নদীর নামটি কঙ্কনা

   পার্থর ট্রেনটা যখন মধুপুর ষ্টেশনে এসে পৌছাল তখন রাত একটা। মাঝ পথে ট্রেন লাইনের মেরামতের জন্যই সময় মাফিক এসে পৌছাতে পারেনি। পার্থ নেমে কাউকে দেখতে পেলনা। সেই আশাও সে করেনি। ছোট্ট মফঃস্বল শহর  এই মধুপুর। এখানকার হাসপাতালের চীফ ডাক্তার হয়ে সে জয়েন করছে। আসার আগে সুমীতা বার বার বলেছিল,” না গেলেই কি নয়”।

উত্তরে পার্থ বুঝিয়েছিল সুমীতাকে,” ওদের টাঁকায় লেখা পড়া শেষ করেছি, শুধু তাই নয়, লিখিত দেওয়া ছিল, ডাক্তারি  পাশের শেষে কোন এক গ্রামে যেয়ে আমাকে দুই বছর কাজ করতে হবে। কাজেই  না করার কোন উপায় নেই। মাত্র তো দুটো বছর, একটু অপেক্ষা করো লক্ষ্মীটি। তার পড়েই আমরা ছাদনা তলায় যেয়ে বসব।“

সুমীতা আর না করেনি। শুধু বলেছিল, যেয়েই আমাকে কল করবে। মনে থাকবে তো।

কোথায় যাবেন?

প্রশ্ন শুনে পার্থ তাকাল। বৃদ্ধ একজন, হাতে টর্চ লাইট। বয়স বোঝা মুশকিল। আবারও একি জিজ্ঞাসা।

“ হসপিটালে যেতে চাই।“

অসুস্থ?

না, তা নয়। আমি এখানকার হসপিটালের  ডাক্তার হিসাবে জয়েন করতে এসেছি। এতো রাত হওয়াতে কেউ নিতে আসেনি।  আপনি এতো রাতে?

আমি এখানকার ষ্টেশন মাস্টার। ট্রেন টাকে পাস করার জন্য থাকতে হয়ে ছিল। চলুন আপনাকে পৌছিয়ে দিয়ে আমি বাড়ী যাবো। সাথে লোটা কম্বল কিছু তো দেখছি না?

না, এই সুটকেস টাই আমার সম্বল। তবে একটু ভারী। কাউকে পাওয়া যাবে কি একটু সাহায্য করার জন্য? জিজ্ঞাসা করলো পার্থ

দাঁড়ান, আমি আসছি। বলে ষ্টেশন মাস্টার অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।  ফিরে এলো এক বিশ পঁচিশ বছরের ছেলেকে নিয়ে।

আমার  সাহায্য কারি। নাম রহীম। কি অদ্ভুত ব্যাপার আপনার নামটা জানা হোল না।

শাহীণ আহমেদ পার্থ। সবাই পার্থ বলে ডাকে। আপনার?

আফজাল খান। চলুন রাত অনেক হোল।

রহীম আগে, রাস্তার মাঝে মাঝে আলো, মাঝে মাঝে নেই। আফজাল খান তার হাতের টর্চ লাইট দিয়ে পথটা কিছুটা আলোকিত করছে।

সাবধানে পা ফেলবেন ডাক্তার সাহেব, পথে গরুর গোবর আছে। বললেন আফজাল সাহেব।

 আকা বাকা পথ বেয়ে এসে পৌছাল হাসপাতালের সামনে।

 আফজাল সাহেব হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো হাসপাতালের সাথে লাগানো  বাসাটা।

এই বাসাতেই আগের ডাক্তার সাহেব থাকতেন। বললেন উনি

দরজা ধাক্কা দিতেই চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এলো একটা ছেলে।

 এইযে সেলিম, তোমার বস, নতুন ডাক্তার সাব, নিয়ে যাও ভিতরে। হুকুমের মতো করেই বলল আফজাল সাহেব

এবার তাহলে চলি, কাল পরশু দেখা হবে। আমি নিজেই আসব। বললেন উনি

আমি যে কি বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো, কথা শেষ না হতেই আফজাল সাহেব বললেন আপনি এই শহরের প্রধান ডাক্তার ধন্যবাদ দিতে হবে না।

 ওরা বিদায় নেবার আগে পার্থ কিছু টাকা রহিমের হাতে দিলো।

রহিম ঘাড় ফিরে তাকাল ষ্টেশন মাস্টারের দিকে। উনি  ইশারা করতেই পকেটে পূরে ফেলল টাকাটা।

মধুপুর উপজেলা। সব মিলিয়ে আশি হাজারের মতো লোকের বাস। বেশির ভাগ লোকই ব্যাবসাই। বছর পাঁচেক হোল ছোট হাসপাতাল টাকে বড় করা হয়েছে। আগে কোন বেড ছিলনা। এখন পাঁচ বেডের হাসপাতাল। ডাক্তার বলতে একজনই। বাকীরা ডাক্তারকে সাহায্য করে।

পার্থর ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরীই হোল। অনেক রাতে পৌছেছে তাছাড়া সুমীতার  সাথে কথা বলতে বলতে অনেকটা রাত পেড়িয়ে গিয়েছিল। সেলিমের ডাকেই ঘুমটা ভাঙল। বাহিরে এসে দেখল নাস্তা তৌরী।

“ সেলিম, নাস্তা কে তৌরী করেছে” জিজ্ঞাসা করল পার্থ

“ বকুলের মা”

বকুলের মা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে দাঁড়াল পার্থর সামনে।

“ আমি যে ডাক্তার সাব আসে তার রান্না, ঘর মোছা সব করে দেই।“ বলল বকুলের মা

“ঠিক আছে” বলে পার্থ সেলিম কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো হাসপাতালের উদ্দেশে।

  সব মিলিয়ে পাঁচ জন কর্মচারী।  ডাক্তারকে সাহায্য করার জন্য আছে একজন নার্স। পার্থ দারজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই সবাই আসে সামনে দাঁড়াল। সেলিম পরিচয় করিয়ে দিলো সবার সাথে। আজ কোন রোগী নাই।

চেম্বারে আসে বসতেই মতীন আসে খবর দিলো চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন দেখা করতে।

“ আসসালাম আলাইকুম” বলে চেয়ারম্যান সাহেব তার উপস্থিতি জানালেন।

আমার নাম উজির আলী, এখানকার চেয়ারম্যান। বলে চেয়ার টা টান দিয়ে বসলেন।

আপনার কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন। কথা গুলো বলে চারিদিকে একবার তাকালেন উজির আলী।

অবশ্যেই।

আপনি একলা এসেছেন ? গিন্নি বুঝি পড়ে আসবে? বলে চেয়ারম্যান একটু হাসল।

আমি একলাই, যাকে বলে ব্যাচেলার। পার্থ এই ধরনের পার্সোনাল কথা মোটেই পছন্দ করেনা। তবুও প্রথম দিনই সেটা প্রকাশ করল না।

চেয়ারম্যান সাহেব উঠে পরলেন ,”আমার সময় কম। একটা মিটিং আছে। এখন উঠি। আবার দেখা হবে।“

দুদিন পরে এক সন্ধায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খুলতেই দেখে আফজাল সাহেব দাঁড়ান। “ এই ভর সন্ধায় ঘরে বসে কি করেন? চলেন ক্লাবে আড্ডা দিয়ে আসি”। বললেন আফজাল সাহেব

“ বেশ তো,” বলেই বেরিয়ে এলো পার্থ।

ছোট্ট একটা ঘর। গোটা দশেক চেয়ার পাতা।  একটা ছোট টেবিল।  জনা পাঁচেক লোক বসা। দুই জন ক্যারাম খেলছে।

বাকি দের হাতে সিগারেট।

আফজাল সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ আমাদের নতুন ডাক্তার। আর উনারা এখানকার স্কুলের মাস্টার”।

একজন সিগারেটের প্যাকেট টা এগিয়ে দিতেই পার্থ বলল, অভ্যাস নেই।

 বসে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলো।

পার্থ ভাবল মাঝে মধ্যে এসে আড্ডা দিলে সময় টা কেটে যাবে।

দেখতে দেখতে চার মাস কেটে গেছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কাজের ধরা বাঁধা কোন সময় নেই। কোন কোন দিন কিছুই করার থাকেনা। তখন সে কল করে সুমীতা কে।

মাঝে মাঝে মরণাপন্ন রোগী এলে রাত টা কাটিয়ে দেয় হাসপাতালে।

অন্য সময় হাটতে বেড়িয়ে পরে।

পথ চলতে যেয়ে লোকেরা “ডাক্তার সাহেব  কেমন আছেন”  বলে সালাম দেয়।

 এমনি একদিন পার্থ  হাটতে হাটতে চলে এলো বেশ দূরে, নদীর পাড়ে।

শুনে ছিল এই মধুপুর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এই নদী। নাম কঙ্কনা। এই নাম কে দিয়েছিল, কখন কিভাবে আসে ছিল কেউ জানেনা। এক সময় এই নদীতে লোকে নৌকা বইত। আজ শুধু তা গল্প কাহিনী। সংরক্ষনের অভাবে আজ কচুরী পানায় ভরে গেছে নদী। নদীর ধারে কাশফুলে ভরে গেছে। লোকে আর এপথ দিয়ে খুব একটা হাটে না। পায়ে চলা পথ এখনো আছে নদীর পাশ দিয়ে।

 তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ভালোই লাগছিল। হই হুল্লা নেই। নিস্থব্ধ চারিদিক। পাখি দের কিচিরমিচির। আবছা অন্ধকার। একটা কাক চিৎকার করে কা কা করে উড়ে গেলো।

পার্থ তাকাল সামনে। মনে হোল সাদা শাড়ী পড়া একটা মেয়ে হেটে চলেছে। ছিপছিপে গড়ন। ঘন চুল এলিয়ে দিয়েছে পিঠে। পার্থ তাকাল চারিপাশে। কেউ নেই। মেয়ে টা তাকাল  ফিরে। পার্থ মুখ টা দেখতে পেলনা।

 এই সময়ে কেন সে এখানে একা। ভাবল পার্থ।

দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো মেয়েটার কাছাকাছি যাবে বলে। না, হারিয়ে গেলো সে, দেখতে পেলনা আর তাঁকে।

পার্থ ভাবল সে তো সামনেই ছিল, কোন বাক তো নেই নি, তবে গেলো কোথায়।

পাশে তাকাতেই মনে হোল কে যেন শিস দিয়ে ডাকল তাঁকে।

তখন অন্ধকার ভেঙ্গে চাদের আলো পড়েছে কচুরী পানার পড়ে।

পার্থ দেখল মৃদু মন্দ হাওয়ায় শাড়ীর আঁচল উড়ছে তার। মাঝ নদীতে দাড়িয়ে। পার্থর দিকে তাকিয়ে হাসছে সে।

পার্থ চোখ টা কচলীয়ে তাকালও আবার। না ভুল নয়। সে দাড়িয়ে। তবে এবার তার মুখে হাসি নাই। দুচোখ ভরে জল।

হাত নাড়িয়ে চলে গেলো।

পার্থ দাড়িয়ে থাকলো  কিছুক্ষণ। ভাবল, কোন ঔসুধ কি খেয়েছে সে ? না, সে খায়নি। তবে কি স্বপ্ন দেখছে?

চিমটি কাটল হাতে। ব্যাথা পেলো।

আস্তে আস্তে ফিরে এলো বাসায়। ঘুরে ফিরে সাদা শাড়ী পড়া মেয়েটার মুখ টা ভেসে উঠছে। বাসায় আসে ডাক দিল সেলিম কে।

“জি স্যার।“

“ তুমি কখন নদীর পাড়ে কাশফুল বনের পাশে গিয়েছ?” প্রশ্ন করল পার্থ।

“ আপনি গিয়েছিলেন স্যার?”

হাঁ

“কখনো যাবেন না স্যার? ওখানে  ভুত পেত্নী আছে। মরা কান্না শূনতে পায়”।

পার্থ কথা বাড়াল না। সেলিম কে বলল, তুমি এসো।

ভয় ডর পার্থের কোন কালেই ছিলনা।  কলেজে পড়া কালীন মাঝে মাঝে রাতে সে শ্মশানে যেয়ে বসে থাকতো। বাঁশি বাজাতো। কেন? সে নিজেও জানেনা।

আজ যা সে দেখেছে তা কাউকে বলার নয়। মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না পার্থ।  ভাবল কাল আবারও যাবে সে।

দেখি সে আসে কি না।

 পরদিন। সন্ধা ঘনিয়ে এলো। পার্থ পা বাড়াতেই নঈম আসে খবর দিলো একটা রোগী এসেছে। বিরক্তির চিহ্ন ঢেকে পার্থ এসে দাঁড়াল রোগীর কাছে। দেখে শুনে ঔষধ লিখে দিতে দিতে আধা ঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো।

 চাঁদের আলোয় পথ দেখে এসে দাঁড়াল নদীর পাড়ে। জনশূন্য। কেউ কোথাও নেই। বুকের মাঝে অজানা এক অনুভূতি। সামনে পড়ে থাকা একটা বড় পাথরের উপর বসল পার্থ। ঘাড়ের কাছ দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। তাকাল পিছনে।

না কেউ নেই।

 “ আজ দেরী করে এলে যে?”

  চমকে সামনে তাকাল পার্থ। একটু দূরে সাদা কাপড় পরা, আচল উঠিয়ে মুখটা ঢাকা।

“আমাকে তুমিই মুক্তি দিতে পারবে। আমি আর পারছিনা। ওরা আমাকে বন্দি করে রেখেছে ওই পানির নিচে”। কাঁদতে কাঁদতে বলল সে।

  পার্থ ভাবল সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে নাতো ? না, সে তো সব কথাই শূনতে পেলো।

“ বন্দি করে রেখেছে? কে ? কোথায়? কেন?” এত গুলো প্রশ্ন একসাথে করলো পার্থ।

শোন তাহলেঃ

  দেখতে আমি সুন্দরীই ছিলাম। লোকে তাই বলত। সেটাই আমার কাল হয়েছিল।  আমি ছিলাম এক কাঠ মিস্তিরির মেয়ে। মা মারা গিয়েছিল ছোট বেলায়। বাবাই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিল। বয়সের সাথে সাথে আমার রুপের কথা ছড়িয়ে পরেছিল এই শহরে। একদিন বাবা এসে বলল, মা, বাহিরে বেশি যাসনে।

কেন? সে কথা বাবা কে জিজ্ঞাসা করিনি। বুঝে নিয়ে ছিলাম বাবা কি বলতে চাইছে।

পথে আসতে যেতে বকাটে ছেলে গুলো উত্যক্ত করতে লাগল। তার মধ্যে ছিল চেয়ারম্যানের ছেলে মহিম। যদিও আমি কোন সময়ে একলা  চলাফেরা করিনা রাস্তা দিয়ে।

মহিম ছিল ওদের লিডার। একদিন ওর নির্দেশে অনন্যারা এসে আমাদের পথ আগলে ধরল। আমার বান্ধবীদেরকে চলে যেতে বলল। ওরা ইতস্তত করতেই ওদেরকে জোরে ধমক দিল। ওরা যাওয়ার আগে বার বার আমার দিকে তাকাতে লাগল।

আমি দাড়িয়ে রইলাম। মহিম এলো। দাঁড়াল আমার সামনে। কোন ভূমিকা না করেই বলল,” আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই”।

যার পেশাই হচ্ছে গুণ্ডামি, লেখাপড়ার ধার দিয়ে যায়নি। বাপের ছত্র ছায়ায় থেকে যা ইচ্ছা তাই করে চলেছে, কেউ কিছু বলার সাহস পায়না।

জীবনে কাউকে ভয় করিনি। আজও ভয় এলোনা। বললাম, “বিয়ে করতে চান, বৌকে খাওয়াতে পারবেন? থাকেন তো বাপের বাসায়। পড়াশুনার তো ওই ছিরি”।

 দেখলাম রাগে সে কাঁপছে। আমার হাত চেপে ধরল। হেঁচকা টান দিতেই, ওড়না টা পড়ে গেলো নিচে। উঠাতে যেতেই সে আমার চুল চেপে ধরল। আমার আর হিতাহিত জ্ঞান ছিলনা।  কষে একটা থাপ্পড় মারলাম ওর গালে।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে ছেড়ে দিল আমাকে। ভাবতে পারিনি সবার সামনে তাঁকে আমি এমন অপমান করব।

আমিও ভাবিনি। সব কিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো যে আমি ভাববার কোন সুযোগ পাইনি।

হনহন করে বাসায় চলে এলাম। জানি এর প্রতিশোধ সে নেবে। তবে কি ভাবে সেই টাই আমি জানিনা।

বাবা কে  কিছুই বলিনি। শুধু অপেক্ষায় থাকলাম।

বেশ কিছুদিন কেটে গেলো।

এক রাতে, বাবা তখনো ফেরেনি। উঠানে অনেক গুলো পায়ের শব্দ শুনলাম। কোন কিছু বোঝার আগেই ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঢুকল পাঁচ জন। সাথে মহিম। চিৎকার করার আগেই মুখে রুমাল গুজে দিলো। মাথায় কালো কাপড়  দিয়ে ঢেকে পাজা কোলে করে উঠিয়ে নিলো ওদের গাড়ীতে।

 কোথায় নিয়ে এলো আমি জানিনা। তারপর ওরা আমার উপর যে অত্যাচার করেছিল তা আমি তোমাকে বলতে পারবনা।

শুধু এই টুকুই বলি, একদিন ওরা আমার গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দিলো কড়ি কাঠে।

তারপর আমার নিঃস্পন্দন দেহটাকে মোটা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দুপাশে ভারী লোহার বস্তা বেধে ডুবিয়ে দিলো এই মাঝ নদীতে।  আমি আজও ওখানেই পড়ে আছি। আমাকে তুমি উদ্ধার করো । পারবে না?

পার্থ শুনছিল। মনে হচ্ছিল কে যেন ওর কানের কাছে এসে কথা বলছে। অথচ সে বসে আছে দুরে। শুধু সাদা শাড়ীটাই দেখা যায়।

কোথায় সেই জায়গা? জিজ্ঞাসা করলো পার্থ।

নড়ে ঊঠল সাদা কাপড়টা।

পার্থ দেখল সামনে কেউ নেই। তাকাল চারিদিকে। কোথাও দেখেতে পেলো না তাকে।

আবারো কে যেন শিষ দিয়ে ডাকলও তাকে।

তাকাল বায়ে।

দেখল মাঝ নদীতে দাড়িয়ে সে। ঝপাৎ করে শব্দ হোল। মনে হোল কি যেন ডূবে গেলো ঐখানে।

পার্থ বূঝল এই সেই জায়গা। এখানেই হয়েছে তার সমাধি।

 আরও কিছূক্ষণ বসে রইল সে। ভাবল সে ডাক্তার। পুরো ঘটনাটাই Hallucination কিনা? এমন তো হয়।

নিজের কাল্পনিক চিন্তা মনে হয় বাস্তব।

ফিরে এলো বাসায়। সবকিছু ঝেড়ে ফেলতে চাইল মন থেকে।

পরদিন কাজে মন বসাতে চাইল, পারলো না। অগত্যা পার্থরই বন্ধু এখানকার পুলিশের বড় কর্তা, তার ওখানে হাজির হোল।

ওকে দেখে সমীর আশ্চর্যই হোল।

“কি ব্যাপার? আমার তো অসুখ হয়নি,ভায়া। তা কি মনে করে?

“অসুখ হয়েছে আমার, আর তার ডাক্তার তুমি”।

সমীর কিছু বোঝার আগেই পার্থ জিজ্ঞাসা করলো,” তোমার কি জানা আছে বছর দুয়েক আগে এক কাঠ মিস্ত্রীর মেয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল।“

“শুনেছি, কার সাথে যেন চলে গিয়ে ছিল”,।

“তাই কি?”

“কেন? কিছু বলতে চাইছ?”

তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না। ভাববে আমার মস্তিষ্কের কোন একটা জায়গা গড়বড় হয়ে গেছে। তাও বলি।

পার্থ বিস্তারিত সব বলে ছিল সমীরকে।

সমীর শুধু বলেছিল,” তোমাকে আমি কলেজ লাইফ থেকে চিনি। তবে, আমি বাস করি নদীতে, কুমিরের সাথে ঝগড়া করে টিকতে পারবো কি? তুমি তো জানো আমাদের শাসন ব্যাবস্থা”।

“ তোমাদের হাতে তা হলে করনীয় কিছুই নেই”। জিজ্ঞাসা করল পার্থ।

“ আছে, আমি জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাব। ওরা কেস টা ওপেন করে, সরজমিনে তদন্ত করবে। তুমি শুধু আমাকে লোকেশন টা দেখিয়ে দাও”।

  এর পর কয়েক মাস কেটে গেছে। পার্থ ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে ওর কাজে। রোগী বেড়েছে। তবুও প্রতিদিন সন্ধায় সে যায় নদীর পাড়ে। বসে থাকে সেই পাথরটার উপর। সে আর আসেনা।

পার্থ ভাবে হয়তো সে অভিমান করেছে। পার্থ তো কিছুই করতে পারলো না।

এক সকালে পার্থের হাতে কোন কাজ নেই। খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছিল।  সেলিম  দৌড়ে এসে খবর দিলো নদীর পাড়ে অনেক পুলিশ। মাঝ নদীতে কি যেন খুজছে।

 পার্থ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। অনেক লোক নদীর চারিপাশে ঘিরে দাঁড়ান। চেয়ারম্যান সাহেব কে দেখা যাচ্ছে।  মহিম আর তার সাগরেদ রা এক পাশে দাঁড়ান। ফ্যাকাসে চেহারা।

পার্থে সাথে চোখাচোঁখি হোল সমীরের।

দূরে বড় নৌকা থেকে লোহার শিকল, মাথায় আংটা বাঁধা ডুবিয়ে দিয়েছে পানির নিচে। সবাই তাকিয়ে আছে দূর পানে।

“ স্যার, কিছু তোঁ বাধছে না? চলে আসব?”। বলল নৌকায় কর্মরত একজন।

পার্থ এগিয়ে এলো সমীরের কাছে। ফিসফিস করে বলল, “ দশ বারো হাত বায়ে খুজতে বলও”।

সমীরের নির্দেশে নৌকা বায়ে মোড় নিলো। শিকলের ঝন ঝন শব্দ শোনা গেলো। রুধ নিশ্বাসে সবাই দাড়িয়ে।

এক মিনিট। দুই মিনিট, তিন মিনিট। এ যেন ঘণ্টা পেড়িয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।

“ স্যার, কীসে যেন আটকিয়ে গেছে আংটা”। চিৎকার করে বলল দলের কর্তা। নদীর পাড়ে গুনগুণ শব্দের তরঙ্গ বয়ে গেলো।  সবাই  উৎসুক নয়নে চেয়ে আছে নৌকার দিকে।  শিকল টানার শব্দ।

পানিতে ভেসে উঠল লম্বা চট দিয়ে বাঁধা এক বস্তু দু পাশে দুটো লোহার আংটা।

পুলিশ সবাই কে সরে যেতে বলল পাড় থেকে। সমীর এগিয়ে গেলো।

বস্তাটা নামানো হোল পাড়ে।   ছিন্ন হয়ে গেছে চট। দেখা যাচ্ছে কঙ্কালের হাড়।

পার্থ এসে দাঁড়ালো সমীরের পাশে। বলল,” আমি চললাম। তুমি সব কাজ শেষে পূর্ণ মর্যাদার সাথে দাফন করো”।

সমীর ওর কাধে হাত রাখল,বলল  “ কথা দিলাম”।

সেদিন পূর্ণিমা রাত। পার্থ এসে বসল সেই পাথর টার উপর। তাকিয়ে ছিল নদীটার  দিকে।  ঝলমল করছে চারিদিক।

পার্থ জানে সে আর আসবে না। আজ সে মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বাম কাধে চাপ পড়তেই ফিরে তাকাল পার্থ। কিছু দেখতে পেলো না। মনে হোল ওর মুখে কপালে কে যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দু পায়ে কে যেন হাত ছোঁয়াল।

তারপর নীস্তব্দ চারিদিক।

হঠাৎ সামনের কাশবন টা দুলে উঠল।

কে যেন ওর কানে কানে বলে গেলো।

চললাম, চললাম।

ফোন টা বেজে উঠল। ওপাশে সুমীতা। “ ঈদের ছুটিতে আসছ তোঁ?”

আসব।

 

Continue Reading

নাম না জানা মেয়েটা

       সন্ধ্যা হয় হয়। জমির আলী রিক্সাটা দাড় করিয়ে মাথার ঘামটা মুছে নিলো হাতের গামছা দিয়ে। শেষ ভাড়াটা ছিল দূরপাল্লার। প্রথমে যেতে চায়নি। বয়স হয়েছে। ইদানীং বেশি ঘণ্টা রিক্সা চালাতে অসুবিধা হয়। মাথাটা ঝিমঝিম করে। কিন্তু কোন উপায় নেই। সংসার চালাতে হবে। বৌ সকালে উঠে চলে যায় গারমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। ফিরতে রাত হয়। ছেলে মেয়ের মুখ এই জন্মে দেখা হলনা। মাঝে মাঝে বৌ মন মরা হয়ে বসে থাকে। জমির আলী সান্ত্বনা দেয়।

বলে,” মন খারাপ করোনা বৌ। সবই আল্লার ইচ্ছা”। কোন কোন দিন শেষ যাত্রীকে নামিয়ে চলে যায় জামীলার ফ্যাক্টরিতে।

দুজনে একসাথে ফেরে বাসাতে।

 “ এই চলো” বলেই এক বিদেশী উঠে পড়লো ওর রিক্সাতে। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ।

 “ তাড়াতাড়ি চলো” বলল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায়।

কোন কিছু ভাববার সময় পেলনা জমির আলী।

কোথায় যেতে হবে? জিজ্ঞাসা করল ।

তোমার যে দিকে মন চায়। টাকার কথা ভেবো না। শুধু অলি গলি দিয়ে জোরে চালিয়ে যাবে।

কথা শেষ হলনা। একটা কালো রং এর গাড়ী পাঁশে আসে দাড়াতেই লোকটা লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে দৌড় দিলো। হারিয়ে গেলো ভিড়ের মাঝে।

এত দ্রুত সব ঘটে গেলো যে জমির আলীর কিছুক্ষণ সময় লাগলো বাস্তবে ফিরে আসতে।

কালো গাড়ীটা জোরে শব্দ করে বেরিয়ে গেলো।

জমির আলী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকাল পিছনে। দেখল কি যেন পরে আছে রিক্সার পা দানিতে। একটা এনভেলাপ।

উঠিয়ে নিলো। খুললও এনভেলাপটা। ভিতরে কয়েকটা ফটো। একটা মেয়ের। সুন্দর দেখতে। ফটো গুলো উঠানো মলের ভিতর।

মলটা চেনা মনে হোল জমির আলীর। চারি দিকে তাকাল সে। অজান্তে গাটা শিরশির করে উঠল।

রিক্সার গদী টা উঠিয়ে এনভেলাপটা রেখে দিল।

এখনও দুঘণ্টা দেরী জামীলার ছুটি হতে।

“এইযে ভাই যাবেন?”

তাকাল জমির আলী।

মা তার ছোট্ট মেয়েটার হাত ধরে তাকিয়ে আছে  উত্তরের অপেক্ষায়।

জামির আলী ভেবেছিল আর কোন প্যাসেঞ্জার নেবেনা।  বিশ্রাম নেবে। কিন্তু পরিস্থিঁতি ঘোলাটে হওয়াতে দুজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তাছাড়া এই ঘটনার পরে এখানে থাকাটাও সমীচীন নয়।

“ কোথায় যাবো”?

“ রায়ের বাজার।“

চালাতে চালাতে শুধু মনে হতে লাগল এই বুঝি কালো রঙের গাড়ীটা পাঁশে আসে দাঁড়াল।

 ঘিঞ্জি এবড়ো থেবড়ো রাস্তা পাড় হয়ে সে এসে দাঁড়াল রায়ের বাজারের একতালা  বাড়ীটার সামনে।  টাকা মিটিয়ে দিয়ে মহিলা বাড়ীর ভিতর ঢুকতে যাওয়ার আগে জমির আলী জিজ্ঞাসা করল

“কটা বাজে, মেমসাব”?

“সাত টা” বলে ভদ্রমহিলা বাহিরের দরজা টা বন্ধ করে দিলো।

বাহিরে ছাউনী দেওয়া চা’র দোকানে এসে বসলো জমির আলী।  গরম চা টা ফু দিয়ে ঠোটের কাছে ধরল। আরও  একবার ফু দিয়ে কিছু পরিমাণ  ঢেলে দিলো মুখের ভিতর। সারাদিনের ক্লান্তির পর এযেন অমৃত মনে হোল।

একটা নন্তা বিস্কিট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলো।  এখনো হাতে কিছু সময় আছে জামীলাকে আনতে যাওয়ার।

চা টা শেষ করে রিক্সার পাঁশে এসে দাঁড়াল জমির আলী। গদীর নীচ থেকে বের করল এনভেলাপটা।  দেখল আবার। কি যেন রহস্য আছে এর  মাঝে মনে হোল জমির আলীর।

জামীলাকে কিছুই জানালো না সে।  পরের দিন রিক্সা চালিয়ে কিছু টাকা হাতে আসতেই জমির আলী চলে এলো সেই মলের সামনে। এযেন এক অদৃশের টান। রিক্সাটা রাস্তার পাঁশে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো উপরে। হাতে এনভেলপটা। ফটো টা

 আর একবার দেখল।

 দোতালায় এলো জমির আলী। জয়ন্তী জুয়েলারস। এর সামনে তোলা ছবি। আশে পাঁশে কয়েকবার হাঁটল সে। ভেবে ছিল মেয়েটাকে এখানে দেখতে পাবে। আর দেখতে পেলে ওর ছবি ওকে ফিরিয়ে দেবে।

না, কোন কিছু চোখে পড়লনা জমির আলীর। ছবিটা যে কাউকে দেখাবে সে ভরসাও পেলোনা। অগত্যা এস্কেলেটর দিয়ে নিচে নেমে এলো। বাহিরে এসে দাঁড়াল। ভাবল একটা সিগারেট টানলে মন্দ হয়না।

সামনেই দোকানে।  সিগারেট কিনে পাশ ফিরতেই চোখে পড়ল দুই টা লোক কিছু দূরে দাড়িয়ে  তাকিয়ে আছে ওর  দিকে । ওদের দুজন কে সে জয়ন্তী জুয়েলারসের সামনে দেখেছে। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে তাকাল সামনের দিকে ঝুলিয়ে রাখা  খবরের কাগজের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কাগজটার দিকে। সারা শরীর হীম হয়ে এলো। এতো সেই মেয়ের ছবি সাথে সেই বিদেশির। বড় বড় করে লেখা, “ যমুনা হোটেলে জোড়া খুন”।

জমির আলী বুঝতে পারল নিজের অজান্তে সে কীসের মাঝে জড়িয়ে পড়েছে।

 তাড়াতাড়ি রিক্সার দিকে রওনা হোল। ভাবল, বাসায় যেয়েই ছবি গুলো পুড়িয়ে ফেলবে। আর গোয়েন্দা গিরি নয়।

  রিক্সা পর্যন্ত পৌছাতে পারলনা জমির আলী। সেই দুজন ষণ্ডা মার্কা লোক এসে দাঁড়াল ওর দুপাশে। ওদের চোখ এনভেলাপটার দিকে। জিজ্ঞাসা করল,” এই এনভেলপটা কোথায় পেয়েছ?”

আমতা আমতা  করে কিছু বলার আগেই জমির আলীর মনে হোল এনভেলপটা রেগুলার এনভেলপের মতো নয়। করাতের দাতের মত দুপাশে খোঁদায় করা। আর দুইটা কোদালের ছবি। এই ভিন্ন ধরনের এনভেলাপ টাই যত নষ্টের মুল।  এটার জন্যেই সে ওদের নজরে পড়েছে।

 উত্তরের অপেক্ষা না করেই একজন ওর হাত থেকে এনভেলপটা নিয়ে নিলো। অন্যজন ইশারা করে দেখাল ওর হাতের রিভলভারটা। জমির আলীর সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। গলা শুকিয়ে গেছে। ওকে নিয়ে এলো ওরা রাস্তার ওপাশে দাঁড়ান সাদা মারসেডিসের কাছে। কালো টিনটেড গ্লাসে ঢাকা চারিদিক। বাহিরের থেকে কিছুই দেখা যায়না।

  একজন দরজা খুলে দাঁড়াল। অন্যজন আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে গাড়ীর ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো জমির আলীকে।

  ভিতরে বসে আছে তিনশ পাউন্ডের একটা লোক। দরজা বন্ধ হতেই ষণ্ডা মতন লোকটা এনভেলপটা এগিয়ে দিলো মোটা লোকটার দিকে।

 “বস, এই সেই এনভেলপ।“ বলে জমির আলীর দিকে তাকিয়ে নেকড়ের হাসির মতো হাসি দিলো।

মোটা লোকটা এনভেলপ থেকে ছবি গুলো বের করে পাশে রেখে দিলো। ঊল্টা পালটা করে কয়েক বার দেখলও  এনভেলপটা । কি যেন খুজছে , পাচ্ছে না।

তাকাল জমির আলীর দিকে। জমির আলীর আত্মা তখন খাচা ছাড়া।  বুজতে পাড়লো না কি সে খুজছে।

“ Where is that paper? কাগজটা কোথায়?” হুঙ্কার দিয়ে উঠলো মোটা লোকটা।

“কাগজ? কোন কাগজ?” কান্না কান্না স্বরে বলল জমির আলী।

গলা টা টিপে ধরল। জমির আলী নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।

ছুড়ির ধারাল ফলা ওর গালের কাছে ধরল মোটা লোকটা। একটু চাপ দিতেই রক্ত গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।

 ভয়ে থর থর করে কাঁপছে জমির আলী।

লোক টা ছুরির ফলাটা গাল থেকে সরিয়ে এনে ছোঁয়াল ডান চোখের পাশে। হাতের ইংগিতে বোঝাল চোখ টা উঠিয়ে আনবে।

জমির আলীর মনে পড়ল একটা কাগজ সে দেখে ছিল এনভেলাপের মধ্যে। হিজি বিজি কি সব লেখা ছিল। ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি। ওটা সে রিক্সার পা দানিতে ফেলে দিয়ে ছিল।

মনে মনে সে ভাবল এই সুযোগ, রিক্সাতে আছে বলে সে যদি একবার এই গাড়ী থেকে বের হতে পারে তাহলে দেবে ছুট। কপালে যা থাকে।

লোকটার ছুরি টা ওর বুকের কাছে আসার আগেই জমির আলী বলল রিক্সাতে রেখে এসেছে সেই কাগজ টা।

 চোখে ইংগিত করতেই একজন জমির আলিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ী থেকে।

বেরিয়েই জমির আলী দেখল সামনে দাঁড়ান দুই টা পুলিশের গাড়ী।

চারিদিকে তাকালও একবার।

 চিৎকার করে উঠলো, বাচাও বাচাও বলে।

কিছু লোক তাকাল জমির আলীর দিকে। পুলিশ দৌড়িয়ে এলো স্টেনগান হাতে।

লোকটা  ভড়কিয়ে যেয়ে দৌড় দিল গাড়ীর দিকে। ততক্ষণে পুলিশ এসে ঘিরে ফেলেছে গাড়ীটা।

ভিতর থেকে বের করে আনা হোল মোটা লোকটাকে।  সাথে ফটো গুলো।

পুলিশের কর্তা ফটো দেখে বলল,” এই মেয়েটাই কাল রাতে খুন হয়েছে যমুনা হোটেলে। পাশে পাওয়া গেছে এই মলের ছবি”।

জমির আলী কাঁদতে কাঁদতে বলতে যাচ্ছিল সব কথা। পুলিশের বড় কর্তা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,” থানাতে যেয়ে সব শুনব।“ এই কথা বলে পাশে দাঁড়ান পুলিশ কে বলল একটা রুমাল জামির আলিকে দিতে গালের ক্ষত জাগায় চেপে ধরার জন্য।

রুমাল টা চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,” স্যার, আমি একটু আমার রিক্সার কাছে যেতে পারি?”

উদ্দেশ সেই কাগজটা। পড়ে আছে, কি নেই।

আছে, পাদানিতেই পড়ে আছে। আস্তে  করে উঠিয়ে নিলো জমির আলী। পরে খতিয়ে দেখবে কি আছে ওই লেখার মাঝে।

পুলিশ মোটা লোকটা আর সাথের সঙ্গী দুজনকে উঠিয়ে নিলো পুলিশের গাড়ীতে।

জমির আলী কেও নিয়ে এলো থানাতে। ওর বয়ান শেষে চলে যেতে বলল ওকে।

বাসায় এসে সব ঘটনা বলল জামীলাকে। দেখালও চিরকুটটা। ইংরাজিতে লেখা একটা ঠিকানা।

দুই দিন পরে খবরের কাগজে বড় বড় করে লেখা ৬৬৬ বান্দর লেন থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে প্রচুর হীরক সাথে অস্ত্র, কয়েকশো রাউন্ড গুলি।

জমির আলী পড়ল সংবাদটা। কাগজটা বের করে দেখল ঠিকানাটা।  ৬৬৬ বান্দর লেন।

ভাবল, আহ, একটু আগে যদি সে যেতে পারত।

তাহলে———— হীরা–

 

Continue Reading

নতুন জীবন

                                                                         নতুন জীবন

   শফিক তার তল্পী তল্পা নিয়ে এসে উঠলো এক ঘর বেষ্টিত এপার্টমেন্টে। ছেলে মেয়েরা গোছায়ে দিয়ে গেছে এক চিলতে শোবার আর এক চিলতে বসার ঘর টা। বলে গেছে, বাবা এই ক্লোজেটে থাকলো তোমার জামা আর প্যান্ট, হাঙ্গারে ঝুলানো। পাশের এই ড্রয়ারে থাকল তোমার আন্ডার গারমেন্ট গুলো। এই ঝুড়িটার ভিতর রাখবে তোমার ময়লা কাপড় গুলো। বাহিরে যেতে হবেনা । রান্না ঘরের পাশেই আছে ওয়াসার আর ড্রায়ার। পরিষ্কার করে নিও।

শফিক বলেছিল, ঠিক আছে মনে থাকবে। কবে যে সে শেষ ওয়াসার আর ড্রায়ার ব্যবহার করেছিল মনে করতে পারেনা। যদিও সেই বিশাল বাড়ীর নিচের তালাতেই ছিল সব কিছু। এসব নিয়ে মাথা সে কোনদিনই ঘামায়নি। এতদিন তো নুবীয়া এসেই সবকিছু করে দিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বলত, মিস্টার, সব কিছু ধুয়ে ভাজ করে রেখে গেলাম, এখান থেকে নিয়ে নিয়ে পড়বে। আমি আবার দুই সপ্তাহ পরে আসবো।

 শফিক জিজ্ঞাসা করেছিল আসবে তো আমার এপার্টমেন্টে? দুই সপ্তাহে না হয় নাইবা এলে, তিন সপ্তাহ পরে হলেও চলবে।

নুবীয়া রাজি হয়নি। বলেছিল বন্ধের দিন সে কাজ করেনা।

শফিকের বাসাটা ছোট হলেও ছিমছাম। শোয়া বসা আর রান্না ঘর ছাড়াও একটা ছোট্ট বেলকনি আছে। ওখানে বসলে সামনের ফুলের বাগানটা চোখে পরে। রংবেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো।

সব মিলে দশটা পৃথক পৃথক তিন তালা বাড়ী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সুন্দর করে ছাটা লন। চারিদিকে লোহার বেড়া। ঝুট ঝামেলা নেই। নেই কোন পথচারীর হাঁটাচলা । নেই কোন হট্টগোল।

শফিক প্রথমে আসতে চায়নি। ছেলে মেয়েরাই জোর কোরে নিয়ে এসেছে। বলেছিল, বাবা, এত বড় বাড়ী ছেড়ে কারোর বাড়ীর নিচের তলায় মাথা গুজলে তুমি বাজবে না। তোমাকে থাকতে হবে সুন্দর খোলা মেলা নতুন তৈরী এপার্টমেন্টে।

শফিকের কোন না ছিলনা। ওরাই সব ব্যবস্থা করেছিল। সব কিছু শেষ করে এসে বলেছিল, আব্বু সব ঠিক হয়ে গেছে। দোতালায় তোমার ঘর। বেশি উপরে উঠতে হবেনা। পারকীংও কাছে। শুধু টাকাটা পাঠিয়ে দিও।

এতো এক নতুন জীবনের শুরু।

 শফিক কফির পেয়ালা টা নিয়ে এসে বসলো বেলকনিতে। বিকেলের সূর্যের তাপটা উপভোগ করার মত।  ভাবছিল, বিয়াল্লিশ বছর আগে এসে উঠেছিল এক এপার্টমেন্টে, আজ বিয়াল্লিশ বছর পরে ফিরে এলো সেই জায়গায়। শুধু মাঝের সময় টা  সিনেমার পর্দায় দেখা ছবি। আরম্ভ হয়েছিল হাসি আনন্দ, হৈ, হুল্লা করে। শেষে হোল চোখের জল ফেলে। আলো জ্বেলে উঠলো। পর্দা সাদা। শুধু রেশটা রইল আর কিছু রইল না।

এ শুধু ওর জীবনেই নয়, একিই ঘটনার প্রতিফলন ঘটেছে অনেকের জীবনেও। কেউ আবারও জড়িয়ে গেছে অন্যের জালে। ভেবেছে এপথে সে পাবে আলোর সন্ধান, পাবে মানসিক শান্তি। কেউ বা ভাবছে নামাজ কালামের মাঝে ফিরে পাবে তার সুখ শফিক পাবে কি সে?

     শফিক চাইছে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বিকেলের রৌদ টা উপভোগ করতে। উপভোগ করতে চাইছে খোলামেলা ছোট্ট এপার্টমেন্টটা। পা বাড়ালেই মুভি হল। বায়ে মোড় নিলে বিশাল পার্ক। খাবারের বড় বড় রেস্টুরেন্ট গুলো বেশি দূরে নয়।

হাটা পথ।

   আগের মতো অন্ধকার ঘর গুলো আর তাকে গ্রাস করবেনা। কিছুক্ষণ আগে সবাই কে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে নতুন  ঠিকানা দিয়ে। অনেকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছে, নতুন জীবন নতুন ভাবে শুরু হোক এই কামনা করি। আমরাও একদিন হবো এপথের পথিক।

ফোন টা বেজে উঠল।

 ওপাশে সামন্তীর কণ্ঠস্বর। বন্ধুত্ব অনেক দিনের।

 কেমন লাগছে?  নতুন জায়গা, নতুন ঘর। জিজ্ঞাসা করলো সে।

 অনুভূতি টা তোমাকে ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবো না। বলল শফিক

আমরা চার বন্ধু বান্ধাবী শেষ তোমার বাসাতে রাত কাটিয়ে ছিলাম মনে পরে?

তা আর পরবেনা, তুমিই তো নিয়েছিলে সবচেয়ে বড় ঘরটা। এখন একটা শোয়া আর একটা বসার ঘর। পারবে এসে থাকতে? জিজ্ঞাসা করেছিল শফিক।

কোথাও থাকতে জায়গা লাগেনা, মন লাগে। সে মন আমার আছে শফিক। বলেছিল সামন্তী।

আজ রাখি। তুমি সব গুছিয়ে নাও। আসব একদিন। শুধু একটা কথা বলি তোমাকে,” I am so proud of you.” বলে ফোন টা রেখে দিয়েছিল।

 সন্ধ্যা হয় হয়। পাশের বাড়ীর ঘর গুলোতে বাতি জ্বলে উঠল। এ দৃশ্য সে দেখেনি অনেক দিন। শুধু দেখে এসেছে বড় বড় বাড়ী। এক এক বাড়ীতে এক একটা ফ্যামিলি। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ঢেকে যেতো চারিদিক। পাশের বাড়ীর কুকুরটা মাঝে মাঝে চিকন সুরে ডাক দিতো। দু একটা গাড়ী সাঁ করে চলে যেতো।

আজ মনে হচ্ছে ছোট ছোট আলোর কনা চারিদিকে। উপরে, নিচে, মধ্যে। ঘরের মাঝে দু এক জনের চলাফেরা দেখতে পাচ্ছে শফিক তার বেলকনিতে বসে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।

সামনে শীতের মাস। শফিককে ভাবতে হবেনা বরফ পরিষ্কারের কথা। ভাবতে হবেনা এন্টোনিও কে ডাকার কথা। বলতে হবেনা ড্রাইভওয়ে টা পরিষ্কার করে দিয়ে যাও আমার গাড়ী বের করতে হবে। এ কথা ভাবতে যেয়ে শফিকের মনে পড়ল অনেক বছর আগে ওরা ভেবেছিল পড়ন্ত বয়সে এই রকম এপার্টমেন্টে এসেই ঠাঁই নেবে, তবে সেটা হবে দুই থেকে তিন ঘরের।

কফি টা ফুরিয়ে এলো। আবার উঠতে হবে। ভাতের চাল টা বসিয়ে দিয়ে একটু বাহিরে হাটতে যাবে, ভাবল শফিক।

অনেক দিন ঝলমলে আলোর নিচে হাটা হয়নি। অন্ধকারে পাশের পার্কে যেতে মন চাইছে না। এসে দাঁড়াল ফুলের বাগানের চত্বরে।  সামনে আলোয় আলোকিত রাস্তা। শফিককে ডাকছে। শফিক পা বাড়াল সেই পথে।

 

Continue Reading