দিন শেষে সন্ধ্যা নামে

  আব্বু, বলে দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমার ছেলে মেয়ে। সানী আর ছায়া। পাশে এসে দাঁড়াল বউমা আর রোকন।  আসতে দেরী হোল যে?” একসাথে কলকলিয়ে উঠল ওরা।

“ এখন Christmas dayর মেলা চারিদিকে, রাস্তায় ভিড়।  দেরীতো হবেই”। বলে ওদেরকে আশ্বস্ত করলাম।

সানীর জন্মদিন। চলে গেছে বেশ  কিছুদিন আগে। আমরা সেলিবারেট করছি আজ। সুন্দর Sea Food store, Astoria তে। পছন্দ করেছে বৌমা।

রেস্টুরেন্ট টার বৈশিষ্ট হচ্ছে  প্রথমে বিভিন্ন কাঁচা মাছ থেকে পছন্দ করে দিতে হবে কোন মাছ টা খেতে চাও তারপর সেই মাছ রান্না করে সামনে আসবে বিভিন্ন ভাবে ডেকোরেশন করে। সত্যিই এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।

ছবি উঠল। রেস্টুরেন্ট এর মালিক আধো অন্ধকারে Happy Birthday বলতে বলতে নিয়ে এলো কেক। ছায়া নিয়ে এসেছিল টা।  উপস্থিত সবাই একিই স্বরে গেয়ে উঠল “ Happy Birthday to you”. হৃদয় স্পর্শ করা মুহূর্ত।

 হৈ হৈ করে কাটিয়ে দিলাম সন্ধ্যা টা।

সব কিছুরই শেষ আছে। আনন্দ মুখর সন্ধ্যার পর আসে বিষণ্ণতা।  তারপর বাসায় ফেরার পালা।  গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। কয়েক ঘণ্টার আনন্দটা মুছে যেতে দিলাম না তাড়াতাড়ি। অবশেষে গাড়ীটা বের করলাম। পিছনের গাড়ীর হর্ন শুনে বুঝলাম একটু অন্য মসস্ক হয়ে পড়েছিলাম। গাড়ীটা ডানে চলে গেছে বেশ কিছু খানি। উচিৎ নয়।

আমি বুঝি। হয়ত একদিন দ্রুত ছুটে আসা কোন গাড়ী চুরমার করে দেবে আমার গাড়ীটা। রক্তাত দেহটা টেনে হেঁচড়ে বের করবে ঐ দুমড়ে যাওয়া গাড়ীটার থেকে। না ওসব চিন্তা থাক।

পরদিন।  বৃস্টি ভেঝা  সকাল। বাহিরে অঝরে ঝরছে। গতকালের হাসি, আজ কান্নায় রূপান্তরিত হয়ছে। সেই সাথে আমার

 মনটা। গত রাতে দুচোখের পাতা শুধু চেয়েই রইল। বন্ধ হলনা। এগার বারো,—– চার, পাঁচ ছয়। ভোর হোল। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। ঘরের চারিদিকে কোন কিছুর দিকে তাকালেই বিরক্ত লাগছে। ছোট বোনটা  ফোন করল। হ্যালো বলতে ইচ্ছে করলো না। বিক্ষিপ্ত মন। কেন?  জানিনা।

 পাউরুটি দুটো টোস্টার ওভেনে দিয়ে কফির পানি টা বসিয়ে দিলাম। ড্রয়াইং রুমটা আগছাল। সাধারণত এ রকম থাকেনা। আজ ঘুচাতে ইচ্ছে করলো না। টাকা পয়সা গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টেবিলের পরে। সেভ করতে যেয়ে কেটে গেলো গালের পাশটা। রক্তের ক্ষীণ রেখা গড়িয়ে আসছে চোয়ালের দিকে। হাতের কাছে কিছু নেই। চেপে ধরলাম টিসু পেপার টা দিয়ে। লাল হয়ে গেলো পেপার টা। বাণ্ডেড টা খুঁজতে যেয়ে পড়ে গেলো পুরো বাক্সটা। ছড়িয়ে পড়ল ঔষধের বোতল গুলো। খুলে গেলো কয়েকটার মুখ। কিছু ট্যাবলেট একশো মিটার দৌড়ের প্রতিযোগিতায় মেনে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল বিভিন্ন দিকে। আমি দাড়িয়ে রইলেম ওদের মাঝে। বাণ্ডেড টা নেই। মনটা আরও তিরিক্ষি হয়ে গেলো। পা দিয়ে সরিয়ে রেখে তাকালাম আয়নার দিকে। নিজের চেহারা আমি নিজেই চিনতে পারলাম না। এত মলিনতা এত বিষণ্ণতা কেন ?

গালের ধারের রক্তের রেখা তখনও থামেনি। তবে গতিবেগ কম। এমন এবড়ো থেবড়ো মুখে একটা চামড়ার অংশ হয়তো উঁচু হয়েছিল, বিক্ষিপ্ত মন সেটার সন্ধান পায়নি, রেজারের ব্লেড ওটাকে সমতল করে দিয়েছে। আর তাই এই ভুগান্তি।

পোড়া পোড়া গন্ধ এলো রান্নাঘর থেকে। মনে পড়ল পাউরুটি টা টোস্ট করতে দিয়ে ছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম সে কথা। মনের সাথে পেটের সম্পর্ক। এতো আজ নতুন নয়। অনন্তকাল ধরে চলে আসছে এই সম্পর্ক। আজ এই মনের বিষণ্ণতা ভুলিয়ে দিয়েছে আমি ক্ষুধার্ত।  ফিরে এলাম রান্না ঘরে। টোস্ট টা একটু বেশিই পুড়ে গেছে। মন চাইল না খেতে। শুধু কফির পেয়ালা টা নিয়ে এসে বসলাম সোফাতে।

কেন এই বিষণ্ণতা। আমি নিজেও জানিনা। আছে আমার সুন্দর দুটো ছেলে মেয়ে। আছে তাদের হৃদয় কারা বউ, স্বামী। তবে কেন? কেন আমি অতল তলে ডুবে যাচ্ছি। এর থেকে কি কোন পরিত্রাণ নেই। শুধু সেই দিনটাই কি দেবে পরিত্রাণ ?

এসে দাঁড়ালাম বাহিরের বেল্কনীতে। মাঝে মাঝে বৃস্টি ভেজা বাতাস ঝাপট দিয়ে যাচ্ছে চোখে মুখে । ঠাণ্ডার প্রখরতা ততটা নয়। মনে হোল হাত বাড়ালেই বন্ধু নেই, তবে পা বাড়ালেই তোঁ পথ। বেরিয়ে পড়ি।

অস্থিরতা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। হয়তো শান্তি আসবে পথ চলার পথে।

 কিছু কেনা কাঁটা আছে। দেশে যাবো কদিন পর। ক্রিসমাস শেষ। ভীড় ততটা নয়। কেন জানি এখন ভীড় সহ্য হয়না। গুমট ছোট্ট ঘরে বসে থাকতে মন চাইছে না। বেরিয়ে এলাম। রাস্তার ওপর প্রান্তে টার্গেট। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। কয়েকটা জিনিস মাত্র। শেষ মুহূর্তের অর্ডার। বেশিক্ষণ সময় ব্যয় করিনি। মাথার ভিতর অসংখ্য চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। সব গুলিই মূল্যহীন।

বিষণ্ণ মনের এটাই খোরাক। অনেক আগের ঘটনা যা আজকের দিনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই, ওটাকে সামনে এনে মনটাকে আরও ভরাক্রান্ত করা। অথবা কে যেন কি বলেছিল গত বছর  সেটাই আজ হয়ে উঠল মুখ্য।

ক্ষণিকের তরে এই সব ফেলে আসা ঘটনা আমাকে নিয়ে গেলো আরও অতলে।

আমি দেখতে পাচ্ছি আমার সামনে ভবিষ্যৎ নেই। আছে বর্তমান। নিষ্ঠুর বর্তমান। আর অতীত আমাকে টেনে হিঁচড়ে পেছনে নিচ্ছে।

উহ! করে উঠলাম। পিছনের মহিলা তার হাতের  ঠেলাগাড়ি টা দিয়ে আমার পায়ে জোরে আঘাত করেছে। অবশ্য ইচ্ছা ক্রীত নয়। সেল ফোনে কথা, সেই সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাটা, এই দুয়ের ফল স্বরূপ আমার পায়ে ধাক্কা।

সরি বলে অতি করুন দৃস্টি দিয়ে তাকাল আমার দিকে।

ঠিক আছে বলে আমি পা বাড়ালাম গাড়ীর দিকে।

বিকেল চারটা। টেলিভিশন টা চালিয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ ওটার দিকে। একটার পর একটা চ্যানেল পালটালাম। কিচ্ছু ভাল লাগছেনা। বন্ধ করে দিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম ছোট্ট লিভিং রুমে উদ্দেশহীন ভাবে। ভাবলাম কারো সাথে কথা বলতে হবে। মনটা হাল্কা করতে হবে। বিষণ্ণতা দূর করতে হবে।

দুজন বলল তাঁরা ব্যস্ত, অন্যজন ফোন ধরলনা।

এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। স্নিগ্ধা। বান্ধবী বলতে সেই। আর একজন আছে তবে সে থাকে একটু দূরে।

ওর সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। কথা হয় অনেকক্ষণ ধরে। সেইসব কথা যে সব কথার কোন গভীরতা নেই। অথচ তাল কাটেনা।  সময় কেটে যায়।

আজও মনে হোলও তাই হবে । কিন্তু হলনা। তাল কেটে গেলো। আমিই তাল কেটে দিলাম। আমিই কথা বলে হাল্কা হতে চেয়েছিলাম, যখন পেলাম তখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। শুধু  হূ, হা, এই বলেই গেলাম।

রাগ হতে থাকল এই ভেবে, ও কেন জিজ্ঞাসা করছেনা, আমি কেন শুধু হু, হাঁ করছি কোন কথা না বলে,কেন জিজ্ঞাসা করছেনা  আমার কি হয়েছে?

ও ওর কথাই বলে যাচ্ছে, একবারো তো আমার দিক থেকে সাড়াশব্দ নেই কেন সে কথা জানতে চাইছে না।

জানি অন্য অনেক দিন গেছে ও  কথা বলেছে আমি শুনে গেছি, অথবা তার বিপরীত। আজ এটা আমি সইতে পারলাম না।

মাঝ পথে বললাম,” আজ রাখি” বলে ফোন টা রেখে দিলাম। এটা অভদ্রতা। কিন্তু আজ আমার কাছে ভদ্রতা অভদ্রতার  কোন বালায় নেই। ভাবলাম ও আবার হয়ত কল করবে। বলবে,” কি হোল তোমার”?

না, সে আর কল করেনি। তিরিক্ষি হয়ে গেল মেজাজটা। আরও এক ডিগ্রী নেমে এলো মানসিক ভারসাম্য।

রান্না ঘরে যেয়ে ফ্রিজটা খুললাম। ভাতের হাড়ী খালি। ভাত বসাতে হবে।

না আজ নয়। ইচ্ছে করছে না। একদিন উপোষ করলে লোকে মরেনা।

এক গ্লাস পানি আর দুটা বিস্কিট খেয়ে শোবার ঘরে এলাম।

মনে হোল কে যেন আমাকে দেখছে। আমাকে ডাকছে। সামনে, পিছনে, সবদিক থেকে।

মাথা ঢেকে ফেললাম কম্বল টা দিয়ে।

ফোনটা বেজে উঠল। মেয়ে আমার কল করেছে।

বললাম,” আজ আর কথা বলব না মা মনি। ভালো লাগছে না।  চেস্টা করে দেখি ঘুম আসে কি না”।

বলল,” ঘুমাও আব্বু , কাল কথা হবে”।

Continue Reading