অতীত কথা কয়

আকাশ ছিড়ে রৌদের আলো এসে পড়েছে উদয়ের বিছানাতে। চোখ না মেলেই পাশে হাত দিয়ে অনুভব করতে চাইল রাতের বাসি শরীর টা। না, কেউ নেই। কখন যে কেয়া উঠে গেছে, সে টের পাইনি। পাশের টেবিলে ঘড়ি টার দিকে তাকাল উদয়। নয় টা বেজে চল্লিশ মিনিট। বেলা হয়ে গেলো ভেবে আবারও কেয়ার বালিশ টা চেপে ধরে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করল।
কোন সারাশব্দ নেই। ভাবল কেয়া হয়তো গোসলে ঢুকেছে। রাতের কথা একবার ভাবল উদয়। হাসি পেলো। পঞ্চাশের কোঠায় পা দিয়েও কেয়ার শরীরের গঠন মনে করিয়ে দেয় সে যেন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই করছে। অবশ্য এর পুরো ক্রেডিট টা উদয় নিতে চায়।
বলে, আমার দেখা পেয়েছিলে, সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছি তোমাকে তাই না তোমার এই মাধুর্য। এই উপচে পড়া সৌন্দর্য। বিয়ে করতে ওই সব, মানে ওদের একজন কে, বুঝতে, এতো দিনে পাঁচ সাত টা গুঁড়ি গুঁড়ি হেটে বেড়াতো, আর তোমার গাল চুপসে– কথা শেষ হতে পারতো না, কেয়া এসে ঠোট টা বন্ধ করে দিতো।
এই সব ভাবতে ভাবতে উঠে বসল উদয়। কলের পানির শব্দ সে শুনতে পেলো না। তাহলে কি কেয়া বারান্দায়?
নেমে এলো সে, ড্রয়াইং রুমে এসে দেখল কেয়া চেয়ারে বসা। চেহারায় বন্ধের দিনের সেই হাস্যজ্জল আভাস টা নেই। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতোই থমথমে ভাব।
এতক্ষণে ওর হাতে কফির পেয়ালা থাকার কথা, সেটা নেই।
কেয়া তাকাল উদয়ের দিকে। চোখের কোনের পানির বিন্দুটা দেখতে পেলো উদয়। সহসা মনে হোল, কাল রাতে কি কোন কিছু বলেছিল যা কেয়াকে আঘাত দিয়েছে।
না, মনে তো পড়ে না। কিছু হলে তো সে শেষ চুমু টা দিয়ে বলত না, “ এবার ঘুমোও”।
তাহলে ?

কি হয়েছে?
প্রশ্ন করতেই কেয়া ডাকল তাকে কাছে আসতে। বললও, বসো আমার পাশে।
উদয় অনুভব করল হঠাৎ তার হৃদপিণ্ডের কার্জ র্ক্ষমতা বেড়ে গেছে। যেখানে তার হার্ট বীট থাকে পঞ্চান্ন থেকে ষাট এখন একশর কাছাকাছি।
কি হয়েছে? আবারও প্রশ্ন তার।
বাবা মারা গেছে।
কার বাবা? তোমার না আমার? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল সে।
তোমার। কিছুক্ষণ আগে কল এসেছিল। তুমি ঘুমিয়েছিলে।
উদয় বিশ্বাস করতে চাইল না। বলল, না তুমি ভুল শুনেছ। কয়দিন আগেই তো কথা হোল। বলেছিল, কবে আসবি? বলেছিলাম, সামনের বছরের প্রথম দিকে আশা রাখি।
জন্ম, মৃত্যু তো কারোর হাতে নেই। বলে কেয়া উদয়ের মাথা টা ওর বুকের কাছে নিয়ে এলো।
উদয় কাঁদতে চাইল কিন্তু কাঁদতে পারলো না। থেকে থেকে বুকের মাঝে একটা ব্যাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকলো।
আস্তে আস্তে মাথাটা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল, ব্যাল্কনী তে এসে তাকালও দূরে।
মা কে হারিয়েছে অনেক আগে। ভাল মন্দ সবকিছু শেয়ার করতো বাবার সাথে। বয়সের এক পর্যায়ে বাবা হয়ে যায় বন্ধুর মতো। সেই সম্পর্কে এসে দাড়িয়ে ছিল উভয়ের মধ্যে।
উদয় আবদার করেছিল বাবা কে, এখানে এসে থাকার জন্য।
বাবা রাজি হয়নি। বলেছিল, এই বয়সে ওখানে যেয়ে থাকতে পারবো নারে। আর তাছাড়া তোর মার স্মৃতি জরানো এখানে।
উদয় আর কথা বাড়ায় নি।
কিন্তু একটা খত আজও তার বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। ভুলতে পারে না সে। যে অন্যায় সে সেদিন করেছিল, তার প্রায়শ্চিত্ত আজও করতে পারেনি। সেদিন এতো অবুঝ কেনও সে হয়েছিল? জানে না।
বাবা কেঁদে ছিল কিনা বলতে পারেনা, তবে আঘাত পেয়েছিল নিঃসন্দেহে।

কেয়া এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। পাশ ফিরে কেয়ার মুখটা হাতের মাঝে নিয়ে বলল,
আজ তোমাকে বলব, আজ আমি বলে হাল্কা হতে চাই। অনেক অনেক আঘাত আমি দিয়ে ছিলাম আমার বাবা কে। সে হয়ত মনেও রাখেনি সেই কথা। কিন্তু আমি তো ভুলতে পারিনি। কেন সেদিন আমি যেয়ে বলিনি, বাবা আমি দুঃখিত।

আজ নয়। আরেকদিন বলও, আমি শুনবো।

না, আজই। শোন,
বাবা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। কোন কিছুর দরকার হলে অনন্যরা চাইতো মার কাছে, আর আমি চাইতাম বাবার কাছে।
তবে বাবা কে যে ভয় পেতান না তা নয়। পড়া শোনার ব্যাপারে বাবা কোন কিছুর সাথে সন্ধি করতে রাজি নয়।
কথায় কথায় বাবা একদিন বলেছিল,
“জানিস উদয়, আমি খুবই ভাল ছাত্র ছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডিগ্রীটা আমি নিতে পারিনি। তার আগেই তোর দাদা মারা গেলো। আমিই সবার বড় ছেলে। আমার পড়ে আরও চার টা ভাই বোন। তোর দাদি দিশাহারা হয়ে পড়ল। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে এলাম। চাকরি নিলাম। সংসারের হাল ধরলাম।
তোর মা এলো।
সংসারের ভিতরের হাল ধরলও সে, আমি ধরলাম সামনে। এক সময় তোর চাচা ফুফুরা মানুষ হয়ে বেড়িয়ে গেলো। তোর দাদি রয়ে গেলো আমার সাথে। তোকে তো সেই বড় করেছিল কোলে পিঁঠে করে”।
সেইজন্য বাবার কাছে লেখাপড়া আগে। বলেছিল, আমার মতো তোকে অর্ধেক পথে লেখাপড়ার পাঠ চুকাতে হবেনা।

মনে পড়ে, আরও মনে পড়ে একরাতে জ্বরে যখন আমি ছটফট করছি, সারা রাত বাবা মাথার কাছে বসে পানিতে ভেজা কাপড় দিয়ে কপাল মুছিয়েছে। বলে উদয় থামল। কি যেন চিন্তা করল।
কেয়া বলল, তুমি তাই বলছ, তোমার সাথে বিয়ে হয়ে আমি যখন এই বাড়ীতে এলাম একবারও আমার মনে হয়নি আমি এই বাড়ীতে আগে কখন আসিনি। বাবা আমাকে বৌমা বলে ডাকতো ঠিকই কিন্তু তার মেয়েদের থেকে আমাকে কম ভালোবাসতো না।
আমার চিকেনপক্স হয়েছিল, মনে আছে?
আছে।
মশারির ভিতর বাবা নিজে হাতে খাবার এনে আমাকে খাইয়ে দিতো।
মনে পড়ে?
পড়ে।
তুমি তো বললে না বাবা মনে আঘাত পেয়েছিল তোমার কোন ব্যবহারে।
বলছি।
বাবা তখন রিটায়ার করেছে। শহরের এক কোনায় ছোট্ট একটু জমি কিনে সেখানে বাসা বেঁধে আমরা আছি। যেই বাসাতে তুমি এসে উঠেছিলে।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। হলে থাকি। সেখানে থাকার যে খুব একটা দরকার ছিল তা নয়। বাসা থেকে ক্লাস করা যেতো। কিন্তু পড়াশোনার সাথে সাথে আড্ডার নেশা টা আমাকে পেয়ে বসেছিল।
বাবা বলেছিল, হলে না থাকলেই কি নয়।
যুক্তি দিয়েছিলাম, হলে থাকলে লাইব্রেরি তে যখন তখন যেতে পারবো, অন্যান্য ছাত্রদের সাথে কোশ্চেন নিয়ে কন্সালট করতে পারবো, ভেবে দেখিনি বাবার উপর চাপ টা কতটুকু পড়বে।
সে না করে নি।
সেই সময়ে একটা সুযোগ এলো বিদেশে আসার। বাবা কে বললাম। বাবা বলল, নিশ্চয় যাবে।
ভেবে নিলাম, আর কি, আমার দায়িত্ব কাগজ পত্র গোছান, বাদবাকি দায়িত্ব বাবার। সেদিন মনে হয়নি বাদবাকি দায়িত্বটা যে কত বড় দায়িত্ব একজন রিটায়ার মানুষের পক্ষে।
ফুর্তি ফুর্তি ভাব আমার। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ভিসা পেয়ে গেলাম। ট্রাভেল এজেন্সিতে যেয়ে টিকিট বুক করতে গেলে ওরা বলল, দুই দিনের মধ্যে যদি টিকেট না কিনি তবে ওরা আর আগের দামে দিতে পারবেনা। যদিও আমার যাওয়ার দিন আরও তিন মাস পড়ে।
সেই রাতে বাসায় এলাম। বাবা কে বললাম আগামীকাল আমার এতো টাকা লাগবে।
বাবা বলল, আগামীকালই? কয়দিন পড়ে দিলে হয় না? ধর, চার পাঁচ দিন পরে?
না, টিকিটের দাম বেড়ে যাবে?
কিন্তু কালকের মধ্যে তো আমি দিতে পারবোনা বাবা।
তাহলে থাক। রাগ করে আমি বেড়িয়ে আসছি, মা ডাক দিলো। উদয় খেয়ে যা। যাসনে বাবা।
খিদে নেই। বলে চলে এলাম হলে।
সারা রাত শুধু একটা কথাই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলো,” আমার আর যাওয়া হোল না, বিদেশে”।

যেহেতু পরীক্ষা সামনে, ক্লাস নেই, কাজেই সকালে ঘুম থেকে উঠার তাড়া নেই।

ভোর সাত টায় দরজায় টোকার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দরজা খুললাম। বাবা দাড়িয়ে। হাতে একটা ব্যাগ।
সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল কি ভুলই না আমি করেছি। আমার কর্মের মাসুল দিতে বাবা কে আসতে হয়েছে এই কাক ডাকা ভোরে। টাকা জোগাড় করে।
কেন সেদিন আমি বলতে পারিনি, বাবা আমি সত্যিই দুঃখিত।
বাবার চোখে কোন রাগ দেখিনি সেদিন। শুধু বলেছিল, “ টাকা টা সাবধানে রাখিস, পারলে আজই যেয়ে টিকিটের বাবস্থা করিস”।
কোথা থেকে টাকা জোগাড় হয়েছিল আজও আমি তা জানিনা। অনেক কষ্ট করে তাকে জোগাড় করতে হয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

সেই টিকিট আমি কেটে ছিলাম আরও দশ দিন পর। ট্রাভেল এজেন্সির লোক টা ছুটি নিয়ে বাড়ী চলে গিয়েছিল। টিকিটের দামও বাড়েনি।
বলতে পারো, কেনও সেদিন আমার ঐ মতিভ্রম হয়েছিল। যার খেসারত আমি আজও দিয়ে চলেছি।
আজ বাবা চলে গেলো, আমি বলতে পারলাম না, বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও।

কেয়া উদয়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
ভেবো না, বাবা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। যেমন তুমি তোমার ছেলের কোন দোষ দেখো না। সেই রকম বাবাও তোমার কোন দোষ দেখিনি।
এসো, এবার আমার কোলে মাথা রেখে শোবে, চলো।

 

Continue Reading

দুই কন্যা

                                                                                                          এক

এই চিঠি যখন তুমি পাবে তখন আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছি। তাতে তোমার কিছু আসে যায় না। দূরে তো আমি সব সময় তোমার কাছ থেকে। কেন? আজও তা জানতে পারলাম না। তুমিও জানতে দাওনি।
দুটো কলেমা উচ্চারণ করে আমাদের বিয়ে হয়েছিল।
ঐ পর্যন্তই।
তোমার হাত কোনদিন আমার হাত ছুঁইনি।
বিয়ের রাতে প্রতিটি বর যেমন স্ত্রীকে কাছে টানতে চায়, আমিও তাই চেয়েছিলাম।
তুমি সাপ দেখার মতো ঝটকে সরে দাড়িয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলে,” তুমি আমার স্বামী, শুধু বাহিরের লোকে জানবে। এর বেশি নয়”।
আরও বলেছিলে, কোনদিন যদি আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা কর, তবে আমার মড়া মুখ দেখবে।
আমি চমকে তোমার দিকে চেয়ে ছিলাম। দেখলাম তোমার রাগান্বিত মুখ।
সেটা কি আমার উপর?
আমার উপর কেনও ই বা হবে। তুমি তো আমাকে জানতে, চিনতে চাওনি। তবে কেন?
মনে পড়েছিল অনেক আগে পড়া রবীন্দ্রনাথের সেই গল্প-“মহামায়া”, বাড়ন করা সত্ত্বেও রাজীব মহামায়ার আগুনে পোড়া মুখটা দেখে ছিল। সেই তার কাল। হারালও সে তাকে।
তাই আমিও তোমার হাত ছুঁই নি। চেষ্টা ও করিনি। মনে হয়ে ছিল থাক না, আজ না হয় কাল সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিজের উপর এতো খানি আস্থা কোথা থেকে এসেছিল জানিনা। যদি সেই দিন সেই ক্ষণে ইতি টেনে দিতাম তাহলে আজ এই চিঠি লেখার দরকার পড়তো না।
কিন্তু পারিনি।
কেন, জানো?
আমাকে দেখানো তোমার সেই পুরান ছবি টা দেখে ভাল লেগেছিল। বলেছিলাম, বাহ, বেশ তো মিষ্টি দেখতে। ঐ ভাল লাগাটা মনের মাঝে গেঁথে গিয়েছিল। আজও গেঁথেই রইল।

তুমি এলে বিদেশ থেকে। মাত্র একদিন তোমাকে দেখেছিলাম। তাও কয়েক মিনিটের জন্য। বলেছিলে, বিয়ের আগে মেলামেশা তুমি পছন্দ করোনা। তোমার গম্ভীর মুখটাকে আমার মনে হয়েছিল লজ্জায় নুয়ে পড়া লজ্জাবতী লতা।

তারপর এলো সেই রাত। তুমি নিচে বিছানা পাতলে। আমিই বলেছিলাম, উপরে এসো। আমার মেঝেতে শোয়ার অভ্যাস আছে। তুমি না করনি।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই যদি তোমার অভিপ্রায় তবে বিয়েতে রাজি হয়েছিলে কেনও?
“প্রতিশোধ”। বলে ওপাশ ফিরে শুয়েছিলে।
তা সেই প্রতিশোধ আমার উপর কেন? আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি।
তার উত্তর তুমি দাও নি।
সকাল হয়ে এলো। দুচোখের পাতা বন্ধ হয়নি সাড়া রাত।
দরজা খোলার আগেই মেঝের বিছানা উঠিয়ে রেখে ছিলাম।
কপাট খুলতেই দেখি ভাবী দাঁড়ানো।
“ কি দেবর মশাই, গালে, মুখে লাল দাগ কোথায়? যা দিয়েছিলাম কাজে লাগিয়েছ তো?” বলে হাসলও আমার দিকে তাকিয়ে। ওর চোখের চাহুনীতে রহস্যের আভাস। মেয়েরা মেয়েদের কে চিনতে পারে। হয়তো সেও পেরেছিল। তা না হলে বিদায়ের দিন ভাবী কানের কাছে এসে কেনও বলবে, “ বড্ড একটা ভুল হয়ে গেল দেবর পো”।

এয়ারপোর্টে তুমি নিতে এলেনা। আসবে না সেটা আমি জানতাম। তবে কাজ থেকে ফিরে এসে যখন আমাকে দেখলে, একবারো জিজ্ঞাসা করলে না, জার্নি টা কেমন ছিল। শুধু আমার ঘর টা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলে। আস্তে আস্তে আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম সব কিছুতে।
কাজ নিলাম। নয়টা পাঁচটা।
একি সময়ে দুজনে ফিরে আসি।
তুমি তোমার চায়ের কাপটা সাজিয়ে নিয়ে বাহিরে ছোট্ট এক চিলতে জাগাটায় বসতে । আর আমি ঘরের ভিতর।
জানো, আমার নিজের অজান্তেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলে ছিলাম। তা না হলে এরকম জীবন আমি কেনও কাটাতে যাবো। যাক সে সব কথা।
তোমার অতীত আমি কোনদিন জানতে চাইনি, তবে কি জানো অতীতকে বর্তমানের সাথে না মেশানোই ভাল। তাতে শুধু কষ্টই পাবে।
আমি কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে নিয়ে ঘর বাধতে। ভেবেও ছিলাম একদিন সব ঠিক হওয়া যাবে। কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না।
কেন?

বছর পেরিয়ে গেলো।
এই লুকোচুরি খেলার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সেদিন কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। দুঃস্থ বয়স্ক দের সেবায় নিয়জিত এক সংগঠনে লোক দরকার। দরখাস্ত পাঠিয়েছিলাম। যেতে বলেছে।
আর নয়।এবার নুতন করে জীবন শুরু করব ঐ বয়স্কদের মাঝে।

আমার দস্তখৎ দেওয়া কাগজ পত্র গুলো টেবিলের উপর রইল। উকীল কে দেখাতে পারো।
পারলে নতুন করে আবার জীবন শুরু করো।
বিদায়।
ইতি।

দুই

“এই টুনি তুই মেয়ে পেলি কনে”, চিৎকার করে বলতাম আর ওর পিছনে পিছনে হাঁটতাম। আমার মতো তিন চার জন,
বয়স ছয়, সাত। টুনি ওর মেয়েটাকে কোলে করে ফিরে চাইত আমাদের দিকে। চোখে আগুনের হল্কা। মাঝে মাঝে বলত,
যা, তোদের মা কে যেয়ে জেজ্ঞাসা কর।
কেন বলতাম, এর মানেই বা কি কিছুই বুঝতাম না। সবাই বলতো, আমরাও বলতাম।
বয়স টা যখন বারো চৌদ্দর কোঠায় পৌছাল তখন কথার মানে টা বুঝতে পারলাম, আমরা তখন আর ওর পিছনে যাই না। সেই জাগা পুরন করেছে অন্য আরেক দল।

দেখতে দেখতে অনেক গুলো বছর পেড়িয়ে গেলো। আসা যাওয়ার পথে টুনি কে দেখি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমি লজ্জায় মুখ নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। ভাবি ওকি আমার সেই ছয় সাত বছরের চেহারা টা মনে রেখেছে। ছোট্ট শহর সবাই তো সবাই কে চেনে। লজ্জাটা আমার সেই জন্য। মেয়েটা এখন আর কোলে নেই, হাত ধরে হাটে।

তারপর আমি এই শহর ছেড়ে চলে গেছি। বহু দূরে। অনেক দিন পর ফিরে এলাম দেশে। এলাম আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শহরে। উঠলাম আমার এক বন্ধুর বাসায়। পিছনে ফেলে আসা দিন গুলো মনের পর্দাতে ভেসে উঠল। আলাপে আলাপে প্রসঙ্গ এলো টুনি পাগলির কথা।
কোথায় সে? জিজ্ঞাসা করলাম।
চলে গেছে এই ধরাধাম থেকে। বলল আমার বন্ধুটি।
ওর সেই মেয়েটা?
আছে, এই তো দুই মাইল দূরে, সাকোর পাড় গ্রামে থাকে।
যাওয়া যায় সেখানে? হঠাৎ প্রশ্ন করলাম আমি।
যাওয়া যায়। তবে ওর বাসা আমি চিনি না। খোঁজ নিয়ে বের করতে হবে।
ওঠ চল, আমি এখনি যাবো। বলে তাকালাম ওর দিকে।
কেনও জানি টুনির চেহারা টা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। রাগান্বিত নয়। অসম্মানে কুচকিয়ে যাওয়া চেহারা। যার জন্য দায়ি আমরা।
ছোট বেলার অনেক স্মৃতি ভোলা যায়না। ফিরে ফিরে আসে। হয়ত আমার অবচেতন মনে ফেলে আসা টুনির চেহারা টা দাগ কেটে ছিল। ওর প্রসঙ্গ উঠতেই আমার মনে হোল ওর উপর যে অন্যায় আমরা করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত করতে যাবো আজ তার মেয়ের কাছে, বলব, আমি দুঃখিত।

রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম আমরা দুজন। সাকোর পাড় গ্রামের ভিতরে রিক্সা যেতে পারলো না।
পায়ে চলা পথ। নেমে পড়লাম।
বন্ধুটি অনেক খোঁজ নিয়ে বের করলো বাসাটা। উঠানে দাড়িয়ে জোরে বলল,” কেউ আছে বাসাতে”। ওর গলার স্বর সব সময় উচুতে খেলা করে।
বেড়িয়ে এলো পাতলা গড়নের একটি মেয়ে। বয়স বোঝা যায় না। এক পেচে পড়া শাড়ী।
কাকে চাই? জিজ্ঞাসা তার।
তোমারি নাম—-? বন্ধুটির প্রশ্ন
হাঁ।
এবার আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, তোমার মাকে আমি চিনতাম। ছোট বেলায় খুবই খারাপ ব্যবহার করেছি তার সাথে। তাকে তো পেলাম না। বলতে পারো ক্ষমা চাইতেই এসেছিলাম।
সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। অবশেষে বলল, শুধু আপনি নয়, আমার মা কে অনেকেই খুব খারাপ কথা বলেছে রাস্তা ঘাটে। কোন কিছু না জেনে। আমি তখন ছোট বুঝতে পারিনি কি বলছে ওরা, আপনারা। কেন? বলতে পারেন, কেনও এতো খারাপ কথা বলতেন?
ওর প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। শুধু এই টুকুই মনে হোল , ওর মার কাছে আমি অপরাধী রয়ে গেলাম সাড়া জীবনের জন্য।
বললাম, তোমার মা থাকলে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম, তা যখন হলনা পারলে তুমি ক্ষমা কর।
সে ঘরের ভিতর চলে গেলো, ফিরে এলো একটা মাদুর নিয়ে। পেতে দিয়ে বলল, বসেন, সব বলব আজ আপনাদের কে।

মা আমাকে সব বলে গেছে। সব ঘটনা। কেন তাকে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যেতে হয়ে ছিল।
শোনেন।
বলও।
নানা ছিল গাদনপুরের চেয়ারম্যান। প্রতিপত্তি ছিল। লোকে যেমন সামনে সম্মান করতো, পিছনে তেমনি ভেংচি কাটত। শত্রুর তার অভাব ছিলনা। গদী রাখতে হলে অনেক ভাল মন্দ লোক কে পুষতে হয়। নানাও পুষেছিল অনেক কে। ওই গদী টিকিয়ে রাখতে যেয়ে সে মা কে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক মদখোরের কাছে বিয়ে দেয়। নানী বাধা দিয়ে ছিল। কিন্তু পারেনি। মা ছিল নানার একমাত্র মেয়ে। এই গদীর লোভ বড় ভয়ঙ্কর।
আমি ঐ মদখোরের মেয়ে।
কোন এক সময়ে নানার সাথে আমার বাপের টাকা পয়সা নিয়ে মনোমালিন্য হয়। নানা তার লোকজন দিয়ে চেম্বার থেকে বের করে দিয়েছিল ঐ মদখোর কে।
এই বলে থামল সে।

আমি পিছন ফিরে চাইতেই দেখলাম লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়া একজন দাড়িয়ে।
টুনির মেয়ে বলল, আমার স্বামী। এখানকার পাঠশালাতে মাস্টারি করে।
এগিয়ে আসতেই আমার উঠে দাঁড়ালাম।
আমার নাম কছম আলী, এখানে কি ব্যাপারে?
কিছু বলার আগেই টুনির মেয়ে বিস্তারিত সব বলল।
কছম আলী শুধু একটা কথাই বলল, অনেক কাঁদিয়ে ছিলেন আমার শাশুড়িকে। বলে ঘরের ভিতর চলে গেলো।

আমরা বসলাম। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই।
আমিই মৌনতা ভাঙলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর?

সেই সময় আমার মা অন্তঃসত্ত্বা। একদিন বাবা নানার উপর প্রতিশোধ নিতে যেয়ে মা কে বের করে দিল বাসা থেকে মিথ্যে দোষারোপ দিয়ে। আমার পিতৃ অস্বীকার করে। বলেছিল, আমার মা কুলাঙ্গার।
মা এসে উঠল নানার বাসায়। কিন্তু সেখানে সে থাকতে পারলনা। আমার বাবা, মার নামে মিথ্যে সব ঘটনা রটনা করতে থাকল। বিষিয়ে উঠল বাসার পরিবেশ।
এক রাতে মা এক কাপড়ে বেড়িয়ে পড়ল। চলে এলো বহু দূরে। আশ্রয় নিলো এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায়।
সেখানেই আমার জন্ম। বাবার কোন সন্ধান না থাকাতে লোকে মার নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে থাকল। সেই অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে, ভিক্ষা করে মা আমাকে তিলেতিলে মানুষ করেছিল।
আমার মা নষ্টা নয়। আমার কাছে আমার মা দেবী, আপনাদের মার মতই সেও একজন মা। সারা জীবন শুধু অপবাদই পেয়ে গেল।
এই বলে একটু থামতেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি বেড়িয়ে এলো। আমি আমার হাতের রুমাল টা এগিয়ে দিলাম।
আমার বন্ধু উঠে উঠানের এককোণে যেয়ে দাড়িয়ে রইল।
জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নানা খোঁজ নেই নি?
না, জানিনা সে বেচে আছে কিনা। তিক্ততা মেশানো গলার স্বর।
বললাম, আমি আবারও ক্ষমা চাইছি। ছোট বেলার ঐ খেলা বড় নিষ্ঠুর খেলা ছিল। আজ তা বুজতে পারছি।
বলে তাকালাম ওর দিকে। সে চেয়ে রইল দূরে, দুর আকাশের কোনে।
আমার চোখের কোণটা যে ভেজেনি তা নয়।
উঠে দাঁড়ালাম।

সে শাড়ীর আচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভিতর চলে গেলো।

 

Continue Reading

সন্ধ্যা তাঁরা

দাদু, দাদু ওঠো, তুমি না খেলনা কিনতে নিয়ে যাবে বলেছিলে?  ওঠো।

কেন? গতকালই না কিনে দিলাম সাইকেল টা?

না, আমি বারবী চাই। বারবী কিনে এনে তুমি আমাকে গল্প বলবে। সেই রাক্ষস খোক্কসের গল্প।

জানো দাদু, বাবা বলে আমি নাকি রাজকন্যার মতো দেখতে। আর মা শুধু বলে, দুধ খাও, দুধ খাও।

আচ্ছা দাদু, আমার মা তোমার কি হয়।

বৌমা।

কি—ব,ব,ব, ম,ম,– ধ্যাত।

তোমার মা কোথায় দাদু।

চলে গেছে।

দাদির মতো চলে গেছে ?

হাঁ।

দাদি দেখতে রাজকন্যার মতো ছিল?

ঐ দেখো ছবিটা ঠিক তোমার মতো, তাই তোঁ ভাবছি তোমাকে বিয়ে করব।

ধ্যাত, তুমি দেখতে মোটেই সুন্দর না। তুমি বলেছিলে বিয়ে করতে রাজপুত্র আসে ঘোড়ায় চড়ে।

হাঁ, আমি আসবো সাদা গাড়ীতে চড়ে, লাল টুকটুকে রাজকন্যাকে নিতে।

ধ্যাত, তুমি দেখেতে পচা। কখন যাবে দোকানে?

এই তোঁ যাবো, দুধ টা খেয়ে নাও।

না, আমি চকলেট দুধ চাই।

মা চকলেট দুধ দিতে বারণ করেছে। চকলেট দুধ খেলে তোমাকে অনেক বার বাথরুমে যেতে হবে।

জানো দাদু আমি এখন পটিতে বসতে পারি। আমি অনেক বড় হয়ে গেছি তাই না, দাদু।

হাঁ, অনেক বড় হয়েছ, এবার ঢকঢক করে দুধ টা খেয়ে নাও তোঁ দাদুমনি।

তুমি ও মার মতো দুধ খাও দুধ খাও বলও।

এই তোঁ লক্ষ্মীটি, সব দুধ শেষ, চলো আবার আমরা দোকানে যাবো।

উঠে Car Seat টা তে বসো।

না, আমি সামনে বসবো।

সামনে বসলে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে।

না, আমি বলব আমি বড় হয়েছি, পটিতে বসতে পারি।

Car Seat এ না বসলে আমি যেতে পারবো না, যেতে না পারলে বারবী কেনা হবে না।

জানো দাদু, বাবা বলেছে তোমাকে বিরক্ত না করতে। আমি কি তোমাকে বিরক্ত করি?

না, না আমি তোমার বাবা কে বলে দেবো, দাদুমনি আমাকে একটুও বিরক্ত করে না।

নামো, আসে গেছি।

ঐ দেখো দাদু, ট্রেন। আমি ট্রেনে চড়বো।

“ এরা কেন যে এইসব ট্রেন/ফ্রেম মলের মধ্যে নিয়ে আসে”।

দাদু দেখো ঐ ছেলেটার হাতে, আইসক্রিম। আমি আইসক্রিম খাবো।

আগে বারবী ,তারপর ট্রেন, তারপরই না আইসক্রিম খাবে।

না, আমি আগে আইসক্রিম খাবো।

ঠিক আছে, চলো লাইনে দাড়াও।

কেন? ঐ মেয়ে টা কে যেয়ে বলও।

দেখছ না, সবাই লাইনে দাড়িয়ে?

ধ্যাত।

এই ধ্যাত কথাটা কোথা থেকে শিখেছ?

মা বলে ধ্যাত—।

হু।

চলো ওই সোফাতে বসে আইসক্রিম টা শেষ করবে।

দাদু তুমি একটু খাবে?

দাও।

না না অতো বড় হা করে না। এই ভাবে চেটে চেটে খাবে। তুমি কিচ্ছু জানো না।

দাদু, দাদু দেখো, আইসক্রিমটা জামায় পড়ে গেছে। কি হবে ? মা তো বকবে।

কাদে না। বাসায় যেয়ে ধুয়ে ঠিক করে দেবো, মা জানতেই পারবে না।

তুমি সত্যি বলছ?

হাঁ।

আমার ঘুম পাচ্ছে।

চলো, সব কেনা কাঁটা শেষ। আইসক্রিম খেয়েছ, বারবী কিনেছ, ট্রেনে চড়েছ।

এসে গেছি।

দাদুমনি, দাদুমনি, ঘুমিয়ে পড়েছ?

একটু ওঠো, এবার এসো আমার কোলে, মাথাটা রাখো আমার কাঁধে।

এবার বিছানায় শুয়ে থাকো, আমি তোমার জুতো টা খুলে দেই।

গল্প বলো দাদু।

গল্প শুনবে, রাক্ষস খোক্কসের গল্প।

হ্যাঁ

তবে শোন,

সাতসমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে————————

ঠক ঠক ঠক, চোখ মেলে চাইলাম। পাশে তাকালাম। বিছানা খালি।

উঠে দরজা খুলতেই দেখি শান্ত আর বউমা।

হঠাৎ? কি মনে করে?

তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছি। বলল বউমা।

শান্ত একটা সাদাকালো ফটো এগিয়ে দিল। “দেখোতো কিছু বুঝতে পারো কি না”?

দেখলাম, ছোট্ট একটা হাত, শুধু আঙ্গুল গুলো দেখা যাচ্ছে। যেন বলছে, “ কি দাদু চিনতে পারছ”?

 

Continue Reading