আজ সেই দিন যেদিন সে চলে গিয়েছিল, সেদিন দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমি শুধু দেখেছিলাম। কিছুই করতে পারিনি। আমি সেদিন কিছু একটা মিরাকেল ঘটবে ভেবেছিলাম। দৌড়ে যেয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,” মিরাকেল ঘটে, তাঁই না”?
সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ।
বলল, আমার পঁয়ত্রিশ বছরের ডাক্তারির অভিজ্ঞতায় মিরাকেল কি জানা নেই, মিরাকেল ঘটেনি, ঘটবেনা।
তুমি অন্যান্য যা যা করার সেই ব্যবস্থা করো।
তোমরা কখনও হিমশীতল শরীরে হাত রেখেছ কি? অনুভব করেছ কি ঠাণ্ডার তীব্রতা? আমি করেছি। আমি দেখেছি কি ভাবে জীবনের সব লেনদেন শেষ হয়ে যায়। নেমে আসে অন্ধকার।
দাড়াও, ঘরের জানালা গুলো খুলে দেই । গুমোট ঘরটা আমাকে অস্থির করে তুলেছে। আমি বাতাস চাই। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চাই।
সে শুধু রেখে গেলো অনেক অনেক ভালবাসার স্মৃতি।
আনাচে কানাচে।
দু দুটো বছর। আমি অনেক ঘুরলাম। অনেক জাগায় গেলাম। খুজে পেতে চাইলাম সেই শব্দ টাকে। যেটা লেখা থাকে বই এর পাতায়।
শান্তি, হা শান্তি।
কোথায় সে লুকিয়ে আছে? আমার জানতে ইচ্ছা করে। জানতে ইচ্ছা করে তার অস্তিত্ব আছে কি না।
যদি থেকেই থাকে তবে কেন আজও আমি হেটে বেড়াই মাঝ রাতে। ঘরের চৌকাঠ পেড়িয়ে এসে দাড়াই ব্যালকণিতে।
নীস্তব্দ চারিদিক।
তাকিয়ে থাকি দূরে লাল নেওন সাইন টার দিকে।
ওটা নিভছে জ্বলছে।
ওটা কেনও নিভে যায়না। তাহলে তো ওকে পুড়তে হবে না।
প্ল্যানচেট করে যদি একবার নিয়ে আসি, যদি তা সত্যি হয়, জিজ্ঞাসা করবো, “ তুমিও কি কাঁদো? নাকি তোমাদের তা করতে নেই।
তুমি কি “উহ উহ” করো যখন তেলের ছিটে পরে আমার হাতটা পুড়ে যায়।
নাকি শুধু দাড়িয়ে থেকে দেখো।
চোখ দিয়ে জল ঝরে, কিছু করতে পারনা, তাঁই ।
সেই যে বলতে, রান্নার কাজ তোমার দাড়া হবেনা।
আবারও বলবে কি?
জানি তুমি তা বলবে না। আগের মত পাশে এসে দাড়ও কি না, জানিনা।
যত্ন করে রাখা সাজানো বালিশ টা চেপে ধরে কাঁদো কি না।
জানিনা।
জানিনা, খোলা জানালা দিয়ে যে বাতাস এসে দুলিয়ে দিলো পর্দা টা সেকি তুমি।
আমি জানিনা।
দেখেছ কি ঘুনে ধরা কাঠ। আস্তে আস্তে ওর ভিতর টাকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে নেয়। শেষে একদিন ঝরে পড়ে।
আমি দেখেছি সেই কাঠ। দেখেছি সতেজ মসৃণ কাঠ টার মাঝে কালো কালো দাগ। মসৃণতা হারিয়ে গেছে। তবু সে দাড়িয়ে থাকে।
ভোর ছটা। ফোন টা বেজে উঠলো। ওটা পড়ে থাকে আমার পাশের বালিশের উপর। সত্যি বলতে কি সারা রাত জেগে থাকার পর চোখ টা কেবল লেগে এসেছিল। এতো ভোরে কোন কারন ছাড়া কেউ কল করবে না জানি। মাঝ রাতে অথবা অতি ভোরে ফোনের আওয়াজ আমাকে ব্যতী ব্যস্ত করে তোলে। তাঁই ফোন টা উঠালাম। ওপারে পল্লবীর ভয়ার্ত স্বর।
কি হয়েছে?
তুমি এখনি এসো শমিত দা, এখনি এসো।
কি হয়েছে বলবি তো?
তুমি এলেই দেখতে পাবে। দেড়ি করো না, Please.
অগত্যা উঠে পড়লাম। মুখে হাতে পানি ছিটিয়ে গাড়ীর কাছে এসে দাঁড়ালাম। কেনও জানি এক অজানা ভয় মনের মধ্যে। ওর আতঙ্কিত গলার স্বর আমার কানে বাজছে।
পল্লবী আমার কেউ নয়। আত্মীয়তা নেই আমার সাথে । ওর বড় বোন কে আমি চিনতাম। সেই সুবাদে ওকেও চিনি। অনেক দিনের চেনা। দেখেছি যখন ওর গলায় ওড়না পড়েনি। মাঝে মাঝে এসে বলত,” শমিত দা তুমি মেজবু কে বিয়ে করবে”?
বলতাম, না, তোমার মেজবু আমার বন্ধু।
সেই পল্লবী চোখের সামনে বড় হোল। মিষ্টি চেহারার মেয়ে টা ঘুরে বেড়াতো ওর মেজবুর পাশে। একদিন মেজবুর বিয়ে হয়ে চলে গেলো অন্য খানে সেই সাথে সেও। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমাকে নিয়ে। মাঝে অনেক গুলো গ্রীষ্ম, শীত পাড় হয়ে এলাম। আমার জীবন টা অনেক কাঁটা ছেড়ার মাঝ দিয়ে পাড় হয়ে এসে ঠেকলও এক ছোট্ট ঘরে।
এমনি একদিনে একটা ছোট্ট চিরকুট এসে পড়ল হাতে।
অনুর লেখা। সাথে একটা বিভিন্ন রঙে মাখান কার্ড।
শমিত,
আসছে মাসের ১২ তারিখে পল্লবীর বিয়ে।
তোমাকে আসতে হবে।
অনু
মনে হোল মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। পল্লবীর বিয়ে। সেই ছোট্ট মেয়েটা, যে কিনা বলত আমি ওর মেজবু কে বিয়ে করবো কি না, সেই আজ বিয়ের সাজে সাজছে। মেন্দির রঙ এ রাঙিয়ে দিয়েছে তার দুটো হাত। মাথার পড়ে লাল ওড়না।
বসে আছে নত মুখে।
আমি পৌছেছিলাম বিয়ের দুদিন আগে। ষ্টেশন থেকে অনু নিয়ে এসেছিল। পথে আসতে আসতে বলল, এক অনুশঠানে পল্লবী কে দেখে ছিল সঞ্জীবের বাবা। সেখানেই অনুর মা কে বলেছিল, আপনার মেয়ে কে আমার খুব পছন্দ। আমার ছেলের সাথে মানাবে। অনুর মা পড়ে জানাবে বলেছিল।
সঞ্জীব কেবল কম্পিউটার সাইন্সে পাশ করে এক বড় কোম্পানিতে ঢুকেছে। দেখতে মন্দ নয়। কথা বার্তায় চৌকস। বলল অনু।
বললাম, একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো, তাঁই নয় কি ? ওর তো এখনও বিয়ের বয়স হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
অনু বলেছিল, তুমি তো জানো বাবা নেই, মা র বয়স হয়েছে। মা চাইছে না এই সম্বন্ধ হাতছাড়া করতে। আর তাছাড়া পল্লবীও রাজি।
গাড়ী এসে দাঁড়ালো দরজায়। আমি আর অনু চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকলাম ঘরে। পল্লবী এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। অপূর্ব লাগছিলো ওকে দেখতে। বলেছিল, শমিত দা তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো।
বলেছিলাম, তুই তো আসছিস সেই খানে যেখানে আমিও আছি। পারবিনা আমার দেখাশুনা করতে?
পারবো বৈকি? বলেছিল সে।
ধুমধাম করে শেষ হোল সব। যাবার সময় অনু জল ভরা চোখ নিয়ে এসে বলেছিল, শমিত, ওকে দেখে রেখো।
সময় পেরিয়ে গেলো। পল্লবীর কোলে এলো এক ছেলে। মাঝে মাঝে রেখে যেতো আমার কাছে।
বলত, শমিত দা, এই থাকলো, দেখে রেখো, আমরা যাচ্ছি একটা পার্টিতে। আসতে যদি দেরী হয়, তুমি এই দুধ টা খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিও।
বাসার সামনে একটু জটলা। দেখতে পেলাম রহিত সাহেব কে, (সঞ্জীবের বাবা), সজীব, ওর বড় ভাই, সাথে আরও কয়েক জন। গাড়ীটা রাস্তার পাশে রেখে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে সঞ্জীবের বাবা এগিয়ে এলো। কোন কথা বলার আগে
বলল, ভিতরে আসুন।
ভিতরে এলাম। পল্লবী বসেছিল একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে। তাকাল। চোখে জল। কাঁদছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,” ওকে ধরে নিয়ে গেছে শমিত দা”।
ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় নিয়ে গিয়েছে? কে নিয়ে গিয়েছে? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
পুলিশ। পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। ওর উপর নজর রাখছিল ওরা। ওরা বলল সঞ্জীব বিভিন্ন খারাপ ওয়েব সাইটে ঘোরাফেরা করে। বলে থামল পল্লবী।
খারাপ ওয়েব সাইট মানে?
ওরা আমাকে ব্যাখ্যা করেনি। শুধু ওকে আর ওর সব ল্যাপটপ গুলি নিয়ে গেছে।
পাঁচ দিন পর জামিনে মুক্তি পেলো সঞ্জীব। পুলিশের মতে “ টাকার বিনিময়ে আনন্দ” এই ধরনের একটা সংস্থার সাথে সে জড়িত। ওতপ্রোত ভাবে জড়িত না থাকলেও তার নাম পাওয়া গেছে ঐ সংস্থার খাতায়। ল্যাপটপে।
দোষ স্বীকার করে নিয়ে ছিল সঞ্জীব। ফলে এক বছরের সাজা, আর এক বছর প্রবেশন। পায়ে ইলেকট্রনিক ব্রেসলেট। তার হাটা চলার পরিধি ছিল সীমিত। ল্যাপটপ তালা লাগানো, ব্যবহার করা নিষেধ।
তার বাচ্চা সে দেখতে পারবে তবে আর একজনের উপস্থিতে। একলা সে থাকতে পারবে না। ফলে সঞ্জীবকে এসে উঠতে হোল ওর বাবার বাসায়। পল্লবী বাচ্চা নিয়ে থেকে গেলো সেই বাসায় যেখান থেকে শুরু করেছিল ওদের জীবন।
বলেছিলাম, পল্লবী, মানুষ দোষ করে, তার প্রায়শিচত্ত করে। পারবি না আবার ফিরে যেতে।
না, শমিত দা, একবার যে বিশ্বাস আমি হারিয়েছি তা আর ফিরে আসবেনা কোনদিন। জীবনের শুরুতেই সব শেষ হয়ে গেলো আমার।
বললাম, নতুন করে জীবন শুরু করা বড় কঠিন। তাছাড়া তোর ছেলের কোথাও তো ভাবতে হবে। একলা তোর পক্ষে ওকে ঠিক পথে চালানো সম্ভব হবে কিনা জানিনা। কয়টা উদার ছেলে আছে এই ধরাধামে যে ছেলে সহ —
কথা শেষ করার আগেই সে বলল, শমিত দা যে আসবে সেতো সব দেখে শুনেই আসবে, আর যদি না পাই আশীর্বাদ করো যেন ছেলেটাকে মানুষ করে দিয়ে যেতে পারি।
সঞ্জীবের পায়ের বেড়ি খুলে গেছে। সে এখন মুক্ত। বাচ্চা বড় হয়েছে। নয় বছর বয়স। ছুটির দিনে বাপের কাছে আসে। কিন্তু ওরা দুজন আর হাতে হাত রাখতে পারলো না।
যা ভেঙ্গে যায় তা আর জোড়া লাগেনা। লাগলেও একটা দাগ থেকে যায়। ওদের বেলাতে তাঁই হোল। জোড়া লাগলো না।
পল্লবী চাকরি করে এক ইনভেস্টমেন্ট ফার্মে। মাঝে মাঝে আসে আমার কাছে।
বলে, শমিত দা, তুমি তো বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যাও, আমাকে নিয়ে যাবে ? আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।
বললাম, পারবো বৈকি। তবে এই ঘুনে ধরা সমাজ তোকে যেতে দেবেনা আমার সাথে। আমি একেলা, তুইও একেলা, এই হয়েছে জ্বালা। ওরা নিন্দে রটাবে।
কেন? তুমি আমার বড় ভাই।
সে তো তুই আর আমি জানি । তবে ভাবিস না। অনু কে বলব। ও যদি যায় তবেই সব সমস্যার সমাধান। কি বলিস?
ফোনটা উঠিয়ে প্রথম প্রশ্ন,” কিরে, তোর ডায়রির পাতা ইদানীং খালি যাচ্ছে, কি হোল”?
বললাম, বড় নিরামিষ যাচ্ছে দিনকাল। এক ঘেয়েমী। কোন বৈচিত্র্য নাই। খাও দাও আর ঘুমাও। এসব তো লেখা যায় না। অন্তত পক্ষে পাঠকের জন্য নয়”’
-তাহলে ভুত, প্রেত নিয়ে লেখ। যেমন, হেটে আসছিস অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে হাসতে এক বুড়ি তোর পথ আগলিয়ে ধরলও। (সুন্দরী মেয়ে বলব না, তাহলে তোর মেয়ে আমার মাথা ভেঙ্গে দেবে)
ইয়ার্কি পেয়েছিস। তবে মনে পড়ছে একজনের কথা। ঐ যে বললি ভুত, প্রেত। দেখেছিলাম।
তবে শোন,
আমার বয়স তখন পাঁচ। তোর তখনও জন্ম হয়নি। আমাদের বাসার পাশে মাঠ। মাঠের শেষে একটা টিনের ছাউনী দেওয়া বাড়ি। ওখানে থাকতো টুকু নামে আমার এক বন্ধু। আমরা এক বয়সী। ও থাকতো ওর মা আর ভাইয়ের সাথে। বাবা গত হয়েছে অনেক দিন হোল। আমি যেতাম ওদের বাড়ীতে। টুকুর সাথে মার্বেল খেলতে।
আমি যন্ত্রের মত এগিয়ে যেতাম, কিসের যেন একটা টান অনুভব করতাম। কাছে এলে আমার গালটা টিপে দিতো। কোলে বসিয়ে বলত,” তোকে আমি মধু বলে ডাকব। আর তুই আমাকে ছোটমা বলে ডাকবি। কেমন”?
-কেনও আমাকে মধু বলে ডাকবে? আমার নাম তো মিন্টু।
বলত, তুই যে আমার পরানের মধু। বলে আমাকে চেপে ধরত বুকের মাঝে।
আমি মুখ লুকাতাম ওর নরম বুকে।
তুই এখানে বস আমি আসছি ,বলে উঠে যেয়ে নিয়ে আসতো দুধ কলা। আমাকে নিজে হাতে খাইয়ে দিতো।
কপালে চুমু দিয়ে বলত, কাল এবার আসবি তো?।
বলতাম, কাল এলে কি খেতে দেবে?
মুড়ি পাটালি।
আমি খুব পছন্দ করি মুড়ি পাটালি।
একদিন আমি টুনি দের বাসায় এক্কা দক্কা খেলছিলাম। পানির পিপাসা পাওয়াতে দৌড়ে বাসায় এসে দেখি ছোটমা বসে আছে মার পাশে। দুজনে গল্প করছে। আমাকে দেখে হাসল। ডাক দিলো।
“ একে বারে ঘেমে নেয়ে গেছিস”। বলে আঁচল টা দিয়ে আমার মুখ টা মুছে দিলো।
মা বলল,” তোর খুব নাওটা হয়েছে”।
“ আমি ওকে মাঝে মধ্যে দুধ কলা খাইয়ে দেই। তুমি কিছু মনে করোনা নাতো খালা”।
না, আমি জানি কেনও তুই ওকে এতো ভালবাসিস।
আমি পানি খাওয়ার কথা ভুলে যেয়ে ওর গা ঘেঁসে বসলাম।
টুনি এসে ডাক দিল খেলতে যেতে।
বললাম, আজ আর খেলবো না।
মা বলল, খেলবি না কেনও? এখানে বসে আমাদের কথা শুনবি। তাঁই না?
বললাম, আমার আর খেলতে ইচ্ছা করছে না। আসলে ছোটমার পাশ ছেড়ে যেতে চাইছি না।
ছোটমা আমার চুলগুলো হিজিবিজি করে দিয়ে বলল, যা পাজি, খেলতে যা।
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গেলাম। এক্কা দক্কায় আর মন বসলো না।
দুদিনের জন্য মামা বাড়ীতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দৌড়ে গেলাম টুকু দের বাড়ীতে। ছোটমা বসে আছে মাটির বারান্দায়। আমাকে ডাকল না। আমি পাশে যেয়ে বসলাম। আমার দিকে তাকাল। চোখে জল। আমি হাত দিয়ে চোখটা মুছিয়ে দিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
বলল,” তুই বাসায় যা। আজ তোকে আমি খাওয়াতে পারবো না”।
আমি খেতে চাইনা। আমি তোমার পাশে বসে থাকবো। কি হয়েছে তোমার?
-তুই বুঝবি না।
আমার কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না। বাসায় এসে মা কে বললাম, মা, ছোটমা কাঁদছে? ওকে বোধ হয় কেউ মেরেছে।
মা বলল, না কেউ মারে নি। ওর বর টা আবার বিয়ে করেছে। ওর ঘরে সতীন এসেছে।
সতীন মানে কি, কিছুই বুঝলাম না। আর টুকুর ভাই কে তো ছোটমা অনেক ভালো করে খাওয়াত। তাহলে আবার বিয়ে করবে কেনও?
সেই রাতে আমার ঘুম এলোনা। সকালে উঠেই গেলাম ওদের বাড়ীতে। ছোটমার এমন অগ্নিমূর্তি আগে কখনো দেখিনি। হাতে একটা চেলা কাঠ। সামনে একটা মেয়ে দাঁড়ান। কালচে গায়ের রং। পরনে লাল শাড়ী। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলছে। ছোটমা কে বেড়িয়ে যেতে বলছে বাড়ী থেকে। ছোটমা চেলাকাঠ নিয়ে এগিয়ে যেতেই চোখ পড়লো আমার উপর।
দু পা পিছিয়ে এসে আমাকে বলল,” এখানে কি করছিস। বাসায় যা”। বলে একটা ধমক দিলো।
দুই তিনদিন যাইনি ঐ বাসায়। এক সকালে টুকু এসে হাজির। বলল,” চল এখুনি আমাদের বাসায়”।
কেন?
গেলেই দেখতে পারবি। বলল সে
যেয়ে দেখি বেশ কিছু আমার মত ছেলে মেয়ে আর বয়স্ক কিছু লোকজন সাথে টুকুর ভাই দাঁড়ানো।
ছোটমার ঘর বন্ধ। মাঝে মাঝে ঐ ঘর থেকে মোটা গলার স্বরে কে যেন কি বলছে। কিছুই বুঝলাম না।
হঠাৎ করে ঘরের ভিতর জিনিস পত্র ছুড়ে ফেলার শব্দ হোল । তারপর সব চুপ।
আমি টুকু কে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে রে। আমার ভয় করছে।
টুকু বলল, ভাবী কে জিনে ধরেছে।
জিন মানে?
আমি জানিনা। ভাই বলল।
আবারও কর্কশ গলায় ভাই কে আসতে বলল দরজার কাছে। টুকুর মা ওর ভাই কে যেতে বারণ করলো,” যাসনে খোকা”।
দরজা টা কেঁপে উঠল। ভিতর থেকে বলল, আমি আজ যাচ্ছি। আবার আসব। ওর দিকে যত্ন নিবি।
দুমাস কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেক বার ছোটমা অজ্ঞান হয়ে গেছে।
মা কে জিজ্ঞাসা করতাম, মা ছোটমার খারাপ কিছু হবে নাতো?
মা বলত, না তোর ছোটমা ভালো থাকবে। কিছু হবে না তোর ছোটমার। বলে মা আমাকে আশ্বাস দিতো।
একদিন বাবা আসে বলল, বদলির চিঠি এসেছে। সামনের মাসে চলে যেতে হবে এখান থেকে। আমি শুনলাম। সারা বাসা ঘুরে ঘুরে কেঁদে বেড়ালাম। ছোটমা কে বলিনি। শুধু যেয়ে যেয়ে আদর নিয়ে এসেছি।
এবার সময় হোল বলার। আমি এলাম। ছোটমা রান্নাঘরে। পরনে হাল্কা হলুদ রঙের শাড়ী। আমাকে দেখে বলল, কি ব্যাপার সোনা, এতো সকালে?
তোমার সাথে কথা আছে ছোটমা। বলতে যেয়ে আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ল। জড়িয়ে ধরলাম ছোটমা কে।
ছোটমা উনন থেকে হাড়ীটা নামিয়ে রেখে আমাকে নিয়ে এলো বারান্দায়।
মুখটা উচু করে ধরে বলল, কেউ বকেছে?
না।
তাহলে?
আমরা চলে যাচ্ছি ছোটমা। বলে হু হু করে কেঁদে উঠলাম।
চলে যাচ্ছি মানে?
বাবা বদলি হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে গাড়ী আসবে নিয়ে যেতে। তোমার সাথে আর দেখা হবে না ছোটমা।
ছোটমা আমাকে ওর বুকের মাঝে চেপে ধরল। কোন কথা বলল না। ওর শাড়ী ভিজে গেলো আমার চোখের জলে।
তারপর আমাকে চুমু দিয়ে বলল, তুই অনেক বড় হবি। বড় হয়ে আমাকে দেখেতে আসবি। আমি তোর পথ চেয়ে থাকব।
আর দেখা হয়েছিল?
না,
গিয়েছিলাম পঁচিশ বছর পরে কঙ্কনাকে নিয়ে। সেই জায়গা আমি চিনতে পারি নি। অনেক কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কেউ কোন খোঁজ দিতে পারেনি।
জানিস আমার ছোটমা হারিয়ে গেলো। আমার দোষ। আমি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কথা আমি রাখিনি। সে শুধু আমার পথ চেয়েই রইল। আমার পায়ের শব্দ শুনতে পেলনা।
এখনও মাঝে মাঝে যখন একলা বসে থাকি মনে হয়, কে যেন আমার গালটা টিপে দিয়ে বলছে