যে কথা বলা হয়নি

শ্যামলী চলে গেলো। ঘরটা ফাকা। মেয়েটা আমার বুকের মাঝে একটা আঁচড় দিয়ে গেলো। বেশ তো ছিলাম। ছেলে মেয়েরা আসতো, দিনে দিনে চলে যেতো। এতো দিন ধরে তো কেউ থাকে নি আমার ঘরে।

 পান থেকে চুন খসতে দেয়নি। চশমা, ঘড়ি ঘুচিয়ে রাখতো। মাঝে মাঝে বলতো, শমিত কাকা ইদানীং  তুমি সব কিছু ভুলে যাচ্ছ। আমার কি ভয় হয় জানো?

কি?

না থাক। আমি ও কথা ভাবতে চাই না। শুধু উপরের ছিটকিনি টা লাগাবে না।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেনও রে?

বলেছিল, শুধু যা বললাম তাই শোন। আর তোমার কথা বলার একটা সাথি দরকার। ছেলে বন্ধু নয় মেয়ে বন্ধু। সতী খালা কে বলও মাঝে মাঝে এখানে চলে আসতে।

হাসতে হাসতে বলেছিলাম, শোন আমাদের সমাজ এখনও কুসংস্কার আর নীচমনা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। যদি দুই পা এগিয়ে কোন ভদ্র মহিলার সাথে কথা বলেছি অমনি সবার চক্ষু আমার দিকে। মনে হয় আমি যেন অস্পৃশ্য।

তোকে একটা ঘটনা বলি, আমার কয়জন বন্ধু আর বান্ধবী একদিন বেড়াতে গিয়েছিলাম।  সবাই দুজন করে  শুধু আমিই একা। হঠাৎ ই এক বান্ধবী কে বললাম, এসো তোমার সাথে সেলফী উঠাই। উঠালাম।  বললাম, ফেসবুকে দেবো।

সে হৈ হৈ করে উঠলো। বলল, না না দিও না। তোমার সাথে ছবি দেখলে লোকে অন্য কিছু ভাববে। বললাম কেন আগে তো উঠিয়েছো?

তখন তুমি দোকলা ছিলে, এখন একলা।

বুজতে পারছিস। কাজেই অনেক ভেবে চিনতে চলতে হয়।

কত কথাই না ওর সাথে বসে বসে বলতাম।

যাওয়ার সময় চোখ টা মুছে বলেছিল, আমাকে মাঝে মাঝে কল করবে তো।

বলেছিলাম, করবো, যা সামনের থেকে, আর মায়া বাড়াস নে।

মনের মধ্যে মাকড়সার জালের মতো  অনেক অনেক আগের ঘটনা গুলো ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। যা কিনা বলা হয়নি কাউকে।

মনে পরে  কি ইয়াসমিনের কথা।

ও থেকে গিয়েছিল আমার বাসায়। একটু অস্বস্তি বোধ যে হয়নি তা নয়। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। বয়স বলে কথা। এখন সব কিছু শুষ্ক মরুভূমির মতো। তাতে দুব্বা গজাবে না। কাজেই ভয় এর কোন কারন নেই।

অনেক রাত পর্যন্ত দুজনে গল্প করেছিলাম। খুব যে একটা ওকে আমি চিনি তা নয়। দুই একটা ঘটনার মধ্যেই পরিচয়। তবুও মনে হয়েছিল ও অনেক পাল্টেছে। জীবনের উচু নিচু পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে আজ এখানে আসে পৌছেছে সেও ,আমিও।   ফেলে আসা অবুঝ দিনের ঘটনা গুলো কোথায় যেন ভেসে গিয়েছে।

সামনে নেই ভবিষ্যৎ পিছনে হাসি কান্নায় ভরা। ওরও আমারও।

সেই সব কথা বলতে বলতে সতীর কল এসেছিল মনে আছে। কোন কারন নয়, শুধু জানতে চাওয়া। মনের  ভিতরে একটু হাসি এলো,  “ মেয়েলি মন”।

কথা শেষে ইয়াসমিন চলে গিয়েছিল ঘরে। আমি উপরের তাক থেকে লোটা কম্বল পেড়ে ড্রয়াইং রুমে শোবার  আয়োজন করেছিলাম।  ঢং  করে পাশের ঘড়িটা জানালো রাত দুটো। চোখ টা বুজে এলো।

গরম নিশ্বাস আমার কপাল ছুয়ে গেলো। একটা ভেজা আঙ্গুল আমার ঠোট ছুঁইয়ে আস্তে আস্তে গ্রীবা পেরিয়ে বুকের কাছে এসে থেমে রইল কিছুক্ষণ। সারা শরীরে নেমে এলো আফিং এর মাদকতা। আমি আঙ্গুল টা ধরতে চাইলাম, পারলাম না। চোখ খুলতে গেলাম কে যেন দুই হাত দিয়ে বন্ধ করে দিল। আঙ্গুল টা আরও নিচে নেমে এলো। নাভীর কাছে। আমি না না বলে চিৎকার করে উঠলাম। ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো। এতো স্বপ্ন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

ইয়াসমিন দরজা খুলে বেড়িয়ে এসেছিলো। বলেছিল, কি হোল।

বলেছিলাম, দুঃস্বপ্ন। তুমি শুয়ে পড়।

এরপর আমরা দুজন বন্ধুত্তের বেড়া জালে আটকিয়ে গেলাম। নিউইয়র্ক শহর ঘুরেঘুরে ওকে দেখিয়ে ছিলাম। মাঝে মধ্যে সতী যোগ দিতো। যাওয়ার দিন বলে গিয়েছিল, দেশে এলে আমার বাসায় উঠবে।

রক্তে কেফিন দরকার বুঝতে পারছি। বাহিরের আকাশ টাও মেঘলা হয়ে এলো। দুই একবার বিদ্যুৎ চমকিয়ে গেছে। আজ আবহাওয়ার পূর্বাভাসে মেঘের ঘনঘটার কথা ছিল না।  বলেছিল আকাশে থাকবে নীল মেঘের ছড়াছড়ি।  কিন্তু কোথায়, হঠাৎ করে কোথা থেকে জড়ো হয়েছে এক গুচ্ছ কালো মেঘ। মাঝে মাঝে গর্জন করে তার উপস্থিতি জানিয়ে  দিচ্ছে।  আমি বাহিরে বসে কফিতে চুমক দিয়ে স্মৃতি মন্থন করবো ভেবেছিলাম।  হোল না।

ভিতরে এসে বসলাম। ফোন টা বাজছে। শুভঙ্করের ফোন। না, আজ কারোর ফোন ধরতে ইচ্ছা করছে না। তার চেয়ে শোন আমার কথা।

আমার খামখেয়ালি, অন্যমনস্কতা, অথবা উপেক্ষা করা, যাই বলা হোক না কেনও, দোষ টা আমার। আমি ছয় মাসের মধ্যে তার কোন খোঁজ নেইনি। সে তার ফোন নাম্বার টা রেখে গিয়ে ছিল, বলেছিল, মিন্টু ভাই, এই রইল আমার নাম্বার, পারলে কল করেন।

মনে পরে কি সাধনার কথা। স্বামী থেকে বিতাড়িত, কেন্সারে সর্ব শরীর জর্জরিত। কি ভাবে ভুলে গিয়েছিলাম তাকে। এমনি হয়।

সবাই নিজের বাস্ততায় মগ্ন। আমি বা তার ব্যতিক্রম হবো কেনও। খুজতে থাকলাম সেই কাগজ টা। যেখানে সে লিখে দিয়েছিল নাম্বার টা। কোথাও পেলাম না। অস্থির হয়ে এ ঘর ও ঘর করলাম অনেক বার। সতী কে কল করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে জানে কিনা।

বলে ছিল , সে কিভাবে জানবে।

তাই তো তার তো জানার কথা নয়। দুদিন পেড়িয়ে গেলো। হঠাৎ মনে পড়ল পুরানো মানিব্যাগ টার কথা। ওটার ভিতরে রেখেছিলাম। ওটা যে কেনও এতদিন ফেলে দেইনি তা উপরওয়ালাই জানেন।

চিরকুট টা পাইয়েছিলাম, কলও করেছিলাম। বলেছিলাম সাধনার সাথে দেখা করতে চাই, আসতে পারি কি?

ওপার থেকে বলেছিল, একটু দেরী হয়ে গেলো। গত মাসে সে চলে গেছে।

আমার নামটা জানার পরে বলেছিল, আপনার নামে একটা খাম সে রেখে গেছে। বলে গেছে কোনদিন যদি আপনি আসেন তবে আপনাকে দিতে।

সেদিন বসে ছিলাম অন্ধকার ঘরের মাঝে। বাহিরে আজকের মতো অঝোরে ঝরছিল।  এ যেন আমার কান্না। আমি কাঁদতে পারিনি বলেই হয়তো বাহিরে তার প্রতিফলন হয়েছিল।

পৌঁছেছিলাম কমেকে। ওর বোনের বাসায়। দরজা খূলে দাঁড়াল যে সে অবিকল দেখতে সাধনার মতো। ভিতরে এসে বসতেই মেয়েটা একটা তোয়ালে এনে দিয়েছিল, সাথে একটা খাম। বলেছিল, মা বাসায় যেয়ে পড়তে  বলেছে।

 বড় বড় করে খামের উপর লেখা , মিন্টু ভাই।

চিঠি তে লেখা ছিল,

 মিন্টু ভাই,

 আপনার ফোনের আশায় থাকতে থাকতে আজ মনে হচ্ছে আর হয়তো দেখা হবে না। সময় আমার ফুরিয়ে এসেছে। কেন যে সেদিন আপনার নাম্বার টা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম  তা জানিনা। এই চিঠি যদি আপনার হাতে পৌছায় তবে একটা অনুরোধ আমার মেয়ে টা কে রেখে গেলাম ওর খালার কাছে, আপনি শুধু মাঝে মধ্যে ওর খোঁজ নিয়েন। দাবি করবো না শুধু অনুরোধ। কেন জানি সব সময় আমার মনে হতো আপনি আমার বড় ভাই। যাওয়ার আগে আপনার দেখা পেলাম না। দুর থেকে আশীর্বাদ করেন যেন উপরে যেয়ে দুঃখের ভাঁড় আবারো বহন করতে না হয়।

ইতি

সাধনা

পড়া শেষে চুপ করে বসেছিলাম। ভাবলাম পাথরের গা বেয়ে পানি ঝরতে তো আমি দেখেছি । তবে আমার চোখ দিয়ে সেদিন পানি ঝরল না। কেন? হয়তো নিজেকে দোষী মনে হয়েছিল। তাই।

সুবর্ণ কে নিয়ে এসেছিলাম কিছুদিনের জন্য। ছিল আমার বাসায়। মাঝে মাঝে চলে আসে সে। মামা ভাগ্নী মিলে সময় আমাদের ভালই কেটে যায়।

দরজায় খট খট শব্দ। দরজা খুলতেই দেখি শুভঙ্কর। ভিজে একশেষ। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সোজা বাথরুম যেয়ে তোয়ালে টা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল, ফোন উঠাস নি কেন?

ইচ্ছা করে নি।

ওসব ভোগলামী ছাড়। তোর বৌদি তোকে যেতে বলেছে।

অগত্যা উঠতে হোল।

 

Continue Reading