হঠাৎ সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। মনে হোল গায়ে জ্বর এসেছে। থারমমিটার টা খুজলাম। পেলাম না। রাত তখন তিনটা। মুখে তেঁতো তেঁতো পানি উঠছে। ড্রয়ার টা খুলে দুটো টাইলিনল বের করলাম। বুকের ব্যথাটা আসছে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে কার্ডিওলজীস্টের কাছে গিয়ে ছিলাম। বলে ছিল সব ঠিক আছে। তবে আমি হাই রীস্ক পেসেন্ট। কলেস্টেরলের ঔষধ টা দুই গুন বাড়ীয়ে দিলো, সেই সাথে প্রেসারের ঔষধ টাও। বলে ছিল ব্যথা বেশি বাড়লে তবে এসো নচেৎ ছয় মাস পরে অ্যাপএনমেন্ট করো।
এ ব্যথা কিসের ব্যথা বলা মুশকিল। তাই যখন তখন কাউকে ব্যতিব্যস্ত করা আমার কুস্টীতে নাই। তাছাড়া লেখা পড়া করে যতটুকু জেনেছি তাতে আসল ব্যথা আরম্ভ হলে খুব একটা হাতে সময় থাকবে না। তাঁই দরজার উপরের তালাটা আর লাগাই না। ওটার কোন চাবি নেই। শুধু ভিতর থেকেই বন্ধ হয়।
অসুস্থ হলে মানুষ মনের দিক থেকেও দুর্বল হয়ে পরে। আমিও যে হয়নি তা নয়। সেটাকে ঝেড়ে ফেলার জন্য ল্যাপটপ টা নিয়ে বসলাম। বিভিন্ন ইনিস্টিটিউশণের একাউন্ট গুলো আর একবার খতিয়ে দেখবার জন্য। যাতে ছেলে মেয়েদের কোন কিছু খুজে পেতে অসুবিধা না হয়।
মাথা টা ভীষণ ধরেছে। রান্না ঘরের আলোটা জ্বালাতেই চোখটা ধাধীয়ে উঠলো। মনে হোল কে যেন জোরে আঘাত করলো চোখে। বন্ধ করে দিলাম আলোটা। চোখের কণ বেয়ে পানির ধারা নেমে এলো। মুছতে যেয়ে হাতের নাপকীন টা পড়ে গেলো মেঝেতে। উঠাতে যেয়ে বাড়ি লাগলো টেবিলের কোনায়। টলে পড়ে গেলাম। হাত দিয়ে ঠেকাতে যেয়ে কব্জীতে ব্যাথা লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে জানালায় এসে আঘাত করলো দমকা হাওয়া। খুলে গেলো কপাট। টেবিলের কাগজ গুলো ছড়িয়ে পড়লো মেঝে তে।
উঠতে চাইলাম। পারলাম না। হাতটা ব্যাথায় টনটন করছে। গড়িয়ে এসে সোফাটাকে আঁকড়িয়ে ধরলাম। হাটু গেরে বসে দুই কনুই দিয়ে সোফার উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আস্তে আস্তে জানালার কাছে যেয়ে জানালাটা বন্ধ করতে যেয়ে মনে হোল কে যেন জানালাটা কে টেনে ধরে রেখেছে। যত জোরে আমি টানছি ঠিক তত জোরে কে যেন টানছে আমার বিপরীত দিকে।
ঠিক সেই সময় এক ঝরো হাওয়া আঘাত করল মুখে, শরীরে। জানালার থাকে হাত সড়ে গেলো আমার। চর্কির মত ঘুরে আমি এসে পড়লাম সোফাতে। কে যেন আমাকে টেনে এনে বসিয়ে দিলো।
বাতাস থেমে গেলো। জানালার কপাট টা আস্তে আস্তে ফিরে এলো তার জায়গায়।
হাতের ব্যাথা টা ক্রমশ বাড়ছে। একটা Motrin খাবো বলে কেবিনেট টা খুললাম। কিন্তু Child proof বোতলের ক্যাপটা খুলতে পারলাম না। ওটা বেসিনের পাশে রেখে আবারও থারমমিটার টা খুজতে এলাম বেডরুমে। শরীরের তাপের মাত্রাটা বেড়েছে মনে হচ্ছে। ড্রয়ার টা খুলতেই দেখলাম সামনেই পড়ে আছে ওটা। অথচ প্রথম বার আমি দেখিনি ওটাকে। হয়ত চোখের ভূল।
তাপমাত্রা ১০২ । টাইলিনল টা খেয়েছি প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেলো। এখনও জ্বর টা নামেনি। হাতের ব্যথা টা মনে করিয়ে দিলো কিছু একটা করা দরকার। শোয়া হলনা। কোল্ড কমপ্রেস দিতে হবে। Motrin টা খাওয়ার দরকার ছিল। ওটা ব্যথা আর ইনফ্লেমেসন দুটোরই কাজ দিতো। কিন্তু খুলতে পারলাম না বলে খাওয়া হলনা।
ফিরে এলাম রান্না ঘরে। ফ্রিজ টা খুলে কতগুলো বরফের টুকরা একটা কাপড়ে জড়িয়ে নিলাম। বেসিনের কাছে রাখা Motrin এর বোতল উঠিয়ে রাখবো বলে হাত দিতেই ক্যাপটা খুলে পড়ে গেলো। অথচ ওটাকে অনেক চেস্টা করেছি খুলতে, পারিনি।
ওর কাছে আমার ঘরের এক গোছা চাবি দেওয়া আছে। আপদে বিপদে কাজে লাগতে পারে তাঁই।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কি হয়েছে? সারা রাত সোফার উপর ঘুমিয়ে ছিলে?
-তাই তো মনে হচ্ছে। রাতে অনেক জ্বর এসে ছিল। পড়ে যেয়ে হাতে ভীষণ চোট পেয়েছিলাম। ঠাণ্ডা সেক দিয়েছি অনেকক্ষণ ধরে। জানালা টা বন্ধ করে দাওতো। কাল সারা রাত খোলা ছিল। এই বলে সতীর দিকে তাকালাম।
সে আমার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকলো। কাছে এসে হাত টা কপালে রাখল।
-এখন জ্বর নেই। এই বলে জানালা টা বন্ধ করে দিল।
হাতটা দেখে বলল, একটু ফুলেছে।
এবার ওঠো। গোসল করে নাও। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি, Motrin খেতে হবে। শান্তর বাসায় আজ সবাই কে ডেকেছে। মনে নেই?
মনে পড়ল। শুধু তাঁই নয়, খাবার তো আমাকেই নিয়ে যেতে হবে। বলেছে ১২ টার মধ্যে আসতে।
দুদিন আগে কল করে বলে ছিল,” আব্বু, তুমি কি খাবার অর্ডার দিতে পারবে”?
জানে, না আমি করবো না। এ যে কত বড় অধিকার বাবা মা র উপর তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।
লোক জন এসে পৌছায় নি। বারটায় বললে এরা আসবে একটায়। এটাই রীতিতে দাঁড়িয়েছে। সময় জ্ঞান কয়জনের আছে বলা মুশকিল। সতী যথারীতি লেগে গেলো কাজে। আমি সোফায় বসে বাস্কেট বল খেলা দেখতে থাকলাম। এর মাঝে বৌমা এসে জিজ্ঞাসা করে গেছে কফি খাবো কিনা।
বললাম, মন্দ হয় না। আমি বানিয়ে নেবো।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে অনেকে এসে গেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো সবাই। শান্তর ঘর টা বড়। ভেঙ্গে নতুন করে গড়া।
আমি দেখলাম এখানে তিন জেনারেসনের সবাই হেটে খেলে বেড়াচ্ছে।
আমাদের বয়সি, যাদের পা আর মাজায় ব্যথা অথবা চোখে ছানি পড়েছে তারা সোফায় অথবা চেয়ারে বসে গল্প করছে ওপাড়ের জগত নিয়ে। শান্তর বন্ধুরা তর্ক করছে ফুটবল, বেজবল নিয়ে। ছোটরা ছুটাছুটি করছে।
অরুন কেবল এসেছে দেশ থেকে। অনেকে ওকে ঘিরে। শুনতে চাচ্ছে দেশের কথা, কত শাড়ী এনেছে, কোথায় কোথায় বেড়িয়ে এলো, শরীর খারাপ হয়েছিল কি না সে সবের কথা। দূরে দাড়িয়ে জীনাত ভাবি। শান্তর শাশুড়ির সাথে গল্পে মশগুল, মনে হোল চেহারায় একটু মলিনতা।
তিথী, বৌমার কাজিন, হেলে দুলে হাঁটছে। ওর শরীরে ভেতরে একটা দুস্টু ছেলে মাঝে মাঝে ওকে কিক করছে। বলছে, “ অনেক দিন হয়েছে, এবার আমি পৃথিবীর আলো দেখতে চাই”।
আর এক কাজিনের একমাসের ছেলেটা বুকের মাঝে লেপ্টীয়ে শুয়ে।
মনে পড়লো সেই কথাগুলো “ এসেছে নুতন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান” । ওদের জন্য আমাদের বিদায় নেবার সময় এসেছে। কিন্তু কেউ কি যেতে চায়। থাক মরনের কথা।
বললাম, দেবে আমার কোলে।
কোলে এসে ছোট্ট করে হাই তুলল। বুকের উষ্ণতা ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। আমি ওর টুসটুসে আঙুল নিয়ে খেলা করছিলাম । ওর ছোট্ট জীবন টা টুনটুনি পাখির মত নিষ্কলঙ্ক । আমি ওর লালচে মাখনের মত গাল টা টিপে দিলাম। ওর ঠোট টা হেসে উঠল। মনে হোল ও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। আমার আঙুলটা চেপে ধরল। ঠোটের কণে সেই হাসি টা লেগে আছে।
অনেক অনেক বছর আগে সেই ছোট্ট হাতটা নিয়ে খেলা করতাম, কান পেতে শুনতাম আমি ওর নিশ্বাসের শব্দ। দুধের বোতল মুখে দিলে সে ধরত আমার আঙ্গুলটা, পিট পিট করে তাকাত আমার দিকে, ফীক করে হেসে দিতো, দুধ গড়িয়ে পড়তো গালের চার পাশে। আমার দিকে হেসে তাকিয়ে থাকতো। মনে হতো স্বর্গের থেকে এক ঝলক আলো ঝরে পড়লো আমার ঘরে। কপালে চুমু দিয়ে উঠিয়ে নিতাম আমার বুকে। পাশ থেকে সে বলতো,” ওকি দুধ টা শেষ করেছে”।
বলতাম, হাঁ করেছে।
তাহলে শুইয়ে দাও।
না ও শোবে না, ও বাদুরের মত আটকিয়ে আছে আমার বুকে। ওকে কি নামাতে পারি?
ওকে তুমি স্পয়েল করবে, বলে পাশ ফিরে শুতো।
তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। সেই ছোট ছোট হাত গুলো আজ কত বড়। কত বড় দায়িত্বশিল ছেলে সে আজ। বাড়ীর মালিক।
তদারকি করছে। দেখছে, তার করণীয় সব কিছুই করছে, যাতে সবাই আনন্দ পেতে পারে এই সীমিত সময়ের মধ্যে।
স্পয়েল হয়নি, বরং ভালোবেসে সবাই কে আকড়ে ধরেছে। কাছে টেনে নিয়েছে।
তুমি ওকে মানুষ করে দিয়ে গিয়েছিলে। তাতো সে ভোলেনি।
শুধু তুমিই দেখলে না ওর সম্পূর্ণ গড়ে উঠা নতুন ওর বাড়ীটা।