আকাশ ছিড়ে রৌদের আলো এসে পড়েছে উদয়ের বিছানাতে। চোখ না মেলেই পাশে হাত দিয়ে অনুভব করতে চাইল রাতের বাসি শরীর টা। না, কেউ নেই। কখন যে কেয়া উঠে গেছে, সে টের পাইনি। পাশের টেবিলে ঘড়ি টার দিকে তাকাল উদয়। নয় টা বেজে চল্লিশ মিনিট। বেলা হয়ে গেলো ভেবে আবারও কেয়ার বালিশ টা চেপে ধরে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করল।
কোন সারাশব্দ নেই। ভাবল কেয়া হয়তো গোসলে ঢুকেছে। রাতের কথা একবার ভাবল উদয়। হাসি পেলো। পঞ্চাশের কোঠায় পা দিয়েও কেয়ার শরীরের গঠন মনে করিয়ে দেয় সে যেন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই করছে। অবশ্য এর পুরো ক্রেডিট টা উদয় নিতে চায়।
বলে, আমার দেখা পেয়েছিলে, সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি তোমাকে তাই না তোমার এই মাধুর্য। এই উপচে পড়া সৌন্দর্য। বিয়ে করতে ওই সব, মানে ওদের একজন কে, বুঝতে, এতো দিনে পাঁচ সাত টা গুঁড়ি গুঁড়ি হেটে বেড়াতো, আর তোমার গাল চুপসে– কথা শেষ হতে পারতো না, কেয়া এসে ঠোট টা বন্ধ করে দিতো।
এই সব ভাবতে ভাবতে উঠে বসল উদয়। কলের পানির শব্দ সে শুনতে পেলো না। তাহলে কি কেয়া বারান্দায়?
নেমে এলো সে, ড্রয়াইং রুমে এসে দেখল কেয়া চেয়ারে বসা। চেহারায় বন্ধের দিনের সেই হাস্যজ্জল আভাস টা নেই। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতোই থমথমে ভাব।
এতক্ষণে ওর হাতে কফির পেয়ালা থাকার কথা, সেটা নেই।
কেয়া তাকাল উদয়ের দিকে। চোখের কোনের পানির বিন্দুটা দেখতে পেলো উদয়। সহসা মনে হোল, কাল রাতে কি কোন কিছু বলেছিল যা কেয়াকে আঘাত দিয়েছে।
না, মনে তো পড়ে না। কিছু হলে তো সে শেষ চুমু টা দিয়ে বলত না, “ এবার ঘুমোও”।
তাহলে ?
কি হয়েছে?
প্রশ্ন করতেই কেয়া ডাকল তাকে কাছে আসতে। বললও, বসো আমার পাশে।
উদয় অনুভব করল হঠাৎ তার হৃদপিণ্ডের কার্জ র্ক্ষমতা বেড়ে গেছে। যেখানে তার হার্ট বীট থাকে পঞ্চান্ন থেকে ষাট এখন একশর কাছাকাছি।
কি হয়েছে? আবারও প্রশ্ন তার।
বাবা মারা গেছে।
কার বাবা? তোমার না আমার? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল সে।
তোমার। কিছুক্ষণ আগে কল এসেছিল। তুমি ঘুমিয়েছিলে।
উদয় বিশ্বাস করতে চাইল না। বলল, না তুমি ভুল শুনেছ। কয়দিন আগেই তো কথা হোল। বলেছিল, কবে আসবি? বলেছিলাম, সামনের বছরের প্রথম দিকে আশা রাখি।
জন্ম, মৃত্যু তো কারোর হাতে নেই। বলে কেয়া উদয়ের মাথা টা ওর বুকের কাছে নিয়ে এলো।
উদয় কাঁদতে চাইল কিন্তু কাঁদতে পারলো না। থেকে থেকে বুকের মাঝে একটা ব্যাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকলো।
আস্তে আস্তে মাথাটা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল, ব্যাল্কনী তে এসে তাকালও দূরে।
মা কে হারিয়েছে অনেক আগে। ভাল মন্দ সবকিছু শেয়ার করতো বাবার সাথে। বয়সের এক পর্যায়ে বাবা হয়ে যায় বন্ধুর মতো। সেই সম্পর্কে এসে দাড়িয়ে ছিল উভয়ের মধ্যে।
উদয় আবদার করেছিল বাবা কে, এখানে এসে থাকার জন্য।
বাবা রাজি হয়নি। বলেছিল, এই বয়সে ওখানে যেয়ে থাকতে পারবো নারে। আর তাছাড়া তোর মার স্মৃতি জরানো এখানে।
উদয় আর কথা বাড়ায় নি।
কিন্তু একটা খত আজও তার বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। ভুলতে পারে না সে। যে অন্যায় সে সেদিন করেছিল, তার প্রায়শ্চিত্ত আজও করতে পারেনি। সেদিন এতো অবুঝ কেনও সে হয়েছিল? জানে না।
বাবা কেঁদে ছিল কিনা বলতে পারেনা, তবে আঘাত পেয়েছিল নিঃসন্দেহে।
কেয়া এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। পাশ ফিরে কেয়ার মুখটা হাতের মাঝে নিয়ে বলল,
আজ তোমাকে বলব, আজ আমি বলে হাল্কা হতে চাই। অনেক অনেক আঘাত আমি দিয়ে ছিলাম আমার বাবা কে। সে হয়ত মনেও রাখেনি সেই কথা। কিন্তু আমি তো ভুলতে পারিনি। কেন সেদিন আমি যেয়ে বলিনি, বাবা আমি দুঃখিত।
আজ নয়। আরেকদিন বলও, আমি শুনবো।
না, আজই। শোন,
বাবা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। কোন কিছুর দরকার হলে অনন্যরা চাইতো মার কাছে, আর আমি চাইতাম বাবার কাছে।
তবে বাবা কে যে ভয় পেতান না তা নয়। পড়া শোনার ব্যাপারে বাবা কোন কিছুর সাথে সন্ধি করতে রাজি নয়।
কথায় কথায় বাবা একদিন বলেছিল,
“জানিস উদয়, আমি খুবই ভাল ছাত্র ছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডিগ্রীটা আমি নিতে পারিনি। তার আগেই তোর দাদা মারা গেলো। আমিই সবার বড় ছেলে। আমার পড়ে আরও চার টা ভাই বোন। তোর দাদি দিশাহারা হয়ে পড়ল। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে এলাম। চাকরি নিলাম। সংসারের হাল ধরলাম।
তোর মা এলো।
সংসারের ভিতরের হাল ধরলও সে, আমি ধরলাম সামনে। এক সময় তোর চাচা ফুফুরা মানুষ হয়ে বেড়িয়ে গেলো। তোর দাদি রয়ে গেলো আমার সাথে। তোকে তো সেই বড় করেছিল কোলে পিঁঠে করে”।
সেইজন্য বাবার কাছে লেখাপড়া আগে। বলেছিল, আমার মতো তোকে অর্ধেক পথে লেখাপড়ার পাঠ চুকাতে হবেনা।
মনে পড়ে, আরও মনে পড়ে একরাতে জ্বরে যখন আমি ছটফট করছি, সারা রাত বাবা মাথার কাছে বসে পানিতে ভেজা কাপড় দিয়ে কপাল মুছিয়েছে। বলে উদয় থামল। কি যেন চিন্তা করল।
কেয়া বলল, তুমি তাই বলছ, তোমার সাথে বিয়ে হয়ে আমি যখন এই বাড়ীতে এলাম একবারও আমার মনে হয়নি আমি এই বাড়ীতে আগে কখন আসিনি। বাবা আমাকে বৌমা বলে ডাকতো ঠিকই কিন্তু তার মেয়েদের থেকে আমাকে কম ভালোবাসতো না।
আমার চিকেনপক্স হয়েছিল, মনে আছে?
আছে।
মশারির ভিতর বাবা নিজে হাতে খাবার এনে আমাকে খাইয়ে দিতো।
মনে পড়ে?
পড়ে।
তুমি তো বললে না বাবা মনে আঘাত পেয়েছিল তোমার কোন ব্যবহারে।
বলছি।
বাবা তখন রিটায়ার করেছে। শহরের এক কোনায় ছোট্ট একটু জমি কিনে সেখানে বাসা বেঁধে আমরা আছি। যেই বাসাতে তুমি এসে উঠেছিলে।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। হলে থাকি। সেখানে থাকার যে খুব একটা দরকার ছিল তা নয়। বাসা থেকে ক্লাস করা যেতো। কিন্তু পড়াশোনার সাথে সাথে আড্ডার নেশা টা আমাকে পেয়ে বসেছিল।
বাবা বলেছিল, হলে না থাকলেই কি নয়।
যুক্তি দিয়েছিলাম, হলে থাকলে লাইব্রেরি তে যখন তখন যেতে পারবো, অন্যান্য ছাত্রদের সাথে কোশ্চেন নিয়ে কন্সালট করতে পারবো, ভেবে দেখিনি বাবার উপর চাপ টা কতটুকু পড়বে।
সে না করে নি।
সেই সময়ে একটা সুযোগ এলো বিদেশে আসার। বাবা কে বললাম। বাবা বলল, নিশ্চয় যাবে।
ভেবে নিলাম, আর কি, আমার দায়িত্ব কাগজ পত্র গোছান, বাদবাকি দায়িত্ব বাবার। সেদিন মনে হয়নি বাদবাকি দায়িত্বটা যে কত বড় দায়িত্ব একজন রিটায়ার মানুষের পক্ষে।
ফুর্তি ফুর্তি ভাব আমার। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ভিসা পেয়ে গেলাম। ট্রাভেল এজেন্সিতে যেয়ে টিকিট বুক করতে গেলে ওরা বলল, দুই দিনের মধ্যে যদি টিকেট না কিনি তবে ওরা আর আগের দামে দিতে পারবেনা। যদিও আমার যাওয়ার দিন আরও তিন মাস পড়ে।
সেই রাতে বাসায় এলাম। বাবা কে বললাম আগামীকাল আমার এতো টাকা লাগবে।
বাবা বলল, আগামীকালই? কয়দিন পড়ে দিলে হয় না? ধর, চার পাঁচ দিন পরে?
না, টিকিটের দাম বেড়ে যাবে?
কিন্তু কালকের মধ্যে তো আমি দিতে পারবোনা বাবা।
তাহলে থাক। রাগ করে আমি বেড়িয়ে আসছি, মা ডাক দিলো। উদয় খেয়ে যা। যাসনে বাবা।
খিদে নেই। বলে চলে এলাম হলে।
সারা রাত শুধু একটা কথাই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলো,” আমার আর যাওয়া হোল না, বিদেশে”।
যেহেতু পরীক্ষা সামনে, ক্লাস নেই, কাজেই সকালে ঘুম থেকে উঠার তাড়া নেই।
ভোর সাত টায় দরজায় টোকার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দরজা খুললাম। বাবা দাড়িয়ে। হাতে একটা ব্যাগ।
সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল কি ভুলই না আমি করেছি। আমার কর্মের মাসুল দিতে বাবা কে আসতে হয়েছে এই কাক ডাকা ভোরে। টাকা জোগাড় করে।
কেন সেদিন আমি বলতে পারিনি, বাবা আমি সত্যিই দুঃখিত।
বাবার চোখে কোন রাগ দেখিনি সেদিন। শুধু বলেছিল, “ টাকা টা সাবধানে রাখিস, পারলে আজই যেয়ে টিকিটের বাবস্থা করিস”।
কোথা থেকে টাকা জোগাড় হয়েছিল আজও আমি তা জানিনা। অনেক কষ্ট করে তাকে জোগাড় করতে হয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
সেই টিকিট আমি কেটে ছিলাম আরও দশ দিন পর। ট্রাভেল এজেন্সির লোক টা ছুটি নিয়ে বাড়ী চলে গিয়েছিল। টিকিটের দামও বাড়েনি।
বলতে পারো, কেনও সেদিন আমার ঐ মতিভ্রম হয়েছিল। যার খেসারত আমি আজও দিয়ে চলেছি।
আজ বাবা চলে গেলো, আমি বলতে পারলাম না, বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও।
কেয়া উদয়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
ভেবো না, বাবা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। যেমন তুমি তোমার ছেলের কোন দোষ দেখো না। সেই রকম বাবাও তোমার কোন দোষ দেখিনি।
এসো, এবার আমার কোলে মাথা রেখে শোবে, চলো।