একটা ভ্রমন কাহিনী (শেষ পর্ব)

      পায়ে পায়ে আমরা নিচে নেমে এলাম। তখন রাত একটা। তুমি তোমার ঘরের দরজা বন্ধ করলে। আমি কিছুক্ষণ বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলাম । সকাল সাতটায় মুস্তফা আসবে। আমাদের গাইড। নিউইয়র্ক থেকে ওর সাথে যোগাযোগ করেছিল আমার ছেলে। বলেছিল, আব্বু, এই ট্যুর গাইডের রিভিউ ভাল। ফাইভ স্টার। তোমাকে কিছু ভাবতে হবেনা।

না ভাবা টা আমার পক্ষে অস্বাভাবিক। মুস্তফা টাকা পয়সা নিয়ে আমাদের সাথে কোন চুক্তি করেনি। কাজেই তার দায় দায়িত্ব  কত টুকু আমার জানা নেই। যদি সে সকালে না আসে তাহলে পরবর্তীতে আমাদের কি করনীয় এই সব ভাবতে ভাবতে রাত টা পেড়িয়ে গেলো। তোমাদের কে বলেছিলাম ঠিক সকাল সাতটায় নিচে নামতে। দুই রাত কাটাব বাহিরে। ফিরে এসে আবার এই খানেই উঠব। সেই ভাবে দুই একটা জামা কাপড় আর ঔষধের ব্যাগটা নিয়ে নিচে নেমে এলাম সাতটার আগে। তোমাদের দরজায় টোকা দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, সাত টা বাজতে বেশি দেরী নেই।

তোমরা সবাই নেমে এলে। কাউন্টারে জিজ্ঞাসা করলাম, মুস্তাফা নামে কেউ কল করেছিল কিনা।

আমার মনে আছে সে কি বলেছিল। বলেছিল, মুস্তাফা বাহিরে দাড়িয়ে আছে। তুমি দরজাটা খুললে। সামনে দাঁড়ানো, ছয় ফুটের কাছাকাছি, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, তোমার ছেলের বয়সই এক জন। হাসি দিয়ে এগিয়ে এলো। বলল, আমি মুস্তফা। তোমাদের গাইড। প্রথম দর্শনেই ওকে আমার ভাল লেগেছিল। ও এসে ভাবীর আর ভাইয়ের সুটকেস দুটো হাতে নিয়ে বলল, আমাকে অনুসরণ কর। অলিগলি পাড় হয়ে এসে পৌছালাম বড় রাস্তায়।  ওখানে ওর মাইক্রবাস দাঁড়ান। একে একে সবার সুটকেস ব্যাগ গুলো উঠিয়ে নিলো পিছনে। তুমি জিজ্ঞাসা করলে নাস্তা কোথায় করব। সে বলল, এক ঘণ্টার মত যদি অপেক্ষা করতে পারো তবে আমরা অ্যাটলাস পাহাড়ের উপরে এক রেস্টুরেন্টে নাস্তা করব। ওখান থেকে মনোরম দৃশ্য দেখবে, যা তোমাদের চোখ জুড়িয়ে যাবে। আমরা রাজি হয়েছিলাম।

ভোরের মারাকাস। দোকান গুলো রাতের ব্যবসা শেষ করে এখনও ঘুমন্ত। রাস্তায় গাড়ির চলাচল কম।  হৈ হৈ শব্দ নেই। আমরা পেড়িয়ে এলাম মারকাস শহর। চারি দিকে খেজুর গাছের সারি। দূরে পাহাড়। সকালের নরম রৌদ টা পাহাড়ের চুড়ায় ঝলমল করছে। কোথা থেকে কত গুলো নাম না জানা পাখি উড়ে গেলো। ক্রমেই বড় রাস্তা টা ছোট হয়ে এলো। পাহাড় এগিয়ে এলো আমাদের কাছে। মুস্তাফা বলল, এই অ্যাটলাস পাহাড়। চারি দিক জুড়ে।

সমীতা, তুমি বসে ছিলে সবার পিছনে। মাঝে ভাই ভাবী আর শম্পা। মুস্তাফার পাশে আমি। আস্তে আস্তে মনে হোল আমাদের কে পাহাড়টা ঘিরে ফেলছে। বিশাল উঁচু পাহাড়ের মাঝে মাঝে বসতি। মুস্তফাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঐ পাহাড়ের মাঝে ওরা যায় কি ভাবে?  বলেছিল,নিচের থেকে উঠার রাস্তা আছে। যায় গাধার পীঠে চড়ে। সবুজ পাহাড়ের পাশে পাথরের পাহাড়। অপূর্ব। মনে আছে সমীতা, তুমি বলে উঠেছিলে, আহ! আল্লাহর কি মহিমা। চোখ জুড়ান দৃশ্য।

গাড়ী এসে থামল রেস্টুরেন্ট চেগরউনিতে। অ্যাটলাস পাহাড়ের উচ্চতা ৪১৭৮ মিটার। আমরা তার মাঝ খানে। শম্পা আমার হাতে টান দিয়ে বলল, এসো এখানে, যেখান থেকে নিচে তাকালে মাথা ঘুরে আসে। খাদ নেমে গেছে। আমার বিভিন্ন পজে ছবি উঠিয়ে দাও। তুমি জোরে বলে উঠে ছিলে, অত পাশে যেওনা। আমি তাকিয়ে দেখেছিলাম তোমার সেই ভয়ার্ত চাহুনী। আজও চোখে ভাসে।

থাক সে কথা। তুমি আর শম্পা বড় বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছিলে ছবি তোলা নিয়ে। আমি দেখছিলাম পাহাড়ের মাঝে মাঝে বন্য ফুলের সমারোহ।  

মুস্তফা এসে বললও, তোমরা সবাই দাড়াও আমি ছবি উঠাই তোমাদের।

নাস্তা শেষে আবারও চলা শুরু।

এবার আমাদের গন্তব্য স্থান Kasbah ( cinema village)। লাল রঙ এর ইটের তৈরি সব বাড়ী । রুক্ষতা ঘিরে আছে চারিদিকে। সূর্য আমাদের মাথার উপর। মাঝে মাঝে হাওয়া বইছে। মুস্তফা বলেছিল, Kasbah Toourirt এর কথা। এটা হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে পুরাতন বাড়ী Quarzazate এ । সূর্যের তাপে শুঁখানো মাটি আর ক্ল্যে দিয়ে তৈরি। এই বাড়ী টাকে ঘিরে তৈরী হয়েছিল বিখ্যাত ছবি,Lawrence of Arabia, Gladiator,Cleopatra. আমাদের গাইড নিয়ে এলো এক উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে। বলেছিল, এই খানে Gladiator ছবির লড়াইয়ের শুটিং হয়েছিল। সেই সব ছবির কিছু কিছু দৃশ বিভিন্ন দেয়ালে গাঁথা। হাটতে হাটতে আমরা ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। মুস্তাফা নিয়ে এলো এক মাটি দিয়ে তৈরী হোটেলে। আমরা বসলাম। ডাণ্ডা পানীয় এনে দিলো। ঘামে ভেজা মুখটা মুছে নিলো সবাই। সজন ভাই দেখতে থাকল মেন্যু টা।

মুস্তাফাকে তুমিও ভুলতে পারোনি, আমিও না। ভদ্র, মার্জিত একটা ছেলে। আমাদের সাথে মিশে গিয়েছিল। ঠোটের কোনের হাসিটা আমি আজও ভুলিনি। হঠাৎ সে আমাদের বাংলা কথা শুনে বলেছিল, এই ভাষা আমার কানে বাজে। প্রথমে বুঝতে পারিনি কি সে বলতে চাইছে। সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কি বলছ?

আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ফীয়ান্সে ছিল বাংলা দেশের, নাম ছিল রাবেয়া।

আমরা সবাই নড়েচড়ে বসলাম। কোথায় দেখা হয়েছিল? ভাবীর প্রশ্নের জবাবে বললও,

মারাকাসে।

কিভাবে?

তোমাদের মতোই সে এসে ছিল ট্যুরে। থাকতো লন্ডনে। বাবা মার সাথে। শ্যামলা গায়ের রঙ হলে কি হবে, দেখতে ছিল অপূর্ব। ওর সাথে ছিল আরও চার জন মেয়ে। ওদের কে নিয়ে তিন দিন আমি বিভিন্ন জাগায় ঘুরেছি। ওর সাথেই কথা হতো আমার বেশি। কথার সাথে সাথে জড়িয়ে পড়লাম আমরা দুজন। ফিরে যাওয়ার দিন সে বলেছিল, এই আমার ফোন নাম্বার, কল করো। আমি আসব আবার এই মারাকাসে।

কথা হতো প্রতিদিন। সে তার কথা রেখেছিল।

রাবেয়া এসে ছিল ছয় মাস পর। ওর মা বাবা কে নিয়ে। আমাদের বাড়ীতে।

তারপর? জিজ্ঞাসা করেছিল সজন ভাই।

তারপর, আমার যেমন বাবা মা কে রেখে লন্ডনে যাওয়া সম্ভব নয় তেমনি ওকেও বাবা মা র কাছা কাছিই থাকতে হবে। বলেছিলাম নাই বা হোল বিয়ে।  বাবা মা কে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? বন্ধুত্বই হোক আমাদের বন্ধন।

তাই বিয়ের পর্ব ওখানেই শেষ। আমরা বন্ধু হিসাবেই থেকে গেলাম, আজও আছি।

ওর কি বিয়ে হয়েছে? শম্পার প্রশ্নের উত্তরে মুস্তাফা বলেছিল, বিয়ে হয়েছে, স্বামী নিয়ে এসেছিল এখানে। আমিই ওদের কে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে ছিলাম মারাকাস শহর।

তুমি বলে উঠেছিলে, আমারই বধুয়া আন বাড়ী যায় আমারি আঙিনা দিয়া।

এতো জীবন কাহিনী নয় এতো নাটক।

তাই হবে, বলে তাকিয়ে ছিল তোমার দিকে, একটু থেমে বলল, আমাদের Dade George এ যেতে রাত হয়ে যাবে মনে হয়। ওখানে আমরা রাত কাটাব। সন্ধ্যার আগে পৌছাতে পারলে ভাল।

Dade george. সাপের মতো আকাবাকা রাস্তা। চিকন রাস্তার দুই পাশে বিশাল পাথরের পাহাড়। মনে হচ্ছে রাস্তা টাকে গিলে খাবে এই george.

পাহাড়ের গায়ে কে যেন তার হাতুড়ি বাটাল দিয়ে মনের মতো করে তৈরী করেছে বিভিন্ন ধরণের মূর্তি।

মাঝে মাঝে একটা পাথরের উপর আর একটা পাথর দাঁড়ান। ধাক্কা দিলেই পরে যাবে, অথচ তা হবার নেই। এই দৃশ দেখে আমরা mesmerized, আমরা hypnotized.

পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে পাহাড়ের চুড়ায়, তার সারা গায়ে। ছড়িয়ে দিয়েছে লালচে আভা দুই পাহাড়ের মাঝ খানে। পাহাড়ের মাঝে মাঝে যেন আগুনের খেলা।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সেই আলোর ঝলকানি আর নেই। শুধু অন্ধকার। এই অন্ধকারকে মুস্তাফা এড়াতে চেয়েছিল। পারলনা। একেবেকে আমরা উপরে উঠছি আবার নিচে নামছি। গাড়ীর আলোতে পথ দেখা। মুস্তাফার পাকা হাত। কখন বায়ে কখন ডানে ঘুরাচ্ছে। দুই পাশে খাদ নেমে গেছে। কোন বাধন নেই পাশে।

 দেখেছি আলো, দেখলাম মিশমিশে অন্ধকার। মনে পড়ল, কে যেন লিখেছিল, অন্ধকারের ও রুপ আছে। মাঝে মাঝে কিসের আওয়াজ পাহাড়ে বারি খেয়ে আমাদের কানে এসে পৌছাচ্ছে। সবাই চুপ। ঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো। আমরা অবশেষে এসে পৌছালাম পাহাড়ের গায়ে ঘেঁষা হোটেলে।

হোটেল টা ছোট হলেও সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। শুধু একটাই অসুবিধা হয়েছিল। তোমার রুমটা আমাদের থেকে দূরেই পড়েছিল। তোমার ভাল লাগেনি। সেটা আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝে ছিলাম। কিন্তু কি করবে বলও।

পরদিন ভোরে বাহিরে এসে দেখলাম তুমি দাড়িয়ে আছো বারান্দায়। তাকিয়ে আছো সামনের পাহারটার দিকে। যেখান থেকে ক্ষীণ একটা পানির রেখা নিচে নেমে আসছে। সত্যিই অপূর্ব।  আলোর সাথে মিলিয়ে তোমার পরনের সাদা outfit টা অপূর্ব লাগছিল।

এখনো মনে রেখেছ দেখছি?

শুধু তাই না, তারি সাথে মিলিয়ে তোমার সাদা স্যান্ডেল, যেটা আমারই পছন্দে কিনেছিলে। আছে কি সেটা?

আছে। থাক, পুরন কাসুন্ধী ঘেঁটে লাভ কি? বলও, তারপর, আমাদের যাত্রার কথা।

নাস্তা সেরে বাহিরে এসে দাঁড়ালাম আমরা সবাই। ডাণ্ডা প্রচণ্ড না হলেও, মন্দ না। চারিদিকে লোকের বসতি আছে বলে মনে হোল না। জিজ্ঞাসা করতেই হোটেলের ম্যানেজার বলল, আছে, একটু ভিতরে।

সামনের পাহাড়ের উপরে একটু বারান্দা করা। পাশের সিঁড়ি বেয়ে উঠা যায়। শম্পা দেরী করেনি। তড়তড় করে উপরে উঠে ডাক দিল আমাকে, “ছবি উঠাও, সম্পূর্ণ পাহাড়টা যেন উঠে”।

 ওর আবদারের অন্ত নেই।

 সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। পথে থামবো Todra Gorge এ। মুস্তাফা বলেছিল, Todra Gorge যদি না দেখো তাহলে পৃথিবীর অনেক সৌন্দর্যের এক সৌন্দর্য তোমার জীবনে দেখা হলনা। আকাবাকা পথ বেয়ে আমাদের যাত্রা আবার শুরু।

Tinerhir থেকে নয় মাইল দুর Todra Gorge। আমরা এসে পৌছালাম ৬৬ ফুট উন্মুক্ত Todra Gorge এর ঢোকার পথে। শো,শো শব্দ। নিচে বয়ে যাওয়া পানির স্রোত। চারিদিকে ঘেরা হাজার ফুট উচু limestone এর পাহাড়। তার উপরে পড়েছে সূর্যের আলো। সোনালী রঙ ধারণ করে দাড়িয়ে রয়েছে। আর আমরা মুগ্ধ।  চেয়ে চেয়ে দেখছি।

তুমি বলেছিলে, It’s breathtakingly beautiful. অনেক ছবি আমরা উঠিয়ে ছিলাম। শম্পার বিভিন্ন পজের ছবির অভাব নেই।

মাত্র আধা ঘণ্টা সময় আমরা পেয়েছিলাম। মন ভরে নি।

আমাদের তো কিছু করার ছিলনা। Merzouga তে যেতে হবে। রাত কাটাব খোলা আকাশের নিচে।

সূর্য যখন পড়ন্ত সেই সময় আমরা এসে পৌছালাম সাহারার প্রান্তে। জীবনে এই picture perfect মুহূর্ত আবার কখন কোথাও দেখবো কি না জানিনা। তুমি বলেছিলে, দেখো, চারিদিক লালচে রঙ এর বালির সমুদ্র। ধুধু মরুভূমি। সূর্যের আলো থমকে দাড়িয়ে গেছে। পথ পাচ্ছে না কোথায় যাবে। হারিয়ে গেছে রঙ এর বালির মাঝে।

The Sahara is the most beautiful, enigmatic and awe-inspiring natural wonder, আমরা উপভোগ করেছিলাম। পাঁচ জন পাঁচটা উটের পিঠে। এক সারীতে। ভাবী বলেছিল, আমি পারবো তো?

 হেলে দুলে উট গুলো এগিয়ে চলেছে। কখন নিচে নামছে কখন উপরে উঠছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। কোথাও উচু, কোথাও সমতল।

উটের পিঠে চড়ে দের ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে আমাদেরকে পৌছাতে হবে তাবুতে। আমি ছিলাম সবার পিছনে। তুমি তার পরে। সজন ভাই সবার আগে।

সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে।

আমরা দাঁড়ালাম।  উটদের কে রেস্ট দিতে হবে।

বালির সমুদ্রে অস্তগামী সূর্যের আভা মোহনীয় পরিবেশ তৈরী করেছিল। পশ্চিমের আকাশ লাল। সেই লাল রঙ এসে পড়েছে লাল বালিতে। মনে হোল যেন আগুন জ্বলছে।

তারপর নেমে এলো অন্ধকার । আমরা আবার উটের পিঠে বসলাম।

তাবুতে এসে দেখলাম আরও কিছু লোক আমাদের আগেই এসে গেছে। রাতের খাওয়া হবে খোলা আকাশের নিচে।

আমাদেরকে আনন্দ দেবার জন্য হবে কাম্প ফায়ার। ওরা গাইবে ওদের গান।

সবই হয়েছিল।

 তুমি আস্তে আস্তে বালি ভেঙ্গে উপরে উঠে গেলে। ডাক দিলে আমাকে। সমীতা এসো, দেখবে এসো।

আমি ও এলাম। মিসকালো অন্ধকার চারিদিকে। আকাশে অগণিত তারার মেলা, মিটমিট করে জ্বলছে। তুমি শুয়ে পড়লে বালিতে। তাকিয়ে থাকলে আকাশের দিকে। বললে, এ সৌন্দর্য আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারবনা। এ সৌন্দর্য শুধু নিজের চোখে দেখতে হয়, অন্যের চোখে নয়।

রাত কয়টায় আমরা তাবুর মধ্যে গিয়েছিলাম, মনে আছে? দুইটা। মাঝে মাঝে উট গুলো ডাকছিল। মনে হচ্ছিল কাঁদছে। তুমি বসলে আমার পাশে। বললে, দেখা হোল, তোমার অনেকদিনের আশা পূর্ণ হোল। ভাই ভাবীরা চলে গেছে। শম্পাও ঘুমানোর পথে। তোমার তাঁবুটা এবার আর দূরে নয়, আমাদের কাছেই।

চলো।

পরদিন মুস্তাফা এসেছিল কাক ডাকা ভোরে। তার গাড়ী নিয়ে। এসেছিলাম উটের পিঠে, ফিরে এলাম গাড়ীতে। নাস্তা শেষে ফেরার পালা। যা দেখলাম তা শুধু নিজের ভাণ্ডারেই সঞ্চিত করে ফিরে এলাম মারাকাসে।

আরও দুদিন পরে মুস্তাফা আমাদেরকে নামিয়ে দিয়েছিল এয়ারপোর্টে। বলেছিল, তোমরা আবার আসবে,আসবে আমার বিয়েতে।

শম্পা আমার কাছে এসে বলেছিল, Thank you, তুমি তোমার কথা রেখেছ। এর পরের বার আমরা কোথায় যাবো?

তোমার সাথে ওটাই ছিল শেষ ভ্রমণ। কি হোল? ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে আছো কেনও?

চোখেতে বালির কনা পড়েছে।

আসি। আবার কবে তোমার সাথে দেখা হবে জানি না।

শুধু এইটুকুই বলি, ভাল থেকো।

Continue Reading

একটা ভ্রমন কাহিনী ৩

স্কোয়ার দেখব,দেখব সেই বিখ্যাত বাজার। তাইতো ক্লান্তিকে তুচ্ছ করে আমরা ঠিক তিন টার সময় বেড়িয়ে পড়েছিলাম। সবাই ক্ষুধার্ত। ইব্রাহিম জিজ্ঞাসা করেছিল, ঠিক মতো যেতে পারবে তো স্কোয়ারে?

বলে ছিলাম বেড়িয়ে ডানে, একটু এগিয়ে আবার ডানে মোড়, তারপর বায়ে, শেষ মাথায় যেয়ে আবার বায়ে মোড় নিলে স্কোয়ারের যাওয়ার রাস্তায় উঠে যাবো। ঠিক বলিনি? সে হেসে বলেছিল, সব ঠিক আছে।

সেদিন তোমরা তাড়াতাড়িই সেজে নিয়ে ছিলে। 

তোমার পরনে সাদা কামিজ,কালোর উপর সাদা নক্সা করা সালওয়ার। মাথায় অফ হোয়াইট দোপাট্টা।

শম্পা পড়েছে ম্যাজেন্টা রঙের টপস, কালোর উপর ফুলফুল আঁকা প্যান্ট, মাথায় পীঙ্ক রঙএর হেড ব্যান্ড, চোখে ডিজাইনার সানগ্লাস। ভাবীর পরনে  নানা রঙ এর সমারহে বানানো কামিজ আর কচি কলাপাতা রঙের সালওয়ার। মাথা ডেকেছে  লাল ওড়না দিয়ে।  তোমাদের সবাই কে সত্যিই অপূর্ব লাগছিল।

এতোও তোমার মনে থাকে? এবার আমি বলি। ভুল হলে শুধরে দিও।

এসে দাঁড়ালাম রাস্তা যেখানে এসে শেষ হয়ে গেল। Jemaa-el- Fnaa. The square. বিখ্যাত মার্কেট প্লেস মারাকাসের। খালি আকাশের নিচে ব্যবসাদাররা বসেছে তাদের মালা মাল নিয়ে। কানের দুল, গলার মালা। আছে ফলের রসের দোকান। আমি, শম্পা আর ভাবী চেয়েছিলাম আম,ডালিম আর কমলা দিয়ে বানানো রস।

তুমি কেন যে খেলেনা, শুধু শম্পার  থেকে এক সিপ নিয়ে ছিলে। বলে ছিলে আগে দুপুরের খাওয়া তারপর এইসব।

সূর্য মাথার উপর থেকে সরে এসেছে। সহ্য করার মতো রৌদ্রের তাপ। দূরে দেখা যাচ্ছে কুতুবীয়া মসজিদ। দুপুরের তাপের মাঝেও অনেক লোকের আগমন। আমরা এসে বসলাম রেস্টুরেন্ট সেগ্রনীতে। দোতালায়। চারিদিক খোলা। বাজারের দিকে মুখ করে। মাথার উপরে ছাতি।

সজন ভাই ভোজন প্রিয়। অনেকক্ষণ ধরে মেন্যুটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। ওয়াটার এসে মীন্ট চা দিয়ে গেলো। মীন্ট চা হচ্ছে মরক্কান দের কালচারের সাথে জড়িত। তা তুমি কসমোপলিটান কাসাব্ল্যাংকাতে যাও অথবা অ্যাটলাস পাহাড়ের বারবার ভীলেজে যাও। শুধু একটি মাত্র দ্রুব সত্য the tea is served.

চা বানানোর প্রক্রিয়া বিভিন্ন জাগায় বিভিন্ন রকম, কিন্তু ভেতরের মালমসলা এক। green tea, mint leaves and sugar.

সজন ভাই বলল, কি খাবে?

তুমি বলেছিলে Tagine, শুনে এসে ছিলে তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে।

বীফ Tagine, চিকেন Tagine, ল্যাম্ব Tagine, সাথে থাকে তরিতরকারি। যেমন carrot, beans, peas.

রান্না করে মাটির পাত্রে উপরে লম্বা cone shaped এর ঢাকনা দিয়ে।

আমরা তিন রকমের খাবার আনতে বলেছিলাম। তোমরা বেশ পছন্দ করেই খেয়েছিলে।

খাওয়া শেষে নামে এলাম রাস্তায়। পড়ন্ত বিকেল। লোকের ভিড় বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে বিভিন্ন ধরণের স্টল।

কেউ দেখাচ্ছে জাদুর খেলা। কেউবা পাশে ঘুর ঘুর করে ঘুরে বলছে, নেবেন স্যার, এই হ্যাট টা। ১০০ দেরহাম।

শম্পা কে পেয়ে বসলো লোকটা। হ্যাটটা ওর মাথায় চাপিয়ে দিয়ে বলল, কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে।

বললাম, না শম্পা মোটেও ভাল দেখাচ্ছেনা। দাড়াও তোমার ছবি উঠাই ওর সাথে, মাথায় হ্যাট পরে।

এ এক আজব জায়গা। ছবি উঠিয়েছি তার সাথে, ওর চেহারা তো patent করা। বিনে পয়সায় কিছু হয় না এখানে। ওর  সাথে ছবি উঠানোর খেসারত দিতে হোল। খসে গেলো দশ দেরহাম।

একটু এগিয়ে যেতেই দেখা গেলো সাপুড়ে  তিনটা অজগর সাপ নিয়ে বসে আছে। খেলা দেখাবে পয়সা দিলে। তুমি, ভাবী ভয়ে চলে গেলে অন্য দিকে। আমি আর শম্পা এগিয়ে গেলাম। একজন একটা সাপ নিয়ে এলো। বলল, গলায় ঝুলিয়ে দিলে ৩০ দেরহাম দিতে হবে। বললাম, না, শুধু ছবি উঠাব। তাহলে ১০ দেরহাম।  ওতেই রাজি আমরা। আমি, শম্পা আর অজগর সাপ।

বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা এলো। আলো জ্বলে উঠলো চারিদিকে। সাপুড়ে মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে। চারিদিকে আলোর মেলা।

ছোট্ট মেয়েটা তার হাতের খেলনা টা আকাশে ছুড়ে দিল। বিভিন্ন আলোর রঙয়ে রঞ্জিত হয়ে সে ফিরে এলো মাটিতে।

এগিয়ে এলো সে তোমার আর ভাবীর কাছে।

নেবেন, নেবেন ম্যদাম। সে পাঁচটা উরন্ত খেলনার দাম চাইল ২০ দেরহাম। শম্পা এগিয়ে এলো। বলল, আমারও ওটা চাই ।

ইব্রাহীম বলে দিয়েছিল, দরাদরি করবে। যা চাইবে তার চার ভাগের এক ভাগ দাম বলবে।

আমরা কিন্তু পাঁচ দেরহামে নিয়েছিলাম পাঁচটা। মনে পরে? মনে পরে ঐ মেয়েটা, যে কি না হেনা লাগাচ্ছিল মেয়েদের হাতে। আমাকে বলেছিল, হাতটা দাও, হেনা দিয়ে এঁকে দেবো ফুলের বাগান তোমার হাতে। পাশে থেকে একটা ছেলে তোমাকে বলেছিল, পানি খাবে? তুমি তাকিয়ে ছিলে ওর পরনের চোখ জুড়ান পোশাকের দিকে। হাতে তার চামড়ার পাউচে পানি।

তোমাকে অনেক সেধে ছিল। তুমি ঐ পানি খাওনি।

বাজারের মাঝখানে শুঁখানো ফলের স্টল। আপ্রীকট, কলা, চিনির আবরনে মোড়া বাদাম, আরও কত কি।

বাজারের শেষ প্রান্তে কুতুবীয়া মসজিদ মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে। ১১ শতাব্দীতে বানানো। মসজিদের মাথার উপর তিনটা সোনার বল। কথিত আছে, সাদীয়ান সুলতান আহমেদ এল মানসুর এর মা এই সোনার বল গুলো দিয়ে ছিলেন।

মসজিদের চারিদিকে হাটা পথ, সুন্দর পরে ছাটা বাগান।

সজন ভাই বলেছিল, আমরা একদিন এই মসজিদে নামাজ পড়ব।

উত্তর পশ্চিম কোণে বিভিন্ন জামা কাপড়, খেলনা সরঞ্জামের দোকান। লোকের ভিড় ওদিকেও কম নয়। আমরা হাটতে হাটতে গেলাম ঐ কর্নারে। ভাবী আমার কানে কানে  এসে বলেছি্ল, আমার কিন্তু খুব কেনাকাটা করতে ইচ্ছা করছে।

তুমি ভাবী কে বলেছিলে, আজ নয়। আজ আমরা সবাই ক্লান্ত। রাত এখন নয়টা। কাল ভোর সাতটায় মুস্তাফা আসবে আমাদের কে নিতে। রুমে ফিরে আমাদের বিশ্রাম আর ঘুমানো উচিৎ। কি বলেন?

আমরা রাজি হয়ে ছিলাম। সাহারায় যেতে পথে একরাত কাটাতে হবে। আর এক রাত কাটাব খোলা আকাশের নিচে।

আমরা ফিরে এলাম।

তোমার ফোন বাজছে?

হাঁ। আমার বান্ধবী কল করেছে।

তাহলে কি চলে যাবে?

না, ওখানে পরে গেলেও কিছু হবে না। তোমার সান্নিধ্য আবার কবে পাবো জানি না। ভাল লাগছে পুরানো দিনের গল্প করতে।

তারপর ?

তারপর শম্পা চলে গেলে আমাদের রুমে। ভাবী আর ভাই তাদের দরজা বন্ধ করে দিল।

তুমি আর আমি  আস্তে আস্তে সিঁড়ি পেড়িয়ে রুফ টপে এসে বসলাম।

দূরে আলোয় ঝলমল করা বাজার টা দেখা যাচ্ছে। আকাশে তারার ঝিকিমিকি। আধা চাঁদের আলো তোমার শরীরে মাখা।

তুমি গুনগুণ করে গাইছিলে, —“-আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে– আমি তাইতে কি ভয় মানি! জানি জানি, বন্ধু, জানি– তোমার আছে তো হাতখানি”.

তুমি তাকালে আমার দিকে। জানি তুমি আমাকে দেখছ না, দেখছ অনেক দূরে ফেলে আসা সেই মুখ খানি।

Continue Reading

একটা ভ্রমন কাহিনী ২

আচ্ছা সমীতা তুমি তো কফি খেতে না, চা ছিল তোমার প্রিয়। কবে থেকে এই পরিবর্তন? ঐ টেকো মাথাটা —
না তুমি যা ভাবছ তা নয়। তবে চা খাওয়া ছেড়ে দেইনি, কফি হলে মন্দ হয়না। তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি। সেই মারাকাসের পথে তুমি খুজে খুজে চার কাপ কফি আর একটা চা র অর্ডার দিতে। আর দোকানদার কে বলতে দুই পাতা দেবে।
হায়রে!
এখন বল, প্লেনে উঠার পর কি হোল। স্মৃতির পাতাটা একটু ঝালিয়ে নেই। আমার নিজের কথা খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।

তুমি জানালার পাশে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে। মাঝে মাঝে একটু অস্বাভাবিক শব্দ কানে আসছিল। পাত্তা দেই নি।
শম্পা আমাকে খোঁচা দিয়ে বলল, শুনতে পাচ্ছ?
হেসে বললাম,সহ্য করতে শেখ।
শম্পার ডাকে আমি জেগে উঠেছিলাম। ক্যাবিন ক্রু রাতের খাবার দিয়ে গেছে। পিছন ফিরে ভাবী আর ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, খাবার খাওয়া যাবে তো? উত্তরে ভাবী তার স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বলল, খাওয়া যাবে।
তুমি অবশ্য চেটে পুটে সব শেষ করেছিলে। শম্পাও কম যায়নি। খাওয়া শেষে রেস্টরুমে যাবে বলে সেই যে গেলে, ফিরে আসার সময় পেড়িয়ে গেলো , তুমি এলেনা, আমি আর শম্পা দুজনেই উদগ্রীব। শম্পা আমাকে বলল, একটু দেখে আসবে ওর কি হোল।
আমি সামনে এসে দেখলাম তুমি একটা খালি জাগা পেয়ে শুয়ে পড়েছ। তোমাকে ডিস্টার্ব না করে আমি ফিরে এলাম, শম্পা কে বললাম তুমিও শুয়ে পরো। পা টা উঠিয়ে দেও আমার কোলে। পিছনে ভাবী তার ছোট্ট শরীর টা গুটিয়ে নিয়েছে দুটো সীটের মাঝখানে। সজন ভাইয়ের চোখ বন্ধ।
ভোর নয়টায় আমরা আসে নামলাম কাসাব্ল্যাংকাতে। বাহিরে তাপমাত্রা ৭৫ ডিক্রি ফারেনহাইট। তুমি তোমার গায়ের সোয়েটার টা ছোট সুটকেসে ঢুকিয়ে নিলে। শম্পা তার কাপড়ের ব্যাগ টা কাধে নিলো। আমার কাধে একটা ব্যাগপ্যাক। ভাবীর হাতে ব্যাথা। বললাম আপনার সুটকেস টানতে হবে না আমার হাত খালি।
কাসাব্ল্যাংকা থেকে আমরা যাব মারাকাশে। একঘণ্টার পথ বিমানে। বিমান বন্দরের গরিবিয়ানা হাবটা চোখে পড়ল। তুমি বলেছিলে বিমান বন্দরটা দেখতে আমাদের ঢাকার বিমান বন্দরের মত।
সত্যি বলিনি ?
সত্যি বলেছিলে। আমরা ভিতর দিয়ে হেটে এসে আভ্যন্তরীণ বিমান বন্দরের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে পৌছালাম। গোটা বিশ জন লোক বসা। ছোট্ট একটা দোকান এক কর্নারে। মনে হচ্ছে যেঁ কোন সময় সেটা মুখ থুবড়ে পরে যাবে। মলিন পরিবেশ। শুধু দোকান টাই নয় পুরো লাউঞ্ছ টাই। প্লেনে পানি খাওয়া হয়নি বলে এক বোতল পানি কিনতে গেলাম। দোকানের কর্মচারী ইংরাজি জানেনা। হাত দিয়ে ছোট পানির বোতল দেখালাম। পকেটে মরক্কোর দেহ্রাম নেই। ডলার দেখাতেই দুই ডলার চাইলো। অগত্যা, কিছু করার নেই। বাহিরে এসে তোঁ তুমি দেখেছিলে বড় বোতল দশ দেহ্রামে পাওয়া যায়।
কনভার্সন যেন কত ছিল।
এক ডলারে সাড়ে নয় দেহ্রাম । ও বেটা আমার কাছ থেকে খসিয়ে নিয়েছে।
কিছু করার নেই। তোমার চেহারায় আমেরিকান ছাপ ছিল। ওর দোষ নেই।
ইয়ার্কি পেয়েছ?
ইয়ার্কি করবো কেনও। তারপর। বলও
শম্পা কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ভাই আর ভাবীর চেহারায় ক্লান্তির ছায়া। বিমান ছাড়বে এগারোটায়।

এবারো কিন্তু আমি জানালার ধারেই বসে ছিলাম। একঘণ্টার পথ। দেখতে না দেখতে আমরা আসে পৌছালাম মারাকাস ইন্টারন্যাশনাল বিমান বন্দরে। তুমি বলেছিলে, দেখো, কি সুন্দর দেখতে, মনে হচ্ছে নতুন তৈরি করেছে। দেয়ালের চারিদিকে বড় বড় নাম করা কোম্পানির বিজ্ঞাপন। আলোয় আলোকিত। ভাবী একটু পিছিয়ে পড়তেই তুমি উনার হাতের ব্যাগ টা তোমার হাতে নিয়ে নিলে। আমরা এসে দাঁড়ালাম পাসপোর্ট কন্ট্রোলের লাইনে।

বাহ ! খুব সুন্দর ভাবে কাহিনী টাকে এগিয়ে নিচ্ছ। বলে যাও। তার আগে ওয়েটার কে বলি দুটো রেড ভেলভেট কেক আর দুই কাপ কফি দিতে।
কয় কাপ হোল মনে আছে?
আজ আর মনে করতে চাইনা। এই ক্ষণ আবার আসবে কিনা জানিনা। রবি ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে তার সেই গানটা আমার মতো করে বলি, আজ তোমারে দেখতে পেলেম অনেক দিনের পরে। ভয় করোনা সুখে থাকো অনেকক্ষণ থাকবো আরও—–, হাসছ কেন?
একেবারে পাল্টাও নি তুমি।
পাল্টিয়েছি, তুমি দেখতে পাওনি। এবার বলও, তারপর?
না, এবার তোমার পালা।

তোমরা সবাই একে একে পাড় হয়ে গেলে পাসপোর্টের উপর ছাপছুপ নিয়ে। আমি এসে দাঁড়ালাম কাউন্টারে। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল বোর্ডিং পাসের ছেড়া টুকরা টা দেখাও। আমি কাসাব্ল্যাংকা থেকে মারাকাসের ছেড়া টুকরা টা দিলাম।
সে বলল, এটা নয় নিউইয়র্ক থেকে কাসাব্ল্যাংকা টা চাই। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তন্য তন্য করে সব পকেট খুজলাম। কোথাও নেই। বললাম, পাচ্ছি না।
সে বলল, ওটা লাগবে।
বিদেশ বিভুয়ে একি ঝামেলা। ভাবলাম, ওটা হয়তো আমি সীটের সামনের পকেটে রেখে এসেছি। তাহলে। করুন দৃষ্টিতেঁ তাকালাম ওর দিকে। ওতে ওর মন গল্লো না।
হঠাৎ ই কি মনে করে মানিব্যাগ টা বের করলাম। দেখলাম মানিব্যাগের কোনায় 35C লেখা কাগজটা জ্বলজ্বল করছে।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
তোমাদের কাছে আসতেই তুমি বললে,কি হয়েছিল?
বললাম ঘটনা টা।

আর আমি বলেছিলাম, বোর্ডিং পাস সব সময় কাছে রাখতে হয়। ফেলতে নেই।
হা, মনে আছে তোমার লেকচার। তারপর আমরা লাগেজ গুলো নিয়ে বেড়িয়ে এলাম বাহিরে। RIAD ANDALLAর গাড়ীর ড্রাইভার আমার নাম লিখে বাহিরে দাড়িয়ে থাকার কথা।

তুমি তাকে না দেখে অস্থির হয়ে উঠলে। এটা তোমার মজ্জাগত। ধৈর্য তোমার সব সময় কম। আমি বলেছিলাম, এখানে কোথাও আছে। অনেক লোকের ভিড়। আমাদের চোখে পড়ছে না।
হাঁ, পরে দেখলাম, আমার নাম নয়, ওদের হোটেলের নাম লেখা একজন দাড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই সে এগিয়ে এলো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজিতে বলল ওকে অনুসরণ করতে।
মাইক্রোবাস, এয়ারকন্ডিশন নেই। বাহিরে গরম। ড্রাইভার ইংরাজি জানেনা। তাতে আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছেনা। আমরা দেখছি বাহিরের খোলা মাঠ। মাঝে মাঝে খেজুর গাছের সারি। সূর্যের আলো এসে পড়েছে কাচা পাকা খেজুরের থোকার মাঝে। সোনালী আলোয় ঝলমল করছে।
আধা ঘণ্টার পথ। হাইওয়ে ছাড়িয়ে আমরা এসে পড়লাম শহরের মাঝে। আমাদের হোটেল ( হোটেল নয় বলে Riad) মদিনাতে। তোমাকে আমি প্লেনে বলেছিলাম আমরা থাকবো মদিনাতে। তুমি অবিশ্বাসের মতো আমার দিকে চেয়ে বলেছিলে, তুমি মরক্কো যাচ্ছ না সৌদী আরবে। আমি বলেছিলাম, এই মদিনা সেই মদিনা নয়। এ হচ্ছে পুরানো দেয়ালে ঘেরা এক শহর যেখানে আছে সব রকমের আকর্ষণীয় বস্তু। এখানে দেখবে সাপের খেলা, দেখবে বড় বড় মসজিদ। আমরা থাকবো ঠিক এইসবের মাঝে। আমাদের RIAD আকর্ষণীয় বাজার Djemaa el Fna র কাছে।

তুমি আমাকে Riad কি ব্যাখ্যা করনি। বলেছিলে পরে করবে। আমাদের গাড়ী বড় রাস্তা পেরিয়ে গলির ভিতর এলো। এরকম গলি আমি পুরানো ঢাকাতে দেখেছি। সজন ভাই বলল, কোন হোটেল তো দেখছি না। আমাদেরকে ঠিক জাগায় নিয়ে এসেছে তো।
গলিতে সব দোতালা তিনতালা বাড়ী। এখানে হোটেল কোথায়? আমরা দেখে এসেছি হোটেল সেরাটন, দেখেছি হলিডে ইন। এতো ঠাঠারি বাজার। আমি তোমার দিকে তাকালাম। মনে হোল তুমি ও যেন কি খুজছো। ড্রাইভার এক গলির পাশে নামিয়ে দিলো। Riad Andalla বলে কোন নামের চিহ্ন কোথাও দেখলাম না। তুমি ড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করলে ,”এ কোথায় নামালে”। ভুলে গিয়েছিলে সে ইংরাজি জানেনা। সেই মুহূর্তে এক মহিলাকে হন্তদন্ত করে এগিয়ে আসতে দেখলাম । আমাদের নামানো একটা সুটকেস হাতে নিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে তাকে অনুসরণ করতে বলল।
এবড়ো থেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে ছোট্ট চিপা গলিতে এসে পড়লাম। একটু এগিয়ে ডানে মোড় নিয়ে আর একটা গলিতে ঢুকলাম। আমার চিন্তা লুই ভাটনের ক্যারীঅন টা নিয়ে। ওর চাকা গুলো ঘজ ঘজ শব্দ করছে মনে হোল।

তোমার চেহারায় তা ফুটে উঠেছিল। আমাদের কে আর একটা বাকও নিতে হয়েছিল। আমরা এসে দাঁড়ালাম Riad Andalla র সামনে।
লোহার দরজা খুলে গেলো। হ্যালো বলে অভ্যর্থনা জানাল ইব্রাহিম। তখনি তোমাকে আমি বলেছিলাম, এই দেখো Riad। এটা হোটেল নয়, মরক্কোর ট্র্যাডিশনাল বাসা। এই বাসা তিন থেকে চার তালার বেশি হয় না। আমাদের টা তিনতলা।
সাধারণত এর মাঝ খানে পানির ফোয়ারা আর ফুলের ঝার থাকে। আমাদের Riad টা অতো বড় না হওয়াতে ওরা উঠান টাকে বসার জাগা করেছে। Riad দে জানালা বাহিরের দিকে থাকে না। তুমি দেখছ সব ঘরের জানালা ভিতরের দিকে। উঠানের দিকে মুখ করে। আমার খুব ভাল লেগেছিল। শুধু আমার নয়, নার্গিস ভাবী আর সজন ভাই এসে বলল, একটা নতুনত্বের স্বাদ পাচ্ছি।
তোমার কথা শেষ হতেই ইব্রাহিম এসে বললও আমাদের সবার রুম দোতালায়।
তুমি চাবি চেয়েছিলে। সে হেসে বলেছিল এটা বাসা, এখানে চাবি লাগে না। সব কিছু খোলা রেখে চলে যেতে পারো, কেউ হাত দেবে না।
পা বাড়ালেই সেই বিখ্যাত OPEN SQUARE, Djemaa el Fna, তুমি বলেছিলে এই স্কোয়ারে ঘিরে আছে বাজার, আছে মসজিদ, আছে কাফে। আমাদের সবার মন চাইছে কখন দেখবো সেই জাগা। তুমি বললে, এখন দুইটা বাজে আমরা তিনটায় বের হবো, ফিরে আসতে হবে তাড়াতাড়ি। কারন গাইড আসবে কাল ভোরে। আমরা রওয়ানা হবো সাহারার পথে।

 

Continue Reading

একটা ভ্রমন কাহিনী

পিঠের উপর আলতো হাতের ছোঁয়ায় ঘাড় ফিরে তাকালাম।
সমীতা।
ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কি? চিনতে অসুবিধা হচ্ছে? বলে হাসল সে।
সেই হাসি। আজও মুছে যায়নি আমার মন থেকে।
তোমাকে চিনতে পারবো না, তাই কি হয়? কি মনে করে এই অবেলায়, এই ছোট্ট কনফেক্সনারীতে।
বান্ধবীর বাসাতে যাব, ভাবলাম কিছু একটা হাতে করে নিয়ে যেতে হয়, সেই সুবাদে নেমেছিলাম। নেমে এসে তোমাকে দেখবো তাতো ভাবিনি।
বিধাতার খেলা বোঝা দায়।
কবে থেকে তুমি আমার ভাষায় কথা বলতে শুরু করলে? আমি কথার আগে পিছে ইনশাল্লাহ, মাশাল্লা লাগাতাম বলে তুমি বলতে ওটা আমার ভাষা।
এখন আমি দুই ভাষাতেই কথা বলি। তোমার কোন তাড়া আছে কি?
না অতটা নয়, কেন?
তাহলে চলো কোথাও বসি। অনেকদিন পরে দেখা। স্মৃতির পাতা গুলো উল্টিয়ে দেখতে আপত্তি কি?
চলো।
এসে বসলাম হাউজ অফ কাফে তে। বাহিরের বাতাস টা আরামদায়ক। তাই ছাতার নিচে দুটো চেয়ার টেনে নিলাম।
ওয়েটার এসে দুটো মেন্যু দিয়ে গেলো।
সমীতা মেন্যু নিয়ে নাড়া চাড়া করছিল। আমার চোখ পড়ল ওর আঙ্গুলের আংটি টার দিকে।
ওয়াটার এসে পাশে দাড়াতেই বললাম, কি খাবে?
শুধু কফি।
কফির সাথে আরও কিছু আনতে বলে তাকালাম ওর চোখের দিকে।
কি? কি দেখছ?
তোমাকে। একটুও পাল্টাও নি তুমি। মনে পরে কবে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল।
পরে বইকি।

শম্পা কোথায় ?
যে শম্পাকে তুমি দেখেছিলে সে শম্পা আর নেই। বিয়ে হয়ে গেছে।
দোষ আমারই। যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তুমিও চলে গেলে অন্য ষ্টেটে। আমিও ছন্নছাড়ার মতো বেড়িয়ে পড়লাম। বেশ কিছু বছর ঘুরে গেলো। কে কোথায় তার খোঁজ আর রাখতে পারিনি।

মনে পরে, দেখা হলেই শম্পা বলতো, খালেদ দা এবার অন্য কোন দেশে বেড়াতে গেলে আমাকে নিয়ে যাবেন তো?
ওর কথা আমি রেখেছিলাম।
জানি। ও ছিল বলেই আমারও যাওয়া হয়েছিল। কি খুশিই না সে হয়েছিল। তোমার সাথে তোমার হাত ধরেই তো সে ঘুরে বেড়াতো মারাকাসের পথে পথে।
যেদিন প্লেনের টিকিট কেটে ওকে বলেছিলাম , শম্পা সব গুছিয়ে নাও, আমরা মারাকাস যাব।
ওর বিশ্বাস হয়নি, বলেছিল, যেদিন মারাকাসে পৌছাব, সেদিন আমার স্বপ্ন পুরন হবে। সেদিন তোমাকে বলব তুমি তোমার কথা রেখেছ।
ও যে কখন আপনি থেকে তুমিতে এসেছে বুঝতে পারিনি। ওর মুখে তুমি ডাক টা খুব ভাল লেগেছিল, ও যেন আপন করে নিলো আমাকে।
আচ্ছা তোমার মনে আছে সেই ভ্রমনের দিনগুলো। সবকিছু ঠিক হয়েও হচ্ছীলনা।
কেন থাকবে না।
আমি কাজে ব্যস্ত, হঠাৎ তোমার ফোন, বললে, মরক্কো যাবে? এই রকম হঠাৎ হঠাৎ আজগুবি চিন্তা তোমার মাথায় আসে। তাই গুরুত্ব না দিয়ে বলে ফেলেছিলাম মন্দ কি? সেই “মন্দ কি” টা তুমি ধরে নিলে আমি রাজি।
কদিন পরে ফোন করে বললে, একমাস পরে আমরা রওনা দেবো মারাকাসের পথে।
তুমি হায় হায় করে উঠেছিলে। বলেছিলে, পাগল নাকি? আমার যাওয়া হবে না।
কিন্তু হয়েছিল। শম্পা এসে যোগ দিয়েছিল আমাদের সাথে।

ওয়েটার এসে পাশে দাঁড়াল, জিজ্ঞাসা করলো আরও কিছু লাগবে কি না।
বললাম আর এক কাপ কফি হলে মন্দ হয় না। সে অর্ডার নিয়ে চলে গেল। সমীতা ছোট্ট আয়না বের করে ঠোটের উপর আঁকা রঙ টা একবার দেখে নিলো।

আমি তাকিয়ে ছিলাম নিখুঁত ভাবে থ্রেড করা ওর ভুরু দুটোর দিকে। ও মুখ তুলে চাইল। বলল, আচ্ছা খালেদ, আর একবার আমরা বেড়িয়ে পড়তে পারিনা? মরুভূমি নয়। ট্রেনে ট্রেনে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরবো।
হাসতে হাসতে বললাম, তা মন্দ বলোনি। তোমার ওই টাঁক মাথা লোকটা আমাকে শট গান দিয়ে গুলি করবে।
না তা সে করবে না, সে জানে তোমার আমার বন্ধুত্বের কথা।

জানো সমীতা, এয়ারপোর্টে যে ভাই ভাবীর সাথে পরিচয় হয়েছিল উনারা এখন আমার খুব কাছের মানুষ। কত সহজেই না মানুষ আপন হয়ে যায়। তাই না?
রতনে রতন চেনে।
বাহ, কবে থেকে এই ভাষায় কথা বলতে শিখলে, টাঁক মাথার গুন আছে দেখছি?
না, শিখে ছিলাম তোমার কাছ থেকে। জানো, মনে হয় এই তো সেদিন তুমি, আমি আর শম্পা। তোমার গাড়ী রেখে গেলে আমার ড্রাইভওয়ে তে। এয়ারপোর্টে পৌছে দিয়ে গেলো তোমার মেয়ে। রাত নয়টায় আমাদের ফ্লাইট। Royal Air Marco. ঐ দেশের এয়ার লাইন। আমরা লাউঞ্ছে বসে আলাপ করছিলাম মরুভূমির কথা, রাত কাটাবো খোলা আকাশের নিচে।
আপনারা মারাকাসে যাচ্ছেন বুঝি? প্রশ্ন শূনে তুমি তাকালে পিছনে। পরিচয় হোল। নার্গিস আর সজন। ওরাও একি পথের যাত্রী। শুধু তাই নয়, একই হোটেলে আমাদের অবস্থান। Riad Andala.

সজন ভাই বলল, আমাদের কে বোর্ডিং করার জন্য লাইন দিতে বলছে, চলেন লাইনে দাঁড়াই। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। শম্পা ঘুরে ঘুরে দোকান গুলো দেখে বেড়াচ্ছিল। তুমি বললে, ও পনের বছর বাহিরে কোথাও যায়নি, ওর দেখে স্বাদ মিটছে না।

তোমার এতো সবও মনে আছে।
কেন থাকবে না। এইসব স্মৃতি তো ভুলবার নয়।
মনে আছে তুমি ইচ্ছে করে জানালার পাশে সীট নিয়েছিলে। জানতে আমি জানালার পাশে বসতে পছন্দ করি। শম্পা বসতে চেয়েছিল, তুমি বলেছিলে, থাক শম্পা, রাতে কিছুই দেখতে পাবেনা, জানালা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, মাথাটাও রাখতে পারবে না। শম্পা কি বুজেছিল জানিনা, তবে সে আর বসতে চাইনি।
ঠিক আমাদের পিছনেই নার্গিস ভাবি আর সজন ভাইএর সীট। ভাবী তার মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেছিল, আল্লার রহমত, আপনাদের কে পেলাম এই যাত্রায়। কি ভালই না লাগছে আমার।
এয়ার হস্টেস হেডফোন আর ছোট একটা পার্স দিয়ে গেলো। ওর ভিতরে আছে রাত ও সকালের সরঞ্জাম।

তুমি জানালাতে বালিশ দিয়ে মাথাটা এলিয়ে দিলে। শম্পা হেডফোন কানে লাগিয়ে টিভির চ্যানেল গুলো পাল্টাতে লাগল।
আমি এয়ার হস্টেস কে ডেকে বললাম, এক গ্লাস পানি দিতে পারবে কি?

ক্রমশঃ

 

Continue Reading