রাত সাড়ে আটটা। চারিদিক অন্ধকার। দূরে নোঙর করা এক জাহাজের মিটিমিটি আলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। লোকেরা চলে গেছে যার যার ঘরে। শুধু আমরা দুজন বসে আছি।
“এবার উঠতে হবে সতী”।
“হাঁ, চলো”।
পাড় থেকে উঠে এলাম। বসলাম এসে সুইমিং পুলের পাশে বিছানো দুটা হেলান দেওয়া চেয়ারে। সন্ধায় পুলে নামা নিষেধ। কিছু দূরে আলোর নিচে এক মেয়ে স্বল্প কাপড় পড়ে শুয়ে আছে। আমাদের জায়গাটা আলো আধারে ভরা । পিছনে ছোট ছোট গাছের ভিতর থকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। ওরা চুপ করলে চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু আমাদের দুজনের কথা, সতী বলছে তার স্মৃতির ভাজে ভাজে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
ছোট বেলা, পায়ের নুপুরের টুংটাং শব্দ। আলতা পায়ে বাবা কে বলেছিল,”দেখত বাবা আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, তাই না”?
“হাঁ মা, রাজপুত্র আসবে রাজকন্যা কে নিতে”।
এসেছিল, আবার চলেও গেলো। সতীর কান্নায় বুজে আসা গলা। আমি তাকালাম ওর দিকে। পাশের ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলোর রশ্মি এসে পড়েছে ওর চোখের জলের উপর। চিকচিক করছে হীরের কনার মত। ও তাকাল আমার দিকে।
“চলো, রাত সাড়ে নটা হোল। ডিনারে বসে শুনবো অন্য কথা”।
থাই রেস্টুরেন্ট টা সতী পছন্দ করে রেখেছিল। আমরা যেয়ে বসলাম। সতী মেন্যু উল্টিয়ে দেখে দুটো আইটেম আনতে বলল। সাথে একটা এপিটাইযার। জিজ্ঞাসা করলো, আমি মেন্যু টা দেখব কি না?
বললাম,” দরকার আছে কি”?
বলল,” জানি তুমি কোনদিনই কোন কিছু চয়েস করনি। তোমার কথায়, তুমি বাচার জন্য খাও, খাওয়ার জন্য বাচো না।“
“তুমি মনে রেখেছ কথাটা, দেখছি”?
ও কোন উত্তর দিলো না।
খাবার এলো। সতী কে বললাম,” তোমার Item Selection এর তারিফ না করে পারছিনা”।
ও হাসল। “ কেমন হয়েছে খাবার গুলো?”
“খুউব ভালো। সেইজন্যই তো মেন্যু নিয়ে ঘাটাঘাটি আমি করিনি”।
খাওয়া শেষে বেড়িয়ে এলাম রাস্তায়। চারিদিক ঝলমল করছে চাঁদের আলোতে। শুধু আমরা দুজন রাস্তায়। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ী পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। পাশের পাহাড় বেয়ে আলোর ঝরনা ঝরে ঝরে পড়ছে। রাস্তার পাশে বেঞ্চে বসে একজন কাসার থালে টুংটুং করে বাজনা বাজাচ্ছে। চোখ বন্ধ। অন্ধ কি না জানিনা।
সতী গুনগুণ করে গেয়ে উঠলো,” ধন্য ধন্য ও বলি তারে—————– “ দু এক বার গেয়ে থেমে গেলো।
বললাম,” থামলে কেন”?
“ আর তো জানিনা”।
“ ঐ লাইন টাই বার বার গাও, শুনতে ভালো লাগছে এই পরিবেশে।“
সতী গুন গুনিয়ে উঠলো।
আমি ফিরে গেলাম দূরে,বহু দূরে টেমস নদীর পাড়ে। সেই রাতেও ছিল পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে। সে বলেছিল,” তোমার বেসুরো গলায় গাও তো সেই গানটি,” আমারও পরানো যাহা চায়, তুমি তাই, তাই গো—–“
আজ মনে হোল পরিবেশ এক, পটভূমি আলাদা, সম্পর্ক আলাদা।
হাত বাড়ালেই যাকে পাওয়া যেতো, না চাইতেই যে কাধে মাথা রাখতো সে আজ বহু দূরে। আজ যে কাছে সে কাছে থেকেও মনে হয় অনেক দূরে। তবুও সময় কাটে ওর সাথে। এটাও তো বড় পাওয়া। ভাবি, কোন দমকা হাওয়ায় এই সেঁকো যেন ছিড়ে না যায়।
কি ভাবছ?
ভাবছিলাম আমার অতীত। তুমি তো বলেছিলে, ভবিষ্যৎ ভেবোনা, তুমি ওটা জাননা, বর্তমান আমার পথের পাথেয়। তাই অতীত আর বর্তমানের মধ্যে যোগ সুত্র বাধতে চাইছিলাম।
“ মাঝে মাঝে তোমার কথার মাথা মুণ্ডু খুজে পাইনা। এইযে এসে গেছি আমাদের ভিলাতে। আচ্ছা সত্যি করে বলতো কি ভাবছিলে?”
“ বললাম তো, অতীত”।
“ অতীত কে টেনে এনো না, তাতে শুধু দুঃখই পাবে। বর্তমানকে আঁকড়িয়ে ধরো”।
“ আচ্ছা, জানো মাঝে মাঝে তুমি দার্শনিকদের মতো কথা বলও”।
“ ঠেকে শিখেছি। এখন বলও কাল গাড়ী আসবে কখন”?
“আটটায়। তবে সাতটায় আমরা নিচে নামব নাস্তা করতে। তোমাকে কি ঘুম থেকে উঠাতে হবে”?
“না, তুমি নামার আগে আমাকে কল করো”।
দুজনে এসে দাঁড়ালাম যার যার ঘরের সামনে।
শুভরাত্রি, বলে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
সকাল সাতটা। এসে বসলাম ব্রেকফাস্ট রুমে। সতীর পরনে নীল কামিজ, সাদা সালওয়ার, মাথার উপর আলতো করে টানা নীল ওড়না। মনে হোল সাজতে যেয়ে জানালা দিয়ে বাহিরের আকাশ টা দেখেছিল সে। আকাশে নীলের ছড়াছড়ি।
অপূর্ব লাগছিল দেখতে ওকে। বললাম,” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে”?
সলজ্জ নয়নে তাকাল সে আমার দিকে।
লোকজনের আনা গোনা ততটা নয়। বিভিন্ন জাগায় বিভিন্ন রকমের খাবার। এক জাগায় বাবুর্চি মাথায় কাগজের টুপি, গায়ে আপ্রন পড়ে ডিম ভাজছে। অন্য খানে একজন পরাটা আর ফ্রেঞ্চ টোস্ট করতে ব্যস্ত।
দুটা পরাটা সাথে দুটা ডিম পোঁচ আর একটা ডেনিস নিয়ে এলাম। কফি আমার চাই খাবারের সাথে। সতী ঘুরে ঘুরে দেখছিল কোথায় কি কি আছে। অবশেষে সে নিয়ে এলো দুটা পাউরুটি টোস্ট আর একটা অমলেট। এক প্লেট ভরা ফলমূল। আমাকে ফলের প্লেট টা এগিয়ে দিয়ে বলল,” এটা তোমার জন্য”।
বাহ! নিজেরটা কোথায়?
আনবো পড়ে । বলে বসলো।
“ তোমার জন্য চা বানিয়ে আনবো”?
“আনো। অরেঞ্জ জুস টা পারলে নিয়ে এসো”। বলে টোস্টাতে কামড় দিলো।
অনেকের প্লেটে ভাত, নুডুলশ, সাথে ডিম পরাটা। পিরামিড করে সাজান।
সতীকে দেখিয়ে বললাম, “ এত সকালে এত সব খাবে কি ভাবে”?
“ সবাই কি তোমার মতো? ওরা খাওয়ার জন্য বাচে”। বলে উঠে গেলো ফল আনতে।
বাহিরে এসে যখন দাঁড়ালাম তখন আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। সতীকে বললাম,” তুমি দাড়াও এই ফুল আর ফোয়ারার পাশে, হলিডে ভিলা লেখাটা নিয়ে ধরে রাখি তোমার স্মৃতি আমার এই ক্যামেরার মাঝে”।
ও বলল,” শুধু আমার কেন, আমাদের দুজনের স্মৃতি ধরা থাক এর ভিতর। ঐ লোক টাকে বলও ছবিটা উঠাতে”।
গাড়ী এলো ঠিক আটটায়। আজকের ড্রাইভার সেলিম। বাঙালী নয়। হয়তো মিক্স। জিজ্ঞাসা করিনি।
বলল ,”স্যার, আমরা প্রথমে যাবো স্ক্যাইক্যাব দেখতে, তারপর কালো বালির বীচে, ক্রকডাইল ফীডিং, শেষে বোট বিহারে”।
গাড়ী চলছে একেবেকে। কখনো পাহাড়ের পাশ দিয়ে, কখনো সমুদ্রের থেকে বেড়িয়ে আসা নদীর কিনারায় বাঁধা বোট গুলোকে বায়ে রেখে। সতী তাকিয়ে ছিল জানালা দিয়ে। সূর্যের আলো পরা ওড়না থেকে নীলাভ রঙ ছড়িয়ে দিলো ওর মুখমণ্ডলে। চিক চিক করছিল ওর পাথর কুচিতে গাঁথা কানফুল টা। মনে হচ্ছে আগুনের রশ্মি ছিটকে পড়ছে ওর কানফুল থেকে। আমি ক্যামেরা বের করলাম, সূর্যের তাপে ভেজা মুখটা ভেসে উঠল ক্যামেরার লেন্সএ। ক্লীক। গেঁথে গেলো অপূর্ব মুখমণ্ডলটা মেমোরি কার্ডের মাঝে।
গাড়ী এসে দাঁড়াল Machincang Mountain এর পাদদেশে। এখান থেকে আমরা যাবো ক্যাবেল কারে করে। Base Station থেকে Middle Station তারপর সেখান থেকে Top Stationএ। Langkawi Cable Car কে বলে SkyCab.
এটার অবস্থান Langkawi Island এর সাউথওয়েস্ট কোস্টে।
সেলিম বলল,” আপনাদের দের ঘণ্টা লাগবে দেখে ফিরে আসতে। আমি পিছনের পারকীং লটে থাকবো। নেমে এসে ফোন করেন”। আমাদের টিকিট কাঁটা ছিল। উঠে বসলাম। চার জনের বসার জায়গা। আমাদের সাথে একটা অল্প বয়স্ক যুগল। হতে পারে স্বামী স্ত্রী। হতে পারে প্রেমিক প্রেমিকা। ঢলে পড়ছে হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে। মনে করিয়ে দিলো পিছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। আমরা করেছি, এরা করছে, ওরাও করবে। এত চিরন্তন সত্য।
Base Station থেকে Middle Station এর দূরত্ব পাঁচ হাজার পাঁচশ ফিটের কিছু বেশি। আমরা যাচ্ছি ২০০০ ফুট উপর দিয়ে। নিচে বিভিন্ন রঙের বন্য ফুল। পাশে উঠে গেছে পাহাড়। এ শুধু দেখে উপলব্ধি করা যায়, বলে বোঝানো যায়না। সতী তাকিয়ে ছিল বাহিরের দিকে। অপর দিক থেকে ফিরে আসা একটা কেবেল কার থেকে একজন আমাদেরকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালো।
সতী হঠাৎ বলে উঠল,” দেখো, দেখো শমিত দা, পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনা পড়ছে। নিচে তাকাও তোমার মাথা ঘুরে যাবে”। ওর উচ্ছলতা আমার মনে এনে দিলো এক পরিতৃপ্তের ছোঁয়া।
আবারও আমি ফিরে গেলাম পিছনে। Alberta, Canada, ফিরছিলাম Glacier Mountain দেখে। সতীর মতো সে ও সেদিন বলে উঠেছিল,” দেখো, পাহাড় ভেঙ্গে ঝরনা বইছে। এই মন ভোলানো দৃশ্য কি আর আমি কোনদিন দেখতে পারবো তোমার সাথে”?
সে দেখাই ছিল শেষ দেখা।
“সতী, তাকাও আমার দিকে, পিছনের উচু পাহাড়টা নিয়ে তোমার ফটো উঠাবো”। ও তাকালও। ওর চোখে প্রাদা সানগ্লাসটা খুব সুন্দর মানিয়ে ছিল। বলল,” দেখি শমিত দা, কেমন উঠেছে”।
সামনের ছেলেটা বলল,” তোমার ক্যামেরাটা দাও, তোমাদের দুজনের ছবি উঠিয়ে দেই। আরও একটু closely বস, তা না হলে পিছনের রক পাহাড়টা আসছেনা”। আমি তাকালাম সতীর দিকে। সতী হেসে বলল,” সব জেন্ডার প্রবলেম”।
আমাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হোল Viewing Platformএ। সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছি Main island, আর সেই সাথে আসে পাশের Island গুলোর panoramic দৃশ্য। কাছের থেকে দেখা বন্য ফুল। মন কেড়ে নেয়।
এবার আমরা এলাম Top Stationএ। সেখান থেকে একটু হেটেই ২৩০০ ফিটের উপরে Machincang Mountainএর চুড়ায়,Sky bridgeএ। এটা হচ্ছে The Longest Free Span and Curved Bridge In The World। ৪১০ ফুট লম্বা এই ব্রিজ।
সোজা ব্রিজের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে এর অপর প্রান্ত দেখা যায় না। সোজা ব্রিজে দেখার মাঝে যেমন একটা এক ঘেয়েমী এটাতে তা নেই। শেষ প্রান্তের দৃশ্যটা জানা নেই কি দেখবো সেখানে যেয়ে।
আমি একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। পাশ ফিরে সতীকে না দেখে পিছনে তাকালাম। সতী আস্তে আস্তে হেটে আসছে একটা যুগলের সাথে। ওদের হাতে স্ট্রলার। একটা বাচ্চা বসা। কাছে আসতেই পরিচয় করিয়ে দিল, বিক্রম আর দ্রীবনী। দিল্লীতে থাকে। এসেছে তিনদিন হোল, এখান থেকে যাবে সিঙ্গাপুর। আমি আর বিক্রম কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম। বিক্রম ইঞ্জীনিয়ার। আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো কি ভাবে এই সাসপেন্ডেড ব্রিজ বানানো হয়েছে। আমার মাথায় কিছুই ঢুকলও না। ও কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল সামনে। যেখানে নীল আকাশ মিলেছে পাহাড়ের চুড়ায়। পিছনে ফিরে দেখি দ্রীবনী সতীকে কি যেন বলছে। সতীর চোখ ছলছল করছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
অবশেষে বিদায়ের পালা। বিক্রম বলল,” এই আমার ঠিকানা, কোন সময় দিল্লীতে এলে আমাকে কল করতে ভুলবেন না”।
অপুরুপ,মনোমুগ্ধকর, দৃশ্য দেখা শেষে নিচে নেমে এলাম। সতী বলল,” জানো দ্রীবনী কি বলছিল? ঐ ছোট্ট ছেলে টা—“
“ থাক সতী আমি শুনতে চাইনা। হৃদয় বিদারক ঘটনা আর নাই বা শুনলাম”।
“ তবে থাক, চলো ঐ ছায়ার নিচে বসি। তোমার ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করো। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে”।
বাহিরে তাপমাত্রা নব্বুই ডিগ্রী ফারেনহাইট। এখানে গ্রীষ্ম, শীত, বসন্ত বলে কোন ঋতু নেই। তাপমাত্রা সব সময় আশি, নব্বুই এর কোঠায়। সতী বলল,“ আমি একটু রেস্ট রুম থেকে হাতে, মুখে পানি দিয়ে আসি। তুমিও যাবে কি”?
বললাম,” না, তুমি যাও, আমি সেলিম কে কল করে গাড়ী আনতে বলি”।
সেলিম ফোন ধরল না। হয়তো ব্যস্ত কোন কারনে। অগত্যা আমাদেরকে যেতে হবে পারকীং লটে। সতী ফিরে এলো, হাতে দুটো ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে। বলল,” এই ঠাণ্ডা পানিটা খাও, তোমাকে আমি একেবারেই পানি খেতে দেখিনি”।
“ঠিক আছে। এখন চলো, সেলিম কে খুজতে হবে, ও ফোন ধরছে না”, বলে একটু এগোতেই দেখলাম সেলিম হেটে আসছে।
কাছে আসে বলল,” আমরা এখন যাবো কালো বালির বীচ দেখতে। আধা ঘণ্টার উপর লেগে যাবে। ওখানে যেয়ে লাঞ্চ করবো”।
বললাম,” কোন অসুবিধা নেই”।
সতী গাড়ীর সীটে মাথাটা এলিয়ে দিলো। জিজ্ঞাসা করলাম,” শরীর খারাপ লাগছে?”
বলল,” না, চিন্তা করোনা”, বলে হেসে চোখটা বন্ধ করলো।
আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম, সবুজ মাঠ, সারি সারি নারকেল গাছ, দুরের পাহাড়। গাড়ী বাক নিলো গ্রামের পথে, ছোট ছোট বাড়ী ঘরকে পাশে রেখে এগিয়ে চলল।
আমারও চোখ বুজে এলো ।
ক্রমশ