১০ই এপ্রিল
ভোর ছটা। ফোন টা বেজে উঠলো। ওটা পড়ে থাকে আমার পাশের বালিশের উপর। সত্যি বলতে কি সারা রাত জেগে থাকার পর চোখ টা কেবল লেগে এসেছিল। এতো ভোরে কোন কারন ছাড়া কেউ কল করবে না জানি। মাঝ রাতে অথবা অতি ভোরে ফোনের আওয়াজ আমাকে ব্যতী ব্যস্ত করে তোলে। তাঁই ফোন টা উঠালাম। ওপারে পল্লবীর ভয়ার্ত স্বর।
কি হয়েছে?
তুমি এখনি এসো শমিত দা, এখনি এসো।
কি হয়েছে বলবি তো?
তুমি এলেই দেখতে পাবে। দেড়ি করো না, Please.
অগত্যা উঠে পড়লাম। মুখে হাতে পানি ছিটিয়ে গাড়ীর কাছে এসে দাঁড়ালাম। কেনও জানি এক অজানা ভয় মনের মধ্যে। ওর আতঙ্কিত গলার স্বর আমার কানে বাজছে।
পল্লবী আমার কেউ নয়। আত্মীয়তা নেই আমার সাথে । ওর বড় বোন কে আমি চিনতাম। সেই সুবাদে ওকেও চিনি। অনেক দিনের চেনা। দেখেছি যখন ওর গলায় ওড়না পড়েনি। মাঝে মাঝে এসে বলত,” শমিত দা তুমি মেজবু কে বিয়ে করবে”?
বলতাম, না, তোমার মেজবু আমার বন্ধু।
সেই পল্লবী চোখের সামনে বড় হোল। মিষ্টি চেহারার মেয়ে টা ঘুরে বেড়াতো ওর মেজবুর পাশে। একদিন মেজবুর বিয়ে হয়ে চলে গেলো অন্য খানে সেই সাথে সেও। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমাকে নিয়ে। মাঝে অনেক গুলো গ্রীষ্ম, শীত পাড় হয়ে এলাম। আমার জীবন টা অনেক কাঁটা ছেড়ার মাঝ দিয়ে পাড় হয়ে এসে ঠেকলও এক ছোট্ট ঘরে।
এমনি একদিনে একটা ছোট্ট চিরকুট এসে পড়ল হাতে।
অনুর লেখা। সাথে একটা বিভিন্ন রঙে মাখান কার্ড।
শমিত,
আসছে মাসের ১২ তারিখে পল্লবীর বিয়ে।
তোমাকে আসতে হবে।
অনু
মনে হোল মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। পল্লবীর বিয়ে। সেই ছোট্ট মেয়েটা, যে কিনা বলত আমি ওর মেজবু কে বিয়ে করবো কি না, সেই আজ বিয়ের সাজে সাজছে। মেন্দির রঙ এ রাঙিয়ে দিয়েছে তার দুটো হাত। মাথার পড়ে লাল ওড়না।
বসে আছে নত মুখে।
আমি পৌছেছিলাম বিয়ের দুদিন আগে। ষ্টেশন থেকে অনু নিয়ে এসেছিল। পথে আসতে আসতে বলল, এক অনুশঠানে পল্লবী কে দেখে ছিল সঞ্জীবের বাবা। সেখানেই অনুর মা কে বলেছিল, আপনার মেয়ে কে আমার খুব পছন্দ। আমার ছেলের সাথে মানাবে। অনুর মা পড়ে জানাবে বলেছিল।
সঞ্জীব কেবল কম্পিউটার সাইন্সে পাশ করে এক বড় কোম্পানিতে ঢুকেছে। দেখতে মন্দ নয়। কথা বার্তায় চৌকস। বলল অনু।
বললাম, একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো, তাঁই নয় কি ? ওর তো এখনও বিয়ের বয়স হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
অনু বলেছিল, তুমি তো জানো বাবা নেই, মা র বয়স হয়েছে। মা চাইছে না এই সম্বন্ধ হাতছাড়া করতে। আর তাছাড়া পল্লবীও রাজি।
গাড়ী এসে দাঁড়ালো দরজায়। আমি আর অনু চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকলাম ঘরে। পল্লবী এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। অপূর্ব লাগছিলো ওকে দেখতে। বলেছিল, শমিত দা তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো।
বলেছিলাম, তুই তো আসছিস সেই খানে যেখানে আমিও আছি। পারবিনা আমার দেখাশুনা করতে?
পারবো বৈকি? বলেছিল সে।
ধুমধাম করে শেষ হোল সব। যাবার সময় অনু জল ভরা চোখ নিয়ে এসে বলেছিল, শমিত, ওকে দেখে রেখো।
সময় পেরিয়ে গেলো। পল্লবীর কোলে এলো এক ছেলে। মাঝে মাঝে রেখে যেতো আমার কাছে।
বলত, শমিত দা, এই থাকলো, দেখে রেখো, আমরা যাচ্ছি একটা পার্টিতে। আসতে যদি দেরী হয়, তুমি এই দুধ টা খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিও।
আমারও সময় কেটে যেতো ওকে নিয়ে। মনে হতো, ভুলই বলেছিলাম সেদিন, ওর বয়স হয়নি বিয়ে করার। সুখের ছোট্ট নীড় ওরা বেধেছে। দেখে ভালো লাগছে।
বাসার সামনে একটু জটলা। দেখতে পেলাম রহিত সাহেব কে, (সঞ্জীবের বাবা), সজীব, ওর বড় ভাই, সাথে আরও কয়েক জন। গাড়ীটা রাস্তার পাশে রেখে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে সঞ্জীবের বাবা এগিয়ে এলো। কোন কথা বলার আগে
বলল, ভিতরে আসুন।
ভিতরে এলাম। পল্লবী বসেছিল একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে। তাকাল। চোখে জল। কাঁদছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,” ওকে ধরে নিয়ে গেছে শমিত দা”।
ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় নিয়ে গিয়েছে? কে নিয়ে গিয়েছে? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
পুলিশ। পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। ওর উপর নজর রাখছিল ওরা। ওরা বলল সঞ্জীব বিভিন্ন খারাপ ওয়েব সাইটে ঘোরাফেরা করে। বলে থামল পল্লবী।
খারাপ ওয়েব সাইট মানে?
ওরা আমাকে ব্যাখ্যা করেনি। শুধু ওকে আর ওর সব ল্যাপটপ গুলি নিয়ে গেছে।
পাঁচ দিন পর জামিনে মুক্তি পেলো সঞ্জীব। পুলিশের মতে “ টাকার বিনিময়ে আনন্দ” এই ধরনের একটা সংস্থার সাথে সে জড়িত। ওতপ্রোত ভাবে জড়িত না থাকলেও তার নাম পাওয়া গেছে ঐ সংস্থার খাতায়। ল্যাপটপে।
দোষ স্বীকার করে নিয়ে ছিল সঞ্জীব। ফলে এক বছরের সাজা, আর এক বছর প্রবেশন। পায়ে ইলেকট্রনিক ব্রেসলেট। তার হাটা চলার পরিধি ছিল সীমিত। ল্যাপটপ তালা লাগানো, ব্যবহার করা নিষেধ।
তার বাচ্চা সে দেখতে পারবে তবে আর একজনের উপস্থিতে। একলা সে থাকতে পারবে না। ফলে সঞ্জীবকে এসে উঠতে হোল ওর বাবার বাসায়। পল্লবী বাচ্চা নিয়ে থেকে গেলো সেই বাসায় যেখান থেকে শুরু করেছিল ওদের জীবন।
বলেছিলাম, পল্লবী, মানুষ দোষ করে, তার প্রায়শিচত্ত করে। পারবি না আবার ফিরে যেতে।
না, শমিত দা, একবার যে বিশ্বাস আমি হারিয়েছি তা আর ফিরে আসবেনা কোনদিন। জীবনের শুরুতেই সব শেষ হয়ে গেলো আমার।
বললাম, নতুন করে জীবন শুরু করা বড় কঠিন। তাছাড়া তোর ছেলের কোথাও তো ভাবতে হবে। একলা তোর পক্ষে ওকে ঠিক পথে চালানো সম্ভব হবে কিনা জানিনা। কয়টা উদার ছেলে আছে এই ধরাধামে যে ছেলে সহ —
কথা শেষ করার আগেই সে বলল, শমিত দা যে আসবে সেতো সব দেখে শুনেই আসবে, আর যদি না পাই আশীর্বাদ করো যেন ছেলেটাকে মানুষ করে দিয়ে যেতে পারি।
সঞ্জীবের পায়ের বেড়ি খুলে গেছে। সে এখন মুক্ত। বাচ্চা বড় হয়েছে। নয় বছর বয়স। ছুটির দিনে বাপের কাছে আসে। কিন্তু ওরা দুজন আর হাতে হাত রাখতে পারলো না।
যা ভেঙ্গে যায় তা আর জোড়া লাগেনা। লাগলেও একটা দাগ থেকে যায়। ওদের বেলাতে তাঁই হোল। জোড়া লাগলো না।
পল্লবী চাকরি করে এক ইনভেস্টমেন্ট ফার্মে। মাঝে মাঝে আসে আমার কাছে।
বলে, শমিত দা, তুমি তো বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যাও, আমাকে নিয়ে যাবে ? আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।
বললাম, পারবো বৈকি। তবে এই ঘুনে ধরা সমাজ তোকে যেতে দেবেনা আমার সাথে। আমি একেলা, তুইও একেলা, এই হয়েছে জ্বালা। ওরা নিন্দে রটাবে।
কেন? তুমি আমার বড় ভাই।
সে তো তুই আর আমি জানি । তবে ভাবিস না। অনু কে বলব। ও যদি যায় তবেই সব সমস্যার সমাধান। কি বলিস?
তবে তাই করো। আমি অপেক্ষায় রইলাম।