হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে গেল একটা দিন। আনন্দ হাসি গানে ভরপুর একটা দিন। কতদিন এমন আনন্দ হয়নি। কতদিন এমন ভাবে হাসিনি। হাসি তো আর আসে না। আনন্দ তো আর আমাকে হাতছানি দেয় না। পুরো বাড়ি জুড়ে আমার বিষাদ। বিষাদ আমার আস্টেপৃস্টে জড়িয়ে রেখেছে। বিষাদই আজ আমার নিত্যসঙ্গী। বিষাদই আজ আমার প্রিয় বন্ধু।
কতদিন কতদিন হোল সে আমাকে ছেড়ে গেছে। দিনগুলি একটি একটি করে আমার প্রাণের উপর দিয়ে চলে গেছে। একটি একটি দিন, হ্রদয়ে আমার বিষাদের পাহাড় তৈরি করে দিয়ে গেছে। আহা বিষাদ । বিষাদ এখন আমার ভাল লাগে।
এরই মধ্যে হঠাৎ একটা দিন। হঠাৎ সেদিন ওরা এসেছিল কলকল করতে করতে। আমার নীস্তব্দ বাড়ীটা হঠাৎ করে জেগে উঠেছিল। জেগে উঠেছিল ওদের কোলাহলে। ওরা এসেছিল একসাথে, এসেছিল আমার ভেতরের নিঃস্বপ্রভো আলোটাকে সপ্রতিভ করতে। হাসির বন্যা বহিয়ে দিয়েছিল। প্রাণ পেয়ে ছিল আমার ঘুমিয়ে পরা বাসাটা। এসে ছিল শেলী, আমিন, সালিমা- ইউসুফ, ফাতেমা- সাইদ ভাই। এসেছিল জীবু বিয়েন, জিজ্ঞাসা করেছিল,” ওরা কবে আসবে শাফি ভাই, আপনের ঘরে উনন জ্বলেনা অনেক দিন। আমিই না হয় জ্বালিয়ে ওদের নাস্তার ব্যবস্থা করবো।”
সেই কাঁক ডাকা ভোঁরে উনি এসেছিলেন , বলতে হয়নি কিছু, নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিলেন সব কিছু। জিজ্ঞাসা করে ছিলাম “ আমি কি কোন সাহায্যে লাগতে পারি.”।
“ না, আজ আপনি আনন্দ করবেন ওদের সাথে, এ দিকটা সামলাবো আমি”।
মেয়ে আমার বলেছিল,” আব্বু, লাঞ্চ এর ব্যবস্থা আমি করবো, তুমি ভেবোনা, ম্যাডিটেরিয়ান খাবার নিয়ে আসবো, তুমি শুধু ওদের সঙ্গ দেবে। এসেছিল সুষমা আর রেজ, সান্তনু আর তাসমিয়া। আমার ঘর ছিল কানায় কানায় ভরা।
দুপুরের আগেই ওদের গাড়ী এসে দাঁড়ালো আমার ড্রাইভওয়ে তে। হৈ হৈ করতে করতে নেমে এলো ওরা। সবাই ভিতরে আসতেই পরিচয় করিয়ে দিলাম জীবু বিয়েন আর সাথে।
কথা বলছে শেলি, ফাতেমা আর সেলিমা । আমিন আর ইউসুফ কথার ফাকে ফাকে বাহিরে যেয়ে ধূমপান করে আসছে।
গল্প কথায় ওদের সাথে মিশে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল ৪৭ বছর আগের কথা। মেয়েদের সাথে তখন ছিল আমাদের একটা দুরের সম্পর্ক।
সম্পর্ক। কিন্তু একবার কলকাতায় এক্সকারসনে গিয়ে হয়ে গেল ওরা হোল আমাদের অনেক কাছের বন্ধু। সেই বন্ধুত্বই অটুট রয়েছে এতদিনও।
বাহিরে আবহাওয়া টা একটু মিনমিনে। রোদের আভাস কম। বাতাস বইছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে ঠাণ্ডার প্রকোপ টা ততোটা না হলেও, গায়ে গরম কাপড় ছাড়া বের হওয়া যায় না।
আমার মেয়ে জামাই, সুষমা, রেজ এলো এলো ভড় দুপুরে লাঞ্চ নিয়ে। অনেক কিছু নিয়ে এসেছে মেয়েটা। সবাই মিলে সাজিয়ে নিলো খাবার টেবিল। মনে হচ্ছে এ বাসা আমার একার নয়। এ বাসা সবার। সেলীমা, শেলি, ফাতেমা ওরা নিজেরাই সব কিছু খুঁজে বের করে নিচ্ছে নিজের প্রয়োজন মত। বিয়ান জানে বাসার কোথায় কোণটা থাকে। দরকার মত সব কিছুর তত্ত্বাবধান উনিই করছেন।
এক সময় সাইদ ভাই বললও, “ চলো, খাওয়ার পর কল্পনার কবর টা যিয়ারত করে আসি। আজ শুক্রবার। ভালো দিন।” সবাই সমর্থন তার কথায়।
খাওয়া শেষে বেড়িয়ে পড়লাম কবরস্তানের উদ্দেশ্যে। লাল গোলাপ কিনে নিলাম। এক গাড়ীতে সবাই। শেলি বলল, “ দেখো, অদ্দ্রীষ্টের কি পরিহাস, কল্পনা নেই, আমরা যাচ্ছি তার কবর যিয়ারত করতে।”
গাড়ী এসে থামল। নেমে এলাম সবাই। লাল গোলাপ ওর খুব পছন্দ ছিল। রেখে দিলাম ওর কবরের পাশে। আমিন দোয়া করলো। সবার চেহারার মধ্যে মলিনতা। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। কনকনে বাতাস বইছে। এবার ফেরার পালা।
ঘরে ঢুকে দেখলাম সুষমা সুন্দর করে টেবিল সাজিয়ে রেখেছে বিকালের নাস্তার জন্য। কফিটা দরকার । না এবার হবে চা র প্রস্তুতি। বললাম, আমি ভালো মসলা চা বানাতে পারি। বিয়ান সমর্থন দিলো।
অনেক দিন পর আবার প্রান খুলে হাসলাম ওদের সাথে। ফাতেমা আনন্দে আত্মহারা, স্লাম্বার পার্টি হবে আজ। কারো মাঝে আজ নৈরাশ নেই। আছে উদ্দাম উচ্ছল আনন্দ। এই ভাবে যদি জীবনটা চলে যেতো। কিন্তু তা তো হবার নয়।
রাতের খাবার বিয়ান আর সুষমা মিলে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। খাওয়া শেষে বিয়ানের যাবার পালা। খাওয়া শেষে বিদায় নিয়ে তিনি গাড়ীতে স্টার্ট দিলেন।
রাত গভীর। ঘড়ির কাটায় ২ টা। আমাদের আড্ডা চলছে। টিভি’র পর্দায় মুভি চলছে একটার পর একটা। অবশেষে সময় হোল আসর ভাঙার। এলিয়ে দিতে হবে সারা দিনের পরিশ্রান্ত দেহটাকে বিছানায়। জানি ঘুম আমার আসবে না। ওরা বেছে নিয়েছে যার যার ঘর। আলো নিভিয়ে দিলাম।
সকালে উঠে নিচে নামতেই দেখলাম আমিন বসে আছে। কফি আমাদের দুজনেরই প্রিয়। ফোন টা বেজে উঠল। এই সাতসকালে বিয়ানের কণ্ঠস্বর।
তিনি এসে নাস্তা বানাতে চান। বলেছিলাম প্রয়োজন হবেনা ।
কিন্তু যথা সময়ে তিনি এসে হাজির। মুখে হাসি। কোন কিছুতে তার না নেই। অনেক করেছিলেন চির বিদায় নেয়া আমার আনন্দ , আমার চল্লিশ বছরের জীবনসাথী কল্পনার জন্য। আজও করে চলেছেন ।
সব পর্ব শেষ। এবার সবাই মিলে জাক্সন হাইটসে যাবো। সাইদ ভাই এর পকেট ভেঙ্গে আমরা লাঞ্চ করবো। বিয়ান যেতে চাইলন না। তাকে যেতে হবে অন্য খানে।
জাক্সন হাইটসের রেস্টুরেন্টে ঢুকেই শেলির মনে হোল সে ভীষণ ক্ষুধার্ত। একের পর এক সে আনতে বলছে নানান খাবার। বললাম, ধীরে শেলি, ধীরে। খাওয়া শেষে উঠে পড়লাম। ওদের যেতে হবে দূর পাল্লায়। শেষ হয়ে এলো আনন্দ ভরা ৩০ টা ঘণ্টা। কোণ দিক দিয়ে কাটল এতোটা সময়। মনে হচ্ছিল, সময় টা কেন আরও দীর্ঘ হোল না। তাহলে তো আরও কিছুক্ষণ আনন্দ ফুর্তিতে কাটানো যেতো। আরও কিছু সময় মুক্ত থাকা যেতো বিষাদ থেকে। কিন্তু সময় তো থেমে থাকেনা। ঘড়ির কাঁটাকে তো থামানো যায়না। কাল তো বয়ে চলে নিরবধি। আমার কি ক্ষমতা তা বেঁধে রাখি। ?
বন্ধুদের বিদায় নেয়ার সময় এলো। আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওরা চলে গেল। আমি আবার ফিরে এলাম আমার সেই পরিচিত বলয়ে। সেই বলয়ে যেখানে কেটে যাচ্ছে বিষণ্ণতায় ভরা আমার একাকী দিনগুলি। ফিরে এলাম হঠাৎ একদিনের কল-কাকলীতে মুখর হয়ে ওঠা আমার সেই নীস্তব্দ বাড়ীতে। আমি ফিরে এলাম আমার নিজের জগতে। আলো নেবানো ঘরে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দৃস্টি মেলে দিলাম সামনে। কি দেখতে চাই দুচোখ মেলে? দৃস্টি আমার কাকে খুঁজে ফেরে অতল আঁধারে? নেই কেউ নেই। নেই, কারো হাসির শব্দ নেই। কারো উচ্ছলতায় বাড়ী টা আজ আর ভরে থাকেনা। যে ছিল, আনন্দ হাসিতে যে বাড়িটা ভরিয়ে রাখত, সে আজ চির নিদ্রায় শায়িত ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালের গভীর শীতলতায়। এখন আমার চারিদিক জুড়ে শুধু অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে আমাকে আস্টেপৃস্টে জড়িয়ে রয়েছে আমার এই সময়ের একান্ত সঙ্গী বিষাদ।
অনির্বাণ হাঁটছিল অন্যমস্ক ভাবে। অফিস শেষে যে ট্রেন টা তার ধরার কথা ছিল সেটাতে যাবেনা ঠিক করলো। কেন, সে নিজেও জানেনা। বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই। কোনদিন যে ছিল তাও নয়। আজ অস্বাভাবিক ভাবেই দেরী করছে সে। গতকাল পাওয়া চিঠি টা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। শান্তি, শান্তি অনেক খুঁজে অনির্বাণের সন্ধান পেয়েছে। তাইতো লিখেছে সে,” আসতে পাড়বি একদিন আমার এখানে”।
সামনের কফি শপ টাতে বসে এককাপ কফি খেয়ে নেবে ভাবল অনির্বাণ। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ফিরে গেল সে অনেক পিছনে।
ছোট্ট শহর। অনির্বাণদের বাসার পাশের বাসাটা ছিল শান্তিদের। বয়স তখন কত ? চার, পাঁচ। এক্কা দোক্কা খেলার সাথী। হারিয়ে যেতো দুজনে পুকুর পাড়ে। জাম গাছের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরা জাম তুলে খেতো। সারা মুখ হয়ে যেতো নীল।
শান্তি বলত,” অণু, চল যাই ওই শালিক পাখি টাকে ধরি।” শান্তি সবসময় মাতব্বরি করতো অনির্বাণের উপর। অনির্বাণও সেটা মেনে নিয়েছিল। হাত ধরাধরি করে দুবন্ধু একদিন খেলতে খেলতে বড় হয়ে গেল। অনির্বাণ ষোল, শান্তি পনেরো।
অনির্বাণ চলে যাবে দূর শহরে। শান্তি তাকে বলেছিল,” জানিস অণু, তুই চলে গেলে আমি একেবারে একলা হয়ে যাবো। অনেক কাঁদবো। তুই একমাত্র আমাকে বুঝতে পারতিস।” অনির্বাণ চোখ মুছে বলেছিল,” ভাবিস না, আমি তোর খোজ রাখবো।”
না, কথা সে রাখেনি। ভুলে গিয়েছিল সে শান্তি কে, মেতে উঠে ছিল নতুন জীবন নিয়ে, ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছিল অতীত কে। কিন্তু আজ চিঠি টার দিকে তাকিয়ে চোখের কোণ টা ভিজে উঠল। আবারো পড়ল সে চিঠি টা। করুন ভাবে লেখা। “ পারবি অণু, পারবি কি একবার আসতে, আমাকে দেখতে।”
যাবে সে। ঠিকানা দেখল। কানাডার।
তিন দিনের ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল অনির্বাণ তার গাড়ী নিয়ে। টরেন্ট শহরের কিছু দূরে শান্তির ঠিকানা। অনির্বাণ যখন পৌছালো সূর্য তখন অস্তাচলে। বাড়ী চিনতে অসুবিধা হয়নি। দুরু দুরু বুক কাঁপছে। প্রায় বিশ বছর পরে শান্তির সাথে দেখা হবে। আনন্দ নয়, কোথা থেকে একটা ভয় তাকে গ্রাস করছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে। গাড়ীর আয়নায় চেহারা টা দেখে নিলো অনির্বাণ। নেমে এসে দরজায় টোকা দিতেই এক বয়স্ক ভদ্র মহিলা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলো,” কাকে চাই?”
“ শান্তি আছে?” অনির্বাণ জানতে চাইলো।
“ আপনি বুজি অনির্বাণ?”
অনির্বাণ বুঝল সে এখানে অপরিচিত নয়।
“জী” শব্দ টা সে অনেকদিন পর ব্যবহার করলো।
“ আসুন” বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো ভদ্রমহিলা।
ছোট্ট ঘর,দুটো লাভ চেয়ার, তার সামনে কফি টেবিল, একটু দূরে সাধারণ একটা টুল। পাশে লম্বা আয়না। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। দেয়াল গুলোতে রংএর ছোপ পড়েনি অনেকদিন। অনির্বাণের মনে হোল ঘরটাতে দারিদ্র্যতার ছাপ।
উঠে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে দাড়াতেই পাশের দরজা খুলে এলো ঘোমটায় মুখ ঢাকা এক ভদ্রমহিলা। ছিপছিপে শরীর। “ কেমন আছিস অণু”?
অনির্বাণ থমকে যেয়ে তাকালও ঘোমটা ঢাকা অতি পরিচিত অথচ অনেক দূরের মহিলার দিকে। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না, পলক পড়েনা চোখে।
“ ঘোমটা সরাবি ? নাকি পর পুরুষের সামনে মুখ দেখাতে না করে দিয়েছে কেউ?” অনির্বাণের জিজ্ঞাসা।
এ কথার উত্তর না দিয়ে শান্তি বললো, “ শানু, সেই যে তুই চলে গেলি আর ফিরে এলি না, খোজ ও নিলিনা।”
“ আমি তার জন্য অনুতপ্ত। কি হয়ে ছিল আমার জানিনা, পিছনে ফেলে আসা দিনগুলি আর আমার মনের মধ্যে আসেনি। আমাকে ক্ষমা করিস।”
“ ওসব ক্ষমার কথা বাদ দে। তোকে ডেকে এনেছি একটা কাজে। সেটা বলবো পরে।”
অনির্বাণ বুঝতে চেষ্টা করলো শান্তি কি বলতে চাইছে। ওর মনে হোল উঠে যেয়ে শান্তির হাত টা চেপে ধরবে কিনা। যে ভাবে দুজন হাত ধরাধরি করে দৌড়িয়ে বেড়াতো। কোথায় জেনো সংকোচ, দ্বিধা।
শান্তি বলে ,” জানিস অনু, যে শহর তুই ছেড়ে এসেছিলি ওটা অনেক পালটিয়ে গিয়েছিল। মাস্তানদের উপদ্রব আরম্ভ হোল। তখন আমার উঠতি বয়স। স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। বুঝতেই পারছিস -। আচ্ছা দেখ, আমি শুধু বক বক করছি। হোটেল ঠিক করে আসিস নিতো ?”
“না হোটেল ঠিক করিনি।”
“তা হলে এখানে থেকে যা। একটা ঘর আমার। তোকে এই ড্রয়াইং রুমের মেঝেতে থাকতে হবে, অসুবিধা হবে না তো? “ বলল শান্তি।
“ অত ফর্মালিটি করিসনাতো? তুই বল তোর কথা, আমি শুনতে এসেছি আর দেখতে এসেছি তোকে।”
অনির্বাণ তাকিয়ে ছিল শান্তির কাপড়ে ঢাকা হাতটার দিকে। মনে হলো সমস্ত শরীর টাকে সে কাপড়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু কেন?
“ বল কি বলছিলি” অনির্বাণ ফিরে যেতে চাইল সেখানে, যেখানে কথা অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল।
“ যা বলছিলাম, উঠতি বয়স আমার, তারপর দেখতে শুনতে খারাপ ছিলাম না। ঐ হোল আমার কাল। তারপর হিন্দুর মেয়ে আমি। স্কুলের পথে আসতে যেতে উতক্তা করেতে লাগলো মাস্তানরা। মাস্তান দের সর্দার একদিন আমাদের বাসাতে এলো। বাবা কে বললও সে বিয়ে করবে আমাকে। যদি রাজি না হই তবে উচিত শিক্ষা দেবে।”
বাবা তাকে বের করে দিয়েছিল বাসা থেকে। স্কুলে যাওয়া আমার বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে থাকি।
“ আইনের আশ্রয় নিসনি কেন?” প্রশ্ন অনির্বাণের।
“ তুই কি পাগল হলি? ওরাই তো আইন, ওরাই সব। আমাকে যে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাইনি সেটাই তো ভাগ্য।” বললও শান্তি।
বলল,” অনু, ভালই হতো, যদি নিয়ে যেতো আমাকে, তাহলে আজ তোকে ডেকে পাঠাতাম না। তুই অস্বস্তি বোধ করছিস না তো?”
“ কি যে বলিস ? বল তোর কথা।”
“বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ভাবলাম ঝড় হয়ত থেমে গেছে। রহীমাদের বাসাতো তুই চিনতিস। ওখানে যাবো ঠিক করলাম। কাউকে কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। রাস্তার থেকে গলিতে মোড় নিতেই পড়লাম ওদের মুখোমুখি। ভয়ে আমার শরীর আড়ষ্ট হয়ে এলো। দেখলাম মাস্তানদের সর্দারের দুটো হিংস্র চোখ। এগিয়ে এলো। কোন কথা বলেনি। শুধু ঢেলে দিয়েছিল এক বোতল এসিড আমার মুখের পরে।”
অনির্বাণ শিউরিয়ে উঠল কথা শুনে। তারপর,—-
“ চীৎকার করে ওখানে লুটিয়ে পড়েছিলাম। যখন জ্ঞান হোল দেখলাম, হাঁসপাতালের বেডে শুয়ে। সমস্ত মুখ ব্যান্ডেজে বাধা। “ এই বলে শান্তি একটু থামল.
“ বল শানু, থামিস না” অনির্বাণ উৎকণ্ঠিত
শানু বলে,” অনু, মনে আছে তুই বলতিস আমার গালের সেই ছোট্ট তিল টা তোর খুব পছন্দ। সেটা হারিয়ে গেছে।”
অনির্বাণের চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মুখে কোন কথা নেই। শান্তির
নিজের অজান্তে কখন যে ঘোমটা একটু সরে গিয়েছিল সে নিজেও জানে না। পাশের আয়নায় ফুটে উঠেছিল ঝলসে যাওয়া মুখটা। অনির্বাণের সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠেছিল। চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল । তাকাতে পারেনি দ্বিতীয় বার।
“ শানু থাক বলতে হবে না। কি শাস্তি হয়েছিল ওই বদমাশদের?” অনির্বাণ জানতে চাইল।
শান্তি একটু হাসলো। শাস্তি, কোথায় শাস্তি? প্রমাণ হয়েছিল ওই সময় ওরা ছিল অন্য গ্রামে। তুই ভাবছিস আজ আমি এখানে এলাম কি ভাবে, তাইনা? এক জনের দয়ায়। আমাকে দেখেছিল হাসপাতালে। এসেছিল তার মা কে দেখতে। পাশের রুমে। পরিচয় হয়েছিল বাবার সাথে। শুনেছিল সব।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমরা সেই শহর ছেড়ে অন্য শহরে বাসা বেধে ছিলাম। বছর না পেড়োতেই একদিন কামাল এসেছিল আমাদের বাসায়। বাবাকে প্রস্তাব দিয়ে ছিল। বাবা প্রথমে রাজি হয়নি। বলেছিল তাকে, “দয়া দেখাতে আসোনি তো? তুমি দেখেছ শান্তিকে? পারবে সহ্য করতে? তোমরা, আমরা এক গোত্রের নই। পারবে কি সে দন্ধ থেকে বেড়িয়ে আসতে?”
সে শুনেছিল। বলেছিল তার কোথা। নিয়েছিল আমাকে।
এখনো কিছু ভাল মানুষ আছেরে অনু। এই বলে শান্তি উঠে দাঁড়াল। বললও
“ চল খেতে বসি, সেখানে শেষ করবো সব কথা।”
অনির্বাণ জিজ্ঞাসা করলো,” তোর সেই দেবতা কোথায়?”
“ সব বলবো তোকে, আগে হাত মুখ ধুয়ে নে।”
খাবার টেবিলে বসে শান্তি বলে,” কি জানিস অনু, এখন মনে হয় উপরওয়ালা বলে কিছু আছে। তা না হলে আমার দেবতা যখন চলে গেল তখন তোর খোজ আমি পেয়ে গেলাম। আমার এক দরজা বন্ধ হোল আর এক দরজা খুলে গেল।
হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে ও চলে গেল একদিনের মধ্যে। রেখে গেল আমার তিন বছরের মেয়েকে। অনু, পারবি ? পারবি আমার অবর্তমানে অনন্যাকে মানুষ করতে? পারবি অনু?”
অনির্বাণ কথা দিয়েছিল। বলেছিল,” ভাবিসনে শানু, একবার ভুলেছিলাম, আর নয়।”
কয়েক বছর পাড়িয়ে গেছে। এক রোঁদরো ঝরা বিকেলে অনির্বাণ তার ড্রয়াইং রুমে বসে বই পড়ছিল, এমন সময় কোথা থেকে দুষ্টু মেয়ে টা কাকু কাকু বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল অনির্বাণের বুকে, গালে গালে রেখে বললও,” তুমি না বলেছিলে জোন্স বীচে নিয়ে যাবে কাকুমনি?”
চন্দন পুর জেলা শহর থেকে একটা রাস্তা পশ্চিমের দিকে চলে গেছে গোপাল গনজ। পিচের রাস্তা। দুদিকে বড় বড় গাছের সমারহ। সেই গাছের ছায়ায় ক্লান্ত পথিক দুদন্ড বিশ্রাম নেয়। পাশে ধান আর আখের ক্ষেত। দুরে ছোট ছোট বাড়ী। কোনোটা মাটির কোনোটা ইটের। বাচ্চারা খেলা করে রাস্তার পাশে। বড় বড় টা্র্ক পাট নিয়ে যায় দুর পাল্লায়। এই এলাকা পাটের চাষের জন্য প্র্সিদ্ধ। গোপাল গন্জ থেকে বায়ে বাক নিয়ে
যে রাস্তা টা চলে গেলো সে রাস্তা ধরে ১৮ কিলোমিটার গেলে একটা ছিম ছাম শহর নাম সুন্দর পুর। গা্র্ম নয় উপজেলা। লোক সংখা বেশি নয়। এক কালে হিন্দু অধুসসিত ছিলো এই শহরটি। যাতা্র্ নাটক সবই হোতো। সাংসকি্র্তির দিক দিয়ে ছিলো উচ্চমানের। এখন আর হয়না। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে গেছে অনেক কিছু।
এই শহরের মাঝে আছে ছেলে দের আর মেয়েদের হাই স্কুল। আছে কলেজ। এই শহরের বেশির ভাগ লোকই ব্যবসাই।
জমির আলি সাহেব ছেলেদের হাইস্কুলের হেড মাস্টার। কোলকাতা থেকে পড়াশুনা করে এই শহরে এসে উঠে ছিলেন। দুর গা্র্মে প্র্তরিক বাড়ী। লোকে সমিহ করে। সল্প ভাসি, কথা বলে কম। যত টুকু প্র্য়োজন তার অধিক কথা উনাকে কেউ বলতে শুনিনি। স্কুলের দায়িত্ত পালনের সাথে সাথে পাটের আর কাঠ কাটা কলের ব্যবসা আছে। কাঠ কাটা কলের নাম রেখেছে বড় মেয়ের নামে। অন্যন্না মিল। অন্যন্নার দাদা অন্যন্নাকে কপালি বলে ডাকতো। বলতো এ মেয়ের জন্ন্য জামাই খুজতে হবেনা। খুজতে অবশ্য হয়নি। সে কথা থাক।
হেড মাস্টার সাহেবের দুই মেয়ে। অন্যন্না আর সম্পা। অন্যন্না দুই বছরের বড়। উজ্জল ফর্সা বলা চলে, মানান সই লম্বা, শরিরের গঠন ভালো, সম্পা শ্যেমলা কোকরানো চুল, চেহারায় মিস্টতা ভাব। এক জন ধির স্থির অন্যজন চনচ্ল , দুরোন্ত। দুজন দুজন কে ছাড়া চলেনা। মাঝা মাঝে অন্যন্না তার অধিকার ফলায় সম্পার উপর, “ শুধু বাইরে বইরে টো টো করে বেড়াবি নাকি মা কে একটু সাহ্যায্য করবি।” ওর জন্ন্য তো তুমি রয়েছো, আমাকে ডাকছো কেনো? আমি যচ্ছি রহিমাদের বাসায়, ওখানে সবাই মিলে আড্ডা দেবো।” অন্যন্না মার কাছে বসে সাহায্য করে মাকে, তেল টা, নুন টা এগিয়ে দেয়। সম্পার মধ্যে আছে উচছলতা যা সচারচর দেখা যায়না। হেড মাস্টার সাহেবের বাসাটা পা্র্য় এক বিঘা জমির উপর, পেছনে সেগুন গাছ, আম গাছ, পাশে ছোট্ট পুকুর, এক সময় কিছু মছের চাস করা হোতো। আজ আর নেই। খরাতে জল শুকিয়ে এসেছে। বাগানের মাঝ দিয়ে হাটা পথ। এপথ ছিলোনা মানুষ জনে হেটে হেটে বানিয়ে নিয়েছে।
স্কুল শেষে দৌরিয়ে এলো সম্পা, “ মা, কিছু কাঠ আর চাল ডাল দিতে পারবে? আমি, টুনি আর পরুল মিলে বোনভোজন করবো পুকুর পাড়ে। “ বাবা শুনলে বকবে। দাও না মা। নাছর বান্দা। “ যা আমি সব পাঠিয়ে দিচ্ছি ওসমান কে দিয়ে, ওসমান ঠেকা খাটে মাস্টার মশাই এর বাসায়। অন্যন্না শুনছিলো সব কথা, বলল,” চল আমিও তোদের সাথে বোনভোজন করবো” আবার তুমি কেনো? সম্পা চিৎকার কর উঠলো। আপা গেলে ওর মাত্ববড়ি থাকবে না। বোনভোজনে যোগ দেওয়া অন্যন্নার প্র্ধান উদ্দেশ না, উদ্দেশ বোনকে চোখে চোখে রাখা।
দুরন্ত সে, আগুন নিয়ে খেলা করতে যেয়ে কখন কি হয় বলা যায়না। বোনটা তার খুব আদরের। সে কথার সংগি। সে তার নিত্তদিনের ছায়া।
বাবার চোখের মনি দুবোন। ওরা মাকে বলে, “ আচ্ছা মা বাবা অনেক মজার মজার কথা বলে , তাই না?”
জানিনা বাছা, তোমাদের কাছে কেনো এত ভালোলাগে। ওরা জানে বাবাকে ছাড়া মা অচল। মনে পরে সম্পার, সে মা কে বলে ছিলো,” আচ্ছা মা, তুমি শুয়ে বসে কাটাও গা ব্যথা হয়না।” বাবা সে কথা শুনে দুবোন কে ডেকে বলেছিলো, “ তোমাদের মা অনেক কষ্ট করে তোমাদের কে মানুষ করছে, মার চোখে কোনোদিন জল আনাবে না।”
সেদিন ওরা বুঝেছিলো বাবা মাকে কত ভালোবাসে।
দেখতে দেখতে সম্পার গলায় ওড়না এলো। বুঝতে পাড়লো সে বড় হয়েছে। পাড়া বেড়ানো কমে এলো। বকাটে ছেলেদের তো অভাব নেই। অন্যন্না তৈরি হচ্ছে মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্ন্য। বরাবরি ভালো ছাতি্র্ সে। সম্পার পটুতা অন্য দিকে। লেখার হাত ভালো। বাবা বলেছে অন্যন্না ভালো রেজালট করলেওকে ঢাকাতে পাঠিয়ে দেবে, ভালো কলেজে ভর্তি হবে। সম্পা শুনেছে সে কথা। অন্যন্নার কাছে এসে বলে,” আপা তুমি চলে যাবে।” কান্নায় গলা বুজে আসে। আপা ছাড়া তার মনের কথা বলার কেউ নেই। আপাই তার সো্র্তা। আপাই সব।
মনে পড়ে ছোটবেলায় সে আপাকে বলেছিলো,” আচ্ছা আপা আমাদের এক বাড়ীতে বিয়ে হোলে আমরা এক সাথে থাকতে পারবো, তাই না?” আপা শুধু হেসে ছিলো।
অন্যন্না ভালো রেজাল্ট করেছে। ভর্তি হবে ঢাকার নাম করা কলেজে। চলে যেতে হবে। সম্পার চোখে জল।
জানতে দেয়না আপাকে, পাছে আপা দুক্ষো পায়। পুকুরের পাশে বসে অঝরে কাঁদে। তার খেলার সাথি, তার কথা বলার সাথি চলে যাবে অনেক দুরে। গুমরিয়ে উঠছে বুকের ভিতর। তবু যেতে দিতে হবে। অন্যন্না ওকে চেপে ধরে বলে, “ কাদিঁস নে, আমিতো ছুটি ছাটায় আসব, চিঠি দিস।”
অন্যন্না চলে গেলো। সম্পা ধিরে ধিরে দুরন্তপনা ছেড়ে মার পাশে এসে দাড়ালো। বাবার ওজুর পানি এগিয়ে দেয়, মাকে রান্না ঘরে সাহায্য করে। অন্যন্নার চিঠি আসে। নতুন জীবনের খবর, নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ। অন্যন্নাকে উঠিয়ে দিয়ে এসেছিলো ওর বাবা অন্যন্নার এক ভাই ভাবীর কাছে। বলে এসেছিলো বাবা রফিক ওকে দেখে রেখো। অল্প ছুটি ছাটায় ওদের বাসাতে উঠতো অন্যন্না।
অন্যন্নার কলেজ শেষ। সম্পা মাদ্ধোমিক পরীক্ষা শেষ করলো। গরমের ছুটি। দুজনে বাসাতে। কথা শেষ হয়না। অন্যন্না বলে ঢাকার অভিগ্গতার কথা। বলে,”জানিস একজনের দেখা পেয়েছি। “ কি? কার। তার মানে তুমি পে্র্মে পড়েছ।” ওকে দেখলে পে্র্মে না পড়ে থাকা যায় না” “কি বলছ,তোমার মুখের সামনে টিকতে পাড়লো,”
তুই দেখলে বুঝতে পারবি। ফটো টটো আছে, না সব বুকের মধে্য। “ না নেই।” বাবা মাকে বলবো। “ না না এখন নয়”। ওব বাবা। নাম কি? সাহারিয়া। আধুনিক নাম মনে হচ্ছে। কি নামে ডাকো? এখনো নাম ধরে ডাকিনি, তবে সোনা টোনা এসব বলে ডেকে ফেলবো। তুমি আমাকে লজ্জায় ফেললে আপা।
আপার আনন্দে সেও আনন্দিতো। একটা চিঠি লেখে হবু দুলাভাই কে পাঠিয়ে দিয়েছিলো আপার সাথে।
লেখাতে সে ছিলো পারদর্শি। বাংলায় অনর্াস নিয়ে সম্পা ভর্তি হলো Universityতে। দুই বোন একে অপরের রুমমেট। নতুন বন্ধু, নতুন শহর, আর আছে অন্যন্নার উপদেশ। অনেক ছেলে পে্র্ম নিবেদন করবে, ফিরেও তাকাবি না। যদি সাহরিয়ার মত কাউকে পাশ তবে চিন্তা ভাবনা করিস। সম্পা বলে ছিলো,” আচ্ছা আপা, তোমার এই সাহরিয়া তো দুটো জন্মেছে বলে মনে হয়না, তা আমি আর একটা সাহরিয়া কোথায় পাবো”।
সেই সাহরিয়া কে খুজতে যেয়ে সম্পা কে একলা থাকতে হলো বেশ কিছু বছর।
এর মাঝে নদীর পানি অনেক গড়িয়ে গেছে। অন্যন্না আর সাহরিয়া হয়ে গেছে স্বামী স্তী্র্। চলে গেছে বহু দুরে আর এক দেশে জীবিকার সন্ধানে।
সম্পা আজ একা। পড়াশুনা শেষ করে উঠেছে সেই ভাই এর বাসায়। মাঝে মাঝে অন্যন্নার সাথে কথা হয় ফোনে। দিনের শেষে রাত আসে, বছর ঘুরে যায়, সাথে সাথে বয়সের ছাপ এসে পড়ে সম্পার জীবনে। একটার পর একটা পাশ দিতে থাকে। অবশেষে একটা ছোটদের স্কুলে শিক্ষয়েত্র্ হয়ে যোগদান করে। বাচ্চারা কেনো জানি ভীষন ভালবাসতো ওকে। ভালোবাসার মতই মন ছিলো ওর। দেখা পেলো একজনের। জানালো আপাকে।
“আপা পেয়েছি, তবে তোমার সাহরিয়ার মত কিনা জানিনা”। আপার চিন্তা লাঘব। তার বোনকে অনেক দিন সে দেখেনা। জীবনের কাটা ঘুরে চলেছে। একটা চিঠি এসে পড়লো অন্যন্নার হাতে। সম্পার লেখা। “ মেরুদন্ডহীন লোকের সাথে ঘর করার আগেই ভেংএ দিলাম, আপা”। অন্যন্না কোনো কিছু জিগ্গাসা করেনি, শুধু চোখের জল ফেলেছিলো। সম্পা ভেংএ পড়েনি। জীবনে হোচট খেয়ে সে চলতে শিখেছে। স্কুলের ছোট ছটো ছেলে মেয়ে দের মধে্য আপামনি হয়ে বাচতে চেয়েছে।
ভাই এর আনা এক পাত্র্রর সাথে পরিচয় হোলো। নাম মহিম। প্র্থম দেখাই পে্র্ম তা নয়। দেখা সাক্ষাত। দিন ধার্য হলো। সম্পার কুমারি জীবনের অবসান। আপা খুশি। মহিম কে সম্পার ভালো লেগেছিল। সল্প ভাসি। নিজেস্য পি্র্ন্টিং পে্র্স আছে । কাজের ফাকে ফাকে সম্পা কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো দুর পাল্লায়। রাংয়ামাটি, কক্সবাজার, বন্দর বন। বছর ঘুরতেই কোলে এলো এক ফুট ফুটে ছেলে, আনন্দ। সম্পা লিখে ছিলো তার আপাকে, “ তোমার সাহরিয়াকে আমি খুজে পাইনি, আমি আনন্দের মাঝে খুজে পেয়েছি আমার আনন্দ”।
বিধাতার দাবা খেলায় কোন গুটি কখন কাটা পড়ে কেউ জানানা। জানেনি সম্পা। দুদিনের জ্বরে মহিম হারিয়ে গেলো। চলে গালো এই পৃথিবির মায়া ছেড়ে। রেখে গেলো সম্পা আর আনন্দ কে। সম্পা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল। এই পৃথিবীর আলো তার কাছে মনে হলো কালো ধোঁয়া। জীবনের শুরুতেই সব শেষ। শুক পাখি বাসা বেধে ছিলো অন্য খানে তার কাছে নয়। আপা জানলো, জলে ভিজিয়ে দিলো বালিস। কাঁদতে কাঁদতে বলে ছিলো,”কাদিস নে আমি তোকে নিয়ে আসব এখানে।”
স্কুলের চাকরিটা রেখে ছিলো। কস্ট করে সংসার আর ছেলেকে গড়ে তোলার দায়িত্ত সে পালন করেছিলো। ভাবতো পৃথিবিতে কিছু লোক জন্মায় ভ্যাগের সাথে লড়াই কোরে বাচার জন্ন্য, সে তাদেরই একজন।
আড়াই বছরের আনন্দ কে নিয়ে সে এলো আপার কাছে। বোন কে পেয়ে আনন্দ ধরেনা। বলে, “তোর কোনো অসুবিধা হবেনা এখানে, মনে করবি এটা তোরই বাসা।” সেদিন সম্পা ঠাই পেয়েছিলো। ঠাই পেয়েছিলো বিশাল হূদয়ে সমপ্ননো তার বোনের কাছে।
বিধাতার দাবার চাল তখনো বাকি। তা না হোলে আজ সাহরিয়াই বা কেন ভাবতে বসবে, ভুল কি তার হয়েছিলো? যদি সে ছয় মাসের মাথায় সম্পাকে খালেদের হাতে সমর্পন না করতো তাহলে কি আজ সম্পার জীবন কাহিনি অন্ন্য ভাবে লেখা হতো? এ দন্দ তার হূদয়ে, কোনদিন সে বলেনি অন্ন্যনাকে। খালেদ সম্পাকে নিয়ে বাসা বাধলো বেশ কিছু দুরে। সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠেনি। তবুও জীবন চলবে তার গতিতে।
অন্ন্যনাকে সম্পা বলে ছিলো, আমার কপালের খন্ঢন তো তুমি পাল্টাতে পারবে না, আপা। বিধাতা লিখেছে এই ভাবে, কাকে আমি প্র্শ্ন করবো?;” সাতদিন কাজ করে সে সংসার চালায়, ছেলে কে বড় করেছে, কলেজ শেষ করে সে এখন ছোটো খাটো চাকরি করে।
এক দিন অন্ন্যনা সাহরিয়াকে বলেছিলো,” আমার অবর্তমানে তুমি আমার বোনটাকে দেখো,” সে কথা দিয়েছিলো।
সময় থেমে থাকেনি। অন্ন্যনার সাথে কথা হয় সম্পার প্র্তি রাতে। কথা ফুরাতে চায় না। সাহরিয়া বলে,” কি কথা বলো তোমরা প্র্তি রাতে।” ও তুমি বূঝবে না। সাহরিয়া কথা বারায়নি।
বিধাতার শেষ খেলা দেখে সম্পা ইসত্মভিতো হয়ে গিয়েছিলো। সাহরিয়া ফোন করে জানিয়েছিলো অন্ন্যনার কঠিন অসুখের কথা। সম্পা শুনতে চাইনি, বিশ্বাস করতে চাইনি, তার আদরের আপা আজ মূতু পথ যাতি্র্।
অন্ন্যনা বলেছিলো, আয় কদিন এসে আমার কাছে থেকে যা। এসেছিলো, থেকে ছিলো, সেবা করে ছিলো অন্ন্যনার চলে যাওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত।
পাষানের ভাড় সম্পার হূদয়ে, তার ত্নতি্র্তে তনতি্র্তে। ভালো মন্দ মিশিয়ে কথা বলার মানুষটা তার হারিয়ে গেলো চিরতরে। চেষ্টা করে স্বামি, ছেলেনিয়ে ভুলে থাকতে। পারেনা। ভেসে ওঠে তার মনের পর্দায় তার আপার চেহারা যে দিতো পে্র্ররনা, দিতো উপদেশ দিতো বেচে থাকার নতুন পথ।
সন্ধা ঘনিয়ে আসে ।আকাশের লালচে আভা এসে পড়েছে সম্পার ছোট্ট বারান্দায়। চা এর কাপে চুমুক দিয়ে তাকিয়ে থাকে দুর আকাশের দিকে। ভেসে আসে সুর “কি পাই নি তার হিসাব মিলাতে মনো মর নহে রাজি কি পাই নি।”
সুযর্ ঢলে পড়ে। মিলিয়ে যায় পূথিবির আলো, নেমে আসে অন্ধকার।
My name is Khan মুভি টা দেখে বেড়িয়ে আসতেই দেখে হোল অনেক দিনের পরিচিত এক ভাবীর সাথে। “ কেমন আছেন” জিজ্ঞাসা করল ভাবী। “ ভালো, আপনি?” কুশল সংবাদ আদান প্রদানের পরে বললও “ পরিচয় করিয়ে দেই, আমার বোন।” পরিচয় হোল। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মুখে কসমেটিকের ব্যবহার খুব একটা নয়, মাথায় আলতো করে ঘোমটা টানা। বয়স বোঝা মুশকিল। একটু হেসে চোখ টা সরিয়ে নিলো। হয়তো অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলতে অভ্যস্ত নয়। সেটাই স্বাভাবিক। ভাবীর সাথে কথা শেষে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ছোট্ট একটা জিনিষ কিনতে মলে গিয়ে ছিলাম, পেলাম না। তাই উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল এক পরিচিত মুখ। হাতে ভিক্টোরিয়া সিক্রেটের শপিং ব্যাগ। সামনা সামনি হতেই বললাম “ চিনতে পারছেন”? তাকালো, এবার আর চোখ নামিয়ে নিলো না। “ হা পারছি, অনেক দিন পর দেখা, তাই না?”
শপিং শেষ না শুরু ?
মাঝা মাঝি। আপনার?
যেটা কিনতে এসে ছিলাম, পেলাম না। তাড়া আছে কি?
না ততটা নয়
কোথাও বসে এক কাপ কফি খেতে বললে আপত্তি করবেন কি?
না বলা টা আমার মজ্জা গত, তবে আজ আর না বলব না। কোথায় বসবেন?
ওই তো ওখানে, Food court এ।
দুকাপ কফি নিয়ে বসলাম মুখোমুখি। আজ লজ্জার আভা দেখলাম না। সাবালীল ভঙ্গি।
জিজ্ঞাসা করলো,” কি করা হয়?” ফ্রি লেন্স রাইটার। যখন যা মনে আসে অথবা চতুর্দিকে যা দেখি তা নিয়ে লেখি। কেউ যদি ছাপায় ভালো, নতুবা নিজের মধ্যে রাখী। “ বোনের সাথে পরিচয় হোল কি ভাবে?। আপনার দুলাভাই কে চিনতাম আগে থেকে। কোন এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল , সেই সুবাদেই পরিচয়। “ কেউ আছে কি? “বলতে পারেন আছে। এক ছেলে, একমেয়ে। তারা তাদের নিজেদের সংসার নিয়ে বাস্ত। আমি আমাকে নিয়ে”।” বুঝলাম। আমিও আপনার মত।”
তাই কি?
জানি না। আপনার জীবনের বিশ্লেষণ আমার জীবনের বিশ্লেষণের সাথে নাও মিলতে পারে। আপনি দেখছেন হারানোর বেদনাটা এক ভাবে, আমি দেখছি অন্য ভাবে। প্রশ্ন হয়তো এক। কেনো হোল?
এই কেনো খুঁজতে যেয়ে আমিও দিশাহারা। তা কি করে হোল? প্রশ্ন তার।
সে অনেক কথা। আপনি বলুন আপনার কথা দেখি কোঁথাও মিল আছে কিনা
বলল, আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমার। সাত বোন দুই ভায়ের মধ্যে আমি ত্রিতিয়। বাবা সরকারী চাকরী করতেন। বদলীর চাকরী। বিভিণ্ণ সময়ে বিভিন্ন জাগায় থেকেছি। সব বোনের মধ্যে আমিই ছিলাম স্বল্পভাষী। অনেকে জানতোই না আমি বলে কেউ আছে এই বাসাতে।
একদিন বাবা এসে মা কে বলল তার এক বন্ধুর ছেলে এসেছে আমেরিকা থেকে। বাসাতে নিয়ে আসতে চায়। মা রাজী। তাদের মনে কি ছিল জানিনা। আমরা বোনেরা ভীষণ খুশী। গল্প শোনা যাবে আমেরিকার। এলো সে। সব বোনরা মিলে ঘিরে বসলাম। খুব একটা অপ্রস্তুত হোল বলে মনে হোল না। পাতাল রেলের কথা, বড় বড় বাড়ী এই সব বলতে বলতে এক গেলাস পানি চাইল। বুঝলাম নার্ভাস হচ্ছে। এত গুলো মেয়ের সামনে কথা বলা চাট্টি খানি কথা নয়।
চলে গেল সে। আমরাও আমাদের কাজে বাস্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ মা একদিন আমাকে ডেকে পাঠাল। বলল,” বাহিরে খুব একটা যাওয়া আসা করোনা।” বুঝলাম না কেন। বললাম” হঠাৎ কি হোল? বলল।” তোমার বাবার বন্ধুর ছেলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে তোমার জন্য।”। আকাশ থেকে পড়লাম। “ কি বলছ?” আমার আগে আরো দুবোন রয়েছে। “ কিন্তু তোমাকেই তার পছন্দ।”। বিদেশে যাওয়ের সখ আমার চিরওদিনই ছিল। তাই বলে এই ভাবে?
তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্তা করতে হবে, কারণ সে ফিরে যাবে আমেরিকাতে। কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল বুঝার আগেই শুধু এটুকু জানলাম আমার আমিত্ব শেষ। আমি এখন অন্যের স্ত্রী।
এলাম এদেশে। স্বামী আমার দেবতুল্য। কোনদিন কুটো টা ছিঁড়তে দেয়নি। হয়তো বয়স আমার কম ছিল বলে। কিছুদিন পর ওরই এক বন্ধুর সাথে বিয়ে হয়ে আমার বড় বোন (আপনার ভাবী) এলো এদেশে।
আমার স্বামী অনেক পাশ দিয়ে পরে এক ফার্মাসীউটিকাল ইন্ডাস্ট্রি তে ভালো পজিশনে চাকরী পেলো। সংসারের সচ্ছলতার সাথে সাথে কোল জুড়ে এলো এক মেয়ে। ওর বাবার অনেক আদরের। তিন বছরের ব্যবধানে আরও একটা ফুটফুটে মেয়ে এলো আমাদের সংসারে। হই হুল্লো করে দিন গুলো আমার ভালোই কাটছিল, যদি না সে এসে একদিন বলত তার বুকের কাছে একটা চাঁপা
ব্যথা। দুলাভাই কে ফোন করলাম, বলল, এখনি নিয়ে যা হাসপাতালে। দুটো Artary ব্লক। স্টেনট লাগিয়ে দিলো। মনের মধ্যে অজানা একটা ভয়। কখন কি হয় কে জানে। এভাবে চলে গেল অনেক বছর। বড় মেয়ে তখন কলেজের ত্রীতীয় বর্ষের ছাত্রী।
এক রাতে ওর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা, তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স ডাকলাম। হাসপাতাল পর্যন্ত পোঁছাতে পারেনি, তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। আমার জীবনের বড় খুঁটিটা বন্যার জলে ভেসে গেল। “
এই বলে সে থামল, আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত ওর জীবন কাহিনী শুনছিলাম। থেমে যেতেই বললাম– তারপর।
তারপর , দুলাভাই আর বোন বুকে টেনে নিলো আমাদের তিনজন কে। আমাদের বাসাটা ভাড়া দিয়ে দিলাম। জমাট বাধা কান্না আমার বুকে। মাঝে মাঝে আড়ালে যেয়ে কেঁদে বুক ভাসাতাম। যাকে কোন দিন কুটো টা ছিঁড়তে দেইনি তার কাঁধে সব দায়িত্ব দিয়ে সে চলে গেল। আমি চোখের জল মুছে মন কে শক্ত করার চেষ্টা করলাম।
বিধাতার কাছে প্রার্থনা করলাম শক্তি দিতে।
আজ তিন বছর হয়ে গেল, মেয়ে দুটো কে সমাজের মাঝে মাথা উঁচু করে দাড় করাতে পেরেছি। নিজের বাসাতে ফিরে এসেছি। বড় মেয়ে তার বর খুঁজে পেয়েছে আমাদের জানাশোনার মধ্যে। আমি ছোট্ট একটা কাজ নিয়ে সময় কাটাচ্ছি। কত টুকু করতে পেরেছি তার হিসেব নিকেশ আজ আর করিনা।
বললাম আপনার পারিপারশীকতা আপনাকে সাহায্য করেছে। যে দাগ আপনার মনে গাথা তা মুছে যাবার নয়। তার একবার ছিঁড়ে গেলে তা জোড়া লাগে না, লাগলেও একটা দাগ থেকে যায়। এইটাই নিয়ম। তবুও বলব আপনি মনের দিক থেকে অনেক শক্ত।এ ব্যথা তো চলে যাবার নয়। তবু বলি, কাঁদেন, কাঁদলে হয়তো বুকটা একটু হাল্কা হবে। কিছু একটা কে আঁকড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা তো সবাই করে। আপনি হয়ত তা খুঁজে পেয়েছেন।
হয়তো তাই! মনকে বুজ দেই, যার ধন সে নিয়েছে আমার করার কিছুই নেই। এই সান্ত্বনা নেয়েই আমি বেচে আছি।
বললাম, সুন্দর একটা সময় কাটালাম আপনার সাথে, এই রইল আমার ফোন নাম্বার, প্রয়োজন বোধে কল দিয়েন।
“ শুভেন্দু না”, ডাক শুনে পাশ ফিরে তাকাল শুভেন্দু। এক কেতা দুরস্ত ভদ্রলোক, পরনে পলো সার্ট, বেনানা রিপাবলিকের প্যান্ট, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। চিনতে অসুবিধা হলো না। একসাথে স্কুল শেষ করে দুজন দুদিকে চলে গিয়েছিল। পরে আর একবার দেখা হয়ে ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির চত্বরে। আজ এতকাল পরে ব্যাংককের রাস্তায় দেখা। শশাঙ্ক বরাবরই চোঁওকস ছেলে।
“কি মনে করে এই বিদেশ বিভুয়ে” শশাঙ্ক প্রশ্ন করে।
বলতে পারিস রীক্রেসনাল টুর। এসে ছিলাম বাংলাদেশে কিছুদিনের জন্য, ভাবলাম ঘুরে যাই, দেখে যাই এই দেশ টা। এবার তোর কথা বল।”
চাকরী নিয়ে এসেছি এদেশে আজ দুবছর হোল। তারপরই প্রসঙ্গ পাল্টালো শশাঙ্ক, শেষ তোর সাথে যখন দেখা হয়েছিল, দেখে ছিলাম এক সুন্দরীর হাতে হাত ধরে চলতে, দেখছিনে কেন তোর পাশে?
চলে গেছে। ছোট্ট জবাব শুভেন্দুর।
চলে গেছে কোথায়, শশাঙ্কর কণ্ঠে বিস্ময়, কিছুটা বেদনার্তও।
বিধাতা ডেকে পাঠালেন তাকে।
কতদিন হোল ?
তা বেশ কিছুদিন। তোর কোথা বল। শুভেন্দু কথা ঘোরাতে চাইল।
হাসলো শশাঙ্ক। একটানা বলে গেল, ছন্নছাড়া জীবন, ডানা গুটিয়ে বসিনি কোঁথাও। Flying like a bird. পিছুটান নেই। চোখের জল আমিও ফেলিনা, আমার জন্যও কেউ ফেলেনা। তাই বলে ভাবিস না আমি gay। মেয়ে বন্ধু ছেলে বন্ধু দুই আছে। তুই তো এখন আমারই মত। তাই না ?
না, তুই হচ্ছিস রবীন্দ্রনাথের বনের পাখী, আর আমি খাঁচার। তুই উড়তে ভালবাসিস, আমি বসে থাকতে চাই কারোর ছায়াই। মায়া মমতায় ভরা। তোর আনন্দের সাথে আমার আনন্দ মেলে না। তাই বলে আমি বলছি না তোর টা সত্যি নয়। তাড়া আছে তোর? না থাকলে চল ওই কফি শপে বসি। চল।তাগাদা দিল শুভেন্দু।
কফির পেয়ালায় শশাঙ্কই কথা শুরু করলো। সত্যি বলতে কি তোদের ডানা ভেঙ্গে গেছে। তোরা উড়তে চাইলেও উড়তে পারবি না। তোদের মন একজন কে ঘিরে, তার বাহিরে তোদের দরজা বন্ধ। তোরা একাকীত্ব কে ভালবাসিস। ভালবাসিস দুঃসহ পীড়াকে। নিংড়ে তার থেকে রস বেড় করতে। এর মধ্যে তোরা খুঁজে ফেরিস জীবনের আনন্দ। আমি বলবো দুঃসহ আনন্দ। এই দেখ আমাকে, কোন কমিটমেনট নিই কারো কাছে। তাই বলে যে আমার লাইফ এ discipline নেই তা নয় I have very disciplined life. উচ্ছিরিংখলতা আমি ভালোবাসি না। তোর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমার ভারজীনীটি নিয়ে। ওটা হারিয়েছে অনেকদিন হোল। কার সাথে মনে করতে পারিনা। আমি বর্তমানে বিশ্বাসী, অতীত কে আঁকড়িয়ে ধরে থাকতে চাইনা, ভবিষ্যতে বিশ্বাসী নই।
কি জানিস শশাঙ্ক, শুভেন্দু ওর কথায় যোগ দিল, লাইফ এর একটা সাইকেল আছে। জন্ম থেকে মিরতু। তোর সাইকেল টা মাঝ পথে ভেঙ্গে গেছে। ভেবে দেখ তোর জন্য কেউ দুফোঁটা জল ফেলবে না তোর অবর্তমানে। তুই বলে এ পৃথীবি তে কেউ ছিল তা কেউ জানবেনা। রাতের অন্ধকারে এক গেলাস জল ঢেলে কেউ তোকে এগিয়ে দেই নি। কেউ তোর পথপানে চেয়ে বসেছিল না, আজও নেই। বলবে না তোমাকে আজ বড় ক্লান্ত লাগছে।
ঝনঝন করে উঠল শশাঙ্ক । রাখ তোর বুজরুকী। এ শুধু সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার। এটা উই পোকার মত। কুড়ে কুড়ে খাবে। এই বন্দন থেকে তোকে বেড়িয়ে আসতে হবে। যদি বাঁচতে চাস।
তুই ভেবে দেখ শশাঙ্ক। ধীর গলায় বলে শুভেন্দু, একলা ঘরে তুইও থাকিস, আমিও। তুই কি শুনতে পাশ টুং টাং চুড়ির শব্দ। দেখতে কি পাশ আবছা আলো ছায়ার মাঝে কে জেনো হেঁটে গেলো।
শশাঙ্কের কণ্ঠে এবার একটু উত্তাপ। না আমি পাইনে, অনন্যরা ও পায়না। তাড়া বেচে থাকার জন্য অন্য পথ অবলম্বন করে। ডুবে যায় অন্য কিছুর মধ্যে। তোকেও তাই করতে হবে। সন্ন্যাসী হয়ে বনে বনে ঘুরে লাভ নেই। তোকে সমাজের মধ্যে বাঁচতে হবে।
পারছি না। জীবনের মানে হারিয়ে ফেলেছি শশাঙ্ক। স্বপ্ন আর দেখি না। তুই বলবি আমি নিজেকে নিয়ে যাচ্ছি আত্মঘাতের চরম সীমায়। হয়তো তাই। এর শেষ কোথায় আমি জানিনা।
দেখ শুভেন্দু, তুই আমার মতও হতে পারবি না এবার ফিরেও যেতে পারবি না তোর আগের জাগায়। তোকে এই দুয়ের মধ্যটা বেছে নিতে হবে।
চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি বান্ধবী দের সাথে কথা বলে মনটা হাল্কা করতে। সাময়িক ভাবে যে উপশম হয়না তা নয়। সেটা একেবারেই সাময়িক। জানিস শশাঙ্ক জীবনের কোন মানে আমি আর খুঁজে পাই না। এইতো কিছুদিন আগেও যা ছিল আমার ধরাছোঁয়ার মাঝে আজ তা নাগালের বাহিরে। ম্রীতু কে এক সময় ভয় পেতাম, আজ পাইনা। বুকে বাথা উঠলে সবাই কে জাগিয়ে তুলতাম। আজ ভাবি ব্যথা টা বাড়েনা কেন।
শুভেন্দু, থামবি তুই। শশাঙ্কও ক্ষুব্ধ হয়। নইরাসশো ভাললাগে না আমার। তুই অতীত কে আঁকড়িয়ে ধরে বাঁচতে চাইছিস। তা হবার নয়। বর্তমান হচ্ছে তোর সমাধান। আমাকে দেখ, অতীত কে পরোয়া করি না, ভবিষ্যৎ কি কেউ জানেনা,। তোকে তাই করতে হবে। অতীত তোকে বারবার পিছে টেনে নেবে। ঝেড়ে ফেল অতীত কে। সামনে এগিয়ে চল।
শিউরে উঠে শুভেন্দু। কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে, পারবো না। পারবো না শশাঙ্ক। অতীত আমার সব। বর্তমান আমার সাঁকো। আমি সাঁকো পাড় হচ্ছি। কোথায়, কতদূরে এর শেষ আমি জানিনা। তবে একটা সত্য জেনে রাখ শশাঙ্ক এই সাঁকো পেরিয়ে জীবনের শেষ অব্দি আমি নাও পোঁছাতে পারি। মাঝ পথেই এই জীবনের সাঁকো আমি ভেঙ্গে দিতে পারি। জানি এটাকে মাঝ পথে ভেঙে দেয়া যায়, ভেঙ্গে দেয়া যায়। চমকে উঠল শশাঙ্ক। কী বলতে চাইছে শুভেন্দু? এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল তার বুক।
ওই আমার বাস এলো PATTAY যাওয়ার। উঠে পড়ল শুভেন্দু
চলি শশাঙ্ক। হয়তো আবার দেখা হবে কোথাও, কোন খানে।
শুভেন্দু। এক অসহায় কণ্ঠে ডাকল শশাঙ্ক।
বল, বাস স্টপের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে জবাব দিল শুভেন্দু।
জীবনের সাঁকোটা মাঝ পথে ভেঙ্গে দিস নেরে শুভেন্দু। ভেঙ্গে দিসনে।
দুদিন হয়েছে মালতী এসেছে তার বান্ধবির কাছে । তার স্বামী চা বাগানের ম্যানেজার। ঘুম না আসায় উঠে এসে দাড়িয়ে ছিল নির্জন বারান্দাটা তে। এক ফালি চাঁদের আলো এসে পরেছে সেখানে। জোনাকি পোকার আলো নিভছে জ্বলছে । মায়া ময় পরিবেশ। আধো আলো, আধো অন্ধকার। গভীর রাতের নীস্তবতা ভেদ করে করুন বাঁশির সুর মালতীর কানে পৌছে। মালতী স্তম্ভিত। এ সুর তার চেনা । অনেক আগে এ সুর সে শুনেছিল। বাঁশির সুর আকাশে বাতাসে আনে অনির্বচনীয়ের আহবান। এ সুর মালতীর অন্তরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে। মালতী ভাবে, কে এই বংশীবাদক ? বাঁশিতে বাজছে তার হারিয়ে যাওয়া গান গুলি । এক সময় নিস্তব্ধ হয়ে এলো সব। চাঁদের আলো নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু জোনাকির আলো।
এলোচুলে মালতী এসে দাঁড়ালো তার খাটের পাশে। কি এক অজানা ভয় তাকে শিহরিত করে তুললো। ফিরে যেতে চাইলো অনেক পিছনে। না এ হতে পারে না । এ হবার নয় । ভাবলো, সকাল হলে জিজ্ঞাসা করবে কে এই বংশীবাদক।
পাখীর কিচির মিচিরে মালতীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোরের সূর্যের আভা এসে পরেছে তার জানালায়। আকাশ টা লাল রং এ আচ্ছাদিত। আড়া মোড়া করে উঠে আসতেই বান্ধবীর ডাক শুনল সে। “ কিরে ঘুম হোল?”
‘ না, হয়নি। জানিস কাল রাতে দাঁড়িয়েছিলাম বারান্দায়। দূরে করুন সুরে কে জেনো বাঁশি বাজাচ্ছিল। বলতে পারিস কে?”
“ ও, উনি তো প্রতি রাতেই বাজায়। পাশের চা বাগানের ম্যানেজার। থাকে একলা। নিজেকে নিয়েই বাস্ত।”
আজ রাতে বাজালে, পারবি আমাকে নিয়ে যেতে ওখানে। মালতী বলে।
সে তো অনেক রাতে বাজায়। উৎকণ্ঠার সাথে বলে সুমীতা।
তা হোক , আমি যেতে চাই। দেখতে চাই উনাকে । প্রশ্ন করিস না কেন? তোদের ড্রাইভার কে বলিস সে জেনো আজ রাতে নিয়ে যায় আমাকে।
সুমীতা রাজি হোল। দু বান্ধবী বাকি সময় টা কাটিয়ে দিলো গল্প গুজব করে।
রাত তখন দু প্রহর। আধো রাতে শুনতে পায় বাঁশির সুরের আর্তনাদ। সেই চেনা সুর ছড়িয়ে পড়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন চা বাগানে ।
মালতী ডাক দিলো শম্ভু কে।
শম্ভু?
জি মা
আমাকে নিয়ে যেতে পারবে ঐখানে, যেখান থেকে ঐ গান ভেসে আসছে । জানো কোথায়?
জানি মা জি, শম্ভু বলে।
দু জনে বেড়িয়ে পড়ল গাড়ী তে করে। বেশি দূর নয়।
এসে গেছি মা জি, ঐ যে দেখছেন বাসাটা ঐখানে উনি থাকেন। বললও শম্ভু।
মালতী পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। কে সে যে একাকীত্ব ভাবে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি । পাশে মদের বোতল। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলো একটা ছবি তার সামনে।
মালতী পেছনে এসে দাড়াতেই বাঁশি বাজানো বন্ধ করে সে তাকাল মালতীর দিকে।
চাঁদের আলো এসে পড়েছে বাদকের মুখে। পলক পড়েনা চোখে। পাশে রাখা মোমবাতি টা উঁচু করে ধরল মালতী।
অনুপম তুমি ?
আমারও তো সেই প্রশ্ন, তুমি এখানে মালতী?
এসেছি দুদিন হোল বান্ধবীর বাসাতে। রাতে গানের সুর আমাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছিল। আমার চেনা সুর কে বাজাচ্ছে তাই দেখতে ছুটে এলাম।
অনুপম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, এই সুর তোমাকে শুনিয়েছিলাম ১২ বছর আগে। মনে পড়ে? দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো। অনুপম বলে মালতীকে।
ঐ ঝাপসা করে তোলা ছবি টা তোমাকে দিয়েছিলাম । আজও রেখে দিয়েছ দেখছি?
হা, ওটার সামনে বসে বাজায়ই। ফিরে যাই আমার ফেলে আসা দিনগুলিতে।
মনে পড়ে, তোমার ভাই এর সাথে তোমাদের বাসাতে এসেছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তুমি এস,এস,সি পরীক্ষা দেবে।
মনে পড়বে না কেন? মালতী ফিরে যায় অতিতে। অপু ভাই তোমাকে বলেছিল, অনুপম তুই কি আমার এই মাথায় গোবর পোড়া বোনের মাস্টার হতে পারবি?
মনে পড়ে, আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। সেইতো শুরু। প্রতিদিন আসতাম, তোমার গোবর পোড়া মাথায় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অংক, ঢোকানোর চেষ্টা করতাম। তুমি বলতে, আমার দাড়া কিচ্ছু হবেনা অনুপম দা। কিন্তু হয়েছিল। তুমি ভালভাবে পাশ করেছিলে।
বলেছিলাম, এবার আমার পাঠ চুকল। এর আসতে হবেনা তোমাদের বাসাতে।
তুমি কি বলেছিলে মনে পড়ে?
পড়ে বৈকি? বলেছিলাম, বাসাতে না হয় নাই এলে, বাহিরে তোমার সাথে দেখা হবে। কখন যে আপনি থেকে তুমি তে চলে গেছি আমি নিজেও জানিনা। তুমিও আমাকে শুধরিয়ে না দিয়ে বলে ছিলে ,” দেখা হবে কাল ১২ টায় বলাকার সামনে”। দুটা বছর কোন দিক দিয়ে চলে গিয়েছিল আমরা নিজেরাও জানিনা।
মালতী, তুমি রবীন্দ্র সংগীত ভালবাসতে। আমার গলায় সুর নেই। তাই ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো। ভর্তি হয়ে ছিলাম গানের স্কুলে। বাঁশি শিখতে। তুমি জানতে না। হাতে খড়ী শেষ হবার পর তোমাকে নিয়ে বসেছিলাম এক নির্জন মাঠে । তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে , তোমার হাতে ওটা কি ? বলেছিলাম, এখানে বোসো। চোখ বন্ধ করো। আমি বাঁশিতে গান ধরে ছিলাম “ ঐ মালতী লতা দোলে,—“ গান শেষ হলে তুমি অনেকক্ষণ কেঁদে ছিলে ।
বাসাতে যেয়েও কেঁদেছিলাম। কেন জানিনা। তারপর, তারপরের ঘটনা মনে আনতে চাইনা। যুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠল। সব কিছু লনড ভনড হয়ে গেল। বাবা বাসাতে তালা লাগিয়ে দূরে গ্রামে মামার বাসায় আমাদের কে নিয়ে চলে এলো। তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না । তুমি কি ভাবে আছো তাও জানতে পারলাম না ।
জানো মালতী, সাত দিন পর আমি গিয়েছিলাম তোমাদের বাসাতে। দেখলাম তালা ঝুলছে। কাউ কিছু জানেনা। আমি অস্থির হয়ে অনেক্ষখন পায়চারি করেছিলাম। অনেক খুঁজেছি তোমাকে, পাইনি। প্রতি সপ্তাহে গেছি তোমাদের পাড়ায় । দেখেছি তালা বন্ধ। মাসের পর মাস পেড়িয়ে গেছে। আমার বন্ধু, মহসিন, তুমি তাকে চেনো, খবর দিয়েছিল তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এক ইনজিনিয়ারের সাথে। বিশ্বাস করিনি।
ঠিকই শুনেছিলে। আমার করনীয় কিছু ছিলনা । ভাইয়া চলে গিয়েছিল মুক্তি যোদ্ধা হয়ে। খবর এসে ছিল সে আর নেই। বাবা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় মামা এক প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, উনার বন্ধুর ছেলে, ইনজিনিইয়ার। বাবা রাজি। সেদিন স্বার্থপরের মত তোমার কথা আমি ভাবিনি। দেখেছিলাম বাবা মার চোখে জল। ভাইকে হারানোর ব্যেথা। তোমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম । আকাশ কে নিয়ে ঘর বেধে ছিলাম। চলে গিয়েছিলাম জার্মানিতে।
সে খবর আমি পেয়েছিলাম। আঘাত যে পায়নি সে কথা বললে ভুল হবে । তবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরীপেক্ষীতেই তোমাকে এ পথ বেছে নিতে হয়েছিল। চলে গিয়েছিলাম লন্ডনে পিএইচডি করার জন্য। ফিজিক্সে পিএইচডি করে ফিরে আসেছিলাম চার বছর পর।
ফিজিক্সে পিএইচড করে আজ তুমি চা বাগানের ম্যানেজার। কেন?
কোন কিছুতেই মন বসছিলো না, ভাবলাম দূরে কোথাও একাকীত্ব ভাবে জীবন কাটাবো। এক বন্ধুর সাহায্যে এই চাকরি টা পেয়েছিলাম। এবার তোমার কোথা বল।
এতো রাতে কর্তা আসতে দিলো।
সে নেই । চলে গেছে দুবছর হোল। তালা ঝোলা সেই বাসাতে থাকি। তুমি বোতল ধরলে কেন ? কেন নিজেকে শেষ করে দিলে এভাবে ।
সে কোথা থাক। অনেক রাত হোল। তোমার ফিরে যাওয়া উচেৎ।
আবার দেখা হবে কি? মালতীর জিজ্ঞাসা।
আজ থাক
মালতী চলে গেল। পেছন ফিরে চেয়ে ছিল বার বার। অনুপম দাঁড়িয়ে ছিল যতক্ষণ না গাড়ীটা মিলিয়ে যায়।
সকালে চা র পেয়ালায় চুমুক দেওয়ার আগেই মালী এসে বললও, “ মা জী আপনার চিঠি। “
আমার চিঠি? মালতী আশচার্জিন্নত হোল।
হা মা জী, ডেরাইভার দিয়ে গেল
চিঠি খুলল মালতী, “ তুমি জানতে চেয়ে ছিলে দেখা হবে কি না। না, মালতী, তোমার যে মূর্তি আমি গেঁথে রেখেছি আমার হ্রদয়ে সেটাকে ভাঙতে দিতে চাই না । যে দোলনায় আমরা দুলেছিলাম তাকে ছিঁড়তে চাইনা। আমার প্রেম থাকুক আমার মনের মাঝে নিষ্কলঙ্ক হয়ে। তুমি হারিয়ে যাওনি। রাতের অন্ধকারে তোমাকে ফিরে পাই আমার সুরে। তুমি আছো, তুমি থাকবে। বিদায়।”
দু ফোটা চোখের জল ঝরে পড়ল চা র পেয়ালার উপর। সে রাতে করুন সুরে বাঁশি আর বাজেনি.
রাফিকের মনটা আজ অস্থির। কাজে অনেক ঝামেলা হয়েছে। বড় সাহেব ডেকে পাঠিয়েছিল। বলল,” রাফিক সাহেব আপনার কাছ থেকে আমি এই রকম ভুল আশা করিনি। আপনি চৌকশ, বুদ্ধি দীপ্ত লোক। কি ভাবে হোল এই ভুল?” রাফিক জানেনা, কেন? শুধু জানে শোভার সাথে কয়দিন ধরে মনমালিন্য চলছে। হয়তো শে কারণে কাজে মন বসাতে পারেনি। শোভা তার স্ত্রী নয়, প্রেমিকা। দুবছর হোল পরিচয়। ইদানীং সে উপলব্ধি শোভা তার কাছ থেকে জেনো দুরে চলে যাচ্ছে। হয়তবা মনের ভুল। তাই বা কেন? যখন সে তাকে কোথাও যাবার কথা বলে শোভা এড়িয়ে যায়, কোন একটা অজুহাত দেয়। এটাতো আগে ছিলনা। তাই রাফিক ঠিক করেছে আজ সে একটা বোঝাপড়া করবে। আসতে বলেছে তুং শিং রেস্টুরেন্টে, বিকেল পাঁচ টায়।
যথা সময় রাফিক হাজির। ভিতরে যেয়ে দেখে এলো শোভা এসেছে কি না। না সে নেই। রাফিক বাইরে অপেক্ষা করলো। অস্থির ভাবে পায়চারি করতে থাকলো। মনে মনে ভেবে রেখেছে কি সে জিজ্ঞাসা করবে। বেশী কঠোর হওয়া যাবেনা। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। শোভা তার মনের মধ্যে অনেক খানি অংশ দখল করে রেখেছে। এটা অস্বীকার করা যাবেনা। ঘড়ি টা দেখলো রাফিক। আধা ঘণ্টা পেড়িয়ে গেছে। টাইম মেনটেন শোভা কোনদিন করেনি। কাজেই সে বিচলিত হলনা। দুরে একটা কাপলের অঙ্গ ভঙ্গি দেখে সে বিরক্ত হোল। এ ধরনের দৃশ সে দেখে অভ্যস্ত। তবুও রাফিকের কাছে এটা দৃষ্টি কটু লাগে। সে আর শোভা হাত ধরা ধরি করে হেঁটেছে, গলা জড়িয়ে নয়। তার মতে এ ধরনের দৃশ্য ঘরেই শোভা পায়, রাস্তায় নয়। রফিক ভাবে সে কি সেকেলে হয়ে গেছে। বয়স তার তিরিশের কোঠায়। অধিক আধুনিকতা তার কাছে বিরক্তিকর লাগে। ঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো। না শোভা এলো না। দুঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো। এবার যাওয়ার পালা।
শোভা আজ আর আসবেনা। তা সে যেই কারণেই হোক। রাফিক অশ্তীর। ফোন করতে চাইলো। না ভুল করে ফোন টাও ফেলে রেখে এসেছে। গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল রফিক। এমন তো হয়নি আগে। দেরী করতো কিন্তু আসেনি তা হয়নি কখনো। অনেক কিছু তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আজ সে বাসাতে তাড়াতাড়ি ফিরবে না ঠিক করলো। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরবে। গাড়ীর কাটা ৭০ এর ঘর পেড়িয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। শেষ মুহূর্তে রাফিক যেখানে এসে পোঁছিলো আগে সে কখনো আসেনি। মনে করতে পারেনা কোথায় কোন টার্ন সে নিয়েছিল। অন্ধকার চারিদিকে। বাসা ঘরের অস্তিত্ব সে দেখতে পেলো না। নির্জন। হটাৎ তার গাড়ীর সামনে দিয়ে একটা হরিণের বাচ্চা দোড়িয়ে গেলো। ছমছমে ভাব।
রাফিক ভীতু নয়। তবুও চতুরদিকের পরীস্তীতী তাকে ভাবান্বিত করছে। জানেনা সে কোথায়। দুরে একটা আলো জ্বলতে দেখল সে। বেশ দুরে। গেট টা খোলা। ঢুকে পড়লো সে। ওখানে যেয়ে জিজ্ঞাসা করবে কীভাবে সে ফিরে যাবে। না এটা বাড়ী নয়। অফিস মনে হচ্ছে। চারিদিকে ধুধু মাঠ। পীচ কালো অন্ধকার। রাফিকের গাটা ছমছম করে উঠল। কিছু দুরে দুরে ছোট ছোট আলো জ্বলছে নিভছে। পাশের গাছ থেকে একটা বড় পাখি পাখার ঝাপটা দিয়ে উড়ে গেলো।
এ কোথায় সে এসে পড়েছে। দুরে দেখা মিট মিট আলোর কাছে সে এগিয়ে গেলো। ফলকে লেখা “ পারভিন হোসেন”। এতো কবরস্তান। ঘুমন্ত সবাই। শুয়ে আছে এখানে। ছোটো বেলায় দাদী নানী শ্মশানের কথা বলে ভয় দেখাতো। ভুত পাত্নী নাচা নাচি করে শুনেছিল। আজ সে নিজেই সেখানে।
একটা দমকা হাওয়া রাফিকের মুখে ঝাপটা মাড়লো। আমাবস্যার রাত। আকাশে তারার ঝীলী মিলি ততটা নয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন। এ এক মায়া ময় পরিবেশ। দুরে একটা কান্নার মত শব্ধ কানে এলো রাফিকের। বুঝতে চেষ্টা করলো কোথা থেকে আসছে। মিলিয়ে গেলো ক্ষণিকের মধ্যে। গা টা শিরশির করে উঠল রাফিকের। শোঁ শোঁ বাতাসের শব্ধ। নির্জন অন্ধকার ময় মাঠে সে একা। ভুলে গেলো শোভার কথা, ভুলে গেলো কাজে যা ঘটেছে তার কথা। রফিকের মাঝে দারশনিকতার ভাব এসে জোড়ও হোল।
ভাবল এই খানে যারা শুয়ে আছে তারা একদিন আমাদের সাথে পায়ে পায়ে হেটে ছিল। দুঃখ কষ্ট আনন্দের মধ্যে কাটেয়ে ছিল দিন গুলো। সব ছেড়ে আজ নির্জন মাঠে শুয়ে। দেড় বছরেরে মেয়ে টা যে কিনা পৃথিবীর আলো দেখতে পেলোনা ভালভাবে সে শুয়ে আছে তার বাবার থেকে কিছু দুরে। দিনের আলো যখন নিভে আসে, সব পাখি যখন ঘরে ফিরে যায়। নেমে আসে অন্ধকার, তখন কি তার বাবা তাকে কোলে করে বলে,” মা, আমি তো তোড় জন্যই এসেছি এখানে”। দেড় বছরের মেয়েটা বাবার কোলে মুখ গুঁজে বলে,” আমি তো তোমার আদর না পেয়েই চলে এসেছিলাম বাবা”। এমন কি হয় এখানে ? যে বউ তার ভালবাসার স্বামী কে রেখে এসেছে, যে তার কোলের ধন রেখে এখানে ঘুমিয়ে আছে তারা কি শুনতে পায় ফেলে আসা ওদের আর্তনাদ। রাফিক জানেনা। শুধু জানে এই বিশাল মাঠে যারা শুয়ে আছে তারা সব এক। কোন ভেদা ভেদ নেই। গরীব, ধনী, ছোটো,বড়, ছেলে, মেয়ে সব এক গোত্রের। এখানে নেই কোন দল, নেই কোন কন্দল। এরা কি নিজেদের মধ্যে কথা বলে ? আফসোস করে ফেলে আসা দিন গুলোর জন্য ? রাফিক জানতে চায়। উত্তর নেই।
এ এক শান্তির পরিবেশ মনে হোল রাফিকের কাছে। একে অপরকে দাবিয়ে উপরে উঠার সংঘাত নেই। নেই হিংসা। জীবনের সব লেটা চুকিয়ে এই খানেই এসে একদিন আশ্রয় নিতে হবে সে কথা কেউ বুঝতে চায়না, শুনতেও চায়না।
একটা হাতের স্পর্শ রাফিক তার কাঁধে অনুভব করল। হাতটা সরছে না তার কাঁধ থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখার সাহস সে সঞ্চয় করতে চাইল। বুকের দপদপানি টা বাড়ছে। হয়তো এই হাত টা কাঁধ থেকে গলার কাছে আসবে। তারপর সঙ্কুচিত হতে থাকবে তার শ্বাসনালী। নীল হয়ে যাবে তার সাড়া দেহ। কেউ জানবেনা সে কোথায়। সে হয়ে যাবে ওদের একজন।
“ এখানে রাতে আসা নিষেধ”। চমকে উঠল রাফিক। এতো কথা বলছে। স্পষ্ট ভাবে। তাহলে সে ওদের একজন নয়। ও আমাদের একজন। ফিরে তাকালো রফিক। ছ ফুট লম্বা। হাতে টর্চ লাইট। “ এখানে এতো রাতে কেন”? প্রশ্ন তার। “ পথ হারিয়ে, এই আমার ঠিকানা, ফেরে যাব কি ভাবে?”
দেখে ছিলেম তাকে রান্না ঘরের মেঝেতে বসে পিয়াজ ছুলতে , দেখে ছিলেম দৌড়ে যেয়ে নীচের থেকে বাজার নিয়ে আসতে। কাছে এসে বলতে শুনেছিলেম “ মামা, তোমার কফির পানি হয়েছে, খাবেনা ?”
বলেছিলাম,” এতো দোড় দোড়ি করছিস কেন? একটু বোস।”
বলেছিল সে,” বসব আমি রাত নটায়, তখন আরম্ভ হবে আমার সিরিয়াল টা।”
বলেছিলাম, ‘’ রাত হবে অনেক, বাড়ী যেতে ভয় পাবিনা?”
“ না মামা, ভয় আর পাই না , যেদিন চড় খেয়ে ছিলাম স্বামীর হাতে।”
বিয়ে হয়ে ছিল ১৩ বছর বয়সে। দুই ভাই এক বোন এর মধ্যে দিলারাই বড়।
বাবার সংসারে স্বচ্ছলতা না থাকায় মেয়ে কে পাড় করে দিতে হয়েছিল ১৯ বছরের এক ছেলের সাথে। রিক্সা চালক, থাকে ঢাকা তে। বস্তীর এক ছোট্ট ঘরে এসে ঠাই নিয়ে ছিল দিলারা । বশীর কর্মঠ। সকালে বেড়িয়ে যায় রিক্সা নিয়ে। ফেরে রাতে। দিলারা পথ চেয়ে বসে থাকে। যে মেয়ে কিছুকাল আগেও পুতুল নিয়ে খেলে ছিল আজ সে সংসারি। ভাতটা, ডাল টা, তরকারী টা তয়রী করে রাখে, কখন বশীর আসবে ক্লান্ত হয়ে।
এটাই নিয়ম। ১৩ বছরের মেয়ে বুঝে নিয়ে ছিল সংসার কি। ঘিঞ্জি বস্তীর চারিদিকে দূরগন্ধ ময় পরিবেশের মধ্যেও দিলারা খুঁজে পেয়ে ছিল সুখের সন্ধান। অবসর দিনে বশীর দিলারা কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ত ওর রিক্সায়। দেখাতো বড় বড় দালান, বড় বড় বাড়ী, সিনেমা হল আরও কতো কি।
দিলেরা একটা ছুটা কাজ নিয়ে ছিল বাসার কাছে। সকালে যেয়ে ধোঁয়া মোছার কাজ সেরে ফিরে আসত দুপুরের মাঝে।
দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর পেড়িয়ে গেল। দিলারার কোলজুড়ে এলো এক ফুটফুটে মেয়ে। কাজ সেরে ক্লান্ত বশীর মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বস্তীর মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। দিলার
বাড়ে ভাত।
মেয়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে বশীর ও পাল্টে যেতে থাকল। রাত করে বাসায় ফেরে। মুখে মদের গন্ধ। কোন কোন দিন না খেয়ে শুয়ে পড়ে। জিজ্ঞাসা করলে বলে,” খেয়ে এসেছি।”
“ কোথায়?”
“ সে কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে?” ঝঙ্কার মেরে ওঠে বশীর।
দিলারা আড়ালে যেয়ে চোখের জল ফেলে।
মেয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হতে থাকল আর দিলারার ঘুণে ধরা সংসারের ফাটল বাড়তে থাকল। বশীর কোন কোন দিন রাতে আসত না। মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে ধরে দিলারা রাত কাটিয়ে দিতো।
মতির মা বস্তির আদিবাসী । বয়স হয়েছে। সব ঘরের খবরা খবর সে জানে। লোকে তাকে বাংলা বেতার নাম দিয়েছে। এক পড়ন্ত বেলায় দিলারার দরজার সামনে এসে ডাকল ,” ও পদ্মার মা, ঘরে আছো।” দিলারা দরজা খুলে মতির মা কে দেখে বিরক্ত অনুভব করলো। সে জানে মতির মা এমনি আসেনি। নিশ্চয় কোন পরোনিন্দা কর খবর নিয়ে এসেছে।
“ কি ব্যপার ? এই বেলায়।” দিলারার কথা শেষ হওয়ার আগেই মতির মা বসে পড়ল দরজার সামনের ছোট্ট জাগাটা তে।
“ বলি কি পদ্মার মা, খবরা খবর কিছু রাখো?”
দিলারার বুঝতে অসুবিধা হলনা কোন দিকে মতির মা এগুচ্ছে। হৃদকম্পন বেড়েই চলেছে।
মনে হচ্ছে সামনের সব কিছু হলদে রং এ আচ্ছাদিত। পাকস্থলীতে ছোট ছোট পোকা গুলো শুর শুরি দিচ্ছে মনে হোল দিলারার। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,” কি খবর মতির মা।”
“ তোমার নাংর, বশীর, ঠাঠারি পাড়ায় আর এক সাং নিয়ে থাকে, তা জানো।”
পোকা গুলো এখন উপরের দিকে আসছে মনে হোল দিলারার। মনে হচ্ছে ঘুমে তার চোখ বুজে আসছে। মাথার শিড়াটা দপ দপ করছে।
“ আমাকে নিয়ে যেতে পার সেখানে, মতির মা?” কর্কশ কণ্ঠে বললও দিলারা।
“ তা পারবো না কেনে ? আমার ছোট নাতিকে দিয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি”। এই বলে মতির মা উঠে পড়ল।
দিলারা পৌছিয়েছিল ভর সন্ধ্যায় ঠাঠারি পাড়ার সেই বাসাটার সামনে। দরজায় টোকা দিতেই আলু থালু বেশে এক মেয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল। “ কি চাই?”
বশীর কোথায় ? উচ্চও কণ্ঠে দিলারা প্রশ্ন করেছিল। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই বশীর এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে। “ এখানে কেন?” ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করলো বশীর।
দিলারর শরীর রাগে দুঃখে থর থর করে কাঁপছে। “ বৌ মেয়ে রেখে এখানে এসে আনন্দ ফুর্তি করছ ?”
বশীর কোন কথা না বলে একটা থাপ্পড় দিয়েছিল দিলার গালে। দিলারা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসেছিল বাসাতে। মেয়ে টাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিল অনেক।
“ না, কাঁদলে হবেনা, আমাকে বাঁচতে হবে।” এই ছিল তার পণ। এই শপথ নিয়ে দোরে দোরে গিয়েছিল কাজের জন্য। মুখ ঝামটা শুনেছে, কেউবা ভিখিরি বলে দু মুঠো চাল দিতে চেয়েছে। অশোভন ইংগিত যে পাইনি তা নয়।
তিন বেলা খাবার জোটেনি অনেকদিন। তবুও মনোবল হারায় নি সে। হারায়নি আস্তা উপর ওয়ালা থেকে ।
দাঁড়িয়ে ছিল একদিন এক বাড়ীর গেঁটের পাশে। দারওয়ান ঢুকতে দেইনি। সুতীর শাড়ী পরা এক ভদ্রমহিলা ঢুকতে যেয়ে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। দিলারার চোখের চাউনিতে ছিল ব্যদনা। ভদ্রমহিলা থমকে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। দিলারা বলেছিল,” মা কাজ চাই।”
উপরওয়ালার কলকাঠি নাড়া কে বুঝবে। দিলারা কে কাজ দিয়েছিল। তাও তো অনেক বছর হয়ে গেল।
সেই বাসাতেই আমার সাথে দিলার দেখা। বলেছিল,” জানো মামা সেই হারামজাদা ফিরে এসেছিল আমার কাছে কয়েক মাস আগে। আমি তাকে ঢুকতে দেইনি বাসাতে। শুনেছি শুধু মদে নয়, এখন ড্রাগেও তার আসক্তি।”
আরও বলেছিল, মেয়েকে সে প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করবে। করেও ছিল, করেছিল উপরওয়ালার দোয়া আর মুনিবের সাহায্যে।
ওর চোখে দেখেছিলাম ভব্যিষতের নেশা। উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি। সামান্য এক মেয়ের কঠোর সাধনা। কতক্ষণ অন্য মনস্ক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানিনা।
মনে হোল এক পাখা ভাংয়া পাখি আবারো উড়তে চাইল। জড়িয়ে নিলো তার পাখার ছায়ায়
ছোট্ট শিশুটিকে। বললও, “ আমি উড়তে পারিনি, তুই পারবি। তুই উড়বি ওই বিশাল আকাশের মাঝে।”
মামা ,
কিরে
কি ভাবছ? তোমার কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
হা খাবো।
শোন, কাল আমার যাওয়ার পালা। ভালো থাকিস।
সে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ওর চোখের কণে ছোট্ট জ্বলের কণা। ও জল নয়।
হীরের কণা। যার রস্মি ওকে পথ দেখাবে। চলে গেল সে তার কাজের জগতে। আমি কফির পেয়ালায় চুমুক দিলাম।
কলকাতায় এসেছি বেশ কিছুদিন হোল। পুরানো কাগজ পত্র ঘাটতে যেয়ে পেলাম অনেক আগের সাদা কালো একটা ছবি। দিলিপ, শিবু, আর আমি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শিবু দের কে চলে যেতে হয়েছিল ভারতে। তারপর আর খোজ পাইনি। শুনে ছিলাম সে কানপুরে আছে। সঠিক জানিনা। মনে হোল যোগা যোগ টা করতে পারলে একবার ঘুরে আসা যেতো। দিলিপ কে ফোন করলাম। সে হয়তো জানতে পারে।
ফোন টা উঠাতেই বললাম, “ দিলিপ, আমি সজীব বলছি”
তা কি মনে করে”। “
শোন, তুই কি জানিস শিবু কোথায়? আমি কলকাতায়। ভাবছি যদি সম্ভব হয়, তবে ওর সাথে দেখা করবো।”
“ মাস ছয়েক আগে সে এসেছিল। দাড়া, ওর নাম্বার টা দিচ্ছি।”
নাম্বার টা পেয়েই সাথে সাথে ডায়েল করলাম। ওপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো,” আপ কোন হ্যাঁয়”
সমস্ত খবরাখবর নিয়ে বললাম,” আজ বিকেলের ট্রেনেই রওয়ানা হচ্ছি। তুই স্টেশনে থাকিস।”
অনেক দিন পরে দেখা হবে। অজানা আনন্দে মনটা ভরে উঠল।
যথারীতি শিয়ালদহ স্টেশনে চলে এলাম। ট্রেন ৪ টা ৫০ মিনিটে ছাড়বে দিল্লীর দিকে, মাঝে কানপুর। লোকজনের আনাগোনা অতটা নয়। শীতের বিকেল। ট্রেনে লম্বা জার্নির কথা অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম। যাক, আজ তা পূরণ হতে চলেছে। কামরা টা পরিস্কার, পরিচছন্ন। সব মিলে আমরা গোটা দশ জন লোক। জানালার পাশের সীট আমার সবসময় প্রীয়। Steve Jobs এর আত্মজীবনী বই টা খুলে বসলাম। অনেক দূরের পথ। কথা বলার সঙ্গী সাথী না থাকায় বই একমাত্র সম্বল আমার। ঘণ্টা দুই পেড়িয়ে ট্রেন এসে থামল দুর্গাপুর এ। দু এক জন যাত্রী উঠা নামা করলো।
“ বসতে পারি”। বাংলায় প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে দেখি, মধ্য বয়স্ক এক ভদ্রলোক। পরনে সাদা পাঞ্জাবী উপরে কোর্তা। এই ঠাণ্ডার উপযুক্ত পরিচছদ নয়। বললাম,” নিশ্চয়”। ভদ্রলোক বসলেন। “ কি বই? প্রেমের না অন্যকিছু।” প্রশ্ন টা আমার মনপুত নয়। বললাম ,” জীবন কাহিনী”। আমার চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ ভালবেসেছেন কাউকে কোনদিন।” একটু বিরক্ত অনুভব করলাম। নিতান্তই পার্সোনাল ব্যাপার। তবুও বলতে ব্যাধ হলাম, “ হা, বেসেছিলাম”। উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। আনমনা। দ্রীস্তী মনে হোল অনেক দুরে প্রসারিত।
হঠাৎ ই বললেন, এই, এই স্টেশন থেকেই সে উঠে ছিল।
“ কে, কে উঠেছিল?”
“আকরাম”
“ আকরাম কে?”
আকরাম আহমেদ, কাজ করতো দিল্লি তে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টএ। আপনি যে সীট টাতে বসে আছেন, ওই টাতে সে বসে ছিল। সে কি জানতো দু ঘণ্টা পরে তার জীবনের অধ্যায় অন্যভাবে লেখা হবে। বলতে থাকলেন, স্টেশন বারাকরে ট্রেন থামতেই উঠে এলো নীল রং এর কামিজ পরনে, গায়ে লাল সাল জড়ানো মেয়েটি। বসলো, ওই যে ভদ্রলোক বসে আছেন ওই সীট টাতে। দুজনে মুখোমুখি না হলেও চোখের দ্রীস্তীর বাহিরে নয়। দু একবার যে চোখাচোখি হয়নি তা নয়। দ্রীস্তীকটু হবে বলে আকরাম আর তাকায়নি ওর দিকে। তবে দেখা হয়ে ছিল ট্রেনের ক্যান্টিনে। নাম মল্লিকা। মল্লিকা ব্যানারজি।
আকরাম ইতস্ত করে বলেছিল,” চা খেতে আপত্তি আছে? একসাথে।” মল্লিকা না করেনি। চা র পেয়ালা শেষ করতে করতে কথা হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। জেনে ছিল মল্লিকা দিল্লীর এক কলেজে পড়ে। এসে ছিল বাড়ীতে ছুটির সময়। নিজেদের কামরায় আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ক্যান্টিনে কাটিয়ে ছিল পুরো সময় টা। ট্রেন দিল্লী তে এসে পোওঁছালো সকাল ১০ টা ২২ মিনিটএ।
এবার বিদায়ের পালা। আকরাম বলেছিল,” আমি যাবো ডালহোসী পাড়ায়। আপনার কোন আপত্তি না থাকলে আমি নামিয়ে দিতে পারি”। নেমে যাওয়ার আগে আকরাম ওর বিজনেস কার্ড টা মল্লিকা কে দিয়ে বলেছিল, “ সময় পেলে ফোন করেন।” সেই ফোন এসেছিল দশদিন পরে, রাত ৮ টায়।
“ কেমন আছেন? চমকিয়ে উঠলেন তো?” কথা গুলি আকরামের কানে সেতারের মত রিন ঝীন করে বাজলো ‘ না না চমকাবো কেনো? আপনার কথা মনে হচ্ছিল।” কথা টা বলেই সে বুঝতে পারলো, বলাটা ঠিক হলো না। একবার মনেও হয়ে ছিল, যেখানে মল্লিকা কে নামিয়ে দিয়ে এসেছিল সেই বাসায় যেয়ে দরজায় কড়া নাড়াবে কিনা। না পরে সেই চিন্তা বাস্তবে আনেনি। আজ তার মনে হোল এতো মেঘ না চাঁইতেই জল।
আকরাম সাহস সঞ্চয় করে বললও,” কাল বন্ধের দিন, এক সাথে বসে যদি লাঞ্চ করি আপত্তি আছে কি?”
না নেই। কোথায় দেখা হবে। কখন ? ও প্রান্ত থেকে জবাব আসে ।
লরেন্স স্ট্রীটের কর্নারে। দুপুর ১২ টায়
রাতটা যে কিভাবে কেটেছে আকরাম নিজেও জানেনা। ভোর হতেই হাতের কিছু কাজ শেষ করে তয়রি হয়ে নিলো। ঠিক ১২ টায় লরেন্স স্ট্রীটের কর্নারে সে হাজির। মল্লিকা তখনো আসেনি। ভাবছিল আদ্যও সে আসবে কি না। ভুল হয়ে গেছে, কালকে ফোন নাম্বার টা নেওয়া হয়নি। অস্থির হয়ে আকরাম ঘড়ি টা দেখল। ১২ টা ৫ মিনিট। ঠিক সেই সময় মল্লিকের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। “ দেরী হয়ে গেল, তাই না?”
“না, না দেরী কোথায় , মাত্র তো ৫ মিনিট,” চলেন, মেডিটেরিয়ান ফুডে কোন আপত্তি নেই তো?”
না নেই।
ওরা যেয়ে বসেছিল সেভিলা- দি ক্লারিজ এ। দুদিনের দেখাতেই মনে হয়েছিল ওরা দুজনে অনেক কাছের। মনের মিল খুঁজে পেয়েছিল দুজনে। বিকেলের পড়ন্ত বেলাতে হেঁটে ছিল ইনডিয়া গেট এর লনে। আইস ক্রিম খেতে খেতে ঠিক করেছিল আবারো মিলিত হবে দুজনে কোথাও কোনো খানে।
সেই শুরু। দিন শেষে মাস, মাস শেষে বছর কেটে গেছে। হেঁটেছে দুজনে কণাট প্লেসে। মল্লিকার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল লোডি গার্ডেনে। গুনগুন করে গেয়ে ছিল বেসুরো গলায়,” আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি।”
এই চলার যে শেষ কোথায় সেটা ওরা বুঝতে পারিনি। ফাইভ সেনস গার্ডেন এ বকুল গাছটার নীচে বসে মল্লিকা বলে ছিল আকরাম কে,” বাবা মেনে নেবেনা অন্য গোত্রের ছেলেকে।”
আমি যেয়ে তোমার বাবা কে বলবো
তুমি আমার বাবা কে চেনো না। আমি জানি না , এর পরিনিতি কোথায়।
কিন্তু দুজন দুজন থেকে প্রিথক হওয়ার সম্ভবনা নেই। গোত্র, সংসকার আজ বাধা হয়ে দাড়িয়েছে দুজনের মধ্যে। মল্লিকা আকরামের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “ ছুটিতে বাড়ী যেয়ে বাবাকে সব বলবো। দেখি কি হয়।”
বাবা কে সে বলেছিল। বাবার এই অগ্নি মূর্তি সে আগে কখনো দেখিনি।
“ মেয়ে কে আমি জলে ভাসিয়ে দেবো তবুও মুসলমান ছেলের সাথে বিয়ে দেবোনা।” মল্লিকা কে সে আর ফিরে যেতে দেয়নি দিল্লীতে। ছুটির সময় পেড়িয়ে গেলো। মল্লিকা এলো না। একদিন ভোরের ট্রেনে আকরাম রওনা হয়ে গিয়েছিল বারাকরের পথে। লোকের কাছে পথের নির্দেশ নিয়ে সে এসে দাঁড়িয়েছিল ব্যানার্জির বাসার সামনে। কড়া নাড়তেই, কর্কশ স্বরে কেউ উঠল, “ কে, কি চাই?” আকরাম নরম সুরে বলল, “ আমি?”
আকরাম ভদ্র চিত্ত গলায় বলল, “ একবার মল্লিকের সাথে দেখা করতে পারি।”
এ যেন আগুনে ঘি ঢালার মত। চিৎকার করে উঠলেন হবুনাথ ব্যানার্জি। “ মেয়ে কে আমি দু টুকরো করে জলে ফেলে দেবো তবু তোমার হাতে দেবোনা”।
চিৎকার শুনে দু একটা মাস্তান গোছের ছেলে এসে জোড়ও হোল। মল্লিকার ছায়া আকরাম সেদিন দেখতে পায়নি। ভগ্ন হ্রদয় নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করেছিল। ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে সে। একবার যদি মল্লিকার সাথে দেখা করতে পারতো। চিন্তা গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাঁচছে। আমবাগান টা পাড়
হওয়ার আগেই একটা প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়ল আকরামের মাথায়। জ্ঞান হারিয়ে পরেছিল সে।
যখন চোখ মেলে চাইল ঝাপসা ভাবে দেখতে পেলো এক মেয়ের মুখ।
মল্লিকা!
উত্তেজিত হবেন না। আমার নাম সঙ্গীতা। নার্স।
আমি কোথায়, জিজ্ঞাসা করলো আকরাম
আপনি কামার দুবী হাসপাতালে। মাথায় আঘাত পাওয়াতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন রাস্তায়। কয়েকজন মিলে নিয়ে গিয়ে ছিল ওখানকার এক ক্লিনিক এ। সেখান থেকে ট্রান্সফার করে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। ৫ দিন
পরে আপনের জ্ঞান ফিরেছে।
বারকরের মল্লিকার খবর জানেন?
না, আমি তো ওখানকার নই।
আরও দশ দিন লেগে গিয়েছিল কিছু টা সুস্থ হয়ে হাঁসপাতাল থেকে বেড়িয়ে আসতে। জিজ্ঞাসা করেছিল বারকরের ক্লিনিক এর নাম। গিয়েছিল আকরাম সেখানে। খোজ নিয়েছিল মল্লিকার। জেনে ছিল দিন পাঁচেক আগে সে আত্মহত্যা করেছে। লিখে রেখে গেছে,” আকরাম যে পথে গেছে আমি সেই পথেই চললাম।”
আকরাম খুঁজেছিল শ্মশানের আনাচে কানাচে। কোথায় তার শেষ ক্রীত সম্পন্ন হয়েছিল জানতে। খোজ পায়নি। ফিরে গিয়েছিল স্টেশনে।
এর পর আকরামের খোজ আর কেউ সঠিক ভাবে দিতে পারেনি। তবে শোনা যায় সে দূরে এক মিশনারিতে কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিল। দুস্ত মানুষের সেবা করতো। কলকাতার কুষ্ঠ সেন্টারে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল। তাও তো অনেক দিনের কথা। অনেকে বলে প্রতি বছর ২৫ শে জানুয়ারি সে বারকর স্টেশন আসে। শ্মশানে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়।
২৫ শে জানুয়ারী কেন ?
ওই দিনই তো ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ আমার স্টেশন এসে গেছে, চলি। সালাম।”
ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। বাহিরে ঘন কুয়াশা। মনে হচ্ছে সাদা চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে স্টেশনটা। তাকিয়ে ছিলাম জানলা দিয়ে। কুয়াশা ভেদ করে আবছা আলোর রস্মী এসে পড়েছিল স্টেশনটার নামের ফলকের উপর। বারাকর।
চমকিয়ে উঠলাম। এই তো সেই বারাকর।
সামনে বসা ভদ্রলোক কে জিজ্ঞাসা করলাম, আজ কত তারিখ ?
২৫ শে জানুয়ারী।
২৫ শে জানুয়ারী , বারাকর।
হন্তদন্ত করে গেলাম দরজার কাছে। ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে। দূরে একটা ছায়া দ্রুত মিলিয়ে গেলো কুয়াশার ভিতর।