রংধনু

                                      

                                                                                         

                                                         

                                                                       রংধনু

দৌড়ে এসেও ট্রেনটা ধরা গেলনা। কপাট টা বন্ধ হয়ে গেলো। বাহিরে গরম। পাতালের নিচে আরও বেশি। পরবর্তী ট্রেন টা আসতে একটু সময় লাগবে। কাজের দিন আজ। চল্লিশ মিনিট লাগবে ফীফথ এভিনিউ তে পৌছাতে। দশ মিনিটের মধ্যে ট্রেন টা যদি আসে তাহলে ঠিক সময়ে কাজে পৌঁছানো যাবে। অগত্যা পায়চারী করতে থাকলাম।

হঠাৎ ই চোখ পড়লো দূরে দাঁড়ান মেয়ে টার দিকে। নিতান্তই সাধা মাটা। পরনে ঘিয়ে রঙের প্যান্টের উপর কালো সার্ট। খুব একটা মানান শই নয়। সদ্য গোসল করে আসাতে ভিজে চুল লতিয়ে পরে আছে কাধের পর। হলিউড, বলিউডের নায়িকাদের মতো নয়, তবুও চোখ ফেরাতে পারলাম না। কাছে যাবো ভেবেও যাওয়া হলনা। ভাবলাম দূরে থেকেই দেখি।

এই দেখো, বাড়া ভাতে ছাই দিলো কেন ওই ভুঁড়ি ওলা লোকটা? ওর ভুঁড়িটা ঢেকে দিলো ওকে। রাগ হোল লোকটার উপর। এপাশ ওপাশ করে অনেক বার দেখার চেষ্টা করলাম। ভুঁড়িটা বিশাল পর্বত হয়ে দাড়িয়ে রইল আমার আর তার মাঝে।   লোকটা একবারও আমার দেখা মেয়েটার দিকে তাকাল না। মনে হোল যেয়ে বলি,” অহে তুমি না হও রসকষ হীন, তাই বলে অন্যের চোখের তৃষ্ণার মাঝে বাঁধ বাধার তুমি কে? দয়া করে তোমার এই আকাশ চুম্বী ভুঁড়িটা নিয়ে ওপাশে যাবে কি? আমাকে আমার তৃষ্ণা মেটাতে দাও”। বলা হলনা। বলতে পারতাম কি না সেটাও সন্দেহের ব্যাপার।

ট্রেন এসে গেলো। লোকের ভিড় বেড়েছে। বসার জাগা নেই। রেলিং টা ধরে দাঁড়ালাম, তাকালাম সেই দিকে যে দিক দিয়ে ওর উঠার কথা। না, সেও উঠেছে একিই কামরায়। আগের থেকে দূরত্ব একটু কম।

 চোখে কাজল পরেছে একটু গাঢ় করে। ইদানীং চৌকস মেয়েদেরকে এত গাঢ় করে কাজল পরতে দেখিনি। তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।

ষ্টেশনে থামতেই আরও কিছু লোক উঠল। ভিড়ের চাপটা অনুভব করলাম। দুজনের হাতের মাঝ দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওর নাক ফুলটা। ডায়মন্ড নয়। হয়ত জারকনীয়া। ওটা মানিয়েছে ওর নাকে। বাঁশির মত নাক নয় আবার চ্যাপ্টাও নয়। দুয়ের মাঝে।

আচ্ছা, পাশের লোকটা বড় বেশি ওর গায়ের সাথে ঘেঁসে দাঁড়িয়েছে। কোন অভিসন্ধি নেইতো ? ছয় ফুট উচু লোকটা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি মেয়েটার দিকে বার বার তাকাচ্ছে কেন? ভিড় ঠেলে কাছে যেয়ে বলব নাকি,” এই, তোর ঐ ঘামে ভেজা শরীর টা দিয়ে ওকে চাপ দিচ্ছিস কেন?” ভয়ও হোল। আমি পাঁচ-ছয়। গলাটা টিপে ধরলে জানটা নিয়ে ফিরে আসতে পারবো না।

অগত্যা ঐ চিন্তা বাদ দিলাম।

  একটু অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আবার ঘাড় ফেরাতেই ওকে আর দেখা গেলনা। তাহলে? কোথায় গেলো? স্টেশন তো আসেনি। বুকের মাঝে শিরশির করে উঠল। এই কি প্রেম? সেই গানটা মনে পড়ল,” তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে”। ভাবলাম সামনা সামনি হলে এই গান দিয়েই ওকে প্রথম সম্বোধন করব। কিন্তু আমার ভাষা যদি সে না জানে? ইংরেজিতে তর্জমা করার মত বিদ্যে আমার নেই। তাছাড়া আসল মানেটাও ফুটে  উঠবে না। তাহলে? মাথার মধ্যে শত চিন্তা।

  সীটে বসে পড়েনি তো? না, তাই বা কি করে হবে। কেউ তো উঠা নামা করেনি। ঐ লোকটাই যত নষ্টের মুল।

ঐ তো।  জানালার কাঁচে ওর অবয়ব টা দেখা যাচ্ছে। হয়ত ডান হাতটা অবশ হয়ে এসেছিল। হাতটা পাল্টাতে যেয়ে সরে গিয়েছিল শরীর টা। এই ভালো হোল। জানালার কাচেই ওকে দেখব। জানালাটার নিচেই বসা আর একটি মেয়ে। ও না ভাবে আমি ওর দিকে তাকিয়ে  আছি? আসলে আমিতো দেখছি জানালায় ওর ছবি।

  কয়েকটা চুল ওর কপালের উপর আসে পড়েছে। কি অপরূপ দেখাচ্ছে। আহা!  আমি যদি আঁকতে পারতাম তবে এই ছবির স্থান হতো মনালিসার পরে।  বড় বড় সমজদাররা ব্যাখ্যা করতে বসতো এই ছবি নিয়ে। বিভিন্ন ধরেনের বিশ্লেষণ হতো। আমরা হয়ে যেতাম বিশ্ববিখ্যাত। ওর কপালে পড়ে থাকা চুল আরা আমার হাতের কাজ।

     ঝাঁকি দিয়ে ট্রেনটা থামতেই ফিরে এলাম বাস্তবে। এতো আমার স্টেশন। ফীফথ এভিনিউ। নামা হলনা। আসলে নামতে ইচ্ছে করল না। ওর সাথেই আমি যাবো। আমার যাত্রা শেষ হবে ওর ষ্টেশনে।

প্রতিদিনই তো কাজে যাই। আজ না হয় নাই বা গেলাম। অজুহাত দেওয়া যাবে। পেটে ব্যাথা। ইচ্ছে থাকা সত্তেও আসতে পারেনি কাজে। পেটে ব্যাথা চোখে দেখা যায়না। হাত দিয়ে অনুভব করা যায় না। এ জ্বর নয়। টাইলিনল খেলেই চলে যাবে না। কাজেই আমি নিশ্চিত।

  ট্রেনটা থামল ষ্টেশনে। কিছু লোক নেমে গেলো। উঠল দু এক জন। ও সরে আসে দাঁড়াল, সোজা ভাবে। এবার আমি ওর পূর্ণ শরীর টা দেখতে পেলাম। পায়ে অল্প হিলের স্যান্ডেল। রং টা বোঝা গেলনা। হয়ত পুরান। আমার কাছে মনে হোল এই রং টাই মানিয়েছে। তাকাল সে আমার দিকে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকালাম কামরার ছাদের দিকে। গুনতে থাকলাম কতো গুলো পেরেক গেথে এই ছাদ টা বানাও হয়েছে। ভাবলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখছে, আমার কথা ভাবছে। এই ভাবনা টা ভাবতে আমার খুব ভালো লাগলো। এবার কড়িকাঠ গোনা শেষ করে তাকালাম ওর দিকে। ও ফিরে দাঁড়িয়েছে।  কাধের ব্যাগটা কে ঠিক করে নিলো। পিছনে পড়ে থাকা চুল গুলো ডান হাত দিয়ে  একটু এলোমেলো করে দিলো। আমার মনে হোল যেন সাগরের ঢেউ আসে আছড়ে পড়লো ওর পিঠে।

 ট্রেনটা হুইসেল দিলো। কনডাকটারর গলা শুনা গেলো। “ সামনে ট্রেন থাকাতে একটু বিলম্বিত হচ্ছে। ধরজো ধরুন।

মেয়ে টা হাত ঘড়ির দিকে তাকাল।

বুঝলাম এই ষ্টেশনে সে নামবে।

 আমিও ঠিক করে নিলাম আমার ব্যাগ টা। কি বলে সম্বোধন করবো সেটা ঝালাই করে নিলাম। আমি এদেশে আছি অনেকদিন। জানি, হিতে বিপরীত হলে “সরি” শব্দটা আগুনে জল দেওয়ার মতো কাজ করবে। যেমন করে পলিটিশিয়ান দের ব্যাপারে। ডাহা মিছে কথা বলে পরের দিন “সরি” বলে নুতন দিনের সুচনা করে।

 আমি মিছে কথা বলতে চাইছি না, আমার মনের ভিতর তার যে অবয়ব আমি এঁকেছি তারই প্রকাশ। বলব তারে,” সবই তো শুনলেন। কাজের শেষে বসবেন ঐ রেস্তোরায় এক কাপ চা খেতে”?

 হয়ত গটমট করে চাইবে, নয়ত বলবে , আমি বিবাহিত অথবা এনগেজড। এনগেজড আমি সামলাতে পারবো। বিবাহিত হলেই মুশকিল। কাজেই উপরওয়ালার নাম জপতে লাগলাম।

 ট্রেনটা চলতে শুরু করলো। এক মিনিটের মধ্যে আসে দাঁড়াল ষ্টেশনে।

এক্সকীউজ মি বলে সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। আমিও লোকদের পাশ কাটিয়ে আসে দাঁড়ালাম ওর একটু পিছনে।

দরজা খুলে গেলো। ও তড়িৎ বেগে নেমে হাঁটতে থাকলো গেটের দিকে। আমি একটু পিছিয়ে পড়লাম। দুজন কে ধাক্কা দিয়ে, দুজনের পাশ কাটিয়ে আসে পৌছালাম ওর একটু পিছনে। আমাকে দাড়াতে হবে ওর পাশে। নচেত কথা গুলো বলব কি ভাবে?

  ও কাঠবেরালির মতো দু তিন ধাপ দিয়ে সিঁড়ি গুলো পেরিয়ে আসে দাঁড়াল রাস্তায়। আমি আবারও পিছিয়ে গেলাম কিছুটা।

রাস্তায় আসে তাকালাম দুদিকে। দেখলাম সে দাড়িয়ে রাস্তার কোনায়। এগিয়ে যেতেই দেখলাম ওপার থেকে দৌড়ে এলো একটা মেয়ে। জড়িয়ে ধরল ওকে। গভীর ভাবে চুমো খেলো। দুজনে মিশে গেলো একে অন্যের মাঝে। থেকে থেকে চুমো দিতে লাগলো একে অপরকে। হাত ধরাধরি করে পেড়িয়ে গেলো রাস্তা টা।

আমি তাকিয়ে দেখলাম। ভাবলাম এই হোল ভালো। আমার আঁকা ছবি থাক আমারি মাঝে। ফিরে দাঁড়ালাম। পা বাড়ালাম পাতাল রেলের সন্ধানে।

 

Continue Reading

সাপুড়ে

                                         সাপুড়ে

     “ সাপের খেলা সাপের খেলা কে দেখবি আয়” এই বলে চিৎকার করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত গফুর। বড় এক

লাঠির দুপাশে দুটো বাক্স। তার ভিতর গোখরো, চন্দ্রবোড়া, কালসাপ। আমরা ছোট ছোট ছেলেরা ওর পিছন পিছন যেতাম, বলতাম, “ গফুর ভাই, নতুন সাপ ধরেছ? অজগর?” হাসি দিয়ে বলত,” ধরেছি। বড় গোখরো। বিষ দাত এখনও আছে।   দেখবি আয়”। ভয়ে আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে যেতো। রহিমের ভয় ডর ছিল কম। ও এগিয়ে যেতো। আমরা ওর পিছনে।

গফুর ভাই আবারও হাসি দিয়ে বলত,” এই বাক্সটা তে হাতদে”। রহিম হাত ছোঁয়াতেই ফোঁস করে শব্দ। আমরা দৌড় দিতাম। রহিম হি হি করে হাসত।

  আমার বয়স তখন দশ। গফুর প্রায় আসতো আমাদের বাসাতে। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে বসতো এসে বারান্দায়। বাক্স দুটো পাঁশে রেখে গামছা দিয়ে মুখটা মুছে দালানে হেলান দিয়ে বসত । আমি বাক্স গুলোর পাঁশে ঘুর ঘুর করতাম। গফুর আমার দিকে তাকিয়ে বলত,’ দাড়া, তোকে বড় গোখরো সাপের খেলা দেখাই”। বলে বাক্স থেকে বের করতো গোখরো সাপটা। ফোঁস করে ফনা বের করে হেলে দুলে দাঁড়াত সে। গফুর তার হাতের বাঁশীটা বাজাতেই সাপ টা মাথা নাড়িয়ে ছোবল দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতো গফুরের দিকে। আমি ভয়ে লাফ দিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরতাম। গফুর খপকরে সাপটার গলা ধরে ফেলতও। আস্তে করে ছেড়ে দিতো বাক্সটার মধ্যে। সুবোধ বালকের মতো গোল হয়ে শুয়ে পড়ত সে বাক্সটার মাঝে।

মা বলত,” গফুর, দুপুরে কিছূ খেয়েছিস?”

“না, খালাম্মা”।

“ তা খাবি কেনও? সারাদিন এই রৌদের মধ্যে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়িয়েছ ?” মা রাগ করতো।

গফুর হাসত।

আমার মনে হতো মার একটা আলাদা টান আছে ওর উপর। গফুরও সেটা বুঝত।

মা ডাকতো ওকে রান্না ঘরে। বলত,” আয়, এখানে বসে খেয়েনে।“

মাকে হারিয়েছে সে ছোট বেলায়। তখন ওর বয়স ছিল ছয়। বাবা ছিল কাঠের মিস্ত্রি। পাশের বাসার কানুর মার কাছে রেখে কাজে যেতো। এই ভাবে দুটো বছর কাটল।  বাবা আবার বিয়ে করলো। ভেবে ছিল বৌ এসে ছেলেটাকে দেখে শুনে রাখবে।

বিঁধি বাম। হোল উল্টো। গফুর হোল সৎমার চোখের শুল।

বাবা ওকে ভর্তি করে দিয়ে ছিল ক্লাস ওয়ানে। রং চং এ আঁকা বই নিয়ে সে যেতো স্কুলে। ওরই মতো গুঁড়ি গুঁড়ি বাচ্চাদের সাথে। স্কুল থেকে ফিরে আসতো হাতে পায়ে ধুলো মেখে। বাবা কাজ সেরে ফিরে এসে ছেলের হাত পা মুখ ধুইয়ে দিতো। পাঁশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করত,” আজকে কি শিখেছ ক্লাসে?”

গফুর তার বইটা বের করে দেখাতো বাবা কে।

সেই দিনগুলো শেষ হয়ে গেলো খুব তাড়াতাড়ি।

 তিনটে মাস যেতে না যেতে সৎমার আসল রুপ বেরিয়ে এলো। স্কুল থেকে এসে মার কাছে বলত,” মা খিদে পেয়েছে? খাওয়া দাও।“

ঝামটা মেরে উঠত কামিলা। “ ছেলে আমার নেদা পড়া করে এসেছে। খাওয়া দাও”।

কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যেতো গফুর।

বছর না ঘুরতেই বাবা বুঝতে পেরেছিল এ বাসায় গফুরের স্থান নেই।  এদিকে কামিলা সন্তান সম্ভবনা।

একদিন কাজ থেকে ফেরার পথে এসেছিল গফুরের মামা বাড়ী। বলল সব কথা। গফুর কে তারা স্থান দিতে পারবে কিনা। জয়নাল উদ্দিন না করে নি। গফুর এসে আশ্রয় নিয়ে ছিল মামার বাসায়। গফুরকে রেখে বাবা চোখ মুছতে মুছতে চলে যাওয়ার আগে বলেছিল,” ভালো থাকিস বাবা। আমি আবার আসব তোকে দেখতে”।

মামা সাপুড়ে। মামার কাছেই গফুরের হাতেখড়ি।  মামার সাথে যেতো সাপ ধরতে। শিখিয়েছিল কোন সাপ কিভাবে ধরতে হয়। স্কুলে আর যাওয়া হয়নি গফুরের। তার বদলে শিখে ছিল বাঁশি। বাঁশির তালে তালে সাপের নাচ দেখত সে।

একদিনের  জ্বরে মামী চলে গেলো সবাই কে ছেড়ে।  মামা ভেঙ্গে পড়ল। গফুর তখন ষোল বছরের যুবক। মামার উপযুক্ত ছাত্র সে।  ধরেছিল হাল। মামাকে বলেছিল বিশ্রাম নিতে।  সাপের বাক্স নিয়ে বেরিয়ে পরেছিল রাস্তায়।

“ সাপের খেলা সাপের খেলা কে দেখবি আয়” বলে ঘুরত রাস্তায় রাস্তায়। জড়ো হতো লোকেরা। বাচ্চারা চোখ বড় বড় করে দেখত সাপের খেলা। লোকে ছুড়ে দিতো পয়সা।

এমনি ভাবে ঘুরতে ঘুরতে এসেছিল সে আমাদের বাসায়। মাকে বলেছিল,” সাপের খেলা দেখবেন খালাম্মা?”

“দেখাও,  বয়স কতো তোমার?” মা জিজ্ঞাসা করেছিল।

খেলা শেষে মা আলমারি খুলে কয়েকটা টাকা এনে ওর হাতে দিয়ে ছিল। বলেছিল, বসো,

পাটালি আর মুড়ি এনে ওর সামনে দিয়ে বলল,” খেয়ে নাও। সারাদিন নিশ্চয় কিছু খাওয়া হয়নি”?

সেই থেকে দেখেছি গফুর দিনের শেষে একবার হলেও মা কে দেখা দিয়ে যেতে।

একদিন মা আমাকে ডেকে বলেছিল,”শোন, ভাগ্যের খেলায় হয়ত গফুর হেরে গেছে কিন্তু সে তোমার বড়, তাঁকে ভাই বলে সম্বোধন করবে”। সেই থেকে সে আমার গফুর ভাই। মাঝে মাঝে গফুর ভাই আমার জন্য নিয়ে আসতো লেবেঞ্চুস।

বলত,” মা কে দেখিও না, এখনি খেয়ে নাও”।

  এক ঈদে নামাজ শেষে গফুর ভাই এসেছিল মার সাথে দেখা করতে। পরনে পুরানো পাজামা, পুরানো জামা। মাকে সালাম করল। মা ওকে বসতে বলে ভিতরে গেলো। ফিরে এলো নতুন পাজামা পাঞ্জাবি হাতে। বলল,” গফুর এটা পরে এসো”।

গফুর ভাই তাকিয়ে ছিল মার দিকে। এই প্রথম তাঁকে কাঁদতে দেখে ছিলাম। মা কে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদে ছিল।

বলেছিল,” মার চেহারা মনে পরেনা, তুমিই আমার মা”।

অনেক বছর পেরিয়ে আমি তখন স্কুলের শেষ বর্ষে। পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত।  একদিন মা ডাক দিলো। বলল,” খোকা, গফুর তো বেশ কিছু দিন হয় আসেনি ।একটু ওর বাসায় যেয়ে দেখবি।  ভালো আছে কিনা”?

জানি, না করার উপায় নেই।

যাচ্ছি, বলে বাবার সাইকেল টা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পনের মিনিটের পথ। বাসার চত্বরে এসে জোরে ডাক দিলাম।

গফুর ভাই ডাক শুনে বলল,” ঘরে আয়”।

ঘরে ঢুকে দেখি গফুর ভাই চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। নিচে একটা ছোট গামলা। তার মধ্যে লালচে দাগ।

”কি হয়েছে তোমার”? জিজ্ঞাসা করতেই বলল

“ জ্বর, তবে—-“ কথা শেষ হলনা। ভীষণ ভাবে কাশতে থাকলো। একটু থেমে কফটা থু করে গামলাতে ফেলতেই মনে হলও রং টা লালচে।

আমি কিছু বলার আগেই সে বলল,” জানিস পীন্টু, একটা অনেক বড় গোখরো ধরেছি। এখনও বিষদাঁত ভাঙ্গা হয়নি। চল তোকে  দেখাবো”। বলে উঠতে গেলো। পারলনা। মাথাটা  টলকে উঠল। শুইয়ে দিলাম বিছানায়।

বললাম, কাল এসে আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

বাড়িতে এসে মা কে বললাম, গফুর ভাই এর শরীর খুব খারাপ । তুমি যাবে?

হাঁ, কাল আমাকে নিয়ে যাবি। ওর জন্য খাবার নিয়ে যাবো। তোর বাবা কে বলিস ভালো একটা রিক্সা ঠিক করে দিতে।

সেই কাল আর আসেনি।

সকালে এসে জাফর খবর দিলো, গফুর মারা গেছে সাপে কেটে ।

সাইকেল চালিয়ে দ্রুত যেয়ে পৌছালাম। অনেক লোক এসেছে। দৌড়িয়ে গেলাম বাক্সটার কাছে। ডালা খোলা। বিষধর গোখরো টা নাই।

পাঁশে পরে আছে গামলাটা, জমাট রক্ত।

আমি কাঁদছি। মনে পড়ছে সেই লেবঞ্চুসের কথা। মনে পড়ছে ঈদের দিনে মা র দেওয়া নতুন জামা,পাজামা পরে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,”দেখত আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?”

মনে হচ্ছিল ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে  দেই। বলি, চলো গফুর ভাই, সময় তো হোল, বাঁশি টা নাও, ডাক দাও ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দেরকে, বলও,”   সাপের খেলা সাপের খেলা কে দেখবি আয়”।

Continue Reading