দূর দিগন্ত পাড়ে

                                                             ১

      ষোলই পৌষ, পয়লা জানুয়ারী। বাহিরে  শীতের প্রকোপ ততটা নয়। সকালে সতীর দেওয়া সাদা সাল টা গায়ে দিয়ে বেল্কনীতে এসে বসলাম।  হাতে কফির পেয়ালা। আকাশে পেজা পেজা নীল মেঘ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে । নরম সূর্যের আলো এসে পড়েছে আমার বেল্কনীতে। সামনের ছোট্ট বাগানে দুটো শালিক কোথা থেকে এলো জানিনা। দেখছিলাম শালিক দুটোকে। একে অপর কে মাঝে মাঝে ঠোকর দিচ্ছে আবার দূরে সড়ে যাচ্ছে। হয়তো এটাই ওদের ভালবাসা জানানোর প্রকাশ। আরও কিছুক্ষণ হয়তো ওদের নিয়ে ভাবতাম। কিন্তু হলনা।

  দরজায় দুমদাম শব্দ। একমাত্র শুভঙ্করই জানায় এইভাবে তার আগমন বার্তা। দরজা খুলতেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল। কোন কিছু না বলে সোজা চলে গেলো আমার রান্না ঘরে। আমি শুধু চেয়ে রইলাম ওর দিকে। কফি মেশিনে তার পছন্দ ফ্লেভারের K-cupটা বসিয়ে আমার দিকে তাকাল।

 “ কিরে? এত সকালে তুই কি কারনে? আর এত দুমদাম শব্দই বা করছিস কেন?” জানি একথা ওকে বলে কোন লাভ নেই।

ঠিক যা ভেবেছিলাম।  এইসব কথা ওর কান দিয়ে ঢুকালো না। ও ভাবে এটা ওর বাসা। ওর অধিকার আছে যখন তখন আসার। সত্যি বলতে কি আমার বাসার এক গোছা চাবি ওর কাছে থাকে। ছোট বেলা থেকে দুজন এক সাথে বড় হয়েছি। হাসি কান্না ভরা দিন গুলো পাড় করেছি। কাজেই আমার এই ছোট্ট এপার্টমেন্টের উপর ওর যে অধিকার তা আমি কেড়ে নেইনি। ওর উচ্ছ্বাস, ওর হাসি আমাকে আনন্দ দেয়।

“কি ভেবে এত সকালে?” আবারও আমার জিজ্ঞাসা।

“ খুব ভালো একটা ডিল দিয়েছে মালয়েশিয়া যাওয়ার। দশ দিনের মধ্যে রওয়ানা দেবো। তোর পাসপোর্ট টা দে টিকেট কাটতে হবে। আর সতী কে খবর দে। ওকেও যেতে হবে আমাদের সাথে। তোর কোন প্রশ্ন থাকলে আমাকে নয় তোর বৌদিকে কল কর”। এত গুলো কথা বলে সে আমার দিকে তাকাল।

“ ধীরে বন্ধু, ধীরে। আমার যে সময় আছে তোকে কে বললে। আর সতী ই যে যাবে তার গ্যারান্টি তোঁ আমি দিতে পারব না”। জানি একথা ধপে টিকবে না। আমি রিটায়ার্ড। অফুরন্ত সময় আমার হাতে। সে সেই কথা জানে। আমারও যে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তা নয়। অনেক দিন ধরে গুমট অন্ধকারে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটু আলো বাতাস দরকার। কবে যে শেষ বেড়াতে বেড়িয়েছিলাম আজ তা মনে পড়ে না।

  সতী আমার বান্ধবী। আমার সাথে সতীর সম্পর্ক  শুধু বন্ধুত্তের। একে অপরের সান্নিধ্য উপভোগ করি সেই সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলি। কথার ছলে ঠাট্টা, আবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সময় কেটে যায় আমাদের।

শুভঙ্কর বলে উঠলো,” কি ভাবছিস?”

“ না, কিছু না। তুই আমার পাসপোর্ট নিয়ে যা। আর আমি সতীর সাথে কথা বলে দেখি।“

“ গুড বয়,” এই কথা বলে সে কফির শেষ অংশ টা গলায় ঢেলে দিলো। পাসপোর্ট টা হাতে পেয়েই যে ভাবে ঝরের মতো এসে ছিল সেই ভাবেই বেড়িয়ে গেলো।

আমি দরজা টা বন্ধ করে দিলাম।

 পেছন ফিরতেই আবারও দরজায় দুমদাম  শব্দ। খুলতেই বলল,” বৌদি তোকে যেতে বলেছে আজ রাতে”। বলেই আবারও হাওয়া।

  সকাল দশটা। বন্ধের দিন। এত ভোরে সতী বিছানা ছেড়ে উঠেছে কিনা, ঊঠেলেও হয়তো নাশতা করছে। দোটানার মধ্যে থাকতে ঈচ্ছা করলো না। ফোন টা ঊঠালাম।

“ এতো ভোরে? কি ব্যাপার?”

ভূমিকা না করে বললাম,” মালয়েশিয়ায় যাবে?”

“ কোথায় যাবে?” একটু সময় নিলো বুঝে উঠতে।

 “মালয়েশিয়া, দশ দিনের মধ্যে যাবো। তুমি, আমি, শুভঙ্কর আর বৌদি। রাজি তো?”

 “রাজি?” কোন রকম চিন্তা না করেই সে বলল।

  “ তাহলে আজ বিকেলে শুভঙ্করের বাসায় যাবো। তুমি তৈরী হয়ে থেকো, ঠিক পাঁচটায়। পাসপোর্ট টা নিয়ে নিও”।

  শুভঙ্করের বাসায় আড্ডাটা ভালোই জমেছিল। বৌদির হাতের রান্নার কোন তুলনা নেই। মাঝে মাঝে তার ছিটে ফোঁটা আমার বাসাতেও আসে। সতীর মুখে চোখে আনন্দের ধারা বইছে। কলকল করে বলে উঠল,” জানো বৌদি  I am so excited. শোন  তুমি আর আমি  কিন্তু এক রুমে থাকব। ওরা দুজন অন্য ঘরে”।

শুভঙ্কর শুনে চিৎকার করে উঠল,” সে কি, আমি আমার বৌ কে নিয়ে থাকতে পারবো না বিদেশ বিভুয়ে। আমার যে অনেক দিনের সাধ বিদেশ বিভুয়ে এক সাথে এক রুমে থাকা ”।

“না,” হাসতে হাসতে সতী বলল। “ অনেক থেকেছ, ছয়টা দিন না থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হবেনা”। বলে বৌদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,” কি বলও,বৌদি”?

“ঠিক আছে”, বলে হাসতে হাসতে বৌদি মিষ্টির প্লেট টা এগিয়ে দিলো।

আড্ডা ভাঙল রাত বারটায়।

সতী কে নামিয়ে দিয়ে আমি এলাম আমার ঘরে।

 সাতদিন পরে আমরা রওয়ানা দেবো। প্রথমে Langkawi. সেখানে তিন রাত। তারপর কুয়ালা লাম্পুর। দিন গুনছি। অনেকদিন পর বাহিরে যাবো বলেই হয়তো এক অজানা শিহরন সাড়া মনে।

 দিন গুলো পেরিয়ে চার দিনে এসে দাড়িয়েছে। সকাল আটটা। ফোনটা বেজে উঠল। শুভঙ্করের। গলারা স্বরে আতংক।

“কি হয়েছে?”

“ এখুনি আসতে পারবি?”

  আসছি, বলেই বেড়িয়ে পড়লাম। পৌছে দেখি বৌদি খাটে শোয়া। কম্বল দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢাকা।

  শুভঙ্কর বলল, “ একশ চার জ্বর। সেই সাথে বমী।  রাত থেকে। এক বন্ধু ডাক্তার দেখে গেছে। ঔষধ পড়াতে এখন বমী বন্ধ  হয়েছে। তোর বৌদি তোকে আসতে বলেছে। কথা আছে।“

“কি কথা?”

 “সেই বলবে, তুই বোস।“ বলে শুভঙ্কর বেড়িয়ে গেলো।

 বৌদি ডাকল ওর পাশে বসার জন্য।

  আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল “ শমিত দা, আমার মালয়েশিয়ায় যাওয়া হবেনা। এই শরীর নিয়ে যেতে পারবো না। তুমি আর সতী ঘুরে এসো”।

এই কথা শোনার জন্য তৈরী ছিলাম না। বললাম “ না, বৌদি। তা হয়না। তুমি তো বোঝো কেন আমি না করছি। আর তাছাড়া সতীই বা রাজি হবে কেন?” বৌদি কে বোঝাবার চেষ্টা করলাম।

 সে বলল,” তুমি সতী কে আসতে বলও। আমি ওর সাথে কথা বলব। আর তোমরা একে অপর কে চেনও। জানো, বন্ধুত্ত দিয়ে গড়া তোমাদের সম্পর্ক। তোমাদের মধ্যে যে পবিত্রতা আমি দেখেছি তাতে কে কি বলল তা নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন”।

 আমি আর কথা বাড়াই নি। সতী কে আসতে বললাম।

 সতী এলো। আমি উঠে অন্য ঘরে চলে গেলাম।

  কিছুক্ষণ পড়ে আমার ডাক পড়ল। বৌদির মাথার কাছে সতী বসা। বৌদি বলল,”সতী রাজি আছে। তুমি বাবস্থা কর যাওয়ার”।

 আমি চাইলাম সতীর দিকে।

                                              ২

 রাত সাড়ে এগার টায় ফ্লাইট। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে।  আমরা দুজন। এই ভ্রমনের সবকিছু যারা ঠিক করেছিল আজ  তাঁরাই রয়ে গেলো পিছনে।  বিধাতার কি খেলা।  সতীর মুখ দেখে মনে হোল এই যাত্রা না হলেই বোধহয় ভালোছিল।

কথার মাঝে মাঝে অন্যমনস্কতা ।  বললাম,” যদি comfort ই feel না করো তবে রাজি হলে কেন”?

বলল,” বৌদি বলেছিল “আমি তোমার বড় বোন। আমি যদি মনে করতাম শমিতের সাথে তোমার একলা যাওয়া উচিত নয় তবে তোমাকে আমি যেতে বলতাম না। আমি চাই তোমরা ঘুরে আসো”।” এই বলে সতী তাকাল আমার দিকে।

 “ তাহলে তোঁ সব ল্যাটা চুকে গেছে। এবার ইনজয় করার চেষ্টা কর”। বলে আমি ঊঠে গেলাম ফ্লাইট বোর্ডে গেট নম্বার দিয়েছে কিনা দেখার জন্য।

  যথারীতি প্লেন আকাশে উড়ল। সতী তার আকাঙ্ক্ষিত জানালার পাশের সীটে বসে মাথাটা এলিয়ে দিলো।

বললাম,” আমার এই ছোট বালিশটাও নেও”।

“কেন, তোমার লাগবে না”? বলে সে সীট বেল্ট টা বেধে নিলো।

“না, যার নরম বিছানায় ঘুম আসেনা সে এই হেলান দেওয়া চেয়ারে ঘুমাবে কি ভাবে? তার চেয়ে একজনের ঘুমটা যেন সম্পূর্ণ হয় তাই কি ভালো না?” বলে বালিশ টা এগিয়ে দিলাম।

ও মাথাটা আবারও এলিয়ে দিলো। বলল,” ওরা খাবার দিলে আমাকে ডেকো না”।

 সামনে সীটের সাথে লাগান টেলিভিশনটা অন করে দেখতে চাইলাম কোন ভালো মুভি আছে কিনা। না, কিছু নেই।

  অগত্যা বিভিন্ন লেখকের লেখা সমকালীন প্রেমের গল্প বইটা খুলে বসলাম।

প্লেন তার নির্ধারিত altitude এসে পৌছেছে। সীট বেল্ট বাধার সঙ্কেত নীভে গেছে। লোকদের আনাগোনা টয়লেটের কাছে।

হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি। সাথে সাথে ক্যাপ্টেনের নির্দেশ,” আমরা প্রতিকুল আবহাওয়ার সম্মুখীন। আপনারা নিজ নিজ আসনে ফিরে বেল্ট বেধে বসুন”।

 ঝাঁকুনিতে সতীর ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। চোখ মেলে জিজ্ঞাসা করল,” কি হয়েছে”?

“কিছু না। তুমি ঘুমাও”। বলে আমি আবার বই এর পাতায় চোখ দুটো ফিরিয়ে নিলাম।

ক্রমশ

 

Continue Reading