প্রতিশোধ (শেষ পর্ব)
পোস্ট মরটমের রিপোর্ট অনুসারে খুন হয়েছে রাত বারোটার পরে। আফসারউদ্দিন বার বার রিপোর্ট টা পড়ল। পাঁচটা
ছুরির একটাতেও হাতের ছাপ নেই এটাই রহস্য।
রহমত এসে খবর দিলো পাঁচজনের খোজ পাওয়া গেছে। সবাইকে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। আফসার উদ্দিন বাহিরে এসে দাঁড়াল। আকাশটা আজ মেঘলা। লোকদের মনে খুশীর বন্যা বইছে। রাখাল মারাগেছে। দু এক জাগায় ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। একথা আফসারউদ্দিনের কানে এসেছে।
কনেস্টবল রহমান খোদেজা আর ওর মাকে নিয়ে এলো পুলিশ ষ্টেশনে। খোদেজার মাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলে আফসারউদ্দিন রহমত কে বলল খোদেজাকে ইনটারোগেশন রুমে নিয়ে যেতে। খোদেজা বোরখা পরে এসেছিল যাতে লোকেরা চিনতে না পারে। পাঁশে খুলে রেখে দিলো। বয়স ষোল সতেরো হবে। চোখে হিংস্রতার ছাপ।
আফসারউদ্দিন ঢুকতেই খোদেজা বিষ মিশানো স্বরে বলল,” হারামজাদার গলাটা কাটেনি কেন?”
“ ওর যে গলা কাটা হয়নি তা তুমি জানলে কি ভাবে? তুমি তো থাকো অনেক দুরের গ্রামে”?
“ঐ লম্পটের মরার খবর বাতাসের আগেই চলে এসেছিল। এখন বলেন আমাকে ডেকে এনেছেন কেন”?
“ ঐ রাতে তুমি কোথায় ছিলে?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন ।
“কেন? আমাকে সন্দেহ করছেন?”
“অস্বাভাবিক তো কিছু নয়। তবে প্রমান সাপেক্ষ”।
“ওর গলাটা আর একটা অঙ্গ যদি আমি নিজে হাতে কাটতে পারতাম তবে আমার প্রান জুড়াত। যে সর্বনাশ সে আমার করেছে আপনি তা বুঝবেন না। আপনারা জানেন শুধু টাকা খেয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে। সেদিন কেন তার বিচার হয়নি? সেদিন কেন প্রমান হোল আমি খারাপ মেয়ে আর সে সাধু”। উত্তেজিত হয়ে কথা গুলো বলে একটু থামল সে।
তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বলল,“ঐ রাতে আমি আমার বান্ধাবী রওশন আর তার স্বামীর সাথে গোপালপুরের মেলায় গিয়েছিলাম। খোজ নিয়ে দেখতে পারেন। ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল”।
“ চম্পা,রহীমা,মীনু,আলো, এদেরকে চেনও”? জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন।
“ নাম শুনেছি, দেখিনি”।
আফসারউদ্দিন কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই রহমত ঘরে ঢুকল। আফসারউদ্দিনের কানে কানে কি যেন বলল। আফসারউদ্দিন তাকাল খোদেজার দিকে। খোদেজার দুচোখে বিস্ময়। আফসারউদ্দিন আসছি বলে বেরিয়ে গেলো বাহিরে।
কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলো। তাকাল খোদেজার দিকে।
“ রাখাল কে হত্যার দুদিন আগে তোমাকে আর রহীমাকে দেখা গিয়েছিল রহীমাদের বাসার ছাদে। তাইনা?”
খোদেজা কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে রইল।
“ তুমি বলেছিলে তুমি ওদেরকে কোনদিন দেখোনি”। আফসারউদ্দিন প্রশ্ন করল খোদেজা কে।
“ আমি খুন করিনি”। তীব্র স্বরে বলল খোদেজা। “বললাম না আপনাকে ওকে খুন করতে পারলে আমার হাড় জুড়াত”।
সেই রাতে আমি মেলাতে ছিলাম” বলল সে।
আফসারউদ্দিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, ভাবল ওর এই কঠোর ভাবে কথা বলার মাঝে কোন রহস্য আছে কিনা।
আমি আসছি বলে বেরিয়ে গেলো, ডাক দিলো রহমত কে, বলল দীলীপকে ডেকে আনতে।
দীলীপ আসতেই ওকে একটা চিরকুট দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। বলল, গাড়ী নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি যাবে আর আসবে”।
দীলীপ দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
আফসারউদ্দিন রহমত কে ডাক দিয়ে বলল খোদেজা কে নিয়ে যেতে। ওয়েটিং রুমে বসাতে বলল।
বেরিয়ে এসে আফসারউদ্দিন দেখল খোদেজার মা বসে আছে। বাম চোখ কালো ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা।
আফসারউদ্দিন একবার তাকাল খোদেজার মার দিকে।
রহমত কে বলল চম্পা কে নিয়ে আসতে।
“তোমার নাম চম্পা, চম্পা কি?”
“চম্পা বিশ্বাস।‘
“ তুমি তো কলেজে যাচ্ছও? তাই না?”
“হা”
তোমাকে আমি কেন ডেকেছি বুঝতে পারছ?
“জানি কেন ডেকেছেন এবং আপনি খোজ নিন আমার কলেজে। জানতে পারবেন সে রাতে আমার ইস্পেশাল ক্লাস ছিল।
খুন আমি করিনি, তবে ইচ্ছা যে হয়নি তা নয়। সময়, সুযোগ, পরিস্থিতি যদি আমি পেতাম তবে ওকে খুন করতে আমি দ্বিধা করতাম না। কে করেছে যদি জানতে পারতাম তবে তাকে সহস্রও বার প্রনাম করতাম। আজও লোকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে আড়চোখে তাকায়। বাবা মা কে রাস্তায় অপদস্ত করে। আর আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। এক গ্রাম ছেড়ে আর এক গ্রামে চলে গেছি তাও রেহায় নেই। বলতে পারেন কবে আমি আবার চোখ তুলে চাইতে পারব। বলতে পারেন কবে একজন এসে আমাকে বলবে “তোমার অতীত আমি জানতে চাইনা জানতে চাই তোমাকে”। আপনারা তোঁ পুতুল। যখন যে যে ভাবে নাচায় সেই ভাবে নাচেন।“
আফসারউদ্দিন কিছু বলার আগেই রহমত এসে পাশে দাঁড়াল। চোখে ইঙ্গিত করতেই আফসারউদ্দিন বেরিয়ে গেলো।
বাহিরে দাঁড়ান রওশন আর তার স্বামী।
আফসারউদ্দিন তাদেরকে ডেকে নিয়ে গেলো তার চেম্বারে। জিজ্ঞাসা করল খোদেজা যা বলেছে সত্যি কি না।
ওদের হাঁ সূচক উত্তরে আফসারউদ্দিন ওদেরকে যেতে বলে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল।
কোথায় যেন একটা গরমিল আছে মনে হোল আফসারউদ্দিনের। ডাক দিল রহমত কে। বলল,” ওদের পাঁচজন কে যেতে বলও তবে গ্রাম ছেড়ে বাহিরে যেন না যায়।“
আর শোন, এখনি একটু বের হতে হবে। গাড়ী ঠিক করেতে বলও।
রহমত বেরিয়ে গেলো।
গাড়ী নিয়ে আফসারউদ্দিন আর রহমত এসে পৌছাল সেই বাংলো তে। ঘরের ভিতর টা আর একবার ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে চায়। ঘরের ভিতর এসে দাঁড়াল দুজন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলো কোন কিছু চোখে পড়ে কিনা।
“স্যার?”
রহমতের দিকে তাকাল আফসারউদ্দিন।
রহমত আঙ্গুল দিয়ে দেখালও ঘরের কোনে পড়ে থাকা বস্তু টির দিকে। চকচক করছে।
বড় একটা বোতাম। কোটের বোতামের মতো মনে হোল আফসারউদ্দিনের। হাতে গ্লভস পড়ে বোতামটা উঠিয়ে নিয়ে রাখল পকেট থেকে বের করা রুমালের ভিতর। চারিদিকে তাকাল আর একবার। বের হয়ে এলো রুম থেকে।
বলল রহমতকে “ আশে পাশের বাড়ীর লোকদের কে জিজ্ঞাসা বাদ করতে হবে। কেউ কিছু হয়তো দেখেছে যা আমাদের কাজে লাগতে পারে”।
বাংলোর পিছনে বাঁশঝাড়। তার মাঝ দিয়ে পায়ে চলা পথ। সেই পথ যেয়ে পড়েছে বড় রাস্তায়। তার পাশে লোকদের বসতি।
সেই পথ দিয়ে চলতে যেয়ে আফসারউদ্দিনের চোখে পড়ল সাদা একটা কাপড়ের টুকরা বেধে আছে ছোট্ট একটা বাঁশের মাথায়। শাড়ীর ছেড়া অংশ মনে হোল। উঠিয়ে নিয়ে সযত্নে করে রেখে দিলো পকেটে।
প্রথম বাসাতে টোকা দিতেই সুলতান বেরিয়ে এলো। পুলিশ দেখে ঘাবরিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো সেই রাতে এমন কিছু তার চোখে পড়েছে কিনা অথবা কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে কিনা ঐ বাংলো থেকে যা স্বাভাবিক নয়।
না দেখেনি। বলল সুলতান
পাশের বাসায় থাকে শমশের আলী। রহমত ডাক দিলো শমশের আলীকে। বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে দাঁড়াল শমশের।
একি প্রশ্ন করলো আফসারউদ্দিন। জবাব, কিছুই দেখেনি সে।
পিছন ফিরে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই শুনতে পেলো এক মহিলার কণ্ঠস্বর।
“ উনাদেরকে দাড়াতে বলো ”।
“ কিছু বলবেন?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন।
“ দেখেছি একজন কে সাদা শাড়ী পড়া”।
“সাদা শাড়ী পড়া”? প্রশ্ন করলো, সাথে সাথে মনে হোল পকেটে রাখা সাদা টুকরো অংশ টার কথা।
“হাঁ”
“ চিনতে পেরেছেন?”
“না, তবে—“
“তবে কি?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন
“ একটা চোখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা”।
“ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা?” বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল আফসারউদ্দিন।
“আপনি ঠিক বলছেন?”
“জি, আমি সেই রাতে বাঁশ বাগানের ঐ রাস্তায় গিয়েছিলাম ছাগল টাকে আনার জন্য। হনহন করে সাদা কাপড় পড়া মেয়েটা আমার পাশ দিয়ে চলে গেলো। একটু হলেই আমাকে ধাক্কা দিতো।“
“ ঠিক আছে”। কিছু জিজ্ঞাসা না করে আফসারউদ্দিন রহমতকে নিয়ে ফিরে এলো থানায় । মাথার মধ্যে ঘুরছে শুধু একটা কথা, “ এক চোখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা”।
রহমত কে বাসায় যেতে বলে সেও ফিরে এলো তার বাসায়। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। কোন রকমে রাতটা কাটিয়ে
ভোর হতেই নাস্তা শেষ করে বাড়ীর কাজের লোকটাকে বলল রহমত কে ডেকে আনার জন্য।
রহমত এসে দাড়িয়ে ছিল বাহিরে। বুঝে উঠতে পারলনা এতো ভোরে কেন তার ডাক পড়ল।
আফসারউদ্দিন বেরিয়ে এসে রহমত কে বলল এখনি খোদেজার মা কে প্রথমে, এবং অন্য চার জনের মা কে পরে নিয়ে আসতে। রহমত বেরিয়ে যেতেই আফসারউদ্দিন এসে বসল তার চেম্বারে। মনে মনে ভাবল আবার রহস্যের জাল খুলবে।
আধাঘণ্টা পরে রহমত ফিরে এলো খোদেজার মা কে নিয়ে। ওয়েটিং রুমে বসিয়ে আফসারউদ্দিনকে খবর দিলো।
আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো,” অন্য চার জন কে এনেছ?”
“জি।“ বলল রহমত
“ওদেরকে ওয়েটিং রুমের সামনে দিয়ে নিয়ে ভিতরের ঘরে বসাও” বলল আফসারউদ্দিন
চলতে যেয়ে চারজন তাকাল খোদেজার মার দিকে।
বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করলো আফসারউদ্দিন। পেরিয়ে গেলো এক ঘণ্টা।
ডাক দিলো রহমত কে।
খোদেজার মা কে ইনটারোগেশন রুমে নিয়ে যেতে বলে একটা সিগারেট ধরিয়ে দুই টান দিয়ে ফেলে দিলো আফসারউদ্দিন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল বাহিরের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো ইনটারোগেশন রুমের দিকে।
খোদেজার মা মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। আফসারউদ্দিন ঢুকতেই চোখ তুলে চাইল সে। আফসারউদ্দিনের দৃষ্টি ওর কালো ব্যান্ডেজে বাঁধা চোখটার দিকে।
“ ওরা চারজন স্বীকার করেছে তোমরা রাখালকে হত্যা করেছ। আর তুমি দলের নেত্রী।“ এই মিথ্যে কথার চালটা চেলে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
“না আমি করিনি”। দৃঢ় তার সাথে বলল খোদেজার মা।
আফসারউদ্দিন উঠে বাহিরে যেয়ে ফিরে এলো হাতে সাদা একটা শাড়ী নিয়ে। সেটা সে খোদেজার মার বাসা তল্লাশি করে আগেই এনে রেখেছিল।
“ এই শাড়ীটা টা তোমার, তাই না?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন
“ হাঁ, তাতে কি প্রমান হয়েছে?”
আফসারউদ্দিন শাড়ীটার ভাজ খুলল। একটা জাগায় কিছুটা অংশ নেই।
দেখাল খোদেজার মা কে। তারপর পকেট খেকে বের করলো সেই অংশ টুকু।
“ এই অংশ টুকু পাওয়া গেছে বাঁশঝাড়ে। দেখো চিনতে পারো কিনা?” বলে তাকিয়ে থাকলো ওর মুখের দিকে।
আফসারউদ্দিন শুনতে পেলো খোদেজার মার দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ। তাকাল সে আফসারউদ্দিনের চোখের দিকে।
“ এসেছিলাম মারতে, কিন্তু পারিনি। হারামজাদা সর্বনাশ করেছিল আমাদের মেয়েদেরকে”। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল সে
“তার মানে? খুলে বলও। রাখালকে এতরাতে এনেছিল কে ঐ বাংলোয় ”।
“মুকুল আর সোহাগ’।
“মূকুল ? সলেমানপুরের মাস্তান আর সোহাগ তার ডান হাত” ? অবিশ্বাস্যর মত জিজ্ঞাসা করল আফসারউদ্দিন
“ হাঁ, সেই আমাদের কে বলেছিল “প্রতিশোধ নিতে চাও?”
আমরা বলেছিলাম, হাঁ, নিতে চাই কিন্তু কি ভাবে?”
সে বলেছিল রাখালকে নিয়ে আসবে রাতে।
এনেছিল। রাখালকে বলেছিল নতুন মাল পাওয়া গেছে। সোহাগ নিয়ে আসবে। এই বলে ওকে নিয়ে এসেছিল বাংলোতে। আমরা লুকিয়ে ছিলাম বাঁশঝাড়ের মাঝে।
ড্রাগ খেয়ে কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়লে রাখালকে ওরা দুজন মিলে বেধেছিল পিলারের সাথে।
একটু ধস্তাধস্তি হয়েছিল। দুজনের বিপরীতে একজন, পারবে কেন।
আমরা এসে দাঁড়ালাম ওর সামনে। পাঁচটা ছুরি এগিয়ে দিলো মুকুল। প্রতিশোধ নিতে হবে। রাখালের চোখে আতংকের ছাপ। আমাদের শরীরের রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে। আমরা পাচজন ছুরি উঠিয়ে নিলাম হাতে। কিন্তু পারলাম না। পারলাম না ওর বুকে বিঁধিয়ে দিতে।
মুকুল ছুরি গুলো নিয়ে নিলো আমাদের হাত থেকে। গেঁথে দিলো এক একটা ছুরি এক একটা মেয়ের নামকরে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরল। ভয় আমরা পাইনি। কোন অনুশোচনা হয়নি আমাদের । বরং একটা পিশাচ মরেছে, বেচে গেছে অনেকে”। বলে থামল খোদেজার মা।
মুকুলের গায়ে কি কোট ছিল? জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন।
“হাঁ”
আফসারউদ্দিন আর কোন প্রশ্ন না করে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ডাক দিলো রহমত কে।
“গাড়ী বের করতে বলো । সাথে চারজন পুলিশ নিয়ে নাও। সলেমানপুরে যেতে হবে”।
প্রতিশোধ
বাংলো টাইপের বাড়ী। অনেক জনতার ভিড়। পুলিশের গাড়ী। উৎসুক জনতার মুখে শুধু একটাই কথা, “খুব ভালো হয়েছে। পাপের শাস্তি আল্লাহ দুনিয়াতেই দিয়ে দেয়”।
রাখালের লাশ বাঁধা তার বাংলো বাড়ীর এক পিলারের সাথে। পাঁচটা তীক্ষ্ণ ছুরি গাঁথা তার বুকে। একটা ছুরি হৃদপিণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে গেছে ওপর পাঁশে। রক্ত ঝরছে।
রাখালের অত্যাচারে অতিষ্ঠও হয়ে উঠেছিল এই উপজেলার লোক। খুন খারাবি, চাঁদা বাজি, নারী ধর্ষণ এ ছিল তার নিত্য নৈমিত্বিক ব্যাপার। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল টাকা দিয়ে। কেউ কোন নালিশ জানালে পরদিন তার লাশ পাওয়া যেতো নদীর ধারে। ভয়ে সবাই তটস্থ।
রাখালের বাবা কাজ করতো এক কাপড়ের দোকানে। বাড়ী ছিল আরাপপুর গ্রামে। একদিন বাসায় এসে তাহেরা কে ডাক দিয়ে বলল,” রাখালের মা আমাকে এক গ্লাস পানি দাও, বুকটা যেন কেমন করছে”। পানি আর পান করা হয়নি। তার আগেই সব শেষ। রাখালের বয়স তখন বারো। ওর মা দিশাহারা। শোঁকের ছায়া মিলিয়ে যেতেই দেখতে পেলো সে কর্পদহীন। আত্মীয় স্বজন চলে গেছে যার যার পথে। কাজ নিয়ে ছিল চেয়ারম্যানের বাড়িতে। কাজ শেষে কিছু খাবার নিয়ে আসত বাসায়। তাই খেয়ে দুজনে রাত কাটাত। কিছু কিছু দুষ্ট লোকের উপদ্রব যে ছিলনা তা নয়। মার বাড়ন সত্ত্বেও রাখাল কাজ নিয়ে ছিল বাবার এক বন্ধুর দোকানে। অতি অল্প বয়সে পৃথিবী টাকে চিন্তে শিখলো।
শেফালী, তাহেরার এক দুঃসম্পর্কের খালাতো বোন, খবর পেয়ে এলো দেখা করতে। থাকে কাঞ্চনপুর উপজেলায়। অবস্থা ভালো। ছেলে,মেয়ে নেই। তাহেরার চেয়ে বয়সে বড়। শেফালীকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল তাহেরা।
“ আমার কি হবে শেফালী আপা ? কি হবে?” বলতে বলতে কান্নার স্বর দ্বিগুণে উঠল।
শেফালী ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,” সেই জন্যই তো আমি এসেছি। তোকে নিয়ে যাবো আমার কাছে। আমার তো কোন অভাব নেই। শুধু একটারই অভাব। বাসা খালি। উনি তো বাইরে বাহিরেই থাকে কাজ কর্ম নিয়ে। আমার কথা বলার লোক নেই। তোর সাথে কথা বলে সময় কাটবে ”।
তাহেরার চোখের জলের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ল। কি উত্তর দেবে সে জানিনা। শুধু বিধাতার কাছে হাত তুলে বলেছিল,” তুমি আছো। তুমি আমার দিকে মুখ তুলে চেয়েছ”।
রাখাল যেতে চায়নি। বলেছিল,” আমরা কষ্ট করে দাড়াতে পারবো না? মা?”
না, পারবো না। রাতে বেরাতে উপদ্রব সহ্য করেতে পারবো না। তুমি ছোট, তুমি বুঝবেনা।
সাত দিনের মধ্যে তল্পিতল্পা গুছিয়ে রওয়ানা হয়েছিল। ফেলে রেখে গেলো পুরনো দিনের স্মৃতি।
মনে পড়লো তাহেরার, কাজ শেষে জসীম ফিরে আসতো এই ছোট্ট ঘরে। তাহেরা আগিয়ে দিতো গামছা টা। বলত,” হাত মুখ ধুয়ে এসো, আমি ভাত বাড়ছি”।
জসীম খোজ নিতো রাখালের। “ কোথায় সে? সন্ধ্যা হয়ে এলো”।
তাহেরা ছেলেকে সামাল দিতে যেয়ে বলত,” মাঠে গেছে বন্ধুদের সাথে খেলতে। এখনি আসবে”।
“ ভালো করে লেখা পড়া করতে বলো, তা না হলে আমার মতো পরের দোকানে কাজ করে সারা জীবন কাটাতে হবে”।
যেতে যেতে আজ সব কথা মনে পড়ছে তাহেরার। বার বার ফিরে ফিরে তাকাল বাড়ীটার দিকে। দিয়ে গেলো জসীমের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে। বলেছিল,” ভাইজান, আপনি রইলেন, দেখা শোনা করে রেখেন। বাকি আল্লাহ ভরসা”।
পৌছাতে পৌছাতে রাত হয়ে গিয়েছিল। কুতুব আলী, শেফালীর স্বামী তখনো ফেরেনি। খাওয়া শেষে শেফালী ওদের ঘর দেখিয়ে দিয়ে বলেছিল,” শুয়ে পড়। কাল সকালে রাখাল কে নিয়ে আমি স্কুলে যাবো। ওকে ভর্তি করে দেবো”।
রাখাল শুনছিল। একটা কথাও বলল না। স্কুলে যাওয়ার মন তার আর নেই। শুধু থেকে থেকে বাবার কথা মনে পড়ে।
মার মতো এতো সহজ ভাবে সে এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারে নি।
আফসারউদ্দিন, কাঞ্চনপুর উপজেলার দারোগা। ক্রাইম সিনের কাছে এসে বললেন সবায় কে সরে যেতে এখান থেকে। রহমত তার এসিসটেন্ট। দুজনে ঘরে ঢুকল। আসবাব পত্র সব ঠিক মতো সাজানো। কেউ জোর করে ঢুকেছে মনে হোল না। হত্যা করার আগে মনে হোল রাখালকে বাঁধা হয়েছিল পিলারের সাথে। মুখে ছেড়া কাপড় ঢুকানো। যাতে চিৎকার করতে না পারে। পাঁচটা ছুরির কোনটাতে হাতের ছাপ নাই। হত্যাকারী অথবা হত্যাকারীদের হাতে গ্লোভস ছিল মনে হয়। খুব প্লান মাফিক এই হত্যা করা হয়েছে। আফসারউদ্দিন লাশ পোস্ট মরটম করতে পাঠিয়ে দিতে বলে অফিসের দিকে রওয়ানা হোল। যাবার আগে রহমতকে বলে গেলো কাজ শেষে তার সাথে দেখা করতে।
রহমতের কাজ শেষ করে আসতে আসতে দুই ঘণ্টা লেগে গেলো। ঘরে ঢুকতেই আফসারউদ্দিন বলল,” রাখালের যারা ডান হাত তাদের কে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো । এরেস্ট করে নয়। বলবে, ইনটারওগেশনের জন্য ডাকছে। সেই সাথে রাখালের বিপরীতে, যারা ওর শত্রু তাদের নাম গুলো আমার দরকার”।
রহমত চলে গেলো।
নিয়ে এলো ফরিদ, পিকলু, শাহাদত কে। অনেক কুকর্মের সাথে জড়িত।
ফরিদকে নিয়ে আফসারউদ্দিন বসলেন ইনটারওগেশন রুমে।
“ কত দিনের পরিচয় রাখালের সাথে?” প্রশ্ন আফসারউদ্দিনের
“ অনেক দিনের স্যার।“
“বলে যাও”।
“ জুভীনাইল ডিটেসশন সেন্টারে ওর সাথে আমার দেখা। আমাদের দুজনের বয়স ছিল বারোর কাছাকাছি। ওকে গ্রেফতার করা হয়েছিল খুনের দায়ে”। বলে একটু থামল।
তারপর? কাকে খুন করেছিল ?
“ কুতুব আলিকে, যার বাসাতে ওরা থাকত। ও বলেছিল, একদিন স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল সময়ের আগে। বাসায় আসতেই শূনতে পেলো মার চিৎকার। দৌড়ে যেয়ে মার ঘরের দরজা খুলতেই দেখতে পেলো কুতুব আলী ওর মা কে জাপটে ধরেছে বিছানাতে। ওর মা চিৎকার করছে আর পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা করছে। হিতাহিত জ্ঞান ছিলনা রাখালের। পাঁশে পড়েছিল এক বড় কাঠের টুকরা। সেটা উঠিয়ে জোড়ে মারলও কুতুব আলীর মাথায়। ছিটকে পড়লো কুতুব আলী। উঠবার চেষ্টা করতেই আর একটা আঘাত আনলো ওর মুখে। নীস্তেজ হয়ে গেলো কুতুব আলীর দেহটা। রক্ত ছিটকে পড়েছিল রাখালের গায়ে। ওর মা থরথর করে কাঁপছিল। জড়িয়ে ধরেছিল রাখালকে। বলেছিল,” তুই চলে যা। আমি বলব আমি মেরেছি”। রাখাল যায়নি।
শেফালি বাহিরের থেকে ফিরে আসতেই তাহেরা বলেছিল সব। সে বিশ্বাস করেছিল কিনা জানেনা। পুলিশ ডেকে ছিল।
রাখালকে হাতকরা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল থানায়। মাকে সেই তার শেষ দেখা। রাখালের জেল হয়েছিল দশ বছরের। সেই খানে আমার সাথে তার দেখা”। বলে থামল।
“আমি তো শুনেছি তোমাদের মধ্যে মন মালিন্য ছিল বিভিন্ন কুকর্মের নেতৃত্ব নিয়ে?” জিজ্ঞাসা করলো আফসারউদ্দিন।
ফরিদ সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “আমি খুন করিনি স্যার। ঐ সময়ে আমি কাঞ্চনপূরে ছিলাম না স্যার। আপনি খোজ নিয়ে দেখতে পারেন”।
ঠিক আছে বলে আফসারউদ্দিন ওকে যেতে বলল। আরও বলল এই এলাকা থেকে বাহিরে কোথাও যেন না যায়।
এরপর পিকলু কে ডেকে পাঠালও। বডি বিলডার। উচ্চতা ছয় ফুটের কাছাকাছি।
বসতে বলে বলল, তুমি তো রাখালের বডিগার্ড ছিলে? তাইনা?
কোন উত্তর দিলো না পিকলু। আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো কি ভাবে তার সাথে পরিচয়।
“ দেখা হয়েছিল মদন মোহন সরকারের চা র দোকানে। রাখাল আর ফরিদ এসেছিল টাকা নিতে। প্রতিমাসে বরাদ্দ ছিল কোন দোকান কত টাকা দেবে। ফরিদের কাছে শুনেছি জেল থেকে বেরিয়ে সে খুজেছিল মা কে। ওর মা ফিরে গিয়েছিল দেশের বাড়িতে। পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। সেই শুরু। খোজ নিয়ে ফরিদের সন্ধান পেয়েছিল। দুজনে মিলে গরে তুলেছিল সংগঠন। ফরিদ এসে আমাকে বলেছিল দেখা করতে রাখালের সাথে। সেই থেকে পরিচয়”।
“পুলিশের রিপোর্ট অনুসারে পাঁচটা মেয়ের সে সর্বনাশ করেছিল ঐ বাসাতে এবং তুমিই তাদেরকে ধরে নিয়ে এসেছিলে। তাই না”?
“ আপনি তো জানেন, আদালতে তা প্রমান হয়নি”।
“ জানি, এবং এটাও জানি টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল”।
পিকলু এই কথার কোন উত্তর দিলো না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো।“ খুনের দিন রাতে কোথায় ছিলে? তুমি তো সব সময় ওর সাথে থাকো। পাহারা দাও। ঐ দিন রাতে ছিলেনা কেন। তার মানে তুমি জানতে কিছু একটা ঘটতে চলেছে?”
“ না স্যার, আমার মা অসুস্থ থাকায় আমি ছুটি চেয়ে ছিলাম। রাখাল বলেছিল চলে যেতে। আজ আর সে কোথাও যাবেনা। আপনি খোজ নিতে পারেন আমার গ্রামের বাড়িতে।“
“ যদি সে বলে থাকে আর কোথাও আজ সে যাবেনা, তাহলে কার পরামর্শে এত রাতে বাংলো বাড়িতে গিয়েছিল?”
‘জানিনা স্যার”।
“ হু, ঠিক আছে তুমি যাও।“ বলে আফসারউদ্দিন রহমত কে ডাক দিলো।
রহমত আসতেই আফসারউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলো।“ আচ্ছা তোমার কি মনে আছে বছর দুয়েক আগে ঐ বাংলো তে বিভিন্ন সময়ে পাঁচটা মেয়ের সর্বনাশ করা হয়েছিল। যেটা কিনা আদালতে প্রমান হয়নি।“?
“ হাঁ স্যার, মনে আছে।“
“ কোথায় সেই পাঁচ জন? গ্রামে আছে না গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। খোজ নিয়ে তাদেরকে এখানে আনার ব্যবস্থা করো সাথে যেন গার্ডিয়ান থাকে।
“ আমি এখনি যাচ্ছি স্যার” বলে রহমত বেরিয়ে গেলো
আফসারউদ্দীন তাকিয়ে ছিল সামনের দেয়ালের দিকে। বিভিন্ন ক্রিমিনাল দের ছবি আটকানো। মাথায় শুধু একটা ভাবনাই ঘুরে ফিরে আসছে।
পাঁচটা মেয়ে। পাঁচটা ছুরি।
রহস্য টা ঘনীভূত হচ্ছে। তাহলে কি?
ক্রমশ
(শেষ পর্ব আগামী সোমবার ১২ ই ডিসেম্বর)