লজ্জাবতী লতা

         ফোনের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ভাইবারের আওয়াজ। রিংএর শব্দটা শুনলেই বোঝা যায়। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভোর ছয়টা। এতো ভোরে একমাত্র দেশের থেকেই কল করা সম্ভব। ফোনটা তখনো বাজছে। নাছোড় বান্ধা। সাধারণত আমার পাশের বালিশের উপরেই ওটা থাকে। হাত দিলাম। পেলাম না। অগত্যা মাথা টা উঠিয়ে দেখতে চাইলাম। ওটা দু বালিশের মাঝে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ততক্ষণে শব্দ টা বন্ধ হয়ে গেছে।

 থাক ওখানে পড়ে। উঠাতে ইচ্ছা করলো না। যে ব্যাক্তিই হয়ে থাক বুঝতে পেরেছে, এখানে এখনো ভোরের আলো এসে পৌছায় নি।

বন্ধের দিন।

কাজেই পাশ ফিরে গায়ের কম্বল টা চেপে ধরলাম। ঠিক সেই সময়ে ঝমঝম করে আবার বেজে উঠল ফোনটা। দাঁত খিচিয়ে ফোন টা উঠালাম। ভেবে ছিলাম প্রথমে একটা কষে ধমক দেবো। তা এর হোল না।

হ্যালো বলার আগেই, খুব কাকুতি মিনতি করে বললও, সরি দুলাভাই, আমি ডলি, আপনার ঘুম ভাঙ্গালাম। অনেক বার কল করেছি আপনাকে, বিভিন্ন সময়ে, পাইনি। তাই এই অসময়ে আমাকে ফোন করতে হোল। ক্ষমা করে দিয়েন দুলাভাই।

মনে পড়লো, অনেক গুলো কল এসেছিল ঠিকই, নাম্বার টা চেনা নয়, তাই খুব একটা গুরুত্ত দেই নি। কাজেই দোষটা কিছুটা আমার। এই ভেবে অতি ভদ্র গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, সব খবর ভাল তো?

সুসংবাদ আছে দুলাভাই।

কি?

আমার ছোট  মেয়ে মৌর বিয়ে?

কোথায়? দেশে?

না, আপনাদের ওখানে। নিউইয়র্কে না, অরলান্ডো তে। আপনাকে আসতেই হবে দুলাভাই।

ডলির এই আন্তরিকতা শুধু আজ নয়। যেদিন থেকে ওকে আমি দেখেছি, ওর সাথে পরিচিত হয়েছি, সেদিন থেকে। ও আমার কেউ নয়। ও আমার শ্যালিকার ছোট বেলার বান্ধবী। এক পাড়ার মেয়ে। আমার বৌ কে আপা বলে ডাকতো। সেই সুবাদে আমি দুলাভাই। দেশে গেলে ওর বাসায় একবেলা হলেও আমাদেরকে যেতে হতো।

বলত, আপনার কথা আপার কাছে ফোনে শুনতে শুনতে আমি আপনার অতি ভক্ত হয়ে গেছি।

 সেই হৃদয়ের টান টা আজও রয়ে গেছে।

বললাম, তারিখ টা বলও, আমি চেষ্টা করব।

বলল, ৭ ই ডিসেম্বর গায়ে হলুদ, ৮ ই ডিসেম্বর বিয়ে। আপনাকে দুটোতেই আসতে হবে।

সবুর করো, ছুটি ছাটার ব্যবস্থা করতে হবে। তোমাকে আমি জানাবো। এই বলে কথার ইতি টেনে, কম্বল টা মাথার উপরে টেনে দিলাম।

বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে আটটা বেজে গেলো। রবিবারের সকাল। জানালার Blinds গুলো টেনে উপরে উঠিয়ে দিতেই এক ঝলক নরম সূর্যের আলো এসে ড্রয়াইং রুম টা ভিজিয়ে দিলো। আমি Keurig এ বানানো কফির পেয়ালাটা এনে জানালার পাশে বসলাম। বাহিরে ফুলের গাছগুলো তাদের সজীবতা হারিয়ে ফেলেছে শীতের তীব্রতায়। । দুমাস আগের উজ্জ্বল নানা রঙে রঞ্জিত আবরণ কোথায় যেন লুকিয়ে রেখে আজ ভিখারির সাজে সজ্জিত। আমি তাকিয়ে ছিলাম দুর পানে।

ফোনটা বেজে উঠল। ঝর্না, আমার শ্যালিকার ফোন। এতো ভোরে সাধারণত সে কল করেনা।  আশ্চর্য না হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি, ডলির কল পেয়েছ নিশ্চয়?

কি করে বুঝলেন?

এতো ভোরে তুমি তো কল করার বান্দা নও।

কিছু চিন্তা করেছেন? জিজ্ঞাসা করে একটু থেমে বলল, আপনি যদি বিয়েতে আসেন তবেঁই আমার যাওয়া হবে।

তাহলে তো অবশ্যই চেষ্টা করতে হয়। বললাম, আগামী সপ্তাহে তোমাকে জানাবো।

নানা কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়াতে ভুলে গিয়েছিলাম ডলির প্রস্তাব টা। হঠাৎ ফেসবুকে জয়ার ছবি দেখে মনে পড়ে গেলো ডলির কথা।

 জয়া মৌ র বড় বোন।

ওই আমার বেশি পরিচিত। মাঝে মধ্যে টেক্সটে, ফোনে কথা যে হতো না তা নয়। বড্ড মিষ্টি মেয়ে। আমার ভীষণ ভাল লাগত। ওরা তিন বোন। জয়া, জেসী, আর মৌ। শেষ যখন মৌকে দেখেছিলাম সে ছিল ছোট্ট, স্কুলে পড়া একটি মেয়ে। আজ সে বিয়ের পাটিতে বসতে চলেছে।

মনে হোল মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। বুঝতে পারিনি।

 চড়াই উতরাই পাড় হয়ে আজ আমি যেখানে এসে পৌঁছেছি তাতে করে মনে হোল হাতে সময় হয়তো বেশি নাও থাকতে পারে। তাই সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আমি যাবো। অনেক দিন দেখিনি ওদেরকে।

ঝর্নাকে কল দিলাম। বললাম আমি আসছি।  সে থাকে মায়ামীতে।

ওখান থেকে গাড়ী নিয়ে অরলান্ডো যাবো।

টিকিট কাঁটা শেষ।

জয়া কে জানালাম, আমরা আসছি। সে থাকে লসএনযেলিসে । বললাম, বিয়ের ভেনুর কাছাকাছি কিছু হোটেলের নাম পাঠাও।

উত্তরে তার উচ্ছলতা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করলো।

“আমি যে কি excited খালু তুমি আর ঝর্না খালা আসবে শুনে। আমি এখনি মৌ কে বলে দিচ্ছি, সে তোমাকে সব জানাবে”।

মিনিটের মধ্যে টেক্সট এসে গেলো। আমি হোটেল বুক করে ফেললাম।

জানি, এখনি ডলি কল করবে, ঠিক তাই। ফোনটা বেজে উঠল। ওর মেয়েরা জানিয়ে দিয়েছে, আমরা আসছি বিয়েতে।

ডলির সেই একই কথা, আমি কি যে খুশি হয়েছি দুলাভাই, আপনাকে বুঝাতে পারবো না।

দিন এলো। আমি রওয়ানা হয়ে গেলাম। মায়ামীতে এক রাত কাটিয়ে, আমি আর ঝর্না বেড়িয়ে পড়লাম গাড়ী নিয়ে। সকাল দশটা। যেতে সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগবে। পথের জন্য বেঁধে নিয়েছি বিস্কুট ,বাদাম আরও সব মুখরোচক ভাজা পোড়া।

গল্প করতে করতে সময় পেড়িয়ে গেলো। সেই পুরানো দিনের ফেলে আসা সব ঘটনা। মাঝে মাঝে ফিরে যাচ্ছি অনেক পিছনে। কে যেন হাতছানি দিয়ে বলছে, এসো, আমার আবার মিলি দুজনে।

গাড়ী চালাতে চালাতে চোখ ঝাপসা হলে চলবে না। তাই ঝর্না কে বললাম, এবার বলও অন্য কথা।

ঠিক তিন টায় এসে পৌছালাম হোটেলে।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় অনুষ্ঠান।

বাহিরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। পনের মিনিটের পথ হোটেল থেকে বিয়ের ভেনু। আমার শ্যালিকা সুন্দর করে সেজেছে। বলল, দুলাভাই টিপ টা আনতে ভুলে গেছি।

বললাম, আহা, ওটা থাকলে সপ্তকলা পূর্ণ হতো। তবে যাই বলও, ওটার অবর্তমানেও তোমাকে যা লাগছে তাতে আমাকে তোমার উপর নজর রাখতে হবে যাতে কেউ যেন নজর না দেয়।

থাক ঠাট্টা করতে হবে না, এবার চলেন।

এসে পৌছালাম Maitland Civic center এ। এই বৃষ্টি মাথায় করে অনেক লোক এসে গেছে। আমরা কাউকে চিনিনা। নতুন বৌ তখনও এসে পৌছায়নি। আশেপাশে তাকাতেই একজন এসে বলল, আপনারা এখানে?

ঝর্নার পরিচিত।

যাক একজন কে পাওয়া গেলো। সে ছেলের মা কে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিলো। নিউইয়র্ক থেকে এসেছি শুনে বলল, খুবই ঘনিষ্ঠ বুঝি?

খুবই।

কথা বলে ভাল লাগলো। আন্তরিকতা পূর্ণ ব্যবহার। আমিই বললাম, আপনি ছেলের মা, অনেক দায়িত্ব । অনেক লোকজন আসছে। আপনি ওদেরকে দেখাশোনা করুন।

বসে আছি। একজন এসে বলল, বৌ এসেছে, বৌ এসেছে।

আমরা উঠে দাঁড়ালাম।

বাপের হাত ধরে যে মেয়েটি সলজ নয়নে এলো, তাকে আমি দেখলাম বহুদিন পড়ে। লাল রঙের শাড়ী পেঁচিয়ে উঠেছে মাথা অবধী। ঘোমটা টানা। গয়না দিয়ে ঢাকা গলা, কপালে স্বর্ণ খচিত অলঙ্কার। নাকে নথ।

এ এক লজ্জাবতী লতা।

মনে হোল এ পানিতে ভাসা পদ্মফুলের কুড়ি। আস্তে আস্তে উদ্ভাসিত হবে।

আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।

ওর মুখের উপর আর একটা মুখ ভাসছে। ওরা সবাই দেখতে একি রকম। এই দিনে ওদের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। ওদের হাসিতে ঝরে মুক্তো। ওদের চাহুনী বলে, আমি এলাম, আমি জয় করলাম তোমাকে, তোমাদের সবাই কে।

দুলাভাই? কি হোল, ছবি উঠাবেন না?

হাঁ, তাইতো, দেখছিলাম মৌ কে।

খুব সুন্দর লাগছে দেখতে তাই না?

অপূর্ব। দেখো জয়া আর জেসী কে। কি সুন্দর সাঁজ। খুউব মানিয়েছে।

ডলি এসে পাশে দাঁড়ালো।

মৌ আর সউমিক পাশাপাশি বসল স্টেজে।

ফ্লাস পড়ছে। ওরা হাসছে। ওদের হোল নতুন জীবন শুরু।

ডলিকে বললাম, সার্থক হোল আমা্র আসাটা।

কিছুটা সময় কেটে গেলো সবার সাথে কথা বলতে বলতে। হঠাৎ ই কাধে আলতো ছোঁয়া।

 ফিরে তাকালাম।

মৌ।

এসো খালু তোমার সাথে একটা ছবি উঠাই।

আমি তাকালাম ওর কাজলে টানা চোখ দুটোর দিকে। ও চোখে মায়া ঝরছে।

ফ্লাস জ্বলে উঠল।

আমাদের ছবি অমর হয়ে রইল ঐ ক্যামেরার মাঝে।

Continue Reading