দুদিন হয়েছে মালতী এসেছে তার বান্ধবির কাছে । তার স্বামী চা বাগানের ম্যানেজার। ঘুম না আসায় উঠে এসে দাড়িয়ে ছিল নির্জন বারান্দাটা তে। এক ফালি চাঁদের আলো এসে পরেছে সেখানে। জোনাকি পোকার আলো নিভছে জ্বলছে । মায়া ময় পরিবেশ। আধো আলো, আধো অন্ধকার। গভীর রাতের নীস্তবতা ভেদ করে করুন বাঁশির সুর মালতীর কানে পৌছে। মালতী স্তম্ভিত। এ সুর তার চেনা । অনেক আগে এ সুর সে শুনেছিল। বাঁশির সুর আকাশে বাতাসে আনে অনির্বচনীয়ের আহবান। এ সুর মালতীর অন্তরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে। মালতী ভাবে, কে এই বংশীবাদক ? বাঁশিতে বাজছে তার হারিয়ে যাওয়া গান গুলি । এক সময় নিস্তব্ধ হয়ে এলো সব। চাঁদের আলো নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু জোনাকির আলো।
এলোচুলে মালতী এসে দাঁড়ালো তার খাটের পাশে। কি এক অজানা ভয় তাকে শিহরিত করে তুললো। ফিরে যেতে চাইলো অনেক পিছনে। না এ হতে পারে না । এ হবার নয় । ভাবলো, সকাল হলে জিজ্ঞাসা করবে কে এই বংশীবাদক।
পাখীর কিচির মিচিরে মালতীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোরের সূর্যের আভা এসে পরেছে তার জানালায়। আকাশ টা লাল রং এ আচ্ছাদিত। আড়া মোড়া করে উঠে আসতেই বান্ধবীর ডাক শুনল সে। “ কিরে ঘুম হোল?”
‘ না, হয়নি। জানিস কাল রাতে দাঁড়িয়েছিলাম বারান্দায়। দূরে করুন সুরে কে জেনো বাঁশি বাজাচ্ছিল। বলতে পারিস কে?”
“ ও, উনি তো প্রতি রাতেই বাজায়। পাশের চা বাগানের ম্যানেজার। থাকে একলা। নিজেকে নিয়েই বাস্ত।”
আজ রাতে বাজালে, পারবি আমাকে নিয়ে যেতে ওখানে। মালতী বলে।
সে তো অনেক রাতে বাজায়। উৎকণ্ঠার সাথে বলে সুমীতা।
তা হোক , আমি যেতে চাই। দেখতে চাই উনাকে । প্রশ্ন করিস না কেন? তোদের ড্রাইভার কে বলিস সে জেনো আজ রাতে নিয়ে যায় আমাকে।
সুমীতা রাজি হোল। দু বান্ধবী বাকি সময় টা কাটিয়ে দিলো গল্প গুজব করে।
রাত তখন দু প্রহর। আধো রাতে শুনতে পায় বাঁশির সুরের আর্তনাদ। সেই চেনা সুর ছড়িয়ে পড়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন চা বাগানে ।
মালতী ডাক দিলো শম্ভু কে।
শম্ভু?
জি মা
আমাকে নিয়ে যেতে পারবে ঐখানে, যেখান থেকে ঐ গান ভেসে আসছে । জানো কোথায়?
জানি মা জি, শম্ভু বলে।
দু জনে বেড়িয়ে পড়ল গাড়ী তে করে। বেশি দূর নয়।
এসে গেছি মা জি, ঐ যে দেখছেন বাসাটা ঐখানে উনি থাকেন। বললও শম্ভু।
মালতী পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। কে সে যে একাকীত্ব ভাবে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি । পাশে মদের বোতল। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলো একটা ছবি তার সামনে।
মালতী পেছনে এসে দাড়াতেই বাঁশি বাজানো বন্ধ করে সে তাকাল মালতীর দিকে।
চাঁদের আলো এসে পড়েছে বাদকের মুখে। পলক পড়েনা চোখে। পাশে রাখা মোমবাতি টা উঁচু করে ধরল মালতী।
অনুপম তুমি ?
আমারও তো সেই প্রশ্ন, তুমি এখানে মালতী?
এসেছি দুদিন হোল বান্ধবীর বাসাতে। রাতে গানের সুর আমাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছিল। আমার চেনা সুর কে বাজাচ্ছে তাই দেখতে ছুটে এলাম।
অনুপম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, এই সুর তোমাকে শুনিয়েছিলাম ১২ বছর আগে। মনে পড়ে? দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো। অনুপম বলে মালতীকে।
ঐ ঝাপসা করে তোলা ছবি টা তোমাকে দিয়েছিলাম । আজও রেখে দিয়েছ দেখছি?
হা, ওটার সামনে বসে বাজায়ই। ফিরে যাই আমার ফেলে আসা দিনগুলিতে।
মনে পড়ে, তোমার ভাই এর সাথে তোমাদের বাসাতে এসেছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তুমি এস,এস,সি পরীক্ষা দেবে।
মনে পড়বে না কেন? মালতী ফিরে যায় অতিতে। অপু ভাই তোমাকে বলেছিল, অনুপম তুই কি আমার এই মাথায় গোবর পোড়া বোনের মাস্টার হতে পারবি?
মনে পড়ে, আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। সেইতো শুরু। প্রতিদিন আসতাম, তোমার গোবর পোড়া মাথায় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অংক, ঢোকানোর চেষ্টা করতাম। তুমি বলতে, আমার দাড়া কিচ্ছু হবেনা অনুপম দা। কিন্তু হয়েছিল। তুমি ভালভাবে পাশ করেছিলে।
বলেছিলাম, এবার আমার পাঠ চুকল। এর আসতে হবেনা তোমাদের বাসাতে।
তুমি কি বলেছিলে মনে পড়ে?
পড়ে বৈকি? বলেছিলাম, বাসাতে না হয় নাই এলে, বাহিরে তোমার সাথে দেখা হবে। কখন যে আপনি থেকে তুমি তে চলে গেছি আমি নিজেও জানিনা। তুমিও আমাকে শুধরিয়ে না দিয়ে বলে ছিলে ,” দেখা হবে কাল ১২ টায় বলাকার সামনে”। দুটা বছর কোন দিক দিয়ে চলে গিয়েছিল আমরা নিজেরাও জানিনা।
মালতী, তুমি রবীন্দ্র সংগীত ভালবাসতে। আমার গলায় সুর নেই। তাই ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো। ভর্তি হয়ে ছিলাম গানের স্কুলে। বাঁশি শিখতে। তুমি জানতে না। হাতে খড়ী শেষ হবার পর তোমাকে নিয়ে বসেছিলাম এক নির্জন মাঠে । তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে , তোমার হাতে ওটা কি ? বলেছিলাম, এখানে বোসো। চোখ বন্ধ করো। আমি বাঁশিতে গান ধরে ছিলাম “ ঐ মালতী লতা দোলে,—“ গান শেষ হলে তুমি অনেকক্ষণ কেঁদে ছিলে ।
বাসাতে যেয়েও কেঁদেছিলাম। কেন জানিনা। তারপর, তারপরের ঘটনা মনে আনতে চাইনা। যুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠল। সব কিছু লনড ভনড হয়ে গেল। বাবা বাসাতে তালা লাগিয়ে দূরে গ্রামে মামার বাসায় আমাদের কে নিয়ে চলে এলো। তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না । তুমি কি ভাবে আছো তাও জানতে পারলাম না ।
জানো মালতী, সাত দিন পর আমি গিয়েছিলাম তোমাদের বাসাতে। দেখলাম তালা ঝুলছে। কাউ কিছু জানেনা। আমি অস্থির হয়ে অনেক্ষখন পায়চারি করেছিলাম। অনেক খুঁজেছি তোমাকে, পাইনি। প্রতি সপ্তাহে গেছি তোমাদের পাড়ায় । দেখেছি তালা বন্ধ। মাসের পর মাস পেড়িয়ে গেছে। আমার বন্ধু, মহসিন, তুমি তাকে চেনো, খবর দিয়েছিল তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এক ইনজিনিয়ারের সাথে। বিশ্বাস করিনি।
ঠিকই শুনেছিলে। আমার করনীয় কিছু ছিলনা । ভাইয়া চলে গিয়েছিল মুক্তি যোদ্ধা হয়ে। খবর এসে ছিল সে আর নেই। বাবা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় মামা এক প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, উনার বন্ধুর ছেলে, ইনজিনিইয়ার। বাবা রাজি। সেদিন স্বার্থপরের মত তোমার কথা আমি ভাবিনি। দেখেছিলাম বাবা মার চোখে জল। ভাইকে হারানোর ব্যেথা। তোমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম । আকাশ কে নিয়ে ঘর বেধে ছিলাম। চলে গিয়েছিলাম জার্মানিতে।
সে খবর আমি পেয়েছিলাম। আঘাত যে পায়নি সে কথা বললে ভুল হবে । তবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরীপেক্ষীতেই তোমাকে এ পথ বেছে নিতে হয়েছিল। চলে গিয়েছিলাম লন্ডনে পিএইচডি করার জন্য। ফিজিক্সে পিএইচডি করে ফিরে আসেছিলাম চার বছর পর।
ফিজিক্সে পিএইচড করে আজ তুমি চা বাগানের ম্যানেজার। কেন?
কোন কিছুতেই মন বসছিলো না, ভাবলাম দূরে কোথাও একাকীত্ব ভাবে জীবন কাটাবো। এক বন্ধুর সাহায্যে এই চাকরি টা পেয়েছিলাম। এবার তোমার কোথা বল।
এতো রাতে কর্তা আসতে দিলো।
সে নেই । চলে গেছে দুবছর হোল। তালা ঝোলা সেই বাসাতে থাকি। তুমি বোতল ধরলে কেন ? কেন নিজেকে শেষ করে দিলে এভাবে ।
সে কোথা থাক। অনেক রাত হোল। তোমার ফিরে যাওয়া উচেৎ।
আবার দেখা হবে কি? মালতীর জিজ্ঞাসা।
আজ থাক
মালতী চলে গেল। পেছন ফিরে চেয়ে ছিল বার বার। অনুপম দাঁড়িয়ে ছিল যতক্ষণ না গাড়ীটা মিলিয়ে যায়।
সকালে চা র পেয়ালায় চুমুক দেওয়ার আগেই মালী এসে বললও, “ মা জী আপনার চিঠি। “
আমার চিঠি? মালতী আশচার্জিন্নত হোল।
হা মা জী, ডেরাইভার দিয়ে গেল
চিঠি খুলল মালতী, “ তুমি জানতে চেয়ে ছিলে দেখা হবে কি না। না, মালতী, তোমার যে মূর্তি আমি গেঁথে রেখেছি আমার হ্রদয়ে সেটাকে ভাঙতে দিতে চাই না । যে দোলনায় আমরা দুলেছিলাম তাকে ছিঁড়তে চাইনা। আমার প্রেম থাকুক আমার মনের মাঝে নিষ্কলঙ্ক হয়ে। তুমি হারিয়ে যাওনি। রাতের অন্ধকারে তোমাকে ফিরে পাই আমার সুরে। তুমি আছো, তুমি থাকবে। বিদায়।”
দু ফোটা চোখের জল ঝরে পড়ল চা র পেয়ালার উপর। সে রাতে করুন সুরে বাঁশি আর বাজেনি.
কলকাতায় এসেছি বেশ কিছুদিন হোল। পুরানো কাগজ পত্র ঘাটতে যেয়ে পেলাম অনেক আগের সাদা কালো একটা ছবি। দিলিপ, শিবু, আর আমি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শিবু দের কে চলে যেতে হয়েছিল ভারতে। তারপর আর খোজ পাইনি। শুনে ছিলাম সে কানপুরে আছে। সঠিক জানিনা। মনে হোল যোগা যোগ টা করতে পারলে একবার ঘুরে আসা যেতো। দিলিপ কে ফোন করলাম। সে হয়তো জানতে পারে।
ফোন টা উঠাতেই বললাম, “ দিলিপ, আমি সজীব বলছি”
তা কি মনে করে”। “
শোন, তুই কি জানিস শিবু কোথায়? আমি কলকাতায়। ভাবছি যদি সম্ভব হয়, তবে ওর সাথে দেখা করবো।”
“ মাস ছয়েক আগে সে এসেছিল। দাড়া, ওর নাম্বার টা দিচ্ছি।”
নাম্বার টা পেয়েই সাথে সাথে ডায়েল করলাম। ওপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো,” আপ কোন হ্যাঁয়”
সমস্ত খবরাখবর নিয়ে বললাম,” আজ বিকেলের ট্রেনেই রওয়ানা হচ্ছি। তুই স্টেশনে থাকিস।”
অনেক দিন পরে দেখা হবে। অজানা আনন্দে মনটা ভরে উঠল।
যথারীতি শিয়ালদহ স্টেশনে চলে এলাম। ট্রেন ৪ টা ৫০ মিনিটে ছাড়বে দিল্লীর দিকে, মাঝে কানপুর। লোকজনের আনাগোনা অতটা নয়। শীতের বিকেল। ট্রেনে লম্বা জার্নির কথা অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম। যাক, আজ তা পূরণ হতে চলেছে। কামরা টা পরিস্কার, পরিচছন্ন। সব মিলে আমরা গোটা দশ জন লোক। জানালার পাশের সীট আমার সবসময় প্রীয়। Steve Jobs এর আত্মজীবনী বই টা খুলে বসলাম। অনেক দূরের পথ। কথা বলার সঙ্গী সাথী না থাকায় বই একমাত্র সম্বল আমার। ঘণ্টা দুই পেড়িয়ে ট্রেন এসে থামল দুর্গাপুর এ। দু এক জন যাত্রী উঠা নামা করলো।
“ বসতে পারি”। বাংলায় প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে দেখি, মধ্য বয়স্ক এক ভদ্রলোক। পরনে সাদা পাঞ্জাবী উপরে কোর্তা। এই ঠাণ্ডার উপযুক্ত পরিচছদ নয়। বললাম,” নিশ্চয়”। ভদ্রলোক বসলেন। “ কি বই? প্রেমের না অন্যকিছু।” প্রশ্ন টা আমার মনপুত নয়। বললাম ,” জীবন কাহিনী”। আমার চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ ভালবেসেছেন কাউকে কোনদিন।” একটু বিরক্ত অনুভব করলাম। নিতান্তই পার্সোনাল ব্যাপার। তবুও বলতে ব্যাধ হলাম, “ হা, বেসেছিলাম”। উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। আনমনা। দ্রীস্তী মনে হোল অনেক দুরে প্রসারিত।
হঠাৎ ই বললেন, এই, এই স্টেশন থেকেই সে উঠে ছিল।
“ কে, কে উঠেছিল?”
“আকরাম”
“ আকরাম কে?”
আকরাম আহমেদ, কাজ করতো দিল্লি তে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টএ। আপনি যে সীট টাতে বসে আছেন, ওই টাতে সে বসে ছিল। সে কি জানতো দু ঘণ্টা পরে তার জীবনের অধ্যায় অন্যভাবে লেখা হবে। বলতে থাকলেন, স্টেশন বারাকরে ট্রেন থামতেই উঠে এলো নীল রং এর কামিজ পরনে, গায়ে লাল সাল জড়ানো মেয়েটি। বসলো, ওই যে ভদ্রলোক বসে আছেন ওই সীট টাতে। দুজনে মুখোমুখি না হলেও চোখের দ্রীস্তীর বাহিরে নয়। দু একবার যে চোখাচোখি হয়নি তা নয়। দ্রীস্তীকটু হবে বলে আকরাম আর তাকায়নি ওর দিকে। তবে দেখা হয়ে ছিল ট্রেনের ক্যান্টিনে। নাম মল্লিকা। মল্লিকা ব্যানারজি।
আকরাম ইতস্ত করে বলেছিল,” চা খেতে আপত্তি আছে? একসাথে।” মল্লিকা না করেনি। চা র পেয়ালা শেষ করতে করতে কথা হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। জেনে ছিল মল্লিকা দিল্লীর এক কলেজে পড়ে। এসে ছিল বাড়ীতে ছুটির সময়। নিজেদের কামরায় আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ক্যান্টিনে কাটিয়ে ছিল পুরো সময় টা। ট্রেন দিল্লী তে এসে পোওঁছালো সকাল ১০ টা ২২ মিনিটএ।
এবার বিদায়ের পালা। আকরাম বলেছিল,” আমি যাবো ডালহোসী পাড়ায়। আপনার কোন আপত্তি না থাকলে আমি নামিয়ে দিতে পারি”। নেমে যাওয়ার আগে আকরাম ওর বিজনেস কার্ড টা মল্লিকা কে দিয়ে বলেছিল, “ সময় পেলে ফোন করেন।” সেই ফোন এসেছিল দশদিন পরে, রাত ৮ টায়।
“ কেমন আছেন? চমকিয়ে উঠলেন তো?” কথা গুলি আকরামের কানে সেতারের মত রিন ঝীন করে বাজলো ‘ না না চমকাবো কেনো? আপনার কথা মনে হচ্ছিল।” কথা টা বলেই সে বুঝতে পারলো, বলাটা ঠিক হলো না। একবার মনেও হয়ে ছিল, যেখানে মল্লিকা কে নামিয়ে দিয়ে এসেছিল সেই বাসায় যেয়ে দরজায় কড়া নাড়াবে কিনা। না পরে সেই চিন্তা বাস্তবে আনেনি। আজ তার মনে হোল এতো মেঘ না চাঁইতেই জল।
আকরাম সাহস সঞ্চয় করে বললও,” কাল বন্ধের দিন, এক সাথে বসে যদি লাঞ্চ করি আপত্তি আছে কি?”
না নেই। কোথায় দেখা হবে। কখন ? ও প্রান্ত থেকে জবাব আসে ।
লরেন্স স্ট্রীটের কর্নারে। দুপুর ১২ টায়
রাতটা যে কিভাবে কেটেছে আকরাম নিজেও জানেনা। ভোর হতেই হাতের কিছু কাজ শেষ করে তয়রি হয়ে নিলো। ঠিক ১২ টায় লরেন্স স্ট্রীটের কর্নারে সে হাজির। মল্লিকা তখনো আসেনি। ভাবছিল আদ্যও সে আসবে কি না। ভুল হয়ে গেছে, কালকে ফোন নাম্বার টা নেওয়া হয়নি। অস্থির হয়ে আকরাম ঘড়ি টা দেখল। ১২ টা ৫ মিনিট। ঠিক সেই সময় মল্লিকের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। “ দেরী হয়ে গেল, তাই না?”
“না, না দেরী কোথায় , মাত্র তো ৫ মিনিট,” চলেন, মেডিটেরিয়ান ফুডে কোন আপত্তি নেই তো?”
না নেই।
ওরা যেয়ে বসেছিল সেভিলা- দি ক্লারিজ এ। দুদিনের দেখাতেই মনে হয়েছিল ওরা দুজনে অনেক কাছের। মনের মিল খুঁজে পেয়েছিল দুজনে। বিকেলের পড়ন্ত বেলাতে হেঁটে ছিল ইনডিয়া গেট এর লনে। আইস ক্রিম খেতে খেতে ঠিক করেছিল আবারো মিলিত হবে দুজনে কোথাও কোনো খানে।
সেই শুরু। দিন শেষে মাস, মাস শেষে বছর কেটে গেছে। হেঁটেছে দুজনে কণাট প্লেসে। মল্লিকার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল লোডি গার্ডেনে। গুনগুন করে গেয়ে ছিল বেসুরো গলায়,” আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি।”
এই চলার যে শেষ কোথায় সেটা ওরা বুঝতে পারিনি। ফাইভ সেনস গার্ডেন এ বকুল গাছটার নীচে বসে মল্লিকা বলে ছিল আকরাম কে,” বাবা মেনে নেবেনা অন্য গোত্রের ছেলেকে।”
আমি যেয়ে তোমার বাবা কে বলবো
তুমি আমার বাবা কে চেনো না। আমি জানি না , এর পরিনিতি কোথায়।
কিন্তু দুজন দুজন থেকে প্রিথক হওয়ার সম্ভবনা নেই। গোত্র, সংসকার আজ বাধা হয়ে দাড়িয়েছে দুজনের মধ্যে। মল্লিকা আকরামের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “ ছুটিতে বাড়ী যেয়ে বাবাকে সব বলবো। দেখি কি হয়।”
বাবা কে সে বলেছিল। বাবার এই অগ্নি মূর্তি সে আগে কখনো দেখিনি।
“ মেয়ে কে আমি জলে ভাসিয়ে দেবো তবুও মুসলমান ছেলের সাথে বিয়ে দেবোনা।” মল্লিকা কে সে আর ফিরে যেতে দেয়নি দিল্লীতে। ছুটির সময় পেড়িয়ে গেলো। মল্লিকা এলো না। একদিন ভোরের ট্রেনে আকরাম রওনা হয়ে গিয়েছিল বারাকরের পথে। লোকের কাছে পথের নির্দেশ নিয়ে সে এসে দাঁড়িয়েছিল ব্যানার্জির বাসার সামনে। কড়া নাড়তেই, কর্কশ স্বরে কেউ উঠল, “ কে, কি চাই?” আকরাম নরম সুরে বলল, “ আমি?”
আকরাম ভদ্র চিত্ত গলায় বলল, “ একবার মল্লিকের সাথে দেখা করতে পারি।”
এ যেন আগুনে ঘি ঢালার মত। চিৎকার করে উঠলেন হবুনাথ ব্যানার্জি। “ মেয়ে কে আমি দু টুকরো করে জলে ফেলে দেবো তবু তোমার হাতে দেবোনা”।
চিৎকার শুনে দু একটা মাস্তান গোছের ছেলে এসে জোড়ও হোল। মল্লিকার ছায়া আকরাম সেদিন দেখতে পায়নি। ভগ্ন হ্রদয় নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করেছিল। ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে সে। একবার যদি মল্লিকার সাথে দেখা করতে পারতো। চিন্তা গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাঁচছে। আমবাগান টা পাড়
হওয়ার আগেই একটা প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়ল আকরামের মাথায়। জ্ঞান হারিয়ে পরেছিল সে।
যখন চোখ মেলে চাইল ঝাপসা ভাবে দেখতে পেলো এক মেয়ের মুখ।
মল্লিকা!
উত্তেজিত হবেন না। আমার নাম সঙ্গীতা। নার্স।
আমি কোথায়, জিজ্ঞাসা করলো আকরাম
আপনি কামার দুবী হাসপাতালে। মাথায় আঘাত পাওয়াতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন রাস্তায়। কয়েকজন মিলে নিয়ে গিয়ে ছিল ওখানকার এক ক্লিনিক এ। সেখান থেকে ট্রান্সফার করে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। ৫ দিন
পরে আপনের জ্ঞান ফিরেছে।
বারকরের মল্লিকার খবর জানেন?
না, আমি তো ওখানকার নই।
আরও দশ দিন লেগে গিয়েছিল কিছু টা সুস্থ হয়ে হাঁসপাতাল থেকে বেড়িয়ে আসতে। জিজ্ঞাসা করেছিল বারকরের ক্লিনিক এর নাম। গিয়েছিল আকরাম সেখানে। খোজ নিয়েছিল মল্লিকার। জেনে ছিল দিন পাঁচেক আগে সে আত্মহত্যা করেছে। লিখে রেখে গেছে,” আকরাম যে পথে গেছে আমি সেই পথেই চললাম।”
আকরাম খুঁজেছিল শ্মশানের আনাচে কানাচে। কোথায় তার শেষ ক্রীত সম্পন্ন হয়েছিল জানতে। খোজ পায়নি। ফিরে গিয়েছিল স্টেশনে।
এর পর আকরামের খোজ আর কেউ সঠিক ভাবে দিতে পারেনি। তবে শোনা যায় সে দূরে এক মিশনারিতে কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিল। দুস্ত মানুষের সেবা করতো। কলকাতার কুষ্ঠ সেন্টারে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল। তাও তো অনেক দিনের কথা। অনেকে বলে প্রতি বছর ২৫ শে জানুয়ারি সে বারকর স্টেশন আসে। শ্মশানে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়।
২৫ শে জানুয়ারী কেন ?
ওই দিনই তো ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ আমার স্টেশন এসে গেছে, চলি। সালাম।”
ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। বাহিরে ঘন কুয়াশা। মনে হচ্ছে সাদা চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে স্টেশনটা। তাকিয়ে ছিলাম জানলা দিয়ে। কুয়াশা ভেদ করে আবছা আলোর রস্মী এসে পড়েছিল স্টেশনটার নামের ফলকের উপর। বারাকর।
চমকিয়ে উঠলাম। এই তো সেই বারাকর।
সামনে বসা ভদ্রলোক কে জিজ্ঞাসা করলাম, আজ কত তারিখ ?
২৫ শে জানুয়ারী।
২৫ শে জানুয়ারী , বারাকর।
হন্তদন্ত করে গেলাম দরজার কাছে। ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে। দূরে একটা ছায়া দ্রুত মিলিয়ে গেলো কুয়াশার ভিতর।