দুদিন আগেও যে বাড়ী ছিল হৈ হুল্লোড় ভরপুর আজ এই নীস্তবততা কানে বাজে।
আমি এসে পা দিলাম বাহিরের সিঁড়িতে।
সকাল ১০ টা।
ফিরে তাকালাম শূন্য গাড়ী বারান্দা টার দিকে। সুহাই এঁর গায়ে হলুদের দিন এইখানেই লাবু ভাই গরম গরম জিলেপি ভেজে সবাই কে ডেকেছিল।
আসুন গরম গরম জিলেপি খান। সেই সাথে ঝাল মুড়ি আরও মুখরোচক খাদ্য।
আজ শূন্য বারান্দা।
আমি বেল টিপতেই দরজা খুলে দাঁড়াল চয়ন আপা।
সকালের নাস্তার দাওয়াত আমার। শফিক ফোন করে বলেছিল, কি করেন শফি ভাই? ঘুম ভাঙালাম?
না, ঘুম ছুটে গেছে অনেক আগে। শুয়ে শুয়ে আড়া মোড়া কাটছি।
চয়ন আপা আপনাকে আসতে বলেছে, একসাথে নাস্তা করব।
তথাস্তু।
সেই সুবাদেই এই সাতসকালে আমার আগমন।
ঢুকতেই দেখলাম ইলোরা ব্যাস্ত পরোটা ভাজায়। রতু বিয়ান ব্যস্ত ডিমের সরঞ্জাম নিয়ে।
আর সবাই কোথায়? বলে তাকালাম চারিদিকে।
মহারানীরা আস্তে আস্তে নামবে উপর থেকে। বলে হাসল চয়ন আপা।
জীবু চলে গেছে, ওর তাড়া আছে।
নেমে এলো লাজ, এলো মুন্না এলো শুকলা বিয়ান। শেষে নেমে এলো সিলভা।
নাস্তার টেবিলে ছোট ছোট কথা। যার কোন মানে নেই। যাকে বলে টেবিল টক।
সিলভার চেহারাতে উদ্বিগ্নতা লক্ষণীয়। মাঝেমাঝে হারিয়ে যাচ্ছে কথার মাঝ থেকে।
কি ভাবছ?
আচ্ছা শফি ভাই আপনার কি কোন প্রোগ্রাম আছে বৃহস্পতি বারে?
কেনও বলত?
ঐ দিনটা আমার ফিরে যাওয়ার দিন। নামিয়ে দিতে পারবেন JFK AIRPORT এ? ভীষণ ভয় করছে একা একা যেতে।
শাহিন চলে গেছে ওর দুই মেয়েদের কে নিয়ে। কাজের থেকে ছুটি পাই নি।
সিলভা থেকে গিয়েছিল আরও কয়েক দিন। আবার কবে আসবে কে জানে। বোনদের সাথে আরও কিছুদিন কাটান, বিয়ে বাড়ীর শেষে রেশ টুকু সে উপভোগ করতে চায়।
বললাম, আমার কোন আপত্তি নেই। অঢেল সময় আমার।
একটা কিন্তু আছে। বলে তাকালও সে
পরোটার কিছু অংশ আলু ভাজীর সাথে মিশিয়ে মুখে দিতে দিতে বললাম, কিন্তু টা কি?
আপনাকে থাকতে হবে সীকুরীটী চেক না হওয়া পর্যন্ত।
হাসতে হাসতে বললাম, কোন ভয় নেই তোমার, শুধু সীকুরীটী চেক নয়, আমি থাকবো সেই পর্যন্ত যেই পর্যন্ত তুমি গেটের কাছে যেয়ে আমাকে কল না কর। হোল তো? এইবার নাস্তা করতে বস।
একটু স্বস্তি পেলো সে।
একটু হেসে বলল, জানেন শফি ভাই কতবার এসেছি নিউইয়র্কে আজ পর্যন্ত Statue of Liberty দেখা হয়নি।
তাহলে আর দেরী কেনও? কাল সকালেই আমরা বেড়িয়ে পড়ব।
ওর দৃষ্টি আমার চোখে। সেখানে অবিশ্বাসের ছায়া।
বললাম তোমার কোন আপত্তি না থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে ভেবে দেখো। You and I against the world. বুঝেছ তো আমি কি বলতে চাইছি।
না আমার আপত্তি নেই। শাহিন অনেক উদার। ওকে আমি চিনি, ওকে আমি জানি। আমার খুব আনন্দ লাগছে। কখন পিক করবেন।
ঠিক সকাল সাড়ে দশ টায়।
আরও কিছুক্ষণ বসে আমি উঠে পড়লাম। যেতে হবে Asotria তে।
পরদিন সকালে এলাম তপুর বাসার সামনে। সিলভা ওখানে। গাড়ীতে থেকে নামতেই ও বেড়িয়ে এলো। চোখে সানগ্লাস। পড়নে গোলাপি টপসের উপর গোলাপি, সাদা, কালো চেকের জামা। ফেডেড জিন। কাঁধে বড় ব্যাগ।
এই গোলাপ ফুল গাছের কাছে আমার ফটো তোল, বলে পোজ দিয়ে দাঁড়াল।
বললাম, মাথাটা একটু বা দিকে ফিরে, আমার দিকে তাকাও।
ও তাকাল।
আপনি থেকে তুমি তে এসেছে শুনে ভাল লাগল। আমিও ওই ডাকে বিশ্বাসী।
ফটো উঠাতে আমার যেমন আনন্দ, ফটো উঠতে সেই পরিমাণ আনন্দ ওর মাঝে, শুনেছি ওর বোনদের কাছে।
আরও কয়েক টা বিভিন্ন পজে ফটো উঠিয়ে বললাম, এবার চলো। দেরী হয়ে যাবে। অনেক কিছু আমাদের কভার করতে হবে।
এগার টা বেজে গেলো।
শান্তনুর বাসার কাছে গাড়ী পার্ক করে সাবওয়ে নিয়ে আমরা যাবো। অনেক দিন হয়ে গেলো পাতাল রেলে চড়ে কোথাও যাইনি। সাবওয়ের ম্যাপ টা দেখে নিয়েছি, লোড করে নিয়েছি Iphone এ।
N ট্রেন ধরে নামতে হবে ৫৯ স্ট্রীটে, সেখান থেকে ৫ নম্বর ট্রেন নিয়ে সোজা বওলিং গ্রীন। উপরে উঠলেই Statue of Liberty।
খুব আনন্দ লাগছে, বলে তাকাল সিলভা।
গাড়ী যখন পার্ক করলাম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগার পেড়িয়ে গেছে।
বললাম হাটতে পারবে তো ? ট্রেন ষ্টেশনে যেতে পনের মিনিট লেগে যাবে কিন্তু।
পারবো, হেটে আমার অভ্যাস আছে।
প্রথম কিছুটা পথ হিলি, পরে সমতল রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। আমার কাঁধে ব্যাগপাক। নিয়েছি কয়েকটা পানির বোতল। সাথে আছে মুড়ি ভাজা, চানাচুর, কলা। পথের জন্য।
আবহাওয়া টা আজ আমাদের অনুকুলে। না গরম না ঠাণ্ডা। উজ্জ্বল আকাশ। নীল মেঘ খেলা করছে সূর্যের আলোর সাথে।
সকালে নাস্তা করে বের হয়নি, শফি ভাই। বলে কাচু মাচু করে তাকাল আমার দিকে সিলভা।
বাহ, তা আগে বলবে না? বলে তাকালাম চারিদিকে।
ঐ যে ডানকিন ডোনাট। ওখানে নাস্তা করে নেবো।
দেরী হয়ে যাবে নাতো?
আমাদের আজ তাড়া নেই। অফুরন্ত সময় আছে। চিন্তা করোনা। বলে ডানকিন ডোনাটে এসে বসলাম।
নাস্তা শেষে ট্রেন ষ্টেশনে এসে দেখলাম ট্রেন দাড়িয়ে আছে।
উঠে পড়লাম।
একটা ছবি তোল। আমরা দুজনে বসে আছি ট্রেনের ভিতর। ঐ লোকটাকে দেও। বলল সে।
আগে সেলফী টা উঠাই, তারপর দিচ্ছি ওকে। বলে কয়েকটা ছবি ক্যামেরাতে ধরে রাখা হোল।
কোনটা সানগ্লাস পরে, কোনটা সানগ্লাস ছাড়া। বিভিন্ন ভঙ্গিতে।
ট্রেনে বসে টুকি টাকি গল্প। বলল সে, ছাব্বিশ বছর বিয়ে হয়েছে। কোথা দিয়ে সময় চলে গেলো বুজতে পারলাম না।
চলো এসে গেছি। বওলিং গ্রীন। এই ষ্টেশনে নামব আমরা।
উঠে এলাম পাতাল থেকে রাস্তায়।
ঐ দেখো Statue of Liberty ।
তাকিয়ে দেখে বলল, এবার আমার নিউইয়র্কে আসাটা সার্থক হোল।
টিকিট কেটে ফেরীতে উঠলাম।
চলো উপর তালাতে। ওখান থেকে ছবি উঠাব।বলল সে
ভীষণ বাতাস। সিলভার ঘাড় পর্যন্ত এলানো চুল গুলো হওয়ায় উড়ছে। সূর্যের তাপে মুখমণ্ডলে লালচে আভা।
ঐ দিক থেকে উঠাও। বলে সে তাকাল ক্যামেরার দিকে।
অনেক গুলো ছবি বিভিন্ন ভাবে উঠিয়ে বললাম, জানো কত গুলো উঠিয়েছি।
আমার না ছবি উঠাতে অনেক ভাল লাগে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
ফেরী এসে ভিড়ল Liberty Island এ।
সামনে বিরাট মূর্তি টা দাড়িয়ে। অনেক লোকের আগমন আজ। হয়তো প্রতিদিনই এই পরিমাণ লোক আসে।
জিজ্ঞাসা করলাম এর ইতিহাস জানো কি?
না, বলতো?
এই কপার স্ট্যাচু টা a gift from the people of France to the people of the United States.
স্ট্যাচু টা ডীজাইন করে ছিল ফ্রান্স স্কাল্পটর Frédéric Auguste Bartholdi। আর তৈরী করেছিল Gustave Eiffel.
এই robed woman মূর্তি টা রিপ্রেজণ্ট করে Libertas, a Roman liberty goddess।
ঐ যে দেখছ ডান হাতে টর্চ মাথা ছাড়িয়ে গেছে, আর বা হাতে যেটা দেখছ, ওটা কে বলে, tabula ansata ওর মাঝে লেখা আছে July 4, 1776, the date of U.S. Declaration of Independence.
আর পায়ে দেখছ ভাঙ্গা চেন, ওর মানে হচ্ছে ফ্রীডম। Freedom of United States.
অনেক শেখা হোল। এবার ওটাকে পিছনে রেখে আমার একা এবং তোমার সাথে অনেক গুলো ছবি উঠাও।
উঠিয়ে ছিলাম, অনেক অনেক ছবি।
এবার বিশ্রামের দরকার কি বলও। পেটে কিছু দিতে হবে না?
ফিস এন্ড চিপস কিনে এসে বসলাম ছায়ার নিচে টেবিল চেয়ারে।
খেতে খেতে দুই তিনটা সেলফী উঠালে কেমন হয়, বলতো।
মন্দ বলোনি।
দুই তিনটা নয় আরও অনেক উঠিয়ে বললাম, মন ভরেছে?
খাওয়া শেষে ঘড়ি দেখলাম। চারটা বাজে।
বললাম, আরও তো দেখার বাকি। ফ্রীডম টাওয়ার দেখবে না? যেখানে ছিল Twin Tower।
ফিরে এলাম Statue of Liberty দেখে। সিলভার মুখে শুধু এক কথা। কি সুন্দর আজ দিন টা কাটছে। এমন আশা করিনি আগে।
ফ্রীডম টাওয়ার এসে পৌছালাম পাঁচটার পর। ভিতরে যাওয়া হোল না। বাহিরের থেকে ছবি উঠিয়ে এলাম টাইম স্কোয়ারে।
বললাম, টাইম স্কোয়ার দেখতে হয় রাতে। ঝলমল করে চারিদিক। না দেখলে বুজতে পারবে না। তবুও দেখো চারিদিক তাকিয়ে। মন ভোলানো দৃশ্য। তাই না?
সময় কেটে গেলো ছবি উঠিয়ে।
ক্লান্ত আমি। ক্লান্ত সে।
এবার ফেরার পালা।
ফেরার পথে ট্রেনে বসে সিলভা ছবি গুলো দেখছিল।
–এই ছবি গুলো আমাকে পাঠিয়ে দিও। সুন্দর সময় কাটল তোমার সাথে। মনে থাকবে অনন্ত অনন্ত কাল ধরে।
হঠাৎ ই ফোন টা বেজে উঠল।
শান্তনু কল করেছে।
–কোথায় তোমরা?
–এইতো ট্রেনে। কুঈন্স বোরো প্লাজা সামনে।
–আমি তোমাদের আগের ট্রেনে। তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। এক সাথে ডিনার করব। তাসমিয়া কে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওরাও এসে জয়েন করবে। নাম করা SeaFood রেস্টুরেন্টে বসব।
রাজি হয়ে গেলাম। গাড়ী ওর বাসার সামনে।
নেমে দেখলাম ও দাড়িয়ে।
জীবু, তাসমিয়ে, টেগোর এসে জয়েন করল আমাদের সাথে।
এটা একটা উপরি পাওনা।
খাওয়া শেষে হেটে হেটে এলাম শান্তনুর বাসার সামনে। ওদের কে বিদায় দিয়ে গাড়ীতে এসে বসলাম।
শরীর ভেঙ্গে এলো। ক্লান্ত দুজন।
রাত দশটায় সিলভাকে নামিয়ে দিলাম যেখান থেকে ওকে উঠিয়ে ছিলাম।
বললাম মনে থাকবে তোমার সান্নিধ্য।
নামতে যেয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, কবে আসবে আমাদের ওখানে, সানফ্রান্সীস্কতে।
একটু নাটকীয়তা করে বললাম, “সময় যে দিন আসিবে সেদিন যাইবও তোমার কুঞ্জে”।
বলল, বাহ, তুমিতো গানের সুরে কথা বলছ।
বলে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।