পিঠের উপর আলতো হাতের ছোঁয়ায় ঘাড় ফিরে তাকালাম।
সমীতা।
ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কি? চিনতে অসুবিধা হচ্ছে? বলে হাসল সে।
সেই হাসি। আজও মুছে যায়নি আমার মন থেকে।
তোমাকে চিনতে পারবো না, তাই কি হয়? কি মনে করে এই অবেলায়, এই ছোট্ট কনফেক্সনারীতে।
বান্ধবীর বাসাতে যাব, ভাবলাম কিছু একটা হাতে করে নিয়ে যেতে হয়, সেই সুবাদে নেমেছিলাম। নেমে এসে তোমাকে দেখবো তাতো ভাবিনি।
বিধাতার খেলা বোঝা দায়।
কবে থেকে তুমি আমার ভাষায় কথা বলতে শুরু করলে? আমি কথার আগে পিছে ইনশাল্লাহ, মাশাল্লা লাগাতাম বলে তুমি বলতে ওটা আমার ভাষা।
এখন আমি দুই ভাষাতেই কথা বলি। তোমার কোন তাড়া আছে কি?
না অতটা নয়, কেন?
তাহলে চলো কোথাও বসি। অনেকদিন পরে দেখা। স্মৃতির পাতা গুলো উল্টিয়ে দেখতে আপত্তি কি?
চলো।
এসে বসলাম হাউজ অফ কাফে তে। বাহিরের বাতাস টা আরামদায়ক। তাই ছাতার নিচে দুটো চেয়ার টেনে নিলাম।
ওয়েটার এসে দুটো মেন্যু দিয়ে গেলো।
সমীতা মেন্যু নিয়ে নাড়া চাড়া করছিল। আমার চোখ পড়ল ওর আঙ্গুলের আংটি টার দিকে।
ওয়াটার এসে পাশে দাড়াতেই বললাম, কি খাবে?
শুধু কফি।
কফির সাথে আরও কিছু আনতে বলে তাকালাম ওর চোখের দিকে।
কি? কি দেখছ?
তোমাকে। একটুও পাল্টাও নি তুমি। মনে পরে কবে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল।
পরে বইকি।
শম্পা কোথায় ?
যে শম্পাকে তুমি দেখেছিলে সে শম্পা আর নেই। বিয়ে হয়ে গেছে।
দোষ আমারই। যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তুমিও চলে গেলে অন্য ষ্টেটে। আমিও ছন্নছাড়ার মতো বেড়িয়ে পড়লাম। বেশ কিছু বছর ঘুরে গেলো। কে কোথায় তার খোঁজ আর রাখতে পারিনি।
মনে পরে, দেখা হলেই শম্পা বলতো, খালেদ দা এবার অন্য কোন দেশে বেড়াতে গেলে আমাকে নিয়ে যাবেন তো?
ওর কথা আমি রেখেছিলাম।
জানি। ও ছিল বলেই আমারও যাওয়া হয়েছিল। কি খুশিই না সে হয়েছিল। তোমার সাথে তোমার হাত ধরেই তো সে ঘুরে বেড়াতো মারাকাসের পথে পথে।
যেদিন প্লেনের টিকিট কেটে ওকে বলেছিলাম , শম্পা সব গুছিয়ে নাও, আমরা মারাকাস যাব।
ওর বিশ্বাস হয়নি, বলেছিল, যেদিন মারাকাসে পৌছাব, সেদিন আমার স্বপ্ন পুরন হবে। সেদিন তোমাকে বলব তুমি তোমার কথা রেখেছ।
ও যে কখন আপনি থেকে তুমিতে এসেছে বুঝতে পারিনি। ওর মুখে তুমি ডাক টা খুব ভাল লেগেছিল, ও যেন আপন করে নিলো আমাকে।
আচ্ছা তোমার মনে আছে সেই ভ্রমনের দিনগুলো। সবকিছু ঠিক হয়েও হচ্ছীলনা।
কেন থাকবে না।
আমি কাজে ব্যস্ত, হঠাৎ তোমার ফোন, বললে, মরক্কো যাবে? এই রকম হঠাৎ হঠাৎ আজগুবি চিন্তা তোমার মাথায় আসে। তাই গুরুত্ব না দিয়ে বলে ফেলেছিলাম মন্দ কি? সেই “মন্দ কি” টা তুমি ধরে নিলে আমি রাজি।
কদিন পরে ফোন করে বললে, একমাস পরে আমরা রওনা দেবো মারাকাসের পথে।
তুমি হায় হায় করে উঠেছিলে। বলেছিলে, পাগল নাকি? আমার যাওয়া হবে না।
কিন্তু হয়েছিল। শম্পা এসে যোগ দিয়েছিল আমাদের সাথে।
ওয়েটার এসে পাশে দাঁড়াল, জিজ্ঞাসা করলো আরও কিছু লাগবে কি না।
বললাম আর এক কাপ কফি হলে মন্দ হয় না। সে অর্ডার নিয়ে চলে গেল। সমীতা ছোট্ট আয়না বের করে ঠোটের উপর আঁকা রঙ টা একবার দেখে নিলো।
আমি তাকিয়ে ছিলাম নিখুঁত ভাবে থ্রেড করা ওর ভুরু দুটোর দিকে। ও মুখ তুলে চাইল। বলল, আচ্ছা খালেদ, আর একবার আমরা বেড়িয়ে পড়তে পারিনা? মরুভূমি নয়। ট্রেনে ট্রেনে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরবো।
হাসতে হাসতে বললাম, তা মন্দ বলোনি। তোমার ওই টাঁক মাথা লোকটা আমাকে শট গান দিয়ে গুলি করবে।
না তা সে করবে না, সে জানে তোমার আমার বন্ধুত্বের কথা।
জানো সমীতা, এয়ারপোর্টে যে ভাই ভাবীর সাথে পরিচয় হয়েছিল উনারা এখন আমার খুব কাছের মানুষ। কত সহজেই না মানুষ আপন হয়ে যায়। তাই না?
রতনে রতন চেনে।
বাহ, কবে থেকে এই ভাষায় কথা বলতে শিখলে, টাঁক মাথার গুন আছে দেখছি?
না, শিখে ছিলাম তোমার কাছ থেকে। জানো, মনে হয় এই তো সেদিন তুমি, আমি আর শম্পা। তোমার গাড়ী রেখে গেলে আমার ড্রাইভওয়ে তে। এয়ারপোর্টে পৌছে দিয়ে গেলো তোমার মেয়ে। রাত নয়টায় আমাদের ফ্লাইট। Royal Air Marco. ঐ দেশের এয়ার লাইন। আমরা লাউঞ্ছে বসে আলাপ করছিলাম মরুভূমির কথা, রাত কাটাবো খোলা আকাশের নিচে।
আপনারা মারাকাসে যাচ্ছেন বুঝি? প্রশ্ন শূনে তুমি তাকালে পিছনে। পরিচয় হোল। নার্গিস আর সজন। ওরাও একি পথের যাত্রী। শুধু তাই নয়, একই হোটেলে আমাদের অবস্থান। Riad Andala.
সজন ভাই বলল, আমাদের কে বোর্ডিং করার জন্য লাইন দিতে বলছে, চলেন লাইনে দাঁড়াই। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। শম্পা ঘুরে ঘুরে দোকান গুলো দেখে বেড়াচ্ছিল। তুমি বললে, ও পনের বছর বাহিরে কোথাও যায়নি, ওর দেখে স্বাদ মিটছে না।
তোমার এতো সবও মনে আছে।
কেন থাকবে না। এইসব স্মৃতি তো ভুলবার নয়।
মনে আছে তুমি ইচ্ছে করে জানালার পাশে সীট নিয়েছিলে। জানতে আমি জানালার পাশে বসতে পছন্দ করি। শম্পা বসতে চেয়েছিল, তুমি বলেছিলে, থাক শম্পা, রাতে কিছুই দেখতে পাবেনা, জানালা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, মাথাটাও রাখতে পারবে না। শম্পা কি বুজেছিল জানিনা, তবে সে আর বসতে চাইনি।
ঠিক আমাদের পিছনেই নার্গিস ভাবি আর সজন ভাইএর সীট। ভাবী তার মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেছিল, আল্লার রহমত, আপনাদের কে পেলাম এই যাত্রায়। কি ভালই না লাগছে আমার।
এয়ার হস্টেস হেডফোন আর ছোট একটা পার্স দিয়ে গেলো। ওর ভিতরে আছে রাত ও সকালের সরঞ্জাম।
তুমি জানালাতে বালিশ দিয়ে মাথাটা এলিয়ে দিলে। শম্পা হেডফোন কানে লাগিয়ে টিভির চ্যানেল গুলো পাল্টাতে লাগল।
আমি এয়ার হস্টেস কে ডেকে বললাম, এক গ্লাস পানি দিতে পারবে কি?
ক্রমশঃ