চারিদিকেছরিয়েপড়েছেকনারঅসুস্তারকথা।দলেদলেবন্ধুবান্ধবশুভআকাংকিরাআসছেওকেদেখতে।ওজানতোনাসবাইওকেকতভালোবাসে।ভালবাসতোওরউদারমনেরজন্য, ভালবাসতোওরসততার জন্য।
শুরুহলোকিমোথেরাপিদেওয়া।ডক্টররেফএরত্তাবধানে। বায়োপসির রেজাল্টএসেছে।ভালোনয়।দুটোমিউটেশন। এক্সন ২০ এক্সন ২১ । এক্সন ২০ রচিকিৎসাআছে। এক্সন ২১ এরচিকিৎসানেই।ডক্টররেফআশাবাদী।বলল।” আমরাদুটোঔষধএকসাথেদেবো, প্র্তিতিনসপ্তাহপরপর”।তাতে আশা করছি টিউমার টা ছোটো হয়ে যাবে”। এসে ছিলো কৌশিকের বোন Ohio থেকে। সেবা করে ছিলো আড়াই মাস। দাড় করিয়ে ছিলো কনাকে চলার মত করে। এসে ছিলো দেশ থেকে কনার ভাবী, এসে ছিল বোন। তাদের সেবা কৌশিক দেখেছে, দেখছে তাদের অকেলানত পরিসরম। কৌশিক নিভর্তে চোখের জল ফেলেছে। বিধাতার কাছে প্র্াথর্না করেছে তার জীবনের পরিবর্তে কনার জীবন ফিরিয়ে দিতে।এই অসহায় মুহুর্তে কৌশিক ,কনার পাশে এসে দারিয়ে ছিল বিয়াইন (সুসানতুর শাশুড়ি), দাড়িয়ে ছিল জলি ভাবি, চমন ভাবী, রিতা ভাবী। কৌশিক জানে তাদের সেবার ৠন কোন দিন শোধ দেবার নয়। নিঃস্বার্থ ভাবে তারা করে গেছে।
কনা ভালোর পথে। তবুও এ রোগের কোন বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস নেই বলেই সুসানত খোজ নিয়েছে Yale University তে। ওরা বলেছে, সব দরজা যখন বন্ধ হয়ে যাবে তখন এক মাত্র্ উপায় Clinical Trial Medicine.যদি কাজ হয়। কৌশিক মনের জোড় ফিরে পায় কনার শারিরিক সুস্থতা দেখে। বলে, চলো দেশ থেকে ঘুরে আসি। গিয়ে ছিলো। কৌশিক দেখে ছিলো কনার উচছলতা দেশের মাটিতে। যত টুকু আনন্দ করার তা সে করে ছিলো। হয়ত তার অদ্রিশট বুঝতে পেরেছিলো এই তার শেষ আনন্দ।
দেশ থেকে ফিরে এলো। ঔষুধের কর্মোক্ষমতা একটা একটা করে কমতে থাকলো। কনা বুঝতে পারলো তার সময় বেশি নেই। বলল, “সুসমিতা কে ডাকো।” সুসমিতা কে বলল, মা তুমি রেজ কে বলো ওর বাবা মা কে বলতে, আমি থাকতে থাকতে সবকিছু করে দিয়ে যেতে চাই” রেজ সুসমিতার সমপরকো কৌশিক কনা জানে। রেজের বাবা মাকেও ওরা চেনে। অনেক আগের পরিচয়। রেজের বাবাও ফারমাসিসট। কৌশিকের তিন বছরের সিনিয়র। বিধাতার আশীর্বাদে সূশটো ভাবে সম্পন্ন হলো ওদের বিবাহ। রেজকে কনার খুব পছন্দ। কৌশিকের ও।
কনার শাস কোষ্ঠও ক্রমেই বাড়তে থাকলো। কৌশিক কে ডেকে বলল,”আমার সময় এসে গেছে সোনা”। কৌশিক পাগলের মত ছুটে গেলো Yale University Smilow Cancer center এ, বলল,” ওকে Clinical Trial Medicine দাও,”
দেওয়া হলো। কাজ হলো না। সে তখন কষ্টের শেষ সীমায় পৌছে গেছে। কৌশিক কে কাছে ডেকে বল, বাই। কেনো এমন বলছো। ধীরে ধীরে বলল, আমাকে যেতে দাও। কনা চলে গেলো।
কান্নার রোল উঠল Smilow Cancer Center এর ২২২ কক্ষে। কাদঁছে ছেলে সুশান্ত, কাদছে মেয়ে সুস্মিতা। কৌশিক চোখের পানির অঝোর ধারাকে ধরে রাখতে পারেনি। চোখের পনিতে ঝাপসা হয়ে আসা দৃশটি ফেরাতে পারছিল না কনার দিক থেকে। সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ওকে। মুহুর্ত কয়েক আগেও যে ছিল জীবন্ত , এখন সে লাশ। কেনসারের সাথে কনার আড়াই বছরের লড়াই শেষ হয়ে গেল। জীবনের সব আড়ম্বর হারিয়ে সে আজ রিক্ত হাতে বিদায় নিল। নিঃশেষ হয়ে গেল কৌশিক। দীর্ঘ প্রায় চল্লীশটি বছর পায়ে পা মিলিয়ে পথ চলেছে যার সাথে, হাতে হাত ধরে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে গেছে যার সাথে, সে আজ তাকে অসহায় ফেলে রেখে চলে গেল। চলে গেল সেই রহসময় অজানা জগতে, যেখান থেকে কেউ আর কোনোদিন ফেরে না।
কৌশিক আজ একলা বসে সৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে দেখে চল্লিশটি বছরের বিবাহিত জীবনে একটা দিনও খুজেঁ পেলোনা যেখানে হাসি আর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু ছিল। বাড়ীটার আনচে কানাচে তার স্রীতী এখনও উজ্জ্বল। যেদিকে তাকায় ওর অস্তিত্ব অনুভব করে। কোথাও শান্তি পায়না। শান্তি পায় যখন তার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকে। চারিদিক নিস্তব্ধ। কোন হট্টগোল নেই। শান্ত পরিবেশ। মাঝে মাঝে গাংচিল উড়ে যাচছে। হাত টা এগিয়ে দিয়ে বলে,” সোনা আমি তোমার কাছে আছি, তোমার পাশে।মনে হয় সে হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে , সোনা অনেক দিন তুমি আমার হাত ধরোনা , এবার ধরো।
চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবন ,তার আগে তিন বছরের জানা শোনা। এই ৪৩টা বছর কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতে পারলো না। কৌশিকের মনে হয় এইতো সেদিন। মনে হচ্ছে শুরু তেই সব শেষ হয়ে গেল। কৌশিকের চিৎকার করে বলতে ইচছা করে , দিস ইজ নট ফেয়ার, লাইফ ইজ নট ফেয়ার।
বিশাল বাড়ীটা আজ শূন্যতায় গ্রাস করছে। ছেলে মেয়েরা যার যার বাসায় চলে গেছে। ওদের নতুন দুটো পাতানো সংসার কনা দেখে গিয়েছিলো। ছেলে মেয়ে ছিল তার চোখের মনি। যখন জীবনটা পরিপুরনতায় বিকশিত হলো, কৌশিক তাকিয়ে দেখে তার চারপাশে সব রইল শুধু রইল না সে।
শূন্য বাড়ীতে আজ সে একা। স্রীতীর ভারে আজ সে ক্লান্ত। জানেনা এর শেষ কোথায়।
দুমাস পেড়িয়ে গেছে। মনের ভীতরের ক্রন্দন থামে না। আজ এই অসহায় একাকিততে তার সৃতির পাতাগুলি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ যেন এক সেলুলয়েডের ফিতা, একটার পর একটা ঘটনা চোখের সামনে ভেসে আসছে। এ সূতি যে এত হৃদয় বিদারক তা সে আগে বোঝেনি। এ যনত্র্না তো দারিদরের যনত্র্না নয়, এতো পায়ে কাটা ফুটার যনত্র্না নয়, এ হৃদয় নিংড়ে নেওয়া যনত্র্না। এ যনত্র্না শুধু সেই উপলবধি করতে পারবে যে এই পথ দিয়ে পায়ে পায়ে চলেছে। ঝাপসা চোখে দুরে তাকিয়ে থাকে মনে হয় সিড়ি দিয়ে সে নেমে আসছে ওপর থেকে। এখনি শুনবে তার কণ্ঠস্বর, ওটমিলটা বসিয়েছ? প্র্টিন একটু কম দিও। না সেই কণ্ঠ সে শোনে না। সে আসে না। সে নেই।
অনেক দিন তো হয়ে গেলো, তবু কৌশিকের চোখে জল ভেসে আসে। ছেলে সুশান্ত, মেয়ে সুস্মিতা ,বৌমা, জামাই সবাই পালা করে রযেছে কৌশিকের সাথে। একলা থাকতে দিতে চায়না। পাছে কিছু হয়। ওরাও ওদের মা কে হারিয়েছে। ওদের মনের বেথা অপরিসীম। কনা যত দিন ছিলো ওরা প্র্তি বলদিন প্র্তি রাতে ফোন করতো। ফেস টাইমে দেখতো তাদের মা কেমন আছে। সুস্মিতা তার মাকে ডাকত গরজ বলে (মানে গরজিয়াস)।
দিনের শেষে সন্ধ্যা নামে। কৌশিকের কাজ শেষ, বাড়ী ফেরার পালা। জানে কেউ অপেক্ষা করছে না তার জন্য। সারা দিনের ভালো মন্দ ঘটনা গুলো শোনানোর মানুষটা আজ তার হারিয়ে গেছে, চলে গেছে অজানা দেশে। চাবি দিয়ে দরজাটা যখন খোলে, নিস্তব্দতা তাকে গ্রাস করে। মনে হয় ভুতুরে বাড়ী। মেয়ে কোন এক সময় এসে সাজিয়ে রেখে গেছে ভাতের থালা। গরম করে খেয়ে নেবে। সেই পাচঁ পদের বাটিতে সাজিয়ে রাখা দিনগুলি আজ আর নেই। কৌশিক জানে একটু পরে ফোনটা বেজে উঠবে, ছোট বোন রিনা কল করবে। বলবে,”দাদা ভাত খেয়েছ? ওষুধটা খেতে ভুলোনা।” রাত বাড়লে ধীর পায়ে কৌশিক সিড়িঁ বেয়ে উপরে উঠে যায় ঘুমাতে। বিছানায় এখন দুটি বালিশ পাশাপাশি সাজানো আছে। কেন তা সে জানেনা। হয়ত তার অবচেতন মন এখনো ভাবে সে হয়ত আসবে। নীস্তব্দ ঘর। এপাশ ওপাশ করতে করতে রাতটা কেটে যায়।
সাত সকালে সেই পরিচিত মধুর ডাকটা আর শোনেনা। যখন কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি সে, কনা বলতো, সেল ফোনটা নিয়েছ? মানিবেগটা কোথায়, চাবি নিতে ভুলোনা। সে কণ্ঠ আর নেই। সে কণ্ঠ হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। আজ তার পরিবর্তে সকাল পৌনে সাতটায় রিনা ফোন করে বলে, সব কিছু নিয়ে বেড়িও ছোটদা, সাবধানে গাড়ী চালিও।
কৌশিকের কাছে মনে হয় জীবন বেহালার তার ছিড়েঁ গেছে, সুরটা আর ঠিক মত বাজছে না। এ তার আর কখনই জোড়া দেবার নয়। এ আর ঠিক হবার নয়। তবুও নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিতে প্র্তি সপ্তাহে কৌশিক গিয়ে বসে থাকে সেখানে, যেখানে কনা ঘুমিয়ে আছে। চড়া রোদ, যেখানে সে ঘুমিয়ে আছে, জায়গাটা রুক্ষ। আর সেখানে মাটি নয় বালি।পার্ক কর্মকর্তাদের কে কৌশিক বলল,” একটা ছোট মাপেল গাছ লাগাতে পারি ওর কবরের পাশে? একটু ছায়া হবে।” ওরা বললো,” না, তা হবেনা।” তা হলে? কৌশিকের মন ছটফট করতে লাগল। সারাক্ষনই মনে হতে লাগল, এই রুক্ষতা তো ওর সইবে না। নিয়ে এলো সে তিন বস্তা মাটি। ছড়িয়ে দিলো কনার কবরের উপর। সেই সাথে ঘাসের বিচি। ঘাস বড় হবে , রুক্ষতা চলে যাবে। কবরের ওপর ঘাসের একটা আবরন হবে। হয়ত কিছুটা শান্তির ছায়া নেমে আসবে তাতে।
অনেকে বলেন সব কিছুর পিছনে একটা মানে আছে। ওর চলে যাওয়ার পিছনে কি মানে ছিল?
একথা কৌশিক কাকে জিগগাসা করবে? যাকে জিগগাসা করতে পারতো সে তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবু জানতে ইচছা করে এতো সুখ যদি সে দিয়েছিলো তবে এত তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন? বড় সাঁধ ছিলো কনার নাতি পুতি দেখার। বলত, ওদেরকে আমি ইসপয়েল করে দেবো আদর দিয়ে দিয়ে। তা আর হলো না। গাড়ী চালাতে চালাতে একটা গান কৌশিকের মনের ভেতর গুমরে ফেরে,” আমার জীবনের এত হাসি এতো খুশি আজ কোথায় গেলো,”। এই পথ দিয়ে অননানন যারা গেছে তারাও কি কৌশিকের মত জীবনের সমাধান খুজতে চেয়েছিল? কৌশিক ভাবে, যে পথের শেষে আলোর নিশানা নেই সে পথে চলে লাভ কি? তবু চলতে হবে।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে কৌশিকের। কিনতু তা হলে তো চলবে না, আজ তো তার গুছানোর পালা।
কনার ক্লোজেট টা খুলে দেখে এখনো সাজানো রয়েছে ওর চলে যাওয়ার আগে যে কাপড় গুলো সে নিয়ে এসে ছিলো ধোপার দোকান থেকে। থরে থরে সাজানো তার শাড়ীর বহর। সুসমিতা, বৌমা ভাগ করে নিয়ে যাবে সেগুলো।
ছেলেমেয়েরা বলে, “ বাবা বাড়ীটা বিক্রি করে দাও। এতে তোমার অনেক স্রীতী জড়ানো,” সুসমিতা বলে,” তুমি আমার কাছে থাকবে। তোমার স্বাধীনতাতে কোন হস্তক্ষেপ হবেনা। তোমার ছোট একটা ঘর থাকবে তোমার নিজেস্ব।” তাই কি? ছোট একটা ঘরে গেলে কি কৌশিকের সৃতি কৌশিক কে কাতর করবে না। পেছনের সুখময় দিনগুলি কি তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে না? এই স্রীতী তো তার মনের প্র্তিটি রন্দ্রে রন্দ্রে গাথাঁ হয়ে রয়েছে। সুসানত সুসমিতা বলে, তোমার নাতি পুতি হবে। ওদেরকে নিয়ে তোমার দিন কেটে যাবে আববু।
হয়ত তাই। কৌশিক ভাবে নাতি-পুতি এলে ওদেরকে আকাশের চাদঁটা দেখিয়ে বলবে,” ঐ দেখ ওটা হচছে অজানা দেশ। ওই খানে তোদের নানি দাদি রয়েছে। ওখান থেকে সে তোদেরকে চুমো দিচছে।” যখন ওরা আসবে হয়ত শান্তি পাবে ওদের কে আকড়ে ধরে।
প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো কনা চলে গেছে, রেখে গেছে এক বিরাট শূন্যতা কৌশিকের জীবনে।
ঈদের দামাঢোল বাজছে, কৌশিকের ঘর অন্ধকার। জ্বলছে শুধু বসার ঘরের আলোটা। টুং করে সেল ফোনে শব্ধ হলো, মেসেজ এসেছে, কাল ঈদ। এমন তো ছিলোনা ঈদের আগের দিন। কনার হাড়ি পাতিলের শবদে মুখর হয়ে থাকতো বাসাটা। কৌশিক বলত,” কখন শেষ হবে তোমার এই টুংটাং।
কনা বলত, অনেক রাত হবে, তুমি ঘুমাতে যাও। কৌশিক বলত,” রসমালাইয়ের জন্য তোমার বানানো ছানাটা গোল করে দেবো? সে বলত, না, ও তুমি পারবে না। নাছোড়বানদা কৌশিক বলত, বাসন পাত্র্ গুলি ধুয়ে দেবো? তাই দেও। কৌশিক বলত,” এত কিছু বানাচছ, কজন লোক আসবে? সে তুমি বুঝবেনা এটাই আমার আনন্দ। কিনতু আমার মনে হচ্ছে তোমার কষ্ট হচ্ছে। কনা কথায় কান দিতো না বলত,” বক বক না করে ওপরে ঘুমাতে যাও”। আচছা যাচ্ছি। কৌশিক জানে ঘুম তার আসবে না যতক্ষন না সে আসবে। কনার আসতে আসতে রাত প্রায় দুটো হয়ে যাবে। সেই দিনগুলি আজ কোথায়। সেই দিনগুলি চিরতরে হারিয়ে গেছে ।
কৌশিক তাকিয়ে আছে টিভি টার দিকে, ওটার পর্দা টা কালো, চলছে না। ইচছা করেই সে চালাই নি। ভালো লাগছে না। একটা অস্থিরতা তাকে তারিয়ে ফিরছে। মেয়ে সুসমিতা আর রেজ আসবে অনেক রাতে। ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে কৌশিক। কনার ওয়ারডরোবটা খুলে ভাজে ভাজে রাখা শাড়ীগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলো। ভাবলো বেচে থাকলে কোনটা সে কালকে পরত। চোখ ভিজে আসাতে বনধো করে দিলো ওয়ারডরোবটা। আলোটা নিভিয়ে নিসংগ বিছানায় বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পড়লো।
আজ ঈদুল ফিতর। প্র্থম জামাত আটটায়। সুস্মিতা আর রেজ কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কৌশিক।অনেক লোক এসেছে জামাতে। নামাজ শেষে কোলাকুলি। এটার আনন্দই আলাদা। মেয়ে বলে,” তুমিতো হাত মিলাতে পছন্দ করো আববু”। হা, করি। তবে ঈদের কোলাকুলি একটা ভিন্ন আনন্দ আছে।
কিন্তু আজ আর সেই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দটা কৌশিকের অনুভবে আসছে না। কিছুতে যেন আনন্দ পাচ্ছেনা সে। কেন তা সে জানেনা। বুকের ভেতর একটা বিরাট শূন্যতা। দুই একজন সহানুভুতি জানালো। দুই একজন উপদেশ দিলো, কি করা উচিত, কি করা উচিত না। কৌশিক শুধু শুনলো।
আজ কৌশিককে যেতে হবে সেই জাগায় যেখানে কনা ঘুমিয়ে আছে। লাল গোলাপ কিনেছে সে। লাল গোলাপ ছিল কনার খুব পছন্দের।সুশান্তর শাশুড়ি জিবু বিয়াইন বললেন,” কৌশিক ভাই আপনি কবরস্থানে যাবার সময় আমাকেও নিয়ে যাবেন।” বিয়াইন তার স্বামী হারিয়েছেন পাচঁ বছর হয়ে গেল। তার মনটাও কৌশিকের মতো কেঁদে বেড়াচছে।। বেড়িয়ে পড়ল কৌশিক সবাইকে নিয়ে। কবরস্থান ঘণ্টা খানেকের পথ। গাড়ীতে অরুন বিয়াইন, জিবু বিয়াইন, বৌমা, বুসরা। বুসরা বৌমার খালাতো বোন। কথা বলতে বলতে কৌশিক জিবু বিয়াইনকে জিজ্ঞাসা করলো,” আপনি অনেক শক্ত মনের দিক থেকে,। কি ভাবে হলেন।” তিনি বললেন,” সব আল্লার ইচছা, বান্ধার কিছু করার নেই,” আপনি তো আল্লা আর বান্ধা নিয়ে বেশ আছেন, আমি পারছিনা কেনো” প্রশ্ন কৌশিকের।
ওরা পৌছে গেলো কবরস্থানে। আকা বাকা পথ ধরে গাড়ি যাচছে সেখানে যেখানে চির নিদ্রায় শায়িত। অনেক লোকের সমাগম আজ। এসেছে প্রিয়জনের কবর যিয়ারত করতে। কেউ কাদঁছে, কেউ বসে কলমা পড়ছে। ঝিরঝির বাতাস বইছে।
শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। গাড়িটা দাড়ালো। যেখানে দাড়ালো সেখান থেকে কিছু দুরেই কনার কবর। বৌমা রক্ত গোলাপ গুলো নিয়ে এলো। বুসরা পাশে, জিবু বিয়াইন আর অরুন বেয়ান দাড়িয়ে একটু দুরে। এই প্র্থম একটা ঈদ, যে ঈদে কনা কৌশিকের পাশে নেই। জিয়ারতের পর কৌশিক বলল,” আমিতো তোমার কাছে এসেছি, সোনা, আমার ঈদ তো আজ এখানে।”
চোখে জলের বাধ মানছে না। কৌশিকের মনে হলো কনা বলছে, কেদোঁ না, আমি তো তোমার পাশেই আছি। তোমার মধ্যেই আছি, তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাইনি। বৌমা আর বুসরা কৌশিককে জড়িয়ে ধরে বলল,” কেদোঁ না বাবা কেদো না।” বৌমার বাবাও শুয়ে আছে এখান থেকে কিছু দুরে। ওর মনের কথা কৌশিক বুঝতে পারছে, ও প্র্কাশ করছেনা। বেয়াই এর কবর। জিবু বিয়াইন দুরে দাড়িয়ে। এটই হয়ত নিয়ম। কৌশিক জানেনা। তার চোখ কালো চশমার নিচে নিশ্চয় ছলছল করছে। দু ফোটা জল হয়ত গড়িয়েও পড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। বৌমা কাদছে। কৌশিক যেদিকে তাকায় দেখে সবারই মুখ মলিন। কিছু দুরে একটা নতুন কবর খোঁড়া হয়েছে। কোন অভাগার বুকের ধন সবাইকে কাঁদিয়ে আজ এসেছে এখানে ঘুমাতে।
সবাই বলল, চলো এবার সময় হয়েছে, ওদের কে বিদায় দাও।
কৌশিককে যেতে হবে সুস্মিতার শশুড় বাড়ী। সেখানে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর হয়ে গেলো। কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লো কৌশিক। ভীষন ক্লান্ত সে। জিবু বিয়াইন কে নামাতে হবে। কেন জানি একটা অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচছিলো। বাসায় চলে এলো। সুস্মিতা পড়ছে। রেয এলে ওরা রেজের বাবার বাসায় যাবে।
রেজ এলো, ওরা চলে যাচছে। সুস্মিতা বলল,” আব্বু তুমি একলা থাকতে পারবে তো।” হা, মা মনি, পারবো। গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে বাই জানিয়ে মেয়ে টা চলে গেলো। ও দেখতে পেলোনা ওর বাবার চোখটা জলে ভর্তি। সেই ভালো। দেখতে পেলে সে কষ্ট পেতো।
ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসে কৌশিকের শরীর। মন চাইছে না বাইরে যেতে। হয়ত যে উদ্দীপনা আগে ছিলো আজ তা ভাটার দিকে। যে নৌকায় সে ভাসতো দমকা হাওয়ায় তার পাল আজ ছিড়ে গেছে।ওটা আর ভাসবে না, ওটা ডুবন্ত। মন চাইছেনা তবু কৌশিক গেলো বিয়ইনের বাসায়। দেখা হলো অনেকের সাথে। সব পরিচিত মুখ। কথা হলো। শেষে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো কৌশিক।
বাহিরে এসে দাড়ালো। অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারিদিক। নিস্তব্ধ রাস্তা। বুকের ভিতর হাহাকার। ও নেই, কেউ নেই। এই প্র্থম একটা ঈদ যে ঈদে কেউ তার পাশে নেই।
একটা চাপা ব্যথা অনুভব করছে বুকে। হয়ত কিছু নয়। গাড়িটা একটু দুরে। পাশের দালানে হেলান দিয়ে একটু দাড়িয়ে নিলো কৌশিক। ব্যথা টা বাড়ছে। Stent লাগানো আর্টারি টা হয়ত বুজে এসেছে। গাড়ীর কাছে এসে পৌছালো কৌশিক। ER এ সে যেতে রাজি নয়। বীভীশিকা ময় ER সে দেখেছে। বাসায় পৌছালো। উপরে উঠে এলো। ব্যথাটা বাম হাতের থেকে উপরে উঠে আসছে। কৌশিক জানে এ কিসের ব্যথা। এর থেকে মুক্তি নেই। শুয়ে পড়লো সে। ভেসে উঠলো কনার মুখ। সে জেনো ডাকছে তাকে। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হলো।সুশান্ত ,সুস্মিতার মুখটা ভেসে উঠলো, ওরা চিৎকার করে বলছে, যেওনা বাবা যেওনা” কৌশিক ফোন টা আকরিয়ে ধরলো। ডায়েল করতে চাইলো ৯১১। কিন্তু পারলো না। ৯-১—- শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। হাত থেকে পড়ে গেলো ফোনটা। নিস্থব্ধ হয়ে গেল চারিদিক। সে চলে গেলো। চলে গেলো কার কাছে। যাকে সে দেখেছিলো, যাকে সে পেয়েছিলো, যাকে সে হারিয়েছিলো তার কাছ