ডায়রির পাতা থেকে ৩

১৯ শে  মার্চ

হঠাৎ সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।  মনে হোল গায়ে জ্বর এসেছে।  থারমমিটার টা খুজলাম। পেলাম না। রাত তখন তিনটা। মুখে তেঁতো তেঁতো পানি উঠছে। ড্রয়ার টা খুলে দুটো টাইলিনল বের করলাম। বুকের ব্যথাটা আসছে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে কার্ডিওলজীস্টের কাছে গিয়ে ছিলাম। বলে ছিল সব ঠিক আছে। তবে আমি হাই রীস্ক পেসেন্ট। কলেস্টেরলের ঔষধ টা দুই গুন বাড়ীয়ে দিলো, সেই সাথে প্রেসারের ঔষধ টাও।  বলে ছিল ব্যথা বেশি বাড়লে তবে এসো নচেৎ ছয় মাস পরে অ্যাপএনমেন্ট করো।

এ ব্যথা কিসের ব্যথা বলা মুশকিল। তাই যখন তখন কাউকে ব্যতিব্যস্ত করা আমার কুস্টীতে নাই। তাছাড়া লেখা পড়া করে যতটুকু জেনেছি তাতে আসল ব্যথা আরম্ভ হলে খুব একটা হাতে সময় থাকবে না। তাঁই দরজার উপরের তালাটা আর লাগাই না। ওটার কোন চাবি নেই। শুধু ভিতর থেকেই বন্ধ হয়।

অসুস্থ হলে মানুষ মনের দিক থেকেও দুর্বল হয়ে পরে। আমিও যে হয়নি তা নয়। সেটাকে ঝেড়ে ফেলার জন্য ল্যাপটপ টা নিয়ে বসলাম। বিভিন্ন ইনিস্টিটিউশণের একাউন্ট গুলো আর একবার খতিয়ে দেখবার জন্য। যাতে ছেলে মেয়েদের কোন কিছু খুজে পেতে অসুবিধা না হয়।

মাথা টা ভীষণ ধরেছে। রান্না ঘরের আলোটা জ্বালাতেই  চোখটা ধাধীয়ে উঠলো। মনে হোল কে যেন জোরে আঘাত করলো চোখে। বন্ধ করে দিলাম আলোটা। চোখের কণ বেয়ে পানির ধারা নেমে এলো। মুছতে যেয়ে হাতের নাপকীন টা পড়ে গেলো মেঝেতে। উঠাতে যেয়ে বাড়ি লাগলো টেবিলের কোনায়। টলে পড়ে গেলাম। হাত দিয়ে ঠেকাতে যেয়ে কব্জীতে ব্যাথা লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে জানালায় এসে আঘাত করলো দমকা হাওয়া। খুলে গেলো কপাট। টেবিলের কাগজ গুলো ছড়িয়ে পড়লো মেঝে তে।

উঠতে চাইলাম। পারলাম না। হাতটা ব্যাথায় টনটন করছে। গড়িয়ে এসে সোফাটাকে আঁকড়িয়ে ধরলাম। হাটু গেরে বসে দুই কনুই দিয়ে সোফার উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আস্তে আস্তে জানালার কাছে যেয়ে জানালাটা বন্ধ করতে যেয়ে মনে হোল কে যেন জানালাটা কে টেনে ধরে রেখেছে। যত জোরে আমি টানছি ঠিক তত জোরে  কে যেন টানছে আমার বিপরীত দিকে।

ঠিক সেই সময় এক ঝরো হাওয়া আঘাত করল মুখে, শরীরে। জানালার থাকে হাত সড়ে গেলো আমার। চর্কির মত ঘুরে আমি এসে পড়লাম সোফাতে। কে যেন আমাকে টেনে এনে বসিয়ে দিলো।

বাতাস থেমে গেলো। জানালার কপাট টা আস্তে আস্তে ফিরে এলো তার জায়গায়।

তাকিয়ে দেখলাম মেঝেতে ছড়ান ছিটান কাগজ গুলো জড় হয়ে আছে একখানে।

 হাতের ব্যাথা টা ক্রমশ বাড়ছে। একটা Motrin খাবো বলে কেবিনেট টা খুললাম। কিন্তু Child proof বোতলের ক্যাপটা  খুলতে পারলাম না। ওটা বেসিনের পাশে রেখে আবারও থারমমিটার টা খুজতে এলাম বেডরুমে। শরীরের তাপের মাত্রাটা বেড়েছে মনে হচ্ছে। ড্রয়ার টা খুলতেই দেখলাম সামনেই পড়ে আছে ওটা। অথচ প্রথম বার আমি দেখিনি ওটাকে। হয়ত চোখের ভূল।

তাপমাত্রা ১০২ । টাইলিনল টা খেয়েছি প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেলো। এখনও জ্বর টা নামেনি। হাতের ব্যথা টা মনে করিয়ে দিলো কিছু একটা করা দরকার। শোয়া হলনা। কোল্ড কমপ্রেস দিতে হবে। Motrin টা খাওয়ার  দরকার ছিল। ওটা ব্যথা আর ইনফ্লেমেসন  দুটোরই কাজ দিতো। কিন্তু খুলতে পারলাম না বলে খাওয়া হলনা।

ফিরে এলাম রান্না ঘরে। ফ্রিজ টা খুলে কতগুলো বরফের টুকরা একটা কাপড়ে জড়িয়ে নিলাম। বেসিনের কাছে রাখা Motrin এর বোতল উঠিয়ে রাখবো বলে হাত দিতেই ক্যাপটা খুলে পড়ে গেলো। অথচ ওটাকে অনেক চেস্টা করেছি খুলতে, পারিনি।

চারিদিকে তাকালাম। বাহিরে তখনও অন্ধকার। জানালার কপাট টা খোলা।

  ঠক ঠক শব্দ। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে আমার চোখের উপর খেলা করছিল। তাই চোখটা মেলতে একটু সময় লাগল। আবারও সেই শব্দ।

আমি কোথায়?  বুঝে উঠতে একটু সময় লাগতেই দরজা টা খুলে গেলো।

 সতী দাড়িয়ে।

 ওর কাছে আমার ঘরের এক গোছা চাবি দেওয়া আছে। আপদে বিপদে কাজে লাগতে পারে তাঁই।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কি হয়েছে? সারা রাত সোফার উপর ঘুমিয়ে ছিলে?

-তাই তো মনে হচ্ছে। রাতে অনেক জ্বর এসে ছিল। পড়ে যেয়ে হাতে ভীষণ চোট পেয়েছিলাম। ঠাণ্ডা সেক দিয়েছি  অনেকক্ষণ ধরে। জানালা টা বন্ধ করে দাওতো। কাল সারা রাত খোলা ছিল। এই বলে সতীর দিকে  তাকালাম।

সে আমার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকলো। কাছে এসে হাত টা কপালে রাখল।

-এখন জ্বর নেই। এই বলে জানালা টা বন্ধ করে দিল।

হাতটা দেখে বলল, একটু ফুলেছে।

এবার ওঠো। গোসল করে নাও। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি, Motrin খেতে হবে।  শান্তর বাসায় আজ সবাই কে ডেকেছে। মনে নেই?

মনে পড়ল। শুধু তাঁই নয়, খাবার তো আমাকেই নিয়ে যেতে হবে। বলেছে ১২ টার মধ্যে আসতে।

দুদিন আগে কল করে বলে ছিল,” আব্বু, তুমি কি খাবার অর্ডার দিতে পারবে”?

 জানে, না আমি করবো না। এ যে কত বড় অধিকার বাবা মা র উপর তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।

 লোক জন এসে পৌছায় নি। বারটায় বললে  এরা আসবে একটায়। এটাই রীতিতে দাঁড়িয়েছে। সময় জ্ঞান কয়জনের আছে বলা মুশকিল। সতী যথারীতি লেগে গেলো কাজে। আমি সোফায় বসে বাস্কেট বল খেলা দেখতে থাকলাম। এর মাঝে বৌমা এসে জিজ্ঞাসা করে গেছে কফি খাবো কিনা।

বললাম, মন্দ হয় না। আমি বানিয়ে নেবো।

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে অনেকে এসে গেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো সবাই। শান্তর ঘর টা বড়। ভেঙ্গে নতুন করে গড়া।

আমি দেখলাম এখানে তিন জেনারেসনের সবাই হেটে খেলে বেড়াচ্ছে।

আমাদের বয়সি, যাদের পা আর মাজায় ব্যথা অথবা চোখে ছানি পড়েছে তারা সোফায় অথবা চেয়ারে বসে গল্প করছে ওপাড়ের জগত নিয়ে। শান্তর বন্ধুরা তর্ক করছে ফুটবল, বেজবল নিয়ে। ছোটরা ছুটাছুটি করছে।

অরুন কেবল এসেছে দেশ থেকে। অনেকে ওকে ঘিরে। শুনতে চাচ্ছে দেশের কথা, কত শাড়ী এনেছে, কোথায় কোথায় বেড়িয়ে এলো, শরীর খারাপ হয়েছিল কি না সে সবের কথা। দূরে দাড়িয়ে জীনাত ভাবি। শান্তর শাশুড়ির সাথে গল্পে মশগুল, মনে হোল চেহারায় একটু মলিনতা।

তিথী, বৌমার কাজিন, হেলে দুলে হাঁটছে। ওর শরীরে ভেতরে একটা দুস্টু ছেলে মাঝে মাঝে ওকে কিক করছে। বলছে, “ অনেক দিন হয়েছে, এবার আমি পৃথিবীর আলো দেখতে চাই”।

আর এক কাজিনের একমাসের ছেলেটা বুকের মাঝে লেপ্টীয়ে শুয়ে।

মনে পড়লো সেই কথাগুলো “ এসেছে নুতন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান” । ওদের জন্য আমাদের বিদায় নেবার সময় এসেছে। কিন্তু কেউ কি যেতে চায়। থাক মরনের কথা।

বললাম, দেবে আমার কোলে।

কোলে এসে ছোট্ট করে হাই তুলল। বুকের উষ্ণতা ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। আমি ওর টুসটুসে আঙুল নিয়ে খেলা করছিলাম । ওর ছোট্ট জীবন টা টুনটুনি পাখির মত নিষ্কলঙ্ক । আমি ওর লালচে মাখনের মত গাল টা টিপে দিলাম। ওর ঠোট টা হেসে উঠল। মনে হোল ও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। আমার আঙুলটা চেপে ধরল। ঠোটের কণে সেই হাসি টা লেগে আছে।

অনেক অনেক বছর আগে সেই ছোট্ট হাতটা নিয়ে খেলা করতাম, কান পেতে শুনতাম আমি ওর নিশ্বাসের শব্দ। দুধের বোতল মুখে দিলে সে ধরত আমার আঙ্গুলটা, পিট পিট করে তাকাত আমার দিকে, ফীক করে হেসে দিতো, দুধ গড়িয়ে পড়তো গালের চার পাশে। আমার দিকে হেসে তাকিয়ে থাকতো। মনে হতো স্বর্গের থেকে এক ঝলক আলো ঝরে পড়লো আমার ঘরে। কপালে চুমু দিয়ে উঠিয়ে নিতাম আমার বুকে। পাশ থেকে সে বলতো,” ওকি দুধ টা শেষ করেছে”।

বলতাম, হাঁ করেছে।

তাহলে শুইয়ে দাও।

না ও শোবে না, ও বাদুরের মত আটকিয়ে আছে আমার বুকে। ওকে কি নামাতে পারি?

ওকে তুমি স্পয়েল করবে, বলে পাশ ফিরে শুতো।

তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। সেই ছোট ছোট হাত গুলো আজ কত বড়। কত বড় দায়িত্বশিল ছেলে সে আজ। বাড়ীর মালিক।

তদারকি করছে। দেখছে, তার করণীয় সব কিছুই করছে, যাতে সবাই আনন্দ পেতে পারে এই সীমিত সময়ের মধ্যে।

স্পয়েল হয়নি, বরং ভালোবেসে সবাই কে আকড়ে ধরেছে। কাছে টেনে নিয়েছে।

তুমি ওকে মানুষ করে দিয়ে গিয়েছিলে। তাতো সে ভোলেনি।

শুধু তুমিই দেখলে না ওর সম্পূর্ণ গড়ে উঠা নতুন ওর বাড়ীটা।

Continue Reading

ডায়রির পাতা থেকে ২

১৮ ই মার্চ ২০১৭

 গত মঙ্গলবার ঘূর্ণিঝড় স্টেলা ছড়িয়ে দেয়ে গেছে বরফের স্তূপ। মনে হচ্ছে ছোট ছোট সাদা বরফের পাহাড় চারিদিকে ছড়ান। আমি দেখছিলাম আমার জানালা দিয়ে। শান্ত আর বউমা আসবে লাঞ্চ করতে আমার সাথে। মেয়ে কে কল করেছিলাম সেও এসে যোগদান করবে কি না। বলল, না, ও আর রেজ যাবে বন্ধুদের সাথে। ফোনটা রেখে কফির কাপ টা হাতে নিতেই আবারও বেজে উঠল ওটা।

নাম্বার টা দেখে মনে হোল দেশ থেকে কেউ কল করেছে।

শমিত?

হাঁ

চিনতে পাড়ছ কি?

গলার স্বরে চিনতে পারার কথা নয়।

বললাম, না চিনতে পারছিনা। আপনি কে বলছেন?

কি আপনি আপনি করছ। তোমাকে তো আমি তুমি বলে বলছি।

গলক ধাঁধায় না রেখে যদি নাম টা বলেন।

আবারও সেই,বলেন, আমি ইয়াসমিন।

ইয়াসমিন? মনে করার চেষ্টা করলাম।

ইয়াসমিন, মনে পড়ছে? বলল অপর প্রান্ত থেকে। আরও বলল, আমি আগামী বুধবার আসবো নিউইয়র্কে। অনেক দিন পর তোমার সাথে দেখা হবে, কি যে আনন্দ লাগছে।

মনে পড়ছে নাম টা তবে আমার আনন্দ লাগছে না। লাগছে না তার কারন হোল,

ফিরে গেলাম অনেক পিছনে। প্রতাপ আর আমি একি পাড়ার ছেলে। একি সাথে পড়ি। বন্ধুত্ব আমাদের অনেক দিনের। স্কুল শেষে আমি ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে, ও গেলো নটরডেমে। মাঝে মাঝে প্রতাপ আসতো আমার হোস্টেলে। একদিন দুপুরে এসে হাজির। আমি দিবা নিদ্রা নেওয়ার চেস্টা করছিলাম। হোল না। বলল,” চল, কাপড় পরে নে, এক জাগায় যাবো”।

কোথায়?

 গেলেই দেখতে পারবি।

বেড়িয়ে এলাম রাস্তায়। হাটতে হাটতে নিউ মার্কেট পাড় হতেই আবারও জিজ্ঞাসা করলাম, “ কোথায় যাচ্ছিস”?

“ ইডেন কলেজের হস্টেলে”।

ইডেন কলেজের হোস্টেলে? সেখানে কি”? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

সেই একি কথা, গেলেই দেখতে পারবি।

হোস্টেলের কাছে এসে দাড়াতেই একটা মেয়ে এগিয়ে এলো প্রতাপের দিকে। দুজনের মুখেই হাসি। বুঝে নিতে আমার বেশি বেগ পেতে হলনা।  প্রতাপই আলাপ করিয়ে দিলো।

আমার বন্ধু শমিত, আর এ হচ্ছে, ইয়াসমিন।

সাদা,হলুদ, শালওয়ার কামিজের সাথে লাল ওড়না। মোটা বলব না, আবার চিকন ও নয়, দুয়ের মাঝা মাঝি। গায়ের রঙ শ্যামলা। হাসল সে। সাদা দাঁত গুলো সমান্তরাল ভাবে বসানো নয়।  এতো আমার চোখে দেখা।

তিন জন হাটতে থাকলাম। ওরা দুজন কাছাকাছি, আমি পাশে একটু দূরে। ইচ্ছে করেই। ওদের মিটিমিটি হেসে কথা বলার মাঝে আমার কোন বক্তব্য রাখতে চাইনা।

এসে বসলাম নিউ মার্কেটের ভিতরে এক আইস ক্রীমের দোকানে। আমি স্বল্পভাষী নই। কিন্তু আজ কেন জানি কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম ইয়াসমিন মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে আমার দিকে, হেসে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। উত্তরে আমিও হেসে তার জবাব দিচ্ছি।

ঘণ্টা খানেক পরে বেড়িয়ে এলাম। ইয়াসমিন চলে গেলো। যাওয়ার আগে তাকাল আমার দিকে। চোখে চোখ রেখে হাসল আবার।

তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। প্রতাপের সাথেও দেখা হয়নি বেশ কিছুদিন হোল। পরীক্ষা সামনে। এক বিকেলে নিউ মার্কেটের গেটের কাছে দাড়িয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছি।

হঠাৎ ই নাম ধরে ডাক শুনে ফিরে তাকালাম।

ইয়াসমিন।

এগিয়ে এলো।

জিজ্ঞাসা করল,”কেমন আছো? অনেক বার তোমার কথা মনে হয়েছে। তোমার হোস্টেলে একবার যাবো ভেবেছিলাম। পরে তা আর হয়ে উঠেনি”।

আমি সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললাম,” কেনা কাঁটা করতে এসেছ বুঝি”?

হাঁ

বন্ধুরা একটু পাশে যেয়ে দাড়িয়ে আছে।

ইয়াসমিন আরও একটু কাছে এসে বলল,” তুমি কি ব্যস্ত”?

কেন বলত?

আমার সাথে একটু জিকাতলায় যাবে মামার বাসায়। একা যেতে চাইছি না, তাড়াতাড়ি চলে আসব।

সেদিন না করতে চাইলেও না করতে পারলাম না। না করলেই ভালো হতো।

বললাম, চলো।

রিক্সায় উঠে বসলাম। এতো কাছে কোন মেয়ের পাশে আমি বসিনি আগে। ওর কাধের সাথে আমার কাধ, ওর কনুই এঁর  সাথে আমার কনুই গসা লাগছে। ওর ওড়না বাতাসে উড়ে আমার মুখে ঝাপটা মারলও। ও আরও সরে এলো আমার দিকে। ওর গায়ের উত্তাপ আমি পাচ্ছি। ওর নিশ্বাসের উষ্ণতা আমার গালে এসে আঘাত হানছে।  ওর ভরাট বুকের উঠানামা আমি দেখতে পাচ্ছি।

ও পাশে হাত দিয়ে রিক্সার হুড টা উঠিয়ে দিলো। ডান হাতটা উঠিয়ে আমার ঘাড়ের পিছনে  নিয়ে এলো। রিক্সার ঝাকুনেতে আমার কনুই বার বার ছুয়ে যাচ্ছে ওর  শরীরের বিভিন্ন নরম অংশ। ওর কোন ভাবান্তর নাই। আরও চেপে এলো আমার দিকে।

সত্যি বলতে কি আমি তো ঋষি,মহর্ষি নই। রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। হরমোনের স্রোত আমার শরীরেও বইছে। তার প্রতিক্রিয়া আমি বুঝতে পারছি আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গে।

রিক্সা এসে থামল বাড়ীর সামনে। প্যান্টের ভিতরে গোজা জামাটা উপরে উঠিয়ে দিলাম।

নেমে এলাম দুজনে। দরজা টোকা দিতেই খুলে দাঁড়াল কাজের মেয়েটা। ও দুটো টাকা দিয়ে দোকান থেকে কি যেন আনতে বলল।  আমি বাহিরে দাড়িয়ে।

 ইয়াসমিন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভিতরে এসো”।

ভিতরে এলাম, দেখলাম বাসায় কেও নেই। ও তাকাল আমার দিকে। আমি দেখতে পেলাম ওর কামার্ত দুই চোখ।  ওড়না টা সোফার  উপরে পড়ে আছে।   কামিজের  দুটা বোতাম খোলা।

সেদিন আমার বিবেক আমাকে বাঁধা দিয়ে ছিল। প্রতাপের কথা মনে পরে  ছিল।

আমি ঘৃনার সঙ্গে ওর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।  আমি দৌড়ে বাহিরে এসে রিক্সাওয়ালা কে বললাম, একটু জোরে চলো, তাড়া আছে।

সেই শেষ দেখা ।

না শেষ নয়, আরও একবার দেখা হয়েছিল, কার্জন হলের চত্বরে অনেক দিন পরে।

 হাঁটছি কঙ্কনা আর আমি। ডাক শুনে ফিরে তাকালাম।

ইয়াসমিন।

কাছে এসে হাত চেপে ধরল।

“ অনেক কাল পরে দেখা। কেমন আছো?”

কিছু বলার আগেই বলল,”পরিচয় করিয়ে দিলে নাতো”?

পরিচয় শেষে একটা কাগজে ঠিকানা লিখে  বলল, এই রইল, এসো একদিন।

দেখলাম ওর বাম হাতের অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে হীরের আংটি।

কঙ্কনা দুই পা এগিয়ে যেয়ে পিছন ফিরে তাকালও।

আমি দৌড়ে এলাম ওর কাছে।

সে চিরকুট টা হাতে নিলো, কুচিকুচি করে ছিরে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো,তারপর হাস্যজ্জল নয়নে তাকালও আমার দিকে।

 

কি ব্যাপার চুপ করে রইলে যে?

ও, হা, আমি তো কাল একমাসের জন্য ফ্রান্সে যাচ্ছি। তা না হলে—-, মিছে কথা বলতে যেয়ে গলাটা  একটু কেপে ছিল।

সে বলল, আমি সানফ্রানসিসকো তে মেয়ের কাছে যাচ্ছি। তিন ঘণ্টার জন্য Lay over ছিল  JFK Airportএ। ভেবে ছিলাম দেখা হবে।

জানিনা সে আমার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে ছিল কি না। কথা শেষ হোল।

ফোন টা রেখে আমি তাকিয়ে রইলাম জানালা দিয়ে সাদা বরফের উপর পড়া ঝলমলে রৌদের দিকে।

 

Continue Reading

ডাইরির পাতা থেকে ১

  ১২ই মার্চ ২০১৭

 আজ বাহিরে বের হওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলনা। গতকাল সন্ধায় গোটা চারেক বন্ধু তাদের সহধর্মীদের কে নিয়ে এসেছিল আমার এপার্টমেন্টে। আমিই বলেছিলাম। মেয়ে আমার খাবারের অর্ডার দিয়েছিল “নিউ চিলি এন্ড কারি”থেকে । আড্ডা সেরে  সবাই যখন উঠল তখন ঘড়ির কাঁটা একটা পেরিয়ে গেছে।

সতী ছিলনা। সে গেছে বস্টনে তার মেয়ের কাছে। থাকলে সেই সবকিছু  গুছিয়ে রাখতো।

ধোয়া মোছা শেষ করে যখন বেড রুমের দিকে এগোলাম তখন দুটো বাজে।

সকালে একটু দেরী করে উঠে কফির কাপ টা নিয়ে বসলাম। কয়েকটা ফোন কল সারতে হবে। দেশে বেশ কিছুদিন হোল কল করা হয়নি। আর ওই যে বললাম বাহিরে যাবার তাগাদা নেই আজ। অলস ভাবে কাটাব দিন টা।

তা আর হলনা। মানিব্যাগ থেকে ফোন কার্ড টা বের করতে যেয়ে সব কাগজ পত্র গুলো পরে গেলো মেঝে তে। ওগুলো উঠাতে যেয়ে চোখে পড়লো একটা ভিসা গিফট কার্ড। কবে পেয়ে ছিলাম কোথা থেকে পেয়ে ছিলাম মনে করতে পারিনা।

উঠিয়ে নিয়ে এপাশ ওপাশ করে দেখতেই চোখে পড়লো Expiration Date টা। আজই শেষ দিন।

অলস ভাবে আর কাটানো হোল না দিনটা।

রুজভেল্ট ফিল্ড মল খুব একটা দূরে নয় আমার এপার্টমেন্ট থেকে। বাহিরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। গাড়ীটা অটো স্টার্ট দিয়ে ফিরে এলাম ঘরে। এই অটো স্টার্টের চাবি সতীর দেওয়া গিফট। না করেছিলাম। শোনে নি।

 ঠাণ্ডার জন্যই মলে লোকজনের ভিড় কম। গায়ে গায়ে ঠেলা ঠেলি করে কেনাকাটা করার মানসিকতা আগেও ছিলনা, আজও  নেই। ভিসা কার্ড টা শেষ করাই আমার উদ্দেশ। কার্ডে অংকের পরিমাণ মন্দ ছিলনা।

কেনাকাটা শেষ করে ফুড কোর্টে এলাম। এক কাপ কফি খেলে মন্দ হয়না। সেই সাথে ফোন কল গুলো সারতে হবে। এই ভেবে নিরিবিলি একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসলাম। কাপে দুই চুমুক দিয়ে ফোনটা বেড় করে ডায়েল করতে যাব, এই সময়,

“ মিন্টু ভাই”

থতমত খেয়ে হাত কেঁপে ফোনটা পরে যাওয়ার আগেই আবার আঁকড়ে ধরে ঘাড় ফিরে তাকালাম যেদিক থেকে ডাকটা এলো।এই নামে আমাকে এদেশে ডাকেনি কেউ। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার Nick name টা। কে সে যে এখনও মনে রেখেছে আমার এই নাম টা। তাকালাম মহিলার দিকে। হাসির আভা ঠোঁটে।

“চিনতে পারছেন”?

অনেক পিছনে ফিরে গেলাম যেখানে আমাকে চিনত এই নামে। সেই স্মৃতির পাতায় এই মুখ ভেসে উঠলো না।

বললাম,” কিছু মনে করবেন না, চিনতে পারলাম না”

“ না চেনারই কথা। আমি দাড়িয়ে থাকতাম —“ কথা শেষ না করে বলল,” বসতে পারি”

“নিশচই।

“ কতকাল পরে দেখলাম আপনাকে,মিন্টু ভাই”। কথাটা ছুড়ে দিতেই আমার বুকে দুরুদুরু কম্পন শুরু হোল। এমন নয় যে মেয়েদের সাথে কথা বলতে আমি আড়ষ্টতা বোধ করি। শুধু আমার এক বান্ধবীর একটা কথা  মনে করিয়ে দেয়। সে বলেছিল,” শমিত, তুমি কিন্তু এখন Most Eligible bachelor. সাবধানে থেকো”। এই সাবধানতা বজায় রাখতে যেয়ে অনেক কে আমি সন্দেহের মাপ কাঠিতে ফেলেছি।  আজও যে তার বেতীক্রম তা নয়।

“ আমার এই নাম তো সবার জানার কথা নয়। আপনি জানলেন কি ভাবে”?

“ যা বলছিলাম, তার আগে বলি, আমার নাম সাধনা। চিনবেন না। কঙ্কনা আর আমি একি ক্লাসে একি হলে থাকতাম। তাই বলে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তা নয়”

“ ওর বন্ধুদের কে তো আমি চিনি। রেখা,মাগফের, ডলি, শান্তি”। বললাম

“ হাঁ, জানি, কঙ্কনার সাথে মাঝে মধ্যে কথা হতো। ওর কাছ থেকেই আপনার এই নামটা শুনেছিলাম। আজ যখন ওকে আপনার পাশে দেখছি না তখন আর কিছু জিজ্ঞাসা করবো না শুধু জানতে ইচ্ছে করে কতদিন হোল”।

“দু বছর, আপনি একা না সাথে কেউ আছে”।

“ একা”।একটু থেমে আরও বলল,”  আপনাদের দুজনের জোড়া টা আমার খুব ভালো লাগত। হলের গেটের পাশে দাড়িয়ে আপনাদের কে দেখতাম। মনে মনে আপনাদের মত কাউকে নিয়ে এরকম জোড়া বেঁধে হাটতে চাইতাম।  কিন্তু আমার ভাগ্যে তা আর হোল না”।

এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। সতী কল করেছে। বললাম,” কিছু মনে করেন না, এই কল টা আমাকে ধরতে হবে”।

সতীর জিজ্ঞাসা আমি কোথায়, কি করছি।

আমি কোথায় কার সাথে সেটা কিছুটা বিশ্লেষণ করতেই, ও বলল,”শমিত দা, কি বলছ? কার সাথে, মাথা মুণ্ডু কিছু বুজতে পারছিনা”

বুঝলাম অর্ধেক কথা গলার ভিতরে রেখে বলাতে ওর বোধগম্য হচ্ছে না। এদিকে সাধনা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

বললাম, টেক্সট করে জানাচ্ছি।

পাল্টা টেক্সটে সতী জানালো, কোন ক্রমেই যেন আমি সাধনা কে টেলিফোন নাম্বার টা না দেই। আর সবশেষে ওকে যেন কল করতে না ভুলি। বিস্তারিত না জানা পর্যন্ত সে মোটেই  স্বস্তি পাচ্ছে না।

সাধনার বয়স টা আন্দাজ করতে আমার বেগ পেতে হলনা। সেই তুলনায় একটু বুড়িয়ে গেছে মনে হোল। মাথার চুলে ঘনতা কম,তাতে কলপ দিলেও চোখের নিচ আর গলায় রীঙ্কেল গুলো ফুটে উঠেছে প্রকট ভাবে । পরনে সাদামাটা শালওয়ার কামিজ।  সত্যি কথা বলতে কি আমি তো ধোয়া তুলসীপাতা নই, কাজেই সাধনাকে দেখতে যেয়ে তার বুকের অসমতলতা  চোখে পড়ল।

সরি, কি যেন বলছিলেন?

আমার ভাগ্যের কথা। থাক, আপনাকে বিরক্ত করবো না। কঙ্কনার সাথে দেখা হলে ভালো হতো।

তাতো হবার নয়। আমার সাথে আপনার পরিচয় নেই তবু ও বলি, নিজের মনের ভার যদি লাঘব করতে চান তবে আমাকে বলতে পারেন।

নিজের কাজ আর করা হোল না। শুনলাম সাধনার কথা। আমাদের মত জোড়া বেঁধে চলতে চেয়ে ছিল। কিন্তু হলনা।

পল্লবের সাথে দেখা হয়েছিল ডিপার্টমেন্টে।  সে এসেছিল ওর বোনের সাথে দেখা করতে। ঠিক সেই সময় সাধনা বেড়িয়ে আসছিল ক্লাস শেষ করে। করিডোরে দেখা। সেই থেকে পল্লব সাধনার পিছ ছাড়েনি।

বললাম,” সে তো খুব ভালো কথা। সে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, এই তো আপনি চেয়েছিলেন”।

চেয়েছিলাম, পেয়েও ছিলাম কিছুদিনের জন্য।

কিছুদিন, মানে?

বিয়ের পরে জানলাম শুধু আমি নই ওর আরও কয়েক জন মেয়ে বন্ধু আছে যাদের সাথে সে হোটেলে রাত কাটায়।

কিছু বলতে যেয়ে ধমক খেয়েছি।

ডিভোর্স নেননি কেন? প্রশ্ন টা করে ভাবলাম আমি বলার কে।

নিয়েছি, নিয়েছি বললে ভুল হবে, সেই দিয়েছে, সে আরেক কাহিনী।

বলতে যখন শুরু করেছেন, বলেন।

সাধনা চোখ ফিরিয়ে নিলো আমার দিক থেকে।

আজিই প্রথম ডাইরি লিখতে শুরু করেছি। না প্রথম বলব না। ক্লাস নাইনে যখন পড়তাম তখন কিছুদিন লিখেছিলাম। বয়স ছিল ১৪। তাতে শুধু থাকতো সিনেমার কথা। খেলতে যেয়ে কাকে লেং মেরে ফেলে দিয়েছি। কোন মেয়েটা একবার তাকিয়ে হেসেছিল , তাই নিয়ে এক পাতা লিখে ফেলেছি। ভাগ্য ভালো বাবার হাতে পরেনি সেই লেখা। তা হলে খবর ছিল।

সে লেখা আর বেশি দুর এগোইনি।

আজ  আবার শুরু করলাম।

সাধনা তাকাল, বলল, কিছুদিন যেতেই বুঝতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি।  পল্লব এলে ওকে বললাম। খুশীর পরিবর্তে রাগ হোল তার। কোন রকমে কিছু করতে পারি কিনা জিজ্ঞাসা করল। বললাম, না, হবেনা।

আমার লেখা টা যদি এখানেই শেষ হতো তাহলেই বোধ হয় ভালো ছিল।

কিন্তু হলনা, সাধনা বলতে থাকল,

 গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে মার সাথে। ডাক্তার পরীক্ষা শেষে বলেছিল একটা মেমোগ্রাম করা দরকার। বা পাশের ব্রেস্টে একটা লাম্প আছে মনে হচ্ছে।

দুদিন পরে ডাক্তার ফোন করে বলেছিল, রেজাল্ট ভালো আসেনি। কেন্সেরাস। তবে ফার্স্ট স্টেজ। বলেছিল, নয় মাস অপেক্ষা করতে। তারপর masactomy করবে।

সাধনা রাজি।

পল্লব কে বলতেই সে বলেছিল,” কেন্সার, কেন্সের হলে মানুষ বাচেনা। শুধু গাদা গাদা টাকা নস্ট”। বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল। আর ফেরে নি। তার পরিবর্তে পাঠিয়ে দিয়েছিল ডিভোর্সের কাগজ পত্র।

নয় মাস পর এলো এক পরী এই পৃথিবী তে। সেই সাথে একটা ব্রেস্ট কেটে ফেলতে হোল। রেডিয়েশন দিতে হয়েছিল। ভবিষ্যতে ভালো থাকার জন্য।

বড় বোনের সহযোগিতায় আমেরিকায় এসেছে। তাও আজ দশ বছর হয়ে গেল। শুনেছে পল্লব আবার বিয়ে করে লস এঞ্জেলিসে  আছে ।

বললাম,যাক সব ঝামেলা চুকে গেছে।

না, চুকেনি। বিঁধি আমার সাথে আর একটু খেলায় মত্ত হয়েছে। দশ বছর পর আবার সেই বদ রোগ টা ফিরে এসেছে। এবার আর প্রথম স্টেজ নয়, ফীফথ স্টেজ। বলে তাকাল পাশে।

বুঝলাম চোখ মুছছে।

একটু চুপ করে থেকে বলল আজ উঠি মিন্টু ভাই। এই আমার ফোন নাম্বার, থাকি Commack এ। সময় পেলে কল দিয়েন।

 আমি তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।

ও আমার ফোন নাম্বার চায়নি, দিয়ে গেলো ওর নাম্বার।

Continue Reading

দূর দিগন্ত পাড়ে ৫

  আজ শেষ দিন এই Langkawi তে। আলী এলো আমাদের কে নিতে। গাড়ীতে উঠতেই বলল,” তোমরা তো মুসলমান। আজ শুক্রবার। জুম্মা নামাজে যাবে”?

আমি কিছু বলার আগেই সতী বলে উঠল,” নিশচই। মসজিদ কতদুর”?

“ Eagle Square থেকে কাছে। তোমরা সব  দেখা শেষ করে আমাকে কল করলে আমি এসে তোমাদেরকে নিয়ে যাবো”।

Eagle Square। Kuah জেটির পাশে । এই Squareর প্রধান আকর্ষণ হোল বিশাল আকারের মানুষের তৈরী লালচে রঙের ঈগল। মনে হচ্ছে এখনি সে উড়ে যাবে। একে ঘিরে চারিদিকে ফুলের বাগান, ছোট ছোট পুকুর। সুভেনীয়ার আর খাবারের দোকান।

সমুদ্রের থেকে বেড়িয়ে আসা Bayর পেছনে সবুজ পাহাড়। এই দৃশ্য চোখ মন দুই কেড়ে নেয়।

এখানে আসতে হলে সকালে অথবা সন্ধায় আসা শ্রেয়।  কারন রৌদের তাপের সাথে সাথে Concrete এর মেঝের তাপও বাড়তে থাকে। দাঁড়ান অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। আমরা যখন এসেছিলাম সূর্যমামা তখন মধ্য গগনে। কাজেই কিছুক্ষণ বসেই উঠে পড়লাম। সামনে সবুজ গাছে ঘেরা বাগানের ভিতর দিয়ে হেটে এলাম ফুড কোর্টে।

জুম্মা একটায়। এখনও আধা ঘণ্টা বাকি। আলীকে কল করে আসতে বলে আমরা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ আর আইসক্রিম নিয়ে বসলাম ম্যাকডনাল্ডে। পনের মিনিটের ভিতর আলী এসে হাজির। আমাদেরও খাওয়া শেষ।

দশ মিনিটের পথ। এসে পৌছালাম” মসজিদ আল হানা” তে।

সতীকে একজন পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো যেখানে মহিলাদের বসার জায়গা ।

সতী কে বললাম, নামাজ শেষে ঠিক এই পিলারের কাছে এসে দাঁড়াবে আমি না আসা পর্যন্ত।

ও দাড়িয়ে ছিল আমার অপেক্ষায়। আমার দেরী হয়ে গেলো কারন আমার জুতো জোড়া খুজে পেলাম না। তার পরিবর্তে দেখলাম পড়ে আছে এক জোড়া জুতা আমার জুতার মতো দেখতে। ওটা পড়ে এসে সতী কে দেখালাম।

সে বলল,”ভুল করে কেউ নিয়ে গেছে। ভুল বুঝতে পারলে হয়তো এসে রেখে যাবে। চলো, আলীকে কল দাও”।

আলী কে কল দিলাম। সে বলল তার দশ মিনিট লাগবে আসতে। অগত্যা একটা গাছের ছায়ার নিচে এসে দাঁড়ালাম দুজনে। আস্তে আস্তে ভিড় কমে এলো। সতী বলল,” আচ্ছা, এখন তো ভিড় নেই, দেখে আসত জুতো টা কেউ রেখে গেছে কিনা”।

বললাম,” তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে”।

বলল,” এখানে দাড়িয়েই তো আছো, একটু যেতে অসুবিধা কি”?

অগত্যা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলাম। দেখলাম আমি যেখানে রেখেছিলাম ঠিক সেই খানে সাজানো রয়েছে আমার জুতাটা।

অনেক দেখলাম। এবার Langkawi থেকে বিদায় নেবার পালা।

 গাড়ীতে এসে সতীকে বললাম অনেক তো দেখলে মন ভরল কি?

” উপরওয়ালা আমাকে তোমার মতো বন্ধু মিলিয়ে দিয়েছে, তোমার সাথে এলাম, চোখ ভোরে তার সাজানো সৌন্দর্য দেখলাম, এমনকি জুম্মার নামাজ টাও মসজিদে পড়তে পারলাম। আমার আর কি চাওয়ার থাকতে পারে, বলতো”?

ওর দিকে চেয়ে মনে হোল আরও একজন ছিল, সেও অতি অল্পতেই খুশি হতো।

বলতো,” আমার আর কি পাওয়ার থাকতে পারে বলও, তোমার মতো স্বামী পেয়েছি, প্রান জুড়ান দুটো ছেলেমেয়ে, আর আমার কি চাই বলও”?

তাইতো, তার আর কিছুই চাওয়ার ছিলনা।

আমিও পেয়ে ছিলাম, পেয়ে হারালাম।

কি ভাবছ শমিত দা।

না, কিছুনা, চলো।

সতী আলীর দিকে তাকিয়ে বলল,” আলী, ফিরে চলো হলীডে ভিলাতে”।

আলীর গাড়ী বায়ে বাক নিলো।

বিদায় Langkawi বিদায়। সকাল সাড়ে এগারো টায় আমাদের ফ্লাইট। যাবো কুয়ালা লাম্পুর। নটায় এসে পৌছালাম এয়ারপোর্টে । কেন জানি আজ মেঘাচ্ছন্ন সকাল।

 যেতে নাহি দিতে চায়।

গুরু গুরু ডাকছে আকাশ।

বলছে তুই ফিরে আয়।

 দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল উপর থাকে। যে বন্ধনে বেঁধে ছিল আমাদের কে আজ তা খুলে দিতে হবে।

“ যেতে নাহি দিবো হায়, তবু  যেতে দিতে হয়”।

সামনে এগিয়ে যেতে হবে এই তো নিয়ম। পিছনে যা রেখে গেলাম তা রইল আমার স্মৃতির পাতায়।

আমি ,সতী, Langkawi।

কোন এক অলস মুহূর্তে বসে রইব আমার বেল্কনীতে। আকাশে জ্বলবে সন্ধ্যা তাঁরা। হাতের কাছে সদ্য পান করা কফির পাত্র। সামনে খোলা এ্যালবামের পাতায় পাতায় সতীর হাসি, আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউ।

বাবা বলে জড়িয়ে ধরে মেয়েটা বলবে,” কি দেখছ বাবা”?

আরও পরে, সেই আমি, চিনতে পারব না এ্যালবামের ছবি গুলো, আমার স্মৃতির পাতা থেকে বিলীন যাবে ওরা। মনে হবে ওরা দূর দেশের কেউ, ওদের কে আমি চিনি না।  সেই হাসি, যাকে আমি শুইয়ে দিয়েছি বিশাল অন্ধকারের মাঝে, সেই হাসি, যাকে আমি রেখে  এসেছি অস্ত যাওয়া সূর্যের লাল আভায় ভরা সমুদ্রের পাড়ে। আমি চেষ্টা করছি ফিরিয়ে আনতে আমার ওই স্মৃতি গুলো, আমি পারছি না, আমি পারছি না।

 বাবা বলে ডাক দিয়ে মেয়ে টা বলবে,” ঔষধ টা তো খাওনি বাবা”।

“শমিত দা, তোমাকে ডাকছে ওই কাউন্টারের লোকটা। মাঝে মাঝে তুমি কি ভাবো”?

“ তাই তো”।

কাউন্টারে এসে দাড়াতেই লোকটা চোখ বুলিয়ে নিলো আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। লোক বলব না, বলব ছেলে। নিতান্তই কম বয়সি। পাশে একটা মেয়ে। মনে হোল ছেলেটা নতুন, কাজে হাতখরী নিচ্ছে। মেয়ে টা মাস্টার।

বললাম,” যদি কোন অসুবিধা না হয় তবে জানালার পাশে সীট দেবেন”।

“ চেষ্টা করব”। বলে মাথা নিচু করে কাজ করতে থাকলো।

মনে হোল আজকে তার দিন টা ভালো যায় নি। নিশ্চয় বকা খেয়েছে। অগত্যা চুপ করে রইলাম।

কিছুক্ষণ পরে বোর্ডিং পাশ দুটো হাতে এগিয়ে দিলো, মুখ গোমরা করে। কিছু আর জিজ্ঞাসা করলাম না। তাকিয়ে দেখি সীট নম্বর

A & B —- হেসে বললাম,” ধন্যবাদ”।

উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে এলাম দুজনের হ্যান্ড ব্যাগ গুলো নিয়ে।

ওয়েটিং রুমে এসে বসলাম। সব মিলে গোটা বিশ জন বসা। সতী বার বার ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখছিল। বললাম,” কি ব্যাপার, আমাকে নুতন করে দেখছ বুঝি”?

বলল,” আচ্ছা শমিত দা, যদি আমার সাথে তোমার দেখা না হতো  তাহলে কি করতে”?

হাসতে হাসতে বললাম,” জানো না সেই লাইন টা,” যদি তোর ডাক শুনে কেউ না এসে তবে একলা চলো রে”।

“না, তুমি একলা চলতে পারতে না। তোমার মাঝে একটা আকর্ষণ আছে যার জন্য কেউ না কেউ তোমার পাশে এসে দাড়াত। তা সে বন্ধু ভাবেই হোক বা অন্য কোন ভাবে”।

“ তা তুমি সেই প্রজাপতি, উড়তে উড়তে এসে বসেছ পাশে। তোমার ঐ দার্শনিকতা রেখে, চলো, ওরা লাইনে যেতে বলছে, প্লেনে উঠতে হবে”।

একঘণ্টা পনেরো মিনিট পর পৌছালাম কুয়ালা লাম্পুর ইন্টারনেশনাল এয়ারপোর্টে। বাহিরে বের হতেই দেখলাম শুভঙ্করের নাম লিখে দাড়িয়ে আছে ড্রাইভার। কাছে এসে বললাম সেই একি কথা, আমরা দুজন, অন্য দুজন আসতে পারেনি। হাসি দিয়ে বলল, আমার নাম শম্ভু করমা।  বলে আমাদের দুজনের লাগেজ  নিতে চাইল। বললাম আমার টা আমিই টানতে পারবো তুমি সতীর টা নাও।

গাড়ীটা একটু দূরেই পার্ক করা। হাটতে হাটতে বলল,” এখান থেকে এক ঘণ্টা লাগবে হোটেলে যেতে”।

তিন লেন তিন লেন ছয় লেনের হাইওয়ায়। রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ গাছারী। মাঝে মাঝে পরে থাকা মাঠের পরে বড় বড় বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম শম্ভু কে, এই নির্জন এলাকায় এতো কাজ কেন হচ্ছে।

শম্ভু করমা খবর রাখে। বলল, শহরের উপর লোকের চাপ যাতে না পরে সেই জন্য অফিস আদালত কে দূরে নিয়ে আসা হবে।

হোটেল Furama Bukit Bintang এ যখন এসে পৌছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। শম্ভু করমা বিদায় নিলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো কাল একজন সকাল নয়টায় আসবে। ঘুরে নিয়ে বেড়াবে কুয়ালা লামপুরের বিভিন্ন দেখার জায়গায়।

কাগজপত্র আর পাসপোর্ট গুলো কাউন্টারে রাখলাম। ভদ্রলোক আমার কাগজ গুলো এপাস ওপাশ করে বলল তোমার নামে বুকিং নাই। আকাশ থেকে পড়লাম। “নাই মানে, এই যে কাগজে বুকিং কনফার্ম লেখা আছে’?

বলল আছে, তবে তোমার নামে নেই,আছে শুভঙ্করের নামে।

বললাম, আমি তো ওই দলের একজন।

তুমি যে সেই দলের একজন তা আমরা কীভাবে জানি? তোমার বা অন্য কারো নাম তো এখানে লেখা নেই।

মনে মনে বললাম, তোমার নিকুচি করি, তা কি করতে হবে?

সতী এতক্ষণ দেখছিল। ও আমার ধৈর্যের বহর জানে।  আমাকে ডাক দিয়ে বলল,” ওদের সাথে রাগ করে কোন লাভ নেই”।

 এবার গলার স্বর নামিয়ে বললাম,” বড্ড খিদে পেয়েছে, এই আমার সব কাগজ পত্র থাকলো, আমি ঐ সোফাতে যেয়ে বসলাম, তুমি তোমার বড় সাহেবের সাথে কথা বলে যা ইচ্ছা তাই কর”। বলে চলে এলাম।

কিছুক্ষণ পর ভিতর থেকে ফিরে এসে বলল, “ এসো একটা রুম হলেই তো চলবে”?

আবারও সেই একি সমস্যা। সতী মিটমিট করে হাসছে।

বললাম,” না, চলবে না”।

রুম পাওয়া গেলো। একটা রুম খালি হয়ছে, অন্যটা পরে পাওয়া যাবে। খিদেয় পেটের নাড়ী চোঁ চোঁ করছে। সতী জানে খিদে পেলে আমার মাথার ঠিক থাকেনা। তাই সে বলল,” সব ল্যাগেজ এই রুমে রেখে চলো আমরা খেয়ে আসি”।

খোঁজ নিয়ে জানলাম খাওয়ার জায়গা হোটেল থেকে দুই মিনিটের পথ। Berjaya Time square. চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমাদের ওখানকার Time square। আসলে তা নয়। এটা সাত তালা বিল্ডিং। বড় একটা মল। তার ভিতর ফুড কোর্ট।

সতী বলল, তুমি চয়েস করবে না আমি।

বললাম, কোনদিন আমাকে খাবার চয়েস করতে দেখেছ?

নুডুলসের সাথে বিভিন্ন শাকসবজি দিয়ে তৈরী খাবার টা ভালোই লাগলো। খাওয়া শেষে আমি নিয়ে এলাম Frozen Yogart.

সতী বলল,চলো হোটেলে যেয়ে একটু বিশ্রাম নেই, বড় ক্লান্ত লাগছে।

বাহিরে প্রচণ্ড গরম। রৌদের তাপে সতীর চোখের নিচে লালচে আভা, পোড়া পোড়া দাগ, হাতের পাতায় ছোট ছোট ঘামাচির মতো বিন্দু বিন্দু রক্তের দানার মত।

বললাম, রুমে যেয়ে Hydrocortisone cream টা লাগিয়ে নেবে। মুখে আর হাতে।

“ওটা তো তোমার কাছে”। বলল সে

আমার রুম তৈরী। পাশাপাশি। ও চলে গেলো ওর ঘরে আমি আমার।

যথারীতি নয়টায় মাইক্রবাস এসে হাজির। নিয়ে যাবে রাজার বাড়ী দেখাতে, নিয়ে যাবে Petronas Tower, চকলেট ফ্যাক্টরিতে, শেষে যাবো Ganting Highlands এ।

বড় বড় শহর বড় বড় মল, বড় বড় বিল্ডিং আমাকে আকর্ষণ করেনা। আমরা এসেছি পৃথিবীর অনেকের মধ্যে এক বৃহত্তম শহর থেকে। তবুও দেখে যেতে হবে।

রাজার বাড়ী, Istana Negara. চারিদিকে লোহার বেড়া। জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। গেটের সামনে দুটো ঘোড়ায় চড়া Royal Calvary guard. দেখার কিছু নেই।শুধু ফটো অপ। সেখান থেকে Petronas Tower। এক সময় ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উচু বিল্ডিং। আজ আর নয়। এখন নাম তার Tallest Twin Structure. ৮৮ তালার এই বিল্ডিং। বিয়াল্লিশ তালাতে স্কাই ব্রিজ করে দুটো টাওয়ার কে সংযুক্ত করা হয়েছে। উপর থেকে নিচে দৃশ্য দেখতে খুবই মনোরম। বলেছি আগে এই সব বড় বড় বিল্ডিং পৃথিবীর নামকরা ডিজাইনার শপ মন কারে না আর।

শহর ছাড়িয়ে এক ঘণ্টার পথ পেড়িয়ে এলাম Genting Highlands এ। ৬০০০ ফুট উচুতে Resorts World Genting. এখানে আসা যায় cable Car( Genting Skyway)এ করে অথবা গাড়ীতে। আকাবাকা পাহাড়ের পাশ দিয়ে গাড়ী উঠছে উপরে। পেঁজা পেঁজা মেঘ পাহাড়ের গা বেয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব। শহরেরে কোলাহল থেকে দূরে। নিরিবিলি। Resort এ আছে Casino, আছে ছোট ছোট খাবার জায়গা। খাবার নিয়ে আমরা বসলাম জানালার পাশে।

সতী তাকিয়ে ছিল দূরে। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সে। আমি বাঁধা দেইনি। ওর চোখের কণে কি যেন জ্বলজ্বল করছে।

আর আমি তাকিয়ে দেখছিলাম হাতের কাছ দিয়ে সাদা সাদা মেঘগুলো খেলা করতে করতে চলে যাচ্ছে, আমি ধরতে পারছিনা।

“শমিত দা”

“কি বলও”

“আবার কবে তোমার সাথে এই লাগাম হীন ভাবে ঘুরতে বের হবো”

“ তা তো জানিনা”।

ফিরে এলাম হোটেলে। রাতের খাওয়া শেষে Dessert নিয়ে এসে বসলাম ছাদে ঢাকা সুইমিং পুলের পাশে। বাহিরে অঝোরে ঝরছে জল শুধু আমরা দুজন পুলের পাশে। সতী পা টা উঠিয়ে দিলো আর একটা চেয়ারের উপর। বলল, শমিত দা, বলবে কি ওই গান টা কবিতা আকারে।

” আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো”

না ওটা নয়, শোন আর একটা

” বন্ধু, রহো রহো সাথে

আজি এ সঘন শ্রাবণপ্রাতে।

ছিলে কি মোর স্বপনে সাথিহারা রাতে॥

বন্ধু, বেলা বৃথা যায় রে

আজি এ বাদলে আকুল হাওয়ায় রে–

কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখো হাতে”।

সতী হাত টা বাড়ীয়ে দিলো।

শপিং শেষ, বেড়ানো শেষ। এবার বাড়ী ফেরার পালা। প্রান ভরে দেখলাম এখানকার সৌন্দর্য। অতি কাছ থেকে দেখলাম সতীকে। এতো কাছ থেকে সতী কে দেখিনি কখনো। দেখলাম। মনে হোল ওর আর আমার বন্ধুত্বের যে বিশালতা তা হারিয়ে  যাবার নয়।

সতী বলল, শমিত দা আমরা একটা মাইলস্টোন তৈরি করলাম, তাই না?

হাঁ তাই।

ক্যাপ্টেনের নির্দেশ ঘোষিত হোল।  সতী তার মাথা টা এলিয়ে দিলো পাশের জানালায়।

সমাপ্ত

 

Continue Reading

দূর দিগন্ত পাড়ে ৪

 “শমিত দা, শমিত দা, ওঠো—“ সতীর ধাক্কায় ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঘুমের ঘোর টা কেটে উঠার আগেই সে বলল, “ বিড়বিড় করে কি বলছিলে? আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুমি তো এভাবে অঘোরে ঘুমাও না জানি। আজ কি হয়ে ছিল”?

“ জানিনা, তবে ভালোই হোল, স্বপ্নে অনেকদিন যা দেখিনি, তা দেখলাম। আর আমার একটা প্রিয় কবিতা পড়ছিলাম স্বপ্নের মাঝে। শুনবে?

বলও।

,” আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরনীতে মুগ্ধ ললিত অশ্রুগলিত গীতে” বিড়বিড় করে হয়তো ঐটা ই পড়ছিলাম।

  “ তুমি তো স্বর্গ এখানেই গড়েছিলে শমিত দা”

“গড়েছিলাম আবার তা বানের জলে ভেসেও গেলো। যাক সে সব কথা। আসে গেছি, তাই না?”

“হাঁ,”

সতী আর আমি নামলাম গাড়ী থেকে। সেলিমের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম,” তুমি লাঞ্চ খেয়ে নিও”।

ও চলে গেলো।

 আমরা যেখানে এসে দাঁড়ালাম সেখান থেকে রাস্তা টা খাড়া হয়ে নেমে গেছে বীচে।

সতী কে আমার হাত ধরতে বললাম। ও ইতস্তত করছিল।

বললাম,” আমার হাত ধরলে তোমার মহাভারত অশুদ্ধ হবে না বরং পড়ে গেলে তোমাকে আমার কোলে করে নিতে হবে”।

মাঝে মাঝে ওর এই ধরনের শুচিবাই আমাকে বড় বিরক্ত করে।

অবশেষে সে আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে নেমে এলো।

কালো বালির বীচ। কালো কুচকুচে নয়। সাদা কালো মিশানো। বৈজ্ঞানিকদের  মতে কেমিক্যাল Reaction এর জন্য এই রঙ ধারন করেছে। আমার Black Sand Beach দেখা এই প্রথম নয়। দেখেছিলাম Santorini Perissa Beach। আমরা চারজন। সে অনেক বছর আগের কথা। মাঝে মাঝে স্মৃতি মন্থন করি। ফিরে যাই অনেক অনেক পিছনে। চোখে জল আসে।

থাক সে কথা। আজ বলব আজকের কথা।

Langkawi আর সতী। Langkawi থাকবে তার চিরন্তন সৌন্দর্য নিয়ে। লোকে আসবে, দেখবে, মুগ্ধ হবে।

 আর সতী, যে সতীকে আজ আমি দেখছি কালকের সতীর সাথে তার মিল নাও থাকতে পারে।

ভবিষ্যৎ তা বলবে । সতী বলেছিল, ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি ভেবোনা ।

 না, ভাবো না  নগত যা পাচ্ছি তাই হাত পেতে নেই।

সমুদ্রের জল নীল। নীল মেঘের ছায়া পড়েছে জলে। হয়ত তারি প্রতিচ্ছায়া। সতীর নীল রঙ এর ওড়নার সাথে সমুদ্রের জল  মিশে গেছে।  ওর পায়ের পাতায় জল।

দুষ্টুমি করে বল্লাম,”জলের কাছে যেওনা, মিশে যাবে ওর সাথে, আমি তাহলে আর তোমাকে খুজে পাবো না”।

তাকাল সে, কি যেন বলতে গেলো, স্পীড বোটের কর্কশ আওয়াজে আমি তা শুনতে পেলাম না, শুধু দেখলাম সূর্যের তাপে ঘামে ভেজা ওর লালচে মুখ টা।

ছোট্ট একটা পাথরের নুড়ি ছুড়ে দিলো জলে, হয়তো দেখতে চেয়েছিল সমুদ্রের গভীরতা।

ডাক দিলো আমাকে। এসো, আমরা ঝিনুক কুড়াবো।

“ না, এই রৌদ্রে নয়। তুমি চলে এসো”।

ও ফিরে এলো। পকেট থেকে কয়েকটা কাগজের ন্যাপকিন এগিয়ে দিলাম ওর হাতে।

 কি করে বুঝলে? বলল সে।

অনেকদিন ধরে তোমার সাথে চলছি। আর এটা বুঝতে পারবনা?

ও চোখে হাসির ঝলক দিয়ে আমার হাত থেকে ন্যাপকিন গুলো নিয়ে মুখে চেপে ধরলও।

“কখন থেকে বলছি উঠে আসতে। চলো, তোমার জন্য হ্যাট কিনতে হবে। এই রৌদ্রের তাপ তোমার সইবে না”।

  উঠে এলাম উপরে।

বীচ কে ঘিরে দুটো দোকান। বিভিন্ন ধরনের পোশাকে ভরা। একটু দূরে রেস্টুরেন্ট যার চারিদিক খোলা।

ঠিক রেস্টুরেন্ট আর দোকানের মাঝ খানে উপরে কাঠের ছাউনী দেওয়া একটা খোলা জায়গা। দুটো টেবিল পাতা। সেখানে একজন ডাব বিক্রি করছে।

সতী পোশাকে ভরা দোকান থেকে অনেক খুজে একটা হ্যাট নিয়ে এলো।

বলল,” এটা নেবো? পছন্দ হয়?”

বললাম,”না, মানাবে না”

“ আমার যে এটাই পছন্দ”?

বললাম ওকে “খেতে হয় নিজের পছন্দে, পড়তে হয় অন্যের পছন্দে। জানো কি”?

“ তাহলে তুমি পছন্দ করো”।

সাদাটে একটা হ্যাট  নিয়ে আসে বললাম, এটা নাও, মানাবে তোমাকে।

এবার চলো ডাবের পানি খাবে। দুজনে এসে বসলাম চেয়ারে। লোকটা একটা ডাব কেটে দুটো স্ট্র ভিতরে দিয়ে নিয়ে এলো।

সতীকে বললাম,” দেখেছ, দুটো স্ট্র সে আমাদের হাতে না দিয়ে ভিতরে দিয়ে নিয়ে এলো, তারমানে আমাদের দুজনকে একসাথে খেতে হবে। পারবে?”

“আমার আপত্তি নেই। তোমার”?

দাড়াও ওকে বলি একটা ছবি উঠাতে, দুজনে একসাথে মাথা ঠোকাঠুকি করে ডাবের পানি খাচ্ছি। জমবে ভালো। যারা দেখবে তার কি বলবে বলতো?

“ আমি কেয়ার করিনা”। বলে সে চুমুক দিলো, আমিও মাথাটা নামালাম।

 চারিদিকে খোলা, শুধু মাথার উপরে ছাদ। তারি নিচে এসে বসলাম লাঞ্চ করবো বলে। হাওয়া বইছে। সমুদ্রের নীল পানি, উড়ছে গাংচিল, হাঁটছে Seagulls পানির পাশে, আমরা প্রায় ৩০০ ফুট দূরে রেস্তোরায় বসে অর্ডার দিলাম  Pad Thai আর Green papaya salad। সতীর মুখের লাল আভা মিলিয়ে এসেছে।

 বলল,” সমুদ্রের এত কাছে বসে কোনদিন লাঞ্চ করেছ কি”?

“না করিনি, তুমি”?

“ আমি তো এই প্রথম ঘর ছেড়ে এতদূর এলাম। যখন সময় এসেছিল তখন তাকিয়ে দেখি শুধু আমিই আছি সে নেই। তাই বৌদির প্রস্তাবে প্রথমে দ্বিধা থাকলেও পরে আর তা ছিলনা। তোমার মতো বন্ধু কোথায় পাবো, বলও”? বলে ওড়না দিয়ে চোখের কোণা টা মুছে নিলো।

“চলো এবার উঠি। সেলিম বলেছিল দেড় ঘণ্টা লাগবে Mangrove Forest & Kilim River Cruise র ওখানে যেতে”।

সেলিম দাড়িয়ে ছিল গাড়ীর কাছে। আমরা আসতেই বলল,” লাঞ্চ কেমন খেলেন স্যার”?

সতী বলল,” খুবই ভালো ছিল। তুমি কোথায় খেলে”?

খাওয়া হয়নি ।

কেন? প্রশ্ন করলো সতী।

এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল অনেকদিন পরে। না দেখা হলেই বোধ হয় ভালো ছিল।

কেন?

“ওর পাঁচ বছরের  মেয়ে টা গত মাসে একদিনের  জ্বরে মারা গেছে। হাসপাতালে নেওয়ার ঘণ্টা দুএকের মধ্যে সব শেষ। কেন হোল,কি ভাবে হোল, কি রোগ তার কোন সঠিক ব্যাখা তারা দিতে পারেনি। ওর বৌ পাগলের মতো হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টার পর এই মেয়েটা এসেছিল  ওদের কোলজুড়ে। ওর বৌ এখন বাপের বাড়ী। কান্না এখনও থামে না। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যায়। এই খবর শুনে আর খাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা। আমারও একটা ছেলে আছে চার বছরের”। কথা শেষে সে সতীর দিকে তাকাল।

সতী বলল,” সব উপরওয়ালার ইচ্ছা। তোমার আমার করার কোন ক্ষমতা নাই”। কথা হচ্ছিল গাড়ী চলতে চলতে। আমি তাকালাম সতীর দিকে, সেও তাকালও আমার দিকে।

বললাম,” তুমি ফিরে যাবে নাতো অতীতে”?

ওর পূর্ব ইতিহাস আমি জানি।

বলল, “না, আজ যা দেখতে এসেছি তাই দেখব। পিছনে ফেলে আসা ঘটনা কে টেনে আনবো না”।

এসে পৌছালাম KILIM নদীর পাশে। ঘাটে অনেক স্পীড বোট বাঁধা।

Langkawi Mangrove Tour হচ্ছে মাঝারি সাইজের স্পীড বোটে করে kilim নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে দেখা  Mangrove Swamp।  ভিতরে বিভিন্ন ধরনের সবুজ গাছ, শ্যাওলা পড়া পাঁথরের পড়ে শুয়ে থাকা বড় বড় Lizards.

আমাদের বোটে আমরা ছয় জন।

বোটের রঙ সতীর ওড়নার রঙের সাথে একাকার হয়ে গেছে।

বললাম,” দেখেছ কি?  তোমার গায়ে পেঁচানো কাপড়ের রঙ মিশে গেছে বোটের রঙ এর সাথে। ওরা কি জানতো তুমি আসবে আজ”? ও কিছু না বলে শুধু হেসে সলজ নেত্রে তাকাল আমার দিকে।

Kilim নদীর এক পাশে গভীর সবুজ Mangrove অন্য পাশে বিশাল Limestone rocks। কিছু কিছু Limestone rocks দেখতে পাহাড়ের মতো। বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন রঙের পাখি উড়ছে। সাদাটে বানর হেটে বেড়াচ্ছে নদীর পাশে পাথরের উপর। অনেক লালচে রঙ এর ঈগল ঘুরছে মাথার পড়ে।

Eagle Feeding দেখার মতো। শান্ত পানিতে এসে বোট টা থামে, স্টার্ট বন্ধ করলেই ওরা বুঝতে পারে ওদের খাবার আসছে। ঝাক ঝাক ঈগল ঘুরতে থাকে মাথার উপর। বোটের চালক ছুড়ে দেয় মুরগীর ছোট টুকরা। ছোঁ মেরে ঈগল উঠিয়ে নেয় মাংস টা ।

ঈগল খাওয়ানো শেষে এবার বোট এলো Bat Cave এ। অন্ধকার, গাইডের টর্চের আলোয় দেখা যায় ছোট ছোট অনেক বাদুড় ঝুলে আছে দেয়ালের গায়ে। শব্দ করতে নেই। আস্তে আস্তে হেটে যাও।

এখানেই শেষ নয়। বোটের চালক নিয়ে এলো উন্মুক্ত সমুদ্রে। ওখান থেকে দেখা যাচ্ছে Street of Malacca. পাহাড়ের গায়ে লেখা  KILIM GEOFOREST PARK. বোট এসে দাঁড়াল পাহাড়ের কাছে। ফটো সেশন।

সতীকে বললাম,” তুমি এসে বসো বোটের মাথায়  ঐ লেখাটা নিয়ে ফটো উঠাবো”।

ও এলো। চশমা পড়া ছেলেটা বলল,” তুমিও পাশে যেয়ে বসো”। অগত্যা আমিও উঠে এলাম।

দুঘণ্টা বাদে বোট এসে যখন পাড়ে ভিড়ল তখন বিকেল পাঁচটা। সতী ক্লান্ত, আমিও। আজকের মতো দেখা শেষ। ফিরে যাবো আমাদের ভিলাতে। সতী বলল,” ফিরে যেয়ে বীচের পাড়ে একটু বসব, কি বলও?”

“কোন আপত্তি নেই, তবে তার আগে বীচের পাশে কফি হাউজে বসে গলাটা ভিজিয়ে নিলে হয়না”?

“মন্দ কি”?

গাড়ীতে এসে বসতেই সেলিম বলল,” কাল তোমাদের রীলাক্সের দিন, তোমরা তোমাদের মতো ঘুরবে, কোন প্লান আছে কি”?

বললাম,”না, নেই”।

“ তাহলে কাল আমি আমার এক বন্ধুকে পাঠিয়ে দেবো, সে তোমাদেরকে  Langkawi শহর টা ঘুরিয়ে দেখাবে”।

আমরা দুজনেই রাজি। সকাল দশ টায় আসবে সে।

সেলিম যখন আমাদেরকে নামিয়ে দিলো তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আমরা এসে বসলাম কফি হাউজে। প্রথম দিনের সেই মেয়ে টি। এসে বলল,” কফি, চা, আর সেই বিস্কিট, না অন্য কিছু”।

বললাম,” মনে রেখেছ দেখছি”?

সে হেসে চলে গেলো।

আমরা এসে বসলাম সেই চেয়ার দুটো তে যেখান থেকে দেখা যায় সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ।

 বিস্কিটে কামড় দিয়ে সতী জিজ্ঞাসা করল,” আচ্ছা শমিত দা এই ভাবেই কি কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন টা”?

“ মন্দ কি? কথা বলার সাথি, তুমি তো আছো”।

“দোয়া করো শমিতদা আমি যেন তোমার কথা বলার সাথি হয়েই থাকে পারি”।

“ চলো, সমুদ্রের পাড়ে বসবে বলেছিলে”?

“ না আজ থাক, আজ হাটতে ইচ্ছা করছে তোমার সাথে। এই পটভূমিকা আমার জীবনে আবার নাও আসতে পারে।

মনে পরে কি শমিত দা, তোমার বেল্কনীতে বসে এক চাঁদিনী রাতে তুমি আমাকে শুনিয়ে ছিলে সেই গান, কবিতা আকারে। বলবে কি? আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে”।

শোন,

তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম, নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম ॥মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন

তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম ॥জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি, তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি ।

 মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন,তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম ॥

“তোমার চোখে জল”?

“ তোমার চোখেও তো কি যেন চিকচিক করছে, শমিত দা। আসলে আমরা দুজিনেই  তো একি পথের পথিক। শমিত দা তুমি আমাকে শুধু এই আশীর্বাদ করো আমি যেন তোমার বন্ধুত্বের ছায়ায় আমার শেষ জীবন টা কাটিয়ে দিতে পারি”।

“পারবে, দেখো, হাটতে হাটতে অনেকদুর এসে গেছি। চলো ওই টার্কিশ রেস্টুরেন্টে বসি”।

চলো।

ক্রমশ

 

Continue Reading