ডায়রির পাতা থেকে ১০

২৯শে মে

“আচ্ছা ,আপনি আমাকে ফলো করছেন কেন? বলবেন কি?”। প্রশ্ন টা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আমি রাস্তার চারিদিকে একবার তাকিয়ে নিলাম। কারন ভদ্রমহিলার গলার স্বর একটু উচুতে। দুই একজন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। রাস্তার দুপাশের অধিকাংশ পথচারীরা আমাদের ভাষায় কথা বলে। কথাটা যে তাদের কানে যায়নি তা নয়। এবং অনেকেই ভদ্রমহিলার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে না তা বলা কঠিন। আর হঠাৎ করে উনি যে ঘুরে দাড়িয়ে প্রশ্ন করবেন তাও আবার উচ্চস্বরে ভাবতে পারিনি। আমিই একটু পা চালিয়ে উনার কাছে যেয়ে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো, এমনি ভেবে ছিলাম। তার আগেই—
যাক সামনা সামনি যখন হয়েই পরেছি আর আশে পাশে কেউ যখন এগিয়ে আসছে না তখন মনে বল নিয়ে বললাম, আপনাকে আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল এবং এখন ও হচ্ছে, তাছাড়া আপনার কাধের ব্যাগ টাও আমার খুব পরিচিত। বলবেন কি কোথা থেকে কিনেছেন?
ভদ্রমহিলা আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।
বললেন, এই ধরনের কথা আর কতজন কে বলেছেন?
বললাম, আমাকে দেখে কি আপনার তাঁই মনে হয়। আসলে ঠিক এই সাপের চামড়া দিয়ে বানান ব্যাগ, একই ডিজাইন এমন টি অনেক অনেক আগে আমি কিনেছিলাম।
তারপর?
দিয়েছিলাম একজন কে।
বাহ, আপনি তো রীতিমত নাটক তৈরী করে ফেললেন এই রাস্তায় দাড়িয়ে। লেখা টেখার অভ্যাস আছে নাকি?
লিখি, লোকে পড়ে না। যদি কিছু মনে না করেন কোন এক জাগায় বসে এক কাপ চা খেতে খেতে কথা হবে, অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে।
আপত্তি নেই, বেশ ইন্টারেস্টীং লাগছে।
ভদ্রমহিলা হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন।
ঘড়িটাও আমার চেনা। কিনে ছিলাম শিল্পভাণ্ডার থেকে। বলে থামলাম।
তার মানে এটা আপনি আমাকে দিয়েছেন, এই —
কথা শেষ হতে না দিয়ে বললাম, না তা নয়, ওটা কি সিটিজেন ঘড়ি?
কি ভাবে জানলেন।
চলুন চা খেতে খেতে কথা হবে।
লোকেরা আর আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমরা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছি। কিছু একটা ঘটতে যেয়েও ঘটলনা দেখে ওদের মনক্ষুব্ধ।
বসলাম এসে পাশের রেস্টুরেন্টে।
ভদ্রমহিলার ঠিক কপালের কাছে দুই তিন টা পাকা চুল। কানের লতী দুটো একটু ঝুলে গেছে দুল পড়তে পড়তে।
এখন কানে দুটো পার্লের টপস পড়া। ওটাও আমার পরিচিত।
বললাম, ওই কানের টপস দুটা কি ফরচুনঅফ থেকে কিনেছেন?
কোথা থেকে বললেন?
ফরচুনঅফ।
নাম শূনেনি। এটাও কি আপনার পরিচিত?
সত্যি কোথা বলতে কি ঠিক ধরেছেন।
দুই কাপ চা আর সাথে দুটো সমুচা রেখে গেলো অল্প বয়স্ক মেয়ে টা।
জিজ্ঞাসা করলাম, আরও কিছু অর্ডার দেবো কি?
বলল, না ডিপ ফ্রাইড জিনিস খুব একটা খেতে চাই না। মুখরোচক, কিন্তু সইতে পারিনা। হার্ট বার্ন হয়।
তারও হতো।
কি বললেন।
না কিছু না
ভদ্রমহিলা চা র পেয়ালায় চুমুক দিয়ে, হু,আহ্‌ হু,আহ্‌ করে উঠল।
গরম চা খাওয়ার অভ্যাস নেই? তাই কি?
ঠিক ধরেছেন। তা আপনার আর কি কি জিজ্ঞাসা করার আছে?
রাগ করলেন।
রাগ করলে তো আপনার সাথে এসে বসতাম না। কৌতুহল।
ঐ যে বললাম, আপনার ব্যাগ টা আমাকে আকর্ষণ করেছিল। একটু হাত দিয়ে দেখব কি?
ভদ্রমহিলা ব্যাগ টা এগিয়ে দিলেন। চোখের দৃষ্টি আমার মুখের দিকে।
আমি সাপের চামড়া দিয়ে বাধানো ব্যাগ টার উপর হাত বুলাতে বুলাতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
ভদ্রমহিলার ডাকে ফিরে এলাম। কি হোল? ঘোর কাটল?
জানেন এই ব্যাগ টাতে আমার অনেক স্মৃতি মেশানো।
এই ব্যাগ টা নয়, আপনার সেই ব্যাগটা। বেশ জমে উঠেছে। আপনি বলেন, আমি শুনি।
আর এক কাপ চা র অর্ডার দেই, কি বলেন?
মন্দ না।
হাত উচু করে ইশারায় জানালাম আরও দু কাপ চা দিতে।

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্র। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক বন্ধুর সাথে গিয়েছিলাম। কেন? আজ তা মনে করতে পারছিনা। বন্ধু উপরে চলে গেলো। আর আমি নিচের তালায় দোকান গুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। হঠাৎ ই চোখে পড়লো ব্যাগ টা। এতো বড় হোটেলের চকচকে পলিস করা দোকানে ঢুকতে সাহস হচ্ছিল না। আবার ব্যাগটার মোহ কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। বার কয়েক দোকানের সামনে পায়চারি করে একসময় সাহস সঞ্চয় করলাম।
ভিতরে ঢুকলাম। দোকানের কর্মচারী কে বললাম, ব্যাগ টা একটু দেখাবেন কি?
অনীচ্ছুক ভাবে ভদ্রলোক আমার সামনে রাখল। আমি ব্যাগটার উপর দু এক বার হাত বুলালাম।
ব্যাগ টা নেওয়ার মতো কেউ ছিল কি?
ছিল।
তারপর?
তারপর, আমি জানি ওটা আমার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে তবুও দাম টা জানলাম। এটাও জানি ব্যাগ টা কিনতে হলে আমাকে একটু অভাবের মধ্যে পড়তে হবে।
সামনের মাসের খাওয়ার জন্য বরাদ্দ যে স্কলারশিপের টাকা আছে ওটাই আমার সম্বল। ব্যাগ টা কিনলেও মাত্র চার পাঁচ দিনের মতো খাওয়ার টাকা আমার হাতে থেকে যাবে। ভাবলাম পরের টা পরে। ব্যাগ টা আমার চাই।
ভদ্রলোক কে বললাম, কাল এসে নিয়ে যাব।
ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে উঠিয়ে রাখল ব্যাগটা।
পরদিন এসেছিলেন?
এসেছিলাম, ভদ্রলোক হাসিমুখে কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে আমার হাতে দিলো।
ওকে বলে এসেছিলাম আজ তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবো।
সারপ্রাইজ হয়েছিল কি?
ভীষণ।
আর আপনার খাওয়া? মাত্র তো তিন চারদিনের টাকা ছিল।
সে আরেক কাহিনী। খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিলাম। তাতে করে কিছু টাকা এক্সট্রা থাকল। এমন সময় দেশের রাজনৌতীক রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিলো। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দাওয়া হোল। আমি বাসায় চলে এলাম। খাওয়ার কথা চিন্তা করতে হলনা।
এতো দেখছি রীতিমত সিনেমার গল্প।
বলতে পারেন। জানেন, ব্যাগ টা ঠিক আপনারই মতো এই ভাবে কখনও ঝুলিয়ে কখন কাঁধে নিয়ে হাঁটত সে।
আমার কথা শেষ হতেই ভদ্রমহিলা পিছনের দিকে তাকাল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
তারপর তাকাল আমার চোখের দিকে।
কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো। দুজনের কারো মুখে কোন কথা নেই।

সেই কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আমিই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এবার বলুন আপনার কথা। কোথায় থাকেন?
সাফক কাউন্টী তে।
আর কেউ আছে কি?
ওর সাথে সেপারেসনে আছি।
কেন ?
কোন উপায় ছিলনা। পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল। চলে এলাম । সেই সময় কম দামে ছোট্ট একটা জায়গা পেয়ে গেলাম ,কিনে নিলাম। ওখানেই একটা রুম ওরা আমাকে বানিয়ে দিয়েছে আমি দিব্যি আছি।
একেবারে একেলা।
না তা নয়। আসে পাশে দুই একজন বন্ধু বান্ধবী আছে। ওদের সাথে কথা বলে সময় কাটে।
আপনাকে বলতে অসুবিধা নেই, ও প্রতি সপ্তাহে এক গোছা লাল গোলাপ নিয়ে দেখা করতে আসে।
এই যে বললেন সেপারেসনে আছেন।
ভদ্রমহিলা হাসল, “ সে তো বাহিরে, মনের দিক থেকে তো নয়”।
বাহ্‌, বড় রোম্যান্টিক মনে হচ্ছে?
আসলে তাঁই।
ওয়েট্রেস এসে জিজ্ঞাসা করল, আরও কিছু লাগবে কি?
ভদ্রমহিলা তাকাল আমার দিকে, বলল, সরপুঁটি দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু হাতে সময় নেই। আমার শেষ ট্রেন তিনটা একচল্লিশে।
তাহলে উঠতে হয়।
দীর্ঘও একটা নিশ্বাস ফেলল ভদ্রমহিলা। চোখের কোণটা কালচে মনে হোল। কাজলের দাগ নাকি ঘুমের অভাব, জানিনা।
রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম দুজন।
ও এগিয়ে গেলো।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম আবার দেখা হবে কি?
ঘাড় ফিরে তাকাল সে, মুখে হাসি, আমি থমকে গেলাম হাসি দেখে, বলল সে, দেখা হবে রোববারে।

রোববারে?
অসহ্য শব্দ কান ঝালাপালা করে দিলো। চোখ মেলে চাইলাম। অ্যালার্ম টা বাজছে। রাত তিনটা বিশ। সেহেরী খেতে হবে।
তিনটা একচল্লিশ, খাওয়ার শেষ সময়।
ওর কথাটা বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরতে থাকলো,
দেখা হবে রোববারে।

Continue Reading