ডায়রির পাতা থেকে ৮

    ৭ই মে

  সকাল দশটা। নাস্তা শেষে গরম কফিটা উপভোগ করছিলাম। সেই সাথে সকালের খবর গুলো দেখছিলাম CNN এ। দরজা খোলার শব্দে তাকালাম। আমার ঘরের চাবি আছে কয়েক জনের কাছে। ওরা সবাই আসা যাওয়া করে শুধু একজন ছাড়া। কাজেই ধরে নিয়ে ছিলাম কে হতে পারে। তবে এতো সকালে কেনও সেটাই আমার প্রশ্ন।

না, আমার ভুল। দরজা খুলে ঢুকল সতী। আমার দিকে তাকিয়ে চাবিটা রেখে দিলো হাতে ঝুলানো ব্যাগ টার মাঝে।

কি  ব্যাপার এতো সকালে?

 “সকালে মানে? তুমিই না কাল রাতে কল করে বললে যত তাড়াতাড়ি পারো এসো। কথা আছে। ইদানীং তুমি অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছ,  শমিত”। কথা গুলো বলে এগিয়ে গেলো আমার ছোট্ট রান্না ঘরের দিকে।

“চা র পাতা এনে রেখেছিলে”?

রেখেছি, তবে তুমি যে ব্রান্ড বলেছিলে সেটা পাইনি। অন্য টা এনেছি।

চা র পানি বসিয়ে সে এসে বসলো সোফাতে।

কোন ভূমিকা না করেই  বললাম, ইয়াসমিন আসবে সামনের সপ্তাহে।

কোন ইয়াসমিন?

ঐ যে— , কথা শেষ না করে তাকালাম ওর দিকে। সে মিটমিট করে হাসছে।

বলল, সেই ইয়াসমিন যে তোমার যৌবন কালে, মানে ইয়ে, —

ফাজলামি রাখো, এখন বলও কি করব? সে আমার এখানে থাকবে।

তোমার  এখানে থাকবে, মানে? তুমি কি হা বলেছ?

সতীর সেই মিটিমিটি হাসি নেই। রীতিমত সিরিয়াস। ওকে একটু রাগাতে ইচ্ছা করলো।

তা কোথায় সে থাকবে  বলো। আমি নাহয় মেঝেতে থাকবো, ওকে দিয়ে দেবো আমার ঘর টা।

ইয়ার্কি করছ? ওর এখানে থাকা হবে না। উচিৎ ও নয়। আমি যাবো তোমার সাথে এয়ারপোর্টে। বলে চা টা আনতে উঠে গেলো।

তাহলে কি করা যাবে? গত বার নিউইয়র্কের বাহিরে যাচ্ছি বলে পাড় পেয়ে ছিলাম, এবার তা হচ্ছে না।

দেখা যাক কি করা যায়। তোমার চিন্তা করতে হবে না, আমি একটা ব্যবস্থা করবো। শেষ কথা হচ্ছে ওর এখানে  থাকা হবে না।

সতীর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে রীতি মতো উদ্বিগ্ন । আমিও চাইছি না সে এখানে থাকুক। তবে করণীয় কি আছে সেটাও জানিনা।  তবে এটা ভেবে নিশ্চিত আমার চেয়ে সতীরই গরজ বেশি।

সতী আর কথা বাড়াল না। চা টা শেষ করে বলল, আমি উঠি। দিনের দিন আমাকে নিয়ে যাবে এয়ারপোর্টে। আর তোমার চাল বাড়ন্ত। সময় করে কিনে রেখো।

বললাম, ঠিক আছে।

সতী চলে গেলো।  আমি টেলিভিশন টা চালিয়ে দিলাম। সেই এক গেয়েমী খবর। নর্থ কোরিয়ার মিসাইল টেস্ট। আমেরিকা হুমকী দিচ্ছে কিছু একটা করবে এই বলে। অথবা কোথাও পুলিশ আর জনগনের মধ্যে সংঘর্ষ। পৃথিবীর কোথাও শান্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না।  এই সব চিন্তা ভাবনার সময় ফোন টা বেজে উঠল।

অনেকদিন পর শুভঙ্কর কল করেছে।

বললাম, কি মনে করে? বৌদি ভালো তো?

ভালো, সন্ধায় আসতে পারবি রংমহল রেস্টুরেন্টে?

কি ব্যাপার?

মুকুল এসেছে। আড্ডা দেওয়া যাবে। বড় এক ঘেয়েমী হয়ে গেছে জীবন টা।

দেখা হবে, বলে ফোনটা রেখে দিলাম।

মুকুল, বন্ধুদের মাঝে সেই ছিল সবচেয়ে কাছের।

মুকুলের শেষ কথা টা আজও মনে বাজে,

” চললাম শমিত’।

কোথায়?

উত্তর না দিয়ে সে চলে গেলো।

সেই শেষ দেখা। তাও তো আজ বিশ বছর হয়ে গেলো।

 শুভঙ্কর মাধ্যমেই পরিচয় হয়েছিল ওর সাথে। বন্ধুত্ব টা গড়ে উঠেছিল খুব তাড়াতাড়ি। হয়ত ওর সুন্দর  খোলা মনের জন্য। হাসতে জানে আবার হাসাতেও জানে। সেই হাসি একদিন মুছে গেলো। হয়তো ওর হাসির কোটা ফুরিয়ে গিয়েছিল।

ভুলি নি আমি সেই রাতের কথা।

নিউ ইয়ার্স ইভ।  আমরা সবাই এসেছি শুভঙ্কর এর বাসায়। সারা রাতের প্রোগ্রাম। থেকে যাবো রাতে।

টাইম স্কয়ারে লোকে লোকারণ্য।

পাঁচ, চার, তিন, দুই, এতা। রাত ১২ টা। নতুন বছরের সূচনা।

আমরা শ্যাম্পেনের পরিবর্তে শুভ নববর্ষ জানালাম আপেল সাইডার বোতলের মুখ খুলে।

গিন্নিদের বানানো বিভিন্ন ধরণের  মুখরোচক এপিটাইযার পরিবেশন করা হোল। হাতে হাতে ঘুরতে থাকলো।

 আমরা কয়জন বসলাম তাসের আড্ডায়।

মুকুল খেলত না। খেলা দেখতো।

হঠাৎ পাশে তাকিয়ে ওকে দেখলাম না।  ভাবলাম হয়তো সিগারেট টানতে গেছে।  বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। আমরা খেলায় মত্ত।

ঘারে চাপ পড়তেই পাশ ফিরে তাকালাম। মুকুল। চেহারায়  থমথমে ভাব। অজান্তেই বুকটা কেঁপে উঠল। ওর অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া চেহারা আমি দেখিনি কখন।

কি ব্যাপার?

একটু উঠে আসবি? বলল সে।

আমি আমার হাতের কার্ড টা অন্য একজন কে দিয়ে উঠে এলাম।

কি হয়েছে?

আমার সাথে আয়। বলে নিয়ে এলো সেইখানে যে খানে সব ভাবী, বৌদিরা বসে দেখছে লীমীনার (মুকুলের বৌ) নাচ।  নাচ বললে ভুল হবে, এ শুধু আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঘুরছে, ঘুরছে গানের সাথে, “ তোমাকে চাই, তোমাকে চাই—“ ।

মুকুল শুধু বলল, এই রুপ আমি কখন দেখিনি।

কঙ্কনা তাকালও আমার দিকে। ইশারায় ডাকল আমাকে। কাছে যেতেই কানে কানে যা বলল আমি তা শুনতে প্রস্তুত ছিলাম না। যদিও বললাম, তোমার সাথে আমি একমত নই।

ফিরে আসতই মুকুল বলল, আমার আজ বাসায় চলে যাওয়াই উচিৎ। ভাল লাগছে না।

যাই করিস ঠাণ্ডা মাথায় করিস। বললাম, তুই যা ভাবছিস তা হয়ত না।

ও ডাক দিলো লীমীনা কে। লীমীনা শুনতে পেলো বলে মনে হোল না। কাছে যেয়ে মুকুল ওর ঘারে হাত রাখতেই মনে হোল লীমীনা ফিরে এলো বাস্তবে।

কি হয়েছে?

বাসায় যেতে হবে, আমার শরীর টা ভালো লাগছে না।

লীমীনা যেতে প্রস্তুত আছে বলে মনে হোল না।

 “ কেবল না পার্টি টা জমে উঠেছে এখনি যাই যাই করছ কেন? উপরে যেয়ে রেস্ট নেও তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে”। বলে গান টা বাজানোর জন্য হাত বাড়াল। হাত ঐ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই মুকুল ওর হাত টা চেপে ধরল।

আমি তাকালাম কঙ্কনার দিকে। কঙ্কনা এসে দাঁড়ালো ওদের মাঝে।

“ চলেন ভাবী, আমরা অন্য কিছু করি, আজ আর নাচ নয়। অনেক দেখলাম”। বলে নিয়ে গেলো অন্য ঘরে।

মুকুল কে নিয়ে আমি চলে এলাম। অন্যরা কেউ কিছু দেখল না, জানলো না, ওরা তাসের খেলায় মত্ত।

ভোর হওয়ার আগেই মুকুল চলে গিয়েছিল। বিদায় না জানিয়ে।

তারপর?

তারপর সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো, যে আমি কোন কিছু বোঝার আগেই দেখলাম সব শেষ।

মুকুল বলেছিল, লীমীনা আর একজনের সাথে কয়েক মাস ধরে যাওয়া আসা করছে। তাদের মধ্যে কার সম্পর্ক এতো গভীর যে ওরা নতুন করে নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়।

লীমীনা আরও বলে ছিল, মুকুল বন্ধু হিসাবে ভালো, স্বামী হিসাবে নয়।

আজ এতো বছর পর ওকে দেখব। মাঝের সময় টুকু তে কত কিছু ঘটে গেলো সবার জীবনে। তবুও মনের মাঝে একটু শিহরন।

আমি এসে দাঁড়ালাম রংমহল রেস্টুরেন্টে। দরজা খুলে ভিতরে এলাম। চশমা টা ভালো করে মুছে তাকালাম সামনে।

 মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। ও উঠে দাঁড়াল। সেই মন ভুলানো হাসি। শুধু সামনের দুটো দাঁত কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

 

Continue Reading