ডায়রির পাতা থেকে ১১


ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। আসলে স্বপ্নটাই  আমার ঘুমটা কে ভেঙ্গে দিলো। এতকাল পরে লুতু ভাই কেনও আমার স্বপ্নের মাঝে দেখা দিলো তা জানিনা। সে বলে গেলো, তুই নাকি ইদানীং ছাই ভস্ম কি সব লিখছিস। তা আমাকে নিয়ে লেখ না।

ঐ পর্যন্ত।

তারপর সে হারিয়ে গেলো। আমি উঠে বসলাম। সকাল হয়ে এলো। আমি কফির পানিটা বসিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। সামনে লাল গোলাপের ঝারে দুই তিনটে চড়ুই পাখি কিচিরমিচির করে দৌড়িয়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় লোকেদের আনাগোনা এখনও নেই। আজ বন্ধের দিন।

কফিটা হয়ে গেছে। সকালে বাসি মুখে কফির সাধই আলাদা। উঠে গেলাম। কফিটা এনে হেলান দেওয়া চেয়ারে বসতেই দেখতে পেলাম চড়ুই পাখি গুলো কোথায় যেন চলে গেছে।  কিচিরমিচির শব্দ আর নেই।

আমি একেলা। না একেলা নই। সঙ্গী আছে একটা ঘুঘু পাখি। আমার সামনের লনে ভয়ার্ত নেত্রে তাকাচ্ছে চারিদিকে। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল আমার দিকে। তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নেড়ে মাটিতে ঠোকর দিতে থাকলো।

ঘড়ির কাঁটা ছটা ছুঁইছুঁই করছে। মন চাইছে সতীকে কল করতে। এতো ভোরে সে উঠেনি। ফোন করাটা ভদ্রতা নয় জানি। তবুও।

লুতু ভাই। লুতু ভাই দেখা দিয়ে চলে গেলো। লুতু ভাইয়ের কথা আমি বলতে চাই সতীকে। দেরী করে নয়। তাহলে সব হারিয়ে যাবে আমার মন থেকে। বলতে চাই তার  রিক্সা চালানোর কাহিনী, তার হারিয়ে যাওয়া হাতটার কথা। আয়েশা ভাবীর কথা। ছোট্ট এক চিমটে ঘরে সুখের আলো ছড়িয়ে পড়ার কথা। সেই ডাক, “ ও ছোট বাবু—-“।

“এতো ভোরে কেনও কল করেছ? সব ঠিক তো”? সতীর ঘুম থেকে জাগা কণ্ঠস্বর।

আমি তোমাকে লুতু ভাই এর কথা বলব। তুমি এসো।

কে লুতু ভাই, কোন লুতু ভাই? ওর কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর। উৎকণ্ঠার সুর।

মাঝে মাঝে সে বিরক্ত হয় আমার উপর, আমার উদভট সব আবদারের জন্য। কিছু বলে না সে। মেনে নেয়।

আজ ও তাঁই হোল।

বললাম নাস্তা করবে এখানে এসে।

যদিও তার নাস্তা তাকেই বানিয়ে নিতে হবে তা সে জানে। আমি শুধু চা র পানিটা বসিয়ে দেবো।

চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে চলে এসেছে সে। মেকাপের কোন বালাই নেই। এসেই সোজা রান্না ঘরে। কোথায় কি থাকে সে জানে।

বললাম, তোমার একটু অসুবিধা হোল, তাঁই না? হাজার হলেও বন্ধের দিন।

অমলেট টা বানাতে বানাতে বলল, আমার অসুবিধা হলে আমি কি আসতাম? থাক সে কথা, বাহিরে বসে  আমি শুনতে চাই তোমার লুতু ভাই এর কথা। তুমি যেয়ে বস। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি ওখানে।

শুধু তার নাস্তা নয়, আমার জন্য এক কাপ কফি এনে বসলো সে তার পরিচিত চেয়ার টায়।

তাকাল সে।

এবার আমার পালা।

শোন।

ও ওর হাতের থালাটা নামিয়ে রাখল কফি টেবিলের উপর।

বলও।

জানো, জন্ম থেকে আমি দেখছি লুতু ভাইকে আমাদের বাসাতে।

সে কি তোমাদের বাসাতে কাজ করতো ? জিজ্ঞাসা করলো সতী।

না, কাজ করতো বাবার অফিসে। কেউ ছিল না তার। শুনেছি, একদিন বাবার অফিসের সামনে এসে বসে ছিল। বাবা অফিস থেকে বের হবার পথে ওকে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল এখানে সে বসে আছে কেন।

উত্তরে বলেছিল তার একটা কাজ দরকার।

বাবার কি মনে হয়েছিল জানিনা, দুদিন পরে আসতে বলেছিল। এই দুদিন বাবা তার বসের সাথে কথা বলে চাকরির একটা ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সেই তার শুরু। কাজের শেষে আমাদের বাসাতে আসতো। মা কে ডাকতো মা বলে।

থাকতো দুরেরে এক গ্রামে। নাম তার পরানপুর। বাবার ভিটেতে এক ছোট্ট ঘর। সেটাই তার মাথা গোঁজার জাগা।

মা বলতো, লুতু তুই আমাকে পান এনে দিতে পারবি বাজার থেকে।

না করে নি।

আমাকে কাঁধে করে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো।

মা বলত, দেখিস ও যেন পড়ে না যায়।

তোমার তখন বয়স কত? সতীর কৌতূহল।

তিন কি চার।

আর ওর বয়স।

হয়তো বিশ। রাতের খাওয়া শেষে সে তার সাইকেল নিয়ে চলে যেতো পরানপুরে। মা সকালের খাওয়ার জন্য কিছু বেঁধে দিতো।

আমাকে ডাকতো সে ছোট বাবু বলে। বলতে পারো  লুতু ভাই এর কোলে চড়ে চড়েই আমি একদিন বড় হয়ে গেলাম।

মা একদিন লুতু ভাই কে ডেকে বলল, ওরে লুতু তোর তো এবার বিয়ে করা দরকার। মেয়ে খুঁজবো?

লুতু ভাই সলজ নয়নে মার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাখল। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।

তুমি বিয়ে করবে লুতু ভাই? বলতেই সে বলে উঠল,

ধ্যাত। চল বাজারে যাই, মার জন্য পান আনতে হবে।

একদিন সত্যি সত্যি মা লুতু ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্তা করল। দুরের এক গ্রামে। আমরা সবাই মিলে গেলাম মেয়ে দেখতে। বাবা গেলো না। বলল, তোমরা যাও, সাথে করে মিষ্টি নিয়ে যেও।

লুতু ভাইয়ের পরনে মার দেওয়া সাদা পাঞ্জাবি। ঘোড়ার গাড়ীতে করে আমরা যাচ্ছি।

কেন? আর কোন যান বাহন ছিলনা? প্রশ্ন করে সতী তাকাল আমার দিকে।

জানো, কোন সালের কথা আমি বলছি? পঞ্চাশ দশকের। সেই সময়ে গ্রামে যেতে হলে হয় গরু গাড়ী নয়ত ঘোড়া গাড়ী।

এবার শোন।

তোমাকে কি আর এক কাপ কফি এনে দেবো।

না, এখন নয়।

বল, তারপর?

লুতু ভাইয়ের পাশে আমি বসা। মা পিছনে। সাথে মার বান্ধবী, পশু ডাক্তারের বৌ, আমেনা খালা।

লুতু ভাই আমার কানে কানে বলল, ছোট বাবু, তুই কিন্তু সব সময় আমার পাশে থাকবি।

আমরা পৌছালাম। মাটির তৈরী ঘর। মুরগী, ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে উঠানে। একটু দূরে হাত চাপা পানির কল, তারি পাশে একটা কুয়া। একটা ছোট মেয়ে কুয়া থেকে পানি উঠিয়ে গোসল করছে।

আমরা এসেছি ভর দুপুরে। ছোট্ট ঘরে একটা খাট পাতা। সেই খাটে আমরা সবাই বসলাম। মা আর লুতু ভাই সামনে, আমি আর খালা পিছনে।  মেঝেতে মাদুর পাতা।

মেয়ের খালা মেয়ে কে নিয়ে এলো। হলুদ শাড়ী পড়া। পায়ে আলতা। মুখে পাউডারের ছোপ টা একটু বেশি। মাটির দিকে মাথা নুইয়ে বসলো সে মেঝেতে।

তুমি মেয়েদের এই আলতা, পাউডার এতো সব জানলে কি ভাবে। ইঁচড়ে পাকা ছিলে তুমি। তাই না?

বড় ব্যাগরা দাও কথার মাঝে। তখন আমার বয়স কত জানো? তেরো কি চোদ্দ। কাজেই—

সতী হাসতে হাসতে বলল, ঠিক আছে। এবার বলও। আমি খুব টেনশনে আছি।

মাথা নুইয়ে বসলো সে মেঝেতে। মা নেমে এলো। থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উচু করে ধরল।

কিরে লুতু পছন্দ হয়? অল্প হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো লুতু ভাই কে।

লুতু ভাই মাথা নাড়াল।

দুমাস পরে লুতু ভাই বিয়ে করে নিয়ে এলো আয়েশা ভাবী কে সেই ছোট্ট ঘরে। আমি এলাম দেখতে। লুতু ভাই ভাবীকে ডেকে বলল, উনি আমাদের ছোট বাবু, তোমার এক মাত্র দেবর। খুব আদর যত্ন করবে। কোন ত্রুটি যেন না হয়।

ভাবী এসে আমার মুখ টা উচু করে ধরে বলল, বাহ, বেশ মিষ্টি চেহার। কি বলে ডাকব, ছোট বাবু?

আমি লজ্জা পেলাম, মা ছাড়া এই প্রথম কোন মেয়ের হাতের স্পর্শ আমার মুখে লেগেছে।

কি ব্যাপার ছোট বাবু, তোমার গাল টা তো লাল হয়ে গেছে। বলে হাসতে হাসতে আমার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।

আমি চলে এলাম। ওরা দরজায় ছিটকেনি উঠিয়ে দিলো।

আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম বোর্ড পরীক্ষা নিয়ে। মাঝে মাঝে লুতু ভাই আর ভাবী আসতো আমাদের বাসায়। ভাবী মার সাথে কথা শেষে আমার ঘরে এসে বসতো আমার পাশে। চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, কেমন আছো ছোট বাবু। অনেক দিন তুমি আসো না আমাদের বাসায়।

ওদের ওই ছোট্ট বাসাতে আমি গেছি। মনে হতো একটা সুখের নীড়। কিছুই নেই ঘরে। অথচ ওদের দেখে  মনে হতো সব কিছুই আছে ওদের। নেই কোন অভাব নেই কোন অনটন।

একদিন বাবা বাসায় এসে মা কে বলল, জানো, লুতু কাজ ছেড়ে দেবে।

কেন? মা আকাশ থেকে পড়ল।

ও রিক্সা কিনবে।

মা বলল, তাতো ভালো কথা। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবে। ওকে বলবেন আমার সাথে যেন দেখা করে।

পরদিন এসে মা কে সালাম করে বলল, মা আপনে হবেন আমার রিক্সার প্রথম যাত্রী।

সতী জিজ্ঞাসা করলো, তারপর?

জানো সতী সুখ বড় ক্ষণস্থায়ী।

কেন বলছ? ওদের কি কিছু হয়েছিল?

তবে শোন—

আমি তখন স্কুল শেষে দূরের কলেজে চলে গেছি পড়তে। একদিন একটা চিঠি এলো মার।

 লেখা, পারলে বাসাতে এসো, কথা আছে।

এই টুকুই লেখা।

পরদিন ট্রেনে চেপে চলে এলাম। মা বাবার মুখ গম্ভীর। জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? কিছু বলছ না কেন?

বাবা বলল, একটা রিক্সা করে মা কে নিয়ে লুতুর বাসায় যাও। তাহলে সব জানতে পারবে।

সারা পথ মা চুপ, আমিও ভয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করছি না।

রিক্সা এসে থামল। মা কে নামিয়ে এসে দাঁড়ালাম উঠানে। সেখানে ভাবী আলুথালু বেসে বসা। মা এগিয়ে গেলো।

মার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকলো ভাবী।

আমি কিছুই বুঝলাম না। ঘরের দরজা খোলা। পা দিলাম। মেঝে তে লুতু ভাই শোয়া। একপাশ ফিরে। গায়ে চাদর উঠানো।

আমাকে দেখে বলল, এসেছিস ছোট বাবু, বস।

বললাম, তোমার রিক্সা তো বাঁধা দেখলাম, কি হয়েছে বলত? জ্বর?

কোন কথা না বলে চাদর টা সরিয়ে দিলো শরীরের থেকে।

আমি তাকিয়ে রইলাম। কনুই থেকে শুধু একটা কাপড় ঝুলছে।

আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। আমি চেপে ধরলাম কনুই টাকে। ঝুলে পড়া কাপড় টাকে মুচড়িয়ে হাতের মধ্যে নিয়ে এলাম। মনে হোল ওটাকে টেনে ছিড়ে খণ্ড খণ্ড করে ফেলি।

তুই কাঁদিসনে ছোট বাবু। আমি আবার দাঁড়াব। এক হাতে রিক্সা চালাবো। শালা, ঐ ডাক্তার, ছোট্ট একটা ফোড়া কাটতে যেয়ে হাত টাকে বিষাক্ত করে ফেলে ছিল। গেংগীরীন হয়ে গেল। কোন উপায় ছিল না। কেটে ফেলতে হলও।

কান্না চেপে বললাম, তুমি  আবারো দাঁড়াবে লুতুভাই, আমি তোমার এক হাতে চালানো রিক্সায় উঠব।

উঠেছিলাম। সেই শেষ উঠা। আমাকে  নিয়ে ঘুরে ছিল সারা শহর। শুধু দুর পাল্লায় যেতে পারত না। মনের বল। শুধু তারই জোড়ে চলতো সে।

বাবা মা একদিন সেই শহরের মায়া ছেড়ে চলে এলো রাজধানী তে। আমি সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলে এলাম এদেশে।

তারপর?

অনেক বছর পরে আমি গিয়ে ছিলাম ঐ পরানপুরে। সেই বাসা আর নেই। চারিদিকে জঙ্গলে ভরা। দেখা হোল আমার বন্ধু মতলেবের সাথে। জিজ্ঞাসা করলাম লুতুভাই এর কথা। চিনতে পারলো না।

বললাম, এক হাতের রিক্সা চালক।

বলল সে নেই। একদিন রিক্সা নিয়ে চলেছিল দূরপাল্লায়। ক্লান্ত সে। দ্রুত ছুটে আসা দৈত্যের মতো ট্রাক ধাক্কা দিয়ে চুরমার করে দিলো ওকে ওর রিক্সাকে।

আর ভাবী মানে লুতু ভাইয়ের বৌ কোথায় জানিস।

না। এখান থেকে চলে গেছে। কোথায় কেউ জানেনা।

আমি ফিরে এলাম।

জানো সতী, দেখা হলে বলতাম, “ ভাবী, যাবে তুমি ছোট বাবুর সাথে, যাবে কি”?

Continue Reading