দূর দিগন্ত পাড়ে ৪

 “শমিত দা, শমিত দা, ওঠো—“ সতীর ধাক্কায় ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঘুমের ঘোর টা কেটে উঠার আগেই সে বলল, “ বিড়বিড় করে কি বলছিলে? আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুমি তো এভাবে অঘোরে ঘুমাও না জানি। আজ কি হয়ে ছিল”?

“ জানিনা, তবে ভালোই হোল, স্বপ্নে অনেকদিন যা দেখিনি, তা দেখলাম। আর আমার একটা প্রিয় কবিতা পড়ছিলাম স্বপ্নের মাঝে। শুনবে?

বলও।

,” আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরনীতে মুগ্ধ ললিত অশ্রুগলিত গীতে” বিড়বিড় করে হয়তো ঐটা ই পড়ছিলাম।

  “ তুমি তো স্বর্গ এখানেই গড়েছিলে শমিত দা”

“গড়েছিলাম আবার তা বানের জলে ভেসেও গেলো। যাক সে সব কথা। আসে গেছি, তাই না?”

“হাঁ,”

সতী আর আমি নামলাম গাড়ী থেকে। সেলিমের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম,” তুমি লাঞ্চ খেয়ে নিও”।

ও চলে গেলো।

 আমরা যেখানে এসে দাঁড়ালাম সেখান থেকে রাস্তা টা খাড়া হয়ে নেমে গেছে বীচে।

সতী কে আমার হাত ধরতে বললাম। ও ইতস্তত করছিল।

বললাম,” আমার হাত ধরলে তোমার মহাভারত অশুদ্ধ হবে না বরং পড়ে গেলে তোমাকে আমার কোলে করে নিতে হবে”।

মাঝে মাঝে ওর এই ধরনের শুচিবাই আমাকে বড় বিরক্ত করে।

অবশেষে সে আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে নেমে এলো।

কালো বালির বীচ। কালো কুচকুচে নয়। সাদা কালো মিশানো। বৈজ্ঞানিকদের  মতে কেমিক্যাল Reaction এর জন্য এই রঙ ধারন করেছে। আমার Black Sand Beach দেখা এই প্রথম নয়। দেখেছিলাম Santorini Perissa Beach। আমরা চারজন। সে অনেক বছর আগের কথা। মাঝে মাঝে স্মৃতি মন্থন করি। ফিরে যাই অনেক অনেক পিছনে। চোখে জল আসে।

থাক সে কথা। আজ বলব আজকের কথা।

Langkawi আর সতী। Langkawi থাকবে তার চিরন্তন সৌন্দর্য নিয়ে। লোকে আসবে, দেখবে, মুগ্ধ হবে।

 আর সতী, যে সতীকে আজ আমি দেখছি কালকের সতীর সাথে তার মিল নাও থাকতে পারে।

ভবিষ্যৎ তা বলবে । সতী বলেছিল, ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি ভেবোনা ।

 না, ভাবো না  নগত যা পাচ্ছি তাই হাত পেতে নেই।

সমুদ্রের জল নীল। নীল মেঘের ছায়া পড়েছে জলে। হয়ত তারি প্রতিচ্ছায়া। সতীর নীল রঙ এর ওড়নার সাথে সমুদ্রের জল  মিশে গেছে।  ওর পায়ের পাতায় জল।

দুষ্টুমি করে বল্লাম,”জলের কাছে যেওনা, মিশে যাবে ওর সাথে, আমি তাহলে আর তোমাকে খুজে পাবো না”।

তাকাল সে, কি যেন বলতে গেলো, স্পীড বোটের কর্কশ আওয়াজে আমি তা শুনতে পেলাম না, শুধু দেখলাম সূর্যের তাপে ঘামে ভেজা ওর লালচে মুখ টা।

ছোট্ট একটা পাথরের নুড়ি ছুড়ে দিলো জলে, হয়তো দেখতে চেয়েছিল সমুদ্রের গভীরতা।

ডাক দিলো আমাকে। এসো, আমরা ঝিনুক কুড়াবো।

“ না, এই রৌদ্রে নয়। তুমি চলে এসো”।

ও ফিরে এলো। পকেট থেকে কয়েকটা কাগজের ন্যাপকিন এগিয়ে দিলাম ওর হাতে।

 কি করে বুঝলে? বলল সে।

অনেকদিন ধরে তোমার সাথে চলছি। আর এটা বুঝতে পারবনা?

ও চোখে হাসির ঝলক দিয়ে আমার হাত থেকে ন্যাপকিন গুলো নিয়ে মুখে চেপে ধরলও।

“কখন থেকে বলছি উঠে আসতে। চলো, তোমার জন্য হ্যাট কিনতে হবে। এই রৌদ্রের তাপ তোমার সইবে না”।

  উঠে এলাম উপরে।

বীচ কে ঘিরে দুটো দোকান। বিভিন্ন ধরনের পোশাকে ভরা। একটু দূরে রেস্টুরেন্ট যার চারিদিক খোলা।

ঠিক রেস্টুরেন্ট আর দোকানের মাঝ খানে উপরে কাঠের ছাউনী দেওয়া একটা খোলা জায়গা। দুটো টেবিল পাতা। সেখানে একজন ডাব বিক্রি করছে।

সতী পোশাকে ভরা দোকান থেকে অনেক খুজে একটা হ্যাট নিয়ে এলো।

বলল,” এটা নেবো? পছন্দ হয়?”

বললাম,”না, মানাবে না”

“ আমার যে এটাই পছন্দ”?

বললাম ওকে “খেতে হয় নিজের পছন্দে, পড়তে হয় অন্যের পছন্দে। জানো কি”?

“ তাহলে তুমি পছন্দ করো”।

সাদাটে একটা হ্যাট  নিয়ে আসে বললাম, এটা নাও, মানাবে তোমাকে।

এবার চলো ডাবের পানি খাবে। দুজনে এসে বসলাম চেয়ারে। লোকটা একটা ডাব কেটে দুটো স্ট্র ভিতরে দিয়ে নিয়ে এলো।

সতীকে বললাম,” দেখেছ, দুটো স্ট্র সে আমাদের হাতে না দিয়ে ভিতরে দিয়ে নিয়ে এলো, তারমানে আমাদের দুজনকে একসাথে খেতে হবে। পারবে?”

“আমার আপত্তি নেই। তোমার”?

দাড়াও ওকে বলি একটা ছবি উঠাতে, দুজনে একসাথে মাথা ঠোকাঠুকি করে ডাবের পানি খাচ্ছি। জমবে ভালো। যারা দেখবে তার কি বলবে বলতো?

“ আমি কেয়ার করিনা”। বলে সে চুমুক দিলো, আমিও মাথাটা নামালাম।

 চারিদিকে খোলা, শুধু মাথার উপরে ছাদ। তারি নিচে এসে বসলাম লাঞ্চ করবো বলে। হাওয়া বইছে। সমুদ্রের নীল পানি, উড়ছে গাংচিল, হাঁটছে Seagulls পানির পাশে, আমরা প্রায় ৩০০ ফুট দূরে রেস্তোরায় বসে অর্ডার দিলাম  Pad Thai আর Green papaya salad। সতীর মুখের লাল আভা মিলিয়ে এসেছে।

 বলল,” সমুদ্রের এত কাছে বসে কোনদিন লাঞ্চ করেছ কি”?

“না করিনি, তুমি”?

“ আমি তো এই প্রথম ঘর ছেড়ে এতদূর এলাম। যখন সময় এসেছিল তখন তাকিয়ে দেখি শুধু আমিই আছি সে নেই। তাই বৌদির প্রস্তাবে প্রথমে দ্বিধা থাকলেও পরে আর তা ছিলনা। তোমার মতো বন্ধু কোথায় পাবো, বলও”? বলে ওড়না দিয়ে চোখের কোণা টা মুছে নিলো।

“চলো এবার উঠি। সেলিম বলেছিল দেড় ঘণ্টা লাগবে Mangrove Forest & Kilim River Cruise র ওখানে যেতে”।

সেলিম দাড়িয়ে ছিল গাড়ীর কাছে। আমরা আসতেই বলল,” লাঞ্চ কেমন খেলেন স্যার”?

সতী বলল,” খুবই ভালো ছিল। তুমি কোথায় খেলে”?

খাওয়া হয়নি ।

কেন? প্রশ্ন করলো সতী।

এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল অনেকদিন পরে। না দেখা হলেই বোধ হয় ভালো ছিল।

কেন?

“ওর পাঁচ বছরের  মেয়ে টা গত মাসে একদিনের  জ্বরে মারা গেছে। হাসপাতালে নেওয়ার ঘণ্টা দুএকের মধ্যে সব শেষ। কেন হোল,কি ভাবে হোল, কি রোগ তার কোন সঠিক ব্যাখা তারা দিতে পারেনি। ওর বৌ পাগলের মতো হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টার পর এই মেয়েটা এসেছিল  ওদের কোলজুড়ে। ওর বৌ এখন বাপের বাড়ী। কান্না এখনও থামে না। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যায়। এই খবর শুনে আর খাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা। আমারও একটা ছেলে আছে চার বছরের”। কথা শেষে সে সতীর দিকে তাকাল।

সতী বলল,” সব উপরওয়ালার ইচ্ছা। তোমার আমার করার কোন ক্ষমতা নাই”। কথা হচ্ছিল গাড়ী চলতে চলতে। আমি তাকালাম সতীর দিকে, সেও তাকালও আমার দিকে।

বললাম,” তুমি ফিরে যাবে নাতো অতীতে”?

ওর পূর্ব ইতিহাস আমি জানি।

বলল, “না, আজ যা দেখতে এসেছি তাই দেখব। পিছনে ফেলে আসা ঘটনা কে টেনে আনবো না”।

এসে পৌছালাম KILIM নদীর পাশে। ঘাটে অনেক স্পীড বোট বাঁধা।

Langkawi Mangrove Tour হচ্ছে মাঝারি সাইজের স্পীড বোটে করে kilim নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে দেখা  Mangrove Swamp।  ভিতরে বিভিন্ন ধরনের সবুজ গাছ, শ্যাওলা পড়া পাঁথরের পড়ে শুয়ে থাকা বড় বড় Lizards.

আমাদের বোটে আমরা ছয় জন।

বোটের রঙ সতীর ওড়নার রঙের সাথে একাকার হয়ে গেছে।

বললাম,” দেখেছ কি?  তোমার গায়ে পেঁচানো কাপড়ের রঙ মিশে গেছে বোটের রঙ এর সাথে। ওরা কি জানতো তুমি আসবে আজ”? ও কিছু না বলে শুধু হেসে সলজ নেত্রে তাকাল আমার দিকে।

Kilim নদীর এক পাশে গভীর সবুজ Mangrove অন্য পাশে বিশাল Limestone rocks। কিছু কিছু Limestone rocks দেখতে পাহাড়ের মতো। বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন রঙের পাখি উড়ছে। সাদাটে বানর হেটে বেড়াচ্ছে নদীর পাশে পাথরের উপর। অনেক লালচে রঙ এর ঈগল ঘুরছে মাথার পড়ে।

Eagle Feeding দেখার মতো। শান্ত পানিতে এসে বোট টা থামে, স্টার্ট বন্ধ করলেই ওরা বুঝতে পারে ওদের খাবার আসছে। ঝাক ঝাক ঈগল ঘুরতে থাকে মাথার উপর। বোটের চালক ছুড়ে দেয় মুরগীর ছোট টুকরা। ছোঁ মেরে ঈগল উঠিয়ে নেয় মাংস টা ।

ঈগল খাওয়ানো শেষে এবার বোট এলো Bat Cave এ। অন্ধকার, গাইডের টর্চের আলোয় দেখা যায় ছোট ছোট অনেক বাদুড় ঝুলে আছে দেয়ালের গায়ে। শব্দ করতে নেই। আস্তে আস্তে হেটে যাও।

এখানেই শেষ নয়। বোটের চালক নিয়ে এলো উন্মুক্ত সমুদ্রে। ওখান থেকে দেখা যাচ্ছে Street of Malacca. পাহাড়ের গায়ে লেখা  KILIM GEOFOREST PARK. বোট এসে দাঁড়াল পাহাড়ের কাছে। ফটো সেশন।

সতীকে বললাম,” তুমি এসে বসো বোটের মাথায়  ঐ লেখাটা নিয়ে ফটো উঠাবো”।

ও এলো। চশমা পড়া ছেলেটা বলল,” তুমিও পাশে যেয়ে বসো”। অগত্যা আমিও উঠে এলাম।

দুঘণ্টা বাদে বোট এসে যখন পাড়ে ভিড়ল তখন বিকেল পাঁচটা। সতী ক্লান্ত, আমিও। আজকের মতো দেখা শেষ। ফিরে যাবো আমাদের ভিলাতে। সতী বলল,” ফিরে যেয়ে বীচের পাড়ে একটু বসব, কি বলও?”

“কোন আপত্তি নেই, তবে তার আগে বীচের পাশে কফি হাউজে বসে গলাটা ভিজিয়ে নিলে হয়না”?

“মন্দ কি”?

গাড়ীতে এসে বসতেই সেলিম বলল,” কাল তোমাদের রীলাক্সের দিন, তোমরা তোমাদের মতো ঘুরবে, কোন প্লান আছে কি”?

বললাম,”না, নেই”।

“ তাহলে কাল আমি আমার এক বন্ধুকে পাঠিয়ে দেবো, সে তোমাদেরকে  Langkawi শহর টা ঘুরিয়ে দেখাবে”।

আমরা দুজনেই রাজি। সকাল দশ টায় আসবে সে।

সেলিম যখন আমাদেরকে নামিয়ে দিলো তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আমরা এসে বসলাম কফি হাউজে। প্রথম দিনের সেই মেয়ে টি। এসে বলল,” কফি, চা, আর সেই বিস্কিট, না অন্য কিছু”।

বললাম,” মনে রেখেছ দেখছি”?

সে হেসে চলে গেলো।

আমরা এসে বসলাম সেই চেয়ার দুটো তে যেখান থেকে দেখা যায় সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ।

 বিস্কিটে কামড় দিয়ে সতী জিজ্ঞাসা করল,” আচ্ছা শমিত দা এই ভাবেই কি কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন টা”?

“ মন্দ কি? কথা বলার সাথি, তুমি তো আছো”।

“দোয়া করো শমিতদা আমি যেন তোমার কথা বলার সাথি হয়েই থাকে পারি”।

“ চলো, সমুদ্রের পাড়ে বসবে বলেছিলে”?

“ না আজ থাক, আজ হাটতে ইচ্ছা করছে তোমার সাথে। এই পটভূমিকা আমার জীবনে আবার নাও আসতে পারে।

মনে পরে কি শমিত দা, তোমার বেল্কনীতে বসে এক চাঁদিনী রাতে তুমি আমাকে শুনিয়ে ছিলে সেই গান, কবিতা আকারে। বলবে কি? আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে”।

শোন,

তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম, নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম ॥মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন

তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম ॥জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি, তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি ।

 মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন,তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম ॥

“তোমার চোখে জল”?

“ তোমার চোখেও তো কি যেন চিকচিক করছে, শমিত দা। আসলে আমরা দুজিনেই  তো একি পথের পথিক। শমিত দা তুমি আমাকে শুধু এই আশীর্বাদ করো আমি যেন তোমার বন্ধুত্বের ছায়ায় আমার শেষ জীবন টা কাটিয়ে দিতে পারি”।

“পারবে, দেখো, হাটতে হাটতে অনেকদুর এসে গেছি। চলো ওই টার্কিশ রেস্টুরেন্টে বসি”।

চলো।

ক্রমশ

 

Continue Reading