আচ্ছা সমীতা তুমি তো কফি খেতে না, চা ছিল তোমার প্রিয়। কবে থেকে এই পরিবর্তন? ঐ টেকো মাথাটা —
না তুমি যা ভাবছ তা নয়। তবে চা খাওয়া ছেড়ে দেইনি, কফি হলে মন্দ হয়না। তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি। সেই মারাকাসের পথে তুমি খুজে খুজে চার কাপ কফি আর একটা চা র অর্ডার দিতে। আর দোকানদার কে বলতে দুই পাতা দেবে।
হায়রে!
এখন বল, প্লেনে উঠার পর কি হোল। স্মৃতির পাতাটা একটু ঝালিয়ে নেই। আমার নিজের কথা খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।
তুমি জানালার পাশে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে। মাঝে মাঝে একটু অস্বাভাবিক শব্দ কানে আসছিল। পাত্তা দেই নি।
শম্পা আমাকে খোঁচা দিয়ে বলল, শুনতে পাচ্ছ?
হেসে বললাম,সহ্য করতে শেখ।
শম্পার ডাকে আমি জেগে উঠেছিলাম। ক্যাবিন ক্রু রাতের খাবার দিয়ে গেছে। পিছন ফিরে ভাবী আর ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, খাবার খাওয়া যাবে তো? উত্তরে ভাবী তার স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বলল, খাওয়া যাবে।
তুমি অবশ্য চেটে পুটে সব শেষ করেছিলে। শম্পাও কম যায়নি। খাওয়া শেষে রেস্টরুমে যাবে বলে সেই যে গেলে, ফিরে আসার সময় পেড়িয়ে গেলো , তুমি এলেনা, আমি আর শম্পা দুজনেই উদগ্রীব। শম্পা আমাকে বলল, একটু দেখে আসবে ওর কি হোল।
আমি সামনে এসে দেখলাম তুমি একটা খালি জাগা পেয়ে শুয়ে পড়েছ। তোমাকে ডিস্টার্ব না করে আমি ফিরে এলাম, শম্পা কে বললাম তুমিও শুয়ে পরো। পা টা উঠিয়ে দেও আমার কোলে। পিছনে ভাবী তার ছোট্ট শরীর টা গুটিয়ে নিয়েছে দুটো সীটের মাঝখানে। সজন ভাইয়ের চোখ বন্ধ।
ভোর নয়টায় আমরা আসে নামলাম কাসাব্ল্যাংকাতে। বাহিরে তাপমাত্রা ৭৫ ডিক্রি ফারেনহাইট। তুমি তোমার গায়ের সোয়েটার টা ছোট সুটকেসে ঢুকিয়ে নিলে। শম্পা তার কাপড়ের ব্যাগ টা কাধে নিলো। আমার কাধে একটা ব্যাগপ্যাক। ভাবীর হাতে ব্যাথা। বললাম আপনার সুটকেস টানতে হবে না আমার হাত খালি।
কাসাব্ল্যাংকা থেকে আমরা যাব মারাকাশে। একঘণ্টার পথ বিমানে। বিমান বন্দরের গরিবিয়ানা হাবটা চোখে পড়ল। তুমি বলেছিলে বিমান বন্দরটা দেখতে আমাদের ঢাকার বিমান বন্দরের মত।
সত্যি বলিনি ?
সত্যি বলেছিলে। আমরা ভিতর দিয়ে হেটে এসে আভ্যন্তরীণ বিমান বন্দরের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে পৌছালাম। গোটা বিশ জন লোক বসা। ছোট্ট একটা দোকান এক কর্নারে। মনে হচ্ছে যেঁ কোন সময় সেটা মুখ থুবড়ে পরে যাবে। মলিন পরিবেশ। শুধু দোকান টাই নয় পুরো লাউঞ্ছ টাই। প্লেনে পানি খাওয়া হয়নি বলে এক বোতল পানি কিনতে গেলাম। দোকানের কর্মচারী ইংরাজি জানেনা। হাত দিয়ে ছোট পানির বোতল দেখালাম। পকেটে মরক্কোর দেহ্রাম নেই। ডলার দেখাতেই দুই ডলার চাইলো। অগত্যা, কিছু করার নেই। বাহিরে এসে তোঁ তুমি দেখেছিলে বড় বোতল দশ দেহ্রামে পাওয়া যায়।
কনভার্সন যেন কত ছিল।
এক ডলারে সাড়ে নয় দেহ্রাম । ও বেটা আমার কাছ থেকে খসিয়ে নিয়েছে।
কিছু করার নেই। তোমার চেহারায় আমেরিকান ছাপ ছিল। ওর দোষ নেই।
ইয়ার্কি পেয়েছ?
ইয়ার্কি করবো কেনও। তারপর। বলও
শম্পা কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ভাই আর ভাবীর চেহারায় ক্লান্তির ছায়া। বিমান ছাড়বে এগারোটায়।
এবারো কিন্তু আমি জানালার ধারেই বসে ছিলাম। একঘণ্টার পথ। দেখতে না দেখতে আমরা আসে পৌছালাম মারাকাস ইন্টারন্যাশনাল বিমান বন্দরে। তুমি বলেছিলে, দেখো, কি সুন্দর দেখতে, মনে হচ্ছে নতুন তৈরি করেছে। দেয়ালের চারিদিকে বড় বড় নাম করা কোম্পানির বিজ্ঞাপন। আলোয় আলোকিত। ভাবী একটু পিছিয়ে পড়তেই তুমি উনার হাতের ব্যাগ টা তোমার হাতে নিয়ে নিলে। আমরা এসে দাঁড়ালাম পাসপোর্ট কন্ট্রোলের লাইনে।
বাহ ! খুব সুন্দর ভাবে কাহিনী টাকে এগিয়ে নিচ্ছ। বলে যাও। তার আগে ওয়েটার কে বলি দুটো রেড ভেলভেট কেক আর দুই কাপ কফি দিতে।
কয় কাপ হোল মনে আছে?
আজ আর মনে করতে চাইনা। এই ক্ষণ আবার আসবে কিনা জানিনা। রবি ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে তার সেই গানটা আমার মতো করে বলি, আজ তোমারে দেখতে পেলেম অনেক দিনের পরে। ভয় করোনা সুখে থাকো অনেকক্ষণ থাকবো আরও—–, হাসছ কেন?
একেবারে পাল্টাও নি তুমি।
পাল্টিয়েছি, তুমি দেখতে পাওনি। এবার বলও, তারপর?
না, এবার তোমার পালা।
তোমরা সবাই একে একে পাড় হয়ে গেলে পাসপোর্টের উপর ছাপছুপ নিয়ে। আমি এসে দাঁড়ালাম কাউন্টারে। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল বোর্ডিং পাসের ছেড়া টুকরা টা দেখাও। আমি কাসাব্ল্যাংকা থেকে মারাকাসের ছেড়া টুকরা টা দিলাম।
সে বলল, এটা নয় নিউইয়র্ক থেকে কাসাব্ল্যাংকা টা চাই। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তন্য তন্য করে সব পকেট খুজলাম। কোথাও নেই। বললাম, পাচ্ছি না।
সে বলল, ওটা লাগবে।
বিদেশ বিভুয়ে একি ঝামেলা। ভাবলাম, ওটা হয়তো আমি সীটের সামনের পকেটে রেখে এসেছি। তাহলে। করুন দৃষ্টিতেঁ তাকালাম ওর দিকে। ওতে ওর মন গল্লো না।
হঠাৎ ই কি মনে করে মানিব্যাগ টা বের করলাম। দেখলাম মানিব্যাগের কোনায় 35C লেখা কাগজটা জ্বলজ্বল করছে।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
তোমাদের কাছে আসতেই তুমি বললে,কি হয়েছিল?
বললাম ঘটনা টা।
আর আমি বলেছিলাম, বোর্ডিং পাস সব সময় কাছে রাখতে হয়। ফেলতে নেই।
হা, মনে আছে তোমার লেকচার। তারপর আমরা লাগেজ গুলো নিয়ে বেড়িয়ে এলাম বাহিরে। RIAD ANDALLAর গাড়ীর ড্রাইভার আমার নাম লিখে বাহিরে দাড়িয়ে থাকার কথা।
তুমি তাকে না দেখে অস্থির হয়ে উঠলে। এটা তোমার মজ্জাগত। ধৈর্য তোমার সব সময় কম। আমি বলেছিলাম, এখানে কোথাও আছে। অনেক লোকের ভিড়। আমাদের চোখে পড়ছে না।
হাঁ, পরে দেখলাম, আমার নাম নয়, ওদের হোটেলের নাম লেখা একজন দাড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই সে এগিয়ে এলো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজিতে বলল ওকে অনুসরণ করতে।
মাইক্রোবাস, এয়ারকন্ডিশন নেই। বাহিরে গরম। ড্রাইভার ইংরাজি জানেনা। তাতে আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। আমরা দেখছি বাহিরের খোলা মাঠ। মাঝে মাঝে খেজুর গাছের সারি। সূর্যের আলো এসে পড়েছে কাচা পাকা খেজুরের থোকার মাঝে। সোনালী আলোয় ঝলমল করছে।
আধা ঘণ্টার পথ। হাইওয়ে ছাড়িয়ে আমরা এসে পড়লাম শহরের মাঝে। আমাদের হোটেল ( হোটেল নয় বলে Riad) মদিনাতে। তোমাকে আমি প্লেনে বলেছিলাম আমরা থাকবো মদিনাতে। তুমি অবিশ্বাসের মতো আমার দিকে চেয়ে বলেছিলে, তুমি মরক্কো যাচ্ছ না সৌদী আরবে। আমি বলেছিলাম, এই মদিনা সেই মদিনা নয়। এ হচ্ছে পুরানো দেয়ালে ঘেরা এক শহর যেখানে আছে সব রকমের আকর্ষণীয় বস্তু। এখানে দেখবে সাপের খেলা, দেখবে বড় বড় মসজিদ। আমরা থাকবো ঠিক এইসবের মাঝে। আমাদের RIAD আকর্ষণীয় বাজার Djemaa el Fna র কাছে।
তুমি আমাকে Riad কি ব্যাখ্যা করনি। বলেছিলে পরে করবে। আমাদের গাড়ী বড় রাস্তা পেরিয়ে গলির ভিতর এলো। এরকম গলি আমি পুরানো ঢাকাতে দেখেছি। সজন ভাই বলল, কোন হোটেল তো দেখছি না। আমাদেরকে ঠিক জাগায় নিয়ে এসেছে তো।
গলিতে সব দোতালা তিনতালা বাড়ী। এখানে হোটেল কোথায়? আমরা দেখে এসেছি হোটেল সেরাটন, দেখেছি হলিডে ইন। এতো ঠাঠারি বাজার। আমি তোমার দিকে তাকালাম। মনে হোল তুমি ও যেন কি খুজছো। ড্রাইভার এক গলির পাশে নামিয়ে দিলো। Riad Andalla বলে কোন নামের চিহ্ন কোথাও দেখলাম না। তুমি ড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করলে ,”এ কোথায় নামালে”। ভুলে গিয়েছিলে সে ইংরাজি জানেনা। সেই মুহূর্তে এক মহিলাকে হন্তদন্ত করে এগিয়ে আসতে দেখলাম । আমাদের নামানো একটা সুটকেস হাতে নিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে তাকে অনুসরণ করতে বলল।
এবড়ো থেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে ছোট্ট চিপা গলিতে এসে পড়লাম। একটু এগিয়ে ডানে মোড় নিয়ে আর একটা গলিতে ঢুকলাম। আমার চিন্তা লুই ভাটনের ক্যারীঅন টা নিয়ে। ওর চাকা গুলো ঘজ ঘজ শব্দ করছে মনে হোল।
তোমার চেহারায় তা ফুটে উঠেছিল। আমাদের কে আর একটা বাকও নিতে হয়েছিল। আমরা এসে দাঁড়ালাম Riad Andalla র সামনে।
লোহার দরজা খুলে গেলো। হ্যালো বলে অভ্যর্থনা জানাল ইব্রাহিম। তখনি তোমাকে আমি বলেছিলাম, এই দেখো Riad। এটা হোটেল নয়, মরক্কোর ট্র্যাডিশনাল বাসা। এই বাসা তিন থেকে চার তালার বেশি হয় না। আমাদের টা তিনতলা।
সাধারণত এর মাঝ খানে পানির ফোয়ারা আর ফুলের ঝার থাকে। আমাদের Riad টা অতো বড় না হওয়াতে ওরা উঠান টাকে বসার জাগা করেছে। Riad দে জানালা বাহিরের দিকে থাকে না। তুমি দেখছ সব ঘরের জানালা ভিতরের দিকে। উঠানের দিকে মুখ করে। আমার খুব ভাল লেগেছিল। শুধু আমার নয়, নার্গিস ভাবী আর সজন ভাই এসে বলল, একটা নতুনত্বের স্বাদ পাচ্ছি।
তোমার কথা শেষ হতেই ইব্রাহিম এসে বললও আমাদের সবার রুম দোতালায়।
তুমি চাবি চেয়েছিলে। সে হেসে বলেছিল এটা বাসা, এখানে চাবি লাগে না। সব কিছু খোলা রেখে চলে যেতে পারো, কেউ হাত দেবে না।
পা বাড়ালেই সেই বিখ্যাত OPEN SQUARE, Djemaa el Fna, তুমি বলেছিলে এই স্কোয়ারে ঘিরে আছে বাজার, আছে মসজিদ, আছে কাফে। আমাদের সবার মন চাইছে কখন দেখবো সেই জাগা। তুমি বললে, এখন দুইটা বাজে আমরা তিনটায় বের হবো, ফিরে আসতে হবে তাড়াতাড়ি। কারন গাইড আসবে কাল ভোরে। আমরা রওয়ানা হবো সাহারার পথে।