৭ই এপ্রিল
Iceland থেকে গতকাল ফিরে এলাম। পাঁচ দিন চর্কির মত ঘুরেছি। দেখেছি প্রান ভরে। তাই ভাবলাম সব কাজ ফেলে আজ বিশ্রাম নেবো। কিন্তু বিঁধি বাম। ফোনটা বেজে উঠল। ওটা বন্ধ করে রাখব ভেবেছিলাম। তা করলেই ভালো হতো।
অন্যমনস্ক ভাবে হ্যালো বলতেই বুজতে পারলাম এখন আর রেখে দেবার কোন উপায় নেই।
আমি ইয়াসমিন। বলে চুপ করে রইল।
বললাম, কোথায় তুমি। সেই যে মাস খানেক আগে কল দিয়েছিলে, আসবে বলে, তা কবে আসবে?
এসেছি, আমি JFK এয়ারপোর্টে। অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। আগের থেকে বললে কোন একটা অজুহাত হয়তো দিতে। তাই নিউইয়র্কের মাটিতে পা দিয়েই তোমাকে কল করলাম। আসছ তো নিতে?
আমার মাথায় বজ্রাঘাত। এই মুহূর্তে ইয়াসমিনের সান্নিধ্য আমার কামনা নয়। আমি চেয়েছিলাম বিশ্রাম তার পরিবর্তে- যাক তা যখন হবার নয়, বললাম, তুমি অপেক্ষা কর আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে ডেল্টা টার্মিনালে আসছি।
ভাবনা আমাকে পেয়ে বসল। সেই কম বয়সে দেখা ইয়াসমিনের সাথে আজকের ইয়াসমিনের কতটুক পার্থক্য আমার জানা নেই। সতী এই মুহূর্তে গেছে মেয়ের কাছে। সে থাকলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারতো।
অগত্যা উঠতে হোলও। আধা ঘণ্টার পথ। মাঝ পথে আসতেই সতীর কল পেলাম।
কোথায় তুমি?
এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছি?
এয়ারপোর্টে কেন? কাকে ড্রপ করবে?
ড্রপ নয়, আনতে যাচ্ছি।
কাকে?
ইয়াসমিন কে।
What?
নামটা শূনে একটু চমকিয়ে উঠলে মনে হোলও? মুখ টিপে হেসে বললাম কথা টা।
এই কথা শোনার পরে ওর চেহারার পরিবর্তনটা আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম।
ইয়ার্কি মারছ?
মোটেও না। সত্যি বলছি। তুমিও এখানে নাই, কাজেই আমার এপার্টমেন্টেই নিয়ে আসতে হবে। বেশ ভালোই কাটবে দিনগুলো। কি বলও?
রাগাতে চাইলাম ওকে।
সতী ঐ পথ দিয়ে গেলনা। বলল, শুভঙ্কর দা কে কল করো। ওখানে থাকার ব্যবস্থা করো।
বললাম, তা হবার নয়। সে দু চার দিনের জন্য রোডআইল্যান্ড এ গেছে। তুমি আসবে কবে?
ভেবেছিলাম আরও কিছুদিন থাকব। তা বোধ হয় হবেনা।
তা হলে আজ রাত আমার এখানেই থাকবে, গল্প করে কাটিয়ে দেবো? কি বলও?
ফাজলামি রাখো।
হাসতে হাসতে বললাম, এখনও চিনলে না আমাকে।
এই পর্যন্তই তার সাথে আমার কথা হোলও।
পৌছালাম এয়ারপোর্টে। চোখে কালো চশমা, শালওয়ার কামিজের রঙের সাথে মেলানো স্যান্ডেল, হাত ব্যাগ। একটু মুটিয়েছে মনে হোলও। হয়তো বয়সের জন্য।
এই মুহূর্তে ভিড় অতটা নয়। ওর খুব কাছে এসে দাড় করালাম গাড়ীটা। কাছে আসতেই হাসি দিয়ে বলল, এলে তাহলে।
মুখে হাসি এনে বললাম, আমি তো ভদ্র ঘরের সন্তান, তোমাকে তো এয়ারপোর্টে ফেলে রাখতে পারিনা।
আসলে আমি তাই চেয়েছিলাম সে কথা সে জানতে পারলো না।
গাড়ীতে উঠতে উঠতে বলল, তুমি একটুও পাল্টাওনি দেখছি। শুধু চোখের চশমাটা ছাড়া।
চলার পথে কথা সেই বলতে থাকলো। তার নিজের কথা। আমি শ্রোতা।
অনেক পিছনে চলে গেলো সে, প্রথম স্বামী ছিল মাতাল। সরকারের কোন এক ডিপার্টমেন্টে উঁচু পদে কাজ করত।
কাজের শেষে ক্লাবে যাওয়া ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার। অনেক রাতে ফিরে আসতো মাতাল হয়ে। চেষ্টা করেছিল পথে আনার।
পারেনি। ফলে ইতি টানতে হয়েছিল তিন বছরের শেষে।
বললাম। আবারো ঐ পথে পা দিয়েছিলে ?
দিয়েছিলাম।
অনেক দিন একা একা ছিলাম, হঠাৎ আমার এক বান্ধবীর বাসাতে ওর ভাই এর সাথে দেখা। সেই ছিল আমার জীবনে দ্বিতীয় জন। অতি ভদ্র। এক মেয়ে এলো আমাদের জীবনে। ওকে মানুষ করে দিয়ে যেতে পারলো না, তার আগেই ধরা পড়ল ওর লিভার সিরোসিস। দুবছর কষ্ট করে চলে গেলো। বলতে বলতে চোখটা মুছে নিলো। আমরাও এসে পৌছালাম আমার এপার্টমেন্টের কাছে।
দরজা খুলে দিলাম। ও ভিতরে ঢুকল।
দেখছ তো, ছোট্ট এক চিমটে কামরা। তোমার হয়তো অসুবিধা হবে। সতী এলে ওর ওখানে থাকতে পারবে।
সতী, সতী কে? কৌতুহল নিয়ে তাকাল সে আমার দিকে।
আমার এক বান্ধবী।
কেন? তোমার এখানে থাকতে দেবেনা? ওর গলার স্বরে ব্যাকুলতা।
আমার আপত্তি কোথায়, আপত্তি ঐ লোকজনের।
এখনও ওই ঘুনে ধরা সমাজ নিয়ে আছো?
আমিতো ছাড়তে চাই, আমাকে ছাড়তে দেয়না।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “ আচ্ছা, তুমি তো প্রতাপের কথা শুনতে চাইলে না”।
জিজ্ঞাসা করতাম, সময় আর সুযোগ বুঝে। তা তুমিই যখন ঐ নাম টা উঠালে, বলও কি হয়েছিল।
প্রতাপ কে আমি কোন সময়ই ভালবাসিনি শমিত। ওকে আমি শুধু ব্যবহারই করেছি আমার নিজের স্বার্থে। যখন সে বুঝতে পারলো তখন নিজে থকেই সরে গেলো। শুনেছি দেশের বাহিরে কোথাও আছে। বড় ভালো ছেলে ছিল।
তুমি জানো কি, কোথায় সে?
না জানি না।
দেখে মনে হোলও ক্লান্ত সে। মানসিক না শারীরিক বুজতে পারলাম না।
ক্লান্ত শরীর টাকে সোফাতে এলিয়ে দিলো , পা দুটো উঠিয়ে দিলো কফি টেবিলের উপর।
বললাম, সাওয়ার নিয়ে এসো, আমি খাবারের অর্ডার দেই। মেডিটেরানিয়ান খাবার খেতে পারবে তো?
অভ্যাস নেই তবে অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না।
খাওয়া শেষে সে গেলো বিশ্রাম নিতে শোবার ঘরে। আমি ড্রয়াইং রুমে বসে টিভি টা অন করলাম। কখন যে চোখ টা বুজে এসেছিল বলতে পারবো না। ঠক ঠকানো শব্দে ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো। টিভি টা তখনো চলছে।
দরজা খুললাম। সজীব আর তার বৌ, অনীমা।
কি ব্যাপার? অসময়ে? ভিতরে এসো।
এসে বসল। ওরা থাকে আমার দুই ব্লক দূরে। হঠাৎ পরিচয় হয়েছিল Costco তে বাজার করতে যেয়ে। বয়সে অনেক ছোট ,কিন্তু সম্পর্ক টা বন্ধুত্তের পর্যায়ে।
“শমিত দা তৈরী হয়ে নেন টম ক্রুজের নতুন মুভি এসেছে দেখতে যাবো”। বলেই অনীমা তাকাল আমার শোবার ঘরের দিকে। ওর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে আমি তাকালাম পিছনে। ইয়াসমিন এসে দাঁড়িয়েছে।
সরি শমিত দা, আমি জানিনা যে আপনার গেস্ট আছে। অত্যন্ত লজ্জিত স্বরে বলল অনীমা।
সরি হবার কিছু নেই। পরিচয় করিয়ে দেই, আমার কলেজের বান্ধবী। আজি এসেছে সানফ্রান্সীস্ক থেকে। যদি টম ক্রুজের নতুন মুভির পরিবর্তে কফি আর ঝালমুড়ি মুখরোচক মনে হয় তবে এখানে বসো, আমি কফির পানি চাপিয়ে দেই। কি বলও?
সজীবের কিছু বলার আগেই অনীমা বলল, আমি রাজি, আর ইয়াসমিন আপার সাথে গল্প করে সময় টা বেশ কাটবে।
বললাম, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সতী ও এসে হাজির হবে, টেক্সট পাঠিয়েছিল।
অনীমা আর ইয়াসমিন কফির পেয়ালা নিয়ে বসলো ব্যাল্কনীতে। কি নিয়ে কথা ওদের মাঝে বুঝলাম না তবে হাসির উচ্ছল বন্যাতে মনে হোল টপিকস টা তাদের দুজনেরই পছন্দ।
সজীব ফাইনেন্সে পাশ করে একটা বড় হেজ ফাণ্ডে কাজ করে। ফলে আমাদের আলোচনা স্টক নিয়ে। বড় বড় কোম্পানির আরনীং রিপোর্ট কি হতে পারে তাই নিয়ে। সময় কাটানো। সময় অবশ্য কেটেও গেলো। পেড়িয়ে গেছে দুই ঘণ্টা।
অনীমা ব্যাল্কনীর দরজা খুলে এলো লিভিং রুমে।
“ শমিত দা, ইয়াসমিন আপাকে বলছি আমাদের ওখানে যেয়ে থাকতে, কিন্তু রাজি হচ্ছে না”।
আমার মনে হোল ওকে বলি আর একটু পীড়াপীড়ি করো। হয়তো রাজি হতে পারে। কিন্তু হলনা।
ওরা বিদায় নিলো।
আমি আর ইয়াসমিন এসে বসলাম সোফাতে। দূরত্ব বজায় রেখে। ইয়াসমিন তার মোটা ফ্রেমের চশমাটা মুছতে মুছতে বলল,
“আচ্ছা শমিত তুমি আর ও পথে পা বাড়ালে না কেন?”
“ কারন যা পেয়েছিলাম সেটাকে হারাতে চাই না বলে”।
“ যদি বলি এটা তোমার ভুল ধারনা। মানুষ অতীতে কে নিয়ে বাচে না, তা জানো তুমি?”
“ আমি হয়তো বা ভিন্ন ওদের চেয়ে”।
জানো শমিত, আমি— , কথা শেষ হোল না, দরজায় একবার টোকা পড়ল। আমি উঠতে যাওয়ার আগেই দরজা খুলে গেলো। সতী দাড়িয়ে।
সময়ের আগেই চলে এলে। মেয়ে বাধা দিল না? আমার জিজ্ঞাসা।
বাধা যে দেয়নি তা নয়, কেনও জানি ভাবলাম চলেই যাই। অনেকদিন তো হোলও।
সতী তাকাল ইয়াসমিনের দিকে।
আপনিই সতী? বলে ইয়াসমিন উত্তরের অপেক্ষায় রইল।
আমি মনস্তাত্ত্বিক নই। কাজেই দুজনের মনের গভীরতাতে যেয়ে ঘুরপাক খাওয়া আমার সইবে না।
বললাম, “তোমরা দুজনে কথা বল, পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার আছে বলে মনে হয় না। আমি ঐ ঘরে বসে হাতের কাজ গুলো শেষ করে নেই”। দরজা খোলা রইল।
শমিত বলেছিল আপনার কথা। ওর কথা বলার সাথি। শূনে খুব ভালো লাগলো। আরও বলছিল, আপনার কাছে যেয়ে থাকতে। বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ইয়াসমিন।
সতী একটু এগিয়ে এসে বলল, তাই তো আমি তাড়াতাড়ি চলে এলাম। দুজনে মিলে অনেক গল্প করা যাবে। কি বলেন?
কিন্তু আমার তো যাওয়া হবে না বোন।
সতীর চোখে অবিশ্বাসের ছাপ। কেন? প্রশ্ন করলো সে।
আমি এসেছি শমিতের সাথে কিছুদিন কাটিয়ে যেতে। হয়ত ওর সাথে আমার আর দেখা নাও হতে পারে। এই দেখাই হয়তো শেষ দেখা। বলে সে তাকাল খোলা দরজার দিকে।
যাক, তোমাকে বলি, কেনও জানি মনে হচ্ছে তুমি আমার অনেকদিনের চেনা। শমিত কে বলও না। মনে থাকবে?
থাকবে। বলেন। সতী উৎসুক ভাবে তাকালও ইয়াসিনের দিকে।
এসে ছিলাম চিকিৎসা করাতে। তা আর হোলও না।
কিসের চিকিৎসা ?
Bone marrow transplant করতে। ডাক্তার বলল, করা যাবে না। কাজেই আমার হাতে আছে মাত্র চব্বিশ থেকে ছত্রিশ মাস। তাই ওকে দেখতে এলাম। ওর সাথে কয়টা দিন কাটিয়ে যাই।
সতী তাকিয়ে রইল ইয়াসমিনের দিকে। কোন কথা নেই মুখে।
তোমার কাছে তাই থাকা আমার হোলও না।
আমি বেড়িয়ে এলাম। দুজনের চোখ ভেজা। কোন কিছু বোধগম্য হলনা।
সতী বলল, ইয়াসমিন আপা তোমার কাছেই থাক যে কয়দিন আছে। আমি প্রতিদিন এসে দেখে যাবো।
আমি তাকালাম সতীর দিকে।
চোখ ফেরাতেই আয়নায় দেখলাম ইয়াসমিনের ঠোটের নিচে রহস্যের হাসি।