ডায়রির পাতা থাকে ৯

২৩ ই মে

 বছর পেড়িয়ে গেছে। নয়ন ভাই(আমার মেয়ের শ্বশুরের ভাই) বলেছিল, আমার ছেলের বিয়েতে আসতে হবে। এবছর নয়। পরের বছর।

সেই পরের বছর এসে গেলো। আটলান্টা শহরে বিয়ে।  আমি, জীবন বেয়ান আর চয়ন ভাবী, যাবো একই দিনে, একই প্লেনে, একই সময়ে। সকাল দশ টায় প্লেন ছাড়বে। লাগুয়ারদীয়া এয়ারপোর্ট থেকে। জীবন আমার ছেলের শাশুড়ি। চয়ন তার বোন। কাজেই আমাদের মধ্যে আত্মীয়তা আছে।

ভাবলাম যাক গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। সে গুড়ে বালি।

সাউথওয়েস্ট  এয়ারলাইন। আগের থেকে সীট রিজার্ভেশন করা যায়না। ভিতরে ঢুকে খালি সীটে বসতে হবে। ভিতরে এসে  দেখলাম দুটো সীট এক জায়গায় অপর টি অন্যখানে। অগত্যা ওদের দুজনকে বসতে দিয়ে আমি এসে বসলাম অন্য সীটে।

দুই ঘণ্টা গল্প করে কাটানোর স্বপ্ন আমার বেহেশতে গেলো।

ভাগ্যভালো আহমেদ রফিকের লেখা নির্বাচিত রবীন্দ্রনাথ বইটা সাথে নিয়ে এসেছিলাম। খুলে বসলাম।

আটলান্টা এয়ারপোর্ট। এসে পৌছালাম  দুপুর বারোটার কিছু পরে। রেজ (আমার মেয়ের জামাই)  আসবে নিতে। সুষমা, রেজ ওরা আগেই চলে এসেছিল। আমরা উঠব নয়ন ভাইয়ের বাসায়। ওখানে থাকবে সজল ভাই(সুষমার শ্বশুর) আর ভাবী। রেজ ফোন করে জানাল সে পথে, তবে রাস্তায় ভীষণ ভিড়। সময় লাগবে।

একটু দেরী। তাতে আমাদের কোন অসুবিধা নেই। এখানে তো ঘোড়ায় লাগাম দিয়ে আসিনি যে ছুটতে হবে। জীবন, চয়নের চোখ ঢুলু ঢুলু। অনেক ভোরে উঠতে হয়েছে। তাঁই।

 দেড় ঘণ্টার পথ নয়ন ভাইয়ের বাসা। জিজ্ঞাসা করলাম সাথে আসা দুজনকে,” চা, পানি খাবে কিছু?” প্রতি উত্তরে বলল,

“না, ওখানে যেয়েই ব্রাঞ্চ করবো”।

রেজ ভাড়া করা SUV টা নিয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে। আমরা সুটকেস গুলো উঠিয়ে দিলাম। জীবনের সুটকেসের ওজন একটু বেশি। বললাম,” কি ব্যাপার? ভিতরে লোহালক্কড় পুড়ে এনেছ নাকি”।

বলল,” ও আপনি বুঝবেন না। মেয়েলি জিনিস পত্র”।

শহরের ভিতর দিয়ে  আস্তে ধীরে চলেছি আমরা। চারিদিকে তাকিয়ে মন ভরছে না। হয়তো আমরা এসেছি নিউইয়র্ক থেকে, তাঁই। এ আমার গর্বিত মন নয়। যা দেখছি তার উপলব্ধীতা।

 শহর পেড়িয়ে আমরা এলাম চারিদিকে সবুজ গাছে ঢাকা রাস্তার মাঝে। উচু নিচু রাস্তা। আঁকা বাকা।

জীবন আমাকে বলল,” এবার আপনার মন ভরেছে তো”?

ভরেছে?

আমরা বাঁক নিলাম নয়ন ভাইয়ের কমিউনিটিতে। বিরাট বিরাট বাড়ী ঘর চারিদিকে। সুন্দর করে ছাটা লন।  এসে দাঁড়ালাম বাসার সামনে। বিয়ে বাড়ী।

রানা ভাবী, ঘরের গৃহিনী, আর নার্গিস ভাবী (রেজের মা)  নেমে এলো বাকা সিঁড়ি বেয়ে। বিশাল বাড়ী।

“ সবাই কোথায়”। জিজ্ঞাসা করতেই,

“ জুম্মাতে”। বলল রানা ভাবী। “ আসেন, আপনারা কিছু মুখে দেন। আসতে অনেক দেরী হয়ে গেলো”।

উনার আন্তরিকতা সুলভ কণ্ঠের ডাকশুনে মনে হলনা এই প্রথম দেখলাম।

জীবন, চয়ন মিশে গেলো উনার সাথে। হাতে হাতে সাজানো হোল খাবার টেবিল। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম।

মনে হোল এই বাড়ীতে যেন আমি আগেও এসেছি। সজল ভাই, নয়ন ভাই ঢুকল দরজা খুলে।

গোসল শেষে নেমে এলো সুষমা। ডাক দিলো সেই মধুর স্বরে,” আব্বু”।

খাওয়া শেষে নয়ন ভাইয়ের প্রস্তাব, চলেন ঘুরে দেখাই আমাদের জাগাটা।

আমরা তিন আর সজল ভাই আর নার্গিস ভাবী । গাড়ীর চালক নয়ন ভাই।

সবুজের সমারোহ চারিদিকে। রাস্তার দুপাশে খাদ নেমে গেছে। মিশেছে Lake Lanier এর সাথে।

 Lake Lanier একটা Reservoir, Chattahoochee River এর উপরে Buford Dam তৈরীর সময় এটার সৃষ্টি।   আমাদের গাড়ী নেমে এলো উচু রাস্তা থেকে Lake Lanier এর পাড়ে। আমরা নেমে এলাম। ছায়া ঘেরা চিকন রাস্তা বেয়ে এসে দাড়ালাম লেকের পাশে। বড় বড় পাথর বিছানো পাড়।

জীবন, চয়ন ছবি তুলবে। অতি সাবধানে এক পাথর ডিঙ্গিয়ে অপর পাথরে পা দিয়ে এসে দাড়াল।

বললাম, বেশি নড়াচড়া করোনা তাহলেই পড়বে ঐ জলে। দেখছ তো ঐ টারবাইন, ওটা হাইড্রলিক পাম্প। ইলিকট্রিসিটি  তৈরী হয় এখানে।

শুটিং শেষ। ওরা উঠে এলো।

এই সুন্দর মনোরম পরিবেশ ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। তা বললে তো হবে না। যেতে হবে গায়ে হলুদে।

অবশেষে ফিরে এলাম।

আজ রাতে সামি আর সাজিয়ার গায়ে হলুদ। ডালাতে সাজানো বিভিন্ন উপহার। রানা ভাবীর হাতে গড়া চুমকী দিয়ে গাঁথা ছোট্ট পালীকী তে যাবে বৌ এর শাড়ী। সামি সেজেছে ওদের দেওয়া হলুদের পাঞ্জাবি, সাথে ওড়না। মানিয়েছে ।

জীবন, চয়ন পড়ে এলো হলুদের  জন্য আনা শাড়ী। আমি চাপিয়ে নিলাম অনেক আগের সেই ছেলের হলুদে পড়া পাঞ্জাবি টা। নস্টালজিয়া বলতে পারো।

সুন্দর করে সাজানো  পার্টি ঘর। বিভিন্ন রঙ এর কাপড়ে সেজেছে মেয়ের বয়সী মেয়েরা। ওরা হাসছে। ওদের উচ্ছল ভাব আমার ভালো লাগছে।  ভাবী বোনদের গায়ে হলুদের সাঁজ।  সামি বসে আছে ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চে ।

 সাজিয়া আসবে।

ওর বন্ধুরা নিয়ে এলো ওকে। মাথার উপর লাল ওড়না দিয়ে। বসিয়ে দিল সামির পাশে। ওর ব্যচেলারত্ত আজ শেষের পথে।

ও কি জানে তা?

সাজিয়ার বন্ধুরা নাচলো ওদের সামনে। বয়স্করা উঠে এলো মঞ্চে। ছুঁইয়ে দিলো হলুদ ওদের দুজনের মুখে। ফ্লাস জ্বলে উঠলো। ধরে রাখল আজকের স্মৃতি।

আমরা উঠে গেলাম খাবার আনতে।

শনিবার। বিয়ের কোন অনুষ্ঠান আজ নেই । বিয়ের অনুষ্ঠান আগামীকাল। রানা ভাবী বেশ কিছু লোক কে বলেছে দুপুরে খাওয়ার জন্য।

আমরা বললাম,” আটলান্টা শহর টা দেখে আসি, সেই সাথে CNN Tower। ফিরে আসবো সময় মতো”।

বেড়িয়ে পড়লাম। আমি জীবন চয়ন সুষমা আর রেজ। বন্ধের দিন। রাস্তা ঘাটে লোকজন কম। বলেছি, নয়ন ভাইয়ের বাসা সিটি থেকে অনেক দুর। ঘণ্টার উপরে লেগে গেলো পৌছাতে।  CNN Tower এ ও ভিড় কম।

ট্যুরের মাধ্যমে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম কোথায় কিভাবে অ্যাংকররা বসে আমাদের কে খবর শোনায়। ভিন্ন অভিজ্ঞতা। বাসায় মুখরোচক খাবার আছে জেনেও এই মুহূর্তে আমাদের পাকস্থলীর গুরগুর আওয়াজ বন্ধের জন্য সরানাপন্ন হতে হোল

Taco Bellর। খাওয়া শেষে ফেরত যাত্রা। পৌছাতে পৌছাতে তিনটে বেজে গেলো।

অনেক লোকের সমাগম। বিভিন্ন ধরেনের খাবার দিয়ে পরিবেশন করেছেন রানা ভাবী। উন্মুক্ত বসার ঘর। লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। পরিচয় হোল নয়ন ভাইয়ের মেজ ছেলের শ্বশুরের সাথে। থাকেন ভারজেনীয়া। এসেছেন বিয়ে উপলক্ষে।

এক কণে আমরা কজন। আলাপ এদেশের, বাংলাদেশের রাজনীতি, বিভিন্ন জনের শারীরিক সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য কোনায় ধর্ম নিয়ে আলোচনা।

অন্য ঘরে ভদ্রমহিলাদের আলোচনা। কি নিয়ে জানিনা।

একে একে অনেকে চলে গেলো।  থাকলাম আমরা কজন।

রানা ভাবী ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসেছে চেয়ারে। মুখে ক্লান্তি নয়, মনখুন্নতার  প্রকাশ। চলে যাওয়ার আগে কে যেন কি বলে গেছে। তারই প্রকাশ।

বললাম,” মন খারাপ করবেন না। গুরুজনরা বলত, ১০১ টা কথা না হলে বিয়ে হয়না। কাজেই ওসব কথা কানে দেবেন না”।  এতো আমার বলা।

যার মাসের পর মাস বিশ্রামহীন কর্মের ফল আজকের এই অনুষ্ঠান,  সে কেনও শুনতে যাবে অন্যের কটু কথা।

রোববার, বিয়ের দিন। বাহিরে বৃষ্টি। সবার মন খারাপ। এখানে এমন হয়। মাঝে মাঝে এক পশলা বৃষ্টি আবার রৌদ। এই লুকোচুরি চলছে। সামি  পড়েছে মেয়ে পক্ষের দেওয়া গোল্ডেনের উপর লাল কাজ করা শেরওয়ানী। সাথে লাল ওড়না। গলার উপর দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়াছে। মাথায় কারুকার্যও খচিত পাগড়ী। হ্যান্ডসাম ছেলে টাকে আরও হ্যান্ডসাম লাগছে।

অনুষ্ঠান দুপুর দুটায়। দুঘণ্টার পথ বাসা থকে। নয়ন ভাই, ভাবী সামি সহ বেড়িয়ে পড়লো। ফটো অপ আছে। আমরা বের হলাম একটু পরে। আস্তে আস্তে মেঘ কেটে গেলো।  কালো মেঘের আড়াল থেকে দেখা দিলো রোদের ঝলকানি।

আমরা এসে পৌছালাম কান্ট্রি ক্লাবে। বাহিরে ফুল গাছের নিচে তৈরী হয়েছে বর কনে বসার মঞ্চ। পাশে ছোট্ট পুকুরে উঠছে নামছে  পানির ফোয়ারা। সামনে পাতা চেয়ারে সবাই এসে বসল। বাহিরে তাপের মাত্রা একটু বেশি। ছোট হাত পাখা সবার হাতে।

 সামি সাজিয়া এলো। সাজিয়াকে খুব সুন্দর মানিয়েছে লালের উপর গরজীয়াস কাজ করা শালওয়ার কামিজে। মাথায় আলতো করে রাখা ম্যাচিং ওড়না। অলঙ্কারের ভাড়ে আমার মনে হচ্ছে ও একটু নুয়ে পড়েছে। না, এ আমার চোখের ভুল। ইমাম সাহেব বুঝিয়ে দিলো আজকের দিনের তাৎপর্যটা। (একটু বেশি কথা বলে)

ওরা এখন একে পরের নির্ভর শীল। ওরা স্বামী স্ত্রী।

আমরা এলাম বড় হল ঘরে। এখানে হবে অন্যান্য অনুষ্ঠান। নিউইয়র্ক থেকে আমরা কয়েক জন এসেছি। দেখা হোল রানু ভাবী, ইসাখ ভাই, সাদেক ভাই ও ভাবীর সাথে। আমাদের টেবিল নাম্বার চার। সবাই নিউইয়র্ক বাসি।

 অনুষ্ঠানের শুরুতে বর পক্ষের আর কন্যা পক্ষের পরিচিতি। শেষে বর আর বৌ এর আগমন বাজনার তালে তালে।

আনন্দের বন্যা বইছে। ওরা সবাই নাচছে। ওদের আনন্দ আমাদের আনন্দ। এমনি তো হবে। এইদিন তো এর একবার আসবে না সামি-সাজিয়ার জীবনে।

আমরা এলাম,দেখলাম, উপভোগ করলাম।

পরদিন বিদায়ের পালা। রানা ভাবী নয়ন ভাইয়ের আতিথেয়তা ভুলবার নয়।

বললাম, ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। ভালো সময় গুলো চলে যায় তাড়াতাড়ি।

আমরা গাড়ীতে উঠলাম, ওরা বারান্দায় দাড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো।

আজ ওদের হাতে অনেক কাজ।  জামাই বৌ ফিরবে আজ।

২৩ ই মে

 বছর পেড়িয়ে গেছে। নয়ন ভাই(আমার মেয়ের শ্বশুরের ভাই) বলেছিল, আমার ছেলের বিয়েতে আসতে হবে। এবছর নয়। পরের বছর।

সেই পরের বছর এসে গেলো। আটলান্টা শহরে বিয়ে।  আমি, জীবন বেয়ান আর চয়ন ভাবী, যাবো একই দিনে, একই প্লেনে, একই সময়ে। সকাল দশ টায় প্লেন ছাড়বে। লাগুয়ারদীয়া এয়ারপোর্ট থেকে। জীবন আমার ছেলের শাশুড়ি। চয়ন তার বোন। কাজেই আমাদের মধ্যে আত্মীয়তা আছে।

ভাবলাম যাক গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। সে গুড়ে বালি।

সাউথওয়েস্ট  এয়ারলাইন। আগের থেকে সীট রিজার্ভেশন করা যায়না। ভিতরে ঢুকে খালি সীটে বসতে হবে। ভিতরে এসে  দেখলাম দুটো সীট এক জায়গায় অপর টি অন্যখানে। অগত্যা ওদের দুজনকে বসতে দিয়ে আমি এসে বসলাম অন্য সীটে।

দুই ঘণ্টা গল্প করে কাটানোর স্বপ্ন আমার বেহেশতে গেলো।

ভাগ্যভালো আহমেদ রফিকের লেখা নির্বাচিত রবীন্দ্রনাথ বইটা সাথে নিয়ে এসেছিলাম। খুলে বসলাম।

আটলান্টা এয়ারপোর্ট। এসে পৌছালাম  দুপুর বারোটার কিছু পরে। রেজ (আমার মেয়ের জামাই)  আসবে নিতে। সুষমা, রেজ ওরা আগেই চলে এসেছিল। আমরা উঠব নয়ন ভাইয়ের বাসায়। ওখানে থাকবে সজল ভাই(সুষমার শ্বশুর) আর ভাবী। রেজ ফোন করে জানাল সে পথে, তবে রাস্তায় ভীষণ ভিড়। সময় লাগবে।

একটু দেরী। তাতে আমাদের কোন অসুবিধা নেই। এখানে তো ঘোড়ায় লাগাম দিয়ে আসিনি যে ছুটতে হবে। জীবন, চয়নের চোখ ঢুলু ঢুলু। অনেক ভোরে উঠতে হয়েছে। তাঁই।

 দেড় ঘণ্টার পথ নয়ন ভাইয়ের বাসা। জিজ্ঞাসা করলাম সাথে আসা দুজনকে,” চা, পানি খাবে কিছু?” প্রতি উত্তরে বলল,

“না, ওখানে যেয়েই ব্রাঞ্চ করবো”।

রেজ ভাড়া করা SUV টা নিয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে। আমরা সুটকেস গুলো উঠিয়ে দিলাম। জীবনের সুটকেসের ওজন একটু বেশি। বললাম,” কি ব্যাপার? ভিতরে লোহালক্কড় পুড়ে এনেছ নাকি”।

বলল,” ও আপনি বুঝবেন না। মেয়েলি জিনিস পত্র”।

শহরের ভিতর দিয়ে  আস্তে ধীরে চলেছি আমরা। চারিদিকে তাকিয়ে মন ভরছে না। হয়তো আমরা এসেছি নিউইয়র্ক থেকে, তাঁই। এ আমার গর্বিত মন নয়। যা দেখছি তার উপলব্ধীতা।

 শহর পেড়িয়ে আমরা এলাম চারিদিকে সবুজ গাছে ঢাকা রাস্তার মাঝে। উচু নিচু রাস্তা। আঁকা বাকা।

জীবন আমাকে বলল,” এবার আপনার মন ভরেছে তো”?

ভরেছে?

আমরা বাঁক নিলাম নয়ন ভাইয়ের কমিউনিটিতে। বিরাট বিরাট বাড়ী ঘর চারিদিকে। সুন্দর করে ছাটা লন।  এসে দাঁড়ালাম বাসার সামনে। বিয়ে বাড়ী।

রানা ভাবী, ঘরের গৃহিনী, আর নার্গিস ভাবী (রেজের মা)  নেমে এলো বাকা সিঁড়ি বেয়ে। বিশাল বাড়ী।

“ সবাই কোথায়”। জিজ্ঞাসা করতেই,

“ জুম্মাতে”। বলল রানা ভাবী। “ আসেন, আপনারা কিছু মুখে দেন। আসতে অনেক দেরী হয়ে গেলো”।

উনার আন্তরিকতা সুলভ কণ্ঠের ডাকশুনে মনে হলনা এই প্রথম দেখলাম।

জীবন, চয়ন মিশে গেলো উনার সাথে। হাতে হাতে সাজানো হোল খাবার টেবিল। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম।

মনে হোল এই বাড়ীতে যেন আমি আগেও এসেছি। সজল ভাই, নয়ন ভাই ঢুকল দরজা খুলে।

গোসল শেষে নেমে এলো সুষমা। ডাক দিলো সেই মধুর স্বরে,” আব্বু”।

খাওয়া শেষে নয়ন ভাইয়ের প্রস্তাব, চলেন ঘুরে দেখাই আমাদের জাগাটা।

আমরা তিন আর সজল ভাই আর নার্গিস ভাবী । গাড়ীর চালক নয়ন ভাই।

সবুজের সমারোহ চারিদিকে। রাস্তার দুপাশে খাদ নেমে গেছে। মিশেছে Lake Lanier এর সাথে।

 Lake Lanier একটা Reservoir, Chattahoochee River এর উপরে Buford Dam তৈরীর সময় এটার সৃষ্টি।   আমাদের গাড়ী নেমে এলো উচু রাস্তা থেকে Lake Lanier এর পাড়ে। আমরা নেমে এলাম। ছায়া ঘেরা চিকন রাস্তা বেয়ে এসে দাড়ালাম লেকের পাশে। বড় বড় পাথর বিছানো পাড়।

জীবন, চয়ন ছবি তুলবে। অতি সাবধানে এক পাথর ডিঙ্গিয়ে অপর পাথরে পা দিয়ে এসে দাড়াল।

বললাম, বেশি নড়াচড়া করোনা তাহলেই পড়বে ঐ জলে। দেখছ তো ঐ টারবাইন, ওটা হাইড্রলিক পাম্প। ইলিকট্রিসিটি  তৈরী হয় এখানে।

শুটিং শেষ। ওরা উঠে এলো।

এই সুন্দর মনোরম পরিবেশ ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। তা বললে তো হবে না। যেতে হবে গায়ে হলুদে।

অবশেষে ফিরে এলাম।

আজ রাতে সামি আর সাজিয়ার গায়ে হলুদ। ডালাতে সাজানো বিভিন্ন উপহার। রানা ভাবীর হাতে গড়া চুমকী দিয়ে গাঁথা ছোট্ট পালীকী তে যাবে বৌ এর শাড়ী। সামি সেজেছে ওদের দেওয়া হলুদের পাঞ্জাবি, সাথে ওড়না। মানিয়েছে ।

জীবন, চয়ন পড়ে এলো হলুদের  জন্য আনা শাড়ী। আমি চাপিয়ে নিলাম অনেক আগের সেই ছেলের হলুদে পড়া পাঞ্জাবি টা। নস্টালজিয়া বলতে পারো।

সুন্দর করে সাজানো  পার্টি ঘর। বিভিন্ন রঙ এর কাপড়ে সেজেছে মেয়ের বয়সী মেয়েরা। ওরা হাসছে। ওদের উচ্ছল ভাব আমার ভালো লাগছে।  ভাবী বোনদের গায়ে হলুদের সাঁজ।  সামি বসে আছে ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চে ।

 সাজিয়া আসবে।

ওর বন্ধুরা নিয়ে এলো ওকে। মাথার উপর লাল ওড়না দিয়ে। বসিয়ে দিল সামির পাশে। ওর ব্যচেলারত্ত আজ শেষের পথে।

ও কি জানে তা?

সাজিয়ার বন্ধুরা নাচলো ওদের সামনে। বয়স্করা উঠে এলো মঞ্চে। ছুঁইয়ে দিলো হলুদ ওদের দুজনের মুখে। ফ্লাস জ্বলে উঠলো। ধরে রাখল আজকের স্মৃতি।

আমরা উঠে গেলাম খাবার আনতে।

শনিবার। বিয়ের কোন অনুষ্ঠান আজ নেই । বিয়ের অনুষ্ঠান আগামীকাল। রানা ভাবী বেশ কিছু লোক কে বলেছে দুপুরে খাওয়ার জন্য।

আমরা বললাম,” আটলান্টা শহর টা দেখে আসি, সেই সাথে CNN Tower। ফিরে আসবো সময় মতো”।

বেড়িয়ে পড়লাম। আমি জীবন চয়ন সুষমা আর রেজ। বন্ধের দিন। রাস্তা ঘাটে লোকজন কম। বলেছি, নয়ন ভাইয়ের বাসা সিটি থেকে অনেক দুর। ঘণ্টার উপরে লেগে গেলো পৌছাতে।  CNN Tower এ ও ভিড় কম।

ট্যুরের মাধ্যমে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম কোথায় কিভাবে অ্যাংকররা বসে আমাদের কে খবর শোনায়। ভিন্ন অভিজ্ঞতা। বাসায় মুখরোচক খাবার আছে জেনেও এই মুহূর্তে আমাদের পাকস্থলীর গুরগুর আওয়াজ বন্ধের জন্য সরানাপন্ন হতে হোল

Taco Bellর। খাওয়া শেষে ফেরত যাত্রা। পৌছাতে পৌছাতে তিনটে বেজে গেলো।

অনেক লোকের সমাগম। বিভিন্ন ধরেনের খাবার দিয়ে পরিবেশন করেছেন রানা ভাবী। উন্মুক্ত বসার ঘর। লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। পরিচয় হোল নয়ন ভাইয়ের মেজ ছেলের শ্বশুরের সাথে। থাকেন ভারজেনীয়া। এসেছেন বিয়ে উপলক্ষে।

এক কণে আমরা কজন। আলাপ এদেশের, বাংলাদেশের রাজনীতি, বিভিন্ন জনের শারীরিক সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য কোনায় ধর্ম নিয়ে আলোচনা।

অন্য ঘরে ভদ্রমহিলাদের আলোচনা। কি নিয়ে জানিনা।

একে একে অনেকে চলে গেলো।  থাকলাম আমরা কজন।

রানা ভাবী ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসেছে চেয়ারে। মুখে ক্লান্তি নয়, মনখুন্নতার  প্রকাশ। চলে যাওয়ার আগে কে যেন কি বলে গেছে। তারই প্রকাশ।

বললাম,” মন খারাপ করবেন না। গুরুজনরা বলত, ১০১ টা কথা না হলে বিয়ে হয়না। কাজেই ওসব কথা কানে দেবেন না”।  এতো আমার বলা।

যার মাসের পর মাস বিশ্রামহীন কর্মের ফল আজকের এই অনুষ্ঠান,  সে কেনও শুনতে যাবে অন্যের কটু কথা।

রোববার, বিয়ের দিন। বাহিরে বৃষ্টি। সবার মন খারাপ। এখানে এমন হয়। মাঝে মাঝে এক পশলা বৃষ্টি আবার রৌদ। এই লুকোচুরি চলছে। সামি  পড়েছে মেয়ে পক্ষের দেওয়া গোল্ডেনের উপর লাল কাজ করা শেরওয়ানী। সাথে লাল ওড়না। গলার উপর দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়াছে। মাথায় কারুকার্যও খচিত পাগড়ী। হ্যান্ডসাম ছেলে টাকে আরও হ্যান্ডসাম লাগছে।

অনুষ্ঠান দুপুর দুটায়। দুঘণ্টার পথ বাসা থকে। নয়ন ভাই, ভাবী সামি সহ বেড়িয়ে পড়লো। ফটো অপ আছে। আমরা বের হলাম একটু পরে। আস্তে আস্তে মেঘ কেটে গেলো।  কালো মেঘের আড়াল থেকে দেখা দিলো রোদের ঝলকানি।

আমরা এসে পৌছালাম কান্ট্রি ক্লাবে। বাহিরে ফুল গাছের নিচে তৈরী হয়েছে বর কনে বসার মঞ্চ। পাশে ছোট্ট পুকুরে উঠছে নামছে  পানির ফোয়ারা। সামনে পাতা চেয়ারে সবাই এসে বসল। বাহিরে তাপের মাত্রা একটু বেশি। ছোট হাত পাখা সবার হাতে।

 সামি সাজিয়া এলো। সাজিয়াকে খুব সুন্দর মানিয়েছে লালের উপর গরজীয়াস কাজ করা শালওয়ার কামিজে। মাথায় আলতো করে রাখা ম্যাচিং ওড়না। অলঙ্কারের ভাড়ে আমার মনে হচ্ছে ও একটু নুয়ে পড়েছে। না, এ আমার চোখের ভুল। ইমাম সাহেব বুঝিয়ে দিলো আজকের দিনের তাৎপর্যটা। (একটু বেশি কথা বলে)

ওরা এখন একে পরের নির্ভর শীল। ওরা স্বামী স্ত্রী।

আমরা এলাম বড় হল ঘরে। এখানে হবে অন্যান্য অনুষ্ঠান। নিউইয়র্ক থেকে আমরা কয়েক জন এসেছি। দেখা হোল রানু ভাবী, ইসাখ ভাই, সাদেক ভাই ও ভাবীর সাথে। আমাদের টেবিল নাম্বার চার। সবাই নিউইয়র্ক বাসি।

 অনুষ্ঠানের শুরুতে বর পক্ষের আর কন্যা পক্ষের পরিচিতি। শেষে বর আর বৌ এর আগমন বাজনার তালে তালে।

আনন্দের বন্যা বইছে। ওরা সবাই নাচছে। ওদের আনন্দ আমাদের আনন্দ। এমনি তো হবে। এইদিন তো এর একবার আসবে না সামি-সাজিয়ার জীবনে।

আমরা এলাম,দেখলাম, উপভোগ করলাম।

পরদিন বিদায়ের পালা। রানা ভাবী নয়ন ভাইয়ের আতিথেয়তা ভুলবার নয়।

বললাম, ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। ভালো সময় গুলো চলে যায় তাড়াতাড়ি।

আমরা গাড়ীতে উঠলাম, ওরা বারান্দায় দাড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো।

আজ ওদের হাতে অনেক কাজ।  জামাই বৌ ফিরবে আজ।

 

Continue Reading

ডায়রির পাতা থেকে ৬

২৭শে এপ্রিল

আজ ডায়রির পাতায় অন্য কাউকে নিয়ে নয় লিখব আজ আমাকে নিয়ে।

 আমার অনুভূতি টা আমি ব্যক্ত করতে চাই।

 লিখব কারন আমার মনটাকে আমি হাল্কা করতে চাই।

 আমি কাঁদতে পারিনা, আমি কাঁদতে চাই।

আজ সেই দিন যেদিন সে চলে গিয়েছিল, সেদিন দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমি শুধু দেখেছিলাম। কিছুই করতে পারিনি। আমি সেদিন কিছু একটা মিরাকেল ঘটবে ভেবেছিলাম। দৌড়ে যেয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,” মিরাকেল ঘটে, তাঁই না”?

সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ।

বলল, আমার পঁয়ত্রিশ বছরের ডাক্তারির অভিজ্ঞতায় মিরাকেল কি জানা নেই, মিরাকেল ঘটেনি, ঘটবেনা।

তুমি অন্যান্য যা যা করার সেই ব্যবস্থা করো।

তোমরা কখনও হিমশীতল শরীরে হাত রেখেছ কি? অনুভব করেছ কি ঠাণ্ডার তীব্রতা? আমি করেছি। আমি দেখেছি কি ভাবে জীবনের সব লেনদেন শেষ হয়ে যায়। নেমে আসে অন্ধকার।

দাড়াও, ঘরের জানালা গুলো খুলে দেই । গুমোট ঘরটা আমাকে অস্থির করে তুলেছে। আমি বাতাস চাই। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চাই।

সে শুধু রেখে গেলো অনেক অনেক ভালবাসার স্মৃতি।

 আনাচে কানাচে।

দু দুটো বছর। আমি অনেক ঘুরলাম। অনেক জাগায় গেলাম। খুজে পেতে চাইলাম সেই শব্দ টাকে। যেটা লেখা থাকে বই এর পাতায়।

শান্তি, হা শান্তি।

কোথায় সে লুকিয়ে আছে? আমার জানতে ইচ্ছা করে। জানতে ইচ্ছা করে তার অস্তিত্ব আছে কি না।

যদি থেকেই থাকে তবে কেন আজও আমি হেটে বেড়াই মাঝ রাতে। ঘরের চৌকাঠ পেড়িয়ে এসে দাড়াই ব্যালকণিতে।

নীস্তব্দ চারিদিক।

তাকিয়ে থাকি দূরে লাল নেওন সাইন টার দিকে।

ওটা নিভছে জ্বলছে।

ওটা কেনও নিভে যায়না। তাহলে তো ওকে পুড়তে হবে না।

প্ল্যানচেট করে যদি একবার নিয়ে আসি, যদি তা সত্যি হয়, জিজ্ঞাসা করবো, “ তুমিও কি কাঁদো? নাকি তোমাদের তা করতে নেই।

তুমি কি “উহ উহ” করো যখন তেলের ছিটে পরে আমার হাতটা পুড়ে যায়।

 নাকি শুধু দাড়িয়ে থেকে দেখো।

চোখ দিয়ে জল ঝরে, কিছু করতে পারনা, তাঁই ।

সেই যে বলতে, রান্নার কাজ তোমার দাড়া হবেনা।

আবারও বলবে কি?

জানি তুমি তা বলবে না। আগের মত পাশে এসে দাড়ও কি না, জানিনা।

যত্ন করে রাখা সাজানো বালিশ টা চেপে ধরে কাঁদো কি না।

জানিনা।

জানিনা, খোলা জানালা দিয়ে যে বাতাস এসে দুলিয়ে দিলো পর্দা টা  সেকি তুমি।

আমি জানিনা।

 দেখেছ কি ঘুনে ধরা কাঠ। আস্তে আস্তে ওর ভিতর টাকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে নেয়। শেষে একদিন ঝরে পড়ে।

আমি দেখেছি সেই কাঠ। দেখেছি সতেজ মসৃণ কাঠ টার মাঝে কালো কালো দাগ। মসৃণতা হারিয়ে গেছে। তবু সে দাড়িয়ে থাকে।

 কতদিন থাকবে এইভাবে?

 কাঠ টা জনেনা। শুধু জানে ভাঙ্গন ধরেছে তার গায়ে।

মনে পড়ে, প্রথম দেখা,

সুতীর শাড়ী পড়া।

চোখে কাজল, কপালে লাল রঙের টিপ। চোখের কাজল ঢেকে যায়নি সাদাটে রঙের চশমাতে।

ঠোঁটে হাসি।

বলেছিলাম, এই হাসি অন্য কারো জন্য নয়, শুধু আমার।

হাটতে যেয়ে যে ছন্দে দুলে উঠত ওর শরীর সেতো শুধু আমিই দেখেছিলাম।

এই সব স্মৃতি ভাবতে যেয়ে চোখে জল এলো। মনে হোল বলি, তুই কেনও বাহিরে এলি।

হয়তো এই চোখটা ছিল আমার সুখ সৃষ্টির নীড়। আজ এই কষ্টের ভিড় সইতে পারলনা।

রাত হোল। পাশাপাশি দুই বালিশ পাতা বিছানা ডাকছে আমায়। মনে পড়ে অনেক আগে পড়েছিলাম।

“ যখন ঘুম আসে,তখন স্বপ্ন আসে

  যখন স্বপ্ন আসে। তখন তুমি আসো

  আর যখন তুমি আসো, তখন ঘুম আসেনা”।

ঘুম হারিয়ে গেছে অনেক আগে, আজ খুলে রাখব জানালা টা, হয়ত বা আসবে সে।

 

Continue Reading

এক জীবন ভালবাসা

 তখনো দেখেনি তাকে, যে এসে ছিল পায়ে পায়ে, আটপৌড়ে শাড়ী পরে, কপালে টিপ, নাকে নাক ফুল, ঠোটে আলতো করে আকা রং, দুপাশে বেনি, থাক —-এসব কথা আসবে পরে

    ফিরে যাই ছোটো বেলার দিন গুলোতে, হাফ পেন্ট পরা ছেলেটা নাম তার কৌশিক, ধুলো মাখা পায়ে দৌড়ে এসে দেখলো স্কুলের সময় হয়ে গেছে,মারবেল টাই যতো নষ্টের মুল ঝটপট চান সেরে দৌড় দিলো স্কুলের দিকে মা ডাকলোকৌশিক ভাত খেয়ে যা বাবাসময় নেই স্কুলের ঘন্টা পড়ে যাবে সেই দুরন্তপনা কোথায় গেলো

     জাম্বুরা কে ফুটবল বানিয়ে খেলায় কতনা আনন্দ তাতো উপভোগ করেছিলো সেই ছোট বেলায়কাচের মান্জা দেওয়া সুতো দিয়ে ঘুড়ি উড়ানো, ‘ফক্কা, কেটে দিয়েছে একটা ঘুড়ি, ছেলেরা ছুটছে কেটে দেওয়া ঘুড়ির পিছনে মনে পরে স্কুল পালিয়ে নদিতে ঝাপ দেওয়া ড়াংগুলি খেলতে যেয়ে যেদিন পাশে দাড়ানো মেয়ে টার নাকটা ফাটিয়ে দিয়েছিলো সেদিন ভয়ে সে জড়সড় বাসাতে ফিরলে জানি আজ একটা হেস্ত নেস্ত হয়ে যাবে না কিছু হয়নি যেদিন আট আনা দিয়ে বাসে টিকিট কিনে চলে গিয়ে ছিলো দুরের এক শহরেআলি বাবা চল্লিশ চোরসিনেমা দেখতে, সেদিন ভয় আসেনি রাতে ফিরে এলে কি হবে সে যাত্রা দাদি বাচিয়ে দিয়ে ছিল তখন কতবড় সে? চতুর্থ শ্রেনিতে পড়ে যেদিন তিন মাইল হেটে গিয়ে ছিলো আরাপপুরে পুতুল নাচ দেখতে সেই কৌশিক আজ একলা বসে ভাবছে কোথায় গেলো সেই আনন্দ মুখোর দিনগুলো

       এতো দুরন্তপনা করেও কৌশিক ক্লাসে প্র্থম অথবা দ্বিতিয় স্থানের নিচে নামেনি আস্তে আস্তে হাফ পেন্ট ছেড়ে সে ফুলপেন্ট ধরেছে দুরন্তপনা এখন তার মধ্যে নেই এসেছে সাবলীল গতি সে হয়েছে ফুটবল টিমের কেপ্টেন, স্কাউটের গুরুপ লিডার সেদিন কৌশিকের চোখে কোনো স্বপ্ন ছিলোনা ভাবেনি তার ভবিষ তাকে কোনদিকে নিয়ে যাবে সে ভাবে কেনো জীবনটা সেদিন ওখানেই থেমে যাইনি তাহলে আজ তার জীবন বিসলেশন করার কোনো প্র্য়োজন ছিলনা থেমে না যেয়ে ভালই হয়ে ছিলো দেখা হয়ে ছিল তার সাথে যে দিয়ে ছিলো তার জীবনের পরিপুর্নতা কৌশিকের জীবন টা ছিলো বাধা হিন বলগা হরিনের মত কৌশিক, মফস্বল শহরে এক ডাকে পরিচিত নাম

       মাধ্যমিক পরীক্ষায় চার টা লেটার নিয়ে সে পাশ করলো ১৯৬৬ সালে ছোট্ট টিমটিমে জ্বলা শহর থেকে সে এলো উজ্জল নিয়ন সাইনে ভরা ঝলমল শহরে দেশের রাজধানী এখানে সে অনেকের মধ্যে একজন পিছনে ফেলে আসা ছোট্ট শহরটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে না পিছনে সে তাকাবেনা তাকে সামনে আগিয়ে যেতে হবে ভর্তি হলো সব চেয়ে নাম করা কলেজে হস্টেলে থাকা কালিন বন্ধুত্ব হলো অনেকের সাথে রাতের অন্ধকারে বেড়িয়ে পড়ত বন্ধুদের সাথে শাসন করার কেউ নেই নিজের দায়িত্ত নিজের কৌশিক জানতো আলোয় ঝলমল শহরে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা অনেক

   দুবছর পার হয়ে গেলো কোথা দিয়ে সে নিজেও জানেনা কলেজ শেষ রেজাল্ট ভালো সামনে ভবিষ জানে না তার তরী কোথায় যেয়ে ভিরবে জীবনের নতুন অধ্যায়ে আদৌ সফলতা আছে কিনা

ভর্তি হলো ফার্মেসিতে হেসে খেলে বন্ধু বান্ধবিদের নিয়ে ভালই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো

     সেই চলার পথে হঠা করে কেনই বা দেখা হয়ে ছিলো দুই বেনি বাধা মেয়ে টার সাথে যদি দেখাই হয়ে ছিল তবে কেনই বা দুজনে দুজনের চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে ছিলো আজ কৌশিক জীবনসায়াহ্নে বসে অতীতের দিকে ফিরে চাইছে

   দেখা হয়ে ছিল বোনের বাসায়, চোখে কাজল, কপালে টিপ, পরনে সাদা শাড়ী কালো পাড়, ছিপ ছিপে গরন জিজ্ঞাসা করে ছিলো তাকে, “ তোমার নাম কি?” বলল, কনাআপনি বুঝি ভাবির ভাই

বাহ, জেনে গেছ” “ সাদা শাড়ী কালো পাড়ে তোমাকে বেশ মানিয়েছে কৌশিক ভাবল কথা বলাটা ঠিক হলো কিনাপ্র্থম দেখায় কোনো মেয়েকে একথা বলতে নেই” “ তা কেনো, যা দেখতে ভালো তা বলতে বাধা কি কোনো সংকোচ সে দেখেনি তার মাঝে উচ্ছলোতায় ভরা কি এক অনাবিল আনন্দ।। কি এক অমোঘ আকর্ষণ যে আকর্ষণ বার বার কৌশিক কে ফিরিয়ে এনেছে ওখানে কিসের টান সে জানেনা সেই শুরু

           কনা ভর্তি হবে বিশ্ববিদালয়ে উপদেশ চায় কৌশিকের কাছে ঘরে একেলা দুজন অনর্গল হাসির ফোয়ারা বইছে কবে কখন কনা কৌশিকে তুমি বলে ডাকতে শুরু করেছে, সে নিজও জানে না কৌশিক ওর হাত টা হাতের মধ্যে চেপে ধরে বলেছিল, “ ঠকবে না তুমি, কথা দিলামকনার চোখে জল, “ তুমি থেকো আমার মাঝে চিরজীবনের জন্যবলতো,” তুমিই একমাত্র মানুষ যার হাতে আমি হাত রেখেছি, তোমার হাতেই আমি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই

     কৌশিক প্র্তিদিন আসে ছাত্রীহলের গেটের কাছে কনা বেড়িয়ে আসে, কৌশিক বলে, “তুমি এলে পাশের অনান্যরা এতো ম্লান হয়ে যায় কেনো?” “তোমার চোখে আমাকে দেখো তাই

কনা বলত, “ ঝড়ের মতই তুমি এলে আমার জীবনে ভালবাসার মধ্যে যে এতো আনন্দ তাতো বুঝিনি আগে কতদিন তারা কাটিয়ে দিয়েছে খোলা আকাশের নিচে বসেছে দুগাছের ছায়ায় সন্ধ্যা হয়ে আসে কথা ফুরাতে চায়না

     নদীর জল অনেক গরিয়ে গেছে কৌশিক হারিয়ে গেছে দুই বেনি বাধা মেয়েটির মাঝে সে বলেজানো কনা, গান আমার গলায় আসেনা তবু গাইমোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম কনা বলে, “ তাই”?

   পেরিয়ে গেছে সময় দুজন দুজন কে বুঝে নিয়েছে বুঝেছে একেছাড়া অন্যের অস্তিত্ব নেই মাঝে মাঝে কৌশিক গাইতো, “আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই তাই গো” , কনা ওর ঠোট দিয়ে আলতো করে কৌশিকের ঠোট টা চেপে ধরে বলত,” গাইতে হবে না আমি জানি

     কৌশিকের পরীক্ষা শেষ এবার যাবার পালা আমেরিকা আসার ব্যবস্থা তার অনেক আগেই হয়ে ছিলো ইমিগ্রেশন নিয়ে আসবে তার বন্ধুরা অনেক আগেই চলে গেছে ১৯৭৪ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্কের পথে রওনা দেবে আসার আগের দিন দুজনে এসে বসলো ইগলু ক্যাফেতে অনেক কথার পর কৌশিক বলল, “ একটা বছর অপেক্ষা করো, আমি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যবো বাইরে মুষলধারে বূষ্টি সন্ধ্যা হয়ে এলোচলো তোমাকে পৌঁছে দেই তোমার ভাইয়ের বাসায়,” ওর চোখে জল বলল, কাল আকাশের দিকে চেয়ে থাকবো যতক্ষন না তোমার প্লেনটা উড়ে যায়

     যাবার দিন মা বাবা এলো কৌশিককে বিদায় দিতে মার চোখ ভিজা বলল, বাবা সাবধানে থাকিস, এতদুর পথভেবো না মা, চিঠি দিয়ে সব জানাবো বাবা শুধু তাকিয়ে থাকলো হাত নেড়ে কৌশিক বিদায় নিলো যাওয়ার পিছনে আনন্দ বিরহ মিশানো চোখের জল সে দেখেছে কনার, দেখেছে মা ,অজান্তে চোখ ওর ভিজে এলো এই বিরাট শুরুর পিছনে মা বাবার দান কত কৌশিক ভাববার চেস্টা করলো বাবা মা তাকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলো মধ্যবিত্ত সংসারে অভাব সে দেখেনি কোনদিন, দেখেনি মা বাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব সেকেলের প্রেম দিয়ে গড়া ছিলো দুজন আজ কৌশিক নিজের প্রেম দিয়ে বুঝতে চেস্টা করল মা বাবার প্রেম মা কে ছাড়া বাবা চলতে পারতো না, মা চলতে পারতো না বাবাকে ছাড়া হয়ত তারই ছায়া এসে পড়েছিলো কৌশিকের উপর এয়ার হস্টেসের ঢাকে সে ফিরে এলো বাস্তবেকোনো ড্রিঙ্কস নেবেকৌশিক তুলে নিলো সেভেনআপ. তাকিয়ে থাকলো জানালা দিয়ে উড়োজাহাজ তখন আকাশে

       নিউ ইয়র্কের মাটিতে যখন সে পা দিলো তখন রাত তিন টা কৌশিক বাইরে এসে দেখে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে না অপেক্ষা করার তো কথা ছিল? প্লেন আসতে দেরী হওয়াতে ওরা চলে গেছে কৌশিক কি করবে বুঝতে পারছে না নিজেকে অসহায় মনে হোলো বিদেশ বিভুই বলে কথা এতো বড় শহর, ইংলিশ জানে কিন্তু বলার অভ্যাস নাই অজানা আতংকে তার শরীর শিউরে উঠলো নিওনের আলো তার কাছে ঝাপসা লাগছে বিশ ডলার তার পকেটে এই ডলার দিয়ে কতটুক পথ যেতে পারবে তা সে জানেনা যে দিকে তাকায় সাদা কালো মুখ বাংলায় ডাক শুনে কৌশিক ফিরে তাকালোআমাকে বলছেনকৌশিকের প্র্শ্নহা,কেউ আসেনি বুঝিদেখছি না তো?” “কোথায় যাবেনভদ্র্লোকের প্র্শ্ন কৌশিক হাতের কাগজটা আগিয়ে দিলো

ঠিকানাটা দেখে বললেন, “ আপনি কি ফার্মাসিট? “ “কি ভাবে বুঝলেন” “ ঠিকানা দেখে, বেশির ভাগ ফার্মাসিট ওখানেই থাকে, আমিও ওই দলের, তবে থাকি অন্যখানেপরিচয় হলো উনি কৌশিকের থেকে পাচ বছর সিনিয়ার এসেছে ভাগনেকে নিতেপয়সা করি কিছু আছে?” বিশ ডলার ওতেই হবে টেক্সি ঠিক করে দিচ্ছি সোজা চলে যান কৌশিক ভাবলো যাক একটা হিল্লে হলো টেক্সি চলেছে কখনো আস্তে কখনো জোর

   রাতের নিউ ইয়র্ক বইয়ে পড়েছে, ছবিতে দেখেছে বন্ধুরা গল্প করতো, জানিস এম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিং, এত উঁচু, নিচের থেকে যদি ওর মাথা দেখতে চাস, তবে তোর মাথার টুপি পড়ে যাবে শুনে এসে ছিলো রাস্তায় কাগজ পড়ে থাকে, লোকে পয়সা পাশে রেখে কাগজ নিয়ে চলে যায় সে ভুল পরে তার ভেঙেছিলো

ট্যাক্সি এসে দাড়িয়েছে তিন রাস্তার মোড়ে ট্যাক্সিচালকের লাল বাতি সে দাড়িয়ে আছে এত রাতে নিস্তব্দ রাস্তা তবু সে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক এতে অভ্যস্ত নয় একথা সে লিখে জানিয়ে ছিল তার ছোট বোন কে

ট্যাক্সি এসে দাড়ালো , ভাড়া মিটিয়ে কৌশিক উঠে গেলো উপরে সবাই ঘুমাচ্ছে, একজন বলল, পাশে শুয়ে পর, সকালে কথা হবে পকেটে রইলো মাত্র্ দশ ডলার

             বাবা জানতো তার ছেলে ফার্মাসিস্টের কাজ নিয়ে গেছে আসলে তা নয় এখানে ফার্মাসিস্ট হওয়ার পথ কঠিন না হলেও, অতো সহজ নয় অনেকের মতে একেবারেই সহজ নয় যে ছেলে কোনদিন ঘাসের কুটোটা ছেঁড়েনি, বাজারের থলে হাতে বাজারে যায়নি, গায়ে ফু দিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আর লেখাপড়া করে কাটিয়ে দিয়েছে, তাকে আজ কাজ নিতে হয়েছে একটা টয় ফ্যাক্টরিতে আট ঘন্টা কাজ দুই ঘন্টা পর দশ মিনিটের জন্য বিশ্রাম মেশিন থেকে প্র্তি সেকেন্ডে বেরিয়ে আসছে টয়ের একটা অংশ আর কৌশিক সেই গরম অংশটাকে টেনে বের করে পাশে রাখছে কাজ শেষে বাহিরে এসে দাঁড়াল, হাতের আঙ্গুল গুলো লাল আজ চোখে জল আসতে দিলো না কৌশিক, ভেসে উঠলো কনার মুখ, ভেসে উঠলো মা বাবার মুখ, কনা কে কথা দিয়ে এসেছে, আশ্বাস দিয়েছে বাবা মাকে   ভেঙে পড়লে চলবে না

     তিন বন্ধু মিলে বাসা নিয়ে ছিলো টয় ফেক্টরির কাজ ছেড়ে, চাকরি নিলো এক ফর্মাসিউটিক্যাল কোম্পনীতে উচু মানের কোনো চাকরি নয়, তবুও খাওয়ার পরার পরে কিছু ডলার বাড়তি থাকবে তার কিছু অংশ পাঠিয়ে বাবা মার মুখের হাসি সে দেখতে পাবে হিসেবের অংক কসে সে বুঝতে পারবে কবে আসবে ফিরে যাবার দিন টা যে দিন কনাকে দেখবে ,দুজন এক সাথে হবে, সংসার বাধবে বলে এসে ছিলো এক বছর পর আসবো

       চিঠি আসে প্র্তি সপ্তাহে লেখাতে কত সতর্কতা, অত বেশি কাজ করোনা, শরীর খার হয়ে যাবে কৌশিক ভাবে বিধাতা ভালোই করেছে ভবিষ জানতে দেয়নি তাইতো তুলির আচড়ে গড়ে নিয়েছে সে তার নিজের ভবিষ এখানে নেই কোনো দ্বন্দ্ব, নেই কোনো প্র্তিঘাত, আছে শুধু উচ্ছাস আছে শুধু আনন্দ , তুলির আচড়ে আচড়ে একেছে সে কনার হাসি ঝরা অবয়ব মূর্তি ভাঙবার নয় মূর্তি তার হৃদের তন্ত্রীতে গাথা        

কিরে? যাবিনে, বন্ধুর ডাকে ফিরে এলো বাস্তবেসিনেমা তো আরম্ভ হয়ে যবে প্র্তি বন্ধের দিনে ওরা যায় ভারতীয় হিন্দি ছবি দেখতে এই হচ্ছে তাদের রিক্রিয়েশন. “তোর এই উদাস উদাস ভাব কবে কাটবে?” “ এবার কনা ছেড়ে অন্য কিছু কল্পনা করএক বন্ধুর মন্তব্য কৌশিক ওদের কে বুঝাতে পারে না, যা সে পিছনে রেখে এসেছে তা তার জীবনের এক বিরাট অধ্যায়

   “কি রে গলা ভিজাবি আজকে?’” ওটা চলে না কৌশিকের বললনা তোরা পান করিস, আমার কিছু লেখা শেষ করতে হবে ওকে বলে লাভ নেই, গোতম বুদ্ধো,মন্তবো করলো আর এক বন্ধু মূভি শেষে ওরা নিয়ে এলো লাল পানিয়ো, এটাও একটা রিক্রিয়েশন, পাচ দিন অক্লান্ত পরিশ্র্মের পর একটু আমেজ, একটু আনন্দ, এইতো ওরা চেয়েছে ,এর বেশি কিছু নয়

     দেখতে দেখতে বছর ঘুরে এলো, এবার দেশে যাওয়ার পালা কিছু কিনা কাটা করতে হবে বিয়ের বাজার বলে কথা কৌশিক ওর এক ভাবিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো   “কি কি কিনতে হবে জানো কি?”ভাবি জিজ্ঞাসা করলআমি কি ভাবে জানবোবলল কৌশিকমাপ জানো” “ কিসের মাপকৌশিক আকাশ থেকে পড়লো

এইযে ৩২, ৩৩ বি , সিভাবি, স্পষ্ট করে বলো যে পাতলা গঠোনের কৃষাংগ মেয়ে টা দেখছো, ওরকম হবেকি? “ ভাবির প্র্শ্নতা হবে, তবে লম্বায় নয়বুঝেছি তুমি দাড়াও এখানে, আমি আসছি বলে ভাবি চলে গেলো ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর এবার কৌশিক বুঝতে পাড়লো ভাবি কি বলতে চাইছিলো

কেনা কাটা শেষ, নিয়েছে কসমেটিক, কিনেছে গোলাপি সুটকেস

     এয়ার পোর্ট এসেছে অনেকে কৌশিককে বিদায় দিতে গুডলাক এন্ড গুডবাই জানালো সবাই আস্তে আস্তে ভিতরে চলে গেলো কৌশিক কোন দ্বিধা ভয় মনের মধ্যে আসেনি শুধু উচ্ছাস, শুধু আনন্দ বাবা মা কে দেখবে, দেখবে কনাকে একদিন পেরোনোর পর উড়োজাহাজ এসে দাড়ালো তার গন্তবো স্থানে   দাড়ালো টারমিনাল থেকে বেশ দুরে সকাল এগার টা রৌদের তাপ বাড়ছে কপালে ঘামের রেখা হাত দিয়ে মুছে এগিয়ে গেলো টারমিনালের দিকে

     বেরিয়ে এসে কৌশিক দেখলো বাবা দাড়িয়ে আছে, পাশে কনা এক গোছা ফুল নিয়ে বান্ধিদের সাথে যাওয়ার আগে কৌশিক বাবা মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ছিলো কনাকে বাবা বলল, “ চলো, বাহিরে গাড়ি অপেক্ষা করছে, “ বাবা এগিয়ে গেল কনা ওর হাতের ফুলের তোরা কৌশিক কে দিয়ে বলল, “ অনেক ক্লান্ত লাগছে তোমাকেওর বান্ধবি মাগফের বলল,” কৌশিক ভাই অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে, ওজন বেড়েছে মনে হচ্ছে,:

তোরা থামবিকনা ধমোক দিলো

ওতো তোরই থাকবে, আমাদের কে একটু আনন্দ করতে দে

গাড়ী এসে দাড়ালো বাসার সামনে মা বেড়িয়ে এলো জড়িয়ে ধরে বলল,” অনেক শুকিয়ে গেছিস পিছনে কনার বান্ধবীর একটু মুচকে হাসলো সব মা রাই এরকম বলে বৌদি বেড়িয়ে এলো, বলল,” কি দেবর মশাই এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে, মন টিক ছিল না বুঝি?” “ তা যা বলেছো, বড় কঠিন পীড়া ছোট বোন দুটো দৌড়িয়ে এলো, “আচ্ছা তোমরা সব দাড়িয়ে দাড়িয়ে বকর বকর করবে, না সুটকেস গুলো খুলে দেখবে কি কি জিনিস এনেছে সবাই হেসে উঠলো মা কনাকে বলল, “ যাওতো মা, ওর ঘরে ওর কাপড় চোপড় গুলি গুছিয়ে রাখোকনা বাসার অতি পরিচিত মুখ এই সংসারের এক জন হয়ে গেছে শুধু কাগজে কলমে নয় দরজাটা ভেজিয়ে দিলো কৌশিক, কনা কি জেনো বলতে চাইলো বলা হলো না ওর ঠোট টা হারিয়ে গেলো কৌশিকের ঠোটের মাঝে সন্ধা ঘনিয়ে এলো কনা আর তার বান্ধবিরা ফিরে যাবে ছাত্রীহলে কনা মার কাছে যেয়ে বলল,” কাল ফিরে যাবো বাবা মার কাছে, লজ্জায় লাল”,মা জড়িয়ে ধরে কপালে চুম দিয়ে বলল, “ এসো মা এক ঝলক তাকালো সে কৌশিকের দিকেচলো তোমাদের কে এগিয়ে দিয়ে আসি

     ২৬শে অক্টোবর বিয়ে এক অদ্ভত অনুভুতি যাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখতো আজ তা বাস্তবে পরিনিত হতে চলেছে এক বিরাট দায়িত্ব পারবে কি সে ? বৌদি ডাক দিলো, “ দেবর পো এদিকে একটু এসো, এই লিস্ট টা দেখো সব ঠিক আছে কি না

তোমরা করো আমাকে জরিও না, বলল কৌশিকতা না কেনো, তুমি বসে বসে তোমার কনার ধ্যান করো আসলেই তাই সে ওর কথাই ভাবছিলো, অতিত, বতর্মান, ভবিষ্য

     সব ঠিক কনা দের বাড়ী ছোট শহরে যেতে হবে প্লেনে, তারপর মাইক্রোবাস যথারিতি, যথা সময়ে শুভ কাজ সম্পন্য হলো অপুর্ব লাগছিলো ওকে বিয়ের সাজে কপালে টিকলি, নাকে নথ, গলায় হার, আলতো করে রংএর প্র্লেপ কৌশিক চোখ ফেরাতে পারে না, লজ্জায় নতো হওয়া সুযর্মুখি, রুপ সে দেখিনি আগে জেনো লজ্জাবতি ফুল টোকা দিলেই ঝরে পড়বে কৌশিক আলতো করে মুখ টা উঠালো ওর চোখের সামনে, পলক পড়েনা চোখে, বলে , কি সুন্দর রুপ তোমার, আগেতো দেখিনি কখনো কনা বলে তোমারই হাতে গড়া, তোমারিই চোখে দেখা

       কৌশিক নিয়ে এলো কনা কে ওদের বাসায় মা বৌদি দাড়িয়ে আছে বৌ কে বরন করবে, হাতে দুধের পাত্র্, কৌশিক জানেনা এসব রিতি দুর থেকে ভেসে আসছে গানের কলি, “এসো এসো আমার আমার ঘরে এসো আমার ঘরে আজ সে বৌ হয়ে এলো বাসায় জড়িয়ে গেলো সুখ দুখের সাথে কৌশিক বলেছিল, “অনেক কষ্ট করতে হবে

ওখানে, পারবে তোতুমি পাশে থাকলে কোন কষ্ট আমার হবেনা

       দেখতে দেখতে তিনটি মাস হেসে খেলে কেটে গেলো এবার কৌশিকের ফিরার পালা বাবা কে বলেছিলো ওখানে সে কি করে মা কে সে বলেনি মার চোখের জল সে দেখতে চায় না বাবা বলেছিলো, কোনো চিন্তা করিস না, বৌমাকে আমি দেখে রাখব কে জানতো বাবার সাথে এই হবে তার শেষ দেখা কনা চুমো দিয়ে ওকে বলেছিলোচোখের জল দিয়ে তোমার পথ ভিজাবো না, তাতে তোমার অমংগল হবে, যেদিন তুমি আমাকে ডেকে নেবে, সেদিন যেয়ে তোমার কষ্টের ভাড় আমিও বইবো তোমার সাথে

         ফিরে এলো কৌশিক, রেখে এলো কনাকে এখন সে আর একা নয়, তাকে পায়ে দাড়াতে হবে যত কঠিনই হোক রেজিস্টারড ফারমাসিস্ট তাকে হতেই হবে

         একদিন কৌশিক গেছে বাহিরে ফিরে এসে দেখে ঘর ভর্তি, সব বন্ধু বসে আছে ছেকে ধরল তাকে বলতে হবে বাসর রাতের কথা সহিদ এসে বলল, “ শোন এখানে পিপ সো আমরা দেখেছি, এবার বাছাধন তোমার পিপ সোর কথা বলো হাউ ডিড ডু? ওরা সবাই কনা কে চেনেকৌশিক জানে এরা নাছোর বান্দা একটা কিছু তাদের কে বলতে হবেইশোন সবাই নড়ে চড়ে বসলো ভিষন উদগ্রীব,ঘর নিস্তবধ সবার চোখ কৌশিকের দিকেপীপ সো তোরা দেখেছিস নো দা সিচুয়েশন নো হোয়াট ইজ গোয়িং অন, এখন আমার মুখটা বসিয়ে দে ছেলেটার মুখে আর কনার মুখটা বসিয়ে দে মেয়ের মুখের উপর খেল খতম পয়সা হজম ওরা মোটেই সন্তুষ্ট নয় আরো রসালো কিছু আশা করছিলো

       কৌশিক শুরু করলো বিনা পয়সায় ইন্টানর্শীপ একটা ফার্মেসিতে আট ঘন্টা কাজ তারপর বেরিয়ে পড়ে রুজির সন্ধানে কাজ নিয়ে ছিলো ওয়েটারের, এক রেস্টুরেন্টে সব কাজ সেরে ফিরতো রাত একটায় পড়াশুনা করতো ট্রেনের ভিতর, যতটুকু সময় পেতো সপ্তাহে সাত দিন কাজ বিরাম নেই

       দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেলো কনার আসার ব্যবস্থা পাকা বাসা নিতে হবে কৌশিকের চিন্তার অন্ত নাই বাসা পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যপার চাইলেই পাওয়া যায় না বিধাতা হয়তো ওর মনের কথা শুনতে পেয়ে ছিলো

রাতে একটা ফোন এলো রউফ ফোন করেছে ঘনিস্ট বন্ধু বিবাহিত থাকে বৌ নিয়েএকটা ওয়ান বেড রুম এপার্টমেন্ট খালি হয়েছে আমাদের বিল্ডিং তুই তাড়াতাড়ি খোজ নেসকালে যেয়েই আমি খোজ নেবোবলল কৌশিক এপাশ ওপাশ করে রাত টা কেটে গেল সকাল দশ টায় কৌশিক এসে হাজির খবর নিয়ে জানলো সুপার বাহিরে গেছে ফিরবে ঘন্টা খানেক পর কৌশিক বসে রইলো সামনের সিঁড়িতে জাগাটা ভালো লাগলো কৌশিকের পা বাড়ালেই পাতাল রেলপথ বায়ে মোড় নিয়ে একটু গেলেই পোস্ট অফিস দু ব্লক দুরে এন্ড পি সুপার মার্কেট কনার অসুবিধা হবেনা বাজার করতে ভাবনা শেষ না হতেই কৌশিক দেখলো লম্বা প্রায় ছয় ফুট, হেংলা পাতলা মুখে খোচা খোচা দাড়ি একজন ওর পাশের শিড়ি দিয়ে উপরে উঠছে সে আগে কখনো সুপার কে দেখেনি নাম জানে কেনেথ উইলিইয়াম মনে হয় এই হবে সুপারমিঃ উইলিইয়াম?” ডাক দিতেই ভদ্র্লোক ফিরে তাকালো কৌশিকের দিকেইয়েস?” “ আই হার্ড দেয়ার ইজ ওয়ান বেড রুম অ্যাপার্টমেন্ট অ্যাভেইলেবল ?”মিঃ উইলিয়াম কৌশিকের আপদ মস্তক দেখলো, “হু টোলড ইউকর্কশ কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো

কৌশিক আমতা আমতা করে বললো, “আমার এক বন্ধু রউফ এখানে থাকে, সে বলেছিলো,” “ইয়া, আই হাভ বাট — “ কৌশিক এই বাট শুনে বুঝতে পাড়লো সে কি চাইছে” “ হাউ মাচ আই হ্যাভ টু গিভ?”

ফিটি ডলার

নো প্রবলেম” “কান আই হাভ লুককৌশিক জানালো

লেটস গো

.কৌশিকের পছন্দ হলো বেশ বড় বসার ঘর বড় বড় জানালা, জানালা দিয়ে আলো এসে পরেছে বসার ঘরে শোয়ার ঘর টাও মন্দ নয়হাউ মাচ ইজ দা রেন্ট?” কৌশিকের প্র্শ্ন “ “২১০ ডলার

কৌশিক রাজি সব ঠিক কৌশিক চিন্তা মুক্ত বেরিয়ে আসার পথে সুপার ডাক দিলো তাকে বলল, “ নিচে একটা পুরানো সোফা আছে ফেলে দেবো, যদি চাও নিতে পার জেনো শাপে বর বলল,” নিশ্চয়পড়ে পাওয়া সোফা দিয়ে ঘর সাজালো যে রেস্টুরেন্টে কাজ করতো তাদের ফেলে দেওয়া কফির জারগুলি নিয়ে এলো এলাচ, দারচিনি, হলুদ, মরিচের গুড়া দিয়ে সাজিয়ে রাখলো থরে থরে ৫০০ ডলার দিয়ে একটা বেডরুম সেটও কিনে ফেললো

         আজ কণ্ঠার অবসানের দিন অনেক অপেক্ষার পর এসেছে সেই দিন ১২টা ১০ মিনিটে প্লেন আসবে কেনিডি এয়ারপোরর্টে কনাকে দেখবে নতুন জীবন শুরু হবে এক অজানা শিহরন কৌশিকের সারা শরীর দোলা দিচ্ছে সেই চোখ, সেই মুখ, সেই ঠোট

       গত রাতে ফারুক কে বলে রেখেছে তার টোপ খাওয়া গাড়িটা নিয়ে যবে কনাকে আনতে সে রাজি, তবে বললতোদের অশোভন কাড়জো কলাপ আমাকে দেখতে হবে নাতো” “ তোর দেখে অভ্যাস আছেবলল কৌশিক প্লেন এসে নামলো সময় মতো কৌশিকের মনে হচ্ছে সে অনেক ক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে পায়চারি করছে দ্রুততুই একটু ধৈয্ ধরবিফারুকের মন্তবো কৌশিক পায়চারি বন্ধ করে এসে দাড়ালো চোখ তার

দেয়ালে ঢাকা দরজার দিকে হালকা নীল রং এর শাড়ীর আভা সে দেখতে পেলো নীল রং শাড়ীতে মোড়ানো কনাকে অপুর্ব লাগছিলো কৌশিকের চোখে ছোট্ট একটা মিস্টি হাসি দিয়ে কনা তাকালো কৌশিকের দিকে কৌশিক এগিয়ে দিলো লাল গোলাপের তোড়া আলতো ভাবে চুমো দিলো কনার ঠোটে

           কৌশিক ছুটি নিয়ে ছিলো কয়েকদিনের জন্য যেদিন সে এসেছিল তার পরদিনই

গেল সাকর্ল লাইন পরনে বড় বড় ছাপ দেওয়া শিফনের শাড়ী, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা অপূর্ব লাগছিলো কনাকে কৌশিকের চোখে

বলল,” শাড়ী সামলিয়ে রাখতে পারবে তো, ভীষন বাতাস হবে বোটেবোট চলছে কনা ডাক দিলো কৌশিককে

দেখ দেখ এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, বুঝি টুইন টাওয়ার,” খুশি, আনন্দে উছলে পড়ছে দুজনে কৌশিক বললো,” আইস ক্রিম কোণ খাবে?” আপত্তি নেই কনার কৌশিক নিয়ে এলো রেলিং সে হেলান দিয়ে দাড়ানো, বাতাসে শাড়ীর আচল উড়ছে ওটাকে সামলাতে গিয়ে আইসকি্র্মটা পড়ে গেলো পানিতে হাতে রইল শুধু কোণ

কনা তখনো শাড়ী ছেড়ে পেন্ট ধরেনি, লাল শাড়ীতে ওকে ভীষন মানাতো, অপুর্ব লাগতো কৌশিকের চোখে দুজনে বসে থাকতো রেডীও সিটি মিউজীক হলের এর সামনে বসে থাকতো রকফেলের সেন্টারের স্ট্যাচু এর সামনে কনা কৌশিকের কাধেঁ মাথা রেখে বলতো, “ দেখারতো শেষ নেই, সোনা, এখন আমি তোমার কাধে মাথা রেখে তোমাকে দেখবোকৌশিক ওর ঠোট দিয়ে চেপে ধরতো কনার লালচে রং এর ভেজা ঠোট হারিয়ে যেতো দুজনে ভালোবাসার গভীর বন্ধনে

           কনা কাজ নিল ম্যানহাটানের একটি কলম কারখানায় ভোর সাতটায় বেড়িয়ে যায় কৌশিকও বেড়িয়ে পড়ে সেই সাথে কাজ সকাল আটটা থেকে রাত একটা রাতে ফিরে এসে দেখে কনা ঘুমিয়ে আছে দেখা তাদের হতো সাবওয়ে স্টেশনে কনা ফিরতো কাজ থেকে , কৌশিক যেতো তার দ্বিতীয় কাজের দিকে মাঝপথে একই স্টেশনে মিলতো দুজন কিছু সময় কাটাতো একসাথে তারপর কনা চলে যেতো বাসার দিকে,কৌশিক যেতো তার দ্বিতীয় কাজে

         কোন অভিযোগ ছিলোনা কনার কোনদিন কৌশিক কনার মুখে হাসি ছাড়া কিছু দেখেনি মনে পড়ে কৌশিকের পাঁচডলার দিয়ে একটা কার্ট কিনে দিয়ে ছিলো বাজারসওদা আনার জন্য কি যে খুশি হয়েছিলো কনা সেদিন অল্পতেই খুশি ছিলো সে

       অবশেষে লাইসেন্স পরীক্ষা পাশ করে রেজিস্টাডর্ ফামার্সিস্ট হলো কৌশিক তারপর আর পিছনে ফিরে চাইনি

পাচঁ বছর পর কৌশিক আর কনার কোল জুড়ে এলো এক ফুটফুটে ছেলে সুসান্ত মাঝ রাতে দুধ গরম করে কৌশিক খাওয়তো সুসান্তকে কাঁদলে বুকে করে নিয়ে ঘুরতো কনা ঘুমাত, ওর মুখের দিকে তাকালে মনে হতো কি

শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সারা দিনের ক্লান্তির পর অনেক আদরে ওকে তিলেতিলে বড় করেছে কনা শহরের হট্টগোল থেকে বেড়িয়ে কিছু দুরে বাসা নিলো কৌশিক ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়াবে কনার কষ্ট বৃথা যাইনি সুসান্ত মস্তবড় ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেসে বেচেলার ডিগ্রি নিয়ে বেড়িয়ে ছিল একদিনের ঘটনা মনে পরে কৌশিকের

কৌশিক আর কনা গেছে সুসান্তর আবাসিক হলে অনেকক্ষন কাটিয়ে ওরা বেড়িয়ে এলো এসে দাড়ালো এক বড় রাস্তার কোনায়, রাস্তা পাড় হতে হবে সুসান্ত তার মার হাত চেপে ধরে আস্তে আস্তে পাড় হচ্ছে বলল, ভয় পেয়োনা আম্মু আমিতো আছি ছেলে তার মাকে পাড় করে নিয়ে গেলো কৌশিক চেয়ে চেয়ে দেখলো চোখে তার জল আজ সে নিশ্চিন্ত তার অবর্তমানে তার কনা হারিয়ে যাবেনা, তার কষ্টে মানুষ করা ছেলে তাকে আকড়িয়ে থাকবে

           কনা একদিন কৌশিকের কানে কানে বলে ছিলো চাদের এক পিঠ তো দেখলাম আমার অন্য পিঠ দেখতে ইচ্ছা করে বিধাতা তার আশা পুরন করেছিলো কোল জুড়ে এলো এক সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে সুস্মিতা সুস্মিতার সাথে আট বছরের ব্যবধান সুসান্তর সুসান্তর আনন্দ ধরেনা সব সময় সুস্মিতাকে নিয়ে সে খেলছে কখোনো আস্টে পিস্টে জড়িয়ে ধরছে কখনো কুস্তির লড়াই আর সুস্মিতা ভাই এর দুষ্টমিতে খিলখিল করে হাসতো আস্তে আস্তে হামা গুরি থেকে দাড়াতে শিখলো সুস্মিতা কৌশিক কাজ থেকে ফিরে জোড়ে ডাক দিতো, সুসু মেয়েটা দৌরিয়ে এসে বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়তো সারাদিনের কাজের ক্লান্ততা হারিয়ে যেতো এই ছোট্টো মেয়ে টার মাঝে চুমাতে চুমাতে ভরিয়ে দিতো ওর মুখ টা সেও আদর নিতো, আরো জোড়ে চেপে ধরতো বাবা কে

কনা বলতো,” মেয়ে টা আমার বুদ্ধির টোপলা ওকে মানুষ করতে আমার একটুও কষ্ট হয়নিবাবার পদাংক অনুসরন করে ভর্তি হয়েছিলো ফার্রমেসিতে ফিলাডিলফিয়া কলেজ অফ ফার্মেসিতে তিন বন্ধু মিলে নিয়ে ছিলো একটি বাসা বছর তার ছিলো এক সাথে ফার্ম ডী হয়ে বেরিয়ে এসেছিলো আজ বিরাট এক ফার্মে সে কাজ করে নিজের পায়ে দাড়িয়েছে অনেক পরিশ্র্ম করে ছেলে মেয়েকে মানুষ করে ছিলো কনা তাদের আজকের সফল প্র্তিষ্ঠার সব কৃতিত্ব তাদের মায়ের

           কৌশিকের মধ্যে ছিলো অর্গানাইজীং ক্যাপাসিটি বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো দুর পাল্লায় সব ব্যবস্থা করতো সে আনন্দ তার নিজের আনন্দ বাচ্চাদের আনন্দ সবার একটার পর একটা দেশ দেখেছে, দেখেছে সবাই মিলে, দেখেছে শুধু ওরা চার জন

       মনে পরে কৌশিকের, সুসান্ত সুস্মিতা তখন ছোট ওরা বেড়াতে গেছে দেশে দাদি ফুফুর কাছে রেখে দুজনে গেলো, কলকাতা, দিল্লি, আগ্র্রা , জয়পুর কলকাতার ভিক্টরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠে হাটতে হাটতে সন্ধা হয়ে এলোকৌশিক বলল,” চলো গাছের নিচে বসি অনেক তো হাটলাম “   “ চলো তোমার কোলে মাথা রেখে আমিও একটু জিরিয়ে নেবোসেই চলার পথ তাদের শেষ হয়নি

দিল্লির লালকেল্লা, কুতুব মিনার, শেষ করে এসে দাড়িয়ে ছিল তাজমহলের সামনে ইতিহাস ঘেটে লাভ নেই, সবারই জানা তবু কৌশিক কনা কে বলল, “ এই তাজমহলের ইতিহাস তো তোমার জানা, তাই না? যদি উল্টোটা হতো তাহলে তুমি কি করতে কনা কৌশিকের ঠোট টা চেপে ধরে বলেছিলো,” বালই সাঠ, ওকথা বলতে নেই, আমার অমংগোল হবেদিল্লি শেষে এসে পৌছালো জয়পৃর পিংক শহর ।। প্লেন থেকে নেমে চারিদিকে তাকাতেই এক জন এসে বলল, “মাইক্র্বাস লাগবে সাবলাগবেকোথায় যাবেন জানি না, তবে একটা ভালো হোটেলে চলেন, আমার জানা ভালো জায়গা আছে কোনো অসুবিধা হবেনা কতদিন থাকবেন?

তিন দিন একটু দ্বিধা লাগছে কনা বলল, দেখেতো টেক্সি ড্রাইভার বলে মনে হচ্ছে না লেখাপড়া জানা মনে হচ্ছে দামদর ঠিক হলো উঠে পড়লো কৌশিক আর কনাকৌশিক জিজ্ঞাসা করল ওর নাম বলল মহেন্দ্র্ চলতে চলতে কথা হলো, “ কতদিন ধরে এই ব্যবসায়ে,” এটা আমার ব্যবসা নয় স্যার কমার্সের শেষ বছরের ছাত্র্ আমি বাসায় বাবা মা আর ছোট একটা বোন

বাবা চাকরি করে, কলেজ এখন বন্ধ মাইক্র্বাসটা ভাড়া নিয়েছি,বন্ধের মধ্যে যা পাবো তা দিয়ে আমার আর বাবা কেও কিছু সাহায্য করতে পাড়বো কনা ঠিকি বলে ছিলো, সে তাকালো কনার দিকে, দেখলো ওর চোখটা ছলছল করছে এসে গেছি ছোট্টও একটা বাসা ছিমছাম একটা লোক দাড়িয়ে হিন্দিতে কি জেনো বললো ওকে

ওকে যাওয়ার দিন এতো টাকা দিয়েন, স্যার,” স্যার স্যার করোনা, আমার নাম কৌশিক, কনা তাহলে আপনি কৌশিক দা উনি কনাদি এই তিন দিন কি ভাবে চলাফেরা করবেন? আমি বলি কি এই কদিন আমিই আপনাদের কে নিয়ে সমস্ত জাগা দেখিয়ে নিয়ে বেড়াবো, এমনকি আজমির শরিফ নিয়ে যাবোএযেনো শাপে বড়তোমার পোষাবে তো? আজকের ভাড়া টা দিয়ে দেই,” নিলোনা সে বলল, এক সাথে যাওয়ার দিন দিয়েন প্র্তিদিন

ঘুম থেকে উঠে দেখতাম বসে আছে সে বাহিরে সব কিছ সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে ছিলো যাওয়ার দিন বলল,” কৌশিক দা যাবেন আমদের বাসায়, মা আপনাদের কে দেখতে চেয়েছে গিয়ে ছিলো ওরা অভর্থনার কোনো ত্র্টি ছিলোনা বিদায় বেলায় কনা তার ওড়নার আচল দিয়ে চোখ টা মুছে নিয়ে ছিলো

           চার জন মিলে ঘুরেছে অনেক দেশ টেমস নদীর পাশে বসে দেখেছে বিগবেন পড়ন্ত বেলা হাওয়াতে উড়ছিলো কনার সদ্য কার্ল করা চুল, কৌশিকের কাছে অপুর্ব লাগছিলো ওর ঘামে ভিজা মুখটা

   সেইন নদিতে বোটে চড়ে দেখেছিলো আলোয় আলোকিত প্যারিস ঝলমল করছে আইফেল টাওয়ার

আরক দে ট্রায়াম্ফের কাছে কৌশিকের কাধে মাথা রেখে বলেছিল,” এত সুখ আমার সইবেতো”,

লূভের মোনালিসার ছবির সামনে কতক্ষণ ওরা দাড়িয়ে ছিলো আজ কৌশিকের তা মনে নেই

    

ধুসর মরুভুমির মাঝে দাড়িয়ে পিরামিড দেখতে দেখতে কনা বলেছিল, “ সপ্তম আশচারযর এক আসচারয দেখতে পাবো ভাবিনি আগে প্র্চন্ড গরমে ওর মুখটা লালচে হয়ে এসেছিলো বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা কপালে কৌশিক মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলো কনা হাত দিয়ে ঘাম টা মুছে বলল, “ চলো স্পিক্নসা দেখে আসি

       হেটে ছিলো চারজনে বারসিলোনার রাম্বলাস এর পথে জমজমাট রাস্তা, নিউ ইয়র্কের মত সিটি ঘুমাতে জানেনা  

       প্রাগ এর চার্লস ব্রীজ এর উপর দিয়ে হাটতে হাটতে কৌশিক কনাকে বলে ছিল,” দাড়াও আর্টিস্টা কে বলি তোমার একটা ছবি একে দিতেকনা রাজি হয়নি জানে এক মাত্র্ কৌশিকের চোখে সে তুলোনা হিন

সেবার ওরা তিন জন এসেছিলো সুসান্ত আসতে পারেনি সুস্মিতা বলতো, “ আব্বু আমি সানত কে মিস করছি,’

ওরা জানে ভাই বোন একে অন্যের ছাড়া চলেনা সেখান থেকে ভিয়েনা, মোজার্টের ঘর কতকিছু দেখে ছিল

     রোমের পথে ঘুরে ছিলো, দেখে ছিলো মাইকেল এন্জেলোর আকা সিসটিন চেপেল কলেসিয়াম, যেখানে এক সময় হতো গ্লাডিয়েটর দের লড়াই হেটে ছিলো ফ্লোরেন্সের পথে, দেখে ছিলো ডেভিডের মুর্তি গনডুলায় চরে দেখেছিলো ভেনিসের সন্দর্যো

     নামাজপড়ে ছিলো ইস্তানবুলের বুলু মসজিদে এথেনসের পারথিওনের সামনে কত ছবিই না উঠিয়েছে ওরা চারজন সান্তরিনির সূর্য অস্ত দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো শেষ তারা গিয়েছিলো কোস্টারিকা এতো স্রীতী এতো আনন্দ কৌশিকের চোখে জল আনে কোথায় গেলো সেইদিন গুলো একদিন কনা কৌশিকে ডেকে বলল, “ সোনা একটা কথা বলব?” “বলো” “ পারবে আমাকে হজে নিয়ে যেতে, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা কৌশিক কথা রেখেছিলো দুজনে মিলে হজ সম্পন্য করে এসেছিলো

         সময় পেড়িয়ে গেছে দিন ঘুরে মাস, মাস ঘুরে বছর পেরল ছেলে বড় হয়েছে কনা সুসান্ত কে জিজ্ঞাসা করে,” এবার তো সময় হলো আব্বু, নিজের পায়ে দাড়িয়েছ, সঙ্গী একজনকে তো খুজে নিতে হবে আছে কেউ?”

না নেই, তবে ভাবছি অন্য গোষ্ঠির কোনো মেয়েকে নিয়ে এলে কেমন হয়?” সুসান্ত জানে মা এই উত্তরে রাগ হবে, মাকে রাগানোই তার উদ্দেশ্য কনা চায় নিজ ধমর্ের মেয়ে আনতে, প্র্শ্ন করে কৌশিককে, তোমার কি মত?

কৌশিক বলে,” আমার কোন কিছুতে আপত্তি নেই তা সে কালা ধলা মোটা কানা যা হোক, সংসার করবে সে, সুখ তার, সে যদি কালা ধলাতে সুখ গায় তাতে তোমার আপত্তি কি?” কনা রেগে বলে,” তুমিতো ফেরেশতা, কথা বলবে নাতো? আমি চাই আমাদের গোত্র্তোমার ছেলের বন্ধু বান্ধবি কোনো টাই গোত্র্ নয়, যদি ওখানকার কাউকে নিয়ে আসে তবে মেনে নিয়ে নয়, না হলে তুমিই কষ্ট পাবে

         রাত ৯টা ৩০ মিনিট ফোনটা বেজে উঠলো, সানার কলকাল শনিবার কোনো প্রোগ্রাম আছে?” মনে হয়না, কেনো? প্র্শ্ন কৌশিকেরতাহলে কয়েক জন কে বলবো, আড্ডা মারা যাবে,” মন্দ নয়, উই উইল বি দেয়ার

যথা রিতি কনা কৌশিক হাজির অনেক বন্ধুর অগোমন ভাবি এপিটাইযার নিয়ে এলো, সাথে চা কফি, যে যেমন চায় আড্ডা ভালই জমে উঠেছে দেশের রাজনিতি, আমেরিকার রাজনিতি ফারুখ এক সময় সাদা চাদর গায়ে ঝুলিয়ে মার্কশ পন্থী রাজনিতি করতো, আজ সে বুর্জোয়া প্র্থায় বিশ্বাসী বিশ্বাস তার পাল্টিয়ে গেছে বললো, “টাকা যেখানে আমি সেখানে

       হঠা করেই সুসান্তুর আবির্ভাব কনা দেখে বললো,” তুমি এখানে?” হা এলাম, জোয়েল বললো আসতে জোয়েল সানার ছেলে, এক সাথে ওরা বড় হয়েছে

কতক্ষন এসেছ?” সুসান্তর জিগ্গাসা ওর বাবা কে

এইতো এলাম কৌশিক লক্ষ করলো ছেলে তার দিকে চেয়ে কথা বলছে না তার চোখ কাকে জেনো খুজছে কৌশিক কথার ছলে একবার পিছনে তাকালো শ্যমলা ছিপছিপে একটা মেয়ে বসা আগে কখনো দেখিনি তাকে কৌশক নিজে পথ দিয়ে চলেছে, সে চোখের ভাষা বোঝে ছেলের চোখের চাউনি দেখে সে বুঝেছে কাকে সে খুজছে

মেয়েটা একবার তাকালো কৌশিকের দিকে তারপর মাথা নিচু করে রইলো রাত হয়ে এলো এক সময় কৌশিক কনা কে একপাশে ডেকে বললো, “ যে মেয়ে টা কে দেখছদেখে রাখো, পরে বলবোবন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে এলো সুসান্ত বাই বলে চলে গেলো ওর বাসায় গাড়ীতে এসে কৌশিক বললো,” তোমার ছেলের চাউনি দেখে মনে হলো এই সেই মেয়ে যাকে সে খুজছেকৌশিকের ধারনা ভুল হয়নি কনা সুসান্ত কে জিজ্ঞাসা করেছিল, সে না করেনিতোমার পছন্দ হয়মার পছন্দ তার কাছে বিরাট কিছু সে জানে বাবা মেনে নেবে তা সে যেই গোত্র্ মেয়ে নিয়ে আসুক মার পছন্দ টাই বড়

হা আব্বু পছন্দ হয়েছে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো সুসান্তর নাম তন্নি, দেখা ওদের হয়েছিলো এক বিয়ে বাড়ীতে, ওর বাবা ফার্মাসিস্ট কৌশিকের দুবছরের ছোটো, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে বছর তিনেক হলো ওরা সবাই কৌশিককে চেনে ভালই হলো, নিজেদের জানা শোনার মধ্যে তন্নি সুস্মিতার বন্ধু সুস্মিতা খবরটা পেয়ে একটু রাগান্নিতো হয়েছিলো প্র্থমে বললো,” আমি পাঁচ মিনিটের জন্য রেস্টরুমে গেলাম আর এর মধে্য চোখে চাওয়া চায়ি হয়ে গেলো?”

           দিনক্ষন ধার্যও করে কৌশিক কনা আর সুস্মিতা গিয়েছিলো তন্নির খালার বাড়ী কনা তার হাতের দুটো বালা দিয়ে তন্নিকে বরন করেছিলো যাকে বলে পানচিনি তন্নির মা জিবুর চোখে জল বললো,” এখন থেকে আপনি হলেন ওর বাবা, আপনি ওকে দেখে রেখেন

       এনগেজমেন্টের দিন ধার্য হলো এক মাস পর কনা তার পচিশ বছর বিবাহ বার্ষিকতে কৌশিকের দেওয়া গলার হার টা দিয়ে বরন করলো তন্নিকে, বললো,” এটা বংশ পরম্পরায় হাত বদল হবে আমার তাই ইচছা

কৌশিক তার ভাষণ অনেক কিছু বলার পরে একটা প্র্শ্ন রেখেছিলো সবার কাছে, “ বলোতো আজকে কে জিতেছে?” অনেকে অনেক কিছু বললো কৌশিক বললো না সব ভুল আজ জিতেছে তন্নি, সে তার বাবা কে আবার ফিরে পেয়েছে তন্নির চোখে জল

         ছয় মাস পর বিয়ে জিবু বিয়াইন দের আত্মীয় স্বজন সব এখানে বিয়ের গেস্ট লিষ্টে সংখা যেয়ে দাড়ালো সাতশর উপরে দেশ থেকে কৌশিকের বোন বোনের জামাই ভাগনে অপু এসে ছিলো এসে ছিলো আর এক বোন অহাইও থেকে কনার বোন এসে যোগ দিলো ফ্লোরিডা থেকে কনা আনন্দে আত্মহারা তন্নি মঝে মধ্যে ছুটির দিনে সকালে নাস্তা বানায় সবার জন্য বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি ভাব ভাড়া নেওয়া হোলো বিরাট কান্ট্রি ক্লাব যথারিতি ধুমধামের সাথে সম্পন্য হলো বিবাহের অনুষ্ঠান ওরা চলে গেলো হানিমুনে কৌশিক কনার সংসারে এলো আরেক কন্ন্যা কৌশিক কনাকে বললো,” এবার তোমার বিশ্রামের পালাকে জানতো তার শরীরে বাসা বাধে আছে এক মর্মান্তিক রোগ

       কনা ছিলো সংসারের মধ্যমনি সত্য কথা বলতে কোনদিন পিছপা হয়নি মনে যা আসতো তাই বলে দিতো

রান্নায় কনার পারদশির্তা ছিল সর্ব মহলে ওর হাতের রান্নার তুলনা ছিলনা কাচা বাজার করা ছিল তার নেশা কাজের পর প্রায় প্র্তিদিন ছুটত বাজারে দুস্টুমি করে কৌশিক বলত, “ আচ্ছা তুমি প্র্তিদিন বাজারে যাও কেন? একদিন দেখতে যাবো তুমি কার সাথে দেখা করতে যাও জীবনের প্র্তিটি মুহুর্ত উপভোগ করেছে দুজনে

অনেক বছর কেটে গেছে জীবনের, অনেক পথ এগিয়ে গেছে তবু মনে হতো এইতো সব সেদিনের কথা এইতো মাত্র্ সেদিন কনাকে নিয়ে এলো সে ঘরে বলতো, আচ্ছা সোনা , এখনোতো আমার সাধ মিটলো না তোমাকে নিয়ে

কনা বলতো, তোমাকে পেয়ে জীবনের সব সাধ আমি মিটিয়েছি, তোমার মাঝে আমি কোন খুঁত পাইনি তুমি আমার ১০১ পারসেন্ট তুমি ওয়ান ইন মিলিয়ন

         এতো সুখ এতো আনন্দ ওদের ভাগে্য সইলো না কনা একদিন বলল, আমার মাজায় ভীষন ব্যথা আমি আর পারছি নাকৌশিক দেরী করেনি, তাড়াতাড়ী কনাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে বিভিন্ন টেস্ট, সিটী স্ক্যান। এমআরআই করা হলো তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে কৌশিক হল ঘরে দাড়িয়ে, মনের অস্থিরতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে সুসান্ত, সস্মিতা মার কাছে কাধে হাতের স্পরশে কৌশিক ফিরে তাকালো পালমোনোলোজিস্ট। ফিরে তাকাতেই পালমোনোলোজিস্ট বলল, “একটা কথা বলব,” বলেনআপনার স্ত্রীর লাঙ্গে একটা ম্যাস দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ক্যানসারাস। বায়োপসির পরে বুঝা যাবে তবে লক্ষণ ভালো নয়, আরও অনেক জাগায় ছরিয়েছে, একে বলা হয় ফিফত স্টেজে। বাম পাশের লাঙ্গে জল ভর্তিএতগুলি কথা এক সাথে বলে পালমোনোলোজিস্ট একটু থামলো কৌশিকের মনে হলো তার চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল, না, হতে পারে না সত্যি নয়, সত্যি নয়

           ডাক্তার এসে দাড়ালো কনার পাশে বলল সব কথা কনার মুখে কোন ভাবান্তর এলো না মনে হলো সে কিছু বুঝতে পারছে না, বুঝতে পারছে না এর ভয়াবহতা সুসান্ত চোখের জল মুছতে বেড়িয়ে গেলো কনাকে ভর্তি করা হলো মন্টি পেভিলোনের তালা তে সার্জেন এলো পরদিন সকালে লাঙ্গের জল বের করবে ইনশিশন করে বসিয়ে দিলো টিউব, লালচে রংএর জল বেড়িয়ে এলো

           আজ ২৬ শে অক্টোবর, কনা কৌশিকের বিবাহ বার্ষিকি কৌশিক নিয়ে এলো লাল গোলাপের গুচ্ছো

কনার চোখে জল, কৌশিকের মনে হলো অনেক শুকিয়ে গেছে, চোখের কোনে কালি চুমো দিয়ে বলল,” ভয় করো না সোনা, এখন অনেক নতুন নতুন ঔষধ বেড়িয়েছে, তুমি ভালো হয়ে যাবেকনা কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলোতারপর বলল, “ তোমাকে নিয়ে বেহশত আমি এখানেই বানিয়ে ছিলাম, আমার কোন আফসোস নেইসে আরও বলল, “ যখন খোদা আমাকে সুখ আর বেহশত দিয়েছিলো তখন তো আমি বলিনি কেন দিলে? আজ যখন সে আমাকে নিতে চলেছে তখন কেন আমি বলব,”হোয়াই মি?” কৌশিকের চোখের জলের ফোটা পড়লো কনার কপালে ,কনার চোখ বুজে এলো

       চারিদিকে ছরিয়ে পড়েছে কনার অসুস্তার কথা দলে দলে বন্ধু বান্ধব শুভআকাংকিরা আসছে ওকে দেখতে জানতো না সবাই ওকে কত ভালোবাসে ভালবাসতো ওর উদার মনের জন্য, ভালবাসতো ওর সততার জন্য

     শুরু হলো কিমোথেরাপি দেওয়া ডক্টর রেফ এর ত্তাবধানে বায়োপসির রেজাল্ট এসেছে ভালো নয় দুটো মিউটেশন এক্সন ২০  এক্সন ২১ । এক্সন ২০ চিকিৎসা আছে এক্সন ২১ এর চিকিৎসা নেই ডক্টর রেফ আশাবাদী বললআমরা দুটো ঔষধ এক সাথে দেবো, প্র্তি তিন সপ্তাহ পর পর   তাতে আশা করছি টিউমার টা ছোটো হয়ে যাবে”। এসে ছিলো কৌশিকের বোন Ohio থেকে। সেবা করে ছিলো আড়াই মাস। দাড় করিয়ে ছিলো কনাকে চলার মত করে। এসে ছিলো দেশ থেকে কনার ভাবী, এসে ছিল বোন। তাদের সেবা কৌশিক দেখেছে, দেখছে তাদের অকেলানত পরিসরম। কৌশিক নিভর্তে চোখের জল ফেলেছে। বিধাতার কাছে প্র্াথর্না করেছে তার জীবনের পরিবর্তে কনার জীবন ফিরিয়ে দিতে।এই অসহায় মুহুর্তে কৌশিক ,কনার পাশে এসে দারিয়ে ছিল বিয়াইন (সুসানতুর শাশুড়ি), দাড়িয়ে ছিল জলি ভাবি, চমন ভাবী, রিতা ভাবী। কৌশিক জানে তাদের সেবার ৠন কোন দিন শোধ দেবার নয়। নিঃস্বার্থ ভাবে তারা করে গেছে।

       কনা ভালোর পথে। তবুও এ রোগের কোন বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস নেই বলেই সুসানত খোজ নিয়েছে Yale University তে। ওরা বলেছে, সব দরজা যখন বন্ধ হয়ে যাবে তখন এক মাত্র্ উপায় Clinical Trial Medicine.যদি কাজ হয়। কৌশিক মনের জোড় ফিরে পায় কনার শারিরিক সুস্থতা দেখে। বলে, চলো দেশ থেকে ঘুরে আসি। গিয়ে ছিলো। কৌশিক দেখে ছিলো কনার উচছলতা দেশের মাটিতে। যত টুকু আনন্দ করার তা সে করে ছিলো। হয়ত তার অদ্রিশট বুঝতে পেরেছিলো এই তার শেষ আনন্দ।

     দেশ থেকে ফিরে এলো। ঔষুধের কর্মোক্ষমতা একটা একটা করে কমতে থাকলো। কনা বুঝতে পারলো তার সময় বেশি নেই। বলল, “সুসমিতা কে ডাকো।” সুসমিতা কে বলল, মা তুমি রেজ কে বলো ওর বাবা মা কে বলতে, আমি থাকতে থাকতে সবকিছু করে দিয়ে যেতে চাই” রেজ সুসমিতার সমপরকো কৌশিক কনা জানে। রেজের বাবা মাকেও ওরা চেনে। অনেক আগের পরিচয়। রেজের বাবাও ফারমাসিসট। কৌশিকের তিন বছরের সিনিয়র। বিধাতার আশীর্বাদে সূশটো ভাবে সম্পন্ন হলো ওদের বিবাহ। রেজকে কনার খুব পছন্দ। কৌশিকের ও।

     কনার শাস কোষ্ঠও ক্রমেই বাড়তে থাকলো। কৌশিক কে ডেকে বলল,”আমার সময় এসে গেছে সোনা”। কৌশিক পাগলের মত ছুটে গেলো Yale University Smilow Cancer center এ, বলল,” ওকে Clinical Trial Medicine দাও,”

       দেওয়া হলো। কাজ হলো না। সে তখন কষ্টের শেষ সীমায় পৌছে গেছে। কৌশিক কে কাছে ডেকে বল, বাই। কেনো এমন বলছো। ধীরে ধীরে বলল, আমাকে যেতে দাও। কনা চলে গেলো।

       কান্নার রোল উঠল Smilow Cancer Center এর ২২২ কক্ষে। কাদঁছে ছেলে সুশান্ত, কাদছে মেয়ে সুস্মিতা। কৌশিক চোখের পানির অঝোর ধারাকে ধরে রাখতে পারেনি। চোখের পনিতে ঝাপসা হয়ে আসা দৃশটি ফেরাতে পারছিল না কনার দিক থেকে। সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ওকে। মুহুর্ত কয়েক আগেও যে ছিল জীবন্ত , এখন সে লাশ। কেনসারের সাথে কনার আড়াই বছরের লড়াই শেষ হয়ে গেল। জীবনের সব আড়ম্বর হারিয়ে সে আজ রিক্ত হাতে বিদায় নিল। নিঃশেষ হয়ে গেল কৌশিক। দীর্ঘ প্রায় চল্লীশটি বছর পায়ে পা মিলিয়ে পথ চলেছে যার সাথে, হাতে হাত ধরে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে গেছে যার সাথে, সে আজ তাকে অসহায় ফেলে রেখে চলে গেল। চলে গেল সেই রহসময় অজানা জগতে, যেখান থেকে কেউ আর কোনোদিন ফেরে না।

       কৌশিক আজ একলা বসে সৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে দেখে চল্লিশটি বছরের বিবাহিত জীবনে একটা দিনও খুজেঁ পেলোনা যেখানে হাসি আর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু ছিল। বাড়ীটার আনচে কানাচে তার স্রীতী এখনও উজ্জ্বল। যেদিকে তাকায় ওর অস্তিত্ব অনুভব করে। কোথাও শান্তি পায়না। শান্তি পায় যখন তার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে। চারিদিক নিস্তব্ধ। কোন হট্টগোল নেই। শান্ত পরিবেশ। মাঝে মাঝে গাংচিল উড়ে যাচছে। হাত টা এগিয়ে দিয়ে বলে,” সোনা আমি তোমার কাছে আছি, তোমার পাশে।মনে হয় সে হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে , সোনা অনেক দিন তুমি আমার হাত ধরোনা , এবার ধরো।

   চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবন ,তার আগে তিন বছরের জানা শোনা। এই ৪৩টা বছর কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতে পারলো না। কৌশিকের মনে হয় এইতো সেদিন। মনে হচ্ছে শুরু তেই সব শেষ হয়ে গেল। কৌশিকের চিৎকার করে বলতে ইচছা করে , দিস ইজ নট ফেয়ার, লাইফ ইজ নট ফেয়ার।

     বিশাল বাড়ীটা আজ শূন্যতায় গ্রাস করছে। ছেলে মেয়েরা যার যার বাসায় চলে গেছে। ওদের নতুন দুটো পাতানো সংসার কনা দেখে গিয়েছিলো। ছেলে মেয়ে ছিল তার চোখের মনি। যখন জীবনটা পরিপুরনতায় বিকশিত হলো, কৌশিক তাকিয়ে দেখে তার চারপাশে সব রইল শুধু রইল না সে।

     শূন্য বাড়ীতে আজ সে একা। স্রীতীর ভারে আজ সে ক্লান্ত। জানেনা এর শেষ কোথায়।

দুমাস পেড়িয়ে গেছে। মনের ভীতরের ক্রন্দন থামে না। আজ এই অসহায় একাকিততে তার সৃতির পাতাগুলি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ যেন এক সেলুলয়েডের ফিতা, একটার পর একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে আসছে। এ সূতি যে এত হৃদয় বিদারক তা সে আগে বোঝেনি। এ যনত্র্না তো দারিদরের যনত্র্না নয়, এতো পায়ে কাটা ফুটার যনত্র্না নয়, এ হৃদয় নিংড়ে নেওয়া যনত্র্না। এ যনত্র্না শুধু সেই উপলবধি করতে পারবে যে এই পথ দিয়ে পায়ে পায়ে চলেছে। ঝাপসা চোখে দুরে তাকিয়ে থাকে মনে হয় সিড়ি দিয়ে সে নেমে আসছে ওপর থেকে। এখনি শুনবে তার কণ্ঠস্বর, ওটমিলটা বসিয়েছ? প্র্টিন একটু কম দিও। না সেই কণ্ঠ সে শোনে না। সে আসে না। সে নেই।

     অনেক দিন তো হয়ে গেলো, তবু কৌশিকের চোখে জল ভেসে আসে। ছেলে সুশান্ত, মেয়ে সুস্মিতা ,বৌমা, জামাই সবাই পালা করে রযেছে কৌশিকের সাথে। একলা থাকতে দিতে চায়না। পাছে কিছু হয়। ওরাও ওদের মা কে হারিয়েছে। ওদের মনের বেথা অপরিসীম। কনা যত দিন ছিলো ওরা প্র্তি বলদিন প্র্তি রাতে ফোন করতো। ফেস টাইমে দেখতো তাদের মা কেমন আছে। সুস্মিতা তার মাকে ডাকত গরজ বলে (মানে গরজিয়াস)।

     দিনের শেষে সন্ধ্যা নামে। কৌশিকের কাজ শেষ, বাড়ী ফেরার পালা। জানে কেউ অপেক্ষা করছে না তার জন্য। সারা দিনের ভালো মন্দ ঘটনা গুলো শোনানোর মানুষটা আজ তার হারিয়ে গেছে, চলে গেছে অজানা দেশে। চাবি দিয়ে দরজাটা যখন খোলে, নিস্তব্দতা তাকে গ্রাস করে। মনে হয় ভুতুরে বাড়ী। মেয়ে কোন এক সময় এসে সাজিয়ে রেখে গেছে ভাতের থালা। গরম করে খেয়ে নেবে। সেই পাচঁ পদের বাটিতে সাজিয়ে রাখা দিনগুলি আজ আর নেই। কৌশিক জানে একটু পরে ফোনটা বেজে উঠবে, ছোট বোন রিনা কল করবে। বলবে,”দাদা ভাত খেয়েছ? ওষুধটা খেতে ভুলোনা।” রাত বাড়লে ধীর পায়ে কৌশিক সিড়িঁ বেয়ে উপরে উঠে যায় ঘুমাতে। বিছানায় এখন দুটি বালিশ পাশাপাশি সাজানো আছে। কেন তা সে জানেনা। হয়ত তার অবচেতন মন এখনো ভাবে সে হয়ত আসবে। নীস্তব্দ ঘর। এপাশ ওপাশ করতে করতে রাতটা কেটে যায়।

   সাত সকালে সেই পরিচিত মধুর ডাকটা আর শোনেনা। যখন কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি সে, কনা বলতো, সেল ফোনটা নিয়েছ? মানিবেগটা কোথায়, চাবি নিতে ভুলোনা। সে কণ্ঠ আর নেই। সে কণ্ঠ হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। আজ তার পরিবর্তে সকাল পৌনে সাতটায় রিনা ফোন করে বলে, সব কিছু নিয়ে বেড়িও ছোটদা, সাবধানে গাড়ী চালিও।

     কৌশিকের কাছে মনে হয় জীবন বেহালার তার ছিড়েঁ গেছে, সুরটা আর ঠিক মত বাজছে না। এ তার আর কখনই জোড়া দেবার নয়। এ আর ঠিক হবার নয়। তবুও নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিতে প্র্তি সপ্তাহে কৌশিক গিয়ে বসে থাকে সেখানে, যেখানে কনা ঘুমিয়ে আছে। চড়া রোদ, যেখানে সে ঘুমিয়ে আছে, জায়গাটা রুক্ষ। আর সেখানে মাটি নয় বালি।পার্ক কর্মকর্তাদের কে কৌশিক বলল,” একটা ছোট মাপেল গাছ লাগাতে পারি ওর কবরের পাশে? একটু ছায়া হবে।” ওরা বললো,” না, তা হবেনা।” তা হলে? কৌশিকের মন ছটফট করতে লাগল। সারাক্ষনই মনে হতে লাগল, এই রুক্ষতা তো ওর সইবে না। নিয়ে এলো সে তিন বস্তা মাটি। ছড়িয়ে দিলো কনার কবরের উপর। সেই সাথে ঘাসের বিচি। ঘাস বড় হবে , রুক্ষতা চলে যাবে। কবরের ওপর ঘাসের একটা আবরন হবে। হয়ত কিছুটা শান্তির ছায়া নেমে আসবে তাতে।

         অনেকে বলেন সব কিছুর পিছনে একটা মানে আছে। ওর চলে যাওয়ার পিছনে কি মানে ছিল?

একথা কৌশিক কাকে জিগগাসা করবে? যাকে জিগগাসা করতে পারতো সে তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবু জানতে ইচছা করে এতো সুখ যদি সে দিয়েছিলো তবে এত তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন? বড় সাঁধ ছিলো কনার নাতি পুতি দেখার। বলত, ওদেরকে আমি ইসপয়েল করে দেবো আদর দিয়ে দিয়ে। তা আর হলো না। গাড়ী চালাতে চালাতে একটা গান কৌশিকের মনের ভেতর গুমরে ফেরে,” আমার জীবনের এত হাসি এতো খুশি আজ কোথায় গেলো,”। এই পথ দিয়ে অননানন যারা গেছে তারাও কি কৌশিকের মত জীবনের সমাধান খুজতে চেয়েছিল? কৌশিক ভাবে, যে পথের শেষে আলোর নিশানা নেই সে পথে চলে লাভ কি? তবু চলতে হবে।

   চোখ ঝাপসা হয়ে আসে কৌশিকের। কিনতু তা হলে তো চলবে না, আজ তো তার গুছানোর পালা।

কনার ক্লোজেট টা খুলে দেখে এখনো সাজানো রয়েছে ওর চলে যাওয়ার আগে যে কাপড় গুলো সে নিয়ে এসে ছিলো ধোপার দোকান থেকে। থরে থরে সাজানো তার শাড়ীর বহর। সুসমিতা, বৌমা ভাগ করে নিয়ে যাবে সেগুলো।

     ছেলেমেয়েরা বলে, “ বাবা বাড়ীটা বিক্রি করে দাও। এতে তোমার অনেক স্রীতী জড়ানো,” সুসমিতা বলে,” তুমি আমার কাছে থাকবে। তোমার স্বাধীনতাতে কোন হস্তক্ষেপ হবেনা। তোমার ছোট একটা ঘর থাকবে তোমার নিজেস্ব।” তাই কি? ছোট একটা ঘরে গেলে কি কৌশিকের সৃতি কৌশিক কে কাতর করবে না। পেছনের সুখময় দিনগুলি কি তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে না? এই স্রীতী তো তার মনের প্র্তিটি রন্দ্রে রন্দ্রে গাথাঁ হয়ে রয়েছে। সুসানত সুসমিতা বলে, তোমার নাতি পুতি হবে। ওদেরকে নিয়ে তোমার দিন কেটে যাবে আববু।

   হয়ত তাই। কৌশিক ভাবে নাতি-পুতি এলে ওদেরকে আকাশের চাদঁটা দেখিয়ে বলবে,” ঐ দেখ ওটা হচছে অজানা দেশ। ওই খানে তোদের নানি দাদি রয়েছে। ওখান থেকে সে তোদেরকে চুমো দিচছে।” যখন ওরা আসবে হয়ত শান্তি পাবে ওদের কে আকড়ে ধরে।

     প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো কনা চলে গেছে, রেখে গেছে এক বিরাট শূন্যতা কৌশিকের জীবনে।

ঈদের দামাঢোল বাজছে, কৌশিকের ঘর অন্ধকার। জ্বলছে শুধু বসার ঘরের আলোটা। টুং করে সেল ফোনে শব্ধ হলো, মেসেজ এসেছে, কাল ঈদ। এমন তো ছিলোনা ঈদের আগের দিন। কনার হাড়ি পাতিলের শবদে মুখর হয়ে থাকতো বাসাটা। কৌশিক বলত,” কখন শেষ হবে তোমার এই টুংটাং।

কনা বলত, অনেক রাত হবে, তুমি ঘুমাতে যাও। কৌশিক বলত,” রসমালাইয়ের জন্য তোমার বানানো ছানাটা গোল করে দেবো? সে বলত, না, ও তুমি পারবে না। নাছোড়বানদা কৌশিক বলত, বাসন পাত্র্ গুলি ধুয়ে দেবো? তাই দেও। কৌশিক বলত,” এত কিছু বানাচছ, কজন লোক আসবে? সে তুমি বুঝবেনা এটাই আমার আনন্দ। কিনতু আমার মনে হচ্ছে তোমার কষ্ট হচ্ছে। কনা কথায় কান দিতো না বলত,” বক বক না করে ওপরে ঘুমাতে যাও”। আচছা যাচ্ছি। কৌশিক জানে ঘুম তার আসবে না যতক্ষন না সে আসবে। কনার আসতে আসতে রাত প্রায় দুটো হয়ে যাবে। সেই দিনগুলি আজ কোথায়। সেই দিনগুলি চিরতরে হারিয়ে গেছে ।

     কৌশিক তাকিয়ে আছে টিভি টার দিকে, ওটার পর্দা টা কালো, চলছে না। ইচছা করেই সে চালাই নি। ভালো লাগছে না। একটা অস্থিরতা তাকে তারিয়ে ফিরছে। মেয়ে সুসমিতা আর রেজ আসবে অনেক রাতে। ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে কৌশিক। কনার ওয়ারডরোবটা খুলে ভাজে ভাজে রাখা শাড়ীগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলো। ভাবলো বেচে থাকলে কোনটা সে কালকে পরত। চোখ ভিজে আসাতে বনধো করে দিলো ওয়ারডরোবটা। আলোটা নিভিয়ে নিসংগ বিছানায় বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পড়লো।

     আজ ঈদুল ফিতর। প্র্থম জামাত আটটায়। সুস্মিতা আর রেজ কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কৌশিক।অনেক লোক এসেছে জামাতে। নামাজ শেষে কোলাকুলি। এটার আনন্দই আলাদা। মেয়ে বলে,” তুমিতো হাত মিলাতে পছন্দ করো আববু”। হা, করি। তবে ঈদের কোলাকুলি একটা ভিন্ন আনন্দ আছে।

   কিন্তু আজ আর সেই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দটা কৌশিকের অনুভবে আসছে না। কিছুতে যেন আনন্দ পাচ্ছেনা সে। কেন তা সে জানেনা। বুকের ভেতর একটা বিরাট শূন্যতা। দুই একজন সহানুভুতি জানালো। দুই একজন উপদেশ দিলো, কি করা উচিত, কি করা উচিত না। কৌশিক শুধু শুনলো।

     আজ কৌশিককে যেতে হবে সেই জাগায় যেখানে কনা ঘুমিয়ে আছে। লাল গোলাপ কিনেছে সে। লাল গোলাপ ছিল কনার খুব পছন্দের।সুশান্তর শাশুড়ি জিবু বিয়াইন বললেন,” কৌশিক ভাই আপনি কবরস্থানে যাবার সময় আমাকেও নিয়ে যাবেন।” বিয়াইন তার স্বামী হারিয়েছেন পাচঁ বছর হয়ে গেল। তার মনটাও কৌশিকের মতো কেঁদে বেড়াচছে।। বেড়িয়ে পড়ল কৌশিক সবাইকে নিয়ে। কবরস্থান ঘণ্টা খানেকের পথ। গাড়ীতে অরুন বিয়াইন, জিবু বিয়াইন, বৌমা, বুসরা। বুসরা বৌমার খালাতো বোন। কথা বলতে বলতে কৌশিক জিবু বিয়াইনকে জিজ্ঞাসা করলো,” আপনি অনেক শক্ত মনের দিক থেকে,। কি ভাবে হলেন।” তিনি বললেন,” সব আল্লার ইচছা, বান্ধার কিছু করার নেই,” আপনি তো আল্লা আর বান্ধা নিয়ে বেশ আছেন, আমি পারছিনা কেনো” প্রশ্ন কৌশিকের।

   ওরা পৌছে গেলো কবরস্থানে। আকা বাকা পথ ধরে গাড়ি যাচছে সেখানে যেখানে চির নিদ্রায় শায়িত। অনেক লোকের সমাগম আজ। এসেছে প্রিয়জনের কবর যিয়ারত করতে। কেউ কাদঁছে, কেউ বসে কলমা পড়ছে। ঝিরঝির বাতাস বইছে।

   শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। গাড়িটা দাড়ালো। যেখানে দাড়ালো সেখান থেকে কিছু দুরেই কনার কবর। বৌমা রক্ত গোলাপ গুলো নিয়ে এলো। বুসরা পাশে, জিবু বিয়াইন আর অরুন বেয়ান দাড়িয়ে একটু দুরে। এই প্র্থম একটা ঈদ, যে ঈদে কনা কৌশিকের পাশে নেই। জিয়ারতের পর কৌশিক বলল,” আমিতো তোমার কাছে এসেছি, সোনা, আমার ঈদ তো আজ এখানে।”

   চোখে জলের বাধ মানছে না। কৌশিকের মনে হলো কনা বলছে, কেদোঁ না, আমি তো তোমার পাশেই আছি। তোমার মধ্যেই আছি, তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাইনি। বৌমা আর বুসরা কৌশিককে জড়িয়ে ধরে বলল,” কেদোঁ না বাবা কেদো না।” বৌমার বাবাও শুয়ে আছে এখান থেকে কিছু দুরে। ওর মনের কথা কৌশিক বুঝতে পারছে, ও প্র্কাশ করছেনা। বেয়াই এর কবর। জিবু বিয়াইন দুরে দাড়িয়ে। এটই হয়ত নিয়ম। কৌশিক জানেনা। তার চোখ কালো চশমার নিচে নিশ্চয় ছলছল করছে। দু ফোটা জল হয়ত গড়িয়েও পড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। বৌমা কাদছে। কৌশিক যেদিকে তাকায় দেখে সবারই মুখ মলিন। কিছু দুরে একটা নতুন কবর খোঁড়া হয়েছে। কোন অভাগার বুকের ধন সবাইকে কাঁদিয়ে আজ এসেছে এখানে ঘুমাতে।

   সবাই বলল, চলো এবার সময় হয়েছে, ওদের কে বিদায় দাও।

কৌশিককে যেতে হবে সুস্মিতার শশুড় বাড়ী। সেখানে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর হয়ে গেলো। কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লো কৌশিক। ভীষন ক্লান্ত সে। জিবু বিয়াইন কে নামাতে হবে। কেন জানি একটা অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচছিলো। বাসায় চলে এলো। সুস্মিতা পড়ছে।  রেয এলে ওরা রেজের বাবার বাসায় যাবে।

      রেজ এলো, ওরা চলে যাচছে। সুস্মিতা বলল,” আব্বু তুমি একলা থাকতে পারবে তো।” হা, মা মনি, পারবো। গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে বাই জানিয়ে মেয়ে টা চলে গেলো। ও দেখতে পেলোনা ওর বাবার চোখটা জলে ভর্তি। সেই ভালো। দেখতে পেলে সে কষ্ট পেতো।

    ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসে কৌশিকের শরীর। মন চাইছে না বাইরে যেতে। হয়ত যে উদ্দীপনা আগে ছিলো আজ তা ভাটার দিকে। যে নৌকায় সে ভাসতো দমকা হাওয়ায় তার পাল আজ ছিড়ে গেছে।ওটা আর ভাসবে না, ওটা ডুবন্ত। মন চাইছেনা তবু কৌশিক গেলো বিয়ইনের বাসায়। দেখা হলো অনেকের      সাথে। সব পরিচিত মুখ। কথা হলো। শেষে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো কৌশিক।

     বাহিরে এসে দাড়ালো। অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারিদিক। নিস্তব্ধ রাস্তা। বুকের ভিতর হাহাকার। ও নেই, কেউ নেই। এই প্র্থম একটা ঈদ যে ঈদে কেউ তার পাশে নেই।

     একটা চাপা ব্যথা অনুভব করছে বুকে। হয়ত কিছু নয়। গাড়িটা একটু দুরে। পাশের দালানে হেলান দিয়ে একটু দাড়িয়ে নিলো কৌশিক। ব্যথা টা বাড়ছে। Stent লাগানো আর্টারি টা হয়ত বুজে এসেছে। গাড়ীর কাছে এসে পৌছালো কৌশিক। ER এ সে যেতে রাজি নয়। বীভীশিকা ময় ER সে দেখেছে। বাসায় পৌছালো। উপরে উঠে এলো। ব্যথাটা বাম হাতের থেকে উপরে উঠে আসছে। কৌশিক জানে এ কিসের ব্যথা। এর থেকে মুক্তি নেই। শুয়ে পড়লো সে। ভেসে উঠলো কনার মুখ। সে জেনো ডাকছে তাকে। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হলো।সুশান্ত ,সুস্মিতার মুখটা ভেসে উঠলো, ওরা চিৎকার করে বলছে, যেওনা বাবা যেওনা” কৌশিক ফোন টা আকরিয়ে ধরলো। ডায়েল করতে চাইলো ৯১১। কিন্তু পারলো না। ৯-১—- শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। হাত থেকে পড়ে গেলো ফোনটা। নিস্থব্ধ হয়ে গেল চারিদিক। সে চলে গেলো। চলে গেলো কার কাছে। যাকে সে দেখেছিলো, যাকে সে পেয়েছিলো, যাকে সে হারিয়েছিলো তার কাছ

Continue Reading

এসিডের ছোবল

অনির্বাণ হাঁটছিল অন্যমস্ক ভাবে। অফিস শেষে যে ট্রেন টা তার ধরার কথা ছিল সেটাতে যাবেনা ঠিক করলো। কেন, সে নিজেও জানেনা। বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই। কোনদিন যে ছিল তাও নয়। আজ অস্বাভাবিক ভাবেই দেরী করছে সে। গতকাল পাওয়া চিঠি টা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। শান্তি, শান্তি অনেক খুঁজে অনির্বাণের সন্ধান পেয়েছে। তাইতো লিখেছে সে,” আসতে পাড়বি একদিন আমার এখানে”।

সামনের কফি শপ টাতে বসে এককাপ কফি খেয়ে নেবে ভাবল অনির্বাণ। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ফিরে গেল সে অনেক পিছনে।

ছোট্ট শহর। অনির্বাণদের বাসার পাশের বাসাটা ছিল শান্তিদের। বয়স তখন কত ? চার, পাঁচ। এক্কা দোক্কা খেলার সাথী। হারিয়ে যেতো দুজনে পুকুর পাড়ে। জাম গাছের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরা জাম তুলে খেতো। সারা মুখ হয়ে যেতো নীল।

শান্তি বলত,” অণু, চল যাই ওই শালিক পাখি টাকে ধরি।” শান্তি সবসময় মাতব্বরি করতো অনির্বাণের উপর। অনির্বাণও সেটা মেনে নিয়েছিল। হাত ধরাধরি করে দুবন্ধু একদিন খেলতে খেলতে বড় হয়ে গেল। অনির্বাণ ষোল, শান্তি পনেরো।

অনির্বাণ চলে যাবে দূর শহরে। শান্তি তাকে বলেছিল,” জানিস অণু, তুই চলে গেলে আমি একেবারে একলা হয়ে যাবো। অনেক কাঁদবো। তুই একমাত্র আমাকে বুঝতে পারতিস।” অনির্বাণ চোখ মুছে বলেছিল,” ভাবিস না, আমি তোর খোজ রাখবো।”

না, কথা সে রাখেনি। ভুলে গিয়েছিল সে শান্তি কে, মেতে উঠে ছিল নতুন জীবন নিয়ে, ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছিল অতীত কে। কিন্তু আজ চিঠি টার দিকে তাকিয়ে চোখের কোণ টা ভিজে উঠল। আবারো পড়ল সে চিঠি টা। করুন ভাবে লেখা। “ পারবি অণু, পারবি কি একবার আসতে, আমাকে দেখতে।”

যাবে সে। ঠিকানা দেখল। কানাডার।

তিন দিনের ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল অনির্বাণ তার গাড়ী নিয়ে। টরেন্ট শহরের কিছু দূরে শান্তির ঠিকানা। অনির্বাণ যখন পৌছালো সূর্য তখন অস্তাচলে। বাড়ী চিনতে অসুবিধা হয়নি। দুরু দুরু বুক কাঁপছে। প্রায় বিশ বছর পরে শান্তির সাথে দেখা হবে। আনন্দ নয়, কোথা থেকে একটা ভয় তাকে গ্রাস করছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে। গাড়ীর আয়নায় চেহারা টা দেখে নিলো অনির্বাণ। নেমে এসে দরজায় টোকা দিতেই এক বয়স্ক ভদ্র মহিলা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলো,” কাকে চাই?”

“ শান্তি আছে?” অনির্বাণ জানতে চাইলো।

“ আপনি বুজি অনির্বাণ?”

অনির্বাণ বুঝল সে এখানে অপরিচিত নয়।

“জী” শব্দ টা সে অনেকদিন পর ব্যবহার করলো।

“ আসুন” বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো ভদ্রমহিলা।

ছোট্ট ঘর,দুটো লাভ চেয়ার, তার সামনে কফি টেবিল, একটু দূরে সাধারণ একটা টুল। পাশে লম্বা আয়না। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। দেয়াল গুলোতে রংএর ছোপ পড়েনি অনেকদিন। অনির্বাণের মনে হোল ঘরটাতে দারিদ্র্যতার ছাপ।

উঠে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে দাড়াতেই পাশের দরজা খুলে এলো ঘোমটায় মুখ ঢাকা এক ভদ্রমহিলা। ছিপছিপে শরীর। “ কেমন আছিস অণু”?

অনির্বাণ থমকে যেয়ে তাকালও ঘোমটা ঢাকা অতি পরিচিত অথচ অনেক দূরের মহিলার দিকে। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না, পলক পড়েনা চোখে।

“ কি রে বোবা হয়ে গেলি নাকি? বোস.”

অনির্বাণ বসে বললও,” তোর গলার স্বর একই রকম রয়ে গেছে রে শানু?”

শান্তি বসলো একটু দুরে টুলটার উপর। “ তোকে অনেক খুঁজেছি আমি, পাইনি। ফেস বুকের বদৌলতে তোকে পেলাম.”

“ ঘোমটা সরাবি ? নাকি পর পুরুষের সামনে মুখ দেখাতে না করে দিয়েছে কেউ?” অনির্বাণের জিজ্ঞাসা।

এ কথার উত্তর না দিয়ে শান্তি বললো, “ শানু, সেই যে তুই চলে গেলি আর ফিরে এলি না, খোজ ও নিলিনা।”

“ আমি তার জন্য অনুতপ্ত। কি হয়ে ছিল আমার জানিনা, পিছনে ফেলে আসা দিনগুলি আর আমার মনের মধ্যে আসেনি। আমাকে ক্ষমা করিস।”

“ ওসব ক্ষমার কথা বাদ দে। তোকে ডেকে এনেছি একটা কাজে। সেটা বলবো পরে।”

অনির্বাণ বুঝতে চেষ্টা করলো শান্তি কি বলতে চাইছে। ওর মনে হোল উঠে যেয়ে শান্তির হাত টা চেপে ধরবে কিনা। যে ভাবে দুজন হাত ধরাধরি করে দৌড়িয়ে বেড়াতো। কোথায় জেনো সংকোচ, দ্বিধা।

শান্তি বলে ,” জানিস অনু, যে শহর তুই ছেড়ে এসেছিলি ওটা অনেক পালটিয়ে গিয়েছিল। মাস্তানদের উপদ্রব আরম্ভ হোল। তখন আমার উঠতি বয়স। স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। বুঝতেই পারছিস -। আচ্ছা দেখ, আমি শুধু বক বক করছি। হোটেল ঠিক করে আসিস নিতো ?”

“না হোটেল ঠিক করিনি।”

“তা হলে এখানে থেকে যা। একটা ঘর আমার। তোকে এই ড্রয়াইং রুমের মেঝেতে থাকতে হবে, অসুবিধা হবে না তো? “ বলল শান্তি।

“ অত ফর্মালিটি করিসনাতো? তুই বল তোর কথা, আমি শুনতে এসেছি আর দেখতে এসেছি তোকে।”

অনির্বাণ তাকিয়ে ছিল শান্তির কাপড়ে ঢাকা হাতটার দিকে। মনে হলো সমস্ত শরীর টাকে সে কাপড়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু কেন?

“ বল কি বলছিলি” অনির্বাণ ফিরে যেতে চাইল সেখানে, যেখানে কথা অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল।

“ যা বলছিলাম, উঠতি বয়স আমার, তারপর দেখতে শুনতে খারাপ ছিলাম না। ঐ হোল আমার কাল। তারপর হিন্দুর মেয়ে আমি। স্কুলের পথে আসতে যেতে উতক্তা করেতে লাগলো মাস্তানরা। মাস্তান দের সর্দার একদিন আমাদের বাসাতে এলো। বাবা কে বললও সে বিয়ে করবে আমাকে। যদি রাজি না হই তবে উচিত শিক্ষা দেবে।”

বাবা তাকে বের করে দিয়েছিল বাসা থেকে। স্কুলে যাওয়া আমার বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে থাকি।

“ আইনের আশ্রয় নিসনি কেন?” প্রশ্ন অনির্বাণের।

“ তুই কি পাগল হলি? ওরাই তো আইন, ওরাই সব। আমাকে যে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাইনি সেটাই তো ভাগ্য।” বললও শান্তি।

বলল,” অনু, ভালই হতো, যদি নিয়ে যেতো আমাকে, তাহলে আজ তোকে ডেকে পাঠাতাম না। তুই অস্বস্তি বোধ করছিস না তো?”

“ কি যে বলিস ? বল তোর কথা।”

“বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ভাবলাম ঝড় হয়ত থেমে গেছে। রহীমাদের বাসাতো তুই চিনতিস। ওখানে যাবো ঠিক করলাম। কাউকে কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। রাস্তার থেকে গলিতে মোড় নিতেই পড়লাম ওদের মুখোমুখি। ভয়ে আমার শরীর আড়ষ্ট হয়ে এলো। দেখলাম মাস্তানদের সর্দারের দুটো হিংস্র চোখ। এগিয়ে এলো। কোন কথা বলেনি। শুধু ঢেলে দিয়েছিল এক বোতল এসিড আমার মুখের পরে।”

অনির্বাণ শিউরিয়ে উঠল কথা শুনে। তারপর,—-

“ চীৎকার করে ওখানে লুটিয়ে পড়েছিলাম। যখন জ্ঞান হোল দেখলাম, হাঁসপাতালের বেডে শুয়ে। সমস্ত মুখ ব্যান্ডেজে বাধা। “ এই বলে শান্তি একটু থামল.

“ বল শানু, থামিস না” অনির্বাণ উৎকণ্ঠিত

শানু বলে,” অনু, মনে আছে তুই বলতিস আমার গালের সেই ছোট্ট তিল টা তোর খুব পছন্দ। সেটা হারিয়ে গেছে।”

অনির্বাণের চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মুখে কোন কথা নেই। শান্তির

নিজের অজান্তে কখন যে ঘোমটা একটু সরে গিয়েছিল সে নিজেও জানে না। পাশের আয়নায় ফুটে উঠেছিল ঝলসে যাওয়া মুখটা। অনির্বাণের সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠেছিল। চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল । তাকাতে পারেনি দ্বিতীয় বার।

“ শানু থাক বলতে হবে না। কি শাস্তি হয়েছিল ওই বদমাশদের?” অনির্বাণ জানতে চাইল।

শান্তি একটু হাসলো। শাস্তি, কোথায় শাস্তি? প্রমাণ হয়েছিল ওই সময় ওরা ছিল অন্য গ্রামে। তুই ভাবছিস আজ আমি এখানে এলাম কি ভাবে, তাইনা? এক জনের দয়ায়। আমাকে দেখেছিল হাসপাতালে। এসেছিল তার মা কে দেখতে। পাশের রুমে। পরিচয় হয়েছিল বাবার সাথে। শুনেছিল সব।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমরা সেই শহর ছেড়ে অন্য শহরে বাসা বেধে ছিলাম। বছর না পেড়োতেই একদিন কামাল এসেছিল আমাদের বাসায়। বাবাকে প্রস্তাব দিয়ে ছিল। বাবা প্রথমে রাজি হয়নি। বলেছিল তাকে, “দয়া দেখাতে আসোনি তো? তুমি দেখেছ শান্তিকে? পারবে সহ্য করতে? তোমরা, আমরা এক গোত্রের নই। পারবে কি সে দন্ধ থেকে বেড়িয়ে আসতে?”

সে শুনেছিল। বলেছিল তার কোথা। নিয়েছিল আমাকে।

এখনো কিছু ভাল মানুষ আছেরে অনু। এই বলে শান্তি উঠে দাঁড়াল। বললও

“ চল খেতে বসি, সেখানে শেষ করবো সব কথা।”

অনির্বাণ জিজ্ঞাসা করলো,” তোর সেই দেবতা কোথায়?”

“ সব বলবো তোকে, আগে হাত মুখ ধুয়ে নে।”

খাবার টেবিলে বসে শান্তি বলে,” কি জানিস অনু, এখন মনে হয় উপরওয়ালা বলে কিছু আছে। তা না হলে আমার দেবতা যখন চলে গেল তখন তোর খোজ আমি পেয়ে গেলাম। আমার এক দরজা বন্ধ হোল আর এক দরজা খুলে গেল।

হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে ও চলে গেল একদিনের মধ্যে। রেখে গেল আমার তিন বছরের মেয়েকে। অনু, পারবি ? পারবি আমার অবর্তমানে অনন্যাকে মানুষ করতে? পারবি অনু?”

অনির্বাণ কথা দিয়েছিল। বলেছিল,” ভাবিসনে শানু, একবার ভুলেছিলাম, আর নয়।”

কয়েক বছর পাড়িয়ে গেছে। এক রোঁদরো ঝরা বিকেলে অনির্বাণ তার ড্রয়াইং রুমে বসে বই পড়ছিল, এমন সময় কোথা থেকে দুষ্টু মেয়ে টা কাকু কাকু বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল অনির্বাণের বুকে, গালে গালে রেখে বললও,” তুমি না বলেছিলে জোন্স বীচে নিয়ে যাবে কাকুমনি?”

“ হা, মা মনি চলো.”

Continue Reading

ফেলে আসা দিন গুলো

My name is Khan মুভি টা দেখে বেড়িয়ে আসতেই দেখে হোল অনেক দিনের পরিচিত এক ভাবীর সাথে। “ কেমন আছেন” জিজ্ঞাসা করল ভাবী। “ ভালো, আপনি?” কুশল সংবাদ আদান প্রদানের পরে বললও “ পরিচয় করিয়ে দেই, আমার বোন।” পরিচয় হোল। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মুখে কসমেটিকের ব্যবহার খুব একটা নয়, মাথায় আলতো করে ঘোমটা টানা। বয়স বোঝা মুশকিল। একটু হেসে চোখ টা সরিয়ে নিলো। হয়তো অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলতে অভ্যস্ত নয়। সেটাই স্বাভাবিক। ভাবীর সাথে কথা শেষে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ছোট্ট একটা জিনিষ কিনতে মলে গিয়ে ছিলাম, পেলাম না। তাই উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল এক পরিচিত মুখ। হাতে ভিক্টোরিয়া সিক্রেটের শপিং ব্যাগ। সামনা সামনি হতেই বললাম “ চিনতে পারছেন”? তাকালো, এবার আর চোখ নামিয়ে নিলো না। “ হা পারছি, অনেক দিন পর দেখা, তাই না?”

শপিং শেষ না শুরু ?

মাঝা মাঝি। আপনার?

যেটা কিনতে এসে ছিলাম, পেলাম না। তাড়া আছে কি?

না ততটা নয়

কোথাও বসে এক কাপ কফি খেতে বললে আপত্তি করবেন কি?

না বলা টা আমার মজ্জা গত, তবে আজ আর না বলব না। কোথায় বসবেন?

ওই তো ওখানে, Food court এ।

দুকাপ কফি নিয়ে বসলাম মুখোমুখি। আজ লজ্জার আভা দেখলাম না। সাবালীল ভঙ্গি।

জিজ্ঞাসা করলো,” কি করা হয়?” ফ্রি লেন্স রাইটার। যখন যা মনে আসে অথবা চতুর্দিকে যা দেখি তা নিয়ে লেখি। কেউ যদি ছাপায় ভালো, নতুবা নিজের মধ্যে রাখী। “ বোনের সাথে পরিচয় হোল কি ভাবে?। আপনার দুলাভাই কে চিনতাম আগে থেকে। কোন এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল , সেই সুবাদেই পরিচয়। “ কেউ আছে কি? “বলতে পারেন আছে। এক ছেলে, একমেয়ে। তারা তাদের নিজেদের সংসার নিয়ে বাস্ত। আমি আমাকে নিয়ে”।” বুঝলাম। আমিও আপনার মত।”

তাই কি?

জানি না। আপনার জীবনের বিশ্লেষণ আমার জীবনের বিশ্লেষণের সাথে নাও মিলতে পারে। আপনি দেখছেন হারানোর বেদনাটা এক ভাবে, আমি দেখছি অন্য ভাবে। প্রশ্ন হয়তো এক। কেনো হোল?

এই কেনো খুঁজতে যেয়ে আমিও দিশাহারা। তা কি করে হোল? প্রশ্ন তার।

সে অনেক কথা। আপনি বলুন আপনার কথা দেখি কোঁথাও মিল আছে কিনা

বলল, আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমার। সাত বোন দুই ভায়ের মধ্যে আমি ত্রিতিয়। বাবা সরকারী চাকরী করতেন। বদলীর চাকরী। বিভিণ্ণ সময়ে বিভিন্ন জাগায় থেকেছি। সব বোনের মধ্যে আমিই ছিলাম স্বল্পভাষী। অনেকে জানতোই না আমি বলে কেউ আছে এই বাসাতে।

একদিন বাবা এসে মা কে বলল তার এক বন্ধুর ছেলে এসেছে আমেরিকা থেকে। বাসাতে নিয়ে আসতে চায়। মা রাজী। তাদের মনে কি ছিল জানিনা। আমরা বোনেরা ভীষণ খুশী। গল্প শোনা যাবে আমেরিকার। এলো সে। সব বোনরা মিলে ঘিরে বসলাম। খুব একটা অপ্রস্তুত হোল বলে মনে হোল না। পাতাল রেলের কথা, বড় বড় বাড়ী এই সব বলতে বলতে এক গেলাস পানি চাইল। বুঝলাম নার্ভাস হচ্ছে। এত গুলো মেয়ের সামনে কথা বলা চাট্টি খানি কথা নয়।

চলে গেল সে। আমরাও আমাদের কাজে বাস্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ মা একদিন আমাকে ডেকে পাঠাল। বলল,”   বাহিরে খুব একটা যাওয়া আসা করোনা।” বুঝলাম না কেন। বললাম” হঠাৎ কি হোল? বলল।” তোমার বাবার বন্ধুর ছেলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে তোমার জন্য।”। আকাশ থেকে পড়লাম। “ কি বলছ?” আমার আগে আরো দুবোন রয়েছে। “ কিন্তু তোমাকেই তার পছন্দ।”। বিদেশে যাওয়ের সখ আমার চিরওদিনই ছিল। তাই বলে এই ভাবে?

তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্তা করতে হবে, কারণ সে ফিরে যাবে আমেরিকাতে। কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল বুঝার আগেই শুধু এটুকু জানলাম আমার আমিত্ব শেষ। আমি এখন অন্যের স্ত্রী।

এলাম এদেশে। স্বামী আমার দেবতুল্য। কোনদিন কুটো টা ছিঁড়তে দেয়নি। হয়তো বয়স আমার কম ছিল বলে। কিছুদিন পর ওরই এক বন্ধুর সাথে বিয়ে হয়ে আমার বড় বোন (আপনার ভাবী) এলো এদেশে।

আমার স্বামী অনেক পাশ দিয়ে পরে এক ফার্মাসীউটিকাল ইন্ডাস্ট্রি তে ভালো পজিশনে চাকরী পেলো। সংসারের সচ্ছলতার সাথে সাথে কোল জুড়ে এলো এক মেয়ে। ওর বাবার অনেক আদরের। তিন বছরের ব্যবধানে আরও একটা ফুটফুটে মেয়ে এলো আমাদের সংসারে। হই হুল্লো করে দিন গুলো আমার ভালোই কাটছিল, যদি না সে এসে একদিন বলত তার বুকের কাছে একটা চাঁপা

ব্যথা। দুলাভাই কে ফোন করলাম, বলল, এখনি নিয়ে যা হাসপাতালে। দুটো Artary ব্লক। স্টেনট লাগিয়ে দিলো। মনের মধ্যে অজানা একটা ভয়। কখন কি হয় কে জানে। এভাবে চলে গেল অনেক বছর। বড় মেয়ে তখন কলেজের ত্রীতীয় বর্ষের ছাত্রী।

এক রাতে ওর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা, তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স ডাকলাম। হাসপাতাল পর্যন্ত পোঁছাতে পারেনি, তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। আমার জীবনের বড় খুঁটিটা বন্যার জলে ভেসে গেল। “

এই বলে সে থামল, আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত ওর জীবন কাহিনী শুনছিলাম। থেমে যেতেই বললাম– তারপর।

তারপর , দুলাভাই আর বোন বুকে টেনে নিলো আমাদের তিনজন কে। আমাদের বাসাটা ভাড়া দিয়ে দিলাম। জমাট বাধা কান্না আমার বুকে। মাঝে মাঝে আড়ালে যেয়ে কেঁদে বুক ভাসাতাম। যাকে কোন দিন কুটো টা ছিঁড়তে দেইনি তার কাঁধে সব দায়িত্ব দিয়ে সে চলে গেল। আমি চোখের জল মুছে মন কে শক্ত করার চেষ্টা করলাম।

বিধাতার কাছে প্রার্থনা করলাম শক্তি দিতে।

আজ তিন বছর হয়ে গেল, মেয়ে দুটো কে সমাজের মাঝে মাথা উঁচু করে দাড় করাতে পেরেছি। নিজের বাসাতে ফিরে এসেছি। বড় মেয়ে তার বর খুঁজে পেয়েছে আমাদের জানাশোনার মধ্যে। আমি ছোট্ট একটা কাজ নিয়ে সময় কাটাচ্ছি। কত টুকু করতে পেরেছি তার হিসেব নিকেশ আজ আর করিনা।

বললাম আপনার পারিপারশীকতা আপনাকে সাহায্য করেছে। যে দাগ আপনার মনে গাথা তা মুছে যাবার নয়। তার একবার ছিঁড়ে গেলে তা জোড়া লাগে না, লাগলেও একটা দাগ থেকে যায়। এইটাই নিয়ম। তবুও বলব আপনি মনের দিক থেকে অনেক শক্ত।এ ব্যথা তো চলে যাবার নয়। তবু বলি, কাঁদেন, কাঁদলে হয়তো বুকটা একটু হাল্কা হবে। কিছু একটা কে আঁকড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা তো সবাই করে। আপনি হয়ত তা খুঁজে পেয়েছেন।

হয়তো তাই! মনকে বুজ দেই, যার ধন সে নিয়েছে আমার করার কিছুই নেই। এই সান্ত্বনা নেয়েই আমি বেচে আছি।

বললাম, সুন্দর একটা সময় কাটালাম আপনার সাথে, এই রইল আমার ফোন নাম্বার, প্রয়োজন বোধে কল দিয়েন।

Continue Reading

আগুনে পোড়া তামা

দেখে ছিলেম তাকে রান্না ঘরের মেঝেতে বসে পিয়াজ ছুলতে , দেখে ছিলেম দৌড়ে যেয়ে নীচের থেকে বাজার নিয়ে আসতে। কাছে এসে বলতে শুনেছিলেম “ মামা, তোমার কফির পানি হয়েছে, খাবেনা ?”

বলেছিলাম,” এতো দোড় দোড়ি করছিস কেন? একটু বোস।”

বলেছিল সে,” বসব আমি রাত নটায়, তখন আরম্ভ হবে আমার সিরিয়াল টা।”

বলেছিলাম, ‘’ রাত হবে অনেক, বাড়ী যেতে ভয় পাবিনা?”

“ না মামা, ভয় আর পাই না , যেদিন চড় খেয়ে ছিলাম স্বামীর হাতে।”

থমকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। বললাম, বস, বল তোর কথা।”

বিয়ে হয়ে ছিল ১৩ বছর বয়সে। দুই ভাই এক বোন এর মধ্যে দিলারাই বড়।

বাবার সংসারে স্বচ্ছলতা না থাকায় মেয়ে কে পাড় করে দিতে হয়েছিল ১৯ বছরের এক ছেলের সাথে। রিক্সা চালক, থাকে ঢাকা তে। বস্তীর এক ছোট্ট ঘরে এসে ঠাই নিয়ে ছিল দিলারা । বশীর কর্মঠ। সকালে বেড়িয়ে যায় রিক্সা নিয়ে। ফেরে রাতে। দিলারা পথ চেয়ে বসে থাকে। যে মেয়ে কিছুকাল আগেও পুতুল নিয়ে খেলে ছিল আজ সে সংসারি। ভাতটা, ডাল টা, তরকারী টা তয়রী করে রাখে, কখন বশীর আসবে ক্লান্ত হয়ে।

এটাই নিয়ম। ১৩ বছরের মেয়ে বুঝে নিয়ে ছিল সংসার কি। ঘিঞ্জি বস্তীর চারিদিকে দূরগন্ধ ময় পরিবেশের মধ্যেও দিলারা খুঁজে পেয়ে ছিল সুখের সন্ধান। অবসর দিনে বশীর দিলারা কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ত ওর রিক্সায়। দেখাতো বড় বড় দালান, বড় বড় বাড়ী, সিনেমা হল আরও কতো কি।

দিলেরা একটা ছুটা কাজ নিয়ে ছিল বাসার কাছে। সকালে যেয়ে ধোঁয়া মোছার কাজ সেরে ফিরে আসত দুপুরের মাঝে।

দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর পেড়িয়ে গেল। দিলারার কোলজুড়ে এলো এক ফুটফুটে মেয়ে। কাজ সেরে ক্লান্ত বশীর মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বস্তীর মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। দিলার

বাড়ে ভাত।

মেয়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে বশীর ও পাল্টে যেতে থাকল। রাত করে বাসায় ফেরে। মুখে মদের গন্ধ। কোন কোন দিন না খেয়ে শুয়ে পড়ে। জিজ্ঞাসা করলে বলে,” খেয়ে এসেছি।”

“ কোথায়?”

“ সে কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে?” ঝঙ্কার মেরে ওঠে বশীর।

দিলারা আড়ালে যেয়ে চোখের জল ফেলে।

মেয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হতে থাকল আর দিলারার ঘুণে ধরা সংসারের ফাটল বাড়তে থাকল। বশীর কোন কোন দিন রাতে আসত না। মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে ধরে দিলারা রাত কাটিয়ে দিতো।

মতির মা বস্তির আদিবাসী । বয়স হয়েছে। সব ঘরের খবরা খবর সে জানে। লোকে তাকে বাংলা বেতার নাম দিয়েছে। এক পড়ন্ত বেলায় দিলারার দরজার সামনে এসে ডাকল ,” ও পদ্মার মা, ঘরে আছো।” দিলারা দরজা খুলে মতির মা কে দেখে বিরক্ত অনুভব করলো। সে জানে মতির মা এমনি আসেনি। নিশ্চয় কোন পরোনিন্দা কর খবর নিয়ে এসেছে।

“ কি ব্যপার ? এই বেলায়।” দিলারার কথা শেষ হওয়ার আগেই মতির মা বসে পড়ল দরজার সামনের ছোট্ট জাগাটা তে।

“ বলি কি পদ্মার মা, খবরা খবর কিছু রাখো?”

দিলারার বুঝতে অসুবিধা হলনা কোন দিকে মতির মা এগুচ্ছে। হৃদকম্পন বেড়েই চলেছে।

মনে হচ্ছে সামনের সব কিছু হলদে রং এ আচ্ছাদিত। পাকস্থলীতে ছোট ছোট পোকা গুলো শুর শুরি দিচ্ছে মনে হোল দিলারার। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,” কি খবর মতির মা।”

“ তোমার নাংর, বশীর, ঠাঠারি পাড়ায় আর এক সাং নিয়ে থাকে, তা জানো।”

পোকা গুলো এখন উপরের দিকে আসছে মনে হোল দিলারার। মনে হচ্ছে ঘুমে তার চোখ বুজে আসছে। মাথার শিড়াটা দপ দপ করছে।

“ আমাকে নিয়ে যেতে পার সেখানে, মতির মা?” কর্কশ কণ্ঠে বললও দিলারা।

“ তা পারবো না কেনে ? আমার ছোট নাতিকে দিয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি”। এই বলে মতির মা উঠে পড়ল।

দিলারা পৌছিয়েছিল ভর সন্ধ্যায় ঠাঠারি পাড়ার সেই বাসাটার সামনে। দরজায় টোকা দিতেই আলু থালু বেশে এক মেয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল। “ কি চাই?”

বশীর কোথায় ? উচ্চও কণ্ঠে দিলারা প্রশ্ন করেছিল। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই বশীর এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে। “ এখানে কেন?” ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করলো বশীর।

দিলারর শরীর রাগে দুঃখে থর থর করে কাঁপছে। “ বৌ মেয়ে রেখে এখানে এসে আনন্দ ফুর্তি করছ ?”

বশীর কোন কথা না বলে একটা থাপ্পড় দিয়েছিল দিলার গালে। দিলারা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসেছিল বাসাতে। মেয়ে টাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিল অনেক।

“ না, কাঁদলে হবেনা, আমাকে বাঁচতে হবে।” এই ছিল তার পণ। এই শপথ নিয়ে দোরে দোরে গিয়েছিল কাজের জন্য। মুখ ঝামটা শুনেছে, কেউবা ভিখিরি বলে দু মুঠো চাল দিতে চেয়েছে। অশোভন ইংগিত যে পাইনি তা নয়।

তিন বেলা খাবার জোটেনি অনেকদিন। তবুও মনোবল হারায় নি সে। হারায়নি আস্তা উপর ওয়ালা থেকে ।

দাঁড়িয়ে ছিল একদিন এক বাড়ীর গেঁটের পাশে। দারওয়ান ঢুকতে দেইনি। সুতীর শাড়ী পরা এক ভদ্রমহিলা ঢুকতে যেয়ে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। দিলারার চোখের চাউনিতে ছিল ব্যদনা। ভদ্রমহিলা থমকে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। দিলারা বলেছিল,” মা কাজ চাই।”

উপরওয়ালার কলকাঠি নাড়া কে বুঝবে। দিলারা কে কাজ দিয়েছিল। তাও তো অনেক বছর হয়ে গেল।

সেই বাসাতেই আমার সাথে দিলার দেখা। বলেছিল,” জানো মামা সেই হারামজাদা ফিরে এসেছিল আমার কাছে কয়েক মাস আগে। আমি তাকে ঢুকতে দেইনি বাসাতে। শুনেছি শুধু মদে নয়, এখন ড্রাগেও তার আসক্তি।”

আরও বলেছিল, মেয়েকে সে প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করবে। করেও ছিল, করেছিল উপরওয়ালার দোয়া আর মুনিবের সাহায্যে।

ওর চোখে দেখেছিলাম ভব্যিষতের নেশা। উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি। সামান্য এক মেয়ের কঠোর সাধনা। কতক্ষণ অন্য মনস্ক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানিনা।

মনে হোল এক পাখা ভাংয়া পাখি আবারো উড়তে চাইল। জড়িয়ে নিলো তার পাখার ছায়ায়

ছোট্ট শিশুটিকে। বললও, “ আমি উড়তে পারিনি, তুই পারবি। তুই উড়বি ওই বিশাল আকাশের মাঝে।”

মামা ,

কিরে

কি ভাবছ? তোমার কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

হা খাবো।

শোন, কাল আমার যাওয়ার পালা। ভালো থাকিস।

সে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ওর চোখের কণে ছোট্ট জ্বলের কণা। ও জল নয়।

হীরের কণা। যার রস্মি ওকে পথ দেখাবে। চলে গেল সে তার কাজের জগতে। আমি কফির পেয়ালায় চুমুক দিলাম।

শাফিউল আলম

Continue Reading

স্টেশন বারাকর

কলকাতায় এসেছি বেশ কিছুদিন হোল। পুরানো কাগজ পত্র ঘাটতে যেয়ে পেলাম অনেক আগের সাদা কালো একটা ছবি। দিলিপ, শিবু, আর আমি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শিবু দের কে চলে যেতে হয়েছিল ভারতে। তারপর আর খোজ পাইনি। শুনে ছিলাম সে কানপুরে আছে। সঠিক জানিনা। মনে হোল যোগা যোগ টা করতে পারলে একবার ঘুরে আসা যেতো। দিলিপ কে ফোন করলাম। সে হয়তো জানতে পারে।

ফোন টা উঠাতেই বললাম, “ দিলিপ, আমি সজীব বলছি”

তা কি মনে করে”। “

শোন, তুই কি জানিস শিবু কোথায়? আমি কলকাতায়। ভাবছি যদি সম্ভব হয়, তবে ওর সাথে দেখা করবো।”

“ মাস ছয়েক আগে সে এসেছিল। দাড়া, ওর নাম্বার টা দিচ্ছি।”

নাম্বার টা পেয়েই সাথে সাথে ডায়েল করলাম। ওপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো,” আপ কোন হ্যাঁয়”

বললাম,” নিকুচি করি তোর হিন্দি। আমি সজীব বলছি।” একটু ভড়কিয়ে গেল সে, সচেতন হতেই বললও,” শালা, কোথায় তুই।।” বললাম, “কলকাতায়।” “চলে আয়, আমি কানপুরে।”

“সেইজন্যই তো কল করলাম।”

সমস্ত খবরাখবর নিয়ে বললাম,” আজ বিকেলের ট্রেনেই রওয়ানা হচ্ছি। তুই স্টেশনে থাকিস।”

অনেক দিন পরে দেখা হবে। অজানা আনন্দে মনটা ভরে উঠল।

যথারীতি শিয়ালদহ স্টেশনে চলে এলাম। ট্রেন ৪ টা ৫০ মিনিটে ছাড়বে দিল্লীর দিকে, মাঝে কানপুর। লোকজনের আনাগোনা অতটা নয়। শীতের বিকেল। ট্রেনে লম্বা জার্নির কথা অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম। যাক, আজ তা পূরণ হতে চলেছে। কামরা টা পরিস্কার, পরিচছন্ন। সব মিলে আমরা গোটা দশ জন লোক। জানালার পাশের সীট আমার সবসময় প্রীয়। Steve Jobs এর আত্মজীবনী বই টা খুলে বসলাম। অনেক দূরের পথ। কথা বলার সঙ্গী সাথী না থাকায় বই একমাত্র সম্বল আমার। ঘণ্টা দুই পেড়িয়ে ট্রেন এসে থামল দুর্গাপুর এ। দু এক জন যাত্রী উঠা নামা করলো।

“ বসতে পারি”। বাংলায় প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে দেখি, মধ্য বয়স্ক এক ভদ্রলোক। পরনে সাদা পাঞ্জাবী উপরে কোর্তা। এই ঠাণ্ডার উপযুক্ত পরিচছদ নয়। বললাম,” নিশ্চয়”। ভদ্রলোক বসলেন। “ কি বই? প্রেমের না অন্যকিছু।” প্রশ্ন টা আমার মনপুত নয়। বললাম ,” জীবন কাহিনী”। আমার চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ ভালবেসেছেন কাউকে কোনদিন।” একটু বিরক্ত অনুভব করলাম। নিতান্তই পার্সোনাল ব্যাপার। তবুও বলতে ব্যাধ হলাম, “ হা, বেসেছিলাম”। উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। আনমনা। দ্রীস্তী মনে হোল অনেক দুরে প্রসারিত।

হঠাৎ ই বললেন, এই, এই স্টেশন থেকেই সে উঠে ছিল।

“ কে, কে উঠেছিল?”

“আকরাম”

“ আকরাম কে?”

আকরাম আহমেদ, কাজ করতো দিল্লি তে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টএ। আপনি যে সীট টাতে বসে আছেন, ওই টাতে সে বসে ছিল। সে কি জানতো দু ঘণ্টা পরে তার জীবনের অধ্যায় অন্যভাবে লেখা হবে। বলতে থাকলেন, স্টেশন বারাকরে ট্রেন থামতেই উঠে এলো নীল রং এর কামিজ পরনে, গায়ে লাল সাল জড়ানো মেয়েটি। বসলো, ওই যে ভদ্রলোক বসে আছেন ওই সীট টাতে। দুজনে মুখোমুখি না হলেও চোখের দ্রীস্তীর বাহিরে নয়। দু একবার যে চোখাচোখি হয়নি তা নয়। দ্রীস্তীকটু হবে বলে আকরাম আর তাকায়নি ওর দিকে। তবে দেখা হয়ে ছিল ট্রেনের ক্যান্টিনে। নাম মল্লিকা। মল্লিকা ব্যানারজি।

আকরাম ইতস্ত করে বলেছিল,” চা খেতে আপত্তি আছে? একসাথে।” মল্লিকা না করেনি। চা র পেয়ালা শেষ করতে করতে কথা হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। জেনে ছিল মল্লিকা দিল্লীর এক কলেজে পড়ে। এসে ছিল বাড়ীতে ছুটির সময়। নিজেদের কামরায় আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ক্যান্টিনে কাটিয়ে ছিল পুরো সময় টা। ট্রেন দিল্লী তে এসে পোওঁছালো সকাল ১০ টা ২২ মিনিটএ।

এবার বিদায়ের পালা। আকরাম বলেছিল,” আমি যাবো ডালহোসী পাড়ায়। আপনার কোন আপত্তি না থাকলে আমি নামিয়ে দিতে পারি”। নেমে যাওয়ার আগে আকরাম ওর বিজনেস কার্ড টা মল্লিকা কে দিয়ে বলেছিল, “ সময় পেলে ফোন করেন।” সেই ফোন এসেছিল দশদিন পরে, রাত ৮ টায়।

“ কেমন আছেন? চমকিয়ে উঠলেন তো?” কথা গুলি আকরামের কানে সেতারের মত রিন ঝীন করে বাজলো ‘ না না চমকাবো কেনো? আপনার কথা মনে হচ্ছিল।” কথা টা বলেই সে বুঝতে পারলো, বলাটা ঠিক হলো না। একবার মনেও হয়ে ছিল, যেখানে মল্লিকা কে নামিয়ে দিয়ে এসেছিল সেই বাসায় যেয়ে দরজায় কড়া নাড়াবে কিনা। না পরে সেই চিন্তা বাস্তবে আনেনি। আজ তার মনে হোল এতো মেঘ না চাঁইতেই জল।

আকরাম সাহস সঞ্চয় করে বললও,” কাল বন্ধের দিন, এক সাথে বসে যদি লাঞ্চ করি আপত্তি আছে কি?”

না নেই। কোথায় দেখা হবে। কখন ? ও প্রান্ত থেকে জবাব আসে ।

লরেন্স স্ট্রীটের কর্নারে। দুপুর ১২ টায়

রাতটা যে কিভাবে কেটেছে আকরাম নিজেও জানেনা। ভোর হতেই হাতের কিছু কাজ শেষ করে তয়রি হয়ে নিলো। ঠিক ১২ টায় লরেন্স স্ট্রীটের কর্নারে সে হাজির। মল্লিকা তখনো আসেনি। ভাবছিল আদ্যও সে আসবে কি না। ভুল হয়ে গেছে, কালকে ফোন নাম্বার টা নেওয়া হয়নি। অস্থির হয়ে আকরাম ঘড়ি টা দেখল। ১২ টা ৫ মিনিট। ঠিক সেই সময় মল্লিকের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। “ দেরী হয়ে গেল, তাই না?”

“না, না দেরী কোথায় , মাত্র তো ৫ মিনিট,” চলেন, মেডিটেরিয়ান ফুডে কোন আপত্তি নেই তো?”

না নেই।

ওরা যেয়ে বসেছিল সেভিলা- দি ক্লারিজ এ। দুদিনের দেখাতেই মনে হয়েছিল ওরা দুজনে অনেক কাছের। মনের মিল খুঁজে পেয়েছিল দুজনে। বিকেলের পড়ন্ত বেলাতে হেঁটে ছিল ইনডিয়া গেট এর লনে। আইস ক্রিম খেতে খেতে ঠিক করেছিল আবারো মিলিত হবে দুজনে কোথাও কোনো খানে।

সেই শুরু। দিন শেষে মাস, মাস শেষে বছর কেটে গেছে। হেঁটেছে দুজনে কণাট প্লেসে। মল্লিকার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল লোডি গার্ডেনে। গুনগুন করে গেয়ে ছিল বেসুরো গলায়,” আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি।”

এই চলার যে শেষ কোথায় সেটা ওরা বুঝতে পারিনি। ফাইভ সেনস গার্ডেন এ বকুল গাছটার নীচে বসে মল্লিকা বলে ছিল আকরাম কে,” বাবা মেনে নেবেনা অন্য গোত্রের ছেলেকে।”

আমি যেয়ে তোমার বাবা কে বলবো

তুমি আমার বাবা কে চেনো না। আমি জানি না , এর পরিনিতি কোথায়।

কিন্তু দুজন দুজন থেকে প্রিথক হওয়ার সম্ভবনা নেই। গোত্র, সংসকার আজ বাধা হয়ে দাড়িয়েছে দুজনের মধ্যে। মল্লিকা আকরামের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “ ছুটিতে বাড়ী যেয়ে বাবাকে সব বলবো। দেখি কি হয়।”

বাবা কে সে বলেছিল। বাবার এই অগ্নি মূর্তি সে আগে কখনো দেখিনি।

“ মেয়ে কে আমি জলে ভাসিয়ে দেবো তবুও মুসলমান ছেলের সাথে বিয়ে দেবোনা।” মল্লিকা কে সে আর ফিরে যেতে দেয়নি দিল্লীতে। ছুটির সময় পেড়িয়ে গেলো। মল্লিকা এলো না। একদিন ভোরের ট্রেনে আকরাম রওনা হয়ে গিয়েছিল বারাকরের পথে। লোকের কাছে পথের নির্দেশ নিয়ে সে এসে দাঁড়িয়েছিল ব্যানার্জির বাসার সামনে। কড়া নাড়তেই, কর্কশ স্বরে কেউ উঠল, “ কে, কি চাই?” আকরাম নরম সুরে বলল, “ আমি?”

“ আমি তো সবাই, তুমি কে?”

আমি আকরাম।

দড়াম করে দরজা খুলে গেলো। “ বেড়িয়ে যাও, বেড়িয়ে যাও এখান থেকে।”

আকরাম ভদ্র চিত্ত গলায় বলল, “ একবার মল্লিকের সাথে দেখা করতে পারি।”

এ যেন আগুনে ঘি ঢালার মত। চিৎকার করে উঠলেন হবুনাথ ব্যানার্জি। “ মেয়ে কে আমি দু টুকরো করে জলে ফেলে দেবো তবু তোমার হাতে দেবোনা”।

চিৎকার শুনে দু একটা মাস্তান গোছের ছেলে এসে জোড়ও হোল। মল্লিকার ছায়া আকরাম সেদিন দেখতে পায়নি। ভগ্ন হ্রদয় নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করেছিল। ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে সে। একবার যদি মল্লিকার সাথে দেখা করতে পারতো। চিন্তা গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাঁচছে। আমবাগান টা পাড়

হওয়ার আগেই একটা প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়ল আকরামের মাথায়। জ্ঞান হারিয়ে পরেছিল সে।

যখন চোখ মেলে চাইল ঝাপসা ভাবে দেখতে পেলো এক মেয়ের মুখ।

মল্লিকা!

উত্তেজিত হবেন না। আমার নাম সঙ্গীতা। নার্স।

আমি কোথায়, জিজ্ঞাসা করলো আকরাম

আপনি কামার দুবী হাসপাতালে। মাথায় আঘাত পাওয়াতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন রাস্তায়। কয়েকজন মিলে নিয়ে গিয়ে ছিল ওখানকার এক ক্লিনিক এ। সেখান থেকে ট্রান্সফার করে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। ৫ দিন

পরে আপনের জ্ঞান ফিরেছে।

বারকরের মল্লিকার খবর জানেন?

না, আমি তো ওখানকার নই।

আরও দশ দিন লেগে গিয়েছিল কিছু টা সুস্থ হয়ে হাঁসপাতাল থেকে বেড়িয়ে আসতে। জিজ্ঞাসা করেছিল বারকরের ক্লিনিক এর নাম। গিয়েছিল আকরাম সেখানে। খোজ নিয়েছিল মল্লিকার। জেনে ছিল দিন পাঁচেক আগে সে আত্মহত্যা করেছে। লিখে রেখে গেছে,” আকরাম যে পথে গেছে আমি সেই পথেই চললাম।”

আকরাম খুঁজেছিল শ্মশানের আনাচে কানাচে। কোথায় তার শেষ ক্রীত সম্পন্ন হয়েছিল জানতে। খোজ পায়নি। ফিরে গিয়েছিল স্টেশনে।

এর পর আকরামের খোজ আর কেউ সঠিক ভাবে দিতে পারেনি। তবে শোনা যায় সে দূরে এক মিশনারিতে কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিল। দুস্ত মানুষের সেবা করতো। কলকাতার কুষ্ঠ সেন্টারে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল। তাও তো অনেক দিনের কথা। অনেকে বলে প্রতি বছর ২৫ শে জানুয়ারি সে বারকর স্টেশন আসে। শ্মশানে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়।

২৫ শে জানুয়ারী কেন ?

ওই দিনই তো ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল।

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ আমার স্টেশন এসে গেছে, চলি। সালাম।”

ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। বাহিরে ঘন কুয়াশা। মনে হচ্ছে সাদা চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে স্টেশনটা। তাকিয়ে ছিলাম জানলা দিয়ে। কুয়াশা ভেদ করে আবছা আলোর রস্মী এসে পড়েছিল স্টেশনটার নামের ফলকের উপর।   বারাকর।

চমকিয়ে উঠলাম। এই তো সেই বারাকর।

সামনে বসা ভদ্রলোক কে জিজ্ঞাসা করলাম, আজ কত তারিখ ?

২৫ শে জানুয়ারী।

২৫ শে জানুয়ারী , বারাকর।

হন্তদন্ত করে গেলাম দরজার কাছে। ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে। দূরে একটা ছায়া দ্রুত মিলিয়ে গেলো কুয়াশার ভিতর।

কানে বাজতে থাকল কথাটা, “ এই আমার স্টেশন, সালাম.”

Continue Reading

বেণী পাগলী

বেণী পাগলী, বেণী পাগলী চলে গেছে, আর আসবে না কোনদিন। কিন্তু সে তো আমার মন থেকে চলে যেতে পারিনি। এখনো আমার চোখে ভাসে বেণী পাগলীর চেহারা। পরনে ছেড়া শাড়ি গায়ের সাথে পেঁচানো। হাতে একটা ঝোলা। এলোমেলো চুল, কত দিন ওটার উপর চিরুনির আঁচড় পরেনি কে জানে। চোখের চাহুনীতে মনে হয় কি জেনো খুঁজছে। পাচ্ছেনা।

যশোরের বাগমারা পাড়ায় আমাদের বাসা। আমার বয়স পাঁচ। গোপাল, শিবু, দীলিপ, খোকন আমরা সবায় এক বয়সী। মারবেল খেলার সঙ্গী। দীলিপ চীৎকার করে উঠলো, “ বেণী পাগলী, বেণী পাগলী”। দোর, ছুট। কেন বেণী পাগলী কে দেখে ভয় পেতাম তা আজও জানিনা। দুর থেকে ডাকতো আমাদের কে। দেখাতো হাতে আম গাছ থেকে পারা লাঠি টা। আমরা ভেংচি কাটতাম দুর থেকে।

মাঝে মাঝে গাছের ছায়ায় বসে মাথার উকুন মারতো। ঝোলাটা পাশে। একটু কাছে যেয়ে বলতাম,” এই বেণী, তোর ওই ঝোলাতে কি রে?” বলতো,” সাপ, গোখরো সাপ, আয়, কাছে আয়”। ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যেতো আমাদের। একটা মারবেল ছুড়ে মারতাম ওই ঝোলাটার দিকে, সাপ টা ফোঁস করে ওঠে কিনা দেখার জন্য। বেণী পাগলী লাঠি নিয়ে তাড়া করতো। দে ছুট।

একদিন খেলা শেষে বাসাতে এসে দেখি বেণী মার সাথে উঠোনে বসে। ওমা, দেখে আমার চক্ষু ছানা বড়া। ভয়ে আমি জড়সড়। বেণী আমার দিকে চেয়ে ফিক করে ফোকলা দাঁত বেড় করে হাসলো। পাশের ঝোলা তে হাত দিতেই আমি চীৎকার করে উঠলাম। মা- গোখরো সাপ। কোথায় সাপ, মা ধমক দিলো আমাকে। “ ওই তো, ওই ঝোলার মধ্যে। বেণী পাগলী আবারো ফিক করে হাসল। মা ঝোলা টা টেনে এনে ভেতর থেকে একটা বড় কোঁটা বেড় করলো। তার মধ্যে চাল। মা আরেক বাটী চাল ওর মধ্যে দিয়ে দিলো। বেণী উঠে পড়ল। আমার দিকে তাকাল। এ দৃষ্টি টা সেই আগের দৃষ্টি নয়, মমতায় ভরা। ও চলে গেলো। আমি মাকে বললাম’ মা আমি ওকে ভয় পাই। কেন? জানিনা। মা আর কথা বাড়াল না।

বেণী থাকতো রেল স্টেশনের কাছে। ওদিকে গেলেই ওকে দেখতাম ছেড়া কাপড় পরে বসে আছে গাছের নিচে। কাঁঠি দিয়ে পিঁপড়ে গুলোকে বের করছে আর মারছে। আমি হাঁটতাম রাস্তার উলটো দিক দিয়ে। সে আমার দিকে তাকাত আর ফিক করে হাসতো।

আরও অনেক বার দেখেছি তাকে মার সাথে বসে গল্প করতে। কিন্তু ভয় আমার কাটেনি। সময় পেড়িয়ে গেলো। বাবা বদলি হয়ে আমাদের কে নিয়ে চলে গেলেন অন্য শহরে।

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একদিন যশোরের উপর দিয়ে খুলনা যাবো বোনের বাসায়। মনে পড়ল ছোটো বেলার কথা। nostalgia আমাকে পেয়ে বসলো। নেমে পড়লাম বাস থেকে। একটা রিকশা নিয়ে গেলাম সেই বাগমারা পাড়ায়। চিনতে অসুবিধা হোল। আমরা যে বাসাতে থাকতাম সেখানে উঠেছে বিরাট প্রাসাদ। শিবু দের বাসার সামনের আমগাছ টা নেই। মারবেল খেলার জাগাটা পাকা করে মুদির দোকান বসেছে। একটু এগিয়ে পুকুর, যেখানে সাঁতার শিখেছিলাম, সেখানে উঠেছে বিশাল অট্টালিকা। আমার ছোট বেলার স্রীতি হারিয়ে গেলো। মনে পড়ল বেণী পাগলীর কথা। রিকশা ওলা কে বললাম,” চলো রেল স্টেশনের দিকে”। পোঁছালাম। যে গাছটার নীচে বেণী বসে থাকতো তার কোন চিহ্ন পেলাম না। নেমে পড়লাম। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দোকানের দিকে। না এরা জানবেনা, এরা অতি অল্পবয়সী।

দুরে একটা চা স্টলের সামনে দুজন বয়স্ক লোক চা পান করছে। আমার পরিচয় দিয়ে বললাম অনেকদিন আগে এই শহরে আমি বাস করতাম। বেণী নামে এক পাগলী এখানে ছিল। চেনেন কি? বলল, “ না, তবে ওই যে দেখছেন ছোট দোকান টা ওটার মালিক এখানকার আদিবাসী। উনি আপনাকে হয়ত সন্ধান দিতে পারে।”

দোকানে পা দিতেই ভদ্রলোক তাকালেন। বেশ বয়স্ক। নাম হরিহর ঘোষাল। জিজ্ঞাসা করলাম বেণীর কথা। হরিহর বাবু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বললেন,” একটু দেরী হয়ে গেলো। আজ বছর সাতেক হোল মারা গেছে। যে গাছটার কথা বলছেন ওর নিচেই সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল। দাফন দেওয়ার কেউ ছিলোনা। আমরা সবাই মিলে ব্যবস্তা করে ছিলাম। ওর জীবন ইতিহাস আপনি কি জানেন।” বললাম,” না, আমি তখন অনেক ছোটো, শুধু ভয়ই পেতাম ওকে দেখে।” তবে শুনুন,” ও ছিল এক গেরস্ত ঘরের মেয়ে। এখান থেকে দুই মাইল পুবে গেলে ওদের গ্রাম। বাবার ছিল চালের ব্যবসা। একই মেয়ে। নাম ছিল বনানী। বাবার চোখের মনি। আদর দিয়ে মেয়ে কে মানুষ করেছিল। প্রায় বলত, “ জানো হরি, মেয়ে আমার একদিন বড় ডাক্তার হবে। দেখে নিও।”একদিন দুজনে মিলে বনানী কে নিয়ে গিয়ে ছিলাম মেলায়। ওর চুলের ফিতে লাগবে। লাল রং এর। ও তখন তিন বছর মাত্র। আমরা কথায় বাস্ত। হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখি বনানী নেই পাশে। আমাদের বুক টা ধড়াস করে উঠলো। চীৎকার করে নাম ধরে ডাকতে থাকলাম। ওর বাবার চোখে জল। কি হবে হরি। বললাম ধরজো হারিও না, তুমি যাও এদিকে, আমি ওই দিক টা দেখছি। মেলাতে লোকের সংখ্যা অনেক। চীৎকার শুনে একজন বলল,” কাঁকে খুঁজছেন? “ একটা ছোট্ট মেয়ে। বলল,” ছোট্ট একটা মেয়েকে দেখেছি পুতুল নাচের ওখানে বসে থাকতে।” দড়িয়ে গেলাম। দেখলাম মা আমাদের বসে পুতুল নাচ দেখছে। সে যে কি শান্তি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। ওর বাবা ওকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। তুমি যদি দেখতে সেই দৃশ্য। যত আবদার ছিল তার বাবার কাছে।

এখানের মেয়ে দেড় স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে ছিল। স্কুল শেষে আমার এখানে এসে বসে থাকতো। বাবা কাজ শেষে যাওয়ার পথে নিয়ে যেতো। সে তো আজকের কথা নয়।

একদিন কি হোল জানেন?   বলেন। ও তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। স্কুল শেষে আমার এখানে এসে বসে আছে। বাবা আসবে। কিন্তু সে আসছেনা। শম্ভু, এপাড়ার ছেলে, দোড়িয়ে এসে বলল,” হরি কাকা, করীম কাকা কে সাপে কামড়িয়েছে।” দোড়িয়ে গেলাম ওর চালের আরোতে। পড়ে আছে সে মেঝেতে। গুদামের ভিতর চালের বস্তায় হাত ঢুকিয়ে ছিল। কে জানতো সেখানে বসে আছে বিষধর গোখরো। এক ছোবল। ওঝা আসতে আসতে সব শেষ। বনানী তাকিয়ে থাকলো ওর বাবার মৃত দেহের দিকে। চোখে জল নেই। পাষাণ হয়ে গেছে। বললাম,’ কাঁদ মা মনি, কাঁদ”। সেই যে পাষাণ হয়ে গেলো আর কোনদিন ওর মুখে আমি হাসি দেখেনি।

জিজ্ঞাসা করলাম, ওর পড়াশুনা? ওই খানেই ইতি। মা আর এতদূরের স্কুলে পাঠাতে চাইনি। বিয়েয়ে দিয়ে ছিল এখানকার এক মাস্টারের সাথে। ছেলেটা বকা ঝকা করতো ওকে। মাঝে মাঝে আমার এখান থেকে তেল নুন নিতে আসত। হাসি দেখিনি ওর মুখে। পরান টা আমার ফেটে যেতো। একটা ছেলে হয়ে ছিল। বিধির কি খেলা কেউ জানেনে। ছেলের বয়স তখন চার অথবা পাঁচ। এক দুপুরে বনানী ঘুমিয়ে। ছেলে যে কখন দরজা খুলে বেড়িয়ে গেছে সে জানেনা। এই রাস্তাটা সে পাড় হতে চেয়ে ছিল। কিন্তু পারেনি। দোত্তের মত একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিয়ে ছিল। ছিটকে পড়ল ওই গাছটার নীচে। ছোট্ট ছেলেটার দেহ দুমড়ে কুঁচকে আরও ছোটো হয়ে গিয়েছিল। বনানী কিছুই জানেনা। দৌড়ে যেয়ে আমি ওকে নিয়ে এলাম। সেই মাংস পিণ্ডো টাকে বুকে চেপে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকল। সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা সেদিন ছিলোনা। অদৃষ্টের পরিহাস আরও কিছু বাকী ছিল। কয়েক মাস পর ওর স্বামী ওকে তালাক দিয়ে এই খান থেকে চলে গেলো। ওর মা চলে গেছে অনেক আগেই। শুধু আমিই ছিলাম। বললাম, “ এই ঘরটাতে এসে থাক”। এলো। নিজে নিজেই হাসত। আর ওই গাছটার নিচে যেয়ে বসে থাকতো। ছোটো ছোটো ছেলে দেখলে ধরতে যেতো। এই বলে হরিবাবু থামলেন।

বললাম, আজ বুঝতে পারছি কেন সে বলত ঝোলাতে গোখরো সাপ আছে, কেন সে ওই গাছটার নীচে বসে থাকতো। আমার দেখা ওর শেষ চাউনীতে এত মমতা কেন ছিল। হয়ত আমার মধ্যে খুঁজতে চেয়ে ছিল ওর হারানো ছেলে কে।

বলতে পারেন ওর কবর কত দুরে।

এই তো কাছেই। যাবেন।

চলেন। সেদিন সে আমাকে ছুতে পারেনি, আজ আমিই না হয় আমার হাত দিয়ে ওর কবর টা ছুঁয়ে আসবো.

Continue Reading

নিষিদ্ধ গোলাপ

নভেম্বেরের মাঝা মাঝি। ঠাণ্ডা ততটা প্রকোপ নয়। তাপমাত্রা ৫০ এর কোঠায়। তবুও গায়ে, মাথায় গরম বস্ত্র থাকা ভালো। সেই ভাবে প্রস্তুত হয়েই বেড়িয়ে ছিলাম বাহিরে। যেতে হবে বোস্টন। বন্ধু নামিয়ে দেবে Port authority Bus terminal এ। রাতের বাসে যাবো। বন্ধু যথা সময়ে নামিয়ে দিলো আমাকে, আমার সময় অনুসারে নয়, তার সময় অনুসারে। গরজ আমার, তার নয়। কাজেই পোঁছে গেলাম দু ঘণ্টারও বেশী সময় হাতে নিয়ে। এমতো অবস্থ্যায় করনীয় কিছু নাই, শুধু কফি পান করা ছাড়া। ঘড়িতে দেখলাম দুঘণ্টা সময় আছে বাস ছাড়তে। অগত্যা পাশের স্টারবাক্স থেকে কফি নিয়ে একটা খালি বেঞ্চে বসলাম। গরম কফিতে ঠাণ্ডা কিছু টা কাটবে।

কফিতে চুমুক দেবার আগেই Hi শুনে তাকালাম সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে। Hi এর পরিবর্তে Hi বলতে হবে এটাই প্রচলিত নিয়ম। বললাম, Hi. এক ঝলক দেখে মনে হোল বয়স ষোলো থেকে আঠারোর কোঠায়। Blond hair, অরিজিনাল হয়তো হবেনা, রং করা। গাড়ো লাল লিপিস্টিকের প্রলেপ ঠোঁটে, মুখে রং এর ব্যাবহার একটু বেশী বলে মনে হোল, স্কিন টাইট প্যান্ট, বুঝতে বাকী রইল না সে কোন পেশায়ে নিয়োজিত। “ এক কাপ কফি খেতে ইচ্ছা করছে”। বুঝলাম সে পয়সা চায়। লিংকনের ছবি ওলা নোট টা দিয়ে বললাম, “ এটা কফির জন্য, চেঞ্জ ফেরত দিতে হবেনা “। এটা আমার ভদ্রতা নয়, তাড়াতাড়ি ওকে বিদায় করাই আমার উদ্দেশ্য। মাথায় ঘুরছে শতশত চিন্তা। কাছা কাছি নিশ্চয় ওর পীম্প আছে, যে কিনা নজর রাখছে। এই বাস ডেঁপো টা আমার প্রিয় জাগা নয়। তাও এত রাতে।

“ বসতে পারি ?” খুব ভদ্র ভাবে বলল সে। হাতে কফির কাপ। “ তোমার দেওয়া বাদবাকি ডলার দিয়ে কেক টাও কিনে নিলাম। খিদে পেয়েছে”। এই বেঞ্চ আমার সম্পতি নয়, কাজেই বসতে না বলার অধিকার আমার নেই। সে পাশে বসল। কি নাম তোমার? “জুলীয়া”। কতদিন আছো এই বাপ্সায়ে ? “ বছর খানেক হোল”। বয়স কত? উনিশ পেড়োল। চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম কেউ এগিয়ে আসছে কিনা। কালেঙ্কারীতে জরা তে রাজী নই। উঠে অন্য খানে যেয়ে বসবো ভাবলাম। কিন্তু কি একটা মোহ আমাকে যেতে দিলোনা। জানতে ইচ্ছা করলো, এই বয়সে কেন এ পথে।

“ এখানে বসে থাকলে তোমার ব্যাবসায়ে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবেনা, তাই নয় কি” ?। বলল, “ আজ বাজার মন্দা। তাইতো তোমার কাছ থেকে পয়সা চেয়ে খেতে হোল। আজ আর নয়।” এপথে কেন?

সে অনেক বড় কাহিনী। ঘড়িতে দেখলাম এখনো অনেক দেরী বাস আসতে। বললাম আপত্তি না থাকলে বলতে পারো।

বাসা আমার ক্যানসাস এর এক ছোট্ট শহরে। দুবোন, বোন আমার পাঁচ বছরের বড়। বাবা আর মা। বাবা auto mechanic আর মা এক দোকানে স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করে। কোনদিন দুজনের মধ্যে মিল আমি দেখিনি। বাবা বেশীর ভাগ সময় মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতো। যাকে বলে আল্কহলিক। সংসারে মানসিক অশান্তির সাথে সাথে টাকা পয়সার টানা টানি লাগেই ছিল। বাবার ইনকাম মদেই উড়ে যেতো।

কোনদিন ভালো জামা কাপড় পড়েছি বলে মনে পড়েনা। ফলে বন্ধু বান্ধবী দের সাথে কোথাও যেতে অস্বস্তি বোধ করতাম। বাসাতে আনার মত অবস্তাও ছিল না। বয় ফ্রেন্ড জোগাড় করতে পারিনি হয়তো inferiority complexএ ভুগতাম সেইজন্য। মা বাবার মধ্যে কোলাহল লাগেই ছিল। একদিন তা চরমে উঠল। মদে বুদ হয়ে এসে মার গায়ে হাত তুললো বাবা। অকথ্য ভাসায় গালাগালি করতে থাকলো কোন কারণ ছাড়াই। মা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। বাবাকে দিড়রো ভাসায় বললাম বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে। সে চলে গেলো টলতে টলতে। বেশে কিছুদিন তার কোন দেখা পায়নি। এর মধ্যে আমার বড় বোন তার বয় ফ্রেন্ড নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেলো। লিখে রেখে গেলো,” এই নরকে আমি থাকতে রাজী নই”। সংসারে টানাটানি। ঈস্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী আমি। পারট টাইম কাজ নিলাম এক Bar এ। কোন রকমে টিকে থাকার জন্য। চার পাঁচ দিন বাদে বাবা এসে হাজির হলো। মা কিছু বলল না। শেষ নিঃস্বাস তার এই বাসাতে ত্যাগ করতে হবে বলেই হয়তো বিধাতা তাকে পাঠিয়ে দিয়ে ছিল। সেই রাতে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলো বাবা। সে চলে যাওয়াতে আমি যে দুঃখিত হয়েছিলাম তা নয়। বরং ভাবেছিলাম এখন আমরা, মা আর আমি মিলে অভাব অনটন কিছু টা কাটিয়ে, সুন্দর পরীচছন্ন জীবন অতি বাহিত করতে পারব। কিন্তু বিধি বাম। এক রাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ থেকে চলে এসেছিলাম। কেলাসের কিছু assignment বাকী ছিল। না আসলেই বোধ হয় ভালো হতো। দরজা খুলতেই পুরুষের গলা শুনলাম মার ঘর থেকে। ইচ্ছা করেই দরজাটা জোড়ে বন্ধ করলাম। মার ঘরের দরজাটা খুলে গেলো। মা বেড়িয়ে এলো আর একজনের সাথে, আলু থালু বেস। পরিচয় করিয়ে দিলো, “কেভীন”।

তার চোখের চাউনী আমার ভালো লাগল না। আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। পেড়িয়ে গেলো বেশ কিছুদিন। কোন এক week end এ মা কে কাজে যেতে হয়েছিল। বাসাতে আমি একা। পরীক্ষা সামনে। বাস্ত আমি। ঘরের দরজাতে টোকা পড়ল। ভাবলাম মা এসেছে বোধহয়। খুলতেই দেখি কেভীন মার কাছে এসেছে। বললাম মা নেই। শুনল না। ঘরে ঢুকে পড়ল। হায়েনার দাঁতের মত হলদে দাঁত গুলো বেড়িয়ে এলো। হাসছে। এগিয়ে আসছে। আমার সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। বিধি সেদিন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মা ঢুকলো ঘরে। কেভীন তার হলদে দাঁত বের করে মা কে জড়িয়ে ধরল। ঘ্রীনায় সারা শরীর আমার রি রি করছে। বাড়ী থেকে বেড়িয়ে গেলাম। জানি মা কে বলে কোন লাভ নেই। ঠিক করলাম পরীক্ষা শেষে বেড়িয়ে পড়বো বাড়ী থেকে।

বেড়িয়ে পরেছিলাম এক রাতে সব স্রীতী পিছনে রেখে নতুন জীবনের আসায়। এই বাস টার্মিনালএ এসে পোঁছেছিলাম রাত একটায়। এক বান্ধবীর টেলিফোন নাম্বার ছিল সাথে। ফোন করলাম। উত্তর নেই। না জানা শহর। ভয় যে হয়নি তা নয়। এই বেঞ্চ টাতেই শুয়ে ছিলাম সেই রাতে। ভোরের আলো উঠতেই ফোন করলাম। হ্যালো বলতেই নাম বললাম। চিনলো। ঠিকানা দিলো। পোঁছিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা রুম। আগোছাল। বলল এখানে থাকো, কোন একটা কিছু হয়ে যাবে। রাতে সে বেড়িয়ে যায়। কি করে জিজ্ঞাসা করিনি। একদিন বলল,” চলো, পরিচয় করিয়ে দেই একজনের সাথে, ভালো ছেলে।”

পরিচয় হোল। নাম রিকি। চোওকশ, অতি ভদ্র। বললাম,” চাকরি চাই।” বলল, “ হবে, ধরজো ধর”।

ভালো লাগলো রিকি কে। পোশাক আসাকে মনে হয় ভালো কাজ করে। একদিন প্রস্তাব দিলো তার সাথে রুমমেট হয়ে থাকার জন্য। অখুশি হলাম না। ওর মাঝে আছে একটা আকর্ষণ যা আমাকে বার বার টেনে নিয়ে গেছে ওর কাছে। রাজী হলাম। চলে এলাম ওর এপার্টমেন্টএ। সুন্দর গোছানো সব কিছু। ভাবলাম বিধাতা এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছে। কিন্তু আলোর পিছনে যে অন্ধকার থাকে তা ভুলে গিয়ে ছিলাম।

এক রাতে আমি একা। দরজায় ঠোকা পড়ল। ভাবলাম রিকি এসেছে। খুলতেই দেখি দুজন লোক। কোন কিছু বলার আগেই ডুকে পড়ল। একজন দরজা টা বন্ধ করে দিলো। এর পরের ঘটনা তোমাকে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। সব শেষে যাওয়ার আগে ওরা বলে গেলো, রিকি কে টাকা দিয়েছি, ওখান থেকে তোমার পাওনা নিয়ে নিও”। সেই শুরু। ভদ্র মুখোসের নিচে যে হায়েনার হিংস্রতা থাকে বুঝিনি আগে। রিকিই আমার পিম্প। এর থেকে মুক্তি কবে পাবো জানি না। তোমকে সব কথা বলে বুক টা একটু হাল্কা হোল।

এই পর্যন্ত বলে সে থেমে ছিল। বললাম,” বড়ো বড়ো উপদেশ দিয়ে সময় নষ্ট করবো না। তবে এই বলি রাতের ব্যাবসার সাথে সাথে দিনে কলেজে যেয়ে কোন কোর্স করতে পারো কি না দেখো। হয়তো কাজে লাগবে কোনদিন।

আমার বাস এসে গেছে। বললাম, “ চলি”। তার চোখে কোন জলের আভা আমি দেখিনি। সে চলে গেলো তার গন্তব্য স্থানের দিকে। আমি উঠে পড়লাম বাসে।

সময় পেড়িয়ে গেলো। আমি বাস্ত হয়ে রইলাম আমার কাজ নিয়ে। কখন যে চার বছর পেড়িয়ে গেছে মনে নেই। কোন এক কাঁক ডাকা সকালে ফোন পেলাম আমার এক বন্ধুর। থাকে পার্ক স্লোপে। বলল,” চলে এসো দুপুরে, আড্ডা দেওয়া যাবে, আরও কজন কে বলেছি”। না করলাম না। যথা সময়ে এসে পোঁছালাম। গাড়ী টা পার্ক করে বের হতেই হ্যালো শুনে সামনে তাকালাম। একটা couple এগিয়ে আসছে। আশে পাশে কাউকে দেখলাম না। কাজেই হ্যালো টা আমাকে উদ্দেশ্য করেই। সামনে এসে দাঁড়ালো। কালো চুল কাঁধ পর্যন্ত এলিয়ে পরেছে। ঠোটে হাল্কা করে আঁকা রং এর প্রলাপ মুখের রং এর সাথে মিলিয়ে। গায়ে J-Crewর জামা। কিছু বলার আগেই উচ্ছোসিত হয়ে জড়িয়ে ধরে দুগালে চুমু দিয়ে বলল,” অনেক খুঁজেছি তোমাকে। কত বার যে অয়ী বেঞ্চটাতে বসে কাটিয়েছে আর ভেবেছি হয়তবা একদিন তুমি এই পথ দিয়ে যাবে, সেই আশায়। তোমের দেওয়া টেলিফোনে ফোন করেছি, রং নাম্বার, হয়তো লিখতে ভুল করেছিলাম”। এত গুলো কোথা বলে সে থামল। রং নাম্বার ছিলোনা, আমিই রং নাম্বার দিয়েছিলাম পাঁছে কোন কিছুতে জড়িয়ে পড়ি। সাহসিকতার পরিচয় সেদিন আমি দিতে পারিনি।

বললও “ তোমার দেওয়া উপদেশ আমি পালন করেছিলাম। কমুনিটি কলেজ থেকে কোর্স করে আজ আমি ইলিমেনটারি স্কুলের শিক্ষক। পিছনে ফেলে এসেছি আমার অতীত। Sorry, পরিচয় করিয়ে দেই, আমার ফীয়ান্সে। অ্যালেক্স। আসছে মাসে আমাদের বিয়ে। আসবে তো? তোমার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার টা দাও”।

এবার ঠিক মতই সব দিলাম। বললাম আসবো। আবারও দুগালে চুমু দিয়ে বললও,” আসি, তুমি আমার দেবতা।” দুজনে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেলো লোকের ভিড়ে। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। চোখের কোণটা মুছে আমিও এগিয়ে গেলাম আমার গন্তব্য স্থানের দিকে।

Continue Reading