এক অসমাপ্ত গল্প ( ৯ পর্ব)

                                                                                                      নয় পর্ব

        ডি এন্ড জে এসোসিয়েটের কর্মক্ষেত্র আজ আনন্দে ভরপুর। ডেভিড ফিরে আসছে পাঁচ মাস পর। এমিলি, জন, লরেন্স মিলে তৈরি করেছে “ওয়েল কাম ব্যাক” কার্ড। খুবই সুন্দর দেখতে । সবাই লিখেছে কিছুনা কিছু। ছোট্টও করে আনন্দ লিখেছিল, লং লীভ দা কিং।

     ডেভিড এলো এগারটায়। জেনিফারের সাথে। সবার সাথে হাত মেলানোর পর কিছু বলতে যেয়ে আবেগে বলতে পারলনা। চশমাটা কয়েকবার মুছতে হোল। অবশেষে সবাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে বললও সে কোনদিন ভুলবে না যে সাপোর্ট সে পেয়েছে সবার কাছ থেকে। সব শেষে সে যেয়ে বসলো তার নিজের রুমে। আনন্দকে বললও সে যেন দেখা করে তার সাথে।

   আনন্দ রুমে আসতেই ডেভিড দরজা টা বন্ধ করে দিতে বললও। জেনিফার বসে আছে একটু দুরে। কোন ভণিতা না করেই ডেভিড সরাসরি বললও,” তোমাকে আমি আমার ফার্মের অর্ধেক পার্টনারশিপ দিতে চাই। রাজি আছো?’

আনন্দের একটু সময় লাগলো ডেভিড কি বলছে সেটা বুঝে উঠতে। ডেভিড আবারো বললও, আমি হয়ত আর পুরোপুরি সময় দিতে পারবোনা এই ফার্মের জন্য। । এই পাঁচমাস তুমি এক হাতে যে ভাবে ফার্ম টাকে এগিয়ে নিয়ে গেছো তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। এটা শুধু আমার পরিকল্পনা নয়, জেনিফারের ও। এই ফার্মের হাল একমাত্র তুমিই ধরতে পারবে। কি বল, রাজি?

জেনিফার এগিয়ে এলো আনন্দের কাছে। “ তোমাকে এই মুহূর্তে কথা দিতে হবেনা। চিন্তা করে দেখো।”

আনন্দ তাকাল দুজনের দিকে। “ এটা আমার স্বপ্নের অতীত যে এ ধরনের প্রস্তাব তোমরা আমাকে দিতে পারো। আই রিয়েলি অ্যাপরিসিয়েট ইট। কিন্তু,” বলে আনন্দ থামল।

ডেভিড জেনিফার দুজনেই তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে।

“ অর্ধেক পার্টনারশিপ নিতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা আমার কাছে নাই, ডেভিড।’ বললও আনন্দ

“ তোমার যাতে হার্ডশিপ না হয় সে বাবস্থা আমি করবো” ডেভিড বললও।

“ তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই”

ডেভিড উঠে এসে জড়িয়ে ধরল আনন্দ কে। জেনিফার গালটা এগিয়ে দিলো।

আনন্দ উঠে চলে যেতে যেয়ে আবার ফিরে এলো। একটা কথা আছে।

বলো।

আমি কিছুদিনের জন্য একটু বাহিরে যেতে চাই। পারবে এক সপ্তাহ সামলাতে এদিকটা। বললও আনন্দ।

ডেভিড মাথা নেড়ে হাঁ সূচক ইঙ্গিত দিয়ে বললও,” ডেফিনিট”। শোন?

আনন্দ ফিরে তাকাল।

ফ্লরেন্তা তোমাকে ফোন করতে বলেছে, এই ওর সেল নাম্বার। বলে, হাতের কাগজ টা এগিয়ে দিলো ডেভিড আনন্দের দিকে।

হাতের কাজ গুলো শেষ করে ডায়েল করলো আনন্দ। লন্ডনে এখন রাত নয় টা। পাঁচ বার রিং হওয়ার পর ফোন টা ধরল ফ্লরেন্তা।

“ কেমন আছো?” জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ

“ভালো,এখানে ইউরো সকার ফাঁইনাল। দুটো টিকেট আছে। অনেক কষ্টে পেয়েছি । চলে এসো।” বললও ফ্লরেন্তা

আনন্দ রাজি, যথারিতি দরকারি জিনিস পত্র ক্যারিঅনে নিয়ে পরদিন রওনা হয়ে গেল।

হিতরো এয়ার পোর্টে যখন এসে নামল তখন ভোর পাঁচটা। ফ্লরেন্তা দাঁড়িয়েছিল বাহিরে। ওকে দেখে দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। “ ফ্লাইটে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”

“মোটেও না” বললও আনন্দ।

ফ্লরেন্তার গাড়ীতে করে এসে পৌছালো ওর এপার্টমেন্টে। আধা ঘণ্টার পথ। সুন্দর ছিমছাম করে সাজানো ঘর। ফ্লরেন্তা আনন্দকে তার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললও। “ এখন অনেক সকাল, তুমি রেস্ট নেও। নয় টার দিকে আমরা নাস্তা করব। কেমন?”

আনন্দ রাজি। সেও ভীষণ ক্লান্ত। কিছুক্ষণ ন্যাপ নেওয়াতে শরীরটা একটু ঝরঝরে মনে হোল আনন্দের। বসার ঘরে এসে দেখে ফ্লরেন্তা খবরের কাগজ পড়ছে।

“ কি ঘুম হয়েছে ?” জিজ্ঞাসা করলো ।

“গোসল করে নাও। নাস্তা শেষে আমরা বের হবো। কেমন? তোমাকে নিয়ে যাবো আমার কাজের জাগায়।” বলল ফ্লরেন্তা।

আনন্দ বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবল, ফ্লরেন্তার সাথে দেখা হয়ে ছিল মাত্র একবার। অথচ মনে হচ্ছে সে অনেক দিনের চেনা।

লন্ডন শহরে সূর্যের মুখ দেখা দুরহ। আজ তার ব্যতিক্রম। ঝলমলে রোদ। মনে একটা আলাদা আমেজ এনে দিচ্ছে। আনন্দ ভাবে, সে এসেছিল লন্ডনে অনেক অনেক আগে। হেঁটেছিল দুজনে এই টেমস নদীর পাশ দিয়ে। বসে ছিল বিগ বেনের সামনে। ও আনন্দের কাঁধে মাথা রেখে তাকিয়ে ছিল চোখের দিকে। ভালবাসার ফুলগুলো ঝড়ে পড়ছিল চোখের চাউনী থেকে। সবই আজ স্রীতী।

কি ভাবছ?

কিছুটা জীবনের পিছনে চলে গিয়েছিলাম। “চলো।”

যাওয়ার পথে টমকে উঠিয়ে নিতে হবে। আমার কলীগ। বললও ফ্লরেন্তা।

টমের বাসা, গলিতে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের বসবাস এখানে নয় মনে হোল আনন্দের। খোলা ডাস্টবিনের ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দুরে ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। হর্ন দিতেই টম বেড়িয়ে এলো। বয়স বিশ থেকে পঁচিশ এর কোঠায়। গাড়ীতে আসতেই ফ্লরেন্তা পরিচয় করিয়ে দিলো। একটু লাজুক প্রক্রিতির। কথার মাঝে সে জিজ্ঞাসা করলো আনন্দকে কতদিন থাকবে।

আনন্দ বললও,” এসেছি ফাইনাল খেলা দেখতে। শেষ হওয়ার পর আরও দু এক দিন থাকব, তারপর প্যারিস, জার্মানি হয়ে স্টেটসে ফিরে যাবো।”

তিন তালা বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো ফ্লরেন্তা। লেখা এন্ডড্রুস কমিউনিটি। জিজ্ঞাসা করতেই ফ্লরেন্তা বললও,” এন্ডড্রু নামের এক বিশাল ধনী লোক এর খরচ চালায়। দেখবে, কত হারিয়ে যেতে পারতো এমন ছেলে মেয়েরা আজ তাদের জীবনের সন্ধান খুঁজে পেয়েছে।”

আনন্দ দেখল বিভিন্ন রুমে বয়স বারো থেকে বিশ বছরের ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন কাজ নিয়ে বাস্ত। ফ্লরেন্তা আর টম চলে গেল তাদের নিজের কাজে। ফ্লরেন্তা যাওয়ার আগে বলে গেল,” আনন্দ তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো। আমি মিটিং সেরে তোমার সাথে দেখা করবো।”

দুরে একটা মেয়ে কাঠের সরঞ্জাম দিয়ে কি জেনো বানানোর চেষ্টা করছিল। আনন্দ এগিয়ে গেল মেয়েটার কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তার হাতের কাজ। মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল।

“কিছু বলবে” জিজ্ঞাসা করলো

“ না, তোমার হাতের কাজ দেখছি। খুব সুন্দর। কার কাছ থেকে শিখেছ?”

“ এনড্রিয়ার কাছ থেকে।”

নাম কি তোমার?

আলভীনা।

সুন্দর নাম। কিভাবে এলে এখানে?

সে এক বিরাট কাহিনী।

বলবে কি?

দুটোয় আমার লাঞ্চ ব্রেক, তখন এসো বলবো।

সে বলেছিল, আনন্দের চোখের জল বাঁধ মানেনি সেদিন।

বারো বছর বয়সে তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। বাপের হাতের পিটুনি, মার গঞ্জনার থেকে বাঁচতে যেয়ে ধরেছিল ড্রাগস। সেই আসক্তি মেটাতে যেয়ে ধরতে হয়েছিল চুরির পথ। ধরা পড়ে জেলে ছিল তিন মাস। বেড়িয়ে এসে দেখে বাবা বাসা ছেড়ে চলে গেছে। মা নিয়ে এসেছে নতুন পার্টনার, নাম চার্লস। থাকে মার সাথে।

দিনের পর দিন চার্লস পাশবিক অত্যাচার করেছে আলভীনার পরে। মা দেখেও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে না দেখার ভান করে। তখন আলভীনার বয়স মাত্র তেরো। মাঝে মাঝে আলভীনার মাকে মারতে ও দ্বিধা করেনি চার্লস। বাসাটা হয়ে উঠেছিল নরক কুণ্ডো। এক বছর ধরে এই অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। আলভীনা আর নিতে পারেনি এই যন্ত্রণা। একদিন বাধ্য হয়ে সে তার মা কে বলেছিল চার্লসকে বের করে দিতে বাসা থেকে। মা রাজি হয়নি। অগত্যা আলভীনা কেই বের হয়ে যেতে হয়েছিল রাস্তায়।

থেকেছে বন্ধুদের বাসায় কিছু রাত। শুয়েছে অন্য লোকদের সাথে শুধু মাথার উপর ছাদের আশায়। শেষপর্যন্ত এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল আলোকোজ্জ্বল নগরীর পোড়ো বাড়ীর ছাদের নিচে। রাস্তায় কাটিয়েছে ওরই মত হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়েদের সাথে।

আনন্দ কে দেখিয়েছিল ওর হাতের কাটা দাগ।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল, “ এ দাগ কীসের।”

“ছুরি দিয়ে কেটে ছিলাম মানসিক যন্ত্রণাকে সরিয়ে শারীরিক যন্ত্রণাকে আঁকড়িয়ে ধড়ার জন্য।”

আলভীনা বেচে থাকার কোন মানে খুঁজে পায়নি, জীবনের সব লেনদেন চুকিয়ে দিতে চেয়েছিল। সে ভাবতো, সে চলে গেলে কার কি আসে যায়। কেউ তো তার জন্য এক ফোটা চোখের জল ফেলবেনা। এই রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলে মেয়েদের কথা কেউ ভেবেছে কি? কেউ কোনদিন জিজ্ঞাসা করেছে কি, তোমাদের কি সমস্যা? তাই একদিন সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সে তার হাতের রগ কেটে ফেলে ছিল, রক্তাত অবস্থায় পড়েছিল রাস্তার গলিতে।

নিয়তির খেলা, সে দিন মরণের হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারতনা আলভীনাকে, যদি না এনড্রিয়া ওই পথ দিয়ে না যেতো তার কর্মস্থলে।

এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, কাজে আর যাওয়া হয়নি এনড্রিয়ার সেদিন। আলভীনা সুস্থ হয়ে উঠলে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অ্যালেক্স আর রবার্টের সাথে। ওরা নিয়ে এসেছিল এন্ডড্রুস কমিউনিটিতে। ওদের চেষ্টায় আলভীনা আজ খুঁজে পেয়েছে তার নিজস্ব পরিচয়। জেনেছে কাউ না কেউ আছে যে কি না তার দুঃখে দুঃখিত, তার ব্যাথায় ব্যাথিত হয়।

“ ওরা আমাকে আশ্রয় দিয়ে ছিল, গ্রহণ করেছিল। জানতে চায়নি আমি কে। এযে কতবড় পাওয়া তুমি বুঝবে না” বলেছিল আলভীনা।

আনন্দ তাকিয়ে ছিল দুরে, ভাবল ফ্লরেন্তা, এনড্রিয়া, অ্যালেক্স, রবার্টের মত মানুষ ছিল বলেই আজ আলভীনা আর ওর মত কিছু হারিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়ে আবারো নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারলো। নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি করলো।

“ কি ব্যাপার, কি হোল, সব ঠিক তো?”

ডাক শুনে ফ্লরেন্তার দিকে তাকাল আনন্দ। বললও , চলো, বাসার পথে কি?

হা, টম কে নামিয়ে দেবো যাওয়ার পথে। টুমরোঁ ইজ এ বিগ ডে। দা ফাইনাল।

 ক্রমশ

**** সমস্ত চরিত্রই কাল্পনিক, কারোর সাথে মিল থাকলে তা নিতান্তই কাকতালীয়”***

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প (৮ পর্ব)

                                        ৮ম পর্ব      

চিঠিটা খুললো আনন্দ,

“ কাকুমনি,

আমি লাবণ্য, তোমার পাঠানো টাকা মা পেয়েছে। তোমার মোবাইল নাম্বার আমার কাছে না থাকাতে চিঠি লিখে জানাতে হোল। বাবা কে দেখিনি কখনো, তোমাকে দেখেছিলাম। তাও কিছুক্ষণের জন্য। সেই ব্যস্ততার মধ্যে। মা বলেছিল বাবা আর তোমার বন্ধুত্বের কথা। বাবা আদৌ কিছু রেখে গেছে কিনা, থাকলে কোথায় আমরা কিছুই জানিনা। মাস্তানদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। আসতে যেতে বড় বিরক্ত করে। জানে আমরা দুই অসহায় মহিলা থাকি এখানে । আমার মোবাইল নাম্বার রইল। কল করো কাকুমনি।

তোমার

লাবণ্য।”

চোখের কোণটা মুছে কল করেছিল আনন্দ। লাবণ্যকে বলেছিল,” চিন্তা করিস না মা, আমিতো আছি। চেষ্টা করছি তোদের কে এখানে নিয়ে আসতে। আমার বোনকে বলবো তোদের খোজ নিতে।” লাবণ্য কাঁদোকাঁদো স্বরে বলেছিল, বাবা হয়ত আমাকে তোমার কাছেই দিয়ে গেছে, তা না হলে তোমার সাথে তার দেখা হবে কেন? আমাকে, আমার মা কে তোমার কাছে রাখতে পারবে না কাকুমনি ?

পারবো। কাঁদিস না , তোর মা কে ফোনটা দে।

“ কেমন আছেন আনন্দ দা?” আমেনা ভাবীর ও গলার স্বর নিচু। কান্নার পূর্বাভাস। “ ও, তো, চলে যেয়ে বেচে গেল, যতো বোঝা দিয়ে গেল আপনার আর আমার ঘাড়ে।

ওকথা বলতে নেই, ভাবী।

জানেন আনন্দ দা, সবাই কে ছেড়ে ওর হাত ধরে একদিন বেড়িয়ে পরেছিলাম। তখন আমার বয়স আঠারো, ওর বিশ। বাসার সবার আপত্তি আমাকে ওর হাতে উঠিয়ে দিতে। যদিও একি গ্রামে পাশা পাশি বাস। যাওয়া আসা ছিল। ওর বাবা কাজ করত আমার বাবার গুদামে। তাই আমার বাবা মা এই বিয়েতে রাজি নয়। অগত্যা আমাদের করনীয় কিছু ছিলনা। এক রাতে ওর হাত ধরে বেড়িয়ে পরেছিলাম। আর পিছনে ফিরে চায়নি।

আপনার সাহস ছিল বলতে হবে? ভবিষ্যৎ কি হতে পারে ভেবেছিলেন কি?

না ভাবিনি। এসে উঠেছিলাম আমার এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায়। খালু বছর চার হয়েছে গত হয়েছেন। এক ছেলে। থাকে লন্ডনে। যার কাউ নেই তার উপরওয়ালা আছে। উনিই ঠাই দিয়ে ছিল। মহীউদ্দিন, আমি ডাকতাম মনা বলে, সকালে কাজ করত আর রাতে যেতো কলেজে। আমি খালাকে সাহায্য করতাম।

বাবা মার সাথে দেখা হয়ে ছিল?

না আর দেখা হয়নি, ওরাও আর আমার খোজ নেয়নি।

নতুন চাকরি নিয়ে নতুন বাসা ভাড়া করে আমরা একদিন উঠে গিয়েছিলাম। খালা অনেক কেঁদেছিলেন।

এর পরের ঘটনা আপনি সব জানেন। খালা বেচে থাকলে আজ হয়ত আমার জীবনের খাতা অন্য ভাবে লেখা হতো।

আনন্দদা, আপনি কেন এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নেবেন। অনেক তো করলেন, করছেন।

ওই যে, মেয়েটা বললও,” আমাদেরকে তোমার কাছে রাখতে পারবে না কাকুমনি ? ওর জন্যেই এই ঝামেলা আমার ঘাড়ে নিতে হবে। আমার ছেলে, মেয়ে, বৌমা, জামাই আছে, ওদের সাথে হেসে খেলে ও একদিন বড় হয়ে যাবে।

আমেনা ভাবী বলেছিল, আপনি যা ভালো মনে করেন তাই হবে। আমিও জানি আপনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

আনন্দ ওর বোন ঝুম্পা কে বলেছিল লাবণ্যদের খোজ খবর নিতে। ঝুম্পা খোজ রেখেছিল। মাস্তানদের সাথে কথা বলেছিল। বলেছিল, ওদের বড় বস দের সাথে তার চলাফেরা আছে। মাস্তানরা আর বিরক্ত করেনি লাবণ্যদের।

   আজ রবিবার। নিষ্প্রভ দিন। আনন্দের কিছুই ভাললাগছে না। মাঝে মধ্যে এমন হয়। কিছু একটা নিয়ে বাস্ত থাকার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। মনে হল সামিতাদের কে ছেড়ে আসার পর আর খোজ নেওয়া হয়নি। কথা দিয়েছিল সামিতাকে, আবার সে ফিরে আসবে। কে জানে মেয়েটা কেমন আছে। সামিতার মার ফোন নাম্বারে কল করলো। উত্তর এলো নম্বরটা বাতিল হয়ে গিয়েছে। আনন্দ খুঁজে বের করল হোটেলের নম্বরটা। ডায়েল করলো। ওপাশ থেকে মহিলার কণ্ঠস্বর, “ কুরেঙ্গা হোটেল, ক্যান অ্যাই হেল্প উ?” সব কিছু বুঝিয়ে বলল আনন্দ।

   ওরা নেই এখানে। দুমাস আগে চলে গিয়েছে এই শহর ছেড়ে। আনন্দ চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। ওপাশ থেকে হ্যালো শুনে বলল , যদি কোন সময় ওদের খোজ পান এই নম্বরটা দেবেন, বলবেন আমেরিকা থেকে ফোন করেছিল। “

সামিতা হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল ঐ বোবা মেয়েটা। ওকে আনন্দ কথা দিয়ে ছিল , আবার আসবে, দেখা হবে।

আজ একটা অস্বাভাবিক জ্বালা, যন্ত্রণা আনন্দকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। দুই কাপ কফি শেষ করেছে, আরেক কাপ বানাতে হবে। আনন্দ উঠতে যাবার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। সমিতের ফোন।

“ কি খবর? হঠাৎ। কি মনে করে?”

“ খবর ভালনা। কারীনা ভাবীর ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে। স্টেজ ফাইভ। যাবি দেখতে?”

“ না, আমি যাবনা। আমি এসব সহ্য করেতে পারিনা। কোন পরিত্রাণ নেই এর থেকে। শুধু তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে নিয়ে  যাওয়া। আমি মিঠুর মুখের দিকে চাইতে পারব না। তুই যা।”

আনন্দ ফোন টা রেখে ডায়েল করল স্টিভ কে।

“হোয়াটস আপ”

“ যাবে বারে, ড্রিঙ্কস খেতে চাই।”

“ তোমার ড্রিঙ্কস তো যেকোনো দোকানেই পাবে। তার জন্য বারে যাবার দরকার নিই।”

“ হার্ড ড্রিঙ্কস খাবো আজ। অস্থির লাগছে।”

“ আই উইল পিক ইউ আপ এট ফাইভ।”বলল স্টিভ

বারে এসে বসতেই বারটেনডার যথারীতি ক্লাব সোডা এগিয়ে দিলো।

“ না আজ এসব নয়। গিভ মি স্কচ উইদাউট আইস” আনন্দ বললও

বারটেনডার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল আনন্দের দিকে। স্টিভ মাথা নেড়ে হা সূচক ইঙ্গিত করতেই সে হুইস্কীর গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।

এক পেগ পেটে পড়তেই চোখ ঘোলাটে হয়ে এলো আনন্দের। একটা রমরমা ভাব এলো মনের মধ্যে। সবকিছুতে হলদে রং এর আঁচড়।

চিনতে পারছো? পাশে তাকাল আনন্দ। ঝাপসা। আমি শিখা। মনে পড়ে?

না।

এক শহরে থাকতাম। একি ক্লাসে। তুমি ছেলেদের স্কুলে আমি মেয়েদের । একবার পিকনিকে গিয়েছিলাম একি জায়গায়। তুমি তোমার বন্ধুদের আর আমি আমার বান্ধাবীদের নিয়ে।

মনে পড়ে ?

না।

তোমরা তিন বন্ধু আমাদের বাসার সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতে আর টুং টুং করে বেল দিতে। দেখতে চাইতে জানালাটা খুলে কেউ এসে দাড়ায় কি না। মনে পড়ে?

না

তুমি ছিলে হ্যাংলা পাতলা।

দেখতে ভালো নই, তাই বলতে চাইছ ?

না তা নয়, তবে আহামরি কিছু নয়।

তা মনে রেখেছ সেই চেহারা।

তাইতো এলাম তোমাকে দেখে।

এতদিন পড়ে দেখা। বল তোমার কথা। আনন্দ জানতে চাইল।

ভালোই ছিলাম। হঠাৎ করে স্বামী এসে বলল সে ডিভোর্স চায়।

কেন?

নতুন একজন কে পেয়েছে। বয়স কম, তারপর আবার ব্লন্ড।

তা কি করবে ঠিক করেছ ?

এই বয়সে পাল্লা দিতে পারবো না।

হু! আমি এক কাগজে ডিভোর্স সম্পর্কে পড়েছিলাম। বিষয়টা সত্য। যদি কাজে লাগাতে পারো।

বলো।

তোমারই মত কাহিনী।

ছেলেটা ডিভোর্স চেয়েছিল। মেয়েটা বলেছিল ,” ডিভোর্স দাও আপত্তি নেই। তবে তিরিশ দিন পরে। এই তিরিশ দিন প্রতি রাতে কোলে করে আমাকে বসার ঘর থেকে শোয়ার ঘরে নিয়ে যেতে হবে। পারবে ?”

ছেলেটা রাজি।

প্রথম দিন কোলে করে নিতে যেয়ে মেয়েটার নিশ্বাস এসে পড়ল ছেলেটার মুখে। চোখা চোখি হয়নি দুজনের।

দ্বিতীয় দিন মেয়েটা এলিয়ে দিয়েছিল মাথাটা ছেলেটির বুকে। ওর ব্লাউসের পারফিউমের গন্ধ নাকে এলো। মনে পড়ল এতো তারই পছন্দের পারফিউম। ভুলে গিয়ে ছিল এর গন্ধ।

৩য় দিন কোলে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর চুল গুলো এসে পরেছিল ছেলেটার মুখে। সরাতে যেয়ে মনে হোল আগে ওর চুলে অনেক গোছা ছিল, কবে যে হাল্কা হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি।

পরদিন কোলে উঠাতে যেয়ে মনে হোল ও অনেক শুকিয়ে গেছে। অনেক দিন ওর দিকে ভালো ভাবে তাকায়নি, কবে যে ওর বয়স বেড়ে গেছে, মুখে বলিরেখা, চুলে পাক ধরেছে জানতে পারেনি। ছেলেটা ভাবল “এই সে, যে কিনা তার জীবনের দশটা বছর দিয়েছে আমাকে”। এই সে যে কিনা প্রতিদিন ডাল ভাত বেড়ে খাইয়েছে। আগলিয়ে রেখেছে আমার ছেলে কে। ছেলেটার মনে হোল তার ভালবাসা ফুরিয়ে যায়নি। ওর চোখের মাঝে খুঁজে পেলো তার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা।

পরের দিন কোলে নিয়ে চেপে ধরেছিল তাকে, মুখের উপর পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে বলেছিল, আমি এখনো তোমাকে ভালবাসি, তুমি আমার।

কি! শুনলে তো। এবার এই পরীক্ষা তোমার স্বামীর উপর প্রয়োগ করো, বলে আনন্দ তাকাতে চাইল শিখার দিকে, পারলনা। ঢলে পড়ল মাথা টা টেবিলের পরে।

   যখন চোখ খুলল মাথায় দারুণ ব্যাথা। সানন্দা সামনে দাঁড়িয়ে।

তুমি এখানে?

স্টিভ কল করেছিল। ছাইপাঁশ খেয়ে মাতাল হয়ে গিয়েছিলে। কিছু মনে পড়ে কি?

না।

অনেক আবোল তাবোল বকেছো শুনলাম। পেটে যা পরেছিল সব বের করে দিয়েছিলে ওখানে। একটা কথা বলি।

বলো।

তুমি একদিন আমাকে বলেছিলে তুমি খারাপ হতে চাও। জানো আনন্দ দা, খারাপ হতে চাইলেই সবাই খারাপ হতে পারেনা । অন্ততপক্ষে তুমি পারবেনা। তোমার মত ভালো মানুষরা খারাপ হতে জানেনা। এবার বিশ্রাম নাও। আমি আসি।

এসো।

 ক্রমশ

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প (৭ পর্ব)

                                                             ৭ম পর্ব

   আনন্দ অফিসে ফিরে সোজা চলে গিয়েছিল স্টিভের চেম্বারে। স্টিভ ক্লায়েন্টের সাথে বাস্ত থাকায় বাহিরে সোফায় বসে কয়েকটা ফোন কল সেরে নেবে ঠিক করলো। জেনিফারের সাথে কথা হয়নি বেশ কিছুদিন। সানন্দার খবরও নেওয়া হয়নি। জেনিফার কে পাওয়া গেল, জিজ্ঞাসা করতেই বললো,” ডেভিডকে দুই এক দিনের মধ্যে বাসায় পাঠিয়ে দেবে।” সময় পেলে আজ বিকেলে আনন্দকে একবার আসতে বললো জেনিফার। কোন অসুবিধা হবেনা জানালো আনন্দ। সানন্দাকে কল করেতে যাওয়ার আগেই স্টিভ দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো।

“ কোন কথা আছে কি?”

“মহিউদ্দিনের স্ত্রী আর ওর মেয়ের ইমিগ্রেশনের স্ট্যাটাস টা জানতে এসেছিলাম।”

আনন্দ আমেনা ভাবী কে বলেছিল, তোমাদের এখানে তো আপন বলতে কাউ রইলনা, আমি চেষ্টা করবো তোমাদের কে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া কিনা। স্টিভ ছিল তার একমাত্র ভরসা। সে সমস্ত কাগজপত্র জোগাড় করে জমা দিয়েছিল।

বলল,” দুই এক মাসের মধ্যে আশা করছি উনাকে ডেকে পাঠাবে ভিসার জন্য।”

আনন্দ?” স্টিভ ডাক দিলো

বলো।

নিজের খবর রাখো?

হোয়াট ডু ইউ মিন?

শেষ কবে ওজন নিয়ে ছিলে? চোখের কোণটার পাশে যে কালো ছায়া, দেখেছ কি?

আনন্দ কোন উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে গুডবাই বলে বেড়িয়ে এলো।

নিচে এসে দেখল লরেন্স ফিরে এসেছে ডালাস থেকে। কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে আনন্দ এসে বসলো তার রুমে।

সামান্তা কফির কাপটা সামনে দিয়ে বললও,” পিটার হাসব্র আর জর্জ সয়েঞ্জার আসবে সাড়ে বারটার সময়। ওদের বিল্ডিং এর ডিজাইনের ব্যাপারে।”

সামান্তা চলে যেতেই আনন্দ ফোন করলো সানন্দা কে। আজ বুধবার। সানন্দা বলেছিল বুধবারে তার কাজের চাপ কম, কথা বলতে অসুবিধা নেই।

“কেমন আছেন” বলে অভ্যর্থনা জানালো সানন্দা।

সরি, অনেকদিন খোজ নিতে পারিনি বলে দুঃখিত। বলল আনন্দ

আপনি বাস্ত মানুষ, আসেন আরেক দিন আমার বাসায়।

“ এবার আমার পালা, শনিবার সন্ধ্যা সাত টায় আসবো আপনাকে নিতে। কোন আপত্তি আছে কি?”

না নেই, আমি রেডি থাকব।

সামান্তা এসে জানাল পিটার আর জর্জ এসেছে।

আনন্দ বলল সানন্দা কে, “একটা মিটিং আছে আমার, আজকের কথোপকথন যদি এখানে শেষ করি কিছু মনে করবেন নাতো?”

কি যে বলেন, কাজ আগে না কথা? যদি আবারো কথা না হয় তবে দেখা হবে শনিবারে।

 

আনন্দ কনফারেন্স রুমে এসে দেখল পিটার আর জর্জ কাগজে কি জেনো লেখা লেখি করছে। আনন্দ কে দেখে গুড আফটারনুন বলে অভ্যর্থনা জানাল। ওদের এসোসিয়েশন একটা synagogue বানাতে চায়। তার ডিজাইনের জন্য এসেছে।

পিটার বলল,” তোমাদের ফার্ম কে রেকমেন্ড করেছে আমাদের এক বন্ধু এবং তাদের এসোসিয়েশন”। আনন্দ ধন্যবাদ দিয়ে বলল, “কাগজপত্র রেখে যাও, আমাদের একজন আর্কিটেকট সাইটে যাবে, সমস্তকিছু দেখে আসবে। তারপর আমরা ডিজাইন এবং টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা করব, কেমন?”

ওরা রাজি।

আনন্দ উঠে পড়ল। বিকেল চারটা। ওকে যেতে হবে জেনিফারের বাসায়।

   ঘরে ঢুকতেই জেনিফার এসে আলিঙ্গন করলো আনন্দকে। পাশে দাঁড়ান ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।

“ ফ্লরেন্তা, ডেভিডের বোন, থাকে লন্ডনে।”

“ ফ্লরেন্তা, আনন্দ, ডেভিডের ডান হাত। ডেভিডের অবর্তমানে আনন্দই সবকিছু দেখাশুনা করছে। তোমরা বসে গল্প করো, আমি এখনি আসছি”। বলে জেনিফার বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

ফ্লরেন্তা, বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। ডিভোর্স। সাদা উজ্জ্বল গায়ের রং। তার সাথে মিলিয়ে গলায় কানে পার্লের নেকলেস, কান ফুল। “আপনার কথা জেনিফারের কাছে শুনেছি, আমার আসতে একটু দেরী হয়ে গেল। আন প্রিভিলাইযড বাচ্চাদের স্কুলে আমি পড়াই। কাজেই বুঝতে পারছেন, যখন তখন ওদেরকে রেখে চলে আসতে পারিনা।”

“ আমি বলব, আপনি মহান কাজ নিয়ে আছেন। অনেক ধরজো, অনেক সহিষ্ণুতা থাকলে তবেই পেশা হিসাবে এই কাজকে লোকে বরন করে। কতদিন থাকবেন?” জিজ্ঞাসা আনন্দের।

“ সপ্তাহ খানেক। সময় করে আসেন একবার লন্ডনে। “

“ আপনি সময় দিতে পারবেন তো?”

ফ্লরেন্তা উত্তর দেবার আগেই জেনিফার ফিরে এলো। হাতে কতগুলো কাগজ। আনন্দকে দিয়ে বললও, “ ডেভিড তোমাকে  দিতে বলেছে। “

   আনন্দ কাগজ গুলি হাতে নিয়ে বললও,’ আসি। “

ফ্লরেন্তা আবারো বললও,’ ভুলবেন না কিন্তু আমার ওখানে আসতে। ‘ চোখে উজ্জ্বলতার ছাপ।

“ না ভুলব না”

গাড়ীতে এসে আনন্দের মনে হোল সে ভীষণ ক্লান্ত। এক কাপ কফি খেলে ভাল হতো। না, বাসাতেই ফিরে যাবে সে। এলিয়ে দেবে শরীরটাকে সোফার উপর।

ঘরের ভেতর একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ। জানালা গুলো খুলে দিলো । বাতাস খেলে গেল এপাশ থেকে ওপাশে। টুং টুং শব্দ করে বেজে উঠল ছোট্ট গাছে ঝোলানো ঘণ্টা টা, ওটা কণা এনেছিল সালজবারগ, অস্ট্রিয়া থেকে। কত স্রীতি আনাচে কানাচে পড়ে আছে। সোফাটা ডাকছে তাকে। মাথাটা এলিয়ে টিভি টা অন করতেই গমগম করে উঠল সারা ঘর। তার মানে দীপ এসেছিল। ফুটবল খেলা দেখেছে ফুল ভলুম দিয়ে। বন্ধ করে দিলো টিভি টা। চোখটা বুজে আসল।

 

   আনন্দ দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে এক ধু ধু মাঠের মাঝ প্রান্তে। উপরে হাস্যজ্বল আকাশ। হঠাৎ এক টুকরো কালো মেঘ কোথা থেকে এসে মাথার উপর ঘোরা ফেরা করছে। ডানে গেলে সে যায় ডানে, বাঁয়ে গেলে সে যায় বাঁয়ে। আনন্দের মনে হোল এ যেন এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। সেই চোখ, সেই কান, সেই মুখ। রৌদরজ্বল আকাশে নেমে এলো কালো ছায়া। বিদ্যুতের রেখা একে দিলো কালো মেঘের বুকে। নেমে এলো জল। আকাশ পানে তাকাল আনন্দ। হারিয়ে গেছে মেঘটা। ভিজিয়ে রেখে গেছে তাকে চোখের জলে। চিৎকার করে ডাকতে চাইল তাকে। পারলনা। ঘুম ভেঙ্গে গেল। সারা শরীর ঘামে ভেজা। তাকিয়ে ছিল সে দুরে ছবিটির দিকে।

 

ফোন টা বেজে উঠল। বেলালের ফোন। স্বপ্নের রেশ তখনো কাটেনি আনন্দের। হ্যালো বলতেই বেলাল বললও

“ তোমাকে কি ঘুম থেকে জাগালাম”?

“ না তুমি জাগাওনি, অন্য কেও জাগিয়ে দিয়েছিল আমাকে । বল, কি খবর?”

   “ একটা জরুরী দরকার ছিল তোমার সাথে। তুমি ছাড়া আর কারো সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করতে চাইনা। তোমার উপর আমার একটা অধিকার জন্মে গেছে। তাই না আনন্দ দা।”

“ এত ভণিতা না করে আসল কথাটা বলবে কি?”

“ কল্যাণীর ভাই, নাম শুভ্র। কাজ করে ফার্মাসীউটিকাল কোম্পানিতে। অনেক দিন ওর খোজ পাচ্ছিনা। বুঝতেই পারছো কল্যাণীর অবস্থা। আমি তোমাকে ঠিকানাটা টেক্সট করে দেই, একটু খোজ নিতে পারবে কি?”

আনন্দ বললও সে চেষ্টা করবে। সময় করে খোজ নিয়ে জানাবে। বেলাল জানে আর কিছু বলার দরকার নিই। আনন্দ সময়

বের করে নেবে।

   আনন্দ পৌছেছিল ব্রুকলিনের এক গলিতে। বেল টিপতেই দরজা খুলে দাঁড়াল এক মহিলা।

কাকে চাই?

শুভ্র আছে? জিজ্ঞাসা করতেই মহিলা ভেতরে আসতে বললও

সোফায় বসে আনন্দ পর্যবেক্ষণ করছিল ঘরের চারিদিক। আগোছাল ঘর। জিনিস পত্র ছড়ানো ছিটানো। টেবিলের পরে ঔষধের বোতল। লেখা ভাইকোডিন। আনন্দ জানে এ কীসের ঔষধ।

শুভ্র এলো ঘরে। চোখের কোনে কালি। আলুথালু বেস। চেহারায় রুক্ষতার ছাপ।

আনন্দ নিজের পরিচয় দিলো। বেলাল এবং কল্যাণীর সাথে কি সম্পর্ক তাও জানালো।

“ তোমার খোজ না পাওয়াতে তোমার বোন ভীষণ বিচলিত।” বললও আনন্দ

“ আমি আজিই কল করব,” বলে শুভ্র এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে।

আনন্দ ওর বিজনেস কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বললও, “ কোন দরকার হলে কল করতে ভুলো না। অনেক ডাক্তার বন্ধু আছে আমার।”

শুভ্র আনন্দের দিকে তাকাল। বুঝতে পারলো আনন্দ কি বলতে চাইছে। ভাইকোডিনের বোতলটা হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললও ,” অবশ্যই”।

আনন্দ আর কিছু না বলে বেড়িয়ে এলো।

আজ শনিবার। সানন্দাকে উঠানোর কথা সন্ধ্যা সাতটায়। যথাসময়ে আনন্দের গাড়ী এসে দাড়াল সানন্দার ড্রাইভওয়ায় তে। সানন্দা বেড়িয়ে এলো। পরনে কালো জমিনের উপর মেজেন্টা পাড়ের শাড়ী।

দাড়ান, আপনার একটা ছবি নেবো ওই গোলাপ গাছের কাছ থেকে। বলেই আনন্দ সানন্দার দিকে তাকাল।

সানন্দা না করলো না।

কোথায় যাবো আমরা আজকে? জিজ্ঞাসা করলো সানন্দা।

“ সুশি রেস্টুরেন্টে? একটু দুরে। তবে দিস ইজ দা বেষ্ট।”

“ তাই! জানলেন কি ভাবে আমি সুশি পছন্দ করি?”

“ সবই ইমাজিনেসন।”

আগে থেকে রিজার্ভ থাকাতে টেবিল পেতে অসুবিধা হলনা। বাহিরে অনেক লোক লাইনে দাঁড়ানো। কোনের একটা টেবিল।    সুন্দর জায়গা। আনন্দ বলল সানন্দা কে,” অডার দেওয়াতে আমি অভ্যস্ত নই। ওটা আপনার দায়িত্বে।

“ খাওচ্ছেন আপনি আর অডার দেবো আমি।”

“ হা, তাই।

আনন্দ ভাবে, ওর আর সানন্দার জীবনের সুর এক। ওদের মধ্যে আছে নিটোল বন্ধুত্ব। শুধুই বন্ধুত্ব। ওরা একে অন্যের দুঃখ বোঝে। ওরা একে অন্যকে সান্ত্বনা দেয়। ফিরে যায় অতীতে। অতীত যখন কথা বলে তখন দুজনের চোখ জলে ভরে আসে।

   কি ভাবছেন?

   ভাবছি এইযে আপনি এলেন বান্ধবী হয়ে, এটাও কি একদিন শেষ হয়ে যাবে?

   জীবনে কোন কিছুরই গ্যারান্টি নেই। আছে কি? আগে থেকে সে ভাবনা ভেবে লাভ কি?

   আসলেই তাই! চলেন উঠি। আনন্দ বলে, আজকের সন্ধ্যাটা থাক আমাদের মনের মধ্যে সন্ধ্যা তারার মত।

   বাহিরে আসে দাঁড়ালো দুজনে। আকাশে তারার ঝিলিমিলি।

সানন্দা কে পৌছে দিয়ে আনন্দ ফিরে এলো বাসাতে। চিঠির বাক্স থেকে চিঠি গুলো কুড়িয়ে নিলো। ফেলে আসা সন্ধ্যার আমেজটা হারিয়ে যেতে দিতে চায়না সে। অলস নয়নে তাকিয়ে রইল ছড়িয়ে ছিটেয়ে পড়া চিঠি গুলোর দিকে। চোখটা আটকিয়ে গেল একটা খামের পরে। অজানা এই খাম। কখনো দেখিনি আগে। বাংলায় লেখা আনন্দের নাম। সে হাত বাড়াল খাম টার দিকে।

ক্রমশ:

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প (৬ পর্ব)

                                                                                                                           ছয় পর্ব

   আনন্দ আরো কাছে এগিয়ে গেল। বুকটা ধুঁকধুঁক করছে। একটু দুরে মাটিতে পড়ে থাকা মেয়েটার পায়ের স্যান্ডেলটা দেখতে পেলো আনন্দ। ভিড় ঠেলে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলো সে। উকি দিয়ে দেখার আগেই শুনতে পেলো তার নাম ধরে কে যেন ডাকছে রাস্তার ওপার থেকে। “আনন্দ”। সামান্তা ।

সামান্তার হাতে খাবার। আনন্দের জমে যাওয়া বুকটা আবার নিশ্বাসে ভরপুর হয়ে উঠল।

কাছে এসে সামান্তা বললও, “ তুমি ভেবেছিলে ওটা আমি, তাই না?’

হা,

আনন্দ বললও,’ তুমি খাবার নিয়ে উপরে চলে যাও, আমি খবরের কাগজটা কিনে নিয়ে আসছি।”

মুহূর্তে মধ্যে চারিদিক থেকে পুলিশের গাড়ী, এ্যাম্বুলেন্স এসে জাগাটা ঘিরে ফেলল। লোকের ভিড় কমছে।  উৎসুক পথচারীরা উকিঝুঁকি মেরে চলে যাচ্ছে।

আনন্দ আর দাঁড়ালনা। এসে পৌছালো খবরের কাগজ নিয়ে বসে থাকা লোকটার সামনে। আনন্দ কাছে আসতেই উর্দুতে বলল,” আপ কায়সা হেয়, সাব?”

ভালো।

আজ আনন্দের মনে পড়ছে মহিউদ্দিনের কথা। এই জাগাতেই সে বসতো কাগজ নিয়ে।

এইখানেই প্রথম দেখা হয়েছিল মহিউদ্দিনের সাথে। আনন্দকে দেখে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলত, “ কেমন আছেন?” প্রতিদিন সকালে আনন্দ আসতো কাগজ নিতে। কথা হতো। একটা বন্ধন তৈরি হয়েছিল দুইজনের মধ্যে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক। হাতে সময় থাকলে আনন্দ একটা টুল নিয়ে ওর পাশে বসে গল্প করতো। এক কাপ কফি হাতে তুলে দিত।

কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মহিউদ্দিন বলত তার সংসারের কথা। বলত তার স্ত্রী, তার মেয়ের কথা, যাকে সে এখনো দেখেনি। পনেরো বছর হয়ে গেল। বলত,” জানেন আনন্দ দা মেয়ে আমার আজ পনেরো বছরের যুবতী. অনেক কিছুর জন্য আবদার করে। সবচেয়ে বড় আবদার তার কি জানেন আনন্দদা?

বলো ?

বলে,” কবে আসবে তুমি বাবা, কবে তোমাকে দেখব,” বলতে বলতে মহিউদ্দিনের চোখটা ছলছল করত।

বলেছিল,” সেই যে দেশ ছাড়লাম অন্নের সন্ধানে, আর ফিরে যেতে পারলাম না।”

প্রথমে সে গিয়েছিল জার্মানি। দুই বছর কাজ করেছিল সুতার ফ্যাক্টরিতে। ইল্লিগাল ইমিগ্রান্টদের বের করে দাও, এই অভিযানের শুরুতে মহিউদ্দিন পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকার উদ্দেশ্যে। অনেক কাঠখর পুড়িয়ে একদিন কানাডার বর্ডার পেড়িয়ে এসে পৌছেছিল নিউ ইয়র্কে। সেই শুরু।

“ অনেক রকম কাজই করেছি। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন পরামর্শে চেষ্টা করেছি গ্রিনকার্ড পাওয়ার। আইনজীবিদের কাছে গিয়েছিলাম, টাকার অভাবে ওই পথটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যখন এসেছিলেম, চুল ছিল কালো। আজ সাদাতে ভরে গেছে। কাগজ বেচা শেষ করে, বাসায় যেয়ে দু মুঠো খেয়ে বেরিয়ে পরি আর এক কাজের পথে, ফিরতে ফিরতে রাত একটা।”

আনন্দ বলেছিল, “ কোন এক রবিবারে ছুটি পেলে বলবেন, বেড়িয়ে পরবো দুর পাল্লায়।”

সময় হয়েছিল মহিউদ্দিনের। আনন্দ তাকে নিয়ে গিয়েছিল “মনটক পয়েন্টে”। প্যাকেটে বাধা লাঞ্চ নিয়ে বসেছিল পার্কে। বসেছিল সমুদ্রের ধারে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিউদ্দিন বলেছিল, অনেকদিন পর প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম আনন্দদা।” সুন্দর একটা দিন ওরা কাটিয়ে ছিল একসাথে।

       আনন্দ আলাপ করেছিল স্টিভিন রসের সাথে মহিউদ্দিনের ব্যাপার নিয়ে। স্টিভিন রস আইনজীবি। ওর চেম্বার আনন্দের বিল্ডিং এর আট তালায়। মাঝে মাঝে দুইজন একসাথে সময় কাটায় বারে। আনন্দের হাতে থাকে সফট ড্রিঙ্কস, স্টিভ হুস্কির পেয়ালায় বুদ হয়ে যায়। অনেক সময় আনন্দ তাকে বাসাতে নামিয়ে দেয়। গাড়ী চালানোর মত অবস্থা তার থাকতনা। মেয়ে বন্ধু তার থেকেও নেই। কাপড় পাল্টানোর মত সে মেয়ে বন্ধু পাল্টায়। তবে মনটা তার উদার।

   আনন্দ তাকে বলেছিল, পারবে কি উপকার করতে? টাকা আমি দেবো। যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে সে কাজটা হাতে নিয়েছিল। আনন্দ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মহিউদ্দিনকে স্টিভের সাথে। মহিউদ্দিন একদিন আনন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিল,” কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করলেন”।

প্রতিদিন সকালে দেখা হলেই বলত, “ আনন্দদা, অপেক্ষায় আছি।”

একদিন আনন্দকে দেখে দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল।

“কি ব্যাপার! কি হয়েছে?”

খবর এসেছে। অ্যাপরুভাল লেটার এসেছে। ছয় মাসের মধ্যে গ্রীনকার্ড হয়ে যাবে।

আবারো জড়িয়ে ধরে বললও, সব আপনার জন্য।

না, আমার জন্য নয়। বল, উপরওয়ালার জন্য। স্টিভ কে আমি বলবো।

“ উনি ফেরেশতা, আমার কাছ থেকে টাকা নেইনি, বললেন আপনার বন্ধু তাই।”

আনন্দ সে কথার উত্তর না দিয়ে বললও,” আমি দেশে যাচ্ছি সামনের সপ্তাহে, দেখা করব কি ভাবীর সাথে?”

“ নিশ্চয়!” বলে ঠিকানা দিয়েছিল, সাথে কিছু টাকা।

আনন্দ দেখা করেছিল আমেনা ভাবীর সাথে। মহিউদ্দিনের দাওয়া টাকার সাথে নিজের কিছু টাকা মিশিয়ে ভাবীর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল,” সুসংবাদ আছে! ছয় মাসের মধ্যেই আপনার কর্তা দেশে আসবে।”

অনেক আপ্যায়ন করেছিলেন আমেনা ভাবী।

ঠিক সময় মত গ্রীনকার্ড পেয়েছিল মহিউদ্দিন। আনন্দের সাথে দেখা হতেই বলেছিল, “ আগামী পরশু দেশে যাচ্ছি। দোয়া করবেন”।

আগামী পরশু আর আসেনি মহিউদ্দিনের জীবনে। সেই রাতে আনন্দের ফোন বেজে উঠেছিল। রাত তখন তিনটা। ওপাশের কান্নায় ভাঙা স্বর। আমি মহিউদ্দিনের রুমমেট বলছি,” আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন”।

আনন্দ দেরী করেনি। হাসপাতালে পৌছিয়েছিল। একটু দেরী হয়ে গেছে। চলে গেছে মহিউদ্দিন এই ধরাধাম ছেড়ে। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, আনন্দদা যেন আমার পাশে থাকে।

মেয়েটাকে সে বুকে চেপে ধরতে পারলনা, পারলনা মেয়েটা তার বাবা কে দেখতে। যখন সে পেলো তার আকাঙ্ক্ষিত কার্ডটা তখনি বন্ধ হয়ে গেল তার হৃদক্রিয়া।

আনন্দ ছুটি নিয়ে গিয়েছিল লাশের সাথে। আমেনার কান্না সহ্য করার নয়। আনন্দকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,” আপনি বলেছিলেন, ও আসবে। ও এসেছে, ও এসেছে আনন্দদা, এসেছে লাশ হয়ে।”

সাব, আপকা চেঞ্জ।

ও, হা, দাও। আনন্দ ফিরে এলো বাস্তবে।

কাগজটা নিয়ে পা বাড়ালো অফিসের দিকে।

ক্রমশ

Continue Reading

অসমাপ্ত গল্প ৫

                                                                                ৫ পর্ব

     বৃস্টি ঝরা সকাল। অঝরে ঝরছে। ডালাসের মাটি গ্রীষ্মের তাপ থেকে কিছুটা রেহাই পেলো। সানন্দা ভিজে মাথায় এসে দাঁড়ালো ডেলটা এয়ার লাঈন্সের কাউনটারের সামনে। কোথাও আনন্দকে দেখতে পেলো না। ভাবল, হয়ত সে ভেতরে চলে গেছে। ছয় নম্বর গেঁটের কাছে এসেও আনন্দের খোজ পেলনা। হয়ত ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। অথবা নতুন কোন কাজের চাপে রয়ে গেছে। সেদিন রাতে ফোন নাম্বারটা আদান প্রদান না হওয়াতে সানন্দা আনন্দের কোন খোজেই পেলো না।

     সেই রাতে যা ঘটেছিল আনন্দ তার জন্য প্রস্তুত ছিলনা। রাত দুটার সময় যে ফোন টা এসেছিল তাঁর অপর প্রান্তে ক্রন্দন রত জেনীফার। ডেভিডের স্ত্রী।

“ তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। ডেভিড এর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।”

আনন্দ পরের দিন প্রথম ফ্লাইটে চলে এসেছিল নিউ ইয়র্কে। সোজা চলে গিয়েছিল হাসপাতালের বারো তালায়, ইনটেনসীভ কায়ার ইউনিটের সামনে। সবাই দাঁড়ানো। জেনীফার কাঁদছে। অনন্যাদের মুখ মলিন। ডাক্তারে ভাষ্যে এ যাত্রা ডেভিড রক্ষা পাবে মনে হয়। তবে সবই সময় সাপেক্ষ। জেনীফার কে আশ্বাস দিয়েছিল আনন্দ।

বলেছিল,” তুমি ডেভিড কে দেখো, অন্য দিকটা আমি সামলাবো।

     পরদিন অফিসে এসে আনন্দ খবর পাঠিয়েছিলো সবাইকে কনফারেন্স রুমে আসতে। ডেভিড এর পরেই তাঁর স্থান। ডি এন্ড যে আসোসিয়েটে সব মিলে ষোল জন কর্মচারী। পাঁচ জন আরকিটেকট আনন্দকে নিয়ে। লরেন্স, জন, এমীলী, মাইক।

“ গুড আফটারনুন, আমরা সবাই প্রাথনা করি ডেভিড তাড়াতাড়ী ভালো হয়ে উঠুক। ডেভিডের অবর্তমানে যে দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে তা শুধু আমার নয়, আমাদের সবার। এই ফার্ম আমাদের। এর ভালো মন্দ আমাদের। ডেভিড ফিরে এসে যেন বলতে পারে,” আমি এই ফার্ম দিয়ে গিয়েছিলাম কতগুলো নিঃস্বার্থবান লোকেদের কাছে।” কারো কোন বক্তব্য থাকলে বলতে পারো।” এই বলে আনন্দ থামল।

সবাই চুপ। আনন্দ জানে যদি কোন প্রবলেম আসে তবে আসবে লরেন্সের কাছ থেকে। লরেন্স চেয়েছিল ডেভিডের পরে তাঁর স্থান করে নিতে। ডেভিড দূরদর্শিতা সম্পন্ন লোক, তাই আনন্দকে ডেকে নিয়েছিল পাশে।

আর একজন হতে পারে সে এমীলী।

   এমিলী আনন্দের সাথে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গোড়ে তুলতে চেয়েছিল। আনন্দ সেটা হতে দেইনি। কারণে অকারণে খুঁটী নাটি কাজ নিয়ে সে আনন্দের রুমে আসত। কাজের শেষে যেতে চাইতো আনন্দকে নিয়ে কোন নির্জন জাগায়। একদিন আনন্দ ওকে বলেছিল,” এমীলী তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট, কাজে মন দেও, তোমার সামনে যে ভবিষ্যৎ, সেটা নষ্ট করোনা।” এমীলী আর কোনদিন আনন্দকে বিরক্ত করেনি। তবে একটা চাপা আক্রোশ রয়ে গেছে আনন্দের উপর।

   রুমে আসতেই ইনটারকমে সামান্তা জানালো হিউস্টন থেকে একটা কল আছে আনন্দ ধরবে কিনা? আনন্দ ফরওয়ার্ড করে দিতে বলে হাতের ঘড়িটাতে দেখল দুটা বাজতে চলেছে, জেনীফার তাকে কল করে ডেভিডের খবর দেওয়ার কথা ছিল। নিশ্চয় সে বাস্ত। খারাপ দিকে টার্ন নিলো কিনা ভাবতে ভাবতে ফোনটা উঠিয়ে হ্যালো বলতেই ঐপাশ থেকে রেমীর গলা। রেমী হিউস্টনের সাব অফিসটার তত্ত্বাবধানে। বললও, “ লরেন্সে কে একবার পাঠাতে পারবে কি এখানে? সেন্ডপোর্ট মাল্টি কন্সট্রাকসন টার ব্লুপ্রিন্ট টা একটু পাল্টাতে হবে, লরেন্স বুঝবে ভাল।” আনন্দ লরেন্স কে ডেকে সব বুঝিয়ে বললো। আগামীকালই যেন সে রওয়ানা হয়ে যায় হিউস্টনের পথে।

বিকেল পাঁচটা। জেনীফারের কল না পেয়ে আনন্দ বেড়িয়ে পড়ল হাঁসপাতালের পথে।  

বের হবার পথে মাইক ডাকল আনন্দ কে। “ তুমি হাসপাতালে গেলে আমিও যাবো” বললও মাইক।

“চলো” বলে দুজনে বেড়িয়ে পড়ল।

মাইক হেসীয়ান। বাবা মার একমাত্র ছেলে। ওর যখন ৮ বছর বাবা চলে গিয়ে ছিল আর এক মেয়ের সাথে। অনেক কষ্ট করে মা তাকে মানুষ করেছে। আনন্দকে বলেছিল সব কথা। আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল,” মেয়ে বন্ধু তো আছে জানি, বিয়ে করছো না কেনো?” উত্তর দিয়েছিল, বলেছিল,” আজকাল কজন মেয়ে চায় শাশুড়ী থাকবে একি চালার নীচে? বউ না থাক ভালো , মা কে আমি ছাড়বনা।” আনন্দের চোখটা জলে ভরে এসেছিল, কোন উত্তর দেইনি।

   গাড়ীতে উঠে স্টার্ট দিতেই ফোন টা বেজে উঠল। চেনা নম্বর নয়। ইতস্তো করে ফোনটা উঠালো আনন্দ।

“ কেমন আছেন।” সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর। যার সাথে দেখা হওয়ার কথা ছিল এয়ারপোর্টে কিন্তু বিধির নির্দেশে দেখা হয়নি। “ অনেক কষ্টে আপনার নম্বর টা পেয়েছি। সব ভাল তো?”

   আনন্দ বিশ্লেষণ করলো সব। শুনে সানন্দা বললও,” আমিও ভেবেছিলাম কিছু একটা হয়েছে। তা না হলে

আপনার কথার কোন নড়চড় হয়না শুনেছি আমি।”

“ বাহ! অনেক কিছুই তো শুনেছেন দেখছি।”

উত্তর না দিয়ে সানন্দা বললও,” আসবেন কি, আমার বাসায় রোববার বিকেলে চা খেতে? অবশ্য যদি বাস্ত না থাকেন।”

“ আসবো, ঠিকানা টা টেক্সট করে দিন।”

কথা আর বেশি দুরে আগায়নি।

“ দেখা হলে কথা হবে, আজ তাহলে রাখি।” বলে সানন্দা ফোন রেখে দিয়েছিল।

   হাসপাতালে পোঁছে আনন্দ দেখল জেনীফার ভিজিটর রুমে বসে। মাথা টা হেলিয়ে দিয়েছে দেয়ালে। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। স্বাভাবিক। আনন্দ এপথ দিয়ে গেছে, সে জানে শারীরীক এবং মানসিক যন্ত্রণা।

   আনন্দ কে দেখে বললও,” আজ ডেভিডকে রেগুলার রুমে নিয়ে গেছে। এসব নিয়ে বাস্ত থাকাতে তোমাকে কল করতে পারিনি। চলো।”

আনন্দ ঢুকতেই ডেভিড চোখ মেলে চাইল। ডেভিডের হাতটা চেপে ধরে আনন্দ বললও,” সব ঠিক মত চলছে। তোমাকে কিছু চিন্তা করতে হবেনা।” ডেভিডের চোখের কণে জলের রেখা। জেনীফার বললও, ডেভিড কে রীহেবে নিতে হবে কয়েক মাসের জন্য। আশা করছে সব ঠিক হবে। আগের মত না হলেও কাজ করার মত শক্তি ফিরে পাবে। জেনীফারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আনন্দ আর মাইক বেড়িয়ে এলো।

   রোববার বিকেল পাঁচটায় আনন্দের গাড়ী এসে দাঁড়ালো সানন্দার বাসার সামনে। একগোছা ফুল সাথে করে এনেছে সে। এই ধরনের ফর্মালিটি সে করেনি অনেকদিন। আজ নিয়ে এলো। কেন? নিজেও জানেনা। বেল বাজাতেই ঠোটের কোণে হাসিটা দিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল সানন্দা। পরনে কচি কলাপাতা রংএর শাড়ী। মাথায় সেই একি ভাবে আলতো করে ফেলে রাখা আঁচল।

“ শুনেছি আপনার সময় জ্ঞানের কথা। আজ পেলাম তাঁর নিদর্শন.”

“ কোথা থেকে এসব কথা শুনছেন?” বলে আনন্দ ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিলো সানন্দার দিকে।

ধন্যবাদ দিয়ে বললও,” বাতাসে তো সে কথাই বলে, দেখুনতো অভদ্রের মত দরজা আগলিয়ে কথা বলছি, ঢুকতে না দিয়ে। আসুন”।

ছিমছাম ভাবে সাজানো বসার ঘর। টেবিলে হরেক রকম বিকেলের নাস্তা।

“ আর কেউ আসবে কি?” আনন্দ প্রশ্ন করে।

“কেন?”

 

“ নাস্তার পরিমাণ দেখে বলছি। সব কিছু শুনেছেন, আর আমার খাবারের পরিমাণের কথা শোনেননি।?”

“ তাও শুনেছি, পাখীর মত খান আপনি।”

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ,” এবার বলুন আপনার কথা। “

“ দুই মেয়ে। বড়টার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটটা কলেজে।”

“ বুঝলাম, অন্যজন ওপারে।”

সানন্দার চোখের কোণটা ভিজে মনে হোল আনন্দের কাছে। কথার মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে বললও,” অনেকদিন পর একজন কথা বলার সঙ্গী পেলাম। আপনার আপত্তি নেই তো মাঝে মধ্যে যদি বিরক্ত করি.”।

না , মোটেও নয়।

ঘটে যাওয়া ঘটনার পর আনন্দ মিশেছে অনেকের সাথে। কথাও বলেছে। কিন্তু সুর মেলেনি। একি প্রশ্ন বারবার। উহ, আহ, শব্দ। ভাঙা, ছেড়া মনটাকে আরও ভেঙ্গে দেওয়াই যেন তাদের অভিপ্রায়। সেই জন্যই আনন্দ সরে গিয়েছিল ওদের মাঝ থেকে।

   পেয়েছিল আরেক বান্ধবী কে। একসাথে লেখা পড়া শেষ করেছিল। থাকে একটু দুরে। বলেছিল,” আনন্দ, তোমার দরকার কথা বলার সাথী। আমিতো আছি। ফোন করবো তোমাকে প্রতিদিন, কথা হবে, দেখবে ভালোই লাগবে।” আজও সেই ধারা বজাই রয়েছে।

   “ কিছু ভাবছেন?”

কিছুক্ষণের জন্য আনন্দ ফিরে গিয়েছিল পেছনে। “ জানেন, আমার এক বান্ধবী, আমার দুঃসময়ে ফোন করতো     প্রতিদিন, শুধু আমাকে উৎফুল্ল করে রাখার জন্য। আপনাদের দুজনের মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল আছে। নামের সাথেও। আপনার নাম সানন্দা ওর নাম শাশ্বতী।”

“তাই! আপনার সেই শাশ্বতী কে দেখা করিয়ে দেবেন কি আমার সাথে?”

“ দেবো, সময় আসুক।”

 আনন্দের সন্ধ্যাটা অতিবাহিত হোল খুব সুন্দর ভাবে। এবার উঠার পালা।

সানন্দা বললও ,” কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা বলি।”

“ বলেন”

“ ঘরে উনন জ্বলে কি?”

“না, জ্বলেনা।”

“ আমার অতিরিক্ত একটা মাছের টুকরা রান্না করা আছে। দিয়ে দেই?”

আনন্দ তাকিয়ে ছিল সানন্দার দিকে। করুণা নয়, আন্তরিকতার ছাপ সারা মুখে ছড়ান।

না করতে পারেনি। শুধু বলেছিল ,” এটা যেন জীবনের রুটিনের মধ্যে না এসে পরে।”

  আনন্দ গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বসেছিল কিছুক্ষণ। পুরো সন্ধ্যাটার একটা বিশ্লেষণ মনে মনে আঁকার চেষ্টা করছিল।

    ফোন টা বেজে উঠল। সু র ফোন।

     “ কেমন আছো মা মনি। “

     “ ভালো, আমার প্রমোশন হয়েছে। এক ধাপ উপরে উঠেছি। কাল রাজের “পেটেন্ট ল” পরীক্ষা। খুব টেনশনে   আছি। বাড়ীর মরটগেজ অ্যাপরুভ হবে কিনা তাও কাল জানাবে। সব একসাথে। টেনশণ আর টেনশণ।”

   এতগুলি কথা একবারে শেষ করে সে যেন বাঁচল।

“ চিন্তা করোনা সোনা, আমি তো আছি।”

 

              সোমবার সকাল, রাস্তায় ভিড়। বিশ মিনিটের পথ ঘণ্টা নিয়ে টান দেয়। আজও তাঁর ব্যতিক্রম নেই। আনন্দের অফিসে পোঁছাতে একটু দেরী হয়ে গেল আজ। রুমে ঢুকে বসতেই দরজাতে টোকা পড়ল। জন দাঁড়িয়ে।

“ কিছু বলবে?” আনন্দ জিজ্ঞাসা করলো।

“ বাবার শরীর খুব খারাপ। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। “

“ তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কেন? চলে যাও তাড়াতাড়ি। ফিলাডেলফিয়া যেতে দুঘণ্টার উপর লেগে যাবে। “   বললও আনন্দ।

   জন ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। ছেলেটা চটপটে। গত তিন বছর আগে পাশ করে বেড়িয়েছে। এমীলীর উপর একটু আসক্তি ছিল, কার্যকরি হয়নি।

   বারো টার দিকে সু ফোন করলো। “ আব্বু, রাজ পাশ করেছে। মরটগেজও অ্যাপরুভড। আম্মু খুব প্রাউড হতো আজ, তাই না?” গলার স্বর টা কান্নায় ভেজা।

“ হা, মা মনি, মামি এখনো প্রাউড হচ্ছে। দেখছে তোমাকে। আমরা সেলিবারেট করবো উইক এন্ড এ, ঠিক আছে?”

       আনন্দের মনটা আজ প্রসন্ন। মেয়ের প্রমোশন, রাজের পরীক্ষায় পাশ, ওদের নতুন বাসা। সবাই কে ডেকে বললো সে কথা। বলল, “ বাহির থেকে নিয়ে আসি খাবার সবায় মিলে খাওয়া যাবে.”

সামান্তা কাছেই ছিল, বললও ,” আনন্দ, তুমি বসো, আমি যাচ্ছি.”

আনন্দ ডলার ওর হাতে দিয়ে নিজের কামরায় ফিরে এলো। সামান্তা নেমে গেল নীচে।

দীপকে ফোন করতে হবে মনে পড়ল আনন্দের। তাম্মানা কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা।

ফোনটা উঠিয়ে ডায়াল করতে যাবে এমন সময় শুনতে পেলো বাহিরে লোকদের আর্ত চিৎকার, সেই সাথে

গাড়ীর ব্রেক করার শব্দ। কিচ কিচ কিচ চ চ–। জানালা দিয়ে তাকাল আনন্দ। লোকের ভিড়। জোড়ও হয়ে কি  যেন দেখছে। পাশে কালো গাড়ী টার থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আনন্দের পেটটা অজানা ভয়ে মোচড় দিয়ে উঠল। সামান্তার এতক্ষণ রাস্তায় পৌছানোর কথা। আনন্দ দৌড়ে গেল নীচে। লোকের ভিড়ে কিছুই দেখতে পেলোনা।

ক্রমশ

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প ৪

                                             ৪ পর্ব

  ভোরে ঘুম থেকে উঠা আনন্দের অভ্যাস। সেই কাঁক ডাকা ভোরে উঠে জিমে যাওয়া ছিল তার নিত্যনৈমিততিক ব্যাপার। এখন ও সে ভোরে উঠে। তবে জিমে আর যায়না। ছেলে মেয়েরা জিজ্ঞাসা করলে বলে,” ছয় প্যাক দেখানোর মানুষ টাই যখন নেই তখন ওটা বানিয়ে লাভ কি।”

   “ লাভ তোমার নিজের জন্য, বাঁচার জন্য, তোমার কিছু হলে তোমাকে সেবা শুশ্রষা করার কেউ নেই।” বলে সু।

     আনন্দ তা জানে। শুনেছিল এক বন্ধুর স্ত্রী কাছ থেকে। বলেছিল,” আনন্দ দা, নিজেকে সুস্থ রাখবেন। কিছু হলে আপনাকে কিন্তু    আমরা দেখতে আসতে পারব না ।”

চোখ বড় বড় করে আনন্দ জিজ্ঞাসা করেছিল,” কেন?”

“ কারণ, আপনি পরপুরুষ।”

       হায়রে, চল্লিশ বছর একসাথে উঠা চলাফেরা করেও আনন্দ পরপুরুষই রয়ে গেল।

     ইদানীং আনন্দের অনেক গানই শুনতে ভালো লাগেনা। শুধু দুটো গান সে গাড়ীতে রেখে দিয়েছে। সকালে কফির পেয়ালা নিয়ে গাড়ীতে উঠে চালিয়ে দেয় গান টা “ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে—“ ফেরার পথে শুনতে থাকে “ আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি—“ আজও তার ব্যতিক্রম হলনা। গান শেষ হোল, আনন্দ এসে পৌছাল অফিসের পারকিং লট এ।

ফোন টা বেজে উঠল।

“ আনন্দ দা, কোথায় তুমি” বেলালের কণ্ঠস্বর। এক সাথে এই আর্কিটেক্ট ফার্ম এ কাজ করতো। চলে গেছে ডালাসে।

“ এতো ভোরে, কি মনে করে?”

“ আসতে পারবে এই উইক এন্ডে? আগে, পিছে ছুটি নিয়ে এসো। এলে পড়ে সব বলবো”

ডেভিড কে বলেছিল ছুটির কথা। সে বস। না করেনি। বস হলেও বন্ধুর মত। আনন্দের অসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বলেছিল,” মন শক্ত হলে কাজে এসো। আমি এদিক টা সামলাবো।”

ডালাসে আনন্দের এই প্রথম আসা। গ্রীষ্ম কাল। সূর্যের তাপ টা একটু বেশি। বেলাল এসে ছিল এয়ারপোর্টে। আনন্দের চেয়ে বয়সে সে অনেক ছোট। পঞ্চাশের কোঠায়। একটা মিষ্টতা আছে ওর মধ্যে। যা কিনা আকর্ষণ করে।

   “ তুমি কোনদিন একলা আসবে, ভাবি নি। সবই ভবিতব্য। যাক সে সব কথা, যার জন্য তোমাকে ডেকে আনলাম। আমার বিয়ে.”

     কথাটা বেলাল এতো দ্রুত, ভণিতা না করে বলে ফেলল যে আনন্দ প্রথমে বুজে উঠতে পারলো না সে কি বলছে।

   “ কি বললে?”

   “ বিয়ে, হ্যাঁ, বিয়ে করতে যাচ্ছি, তাই তোমার আশীর্বাদ চাই।”

   বেলাল গত পাঁচ বছর ধরে ডিভোর্স। প্রেম করেই বিয়ে করেছিল, কিন্তু সব প্রেমের ধারা বিয়ের পড়ে এক গতিতে চলেনা। ওরও চলেনি।

“তা ভাগ্যবতী টা কে?”

“ কল্যাণী! একই ফার্মে কাজ করি। ডিভোর্স। আমারই মত। বুঝতেই পারছো। প্লাসে প্লাসে, প্লাস। এবার নেগেটিভ হওয়ার কোন উপায় নেই। নাম কল্যাণী, কাজেই কল্যাণ কর কিছু একটা হবে মনে হচ্ছে।”

ওর এই উচ্ছ্বসিত ভাব, অতীতকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, হাস্যজ্বল মুখ, এর জন্যই বেলাল কে তার ভালো লাগে।

   গাড়ী এসে থামল বিরাট এক অট্টালিকার সামনে।

   “ এই আমার এপার্টমেন্ট। এখানে থাকতে তোমার কোন অসুবিধা হবে নাতো আনন্দ দা?”

কি যে বলো? আমি কোন কাজে লাগতে পারি?

না, তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।

   যথা রীতি খুব সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হোল অনুষ্ঠান। অপূর্ব লাগছিল কল্যাণী কে। সিম্পল ভাবে সাজা। সব কিছুর মধ্যে মার্জিত ভাব। দুজন কে মানিয়েছে। আনন্দের কাছে এসে দাড়াতেই বললও,” আশীর্বাদ করি, ভালো থেকো।”

কল্যাণী বললও “ তোমার কথা অনেক শুনেছি আনন্দ দা, আজ দেখলাম। আশীর্বাদ করো যেন তোমার আর ভাবির মত মন নিয়ে চলতে পারি। তুমি তো ওর মেনটর।”

       ওরা চলে গেল। হোটেলের সুইট অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। যাওয়ার আগে বেলাল আনন্দের কানে কানে বললও,”

কাল হবে বড় অনুষ্ঠান, সুট এনেছ তো?”

না আনি নি, তুমি তো বলনি।

নিজের কপালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে, ইস বলে, বললও “ আমি ফিরে আসি, একটা ব্যবস্থা হবে”।

আনন্দ ফিরে গেল বেলালের এপার্টমেন্টে। তখন রাত বারটা।

         অনেক লোকের আগমন। বিভিন্ন রংএর শাড়ী পরিহিতা মহিলারা বিভিন্ন ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তড়িঘড়ি করে একটা সুট সে কিনে ছিল। ভালোই ফিট করেছে। বেলাল কে আনন্দ বলেছিল ,” আজ তোমার দিন, আমাকে নিয়ে ভেবোনা, আমি আমার মত আনন্দ করবো, তুমি করো তোমার মত।”

আনন্দ দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশে, হাতে সফট ড্রিঙ্কস।

“ আপনি বুঝি একলা? আগে দেখেছি বলে মনে পরছেনা।” কথা শুনে তাকাল আনন্দ। লম্বা ছিপছিপে গড়ন। সাজটা একটু উগ্র মনে হল।

“আমার নাম প্রতিমা।”

ছোট বেলায় আনন্দ ওর হিন্দু বন্ধুদের সাথে প্রতিমা দেখতে যেতো। নিখুঁত টানা চোখ, দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং। আনন্দের কাছে এ প্রতিমা সে প্রতিমা মনে হলনা।

তবুও বলতে হোল,” আমি একলা এসেছি, বেলালের বন্ধু, থাকি নিউ ইয়র্কে।” একসাথে সব তথ্য বলে গেল আনন্দ যাতে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন না আসে।

“ চলুন না ঐ টেবিল টা বসে গল্প করা যাবে।”

আনন্দ একটু হোঁচট খেলো, জিজ্ঞাসা করলো,” আপনিও একলা বুঝি?”

“ হাঁ, কর্তা আসতে পারলো না, মাজায় ব্যথা।” বলে মিটমিট করে হাসল।

আনন্দ আমতা আমতা করতেই কোথা থেকে এসে হাজির হোল বেলাল।

“ কেমন আছো প্রতিমা দি?”

“ তোমার বন্ধু খুবই লাজুক।”

“হাঁ, ও সব সময় লাজুক প্রকৃতির”। বলেই আনন্দের দিকে তাকিয়ে বললও” আনন্দ দা তোমার সাথে কোথা আছে।” বলে আনন্দ কে হেঁচকা টান দিয়ে পাশে নিয়ে গেল বেলাল।

“ কি কথা?” জিজ্ঞাসা করলো আনন্দ।

“ কোন কথা না, শুধু তোমাকে বাঁচানো, উনার হাত থেকে। দাড়াও তোমাকে আমি পরিচয় করিয়ে দেই কয়েক জনের সাথে,”

বলে, আনন্দ হাতের ইশারায় কাকে যেন ডাকতে চাইল, এমন সময়,

“ কেমন আছেন।”

কথা শুনে দুজনেই তাকাল। কাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন বোঝার আগেই, বেলাল বলে উঠল, “ আরে সানন্দা, তুমি? কবে এলে?”

উত্তর দেওয়ার আগেই আনন্দ বললও,” আপনি এখানে?”

বেলাল ঢোক গিলে জিজ্ঞাসা করলো,” তোমরা এঁকে অপর কে চেনো নাকি?”

“ চিনি বললে ভুল হবে। তবে শেষ দেখে ছিলাম মলের এস্কেলেটরে।” বললও আনন্দ।

মুখের সাজের সাথে মেলানো রুচিময় শাড়ীর আঁচল আলতো ভাবে মাথার পরে ফেলা সানন্দার।

“ আমি আপনাকে দেখেছি আমার বোনের বাসায়। দেখেছি ভাবীর সাথে। তাও অনেকদিন হয়ে গেল। তা এখানে কি মনে করে?”

“ সেই প্রশ্ন তো আমারও” আনন্দের জিজ্ঞাসা।

“ আমার কাজিন থাকে এখানে। এসেছি তার বাসায়। শুনলাম বেলাল ভাই এর বিয়ের রিসেপশান। চলে এলাম”।

“ খুব ভালো করেছ। আনন্দ দা কে আমিই টেনে নিয়ে এলাম। তা, তোমরা দুজন বসে গল্প করো, আমি ওই দিকটা সামলাই” বলে সে চলে যেতে যেয়ে একবার তাকাল আনন্দের দিকে রহস্যময় হাসি হেসে।

“ যদি কোন আপত্তি না থাকে তবে চলুন ঐ টেবিল টাতে যেয়ে বসি। সব অপরিচিত, অপরিচিতা দের মধ্যে আপনিই কিছুটা পরিচিত। কথা বলে সময় টা কাটবে। অবশ্য —,”

সানন্দা আনন্দের কথা শেষ করতে না দিয়ে বললও,” আমার আপত্তি নেই। চলুন।”

কোনার টেবিলে যেয়ে বসলো দুজন। এই মুহূর্তে টেবিল টা খালি তবে বেশীক্ষণ আর খালি থাকবে বলে মনে হয়না। সবাই বসতে শুরু করেছে।

“ কবে ফিরবেন?” সানন্দার প্রশ্ন

   “মঙ্গল বারে।”

“ ঐ দিন তো আমিও ফিরছি? তাহলে আবারো দেখা হবে।”

“ তাই তো মনে হচ্ছে?” আনন্দ হাসল একটু।

“ আপনার দুঃখ আমি বুঝি। কারণ,

কথা শেষ হলনা সানন্দার, কলকল করতে করতে চার পাঁচ জন মহিলা ঘিরে ধরল সানন্দা কে।

“ কি রে পরিচয় করিয়ে দে আমাদের সাথে?” এক সাথে সবাই বলে উঠল।

আনন্দ নিজেই নিজের পরিচয় দিলো। ওরা নাছোড় বান্ধা। কিছুক্ষণের জন্য রসালো একটা খবর নিয়ে আনন্দ করতে পারলে মন্দ কি? এই ওদের অভিপ্রায়। কিন্তু আনন্দ ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে বললও,” উনি ও নিউ ইয়র্ক বাসী, আমিও। সেই সুবাদে পরিচয়। বসুন না আপনারা সবাই। আলাপ করি।”

   ওরা বসলো। স্টেজ থেকে ভেসে এলো স্বপ্নার রবীন্দ্র সঙ্গীত। সবাই চুপ। নিস্তব্ধ চারিদিক। কারো মুখে কথা নেই। গানের ঝঙ্কারে হলঘর হয়ে উঠল মুখর। করতালি দিয়ে শেষ হোল সুন্দর একটা সন্ধ্যা। এবার যাবার পালা।

আনন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বললও,” আসি ! এবার দেখা হবে আপনাদের সাথে কোথাও, কোনখানে ।”

সানন্দা আনন্দর দিকে তাকিয়ে বললও,” দেখা হবে এয়ারপোর্টে।”

আনন্দ হা সূচক অর্থে মাথা নাড়িয়ে বললও ,” অবশ্যই”।

 

বেলাল, কল্যাণী চলে গেল ওদের সুইটে। আনন্দ ফিরে এলো ঘরে। চোখের সামনে ভেসে উঠল, প্রতিমা, সানন্দা, আরও অনন্যাদের মুখ। আনন্দের মনে হোল তার জীবদ্দশায় এরকম একটা সুন্দর সন্ধ্যা আবারো আসবে কি না কে জানে।

রাত তখন দুটা।

আনন্দের টেলিফোন বেজে উঠল। ওপাশে কান্নার স্বর। এপাশে আনন্দের মুখ ফ্যাঁকাসে।

ক্রমশ:

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প (৩য় পর্ব)

                             ৩য় পর্ব

   হঠাৎ কি হয়েছিল আনন্দের সে নিজেও জানেনা। হয়ত ব্লাড সুগার নিচে

নেমে গিয়েছিল অথবা শরীরের উপর যে অন্যায় অত্যাচার চলছে তার ই প্রতিক্রিয়া।

পড়ে যেতে যেয়ে রেলিং টাকে আঁকড়িয়ে ধরেছিল আনন্দ, বাঁচিয়েছিল মাথা টাকে, নচেৎ আজ আনন্দের ইতিহাস লেখা হতো অন্যভাবে। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে দরজা টা খুলল আনন্দ। ঘর অন্ধকার। সেঁতসেঁতে, মাকড়সার জাল। জলে ভরে এলো চোখ, এমন তো ছিলনা এ বাড়ি। একজনের অবর্তমানে ভেঙ্গে চোঁচির হয়ে গেল সব। সোফাতে বসলো সে।

কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। মাথার দুপাশের শিরা দুটোর দপদপানি অস্থির করে তুলল আনন্দকে। দীপ আর সু কে ফোন করলো। ওরা আসবে।

     আনন্দ তাকিয়ে ছিল বড় ছবিটার দিকে। নাকে নথ, কপালে টিকলি, মুখে আধো হাসি, আধো লজ্জা, ফিরে গিয়েছিল আনন্দ অনেক পিছনে। ভাবতে চেয়েছিল সেদিন টার কথা, হোলনা, দরজার বেল টা বেজে উঠল। খুলে দিতেই হূরমুড় করে ঢুকল ওরা চারজন।

সু জড়িয়ে ধরল বাবা কে। মাথায় হাত রেখে দাঁড়ালো বৌমা। “ তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো বাবা, চোখের কণে কালি, দেখেছ একবার তাকিয়ে আয়নাতে?” বলে সু মুখ টা গুঁজে দিলো বাবার বুকে।

   বৌমা বললও,” বাবা শেভ করে গরম পানি দিয়ে গোসল টা সেরে নাও। আমি খাবারের অরডার দিচ্ছি, এখনি এসে পড়বে।”

“ দাড়ি আর কাটবো না বৌমা, ভালোই তো দেখাচ্ছে?”

   “ না, মোটাও না, দাড়িতে তোমাকে মানায় না বাবা।” বললও বৌমা।

কপালের দপদপানি টা ম্লান হয়ে এলো ওদের কে দেখ। দীপ আর রাজ এসে বসলো বাবার পাশে। আনন্দ জড়িয়ে ধরল সবাইকে। কেন জানি চোখের জল আটকিয়ে রাখতে পারলো না। বয়ে এলো দুগাল বেয়ে।

   “ পেয়েছ, পেয়েছ শান্তি কোথাও যেয়ে?” দীপের প্রশ্ন।

“ তোমার প্রশ্ন পরে, এখন নয়, বাবা, তুমি গোসল করে এসো।” বলে বৌমা গেল টেবিল গোছাতে।

     আনন্দ উঠে এলো উপরে। আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল, ভেসে উঠল সামীতার মুখটা। মেয়ে টা কেঁদে ছিল অনেক। কেন জানি বুঝতে পেরে ছিল আনন্দ হয়ত আর কোনদিন ফিরে আসবেনা। আনন্দ তাকে চেপে ধরে বলে ছিল,” আসবো, আমি আবার আসবো এখানে।”

টেবিলে বসে দীপের আবার এঁকেই প্রশ্ন। আনন্দ বলে,” পেয়েছিলাম,পেয়েছিলাম সাদা পাহাড়ের চুড়ায়, পেয়েছিলাম ছোট্ট মুখটার মাঝে। এ যেনো পেয়েও না পাওয়া।”

আসলে আমার চারিদিকে ছিল শান্তির নীড়, ওটাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল আমার কাছ থেকে। তাই আমি খুঁজে ফিরি তার সন্ধানে। হয়ত পাবো না সেই রূপে, আসবে অন্য রূপে, অথবা আসবেনা কোনদিন।

   রাজ বলল, “তুমি লেখো, লেখার মাঝে লোকে খুঁজে পায় আত্মার শান্তি।”

   না লেখা আমার আসেনা।  

“ কেন? তুমি না প্রেম করতে? মা কে লিখতে চিঠি। তাতে নিশ্চয় অনেক কিছু লেখা থাকতো।” বললও সু।

“ তা লিখতাম, তোমার মা কি বলেছিল শোনও, বলেছিল,” আচ্ছা, আমি তো তোমার বৌ হয়নি, এখনো প্রেমিকা, ইনিয়ে বিনিয়ে তো কিছু লিখলে পারো, তা নয় , সব দরকারি কথা। সাবধানে থাকবে, বাহিরে গেলে কার্ডিগান গায়ে দেবে, ঠাণ্ডা লাগতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।” কাজেই বুঝতে পারছ আমার লেখার ধরন। ও আমার দাড়া হবে না। লোকে চায় সাহিত্য, আমি ওটার মানেই বুঝিনা।”

কথা বলতে বলতে আনন্দের চোখ দুটো জড়িয়ে এলো। ভীষণ ক্লান্ত সে।

কিছু ঠিক করলে? সু র প্রশ্ন।

কাজে ফিরে যাবো। দেখি, কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পারি কি না। এই বলে আনন্দ উঠে পড়ল। ওরা বাড়িয়ে পড়ল যার যার পথে। এটাই জীবন।

   মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল আনন্দের। অস্থির হয়ে পায়চারি করছিল সারা ঘর। বাহিরে তখন অঝরে বৃষটি। যেন কেও কাঁদছে।

ভোর হয়ে এলো। আবছা আলো আবছা অন্ধকারের মধ্যে আনন্দ বেড়িয়ে পড়ল এক গোছা লাল গোলাপ নিয়ে। যখন সে ফিরে এলো সূর্য তখন মাথার পড়ে। অত্যন্ত ক্ষুধার্ত সে। গাড়ী পার্ক করলো মলের নিচের তালায়। দৌড়ে যেয়ে পা দিলো এসকেলেটরে। নতুন ফুড কোর্ট খুলেছে। অনেকদিন আসেনি সে। এসকেলেটরের মাঝ পথে চোখা চোখী হোল কালো সালওয়ার কামিজ পরা, মাথায় কালো ওড়না আলতো ভাবে জড়ানো, শ্যামলা উজ্জ্বল রং এক মহিলার সাথে। হাতে দুটো চিকন সোনার চুড়ি। হাসির রেখা দেখতে পেলো আনন্দ মহিলার ঠোটে। মনে হোল কোথায় যেন দেখেছে সে। সৃতির ভাজে রয়ে গেছে, মনে এলো না তার। আর একবার পিছনে তাকাতেই দেখল মহিলাও তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। সেই হাসিটা মিলিয়ে যায়নি। নিচের তালায় পা দিলো সে, আনন্দ হোঁচট খেয়ে দাঁড়ালো দোতালায়।

ক্রমশ

Continue Reading

এক অসমাপ্ত গল্প

                                                                               প্রথম পর্ব

সবাই ব্যস্ত ।

আনন্দ নয়। আনন্দের হাতে অফুরন্ত সময়। বছর পেরিয়ে গেল সে একেলা। সে ভাবে, কি আশ্চর্য্য  এখনো সে হেসে খেলে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাচ্ছে কারো বাসায়, দেখছে টিভি, শুনছে গান। তর্ক করছে পলিটিকস নিয়ে. বাড়ছে ভাত একলা ঘরে। সব চলছে তার নিজের গন্ডিতে। 

  ওর জানালার পরদাটা কাজ করছে না। ইচ্ছে নেই ওটাকে ঠিক করার। যাক সব ভেঙে টুকরো হয়ে।  সেদিন উনুন জ্বালাতে যেয়ে আংগুলটা পুড়ে গেল, ঔষধ ছিল, সময় চলে গেছে ঔষধের। চা বানানো, ডিম ভাজা ছাড়া আর কোন কিছু করার মুরোদ তার নেই. রান্না ? এই শব্দ টা তার ডিকসনারির বাহিরে । 

  বড় রান্না ঘর আজ কাজের অভাবে কাঁদছে। আদা রসুন পেঁয়াজ আজ আর আসে না ঘরে। রেফরিজারেটর খালি। আছে শুধু কটা ডিম, আর চা র দুধ । মাঝে মাঝে থাকে পুরানো ভাত। আর অন্যর দেওয়া মাছ, ডাল। 

    প্রিসিলা এসেছিল সেদিন। ঘর মুছতে। দরজা খুলে সুপ্রভাত জানাতেই তাকিয়ে রইল আনন্দের দিকে। ” কিছু বলবে?” 

   ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বলল,” তোমার মুখের চাপা হাসিটা আর নেই।”

   হায়রে পোড়া কপাল. কবে যে সে প্রান খুলে হেসে ছিলো মনে করতে পারে না। 

বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। বাসার সামনে টাতে আর আগের মত জৌলুশ নেই। চিঠির স্তুপ পড়ে আছে । ঘরের আনাচে কানাচে মাকড়সার জাল। টেবিল, চেয়ারে ধুলো। প্রিসিলা আসেনি অনেক দিন। দুটা ডিম এখনো আছে রেফরিজারেটরে. দুধটা খারাপ হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার । আলো আর জ্বলে না।

 

                                                                   দ্বিতীয় পর্ব

রুক্ষ চেহারা, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উস্খখুস্ক চুল, চিরুনি পরেনি চুলে কত দিন জানা নেই, ব্যাগপ্যাক টা কাঁধে নিয়ে আনন্দ দাঁড়িয়ে ছিল বাসার সামনে। ফিরে এলো এক মাস পর। বেড়িয়ে ছিল মনের শান্তির সন্ধানে। পেয়েছে কি? যাওয়ার আগে ডেকে ছিল তার দুই সন্তান কে। দিপ আর সু আনন্দকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,” তোমার কি না গেলেই নয় বাবা ? বাধা তোমাকে দেবনা, এই যদি তোমার শান্তির পথ হয় তবে তাই হোক। আমরা তোমার অপেক্ষায় থাকব”। 

    ব্যাগপ্যাক নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে ছিল আনন্দ। ভুলে গিয়েছিল বয়স তার ষাটের কোঠা পেরিয়ে গেঁছে অনেক আগে। কি এক নেশা তাকে পেঁয়ে বসে ছিল. কোথায় গেলে শান্তি । সেই মোহের টানে এসে পড়েছিল  নেপালের বকতাপুরে। রাত তখন ১১:৩০। ছোট্ট হোটেলের ছোট্ট একটা কামরাঁয় ঘুমিয়ে ছিল আনন্দ । ভোরে দরজায় টুক টুক শব্দে ঘুম  ভেঙে গেল তার। সুর্যের আলো এসে পড়েছে জানালা দিয়ে। দুরে পাহাড়ের চুড়া সাদা বরফে ঢাকা। মুহুর্তে  আনন্দের মনে হলো ঐ সাদা চুড়া তাকে ডাকছে। ওটা তো বরফ নয়, সাদা কাপড় পরা পরিচিত মুখ, ডাকছে তাকে, “এসো, এতদূর যদি এলে, আর একটু পথ এসো ,পাবে আমাকে”। 

টুক টুক শব্দ আবার। ফিরে এলো বাস্তবে , আনন্দ। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো এক মহিলা, হাতে কাপ। ” বাবু আপনার চা.” চা র কাপ হাতে নিয়ে আনন্দ জিজ্ঞেসা করেছিল, ” বলতে পার কিভাবে যাবো চানগু নারায়ন মন্দিরে”?

 “হা বাবু” আগে চলুন আমার বাসাঁয় ওখান থেকে যাব মন্দিরে। ” তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়েছিল আনন্দ । এসে দাঁড়াল  ছোট ছিম ছাম এক বাসার সামনে। উঁঠানে গাছের ছায়া। মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা সেই বাসা যেখানে সে আংটি পরিয়ে ছিল ওর আংগুলে.

    হাতে টান পড়তেই তাকিয়ে দেখে ছোট্ট একটা মেয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কোকরা চুল, কপালের পাশে কালো 

টিপ। আনন্দের কি হলো সে নিজেও জানে না। কোলে তুলে নিলো তাকে, মনে হলো সে জেনো বলছে,”দাদুমনি, তুমি কি আমার মাঝে বাঁচতে পারনা?

 খুজে পাবে দাদিকে আমার মাঝে” 

   নাম কি তোমার?

উত্তর এলো ওর মা র কাছ থেকে। ” ও কথা বলতে পারেনা, বাবু জি” শুনে আনন্দ ওঁকে চেপে ধরেছিল বুকের মাঝে। ওর গরম নিশ্বাস পরেছিল আনন্দের মুখে। চুপটি করে মুখটা গুঁজে দিয়ে ছিল আনন্দের বুকে। 

   হোটেলে আর ফিরে যাওয়া হয়নি, যায় নি মন্দির দেখতে। সামিতাদের বাসাতেই থেকে গিয়েছিল বাকি দিন গুলো। বসে থাকত পাহাড়ের পাদ দেশে

সামিতাকে পাশে নিঁয়ে, তাকিয়ে থাকত চুড়ার দিকে।

 পাশের বাসার টেমীর ডাকে ফিরে এলো আনন্দ তার জগত থেকে।

” এই এলেন বুঝি?”

হা, উত্তর দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল আনন্দ । দরজা টা খুলতে যেয়ে খুলতে পারল না, 

মাথা টলকে উঠল, অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেলো টেমীর চিৎকার ,

আ ন ন দ —-

Continue Reading

স্বর্গ

কেমন আছো? ডাক শুনে চোখ তুলে চাইল অনির্বাণ। বিশ্বাস হচ্ছেনা। চোখ দুটো কচলিয়ে আবারো চাইল। এই বয়সে চোখে ছানি পড়ার কথা নয়।

অঞ্জনা তুমি?

হা আমি। কি করছো একলা বসে।

কিছু নয় । কফি টা শেষ করে উঠবো ভাবছিলাম। তুমি যখন এলে তাহলে আরও একটু বসব। তুমিও বসো। সেই যে চলে গেলে বাই বলে, পেছনে আর তাকাওনি। আমারও বলার কিছু ছিলনা।

হা আমাকে বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল। আমার করনীয় কিছু ছিলনা।

নতুন জায়গা কেমন লাগছে ?

যার হাত ধরে চলে গিয়েছিলাম, বলতে পার যে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তার খোজ আমি আর পরে পাইনি। পরিচয় হয়েছিল অন্যদের সাথে। তারা তাদের মত, নিজেদের নিয়ে বাস্ত। আমি আমার মতই আছি। ঘুরি ফিরি। হই হট্টগোল নাই। ফিরে যে আসবো তোমার কাছে তারও উপায় নেই। তোমাকে যে বলবো এসো আমার এখানে তা বলতে মনে দ্বিধা লাগে। অন্য পথে পা দেওনি দেখছি? এখনো একলাই রয়ে গেলে।

ঠিক ধরেছ ? লোকে কানা ঘুসা করে। কান দেইনে। তোমার উপর রাগ দুঃখ কোনটাই নেই। পারিপার্শ্বিক অবস্থা তোমাকে বাধ্য করেছিল। সেই কথা ভেবেই কাটিয়ে দিচ্ছি দিনগুলি।

সারাদিন কি করো?

কাজ শেষে বাসায় এসে চাল টা চাপিয়ে দেই। তুমি চলে যাবার পরে উনন আর আমার জলেনী। কিনে আনা অথবা অনন্যের দেওয়া খাবার গরম করে গলাধী করন করি।

এই ডিপার্টমেন্ট তো তোমার আয়েত্তে কোন সময় ছিলনা।

কি করবো বলো ? বাধ্য হয়ে অল্প কিছু করতে হয় বেচে থাকার জন্য।

ছুটির দিন গুলি কি ভাবে কাটে?

দূরে ধুধু মাঠে একলা বসে থাকি। বাঁশি বাজাতে জানলে ভালো হতো। জনও শূন্য মাঠে বাঁশির সুর বিরহের বেদনা এনে দেয়। বল তোমার কেমন লাগছে নতুন জাগা। বললে তো যার সাথে হাত ধরে গেলে সে এখন তোমার সাথে নেই।

না নাই। তাকেও বাধ্য হোয়েও অনন্যদের কাছে যেতে হয়। ওই যে বললাম একা একাই কাটাই। জাগা টা সুন্দর । বলেতে পারো মনমুগ্ধ কর। যেনো হাতে আকা ছবি । ফলের   গাছের অভাব নেই। নদী বইছে নিচে। ওখানকার যারা বাসিন্দা তাঁরা সবাই যে যার মত বাস্ত। বন্ধুত্ব করার কোন উপায় আছে বলে মনে হয়না । আমি যে শহরে থাকি সেটা বিশাল। ওখান কার আইন কানুন এমন ভাবে তোইরি, যে তোমাকে কিছু করতে হবেনা। তুমি শুধু থাকবে ধ্যানএ মগ্ন। হত্যা রাহাজানি বলে কিছু নাই।

তা জাগা টা কোথায় বলবে কি? তা হলে আমিও না হয় তল্পী তল্পা ঘুছিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম।

না তোমার এখনো সময় হয়নি । বুঝেছি তোমার দিন আগের মত আর কাটছে না । আমি যে তোমার কাছে আবার আসবো তারও কোন উপায় নেই। আজ অনেক দিন পরে এই শহরে এসে ছিলাম, তোমাকেই খুঁজছিলাম , পেয়েও গেলাম। তাও আবার একেলা।

ভালো করেছ। অনেক দিন পরে তোমাকে দেখে ভালোই লাগছে।

মনে আছে আমরা কাঞ্চন জঙ্ঘা দেখতে গিয়েছিলাম। ভোরের সূর্যের রশ্মি এসে পরেছিল পাহাড়ের চুড়ায়। অপূর্ব আলোর খেলা। তুমি আমার কোলে মাথা রেখে বলেছিলে , কি বলতে দেবেনা ?

না , পিছনে আমি ফিরে যেতে চাইনা । তুমি ও না । তাতে করে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে মনের দিক থেকে । তোমাকে সামনে চলতে হবে। সেই যে গুন গুন করে গাইতে “ নদীর নাম সই আঞ্জনা” এখনো গাওকি?

গাই মাঝে মাঝে। জানো কাল তোমার দুটো ছবি অনেক বড়ো করে বাধিয়ে রেখেছি আমাদের শোবার ঘরে, যাবে দেখতে ?

না থাক , যে বাসা তুমি ছেড়ে গিয়েছিলে নাই বা গেলে সেখানে । কতক্ষন থাকবে?

বেশিক্ষণ নয়। ফিরে যেতে হবে । তোমার সাথে আবার কবে দেখা হবে জানিনা । ভালো থেকো।

এক্সকীউস মি বলে একজন অনির্বাণ কে সম্বোধন করলো

অনির্বাণ তাকাল লোকটার দিকে.

এই খালি চেয়ারটা নিতে পারি?

Continue Reading

দিলারা

নাম তার দিলারা

দেখে ছিলেম বোনের বাসায়

হলুদ রঙের কামিজ পড়ে মুছছিল সে টেবিল টা

পায়ের শব্দে তাকালো সে আমার দিকে

বলল, চা খাবে মামা

ছোট্ট করে হাসি দিয়ে মিলিয়ে গেল রান্না ঘরে .

ছুটো ছুটি করে সে ,বসে না সে এক দন্ড

বললে বলে, বসবো আমি রাত নটায়

কেন?

তখন হবে আমার দেখা সিরিয়াল টা

চলে এসেছি অনেক দুরে

অলস সময় মনে পড়ে ওই হাসিটা

ডাকবে সে কী, বলবে আমায়

মামা, আনবো তোমার চা টা

Continue Reading