এ ঘর কথা বলে
আজ আমার শেষ রাত এ বাসাতে। কাল বিদায়ের পালা। গাড়ীটা ড্রাইভওয়ে তে পার্ক করে এসে দাঁড়ালাম বহু পরিচিত সিঁড়ি গুলোর সামনে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। সামনের দরজার পাশের দুটো আলো জ্বলে উঠেছে। মনে হোল এতোঁ আলো নয়। দুটো জলে ভরা চোখ। আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে।
বলছে,” তুমি আর সে এসেছিলে, আমার গায়ের ঝুল ঝেড়ে, ছানীপরা চোখটা তে এনেছিলে নতুন আলোর রশ্মি । আমি আবার দুচোখ ভরে দেখতে পেয়েছিলাম। দেখতে পেয়েছিলাম ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হেটে যাওয়া পথ। ওরা মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখত আমাকে। দেখত আমার চারিদিকে লাল নীলে ভরা ফুল গুলো”।
বললাম,” আমিতো আর তোকে আগের মতো যত্ন করতে পারবো না, তাই তোকে দিয়ে যাচ্ছি অন্যের হাতে। সে তোকে আরও সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবে। আমি তোকে ভুলবো না। তোর মাঝে কতো স্মৃতি। সুখ দুঃখ দিয়ে ভরা। তোকে সে সাজিয়ে ছিল নিজে হাতে। বলেছিল, এ বাসাতে হবে আমার ছেলে মেয়ের বিয়ে। হয়েও ছিল। তোকে তখন আরও সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল।
মনে পড়ে? তোর পিছনের ডেকে বসে কতো সন্ধ্যা আমরা কাটিয়েছি এক সাথে।
থাকা আজ সেকথা । চোখে জল আসছে। এবার আমি ভিতরে যাবো। গোছাতে হবে।
দরজা খুলে ভিতরে এলাম। থরে থরে ছোট বড় বাক্স পেঁটরা বাঁধা। মনে হোল পাশের বাক্সটা দাপাদাপি করছে। উপরে লেখা হাঁড়িপাতিল।
মনে হোল আমাকে দেখে বলছে, তুমি আমাদেরকে এভাবে বন্দি করে রেখেছ কেন? খুলে দাও। জানো, আমাদেরকে অনেক দেখে, অনেক ভাবনা চিন্তা করে সে নিয়ে এসেছিল। আমার পেট টা বড়, তাই আমি ছিলাম তার প্রিয়। সুঘন্ধ এলাচ দারচিনী আরও কত কি সব আমার পেটের ভিতর দিয়ে তৈরী করতো পোলাও। সুঘন্ধে ময়ময় হয়ে যেতো সারা ঘর। তোমাকে বলত, আমাকে উনন থেকে নামিয়ে ওভেনের ভিতর দিতে। তুমি লক্ষ্মী ছেলের মতো তাই করতে, আর বলতে, আচ্ছা, এত সুন্দর করে রান্না করো কিভাবে।
তোমাকে সে বলত, বক বক না করে আদাটা ছুলে ছোট ছোট করে কেটে দাও, বেলেন্ডারে পিষতে হবে। দেখো, হাত কেটো না।
আচ্ছা, আমাদের কে তুমি কি বন্দি করে রাখবে সারা জীবন? নাকি ফেলে দেবে জঞ্জালে ভরা মাঠে।
না, তোদেরকে কি ফেলতে পারি? আমি তোঁ রাঁধতে পারিনা। তাই তোদেরকে আমার কাছে রাখলে তোরা অথর্ব হয়ে যাবি। তোরা যাবি আমার মেয়ের কাছে। সে তোদেরকে ঘসে মেজে সুন্দর করে রাখবে। সে তার মা র স্মৃতি ধরে রাখতে চায়।
কিছু বলবি ?
হাঁ, ছোট টা তোমার সাথে কথা বলবে।
কি হোল তোর?
আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। তোমার মনে নেই। আমাকে সে এনেছিল মেসীর একদিনের সেল থেকে। অর্ধেক দামে আমাকে বিক্রি করে দিচ্ছিল। অনেক কিছুর সাথে আমাকেও নিয়ে এলো। অন্যরা আমার চেয়ে বড়। তাদেরকে ব্যাবহার করতো মাঝে মধ্যে। দরকার বশত। আমি ছিলাম তার সকাল বেলার সাথি। সকালের চা সে বানিয়ে নিতো আমার মাঝে।
কোন কোন দিন আমাকে অল্প জ্বালে বসিয়ে ওট মিলের দানা ঢেলে দিতো। আমি উত্তপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সে বসে পিউপিল ম্যাগাজিন পড়ত। আমার ভিতরের জলটা দপদপ করে ফুটে উঠতেই সে হাতের চামচ টা দিয়ে আস্তে আস্তে নাড়ত যেন আমি আঘাত না পাই। এই সব স্মৃতি কি ভোলা যায়।
ঠিক আছে তুই আমার কাছে থাকবি।
বাক্সটা খুলে উঠিয়ে নিলাম ওকে। এটাতেই আমি শেষদিন গুলোতে বানিয়ে দিতাম ওট মিল। সাথে ঢেলে দিতাম এক চামচ প্রোটিনের গুড়া।
বললাম, তোকে দেখলে আমার মনে পড়বে ফেলে আসা দিনগুলি।
ওখানে কে?
আমরা, থালা বাসন কাপ পিরিচের দল। আমাদেরকে কার হাতে তুলে দেবে তুমি?
জানো, আমাদেরকে সে যোগাড় করেছিল বিভিন্ন জাগা থেকে। একদিন দেখি আমাদের ভাই বোনের সংখ্যা অনেক।
তুমি বলতে অনেক তোঁ আছে, এটাও লাগবে কি?
সে বলত এটা অন্য ধরনের, পার্টির সময় লাগবে।
অনেক লোক আসতো তোমার বাসায়। আমাদের ডাক পড়ত। ধুয়ে মুছে ফর্সা হয়ে আমরা বসে থাকতাম টেবিলের পাশে।
একে একে সবাই উঠিয়ে নিতো আমাদেরকে। বিভিন্ন রকমের খাবার দিয়ে সাঁজাতোঁ । অনেকে কাঁটা চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ করতো আমাদের পেটে পিঠে আঁচড় দিয়ে।
অনেক দিন সেই আঁচড় আর পড়েনা। তুমি কি আমাদের কে নিতে পারবে না তোমার কাছে?
বললাম, আমি চলেছি এক ছোট্ট জাগায়। তিন থেকে পাঁচজন কে নিতে পারবো আমার সাথে।
ভাবিসনে।
আমার মেয়ে,বৌমা তোদেরকে নিয়ে যাবে। ওদের ওখানে তোরা ভালো থাকবি। অনেক ইয়াং ছেলে মেয়েদের আনাগোনা সেখানে। আবার তোরা শূনতে পাবি টুংটাং শব্দ।
ওরা আমাদের কে যত্ন করবে তোঁ? যে ভাবে সে আমাদেরকে ধুয়ে মুছে উঠিয়ে রাখতো। নাকি ফেলে রাখবে বেসিনে। আরশোলা ঘুরে বেড়াবে আমাদের গায়ে পিঠে।
ওরা থাকে বড় বড় নামকরা বিল্ডিংএ। ওখানে আরশোলা নেই। আছে তোদের গোসলখানা। খাওয়া শেষে তোদেরকে দিয়ে দেবে সেইখানে। গরম জলে ধুয়ে, শুকিয়ে বেরিয়ে আসবি।
কি হোল, তোরা কাঁদছিস কেন?
আমাদের কথা মনে পরে ? আমরা তোমার ঘরের শোভা বাড়ানোতে মগ্ন ছিলাম। দেয়ালের চারিদিকে তাকালে সবাই আমদেরকে দেখতে পেতো। কত প্রশংসাই না করতো ।
ভুলে গেলে?
আমাকে এনেছিল ফরচুনঅফ থেকে। আর ওই কোনার টাকে এনেছিলে বম্বে গ্যালারি থেকে।
সে এই ফর্মাল লিভিং রুমে বসে আমাদের কে দেখত।
এখন, এখন আমরা কোথায় যাবো। তুমি আমাদেরকে ফেলে রেখে যাবে নাতোঁ?
না তোরা যাবি আমার সাথে। ছোট বাসা হলেও চারটা দেয়াল তোঁ আছে। তোদেরকে ওখানে ঝুলিয়ে দেবো। তোদের মাঝে থাকবে ওর ছবি টা। কি, খুশি তোঁ?
উপরে উঠে এলাম।
আমার ঘরে ঢুকতেই খাট টা বলে উঠল, “ আমাকে তুমি ফেলে দেবে শুনলাম? কেন? আমি কি দোষ করেছি? তোমাদের দুজনকে নিয়েই তোঁ ছিল আমার সংসার। আমি শুনতাম তোমাদের কথোপোকথন। পরে তুমি একলাই ছিলে, পাশের বালিশটা রেখে দিয়েছিলে একই জাগায়। সরিয়ে দাওনি। এসবের সাক্ষী তোঁ শুধু আমি একা। আমাকে ফেলে দিওনা। ”
তোকে আমি আমার কাছে নিয়ে যাবো ঠিক করেছি। এত বড় ঘর তোঁ নয়। ছোট্ট একটা শোয়ার, তার পাশে ছোট্ট এক চিমটে জাগা, ওটা বসার ঘর। প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে বৈকি।
চোখে জল আসবে জানি। সবই ভাগ্যের লিখন। তুই কি কখনো ভেবেছিলি তোকে এত বড় বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হবে একদিন। পিছনে ফেলে রেখে যাবি তিলে তিলে গড়া স্মৃতিগুলো।
থাক, কাঁদিসনে।
আমি শেষ বারের মত ঘুরে আসি সব ঘর গুলো। হাতে নিয়েছি ন্যাপকিনের বাক্সটা। এদেখাই শেষ দেখা। ফিরে এসে তোর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ব।
তারপর ———–।