনে নিলো আমাদের তিনজন কে। আমাদের বাসাটা ভাড়া দিয়ে দিলাম। জমাট বাধা কান্না আমার বুকে। মাঝে মাঝে আড়ালে যেয়ে কেঁদে বুক ভাসাতাম। যাকে কোন দিন কুটো টা ছিঁড়তে দেইনি তার কাঁধে সব দায়িত্ব দিয়ে সে চলে গেল। আমি চোখের জল মুছে মন কে শক্ত করার চেষ্টা করলাম।
বিধাতার কাছে প্রার্থনা করলাম শক্তি দিতে।
আজ তিন বছর হয়ে গেল, মেয়ে দুটো কে সমাজের মাঝে মাথা উঁচু করে দাড় করাতে পেরেছি। নিজের বাসাতে ফিরে এসেছি। বড় মেয়ে তার বর খুঁজে পেয়েছে আমাদের জানাশোনার মধ্যে। আমি ছোট্ট একটা কাজ নিয়ে সময় কাটাচ্ছি। কত টুকু করতে পেরেছি তার হিসেব নিকেশ আজ আর করিনা।
বললাম আপনার পারিপারশীকতা আপনাকে সাহায্য করেছে। যে দাগ আপনার মনে গাথা তা মুছে যাবার নয়। তার একবার ছিঁড়ে গেলে তা জোড়া লাগে না, লাগলেও একটা দাগ থেকে যায়। এইটাই নিয়ম। তবুও বলব আপনি মনের দিক থেকে অনেক শক্ত।এ ব্যথা তো চলে যাবার নয়। তবু বলি, কাঁদেন, কাঁদলে হয়তো বুকটা একটু হাল্কা হবে। কিছু একটা কে আঁকড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা তো সবাই করে। আপনি হয়ত তা খুঁজে পেয়েছেন।
হয়তো তাই! মনকে বুজ দেই, যার ধন সে নিয়েছে আমার করার কিছুই নেই। এই সান্ত্বনা নেয়েই আমি বেচে আছি।
বললাম, সুন্দর একটা সময় কাটালাম আপনার সাথে, এই রইল আমার ফোন নাম্বার, প্রয়োজন বোধে কল দিয়েন।
“ শুভেন্দু না”, ডাক শুনে পাশ ফিরে তাকাল শুভেন্দু। এক কেতা দুরস্ত ভদ্রলোক, পরনে পলো সার্ট, বেনানা রিপাবলিকের প্যান্ট, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। চিনতে অসুবিধা হলো না। একসাথে স্কুল শেষ করে দুজন দুদিকে চলে গিয়েছিল। পরে আর একবার দেখা হয়ে ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির চত্বরে। আজ এতকাল পরে ব্যাংককের রাস্তায় দেখা। শশাঙ্ক বরাবরই চোঁওকস ছেলে।
“কি মনে করে এই বিদেশ বিভুয়ে” শশাঙ্ক প্রশ্ন করে।
বলতে পারিস রীক্রেসনাল টুর। এসে ছিলাম বাংলাদেশে কিছুদিনের জন্য, ভাবলাম ঘুরে যাই, দেখে যাই এই দেশ টা। এবার তোর কথা বল।”
চাকরী নিয়ে এসেছি এদেশে আজ দুবছর হোল। তারপরই প্রসঙ্গ পাল্টালো শশাঙ্ক, শেষ তোর সাথে যখন দেখা হয়েছিল, দেখে ছিলাম এক সুন্দরীর হাতে হাত ধরে চলতে, দেখছিনে কেন তোর পাশে?
চলে গেছে। ছোট্ট জবাব শুভেন্দুর।
চলে গেছে কোথায়, শশাঙ্কর কণ্ঠে বিস্ময়, কিছুটা বেদনার্তও।
বিধাতা ডেকে পাঠালেন তাকে।
কতদিন হোল ?
তা বেশ কিছুদিন। তোর কোথা বল। শুভেন্দু কথা ঘোরাতে চাইল।
হাসলো শশাঙ্ক। একটানা বলে গেল, ছন্নছাড়া জীবন, ডানা গুটিয়ে বসিনি কোঁথাও। Flying like a bird. পিছুটান নেই। চোখের জল আমিও ফেলিনা, আমার জন্যও কেউ ফেলেনা। তাই বলে ভাবিস না আমি gay। মেয়ে বন্ধু ছেলে বন্ধু দুই আছে। তুই তো এখন আমারই মত। তাই না ?
না, তুই হচ্ছিস রবীন্দ্রনাথের বনের পাখী, আর আমি খাঁচার। তুই উড়তে ভালবাসিস, আমি বসে থাকতে চাই কারোর ছায়াই। মায়া মমতায় ভরা। তোর আনন্দের সাথে আমার আনন্দ মেলে না। তাই বলে আমি বলছি না তোর টা সত্যি নয়। তাড়া আছে তোর? না থাকলে চল ওই কফি শপে বসি। চল।তাগাদা দিল শুভেন্দু।
কফির পেয়ালায় শশাঙ্কই কথা শুরু করলো। সত্যি বলতে কি তোদের ডানা ভেঙ্গে গেছে। তোরা উড়তে চাইলেও উড়তে পারবি না। তোদের মন একজন কে ঘিরে, তার বাহিরে তোদের দরজা বন্ধ। তোরা একাকীত্ব কে ভালবাসিস। ভালবাসিস দুঃসহ পীড়াকে। নিংড়ে তার থেকে রস বেড় করতে। এর মধ্যে তোরা খুঁজে ফেরিস জীবনের আনন্দ। আমি বলবো দুঃসহ আনন্দ। এই দেখ আমাকে, কোন কমিটমেনট নিই কারো কাছে। তাই বলে যে আমার লাইফ এ discipline নেই তা নয় I have very disciplined life. উচ্ছিরিংখলতা আমি ভালোবাসি না। তোর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমার ভারজীনীটি নিয়ে। ওটা হারিয়েছে অনেকদিন হোল। কার সাথে মনে করতে পারিনা। আমি বর্তমানে বিশ্বাসী, অতীত কে আঁকড়িয়ে ধরে থাকতে চাইনা, ভবিষ্যতে বিশ্বাসী নই।
কি জানিস শশাঙ্ক, শুভেন্দু ওর কথায় যোগ দিল, লাইফ এর একটা সাইকেল আছে। জন্ম থেকে মিরতু। তোর সাইকেল টা মাঝ পথে ভেঙ্গে গেছে। ভেবে দেখ তোর জন্য কেউ দুফোঁটা জল ফেলবে না তোর অবর্তমানে। তুই বলে এ পৃথীবি তে কেউ ছিল তা কেউ জানবেনা। রাতের অন্ধকারে এক গেলাস জল ঢেলে কেউ তোকে এগিয়ে দেই নি। কেউ তোর পথপানে চেয়ে বসেছিল না, আজও নেই। বলবে না তোমাকে আজ বড় ক্লান্ত লাগছে।
ঝনঝন করে উঠল শশাঙ্ক । রাখ তোর বুজরুকী। এ শুধু সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার। এটা উই পোকার মত। কুড়ে কুড়ে খাবে। এই বন্দন থেকে তোকে বেড়িয়ে আসতে হবে। যদি বাঁচতে চাস।
তুই ভেবে দেখ শশাঙ্ক। ধীর গলায় বলে শুভেন্দু, একলা ঘরে তুইও থাকিস, আমিও। তুই কি শুনতে পাশ টুং টাং চুড়ির শব্দ। দেখতে কি পাশ আবছা আলো ছায়ার মাঝে কে জেনো হেঁটে গেলো।
শশাঙ্কের কণ্ঠে এবার একটু উত্তাপ। না আমি পাইনে, অনন্যরা ও পায়না। তাড়া বেচে থাকার জন্য অন্য পথ অবলম্বন করে। ডুবে যায় অন্য কিছুর মধ্যে। তোকেও তাই করতে হবে। সন্ন্যাসী হয়ে বনে বনে ঘুরে লাভ নেই। তোকে সমাজের মধ্যে বাঁচতে হবে।
পারছি না। জীবনের মানে হারিয়ে ফেলেছি শশাঙ্ক। স্বপ্ন আর দেখি না। তুই বলবি আমি নিজেকে নিয়ে যাচ্ছি আত্মঘাতের চরম সীমায়। হয়তো তাই। এর শেষ কোথায় আমি জানিনা।
দেখ শুভেন্দু, তুই আমার মতও হতে পারবি না এবার ফিরেও যেতে পারবি না তোর আগের জাগায়। তোকে এই দুয়ের মধ্যটা বেছে নিতে হবে।
চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি বান্ধবী দের সাথে কথা বলে মনটা হাল্কা করতে। সাময়িক ভাবে যে উপশম হয়না তা নয়। সেটা একেবারেই সাময়িক। জানিস শশাঙ্ক জীবনের কোন মানে আমি আর খুঁজে পাই না। এইতো কিছুদিন আগেও যা ছিল আমার ধরাছোঁয়ার মাঝে আজ তা নাগালের বাহিরে। ম্রীতু কে এক সময় ভয় পেতাম, আজ পাইনা। বুকে বাথা উঠলে সবাই কে জাগিয়ে তুলতাম। আজ ভাবি ব্যথা টা বাড়েনা কেন।
শুভেন্দু, থামবি তুই। শশাঙ্কও ক্ষুব্ধ হয়। নইরাসশো ভাললাগে না আমার। তুই অতীত কে আঁকড়িয়ে ধরে বাঁচতে চাইছিস। তা হবার নয়। বর্তমান হচ্ছে তোর সমাধান। আমাকে দেখ, অতীত কে পরোয়া করি না, ভবিষ্যৎ কি কেউ জানেনা,। তোকে তাই করতে হবে। অতীত তোকে বারবার পিছে টেনে নেবে। ঝেড়ে ফেল অতীত কে। সামনে এগিয়ে চল।
শিউরে উঠে শুভেন্দু। কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে, পারবো না। পারবো না শশাঙ্ক। অতীত আমার সব। বর্তমান আমার সাঁকো। আমি সাঁকো পাড় হচ্ছি। কোথায়, কতদূরে এর শেষ আমি জানিনা। তবে একটা সত্য জেনে রাখ শশাঙ্ক এই সাঁকো পেরিয়ে জীবনের শেষ অব্দি আমি নাও পোঁছাতে পারি। মাঝ পথেই এই জীবনের সাঁকো আমি ভেঙ্গে দিতে পারি। জানি এটাকে মাঝ পথে ভেঙে দেয়া যায়, ভেঙ্গে দেয়া যায়। চমকে উঠল শশাঙ্ক। কী বলতে চাইছে শুভেন্দু? এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল তার বুক।
ওই আমার বাস এলো PATTAY যাওয়ার। উঠে পড়ল শুভেন্দু
চলি শশাঙ্ক। হয়তো আবার দেখা হবে কোথাও, কোন খানে।
শুভেন্দু। এক অসহায় কণ্ঠে ডাকল শশাঙ্ক।
বল, বাস স্টপের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে জবাব দিল শুভেন্দু।
জীবনের সাঁকোটা মাঝ পথে ভেঙ্গে দিস নেরে শুভেন্দু। ভেঙ্গে দিসনে।
দুদিন হয়েছে মালতী এসেছে তার বান্ধবির কাছে । তার স্বামী চা বাগানের ম্যানেজার। ঘুম না আসায় উঠে এসে দাড়িয়ে ছিল নির্জন বারান্দাটা তে। এক ফালি চাঁদের আলো এসে পরেছে সেখানে। জোনাকি পোকার আলো নিভছে জ্বলছে । মায়া ময় পরিবেশ। আধো আলো, আধো অন্ধকার। গভীর রাতের নীস্তবতা ভেদ করে করুন বাঁশির সুর মালতীর কানে পৌছে। মালতী স্তম্ভিত। এ সুর তার চেনা । অনেক আগে এ সুর সে শুনেছিল। বাঁশির সুর আকাশে বাতাসে আনে অনির্বচনীয়ের আহবান। এ সুর মালতীর অন্তরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে। মালতী ভাবে, কে এই বংশীবাদক ? বাঁশিতে বাজছে তার হারিয়ে যাওয়া গান গুলি । এক সময় নিস্তব্ধ হয়ে এলো সব। চাঁদের আলো নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু জোনাকির আলো।
এলোচুলে মালতী এসে দাঁড়ালো তার খাটের পাশে। কি এক অজানা ভয় তাকে শিহরিত করে তুললো। ফিরে যেতে চাইলো অনেক পিছনে। না এ হতে পারে না । এ হবার নয় । ভাবলো, সকাল হলে জিজ্ঞাসা করবে কে এই বংশীবাদক।
পাখীর কিচির মিচিরে মালতীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোরের সূর্যের আভা এসে পরেছে তার জানালায়। আকাশ টা লাল রং এ আচ্ছাদিত। আড়া মোড়া করে উঠে আসতেই বান্ধবীর ডাক শুনল সে। “ কিরে ঘুম হোল?”
‘ না, হয়নি। জানিস কাল রাতে দাঁড়িয়েছিলাম বারান্দায়। দূরে করুন সুরে কে জেনো বাঁশি বাজাচ্ছিল। বলতে পারিস কে?”
“ ও, উনি তো প্রতি রাতেই বাজায়। পাশের চা বাগানের ম্যানেজার। থাকে একলা। নিজেকে নিয়েই বাস্ত।”
আজ রাতে বাজালে, পারবি আমাকে নিয়ে যেতে ওখানে। মালতী বলে।
সে তো অনেক রাতে বাজায়। উৎকণ্ঠার সাথে বলে সুমীতা।
তা হোক , আমি যেতে চাই। দেখতে চাই উনাকে । প্রশ্ন করিস না কেন? তোদের ড্রাইভার কে বলিস সে জেনো আজ রাতে নিয়ে যায় আমাকে।
সুমীতা রাজি হোল। দু বান্ধবী বাকি সময় টা কাটিয়ে দিলো গল্প গুজব করে।
রাত তখন দু প্রহর। আধো রাতে শুনতে পায় বাঁশির সুরের আর্তনাদ। সেই চেনা সুর ছড়িয়ে পড়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন চা বাগানে ।
মালতী ডাক দিলো শম্ভু কে।
শম্ভু?
জি মা
আমাকে নিয়ে যেতে পারবে ঐখানে, যেখান থেকে ঐ গান ভেসে আসছে । জানো কোথায়?
জানি মা জি, শম্ভু বলে।
দু জনে বেড়িয়ে পড়ল গাড়ী তে করে। বেশি দূর নয়।
এসে গেছি মা জি, ঐ যে দেখছেন বাসাটা ঐখানে উনি থাকেন। বললও শম্ভু।
মালতী পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। কে সে যে একাকীত্ব ভাবে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি । পাশে মদের বোতল। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলো একটা ছবি তার সামনে।
মালতী পেছনে এসে দাড়াতেই বাঁশি বাজানো বন্ধ করে সে তাকাল মালতীর দিকে।
চাঁদের আলো এসে পড়েছে বাদকের মুখে। পলক পড়েনা চোখে। পাশে রাখা মোমবাতি টা উঁচু করে ধরল মালতী।
অনুপম তুমি ?
আমারও তো সেই প্রশ্ন, তুমি এখানে মালতী?
এসেছি দুদিন হোল বান্ধবীর বাসাতে। রাতে গানের সুর আমাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছিল। আমার চেনা সুর কে বাজাচ্ছে তাই দেখতে ছুটে এলাম।
অনুপম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, এই সুর তোমাকে শুনিয়েছিলাম ১২ বছর আগে। মনে পড়ে? দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো। অনুপম বলে মালতীকে।
ঐ ঝাপসা করে তোলা ছবি টা তোমাকে দিয়েছিলাম । আজও রেখে দিয়েছ দেখছি?
হা, ওটার সামনে বসে বাজায়ই। ফিরে যাই আমার ফেলে আসা দিনগুলিতে।
মনে পড়ে, তোমার ভাই এর সাথে তোমাদের বাসাতে এসেছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তুমি এস,এস,সি পরীক্ষা দেবে।
মনে পড়বে না কেন? মালতী ফিরে যায় অতিতে। অপু ভাই তোমাকে বলেছিল, অনুপম তুই কি আমার এই মাথায় গোবর পোড়া বোনের মাস্টার হতে পারবি?
মনে পড়ে, আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। সেইতো শুরু। প্রতিদিন আসতাম, তোমার গোবর পোড়া মাথায় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অংক, ঢোকানোর চেষ্টা করতাম। তুমি বলতে, আমার দাড়া কিচ্ছু হবেনা অনুপম দা। কিন্তু হয়েছিল। তুমি ভালভাবে পাশ করেছিলে।
বলেছিলাম, এবার আমার পাঠ চুকল। এর আসতে হবেনা তোমাদের বাসাতে।
তুমি কি বলেছিলে মনে পড়ে?
পড়ে বৈকি? বলেছিলাম, বাসাতে না হয় নাই এলে, বাহিরে তোমার সাথে দেখা হবে। কখন যে আপনি থেকে তুমি তে চলে গেছি আমি নিজেও জানিনা। তুমিও আমাকে শুধরিয়ে না দিয়ে বলে ছিলে ,” দেখা হবে কাল ১২ টায় বলাকার সামনে”। দুটা বছর কোন দিক দিয়ে চলে গিয়েছিল আমরা নিজেরাও জানিনা।
মালতী, তুমি রবীন্দ্র সংগীত ভালবাসতে। আমার গলায় সুর নেই। তাই ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো। ভর্তি হয়ে ছিলাম গানের স্কুলে। বাঁশি শিখতে। তুমি জানতে না। হাতে খড়ী শেষ হবার পর তোমাকে নিয়ে বসেছিলাম এক নির্জন মাঠে । তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে , তোমার হাতে ওটা কি ? বলেছিলাম, এখানে বোসো। চোখ বন্ধ করো। আমি বাঁশিতে গান ধরে ছিলাম “ ঐ মালতী লতা দোলে,—“ গান শেষ হলে তুমি অনেকক্ষণ কেঁদে ছিলে ।
বাসাতে যেয়েও কেঁদেছিলাম। কেন জানিনা। তারপর, তারপরের ঘটনা মনে আনতে চাইনা। যুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠল। সব কিছু লনড ভনড হয়ে গেল। বাবা বাসাতে তালা লাগিয়ে দূরে গ্রামে মামার বাসায় আমাদের কে নিয়ে চলে এলো। তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না । তুমি কি ভাবে আছো তাও জানতে পারলাম না ।
জানো মালতী, সাত দিন পর আমি গিয়েছিলাম তোমাদের বাসাতে। দেখলাম তালা ঝুলছে। কাউ কিছু জানেনা। আমি অস্থির হয়ে অনেক্ষখন পায়চারি করেছিলাম। অনেক খুঁজেছি তোমাকে, পাইনি। প্রতি সপ্তাহে গেছি তোমাদের পাড়ায় । দেখেছি তালা বন্ধ। মাসের পর মাস পেড়িয়ে গেছে। আমার বন্ধু, মহসিন, তুমি তাকে চেনো, খবর দিয়েছিল তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এক ইনজিনিয়ারের সাথে। বিশ্বাস করিনি।
ঠিকই শুনেছিলে। আমার করনীয় কিছু ছিলনা । ভাইয়া চলে গিয়েছিল মুক্তি যোদ্ধা হয়ে। খবর এসে ছিল সে আর নেই। বাবা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় মামা এক প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, উনার বন্ধুর ছেলে, ইনজিনিইয়ার। বাবা রাজি। সেদিন স্বার্থপরের মত তোমার কথা আমি ভাবিনি। দেখেছিলাম বাবা মার চোখে জল। ভাইকে হারানোর ব্যেথা। তোমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম । আকাশ কে নিয়ে ঘর বেধে ছিলাম। চলে গিয়েছিলাম জার্মানিতে।
সে খবর আমি পেয়েছিলাম। আঘাত যে পায়নি সে কথা বললে ভুল হবে । তবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরীপেক্ষীতেই তোমাকে এ পথ বেছে নিতে হয়েছিল। চলে গিয়েছিলাম লন্ডনে পিএইচডি করার জন্য। ফিজিক্সে পিএইচডি করে ফিরে আসেছিলাম চার বছর পর।
ফিজিক্সে পিএইচড করে আজ তুমি চা বাগানের ম্যানেজার। কেন?
কোন কিছুতেই মন বসছিলো না, ভাবলাম দূরে কোথাও একাকীত্ব ভাবে জীবন কাটাবো। এক বন্ধুর সাহায্যে এই চাকরি টা পেয়েছিলাম। এবার তোমার কোথা বল।
এতো রাতে কর্তা আসতে দিলো।
সে নেই । চলে গেছে দুবছর হোল। তালা ঝোলা সেই বাসাতে থাকি। তুমি বোতল ধরলে কেন ? কেন নিজেকে শেষ করে দিলে এভাবে ।
সে কোথা থাক। অনেক রাত হোল। তোমার ফিরে যাওয়া উচেৎ।
আবার দেখা হবে কি? মালতীর জিজ্ঞাসা।
আজ থাক
মালতী চলে গেল। পেছন ফিরে চেয়ে ছিল বার বার। অনুপম দাঁড়িয়ে ছিল যতক্ষণ না গাড়ীটা মিলিয়ে যায়।
সকালে চা র পেয়ালায় চুমুক দেওয়ার আগেই মালী এসে বললও, “ মা জী আপনার চিঠি। “
আমার চিঠি? মালতী আশচার্জিন্নত হোল।
হা মা জী, ডেরাইভার দিয়ে গেল
চিঠি খুলল মালতী, “ তুমি জানতে চেয়ে ছিলে দেখা হবে কি না। না, মালতী, তোমার যে মূর্তি আমি গেঁথে রেখেছি আমার হ্রদয়ে সেটাকে ভাঙতে দিতে চাই না । যে দোলনায় আমরা দুলেছিলাম তাকে ছিঁড়তে চাইনা। আমার প্রেম থাকুক আমার মনের মাঝে নিষ্কলঙ্ক হয়ে। তুমি হারিয়ে যাওনি। রাতের অন্ধকারে তোমাকে ফিরে পাই আমার সুরে। তুমি আছো, তুমি থাকবে। বিদায়।”
দু ফোটা চোখের জল ঝরে পড়ল চা র পেয়ালার উপর। সে রাতে করুন সুরে বাঁশি আর বাজেনি.