ডায়রির পাতা থেকে ১৩

১৪ ই এপ্রিল

ছয় মাস হয়ে গেলো, বশীর বলেছিল তার জীবন বৃত্তান্ত।

 পাঁচ বছরের শোভন।  ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকতো বাবার দিকে। ভুলে গিয়েছিলাম ওদের কথা।

একদিন  টিভির পর্দায়  দেখলাম বোমার আঘাতে বাম হাত হারানো সৈনিক বলছিল তার কাহিনী।  তখনি মনে পড়লো হাতকাঁটা বশীরের কথা।

না সে সৈনিক নয়। লোকে তাকে বলে হাতকাটা ভিখারি। ভিক্ষা করে।

শান্তিনগরে টুইন টায়ারের সামনে প্রতিদিন সকালে আমি তাকে দেখতাম। দারোয়ান গেট খুলে দিতো। গাড়ীটা বের হতেই জানালার কাছে এসে দাড়াত সে। আমি যৎসামান্য টাকা ওর হাতে দিতেই হাসি দিয়ে সরে যেতো।

হাত পাততো  অন্যের কাছে যেয়ে। এমনি ভাবে চলছিল দিন গুলো।

হঠাৎ একদিন ও এলো না, ওকে দেখলাম না গেটের পাশে। বুকের ভিতরে খচ করে উঠল। ওর সাথে হয়ত নিজের  অজান্তেই একটা যোগসূত্র হয়ে গিয়েছিল। তা নাহলে মন খারাপ লাগবে কেন?

গাড়ী থেকে নেমে দারোয়ান কে জিজ্ঞাসা করলাম সে ওকে আজ দেখেছে কিনা।

বলল, দেখেনি।

পরদিন সকালে এলিভেটর দিয়ে নিচে নামার আগে বোন ডাক দিল। “ ছোট দা, কোথায় যাচ্ছিস নাস্তা না করে?”

“ নিচের থেকে আসছি। আজ বের হবো না”। বলে বেড়িয়ে এলাম।

গেটের বাহিরে আসতেই দেখি সে দাড়িয়ে।  আমাকে দেখে এগিয়ে এলো।

“ সালাম স্যার”। বা হাতটা কপালে ঠেকাল। ডান হাত টা কনুই থেকে নেই। কথা বলার ভঙ্গি আর সালাম শব্দের উচ্চারণে মনে হোল পেটে তার বিদ্যা আছে। ভিখারি বৃত্তি এখন তার পেশা, কিন্তু এটাই তার পরিচয় নয়। কৌতুহল জাগলো।

টাকা টা দিতে দিতে বললাম, গতকাল তো তোমাকে দেখলাম না।

গতকাল ছিল আমার জীবনের মহা আনন্দের দিন।

তাই? তা সেই আনন্দটা কি নিয়ে।

উত্তর দিতে যেয়ে থেমে গেলো। সামনে এগিয়ে যেয়ে একজনের কাছে হাত পাতলো। যা পেলো পকেটে রেখে তাকালও সামনে, দৃষ্টি তার রাস্তার ওপারে।

আমি তার রুজীর ক্ষতি করছি ভেবে জিজ্ঞাসা করলাম, দিনে কি রকম পাও।

পরিমাণ শূনে মনে হোল আমি ঐ পরিমাণ তাকে দিতে পারবো।

বললাম, আমি তোমার জীবন বৃত্তান্ত শুনতে চাই। কেনও জানি আমার মনে হয়, এই পথ তুমি ইচ্ছে করে বেছে নেওনি। কি হয়েছিল? বলবে কি?

বলব।

রাজি হতেই বললাম, তোমার  আজকের দিনের ক্ষতিপূরণ টা আমি পুরন করে দেবো।

পাশের চা র দোকানে এসে বসলাম।

সেই মুহূর্তে দারোয়ান এসে বলল, স্যার আপা আপনাকে ডাকছে।

ঠিক আছে। বলে ফোন করলাম। বললাম, আমার আসতে দেরী হবে। তোরা নাস্তা করে নে।

দোকানে ঢুকতেই সে বলল, স্যার, জানলার কাছে বসতে চাই।

বা হাত দিয়ে কপাল টা মুছে বলল, আমার নাম বশীর। বি কম পাশ করে ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিলাম। আট বছর আগে। থাকতাম টিকাটুলি তে।  বৌ কাজ করতো স্কুলে। প্রতিদিন রিক্সা করে ওকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আমি চলে আসতাম কাজে।

আমাদের এক ছেলে। এখন বয়স ছয়। বড় দুষ্টু স্যার। নাম শোভন। ওর মা নামটা রেখে ছিল। তার নাম ছিল শান্তি।

বললাম, ছোট বেলায় সবাই দুষ্টু থাকে।

বলল, ও আমাকে একেবারে চোখের আড়াল হতে দেয় না।

কথা টা আমার বোধগম্য হলনা। ওর আসে পাশে আমি কোন ছেলে দেখিনি। তাহলে।

ঐ যে দেখছেন রাস্তার ওপারে, লাম্প পোস্টের নিচে বসা। ঐ আমার ছেলে। সাধারণত মাথা নিচু করে রাখে। দেখতে চায়না বাবা হাত পেতে বেড়াচ্ছে। অথবা ভাবে আমি লজ্জা পাবো ও তাকিয়ে দেখছে আমি হাত পাতছি কারো কাছে।

কোথাও রেখে আসলে পারো। বললাম বশীর কে।

ও থাকতে চায়না। পাছে আমিও হারিয়ে যাই।

ওর মা? প্রশ্ন করে তাকালাম বাহিরে । শোভন তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। ওকে দেখা যাবে সেইজন্যই সে জানালা টা বেছে নিয়ে ছিল।

বললাম, ওকে নিয়ে আসি, এখানে বসবে।

বলল, না, ও সামনে থাকলে আমি কথা বলতে পারব না। ওখান থেকেই আমাদের কে দেখতে পারবে।

আপনি শান্তির কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন।  শান্তির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে।  সে তখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ক্লাস শেষে দাড়িয়ে ছিলাম বাসের আশায়। দেখলাম সেও দাড়িয়ে। একিই বাসে উঠে নামলামও একি স্টপেজে।

পরদিন ও একি পুনরাবৃত্তি।

তৃতীয় দিন সাহস সঞ্চয় করে কাছে আসে বললাম, যদি কিছু মনে না করেন, আমরা বোধ হয় একি দিকের যাত্রী। একটা রিক্সা শেয়ার করলে একটু পয়সা বেশি পড়বে, তবে এই ঠেলাঠেলির হাত থেকে বাচা যাবে। কি বলেন?

আমার কপাল আর হাতের তালু ভিজে ভিজে মনে হোল।

সাহসের পরিচয় দিয়েছিলে বলব।

তা বলতে।

সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, যদি রিক্সা যোগাড় করতে পারেন বাস আসার আগে, আর শোনেন, এই টাকার বেশি আমি দিতে পারবো না, তাতে যদি রাজি থাকেন। টাকার পরিমাণ দেখে বুজলাম আমার গাঁটির থকে বেশ কিছু খসবে। জানেন তো

তখন টাকাটা মুখ্য নয়।

জানি, অভিজ্ঞতা আছে। তারপর।

রিক্সা পেলাম। উঠে পড়লাম। সেই শুরু।

পাশ করে চাকরি পেলাম। বিয়ে শাদীর পর্ব শেষ। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিলাম। সেও পাশ করে স্কুলে চাকরি নিলো।

শোভন এলো। ভালই যাচ্ছিল দিল গুলো।

শুধু আমার বাবা মা দুজনেই গত হলেন।

শাশুড়ি চলে গেলেন গ্রামের বাড়ীতে শ্বশুরের অবর্তমানে।

আমাদের যাওয়ার পথে শোভন কে নামিয়ে দিতাম ওর এক বান্ধবীর বাসায়। সেদিন দেরী হয়ে যাওয়াতে পাশের বাসার মহিলার কাছে শোভন কে রেখে গেলাম।

নিয়তির খেলা, কেউ জানেনা।

ঢাকা শহরে গাড়ী ঘোড়া কি ভাবে চলে তা তো আপনার অজানা নয়। হঠাৎই ফুট ফাট গুলীর শব্দ। লোকের দৌড়া দৌড়ি। যে যেদিক পারছে দৌড়াচ্ছে। কেউ কেউ রাস্তায় মাথা নিচু করে বসে পড়েছে। সেই মুহূর্তে পিছন থেকে একটা বাস ধাক্কা দিলো আমাদের রিক্সা কে। উল্টে গেলো রিক্সা। আমি শান্তি কে ধরতে যাওয়ার আগেই সে  ছিটকে পড়লো রাস্তায়। সেই মুহূর্তে একটা জীপ ধাক্কা দিল ওকে। আমি পড়ে যেয়ে ওর দিকে হাত বাড়াতেই জীপ টা আমার ডান হাতের উপর দিয়ে চলে গেলো। আমি চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। এই টুকুই আমি জানি।

যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম আমি হাসপাতালে। চাদর দিয়ে ঢাকা শরীর। জিজ্ঞাসা করলাম নার্স কে, আমি কোথায়?

বলল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে।

আমার স্ত্রী?

বলল, উনি হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে পারেনি তার আগেই মারা গেছেন। আপনার মানিব্যাগ থেকে ঠিকানা পেয়ে বাসায় খবর দেওয়া হয়েছিল। আপনার ছেলে আর প্রতিবেশী বাহিরে বসে আছে।

আমি উঠতে যেয়ে অনুভব করলাম আমার ডান হাত নড়ছে না। নার্সকে বললাম আমার গায়ের চাদর টা সরিয়ে দিতে।

দেখলাম, আমার ডানহাত টা কনুই থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। আমি কাঁদতে থাকলাম। শোভন আর বাবুলের মা, বাবা এলো আমার পাশে। কি আর সান্ত্বনা দেবে। জিজ্ঞাসা করলাম, শান্তি কে কি দাফন করা হয়েছে।

বলল, না, আপনি একটু সুস্থ হয়ে মৃত দেহ সনাক্ত করলে ওরা রিলিজ করবে। তখন দাফন দেওয়া যাবে।

বাসায় এলাম দুই সপ্তাহ পরে। শোভন শুধু কেঁদে বেড়ায়। ডান হাতটার অভাবে আমি কিছুই করতে পারিনা। মানসিক দিক দিয়ে ভেঙ্গে পড়লাম। নিজের চেহারা আয়নায় দেখলে ভয় পাই।

তুমি কাজে ফিরে গেলে না? জিজ্ঞাসা করলাম।

ওরা বলল আরও কিছুদিন বিশ্রাম নাও। টাকা পয়সার টানা টানি দেখা দিল। ফিরে গেলাম কাজে মাস খানেক পর।

ম্যানেজার ডেকে পাঠাল তার অফিস রুমে। তখনি মনে হয়েছে দিন আমার ফুরিয়ে এসেছে এখানে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তা বুঝিনি।

চাকরি টা চলে গেলো। ভদ্র ভাবে জানালো আমার কাজ টা আর আমার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। তাই টাকা পয়সা  সব বুঝিয়ে দিলো।

 তারপর? কোথাও কিছু হোল না?

না, কে দেবে চাকরি এই অক্ষম কে। টাকা যা ছিল আস্তে আস্তে শেষে হয়ে এলো। বাসা ছেড়ে দিয়ে বস্তীর এক ঘরে এসে ঠাই নিলাম। ছেলে টার দিকে চাইতে পারতাম না। মাঝে মাঝে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম।

একদিন এই বস্তীর একজন বলল, কি করবে ভায়া। ভিক্ষাবৃত্তি তে নেমে পড়ো। তোমাকে দেখলে লোকের সহানুভূতি হবে।

রেগে ওকে অনেক গালাগালি করেছিলাম।  কিন্তু পেটের জ্বালা বড় নিষ্ঠুর। ঐ জ্বালা মেটাতে এই পথে আসতে হোল।

যা পাই তাতে কোন রকমে চলে যায়।

দুই বছর হয়ে গেলো এই পথে। ছেলেটা কে কিছুঁই কিনে দিতে পারিনা।

ও দোকানের বাহিরে সুন্দর করে সাজানো জামা কাপড়, জুতো গুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।  কিছু বলে না। শুধু বলে, বাবা তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা।

আমি তাকালাম রাস্তার ওপারে বসা শোভনের দিকে। অজান্তেই চোখ টা জলে ভরে এলো।

জানেন স্যার।

ফিরে তাকালাম ওর দিকে। কি বলছিলে?

প্রতিদিন অল্প কিছু টাকা দিনের শেষে সরিয়ে রাখতাম এই ভেবে যদি কোনদিন সময় আসে ছেলেটাকে আমি ঐ সাদা জুতো টা কিনে দেবো। দুই বছর পরে ঐ দিন এলো।

রাতে ছেলেটা আমার অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তাকালাম ওর নিষ্পাপ মুখের দিকে।

লুকিয়ে রাখা গর্তের ভিতর থেকে টাকার ব্যাগ টা বের করে হিসেব করলাম।

সকালে উঠে শোভন কে বললাম, বাবা আজ আর রাস্তায় দাড়াবো না।

ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কেনও বাবা, তোমার শরীর খারাপ।

না, আজ একটা নতুন জিনিস তোমাকে দেখাবো।

হাটতে হাটতে আমরা আসে দাঁড়ালাম ঐ দোকানের সামনে । ছেলে আমার দৌড়িয়ে যেয়ে বাহিরের কাঁচে মাথা রেখে তাকিয়ে রইল ঐ সাদা  জুতো টার দিকে। পাশে এসে দাঁড়ালাম।

আমার দিকে চেয়ে বলল, চলো বাবা, তুমি না আমাকে কি দেখাবে বলেছিলে।

“হাঁ, ঐ  জুতো টা আজ  তোমাকে কিনে দেবো বাবা”। মনে হোল সে কিছুই বুঝতে পারলো না।

ভিতরে এলাম। দোকানের কর্মচারী জুতো জোড়া শোভনের পায়ে লাগিয়ে দিয়ে বলল, একটু হাটোতো খোকা।

শোভন হাটলও না, দৌড়াল।

পায়ে ব্যাথা পাচ্ছও?  জিজ্ঞাসা করল কর্মচারীটা

একটুও না। বড় বড় চোখ করে বলল সে। মুখে হাসি।

সেই মুহূর্তটা আমি আপনাকে বুঝাতে পারব না স্যার। শুধু মনে হোল, আমার জীবন সার্থক। ছেলের মুখে আমি হাসি দিতে পেরেছি।

 গত কাল শোভন ঐ জুতো পরে আমার সাথে গিয়েছিল শিশু পার্কে।

দৌড়ে দৌড়ে কখনও মেরী গো রাউন্ড কখনও দোলনা তে উঠছে। আর আমার দিকে তাকাচ্ছে। ঐ দিনটা ছিল আমার জীবনের বড় আনন্দের । ওর হাসি আমাকে ভুলিয়ে দিয়ে ছিল সবকিছু।

 রোজগারের খাতা শূন্য বলে মনে কোন আপসোস ছিল না।  এই দিনটা তো আর একবার আমার জীবনে ফিরে আসবে না। একটা দিনতো আমরা বাপ, ছেলে মিলে হাসতে পেরেছিলাম। এযে কত বড় পাওয়া তা শুধু আমি জানি।

বলে সে থামল। তাকাল লাম্প পোস্টের দিকে।

আমিও তাকালাম। দেখলাম, শোভন তার হাতদিয়ে জুতো টা মুচছে।

 

Continue Reading